Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শান্তিনিকেতন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    উপন্যাস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক পাতা গল্প832 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ফল

    ট্রেনে ওঠা মাত্র লোকটার দিকে চোখ গেল তার দুটো কারণ। প্রথম, তার ছ জঙ্কা স্লিপার বার্থ-এর খুপরিটা আমার জানলার ধারের রিজার্ভ বেঞ্চের নাক বরাবর। দ্বিতীয় কারণ, ব্যস্তসমস্ত পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তার অসহিষ্ণু চিৎকার চেঁচামেচি। জিনিসপত্র গোছগাছ করা আর শয্যা বিছানোর দ্রুত চেষ্টার ফাঁকে বউটা অজ্ঞাত অপরাধে বার দুই ধমক খেল, আর ছেলে-মেয়ে কটা বার তিনেক তাড়া খেল। আমার ধারণা, এর সবটুকুই ট্রেনে ওঠার উত্তেজনার দরুন।

    মিনিট দশেকের মধ্যে শোয়া এবং বসার পরিপাটি ব্যবস্থা করে আধময়লা রুমাল বার করে ঘাম মুছতে মুছতে লোকটা নিজেই আগে বসে পড়ল। তারপর কর্কশ গলা যথাসম্ভব মোলায়েম করে আহ্বান জানালো, কই গো, বোসো না।… এই ছেলে-মেয়েগুলো, তোরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, এখন বসতে পারিস না?

    হুকুম পেয়ে হুড়মুড় করে প্রথমে ছেলে-মেয়ে চারটে যে-যার পছন্দমতো জায়গা দখল করল। দুটো ছেলে দুটো মেয়ে। তাদের বয়েস বারো থেকে ছয়ের মধ্যে। তাদেরও চোখে মুখে ট্রেনে ওঠার উত্তেজনার ছাপ। বউটির মুখ দেখা গেল না ভালো করে, ভুরুর নিচে পর্যন্ত ঘোমটা টানা। একটু রোগা ধরনের। যতটুকু দেখা গেল গায়ের রঙ ফরসাই মনে হল। বসার আদেশ পেয়ে সেও এগিয়ে গিয়ে ওধারের জানলার। কাছে গুটিসুটি হয়ে বসল। লোকটি আবার উঠে দাঁড়িয়ে সমনোযোগে দ্বিতীয় দফা জিনিসপত্র পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

    লোকটির বয়েস বছর ছেচল্লিশ সাতচল্লিশ হবে। সঠিক অনুমান করা শক্ত, কারণ সমস্ত মুখে বসন্তের দাগ। দাগগুলো বেশ গভীর আর সংখ্যায় অগুণতি। পরনে কালো চওড়া পাড়ের ধুতি, গায়ে প্রায় হাঁটুছোঁয়া কোঁচকানো সিল্কের পাঞ্জাবি, মাথার চুল বেশ পাট করে আঁচড়ানো।

    আমার বেঞ্চে দুটি তরুণ সাহিত্যিক বসেছিল। তারা আমাকে তুলে দিতে এসেছে। আমার প্রতি তাদের সবিনয় হাব-ভাব দেখে হোক বা যে-কারণেই হোক লোকটি আমাকেও বার দুই পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপর ও-দিক ফেরা রমণীটির উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ল, পান খাবে নাকি গো?

    জবাবে তার মাথা দুপাশে নড়ল একটু। অর্থাৎ খাবে না।

    -এনে তো রাখি। এই তোরা চুপচাপ বসে থাকবি, খবরদার জায়গা ছেড়ে উঠবি না।

    শেষের অনুশাসন ছেলে-মেয়েগুলোর উদ্দেশে। পান আনতে গেল। একটু বাদে আমি ঘড়ি দেখলাম। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। তরুণ সাহিত্যিক দুজন বিদায় নিয়ে নেমে যেতেই ঘণ্টা পড়ল। লোকটা তখনো উঠল না দেখে বউটির চকিত মুখখানা একবার এদিকে ঘুরল, তারপর একটা ছেলেকে সরিয়ে সে জানলার দিকে ঝুঁকল।

    ট্রেন ছাড়ার আগেই লোকটা নির্বিঘ্নে উঠল আবার। হাতে পানের ঠোঙা। তারপরেই আমি অবাক। এক-গাল হেসে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।–পান খাবেন সার?

    সৌজন্যের খাতিরে হেসে মাথা নাড়লাম, খাই নে।

    তাড়াতাড়ি সিল্কের জামার পকেটে হাত ঢোকালো।-সিগারেট?

    আবারও মাথা নাড়লাম। তাও চলে না।

    পরক্ষণে সার থেকে একেবারে মশাইয়ে অবতরণ।–পান না সিগারেট না, আপনি কেমনতর সাহিত্যিক মশাই! সঙ্গে সঙ্গে এক-গাল হাসি। আপনার পরিচয় আপনার সঙ্গের ওই ছেলে দুটির কাছ থেকে জেনে গেছি… একজন মহাশয় ব্যক্তির সঙ্গে চলেছি, বড় সৌভাগ্য আমার!

    বলেই বেশ একটু উত্তেজনা-মেশানো আনন্দ নিয়ে খুপরির মধ্যে ঢুকে গেল। বউয়ের হাতে পানের ঠোঙা চালান করার ফাঁকে চাপা গলায় কি বলল ট্রেনের ঘড়ঘড় শব্দে শোনা গেল না। বউটি সন্তর্পণে এদিকে একবার মুখ ফেরালো।

    লোকটা তক্ষুণি আমার বেঞ্চ-এর সামনে ফিরে এলো আবার। বসন্তের দাগভরা। মুখ খুশিতে ভরাট তেমনি।

    -আপনাদের মত গুণীজনের সঙ্গে দুটো কথা বলার সৌভাগ্য হল, বড় আনন্দ পেলাম। বসি একটু, আপনি বিরক্ত হবেন না তো?

    -না না, বসুন। আপনি যাবেন কোথায়?

    -বেনারস। পাশে বেশ জাঁকিয়ে বসল। জন্ম বয়সের কম্ম, কোথাও তো বেরুনো হয় না… সেই কবে বসন্ত হয়ে পটল তুলব-তুলব করছি, বউটা তখন বাবা বিশ্বনাথের চরণে মাথা খুঁড়েছিল, এত বছর বাদে বাবা টেনেছেন–পড়লাম দুর্গা বলে বেরিয়ে। …তা আপনি তো লক্ষ্ণৌ চলেছেন শুনলাম?

    -হ্যাঁ।

    উৎসুক দু চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করল একটু।-হ্যাঁ মশাই, আমি শুনেছিলাম, আজকালকার সাহিত্যিকরা কলম ধরলেই পয়সা, অঢেল রোজগার করে এক-একজনে… আপনার তো তার ওপর একগাদা বই-পত্র, আমার বউ পাড়ার লাইব্রেরি থেকে এনে এনে পড়ে, ভালো লাগলে আমাকে গল্প শোনায়–আপনি ফার্স্ট ক্লাসে না গিয়ে আমাদের মত স্লিপারে চলেছেন যে?

    বললাম, আমার এতেই সুবিধে হয়, তাছাড়া আপনাদের মত দু-পাঁচ জনের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও হয়।

    -তাই বলুন, আলাপ পরিচয় না হলে লিখবেন কি করে! কিন্তু… থাক, নিন্দে করব না। ঘুরে খুপরির দিকে তাকালো।–এই তোরা ফল খা না–শুনছ! ওদের ফল বার করে দাও, আর এখানেও পাঠাও!

    আমি বাধা দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই বাপের হুকুম পেয়ে ছেলেরা বেঞ্চির তলা থেকে যে বিশাল ঝুড়িটা টেনে বার করল তার কাপড়ের ঢাকনা সরাতে আমার চক্ষুস্থির। অতবড় ঝুড়িটা ফলে ঠাসা। বড় বড় আপেল, নাশপাতি, বেদানা, আঙুর, কলা, খেজুর, আরো কত কি। বাসি বা শুকনো নয়, লোভনীয় রকমের তাজা। একসঙ্গে বিরাট ঝুড়ি ভরতি এমন ভালো ভালো ফল নিয়ে বেরুতে আর কাউকে দেখি নি।

    ছেলে-মেয়েরা যে-যার খুশিমত ফল তুলে খেতে লাগল। এর মধ্যে বউটিকে কিছু বাছা ফল তুলে নিয়ে বেশ করে ধুয়ে দুটো ডিশে সাজাবার উদ্যোগ করতে দেখে আমি তাকে শুনিয়েই বললাম, ওঁকে বারণ করুন, অসময়ে আমি কিছু খাব না।

    ফলের আবার সময় অসময় কি! আপনি খাবেন, ওই ফলের ভাগ্যি! দাও গো, তুমি দাও!

    উঠে গিয়ে নিজেই ফলের ডিশ দুটো নিয়ে এলো। আমি সত্রাসে আবারও বাধা দিলাম, এত ফল কেউ খেতে পারে!

    -খুব পারে, গল্প করতে করতে খান, দেখবেন ফুরিয়ে গেছে, হেঁজিপেজি ফল। তো নয়! বলতে বলতে নিজে আড়াইশ গ্রামের একটা আপেল তুলে নিয়ে কামড় বসালো।

    অগত্যা ফলাহারে মন দিয়ে আমি বললাম, আপনার নামটি জানা হল না এখনো।

    –আমার নাম রামতারণ, রামতারণ ঘোষ। সাগ্রহে আমার দিকে ঝুঁকল একটু।–এককালে আমি দেড় মাসের জন্য পাবলিশার হয়েছিলাম, বুঝলেন, দেড় মাসে হাজার টাকা লোকসান! তার আগে কলেজ স্ট্রীটে জুতোর দোকান ছিল, সেই জুতোর দোকান। তুলে দিয়ে রাতারাতি পাবলিশার–টেকে কখনো!

    আমি হতভম্ব। জুতোর দোকান থেকে পাবলিশার!

    আপেল চিবুতে চিবুতে সলজ্জ জবাব দিল, আর বলেন কেন, কপালে ভোগান্তি থাকলে খাবে কে!… যাক সে কথা। আপনাদের মতো দু-একজন সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার খুব আলাপ করার ইচ্ছে ছিল অন্য কারণে।

    আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালাম। রামতারণ ঘোষ চট করে একবার ঘুরে খুপরির দিকে তাকালো। তার বউ বাইরের দিকে ফিরে বসে আছে। আরো ঘন হয়ে বসে একটু গলা খাটো করে সে বলল, আচ্ছা মশাই, আপনারা যে এত ঝুড়ি-ঝুড়ি প্রেমের গল্প লেখেন, এমন সব মেয়ের কথা লেখেন যা পড়ে রাতে ভালো ঘুম হতে চায় না–তার মধ্যে কোথাও সত্যি কিছু আছে, নাকি সব ফানুস?

    ভিতরে একটু নড়বড়ে অবস্থা আমার। জিজ্ঞেস করলাম, কেন বলুন তো? আপনি নিজে বুঝি কখনো প্রেমে পড়েছিলেন?

    সচকিত।–ঐ যাঃ, আপনি ঠিক ধষেছেন! কিন্তু আমার প্রেম তত আকাশে উঠে ফানুসের মত ফটাস করে ফেটে গেল, শুধু ফেটে গেল না, আগুন ধরে গেল। –কিন্তু আপনাদের প্রেমের গল্পে সে-রকম বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড তো একটাও ঘটতে দেখি না!

    প্রশ্ন চাপা দিয়ে তার ফানুস-ফাটা প্রেমের কাহিনী শোনার লোভ আমার। জবাব দিলাম, ও গল্পে অনেক ভেজাল অনেক জোড়াতাপ্লি থাকে.. আপত্তি না থাকলে আপনার ব্যাপারটা শুনতে ইচ্ছে করছে।

    বসন্ত-গুটির ছোপ-ধরা মুখে এবারে সত্যিকারের লজ্জার কারুকার্য দেখলাম। বলল, আমার প্রাণান্ত দশাই হয়েছিল, কিন্তু শুনলে আপনি ভয়ানক হাসবেন। ৬৫ ৪

    আমি মাথা নেড়ে আশ্বাস দিলাম, হাসব না। শেষে দেখা গেল আমার শোনার আগ্রহ থেকে তার বলার আগ্রহ কম নয়। রাত প্রায় সাড়ে-নটা পর্যন্ত দু-তিন দফায় সে আমাকে যে বাঘ কাহিনীটা শোনালো তার বহু শাখা-প্রশাখা পত্র-পল্লব বাদ দিলেও সেটা বর্ণশূন্য মনে হবে না বোধহয়। কিন্তু কাহিনীটি এমন যে সেটুকুওঁ হুবহু তার নিজের ভাষায় ব্যক্ত করলে বর্ণবৈচিত্র্য আরো বাড়বে বলেই বিশ্বাস।

    .

    বুঝলেন মশাই, আমি যাকে বলে আসল প্রেমে পড়েছিলাম সেই উনিশ বছর বয়সে। মল্লিকা দত্তর বয়েস তখন বছর ষোল। তার আগে একটা প্রেমভাব চলছিল। আমার বছর দুই-তিন ধরেমল্লিকা যখন স্কার্ট-ফ্রক পরে বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেত–তখন থেকে। ঠিক সেই সময় আমি আমাদের ভাঙাচোরা বাড়ির সামনের গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার ঠাকমার যখন শ্বাসকষ্ট উপস্থিত, আর বাড়ির লোকের সঙ্গে আমি হাপুস নয়নে কাঁদছি-তখনো ঘড়িতে ঠিক সাড়ে নটা বাজতে চোখ মুছতে মুছতে গলির মুখে ছুটে না এসে পারিনি। ও বেণী দুলিয়ে চলে যেতে ঘরে ফিরে এসে সকলের সঙ্গে মড়া-কান্না কেঁদেছিলাম।

    হঠাৎ একদিন দেখি ও ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। আর তখনি আমার মুণ্ডু ঘুরে গেল। ষোল-ছোঁয়া একটা কাঁচা সুর যেন ওর সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে। ওদের বাড়ি আমাদের গলির সামনের যে রাস্তাটা ঘুরে নাচের ঢঙে বেঁকে গেছে–সেই রাস্তার শেষের মাথায়। আমাদের গলির মুখ থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ। স্কুল যেদিন বন্ধ থাকত সেদিন কম করে বার পঞ্চাশেক আমি ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করতাম।

    মল্লিকাকে ভালবাসার পর থেকেই আমার জীবনে একটা ম্যাজিক হয়ে গেল। কুড়ি বছর বয়সে সেবারে আমি থার্ড ডিভিশনে স্কুল ফাইন্যাল পাস করে ফেললাম। তার আগে মশাই চার-চারবার ঘোল খেয়েছি, বুঝলেন–সেবারে পাস। অবশ্য মল্লিকা দত্তও সেবার স্কুল ফাইন্যাল দিচ্ছে জানতুম, তাই সেই প্রথম ভগবানের কাছে প্রার্থনা। করেছিলাম যেন পাস করি। সেই পাস করলাম, আমি থার্ড ডিভিশন, মল্লিকা সেকেণ্ড ডিভিশন।

    ভিতরে ভিতরে আমার একটা ভূমিকম্পের মত পরিবর্তন হয়ে গেল। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, এবার থেকে ভয়ঙ্কর রকমের ভালো ছেলে হব। বিছানায় চিৎপাত হয়ে কল্পনায় দেখতাম, মল্লিকাকে আমি পড়াচ্ছি, সাহায্য করছি–আর মল্লিকা আমার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে।

    কিন্তু বাদ সাধল আমার বাবা। হার্টের ব্যামো ধরিয়ে বসল। চিচি করে আমায় হুকুম করল, আর বিদ্যেয় কাজ নেই, ঢের হয়েছে–কাল থেকে গিয়ে দোকানে বোসো!

    ভাবুন একবার আমার অবস্থাখানা! কোথায় আকাশে সাঁতরানো প্রেম আর কোথায় কলেজ স্ট্রীটের ঘুপচির মধ্যে জুতোর দোকান! বিশ্বাস করুন, আত্মহত্যা করার জন্য কবার যে আমি বাড়ির ভাঙা কার্নিসের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক নেই।

    সেই জুতোর দোকান নিয়েই পড়তে হল। সকালে বেরোই, রাতে ফিরি। চার মাসের মধ্যে কতগুলো অঘটন ঘটল। প্রথম, মল্লিকার বাবা বাড়ি বদল করল। আমার মাথায় পর-পর দুবার আকাশ ভাঙল। সর্বরক্ষা, আমার তিনটে দিদির বিয়ে বাবা আগেই দিয়ে গেছল। আমি তখন মায়ের সবেধন নীলমণি।

    এরও মাস আষ্টেক বাদে আমার হৃৎপিণ্ডটা বেদম জোরে লাফিয়ে উঠল একদিন। মল্লিকা আমার দোকানে এক দুপুরে জুতো কিনতে এলো। আমার বুকের মধ্যে তখন এই ট্রেন ঝকানির মত ঝকানি, বুঝলেন! হ্যাঁ, নিজের হাতে জুতো পরালাম তাকে–কত জোড়া যে পরালাম ঠিক নেই। যত অপছন্দ ততো খুশি আমি, বার বার ওই সুন্দর দুটো পায়ে হাত ছোঁয়াতে পারছি। আপনাদের কোনো গল্পের কোনো প্রেমিক এভাবে নায়িকার পায়ে হাত দিয়েছে কোনোদিন?

    জুতো পছন্দ করিয়ে শেষে কেউ শুনতে না পায় এমন করে জিজ্ঞাসা করলাম, চিনতে পারলেন? জবাবে সে হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে রইল। আমি তখন নিজের। বাড়ির ঠিকানা বললাম, ও কোন বাড়িতে থাকত বললাম, ওর নাম বললাম, ওর বাবার নাম বললাম। গলির মুখে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেমন মিটিমিটি হাসত, তেমনি হাসতে লাগল মল্লিকা। আমি ধরে নিলাম চিনতে পেরেছে, এবং আগে পারেনি। বলেই লজ্জা পাচ্ছে। যে দামে সে জুতো নিয়ে চলে গেল, দেখে দোকানের কর্মচারীরা। হাঁ। আমার পর পর তিন রাত ঘুম হল না।

    এর পরের দেখা ওই কলেজ স্ট্রীটে, আড়াই বছর বাদে। আমার মা তখন স্বর্গে গেছে। আর আমি একটা বড় দাওয়ে নড়বড়ে জুতোর দোকান বেচে দেবার মওকা খুঁজছি। বেচতে পারলে কি করব তখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি। পাশের বইয়ের দোকানের ছোকরা মালিকটির সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। হঠাৎ আমার সর্বাঙ্গে ঝাঁকুনি। দেখি বইপত্র বুকে চেপে মল্লিকা দত্ত বইয়ের দোকানগুলো দেখতে দেখতে চলেছে। আমার আলাপী ছোকরাটি তাকে দেখিয়ে যে টিপ্পনী কাটল শুনে আমার ভেতরটা কি-রকম যেন হয়ে গেল। বইয়ের দোকানের ছোকরা হেসে হেসে যা জানালো তার সারমর্ম, ওই মেয়েটির নাম মল্লিকা দত্ত, এম. এ. পড়ে। নানা কাগজে তার কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে। এখন কবিতার বই ছাপার বাই চেপেছে মাথায়। সেই সব ছাপা কবিতা আর বাঁধানো একখানা কবিতা ভরতি খাতা নিয়ে সমস্ত পাবলিশারের দোরে দোরে ঘোরে। তার দোকানেও নাকি দুদিন এসে কবিতার বই ছাপার জন্য ঝকাঝকি করে গেছে।

    ভিতরে আমার তখন কি-যে হচ্ছিল আমিই জানি। মল্লিকাকে তখনো দেখা যাচ্ছিল। আমার দু চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল আর সেই সঙ্গে আধা-গোচর একটা সংকল্পে বুকের ধুকপুকুনি বাড়ছিল। এর ঠিক চার দিনের মধ্যে দাঁওয়ের অনেক কম টাকায় জুতোর দোকান বেচে দিলাম। দেনাপত্র চুকিয়ে হাতে পেয়েছিলাম মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার। কলেজ স্ট্রীটে তখন জলের দরে ঘর পাওয়া শক্ত নয়। চল্লিশ টাকায় সেদিনই একটা খুপরিঘর ভাড়া নিলাম। আর তার সাত দিনের মধ্যে আমার কাঠের র‍্যাক, কাঁচের র‍্যাক, সামনের কাউন্টার, ঝকঝকে সাইন বোর্ড রেডি। আমি তখন কল্প-ভারতী

    বুক-সেলার অ্যান্ড পাবলিশারের একমাত্র মালিক। দোকানের সামান্য আসবাবপত্রের জন্য আমার সেদিনে খরচ পড়েছিল চারশ নব্বই টাকা, বাজার থেকে চালু বই কমিশনে দোকান সাজাতে আরো খরচা হয়েছিল ছশ চল্লিশ টাকা। তাছাড়া পাখা লাইট ইলেকট্রিক ইত্যাদির দরুন আরো বেরিয়ে গেছল ধরুন একশ পঁচিশ টাকা। তখন পর্যন্ত মোট খরচ দাঁড়ালো গিয়ে তাহলে বারো শ পঁচানব্বই টাকা। কিন্তু আমার উদ্দীপনা তখন এত প্রবল যে অচিরে আমি বাংলা দেশের সব থেকে বড় পাবলিশার হয়ে বসবই তাতে একটুও সন্দেহ নেই।

    কুড়ি টাকা মাইনের সদ্য নিযুক্ত ছোকরা চাকরটার হাতে দোকান ছেড়ে দিয়ে আমি গেলাম য়ুনিভার্সিটির দোরে ধরনা দিতে। প্রথম দিন দেখা হল না, দ্বিতীয় দিনে বেলা বারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে পায়ের সূতো যখন ছেড়ে ঘেঁড়ে, তখন দেখা। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম। হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, চিনতে পারছেন? বলা বাহুল্য, চিনতে পারল না। আড়াই বছর আগের জুতোর দোকানের সাক্ষাৎ ভুলে। মেরে দিয়েছে দেখে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। সেই গলির বাড়ির কথা আর ওদের পুরনো বাড়ির কথা বললাম। তখনো নিস্পৃহ। তার পরেই যে কথা বললাম, তার প্রতিক্রিয়া দেখে নিজেই আমি মুগ্ধ। বললাম, অনেক কাগজে আপনার কবিতা পড়ি, আর সেই থেকে অনেক সময় ভেবেছি একবার দেখা হলে ভালো হত, নতুন পাবলিশার তো আমি… সেই থোড়-বড়ি-খাড়া ছেড়ে নতুন কিছু করতে চাই। তা আসুন না একদিন আমার দোকানে, এই কাছেই…।

    মল্লিকার সমস্ত মুখখানা উত্তেজনায় রাঙিয়ে উঠল। বিশ্বাস করবে কি করবে না ভেবে পাচ্ছে না। এবারে আমাকে চিনতে পেরেছে মনে হল। বলল, আজ গেলে হয় না, কবিতাগুলো আমার সঙ্গেই ছিল…।

    পরম সমাদরে আমি তক্ষুনি তাকে দোকানে নিয়ে এলাম। চপ-কাটলেট আনালাম। তারপর কাব্য-জগতে নেমে কখন যে রাত হয়ে গেল, দুজনার কারোই হুঁশ নেই। এরপর টানা একটা মাস স্বপ্নের ঘোরে কেটে গেল আমার। আমি মল্লিকার বাড়ি যাই, মল্লিকা দোকানে আসে রোজ। তার কবিতার রাশি আমার হেপাজতে তার অনেকগুলো কবিতা আমার মুখস্থ হয়ে গেল। কেউ যদি তখন বলত রবি ঠাকুর ওর থেকে ভালো কবিতা লিখেছে, আমার সহ্য হত কি না সন্দেহ। রোজ আমরা প্ল্যান করি কিভাবে ছাপা হবে, কত অভিনব সজ্জা-বিন্যাস সম্ভব। কবিতার বইয়ের দরাজ অঙ্কের রয়েলটি আমি আগাম দিয়ে ফেললাম লেখিকাকে। দুনিয়ার পরম প্রীতিবদ্ধ যেন শুধু আমরা দুটি প্রাণী। এই রোমাঞ্চ ভোলবার নয়।

    একটা তরতাজা গাছকে আচমকা বাজ পড়ে ঝলসে যেতে দেখেছেন? দেখেননি? কল্পনা করুন। বিনা মেঘে বজ্রাঘাতে একেবারে জ্বলে পুড়ে ঝলসে গেলাম আমি। পর-পর দুদিন মল্লিকার দেখা পেলাম না, তৃতীয় দিনে যখন তার বাড়ি যাব ভাবছি, ডাকে একটা বিয়ের নেমন্তন্নের চিঠি পেলাম। মল্লিকার বিয়ে। আমি জ্বলে জ্বলে পুড়ে পুড়ে কবরের তলার মানুষের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেলাম।

    তিন দিনের মধ্যে আবার সব বেচেটেচে দিয়ে আমি মোটমাট হাজার খানেক টাকা লোকসান খেলাম। মল্লিকার কবিতার খাতাপত্র রেজিস্ট্রি করে তার বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।

    .

    এই পর্যন্ত বলে রামতারণ ঘোষ উঠে তার খুপরিতে ঢুকে ঝুড়ি থেকে দুটো আপেল তুলে নিয়ে আবার এসে বসল। একটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, গলা শুকিয়ে গেছে, খান।

    আমি ব্যস্ত হয়ে মাথা নাড়লাম–এত রাতে আর না। আর একবার অনুরোধ। করে সে নিজের আপেলে কামড় বসালো। আমার ধারণা তার গল্প বলা শেষ হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, এখন আপনি কি করছেন?

    -ফলের স্টল। ট্রাম-রাস্তার ধারে চার মাথার ওপর দোকান… বেশ ভালই চলছে। হঠাৎ বন্ধ করে চলে এসেছি, কয়েকটা দিন লোকসান খেতে হবে।… বসন্তে যাই-যাই অবস্থা হয়েছিল যখন, আমার স্ত্রী বাবা বিশ্বনাথের কাছে মানত করে বসেছিল তো! সেও আট বছর হয়ে গেল, কত আর দেরি করব–বেরিয়ে পড়লাম।… তারপর গল্পটা শুনুন–

    আমি নড়ে চড়ে সোজা হয়ে বসলাম।

    –সময়ে বিয়ে করলাম বটে, কিন্তু মল্লিকার স্মৃতি আমার মধ্যে ছড়িয়ে থাকল। কোথায় মল্লিকা আর কোথায় এই বউ! মোট কথা দুটো ছেলেপুলে হবার পরেও বউকে আমি ভালো চোখে দেখতাম না। বউকে এক-এক সময় মল্লিকা ভাবতে চেষ্টা করে আরো খারাপ লাগত।

    …বছর আটেক আগের কথা। বসন্ত রোগে একেবারে যমের মুখ থেকে ফিরে এলাম। ছমাস বাদে আবার ফলের স্টলের দরজা খুলেছি। হাতে তখন একটা পয়সা। নেই, আমার চালু দোকান অনেকে জানে বলেই গলাকাটা সুদে ধার দিয়েছে। আগের মতো ফলের স্টক বাড়াতে হলে মূলধন তো চাই।

    একদিন বসে আছি, টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ প্রচণ্ড একটা নাড়াচাড়া খেয়ে আমি দাঁড়িয়ে উঠলাম। আমার স্টলে মল্লিকা ফল কিনতে এসেছে। সঙ্গে একটি লোক, বোধ হয় দেওর-টেওর হবে। মাঝে চোদ্দ-পনের বছর কেটে গেছে, তবু তাকে দেখা মাত্র চিনলাম। সেই মল্লিকা নয়, তবু সেই মল্লিকাই যেন। কিন্তু মল্লিকা আমার মুখের দিকে তাকায়নি, সাগ্রহে আপেল দেখছে। একেবারে অসময়ের আপেল, একমাত্র আমার স্টলে ছাড়া এ তল্লাটে আর কারো কাছে নেই। নিতান্ত অসুখ-বিসুখের দায়ে না পড়লে ও-সময়ে কেউ আপেল কেনে না। মুখ দেখে মনে হল, মল্লিকাও সেই গোছের দায়েই পড়েছে। আপেল পছন্দ হতে মল্লিকা আমার দিকে তাকালো। চোদ্দ-পনের বছর বাদে চার চোখের মিলন। চিনতে পারা দূরে থাক, আমার বসন্তের দাগে-ছাওয়া মুখ দেখে কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণার ভাব।

    – কত করে?

    সম্ভব হলে বা আগের দিন হলে আমি হয়ত বিনে পয়সায় জোর করে আপেল গছিয়ে দিতুম। আহা, সেই মল্লিকার কোনো ছেলে হয়ত অসুখে ভুগছে। কিন্তু আমারও তো সেই অবস্থা। অসময়ের আপেল, আট টাকা করে কেনা আমার, দশ টাকায় বেচি। তবু কেনা দামই বললাম।-আট টাকা কিলো।

    সঙ্গে সঙ্গে মল্লিকার মুখে প্রচণ্ড বিরক্তি।-কম হবে না?

    বুঝুন আমার অবস্থা। আমি জবাব দিতে পারলাম না। শুধু মাথা নেড়ে অক্ষম জানালাম। রাগে গজগজ করতে করতে মল্লিকা চার টাকা দিয়ে পাঁচশ আপেল কিনল। তার আগে তিনবার করে ওজন দেখল। আপেল নিয়ে দাম দেবার সময়ে তার আঙুলে আমার আঙুল ঠেকল। তখনো কেমন বিহূল অবস্থা আমার। ফলের ঠোঙা নিয়ে তারা এগলো। নিজের অগোচরে তাদের পিছনে আমিও তিন-চার পা এগিয়েছি। তারপরেই কাঠ আমি। মল্লিকার ঝাঝালো গলা, পাশের লোককে বলছে, পাঁচশ আপেল চার টাকা, এই সব গলা-কাটা লোকগুলোকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে চাবকে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া দরকার।

    আমি নির্বাক। একটু চুপ করে থেকে রামতারণ ঘোষ বলল, আট বছর আগে সেই বিয়াল্লিশ বছর বয়সে মল্লিকা-জ্বর ছাড়ল আমার।… আর তার পর থেকে নিজের স্ত্রটিকেই অন্যরকম লাগতে শুরু করল। বসন্তের দাগে-ভরা চোখে-মুখে সলজ্জ হাসি। –নিজের এই পরিবারটিকেই বেশ লাগে মশাই এখন… বুঝলেন!

    বলতে বলতে জানলার ধারে ও-দিক ফেরা বউয়ের দিকে তাকালো সে।

    আমার মনে হল এমন সপ্রেম দৃষ্টি আর বুঝি দেখিনি।

    ফল

    ভিতরের সাধনা যখন আরম্ভ হয়ে গেছে তখন বাইরে তার কতকগুলি লক্ষণ আপনি প্রকাশ হয়ে পড়তে থাকে; সে লক্ষণগুলি কী-রকম তা একটি উপমার সাহায্যে ব্যক্ত করতে চেষ্টা করি।

    গাছের ফলকে মানুষ বারবার নিজের সার্থকতার সঙ্গে তুলনা করে এসেছে। বস্তুত, মানুষের লক্ষ্যসিদ্ধি মানুষের চেষ্টার পরিণামের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে এমন জিনিস যদি জগতে কোথাও থাকে তবে সে গাছের ফলে। নিজের কর্মের রূপটিকে নিজের জীবনের পরিণামকে যেন ফলের মধ্যে আমরা চক্ষে প্রত্যক্ষ দেখতে পাই।

    ফল জিনিসটা সমগ্র গাছের শেষ লক্ষ্য–পরিণত মানুষটি তেমনি সমস্ত সংসারবৃক্ষের শেষলাভ।

    কিন্তু মানুষের পরিণতি যে আরম্ভ হয়েছে তার লক্ষণ কী? একটি আমফল যে পাকছে তারই বা লক্ষণ কী?

    সব প্রথমে দেখা যায়, তার বাইরে একটা প্রান্তে একটু রঙ ধরতে আরম্ভ করেছে,তার শ্যামবর্ণ ঘুচবে ঘুচবে করছে–সোনা হয়ে ওঠবার চেষ্টা।

    আমাদেরও ভিতরে যখন পরিণতি আরম্ভ হয় বাইরে তার দীপ্তি দেখা যায়। কিন্তু সব জায়গায় সমান নয়, কোথাও কালো কোথাও সোনা। তার সকল কাজ সকল ভাব সমান উজ্জ্বলতা পায় না, কিন্তু এখানে-ওখানে যেন জ্যোতি দেখা দিতে থাকে।

    নিজের পাতারই সঙ্গে ফলের যে বর্ণসাদৃশ্য ছিল সেটা ক্রমশ ঘুচে আসতে থাকে, চারিদিকে আকাশের আলোর যে রঙ সেই রঙের সঙ্গেই তার মিলন হয়ে আসে। যে গাছে তার জন্ম সেই গাছের সঙ্গে নিজের রঙের পার্থক্য সে আর কিছুতেই সংবরণ করতে পারে না–চারিদিকের নিবিড় শ্যামলতার আচ্ছাদন থেকে সে বাহিরের আকাশে প্রকাশ পেয়ে উঠতে থাকে।

    তার পরে তার বাহিরটি ক্রমশই কোমল হয়ে আসে। আগে বড়ো শক্ত আঁট ছিল কিন্তু এখন আর সে কঠোরতা নেই। দীপ্তিময় সুগন্ধময় কোমলতা।

    পূর্বে তার যে-রস ছিল সে-রসে তীব্র অম্লতা ছিল, এখন সমস্ত মাধুর্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এখন তার বাইরের পদার্থ সমস্ত বাইরেরই হয়,সকলেরই ভোগের হয়, সকলকে আহ্বান করে, কাউকে ঠেকাতে চায় না। সকলের কাছে সে কোমল সুন্দর হয়ে ওঠে। গভীরতর সার্থকতার অভাবেই মানুষের তীব্রতা কঠিনতা এমন উগ্রভাবে প্রকাশ পায়–সেই আনন্দের দৈন্যেই তার দৈন্য, সেইজন্যেই সে বাহিরকে আঘাত করতে উদ্যত হয়।

    তার পরে তার ভিতরকার যেটি আসল জিনিস, তার আঁটি–যেটিকে বাহিরে দেখাই যায় না, তার সঙ্গে তার বাহিরের অংশের একটা বিশ্লিষ্টতা ঘটতে থাকে। সেটা যে তার নিত্যপদার্থ

    নয় তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে আসে। তার শস্য অংশের সঙ্গে তার ছালটা পৃথক হতে থাকে, ছাল অনায়াসে শাঁস থেকে ছাড়িয়ে ফেলা নেওয়া যায়, আবার তার শাঁসও আঁটি থেকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে ফেলা সহজ হয়। তার বোঁটা এতদিন গাছকে আঁকড়ে ছিল, তাও আলগা হয়ে আসে। গাছের সঙ্গে নিজেকে সে আর অত্যন্ত এক করে রাখে না–নিজের বাহিরের আচ্ছাদনের সঙ্গেও নিজের ভিতরের আঁটিকে সে নিতান্ত একাকার করে থাকে না।

    সাধক তেমনি যখন নিজের ভিতরে নিজের অমরত্বকে লাভ করতে থাকেন, সেখানটি যখন সুদৃঢ় সুসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন তাঁর বাইরের পদার্থটি ক্রমশই শিখিল হয়ে আসতে থাকে– তখন তাঁর লাভটা হয় ভিতরে, আর দানটা হয় বাহিরে।

    তখন তাঁর ভয় নেই, কেননা তখন তাঁর বাইরের ক্ষতিতে তাঁর ভিতরের ক্ষতি হয় না। তখন শাঁসকে আঁটি আঁকড়ে থাকে না; শাঁস কাটা পড়লে অনাবৃত আঁটির মৃত্যুদশা ঘটে না। তখন পাখিতে যদি ঠোকরায় ক্ষতি নেই, ঝড়ে যদি আঘাত করে বিপদ নেই, গাছ যদি শুকিয়ে যায় তাতেও মৃত্যু নেই। কারণ, ফল তখন আপন অমরত্বকে আপন অন্তরের মধ্যে নিশ্চিতরূপে উপলব্ধি করে, তখন সে “অতিমৃত্যুমেতি”। তখন সে আপনাকে আপনার নিত্যতার মধ্যেই সত্য বলে জানে, অনিত্যতার মধ্যেই নিজেকে সে নিজে বলে জানে না–নিজেকে সে শাঁস বলে জানে না, খোসা বলে জানে না, বোঁটা বলে জানে না–সুতরাং ওই শাঁস খোসা বোঁটার জন্যে তার আর কোনো ভয় ভাবনাই নেই।

    এই অমৃতকে নিজের মধ্যে বিশেষরূপে লাভ করার অপেক্ষা আছে। সেইজন্যই উপনিষৎ বারংবার বলেছেন, অমরতাকে লাভ করার একটি বিশেষ অবস্থা আছে–“য এতদ্‌বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি।”

    ভিতরে যখন সেই অমৃতের সঞ্চার হয় তখন অমরাত্মা বাইরেকে আর একান্তরূপে ভোগ করতে চায় না। তখন, তার যা গন্ধ, যা বর্ণ, যা রস, যা আচ্ছাদন তাতে তার নিজের কোনো প্রয়োজন নেই–সে এ-সমস্তের মধ্যেই নিহিত থেকে একান্ত নির্লিপ্ত, এর ভালোমন্দ তার ভালোমন্দ আর নয়, এর থেকে সে কিছুই প্রার্থনা করে না।

    তখন ভিতরে সে লাভ করে, বাইরে সে দান করে; ভিতরে তার দৃঢ়তা, বাইরে তার কোমলতা; ভিতরে সে নিত্যসত্যের, বাইরে সে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের; ভিতরে সে পুরুষ, বাইরে সে প্রকৃতি। তখন বাইরে তার প্রয়োজন থাকে না বলেই পূর্ণভাবে বাইরের প্রয়োজন সাধন করতে থাকে, তখন সে ফলভোগী পাখির ধর্ম ত্যাগ করে ফলদর্শী পাখির ধর্ম গ্রহণ করে। তখন সে আপনাতে আপনি সমাপ্ত হয়ে নির্ভয়ে নিঃসংকোচে সকলের জন্যে আপনাকে সমর্পণ করতে পারে। তখন তার যা-কিছু, সমস্তই তার প্রয়োজনের অতীত, সুতরাং সমস্তই তার ঐশ্বর্য।

    ২০ ফাল্গুন, ১৩১৫

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশব্দতত্ত্ব – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    Next Article শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    Related Articles

    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    ফেলুদা এণ্ড কোং – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }