উড়ুক্কু মেশিন
ঝকঝকে সাদা পিরিচের মতো একটা বস্তু উড়ে চলেছে ট্রেনের মাথায়। একবার নক্ষত্ৰবেগে সামনে ছুটে গিয়েই আবার পেছন দিক দিয়ে উড়ে এসে পুরো ট্রেনটির শেষ থেকে মাথা পর্যন্ত টহল দিয়ে গেল ধীর গতিতে। পরক্ষণেই কক্ষচ্যুত উল্কার মতো ছিটকে গেল লন্ডনের দিকে নিঃশব্দে।
ব্যাস, পরের স্টেশনেই ট্রেন গেল দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার ঘামতে ঘামতে নেমে এল ইঞ্জিন থেকে। তার ঘরে বউ-বাচ্চা আছে। উড়ুক্কু মেশিন যেদিকে গেছে, সেদিকে ট্রেন নিয়ে আর সে যাবে না।
ভয়ের চোটে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল বহু ভলান্টিয়ারেরই। ফিরতি ট্রেনে ওঠবার জন্যে হুড়োহুড়ি শুরু হতেই হাঁটা পথে লন্ডন রওনা হল শার্লক হোমস একা।
একদিন একরাত সমানে হেঁটে এবং সামান্য ক্ষণের পরিত্যক্ত বাড়িতে জিরিয়ে নিয়ে লন্ডন পৌঁছাল হোমস।
পৌঁছোল রাত্রে। লন্ডন তখন খাঁ-খাঁ করছে, মাঝে মাঝে ধাতুতে ধাতুতে ঠোকাঠুকির অপার্থিব আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অপার্থিব তো বটেই— পৃথিবীর কোনও ধাতুতে ওরকম কানফাটানো ঝংকার শোনা যায় না। নিশ্চয় চলন্ত বয়লার সদৃশ তিন পা-ওয়ালা মেশিন টহল দিচ্ছে পথেঘাটে। একবার একটা উঁচু বাড়ির ছাদের ওদিকে দেখা গেল এমনি একটা মেশিন। প্রায় একশো ফুট উঁচু। সঙ্গে সঙ্গে একটা ফাঁকা দোকানে ঢুকে গা-ঢাকা দিল হোমস। যতই ডাকাবুকো হোক না কেন, খুনে মঙ্গলগ্রহীদের সঙ্গে চালাকি করতে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখন নয়। নিস্তব্ধ লন্ডন শহর মাঝে মাঝে শিউরে উঠছে বাতাস ফালা ফালা করা স্টিম-সাইরেন জাতীয় ভয়াবহ আওয়াজে। যান্ত্রিক আওয়াজ! লন্ডন যারা মুঠোয় এনেছে তাদেরই সংকেত। এক মেশিন আরেক মেশিনকে সংকেতে জানাচ্ছে— সব ঠিক হ্যায়। লন্ডনের দু-পেয়ে পোকাগুলো চম্পট দিয়েছে হে! রামভীতু সব। দেশটা এখন আমাদের! হাঃ হাঃ হাঃ!
হোমস কল্পনাপ্রবণ নয়। ভাবাবেগকে সে প্রশ্রয় দেয় না। কিন্তু সেই রাতে, আকাশে ঝুলন্ত বিবর্ণ চাঁদের ফ্যাকাশে আলোয় নিঝুম নিস্তব্ধ জনহীন পাথরপুরী লন্ডন শহরের বুকে আততায়ীদের সদর্প বিহার এবং গগনবিদারী উল্লাস-সংকেত শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মনে মনে ভাবল, ওয়াটসন থাকলে এই মুহূর্তে এই শ্মশানপুরীর ভয়াবহতা নিয়ে দু-পৃষ্ঠা লিখে ফেলত নিশ্চয়।
ওয়াটসন এখন কোথায়? অন্ধকারে গা ঢেকে বেকার স্ট্রিটের বাসাবাড়িতে পৌঁছোল হোমস। বাড়ি খালি। মেন্টলপিসের কাঠে ছুরি দিয়ে গাঁথা ওয়াটসনকে লেখা চিঠিখানা যেমন তেমনি পড়ে আছে।
বেঁচে আছে তো বন্ধুবর?
মনটা ভারি হয়ে এল হোমসের। আলো না জ্বালিয়ে কলতলায় গিয়ে জল পেল স্নান করার। দাড়ি কামিয়ে সাবান মেখে স্নান করে এসে বসল মিসেস হাডসনের রান্নাঘরে। শুকনো রুটি আর জল খেয়ে ওপরে উঠতে না উঠতেই টোকা পড়ল সদর দরজায়।
তখন নিশুতি রাত। খট খট খট করে কে যেন অতি সন্তর্পণে টোকা মারছে দরজায়।
পা টিপে টিপে নেমে গেল হোমস। দরজা খোলাই ছিল। ফাঁক দিয়ে দেখল— হপকিন্স। পুলিশ হপকিন্স। গায়ে শতচ্ছিন্ন কাদা-নোংরা পোশাক। চুল অবিন্যস্ত। দৃষ্টি বিভ্রান্ত।
পাল্লা খুলেই ঝট করে হপকিন্সকে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল হোমস।
অস্ফুট চিৎকার করেই সামলে নিল হপকিন্স, ‘মিস্টার হোমস, আপনি বেঁচে আছেন?’
‘আছি এবং থাকব,’ অসীম প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল হোমস, ‘কিন্তু তুমি দরজায় টোকা মারছিলে কেন? সৌজন্য দেখানোর সময় নাকি এখন?’
‘অভ্যেস, মিস্টার হোমস, তা ছাড়া মাথার ঠিক নেই আমার। যা দেখে এলাম—’ বলতে বলতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল হপকিন্স।
আধো অন্ধকারেই হপকিন্সের মুখচ্ছবি দেখে ব্যাপারটা আঁচ করে নিল হোমস। নার্ভাস শক।
দেরাজ থেকে ব্রান্ডির বোতল এনে এক গেলাস খাইয়ে দিল বিধ্বস্ত পুলিশ ইন্সপেক্টরকে, পান করল নিজেও।
তারপর চেয়ারে বসিয়ে বলল, ‘বলো, কী দেখেছ।’
‘দেখেছি ওদের… কালো ধোঁয়া, নীল বিদ্যুৎ, চলন্ত বয়লার, উড়ুক্কু মেশিন।’
‘ওসব আমিও দেখেছি, হপকিন্স। কিন্তু তুমি তো দেখছি সমুদ্রপাড়েও গেছিলে।’
চোখ কপালে তুলে হপকিন্স বললে, ‘আপনি কী করে জানলেন?’
‘তোমার জামাকাপড়ে সমুদ্রের ফেনা শুকিয়ে রয়েছে দেখে।’
‘হ্যাঁ, গেছিলাম মিস্টার হোমস। তাড়া খেয়ে গেছিলাম। তিনদিক থেকে চলন্ত বয়লারগুলো মানুষগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল পূর্বদিকে— যেদিকে সমুদ্র। আমি একটা সাইকেল জোগাড় করে প্রাণের ভয়ে সেইদিকেই গেছিলাম। সৈন্যরা যেখানে কামান ছুড়েছে, সেখানে ওরা কালো ধোঁয়া ছুড়ে দলকে-দল খতম করে দিয়েছে। ভীষণ ভারী কালো ধোঁয়া, মিস্টার হোমস, অনেকটা তরল পদার্থের মতো। মানুষ সমান হাইটে মাটির ওপর দিয়ে গড়িয়ে যায়— তারপর ঝুরঝুর করে ঝরে গিয়ে ভুষোর মতো মাটি লেপটে থাকে— তখন আর কোনও ক্ষতি হয় না। আমরা পালাচ্ছিলাম বলে কালো ধোঁয়া আমাদের দিকে ছোড়া হয়নি। পালিয়ে যখন সমুদ্রের পাড়ে পৌঁছোলাম, তখন দেখলাম কতকগুলো জাহাজে পালে পালে লোক উঠছে। দূরে দূরে চলন্ত বয়লারগুলো দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। কিছু করছে না। মাঝে মাঝে মাথার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে সাদা পিরিচের মতো উড়ুক্কু মেশিন উড়ে যাচ্ছে। জাহাজ মাত্র কয়েকটা, কিন্তু লোকের শেষ নেই। তার ওপর মূর্তিমান যমদূতের মতো চলন্ত বয়লারদের দাঁড়িয়ে থাকা। চেঁচামেচি হট্টগোলের মধ্যে মুরগিঠাসার মতো মানুষঠাসা হয়ে দুটো জাহাজ যেই জেটি ছেড়েছে, অমনি তিনটে চলন্ত বয়লার এগিয়ে গিয়েছিল জেটির ওপর দিয়ে জলের ধারে। ঠিক তখনই জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকা একটা যুদ্ধজাহাজ থেকে পর পর তিনবার কামান দেগে দুটো বয়লারকে টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দিতেই ঘটল বিপর্যয়। চক্ষের নিমেষে মাথার ওপর উড়ে এল একটা উড়ুক্কু মেশিন— কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়ে গেল যুদ্ধ জাহাজের ওপর। নিস্তব্ধ হয়ে গেল জাহাজ। একই সঙ্গে জেটি ছেড়ে যাওয়া জাহাজ দুটোকে লক্ষ করে বার কয়েক নীল বিদ্যুৎ ছুড়ল তৃতীয় বয়লারটা। দুটো জাহাজই সঙ্গে সঙ্গে জ্বলতে জ্বলতে ডুবে গেল জলে। মিস্টার হোমস, ভয়াবহ সেই দৃশ্য দেখে আমি যেন কীরকম হয়ে গেলাম। মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে গেল। কীভাবে সাইকেল চালিয়ে হট্টগোলের মধ্যে দিয়ে চলে এলাম, নিজেও ভালো করে জানি না। এইখানে এসে বিটের কনস্টেবলদের মতো ওই একশো ফুট উঁচু মেশিনগুলোর চোখ এড়িয়ে বেকার স্ট্রিটে আসতেই আপনার কথা মনে পড়ে গেল। বিপদে-আপদে সব সময়েই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি— মুখে স্বীকার না করলেও আপনার কৃপায় মান-যশ পেয়েছি। আর আজ এসেছি শুধু প্রাণটা বাঁচাতে। মিস্টার হোমস, লন্ডন তো শেষ— মানুষ জাতটাও কি শেষ হতে চলেছে?’
জলদগম্ভীর স্বরে হোমস বললে, ‘না, হপকিন্স, তোমার ছবির মতো বর্ণনা থেকেই আমার আগের অনুমানটা সত্যি বলে প্রমাণিত হল। এরা মানুষকে মারতে চায় না— জিইয়ে রাখতে চায়। এক জায়গায় জড়ো করে রাখতে চায়। কেন, সে প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই এসেছি আমি লন্ডনে।’ হোমসের প্রত্যয়-কঠিন ধীরস্থির কণ্ঠস্বর আর অসীম আত্মবিশ্বাস সংবিৎ ফিরিয়ে আনল অস্থির-স্নায়ু হপকিন্সের। হোমসই তাকে এর পর সাবান দিল, স্নানের জল দিল, খাবার দিল। স্নান করে, খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল হপকিন্স।
তখন ভোরের আলো ফুটছে। বেকার স্ট্রিটে এসে দাঁড়াল হোমস। গেল উলটোদিকে ক্যামডেন হাউসে। কর্নেল সিবাস্টিয়ান মোরানের গ্রেপ্তারের পর থেকে এ-বাড়িতে আর ভাড়াটে আসে না। দরজা খোলা। সটান চিলেকোঠায় উঠে গেল হোমস। দেখল জনহীন লন্ডন নগরীকে। একদা যে নগরীর পথঘাট গমগম করত লোকজন গাড়িঘোড়ায়— এখন তা নিস্তব্ধ। কোথাও গাড়ি চলছে না— লোক হাঁটছে না। যেন দুরন্ত প্লেগের আক্রমণে মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে প্রাণচঞ্চল লন্ডন। রিজেন্ট পার্কের সবুজ গাছগুলো কেবল মাথা তুলে বিষণ্ণভাবে দেখছে বহু বছর ধরে গড়ে ওঠা নিষ্প্রাণ নগরীকে— পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম নগরীকে। এই সেদিনও এর আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে থাকত হাজার হাজার চিমনির ধোঁয়ায়। এখন কেবল চিমনিগুলোই আছে, ধোঁয়া নেই। আকাশ-বাতাস পরিষ্কার। দু-মাইল দূরে প্রিমরোজ পাহাড়ে ভোরের আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। চকচকে ধাতুতে। টহল দিচ্ছে চলন্ত বয়লার— মঙ্গলগ্রহীদের মেশিনসান্ত্রি নেই, কেউ কোথাও নেই। সৈন্যসামন্ত, রাজা-প্রজা গেরস্ত-ডাকাত, দ্বিপদ-চতুস্পদ— সব পালিয়েছে! মরেছে। অজেয় লন্ডন আজ সম্পূর্ণ পরাভূত। লুণ্ঠিত।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নেমে এল হোমস। রাস্তা পেরিয়ে নিঃশব্দ চরণে ঢুকল বেকার স্ট্রিটের বাসায়।
দূরে স্টিম সাইরেনের শব্দে যান্ত্রিক সংকেত শোনা গেল ঠিক সেই সময়ে।