ভিনগ্রহীরা কি মঙ্গলের জীব?
আঁতকে উঠল ওয়াটসন, ‘আ-আপনি ক্রিস্টালকে মাঠে ময়দানে ফেলে এলে পারতেন।’
‘কেন ডাক্তার?’ দুই ভুরু নাচিয়ে বললেন প্রফেসর।
‘ক্রিস্টালের পেছন পেছন এখানেও তো আসতে পারে।’
‘আসতে পারে কি ডাক্তার, আসবেই।’
ওয়াটসন প্রায় লাফিয়ে উঠল চেয়ার ছেড়ে।
সাদা দাঁত বার করে হাসলেন প্রফেসর।
বললেন, ‘মাভৈঃ। এই বাক্সের বাইরেটা টিনের— ভেতরে সিসের পাত আছে। না থাকলে আমার পেছন পেছন ওরা এখানে এসে যেত এতক্ষণে।’
‘সিসের পাত!’
‘হ্যাঁ। যাতে বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বা বিকিরণ যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটে। এর ফলেই হানাদার ব্যাটাচ্ছেলে দিশেহারা হয়ে গেছে, আমার টিকি ধরতে পারেনি।’
‘অ!’ আশ্বস্ত হয়ে আসন গ্রহণ করল ওয়াটসন।
চ্যালেঞ্জার ফের বললেন, ‘কিন্তু ওদের সঙ্গে একটা মোকাবিলা দরকার। মেশিনের সঙ্গে নয়— জ্যান্ত হানাদারের সঙ্গে। ক্রিস্টাল এনেছি সেই কারণেই। হোমস, বুঝেছ, কী বলতে চাই?’
‘বিলক্ষণ,’ মুচকি হাসল হোমস, ‘এক ব্যাটাকে জ্যান্ত ধরতে চান। এই তো?’
‘রাইট। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওরা মঙ্গলগ্রহ থেকে এলেও মঙ্গলের জীব নয়।’
‘সে বিশ্বাস আমারও আছে, এতদিন প্রকাশ করিনি।’ সায় দিল হোমস।
‘আমি জানতাম, তোমার বুদ্ধিমত্তা আমার চাইতে খুব একটা নিরেস না হলেও এ ধাঁধার জবাব বার করবেই। সন্দেহটা হল সেইদিন, যেদিন দেখলাম ওরা মঙ্গলের পাতলা বাতাসে ভারী দেহ নিয়ে আস্তে আস্তে চলাফেরা করছে। মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ করা ওখানকার জীবদের দেহের ওজনও সেই অনুপাতে কম হওয়া উচিত। কিন্তু তা নয়। মেশিনগুলো দেখেও মনে হল নকল অক্সিজেনের কারখানা। আসলে ওরা অন্য গ্রহের জীব। মঙ্গলে ঘাঁটি গেড়েছিল ওখান থেকে পৃথিবী লক্ষ করে মহাকাশযান ছুড়তে সুবিধে হবে বলে। কেননা, মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ কম।’
‘এগজ্যাক্টলি!’ সায় দিল হোমস।’
‘মঙ্গল থেকেই ক্রিস্টালটাকে ওরা বহুদিন আগে যেভাবেই হোক পৃথিবীতে পাঠায় তার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর হালচাল পর্যবেক্ষণ করার জন্যে। করেওছে। সেইসঙ্গে করেছি আমরা— ওদের হালচাল।’ বলে বুক ফুলিয়ে কালো চাপ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার, ‘আমি, এই সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহের সর্বশ্রেষ্ঠ জীব প্রফেসর চ্যালেঞ্জার, ওদের গ্রহের আকাশ দেখেছি, গ্রহের চেহারা দেখেছি, দেখে গ্রহবাসীদের চেহারা কীরকমটা হওয়া উচিত, তা আঁচ করে নিয়ে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে ওরা এসেছে সৌরজগতের বাইরের এমন কোনও গ্রহ থেকে, যেখানে এবং যেখানকার ধারেকাছের গ্রহে মানুষের মতো দু-পেয়ে জীব নেই— আছে তেপায়া জীব। তাই ওরা তেপায়া মেশিনের কল্পনা করতে পেরেছে— চাকাওলা গাড়ির কথা ভাবতেও পারেনি— যা এই পৃথিবীর সভ্যতাকে একলাফে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেকখানি।’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান,’ বাধা দিয়ে বললে ডাক্তার ওয়াটসন, ‘একেবারেই সৌরজগতের বাইরে চলে যাচ্ছেন কী হিসেবে?’
‘কারণটা খুলেই বলা হয়েছে, বৎস ডাক্তার। মঙ্গলের আকাশে ডবল চাঁদ দেখেছি, বৃহস্পতি আর শনিগ্রহেও একাধিক চাঁদ আছে। কিন্তু সেসব গ্রহের আকাশ মেঘে ঢাকা— পৃথিবী পর্যবেক্ষণের অসুবিধে। কিন্তু মঙ্গল থেকে পৃথিবীকে দেখতে অনেক সুবিধে। ওদের সভ্যতা যথেষ্ট উন্নত— বহু বছর আগে থেকেই যদি দেখত তাহলে দু-পেয়ে অথবা চাকাওলা মেশিন উদ্ভাবন করত। কিন্তু তা করেনি। অন্যগ্রহে তিনপেয়ে মেশিন বানিয়ে অভ্যস্ত বলেই মঙ্গলের বুকে ঘাঁটি গেড়ে তিনপেয়ে মেশিনই বানিয়েছে।’
ধমক খেয়ে মিনমিন করে ওয়াটসন বললে, ‘কিন্তু পৃথিবী গ্রহেও ক্যাঙারু নিজেদের লেজ ব্যবহার করে তৃতীয় পায়ের মতো।’
‘কিন্তু তারা উন্নত জীব নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগের অনেক সরীসৃপও ইয়া মোটা ল্যাজ ব্যবহার করত ঠেকনা হিসেবে ভারী শরীরটাকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্যে। কিন্তু তেপায়া জীব এ পৃথিবীতে কোথাও নেই— বিবর্তন সেভাবে ঘটেনি। ঘটেছে অনেক দূরে সৌরজগতের বাইরে কোথাও। অক্টোপাসের মতো এই জীবরা গ্রহে গ্রহে বিজয়কেতন উড়িয়ে পৃথিবীগ্রহ বিজয়ের স্বপ্নও দেখেছিল মঙ্গলে ঘাঁটি গেড়ে। বন্ধুগণ, ওদের সেই অভিযান ভন্ডুল করবার জন্যেই জর্জ এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জার এই ক্রিস্টাল নিয়ে পালিয়ে এসেছে এইখানে।’
ওয়াটসন কারও আত্মম্ভরিতা একদম সইতে পারে না। বাঁকা সুরে বললে, ‘পালিয়ে এসে অভিযান ভন্ডুল করতে চান করুন। কিন্তু অক্টোপাসের মতো চেহারা যাদের, তাদের বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধে আমার বিলক্ষণ সন্দেহ আছে।’
‘মাই ডিয়ার ডাক্তার,’ বিনয়ক্ষরিত কণ্ঠে বললেন প্রফেসর, ‘ফ্রেডরিক দ্য গ্রেটও রণক্ষেত্র থেকে পশ্চাদপসরণ করে পরে বিজয়ী হয়েছিলেন। ইতিহাসে এমন নজির ভুরি ভুরি আছে। আর অক্টোপাসের মতো চেহারা যাদের বলছ, তাদের ব্রেন নেই একথা ভুলেও মনে করবে না। যেমন জর্জ এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জারের চেহারাটা গরিলার মতো— কিন্তু সুপার ব্রেনের অধিকারী সে। ঠিক তেমনি আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওদের ওই থলথলে দেহটা আসলে পুরোপুরিই ব্রেন। লিকলিকে শুঁড়গুলোর কাজ কেবল যন্ত্রপাতি নির্মাণ আর চালনা করা। গতর খাটানোর দরকার হয় না বলেই গতর বড় হয়নি— ব্রেন খাটিয়ে ব্রেনটাই কেবল বড় করেছে, পৃথিবীর সব বড় বৈজ্ঞানিকই যা করেন।’
ওয়াটসন বিরক্তি গোপন করে বললে, ‘এঁকে দেখাতে পারেন একটা জীবকে? আমার দেখার সৌভাগ্য এখনও হয়নি।’
‘নিশ্চয় দেখাতে পারি। তারপর জ্যান্ত একজনকেও দেখাব—’ বলে দাড়ির ফাঁক দিয়ে মুচকি হেসে হোমসের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে নিয়ে খাতা পেনসিল টেনে নিয়ে ঝপাঝপ একটা কিম্ভূতকিমাকার জীবের ছবি এঁকে ফেললেন— যার মুখবিবর ত্রিভুজের মতো, চোখ ভাঁটার মতো, মুখবিবরের দু-পাশ দিয়ে ঝুলছে কতকগুলো লিকলিকে শুঁড়। বাদবাকি শরীরটা ভিস্তিওয়ালার জলভরতি চামড়ার থলির মতো বিপুল।
প্রফেসর বললেন, ‘পেছনে দুটো ফুটো আছে— নিশ্চয় কান। কান আর চোখ নিশ্চয় কারও ধড়ে লাগানো থাকে না— ব্রেনের লাগোয়া হয়। তাহলে পুরো থলথলে বস্তুটাই কি ব্রেন নয়?’
ঢোঁক গিলল ওয়াটসন। যুক্তি অকাট্য, নির্বাক থাকাই শ্রেয়।
প্রফেসর চ্যালেঞ্জার টিনের বাক্সে হাত দিয়ে বললেন, ‘ডাক্তার, ক্রিস্টালটা তোমার দেখা দরকার। পৃথিবীতে এমন জিনিস আজ পর্যন্ত কেউ কল্পনাও করতে পারেনি— আবিষ্কার করা তো দূরের কথা। টেলিগ্রাফ যন্ত্রে যেমন তারের মধ্যে দিয়ে খবর ছুটে যায়, এই ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে ইথারের মধ্যে দিয়ে ছবি ভেসে যায়। বলতে পারো গ্রহে গ্রহে যোগাযোগের টেলিভিশন।’
‘ক্রিস্টালভিশন।’ টিপ্পনী কাটল শার্লক হোমস।
‘হোমস,’ এতক্ষণে যেন হোমসের কথা মনে পড়ল চ্যালেঞ্জারের, ‘ক্রিস্টাল এবার বের করব, মক্কেলকে লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসব— তারপর হারামজাদাকে আস্ত ধরবার কী প্ল্যান তুমি এঁটেছ বলো।’
উঠে দাঁড়িয়ে ম্যান্টলপিস থেকে মরক্কো চামড়ার ব্যাগ বার করল হোমস। বার করল সিরিঞ্জ আর মরফিনের শিশি।
‘হোমস!’ আঁতকে উঠল ওয়াটসন, ‘বারো বছর ছেড়ে দেওয়ার পর আবার?’
ধীর কণ্ঠে হোমস শুধু বললে, ‘আমার জন্যে নয়, ওয়াটসন। মানুষের রক্ত যারা নিজেদের রক্তে মিশোয়, তাদের রক্তে এই মাদক দ্রব্যটি মিশিয়ে দেখতে চাই মানুষের মতোই ঝিমিয়ে পড়ে কি না।’
‘হোমস?’ সটান উঠে দাঁড়াল ওয়াটসন।
চ্যালেঞ্জার ততক্ষণে বাক্সর ঢাকনি খুলে ক্রিস্টাল বার করে ফেলেছেন। ডিমের মতো গড়ন, কিন্তু মুঠির মতো বড়। অনুজ্জ্বল নীলাভ দীপ্তি কুণ্ডলী পাকাচ্ছে ভেতরে। কালো কাপড় দিয়ে নিজের মাথা ঢেকে হোমসকে ডাকলেন প্রফেসর। ওয়াটসনও ক্রিস্টাল দৃশ্য দেখবার লোভ সামলাতে না পেরে মাথা গলাল কালো কাপড়ের তলদেশে। অমনি দেখল নীলাভ কুয়াশা সরে যাচ্ছে। সহসা স্পষ্ট দেখা গেল দুটো ড্যাবডেবে চোখ নিষ্পলকে চেয়ে আছে। আশপাশে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত যন্ত্রপাতি।
বিড় বিড় করে বললেন প্রফেসর, ‘চললাম মেশিনের কন্ট্রোল রুমে। এই ক্রিস্টালের জুড়ি ক্রিস্টাল নিয়ে বসে আছে শয়তান। জুড়ির খোঁজে টহল দিচ্ছে। এল বলে এক্ষুনি।’
বলতে না বলতেই অন্ধকার হয়ে গেল ক্রিস্টাল। কালো কাপড় ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রফেসরও উঠে দাঁড়ালেন তক্ষুনি। ঢাকনি খোলা বাক্সের মধ্যে ক্রিস্টাল রেখে বাক্স রাখলেন খোলা জানলার সামনে টুলের ওপর।
বললেন হৃষ্ট কণ্ঠে, ‘শুধু ঢাকনিটা খোলা রইল— তার মানে ঘরের কড়িকাঠটুকুই কেবল দেখতে পাবে ভিনগ্রহী— আমাদের নয়। ডাক্তার তুমি বড় ভয় পেয়েছ— ঘরের ওই কোণে দাঁড়াও। হোমস, তুমি সিরিঞ্জ নিয়ে জানলার এপাশে দাঁড়াও। আমি দাঁড়াচ্ছি ওপাশে।’
কথা শেষ হতে না হতেই ঝন্ ঝন্ ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ শোনা গেল অনেক দূরে। এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো দ্রুত ছন্দে নয়— অনেকটা ধীর গতিতে।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হোমস বললে, ‘এসে গেছে।’
রাস্তার মোড়ে দেখা গেল একটা ফাইটিং মেশিনকে। প্রতি পদক্ষেপে ভক্ ভক্ করে সবুজ বাষ্প ঠিকরে বেরোচ্ছে সন্ধির জায়গাগুলো দিয়ে। বয়লার বপুর চারপাশ দিয়ে ঠিকরোচ্ছে সবুজ বাষ্প। তিনটে পা ফেলে অদ্ভুত বিকট কায়দায় এগিয়ে আসছে বেকার স্ট্রিট দিয়ে।
সরে এল হোমস। ফাইটিং মেশিনের চলন ভঙ্গিমায় সেই তেজ আর নেই। পুরো যন্ত্রটাই যেন নিস্তেজ নিবীর্য।
জানলার সামনে এসে গেছে মেশিন। হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছে রাস্তার ওপর। লক্ষ ভোমরার ডাকের মতো আশ্চর্য একটা গুনগুন গুনগুন আওয়াজে কানে যেন তালা লেগে যাচ্ছে। জুনের ঝকঝকে রোদ ঢাকা পড়ে গেল সহসা। জানলা জুড়ে বয়লার বপু হেলান দিয়ে রয়েছে দেওয়ালে। খটাং খট শব্দে কী যেন খুলে গেল।
জানলার গোবরাটে সপাৎ করে আছড়ে পড়ল একটা শুঁড়। তারপর আর একটা। ধাতুর তৈরি শুঁড় নয়— প্রাণীদেহের শুঁড়। সেইসঙ্গে শোনা গেল হাপরের মতো শব্দে নিশ্বাস নেওয়ার কষ্টকর শব্দ! হু-উ-উ-স হু-উ-উ-স শব্দে আওয়াজ করতে করতে আরও দুটো শুঁড় এসে পড়ল গোবরাটে। তারপর পিছলে এল একটা থলথলে চামড়ার দেহ। গোবরাট পেরোতে যেন প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। শুঁড় দিয়ে অনেক কসরত করে ভারী দেহটাকে নিয়ে এল গোবরাটের ওপর। তারপর ধপাস করে পড়ল ঘরের মেঝেতে। আয়তনে ঠিক যেন বড় ভালুক।
চক্ষের নিমেষে চ্যালেঞ্জার ঝাঁপিয়ে পড়লেন তার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় কালচে একজোড়া গোল চোখ ফিরল প্রফেসরের পানে; একজোড়া শুঁড় পাকসাট দিয়ে বসে গেল গলার ওপর।
দম আটকে গেল চ্যালেঞ্জারের। গরিলা শক্তি নিয়েও নিজেকে ছাড়াতে পারলেন না শুঁড়ের পাকসাট থেকে। ঠেলে বেরিয়ে এল দুই চোখ। অবরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘হোমস… কুইক!’
হোমস তার আগেই অবশ্য ধেয়ে এসেছে। আগন্তুকের দুই চোখ চ্যালেঞ্জারের ওপর নিবদ্ধ থাকায় দেখতে পায়নি হোমসকে। চক্ষের নিমেষে সিরিঞ্জের ছুঁচ ঢুকিয়ে দিল ড্যাবডেবে দু-চোখের ঠিক নীচে থলথলে চামড়ায়। শূন্য সিরিঞ্জ শিশিতে ডুবিয়ে ভরতি করে নিয়ে আবার ফুঁড়ে দিল একই জায়গায়।
থরথর করে কেঁপে উঠল আগন্তুকের প্রত্যঙ্গগুলো। তারপর একটু একটু করে নিস্তেজ হয়ে ঝুলে পড়ল চ্যালেঞ্জারের কণ্ঠদেশ থেকে। হাপরের আওয়াজের মতো নিশ্বাসের শব্দটাও এল কমে। মৃদু ছন্দে স্পন্দিত হতে লাগল থলথলে কলেবর।
গলায় হাত বুলোতে বুলোতে প্রফেসর বললেন, ‘ধন্যবাদ, হোমস!’
ঘরের কোণ ছেড়ে এগিয়ে এসে ওয়াটসন বললে, ‘পচা গন্ধটা কীসের, হোমস?’
‘এর গা থেকে বেরোচ্ছে। চামড়ায় পচন ধরেছে।’ বললে হোমস।
একদৃষ্টে চেয়ে রইল ওয়াটসন। ডাক্তারি চোখে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করার পর বললে, ‘মরফিন দিয়ে তুমি ওর যন্ত্রণা কমিয়ে দিলে। বেচারা! মরতে বসেছিল, একেবারে মেরেই ফেললে। ওই দেখো, ফুসফুস আর কাজ করছে না।’
‘বেচারা!’ ছাদ কাঁপিয়ে হুংকার ছাড়লেন চ্যালেঞ্জার, ‘কাকে বেচারা বলছেন? মানুষের শরীরে জীবাণু আছে— আকাশে বাতাসে জলেও আছে। মানুষ সেই জীবাণু শত্রুকেই বন্ধু করে নিয়ে ঘরসংসার করে এসেছে এই পৃথিবীতে। সেই মানুষের রক্তই এই শয়তান পান করেছে। ওকে বেচারা বলছ?’
হোমস বললে, ‘চ্যালেঞ্জার ঠিকই বলেছেন, ওয়াটসন। নররক্ত অতিশয় সুস্বাদু ওদের কাছে। তাই নির্বিচারে মানুষ বধ করেছে। কিন্তু মানুষের দেহে বাসা বাঁধা জীবাণুরা অদৃশ্য বলেই যে নিরীহ, তা তো নয়। ওরা যেসব গ্রহে বিজয় কেতন উড়িয়ে এসেছে অদৃশ্য জীবাণুরা নিশ্চয় এইভাবে সেসব গ্রহ পাহারা দেয় না। তাই পার পেয়ে গেছে। তাই ঘায়েল হল সবুজ সুন্দর, এই পৃথিবীতে এসে।’
চ্যালেঞ্জার বললেন, ‘বক্তিমে পরে দিও, হোমস। লাশটাকে অ্যালকোহলে ডুবিয়ে জিইয়ে রাখা দরকার গবেষণার খাতিরে। বড় চৌবাচ্চা আছে বাড়িতে?’
‘আছে, আর দোকানে দোকানে আছে অনেক মদ। ওয়াটসন হাত লাগাও। লাশটাকে নীচে নিয়ে যাওয়া যাক।’
এইচ. জি ওয়েলসের লেখা ‘ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ যারা পড়েছ, এর পরের ঘটনা তারা জানো। কিন্তু যে কাহিনি ওয়েলস সাহেব লিখে যাননি— তা-ই নিয়েই এই চমকপ্রদ কাহিনি শেষ করছি।
লাশটাকে হেঁইও হেঁইও করে তিনজনে নামিয়ে নিয়ে গেল একতলায়, ন-ফুট লম্বা, চারফুট চওড়া আর তিনফুট গভীর একটা শুকনো চৌবাচ্চা ছিল সেখানে! দড়ি দিয়ে বেঁধে গুরুভার লাশটাকে টেনে সেই চৌবাচ্চায় ফেলার পর, হাঁপাতে হাঁপাতে চ্যালেঞ্জার বললেন, ‘কী! বলেছিলাম-না মঙ্গলের জীব এরা নয়? ফুসফুসটার নিশ্বাস নেওয়ার আওয়াজ শুনেই বুঝেছিলাম— অতবড় ফুসফুস মঙ্গলের পাতলা হাওয়ার উপযুক্ত নয়। এ প্রাণী এমন কোনও গ্রহের, যেখানকার মাধ্যাকর্ষণ বেশি। তাই যেমন ওজন, তেমনি জোর। মরবার সময়েও ব্যাটাচ্ছেলে টুঁটি জড়িয়ে ধরে হাড়েহাড়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে।’
হোমস বললে, ‘বুঝেছি। এবার দরকার মদ। চলুন, রাস্তার দোকান থেকে নিয়ে আসি।’
বেকার স্ট্রিটেই মদের দোকান ছিল। কয়েক পিপে মদ গড়িয়ে এনে ঢেলে দেওয়া হল চৌবাচ্চায়। তারপর হাত মুছে প্রফেসর উঠে এলেন দোতলায়। খোলা জানলা দিয়ে দেওয়ালের গায়ে হেলান দেওয়া ফাইটিং মেশিনের খোলা হ্যাচের মধ্যে দিয়ে ঢুকলেন ভেতরে। ওয়াটসন আর হোমস বাইরে দাঁড়িয়েই দেখল ভেতরকার রাশিরাশি সূক্ষ্ম কলকবজা। প্রফেসর অনেকক্ষণ এটা-ওটা নাড়াচাড়া করার পর একটিমাত্র জিনিস হাতে ঝুলিয়ে এলেন বাইরে।
জিনিসটা একটা ডিম্বাকৃতি ক্রিস্টাল— অবিকল আগেরটার মতোই, শুধু যা একটা ধাতব বাক্সের খুপরিতে বসানো এবং অনেকগুলো তার ঝুলছে বাক্সটার চারদিক থেকে।
জানলার গোবরাট টপকে ধপাস করে ঘরে লাফিয়ে পড়ে দন্ত বিকশিত করলেন প্রফেসর, ‘এই বস্তুটাই খুঁজছিলাম।’
‘এ তো দেখছি আমাদের ক্রিস্টালের দোসর।’ বললে শার্লক হোমস।
‘হ্যাঁ, কিন্তু এই তারগুলো দিয়ে অন্যান্য জায়গায় রাখা ক্রিস্টালের ছবিও দেখা যায়।’
‘তার মানে মঙ্গলে এদের ঘাঁটির সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে এখন?’
‘হ্যাঁ। সেইজন্যই তো আনলাম।’
পৃথিবী আক্রমণের দশম দিনেই হানাদারদের আজব ক্রিস্টাল-ভিশন আবিষ্কৃত হল এইভাবে। বিভিন্ন তারের যোগাযোগ ঘটিয়ে সে ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে হানাদারদের অনেক ঘাঁটির দৃশ্য দেখলেন প্রফেসর, হোমস এবং ওয়াটসন। দেখলেন, প্রিমরোজ হিলের বিরাট গর্তে দলে দলে হানাদার ধুঁকছে রোগযন্ত্রণায়— মুমুর্ষু প্রকৃতই। যন্ত্রপাতিগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চারদিকে। ওঁদের সামনেই হঠাৎ আকাশ থেকে গোঁত খেয়ে বিশাল উড়ন চাকতিটা ঠিকরে পড়ল গর্তের মধ্যে— চালক নিশ্চয় খতম হয়েছে। একতাল সবুজ ধোঁয়া ঠিকরে গেল চাকতির চারদিক থেকে।
ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে এল হানাদারদের দাপানি। লন্ডনের পথেঘাটে পড়ে থাকতে দেখা গেল কুপোকাত মেশিনদার। পৃথিবী বিজয়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল যাদের-শুধু-চোখে-দেখা-যায়-না— সেই অদৃশ্য রক্ষী জীবাণুদের পালটা আক্রমণে।
মঙ্গলের ঘাঁটিতে বসে হানাদাররা সে খবর পেয়েছিল আগেই। পৃথিবীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়ে গেল কিন্তু বিচ্ছিন্ন হল না। তারা এসেছিল অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে; উচিত শিক্ষা পেয়ে সে চেষ্টার ধার দিয়েও গেল না। বরং ভয় করতে শিখল পৃথিবীকে এবং শ্রদ্ধা জানিয়ে গেল পৃথিবীর একটি মস্তিষ্ককে।
নাম, তাঁর প্রফেসর জর্জ এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জার। ক্রিস্টাল ভিশনের দৌলতে ধীমান জীবদের সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ওঁর। ফলে ছবি সংকেতের মধ্যে দিয়ে শুরু হল কথাবার্তা। ছবি-সংকেতের মধ্যে দিয়েই তারা বুঝিয়ে দিলে প্রফেসরকে, ধারণা তাঁর অভ্রান্ত। সত্যই তারা সৌরজগতের বাসিন্দা নয়, এসেছে বহু দূরের আর এক নক্ষত্রলোক থেকে। গ্রহে গ্রহে উপনিবেশ স্থাপন করে জ্ঞান বিনিময়ই তাদের লক্ষ্য ছিল। সেই সঙ্গে পৃথিবীতে পেয়েছিল অঢেল খাদ্য, পরে যখন তা প্রমাণিত হল বিষাক্ত— তখন আর পৃথিবীতে তারা পা দেবে না। কিন্তু তাদের জ্ঞানভাণ্ডারের কিছু কিছু দান করে যাবে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকে। যাতে একদিন তিনি নিজেই মহাকাশযান বানিয়ে উড়ে যেতে পারেন তাদের গ্রহে। নীল বিদ্যুতের মন্ত্রগুপ্তিও তারা শিখিয়ে দিয়েছিল প্রফেসরকে। ফাইটিং মেশিনের কন্ট্রোল কেবিনেই পাওয়া গিয়েছিল মটরদানার মতো ছোট্ট একটা ক্রিস্টাল। নীল মোটেই নয়, রক্তবর্ণ। কিন্তু বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ সেই ক্রিস্টালের দিকে ছুটে গেলেই তা থেকে বেরিয়ে আসত প্রলয়ংকর তেজরাশি— যা রিফ্লেকটর দিয়ে ঘুরিয়ে নীল বিদ্যুতের আকারে ফেলা যায়। যে দিকে খুশি— যার স্পর্শমাত্র নদী বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, জাহাজ-বাড়ি-জীবদেহ অঙ্গারে পরিণত হয়। নীল বিদ্যুৎকে সংহত করে ঠিকমতো ফেলতে পারলে পরমাণুকে ভেঙে বিপুল শক্তি তার মধ্যে থেকে বার করে আনা যায়। এই শক্তির দৌলতেই গ্রহে গ্রহে ঘুরে বেড়ায় ওরা। মঙ্গল থেকেও এসেছে পৃথিবীতে, মঙ্গল ওদের অস্থায়ী আস্তানা। সমগ্র সৌরজগত পরিভ্রমণ করে একটিমাত্র ধীমান মস্তিষ্কের সন্ধান ওরা পেয়েছে। সেই মস্তিষ্কটিকেই ওরা দিয়ে যাচ্ছে প্রলয়ংকর পরমাণুর শক্তি নিংড়ে নেওয়ার গুপ্তবিদ্যে, আকাশ-যান নির্মাণের কৌশল এবং টেলিপ্যাথির গোপন রহস্য— যা আয়ত্ত করতে না পারা পর্যন্ত মানুষ ইতর প্রাণীর পর্যায়েই থেকে যাবে।
প্রফেসর চ্যালেঞ্জার রক্তবর্ণ ক্রিস্টালটিকে কোথায় রেখেছেন, কেউ তার হদিশ পাচ্ছে না। তবে ইদানীং একটা গুজব শোনা যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জার আজ স্বৰ্গত ঠিকই, কিন্তু তাঁর গুপ্তবিদ্যে নাকি তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অন্য বৈজ্ঞানিকদের হাতে চলে গিয়েছে। যে বৈজ্ঞানিকদের উনি বিশ্বাস করতে পারেননি বলেই পৃথিবীধ্বংসী পারমাণবিক শক্তির উৎস জীবদ্দশায় ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানাননি— সেই বৈজ্ঞানিকরাই নাকি পারমাণবিক শক্তির ফরমুলাটা হাত করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর। ফলে, অ্যাটম বোমা উড়িয়ে দিয়েছে হিরোশিমা ও নাগাসাকি। তেজস্ক্রিয়তার বিষে আজ পৃথিবীর জল বাতাস পর্যন্ত বিষিয়ে যাচ্ছে। মানুষ নিজেই নিজের মৃত্যু ডেকে আনছে। এই সেই শক্তি যা সৌরজগতের বাইরে থেকে দান হিসাবে এসেছিল পৃথিবীতে। কে জানে, দানবরা পৃথিবী ধ্বংসেরই সুদূর পরিকল্পনা করেছিল কি না আত্মহননের মধ্য দিয়ে।