প্রফেসর চ্যালেঞ্জার বনাম মঙ্গলগ্রহী
সেই রাতেই চম্পট দেবেন মুখে বললেও কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লন্ডন ছেড়ে নড়লেন না প্রফেসর। রোজ নিজে গিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে হকারের কাছ থেকে খবরের কাগজ কিনে পড়তেন, সারে জেলা থেকে— মঙ্গলগ্রহীদের মার খেয়ে ভিটেছাড়া হয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের জেরা করতেন, কী কী হাতিয়ার আততায়ীরা ব্যবহার করছে, তার হিসেব নিতেন এবং আগন্তুকদের উদ্দেশ্যটা আঁচ করবার চেষ্টা করতেন। আর রোজ রাতে লক্ষ করতেন আকাশ থেকে তারা খসে পড়ার মতো একটি করে চোঙা এসে নামছে পৃথিবীতে। আর প্রতিদিন বার কয়েক টেলিফোন করতেন শার্লক হোমসকে। রিং বেজেই যেত, কেউ ধরত না। রেগেমেগে দড়াম করে রিসিভার ঝুলিয়ে রেখে ফের দাঁড়াতেন রাস্তায়।
এইভাবেই একদিন রাস্তায় শুনলেন ড্রাইভার অস্টিনকে একটা লোক কী যেন বোঝাচ্ছে। অস্টিন রাজি হচ্ছে না।
ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলেন চ্যালেঞ্জার, লোকটার সঙ্গে একটা এক ঘোড়ার চমৎকার গাড়ি। দুজনের বসার জায়গা আছে।
দেখেই মতলবটা এল মাথায়।
‘অস্টিন!’ হাঁক দিলেন প্রফেসর। দৌড়ে এল অস্টিন।
‘কী বলেছে লোকটা?’
‘আজ্ঞে, ভলান্টিয়ার হতে বলছে।’
‘কীসের ভলান্টিয়ার?’
‘ট্রেন চালাতে হবে। ড্রাইভার পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘চ্যালেঞ্জার জানতেন গুণধর অস্টিন অনেক কিছুই ড্রাইভ করতে জানে। তাই কথা না বাড়িয়ে বললেন, ‘যাও।’
‘যাব?’ অস্টিন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না।
‘হ্যাঁ, যাও দেশের কাজ করো। এ বাড়ির কাজের লোকদের দেশে পাঠিয়ে দাও। আর ওই লোকটাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’
অস্টিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ডেকে নিয়ে এল গাড়ি আর ঘোড়ার মালিক অচেনা মানুষকে।
‘আপনার ড্রাইভার অস্টিনকে—’
‘আপনাদের দরকার? নিয়ে যান। বিনিময়ে আপনার ওই গাড়ি আর ঘোড়াটা রেখে যান। কত দাম?’
‘অ্যাঁ?’
‘কত দাম?’
‘আজ্ঞে… মানে…’
‘এই নিন দশ পাউন্ড। গাড়ি আর ঘোড়া আমার। আচ্ছা আসুন।’
হতবাক লোকটাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেই চ্যালেঞ্জার ছুটলেন বাড়ির ভেতরে, ‘জেসি! জেসি!’
হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলেন প্রফেসর-জায়া। ছাদ কাঁপানো অমন ডাক শুনলে কেউ স্থির থাকতে পারে?
‘জেসি, জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। গয়না সব নেবে, কিছু খাবার আর জল। জলদি!’
‘কোথায় যাব?’
‘বাঁচতে,’ বলে আর কথা বাড়ালেন না প্রফেসর। ঝটপট নিজে বাইরের পোশাক পরে নিয়ে পকেটে গুঁজে নিলেন বেশ কিছু নোট আর মোহর। তারপর মালপত্র আর গিন্নিকে আগে তুলে দিলেন গাড়িতে। নিজে উঠে বসলেন গিন্নির পাশে। গাড়ি ছোটালেন পরমুহূর্তেই।
দিন কয়েকের বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চারের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে পাতা ভরাতে আর চাই না। কোথাও পরিত্যক্ত দোকান থেকে খাবার সংগ্রহ করলেন, কোথাও বা তালা দেওয়া দরজা ভেঙে পরের বাড়িতে রাত কাটালেন, আবার কখনও স্রেফ খড়ের গাদাতেই কর্তাগিন্নি রাত কাটিয়ে দিলেন। এইভাবে পঞ্চাশটা মাইল পেরিয়ে পৌঁছোলেন সমুদ্রতীরে।
গিয়ে দেখলেন, বিস্তর লোক জড়ো হয়েছে তাঁদের আগেই। খানকয়েক ছোটবড়ো জলপোতে বিপজ্জনকভাবে উঠছে যাত্রী। দূরে দাঁড়িয়ে একটা যুদ্ধজাহাজ, প্রহরারত।
মুশকিলে পড়লেন চ্যালেঞ্জার। যে রকম গুঁতোগুঁতি চলছে, বউ নিয়ে ওঠা মুশকিল। পকেটে টাকা আছে, কিন্তু টাকা ছড়িয়েও কাজ তো হবে না। জায়গা তো নেই।
হঠাৎ একটা চিৎকার শোনা গেল, ‘প্রফেসর চ্যালেঞ্জার, প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।’
ফিরে দাঁড়ালেন প্রফেসর। খর্বকায় এক ক্যাপ্টেন উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে তাঁর পানে। কাছে এসেই বললে সোল্লাসে, ‘চিনতে পারছেন? আমি হ্যারিস। ক্যাপ্টেন হ্যারিস!’
তীক্ষ্ণ চোখে হ্যারিসের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে প্রফেসর বললেন, ‘বিলক্ষণ চিনেছি। এক বছর তিন মাস দু-দিন আগে—’
‘আপনি আমার বিরাট একটা উপকার করেছিলেন, সেদিন যদি—’
‘থাক সেকথা। নিজের জাহাজটা কোথায়?’
‘ওই তো!’ দূরে ভাসমান একটা সাদা স্টিমারের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে প্রায় নাচতে নাচতে বললে খর্বকায় ক্যাপ্টেন, ‘দেখছেন-না স্টিম তুলছে। এখুনি রওনা হব। আপনি যাবেন? একটা জায়গা এখনও আছে— কতজনে এসে ঝুলোঝুলি করেছে। একজনের বেশি কাউকে তুলব না। ইনি আপনার সঙ্গে আছেন বুঝি? ইনিও যাবেন— জায়গা হয়ে যাবে। চলুন।’
তড়বড়ে হ্যারিস স্তব্ধ হতেই প্রফেসর বললেন, ‘দক্ষিণা?’
‘আপনার কাছে দক্ষিণা?’
বিশ পাউন্ড বার করে হ্যারিসের হাতে গুঁজে দিয়ে প্রফেসর বললেন কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরে, ‘ইনি আমার স্ত্রী। নিতান্ত অবলা। এঁকে নিরাপদে প্যারিসে পৌঁছে দেওয়ার ভার তোমার। সেখানে আমার বন্ধু প্রফেসর পঁসির কাছে গেলেই উনি যা করবার করবেন।— জেসি, যাও ক্যাপ্টেন হ্যারিসের সঙ্গে।’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জেসি বললে, ‘জর্জ, তুমি?’
‘আমার কাজ এখানে— প্যারিসে নয়। তোমাকে নিরাপদ জায়গায় না পাঠানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না। যাও।’
দ্বিরুক্তি করার সাহস হল না জেসির। কোনওদিনই হয়নি। দুর্দান্ত স্বামীর প্রতিটি সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে বিনা প্রতিবাদে— তাতে মঙ্গলই হয়েছে, প্রফেসর কখনও ভুল করেন না— জেসি তা জানেন।
চোখ মুছতে মুছতে গিয়ে উঠলেন চিমনিতে ধোঁয়াওঠা স্টিমারে। সঙ্গে সঙ্গে স্টিমার ছেড়ে গেল জেটি থেকে। অনেকক্ষণ নিষ্পলকে সেদিকে চেয়ে রইলেন প্রফেসর। একটু একটু করে দিগন্তে মিলিয়ে গেল সাদা স্টিমার। ঘুরে দাঁড়ালেন প্রফেসর। দেখলেন, ঘোড়া এবং গাড়ি উধাও। সেই সঙ্গে বাকি মালপত্র!
চোর বদমাসের কাজ নিশ্চয়ই। আসবার পথেও তিনজন গুন্ডার হাতে পড়েছিলেন। দুজনকে লাথি মেরে শুইয়ে দিয়েছিলেন। তৃতীয়জন ছুরি নিয়ে তেড়ে আসতেই কবজি ধরে হাত খুলে দিয়ে ছুরি কেড়ে নিয়েছিলেন। তা-ই বুঝি তার তন্ময়তার সুযোগ নিয়ে নিঃশব্দে চুরি হয়ে গেল একমাত্র যান এবং বাহন— এই হট্টগোলের সময়ে যা অমূল্য।
রাগে হাত মুঠো পাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করলেন প্রফেসর। ঘন ঝোপের মতো ভুরুর তলায় যেন স্ফুলিঙ্গ ছিটকে এল নীল চোখ থেকে। কিন্তু খামোকা রাগ করলে তো চলবে না— পঞ্চাশ মাইল পথ পেরিয়ে ফিরে যেতে হবে লন্ডনে।
তার আগে রাতটা সমুদ্রতীরেই কাটানো দরকার। এদিক-ওদিক চাইলেন প্রফেসর। কিছুদূরে একটা টিলা। টিলার ওপর একটা প্রস্তর নিবাস। স্বাস্থ্যনিবাস নিশ্চয়। এখন দরজা জানলা বন্ধ।
টিলায় উঠতে আরম্ভ করলেন প্রফেসর। সূর্য ক্রমশ চলছে পশ্চিমে। প্রস্তর নিবাসে যখন পৌঁছলেন, তখন সূর্য দিগন্ত প্রায় ছুঁয়েছে। নীচের ভিড়ও অনেক বেড়েছে। বেড়েছে চিৎকার চেঁচামেচি। জাহাজ কম, কিন্তু যাত্রী বেশি। কাতারে কাতারে আরও লোক আসছে। যতদূর দু-চোখ যায়, মানুষ ছাড়া কিছু নেই।
অমানুষদের দেখা গেল ঠিক তখনই।
আচমকা আতঙ্কে যেন ফেটে পড়ল পলাতক মানুষগুলো। পড়ি কি মরি করে দৌড়াতে লাগল সমুদ্রের তীর লক্ষ করে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উলটো দিক থেকে ভেসে এল ঝনাৎকার। ঝন্ ঝন্ ঝনাৎ ঝনাৎ… ঝন্ ঝন্ ঝনাৎ ঝনাৎ!
আসছে মেটাল মনস্টার! ধাতব দানব!
অচিরেই বড় বড় গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে দেখা গেল প্রায় একশো ফুট লম্বা অতিকায় অমানুষিকীকে। তিনটে সন্ধিযুক্ত ধাতুর ঠ্যাংয়ের ওপর অদ্ভুতভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে প্রায় এক্সপ্রেস ট্রেনের গতিবেগে দৌড়ে আসছে মঙ্গলের অমঙ্গল। পিঠে বিরাট খাঁচায় ছটফট করছে নরদেহ! জীবন্ত খাদ্য।
পরমুহূর্তেই হাহাকার শোনা গেল বাঁ দিক থেকে। চোখ ফিরোলেন প্রফেসর। সেদিকেও আবির্ভূত হয়েছে একটা মনস্টার— দৈত্য!
আবার বুক চাপড়ানির মতো করুণ কান্নাকাটিতে আকাশ যেন বিদীর্ণ হয়ে গেল পেছন দিকে। আবার ফিরলেন প্রফেসর। সেদিকেও লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে পর্বতপ্রমাণ চলন্ত টুলের মতো এগিয়ে আসছে একটা দানব। তিনটে ঠ্যাংয়ের ওপর একটা ত্রিভুজের মতো ফ্রেমের মধ্যে খাড়া বয়লার সদৃশ ডিম্বাকার আধার— মঙ্গলের প্রাণীর ককপিট। অনেকগুলো ধাতুর শুঁড় কিলবিল করছে চারদিক থেকে। দুটো শুঁড় একটা বাক্সর মতো যন্ত্র ধরে রেখেছে সামনের দিকে।
‘নীল বিদ্যুতের যন্ত্র!’ আপন মনেই বললেন প্রফেসর।
সমুদ্রতীরে তখন মড়াকান্না উঠেছে। আতঙ্কিত ধাবমানদের পদতলে যে কতজন পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কেউ তা ফিরেও দেখছে না। সবাই ছুটছে জলের দিকে। কিন্তু কীসের ভরসায়? জলযানগুলো বেগতিক দেখে নোঙর তুলে সরে যেতে শুরু করেছে বারদরিয়ার দিকে।
লক্ষ বৃংহিত ধ্বনিকে হার মানিয়ে দেওয়ার মতো স্টিম সাইরেন বাজিয়ে তিন দানব সটান ধেয়ে গেল জলের দিকেই। পলায়মান জলযানদের পথরোধ করাই যেন উদ্দেশ্য। কিন্তু জলের ধারে পৌঁছেই বিড়ম্বনায় পড়েছে মনে হল। মঙ্গলে এরকম সমুদ্র নেই। জলাতঙ্ক থাকা স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও দানব তিনটে বুক জলে নেমে গেল হুড়মুড় করে।
আর ঠিক সেই সময়ে দেখা গেল ফুল স্পিডে তিন দানবের দিকে ধেয়ে আসছে দূরের যুদ্ধ জাহাজটা। আসছে শরীরী আতঙ্কের মতো। উদ্দেশ্য অতিশয় স্পষ্ট। নিরীহ জলযানদের রক্ষে করতেই হবে মঙ্গলের আতঙ্কদের খপ্পর থেকে।
তাই গোধূলির রক্তাভায় দূর থেকেই দেখা গেল আগুনের ঝলক। পরক্ষণেই নির্ভুল লক্ষ্যে একটা বয়লার চুরমার হয়ে গেল গোলার ঘায়ে। হেলে পড়ল তিনটে ঠ্যাং। আবার শোনা গেল কামান নির্ঘোষ। আবার গোলা ধেয়ে এল দ্বিতীয় দানবটার দিকে— এবারও নির্ভুল লক্ষ্যে চূর্ণ হয়ে গেল দ্বিতীয় বয়লার। তাল তাল বাষ্প ঠেলে উঠল ভেতর থেকে— সেই সঙ্গে সবুজ ধোঁয়া।
তৃতীয় দানবটা ততক্ষণে রণনীতি ধরে ফেলেছে। জাহাজ লক্ষ করে নীল বিদ্যুৎও নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু হঠাৎ আক্রান্ত হওয়ার ফলে হতচকিত হওয়ার দরুনই বোধহয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। যুদ্ধ জাহাজের পাশ দিয়ে নীল বিদ্যুৎ গিয়ে জল স্পর্শ করতেই ছ্যাঁক করে একতাল বাষ্প ঠিকরে গেল শূন্যে।
তিনঠেঙে দানব কিন্তু আর দাঁড়াল না। পড়ি কি মরি করে জল থেকে উঠেই চম্পট দিল জঙ্গলের দিকে। মৃদু হাসি ফুটে উঠল চ্যালেঞ্জারের মুখে। পালটা মার তাহলে দিতে পেরেছে পৃথিবীর মানুষ। তাড়িয়ে দিতে পেরেছে অজেয় মঙ্গল-বিভীষিকাকে।
হাসি মিলিয়ে গেল পর মুহূর্তেই। আকাশ তখন কালো হয়ে আসছে। ভোঁ বেজে উঠেছে যুদ্ধজাহাজে। বিজয়োল্লাসের অট্টরোল শোনা যাচ্ছে সমুদ্রতীরে।
আর ঠিক তখনই জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে কিন্তু অকল্পনীয় দ্রুতবেগে ছিটকে এল একটা উড়ুক্কু যন্ত্রযান। সোজা ধেয়ে গেল সমুদ্রের ওপর দিয়ে যুদ্ধজাহাজের দিকে। চক্ষের পলক ফেলবার আগেই সাদা মতো একটা বস্তু রকেটের মতো উড়ন্ত পিরিচ থেকে ছুটে গেল যুদ্ধজাহাজ লক্ষ করে এবং জাহাজ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হল চাপা শব্দে।
পুঞ্জ পুঞ্জ কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল পুরো জাহাজ এবং আশপাশের জল। এক চক্কর ঘুরে এসে ধোঁয়ার মধ্যে দিয়েই নীল বিদ্যুৎ নিক্ষেপ করল উড়ন্ত চাকতি এবং কান ফাটানো শব্দে জাহাজটা ফেটে ছিটকে গেল শূন্যে এবং দিকে দিকে।
হাঁ হয়ে এই দৃশ্য দেখল সাগরের পাড়ে দাঁড়ানো হতবাক মানুষেরা— দেখল ভাসমান জলযানের যাত্রীরা। উড়ন্ত চাকতি কিন্তু তখন প্রতিহিংসায় নির্মম হয়ে উঠেছে। মুহুর্মুহু নীল বিদ্যুৎ ছুটে এল এক-একটা জলযান লক্ষ করে। নিমেষে নিমেষে অগ্নিদেবতা নৃত্য করে উঠল এক-একটা জলযানের ওপর। এ কী নিষ্ঠুরতা! কী উন্মত্ততা!
কিন্তু জিঘাংসার তখনও বাকি। প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের বিস্ফারিত চোখের সামনেই ঘটল সেই কাণ্ড। সব ক-টা জলযানে আগুন ধরিয়ে দিয়ে উড়ন্ত চাকতি সটান ছুটে এল সমুদ্রতীরে এবং বেশ খানিকটা নেমে এসে আতঙ্কে আধমরা মানুষগুলোর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল উল্কার মতো প্রচণ্ড বেগে।
সেই সঙ্গে পেছন থেকে বেরিয়ে এল তাল তাল কালো ধোঁয়া। যেন প্রকাণ্ড পিচকিরি দিয়ে কালো ধোঁয়াকে পাম্প করে ছড়িয়ে দেওয়া হল অসহায় মানুষগুলোর ওপর।
ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়েই সাঁ করে ওপরে উঠে গিয়ে, যেদিক থেকে এসেছিল, সেই দিকেই মিলিয়ে গেল উড়ন্ত চাকতি। ফিরেও দেখল না ধ্বংসলীলা কী পর্যায়ে পৌঁছেছে।
দেখলেন কেবল প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। ধোঁয়া সরে যাওয়ার পর দেখলেন, কাতারে কাতারে মানুষ লুটিয়ে পড়েছে বালির ওপর। নিষ্প্রাণ। নিষ্পন্দ।
তরল গ্যাসের মতোই ভারী ধোঁয়া গড়িয়ে যাচ্ছে বালির ওপর দিয়ে— ওপরে উঠছে না পৃথিবীর সব ধোঁয়ার মতো।
তাই টিলার ওপর ছিলেন বলে প্রাণে বেঁচে গেলেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।
অগণিত মড়ার দিকে তাকিয়ে রাত কাটিয়ে দিল প্রফেসর। ঘুমোলেন ভোরের দিকে। তারপর পায়ে পায়ে রওনা হলেন লন্ডনের দিকে। পথের কষ্টকে কষ্ট মনে করলেন না। খাবার ফুরিয়ে গেলে দোকান ভেঙে লুঠ করতে দ্বিধা করলেন না। রাতেই হাঁটলেন বেশি— লুকিয়ে রইলেন ঝোপেঝাড়ে। এইভাবে পৌঁছোলেন লন্ডনের উপকণ্ঠে। লন্ডনের দিকে তখন কেউ যাচ্ছে না। লন্ডন নাকি পুরোপুরি মঙ্গলগ্রহীদের পাল্লায়। চ্যালেঞ্জার এক কান দিয়ে শুনলেন— আর এক কান দিয়ে বার করে দিলেন। রাত গভীর হতেই অন্ধকারে গা ঢেকে ঢুকলেন শহরে। এপথ-সেপথ পরিক্রমা করার সময়ে চাঁদের আলোয় নালার মধ্যে অদ্ভুত রকমের লাল ফুল দেখে অবাক হলেন। মঙ্গলগ্রহীরা এর মধ্যেই বাগান সাজাতে আরম্ভ করে দিয়েছে দেখে এত কষ্টেও একটু হাসলেন। তারপর এক সময়ে এনমোর পার্কে নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছোলেন। বাড়ি অটুট। দরজা বন্ধ। পকেট থেকে চাবি বার করে দরজায় যেই লাগিয়েছেন, অমনি চাঁদের আলোয় ছায়া পড়ল দরজার ওপর।
সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালেন প্রফেসর। অদূরে দাঁড়িয়ে একটা ধাতবদানব।
চক্ষের পলকে দরজা খুলেই ভেতরে ঢুকে গেলেন প্রফেসর। যেতে যেতেই শুনলেন ঝন্ ঝন্ ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ দ্রুত এগিয়ে আসছে এই দিকে। এক্সপ্রেস ট্রেনের স্পিডে ছুটে এসে তিনটে ঠ্যাং ভেঙে বয়লার দেহটা প্রায় দরজার সামনে নিয়ে এল দানবটা— সেই সঙ্গে ধাতুর শুঁড়ের ঝাপটায় কাচের শার্সি ভেঙে শুঁড় গলিয়ে দিল ভেতরে।
কিন্তু গরিলার মতো বপু নিয়েও প্রফেসর চ্যালেঞ্জার যে হরিণের মতো ক্ষিপ্র হতে পারেন, সে প্রমাণ তিনি দিলেন সেদিন। ধাতুর শুঁড়ের অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতাকে হার মানিয়ে তিনি সাঁৎ করে হলঘরের পেছনের দরজা দিয়ে পৌঁছোলেন পেছনের উঠোনে— সেখান থেকে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে পাশের গলিতে। কোণ থেকে উঁকি দিয়ে দেখলেন দানবটা শুঁড় বাড়িয়ে তখনও ভেতর হাতড়াচ্ছে— চুরমার করছে জিনিসপত্র। কাজেই বাড়িটাকে এই উৎপাতের হাত থেকে রক্ষে করার জন্যে তিনি একটা দুষ্টবুদ্ধির শরণ নিলেন। রাস্তা থেকে একটা ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে মেটাল মনস্টারকে লক্ষ করে ছুড়ে মারলেন। ঠন করে বয়লার বপুতে লেগে ঢিলটা ঠিকরে যেতেই সপাৎ করে একটা শুঁড় আছড়ে পড়ল তাঁর দিকে— সেই সঙ্গে ঘুরে গেল বয়লার দেহ। গরিলা দেহটা দেখিয়েই প্রফেসর চ্যালেঞ্জার স্রেফ লুকোচুরি খেলে গেলেন ভিনগ্রহের নিষ্ঠুর আততায়ীর সঙ্গে— ছেলেবেলায় খেলেছিলেন, দেখলেন এখনও দিব্বি মনে আছে। দুটো বাড়ির মাঝের গলি দিয়ে বাঁইবাঁই করে দৌড়ে শেষ প্রান্তে পৌঁছে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখলেন ছেড়ে আসা প্রান্তে কালান্তক যমদূতের এই ঝন্ ঝনাৎ ঝন্ ঝনাৎ শব্দে আবির্ভূত হয়েছে চলমান যন্ত্ৰবাহন। বোঁ করে পাশের বাড়ি ঘুরে পাশের গলি দিয়ে ফের রাস্তায় এসে কামানের গোলার মতোই নিজের বাড়ির সামনে এসে গেলেন বুড়ো খোকা চ্যালেঞ্জার এবং পরক্ষণেই উধাও হলেন বাড়ির মধ্যে। পুরো ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে পাছু-নেওয়া দত্যিটা ঝন্ ঝনাৎ ঝন্ ঝনাৎ শব্দে পাশের বাড়ি চক্কর দিয়ে এসে দেখল দাড়িওলা পৃথিবীর পোকা মানুষটা আর নেই— বেমালুম নিপাত্তা। নিশ্চয় রাস্তা দিয়ে পালিয়েছে— এই মনে করে বায়ু বেগে ছুটে গেল রাস্তার এমোড় থেকে ওমোড়ে, ওমোড় থেকে এমোড়ে। কিন্তু ভোঁ-ভাঁ। দাড়িওলা বিটলে পোকাটার আর টিকি দেখা গেল না। রাম ভীতু কোথাকার! স্টিম সাইরেনের তীব্র শব্দে রাস্তা কাঁপিয়ে আকাশছোঁওয়া অট্টহেসেই বোধহয় গজেন্দ্রগমনে উধাও হল সে পাশের রাস্তায়। প্রফেসরও জানলার ফাঁক দিয়ে সেই দৃশ্য দেখেই একচোট হেসে সটান গেলেন রান্নাঘরে অনেকদিন পরে ভালোমন্দ কিছু খাওয়ার অভিলাষ নিয়ে।
খেয়েদেয়ে সুস্থ হয়ে স্নান করতে ঢুকলেন। কলে তখনও জল ছিল। সাবান মেখে স্নান করে এসে বসলেন পড়ার ঘরে। দেওয়ালের একটা ছবি সরিয়ে ভেতরকার খুপরি থেকে বার করলেন ক্রিস্টালটা। স্ত্রী-কে নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে বেরোনোর সময়ে ইচ্ছে করেই অমূল্য এই বস্তুটি তিনি সঙ্গে নেননি।
এখন সেই অমূল্য নিধিই বার করে ফের বসলেন টেবিলে। মাথায় কালো কাপড় ঢাকা দিয়ে দৃকপাত করতেই দেখতে পেলেন বিস্তর চকচকে রড আর মেশিন নিয়ে অনেকগুলো বিকটদেহী মঙ্গলগ্রহী জোড়াতালা লাগাচ্ছে বিরাট বড় একটা গর্তের মধ্যে— ওকিং-এ যে-গর্ত দেখেছিলেন তার দশগুণ বড় তো বটেই। হতচ্ছাড়ারা নতুন নতুন মেশিন বানাচ্ছে। দশটা সিলিন্ডার তো এসেই গেছে। পঞ্চাশ থেকে ষাটটা বিকটাবতারও এসেছে পৃথিবী জয়ের স্বপ্নে মশগুল হয়ে। অফুরন্ত খাদ্য যে এখানে। ভাবতে না ভাবতেই ক্রিস্টালের বুকে ফুটে উঠল সেই ভয়ানক দৃশ্য। সম্পূর্ণ নগ্ন একটা লোককে টেনে এনে ফেলা হল যন্ত্রপাতির গাদার মধ্যে। কতকগুলো শুঁড় চেপে ধরল তাকে মেঝের ওপর। আর একটা শুঁড় একটা নল তুলে ধরল বুকের কাছে…
কাপড় চাপা দিয়ে ক্রিস্টালকে দেওয়ালের খুপরিতে চালান করলেন প্রফেসর। এ দৃশ্য দেখা যায় না। অসহ্য! অসহ্য! অসহ্য! এই কারণেই ভেড়ার পালের মতো মানুষগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সমুদ্রের তীরে। এই কারণেই পিঠের খাঁচায় মুরগি বওয়ার মতো নিয়ে যাওয়া হয় মানুষদের— খিদে পেলেই টাটকা রক্তপানের উদ্দেশে।
সারা শরীর বিবমিষায় শিউরে ওঠে প্রফেসরের। জ্ঞানে বিজ্ঞানে শৌর্যে বীর্যে সমুন্নত মানুষের এই শিক্ষাটুকুর দরকার ছিল বোধহয়— দর্পচূর্ণ হচ্ছে কিন্তু বড় শোচনীয়ভাবে।
গুম হয়ে বসে রইলেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।
রাত ভোর হতেই ছাদে গিয়ে দেখলেন চারপাশ। পরিষ্কার আকাশ। বাতাসে ধোঁয়া নেই। স্টিম সাইরেনের সংকেত শোনা গেল দিকে দিকে। লন্ডন করায়ত্ত— এ বুঝি তারই বিজয়োল্লাস।
নেমে এলেন প্রফেসর। শুকনো মাংস আর রুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট খেলেন। জল গরম করে চা করলেন। তারপর বেরোলেন রাস্তায় টহল দিতে। শত্রুর নজর বাঁচিয়ে পথ পরিক্রমা চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু চ্যালেঞ্জার যে এ বিদ্যাতেও পটু, তার প্রমাণ দিলেন রাস্তায় বেরিয়ে। হানা দিলেন বেকার স্ট্রিটে— শার্লক হোমসের দেখা পেলেন না। ফিরে এলেন গজগজ করতে করতে। তৃতীয় দিন রাত্রে সহসা রাস্তাঘাট ঝলমল করে উঠল বিদ্যুৎ বাতিতে। এ কী কাণ্ড! এ তো নীল আলো নয়, সবুজ আলোও নয়। এ যে ঝকঝকে সাদা আলো! তবে কি মঙ্গলগ্রহীরা বিদায় নিয়েছে? লন্ডন বিভীষিকা মুক্ত হয়েছে? বিমূঢ় হয়ে পথে বেরিয়ে এলেন চ্যালেঞ্জার। দেখলেন, তিনি একা নন, ভোজবাজির মতো বহু লন্ডনবাসীও বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। আনন্দে তারা হাত ধরাধরি করে নাচছে, গাইছে, হাসছে।
সহসা হাসি রূপান্তরিত হল কান্নায়। পতঙ্গকে আলো দেখিয়েই টেনে আনতে হয়। ভিনগ্রহীরাও তা-ই করেছে। গর্ত থেকে পোকার মতোই মানুষদের টেনে নামিয়েছে রাস্তায়। পরমুহূর্তেই দলে দলে তারা হানা দিল রাস্তায় রাস্তায়। চ্যালেঞ্জারের চোখের সামনেই একটা ত্রিপদ দৈত্য শুঁড় বুলিয়ে এক একবারে তিন-চারজনকে ধরে পুরতে লাগল খাঁচায়। শ-খানেক মানুষ তোলা হয়ে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে!
পালিয়ে এলেন প্রফেসর! সত্যিই পালিয়ে এলেন।