চলন্ত বয়লার
লন্ডনে ফিরে এল শার্লক হোমস পরের দিন। বেকার স্ট্রিটের বাসায় এসে পেল প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের একটা চিঠি—
মাই ডিয়ার হোমস,
মঙ্গলগ্রহের বিভীষিকাদের সঙ্গে মোকাবিলা আমিই করব। ওদের সঙ্গে কথাবার্তা চালানো দরকার। এর জন্যে যদি আমার প্রাণ যায়, যাক। তোমাকে টানতে চাই না। কারণ আমার চাইতে তোমার মগজ খুব বেশি নিকৃষ্ট নয়। আমি মরলে মঙ্গল বনাম পৃথিবীগ্রহের যুদ্ধে তোমার ব্রেন অনেক কাজ দেবে।
জর্জ এডওয়ার্ড চ্যালেঞ্জার।
চিঠি পেয়েই জবাব লিখে এনমোর পার্কে চ্যালেঞ্জারের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল হোমস। লিখল, মঙ্গলগ্রহীদের ধ্বংসলীলা সে স্বচক্ষে দেখে এসেছে। মঙ্গলগ্রহীদের অবশ্য স্বচক্ষে দেখেনি— সে-সুযোগও হয়নি। তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে অভিযান আরম্ভ হল এবং ১৯০৪ সালে মঙ্গল যখন পৃথিবীর কাছে আসবে— তখন ওরা আসবে দলে দলে। ওদের চোখে পৃথিবীবাসীরা কীটপতঙ্গের সামিল। তাই মানুষ নিকেশ করছে নির্মমভাবে। অথবা ব্যবহার করবে অন্য কোনও ভাবে। তবে হ্যাঁ, আন্তঃগ্রহ যোগাযোগের যন্ত্র হিসেবে ক্রিস্টাল যন্ত্রটাকে যেন সযত্নে রাখা হয়। এ যন্ত্র ওরা হাতানোর চেষ্টা করতে পারে। তার আগে হোমস চেষ্টা করবে একটা মঙ্গলগ্রহীকে পাকড়াও করে গবেষণা করার— যাতে তাদের নিকেশ করার পথ বার করা যায়। হোমসের ধারণা, এ গ্রহে এসে নিজেদের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গিয়ে একটু ঝামেলায় পড়তে পারে মঙ্গলের আতঙ্করা। চ্যালেঞ্জার যেন এই ধারণাটা নিয়ে তলিয়ে ভাবেন।
বিশেষ দূতের হাতে চিঠিখানা পাঠিয়ে সেদিনের খবরের কাগজ নিয়ে বসল হোমস। গভর্নমেন্টের টনক নড়েছে। সৈন্যবাহিনী পাঠাচ্ছে। কিন্তু মঙ্গলের আতঙ্করা স্রেফ নীল বিদ্যুৎ অথবা তাপরশ্মি ছুড়ে সৈন্যদের ছাই করে দিচ্ছে! ওরা এবার গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। বিরাটকায় চলন্ত বয়লারের মতো যন্ত্রটা যেন রণপায়ে ভর দিয়ে হাঁটছে! তিনটে ঠ্যাং তাদের। নীল বিদ্যুৎ ছুটছে। বয়লারের মাথা থেকে। মাঝে মাঝে কালো ধোঁয়া। বিষ ধোঁয়া। মানুষ মরছে কাতারে কাতারে।
গতরাত্রে আবার একটা চোঙা খসে পড়েছে ওই একই অঞ্চলে— মাইল তিনেক দূরে। প্রত্যেকটা চোঙার মধ্যে পাঁচজন মঙ্গলগ্রহী রয়েছে। রণপায়ে ভর-দেওয়া বয়লারের সংখ্যাও তা-ই। নীল বিদ্যুৎ ছুড়ে শ্মশানে পরিণত করছে তারা গোটা জেলাকে। একটা বয়লারকে কামান দেগে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বয়লাররা কামানটামান সমেত গোটা সৈন্যবাহিনীকে ছাই করে দিয়েছে।
দাঁতে দাঁত পিষে হোমস বললে ল্যান্ডলেডি মিসেস হাডসনকে, ‘মোট দশটা আগুনের ঝলক দেখা গিয়েছিল মঙ্গলের বুকে পর পর দশ রাতে। দুটো এসে পৌঁছেছে— আরও আটটা আসবে সামনের আটটা রাতে।’
দম বন্ধ করা স্বরে মিসেস হাডসন বললে, ‘আগুনের ঝলকগুলো তাহলে—’
‘চোঙা পাঠানোর ঝলক। একটা করে চোঙাকে ওরা পাঠিয়েছে পৃথিবী লক্ষ করে এক-একরাতে। দুটো এসেছে, আরও আসছে।’
খেয়ে উঠে ওয়াটসনের নামে চিঠি লিখে ম্যান্টলপিসে ছুরি দিয়ে গেঁথে আটকে রাখল হোমস। ওয়াটসন গেছে লন্ডনের বাইরে। ফিরে এসে সে পড়ুক শার্লক হোমসের শেষ কাহিনি— বোধহয় এই শেষ।
কেননা, পৃথিবীরও তো বোধহয় এই শেষ।