প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকে চেনে মঙ্গলগ্রহীরা
ধনুক থেকে যেভাবে শনশন করে তির ছুটে যায়, সেইভাবেই শার্লক হোমস চক্ষের নিমেষে ছিটকে গেল চেয়ার থেকে। দুড়দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়ে হইহই করে যাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে এল ওপরের ঘরে, তাঁকে দেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ওয়াটসন। এ যে মানুষ-গরিলা। যেমন চওড়া কাঁধ, তেমনি লোমশ ভুরু। বুকের পাটা তো প্রকৃতই দরজার কপাটের মতো। ইয়া দাড়ি— আসীরিও নৃপতিদের মতো। ঘন নীল চোখ। হাতে ঝুলছে একটা টিনের বাক্স। এ আবার কে?
নীরব জিজ্ঞাসার জবাব দিল হোমস, ‘প্রফেসর চ্যালেঞ্জার, যার কথা তোমাকে বলছিলাম, ওয়াটসন।’
‘ওয়াটসন?’ বিরাট ভুরু কুঁচকে প্রফেসর বললেন, ‘এই সেই ওয়াটসন? ডাক্তার? তোমার সহযোগী?’
‘হ্যাঁ। এইমাত্র আপনার কথাই বলছিলাম। ভাবছিলাম হয়তো আর ইহলোকে নেই আপনি।’
‘হোমস, মাই ডিয়ার হোমস।’ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললেন চ্যালেঞ্জার। ‘প্রায় সেই অবস্থাই হতে বসেছিল আজ সকালে— তাই পালিয়ে এলাম।’
স্থির চোখে চেয়ে হোমস বললে, ‘খুলে বলুন।’
‘আমরা তিনজনেই এখানে বুদ্ধিমান— কম বেশি।’ বলে একটু থামলেন। কারও আপত্তি নেই দেখে ফের বললেন, ‘কিন্তু আমাদের তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান বলে মঙ্গলগ্রহীরা আমাকেই চিনে রেখেছে— কারণ, আমিই এতদিন ধরে তাদের দেখেছি ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে। তারাও দেখেছে আমাকে।’
‘ঠিক কথা,’ হোমস সায় দিতে আত্মগর্বে আরও স্ফীত হলেন প্রফেসর।
বললেন, ‘তাই ঠিক করলাম আজ ভোর রাতে একটা এক্সপেরিমেন্ট করা যাক। লুকোচুরি খেলায় ওদের একজনকে আমার বাড়িতেই সেদিন হারিয়ে দিয়েছি। কাল রাতে রিজেন্ট স্ট্রিটে আলো জ্বালিয়ে মানুষ তোলার দৃশ্যও দেখেছি—’
‘আমিও দেখেছি,’ ফ্যাকাশে মুখে বলল ওয়াটসন, ‘কিন্তু কেন প্রফেসর?’
অনুকম্পার চোখে তাকিয়ে প্রফেসর বললেন, ‘খাবার জন্যে। আমাদের শিরায় আর ধমনীতে নল ঢুকিয়ে রক্ত টেনে নিয়ে ওরা নিজেদের শরীর চাঙ্গা রাখে— ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে সে দৃশ্যও আমি দেখেছি।— ওকী! হোমস, তোমার বন্ধু অজ্ঞান হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।— হবে না? তাহলে দয়া করে ডাক্তার, আমার কথার মাঝে অমন করে আঁতকে উঠো না। আজ সকালে ঠিক করলাম ওদের চেনা দিয়ে দেখি কী করে।’
‘তারপর?’ গম্ভীর হয়ে গেল হোমস।
‘মাথায় কালো কাপড় চাপা দিয়ে চেয়ে রইলাম ক্রিস্টালের দিকে। যন্ত্রটা ওদের। লন্ডনেই কোথাও আছে, সে খবরও রাখে। তাই কিছুক্ষণ ওদের নররক্ত পানের দৃশ্য দেখবার পর হঠাৎ একজন সটান চাইল আমার চোখের দিকে।’
ওয়াটসন নিশ্চুপ। হোমস পাইপ ধরিয়ে নিল দেশলাই জ্বালিয়ে।
প্রফেসর বললেন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে অনেকক্ষণ ড্যাবডেবে চোখে চেয়ে রইল আমার দিকে। তারপর ক্রিস্টাল অন্ধকার হয়ে গেল। আমিও গতিক সুবিধের নয় বুঝে এই টিনের বাক্সে ক্রিস্টালটাকে রেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। আধ মিনিটও গেল না— দুটো মোড় পেরোতে না পেরোতেই এনমোর পার্কের বাড়ির সামনে হাজির হল একটা তেপায়া যন্ত্র। দূর থেকেই শুনলাম ভাঙাচোরার শব্দ। তছনছ করে ক্রিস্টাল খুঁজছে। না পেয়ে এতক্ষণে বোধহয় বাড়িটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়েও দিয়েছে। আমি আর ওমুখো হচ্ছি না।’
কাষ্ঠ হেসে হোমস বললে, ‘ওদের চোখে আপনি তাহলে আসামি।’
‘আসামি না কচু!’ হুংকার ছেড়ে বললেন চ্যালেঞ্জার, ‘ওদের ক্রিস্টালটা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাকে। কিন্তু ক্রিস্টাল তো এইখানে—’
বলে, টিনের বাক্সটা তুলে টেবিলের ওপর রাখলেন প্রফেসর।