Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প813 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৩. জন ওয়াটসন এম ডি-র স্মৃতিচারণের পরবর্তী অংশ

    প্রবল বাধা দেওয়ার পরেও কিন্তু আমাদের প্রতি বিন্দুমাত্র বিরূপ মনোভাব দেখা গেল না বন্দীর। বরং যখন দেখলে বজ্রমুষ্টি থেকে ছাড়ান পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন অমায়িকভাবে জিজ্ঞেস করলে, লাগেনি তো? মারপিটের ফলে আমরা জখম হয়েছি কিনা জানবার জন্যে এই উদবেগ কিন্তু অকপট। শার্লক হোমসকে বললে, নিশ্চয় এখন থানায় নিয়ে যাবেন আমাকে। আমার গাড়ি তো নীচেই রয়েছে। পায়ের বাঁধন খুলে দিন–হেঁটে যাচ্ছি। আগে হালকা ছিলাম–এখন ভারী হয়েছি–পাঁজাকোলা করে তোলা খুব সহজ হবে না।

    দৃষ্টি বিনিময় করল লেসট্রেড আর গ্রেগসন–বুকের পাটা আছে বটে বন্দীর। ধরা পড়বার পর এই প্রস্তাব কেউ করে? শার্লক হোমস কিন্তু তৎক্ষণাৎ হেঁট হয়ে কথা রাখল বন্দীর। তোয়ালে দিয়ে বেঁধেছিলাম পা জোড়া খুলে ফেলে দিল তোয়ালে। উঠে দাঁড়িয়ে পা টান টান করে সে দেখে নিলে পা দুটো আবার স্বাধীন হয়েছে কিনা। বেশ মনে পড়ে লোকটার দিকে সজাগ চোখে চেয়ে থাকবার সময়ে লক্ষ করেছিলাম তার অমানুষিক কাঠামো। এ-রকম শক্তিমান পুরুষ কখনো দেখিনি। রোদেপোড়া কালচে মুখে দৃঢ় সংকল্প আর অফুরন্ত প্রাণশক্তি যেন ফেটে পড়তে চাইছে দৈহিক শক্তির মতোই লোকটার মনের শক্তিও প্রচণ্ড এবং ভয়ংকর।

    শার্লক হোমসের দিকে অকপট প্রশংসাভরা চোখে তাকিয়ে বললে, পুলিশ-চিফের পদ যদি খালি থাকে, আপনাকে সেখানে বসানো উচিত। আমাকে খুঁজে বার করলেন কী করে ভেবে পাচ্ছি

    না।

    ডিটেকটিভ দু-জনের পানে তাকিয়ে হোমস বললে, তোমরাও এসো সঙ্গে।

    লেসট্রেড বললে, আমি চালাব গাড়ি। ভালোই তো! গ্রেগসন, তুমি আমার সঙ্গে গাড়ির ভেতরে থাকবে। ডাক্তার, তুমিও চলো। গোড়া থেকে কেসটায় আগ্রহ দেখিয়েছ তুমি–লেগে থাকো শেষ পর্যন্ত।

    রাজি হলাম সানন্দে। দল বেঁধে নেমে এলাম নীচে। পালাবার চেষ্টা করল না কয়েদি। শান্তভাবে উঠে বসল নিজেরই গাড়ির মধ্যে আমরা উঠলাম পেছন পেছন। ওপরে গিয়ে বসল লেসট্রেড। চাবুক হাঁকিয়ে খুব অল্প সময়ে এনে ফেলল গন্তব্যস্থানে। পথ দেখিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল একটা ছোটো চেম্বারে। একজন পুলিশ ইনস্পেকটর লিখে নিলে কয়েদির নাম আর যাদের খুনের দায়ে তাকে ধরা হয়েছে, তাদের নাম। অফিসারের মুখ সাদা, আবেগহীন, নিরুত্তাপ। যন্ত্রবৎ কর্তব্য করে জিজ্ঞেস করল, এই সপ্তাহের মধ্যেই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হবে কয়েদিকে। মি. জেফারসন হোপ, ইতিমধ্যে যদি কিছু বলতে চান বা বলতে পারেন তবে খেয়াল রাখবেন, যা বলবেন তা লিখে নেওয়া হবে এবং আপনার বিরুদ্ধে তা প্রয়োগ হতে পারে।

    মন্থর কণ্ঠে কয়েদি বললে, অনেক কথাই বলার আছে আমার। সব কথাই বলতে চাই আপনাদের।

    ইনস্পেকটর বললে, কোর্টে বলবেন কিনা ভেবে দেখুন।

    হয়তো আমাকে আর কোর্টে যেতে হবে না। চমকে উঠবেন না। আত্মহত্যার কথা একদম ভাবছি না। আপনি কি ডাক্তার? জ্বলন্ত কালো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে শেষ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করল কয়েদি।

    বললাম, হ্যাঁ, আমি ডাক্তার।

    তাহলে হাতটা এখানে রাখুন, একটু হেসে বলয় বন্দী কবজি দিয়ে দেখাল বক্ষদেশ।

    হাত রাখলাম আমি। সঙ্গেসঙ্গে অনুভব করলাম বুকের খাঁচায় একটা প্রচণ্ড রকমের তোলপাড় চলছে–ধুকধুকুনি দুরমুশ পেটার মতো বেড়ে চলেছে। অপলকা বাড়ির ভেতরে শক্তিশালী ইঞ্জিন পুরোদমে চললে বাড়ির দেওয়াল যেমন মুহুর্মুহু কাঁপতে থাক, জেফারসন হোপের বুকের দেওয়াল সেইভাবে কাপছে, শিউরোচ্ছে, লাফাচ্ছে। ঘর নিস্তব্ধ বলেই স্পষ্ট শুনতে পেলাম একটা চাপা গুঞ্জন, একটা অদ্ভুত ঘর-ঘর গুর গুর শব্দ উত্থিত হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে।

    সর্বনাশ! এ যে দেখছি অ্যাওরটিক অ্যানিউরিজম! ধমনী ফুলে উঠেছে, দেওয়াল আর চাপ সইতে পারছে না!

    নামটা তাই বটে! প্রশান্ত স্বরে বললে জেফারসন। গত সপ্তাহে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। বেশিদিন আর নেই–ধমনী ফেটে যাবে যেকোনো মুহূর্তে। গত কয়েক বছর ধরে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। সল্টলেক পাহাড়-পর্বতে খোলা জায়গায় দিনরাত থেকেছি, না-খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছি, তারই ফল এই রোগ। কাজ শেষ এখন গেলেই বাঁচি। তবে যাওয়ার আগে যা করে গেলাম তার বৃত্তান্ত রেখে যাব। আর পাঁচটা গলা কাটার দলে যেন আমাকে ভেড়ানো না হয়।

    দুই ডিটেকটিভ আর ইনস্পেকটরের মধ্যে দ্রুত পরামর্শ হয়ে গেল জেফারসনের কাহিনি এখন শোনা সমীচীন হবে কিনা—এই নিয়ে।

    ইনস্পেকটর বললে, ডাক্তার, বিপদ কি এসে গেছে? অবস্থা কি খুব খারাপ?

    হ্যাঁ। জবাব দিলাম আমি।

    সেক্ষেত্রে আইনের স্বার্থে ওঁর কাহিনি এখুনি লিখে নেওয়া আমাদের কর্তব্য। বলুন আপনার কী বলার আছে। তবে আবার বলছি যা বলবেন, তা কিন্তু লিখে নেওয়া হবে।

    বসতে বসতে কয়েদি বললে, আপনাদের অনুমতি নিয়ে বসলাম। অ্যানিউরিজম ভারি পাজি রোগ, একটুতে কাহিল হয়ে পড়ি। আধ ঘণ্টা আগে যা ধপড়াই গেছে এখনও সামলে উঠতে পারিনি। মরতে চলেছি মনে রাখবেন, এখন আর মিথ্যে বলা যায় না। যা বলব তার প্রতিটি শব্দ নির্জলা সত্য–আপনারা কীভাবে নেবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার।

    বলে চেয়ারে হেলান দিয়ে অত্যাশ্চর্য কাহিনি শোনাল জেফারসন। ধীরেসুস্থে সাজিয়ে-গুছিয়ে প্রশান্ত কণ্ঠে বলে গেল একটার পর একটা ঘটনা যেন প্রতিটি ঘটনাই অত্যন্ত মামুলি–অভিনব কিছু নয়। নীচে যা লিখছি, তার প্রতিটি কথা কিন্তু জেফারসন নিজের মুখে বলেছে যেভাবে বলেছে লেখাও হচ্ছে সেইভাবে। কেননা লেসট্রেড তা লিখে নিয়েছিল নিজের নোটবইয়ে। সুতরাং বিবরণের সত্যতা সম্বন্ধে আমার গ্যারান্টি রইল।

    এই দু-জনকে আমি যে কতখানি ঘৃণা করি তা আপনারা উপলব্ধি করতে পারবেন না। তা নিয়ে আপনাদের কিছু এসেও যায় না। শুধু জেনে রাখুন, এরা দুটি নরহত্যার অপরাধে অপরাধী। বাপকে খুন করেছিল একজন মেয়েকে আর একজন। সুতরাং বেঁচে থাকার অধিকার এদের ছিল না। খুন করেছে অনেকদিন আগে এত বছর পরে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়ে দণ্ড দেওয়াও সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমি তো জানি ওরা খুনি। তাই ঠিক করলাম আমিই হব একাধারে বিচারপতি, জুরি আর জল্লাদ। আমার জায়গায় আপনারা থাকলে এবং ভেতরে পৌরুষ থাকলে আপনারাও ঠিক তাই করতেন।

    যে-মেয়েটির কথা আমি বললাম, তার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল আজ থেকে বিশ বছর আগে। কিন্তু জোর করে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওই ড্রেবারের সঙ্গে বুক ভেঙে দেওয়া হয়েছিল পাশবিক দিক দিয়ে। মারা যাওয়ার পর তার আঙুল থেকে বিয়ের আংটি খুলে দেখতে দেখতে আর মহাপাপের কথা মনে করতে করতে মরবে ড্রেবার এবং সে-মৃত্যু হবে আমারই হাতে। এই আংটি নিয়ে ড্রেবার আর ওর শাগরেদের পেছনে ঘুরেছি দু-দুটো মহাদেশ–তারপর ধরেছি এই লন্ডন শহরে। ভেবেছিলাম দেশদেশান্তরে ঘুরিয়ে জিভ বার করে দেবে আমার, যাতে বেদম হয়ে হাল ছেড়ে দিই। কিন্তু পারেনি। কাল যদি মারা যাই, যাব বলেই আমার বিশ্বাস, জেনে যাব যে-কাজ করব বলে বিশ বছর আগে প্রতিজ্ঞা করেছি, তা সুষ্ঠুভাবেই করে গেলাম। এ-দুনিয়ায় ওই দু-জনের রক্তে তর্পণ করা ছাড়া আর কোনো কাজ আমার ছিল না। সে-কাজ আমি শেষ করেছি। নিজের হাতে দুনিয়া থেকে ওদের সরিয়ে দিয়েছি। আর কিছু আশা আমার নেই, বাসনাও নেই।

    ওরা বড়োলোক, আমি গরিব। কী কষ্টে যে পেছন ধাওয়া করেছি, তা শুধু আমিই জানি। লন্ডন শহরে পৌঁছে দেখলাম রেস্ত বলতে কিছু নেই, কাজ-টাজ না-জোটালেই নয়। ঘোড়ায় চড়া অথবা ঘোড়ার গাড়ি চালানো আমার কাছে হাঁটা চলার মতোই সত্তায় মিশে গেছে। তাই এক গাড়ির মালিকের কাছে ধরনা দিতেই পেয়ে গেলাম চাকরি। হপ্তায় কিছু টাকা দিতে হবে মালিককে তার ওপরে যা রোজগার করব তা আমার। দিয়ে থুয়ে কিছুই অবিশ্যি থাকত না–তার মধ্যেও কষ্টেসৃষ্টে দু-বেলার খাবার জুটিয়ে নিলাম। সবচেয়ে বেগ পেলাম পথঘাট চিনতে। দুনিয়ায় যত গোলকধাঁধা আজ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে, লন্ডন শহরের গলিখুঁজি তাদের সবাইকে টেক্কা মারতে পারে। মাথা গোলমাল করে দেয়। পাশে খোলা ম্যাপ নিয়ে গাড়ি হাঁকাতাম বলেই একটু একটু করে চিনে গেলাম মূল সড়ক আর প্রধান হোটেলগুলো। তারপর আর খুব একটা অসুবিধে হয়নি।

    ড্রেবার আর স্ট্যানজারসনের ঠিকানা বার করতে বেশ সময় লেগেছে। হাল ছাড়িনি। খুঁজতে খুঁজতে একদিন ঠিক করে ফেলেছি। নদীর ওপারে ক্যামবারওয়েলের একটা বোর্ডিং হাউসে উঠেছিল দু-জনে। ঠিক করলাম এবার আর চোখের আড়াল হতে দেব না। লম্বা দাড়ি রাখার ফলে এখন আর আমাকে দেখলে চেনা যায় না। ঠিকানা যখন পেয়েছি, তখন আর রক্ষে নেই। তক্কে তক্কে থাকব সুযোেগ না-আসা পর্যন্ত।

    লন্ডনের যেখানেই ওরা যাক না কেন দু-জনে, ছায়ার মতো লেগে থাকতাম পেছনে! কখনো গাড়িতে, কখনো পায়ে হেঁটে। তবে গাড়িতেই বেশি সুবিধে–চোখের আড়াল হতে পারত না। খুব ভোরে অথবা গভীর রাত্রে রোজগার করতাম অতি সামান্য মালিক রেগে আগুন হল বখরা না-পেয়ে। লাঞ্ছনা মুখ বুজে সয়ে গেলাম দুই শিকারকে নাগালের মধ্যে পাওয়ার আনন্দে।

    দু-জনেই কিন্তু মহা ধূর্ত। পেছন নেওয়ার সম্ভাবনা আছে ভেবেছিল নিশ্চয়। তাই একলা কখনো রাস্তায় বেড়াত না, সন্ধের সময় তো নয়ই। ঝাড়া দুটো সপ্তাহ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিদিন লেগে রইলাম পেছনে কিন্তু ছাড়াছাড়ি হতে দেখলাম না একবারও। অর্ধেক সময় মদে চুরচুর হয়ে থাকত ড্রেবার, কিন্তু স্ট্যানজারসনকে ঢুলতে কখনো দেখিনি। খুব ভোরে আবার অনেক রাত্রেও খরনজর রেখেছি দু-জনের ওপর ক্ষণেকের জন্যে সুযোগ পাইনি। মুষড়ে পড়িনি। কেননা মন বলছিল, সময় এবার হয়েছে। এবার আর পার পাবে না বাছাধনেরা। ভয় শুধু বুকের এই রোগটা নিয়ে। কাজটা শেষ করার আগেই ফেটে গিয়ে আমাকেই না শেষ করে দেয়।

    একদিন সন্ধে নাগাদ টুকুঁয়ে স্ট্রিটে টহল দিচ্ছি গাড়ি নিয়ে এই রাস্তাতেই থাকত ওরা–দেখলাম একটা ভাড়াটে গাড়ি এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। মালপত্র ভোলা হল গাড়িতে, একটু পরেই বেরিয়ে এসে গাড়ির ভেতরে উঠে বসল ড্রেবার আর স্ট্যানজারসন, গাড়ি ছুটল সামনে। চাবুক হাঁকিয়ে আমিও ঘোড়া ছোটালাম পেছন পেছন, মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। বেশ বুঝলাম, বদমাশ দুটো ফের ডেরা পালটাচ্ছে। ইউস্টন স্টেশনে ওরা নামতেই আমি একটা ছোকরাকে ডেকে আমার ঘোড়াটা দেখতে বলে ঢুকলাম প্ল্যাটফর্মে–ওদের পেছনে পেছনে। শুনলাম, লিভারপুল ট্রেনের টিকিট চাইছে। গার্ড বললে, একটা গাড়ি তো এইমাত্র ছেড়ে গেল। পরের গাড়ি? সে অনেক দেরি। মুখ শুকিয়ে গেল স্ট্যানজারসনের, কিন্তু খুশিতে ডগমগিয়ে উঠল ড্রেবার। হট্টগোলের মাঝে একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলাম বলে শুনতে পেলাম প্রতিটি কথা। ড্রেবার বললে, ওর নাকি একটা ব্যক্তিগত দরকার আছে। স্ট্যানজারসন যেন একটু অপেক্ষা করে ওর জন্যে কাজটা সেরে এসে আবার একসাথে থাকা যাবেখন। বেঁকে বসল স্ট্যানজারসন। মনে করিয়ে দিলে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে দু-জনে কখনো ছাড়াছাড়ি হবে না। ড্রেবার বললে, ব্যাপারটা গোলমেলে, তাই তার একার যাওয়া দরকার। স্ট্যানজারসন কী জবাব দিল শুনতে পেলাম না। কিন্তু রাগে আগুন হয়ে যা মুখে আসে বলতে লাগল ড্রেবার। স্ট্যানজারসন যেন ভুলে না যায় সে ড্রেবারের মাইনে-করা-চাকর হুকুম দিতে যেন না-আসে। স্ট্যানজারসন আর কথা বাড়াল না! শুধু বললে, লাস্ট ট্রেন মিস করলে যেন হ্যালিডেজ প্রাইভেট হোটেলে চলে যায় ড্রেবার ওখানেই থাকবে সে ড্রেবার বললে, এগারোটার আগেই ফিরে আসবে প্লাটফর্মে। বলে, বেরিয়ে গেল স্টেশন থেকে।

    এই হল সুবর্ণ সুযোগ। এত বছর এই সুযোগের প্রতীক্ষায় থেকেছি। দুই শত্রুই এখন আমার হাতের মুঠোয়। একসঙ্গে থাকলে আমাকে রুখতে পারত, কিন্তু আলাদাভাবে পারবে না। তা সত্ত্বেও হঠকারিতা দেখালাম না–ঝোকের মাথায় কিছুই করলাম না। কী করব সে-প্ল্যান ঠিক ছিল অনেক আগে থেকেই। মরবার আগে যদি জানতেই না পারল কেন মরতে হচ্ছে এবং কার হাতে মারা যাচ্ছে তাহলে সে প্রতিহিংসার কোনো মানেই হয় না। তাই এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে আমার পরম শত্রু দু-জন জানবার সুযোগ পায় জীবনটা যেতে বসেছে কোন পাপের শাস্তিতে। দিন কয়েক আগে এক ভদ্রলোক ব্রিক্সটন রোডে অনেকগুলো বাড়ি দেখতে বেরিয়েছিলেন আমার গাড়িতে চেপে–ভুল করে একটা বাড়ির চাবি ফেলে যান গাড়ির মধ্যে। সেই রাতেই ভদ্রলোক চাবি ফেরত নিয়ে যান বটে, কিন্তু তার আগেই চাবির একটা ছাঁচ বানিয়ে নিয়েছিলাম। সেই ছাঁচ থেকে একটা নকল চাবিও করেছিলাম। এতবড়ো শহরে অন্তত একটা বাড়ির মধ্যে ঢোকার ব্যবস্থা করা গিয়েছিল এই চাবির দৌলতে যে-বাড়ি জনমানবশূন্য এবং নির্বিঘ্নে আমার প্ল্যান সম্পন্ন করার পক্ষে আদর্শ। ড্রেবারকে এই বাড়ির মধ্যে ঢোকানোটাই এখন সমস্যা। সমাধান হয়ে গেল সে-সমস্যারও।

    স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে একটার পর একটা মদের আড্ডায় ঢুকতে লাগল ড্রেবার। শেষ আড্ডাটায় রইল আধঘণ্টা। বেরিয়ে যখন এল, পা টলছে। মেজাজ শরিফ। সামনেই একটা ঘোড়ার গাড়ি দেখে উঠে বসল তাতে। আমি গাড়ি নিয়ে চললাম পেছনে এত পেছনে যে আমার ঘোড়ার নাক রইল সামনের গাড়োয়ানের গজখানেক পেছনে। এইভাবেই গেলাম সারারাস্তা; ওয়াটারলু ব্রিজ পেরোলাম। মাইলের পর মাইল রাস্তা পেছন ফেলে এলাম–তারপর চোখ কপালে উঠল যখন দেখলাম গাড়ি এসে দাঁড়ালে সেই বাড়িতেই যে-বাড়িতে এতদিন আস্তানা নিয়েছিল দুই বন্ধু। ফিরে আসার উদ্দেশ্যটা বুঝলাম না। গাড়ি নিয়ে দাঁড়ালাম শ-খানেক গজ তফাতে। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকল ড্রেবার। এক গেলাস জল দেবেন? কথা বলতে বলতে মুখ শুকিয়ে গেছে।

    এক গেলাস জল দিলাম আমি–এক নিশ্বেসে গেলাস খালি করে দিল জেফারসন।

    বললে, বাঁচলাম। যাই হোক, মিনিট পনেরোর মতো দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ বাড়ির ভেতরে ঝটাপটির শব্দ শুনলাম। যেন মারপিট চলছে। তারপরেই খুলে গেল দরজা, ছিটকে বেরিয়ে গেল দুটো লোক–একজন ড্রেবার–আরেকজনের কম বয়স–চিনি না, কখনো দেখিনি। ড্রেবারের কলার ধরেছিল ছোকরা। সিঁড়ির মাথায় এসে এমন ঘাড়ধাক্কা আর লাথি মারল ড্রেবারকে যে রাসকেলটা ঠিকরে গিয়ে পড়ল মাঝরাস্তায়। হাতের লাঠি সাঁই সাঁই করে মাথার ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে ছোকরা বললে তারস্বরে, কুত্তা কোথাকার! ফের যদি ভদ্রলোকের মেয়ের গায়ে পড়তে আসিস তো এমন শিক্ষা দেব যে জীবনে ভুলবি না! সত্যিই হয়তো ড্রেবারকে লাঠিপেটা করে মেরেই ফেলত ছোকরা–এমন প্রচণ্ড রেগেছিল। তবে কাপুরুষ কুত্তাটা আর দাঁড়াল না–টেনে দৌড়াল মোড়ের দিকে। আমার গাড়ি দেখেই লাফিয়ে উঠে বসল ভেতরে। বললে, চলো হ্যালিডেজ প্রাইভেট হোটেল।

    গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়ার পর আনন্দের চোটে এমন বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল আমার যে ভয় হল ঘাটে এসে তরী না-ডোবে। শেষ মুহূর্তে ধমনী না-ফেটে যায়। অ্যানিউজিমকে নিয়েই আমার যত ভয়। আস্তে আস্তে চালালাম গাড়ি, মনে মনে ভাবতে লাগলাম কী করলে এখন সবচেয়ে ভালো হয়। শহরের বাইরে নিয়ে যেতে পারি, মফস্সলে নিরালা গলিঘুজির মধ্যে ঢুকে শেষবারের মতো মুখোমুখি হই। করতাম তাই, এমন সময়ে নিজে থেকেই সমস্যাটার সমাধান করে দিল ড্রেবার। আবার মদের নেশা চাড়া দিয়েছে–বললে প্যালেসে যেতে। ভেতরে ঢোকার আগে আমাকে বলে গেল বাইরে দাঁড়াতে। অনেকক্ষণ রইল ভেতরে। বেরিয়ে এল অত্যন্ত বেহুঁশ অবস্থায়। মন বলল, এই তো সুযোগ। আর ভয় নেই। ড্রেবার এখন আমারই মুঠোয়।

    ঠান্ডা মাথায় খুন করার ইচ্ছে আমার ছিল না। দয়া করে ওই জাতের খুনি ঠাওরাবেন না আমাকে। করলে অবশ্য ক্ষতি ছিল না কিন্তু ন্যায়বিচার ছাড়া আমার কোনো লাভ হত না, আমি যা করব ঠিক করেছিলাম, তা আর হত না। বিশ বছর ধরে ভেবেছি, যেদিন সুযোগ পাব, সেদিন আগে ওর পাপের চেহারাটা সামনে তুলে ধরব–এ-সুযোগ ওকে আমি দেবই। আমেরিকায় হন্যে হয়ে ওদের পেছনে ঘোরবার সময়ে ছোটো ছোটো অনেক চাকরি করতে হয়েছিল। ইয়র্ক কলেজে দারোয়ানগিরি আর ঝাড়ুদারের কাজও করেছিলাম। বিষ নিয়ে একদিন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন প্রফেসর। একটা জিনিস দেখালেন ছাত্রদের জিনিসটা নাকি একটা অ্যালকালয়েড। দক্ষিণ আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানরা তীরে এ-রকম বিষ মাখিয়ে রাখে–সেই বিষ থেকে অ্যালকালয়েডটা উনি নিষ্কাষন করেছেন। মারাত্মক বিষ। এক গ্রেনেই মৃত্যু সঙ্গে সঙ্গে। কোন বোতলে থাকে বিষটা দেখে রেখেছিলাম। গ্লাস খালি হয়ে যাবার পর বোতল থেকে একটু ঢেলে নিয়েছিলাম। ওষুধপত্র বানাতে আমি জানি। তাই ওই বিষ দিয়ে কতকগুলো সাদা বড়ি বানালাম–যে-বড়ি সহজেই গলে যায় হুবহু ওইরকম আরও কয়েকটা বড়ি বানালাম–কিন্তু তার মধ্যে বিষ দিলাম না। দু-রকম বড়ি রাখলাম একটা সাদা কৌটোয়। তখন থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম দুই শয়তানকে কৌটো থেকে বড়ি খাওয়াব–তারপর যা পড়ে থাকবে নিজে খেয়ে নেব। মৃত্যু আসবে নিঃশব্দে বন্দুকের মুখে রুমাল গুঁজে গুলি করলেও আওয়াজ হত–এতে কোনো শব্দই হবে না। বড়ির কৌটো তখন থেকে কিন্তু পকেটে পকেটে রাখতাম। সময় হয়েছে এবার বড়িকে কাজে লাগানোর।

    ঘড়ির কাটা অনেক আগেই বারোটার ঘর ছাড়িয়েছে একটা বাজতে দেরি নেই, রাত নিশুতি, দুর্যোগ চরমে উঠেছে ঝড়ো বাতাস আর তুমুল বৃষ্টিতে রাস্তা ফাঁকা। এত আনন্দ হল আমার যে ইচ্ছে হল গলা ছেড়ে গান ধরি। জানি না আপনাদের কেউ আমার মতো পরিস্থিতিতে কখনো পড়েছেন কিনা। বিশ বছর ধরে যা চেয়েছেন, হঠাৎ যদি তা হাতের মুঠোয় পেতেন–ঠিক আমার মতোই আনন্দে নেচে উঠতেন গাড়ির ওপরেই। চুরুট ধরিয়ে টানতে লাগলাম স্নায়ু শান্ত করার জন্যে। কিন্তু হাত কাঁপতে লাগল সমানে—দপ দপ করতে লাগল দুটো রগ প্রচণ্ড উত্তেজনায়। লাগাম ধরে গাড়ি হাঁকিয়ে যেতে যেতে যেন স্পষ্ট দেখলাম অন্ধকারের মধ্যে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে আমার প্রাণের লুসি আর ওর বুড়ো বাপ। জন ফেরিয়ার। বিশ্বাস করুন আপনাদের যেমন দেখছি ওদেরও যেন ঠিক তেমনি দেখতে পেলাম ঝড়বাদলের সেই রাতে। ঘোড়ার দু-পাশে দু-জন ছুটছিল আর হাসছিল আমার দিকে তাকিয়ে। সমস্ত রাস্তা গেল এইভাবে। তারপর গাড়ি ঢোকালাম ব্রিক্সটন রোডে।

    রাস্তা একদম ফাঁকা–কেউ নেই। বৃষ্টির ঝরঝর আওয়াজ ছাড়া কোনো শব্দও নেই। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে ড্রেবার। মাতালের ঘুম। হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, সময় হয়েছে নামবার।

    চলো, বললে ড্রেবার।

    হোটেলে এসেছে মনে করে আর একটি কথাও না-বলে বাগান দিয়ে হেঁটে এল আমার পেছন পেছন। পাশে পাশে হাঁটতে হল বাধ্য হয়ে–নইলে টলে পড়ে যেত বাগানেই। সদর দরজার চাবি খুলে ঢোকালাম সামনের ঘরে। বিশ্বাস করুন, এখানেও বাপবেটিতে হেঁটে এল আমার সামনে। রাস্তা থেকে বাড়ির ভেতর হাসিমুখে যেন পথ দেখিয়ে আনল আমাকে।

    ঘর অন্ধকার। দুমদাম পা ফেলে বললে ড্রেবার–এ যে দেখছি নরকের অন্ধকার।

    আলো এখুনি ফুটবে, বললাম আমি। মোমবাতি এনেছিলাম সঙ্গে। দেশলাই বার করে জ্বালালাম। নিজের মুখে আলো ফেলে ঘুরে দাঁড়ালাম ওর সামনে। বললাম–এনক ড্রেবার, এবার বলো তো আমি কে?

    মদের নেশায় ঢুলু ঢুলু লাল চোখে ক্ষণেকের জন্যে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল আপাদমস্তক। বুঝলাম, চিনেছে আমি কে। আরক্ত মুখে টলতে টলতে হেঁটে গেল কয়েক পা, দরদর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ল কপাল বেয়ে, খটাখট শব্দে ঠোকাঠুকি লাগল দাঁতে দাঁতে। দেখবার মতো দৃশ্য। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে হেসে নিলাম বেশ কিছুক্ষণ। প্রতিহিংসার মতো মিষ্টি কিছু নেই, এই আমি জানতাম বরাবর। কিন্তু আত্মার শান্তি যে তার চাইতেও মিষ্টি, তা জানলাম সেই প্রথম।

    বললাম–কুকুর কোথাকার! সল্টলেক সিটি থেকে তোর পেছন নিয়েছি গিয়েছি সেন্ট পিটাসবার্গ–প্রত্যেকবার পালিয়েছিস নাগালের বাইরে। আর পালাতে পারবি না। অনেক ঘুরেছিস আর তোকে ঘুরে মরতে হবে না। হয় তুই, আর না হয় আমি কালকের সূর্য ওঠা আর দেখব না। কেঁচোর মতো কুঁচকে আরও তফাতে সরে গেল ড্রেবার। মুখ দেখে মনে হল আমাকে। বদ্ধ উন্মাদ ঠাউরেছে। সেই মুহূর্তে আমি অবশ্য পাগলই হয়ে গিয়েছিলাম। দমাদম হৃদঘাত শোনা যাচ্ছিল রগের শিরায় যেন হাতুড়ি পড়ছে। নাক দিয়ে বাড়তি রক্ত বেরিয়ে না-গেলে বোধ হয় সিধে থাকতে পারতাম না–জ্ঞান হারাতাম। রক্ত বেরিয়ে যেতেই বাঁচলাম।

    দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা ওর নাকের সামনে নাড়তে নাড়তে গলার শির তুলে বললামলুসি ফেরিয়ারকে ভাবতে এখন কেমন লাগছে বল? ফলটা পেতে বড্ড দেরি হল রে–কিন্তু রেহাই তোর নেই। ঠোঁট কাঁপতে লাগল কাপুরুষের প্রাণ ভিক্ষা বৃথা জেনেই সে চেষ্টা করেনি—কিন্তু চোখে দেখলাম সেই অনুনয়।

    বললে বিড় বিড় করে খুন করবে?

    খুন? দাঁতে দাঁত পিষে বললাম আমি-খুন কীরে? পাগলা কুত্তাকে কেউ খুন করে না। পাগলা কুত্তার মতোই মারে! সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে যাকে ভালোবেসেছিলাম, যার বাবাকে কসাইয়ের মতো খুন করতে তোদের হাত কাঁপেনি, মরা বাবার কাছ থেকে হিড় হিড় করে যাকে টেনে নিয়ে গিয়ে তোর নোংরা ব্যাভিচারের হারেমে পুরেছিলি–সেই লুসির ওপর একবারও কি তুই দয়া দেখিয়েছিলিস?

    চিৎকার করে বললে—-আমি মারিনি লুসির বাবাকে।

    কিন্তু লুসির বুক তুই ভেঙেছিলি, কৌটোটা ওর সামনে বাড়িয়ে ধরে বলেছিলাম ভীষণ গলায়। ভগবানের বিচার আছে কিনা দেখা যাক। দুটো বড়ি আছে এতে। একটা খাবি তুই একটা আমি। একটাতে আছে মৃত্যু–একটাতে জীবন। ভগবান বলে যদি কিছু থাকে দুনিয়ায় দেখা যাক কে মরে কে বাঁচে।

    বিকটভাবে চেঁচাতে চেঁচাতে হাতে পায়ে ধরতে লাগল ড্রেবার কিন্তু গলায় ছুরি চেপে ধরে বড়ি খেতে বাধ্য করলাম আমি। বাকি বড়িটা খেলাম নিজে। তারপর মিনিটখানেক নিঃশব্দে চেয়ে রইলাম দু-জনে দু-জনের মুখের দিকে কে বাঁচে কে মরে দেখবার জন্যে। যন্ত্রণার প্রথম অভিব্যক্তি মুখে ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম বিষের কাজ আরম্ভ হয়ে গেছে। সে-দৃশ্য আমি কোনোদিন ভুলব না। প্রথম প্রতিক্রিয়াটা দেখা গেল চোখে। দেখেই অট্টহাসি হাসতে লাগলাম। লুসির অভিশপ্ত বিয়ের আংটি চোখের সামনে নাড়তে লাগলাম। খুব বেশি সময় অবশ্য পেলাম না। অ্যালকালয়েডটার বিষক্রিয়া সত্যিই অত্যন্ত দ্রুত। প্রথমে একটা নিদারুণ যন্ত্রণায় খিচ ধরল পা থেকে মাথা পর্যন্ত, তারপর দু-হাত সামনে ছুঁড়ে চেষ্টা করল বাতাস খামচে ধরার। পরক্ষণেই টলতে টলতে ভাঙা গলায় বীভৎসভাবে চেঁচিয়ে উঠে দড়াম করে আছড়ে পড়ল মেঝের ওপর–আর নড়ল না। পা দিয়ে চিত করে শুইয়ে হাত দিলাম বুকের ওপর। হৃৎপিণ্ড আর চলছে না। মারা গেছে ড্রেবার।

    দর দর করে রক্ত পড়ছিল আমার নাক দিয়ে। হৃক্ষেপ করিনি। কী জানি তখন কেন খেয়াল হল, ওই রক্ত নিয়ে দেওয়ালে কিছু লিখে যাই। পুলিশকে ভুলপথে চালানোর জন্যেই বোধ হয় বদ বুদ্ধিটা এসেছিল মাথায়। মনে তখন ফুর্তি উপচে পড়েছে। নিউইয়র্কের একটা ঘটনা মনে পড়ল। খুন হয়েছিল একজন জার্মান। ডেডবডির ওপরে লেখা ছিল RACHE. খবরের কাগজওয়ালারা নানান কথা বলেছিল এই নিয়ে। খুনটা নাকি গুপ্ত সমিতির কীর্তি। ভাবলাম নিউইয়র্কওয়ালারা যে-ধোকায় ভোলে, লন্ডনওয়ালারাও নিশ্চয়ই সেই ধোঁকায় ভুলবে। তাই আঙুল ডোবালাম নিজের রক্তে, দেওয়ালে লিখলাম RACHE. বেরিয়ে এলাম বাইরে, গাড়িতে চেপে দেখলাম আশপাশ। কেউ নেই। রাস্তা ফাঁকা। নিশুতি রাত। কনকনে ঠান্ডা। ঝড়বাদলা একটুও থামেনি। কিছুদূর গাড়ি হাঁকিয়ে যাওয়ার পর পকেটে হাত দিয়ে দেখি লুসির বিয়ের আংটিটা নেই। মাথায় বাজ পড়ল যেন। লুসির স্মৃতি বলতে ওই আংটি ছাড়া কিছুই আর কাছে ছিল না। ড্রেবারের লাশের ওপর ঝুঁকে পড়ার সময়ে পকেট থেকে পড়ে গেছে নিশ্চয়। সঙ্গেসঙ্গে ফিরে এলাম গাড়ি নিয়ে। কপালে যাই থাকুক না কেন, ও-আংটি আমার চাই। পাশের গলিতে গাড়ি রেখে হনহন করে হেঁটে বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছি মুখোমুখি ধাক্কা খেলাম একজন পুলিশের চৌকিদারের সঙ্গে। পাছে সন্দেহ করে বসে এত রাতে কী করতে এসেছি ফাঁকা বাড়িতে, তাই মালের অভিনয় করে বেঁচে গেলাম সে-যাত্রা।

    ড্রেবার নিধন তো হল, এবার স্ট্যানজারসনকেও যে মারতে হবে একই পন্থায়–নইলে জন ফেরিয়ারের ঋণ তো শোধ হবে না। হ্যালিডেজ প্রাইভেট হোটেলে উঠেছে জানতাম। সারাদিন ঘুর ঘুর করলাম আশেপাশে কিন্তু একবারও বাইরে এল না শয়তান। মহা ধড়িবাজ তো! নিজেকে আগলাতে জানে। নির্দিষ্ট সময়ে ড্রেবার না ফিরতেই নিশ্চয় আঁচ করেছিল বিপদ এসে গেছে। কিন্তু যত ধড়িবাজই হোক না কেন, বাড়ির বাইরে পা না-দিলেও আমার নাগালের বাইরে যে থাকা যায় না–এ-বুদ্ধি তার ঘটে ছিল না। শোবার ঘরের জানলা কোথায় দেখে নিলাম। পরের দিন কাকডাকা ভোরে মই জোগাড় করলাম পাশের হোটেল থেকে মই লাগিয়ে জানলা দিয়ে ঢুকলাম ভেতরে। ঘুম থেকে টেনে তুলে বললাম অনেকদিন আগে একটা প্রাণ হরণের জবাব দেওয়ার সময় এখন হয়েছে। ড্রেবার মরেছে কীভাবে বলবার পর বিষবড়ির কৌটো বাড়িয়ে দিলাম জীবন অথবা মৃত্যুকে বেছে নেওয়ার জন্যে। কিন্তু বাঁচবার এই শেষ সুযোগ তার মনঃপূত হল না। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে গলা টিপে ধরতে গেল আমার। নিজেকে বাঁচানোর জন্যে বাধ্য হয়ে ছুরি মারলাম বুকে। বড়ি খেলেও বাঁচত না ঠিকই। ভগবানের বিচারে ভুল হয় না। ঠিক বিষ বড়িটাই মুখে পুরতে হত নিয়তির নিয়মে।

    আর বিশেষ কিছু বলার নেই আমার। বলতেও পারছি না–প্রাণটা গলায় এসে ঠেকেছে। আমেরিকা ফিরে যাওয়ার জন্যে টাকা দরকার। তাই দিনকয়েক গাড়ি হাঁকিয়ে কাটালাম স্রেফ পয়সার ধান্দায়। গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম গাড়ির আড্ডায়, এমন সময়ে ছেড়া পোশাক পরা রাস্তার একটা ছোকরা এসে বললে জেফারসন হোপ বলে কেউ আছে কিনা। ২২১বি বেকার স্ট্রিটের এক ভদ্রলোক ডেকেছেন, গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। সন্দেহ করার কোনো কারণ ছিল না। তাই এলাম। আসার পরেই এই ভদ্রলোক লোহার বেড়ি পরিয়ে দিল হাতে–জীবনে এমন সুন্দরভাবে হাতকড়া লাগাতে কাউকে দেখিনি। আমাকে খুনি মনে করতে পারেন আপনারা, তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ আমি জানি আপনাদের মতোই আমিও একজনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

    মর্মস্পর্শী বর্ণন-ভঙ্গিমার ফলে লোমহর্ষক এই কাহিনি দাগ কেটে বসে গেল মনের মধ্যে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম প্রতিটা কথা। পোড়খাওয়া গোয়েন্দা দু-জনও দেখলাম অভিভূত হয়েছে। দু-দুটো খুনের আগাপাশতলা জানার পরও খুনির কাহিনি শোনবার জন্যে উগ্রীব হয়ে বসে আছে। কাহিনি শেষ হওয়ার পর কারো মুখে কিছুক্ষণ আর কথা ফুটল না। ঘর নিস্তব্ধ। শুধু যা খসখস ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ হচ্ছে লেসট্রেডের পেনসিলে শর্টহ্যান্ডে শেষ ক-লাইন লিখে নিচ্ছে কর্তব্যনিষ্ঠ ডিটেকটিভ।

    অবশেষে মুখ খুলল শার্লক হোমস। বলল, একটা প্রশ্ন। আমার বিজ্ঞাপনের জবাবে আংটি নিতে কে এসেছিল?

    কৌতুকছলে চোখ টিপল জেফারসন হোপ। বলল, আমার ব্যাপারে শুধু আমাকে নিয়েই কথা বলা ভালো, অন্যকে টানতে চাই না। আপনার বিজ্ঞাপনটা দেখে ভাবলাম সত্যিই হয়তো কেউ কুড়িয়ে পেয়েছে আংটিটা অথবা আংটির ফাঁদ পেতে কেউ আমায় ধরতে চাইছে। আমার বন্ধুটি নিজে থেকেই আংটি আনতে চাইল। খুব ঠকিয়েছে আপনাকে, তাই না?

    তা আর বলতে, আন্তরিকভাবেই বললে হোমস।

    গম্ভীর মুখে ইনস্পেকটর বললে, জেন্টেলমেন, এবার তো আইনমাফিক কয়েদিকে হাজতে ঢোকাতে হয়। বেস্পতিবার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করব আসামিকে আপনারা দয়া করে আসবেন, সাক্ষী হতে হবে। আমার দায়িত্ব সেই পর্যন্ত। বলে ঘণ্টা বাজিয়ে দু-জন পাহারাদারকে দিয়ে আসামিকে পাঠিয়ে দিল হাজতে। আমি আমার বন্ধু বাইরে এসে ছ্যাকড়া গাড়ি চেপে ফিরে এলাম বেকার স্ট্রিটে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন
    Next Article When the World Screamed – Arthur Conan Doyle

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }