খাঁচায় মানুষ কেন
ডোমনিথর্পি থেকে হোমস ফিরে আসার আগেই লন্ডন অঞ্চলে সাতটা চোঙা অবতীর্ণ হয়েছিল, খুব সম্ভব বেস্পতিবার মধ্যরাত্রে পৌঁছেছে অষ্টম সিলিন্ডার— আগের সাতটার কাছাকাছি তো বটেই। তার মানে আর বাকি রইল মাত্র দুটো। মোট দশটি চোঙার পঞ্চাশজন মঙ্গলগ্রহী একত্র হয়ে অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করবার পর কী কাণ্ড শুরু হবে পৃথিবীর বুকে, ভাবতেই গা শিরশির করে উঠল শার্লক হোমসের মতো শক্ত ধাতের মানুষেরও। নীল বিদ্যুতের উত্তাপ আর কালো ধোঁয়ার ধ্বংসলীলা তো এর মধ্যেই সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে পৃথিবীর বুকে। এর পরেও যদি নয়া হাতিয়ারের আবির্ভাব ঘটে, তাহলে আর রক্ষা নেই।
রেহাই পাওয়া যাবে যদি আততায়ীদের অস্ত্রের আর খাদ্যের ভাণ্ডার শূন্য হয়— মঙ্গলগ্রহের ঘাঁটি থেকে সরবরাহ না এসে পৌঁছায়।
কিন্তু সে সম্ভাবনা আছে কী? এই হামলার কারণটা যদি সঠিকভাবে জানা যেত, ওদের উদ্দেশ্যটা যদি আঁচ করা যেত— তাহলে সব প্রশ্নেরই সদুত্তর পাওয়া যেত। দুপুর নাগাদ আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠল হপকিন্স। শরীর ঝরঝরে। মাথাও সুস্থ। সমুদ্রতীরে যা কিছু দেখে এসেছে, তার আরও নিখুঁত বর্ণনাও দিতে পারছে।
বললে, ‘মিস্টার হোমস, ওরা কিন্তু কালো ধোঁয়া দিয়ে ইচ্ছে করলেই সবাইকেই মারতে পারত। মারল না। শুধু যারা ওদের ক্ষতি করেছে, তাদের শেষ করে দিয়েছে। বাকি সবাইকে—’
বলেই থেমে গেল হপকিন্স। চোখের তারায় ফুটে উঠল কুহেলি।
হোমস বললে, ‘থামলে কেন?’
‘মিস্টার হোমস, বাকি সবাই তাড়া খেয়ে যখন এক জায়গায় জড়ো হয়ে বলির পাঁঠার মতো কাঁপছে, তখন তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজনকে শুঁড়ে করে ধরে খাঁচায় পুরে রাখল।’
‘খাঁচায়!’
‘হ্যাঁ। চলন্ত বয়লারদের পিঠে বিরাট খাঁচার মধ্যে জ্যান্ত মানুষ অনেক দেখেছি। এই দেখেই সাইকেল চালিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। মিস্টার হোমস, ওরা মানুষ খাঁচায় রাখছে কেন?’
গুম হয়ে রইল হোমস। তারপর বললে, ‘খাবার জন্যে নয় তো?’
‘খাবার জন্যে। মানুষ কি খাবার?’
‘মানুষের কাছে ইতর প্রাণীরা যেমন খাদ্য, ওদের কাছে মানুষের মতো ইতর প্রাণীরাও— তেমনি খাদ্য হতে পারে তো!’
‘আমরা কি জন্তু!’ হপকিন্স যেন বিলক্ষণ অপমানিত।
‘শাকসবজি অথবা ইটপাথরও তো নই— জ্যান্ত জীব। সুতরাং…’ বাকিটা আর মুখ ফুটে বলল না হোমস।
রাতের অন্ধকারে শুকনো রুটি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পায়নি হোমস, কিন্তু এখন দিনের আলোয় জ্যাম জেলি বিস্কুট পেল এন্তার। মিসেস হাডসন সব গুছিয়ে রেখে গেছে শার্লক হোমসের ফিরে আসার কথা ভেবে।
সুতরাং খাওয়াটা মন্দ হল না। হালকা মদও পাওয়া গেল খাবার আলমারিতে। মনটা তরতাজা করে দুজনে বেরুল রাস্তায়। প্রথমে অবশ্য জানলা দিয়ে মুন্ডু গলিয়ে দেখে নিল রাস্তায় একশো ফুট লম্বা তালঢ্যাঙা মেটাল দানবরা ঘুরছে কি না। রাস্তার দু-পাশ খাঁ-খাঁ করছে দেখে পেরুল চৌকাঠ। নিস্তব্ধ পথ পেরিয়ে হাইড পার্কের মধ্যে দিয়ে গেল ফেনসিংটন গার্ডেনে। একটা লম্বা গাছের মগডাল পর্যন্ত উঠল হপকিন্স। নেমে এসে বললে, মাইল কয়েক দূরে প্রিমরোজ হিলে তিনটে যন্ত্রদানবকে দেখা যাচ্ছে।
আবার শুরু হল পথ পরিক্রমা। কিছু দূরে একটা নালার পাড়ে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেল হোমস। অপলকে চেয়ে রইল নালার পানে।
হপকিন্স দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল, অদ্ভুত লাল ফুলে ছেয়ে গেছে নালার জল। অনেকটা কচুরিপানার মতো গড়ন। কিন্তু রঙটা এই সবুজ পৃথিবীর পাতার মতো নয়— লাল।
বিড়বিড় করে বললে হোমস, ‘রক্তরাঙা গ্রহের ফুল মনে হচ্ছে।’
সভয়ে অদ্ভুত দর্শন ফুলগুলোর পানে চেয়ে থেকে হপকিন্সও বললে যন্ত্রচালিতের মতো, ‘তা-ই তো মনে হচ্ছে। লন্ডন শহর চষে ফেলেছি মিস্টার হোমস। এরকম বিকট ফুল তো কোথাও দেখিনি। তা ছাড়া রংটা…’
‘হ্যাঁ, লাল গ্রহ মঙ্গলের রংই বটে। হপকিন্স, মঙ্গলের প্রাণীরা নিজেদের গ্রহের ফুল ফল দিয়ে নতুন বাড়ি সাজাতে আরম্ভ করে দিয়েছে এরই মধ্যে।’
‘যেমন আমরা নতুন বাড়ি সাজাই।’
‘হ্যাঁ। কিন্তু…’ হেঁট হল হোমস। লাল ফুলের কাছে চোখ নিয়ে গিয়ে বললে, ‘কিছু পাতা বাদামি হয়ে এসেছে। ঝরে যাচ্ছে। প্রাণের চিহ্ন মুছে যাচ্ছে— এর মধ্যে! কেন, হপকিন্স, কেন?’
বলতে বলতে লম্বা হাত বাড়িয়ে পটাং করে একটা বিবর্ণ পাতা ছিঁড়ে এনে চোখের সামনে মেলে ধরল হোমস। তারপর পকেট থেকে আতস কাচ বার করে খুঁটিয়ে দেখল পাতার শিরা-উপশিরা। শেষকালে আতস কাচ পকেটস্থ করে বললে চাপা উত্তেজনায়, ‘হপকিন্স আমার অনুমানই ঠিক। পাতাটার মৃত্যু হচ্ছে।’
অবাক হয়ে হপকিন্স বললে, ‘কিন্তু এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন, মিস্টার হোমস? জন্মালে সবাই মরে—’
‘বাঃ, গীতার বাণী মুখস্ত করে ফেলেছ দেখছি। অমর কেউ নয়— ঠিক কথা। জন্মালে মরতেই হবে। কিন্তু হপকিন্স, এত তাড়াতাড়ি কেন? এই তো সেদিন মঙ্গলের প্রাণীরা নেমেছে পৃথিবীতে, সে গ্রহে যে গাছপালা আছে তাদের বীজও ছড়িয়েছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তাদের মৃত্যুর কারণটা কি কল্পনাও করতে পারছ না?’
ঢোঁক গিলে হপকিন্স বললে, ‘আজ্ঞে না।’
‘ইডিয়ট,’ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে হোমস, ‘দুই গ্রহের জল হাওয়া দু-রকম। ওখানে যা বাঁচে, এখানে তা মরে। ওখানকার পরিবেশ যাদের কাছে স্বাস্থ্যকর, এখানকার পরিবেশ তাদের কাছে অস্বাস্থ্যকর। হে হাঁদারাম হপকিন্স, এই কারণেই ওখানকার ফুল এখানে পটল তুলছে। কে জানে, কে জানে…’ প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে নিরুদ্ধনিশ্বাসে বললে হোমস, ‘কে জানে মৃত্যুর সমাপ্তি এবার অজেয় মঙ্গলগ্রহীদের কুপোকাত করবে কি না!’
চোয়াল ঝুলে পড়ল হপকিন্সের। সত্যি সত্যিই ঝুলতে লাগল বুকের ওপর। হাঁ হয়ে গেল মুখটা। চিরটা কাল এমনিভাবে চোখ খোলা রেখে অনেক জটিল রহস্যের সহজ সমাধান দেখিয়ে পুলিশ এবং জনসাধারণের মুণ্ড ঘুরিয়ে দিয়েছে শার্লক হোমস। এবারও, ভিনগ্রহী দস্যুদের করাল আক্রমণেরও সমাপ্তি সূচনা কি ধ্বনিত হল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অপরাধ-বিজ্ঞানীর কণ্ঠে?
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল হপকিন্স। চোয়ালটা অবশ্য ঝুলতে লাগল আগের মতোই।
হোমস ততক্ষণে একটা পরিত্যক্ত দোকানে ঢুকে নোট বইয়ের পাতায় পাতায়, খসখস করে কী যেন লিখে চলেছে আপন মনে। একপৃষ্ঠা… দু-পৃষ্ঠা তিন পৃষ্ঠা। লেখা শেষ। পাতা ছিঁড়ে ভাঁজ করে হপকিন্সকে ডাকল হোমস।
বললে, ‘হপকিন্স, একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তোমাকে দিচ্ছি। এই কাগজ ক-খানার মধ্যে যা লিখে দিলাম তা অতিশয় সামরিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলে জানবে। মিলিটারি দপ্তর এই কাগজের লেখা তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলগ্রহীদের বিরুদ্ধে রণনীতি নির্ধারণ করতে পারেন। মঙ্গলগ্রহীরা কী খায়, এখনও সঠিক জানা যায়নি। মানুষ খায় কি না, সেটা পরে প্রমাণিত হবে-খন। আপাতত তোমার খাদ্যের দরকার। এই দোকানে প্রচুর বিস্কুট আর টিনে খাবার আছে। পকেট ভরতি করে নিয়ে রওনা হও বার্মিংহামের দিকে।’
টপ করে চোয়াল বন্ধ করে হপকিন্স। বললে, কাতর কণ্ঠে, ‘বার্মিংহাম!’
‘অত আঁতকে ওঠার কী আছে?’
‘একশো মাইলেরও বেশি পথ— হেঁটে যাব?’
‘লন্ডনের বাইরে একবার গিয়ে পড়লে পথেঘাটে ঘোড়া কি অন্য যানবাহন পেয়ে যাবে। সে ভাবনা তোমার। কিন্তু বার্মিংহাম তোমাকে যেতেই হবে— এই চিরকুট নিয়ে।’
‘আর আপনি? এই ভয়ংকরদের মধ্যে থাকবেন?’
‘হপকিন্স, থাকতে আমাকে হবেই। এদের মধ্যে থেকে এদেরই ত্রুটি অন্বেষণ করতে হবে— প্রাণ হাতে নিয়ে সেই কাজই করে যাব দেশের স্বার্থে— পৃথিবীর স্বার্থে।’
এরপর তার কথা বলা চলে না। হপকিন্স প্যান্টের আর কোর্টের পকেটে বেশ কিছু টিনের খাবার ঠেসে নিয়ে শুকনো মুখে রওনা হল বার্মিংহাম অভিমুখে।
শার্লক হোমস বেরোল রোদে। জনহীন লন্ডন শহরের পথেঘাটে অতি সন্তর্পণে চোরের মতো ঘুরতে লাগল নতুন সূত্রের আশায়।
একটা সূত্র অবশ্য পাওয়া গেছে। মোক্ষম সূত্র।
লাল ফুলেদের মৃত্যু। পৃথিবীর হাওয়ায় তাদের জন্মেই মরণের কোলে ঢলে পড়া। মঙ্গলের প্রাণ যখন পৃথিবীতে এসে নিষ্প্রাণ হয়ে যায় তখন…
আচমকা সজাগ হল শার্লক হোমস। রাস্তার মোড়ে দেখা গেল একটি নরদেহ। হাতে উন্মুক্ত কৃপাণ। টলতে টলতে আসছে এইদিকেই।
সাঁৎ করে পাশের মনোহারী দোকানে ঢুকে পড়ল হোমস। বিরাট দোকান। কাচের শো-কেসের পর শো-কেস। থরে থরে সাজানো টিনের খাবার, প্রসাধন দ্রব্য এবং বিবিধ সামগ্রী।
ফুটপাথ থেকে পায়ে পায়ে পিছু হটে এসে এই দোকানের ভেতরেই এসে দাঁড়াল হোমস।
কিন্তু উৎকর্ণ কর্ণরন্ধ্রে ভেসে এল দ্রুত ধাবমান পদশব্দ। কৃপাণ হাতে টলায়মান পুরুষটি ছুটে আসছে এইদিকেই। মুহূর্তের মধ্যে খোলা দরজার সামনে আবির্ভূত হল সে। কৃপাণ উঁচিয়ে বললে শ্লেষ্মা জড়িত ঘড়ঘড়ে গলায়, ‘শার্লক হোমস। এবার তোমাকে একা পেয়েছি…’
আরও কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে সকৌতুকে বললে শার্লক হোমস, ‘মর্স হাডসন যে। আমি তো ভেবেছিলাম আমি একাই বুঝি রইলাম পড়ে পুরোনো এই শহরে। বড্ড একা লাগছিল। বাঁচলাম তোমাকে পেয়ে।’
‘বাঁচাচ্ছি, শয়তান কোথাকার।’ চৌকাঠ পেরিয়ে আরও দু-পা ভেতরে অগ্রসর হল হাডসন, ‘মার্থা হাডসন কোথায়?’
দু-পা পিছিয়ে গিয়ে একটা টুলের পাশে দাঁড়িয়ে হোমস বললে, ‘মার্থা? মানে, মিসেস হাডসন? আমার ল্যান্ডলেডি?’
‘হ্যাঁ রে রাসকেল! আমার বিয়ে করা বউ। কোথায় সে?’
‘ব্রাদার হাডসন, ছ-জন নেপোলিয়নের মূর্তি নিয়ে যে কেলোর কীর্তি হয়েছিল, তোমার শ্রীঘর অনিবার্য ছিল সেই কেসে। এখনও দেখছি তোমার আক্কেল হয়নি। রাসকেল বলাটা কি ঠিক হচ্ছে?’
‘শয়তান! বল কোথায় রেখেছিস মার্থাকে? কাল থেকে দেখছি তোকে— সঙ্গে ছিল ওই ন্যাওটা হপকিন্সটা। আজ তোকে পেয়েছি একা, বল— কোথায় রেখেছিস মার্থাকে?’
‘হাডসন, মিসেস হাডসন তোমার বিয়ে করা বউ ঠিকই, কিন্তু ফেলে পালানো বউ। পুলিশের ভয়ে তুমি নিরপরাধিনী মেয়েটাকে অনাহারে রেখে গা-ঢাকা দিয়েছিলে, আমিই তাকে লন্ডনে এনে বাড়ি কিনে ল্যান্ডলেডি বানাই— বাড়ি ভাড়ার টাকায় যাতে সংসার চলে যায়, তাই ওপরতলাটা ভাড়াও নিই ওয়াটসনের সঙ্গে। কিন্তু কাকপক্ষী এই বদান্যতার কথা জানে না—’
‘আমি জানি, কুত্তার বাচ্চা। নিকুচি করেছে তোর বদান্যতার। বল কোথায় ফের লুকিয়েছিস মার্থাকে?’
‘খুব ভাল জায়গায়। যেখানে তোমার মতো নচ্ছার কেন— মঙ্গলগ্রহীদের ওই যন্ত্রদানবও পৌঁছোতে পারবে না।’
‘কোথায়?’
‘বলব না।’
‘না বললে মরবি।’
‘মরলেও ঠিকানা পাবে না।’
‘তবুও মর!’ বলেই ক্ষিপ্রবেগে ফিরে এসে হোমসের মাথা লক্ষ করে কৃপাণ চালাল হাডসন।
হোমসও তৈরি ছিল। পলক ফেলার আগেই পাশের টুল হাতে উঠে এল এবং কৃপাণটা ঘ্যাঁচাৎ করে বসে গেল টুলের কাঠে।
হাডসনের শ্লেষ্মা-ঝরা মুখের কাছ থেকে মুখটা সরিয়ে নিয়ে মোলায়েম গলায় হোমস বললে, ‘বড় সর্দি লেগেছে দেখছি।’
এক হ্যাঁচকায় কৃপাণ ছাড়িয়ে নিয়ে আবার হোমসের মাথা লক্ষ করে কোপ মারল হাডসন। এবার কিন্তু পিচ্ছিল ভঙ্গিমায় একপাশে সরে গিয়ে হোমস শুধু বললে, ‘অত চেঁচিও না, মঙ্গলগ্রহের শান্ত্রীরা শুনতে পাবে।’
হোমসের প্রখর কর্ণযন্ত্র আগেই যা শ্রবণ করেছিল এখন তা স্পষ্টই শোনা গেল কথা শেষ হতে না হতে। ঝনাৎ… ঝন… ঝন… ঝনাৎ… ঝন… ঝন।
ধাতুতে ধাতু ঠুকে কারা যেন এগিয়ে আসছে এই দিকে।
চাপা গলায় হোমস বললে, ‘নির্বোধ কোথাকার! কৃপাণ উঁচিয়ে বেপরোয়াভাবে ধেয়ে এসেছিলে যখন, তখনই তোমাকে দেখেছে ওরা। এখনও চেঁচাচ্ছ ষাঁড়ের মতো গাঁকগাঁক করে!…’
‘শাট আপ!’ গলার শির তুলে চেঁচিয়ে উঠে হোমসকে লক্ষ করে ছুটে এল হাডসন। বিদ্যুৎগতিতে হোমস একটা শো-কেস থেকে আরেকটা শো-কেসের আড়ালে সরে গেল বলেই রক্ষে, নইলে কচুকাটা হয়ে যেতে হত হাডসনের মুহুর্মুহু কৃপাণ চালনায়। কৃপাণ আঘাতে ঝনঝন করে গুঁড়িয়ে গেল একটা শো-কেস।
ঝনাৎ ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দটা স্তব্ধ হল দোকানের ঠিক সামনেই। বিশাল বয়লার সদৃশ যন্ত্ৰদেহ হেঁট হল দোকানের অভ্যন্তরের দৃশ্য ভালোভাবে দেখবার জন্যে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অজগরের মতো একটা মোটা শুঁড় ধেয়ে এল ভেতরে।
হাডসন অশ্লীল গালাগালি দিয়ে কৃপাণ চালাল সেই শুঁড় লক্ষ করে— ঠনাৎ শব্দে ধাতব শুঁড়ে কৃপাণ লেগেই হাত থেকে ঠিকরে গেল শূন্যে এবং চোখের পলক ফেলার আগেই শুঁড়টা ঠিক অজগরের মতোই হাডসনকে পেঁচিয়ে ধরে অবলীলাক্রমে তুলে নিল শূন্যে এবং শূন্যেই একবার দুলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।
হাডসনের বিকৃত আর্তনাদ শোনবার জন্যে কিন্তু দাঁড়িয়ে রইল না হোমস। হাতের কাছে খাবারদাবার যা পেল ঝটপট পকেটে পুরে সাঁৎ করে বেরিয়ে গেল পেছনের দরজা দিয়ে। সেখান থেকে একটা সরু গলি দিয়ে পেছনের রাস্তায় যেতে যেতেই পেছন ফিরে দেখতে পেল শুঁড়টা দোকান থেকে শো-কেস ভেঙে টিনের খাবার লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে বাইরে। রাস্তায় বেরিয়ে আসতে না আসতেই প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ল বাড়ির সামনের দিকটা। যন্ত্রদানবের ধাক্কা বোধহয় সইতে পারল না।
হোমস তখন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছে। এ-রাস্তা সে-রাস্তা হয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে শুনতে পেল হাডসনের বিকট আর্তনাদ আর ধাতব ঝনৎকার।
দূরের মোড় ঘুরে অদৃশ্য হল একটা দানব দেহ। পিঠের খাঁচায় আকুলিবিকুলি করছে মর্স হাডসন। আর ডাকছে পরিত্রাহি স্বরে, ‘হোমস! হোমস! হোমস!’
শুষ্ক কঠিন চোখে নিষ্পলকে চেয়ে রইল শার্লক হোমস।
মানুষ নিয়ে কোথায় চলেছে মঙ্গলগ্রহী? ল্যাবরেটরিতে গিনিপিগের মতো কেটেকুটে এক্সপেরিমেন্টের জন্য? না রান্নাঘরে?