হাউ মাউ খাঁউ— মানুষের রক্ত পাঁউ
বাড়ি কাঁপিয়ে দরজা খুলে বন্ধ করলেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। যেন পাগলা হাতি ঢুকল বাড়িতে।
আওয়াজ পেয়েই দৌড়ে হলঘরে নেমে এলেন চ্যালেঞ্জার-গৃহিণী।
‘জর্জ, তুমি ঠিক আছ?’
‘ঠিক আছি মানে? বোমার মতো ফেটে পড়লেন চ্যালেঞ্জার, ‘রীতিমতো বেঁচে আছি। আর গবেট স্টেন্ট তার দলবল নিয়ে সাদা পতাকা দেখাতে গিয়ে ছাই হয়ে গেল নীল বিদ্যুতের ছোঁয়ায়। ইডিয়ট কোথাকার।’
শিউরে উঠে মুখে করতল চাপা দিয়ে জর্জ-গৃহিণী বললেন, ‘কী বলছ তুমি?’
‘ঠিকই বলছি। নির্বোধগুলোকে সব বলেছিলাম। আমার কথা কানে তুলল না। তুললে এভাবে মরতে হত না। এক হতভাগা গর্তের ধারে দাঁড়িয়েও খুশি হয়নি— গর্তের ভেতরে নেমে কথা বলতে গিয়েছিল মঙ্গলের জীবদের সঙ্গে। পরিণামটা কী হল জানো?’
‘কী?’
‘কতকগুলো শুঁড় বেরিয়ে এসে হিড়হিড় করে তাকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়েও আর লাভ হল না। ননসেন্স কোথাকার!’
‘আহা রে! লোকটার কী হল, তার খোঁজ নিলে না, আর গাল পাড়ছ?’
‘তবে না তো কি প্রশংসায় পঞ্চমুখ হব? বারণ করেছিলাম, শোনেনি কেন?— কী রান্না হয়েছে? ক্ষিদে পেয়েছে— ঝটপট।’
খাবার এল তক্ষুনি। চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয় দিয়ে উদরের অগ্নি নিভিয়ে গিন্নিকে সব কথা খুলে বললেন চ্যালেঞ্জার। বললেন, ক্রিস্টাল দিয়ে অনেক আগেই তিনি মঙ্গলের বাছাধনদের মতলবটা আঁচ করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রী-কে বলেননি পাছে ভয় পান। এখন আর অত ভাবনা নেই। যা হবার তা হয়ে গেছে— ভাবনা শুধু শার্লক হোমসকে নিয়ে। সে বেঁচে আছে তো? বৈজ্ঞানিকগুলো সাবাড় হয়েছে— তাতে দেশের অমঙ্গল খুব একটা হবে না। কিন্তু শার্লক হোমস ম’লে সারা পৃথিবীর ক্ষতি হয়ে যাবে।
বৈজ্ঞানিকদের নিয়ে এহেন কথাবার্তায় রাগ করে উঠে গেলেন প্রফেসর-গৃহিণী। ক্রিস্টাল নিয়ে বসলেন প্রফেসর। মাথায় কালো কাপড় চাপা দিতেই দেখলেন, কতকগুলো ধাতুর রডকে লিকপিকে শুঁড় দিয়ে জোড়া লাগাচ্ছে। মঙ্গলের বিকটদেহীরা। অর্থাৎ, নতুন অস্ত্র তৈরি হচ্ছে।
ফোন করলেন হোমসকে। সাড়া পেলেন না। তার পরের দিনও না। তার পরের দিন বিশেষ দূত মারফত একটা চিঠি এসে পৌঁছাল। হোমস জীবিত। কিন্তু লন্ডনে এখন নেই।
স্বস্তির নিঃশ্বেস ফেলে বাঁচলেন চ্যালেঞ্জার। হোমস আর তিনি ছাড়া এ পৃথিবীতে আর মূল্যবান মস্তিষ্কের অধিকারী কেউ আছে বলে তিনি মনে করেন না।
তবে হোমসের দুটো কথা নিয়ে ফুঁসে উঠলেন প্রফেসর। হোমস লিখেছে, ওদের চোখে নাকি পৃথিবীর মানুষ কীট-পতঙ্গের সামিল। তাদের দলে প্রফেসর পড়তে রাজি নন। দ্বিতীয় কথাটা অবশ্য একটু চিন্তার ব্যাপার। পৃথিবীর জল হাওয়ায় মঙ্গলগ্রহীরা নাকি ফ্যাসাদে পড়তে পারে— স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে।
এ নিয়ে গবেষণার দরকার। কেন? গজগজ করতে লাগলেন প্রফেসর। তবুও খচখচ করতে লাগল মনের ভেতরটা। হাজার হোক হোমসের কথা তো। বাজে কথা সে বলে না।
হোমস আরও লিখেছে, ক্রিস্টালটা যেন সযত্নে রাখা হয়। এ ক্রিস্টাল দখল করার চেষ্টা করতে পারে ব্যাটাচ্ছেলেরা। ক্রিস্টালের কথা খেয়াল হতেই কালো কাপড় মাথায় ঢাকা দিয়ে বসে গেলেন প্রফেসর। দেখলেন চামড়ার থলির মতো দেহ নিয়ে মঙ্গলগ্রহীরা নড়াচড়া করছে। আরও দেখলেন ন্যাংটা শরীরে একটা মানুষকে চিৎপাত করে মাটির ওপর চেপে রয়েছে কতকগুলো ধাতু দিয়ে তৈরি শুঁড়। সেই লোকটা নিশ্চয়— ওকিং-এ গর্তে নেমেছিল বলে যাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল মঙ্গলগ্রহীরা। কিন্তু কী করতে চায় ওকে নিয়ে? কাপড়-জামা খুলে শুইয়ে রেখেছে কেন? ছটফট করছে লোকটা। হাঁ করে যেন খাবি খাচ্ছে। বোধহয় চেঁচাচ্ছেও। মঙ্গলগ্রহীরাও ঘিরে ধরেছে ওকে। ধাতুর শুঁড়গুলো চেপে রেখেছে মেঝের ওপর। হঠাৎ আর একটা ধাতুর শুঁড় আবির্ভূত হল দৃষ্টিপথে। একটা চকচকে নল ঢুকিয়ে দিল লোকটার বুকে। তারপর নলের খোলা নল মুখ লাগিয়ে একে একে সরে যেতে লাগল ভিনগ্রহী আতঙ্কেরা। ঠিক যেভাবে সোডা ওয়াটার পান করা হয় কাগজের নল লাগিয়ে— অনেকটা সেই রকমের দৃশ্য দেখেই চ্যালেঞ্জার বুঝলেন কী ভয়ানক উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে আগন্তুকরা। মানুষের কাঁচা রক্ত ওদের উপাদের খাদ্য। টাটকা রক্তে সঞ্জীবিত রাখছে নিজেদের— উষ্ণ রুধিরে স্নিগ্ধ করছে তৃষিত দেহের জ্বালা। হোমস ঠিক অনুমানই করেছে। পৃথিবীর মানুষ ওদের কাছে পোকামাকড় ছাড়া কিছুই নয়।
ক্রিস্টাল নামিয়ে হাঁক পাড়লেন প্রফেসর। গিন্নিকে ডেকে বললেন, আজই লন্ডন ছেড়ে পালাতে হবে। এ জায়গা আর নিরাপদ নয়। ক্রিস্টাল সে কথা বলছে।