মঙ্গলে অগ্ন্যুৎপাত?
ডিসেম্বর গড়িয়ে গিয়ে জানুয়ারি এসে গেল। সালটা ১৯০২। মে মাস শুরু হল। দীর্ঘ এই ক-টি মাস শার্লক হোমস ব্যস্ত রইল চোর-ডাকাত-খুনে-গুন্ডাদের রহস্য নিয়ে। ফাঁকে ফাঁকে দৌড়ে যেত চ্যালেঞ্জারের বাড়িতে। গিয়ে দেখত যোগীবরের মতো ক্রিস্টাল নিয়ে মঙ্গলের চেহারা দেখে চলেছেন ভদ্রলোক। আর লিখে চলেছেন পাতার পর পাতা।
ক্রিস্টাল রহস্য কিন্তু আর কেউ জানল না। প্রফেসরের কড়া নির্দেশে ডাক্তার ওয়াটসনকে পর্যন্ত হোমস কিছু বলল না। প্রফেসরের সহধর্মিণীও কিছু জানলেন না।
কিন্তু মে মাসের তেরো তারিখে জেনে গেল পৃথিবীর মানুষ বিস্ময়কর অগ্নুৎপাত শুরু হয়েছে মঙ্গলের বুকে। ব্রেকফাস্ট টেবিলে খেতে খেতে ওয়াটসনই প্রথম দেখল খবরটা খবরের কাগজে। জাভার একটা মানমন্দির থেকে দেখা গেছে, আগের দিন মধ্যরাত্রে অকস্মাৎ ঠিক যেন কামান থেকে আগুনের রাশি ছুটে আসার মতো অগ্নিবর্ষণ ঘটেছে মঙ্গলগ্রহের বুকে। স্পেকটোগ্রাফ বিশ্লেষণ করে অবশ্য জানা গেছে, অতি-উত্তপ্ত হাইড্রোজেন ঠিকরে বেরুচ্ছে মঙ্গলপৃষ্ঠ থেকে, ভয়ংকর বেগে ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে। পনেরো মিনিটের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে রহস্যময় অগ্নিদ্যুতি।
খবরটা পড়ে শুনিয়েই একটা মিটিং অভিমুখে দৌড়াল ওয়াটসন। হোমসও উঠে গিয়ে টেলিফোন করল প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকে।
রিসিভার ধরলেন প্রফেসর স্বয়ং, ‘হোমস নাকি? চলে এসো। দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো খবর পরিবেশনের সময় এবার হয়েছে। স্টেন্টকে ডেকে পাঠিয়েছি— জ্যোতির্বিদ স্টেন্ট।’
চ্যালেঞ্জারের বাড়ি গিয়ে হোমস কিন্তু দেখল তুমুল কিছু একটা হয়ে গিয়েছে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছটফট করছেন প্রফেসর-জায়া। হোমসকে দেখেই দৌড়ে এসে বললেন, ‘এক্ষুনি যান— জর্জকে থামানো যাচ্ছে না।’
ওপরতলায় গিয়ে হোমস দেখল রুদ্রমূর্তিতে পায়চারি করছেন জর্জ এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জার। কী ব্যাপার? না, সেন্ট নামধারী জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টালের মধ্যে বিস্ময়কর দৃশ্যটি দেখবার পর প্রফেসরকে রবার্ট হুডিনির মতো প্রতিভাধর ম্যাজিসিয়ান বলেছিলেন এবং ম্যাজিক লণ্ঠনের চাইতে অদ্ভুত যন্ত্র আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছিলেন। চ্যালেঞ্জার এই কৃতিত্ব গ্রহণ করতে পারেননি। ভদ্রলোককে সবলে দোতলা থেকে একতলায় ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্যে শুধু উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু মনোভাব ব্যক্ত করার আগেই এবং তা কার্যে পরিণত করার আগেই নাকি ভীতু খরগোশের মতো পড়-পড় করে দৌড়ে পালিয়েছেন স্টেন্ট। এ কী অসভ্যতা? সৌজন্য বলে জিনিসটা কি জানা নেই স্টেন্টের? বাড়ি থেকে বিদেয় হওয়ার আগে বিদায় নিতে হয় গৃহস্বামীর কাছে, এটা কি শিখিয়ে দিতে হবে?
ক্ষিপ্ত প্রফেসরকে ঠান্ডা করে ক্রিস্টালের মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চমকে উঠল শার্লক হোমস।
মঙ্গলের দৃশ্য তো আর দেখা যাচ্ছে না। এ তো একটা ধাতব কক্ষ। অদ্ভুত যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে কক্ষের গায়ে। চৌকোনা ঘর নয়— চোঙার মতো। মেঝের ওপর নিমেষহীন নয়নে তাকিয়ে নেতিয়ে পড়ে রয়েছে কয়েকটা মঙ্গলের প্রাণী। খুব কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে এবার। চামড়ার মতো গা ভিজে রয়েছে— চকচক করছে। শুঁড়গুলো এলিয়ে রয়েছে যন্ত্রপাতির ওপর। প্রায় নিস্পন্দ বললেই চলে বীভৎস জীবগুলোকে।
গা ঘিনঘিন করে উঠল হোমসের। বললে, ‘গা চকচক করছে কেন? ঘেমেছে নাকি?’
গুরুগম্ভীর কণ্ঠে প্রফেসর বললেন, ‘চামড়া থেকে গ্রন্থির রসক্ষরণ জাতীয় কিছু একটা হচ্ছে নিশ্চয়। মানুষের মতো মোটেই নয় এরা— সুতরাং এদের পাচনতন্ত্র এবং শরীর থেকে আবর্জনা বার করে দেওয়ার ব্যবস্থাও নিশ্চয় অন্য রকমের।’
ড্যাবডেবে চোখে চেয়েই রইল মঙ্গলের জীবরা। ঘুমোয় না নাকি? জলভরা চামড়ার থলির মতোই চকচকে দেহটা থেকে থেকে কেবল ফুলে উঠছে।
হোমস বললে, ‘মঙ্গলের দৃশ্য আর দেখা যাচ্ছে না কেন?’
‘কারণ ওরা আর মঙ্গলে নেই।’
‘তবে কোথায়?’
‘মহাশূন্যে। শূন্যপথে মহাকাশযানে চেপে ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে। পৃথিবী অভিযান শুরু করেছে মঙ্গলগ্রহীরা। এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম মাথামোটা স্টেন্টকে— আমাকে বলে কিনা ম্যাজিসিয়ান!’
কথাটা ঘুরিয়ে দিল হোমস, ‘কিন্তু পৃথিবীতে ওরা আসছে কেন?’
‘পৃথিবীকে জ্ঞান দিতে। অথবা পৃথিবীর জ্ঞান লুঠ করতে। দুটোই সমান বিপজ্জনক পৃথিবীর পক্ষে।’
‘বৈজ্ঞানিকদের তাহলে তো সজাগ করা দরকার?’
ফুঁসে উঠলেন প্রফেসর, ‘স্টেন্টের সঙ্গে ওই ঘটনার পরেও কি আমার আক্কেল হয়নি বলতে চাও? হোমস, পুরোধা যাঁরা হন চিরকালই তাঁদের এমনি হাসি টিটকারি বিদ্রুপ গালাগাল সহ্য করতে হয়েছে। জীবাণুর জন্যেই রোগ হয়, এই কথা বলতে গিয়ে পাস্তুর কি বছরের পর বছর বিদ্রুপের পাত্র হননি? গ্যালিলিওকে চূড়ান্ত শাস্তি পেতে হয়নি সূর্যের চারদিকে গ্রহরা ঘুরছে— এই কথা বলতে গিয়ে? ডারউইনের বিবর্তনবাদকে মিথ্যের ঝুড়ি বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়নি? মাই ডিয়ার হোমস, জর্জ এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জারও হাস্যাস্পদ হবে মঙ্গলগ্রহীরা পৃথিবী আক্রমণ করতে আসছে— এই কথা বললে। সুতরাং—’
সুতরাং মুখে চাবি দিয়েই রইলেন প্রফেসর। সেই সঙ্গে হোমস। কিন্তু সেই দিনই মধ্যরাত্রে ফের আগুনের ঝলক দেখা গেল মঙ্গলের বুকে। তারপরের দিন মধ্যরাত্রে আবার। তারপরেও আবার। এইভাবে ১২ মে মধ্যরাত্রি থেকে শুরু করে ২১ মে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত আগুনের পাহাড় থেকে আগুন ছিটকে যাওয়ার মতো, অথবা বিশাল কামান থেকে অগ্নিবর্ষণের মতো, মোট দশবার বিস্ময়কর অগ্নি বিচ্ছুরণ ঘটল মঙ্গলের বুকে। সারা ইউরোপ, সারা পৃথিবীর মানমন্দির থেকে দেখা গেল এই দৃশ্য।
এইচ জি ওয়েলস তাঁর বিখ্যাত “ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস” উপন্যাস লেখার আয়োজন করলেন প্রায় সেই সময় থেকেই।
রোজ রাত্রে এসে ক্রিস্টালের দিকে চেয়ে থাকে হোমস। মঙ্গলের জীবেরাও চোখের পাতা না ফেলে চেয়ে থাকত ওর পানে। দুজনে দেখছে দুজনকে। মঙ্গলগ্রহীর মুখ ভাবলেশহীন। হোমস উত্তেজিত। তারপর ফুস করে একসময়ে নিভে যেত ক্রিস্টালের আলো।
সঙ্গে সঙ্গে গাঁকগাঁক করে উঠতেন চ্যালেঞ্জার, ‘বুঝলে কারণটা? মঙ্গলের ওপর থেকে নিজেদের ক্রিস্টাল নিয়ে মহাকাশযানে চড়েছে মঙ্গলের জীব। দেখছে আমাদের প্রতিক্রিয়া। বুঝতে পারছে না পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটা মস্তিষ্কও মাথা ঘামাচ্ছে ওদের নিয়ে।’