নীল বিদ্যুৎ
২২ মে-র পর থেকে অগ্নিঝলক আর দেখা গেল না মঙ্গলের বুকে। কিন্তু ৬ জুন একটা টেলিগ্রাম এসে পৌঁছোল হোমসের নামে। পাঠাচ্ছে বৈদেশিক দপ্তর থেকে স্যার পার্সি ফেল্পস।
‘আজ সকালে ওকিং-এর কাছে একটা বিরাট চোঙা পড়েছে। বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, ভেতরে জীবন্ত প্রাণী রয়েছে। আজ সন্ধ্যায় চলো আমার সঙ্গে। সাহায্য দরকার।’
টেলিগ্রাম পেয়েই সটান চ্যালেঞ্জারের বাড়ি গেল হোমস। প্রফেসর বাড়ি নেই— ওকিং গেছেন।
সন্ধে নাগাদ স্যার পার্সির সঙ্গে ওকিং-গামী ট্রেনে চেপে বসল শার্লক হোমস।
ওকিং শহর আর হরসেল এবং ওটারশ গ্রামের মাঝখানে বিরাট একটা তেপান্তরের মাঠ আছে। শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে এই মাঠের মধ্যিখানে একটা মস্ত গর্ত দেখা দিয়েছে রাতারাতি। আকাশ থেকে জ্বলন্ত গোলা এসে পড়েছে নাকি সেইখানে।
গাঁয়ের লোক এবং শহরের লোক ছুটে এসেছিল রগড় দেখতে। জ্বলন্ত গোলা ঠান্ডা হয়ে যেতে দেখা গিয়েছিল একটা অতিকায় চোঙা। চোঙার ডালাও নাকি একসময়ে খুলে গিয়েছিল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে এবং আবির্ভূত হয়েছিল মাকড়শা অথবা অক্টোপাসের মতো বিদঘুটেদেহী জীবেরা।
কাতারে কাতারে লোক সারাদিন দাঁড়িয়ে গর্ত ঘিরে। বিরাট গর্ত। চারপাশে মাটি উঁচু হয়ে গিয়েছে বাঁধের মতো। পাড়ে দাঁড়িয়ে হুজুগে মানুষরা উৎসুক চোখে দেখছে অদ্ভুত ধাতু দিয়ে তৈরি আশ্চর্য সিলিন্ডারটাকে।
তখন সন্ধে নামছে। সূর্য ডুব দিয়েছে।
হন্তদন্ত হয়ে স্যার পার্সির সঙ্গে শার্লক হোমস এসে পৌঁছাল অকুস্থলে। স্যার পার্সিকে দেখেই এগিয়ে এল স্থানীয় মানমন্দিরের এক জ্যোতির্বিদ— ওগিলভি।
বললে, ‘প্রফেসর চ্যালেঞ্জার এসেছিলেন।’
শান্ত কণ্ঠে হোমস বললে, ‘তারপর?’
‘স্টেন্টের সঙ্গে একচোট হয়ে গেল। সায়েন্টিস্ট স্টেন্ট— ওই দেখুন ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন। চ্যালেঞ্জার আবোলতাবোল কথা বলতে গিয়েছিলেন— হালে পানি না পেয়ে রেগেমেগে চলে গেলেন!’
‘কী কথা?’
‘সিলিন্ডারটা নাকি মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছে। ভেতরকার ওই অক্টোপাসের মতো প্রাণীরা মঙ্গলগ্রহের জীব। ওদের কাছাকাছি না যাওয়াই এখন মঙ্গল।’
‘আপনি দেখেছেন অক্টোপাসদের?’
‘গাঁয়ের লোকেরা দেখেছে। কেউ বলে বিরাট মাকড়সার মতো। বুড়ো বয়েসে প্রফেসরের ভীমরতি হয়েছে। পোকামাকড় কখনও সিলিন্ডারে চড়ে মঙ্গলগ্রহ থেকে আসতে পারে? কী বলেন?’
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হোমস বললে, ‘স্টেন্ট ওখানে কী করছেন?’
ওগিলভি বললে, ‘ওই যে ক্যামেরা হাতে ভদ্রলোককে দেখছেন, উনি খবরের কাগজের লোক। চোঙার প্রাণীদের কাছে আমরা এখন একটা প্রতিনিধির দল পাঠাব। নেতৃত্ব দেবেন স্টেন্ট, সঙ্গে থাকবেন রিপোর্টার। আমিও যাচ্ছি। স্যার পার্সি, চলুন আপনিও বৈদেশিক দপ্তরের প্রতিনিধি হিসেবে।’
খপ করে স্যার পার্সির কাঁধ চেপে ধরে শার্লক হোমস বিনয়ক্ষরিত কণ্ঠে বললে, ‘আজ্ঞে না। বৈজ্ঞানিকদের ইচ্ছে হয় আবিষ্কারের নেশায় ছুটে যেতে পারেন, তবে আমার কথা যদি শোনেন— তাহলে পৃথিবীর বাইরে থেকে যারা এসেছে, তাদের মতলব আঁচ না-করা পর্যন্ত, প্রতিনিধি পাঠাতে যাবেন না— কথাবার্তার চেষ্টা করবেন না।’
হোমসের দীর্ঘ শীর্ণ বপুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিমায় ওগিলভি বললে, ‘মহাশয়ের নাম জানতে পারি?’
জবাবটা দিল স্যার পার্সি, ‘শার্লক হোমস।’
চোখ কপালে উঠে গেল ওগিলভির, ‘শার্লক হোমস! নৌদপ্তরের দলিল নিয়ে এ-অঞ্চলে আপনিই তো এসেছিলেন ১৮৮৮ সালে!’
‘এগজ্যাকটলি।’ নীরস কণ্ঠ হোমসের।
কপাল থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে ওগিলভি বললে, ‘আপনার মতো সাহসী পুরুষ আমাদের সঙ্গে থাকলে খুশিই হতাম। চলি, ওঁরা ডাকছেন।’
একরকম ছুটেই রক্তিম-মুখ স্টেন্টের দিকে চলে গেল ওগিলভি। শেষ কথাটায় শার্লক হোমসের সাহসের প্রতি কটাক্ষ কিন্তু হোমসকে স্পর্শও করল না। সে চেয়ে রইল স্টেন্টের দিকে ঈষৎ উদ্বিগ্ন চোখে।
স্টেন্টের হাতে একটা লাঠির ডগায় সাদা পতাকা। দু-পাশে ক্যামেরা হাতে খবরের কাগজের রিপোর্টার এবং ওগিলভি। তিনজনে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সিলিন্ডারের আরও কাছে। স্টেন্ট নাড়ছে শ্বেত পতাকা।
স্যার পার্সি বললে, ‘এতেই কাজ হবে। আমাদের বন্ধুত্বের নিশানা ঠিক বুঝবে ভিনগ্রহের আগন্তুকরা।’
হোমস বললে, ‘অন্য গ্রহ থেকে যারা এসেছে, তারা এ-গ্রহের রীতিনীতির কী জানে? সাদা পতাকার অন্য মানেও তো করতে পারে?’
ঠিক এই সময়ে দেখা গেল লম্বা রডের ওপর একটা আয়নার মতো বস্তু আস্তে আস্তে ঘুরে গেল আগুয়ান প্রতিনিধিদলের দিকে। গোধূলির ম্লান আভায় রডের শীর্ষদেশে দুলন্ত আয়নাসদৃশ বস্তুটাকে এতক্ষণ দেখতে পায়নি হোমস। এইবার স্পষ্ট দেখা গেল। চোঙার ভেতর থেকে লম্বা রডের ডগায় থিরথির করে কাঁপছে অনেকটা ফণাতোলা কেউটের মতো অদ্ভুত আয়না।
আচম্বিতে আরও একটা জিনিস উঠে এল নীচ থেকে। গোখরোর চ্যাটালো ফণার মতো একটা ঢাকনি দেওয়া বস্তু। অনেকগুলি সন্ধিযুক্ত একটা ধাতব হাত উঠিয়ে নিয়ে এল গোখরোর ফণাকে। আঁকাবাঁকা বহু সন্ধিযুক্ত ধাতুর হাত বিচিত্র ফণাটাকে যেন তাগ করে ধরল আগুয়ান প্রতিনিধিদলের দিকে। পাশেই স্থির হয়ে রইল আয়নার মতো জিনিসটা। দুটো বস্তুই উদ্যত এগিয়ে-আসা তিন মূর্তির দিকে।
পতাকা নাড়তে নাড়তে আরও কয়েক পা এগিয়ে গেল তিন মূর্তি।
কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শার্লক হোমস। দৃষ্টি নির্নিমেষ।
অকস্মাৎ একতাল সবুজ বাষ্প ভক করে উঠে এল নীচ থেকে। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ বাঁধানো নীল বিদ্যুৎ ছুটে গেল গোখরোর ফণার মতো অদ্ভুত দর্শন জিনিসটার মধ্যে থেকে— সোজা প্রতিনিধিদলের দিকে। নীল বিদ্যুৎ মিলিয়ে গেল পর মুহূর্তেই— বাতাস যেন গুঙিয়ে উঠল তীব্র কাতরানিতে— লক্ষ ভোমরা যেন গুনগুনিয়ে উঠল রক্তহিম করা গজরানিতে সিলিন্ডারের দিকে।
ভয়াবহ কাণ্ডটা ঘটল একই সঙ্গে। নীল বিদ্যুৎ প্রায় অদৃশ্য আকারে তিন মূর্তির দিকে ধেয়ে যেতেই সহসা নীল আগুনে আপাদমস্তক ঢেকে গেল তিন মূর্তির। বিকট আতসবাজির মতোই নিমেষে দাউদাউ করে নীল আগুনে জ্বলে উঠেই তিনটে অঙ্গার দেহ আছড়ে পড়ল পেছন দিকে। দেহ বলে তাদের আর চেনাও যায় না।
বিষম হট্টগোল শোনা গেল পাড়ে দণ্ডায়মান জনতার দিক থেকে। আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ছুটল তারা মাঠের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই নীল বিদ্যুৎ আবার ধেয়ে গেল সেইদিকে, আবার গজরে উঠল লক্ষ ভোমরা, আবার অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হল পলায়মান জনতা। জ্বলতে জ্বলতে আছড়ে পড়ল মাঠের ওপর।
অস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠে স্যার পার্সি যেই পেছন ফিরে ছুটতে গেছে, অমনি সাঁড়াশির মতো আঙুলে শার্লক হোমস তার কাঁধ খামচে ধরে এক হ্যাঁচকায় শুইয়ে দিল পাড়ের আড়ালে মাটির ওপর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভোমরা গর্জনে বাতাস ফালাফালা করে মাথার ওপর দিয়ে ছুটে গেল নীল বিদ্যুৎ। দূরে পলায়মান মানুষগুলো জ্বলে উঠল নীল বাজির মতো। আরও দূরে মাইল দুয়েক তফাতে গ্রামের ঘরবাড়িতে আগুন ধরে গেল চক্ষের নিমেষে। দাউদাউ করে অলতে লাগল গাছগুলো পর্যন্ত।
চারদিকের আর্তনাদ আর ভোমরা গর্জনের মধ্যে বিহ্বল কণ্ঠে স্যার পার্সি বললে, ‘হোমস! হোমস! এখানেই শুয়ে থাকবে?’
‘না!’ মাটিতে বুক চেপে শুয়ে থেকে হোমস বললে, ‘ওদের যন্ত্রদৃষ্টিতে ধরা না দিয়ে পালাতে হবে। ওই যে খালটা দেখছ, ওর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাই, দেখতে পাবে না।’
তখন আকাশে তারা ফুটছে। লেলিহান আগুন দেখা দিচ্ছে দিকে দিকে। মাথার ওপর দিয়ে তখনও ছুটে যাচ্ছে নীল বিদ্যুৎ। তীক্ষ্ণ শব্দে বাতাস ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে।
দুই বন্ধু প্রাণ হাতে করে কেঁচোর মতো মাটি দিয়ে এঁকেবেঁকে গিয়ে পড়ল সরু খালে। এগিয়ে গেল ওইভাবেই আরও দূরে। জ্বলন্ত গাছপালার ফাঁক দিয়ে উঠল রাস্তায়। দৌড়ে ফিরে এল ওকিং গ্রামে।
সটান উঠল স্যার পার্সির বাড়িতে। হাঁপাতে হাঁপাতে স্যার পার্সি বললে, ‘হোমস, আজ তুমি না থাকলে—’
‘যা দেখলে, ওটা কিন্তু ছোট অস্ত্রের ভেলকি।’
‘আরও বড় অস্ত্র আছে?’
‘নিশ্চয় আছে। এমন অস্ত্র যা প্রয়োগ করলে ছবির আড়ালে লুকিয়ে থেকেও পার পাওয়া যাবে না।