অদৃশ্য সেনানী
পরের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই আগে ছাদে গিয়ে লন্ডনের অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করে নিল হোমস। চারদিক থমথম করছে। পাখিগুলো পর্যন্ত যেন বুঝেছে এ শহর তার পার্থিব জীবেদের কবলে নেই— মহাপাপিষ্ঠ অপার্থিবরা নারকীয় তাণ্ডবে মত্ত হয়েছে পথেঘাটে এমনকী আকাশেও। কাজেই আকাশবিহার স্থগিত রেখে বৃক্ষশাখার বাসায় টু-লেট ঝুলিয়ে বিহঙ্গকুল পর্যন্ত চম্পট দিয়েছে।
অথবা, থেকেও বোবা হয়ে রয়েছে— বিষম আতঙ্কে। অবাক মানসগোচর সত্তা দিয়ে তারাও বুঝেছে, ভিনগ্রহী এই আতঙ্কদের কাছে পৃথিবীর সব জীবই শত্রু।
তাই, ভোরের লন্ডন শুধু ধূমহীন নির্মল নয়— নীরব নিস্তব্ধ। সৃষ্টির প্রথম প্রভাত থেকে পাখিরা বিরামবিহীন যে গান গেয়ে ঘুম ভাঙিয়েছে মানব সমাজের— সে গান আর শোনা যাচ্ছে না।
এরই নাম কি মহাশ্মশান?
দু-চোখ বুঝি সজল হয়ে এল শার্লক হোমসের।
আচম্বিতে প্রিমরোজ হিলের দিক থেকে ধাতব কণ্ঠস্বরে নৈঃশব্দ্য খানখান করে দিয়ে রণনিনাদ ছাড়ল একটা মেটাল দৈত্য। ভোরের সূর্যও ঠিকরে গেল ধাতব দেহ থেকে। স্টিম সাইরেনের মতো কানের পর্দা ফাটানো তীব্র শব্দও শোনা গেল দিকে দিকে। কিন্তু—
অত্যন্ত সজাগ এবং প্রখর শ্রবণেন্দ্রিয়ের অধিকারী বলেই শার্লক হোমসের মনে হল, এই জয়ধ্বনি যেন আগের শোনা জয়ধ্বনির মতো নয়, বেহালার মূর্ছনা যাকে অভিভূত করে, সুরের ইন্দ্রজাল যে সূক্ষ্ম সত্তা দিয়ে অনুভব করে— সেই শার্লক হোমসের কানে এটুকু তারতম্য ধরা পড়া একান্তই স্বাভাবিক।
তাই খটকা লাগল হোমসের মনে।
সারা দিনে মাঝে মাঝে শোনা গেল দূরায়ত স্টিম সাইরেনের ধ্বনি। ধাতুর বুক চিরে যেন বেরিয়ে আসছে সেই শব্দ। কিন্তু সঞ্চরমান কোনও ধাতব দানবকে দেখা গেল না দিগন্তের কোনওদিকেই, সন্ধে নাগাদ গোধূলির রক্তিমাভায় একবার কেবল ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা ধাতব দেহ প্রিমরোজ হিলের ওপর।
রাত নামল। বাতি জ্বালল না হোমস। বরং বেহালা নামিয়ে খুব আলতো করে টেনে বিচিত্র সুরের জাল বুনে চলল আপন মনে।
রোববার সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে মনে পড়ল, দশম চোঙা কাল রাতেই নেমেছে পৃথিবীতে— নিশ্চয় লন্ডনেরই ধারেকাছে। ওদের বাহিনী এখন সম্পূর্ণ। পঞ্চাশজন মঙ্গলগ্রহী তাদের সমস্ত সাজসরঞ্জাম নিয়ে হাজির লন্ডনে। সে তুলনায় কিন্তু সাজ সাজ রব শোনা যাচ্ছে না আকাশে-বাতাসে অথবা, পথেঘাটে। লন্ডন আরও ঝিমিয়ে পড়ছে। শার্লক হোমসও কি ঝিমিয়ে পড়ছে? চোখ গেল ম্যান্টলপিসে রাখা কোকেন মারফিনের শিশি আর হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের দিকে। নিজেকে নিস্তেজ মনে করলেই, বাইরের উত্তেজনার অভাব দেখা দিলেই রক্তের মধ্যে ছুঁচ দিয়ে মাদক দ্রব্য মিশিয়ে কৃত্রিম উত্তেজনার সৃষ্টি করে এসেছে হোমস এতকাল, কিন্তু এখন আর তার দরকার নেই। লন্ডন ঝিমিয়ে পড়ে পড়ুক, শার্লক হোমস ঝিমিয়ে নেই।
রাস্তায় বেরোল হোমস। বেকার স্ট্রিট খাঁ-খাঁ করছে। সাবধানে মোড় ঘুরে অলিগলি দিয়ে পৌঁছল রিজেন্ট পার্কে, একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় কী যেন পড়ে আছে। ধাতব দেহ। দূর থেকে দেখেই থমকে গেল হোমস।
আর ঠিক তখনই ভক করে খানিকটা সবুজ ধোঁয়া ঠেলে উঠল গাছের ফাঁক দিয়ে— ঠিক যেমনটা দেখা গিয়েছিল ওকিং-এ নীল বিদ্যুৎ নিক্ষেপের পূর্ব মুহূর্তে।
কাঠ হয়ে গেল হোমস।
কিন্তু পলায়নের আগেই শোনা গেল অদ্ভুত সেই চিৎকারটা।
পার্থিব ভাষায় যার নাম গোঙানি, এ যেন তার চাইতেও তীব্র কিছু। ধাতুর বুক চিরে বেরোনো শব্দ নয়, স্টিম সাইরেনের মতো বুকের রক্ত ছলকানো শব্দও নয়। এ শব্দ যেন প্রাণীর।
হ্যাঁ, কোনও সন্দেহই নেই। জীবন্ত প্রাণীর কণ্ঠ নিঃসৃত সেই চিৎকার, আর যা-ই হোক বিজয়োল্লাস নেই— আছে যেন অন্তিম হাহাকার। শব্দটা একবার শোনা গেল— দু-বার শোনা গেল। তৃতীয়বার শব্দ নয়— ভক করে আবার সেই সবুজ ধোঁয়া লুণ্ঠিত ধাতব দেহের ওপরে ঠিকরে গেল— দেহটা কিন্তু নড়ল না।
মেশিন পড়ে রইল গাছের তলায়।
দ্রুত পেছনে সরে এল হোমস। তারপর পেছন ফিরেই পিঠটান দিয়ে গলির মধ্যে।
পেছন থেকে অপার্থিব কণ্ঠে কেউ হুংকার দিল না, রক্ত হিম করা ধাতব নিনাদে হৃৎপিণ্ড অসাড় করে দিল না। একরকম ছুটতে ছুটতে বেকার স্ট্রিটে বাসায় ফিরে হোমস জল গরম করে চা বানিয়ে বিস্কুট দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করে ভাবতে বসলেন সকাল বেলাকার দেখা দৃশ্যটা নিয়ে। তবে কি তার অনুমানই শেষ পর্যন্ত সত্যি হল? ধুঁকতে শুরু করেছে মঙ্গলের আগন্তুকরা? লাল ফুল মরে বাদামি হয়ে যাচ্ছে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল হোমসের। সেই তার প্রথম সূত্র। সেই সূত্রের বশেই শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলার পথনির্দেশ পাঠিয়েছিল বার্মিংহামে। দেখা যাচ্ছে, শেষ ঘনিয়ে আসছে খুব দ্রুত।
বিচিত্র নয়। জীবাণুর সহনশীলতা না থাকার ফলে আমেরিকার শ্বেতকায়দের সংস্পর্শে এসে পাষাণদেহী ইন্ডিয়ানরা হাম আক্রান্ত হয়ে দলে দলে নিকেশ হয়ে যায়নি? দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে দ্বীপে স্রেফ সর্দির জীবাণু কাতারে কাতারে জংলি দ্বীপবাসীকে পরলোকে পাঠায়নি?
হাডসনও লন্ডনের শীতের রাতে ঠান্ডা লাগিয়ে বসেছিল, বুকভরা শ্লেষ্মা নিয়ে নাকে মুখে সর্দি ঝরিয়ে উঠেছিল মঙ্গলগ্রহীদের খাঁচায়। অত্যন্ত পাজি এই সর্দির জীবাণু অদৃশ্য সেনানী হিসেবে কি আক্রমণ করেনি মঙ্গলগ্রহীদের?
কিন্তু ওয়াটসন এখন কোথায়? বেঁচে আছে তো? ওর জন্যে লেখা চিঠি এখনও ছুরি-গাঁথা অবস্থায় পড়ে আছে ম্যান্টলপিসে।
দূর থেকে অন্তিম কাতরানি, আবার শোনা গেল প্রাণী কণ্ঠের চিৎকার— যদি কণ্ঠ বলে কিছু থাকে অক্টোপাসের মতো বিকটদেহী আততায়ীদের।
বন্ধু, বহুদূর থেকে উড়ে এসেছিল পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন নিয়ে। সে স্বপ্ন এখন ধূলিসাৎ। হোমস এখন নিঃসন্দেহ। অদৃশ্য জীবাণুরা পাহারা দিচ্ছে পৃথিবীকে। মঙ্গলের আগন্তুকরা একে একে ঘায়েল হচ্ছে তাদেরই হাতে।
পায়ের চটিজুতো থেকে তামাক বার করে চেরী পাইপে ঠাসতে ঠাসতে হোমস ভাবল… আঃ, ওয়াটসন।
এই সময়ে… দড়াম করে খুলে গেল দরজা। ঘরে ঢুকল ওয়াটসন।