ক্রিস্টাল ডিমে মঙ্গলগ্রহ
পরের দিন সকাল দশটায় ওয়েস্ট কেনসিংটনে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের নিবাস এনমোর পার্কে হাজির হল শার্লক হোমস। বিশাল গাড়িবারান্দাওয়ালা পেল্লায় অট্টালিকা। গৃহভৃত্য হোমসকে পৌঁছে দিল চ্যালেঞ্জারের ঘরের সামনে। দরজায় টোকা দিতেই হুংকার ভেসে এল ভেতর থেকে… ‘ভেতরে আসা হোক।’
ভেতরে এল হোমস। মস্ত স্টাডিরুম। সারি সারি তাকে ঠাসা বৈজ্ঞানিক কেতাব আর যন্ত্রপাতি। বিরাট চওড়া টেবিলের সামনে বসে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। বৃষস্কন্ধ। খর্বাকায়। কুচকুচে কালো বাটালি মার্কা চাপদাড়ি… সুপ্রাচীন আসীরিয় (অসুর?) নৃপতিদের গণ্ডে যা শোভা পেত। লোমাবৃত প্রকাণ্ড এক হাতে যেন খামচে ধরে আছেন একটি লেখনী। ঝুলন্ত পর্দার মতো চোখের পাতার তলা দিয়ে নীল চোখ মেলে হোমসকে নিরীক্ষণ করলেন এ-হেন বিখ্যাত পুরুষটি।
‘চোখ ধাঁধানো নতুন কোনও বৈজ্ঞানিক কাজে বাগড়া দিলাম না তো?’ বললে হোমস।
‘খসড়াটা প্রায় শেষ হয়ে এল,’ বললেন চ্যালেঞ্জার। সেই সঙ্গে লেখনীটা প্রায় নিক্ষেপ করলেন টেবিলে। ‘ভিয়েনা কনফারেন্সে বক্তৃতাটা পড়ব… অনেক তাত্ত্বিকের চোখ কপালে উঠবে, ভুরু কুঁচকে থাকবে। ইতিমধ্যে ঘণ্টাখানেক তোমার প্রহেলিকার পেছনে ব্যয় করা যাবে।’
‘যেমনটা করেছিলেন মাটিলডা ব্রিগস আর সুমাত্রার দানব ইঁদুরদের পেছনে?’
‘আরে দূর, সে তো দুষ্প্রাপ্য কয়েকটা নমুনাকে বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে সাজানোর ব্যাপার। বলো ভায়া, এবার কী ধাঁধা এনেছ।’
ক্রিস্টাল ডিম বার করল হোমস। বলল, গত সন্ধ্যায় কী দেখেছে ডিমের মধ্যে। প্রকাণ্ড থাবায় বিচিত্র বস্তুটি গ্রহণ করে ঝোপের মতো পুরু ভুরু কুঁচকে নির্নিমেষে চেয়ে রইলেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।
তারপর বললেন কুঞ্চিত ললাটে, ‘সত্যিই ভেতরে একটা আভা দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে সুবিধে হবে দেখতে। পর্দাটা টেনে দেবে, ভায়া?’
পর্দা টেনে দিয়ে ঘর প্রায় অন্ধকার করে দিল হোমস। চ্যালেঞ্জার বৃষস্কন্ধ চেয়ে রইলেন ক্রিস্টাল ডিমের পানে। ঘাড়ের ওপর দিয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে ডিম্ব-প্রহেলিকায় তন্নিষ্ঠ হল শার্লক হোমস।
কিছুক্ষণ পরে মন্তব্য শোনা গেল চ্যালেঞ্জারের রাশভ কণ্ঠে, ‘কুয়াশা ঠিকই, কিন্তু আংশিক স্বচ্ছ। প্রায় তরল বলেই এমন নড়ছে, ঢেউয়ের দোলায় দুলছে। আশ্চর্য! সত্যিই আশ্চর্য!’
বলতে বলতে ড্রয়ার থেকে একখণ্ড কৃষ্ণবস্ত্র বার করলেন প্রফেসর। ঘোমটার মতো মেলে ধরলেন ক্রিস্টাল ডিমের ওপর। এবার দেখা গেল, প্রায় স্বচ্ছ কুয়াশার নরম দ্যুতি আবার গলে গলে যেন মিলিয়ে যাচ্ছে এবং গত রাতে দেখা অপার্থিব সেই নিসর্গদৃশ্য ফের আবির্ভূত হচ্ছে।
দূরবিন উলটো করে চোখে লাগালে সব দৃশ্য যেমন ছোট্ট অথচ নিখুঁতভাবে দেখা যায়, এবারের দৃশ্য দেখা গেল প্রায় সেইভাবে। বহুদূর বিস্তৃত ভূমি, অনেক দূরে লালচে-বাদামি রঙের বাঁধ, বাঁধের এদিকে নিম্নভূমির ওপর বিশাল চ্যাটালো ছাদের মতো আয়তক্ষেত্রের পর আয়তক্ষেত্র।
কী যেন সব নড়ছে এই সব আয়তক্ষেত্র এবং পাশের দিকের সবুজ ঘাসে ছাওয়া জমির ওপর। একদম সামনে সমান ব্যবধানে সাজানো সারবন্দি কতকগুলো সরু মাস্তুলের মতো সুউচ্চ খুঁটি… রোদ্দুর ঝকমকে বরফখণ্ডের উজ্জ্বল দ্যুতি ঠিকরে যাচ্ছে প্রতিটির ডগা থেকে।
হোমসের মতো নীরস কাঠখোট্টা মানুষও যেন কীরকম হয়ে গেল এই দৃশ্য দেখে, বলল আবেশ বিহ্বল কণ্ঠে, ‘বিউটিফুল! অপার্থিব!’
বিড়বিড় করে চ্যালেঞ্জার বললেন আপন মনে, ‘অপার্থিব তো বটেই। উপযুক্ত শব্দই ব্যবহার করেছ, ভায়া। এ দৃশ্য পৃথিবী নামক এই গ্রহের পৃষ্ঠে আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি… দেখবেও না।’
বিচিত্র সেই দৃশ্য মুহূর্তের মধ্যে কুয়াশাবৃত হয়েই পরিষ্কার হয়ে গেল পরক্ষণেই। সঞ্চরমান বস্তুগুলিকে এবার ঠাহর করা গেল মোটামুটি। জমির ওপর যারা নড়ছে, তাদের বলা উচিত বিশালাকার গুবরে পোকা। গুটিগুটি এগোচ্ছে শম্বুকগতিতে। ঝকঝক করছে গায়ের আঁশ। আয়তক্ষেত্রাকার ছাদের ওপর সঞ্চরমান বস্তুগুলি আরও কাছে দেখা যাচ্ছে ক্ষুদ্রকায় এবং গোলাকার। নড়ছে এরাও। ইতস্তত। তারপর, একদম সামনে সিধে মাস্তুলের মতো খুঁটিগুলোর ফাঁক দিয়ে মথ পোকা অথবা বাদুরের মতো কী যেন উড়ে এল ডানা ঝটপটিয়ে। এগিয়ে এল অনেক নিকটে। পরমুহূর্তেই, আচম্বিতে, একটা মুখ উঁকি দিল ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে।
হোমসের নজর অতিশয় তীক্ষ্ণ বলেই এক লহমার মধ্যেই যা দেখবার দেখে নিল। দেখল, বড় বড় গোল গোল দুটো চোখ প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে আছে তার পানে। শুধু তাকিয়ে আছে বললে কম বলা হবে, যেন চামড়া ফুঁড়ে ভেতর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে হোমসের।
পরের মুহূর্তেই অন্তর্হিত হল বৃহদাকার গোলাকার দুই চক্ষু… সেই সঙ্গে অদৃশ্য হল অপার্থিব নিসর্গ দৃশ্য… ঘুরপাক খেতে লাগল কেবল পুঞ্জ পুঞ্জ নীল কুহেলি।
ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো চেয়ার থেকে ছিটকে গেলেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। সবলে জানলার পর্দা সরিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন বিদ্যুদ্বেগে।
বললেন মেঘমন্দ্র কণ্ঠে, ‘হোমস, দেখেছ?’
শুষ্ক হেসে হোমস বললে, ‘দেখেছি। যা দেখেছি তা লিখে আপনাকেদেখাচ্ছি। আপনি লিখে জানান কী দেখলেন। দেখি, দুজনের দেখা এক হয় কি না।’
চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল হোমস। ঝড়ের বেগে কলম চালাল কাগজে। প্রফেসরও বসলেন কাগজ পেনসিল নিয়ে। সমানে নাসিকাধ্বনি করতে করতে লিখে চললেন নক্ষত্ৰবেগে। সেকেন্ড কয়েক অখণ্ড নীরবতার পর কাগজ পালটাপালটি করলেন দুই কৃতবিদ্যা পুরুষ। পড়লেন নিরুদ্ধ নিশ্বাসে।
তারপর কাগজ নামিয়ে রেখে আর একবার ঘোর নাসিকাধ্বনি করে বললেন প্রফেসর, ‘তাহলে দেখা যাচ্ছে, যা দেখেছি, তা চোখের ভুল নয়… মরীচিকা দর্শন নয়। কেননা, দুজনেই দেখেছি একই দৃশ্য… একই বিস্ময়। বৈজ্ঞানিক বলেই আমার দর্শনেন্দ্রিয় বিজ্ঞানসম্মতভাবে দেখতে অভ্যস্ত ঠিকই, তবে গোয়েন্দা বলেই তুমি আর একটু খুঁটিয়ে কতকগুলো তুচ্ছ কিন্তু অসাধারণ জিনিস দেখে ফেলেছ… ছাদ, দূরের বাঁধ। আর সঞ্চরমান জীবন্ত বস্তু। কিন্তু ক্রিস্টাল মহাপ্রভু এই যে অপার্থিব দৃশ্যটি দেখালেন, এবার সেই দৃশ্যের একটা যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যাক।’
হোমস বলে উঠল তক্ষুনি, ‘আমার তো মনে হয় অন্য কোনও গ্রহের দৃশ্য।’
আশ্চর্য ক্রিস্টালকে দু-হাতে চোখের সামনে রেখে উলটেপালটে নিরীক্ষণ করতে করতে প্রফেসর বললেন, ‘ভায়া তোমার সঙ্গে একমত হওয়ার প্রলোভন সম্বরণ করতে পারছি না। অনেক সময়ে ছেলেভুলানো খেলনা ক্রিস্টালের মধ্যে আশ্চর্য মরীচিকা দৃশ্য ঢোকানো থাকে। এ যদি সে ধরনের খেলনাও হয়, তাহলেও বলব বাহাদুরি আছে বটে খেলনা প্রস্তুতকারকের।’
হোমস বললে, ‘ক্রিস্টালকে নানান দিক থেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখা যাক পট পরিবর্তন ঘটে কি না।’
সেই পরীক্ষানিরীক্ষাই চলল কিছুক্ষণ ধরে। নানান কোণ থেকে নানানভাবে দৃষ্টিশর নিক্ষেপ করা হল অদ্ভুত ক্রিস্টালের মধ্যে। কখনও মনে হল দূরবিস্তৃত ছাদ আর আকাশচুম্বী মাস্তুল ছাড়াও যেন আরও কিছু চোখে পড়ছে… কিন্তু অতিশয় আবছাভাবে; কখনও পুঞ্জ পুঞ্জ নীলাভ কুয়াশা ছাড়া কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না।
এইভাবেই কিছুক্ষণ এক্সপেরিমেন্ট চালানোর পর হোমস বললে, ‘নিরন্ধ্র অন্ধকার হলে কি ভালো দেখা যাবে বলে মনে হয়?’
‘সম্ভাবনাটা আমার মাথাতেও এসেছে,’ যেন নাভির মধ্যে থেকে জবাব দিলেন চ্যালেঞ্জার গুরুগুরু কণ্ঠে, ‘কিন্তু সে চেষ্টা অন্ধকার সমাগমে করা যাবে-খন। এই মুহূর্তে একটা সিদ্ধান্তে তুমি এবং আমি দুজনেই একমত… যা দেখছি, তা এই পৃথিবীর ওপরকার কোনও দৃশ্য নয়। একমত হচ্ছি ঠিকই… কিন্তু সিদ্ধান্তটাকে যাচাই করতে তো পারছিই না, ফেলেও দিতে পারছি না।’
ঝটিতি জবাব দিল হোমস, ‘চ্যালেঞ্জার, খেয়াল রাখবেন… সিদ্ধান্তটা নিছক অনুমান ভিত্তিক… যুক্তিভিত্তিক নয়। তবে হ্যাঁ, যা দেখেছি, তা যেন সামনের ওই মাস্তুলদের মতো কোনও একটা তালঢ্যাঙা মাস্তুলের ওপর থেকেই দেখছি। সারবন্দি মাস্তুলদের শেষ কোনও মাস্তুলের ডগা থেকে যেন সব কিছু চোখে পড়ছে।’
সায় দিলেন চ্যালেঞ্জার একবাক্যে, ‘আমারও ধারণা তা-ই।’
হোমস উঠে পড়ল, ‘আমার অন্য কাজ আছে, চললাম। আপনি কিন্তু এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যান।’
‘সেটা না বললেও চলবে।’
নিষ্ক্রান্ত হল শার্লক হোমস। প্রফেসর চ্যালেঞ্জার যেন দুর্ধর্ষ শত্রুর ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতোই দ্বিগুণ বিক্রম নিয়ে আক্রমণ করলেন বিজ্ঞানের বিস্ময় সেই ক্রিস্টালকে।
মগজের যাবতীয় শক্তি ফোকাস করলেন সেইদিকে। কী পেলেন, তা যথাসময়ে বর্ণিত হবে।
শার্লক হোমস রাস্তায় নেমে হাতছানি দিয়ে দাঁড় করাল একটা চলমান ছ্যাকড়াগাড়িকে। সেই গাড়িতে আরোহণ করে পৌঁছাল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। দু-দুটো অতি জটিল ক্রাইম কেস নিয়ে মস্তিষ্ক ঘর্মাক্ত করে জ্ঞানদান করল অফিসারদের। সেখান থেকে আপন আলয়ে ফিরে নিজস্ব মতামত লিখে রাখল অপরাধ রহস্য দুটির ওপর… ক্রিস্টাল রহস্যকে নির্বাসন দিল মস্তিষ্কের সব ক-টা খুপরি থেকে। তারপর নৈশ আহারে বসল বন্ধুবর ডাক্তার ওয়াটসনের সঙ্গে। মত্ত হল বিশ্রম্ভালাপে রোজকার মতো… কিন্তু ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করল না ক্রিস্টাল এবং তার মধ্যে দেখা অপার্থিব দৃশ্যের।
পরের দিন সকালে ওয়াটসন রওনা হল রোগী দেখার অভিযানে। হোমস গেল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ক্রাইম কেস দিয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলিকে উত্তেজনা জোগাতে। ফিরে এসে দেখল, বেকার স্ট্রিটে সাদামাটা ঘরটিতে বসে প্রফেসর এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জার। শুধু বসে নেই, বলতে গেলে ছটফট করছেন। আত্যন্তিক উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়তে চাইছেন। কখনও চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠছেন। ঘরময় পায়চারি করছেন। ফের এসে ধপ করে কাষ্ঠাসনে দেহভার ন্যস্ত করে বন্দুক নির্ঘোষের মতো ভীষণ শব্দে আঙুল মটকাচ্ছেন।
শার্লক হোমসের দীর্ঘ শীর্ণদেহ কক্ষমধ্যে আবির্ভূত হতেই প্রফেসর চ্যালেঞ্জার প্রকাণ্ড গরিলার মতো ধেয়ে এলেন তার দিকে।
বললেন রাশভ কণ্ঠে, ‘হোমস তোমার অবর্তমানে তোমার ল্যান্ডলেডির কৃপায় বসবার সুযোগ পেয়েছি ঘরে। ঘরটা যদিও বড় অগোছালো, কিন্তু না এসে পারলাম না। কেন জানো?’
‘কেন?’ দৃষ্টি সূচ্যগ্র হয়ে এল হোমসের, প্রশান্ত রইল কিন্তু কণ্ঠস্বর।
‘ঠিকই ধরেছ তুমি… ক্রিস্টালের মধ্যেকার দৃশ্য অন্য কোনও গ্রহের। কোন গ্রহ আমি তা বের করে ফেলেছি।’
এবার আর প্রশান্ত রইল না হোমসের কণ্ঠস্বর। উত্তেজনার বিস্ফোরণ ঘটল যেন দ্রিমি দ্রিমি স্বরে, ‘মাই ডিয়ার চ্যালেঞ্জার, বলছেন কী?’
‘মাই ডিয়ার হোমস, ওই রকমই বলি আমি। তোমার ভাষায় যাকে বলা যায়… চমকপ্রদ, অসাধারণ, অদ্ভুত। আমার গবেষণাগার থেকে প্রস্থান করার সময়ে একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রেখে গেছিলে— ক্রিস্টালটাকে যেন নিরন্ধ্র অন্ধকারের সুযোগে অবলোকন করা হয়। আমি তা-ই করেছিলাম। ফোটোগ্রাফাররা যে ধরনের পুরু কালো কাপড় দিয়ে নিজের মাথা আর ক্যামেরার আইপিস ঢেকে ছবি তোলে, সেই ধরনের মোটা কালো কাপড় দিয়ে ক্রিস্টাল আর নিজের মাথা ঢেকেছিলাম যাতে আলোকরশ্মি একেবারেই না প্রবেশ করতে পারে। ফলে আমি যতটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম, ততটা স্পষ্ট তুমি নিজেও আজ সকালে দেখতে পাওনি। আমি দেখলাম, রজনীর আবির্ভাব ঘটেছে অজানা সেই গ্রহে। তাই দেখলাম না সেই বিচিত্র নিসর্গ দৃশ্য— কিন্তু দেখলাম আকাশের কালো চন্দ্রাতপে মিটমিট করছে অগুনতি নক্ষত্র। মাই ডিয়ার শার্লক হোমস, পিলে চমকানো আবিষ্কারটা করলাম ঠিক তখনই… একটা পরম সত্যের মণিকোঠার দ্বার নিমেষমধ্যে উদ্ঘাটিত হয়ে গেল আমার মনের মণিকোঠার সামনে।’
উদগ্র উত্তেজনায় পৃষ্ঠবংশ বেঁকিয়ে হোমস বললে, ‘কী সেই পরম সত্য, মাই ডিয়ার প্রফেসর চ্যালেঞ্জার?’
মঞ্চের নায়কের মতো বীরোচিত ভঙ্গিমায় প্রশস্ত বুক চিতিয়ে নাটকীয় কণ্ঠে বললেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার, ‘ছাদের ঠিক মাথায় যেখানে রাশি রাশি তারা চোখ মিটমিট করে চেয়েছিল আঁধার পানে, তারাদের সেই দঙ্গলের মধ্যে দৃষ্টি সঞ্চালন করতেই আবিষ্কার করলাম সপ্তর্ষি মণ্ডলকে, দেখলাম সাত তারাকে। বলো, কী বুঝলে?’
‘গ্রহটা পৃথিবী গ্রহ না হলেও পৃথিবীরই প্রতিবেশী কোনও গ্রহ… তাই একই তারকামণ্ডলীকে দেখা যাচ্ছে আকাশে।’
‘এগজ্যাক্টলি। সাত তারার এই নক্ষত্রকে দেখতে একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন বা খড়্গের মতো। অজানা গ্রহের আকাশেও দেখলাম সেই একই ঝিকিমিকি জিজ্ঞাসা চিহ্ন। সপ্তর্ষিকে চৈত্র-বৈশাখ মাসের সন্ধ্যায় উত্তর আকাশের খুব ওপরে দেখতে পাওয়া যায়। জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় শ্রাবণে ক্রমেই পশ্চিমে সরে আসে। শেষে ভাদ্র থেকে অঘ্রাণ মাস পর্যন্ত আকাশে দেখাই যায় না। পৌষ মাসে দেখা যায় উত্তর-পূর্ব আকাশে। হোমস, মাসগুলোর নাম শুনে তোমার খটমট লাগছে বুঝতে পারছি… কিন্তু বাংলায় নামগুলো বললাম সপ্তর্ষি নিয়ে অদ্ভুত একটা কাহিনি মনে পরে গেল বলে। যদি পারমিট করো তো বলতে পারি।’
ভ্রূকুঞ্চিত করে হোমস বললে, ‘সংক্ষেপে সারুন।’
‘ভারতীয় পুরাণ পড়েছ? পড়োনি? অন্যায় করেছ। আমার মতে প্রতি বৈজ্ঞানিকের উচিত ভারতীয় পুরাণ কণ্ঠস্থ রাখা। তুমি অবশ্য বৈজ্ঞানিক নও। কিন্তু অপরাধ-বিজ্ঞানী তো বটে। আচ্ছা আচ্ছা, সংক্ষেপেই সারছি এবার। পুরাণের মতে উত্তানপাদ রাজার পুত্র ধ্রুবর নামে হয়েছে ধ্রুবতারা। ধ্রুবর মতো সাতজন ঋষিও আকাশে তারা হয়ে আছেন। তাঁদের নামেই এই সাতটি তারার নাম… বশিষ্ঠ, মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলহ, পুলস্ত্য আর ক্রতু। সপ্তর্ষির মাথার তারা দুটোকে মনে মনে একটা লাইন দিয়ে যোগ করে সেই লাইনটাকে সামনের দিকে বাড়িয়ে গেলেই ধ্রুবতারার পাশ দিয়ে যাবে। সপ্তর্ষি যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, এই লাইন ধ্রুবতারার পাশ দিয়ে যাবেই মাই ডিয়ার হোমস, এই ভাবেই অজানা গ্রহের আকাশে খুঁজে পেলাম ধ্রুবতারাকেও। এমনকী বশিষ্ঠ মুনির স্ত্রী অরুন্ধতী তারাকেও দেখলাম অস্পষ্টভাবে বশিষ্ঠের পাশেই। এর পরে আর কোনও সন্দেহই রইল না, যে যা দেখছি তা এই সৌরজগতেরই কোনও গ্রহের আকাশ।’
‘হুম!’ গলার মধ্যে দিয়ে শব্দটাকে ফের বার করল হোমস, ‘হুম।’
চ্যালেঞ্জার বললেন, একটু ভুরু কুচকেই বললেন, ‘প্লিজ, আমার কথার মধ্যে ওই রকম হুম হুম আওয়াজটা আর ছেড়ো না।… যা বলছিলাম সপ্তর্ষিমণ্ডল এবং অন্যান্য তারকামণ্ডলও চেনাজানা। কিন্তু এর পরেই যা ঘটল, তা এমনই সৃষ্টিছাড়া যে দেখেই প্রথমে চমকে উঠেছিলাম, সত্যি কথা বলতে কী, দু-চোখ কপালেও তুলে ফেলেছিলাম। সৃষ্টিছাড়া হলেও জিনিস দুটো অকাট্য প্রমাণ… তোমার অনুমানের নিরেট যুক্তি।’
এই পর্যন্ত বলে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার স্তব্ধ হলেন এবং শব্দ করে দুই করতল লাগলেন।
শার্লক হোমস তখন যেন নাচার হয়েই বললে, ‘মাই ডিয়ার চ্যালেঞ্জার, আমার হুম বিস্ময়োক্তিটা আপনার কাছে যতখানি পীড়াদায়ক, তার চাইতেও বেশি পীড়াদায়ক আপনার ওই হাতঘষার শব্দটা আমার কাছে।’
‘তা-ই নাকি?’ ঘন ভুরু নাচিয়ে বললেন চ্যালেঞ্জার।
‘আজ্ঞে, হ্যাঁ। তা ছাড়া, কথা বলতে বলতে ঠিক কাজের কথার জায়গায় এসে থেমে যাওয়াটাও ঠিক নয়… এতে চিন্তার ট্রেন উলটে যায়।’
‘আচ্ছা!’ ফের ভুরু নৃত্য করেই বললেন প্রফেসর, ‘কদ্দূর বলেছিলাম?’
‘দুটো জিনিস দেখেছিলাম… অকাট্য প্রমাণ।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আশ্চর্য গ্রহের আকাশে দুটো জিনিস। হঠাৎ দিগন্তে চাঁদ উঠল। একটা নয়, দুটো। দুটোই খুব ছোট, রীতিমতো এবড়োখেবড়ো পৃষ্ঠদেশ; এদের একটা এত জোরে উঠে এল এবং এমন পাঁইপাঁই করে গ্রহ পরিক্রমা শুরু করে দিলে যে আমি নিজেও দেখতে পেলাম তার দ্রুত গতি। দেখতে দেখতে ডবল চাঁদ সরে গেল দৃষ্টিপথ থেকে।’ ভীমবেগে বাম করতলে ডান মুষ্ট্যাঘাত করে বললেন চ্যালেঞ্জার, ‘ভায়া… হোমস, অকাট্য প্রমাণটা কী, এবার বুঝেছ?’
গম্ভীর হয়ে গেল হোমস।
বলল, ‘বুঝেছি। সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখা মানে সৌরজগতের আকাশ দেখা। আর যমজ চাঁদ দেখা মানে মঙ্গলগ্রহের আকাশ দেখা। তারাদের প্রতিবেশী রক্তরাঙা গ্রহ মঙ্গলের আকাশেই কেবল দেখা যায় ডবল চাঁদ… ডিমোস আর ফোবোস।…’
‘হোমস, মঙ্গল গ্রহের প্রাকৃতিক দৃশ্যই দেখেছি আমরা… যমজ চাঁদই অকাট্য প্রমাণ।’ প্রকাণ্ড মাথা নেড়ে সায় দিলেন প্রফেসর।
‘সূর্যের অস্তিত্বের মতোই অকাট্য এবং পরম সত্য।’
ঠিক এই সময়ে টোকা পড়ল দরজায়। মুখ বাড়িয়ে বিলি বললে, ‘মিস্টার হোমস, এক ভদ্রলোক এসেছেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে।’
বিলির কথা শেষ হতে না হতেই পাল্লা আরও ফাঁক করে সুট করে ভেতরে ঢুকে পড়ল নার্ভাস প্রকৃতির এক টেকো পুরুষ। এক হাতে টুপিটা নিয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না… চালান করছে ডান হাত থেকে বাঁ হাতে, আবার বাঁ হাত থেকে ডান হাতে। টুপিটা যেমন নোংরা, তেমনি বদখত।
‘স্যার,’ কেশেটেসে গলা সাফ করে নিয়ে বললে আগন্তুক, ‘আমি বল্ডুইন বলছি।’
শুষ্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুষ্কতর কণ্ঠে বলল শার্লক হোমস, ‘চিনতে পেরেছি।’
আরও ঘাবড়ে গেল বল্ডুইন।
‘আপনি কি খুবই ব্যস্ত?’
‘একটু।… দু-মিনিট সময় দেওয়া যাবে আপনাকে।’
তড়বড় করে উঠল বল্ডুইন, ‘স্যার, ক্রিস্টাল ডিমটার দাম পাঁচ পাউন্ড নয়… অনেক বেশি।’
‘হতে পারে। কিন্তু বেচেছেন পাঁচ পাউন্ডে… দামটা চড়াতেও এসেছেন অনেক দেরিতে।’
‘মর্স হাডসন বলছিল, আরও বেশি দাম পাওয়া যাবে দুই ভদ্রলোকের কাছে। একজন সেন্ট ক্যাথরিন হাসপাতালের মিস্টার জ্যাকব ওয়েজ। আর একজন জাভার প্রিন্স অফ বসো-কুনি। দুজনেই টাকার কুমির। এঁদের কাছ থেকে দুটো পয়সা বেশি লাভ করলে আমি আর মর্স হাডসন ভাগাভাগি করে নিতে পারতাম।’
কঠোর হল শার্লক হোমসের ধূসর চক্ষু, চোয়ালের হাড় এবং কণ্ঠস্বর, ‘বল্ডুইন, মর্স হাডসনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে জেলে যাওয়ার পথটা আপনি নিজেই পরিষ্কার করে রেখেছেন। চোরাই আংটি যদি আপনার দোকানঘরে ফেরত না দিত, আপনাদের দুজনকেই শ্রীঘর দর্শন করিয়ে ছাড়তাম। আর, এখন তার উশকানিতে বেশি মুনাফার লোভে যে জিনিসটা ফেরত নিতে এসেছেন আমার দখলে আর তা নেই।’
গুড়গুড় করে মেঘ ডাকা গলায় চ্যালেঞ্জার বললেন, ‘খাঁটি কথাই বলেছেন মিস্টার হোমস। জিনিসটা ওঁর দখলে আর নেই।’
ফোঁস করে উঠল বল্ডুইন, ‘বুঝব কী করে যে উনি খাঁটি কথা বলেছেন? তা ছাড়া আমাদের কথায় আপনি ফোড়ন দিতে আসছেন কেন? আপনাকে তো আমি চিনি না।’
আর যায় কোথা! তড়াক করে গরিলা সদৃশ বপু নিয়ে অবিশ্বাস্য বেগে চেয়ার থেকে ছিটকে গেলেন প্রফেসর, ‘কী! আমার কথায় অবিশ্বাস। বৎস ইঁদুর, আমার নাম জর্জ এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জার। হোমস, পথ ছাড়ো— ইঁদুরটাকে এখান থেকেই সোজা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি রাস্তায়!’
সেই রুদ্র মূর্তি, বাজখাঁই কণ্ঠস্বর, নীল চোখের আগুন দেখেই প্রকৃতই ইঁদুরের মতো চক্ষের নিমিষে সড়াৎ করে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হল বল্ডুইন। ইঁদুর ছোড়ার এমন সুযোগ হাত ফসকে যাওয়ায় চ্যালেঞ্জার আরক্ত মুখে ফের আসন গ্রহণ করলেন চেয়ারে।
বললেন কালবৈশাখী গলায়, ‘রাসকেলটাকে যদি ধরতে পারতাম… যাকগে, ক্রিস্টাল নিয়ে আরও গবেষণার দরকার। হোমস, ব্যাপারটা আপাতত তোমার আমার মধ্যেই গোপন থাকুক— আর কাউকে বোলো না।’
‘সেকী! বৈজ্ঞানিক মহলের মতামত দরকার যে!’
‘বৈজ্ঞানিক মহল!’ চ্যালেঞ্জার মনে হল জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মতো গুমগুম করে উঠলেন, ‘তারা নতুন তত্ত্ব আর অভিনব তথ্যের বোঝে কী? বাগড়া দিতে জানে, তর্ক করতে জানে, মূর্খের দল!— না, হোমস, কাউকে না। আজ বিকেলে চারটের সময়ে এসো আমার বাড়িতে।’
‘আসব। ডাক্তার ওয়াটসনকে বলব? ওর মাথা কিন্তু সাফ।’
‘প্লিজ। এখন কাউকে নয়। আসি এখন।’