কালো ধোঁয়া— উড়নচাকি
স্যার পার্সি হন্তদন্ত হয়ে এল পরদিন সকালে। সরকার বিরাট দায়িত্ব দিয়েছে শার্লক হোমসকে। লন্ডন ছেড়ে যাওয়া চলবে না। এখানে থেকেই ভিনগ্রহী শত্রুদের গতিবিধি নজরে রাখতে হবে এবং লড়াইয়ের পদ্ধতি স্থির করতে হবে। এ-জন্যে এদেশের সর্বোচ্চ খেতাব দেওয়া হবে তাকে যথা সময়ে—নাইটহুড।
‘অর্থাৎ স্যার শার্লক বলবে আমাকে সবাই এখন থেকে?’ মৃদু হেসে বললে হোমস।
‘হ্যাঁ।’
মাথা নাড়ল শার্লক হোমস, ‘আমি মিস্টার শার্লক হোমসই থাকতে চাই— স্যার শার্লক হতে চাই না। সরকার যে কাজ দিয়েছেন, তা দেশের কাজ। নিশ্চয় করব। তবে এখন আমাকে ডোমনিথর্পি যেতে হচ্ছে।’
আঁতকে উঠল স্যার পার্সি, ‘কেন?’
ল্যান্ডলেডি মিসেস হাডসনকে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসব। ছোকরা চাকর বিলিকেও ছুটি দিয়েছি দেশে যাওয়ার জন্যে। লন্ডন আর নিরাপদ নয়। ওদের দুটো সিলিন্ডার নেমেছে সারে জেলায়। আমার বিশ্বাস, ফাঁকা জায়গায় নেমে ওরা আগে গুছিয়ে নেবে নিজেদের— তারপর পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম শহর লন্ডনে হানা দেবে।’
স্যার পার্সি সায় দিয়ে বলল, ‘ঠিকই বলেছ। এই জন্যেই বোধহয় সরকার এখান থেকে দপ্তর ওঠাচ্ছেন।’
‘ওঠাতেই হবে। কোথায় যাচ্ছে?’
‘বার্মিংহাম। হোমস, দেশের জন্যে, সমস্ত মানবজাতির জন্যে তোমার এখন লন্ডনেই থাকা দরকার। হালচাল দেখে প্ল্যান ঠিক করা দরকার। তুমিই হবে সরকারের লন্ডন পর্যবেক্ষক— এই নাও তার নিয়োগপত্র।’
নিয়োগপত্রে চোখ বুলিয়ে কপাল কুঁচকে হোমস বললে, ‘এ যে দেখছি বিরাট দায়িত্ব। ক্ষমতাও অসীম।’
‘তা তো বটেই।’
‘আমার দাদা মাইক্রফটকে বলো-না।’
‘তিনি রাজ পরিবারের সঙ্গে স্কটল্যান্ডে ব্যালোমোরল কাসলে চলে গেছেন। হোমস, তুমি ছাড়া এ দায়িত্ব নেওয়ার দ্বিতীয় লোক এ শহরে আর নেই।’
‘বুঝলাম। কিন্তু ডোমনিথর্পি আমাকে যেতেই হবে। ফিরে এসে দেখব মঙ্গলগ্রহীদের হালচাল।’
মাঝরাতের ট্রেনে ডোমনিথর্পি এসে পৌঁছলেন শার্লক হোমস মিসেস হাডসনকে নিয়ে। গাঁয়ের সরাইখানায় এখনও আলো জ্বলছে— দারুণ গুলতানি চলছে। গাঁয়ের জনা বারো মাতব্বর মিটিং করছেন অন্য গ্রহের আপদগুলোকে একহাত নেওয়ার ব্যাপারে।
খেতে খেতে শুনল হোমস সমবেত সিদ্ধান্ত। এখন যেখান থেকে পারো, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জড়ো হও— মারো মঙ্গলগ্রহীদের।
হাত তুলে বাধা দিল হোমস।
বলল, ‘বন্ধুগণ, উত্তেজিত হবেন না। সরকারের কামান বন্দুক হার মেনেছে যাদের কাছে— তাদের আপনারা গেঁইয়া হাতিয়ার নিয়ে আটকাতে পারবেন না। তা ছাড়া গুজব শুনছি ওরা নাকি নীল বিদ্যুৎ ছাড়াও এবার কালো রঙের ধোঁয়া ছাড়ছে— আড়ালে লুকিয়ে থেকেও যার বিষক্রিয়া থেকে রক্ষে নেই।’
‘তাহলে কী করতে বলেন?’ বললেন মোড়লমশাই।
‘চম্পট দিন। দেখলেই সরে পড়ুন— যদি প্রাণের মায়া থাকে।’
ঠিক এই সময়ে একটা টেলিগ্রাম এল হোমসের নামে। স্যার পার্সি পাঠিয়েছে বার্মিংহাম থেকে। সারে জেলা থেকে টেমস নদীর পাড় ধরে লন্ডন পৌঁছেছে মঙ্গলগ্রহীরা। সৈন্যরা কাতারে কাতারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। মরেছে কত, সে হিসেবও পাওয়া যাচ্ছে না। সারে জেলাতে চতুর্থ চোঙা এসে পড়েছে।
ঘরে এসে টেলিগ্রামের জবাব লিখে পাঠাল হোমস। সাধু সাবধান! চারটে চোঙা এসেছে— আরও ছ-টা আসছে। চারটেই পড়েছে সারেতে— বাকি ক-টাও কোথায় পড়বে, সে হিসেবও নিশ্চয় মঙ্গলগ্রহীরা করে রেখেছে। ওরা ইংল্যান্ডের বিশেষ এক জায়গাতেই শক্তি সংহত করছে মনে হচ্ছে। শুধু বুঝতে পারা যাচ্ছে না বাছাধনদের মতলবটা কী। মানুষ মেরে সাফ করতে চায়, না, টিকিয়ে রাখতে চায়।
টেলিগ্রাম পাঠানোর ব্যবস্থা করে রাতটা সরাইখানাতেই কাটাল হোমস। মিসেস হাডসন গেল নিজের বাড়িতে।
পরের দিন সকালে আরও খবর শোনা গেল সরাইখানার মালিকের মুখে। পঙ্গপালের মতো মানুষ ট্রেন-বোঝাই হয়ে লন্ডন থেকে চলে আসছে। সেখানে কালো ধোঁয়া ছাড়ছে মঙ্গলগ্রহের প্রাণীরা। ঘন ধোঁয়া বেশ ভারী। মাটির ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। নাকে গেলেই প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মঙ্গলগ্রহের চলন্ত মেশিনগুলোই আবার বাষ্প ছুড়ে কালো ধোঁয়াকে কালচে পাউডার বানিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে— তখন আর মানুষ মরছে না।
‘যাক, তাহলে একটা প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল,’ বললে শার্লক হোমস। ‘মঙ্গলগ্রহীরা মানুষ মেরে পৃথিবী সাফ করতে চায় না। রুখে দাঁড়ালে কিছু লোক মারছে— তারপর নিজেরাই ধোঁয়ার বিষক্রিয়া নষ্ট করে দিচ্ছে। সেইসঙ্গে আবিষ্কার করা গেল কালো ধোঁয়াকে দরকার মতো বাষ্প ছুড়ে নির্বিষ করারও পদ্ধতি।’
তৎক্ষণাৎ পোস্ট অফিসে গিয়ে টেলিগ্রামে পর্যবেক্ষণটা বার্মিংহামে স্যার পার্সির কাছে পাঠিয়ে দিল হোমস।
পরের দিন খবর এসে পৌঁছোলো কেম্ব্রিজ থেকে। এক রাতেই দুটো চোঙা অবতীর্ণ হয়েছে পৃথিবীতে। একটা সারে জেলাতেই আর একটা খাস লন্ডন শহরে— প্রিমরোজ পাহাড়ে।
খেতে খেতে এক ভদ্রলোক বিস্ময় প্রকাশ করলেন এই ব্যাপারে। চব্বিশ ঘণ্টা অন্তর একটা করে চোঙা ছিটকে এসেছে মঙ্গলগ্রহ থেকে। পৃথিবীতেও তাহলে চব্বিশ ঘণ্টা অন্তর তাদের পৌঁছোনোর কথা। কিন্তু দুটো চোঙা একই রাতে এল কীভাবে?
হোমস বললে, ‘মশায়, মঙ্গলগ্রহীদের এই চোঙাগুলোকে কামান থেকে ছোড়া গোলা বলে ভুল করবেন না। প্রতিটি চোঙা এক একটি মহাকাশযান। মহাশূন্যে নিজেদের গতি নিয়ন্ত্রণ, দিক পরিবর্তন এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলে অবতরণের ক্ষমতা এদের আছে। তাই প্ল্যান মাফিক চোঙাগুলো কয়েক মাইল দূরে দূরে পড়ছে ইংল্যান্ডের একই অঞ্চলে।’
হাঁ করে শুনছিলেন ভদ্রলোক। দু-দিন আগে লন্ডন থেকে ইনিই প্রাণ হাতে করে পালিয়ে এসেছেন। লন্ডনে কালো ধোঁয়ার প্রতাপ স্বচক্ষে দেখেছেন, চলন্ত বয়লারের বিশাল মেশিনদেরও দেখেছেন। দেখেছেন নীল বিদ্যুতের মতো মারাত্মক তাপরশ্মির ভয়াবহ লীলা।
তাই শার্লক হোমসের ব্যক্তিমে শুনলেন দু-চোখ বড় বড় করে। শোনবার পর বললেন, ‘আপনি কি তাহলে বলছেন, কালো ধোঁয়া আর নীল বিদ্যুৎ দিয়ে হারামজাদারা শেষ করে ছাড়বে ইংল্যান্ডকে?’
হাসল হোমস। গরম খাবার মুখে তুলে চিবুতে চিবুতে বললে, ‘এবার আসছে বোধহয় তৃতীয় অস্ত্র।’
‘তৃতীয় অস্ত্র!’
‘মাত্র চারটে চোঙার ভেলকি আমরা এতদিন দেখেছি— নীল বিদ্যুৎ প্রথমে, কালো ধোঁয়া তারপরে। আরও চোঙা আসছে— নামাচ্ছে আরও যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র যা প্রথমে আনা যায়নি। এবার সেইসব যন্ত্রপাতি, জোড়া লাগিয়ে তৃতীয় অস্ত্র বানানো কি অসম্ভব? এমন কোনও অস্ত্র যা কালো ধোঁয়া, নীল বিদ্যুৎ আর চলন্ত বয়লারদের চেয়েও দ্রুতগতি হবে— পুরো দেশটাকে আরও তাড়াতাড়ি কবজায় আনবে— তারপর সমস্ত পৃথিবীকে?’
খাবি খেতে খেতে লন্ডন থেকে পলাতক ভয়ার্ত ভদ্রলোক বললেন, ‘মিস্টার হোমস, আপনি যেন ওদের অস্ত্রাগারটা এইমাত্র দেখে এসে কথা বলছেন। অথচ যা বলছেন, তা উড়িয়ে দেওয়ার মতো অযৌক্তিকও নয়। কী মনে হয় আপনার? তৃতীয় অস্ত্রটা কী মনে হয় আপনার? তৃতীয় অস্ত্রটা কী হতে পারে?’
‘উড়ুক্কু মেশিন।’
‘অসম্ভব।’
‘অসম্ভব আমাদের কাছে— ওদের কাছে নয়। যারা এত লক্ষ মাইল অক্লেশে উড়ে এসে পৃথিবীতে আসন গেড়ে বসেছে— তাদের পক্ষে পৃথিবীর আকাশে উড়ুক্কু মেশিন উড়িয়ে দেওয়া এমন কিছু বিরাট ব্যাপার নয়।’
লন্ডনগামী ট্রেনের একটা কামরায় দেখা গেল শার্লক হোমসকে এর পরের দিন। মাথায় চেক টুপি। গায়ে চেক কোট— যেন তদন্তে চলেছে।
ট্রেন ফাঁকা। লন্ডনের দিকে যাওয়ার লোক নেই ভলান্টিয়ার ছাড়া। শুকনো মুখে এদের একজন কেউ হোমসকে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তদন্তে চললেন নাকি মিস্টার হোমস?’
হোমসও জবাবটা দিয়েছিল তক্ষুনি, ‘তদন্তই তো। বিশ্বের বৃহত্তম তদন্ত। বৃহত্তম ক্রাইম অনুষ্ঠিত হচ্ছে বহির্বিশ্ব থেকে— তারই তদন্ত।’
ভলান্টিয়ার ভদ্রলোকের প্রাণটা এমনিতেই গলায় এসে ঠেকেছিল নিদারুণ উৎকণ্ঠায়। হোমসের স্মিত মুখের রসিকতায় ভাষা খুঁজে পায়নি।
ট্রেন কিন্তু লন্ডন পৌঁছোনোর আগেই একটা ঘটনা ঘটল।
আচম্বিতে একটা ছায়া এসে পড়ল চলন্ত ট্রেন আর তার পাশে। উড়ন্ত কিছুর ছায়া। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল হোমস। তারপর তাকাল আকাশ পানে। চেয়ে রইল একদৃষ্টে। নিঃশঙ্ক চোখে তাঁর তৃতীয় অনুমানও সত্যি হল তাহলে।