ক্রিস্টাল কবে এসেছিল পৃথিবীতে?
নাওয়া-খাওয়া উড়ে গেল চ্যালেঞ্জার এবং হোমসের। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দু-চারটে কেস নিয়ে একটু মাথা ঘামিয়ে চ্যালেঞ্জারের স্টাডিরুমে দৌড়ে আসা আরম্ভ হল হোমসের। চ্যালেঞ্জারও নিবন্ধ লেখা বন্ধ রেখে যখন-তখন মাথায় কালো কাপড় চাপিয়ে দিনের মধ্যে প্রায় ষোলো ঘণ্টা চেয়ে রইলেন ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে মঙ্গলগ্রহের শহরের দিকে। চ্যালেঞ্জার-গৃহিণী স্বামীর পাগলামি জানতেন। জিজ্ঞাসাও করলেন না হঠাৎ পড়ার ঘরে হোমসকে নিয়ে দিনরাত বসে থাকা হচ্ছে কেন।
এইরকমই একদিন হোমস পুরোনো প্রশ্নটাই নতুন করে জিজ্ঞাসা করেছিল চ্যালেঞ্জারকে, ‘ক্রিস্টালটা পৃথিবীতে এল কীভাবে? কবে?’
প্রফেসর বললেন, ‘ভায়া, বিষয়টা নিয়ে আমি মাথা ঘামিয়েছি। আমার এই বিরাট ব্রেন যখন কোনও বিষয় ভাবে, তখন তার সুরাহা করে তবে ছাড়ে।’ —বলে, সমর্থনের আশায় প্রোজ্জ্বল চোখে চাইলেন হোমসের পানে।
চ্যালেঞ্জারের আত্মম্ভরিতা বিশ্ববিখ্যাত। অহংকারে মটমট করছেন— শিবের মাথায় বেলপাতা দিলেই যেমন খুশি, চ্যালেঞ্জারের কাছে একটু প্রশস্তি তার চাইতেও বেশি কাজ দেয়।
ধুরন্ধর হোমস তাই তক্ষুনি বললে, ‘বিলক্ষণ। আপনার সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকরা কেবল আপনাকে চিনতে পারল না, এইটাই যা দুঃখ।’
‘ছেড়ে দাও ওসব ইডিয়টদের কথা। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ১৮৯৪ সালে একটা প্রচণ্ড বিপর্যয় দেখা গিয়েছিল মঙ্গলের বুকে। হয়তো তখনই তড়িৎশক্তি অথবা ওই ধরনের কোনও শক্তি মারফত ক্রিস্টালদের পাঠানো হয়েছে পৃথিবীতে।’
‘ক্রিস্টালদের।’
‘তা নিশ্চয়। সাত বছর ধরে যারা অত খুঁটি পুঁতে আমাদের ওপর নজর রাখছে, তারা কি একটা ক্রিস্টাল এত ঝামেলা করে পাঠাবে? কক্ষনো না— যত খুঁটি দেখেছি, ততগুলো ক্রিস্টাল কি তারও বেশি এসে পড়েছে পৃথিবীর নানান জায়গায়। সারা পৃথিবীর ছবি ওরা কত বছর ধরে দেখে আসছে খুঁটিদের মাথায় লাগানো নিজেদের ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে।’
‘উদ্দেশ্য?’
‘পৃথিবী আক্রমণ!’
‘ও তো গল্পকথায় অনেক পড়েছি।’
‘অনেক গল্পকথাই তো শেষ পর্যন্ত সত্যি হয় হোমস। মঙ্গলের বুকে খাল দেখে ১৮৭৭ সালে যখন জল্পনা-কল্পনা আরম্ভ হয়েছিল, তখন তো গল্পকথাই বলা হয়েছিল সব ব্যাপারটাকে। কিন্তু আমরা তো নিজেদের চোখে দেখেছি টানা লম্বা খাল রয়েছে শহরের ঠিক পাশেই।’
হোমসের চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য। ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে দেখা দৃশ্য। দূরে লাল পাহাড়। কাছে আয়তাকার ছাদের পর ছাদ, পাশে সবুজ মাঠ। তারও ওদিকে সুদীর্ঘ জলপথ। খাল। মাঠে চলমান মঙ্গলগ্রহীদের যন্ত্রযান। বিভিন্ন সাইজের, বিভিন্ন আয়তনের। বেশির ভাগই মনে হয় স্বয়ংচালিত। কোনও মঙ্গলগ্রহী নেই আশপাশে। তারা কেউ শুঁড়ের উপর ভর দিয়ে হাঁটছে মন্থরগতিতে— কেউ নকল ডানা লাগিয়ে উড়ছে এ-খুঁটি থেকে সে-খুঁটিতে। কর্মব্যস্ততা সর্বত্র। গমগম করছে মঙ্গলের শহর।
চ্যালেঞ্জারের গমগমে গলায় সংবিৎ ফিরল হোমসের, ‘ভায়া কী ভাবছ?’
‘ভাবছি, এতবড় শহর, এত প্রাণী— অথচ এতদিন শুনেছিলাম মঙ্গলে বাতাস নেই, জল নেই।’
‘কিন্তু এখন তো জল দেখলে। বাতাসটা নিশ্চয় ওরা তৈরি করে নিচ্ছে।’
‘মঙ্গলের জীবরা?’
‘হ্যাঁ। লাল মাটি মানেই অক্সিডাইজড মাটি। ওই বাড়িগুলো আসলে ওদের কলকারখানা। দেখেছ তো এমনভাবে তৈরি যে বাইরে থেকে চট করে ভেতরে ঢোকা মুশকিল। আমার মনে হয় ওই কলকারখানার মধ্যেই বড় বড় মেশিনে মাটি থেকে অক্সিজেন বার করে নিয়ে নকল হাওয়া তৈরি করে বেঁচে আছে মঙ্গলগ্রহীরা।’
‘লোকে শুনলে কিন্তু উদ্ভট কল্পনা বলবে।’
বলেই হোমস বুঝল বেফাঁস কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বজ্রগর্জনে কড়িকাঠ পর্যন্ত কাঁপিয়ে চ্যালেঞ্জার টেবিলে দমাদম ঘুসি মারতে মারতে বললেন, ‘কোন বেল্লিকটা বলে সেকথা?’
অত ঘুসি খেয়ে নিষ্প্রাণ টেবিল পর্যন্ত শিউরে উঠল যেন। ক্রিস্টাল গড়িয়ে গেল ওপর থেকে, কিন্তু মাটিতে পড়ার আগেই খপ করে লুফে নিয়ে হোমস বললে, ‘আপনাকে যারা দেখতে পারে না— সেই পিগমি বৈজ্ঞানিকরা।’
আগ্নেয়গিরি নিভে গেল সঙ্গে সঙ্গে। গজরাতে গজরাতে চ্যালেঞ্জার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘দাও ক্রিস্টালটা।’