মঙ্গলের উড়ন্ত বিভীষিকা
সেইদিনই বিকেলে এনমোর পার্কের পড়াশুনার ঘরে ফের ক্রিস্টাল নিয়ে হাজির হলেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার এবং শার্লক হোমস। কালো কাপড়ের অবগুণ্ঠনে দুই স্বনামধন্য পুরুষ নিজেদের মুণ্ড ঢেকে দৃকপাত করলেন বিচিত্র ক্রিস্টালের পানে। বাইরের ছিটেফোঁটা আলো পর্যন্ত প্রবেশপথ খুঁজে পেল না ঘোমটার আড়াল দিয়ে।
যেই বন্ধ হল আলোর প্রবেশপথ, অমনি নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে দ্যুতি বিকিরণ শুরু করে দিলে ক্রিস্টাল বল। সাধারণ দ্যুতি নয়— যেন নীল আভা ঠিকরে বেরতে লাগল ভেতর থেকে। হোমসের ধারালো নাক চিবুক আলোকিত হল নীলাভ আভায়, আলোকিত হল চ্যালেঞ্জারের বিশাল দাড়ির জঙ্গল। দু-হাতের মধ্যে সন্তর্পণে ক্রিস্টালকে ঘুরিয়েফিরিয়ে সঠিক অবস্থায় আনবার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন প্রফেসর।
সফলও হলেন। আচম্বিতে দেখা গেল পুঞ্জ পুঞ্জ কুয়াশা। তালগোল পাকিয়ে সরে সরে যাচ্ছে কুয়াশা আবৃত দৃশ্যপট থেকে।
সোল্লাসে, কিন্তু চাপা গলায় বললেন চ্যালেঞ্জার, ‘আসছে।’
সত্যিই আসছে। অদ্ভুত সেই দৃশ্যপট, সেই নিসর্গ দৃশ্য, ফের ফিরে আসছে ক্রিস্টালের মধ্যে। দেখা যাচ্ছে লালচে-বাদামি রঙের দিগন্ত ছাওয়া পাহাড় শ্ৰেণি— যা কিনা দেখতে উঁচু বাঁধের মতোই, দেখা যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মের মতো বহুদূর বিস্তৃত মঞ্চের মতো। অবশেষে কুয়াশা আরও দূরীভূত হল— স্পষ্টতর হয়ে উঠল সারিবদ্ধ সুউচ্চ মাস্তুল শ্রেণি—প্রতিটির শীর্ষ দ্যুতিময়। নির্মেঘ গাঢ় নীল আকাশে সুস্পষ্টভাবে দেখা গেল টলটলে পরিষ্কার কিন্তু পাণ্ডুর সূর্যের মুখ।
চ্যালেঞ্জার বললেন, ‘পৃথিবীর ওপরে সূর্যের যে সাইজ, এ যে দেখছি তার অর্ধেক। কারণও আছে। খুব কাছাকাছি এলেও, পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে মঙ্গলের দূরত্ব সাড়ে তিন কোটি মাইল হয়। কাজেই মঙ্গলের আকাশে সূর্য তো ছোটই দেখাবে। আরে! আরে! ওরা কারা হোমস?’
নীচের ছাদে কারা যেন নড়ছে। গোল বর্তুলের মতো দেহ তাদের। চকচকে। চারপাশ দিয়ে বেরিয়েছে অনেকগুলো শুঁড়। এই শুঁড়ের ওপর ভর দিয়েই তারা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে লম্বাচওড়া আয়তাকার ক্ষেত্রের ওপর!
হোমসও দেখেছিল চলমান প্রাণীদের।
বললে পাতলা ঠোঁট শক্ত করে, ‘চ্যালেঞ্জার, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমরা যা কিছু দেখছি ওই মাস্তুলেরই কোনও একটার মাথা দিয়ে দেখছি। মাস্তুলগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়ির ছাদে। তাই দূরের জিনিস অত স্পষ্ট, কিন্তু নীচের কাছের দৃশ্য দেখতে একটু অসুবিধে হচ্ছে।’
রুদ্ধশ্বাসে চ্যালেঞ্জার বললেন, ‘ঠিকই বলেছ। আমারও তা-ই মনে হচ্ছে। সব বাড়ির ছাদেই অদ্ভুত প্রাণীরা টহল দিচ্ছে। ঠিক যেন অক্টোপাস, মাকড়শা, কাঁকড়ার দল। আরে গেল যা, এ যে দেখছি উড়তেও পারে!’
সহসা খুব কাছের একটা ছাদ থেকে বহু শুঁড় বিশিষ্ট গোল বলের মতন চকচকে কালো দেহ নিয়ে শূন্যে উঠে পড়ল একটা প্রাণী। বাদুড় যেমন চামড়া দিয়ে জোড়া প্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে উড়ে যায় পৃথিবীর আকাশে, অনেকটা সেইভাবেই আশ্চর্য কিন্তু বদখত সেই প্রাণীটা শূন্যে উড়ে গেল অবলীলাক্রমে— ক্ৰমশ ওপরে উঠতে উঠতে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল ক্রিস্টালের মধ্যে।
হোমস বলল, ‘ডানা নাড়ছে না কিন্তু।’
‘হয়তো নাড়ানোর মতো ডানা নয়— তাই নাড়ছে না।’
হোমসের দিকেই উড়ে আসতে আসতে হঠাৎ অন্যদিকে উড়ে গেল উড়ুক্কু প্রাণীটা। কাছের একটা মাস্তুলশীর্ষে পৌঁছে লিকলিকে শুঁড় দিয়ে মাস্তুল আঁকড়ে ধরে চেপে বসল ডগায়।
বিষম উত্তেজিত হয়ে চ্যালেঞ্জার বললেন, ‘হোমস! হোমস! খুঁটির ডগায় কী করছে বলো তো?’
‘আমরা যা করছি তা-ই। তার মানে আমরা যেমন ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে দেখছি— মঙ্গলের প্রাণী তেমনি দেখছে আমাদের।’
‘অ। এ নিয়ে তোমার সঙ্গে একমত হওয়ার আগে একটু তর্ক করতে চাই।’
‘পরে করবেন। ওই দেখুন, মঙ্গলের জীব এবার এদিকেই আসছে।’
বাস্তবিকই, কাছের মাস্তুলশীর্ষ ছেড়ে দিয়ে সটান যেন ওঁদের দিকেই উড়ে আসছে উড়ুক্কু জীবটা।
ঝড়ের বেগে চ্যালেঞ্জার বললেন, ‘অদ্ভুত ডানা তো— একদম নাড়ছে না।’
হোমস বললে শীতলকণ্ঠে, ‘ডানা নাও হতে পারে।’
‘তবে কী?’
‘মেশিন। ওড়বার যন্ত্র।’
‘রাবিশ। চেহারা যাদের পোকার মতো, তাদের আবার ওড়বার মেশিন; হোমস, কল্পনাকে বেশি ছুটিও না। আমার মতে, এটা হয় পুরুষ, না-হয় স্ত্রী। ব্যাটাছেলে অথবা মেয়েছেলেরা উড়তে পারে। তাই একদল ছাদে নড়ছে— উড়তে পারছে না। এসে গেছে।’
একদম কাছে এসে গেছে উড়ুক্কু প্রাণী। ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে দেখা গেল একজোড়া ভাঁটার মতো সুবিশাল চোখ যেন ওঁদের দিকেই চেয়ে রয়েছে নিষ্পলকে। পরমুহূর্তেই আরও কাছে এসে গেল মঙ্গলগ্রহী। ডানা আর দেখা গেল না— শুধু একজোড়া চোখ। তারপরেই ক্রিস্টালের বুক জুড়ে শুধু একজোড়া চোখ হিমশীতল চাহনি মেলে চেয়ে রইল ওঁদের দিকে।
এক লহমার জন্যে ঘটল এই কাণ্ড। মেরুদণ্ড পর্যন্ত শিরশির করে উঠল অপার্থিব সেই চাউনির সামনে।
পরক্ষণেই অন্ধকার হয়ে গেল ক্রিস্টালের ভেতরটা। একরাশ নীলাভ দ্যুতি কেবল ঠিকরে এল ভেতর থেকে। আর কিছু না।
কালো কাপড়ের ঘোমটা নিক্ষেপ করে চেয়ার ছেড়ে ছিটকে গেলেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। কাগজ পেনসিল এনে ধপাস করে বসলেন চেয়ারে।
বললেন রুদ্ধশ্বাসে, ‘হোমস, তুমিও লেখো। আমিও লিখি। এইমাত্র যা দেখলাম তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখে ফেলি অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্যে।’
সেকেন্ড কয়েক কাগজের কলম আর পেনসিল চলার খচমচ আওয়াজ এবং প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের সেই নাসিকাধ্বনি ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না।
তারপর পেনসিল নামিয়ে রেখে প্রফেসর বললেন, ‘মঙ্গলের একটা শহর দেখলাম এইমাত্র। দেখলাম তাদের ঘরবাড়ি। আর দেখলাম মঙ্গলের জীব, তাদের কেউ কেউ উড়তেও পারে। তারা পোকা শ্রেণির— তাই অমন অক্টোপাসের মতো দেহ।’
হোমস বললে, ‘চ্যালেঞ্জার। আপনি সইতে পারেন না— কিন্তু যুক্তি মানেন। সেই ভরসাতেই ফের বলছি— যে জীবটা উড়ে এসে আমাদের দেখে গেল— সে নিজে থেকে ওড়েনি, যন্তর লাগিয়ে উড়েছে। পোকা বলে তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করবেন না। মঙ্গলের সভ্যতা পৃথিবীর সভ্যতার চেয়ে অনেক এগিয়েছে বলেই তাদের বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমরা ধরতে পারছি না।’
‘কোন যুক্তিতে একথা বলা হল?’ থমথমে মুখে শুধালেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার।
হোমস বললে, ‘এককালে তিমি ডাঙায় ছিল— জলে গিয়ে তাদের ডাঙায় উপযুক্ত প্রত্যঙ্গগুলো প্রায় অদৃশ্য হয়ে এসেছে। মঙ্গলের বুকে যাদের বদখত বপু দেখে পোকা বলছেন, অক্টোপাস বলছেন— কে জানে বিরাট ওই দেহের মধ্যে তাদের ব্রেনটা এত বিরাট বলে লক্ষ লক্ষ বছর কেবল ব্রেনটা খাটিয়ে গেছে, হাত-পায়ের মতো প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করেনি বলে তারা আজ লিকলিকে শুঁড় হয়ে গিয়েছে।’
ঘোঁৎ করে শব্দ করে দাড়ি চুলকে প্রফেসর বললেন, ‘মন্দ বলোনি। যুক্তি জিনিসটা আমিও মানি। হোমস, তোমার খাঁটি বিজ্ঞানের লাইনে আসা উচিত ছিল।’
কাষ্ঠ হেসে হোমস বললে, ‘বিজ্ঞানের লাইনে আমিও আছি। এর নাম সায়েন্স অব ডিডাকসন— অবরোহ বিজ্ঞান। কিন্তু প্রশ্ন তা নয়, চ্যালেঞ্জার।’
‘তবে কী, ভায়া শার্লক হোমস?’
জবাবটা দেওয়ার আগে আর একবার ক্রিস্টালের মধ্যে তাকানো যাক।’
কথা বলতে বলতেই কালো ঘোমটা দিয়ে নিজের আর চ্যালেঞ্জারের মুণ্ড ঢেকে ক্রিস্টালের মধ্যে তাকাল হোমস। আবার দেখা যাচ্ছে মঙ্গলের দৃশ্য। লাল পাহাড়। ঘন নীল আকাশ। পাণ্ডুর সূর্য। ছাদ, মাস্তুল, দ্যুতিময় শীর্ষ। ছাদে টহল দিচ্ছে ঢিবির মতো থলথলে প্রাণীরা। হঠাৎ একটা প্রাণী উড়ল শূন্যে। কিছুক্ষণ এ-মাস্তুল সে-মাস্তুল দেখে এসে ছাদের কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ ডানা খসিয়ে ধপ করে নেমে পড়ল ছাদের ওপর।
সঙ্গে সঙ্গে বিকট চিৎকার করে উঠে দড়াম করে টেবিল চাপড়ে চ্যালেঞ্জার বললেন, ‘হোমস, তোমার বৈজ্ঞানিকই হওয়া উচিত ছিল। ঠিকই ধরেছ তুমি— ডানাটা নকল— উড়বার যন্ত্র।’
ঘোমটা দিয়ে ক্রিস্টাল চাপা দিয়ে মুখ তুলল হোমস। ‘দু-টুকরো হিরের মতো জ্বলছে দুই চক্ষু!’
বললে চোয়াল শক্ত করে চ্যালেঞ্জার, ‘প্রশ্নটা এবার বলি। কী চায় ওরা?’
‘কী আবার চায়?’
‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা যেমন ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে ওদের দেখছি— ওরাও তেমনি মাস্তুলের ডগায় লাগানো ক্রিস্টাল দিয়ে আমাদের ওপর নজর রাখছে। কিন্তু কেন?’
ঝোপের মতো দুই ভুরু কুঁচকে বললে প্রফেসর, ‘বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা আছে বলে। পৃথিবী নামক গ্রহে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের মতো এতবড় বিরাট ব্রেনওয়ালা বৈজ্ঞানিক যখন আছে, তখন মানুষ জাতটাও নিশ্চয় পর্যবেক্ষণের বস্তু।’
আনমনা হয়ে গেল হোমস। বললে আপন মনে, ‘ওদের ক্রিস্টাল পৃথিবীতে এল কীভাবে? কেন?’
‘আফ্রিকার বর্বররা যেমন ইউরোপের কাণ্ডকারখানা বুঝতে পারে না—আমরাও হয়তো সেই অবস্থায় রয়েছি, হোমস।’
হোমস প্রফেসরের চোখে চোখ রেখে বললে আস্তে আস্তে, ‘ওদের ক্রিস্টাল পৃথিবীতে পৌঁছেছে আগে। নজরও রাখছে ওরা আমাদের ওপর— এরপর কি ওরা নিজেরাই আসবে এই গ্রহে?’
প্রদীপ্ত হল চ্যালেঞ্জারের নীল চক্ষু, ‘পৃথিবী আক্রমণ!’
ঠোঁট টিপে রইল শার্লক হোমস।