ওয়াটসনের অভিজ্ঞতা
ওয়াটসন ছিল লন্ডন শহরেই— হাইগেট অঞ্চলে। দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধে ওর যে বিশ্বস্ত আর্দালি মুরে ওর জীবন বাঁচায়, তার অন্তিম শয্যায় হাজির ছিল প্রথম সিলিন্ডার সারে জেলায় অবতীর্ণ হওয়ার আগে থেকেই। মুরে তখন অচেতন। দিনরাত সেবা করে গিয়েছে ওয়াটসন। শুক্রবার প্রথম চোঙা নামল ওকিং-এ। তারপরের সাতটা দিনে অনেক কাণ্ডই ঘটে গেল সারে জেলা আর লন্ডন শহরে। প্রতি রাতে নামল একটা চোঙা। প্রতিদিন আসতে লাগল নতুন নতুন খবর। প্রতিটিই আগের চাইতে উৎকণ্ঠাময়, ভয়ংকর এবং রোমাঞ্চকর। তারপর শুরু হল লন্ডন ত্যাগের হিড়িক। হাইগেট পর্যন্ত ফাঁকা হয়ে গেল সাতদিনের মধ্যে। অথচ একদিনের জন্যেও মাত্র পাঁচ মাইল দূরে বেকার স্ট্রিটে গিয়ে বন্ধুবর শার্লক হোমসের খবরটা পর্যন্ত নেওয়ার সময় হল না ওয়াটসনের।
হল মুরের মৃত্যুর পর। চাদর দিয়ে মৃতদেহ ঢেকে গিয়ে উঁকি মারল বাইরে। এই ক-দিন রাস্তায় এক্সপ্রেস ট্রেনের বেগে চলমান ধাতব দানবদের সে ছুটতে দেখেছে। ধাতুর জয়েন্ট থেকে ফুস ফুস করে সবুজ বাষ্প বেরিয়ে আসতে দেখেছে ছোটার সময়ে। ছাদের মাথা দিয়ে একশো ফুট লম্বা বয়লারের মাথাও দেখেছে। দেখেছে এপাশে-ওপাশে বহু বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে মেটাল মনস্টারদের আক্রমণে। দেখেছে নীল বিদ্যুতের ছোঁয়ায় বাড়ির পর বাড়ি কীভাবে নিমেষে জ্বলে উঠছে। দেখেছে রাস্তা থেকে পলায়মান মানুষগুলোকে কীভাবে শুঁড় ঝুলিয়ে টপাটপ তুলে নিয়ে পিঠের খাঁচায় বন্দি করে রাখছে আকাশছোঁয়া দৈত্যরা। ভাগ্যক্রমে অক্ষত থেকে গিয়েছে ও যেখানে ছিল, সেই বাড়িটি। তাই ওপরতলায় জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছে কীভাবে ফাইটিং মেশিনরা কালো ধোঁয়া ছেড়ে রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ মেরেছে, সৈন্য মেরেছে, মারমুখো জনতাকে মেরেছে। তারপর দেখেছে সেই ধোঁয়াই থিতিয়ে গিয়ে কালো গুঁড়ো হয়ে রাস্তা ছেয়ে গিয়েছে— তার ওপর রাস্তার কুকুরকে হাঁটতে দেখেছে। কুকুর কিন্তু মরেনি। এ থেকেই বুঝেছে, কালো ধোঁয়া শুকিয়ে গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়লে বিষক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়।
মুরে যখন মারা গেল অজ্ঞান অবস্থাতেই, তখন লন্ডন নিস্তব্ধ। পথঘাট খাঁ-খাঁ করছে। ওষুধের ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিল ওয়াটসন। হেঁটেছে রাতের অন্ধকারে— ঘুমিয়েছে পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে দিনের বেলা। পাঁচ মাইল পথ পেরুতেই প্রাণান্ত হয়েছে। প্রিমরোজ হিলের ওপর আধডজন ফাইটিং মেশিনকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝেছে ওইখানেই তাদের আসল ঘাঁটি। ওই জন্যে একটা সবুজ আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে জায়গাটা। নালায় দেখেছে অদ্ভুত লাল ফুল। মাটিতে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে সেই ফুল। রেল লাইনের বাঁধ পর্যন্ত ছেয়ে গেছে বিচিত্র ফুলে। রিজেন্ট স্ট্রিটে দেখেছে ঝকঝকে সাদা আলো। ছুটে গিয়েছিল ওয়াটসন নিজেও। অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। দূর থেকেই দেখেছে টপাটপ মানুষ তুলে খাঁচায় পোরার দৃশ্য। ফাইটিং মেশিনদের ধারেকাছেও আর ঘেঁসেনি ওয়াটসন— আলো দেখে আর ভোলেনি। পরের দিন ধুঁকতে ধুঁকতে বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে বন্ধুবরের কামরায় ঢুকে দেখেছে শার্লক হোমস প্রশান্ত চিত্তে চেরিকাঠের পাইপ ঠাসছে পারস্যদেশের চটিজুতোয় রাখা তামাক দিয়ে।
ওয়াটসনকে দেখেই বলেছে সহজভাবে, ‘এসো ওয়াটসন। তোমাকেই খুঁজছিলাম।’ যেন হাতে একটা জটিল কেস এসেছে— আলোচনা দরকার।
আর সইতে পারেনি ওয়াটসন। মাথা ঘুরে পড়ে গেছে একটা চেয়ারে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ব্র্যান্ডি এনে বন্ধুর গলায় ঢেলে দিয়েছে হোমস। সংবিৎ ফিরে পেয়ে ওয়াটসন জিজ্ঞেস করেছে, ‘অ্যাদ্দিন এখানেই ছিলে নাকি?’
‘মোটেই না। রোববার বেরিয়েছিলাম মিসেস হাডসনকে নিয়ে। গাঁয়ে রেখে এলাম— নিজের লোকজন আছে সেখানে। ফিরেছি বুধবার। অপেক্ষায় ছিলাম তোমার আর প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের।’
‘প্রফেসর চ্যালেঞ্জার!’
‘হ্যাঁ। বিরাট বৈজ্ঞানিক। নিজেকে আরও বিরাট মনে করেন।’
‘হামবড়া?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাঁর অপেক্ষায় কেন?’
‘ক্রিস্টালটা তাঁর কাছেই গচ্ছিত রেখেছি যে।’
‘কোন ক্রিস্টালটা?’
হোমস তখন খুলে বলল। এতদিন যা বলেনি ওয়াটসনকে একবাড়িতে থেকেও— সব বলল। বলল, কীভাবে চ্যালেঞ্জার আর তিনি আগে থেকে জানতেন মঙ্গলগ্রহ থেকে আক্রমণ শুরু হবে পৃথিবীতে। ওকিং-এ প্রথম চোঙাটা পড়তেই চ্যালেঞ্জার দৌড়ে গেছিলেন সেখানে। কিন্তু তাঁর কথা না শুনে স্টেন্ট আর ওগিলভি প্রমুখ বৈজ্ঞানিকরা মরেছে। হয়তো চ্যালেঞ্জারও। কেননা সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি নিপাত্তা।
ঠিক এই সময়ে সদর দরজা থেকে বাড়ি কাঁপানো ষণ্ডকণ্ঠে একটা হাঁক ভেসে এল, ‘মহাশয়ের অন্দরে কি প্রবেশ করতে পারি?’