Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক পাতা গল্প82 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – ৩. তৃতীয়াঙ্ক

    তৃতীয়াঙ্ক

    প্রথম গর্ভাঙ্ক

    প্রতিষ্ঠানপুরী—রাজনিকেতন-সম্মুখে।
    (মন্ত্রীর প্রবেশ)

    মন্ত্ৰী। (স্বগত) মহারাজ যে মুনির আশ্রম হতে স্বদেশে প্রত্যাগমন করেছেন, এ পরম সৌভাগ্য আর আহ্বাদের বিষয়। যেমন রজনী অবসন্ধা হলে, স্বৰ্যদেবের পুনঃপ্রকাশে জগন্মাতা বস্থদ্ধর প্রফুল্পচিত্ত হন, রাজবিরহে কাতরা রাজধানীও নৃপাগমনে অদ্য সেইরূপ হয়েছে। (নেপথ্যে মঙ্গলবাদ্য) পুরবাসীরা অস্ত অপার আনন্দার্ণবে মগ্ন হয়েছে। অদ্য যেন কোন দেবোৎসবই হচ্যে! আর না হবেই বা কেন? নহুষপুত্র যযাতি এই বিশাল চন্দ্রবংশের চূড়ামণি; আর ঋষিবর-দুহিতা দেবযানীও রূপগুণে অনুপমা; অতএব এদের সমাগমে নিরানন্দের বিষয় কি? আহা! রাজমহিষী যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মীস্বরূপা। এমন দয়াশীল, পরোপকারিণী, পতিপরায়ণা স্ত্রী, বোধ হয়, ভূমণ্ডলে আর নাই; আর আমাদের মহারাজও বেদবিদ্যাবলে নিরুপম! অতএব উভয়েই উভয়ের অনুরূপ পাত্র বটেন। তা এইরূপ হওয়াই ত উচিত; নচেৎ অমৃত কি কখন চণ্ডালের ভক্ষ্য হয়ে থাকে? লোচনানন্দ সুধাকর ব্যতিরেকে রোহিণীর কি প্রকৃত শোভা হয়? রাজহংসী বিকশিত কমল-কাননেই গমন করে থাকে। মহারাজ প্রায় সাৰ্দ্ধৈক বৎসর রাণীর সহিত নানা দেশ ভ্রমণ ও নানা তীর্থ দর্শন করে এত দিনে স্বরাজধানীতে পুনরাগমন কল্যেন!—যদু নামে নৃপবরের যে একটি নবকুমার জন্মেছেন, তিনিও সৰ্ব্বসুলক্ষণধারী। আহা! যেন সুচারু শমীবৃক্ষের অভ্যস্তরস্থ অগ্নিকণা পৃথিবীকে উজ্জল করবার জন্যে বহির্গত হয়েছে! এক্ষণে আমাদের প্রার্থনা এই, যে কৃপাময় পরমেশ্বর পিতার ন্যায় পুত্রকেও যেন চন্দ্রবংশশেখর করেন। আঃ, মহারাজ রাজকৰ্ম্মে নিযুক্ত হয়ে আমার মস্তক হতে যেন বসুন্ধরার ভার গ্রহণ করেছেন, কিন্তু আমার পরিশ্রমের সীমা নাই। যাই, রাজভবনে উৎসব-প্রকরণ সমাধা করিগে।

    [ প্রস্থান।

    (মিষ্টান্নহস্তে বিদূষকের প্রবেশ।)

    বিদূ। (স্বগত) পরদ্রব্য অপহরণ করা যেন পাপকৰ্ম্মই হলো, তার কোন সন্দেহ নাই; কিন্তু, চোরের ধন চুরি করলে যে পাপ হয়, এ কথা ত কোন শাস্ত্রেই নাই; এই উত্তম সুখাদ্য মিষ্টান্নগুলি ভাণ্ডারী বেটা রাজভোগ হতে চুরি করে এক নির্জ্জন স্থানে গোপন করে রেখেছিল; আমি চোরের উপর বাটপাড়ি করেছি! উঃ, আমার কি বুদ্ধি! আমি কি পাপকৰ্ম্ম করেছি? যদি পাপকৰ্ম্মই করে থাকি, তবে যা হৌক, এতে উচিত প্রায়শ্চিত্ত কল্যেই ত খণ্ডন হতে পারে। এক জন দরিদ্র সদ্বংশজাত ব্রাহ্মণকে আহ্বান করে তাকে কিঞ্চিৎ মিষ্টান্ন দিলেই ত আমার পাপ ধবংস হবে! আহা! ব্রাহ্মণভোজন পরম ধৰ্ম্ম। (আপনার প্রতি লক্ষ্য করিয়া) হে দ্বিজবর। এ স্থলে আগমন পূর্ব্বক কিঞ্চিৎ মিষ্টান্ন গ্রহণ করুন। এই যে এলেম। হে দাতঃ, কি মিষ্টান্ন দিবে, দাও দেখি? তবে বসতে আজ্ঞা হউক। (স্বয়ং উপবেশন) এই আহার করুন। (স্বয়ং ভোজন) ওহে ভক্তবৎসল! তুমি আমাকে অত্যন্ত পরিতুষ্ট করলে। (স্বয়ং গাত্রোত্থান করিয়া) তুমি কি বর প্রার্থনা কর। হে দ্বিজবর। যদি এই মিষ্টান্ন চুরি বিষয়ে আমার কোন পাপ হয়ে থাকে, তবে যেন সে পাপ দূর হয়। তথাস্তু! এই ত নিষ্পাপী হলেম। ওহে, ব্রাহ্মণকুলে জন্ম কি সামান্য পুণ্যের কৰ্ম্ম! (উচ্চৈঃস্বরে হাস্য) যা হউক! প্রায় দেড় বৎসর রাজার সহিত নানা দেশ পৰ্য্যটন আর নানা তীর্থ দর্শন করেছি, কিন্তু মা যমুনা! তোমার মত পবিত্র নদী আর দুটি নাই! তোমার ভগিনী জাহ্নবীর পাদপদ্মে সহস্র প্রণাম, কিন্তু মা, তোমার শ্রীচরণাম্বুজে সহস্ৰ সহস্ৰ প্ৰণিপাত! তোমার নিৰ্ম্মল সলিলে স্নান করলে কি ক্ষুধার উদ্রেকই হয়। যাই, এখন আর বিলম্বে প্রয়োজন নাই। রাণী বললেন, যে একবার তুমি গিয়ে দেখে এসো দেখি, আমার যদু কি কচ্যে? তা দেখতে গিয়ে আমার আবার মধ্যে থেকে কিছু মিষ্টান্নও লাভ হয়ে গেল। বেগারের পুণ্যে কাশী দর্শন! মন্দই কি? আপনার উদর তৃপ্তি হলো; এখন রাণীর মনঃ-তৃপ্তি করিগে।

    [ প্রস্থান।


    দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

    প্রতিষ্ঠানপুরী—রাজশুদ্ধান্ত।
    (রাজা যযাতি এবং রাজ্ঞী দেবযানী আসীন।)

    রাজ্ঞী। হে নাথ! আপনার মুখে যে সে কথাগুলি কত মিষ্ট লাগে, তা আমি একমুখে বলতে পারি না! কতবার ত আপনার মুখে সে কথা শুনেছি, তথাপি আবার তাই শুনতে বাসনা হয়! হে জীবিতেশ্বর। আপনি আমাকে সেই অন্ধকারময় কূপ হতে উদ্ধার করে আমার নিকটে বিদায় হয়ে কোথায় গেলেন?

    রাজা। প্রিয়ে! যেমন কোন মনুষ্য কোন দেবকন্যাকে দৈবযোগে অকস্মাং দর্শন করে ভয়ে অতিবেগে পলায়ন করে, আমিও তদ্রূপ তোমার নিকট বিদায় হয়ে দ্রুতবেগে ঘোরতর মহারণ্যে প্রবেশ করলেম, কিন্তু আমার চিত্তচকোর তোমার এই পূর্ণচন্দ্রাননের পুনর্দর্শনে যে কিরূপ ব্যাকুল হলো, যিনি অন্তৰ্য্যামী ভগবান্‌, তিনিই তা বলতে পারেন। পরে আমি আতপতাপে তাপিত হয়ে বিশ্রামার্থে এক তরুতলে উপবেশন করলেম, এবং চতুদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে দেখলেম, যেন সকলই অন্ধকারময় এবং শূন্যাকার! কিঞ্চিৎ পরে সে স্থান হতে গাত্রোত্থান করে গমনের উপক্রম কচ্চি, এমন সময়ে এক হরিণী আমার দৃষ্টিপথে পতিত হলো। স্বাভাবিক মৃগয়াসক্তি হেতু আমিও সেই হরিণীকে দর্শনমাত্রেই শরাসনে এক খরতর শর যোজনা করলেম; কিন্তু সন্ধানকালে কুরঙ্গিণী আমার প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করাতে তার নয়নযুগল দেখে আমার তৎক্ষণাৎ তোমার এই কমলনয়ন স্মরণ হলো, এবং তৎকালে আমি এমন বলহীন আর বিমুগ্ধ হলেম, যে আমার হস্ত হতে শরাসন ভূতলে কখন যে পতিত হলো, তা আমি কিছুই জানতে পাল্যেম না।

    রাজ্ঞী। (রাজার হস্ত ধরিয়া এবং অনুরাগ সহকারে) হে প্রাণনাথ! আমার কি শুভাদৃষ্ট!—তার পর l

    রাজা। প্রেয়সি! যদি তোমার শুভাই, তবে আমার কি? প্রিয়ে! তুমি আমার জন্ম সফল করেছো। —তার পর গমন করতে করতে এক কোকিলার মধুর ধ্বনি শ্রবণ করে আমার মনে হলো, যে তুমিই আমাকে কুহুরবে আহ্বান কচ্যো।

    রাজ্ঞী। হে প্ৰাণেশ্বর। তখন যদি সেই কোকিলার দেহে আমার প্রাণ প্রবিষ্ট হতে পারত, তবে সে কোকিলা কুহুরবে কেবল এইমাত্র বলতে, “হে রাজন্‌! আপনি সেই কুপতটে পুনর্গমন করুন, আপনার জন্যে শুক্রকন্যা দেবযানী ব্যাকুলচিত্তে পথ নিরীক্ষণ কচ্যে।”

    রাজা। প্রিয়ে! আমার অদৃষ্টে যে এত সুখ আছে, তা আমি স্বপ্নেও জানি না; যদি আমি তখন জানতে পাত্যেম, তবে কি আর এ নগরীতে একাকী প্রত্যাগমন করি? একবারে তোমাকে আমার হৃৎপদ্মাসনে উপবিষ্ট করিয়েই আনতেম! আমি যে কি শুভলগ্নে দৈত্যদেশে যাত্রা করেছিলেম, তা কেবল এখনই জানতে পাচ্যি।

    (বিদূষকের প্রবেশ।)

    কি হে দ্বিজবর! কি সংবাদ?

    বিদূ। মহারাজ, শ্রীমান নবকুমারকে একবার দর্শন করে এলেম। রাজমহিষী চিরজীবিনী হউন। আহা! কুমারের কি অপরূপ রূপলাবণ্য! যেন দ্বিতীয় কুমার, কিম্বা তরুণ অরুণতুল্য শোভা। আর না হবেই বা কেন? “পিতা যস্য, পিতা যস্য”—আহা হা, কবিতাটা বিস্মৃত হলেম যে?

    রাজা। (সহাস্যবদনে) ক্ষান্ত হও হে, ক্ষান্ত হও! তোমার মত ঔদরিক ব্রাহ্মণের খাদ্যদ্রব্যের নাম ব্যতীত কি আর কিছু মনে থাকে?

    রাজ্ঞী। (বিদূষকের প্রতি) মহাশয়। আমার যদুর নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে না কি? (রাজার প্রতি) নাথ! তবে আমি এখন বিদায় হই।

    রাজা। প্রিয়ে, তোমার যেমন ইচ্ছা হয়।

    [ রাজ্ঞীর প্রস্থান।

    বিদূ। মহারাজ! এই যে আপনাদের ক্ষত্রিয়জাতির কি স্বভাব, তা বলে উঠা ভার। এই দেখুন দেখি! আপনি দৈত্যদেশে মৃগয়া করতে গিয়ে কি না কল্যেন? ক্ষত্রিয়দুষ্প্রাপ্যা মহর্ষি-কন্যাকেও আপনি লাভ করেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ। আহা! আপনি দৈত্যদেশ হতে কি অপূৰ্ব্ব অনুপম রত্নই এনেছেন। ভাল মহারাজ! জিজ্ঞাসা করি, এমন রত্ন কি সেখানে আর আছে?

    রাজা। (সহাস্যমুখে) ভাই হে! বোধ হয়, দৈত্যদেশে এ প্রকার রত্ন অনেক আছে।

    বিদূ। মহারাজ, আমার ত তা বিশ্বাস হয় না।

    রাজা। তুমি কি মহিষীর সকল সহচরীগণকে দেখেছ?

    বিদূ। আজ্ঞা না।

    রাজা। আহা! সখে, তার সহচরীদের মধ্যে একটি যে স্ত্রীলোক আছে, তার রূপলাবণ্যের কথা কি বলবো! বোধ হয়, যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মীদেবীই অবনীতে অবতীর্ণ হয়েছেন! সে যে মহিষীর নিতান্ত সহচরী, কি সখা, তাও নয়।

    বিদূ। কি তবে মহারাজ?

    রাজা। তা ভাই, বলতে পারি না, মহিষীকেও জিজ্ঞাসা করতে শঙ্কা হয়। আর আমিও যে তাকে বিলক্ষণ স্পষ্টরূপে দেখেছি, তাও নয়। যেমন রাত্রিকালে আকাশমণ্ডল ঘনঘটা দ্বারা আচ্ছন্ন হলে নিশানাথ মুহূৰ্ত্তকাল দৃষ্ট হয়ে পুনরায় মেঘাবৃত হন, সেই সুন্দরী আমার দৃষ্টিপথে কয়েকবার সেইরূপে পতিত হয়েছিল। বোধ হয়, রাজ্ঞীও বা তাকে আমার সম্মুখে আসতে নিষেধ করে থাকবেন। আহা! সখে, তার কি রূপ-মাধুর্য্য! তার পদ্মনয়ন দর্শন করলে পদ্মের উপর ঘৃণা জন্মে। আর তার মধুর অধরকে রতিসৰ্ব্বস্ব বললেও বলা যেতে পারে।

    (নেপথ্যে) দোহাই মহারাজের। আমি অতি দরিদ্র ব্রাহ্মণ। হায়! হায়! আমার সর্বনাশ হলো।

    রাজা। (সসন্ত্রমে) এ কি! দেখ ত হে? কোন্‌ ব্যক্তি রাজদ্বারে এত উচ্চৈঃস্বরে হাহাকার কচ্যে?

    বিদূ। যে আজ্ঞা! আমি—(অৰ্দ্ধোক্তি)

    (নেপথ্যে) দোহাই মহারাজের! হায়! হায়! হায়! আমার সর্বস্ব গেলো!

    রাজা। যাও না হে! বিলম্ব কচ্যে কেন? ব্যাপারটা কি? চিত্ৰপুত্তলিকার ন্যায় যে নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে?

    বিদূ। আজ্ঞা না, ভাবছি বলি, দেব-অমাত্য হয়ে আপনি দৈত্যগুরুর কন্যা বিবাহ করেছেন, সেই ক্রোধে যদি কোন মায়াবী দৈত্যই বা এসে থাকে; তা হলে—(অৰ্দ্ধোক্তি)

    রাজা। আঃ ক্ষুদ্রপ্রাণি। তুমি থাক, তবে আমি আপনিই যাই।

    বিদূ। আজ্ঞা না মহারাজ! আমার অদৃষ্ট্রে যা থাকে, তাই হবে; আপনার যাওয়া কখনই উচিত হয় না।

    রাজা। (গাত্রোত্থান করিয়া স্মিতমুখে স্বগত) ব্রাহ্মণজাতি বুদ্ধে বৃহস্পতি বটে, কিন্তু স্ত্রীলোকাপেক্ষাও ভীরু! (চিন্তা করিয়া) সে যা হোক, সে স্ত্রীলোকটি যে কে, তা আমি ভেবে চিন্তে কিছুই স্থির কত্যে পাচ্চি না। আমরা যখন গোদাবরী-তীরস্থ পর্বতমুনির আশ্রমে কিঞ্চিৎকাল বিহার করি, তখন একদিন আমি একলা নদীতটে ভ্রমণ কত্যে কত্যে এক পুম্পোদ্যানে প্রবেশ করেছিলাম। সেখানে সেই পরম রমণীয়া নবযৌবনা কামিনীকে দেখলেম, আপনার করতলে কপোল বিদ্যাস করে অশোকবৃক্ষতলে বলে রয়েছে, বোধ হলো, যে সে চিন্তার্ণবে মগ্না রয়েছে; আর তার চারিদিকে নানা কুসুম বিস্তৃত ছিল, তাতে এমনি অনুমান হতে লাগলো, যেন দেবতাগণ সেই নবযৌবন অঙ্গনার সৌন্দৰ্য্যগুণে পরিতুষ্ট হয়ে তার উপর পুষ্পবৃষ্টি করেছেন, কিম্বা স্বয়ং বসন্তরাজ বিকশিত পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে রতিভ্রমে তাকে পূজা করেছেন। পরে আমার পদশব্দ শুনে সেই বামা আমার দিকে নয়নপাত করে, যেমন কোন ব্যাধকে দেখে কুরঙ্গিণী পবনবেগে পলায়ন করে, তেমনি ব্যস্তসমস্তে অন্তর্হিতা হলো। পরম্পরায় শুনেছি, যে ঐ সুন্দরী দৈত্যরাজকন্যা শৰ্ম্মিষ্ঠা; কিন্তু তার পর আর কোন পরিচয় পাই নাই। সবিশেষ অবগত হওয়া আবশ্যক, কিন্তু— (অৰ্দ্ধোক্তি)

    (বিদূষকের এক জন ব্রাহ্মণ সহিত পুনঃপ্রবেশ।)

    ব্রাহ্মণ। দোহাই মহারাজের! আমি অতি দরিদ্র ব্রাহ্মণ! আমার সর্বনাশ হলো!

    রাজা। কেন, কেন? বৃত্তান্তটা কি বলুন দেখি?

    ব্রাহ্ম। (কৃতাঞ্জলিপুটে) ধৰ্ম্মাবতার! কয়েকজন দুর্দ্দান্ত তস্কর আমার গৃহে প্রবেশ করে যথাসৰ্ব্বস্ব অপহরণ কচ্যে! হায়! হায়! কি সৰ্ব্বনাশ! হে নরেশ্বর, আপনি আমাকে রক্ষা করুন।

    রাজা। (সরোষে) সে কি! এ রাজ্যে এমন নির্ভয় পাষণ্ড লোক কে আছে, যে ব্রাহ্মণের ধন অপহরণ করে? মহাশয়, আপনি ক্ৰন্দন সম্বরণ করুন, আমি স্বহস্তে এই মুহূৰ্ত্তেই সেই দুরাচার দস্যুদলের যথোচিত দণ্ড বিধান করবে। (বিদূষকের প্রতি) সখে মাধব্য, তুমি ত্বরায় আমার ধনুৰ্ব্বাণ ও অসিচৰ্ম্ম আন দেখি।

    বিদূ। মহারাজ, আপনার স্বয়ং যাবার প্রয়োজন কি?

    রাজা। (সক্রোধে) তুমি কি আমার আজ্ঞা অবহেলা কর?

    বিদূ। (সত্রাসে) সে কি, মহারাজ? আমার এমন কি সাধ্য যে আপনার আজ্ঞা উল্লঙ্ঘন করি।

    [ বেগে প্রস্থান।

    রাজা। মহাশয়, কত জন তস্কর আপনার গৃহাত্রমণ করেছে?

    ব্রাহ্ম। হে মহীপতে, তা নিশ্চয় বলতে পারি না। হায়! আমার সৰ্ব্বস্ব গেলো!

    রাজা। ঠাকুর, আপনি ধৈর্য্য অবলম্বন করুন; আর বৃথা আক্ষেপ করবেন না।

    (বিদূষকের অস্ত্রশস্ত্র লইয়া পুনঃপ্রবেশ।)

    এই আমি অস্ত্র গ্রহণ কল্যেম। (অস্ত্রগ্রহণ) এখন চলুন যাই।

    [ রাজা ও ব্রাহ্মণের প্রস্থান।

    বিদূ। (স্বগত) যেমন আহুতি দিলে অগ্নি জলে উঠে, তেমনি শত্রুনামে আমাদের মহারাজেরও কোপাগ্নি জ্বলে উঠলো। চোর বেটাদের আজ যে মরণদশা ধরেছে, তার কোন সন্দেহ নাই। মরবার জন্যই পিঁপড়ের পাখা ওঠে। এখন এখানে থেকে আর কি করবো? যাই, নগরপালের নিকট এ সংবাদ পাঠিয়ে দিগে।

    [ প্রস্থান।


    তৃতীয় গর্ভাঙ্ক

    প্রতিষ্ঠানপুরী-রাজান্তঃপুর-সংক্রান্ত উদ্যান।
    (বকাসুর এবং শৰ্ম্মিষ্ঠার প্রবেশ।)

    বক। ভদ্রে! এ কথা আমি তোমার মাতা দৈত্যরাজমহিষীকে কি প্রকারে বলবো? তিনি তোমা বিরহে শোকানলে যে কি পর্য্যন্ত পরিতাপিতা হচ্যেন, তা বলা দুষ্কর। হে কল্যাণি, তোমা ব্যতিরেকে সে শোকানল নিৰ্ব্বাণ হবার আর উপায়ান্তর নাই।

    শৰ্ম্মি। মহাশয়, আমার অশ্রুজলে যদি সে অগ্নি নিৰ্ব্বাণ হয়, তবে আমি তা অবশ্যই করবো; কিন্তু আমি দৈত্যপুরীতে আর এ জন্মে ফিরে যাব না! (অধোবদনে রোদন।)

    বক। ভদ্রে, গুরু মহর্ষিকে তোমার পিতা নানাবিধ পূজাবিধিতে পরিতুষ্ট করেছেন; রাজচক্রবর্তী যযাতির পাটরাণী দেবযানী স্বীয় পিতৃ-আজ্ঞা কখনই উল্লঙ্ঘন বা অবহেলা করবেন না, যদ্যপি তুমি অনুমতি কর, আমি রাজসভায় উপস্থিত হয়ে নৃপতিকে এ সকল বৃত্তান্ত অবগত করাই। হে কল্যাণি। তোমা বিরহে দৈত্যপুরী এককালে অন্ধকার হয়েছে; আর পুরবাসীরাও রাজদম্পতির দুঃখে পরম দুঃখিত।

    শৰ্ম্মি। মহাশয়, আপনি যদি এ কথা নৃপতিকে অবগত করতে উদ্যত হন, তবে আমি এই মুহূৰ্ত্তেই এ স্থলে প্রাণত্যাগ করবে। (রোদন।)

    বক। শুভে, তবে বল, আমার কি করা কৰ্ত্তব্য?

    শৰ্ম্মি। মহাশয়, আপনি দৈত্যদেশে পুনর্গমন করুন এবং আমার জনকজননীকে সহস্ৰ সহস্র প্রণাম জানিয়ে এই কথা বলবেন, “তোমাদের হতভাগিনী দুহিতার এই প্রার্থনা, যে তোমরা তাকে জন্মের মত বিস্মৃত হও।”

    বক। রাজনন্দিনি, তোমার জনক-জননীকে আমি এ কথা কেমন করে বলবো তুমি তাদের একমাত্র কন্যা; তুমি তাদের মানস-সরোবরের একটি মাত্র পদ্মিনী; তুমিই কেবল তাদের হৃদয়াকাশের পূর্ণশশী।

    শৰ্ম্মি। মহাশয়, দেখুন, এ পৃথিবীতে কত শত লোকের সন্তানসন্ততি যৌবনকালেই মানবলীলা সম্বরণ করে, তা তারা কি চিরকাল শোকানলে পরিতপ্ত হয়? শোকানল কখন চিরস্থায়ী নয়।

    বক। কল্যাণি, তবে কি তোমার এই ইচ্ছা, যে তুমি আপনার জন্মভূমি আর দর্শন করবে না? তোমার পিতা মাতাকে কি একবারে বিস্তৃত হলে? আর আমাকে কি শেষে এই সংবাদ লয়ে যেতে হলো?

    শমি। মহাশয়, আমার পিতা মাতা আমার মানস-মন্দিরে চিরকাল পূজিত রয়েছেন। যেমন কোন ব্যক্তি, কোন পরম পবিত্র তীর্থ দৰ্শন করে এলে, তত্রস্থ দেবদেবীর অদর্শনে, তাদের প্রতিমূৰ্ত্তি আপনার মনোমন্দিরে সংস্থাপিত করে ভক্তিভাবে সৰ্ব্বদা ধ্যান করে, আমিও সেইরূপ আমার জনক-জননীকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সহিত চিরকাল স্মরণ করবো; কিন্তু দৈত্যদেশে প্রত্যাগমন করতে আপনি আমাকে আর অনুরোধ করবেন না।

    বক। বংসে, তবে আমি বিদায় হই।

    শৰ্ম্মি। (নিরুত্তরে রোদন।)

    বক। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) ভদ্রে, এখনও বিবেচনা করে দেখ। রাজসভা অতিদূরবৰ্ত্তিনী নয়; রাজচক্ৰবর্ত্তী যযাতিও পরম দয়ালু ও পরহিতৈষী; তোমার আদ্যোপান্ত সমুদয় বিবরণ শ্রবণমাত্রেই তিনি যে তোমাকে স্বদেশগমনে অনুমতি করবেন, তার কোন সংশয় নাই।

    শৰ্ম্মি। (স্বগত) হা হৃদয়, তুমি জালাবৃত পক্ষীর ন্যায় যত মুক্ত হতে চেষ্টা কর, ততই আরও আবদ্ধ হও! (প্রকাশে) হে মহাভাগ! আপনি ও কথা আর আমাকে বলবেন না।

    বক। তবে আর অধিক কি বলবো? শুভে, জগদীশ্বর তোমার কল্যাণ করুন! আমার আর এ স্থলে বিলম্ব করবার কোন প্রয়োজন নাই; আমি বিদায় হলেম।

    [ প্রস্থান।

    শৰ্ম্মি। (স্বগত) এ দুস্তর শোকসাগর হতে আমাকে আর কে উদ্ধার করবে? হা হতবিধাতঃ, তোমার মনে কি এই ছিল? তা তোমারই বা দোষ কি! (রোদন।) আমি আপন কৰ্ম্মদোষে এ ফল ভোগ কচি ৷ গুরুকন্যার সহিত বিবাদ করে প্রথমে রাজভোগচ্যুতা হয়ে দাসী হলেম, তা দাসী হয়েও ত বরং ভাল ছিলেম, গুরুর আশ্রমে ত কোন ক্লেশই ছিল না; কিন্তু এ আবার বিধির কি বিড়ম্বনা! হা অবোধ অন্তঃকরণ, তুই যে রাজা যযাতির প্রতি এত অনুরক্ত হলি, এতে তোর কি কোন ফললাভ হবে? তা তোরই বা দোষ কি? এমন মূৰ্ত্তিমান কন্দৰ্পকে দেখে কে তার বশীভূত না হয়? দিনকর উদয়াচলে দর্শন দিলে কি কমলিনী নিমীলিত থাকতে পারে? (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) তা আমার এ রোগের মৃত্যু ভিন্ন আর ঔষধ নাই! আহা! গুরুকন্যা দেবযানী কি ভাগ্যবতী! (অধোবদনে বৃক্ষতলে উপবেশন।)

    (রাজার প্রবেশ)

    রাজা। (স্বগত) আমি ত এ উদ্যানে বহুকালাবধি আসি নাই। শ্রুত আছি, যে এর চতুষ্পার্শ্বে মহিষীর সহচরীগণ না কি বাস করে। আহা! স্থানটি কি রমণীয়? সুমন্দ সমীরণ সঞ্চারে এখানকার লতামওপ কি সুশীতল হয়ে রয়েছে! চতুর্দিকে প্রচণ্ড তপন-তাপ যেন দেব-কোপাগ্নির ন্যায় বসুমতীকে দগ্ধ করচে, কিন্তু এ প্রদেশের কি প্রশান্ত ভাব। বোধ হয়, যেন বিজনবিহারিণী শাস্তিদেবী দুঃসহ প্রভাকরপ্রভাবে একান্ত অধীরা হয়ে, এখানেই স্নিগ্ধচিত্তে বিরাজ করচেন; এবং তার অনুরোধে আর এই উদ্যানস্থ বিহঙ্গমকুলের কূজনরূপ স্তুতিপাঠেই যেন সূর্য্যদেব আপনার প্রখরতর কিরণজাল এ স্থল হতে সম্বরণ করেছেন। আহা! কি মনোহর স্থান! কিঞ্চিৎকাল এখানে বিশ্রাম করে শ্রান্তি দূর করি। (শিলাতলে উপবেশন) দুষ্ট তস্করগণ ঘোরতর সংগ্রাম করেছিল, কিন্তু আমি অগ্নি অস্ত্রে তাদের সকলকেই ভস্ম করেছি। (নেপথ্যে বীণাধবনি) আহাহা! কি মধুর ধ্বনি বোধ হয়, সঙ্গীতবিদ্যায় নিপুণা মহিষীর কোন সহচরী সঙ্গিনীগণ সমভিব্যাহারে আমোদ প্রমোদে কালযাপন কচ্যে! কিঞ্চিৎ নিকটবৰ্ত্তী হয়ে শ্রবণ করি, দেখি। (নিকটে গমন।)

    নেপথ্যে গীত।
    (রাগিণী সোহিনী বাহার—তাল আড়া।)
    আমি ভাবি যার ভাবে, সে ত তা ভাবে না।
    পরে প্রাণ দিয়ে পরে, হলো কি লাঞ্ছনা।
    করিয়ে সুখেরি সাধ, এ কি বিষাদ ঘটনা!
    বিষম বিবাদী বিধি, প্রেমনিধি মিলিলো না!
    ভাব লাভ আশা করে, মিছে পরেরি ভাবনা!
    খেদে আছি ম্রিয়মাণ, বুঝি প্রাণ রহিল না।

    রাজা। আহা! কি মনোহর সঙ্গীত! মহিষী যে এমন একজন সুগায়িকা স্বদেশ হতে সঙ্গে এনেছেন, তা আমি স্বপ্নেও জানতেম না। (চিন্তা করিয়া) এ কি? আমার দক্ষিণ বাহু স্পন্দন হতে লাগলে কেন? এ স্থলে মাদৃশ জনের কি ফললাভ হতে পারে? বলাও যায় না, ভবিতব্যের দ্বার সর্বত্রেই মুক্ত রয়েছে। দেখি বিধাতার মনে কি আছে।

    শৰ্ম্মি। (গাত্রোত্থান করিয়া স্বগত) হা হতভাগিনি! তুমি স্বেচ্ছাক্রমে প্রণয়পরবশ হয়ে আবার স্বাধীন হতে চাও? তুমি কি জান না, যে পিঞ্জরবদ্ধ পক্ষীর চঞ্চল হওয়া বৃথা? হা পিতা-মাতা! হা বন্ধু-বান্ধব! হা জন্মভূমি! আমি কি তবে তোমাদের আর এ জন্মে দর্শন পাব না। (রোদন।)

    রাজা। (অগ্রসর হইয়া স্বগত) আহা! মধুরস্বরা পল্লবাবৃতা কোকিলা কি নীরব হলো? (শৰ্ম্মিষ্ঠাকে অবলোকন করিয়া) এ পরম সুন্দরী নবযৌবনা কামিনীটি কে? ইনি কি কোন দেবকন্যা বনবিহার অভিলাষে স্বৰ্গ হতে এ উদ্যানে অবতীর্ণ হয়েছেন? নতুবা পৃথিবীতে এতাদৃশ অপরূপ রূপের কি প্রকারে সম্ভব হয়? তা ক্ষণৈক অদৃষ্ঠভাবে দেখিই না কেন, ইনি একাকিনী এখানে কি কচ্যেন। (বৃক্ষান্তরালে অবস্থিতি।)

    শৰ্ম্মি। (মুক্তকণ্ঠে) বিধাতা স্ত্রীজাতিকে পরাধীন করে স্বষ্টি করেছেন। দেখ, ঐ যে সুবর্ণ-বর্ণ লতাটি স্বেচ্ছানুসারে ঐ অশোকবৃক্ষকে বরণ করে আলিঙ্গন কচে, যদ্যপি কেউ ওকে অন্য কোন উদ্যান হতে এনে এ স্থলে রোপণ করে থাকে, তথাপি কি ও জন্মভূমি-দর্শনার্থে আপনার প্রিয়তম তরুবরকে পরিত্যাগ কত্যে পারে? কিম্বা যদি কেউ ওকে এখান হতে স্ববলে লয়ে যায়, তবে কি ও আর প্রিয়বিরহে জীবন ধারণ করে? হে রাজন্‌! আমিও সেইমত তোমার জন্যে পিতামাতা, বন্ধুবান্ধব, জন্মভূমি, সকলই পরিত্যাগ করেছি। যেমন কোন পরমভক্ত কোন দেবের স্বপ্রসন্নতার অভিলাযে পৃথিবীস্থ সমুদয় মুখভোগ পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসধৰ্ম্ম অবলম্বন করে, আমিও সেইরূপ যযাতিমূৰ্ত্তি সার করে অন্ত সকল সুখে জলাঞ্জলি দিয়েছি! (রোদন।)

    রাজা। (স্বগত) এ কি আশ্চৰ্য্য! এ যে সেই দৈত্যরাজ-দুহিতা শৰ্ম্মিষ্ঠা! কিন্তু এ যে আমার প্রতি অনুরক্তা হয়েছে, তা ত আমি স্বপ্নেও জানি না। (চিন্তা করিয়া সপুলকে) বোধ হয়, এই জন্যেই বুঝি আমার দক্ষিণ বাহু স্পন্দন হতেছিল। আহা! অদ্য আমার কি সুপ্রভাত! এমন রমণীরত্ন ভাগ্যক্রমে প্রাপ্ত হলে যে কত যত্নে তাকে হৃদয়ে রাখি, তা বল। অসাধ্য। (অগ্রসর হইয়। শৰ্ম্মিষ্ঠার প্রতি) হে সুন্দরি। রুদ্রের কোপানলে মন্মথ পুনরায় দগ্ধ হয়েছেন না কি, যে তুমি স্বর্গ পরিত্যাগ করে একাকিনী এ উদ্যানে বিলাপ কচ্যো?

    শৰ্ম্মি। (রাজাকে অবলোকন করিয়া লজ্জিত হইয়া স্বগত) কি আশ্চর্য্য! মহারাজ যে একাকী এ উদ্যানে এসেছেন!

    রাজা। হে মৃগাক্ষি। তুমি যদি মন্মথমনোহারিণী রতি না হও, তবে তুমি কে, এ উদ্যান অপরূপ রূপলাবণ্যে উজ্জল কচ্যে?

    শৰ্ম্মি। (স্বগত) আহা! প্রাণনাথ কি মিষ্টভাষী –হা অন্তঃকরণ। তুমি এত চঞ্চল হলে কেন?

    রাজা। ভদ্রে, আমি কি অপরাধ করেছি, যে তুমি মধুরভাষে আমার কর্ণকুহরের সুখপ্রদানে একবারে বিরত হলে?

    শৰ্ম্মি। (কৃতাঞ্জলিপুটে) হে নরেশ্বর, আমি রাজমহিষীর একজন পরিচারিকা মাত্র; তা দাসীকে আপনার এ প্রকারে সম্বোধন করা উচিত হয় না।

    রাজা। না, না, সুন্দরি! তুমি সাক্ষাৎ রাজলক্ষ্মী! যা হোক, যদ্যপি তুমি মহিষীর সহচরী হও, তবে তোমাতে আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। অতএব হে ভদ্রে। তুমি আমাকে বরণ কর।

    শৰ্ম্মি। হে নরবর! আপনি এ দাসীকে এমত আজ্ঞা করবেন না।

    রাজা। সুন্দরি, আমাদের ক্ষত্রিয়কুলে গান্ধৰ্ব্ব-বিবাহ প্রচলিত আছে, আর তুমি রূপে ও গুণে সৰ্ব্বপ্রকারেই আমার অনুরূপ পাত্রী, অতএব হে কল্যাণি তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে আমার পাণি গ্রহণ কর।

    শৰ্ম্মি। (স্বগত) হা হৃদয়, তোর মনোরথ এত দিনের পর কি সফল হবে? (প্রকাশে) হে নরনাথ, আপনি এ দাসীকে ক্ষমা করুন! আমার প্রতি এ বাক্য বিড়ম্বনা মাত্র।

    রাজা। প্রিয়ে, আমি সূর্য্যদেব ও দিষ্মণ্ডলকে সাক্ষী করে এই তোমার পাণিগ্রহণ করলেম, (হস্ত ধারণ) তুমি অদ্যাবধি আমার রাজমহিষীপদে অভিষিক্তা হলে।

    শৰ্ম্মি। (সসন্ত্রমে) হে নরেশ্বর, আপনি এ কি করেন। শশধর কি কুমুদিনী ব্যতীত অন্য কুসুমে কখন স্পৃহা করেন?

    রাজা। (সহাস্যবদনে) আর কুমুদিনীরও চন্দ্রস্পর্শে অপ্রফুল্ল থাকা ত উচিত নয়! আহা! প্রেয়সি, আদ্য আমার কি শুভদিন। আমি যে দিবস তোমাকে গোদাবরী-নদীতটে পর্বতমুনির আশ্রমে দর্শন করেছিলেম, সেই দিন হতে তোমার এই অপূৰ্ব্ব মোহিনীমূৰ্ত্তি আমার হৃদয়-মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে : তা দেবতা সুপ্রসন্ন হয়ে এত দিনে আমার অভীষ্ট্রসিদ্ধি কল্যেন।

    (দেবিকার প্রবেশ।)

    দেবি। (স্বগত) আহা! বকাসুর মহাশয়ের খেদোক্তি স্মরণ হলে হৃদয় বিদীর্ণ হয়। (চিন্তা করিয়া) দেবযানীর পরিণয়কালাবধিই প্রিয়সখীর মনে জন্মভূমির প্রতি এইরূপ বৈরাগ্য উপস্থিত হয়েছে। কি আশ্চৰ্য্য! এমন সরলা বালার অন্তঃকরণ কি গুরুকন্যার সৌভাগ্যে হিংসায় পরিণত হলো? (রাজাকে অবলোকন করিয়া সসন্ত্রমে) এ কি! মহারাজ ষযাতি যে প্রিয়সখীর সহিত কথোপকথন কচ্যেন! আহা! দুইজনের একত্রে কি মনোহর শোভাই হয়েছে! যেন কমলিনীনায়ক অবনীতে অবতীর্ণ হয়ে প্রিয়তমা কমলিনীকে মধুরভাষে পরিতুষ্ট কচ্যেন।

    শৰ্ম্মি। আমার ভাগ্যে যে এত সুখ হবে, তা আমার কখনই মনে ছিল না; হে নরেশ্বর, যেমন কোন যুথভ্রষ্টা কুরক্ষিণী প্রাণভয়ে ভীত হয়ে কোন বিশাল পৰ্ব্বতাস্তরালে আশ্রয় লয়, এ অনাথ দাসীও অদ্যাবধি সেইরূপ আপনার শরণাপন্ন হলো। মহারাজ, আমি এতদিনে চিরদুঃখিনী ছিলাম! (রোদন।)

    রাজা। (শৰ্ম্মিষ্ঠার অশ্র উন্মোচন করিতে করিতে) কেন, কেন, প্রিয়ে! বিধাতা ত তোমার নয়নযুগল কখন অশ্রুপূর্ণ হবার নিমিত্তে করেন নাই? (দেবিকাকে অবলোকন করিয়া সসন্ত্রমে) প্রিয়ে, দেখ দেখি, এ স্ত্রীলোকটি কে?

    শৰ্মি। মহারাজ, ইনি আমার প্রিয়সখী, এঁর নাম দেবিকা।

    দেবি। মহারাজের জয় হউক।

    রাজা। (দেবিকার প্রতি) সুন্দরি, তোমার কল্যাণে আমি সৰ্ব্বত্রেই বিজয়ী। এই দেখ, আমি বিনা সমুদ্রমন্থনে অদ্য এই কমল-কাননে কমলাস্বরূপ তোমার সখীরত্ন প্রাপ্ত হলেম।

    দেবি। (করযোড়ে) নরনাথ, এ রত্ন রাজমুকুটেরই যোগ্যাভরণ বটে, আমাদেরও অদ্য নয়ন সফল হলো।

    শৰ্ম্মি। (দেবিকার প্রতি) তবে সখি, সংবাদ কি বল দেখি?

    দেবি। রাজনন্দিনি, বকাসুর মহাশয় তোমার নিকট বিদায় হয়েও পুনৰ্ব্বার একবার সাক্ষাৎ কত্যে নিতান্ত ইচ্ছুক; তিনি পূর্বদিকের বৃক্ষবাটিকাতে অপেক্ষা কচ্যেন, তোমার যেমন অনুমতি হয়।

    রাজা। কোন্‌ বকাসুর?

    শৰ্ম্মি। বকাসুর মহাশয় একজন প্রধান দৈত্য, তিনি আমার সহিত সাক্ষাৎকারণেই আপনার এ নগরীতে আগমন করেছেন।।

    রাজা। (সসন্ত্রমে) সে কি! আমি দৈত্য বর বকাসুর মহাশয়ের নাম বিশেষরূপে শ্রুত আছি, তিনি একজন মহাবীর পুরুষ। তার যথোচিত সমাদর না কল্যে আমার এ রাজধানীর কলঙ্ক হবে; প্রিয়ে, চল, আমরা সকলে অগ্রসর হয়ে তাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিগে।

    [ সকলের প্রস্থান।

    (বিদূষকের প্রবেশ।)

    বিদূ। (স্বগত) এই ত মহিষীর পরিচারিকাদের উদ্যান; ত কৈ, মহারাজ কোথায়? রক্ষক বেটা মিথ্যা বললে না কি? কি আপদ! প্রিয় বয়স্য অস্ত্রধারী ব্যক্তির নাম শুনলেই একবারে নেচে উঠেন। ছি! ক্ষত্ৰজাতির কি দুঃস্বভাব! এঁদের কবিভায়ারা যে নরবাঘ্র বলেন, সে কিছু অযথার্থ নয়। দেখ দেখি, এমন সময় কি মনুষ্য গৃহের বাহির হতে পারে? আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, আমার কিছু সুখের শরীর নয়, তবুও আমার যে এ রৌদ্রে কত ক্লেশ বোধ হচ্যে, তা বলা দুষ্কর। এই দেখ, আমি যেন হিমাচল-শিখর হয়েছি, আমার গা থেকে যে কত শত নদ ও নদী নিঃস্থত হয়ে ভূতলে পড়ছে, তার সীমা নাই! (মস্তকে হস্ত দিয়া) উঃ আমি গঙ্গাধর হলেম না কি? তা না হলে আমার মস্তক-প্রদেশে মন্দাকিনী যে এসে অবস্থিতি কচ্যেন, এর কারণ কি? যা হোক, মহারাজ গেলেন কোথায়? তিনি যে একাকী দমু্যদলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে বেরিয়েছেন, এ কথা শুনে পুরবাসীরা সকলে অত্যন্ত ব্যাকুল হয়েছে, আর সৈন্তাধ্যক্ষের পদাতিক দল লয়ে র্তর অন্বেষণে নানাদিকে ভ্রমণ কচ্যে! কি উৎপাত! ডাঙ্গায় বসে যে মাছ বঁড়শীতে অনায়াসে গাঁথা যায়, তার জন্যে কি জলে ঝাঁপ দেওয়া উচিত? (চিন্তা করিয়া) হাঁ, এও কিছু অসম্ভব নয়। দেখ, এই উদ্যানের চতুষ্পার্শে রাণীর পরিচারিকার বসতি করে। তারা সকলেই দৈত্যকন্যা। শুনেছি তারা না কি পুরুষকে ভেড়া করে রাখে। কে জানে, যদি তাদের মধ্যে কেউ আমাদের কন্দর্পস্বরূপ মহারাজের রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে মায়াবলে সেইরূপই করে থাকে তবেই ত ঘোর প্রমাদ! (চিন্তা করিয়া) হা, হা, তাও বটে, আমারও ত এমন জায়গায় দেখা দেওয়া উচিত কৰ্ম্ম নয়। যদিও আমি মহারাজের মতন স্বয়ং মূৰ্ত্তিমানূ মন্মথ নই, তবু আমি যে নিতান্ত কদাকার, তাও বলা যায় না। কে জানে, যদি আমাকেও দেখে আবার কোন মাগী ক্ষেপে ওঠে, তা হলেই ত আমি গেলাম। তা ভেড়া হওয়া ত কখনই হবে না। আমি দুঃখী ব্রাহ্মণের ছেলে, আমার কি তা চলে? ও-সব বরঞ্চ রাজাদের পোষায়; আমরা পেট ভরে খাব আর আশীৰ্ব্বাদ কববো, এই ত জানি; তা সাত জন্ম বরং নারীর মুখ না দেখবো, তবু ত ভেড়া হতে স্বীকার হবে না-বাপ! (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া সচকিতে) ও কি? ঐ না —এক মাগী আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে? ও বাবা, কি সৰ্ব্বনাশ! (বস্ত্রের দ্বারা মুখাবরণ) মাগী আমার মুখটা না দেখতে পেলেই বাঁচি। হে প্ৰভু অনঙ্গ! তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আমাকে এ বিপদ হতে রক্ষা কর। তা আর কি? এখন দেখচি, পালাতে পাল্যেই রক্ষা।

    [ বেগে পলায়ন।

    ইতি তৃতীয়াঙ্ক।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleহেক্‌টর-বধ – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
    Next Article মেঘনাদবধ কাব্য – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }