Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প813 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০২. বাস্কারভিল বংশের অভিশাপ

    ডক্টর জেমস মর্টিমার বললেন, আমার পকেটে একটা পাণ্ডুলিপি রয়েছে।

    আপনি ঘরে ঢুকতেই লক্ষ করেছি, হোমস জবাব দিলে।

    পাণ্ডুলিপিটা পুরোনো।

    জাল পাণ্ডুলিপি যদি না হয়, তাহলে অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের।

    কী করে বললেন, বলুন তো?

    যতক্ষণ কথা বলছেন, ততক্ষণ এক ইঞ্চি কি দু-ইঞ্চির মতো পাণ্ডুলিপি বার করে রেখেছেন আমার চোখের সামনে। দলিল দেখে যদি তা কোনযুগে লেখা আঁচ করা না-যায়, তাহলে বিশেষজ্ঞ হিসেবে খুবই নিম্নশ্রেণির বলতে হবে। এ-বিষয়ে তা মার লেখা প্রবন্ধটা সম্ভবত পড়েছেন। আমার হিসেবে আপনার পাণ্ডুলিপির তারিখ ১৭৩০।

    সঠিক তারিখ ১৭৪২, ব্রেস্ট-পকেট থেকে পাণ্ডুলিপিটা টেনে বার করতে করতে বললেন ডক্টর মটির্মার। এটা একটা পারিবারিক পাণ্ডুলিপি। আমার জিম্মায় রেখে গেছেন স্যার চার্লস বাস্কারভিল। মাস তিনেক আগে তাঁর অকস্মাৎ শোচনীয় মৃত্যুতে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল ডেভনশায়ারে। বলে রাখি, আমি ছিলাম একাধারে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু আর গৃহচিকিৎসক। ভদ্রলোক অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষ ছিলেন। ব্যবহারিক বুদ্ধি আর ধূর্ত দুটোই সমান প্রখর ছিল। কিন্তু আমার মতন ছিলেন কল্পনাহীন। তা সত্ত্বেও এ-দলিল তিনি সিরিয়াস চোখে দেখেছিলেন, মনকেও যে পরিণতির জন্যে তৈরি রেখেছিলেন, শেষকালে ঠিক সেইভাবেই তা ঘটেছে।

    হাত বাড়িয়ে পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে হাঁটুর ওপর বিছিয়ে ধরল হোমস।

    ওয়াটসন, লম্বা এস আর ছোটো এসকে কীরকম পালাবদল করে লেখা হয়েছে লক্ষ করেছ নিশ্চয়। যে-কটা লক্ষণ দেখে তারিখটা আঁচ করেছি, এটা তার মধ্যে একটা।

    ওর কাঁধের ওপর দিয়ে হলদেটে কাগজ আর ফিকে হয়ে আসা পাণ্ডুলিপির পানে তাকালাম আমি। মাথায় লেখা : বাস্কারভিল হল, এবং তলায় বড়ো বড়ো টানা ছাঁদে একটা সাল : ১৭৪২।

    লিখিত বিবৃতি বলে মনে হচ্ছে।

    হ্যাঁ, বাস্কারভিল পরিবারে বংশপরম্পরায় একটা কিংবদন্তি চলে আসছে। এটা সেই কিংবদন্তির লিখিত বিবৃতি।

    এর চাইতে আধুনিক আর প্র্যাকটিক্যাল কোনো ব্যাপারে আমার পরামর্শ নিতে এসেছেন আশা করি?

    অত্যন্ত আধুনিক। অত্যন্ত প্র্যাকটিক্যাল, অত্যন্ত জরুরি ব্যাপার ফয়সালা করতেই হবে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। পাণ্ডুলিপিটা অবশ্য ছোটো, বিষয়টার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আপনি অনুমতি দিলে পড়ে শোনাই।

    যেন হাল ছেড়ে দিল হোমস। বসল হেলান দিয়ে। আঙুলের ডগাগুলো একত্র করে বন্ধ করল চোখের পাতা। আলোর সামনে পাণ্ডুলিপি ধরে উচ্চনিনাদী চড়চড়ে গলায় প্রাচীন দুনিয়ার অদ্ভুত কাহিনিটি পড়ে শোনালেন ডক্টর মর্টিমার :

    বাস্কারভিল কুকুরের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেকরকম বিবৃতি শোনা যায়। কিন্তু যেহেতু আমি সরাসরি হিউগো বাস্কারভিলের বংশধর এবং এ-গল্প আমি শুনেছি আমার বাবার মুখে, তিনি শুনেছেন তার বাবার কাছে, তাই ঠিক যেভাবে লেখা হচ্ছে সেইভাবেই ঘটনাটা ঘটেছিল এ বিশ্বাস আমি রাখি। পুত্রগণ, বিধাতার বিচারের ওপর তোমাদেরও আস্থা রাখতে বলব এই কারণে যে পাপের সাজা যিনি দেন, অত্যন্ত দরাজ হৃদয়ে তিনি তা ক্ষমাও করেন। প্রার্থনা আর অনুশোচনা দ্বারা অপসারণ ঘটে না এমন কোনো অভিশাপ এ-সংসারে নেই। তাই, এ-গল্প পড়ে অতীতের কর্মফলকে ভয় করতে না-শিখে বরং ভবিষ্যতে পরিণামদর্শী থেকো, সতর্ক থেকো; যে জঘন্য নোংরা ইন্দ্রিয়াবেগের জন্যে এত কষ্ট সয়েছে আমাদের বংশ, তা যেন ফের ফিরে না-আসে আমাদের কাজকর্মে।

    মহাবিপ্লবের সময়ে (মহাপণ্ডিত লর্ড ক্ল্যারেনডন লিখিত এই বিপ্লবের ইতিহাসের প্রতি একান্তভাবে তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি) বাস্কারভিল জমিদারের এই খামারবাড়ি হিউগো বাস্কারভিলের দখলে ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুর্দান্ত, দুষ্ট, নাস্তিক এবং দেবনিন্দুক পুরুষ। প্রতিবেশীরা হয়তো তার এইসব বদগুণ ক্ষমার চোখে দেখে থাকতে পারেন, কেননা এসব অঞ্চলে সাধুসন্তরা কোনোকালেই সুবিধে করে উঠতে পারেননি; কিন্তু ক্রুর কৌতুকবোধ, উচ্ছঙ্খলতা আর লাম্পট্যর দরুন সারা পশ্চিমাঞ্চলে একটা প্রবাদে পরিণত হয়েছিল হিউগো বাস্কারভিলের নাম। ঘটনাক্রমে প্রেমে পড়েছিলেন এই হিউগো (তমসাচ্ছন্ন এহেন ইন্দ্রিয়াবেগকে যদি আলোকোজ্জ্বল এই নামে অভিহিত করা যায়)। বাস্কারভিল এস্টেটের কাছেই এক তালুকদারের জমিজমা ছিল। এরই মেয়েকে ভালোবেসে ফেললেন হিউগো। মেয়েটি কিন্তু বিচক্ষণ, সতর্ক এবং গুণবতী। ভালো মেয়ে হিসেবে বেশ সুনাম ছিল। হিউগোর কুকীর্তি শুনেছিল বলেই এড়িয়ে চলত তাঁকে। ভীষণ ভয় পেত। তাই একদিন মেয়েটিকে খামারবাড়ি থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে এলেন হিউগো, সঙ্গে ছিল জনা পাঁচ ছয় কুঁড়ের বাদশা মহা বদমাশ ইয়ারবন্ধু। মেয়েটির বাপ আর ভাইরাও রেহাই পেল না, সবাইকেই টেনে এনে বাস্কারভিল ভবনে তুলল হিউগো। সেদিন ছিল ২৯ সেপ্টেম্বর, সেন্ট মাইকেলের ভোজ উৎসব। মেয়েটিকে ওপরের একটা ঘরে আটকে রেখে রোজ রাতের মতো সেদিনও সপারিষদ হিউগো মদ্যপান আর হই-হল্লায় মত্ত হলেন। ওপরতলায় বন্দিনী ভাগ্যহীনা মেয়েটির অবস্থা সঙিন হয়ে উঠল। ভয়ানক খিস্তিখেউর, গান আর চেঁচামেচি শুনে। সে জানত পেটে মদ পড়লে হিউগো বাস্কারভিল নাকি খোদ শয়তান বনে যান ও নাম তখন মুখে আনলেও নরকে যেতে হয়। ভয়ে আতঙ্কে মরিয়া হয়ে এ অবস্থায় অত্যন্ত সাহসী আর তৎপর পুরুষমানুষ যা করত, মেয়েটিও তাই করে বসল। দক্ষিণ দেওয়ালের আইভিলতা ধরে ঝুলতে ঝুলতে পাতার আড়ালে গা ঢেকে নেমে এল নীচতলায় এবং জলাভূমির ওপর দিয়ে রওনা হল বাড়ির দিকে। বাস্কারভিল হল থেকে মেয়েটির বাবার খামারবাড়ি কিন্তু ন-মাইল দূরে। হলের দক্ষিণ দেওয়ালে আজও এই আইভিলতা দেখতে পাবে।

    ঘটনাক্রমে এর কিছুক্ষণ পর খাদ্য পানীয় নিয়ে হিউগো নিজেই ওপরে এলেন বন্দিনীর ঘরে। আরও জঘন্য বস্তু বোধ হয় ছিল সঙ্গে। বন্ধুদের রেখে এসেছিলেন নীচতলায়। ঘরে ঢুকে দেখলেন খাঁচা খালি, পাখি পালিয়েছে। তৎক্ষণাৎ যেন স্বয়ং শয়তান ভর করল তার কাঁধে। সিঁড়ি বেয়ে ঝড়ের মতো নেমে এলেন একতলার ডাইনিং হলে, এক লাফে উঠে পড়লেন টেবিলের ওপর, মদ্য পরিবেশনের সরু-গলা পাত্র আর খাদ্যসম্ভার বোঝাই বারকোষ ঘুরতে লাগল চোখের সামনে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ইয়ারবন্ধুদের বললেন, অশুভ শক্তির হাতে নিজের দেহমন সঁপে দিতেও তিনি পেছপা নন–কিন্তু সেই রাতেই মেয়েটিকে ধরে আনতে হবে মাঝরাস্তা থেকে। মাতাল বন্ধুরা গোল হয়ে ঘিরে শিহরিত অন্তরে শুনল ক্রোধান্বিত হিউগোর সেই শপথ। কিছু বদমাশ আর মাতাল একযোগে চিৎকার করে বললে, তাহলে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হোক মেয়েটির পিছনে। শুনেই ছুটতে ছুটতে বাড়ির বাইরে এলেন হিউগো, হাঁকড়াক করে সহিসদের বললেন, ঘোড়া সাজাতে, কুকুরশালার দরজা খুলে দিতে। ঘোড়া আসতেই লাফিয়ে উঠলেন পিঠের ওপর, মেয়েটির ফেলে যাওয়া একটা রুমাল ফেলে দিলেন হিংস্র কুকুরগুলোর সামনে এবং ডাকাতে হুংকার ছেড়ে সারবন্দি কুকুর নিয়ে টগবগিয়ে ধেয়ে চললেন চন্দ্রালোকিত জলাভূমির ওপর দিয়ে।

    বেশ কিছুক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল মাতাল বন্ধুরা–চক্ষের নিমেষে কী যে ঘটে গেল, তা অনুধাবন করতেই গেল বেশ কিছু সময়। কিন্তু অচিরেই জাগ্রত হল দুষ্ট বুদ্ধি মনের মতো কাজ ঘটতে চলেছে জলাভূমির বুকে–তবে আর দেরি কেন? আচম্বিতে প্রচণ্ড হই-হুল্লায় যেন ফেটে পড়ল সমাগত অতিথিরা, চিৎকার করে কেউ খুঁজল পিস্তল, কেউ ঘোড়া, কেউ ফ্লাস্কভরতি সুরা। কিছুক্ষণ পরে কিছুটা সুবুদ্ধির উদয় হতে তেরো জনের পুরো দলটা ঘোড়ায় চেপে ধাওয়া করল পেছন পেছন। চাঁদের আলোয় ফুটফুট করছে চারদিক। যে-পথে পিতৃগৃহে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে মেয়েটির, সেই পথ ধরেই ওরা দ্রুতবেগে এগিয়ে চলল সামনে।

    মাইলখানেক কি দুয়েক যাওয়ার পর দেখল জলাভূমির ওপর দিয়ে আসছে একজন নৈশ মেষপালক। চিৎকার করে ডাকল কাছে। জিজ্ঞেস করলে শিকার অর্থাৎ মেয়েটিকে দেখেছে কিনা। শোনা যায়, ভয়ের চোটে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারছিল না বেচারা মেষপালক। শেষ পর্যন্ত কোনোমতে বলেছিল, হ্যাঁ, হতভাগিনী মেয়েটিকে সে দেখেছে–পেছনে তাড়া করে চলেছে কুকুরের পাল। বলেছিল–তার চাইতেও ভয়ংকর দৃশ্য আমি দেখেছি। কালো ঘোড়ায় চেপে আমার পাশ দিয়ে ছুটে যেতে হিউগো বাস্কারভিলকে—পেছন পেছন ছুটছে একটা প্রকাণ্ড কুকুর। যেন সাক্ষাৎ নরকের কুকুর! ঈশ্বর করুন ও কুকুর যেন আমার পেছনে কখনো তাড়া না-করে।

    মাতাল ইয়ারবকশিরা এই শুনে বাপান্ত করল মেষপালকের এবং বেগে ঘোড়া ছোটাল সামনে। কিছুদূর যেতে-না-যেতেই ঠান্ডা হিম হয়ে এল গায়ের চামড়া। জলাভূমির ওপর দিয়ে ভেসে এল ধাবমান অশ্বখুরধ্বনি, পরমুহূর্তেই উল্কার মতো পাশ দিয়ে উধাও হল হিউগোর কালো ঘোড়া; মুখ দিয়ে ঝরছে সাদা ফেনা, লাগাম লুটোচ্ছে ধুলোয়, পিঠের জিন শূন্য। একা থাকলে মাতাল বন্ধুরা কেউ আর এগোেত না এই দৃশ্য দেখে, চম্পট দিত ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে। অজানা আতঙ্কে গা হিম হয়ে গেল প্রত্যেকের প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে দলবেঁধে এগিয়ে চলল সামনে খাড়া হয়ে রইল গায়ের লোম। এইভাবে ধীর কদমে যেতে যেতে অবশেষে নাগাল ধরে ফেলল কুকুরগুলোর। প্রত্যেকটা কুকুরই ভালো জাতের; সাহস আর বিক্রমের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু দঙ্গল বেঁধে কেঁউ কেঁউ করছে একটা ঢালু জায়গায় দাঁড়িয়ে জলাভূমির এই তালকে আমরা বলি গয়াল। কেউ গুটি গুটি কেটে পড়ার তালে ছটফট করছে–স্থির থাকতে পারছে না কিছুতেই, কেউ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে সামনে বিস্তৃত সংকীর্ণ উপত্যকার দিকে।

    মাতালদের নেশা তখন কেটে এসেছে, দাঁড়িয়ে গেল সেখানে যে-নেশা নিয়ে রওনা হয়েছিল, এখন আর তা নেই। তিনজন ছাড়া কেউ আর এক পা-ও এগোতে রাজি নয়। ঢাল বেয়ে এগোল যে তিনজন, হয় তাদের বুকের পাটা ওদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, নয়তো আকণ্ঠ মদ গেলায় সবচেয়ে বেশি মাতাল। ঢালু জায়গাটা শেষ হয়েছে একটা প্রশস্ত চত্বরে। প্রকাণ্ড দুটো পাথর খাড়া করা হয়েছে মাঝখানে। সুদূর অতীতে এ-পাথর কারা খাড়া করে রেখেছিল, এখন তাদের নামও কেউ জানে না। পাথরগুলো কিন্তু এখনও গেলে সেখানে দেখতে পাওয়া যাবে। চাদের আলো ঝকঝক করছে খোলা চত্বরে, মাঝামাঝি জায়গায় লুটিয়ে রয়েছে মেয়েটির দেহ নিষ্প্রাণ ভয়ে আর অপবাদে দেহপিঞ্জর ছেড়ে পালিয়েছে প্রাণপাখি। কাজেই লুণ্ঠিত হিউগো বাস্কারভিলের দেহ অথবা মেয়েটির প্রাণহীন দেহ দেখেও কিন্তু মাথার চুল খাড়া হয়নি ডানপিটে-শিরোমণি এই তিন বদমাশের হল আরেক দৃশ্য দেখে। হিউগোর পাশে দাঁড়িয়ে টুটি কামড়ে রয়েছে একটা মহাকায় জীব, দেখতে কুকুরের মতন, কিন্তু আকার পৃথিবীর যেকোনো কুকুরের চাইতে বড়ো–মরজগতের কোনো চক্ষু, এত বড়ো কুকুর কখনো দেখেনি। তিন দুঃসাহসীর চোখের সামনেই হিউগোর টুটি কামড়ে ছিড়ে ফেলে মুখ তুলল অপার্থিব কুকুরটা এবং রক্তঝরা চোয়াল তুলে নরকের আগুন-জ্বলা চোখে তাকাল তিনজনের দিকে। দেখেই ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল ডানপিটেদের। নিঃসীম আতঙ্কে কলজে-ছেড়া চিৎকার করে উঠল তিনজনেই এবং ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে বিকট স্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে ধেয়ে চলল জলাভূমির উপর দিয়ে। শোনা যায়, এই দৃশ্য দেখে সেই রাত্রেই মারা যায় একজন, বাকি জীবনটা পাগল হয়ে থেকেছে অন্য দু-জন।।

    পুত্রগণ, এই হল গিয়ে বাস্কারভিল কুকুরের আবির্ভাব কাহিনি। সেই থেকেই এ-বংশে অনেক উপদ্রবের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কুকুরটা। সব কথা লিখলাম যাতে ভয়টা কম হয়। আবছা জানলে ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরে, স্পষ্ট জানা থাকলে অত ভয় হয় না। অনুমান করে চমকে চমকে উঠতে হয় না। এ-বংশের অনেকেরই মৃত্যু অত্যন্ত রহস্যময়! মৃত্যু এসেছে আচমকা রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে। শান্তি পায়নি মরণকালে। তা সত্ত্বেও বলব আমরা যেন পরমপুরুষের শরণ নিই। তিন চার পুরুষ কেটে যাওয়ার পর নিরপরাধ বংশধরদের তিনি নিশ্চয় আর শাস্তি দেবেন না। পুত্রদের, পরম পিতার দয়ার ওপর তোমাদের আমি ছেড়ে দিচ্ছি। তোমরা তাকে ডাকো। আর, সন্ধের পর যখন অশুভ শক্তির নরক গুলজার চলে জলাভূমিতে, তখন ও-তল্লাট মাড়িয়ো না।

    (হিউগো বাস্কারভিলের এই কাহিনি তাঁর দুই ছেলে রোজার আর জন-কে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে নির্দেশ আছে, বোন এলিজাবেথকে যেন এ-সম্পর্কে একটা কথাও না-বলা হয়।)

    অত্যাশ্চর্য বিবরণ পড়া শেষ করে চশমাটা কপালে ঠেলে তুলে দিয়ে শার্লক হোমসের দিকে তাকালেন ডক্টর মর্টিমার। হাই তুলল হোমস। সিগারেটটা টোকা দিয়ে নিক্ষেপ করল অগ্নিকুণ্ডে।

    বলল, হয়েছে।

    কৌতূহলোদ্দীপক নয় কি?

    রূপকথা সংগ্রহ যাদের বাতিক, তাদের কাছে।

    পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা খবরের কাগজ বার করলেন ডক্টর মর্টিমার।

    মি. হোমস, এবার তাহলে আপনাকে কিছু সাম্প্রতিক খবর দেওয়া যাক। কাগজটা ডেভন কাউন্টি ক্রনিকল, এ বছরের চোদ্দোই জুন তারিখের। ওই তারিখের দিনকয়েক আগে স্যার চার্লস বাস্কারভিলের মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে এই খবরে।

    ঝুঁকে বসল বন্ধুবর, নিবিড় হয়ে এল মুখচ্ছবি। কপাল থেকে চশমাটা চোখের ওপর নামিয়ে পড়া শুরু করলেন ডক্টর মর্টিমার:

    স্যার চার্লস বাস্কারভিলের সাম্প্রতিক অকস্মাৎ মৃত্যুতে বিষাদের কালো ছায়া নেমেছে সারা তল্লাটে। আগামী নির্বাচনে লিবারাল-প্রার্থী হিসাবে মিডডেভন কেন্দ্রে এঁর থাকার সম্ভাবনা ছিল। বাস্কারভিল হলে স্বল্পকাল বসবাস করলে ওঁর সংস্পর্শে যারা যারা এসেছে, তারাই তার অমায়িক চরিত্র, চূড়ান্ত উদারতায় মুগ্ধ হয়েছে। ভালোবেসেছে, শ্রদ্ধা করেছে। এই ক্ষয়িষ্ণু বৈভবের যুগে ইনি চমক সৃষ্টি করেছেন, নতুন খবর তৈরি করেছেন। সুপ্রাচীন এক বংশ দুর্দিনের কবলে পড়ে যখন অনুজ্জ্বল, উনি তখন অল্প বয়সে কুবেরের সম্পদ অর্জন করে দেশে ফিরেছেন এবং সেই টাকায় বংশের হৃতগৌরব ফিরিয়ে এনেছিলেন, স্যার চার্লস দক্ষিণ আফ্রিকায় ফাটকাবাজি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। ঝোঁকের মাথায় যারা টাকার লোভে আরও এগিয়ে যায়, তারাই শেষে পস্তায় লোকসানের পালা শুরু হলে। স্যার চার্লস কিন্তু বুদ্ধিমান পুরুষ। লাভের টাকা নিয়ে ফিরে আসেন ইংলন্ডে! বাস্কারভিল হলে উঠেছেন মাত্র দু-বছর আগে। এর মধ্যেই লোকমুখে ছড়িয়ে গেছে কীভাবে তিনি বিরাট সব পরিকল্পনার মাধ্যমে সংস্কার আর শ্রীবর্ধনের কাজে হাত দিয়েছিলেন। ওঁর অকস্মাৎ মৃত্যুতে সব কাজ এখন বন্ধ। যেহেতুে উনি নিঃসন্তান, তাই তার আন্তরিক ইচ্ছে ছিল জীবদ্দশাতেই ওঁর অগাধ টাকায় সারাতল্লাটের শ্রীবৃদ্ধি দেখে যেতে। তাই তার অকাল মৃত্যুতে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। স্থানীয় নানা তহবিলে এবং জেলার নানারকমের দাতব্য ব্যাপারে তাঁর মুক্তহস্তে চাঁদা দেওয়ার খবর ইতিপূর্বে বহুবার এই স্তম্ভে প্রকাশিত হয়েছে।

    স্যার চার্লসের মৃত্যুসংক্রান্ত পরিস্থিতি তদন্তের ফলে সম্পূর্ণ পরিষ্কার না-হলেও স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে কুসংস্কারজনিত গুজব অপসারণ করতে পেরেছে। মৃত্যুর পেছনে নোংরা কারসাজি আছে, এমন ভাববার কোনো কারণ পাওয়া যায়নি। অস্বাভাবিক কারণে স্যার চার্লস মারা গেলেন, এমন কল্পনাও আর কেউ করতে পারে না। মৃত্যুর কারণ খুবই স্বাভাবিক। স্যার চার্লস বিপত্নীক ছিলেন এবং হয়তো একটু বাতিকগ্রস্তও ছিলেন। বিপুল বৈভবের মালিক হওয়া সত্ত্বেও খুবই সাদাসিধে রুচির মানুষ ছিলেন উনি। বাড়ির ভেতরকার চাকরবাকর বলতে ছিল কেবল একটি দম্পতি, নাম ব্যারিমুর। স্বামী ছিল খাসচাকর, স্ত্রী ঘরকন্নার পরিচালিকা, এদের সাক্ষ্য এবং কয়েকজন বন্ধুর জবানবন্দিতে জানা গেছে কিছুদিন ধরেই শরীর ভালো যাচ্ছিল না স্যার চার্লসের, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। বিশেষ করে হৃদযন্ত্রে গোলযোগ দেখা দেওয়ায় গায়ের রং পালটে যেত, নিশ্বাস আটকে যেত এবং প্রচণ্ড স্নায়বিক উদ্যমহীনতায় ভুগতেন। মৃত ব্যক্তির বন্ধুস্থানীয় গৃহচিকিৎসক ডক্টর জেমস মর্টিমার একই কথা বলেছিলেন তাঁর সাক্ষ্যে।

    এ-কেসের ঘটনাগুলো কিন্তু সাদাসিধে। রাত্রে শয়নের আগে বাস্কারভিল হলের বাগানে সুবিখ্যাত ইউ-বীথিতে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল স্যার চার্লসের। ব্যারিমুর স্বামী-স্ত্রী তাদের জবানবন্দিতে বলেছে, চিরসবুজ ইউ-বীথিতে ভ্রমণ তার বরাবরের অভ্যেস। চৌঠা জুন স্যার চার্লস ব্যারিমুরকে ডেকে বাক্স-বিছানা গুছিয়ে দিতে বলেছিলেন, কেননা পরের দিনই লন্ডনে যাবেন। রাত্রে যথারীতি বেরিয়েছিলেন নৈশভ্রমণে, সঙ্গে ছিল যথারীতি একটা চুরুট। আর ফেরেননি। রাত বারোটার সময়ে হল ঘরের দরজা খোলা রয়েছে দেখে ভয় পেয়ে ব্যারিমুর লণ্ঠন নিয়ে বেরোন মনিবের খোঁজে। দিনে বৃষ্টি হওয়ায় মাটি ভিজে ছিল। ইউ-বীথির রাস্তায় স্যার চার্লসের পদচিহ্ন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, পায়ের ছাপ ধরে চলে ব্যারিমুর ইউ-বীথির উদ্যান-পথের মাঝামাঝি জায়গায় একটা ফটক আছে জলাভূমির দিকে। এই ফটকের সামনে স্যার চার্লসের কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার চিহ্ন পাওয়া গেছে। ইউ-বীথি ধরে আবার এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং পথের শেষপ্রান্তে তাঁর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। ব্যারিমুর তার জবানবন্দিতে একটা ঘটনার উল্লেখ করা সত্ত্বেও তার যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। জলার দিকের গেট পেরিয়ে আসার পর থেকেই স্যার চার্লস নাকি আঙুলে ভর দিয়ে হেঁটেছিলেন পথের শেষ পর্যন্ত। এ-ঘটনা যখন ঘটে, তখন মর্ফি নাকি যাযাবর ঘোড়া-ব্যবসায়ী অকুস্থলের কাছেই জলার মধ্যে ছিল বটে, কিন্তু তার জবানবন্দিতে জানা গেছে মোটেই সে প্রকৃতিস্থ ছিল না অত্যধিক মদ্যপানের দরুন। আর্ত-চিৎকার কানে এসেছিল স্বীকার করেছে, কিন্তু কোন দিক থেকে, তার ঠাহর করতে পারেনি। ধস্তাধস্তির কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি স্যার চার্লসের মৃতদেহে। যদিও ডাক্তার বলেছেন, মুখভাব নাকি অস্বাভাবিক বিকৃত হয়েছিল অবিশ্বাস্য সেই মুখ বিকৃতির দরুন নিজের বন্ধুকেও নাকি চিনতে কষ্ট হয়েছিল ডক্টর মর্টিমারের, বিশ্বাসই করতে চাননি ভূলুণ্ঠিত দেহটি তাঁর একদা বন্ধু এবং রুগি স্যার চার্লসের। পরে অবশ্য তার ব্যাখ্যা শোনা গিয়েছে। হৃদ্যন্ত্র বেদম হয়ে মৃত্যু এলে শ্বাসকষ্টের দরুন মুখের চেহারা অমন হতে পারে। ময়নাতদন্তেও এই ব্যাখ্যার সমর্থন মিলেছে। জানা গিয়েছে, দীর্ঘদিন অসুস্থ দেহযন্ত্র নিয়ে বেঁচে ছিলেন স্যার চার্লস। চিকিৎসকের সাক্ষ্যর ভিত্তিতে রায় দিয়েছেন করোনারের জুরিগণ। এতে ভালোই হয়েছে। কেননা, স্যার চার্লসের উত্তরাধিকারীকে বাস্কারভিলে এরপর বসবাস করতে হবে এবং স্থগিত সৎ কাজেও নতুন করে হাত দিতে হবে। মৃত্যুকে ঘিরে যেসব রোমান্টিক কল্পকাহিনির গুজব ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ছিল, করোনারের কাঠখোট্টা রায় তার অবসান না-ঘটালে বাস্কারভিল হলের পরবর্তী বাসিন্দা খুঁজে বার করতে বেগ পেতে হয়। জানা গেছে, স্যার চার্লস বাস্কারভিলের ছোটো ভাইয়ের ছেলে মি. হেনরি বাস্কারভিল যদি এখনও জীবিত থাকেন, তাহলে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী তিনিই হবেন। তরুণ এই ভদ্রলোক আমেরিকায় ছিলেন জানা গিয়েছিল সেই থেকে আর খবর নেই। বিপুল বৈভবের সংবাদ তার কানে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টাচরিত্র চলেছে।

    কাগজটা ফের ভাঁজ করে পকেটস্থ করলেন ডক্টর মর্টিমার।

    বললেন, মি. হোমস, স্যার চার্লস বাস্কারভিলের মৃত্যু-সম্পর্কিত যেসব ঘটনা জনসাধারণ জেনেছে, এই হল গিয়ে তার বিবরণ।

    শার্লক হোমস বললে, কেসটায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ধন্যবাদ। সত্যিই এতে কেবল কৌতূহল-জাগানো অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। সেই সময়ে খবরের কাগজে কিছু কিছু মন্তব্য চোখে পড়েছিল বটে, কিন্তু রোমে পোপের আর প্রাসাদের বহুমূল্য পাথরের ওপর উঁচু করে খোদাই নকশা নিয়ে রীতিমতো ব্যস্ত থাকায়, সেইসঙ্গে পোপের অনুরোধ রক্ষে করতে গিয়ে অত্যন্ত উদবেগের মধ্যে থাকায় বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক ইংলিশ কেসের সংস্রবে আসতে পারিনি। আপনি বলেছেন, এই প্রবন্ধে জনসমক্ষে প্রকাশিত সব ঘটনাই আছে?

    আছে।

    তাহলে প্রাইভেট ঘটনাগুলো এবার বলুন। আঙুলের ডগা একত্র করে হেলান দিয়ে বসল হোমস। বিচারপতিদের মতন মুখখানা যদূর সম্ভব নির্বিকার করে চেয়ে রইল সমাহিত চোখে।

    ডক্টর মর্টিমারের হাবভাবে এবার ফুটে উঠল অতীব আবেগের লক্ষণ। বললে, আগেই বলি, এ-কথা আমি আর কাউকে বিশ্বাস করে বলতে পারিনি। না-বলার একটা উদ্দেশ্য আছে। প্রকাশ্যভাবে জনপ্রিয় কুসংস্কারকে উসকে দিতে কোনো বিজ্ঞানসাধকই চায় না। আরও একটা উদ্দেশ্য আছে। বাস্কারভিল হলকে ঘিরে অনেক গা-ছমছমে কাহিনিই লোকের মুখে মুখে ফিরছে। কুখ্যাতি বেড়ে যেতে পারে, এমন কিছুই বলা এখন সমীচীন নয়–শেষকালে হয়তো ও-বাড়িতে আর কেউ থাকতেই চাইবে না। এইসব কারণেই ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, যা জানি তার চাইতে কম বলব! সব বললেও ব্যবহারিক লাভ তো কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু আপনার কাছে মন খুলে কথা না-বলার কারণ দেখছি না।

    জলাভূমিতে লোকবসতি খুবই বিরলভাবে বিক্ষিপ্ত। কাছাকাছি যাদের বসবাস মনের দিক দিয়েও তারা অনেকটা কাছের মানুষ। এই কারণেই স্যার চার্লস বাস্কারভিলের সঙ্গে এত দহরম-মহরম হয়েছিল আমার। দেখাসাক্ষাৎ লেগেই থাকত। বেশ কয়েক মাইলের মধ্যে প্রকৃতিবিদ মি. স্টেপলটন আর ল্যাফটার হিলের মি. ফ্রাঙ্কল্যান্ড ছাড়া শিক্ষিত পুরুষ আর কেউ নেই। অবসর জীবনযাপন করছিলেন স্যার চার্লস। কিন্তু তার ভগ্নস্বাস্থ্যের দরুন ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেল আমাদের দুজনের মধ্যে। এছাড়া বিজ্ঞান বিষয়ে দু-জনেরই আগ্রহ থাকায় মনের মিল ঘটল ভালো করেই। কিন্তু আফ্রিকা থেকে বিজ্ঞানের অনেক খবর সংগ্রহ করে এনেছিলেন উনি। বহু সন্ধ্যা আনন্দে কেটেছে এইসব আলোচনায়। বুশম্যান আর হটেনটটদের শারীরস্থান নিয়ে আলোচনা করেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

    শেষ কয়েক মাসের মধ্যে একটা জিনিস ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার কাছে। স্যার চার্লসের স্নায়ুতন্ত্র অত্যধিক চাপের দরুন ভেঙে পড়তে বসেছে। এইমাত্র যে কিংবদন্তিটা আপনাকে বললাম, উনি তা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করেছিলেন। এত বেশি করেছিলেন যে নিজের বাড়ির বাগানে পায়চারি করতেন ঠিকই, কিন্তু রাত্রে কখনো জলায় যেতেন না। শত প্রলোভনেও তাঁকে জলায় টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। মি. হোমস, শুনলে খুবই অদ্ভুত মনে হবে আপনার, কিন্তু উনি সমস্ত সত্তা দিয়ে বিশ্বাস করতেন সত্যিই একটা ভয়াবহ অভিশাপ ঝুলছে বংশের মাথায় অনেক দুর্ভোগ লেখা আছে অদৃষ্টে। পূর্বপুরুষদের যেসব কাহিনি শোনাতেন, তা শুনলে সত্যিই বুক দমে যায়। কল্পনা করতেন বিকট দেখতে কী যেন একটা প্রাণী সবসময়ে তাড়া করছে তাকে। প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন আমাকে, রাত্রে রুগি দেখতে বেরিয়ে অদ্ভুত কোনো জানোয়ার কখনো দেখেছি কিনা, অথবা কুকুরের ডাক শুনেছি কিনা। শেষ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছিলেন বেশ কয়েকবার, প্রতিবারেই উত্তেজনায় কাঁপতে থাকত কণ্ঠস্বর।

    শোচনীয় ঘটনাটার হপ্তাতিনেক আগে এক সন্ধ্যায় গাড়ি নিয়ে গেলাম ওঁর বাড়ি। হল ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন উনি। আমার দু-চাকার হালকা গাড়ি নিয়ে সামনে দাঁড়ালাম। গাড়ি থেকে নামলাম, এমন সময়ে উনি আমার কাঁধের ওপর দিয়ে আমার পেছনদিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলেন–চোখের পাতা আর পড়ল না–সাংঘাতিক বিভীষিকা ফুটে উঠল চোখের তারায় তারায়। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াতেই ছায়ার মতো কী যেন একটা সরে যেতে দেখলাম রাস্তার শেষপ্রান্তে বড়ো, কালো বাছুর নিশ্চয়। উনি কিন্তু এমন উত্তেজিত আর অস্থির হয়ে পড়লেন যে বাধ্য হয়ে জায়গাটায় গিয়ে জানোয়ারটাকে খুঁজলাম। যদিও পেলাম না–পালিয়েছে। কিন্তু ওঁর মনের ওপর মারাত্মক ছাপ ফেলল এই ঘটনা। সমস্ত সন্ধেটা রইলাম সঙ্গে সঙ্গে। কেন এত উত্তেজিত হয়েছেন বোঝানোের জন্যে তখনই যে পাণ্ডুলিপিটা আমার জিম্মায় উনি রেখে দিলেন। এখানে এসে প্রথমেই তা থেকে পড়ে শুনিয়েছি আপনাকে। ঘটনাটা তুচ্ছ হলেও বললাম এই কারণে যে পরের ট্র্যাজেডির সঙ্গে হয়তো এর কোথাও একটা যোগসূত্র আছে–যদিও সেই মুহূর্তে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বিষয়টা একেবারেই তুচ্ছ, এবং ওঁর এত উত্তেজনারও কোনো কারণ নেই।

    আমার পরামর্শ শুনেই লন্ডন যাচ্ছিলেন স্যার চার্লস। আমি জানতাম ওঁর হৃদযন্ত্রের অবস্থা ভালো নয়। কারণটা যত উদ্ভটই হোক না কেন, একনাগাড়ে ভয় আর উদবেগের মধ্যে থাকার ফলে শরীরের ওপর গুরুতর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, হৃদযন্ত্রের ওপর অত্যধিক ধকল পড়ছিল। তাই ভেবেছিলাম মাস কয়েক শহরে পাঁচ রকম ব্যাপারে মন ছেড়ে দিলে এখানকার অযথা উদবেগ থেকে নিষ্কৃতি পাবেন নতুন মানুষ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। মি. স্টেপূলটন আমাদের দু-জনেরই বন্ধু। স্যার চার্লসের ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে উনিও উদবিগ্ন ছিলেন। লন্ডনে পাঠানোর ব্যাপারে একই মত তিনিও পোযণই করতেন। শেষ মুহূর্তে ঘটল এই ভয়ংকর বিপর্যয়।

    স্যার চার্লস মারা গেলেন যে-রাতে, সেই রাতেই ব্যারিমুর তার মৃতদেহ আবিষ্কার করেই। খবর পাঠায় আমাকে। খবর নিয়ে আসে ঘোড়ার সহিস পাকিন্স। আমি তখনও শুতে যাইনি। ঝড়ের মতো ঘোড়ায় চেপে ওকে আসতে দেখেই ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাই বাস্কারভিল হলে। তদন্তে যেসব ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রতিটি আমি যাচাই করেছি, তবে সমর্থন করেছি। পায়ের ছাপ ধরে ইউ-বীথি দিয়ে আমি এগিয়েছি, জলার দিকে ফটকে যেখানে উনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন বলে মনে হয়েছে সে-জায়গা আমি দেখেছি, ঠিক সেইখান থেকে পায়ের ছাপের ধরন পালটে যাওয়া নিয়ে মন্তব্য করেছি, নরম কঁকর জমির ওপর ব্যারিমুরের পায়ের ছাপ ছাড়া আর পায়ের ছাপ নেই লক্ষ করেছি, সবশেষে খুব সাবধানে মৃতদেহ পরীক্ষা করেছি আমি না-আসা পর্যন্ত কেউ ছোঁয়নি মৃতদেহ। দু-হাত ছড়িয়ে, দশ আঙুল দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে, মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন স্যার চার্লস একটা প্রচণ্ড আবেগ আর প্রচণ্ড গেঁচুনি প্রকট হয়ে উঠেছিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে–যার ফলে ওঁকে শনাক্ত করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়েছিলাম। দৈহিক আঘাত একেবারেই নেই। তদন্তের সময়ে কিন্তু একটা মিথ্যে বিবৃতি দিয়েছিল ব্যারিমুর। বলেছিল, মৃতদেহের আশপাশের জমিতে কোনো ছাপ পাওয়া যায়নি। আসলে ও লক্ষ করেনি। আমি করেছিলাম–একটু তফাতে দেখেছিলাম সেই ছাপ, কিন্তু বেশ স্পষ্ট আর টাটকা।

    পায়ের ছাপ?

    হ্যাঁ, পায়ের ছাপ!

    পুরুষমানুষের না মেয়েমানুষের?

    ক্ষণেকের জন্য অদ্ভুতভাবে আমাদের পানে চেয়ে রইলেন ডক্টর মর্টিমার, তারপর প্রায় ফিসফিস করে বললেন চাপা গলায়:

    মি. হোমস, পায়ের ছাপগুলো একটা দানব কুকুরের!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন
    Next Article When the World Screamed – Arthur Conan Doyle

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }