Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প813 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৬. বাস্কারভিল হল

    নির্দিষ্ট দিনে তৈরি হয়ে গেলেন স্যার হেনরি বাস্কারভিল এবং ডক্টর মর্টিমার, এবং ডেভনশায়ার

    অভিমুখে রওনা হলাম আমরা। স্টেশন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে একই গাড়িতে গেল শার্লক। হোমস এবং শেষবারের মতো নির্দেশ আর উপদেশ দিলে আমাকে।

    বলে, ওয়াটসন, আগে থেকেই কাউকে সন্দেহ করে বসে পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে যাও, এটা আমি চাই না। তাই কোনো অনুমিতি তোমাকে শোনাব না–কাকে সন্দেহ বেশি, তাও বলব , যদূর সম্ভব খুঁটিয়ে সমস্ত ঘটনা লিখে জানাবে, থিয়োরি-টিয়োরি যা কিছু খাড়া করবার, আমি করব।

    কী ধরনের ঘটনা লিখব? জিজ্ঞেস করলাম।

    স্যার চার্লস বাস্কারভিলের মৃত্যু সংক্রান্ত যেকোনো তাজা খবর, অথবা হাতের দুই কেসে কাজে লাগতে পারে এমনি যেকোনো ঘটনা–তা সে যত পরোক্ষই হোক না কেন, বিশেষ করে তরুণ বাস্কারভিল আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কটা কীরকম দাঁড়াচ্ছে সেই সম্পর্কে বিশদ বিবরণ। গত ক-দিনে আমি নিজেই কিছু তদন্ত করেছি বটে, কিন্তু ফলাফলটা নেতিবাচক হয়েছে। একটা জিনিস কিন্তু নিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছে। পরবর্তী ওয়ারিশ মি. জেমস ডেসমন্ডের কথা বলছি। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে এবং চেহারা চরিত্র অত্যন্ত অমায়িক! সুতরাং এ-জাতীয় নিগ্রহ বা নির্যাতন তার দিক থেকে আশা করা যায় না। আমার কিন্তু সত্যিই মনে হয়, অনায়াসেই তাঁকে হিসেব থেকে বাদ দিতে পারি আমরা। তাহলে থেকে যাচ্ছে তাঁরাই যারা প্রকৃতপক্ষে জলাভূমিতে স্যার হেনরি বাস্কারভিলকে ঘিরে থাকছে।

    প্রথমেই এই ব্যারিমুর দম্পতিকে হিসেব থেকে বাদ দিলে ভালো হয় না?

    কোনোমতেই না। এর চাইতে বড়ো ভুল আর নেই। নিরপরাধ যদি হয়, নিষ্ঠুর অবিচার হবে ঠিকই, কিন্তু অপরাধী যদি হয়, ঘুণাক্ষরেও তারা যেন টের না-পায় তাদের সন্দেহ করা হচ্ছে। না হে না, সন্দেহভাজনের ফর্দে এদের নামও থাকবে। তারপর ধরো, যদূর মনে পড়ে, বাস্কারভিল হলে একজন সহিস আছে। দু-জন জলাভূমির চাষি আছে। বন্ধু ডক্টর মর্টিমার রয়েছেন–ওঁকে আমি খাঁটি সচ্চরিত্র বলেই বিশ্বাস করি, ওঁর স্ত্রী রয়েছেন যার সম্বন্ধে কিছুই জানি না। প্রকৃতিবিদ স্টেপলটন রয়েছেন, এবং তার বোন রয়েছেন, শুনেছি ভদ্রমহিলা নাকি তরুণী এবং সুন্দরী। তারপরেও রয়েছেন ল্যাফটার হলের মি. ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড তিনিও একটা অজানা বিষয়, এ ছাড়াও দু-একজন অন্য প্রতিবেশী। এদেরকে নিয়েই তোমার বিশেষ পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে।

    যথা সম্ভব করব আমি।

    অস্ত্র নিয়েছ আশা করি?

    হ্যাঁ, নেওয়াটা উচিত মনে করেই নিয়েছি।

    নিশ্চয়, ঠিকই করেছ। অষ্টপ্রহর কাছে রাখবে রিভলবার দিনে রাতে সবসময়ে হুঁশিয়ার থাকবে–মুহূর্তের জন্যেও ঢিলে দেবে না।

    নতুন বন্ধু দু-জন এর মধ্যেই একটা প্রথম শ্রেণির কামরা জোগাড় করে নিয়েছেন, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের প্রতীক্ষায়।

    হোমসের প্রশ্নের জবাবে ডক্টর মর্টিমার বললেন–না, নতুন খবর নেই। একটা কথাই শপথ করে বলতে পারি এবং তা হল গত দু-দিনে কেউ আমাদের পেছনে ঘোরেনি। বাইরে বেরিয়েছি, কিন্তু সবসময়ে কড়া নজর রেখেছি চারপাশে, কেউ চোখ এড়ায়নি।

    দু-জনে কখনো ছাড়াছাড়ি হননি তো?

    গতকাল বিকেল ছাড়া আর হইনি। শহরে এলে সাধারণত একটা দিন নির্ভেজাল আমোদ-প্রমোদ নিয়েই কাটাই। তাই গিয়েছিলাম কলেজ অফ সার্জন্স-এর মিউজিয়ামে।

    বাস্কারভিল বললেন, আর আমি গিয়েছিলাম পার্কের লোকজন দেখতে। কিন্তু গোলমাল কিছু ঘটেনি।

    তাহলেও অত্যন্ত অবিবেচকের মতো কাজ করেছেন, মাথা নাড়তে নাড়তে গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললে হোমস। স্যার হেনরি, আমার একান্ত অনুরোধ, একলা কখনো রাস্তায় বেরোবেন না। যদি বেরোন, সাংঘাতিক দুর্বিপাকে পড়বেন। অন্য বুটের পাটিটা পেয়েছেন?

    না, মশায়, ওটা দেখছি একেবারেই গেল।

    বটে। সেইটাই অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। ঠিক আছে, বিদায়, ট্রেন তখন নড়ে উঠেছে, প্ল্যাটফর্ম থেকে সরে যাচ্ছে। স্যার হেনরি, ডক্টর মর্টিমার প্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে যে কিংবদন্তিটা পড়ে শুনিয়েছেন, তার একটা কথা সবসময়ে মনে রাখবেন। সন্ধের পর যখন অশুভ শক্তির নরক গুলজার চলে জলাভূমিতে, তখন ও-তল্লাট মাড়াবেন না।

    অনেক পেছনে প্ল্যাটফর্ম ফেলে আসার পর ফিরে দেখলাম আমাদের পানে স্থির চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শার্লক হোমসের দীর্ঘ, সাদাসিধে, কঠোর, নিস্পন্দ মূর্তি।

    দ্রুত ছুটে চলল ট্রেন। বেশ ভালোই লাগছে ছুটন্ত ট্রেনে বসে থাকতে। দুই বন্ধুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা বাড়িয়ে নিলাম নানা কথার মাধ্যমে। খেলা করতে লাগলাম ডক্টর মর্টিমারের স্প্যানিয়েলের সঙ্গে। এইভাবেই হুহু করে কেটে গেল সময় ঘন্টা কয়েকের মধ্যে। মাটির রং বাদামি থেকে লালচে হয়ে গেল, ইট থেকে গ্রানাইটে এসে পড়লাম, সুবিন্যস্ত ঝোপ দিয়ে ঘেরা উজ্জ্বল সবুজ ঘাস ছাওয়া মাঠে লাল রঙের গোরু চরতে দেখলাম, গাছপালার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি দেখেই বুঝলাম চমৎকার আবহাওয়া আসছে–যদিও আদ্রর্তার ভাগ একটু বেশি। চোখ বড়ো বড়ো করে সাগ্রহে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন তরুণ বাস্কারভিল এবং ডেভনের পরিচিত নৈসর্গিক দৃশ্য চিনতে পেরে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন জোর গলায়!

    বললেন, ডক্টর ওয়াটসন, এ-জায়গা ছেড়ে যাওয়ার পর পৃথিবীর অনেক জায়গাই আমি দেখেছি, কিন্তু এমনটি কোথাও দেখিনি। তুলনা হয় না?

    আমি মন্তব্য করলাম, ডেভনশায়ারের লোকেরা কিন্তু শপথ নেয় নিজেদের জেলার নামে ব্যতিক্রম আজও চোখে পড়েনি।

    সেটা শুধু জেলা নয়, নির্ভর করে মানুষগুলোর শিক্ষাদীক্ষা রক্তের ওপরেও, বললেন ডক্টর মর্টিমার। এই যে আমাদের এই বন্ধুটি, মাথাটি দেখুন, পশ্চিম ইউরোপের প্রাচীন আর্যজাতি কেল্টদের মাথার মতোই গোল; তাদের সেই উৎসাহ আর স্বদেশপ্রীতি এঁর খুলির মধ্যেও রয়েছে। স্যার চার্লস বেচারার মাথাটি ছিল সত্যিই অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য; বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে অর্ধেকটা স্কটল্যান্ডের পার্বত্য জাতি গেলদের মতে, বাকি অর্ধেক আইভারমিয়ান। কিন্তু আপনি যখন বাস্কারভিল দেখেছিলেন, তখন নেহাতই ছেলেমানুষ ছিলেন নয় কি?

    বাবা যখন মারা যান, আমি তখন কিশোর। তারপর থেকে বাস্কারভিল আর চোখে দেখিনি। কেননা বাবা থাকতেন দক্ষিণ উপকূলে একটা ছোটো কুঁড়েঘরে। সেখান থেকে সোজা গেলাম আমেরিকায় এক বন্ধুর কাছে। তাই বলছি, ডক্টর ওয়াটসনের চোখে সব যেমন নতুন লাগছে, আমার চোখেও তাই লাগছে। জলাভূমির চেহারা দেখবার জন্যেও জানবেন প্রাণটা আকুলিবিকুলি করছে।

    করছে নাকি? তাহলে পূর্ণ হোক আপনার মনোবাসনা, ওই দেখুন জলাভূমি, কামরার জানলা দিয়ে আঙুল তুলে দেখালেন ডক্টর মর্টিমার।

    চৌকোনা সবুজ মাঠ আর গাছপালার নীচু বক্ররেখার ওপর দিয়ে দেখা গেল বহু দূরে ঠেলে উঠেছে ধূসর, বিষণ্ণ একটা পাহাড়, চুড়োটা অদ্ভুত রকমের এবড়োখেবড়ো খোঁচা-খোঁচা, অনেক দূরে থাকায় তা আবছা আর মায়াময়–ঠিক যেন স্বপ্নে দেখা ফ্যানট্যাসটিক নিসর্গ দৃশ্য! দীর্ঘক্ষণ পাথরের মতো নিশ্চুপ দেহে বসে রইলেন বাস্কারভিল, স্থির দুই চক্ষু নিবদ্ধ রইল সেই দুঃস্বপ্ন দৃশ্যের পানে–সাগ্রহ মুখ দেখেই উপলব্ধি করলাম কী ধরনের ভাবের তরঙ্গ উত্তাল হয়ে উঠেছে তার মনের মধ্যে; এই প্রথম তিনি দেখছেন রহস্যমদির সেই জলাভূমির দৃশ্য; প্রহেলিকাময় এই জলার বুকে যারা যুগ যুগ ধরে শাসনের দণ্ড ঘুরিয়েছে তাদেরই রক্ত বইছে তাঁর ধমনীতে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই আদি পুরুষদের সুগভীর ছাপ রয়েছে এখানকার আকাশে বাতাসে মাটিতে। কাঠখোট্টা রেলকামরার এক কোণে টুইডস্যুট পরে ওই দিন যিনি আমেরিকান উচ্চারণে কথা বলেছেন, তার মলিন আর ভাবব্যঞ্জক মুখে পরতে পরতে কিন্তু দেখতে পাচ্ছি দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই পূর্বপুরুষদের প্রচণ্ড চরিত্রের ব্যঞ্জনা, দেখতে পাচ্ছি খানদানি রক্তের উচ্ছ্বাস। উপর্যুক্ত বংশধরই বটে। হেজেলগাছের মতো পিঙ্গলবর্ণ বিশাল দুই চোখে অনুভূতিপ্রবণ স্ফুরিত নাসারন্ধ্রে, ঘন ভুরু যুগলে আদিমপুরুষদের দর্প শৌর্য এবং শক্তি যেন উচ্ছরিত হচ্ছে। নিষিদ্ধ ওই জলা সত্যিই যদি বিপদসংকুল, দুঃসাধ্য তদন্ত পথ চেয়ে থাকে আমাদের প্রতীক্ষায়, এইরকম একজন কমরেডের জন্যে তার সম্মুখীন হতে দ্বিধা নেই আমার–কেননা সে-বিপদকে বুক পেতে নেওয়ার মতো দুঃসাহস এঁর আছে।

    ছোট্ট একটা স্টেশনে এসে দাঁড়াল ট্রেন, নেমে পড়লাম আমরা সকলে। বাইরে, সাদা, নীচু বেড়ার ওদিকে দাঁড়িয়ে একজোড়া বলবান টাট্টু ঘোড়ায় টানা একটা খোলা গাড়ি। আমরা এসেছি, এটাই যেন একটা বিরাট ব্যাপার এ-অঞ্চলে। কেননা, স্টেশনমাস্টার নিজে দাঁড়িয়ে নামিয়ে দিলেন আমাদের মালপত্র। সাদাসিধে, সুস্নিগ্ধ এ-পল্লি অঞ্চলে একটু অবাক হলাম দু-জন বন্দুকধারী লোক দেখে। পরনে সিপাইদের মতো গাঢ় রঙের ইউনিফর্ম, ফটকের সামনে খাটো রাইফেলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দু-জনে। আমরা বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে তীক্ষ্ণ্ণ, সন্ধানী চোখ বুলিয়ে নিলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। কোচোয়ান লোকটার মুখখানা শক্ত, গাঁটযুক্ত খর্বকায় চেহারা। স্যার হেনরি বাস্কারভিলকে দেখেই খটাস করে সেলাম ঠুকল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই চওড়া সাদা রাস্তা বেয়ে যেন উড়ে চললাম আমরা। দু-পাশে টানা লম্বা পশুচারণের তৃণভূমি–ঢেউ খেলে উঠে গেল ওপর দিকে। ঘন সবুজ গাছপাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ঢালা ছাদ দিয়ে ঘেরা বাড়ির তিনকোনা উপরিভাগ। শান্তিপূর্ণ, রৌদ্রালোকিত পল্লিভূমির পেছন দিক দিয়ে কিন্তু ঠেলে উঠেছে বুক-কাঁপানো জলাভূমির ঢেউ-খেলানো দীর্ঘ আভাস–সন্ধ্যাকাশের পটভূমিকায় তা কৃষ্ণকালো, মাঝে মাঝে খোঁচা-খোঁচা কুটিল পাহাড়।

    পাশের রাস্তায় বোঁ করে ঢুকে পড়ল খোলা গাড়িখানা। গভীর গলি এঁকেবেঁকে উঠতে লাগলাম ওপরদিকে। রাস্তা ক্ষয়ে বসে গেছে বহু শতাব্দীর চক্রযানের যাতায়াতে। দু-পাশের খাড়া পাড়ে পুরু শ্যাওলা, ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে তা থেকে; ঝুলছে পুষ্পহীন মাংসল ফার্ন। পড়ন্ত রোদে ঝকমক করছে ব্রোঞ্জশুভ্র ব্রাকেনফার্ন আর নানা রঙের ছাপযুক্ত কাটাঝোপ। আরও উঠতে উঠতে পেরিয়ে এলাম একটা গ্রানাইট পাথর। তলা দিয়ে সশব্দে বইছে স্রোতস্বিনী, ধূসর বর্ণের পাথরের চাইয়ের ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে ফেনা ছড়িয়ে গর্জাতে গর্জাতে দ্রুত নেমে চলেছে নীচের দিকে। ফার আর ওক গাছের ঘন ঝোপে ছাওয়া একটা উপত্যকার মধ্যে রাস্তা আর স্রোতস্বিনী। প্রত্যেকবার মোড় ফেরার সঙ্গেসঙ্গে হর্ষধ্বনি করছেন বাস্কারভিল, ব্যগ্র চোখে চারপাশে দেখছেন এবং অসংখ্য প্রশ্ন করছেন। ওঁর চোখে সবই সুন্দর, আমি কিন্তু বিচিত্র এই পল্লিদৃশ্যের ওপর একটা বিষাদের ছায়া লক্ষ করছি–শীতের প্রকোপ কমে আসার সুস্পষ্ট লক্ষণ। হলদে পাতার গালচে পাতা রয়েছে গতিপথে গাড়ি যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে তা উড়ছে খসখস শব্দে। উড়ন্ত পত্ৰপ আর পচা উদ্ভিদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে ছুটন্ত চাকার ঘড় ঘড় শব্দ। প্রকৃতি যেন কীরকম! বাস্কারভিল বংশের উত্তরাধিকারী বাড়ি ফিরছেন–গাড়ির সামনে এহেন বিষণ্ণ উপহার না-দিলেই কি নয়!

    আরে! আরে! এ আবার কী? সবিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন ডক্টর মর্টিমার।

    জলাভূমির শৈলশ্রেণির মধ্যে থেকে গুল্মচ্ছাদিত একটা উদগত পর্বত খাড়া হয়েছে সামনে। চূড়ায় দাঁড়িয়ে একজন অশ্বারোহী সৈন্য, বাহুর ওপর রাইফেল উদ্যত। ঠিক যেন পাদভূমির ওপর কঠিন, সুস্পষ্ট ঘোড়সওয়ারের প্রস্তর মূর্তি–মলিন, কিন্তু কঠোর নজর রাস্তার দিকে–যে-রাস্তা বেয়ে আমরা চলেছি।

    পাকিন্স, ব্যাপার কী বলো তো? শুধোন ডক্টর মর্টিমার।

    সিটে বসেই শরীরটাকে অর্ধেক ঘুরিয়ে বলল চালক, প্রিন্সটাউন থেকে একজন কয়েদি। পালিয়েছে, হুজুর। আজ নিয়ে তিন দিন হল নিখোঁজ, প্রত্যেকটা স্টেশন আর রাস্তা পাহারা দিচ্ছে সেপাইরা কিন্তু তার টিকি দেখা যাচ্ছে না। এখানকার চাষিরা মোটেই ভালো চোখে দেখছে না ব্যাপারটা।

    খবর দিলে তো পাঁচ পাউন্ড পাবে।

    তা পাবে। কিন্তু গলাটাও কাটা যেতে পারে–পাঁচ পাউন্ড সে তুলনায় কিছু নয়। এ কিন্তু সাধারণ কয়েদি নয়, হুজুর। এর অসাধ্য কিছু নেই।

    কে বলো তো?

    সেলডন, নটিংহিল খুনি।

    কেসটা স্পষ্ট মনে পড়ল। গুপ্তঘাতক নির্মম পাশবিকতা আর অদ্ভুত হিংস্রতা দেখিয়েছিল খুনটার মধ্যে। হোমস সেই কারণেই আগ্রহী হয়েছিল ব্যাপারটায়। প্রাণদণ্ড মকুব করে লঘুদণ্ড দেওয়া হয় মস্তিষ্কের পুরোপুরি সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ দেখা দেওয়ায় মাথা খারাপ না-থাকলে নাকি অমন বর্বরতা দেখানো যায় না। ঢাল বেয়ে উঠে পড়ল আমাদের ভোলা গাড়ি, সামনেই ভেসে উঠল দিগন্ত বিস্তৃত জলাভূমি এবং গ্রন্থিল, এবড়োখেবড়ো প্রস্তরস্তুপ আর ছোটো ছোটো অদ্ভুত পাহাড়–যা ডার্টমুর ছাড়া সচরাচর কোথাও দেখা যায় না। ঠান্ডা কনকনে একটা হাওয়ার ঝাঁপটা সেদিক থেকে এসে গা কাঁপিয়ে দিল আমাদের। ওইখানে কোথাও নির্জন, জনশূন্য ওই প্রান্তরের কোনো এক বিবরে বন্যজন্তুর মতো ঘাপটি মেরে আছে শয়তান-সদৃশ এই লোকটা, সমস্ত মানুষ জাতটার ওপর বিষিয়ে আছে তার অন্তর–তাদের জন্যেই আজ সে সমাজচ্যুত, গৃহহারা, নির্বাসিত। উষর এই পতিত প্রান্তরের ক্রুর সংকেতময়তা, হাড়কাঁপানো এই বাতাস এবং আকাশের ঘনায়মান অন্ধকার যেন সম্পূর্ণ হয়েছে নরপিশাচ ওই কয়েদির আবির্ভাবে। এমনকী বাস্কারভিলও চুপ মেরে গেলেন, ওভারকোট টেনেটুনে গায়ে আরও জড়িয়ে নিলেন।

    উর্বর জমি এখন পেছনে এবং নীচে ফেলে এসেছি। পেছন ফিরে তাকালাম সেদিকে। তির্যক সূর্যরশ্মির দৌলতে ছোটো ছোটো জলের ধারাগুলো যেন সোনার সুতো হয়ে গিয়েছে, সদ্যকর্ষিত মাঠের কালো মাটি যেন আগুনরঙ জ্বলছে এবং বনজঙ্গলের জটাজাল আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সামনের রাস্তা আরও নিরানন্দ, আরও ধন্য হয়ে উঠছে পাটকিলে আর জলপাই রঙের সুবিশাল ঢেউ খেলানো প্রান্তরের ওপর এলোমেলোভাবে ছড়ানো দানবিক গোলাকার প্রস্তরখণ্ডের ওপর দিয়ে বিরামবিহীনভাবে বয়ে আসছে কনকনে হাওয়ার ঝাঁপটা। মাঝে মাঝে পাশ কাটিয়ে আসছিল জলাভূমির কুঁড়েঘর; দেওয়াল আর ছাদ পাথর দিয়ে তৈরি; কর্কশ গায়ে লতার আচ্ছাদন নেই। আচম্বিতে চোখ গিয়ে পড়ল কাপের মতো একটা নিম্নভূমির ভেতর দিকে মাথা নেড়া ওক আর ফার গাছ দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক–বহুবছর ধরে মত্ত প্রভঞ্জন দাপট চালিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে মাথা হেঁট করে ছেড়েছে গাছগুলোর। নতমস্তক এইসব গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে আকাশপানে উঠে রয়েছে দুটো উঁচু, সংকীর্ণ টাওয়ার। চাবুক দিয়ে দেখাল চালক।

    বলল, বাস্কারভিল হল।

    হলের মালিক উঠে বসলেন, আরক্ত গাল আর প্রদীপ্ত চোখ মেলে চেয়ে রইলেন। মিনিট কয়েক পরেই পৌঁছোলাম দারোয়ানের গেটের সামনে। ঢালাই লোহার ওপর গোলোকধাঁধার মত অদ্ভুতরকমের কারুকার্য করা ফটক। দু-পাশে রোদ-জলে বিবর্ণ দুটো থাম, সর্বাঙ্গে চর্মরোগের মতো শ্যাওলার ধ্যাবড়া দাগ, এবং ওপরে বাস্কারভিল বংশের প্রতীকচিহ্ন শূকর-মস্তক। ফটক সংলগ্ন দারোয়ানের বাড়িটা কালো গ্রানাইট আর বেরিয়ে-পড়া পাঁজরার মতো বরগার ধ্বংসস্তুপ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা অর্ধনির্মিত নতুন ভবন–স্যার চার্লসের দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে অর্জিত স্বর্ণভূপের প্রথম ফসল।

    ফটক পেরিয়ে এলাম একটা বীথির মধ্যে, আবার চাকার আওয়াজ ড়ুবে গেল ঝরা পাতার মধ্যে, মাথার ওপর লম্বা ডাল বাড়িয়ে পাতার চাঁদোয়া মেলে ধরল দু-পাশের গাছের সারি ঠিক যেন একটা বিষণ্ণ সুড়ঙ্গ পথ। অন্ধকারময় সুদীর্ঘ এই পথের একদম প্রান্তে ঝকমক করছে বাস্কারভিল ভবন! সেদিকে চেয়ে শিউরে উঠলেন স্যার হেনরি।

    এইখানেই কি? শুধোলেন খাটো গলায়।

    না, না, ইউ-বীথিই রয়েছে বাড়ির দিকে।

    মুখ কালো করে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন তরুণ ওয়ারিশ।

    বললেন, কাকার আর দোষ কী। এ-জায়গায় থাকলে আতঙ্ক পেয়ে বসে, সবসময়ে ভাবতেন ওই বুঝি বিপদে পড়লেন। যেই আসুক না কেন, ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করবে। ছ-মাসের মধ্যে দু-পাশে বিদ্যুৎবাতি বসাব। হলের দরজার সামনে সোয়ান আর এডিসনের হাজার পাওয়ারের আলো জ্বললে এখানকার চেহারা পালটে যাবে চিনতেও পারবেন না।

    বীথিপথ শেষ হয়েছে ঘাস ছাওয়া একটা প্রশস্ত চত্বরের সামনে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি বাড়িটাকে। পড়ন্ত আলোয় দেখা যাচ্ছে বাড়ির মাঝের দিকটাই বেশি ভারী একটা গাড়িবারান্দা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে সেখান থেকে। পুরো সামনের দিকটা আইভিলতায় ঢাকা। যেখানে যেখানে জানলা আছে বা বংশের প্রতীক চিহ্ন রয়েছে, সেইসব জায়গাগুলোই কেবল ফাঁকা থেকে গেছে রহস্যময় এই অবগুণ্ঠনের মাঝে মাঝের এই অংশ থেকেই সুপ্রাচীন জোড়া টাওয়ার উঠে শূন্যে, সারাগায়ে অনেক ছিদ্র, গুলি চালাবার জন্যে ফোকরওয়ালা পাঁচিল। খাঁজ কাটা এই পাঁচিলের ডাইনে আর বাঁয়ে কালো গ্রানাইটের আধুনিক বাড়িটা প্রায় নির্মিত হয়েছে পরবর্তীকালে। মোটা মোটা গরাদ-ঢাকা জানলাগুলোর ম্লান আলো দেখা যাচ্ছে, কালো ধোঁয়া বেরুচ্ছে খাড়া ছাদের ওপরকার উঁচু চিমনির মাথা থেকে।

    স্বাগতম স্যার হেনরি! স্বাগতম জানাই বাস্কারভিল হল।

    খোলা গাড়ির দরজা খুলে ধরার জন্যে দেউড়ির ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছে দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি। হলের হলদেটে আলোর পটভূমিকায় দেখা যাচ্ছে একটি স্ত্রী মূর্তি। এগিয়ে এসে পুরুষ মূর্তির হাত থেকে আমাদের ব্যাগ নিয়ে নামিয়ে রাখতে লাগল মেঝেতে!

    ডক্টর মর্টিমার বললেন, কিছু মনে করবেন না স্যার হেনরি, এই গাড়িতেই সোজা বাড়ি যাচ্ছি আমি। স্ত্রী পথ চেয়ে আছে।

    থেকে যান না? খেয়েদেয়ে যাবেন?

    না না, আমি যাই। গিয়ে দেখব হয়তো কাজের পাহাড় জমে রয়েছে। থেকে গিয়ে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারতাম ঠিকই, তবে ও-ব্যাপারে ব্যারিমুর আমার চেয়ে ভালো গাইড জানবেন। চললাম। দিনে রাতে যখন দরকার পড়বে, খবর দেবেন–দ্বিধা করবেন না।

    চাকার আওয়াজ মিলিয়ে গেল পেছনে। আমি আর স্যার হেনরি ঢুকলাম হলের ভেতরে, ঝন ঝন ঝনাৎ শব্দে ভারী দরজা বন্ধ হয়ে গেল পেছনে। দেখলাম একটা ভারি চমৎকার ঘরে দাঁড়িয়ে আমরা। বিরাট, ভারী ওককাঠের বরগা দিয়ে মজবুত সিলিং অনেক উঁচুতে–মহাকালের প্রাকুটি নিক্ষেপে কালো হয়ে গিয়েছে প্রতিটি কাঠের কড়ি। পেল্লায় আকারের লোহার কুকুরের পেছনে সেকেলে ধাঁচের প্রকাণ্ড কাঠের গুঁড়ি পট পট শব্দে জ্বলছে তার মধ্যে। আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে ধরলাম আমি আর স্যার হেনরি দীর্ঘপথ পরিক্রমায় দু-জনেরই হাত ঠান্ডায় আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারপর দেখলাম চারিদিকের সুউচ্চ পাতলা জানালা, দেওয়ালের ওককাঠের তক্তা, হরিণের মাথা, বংশ প্রতীক, দাগ ধরা শার্সির কাচ সব কিছুই মাঝের ল্যাম্পের স্তিমিত আলোয় যেন বিষণ্ণ, অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং ম্লান।

    স্যার হেনরি বললেন, এইরকমটাই কিন্তু আশা করেছিলাম। প্রাচীন যেকোনো ফ্যামিলির বাড়ির ছবি এই ধরনেরই হয়। ভাবুন দিকি, এই হলেই পাঁচ-শশা বছর ছিলেন আমার পূর্বপুরুষরা! ভাবলেও বুক দমে যায়।

    দেখলাম, চারিদিকে তাকিয়ে ছেলেমানুষি উৎসাহে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মলিন মুখ। আলো পড়েছে মুখে, লম্বা ছায়া লুটোচ্ছে দেওয়ালে, কালো চাদোয়ার মতো ঝুলছে মাথার ওপরে। মালপত্র আমাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসেছে ব্যারিমুর। হাতেকলমে ট্রেনিং পাওয়া অভিজ্ঞ পরিচালকের মতোই বিনম্র ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে। লোকটার চেহারা সত্যিই অসাধারণ। দীর্ঘাঙ্গ, সুশ্রী, চৌকোনা, কালো দাড়ি এবং দশজনের ভিড়ে চোখে পড়ার মতো পাণ্ডুর চোখ-মুখ।

    স্যার, ডিনারের ব্যবস্থা এখুনি করব কি?

    খাবার তৈরি?

    মিনিট কয়েকের মধ্যে হয়ে যাবে। ঘরে গেলেই গরম জল পাবেন। যতদিন আপনি নতুন ব্যবস্থা না-করছেন, ততদিন আমি আর আমার স্ত্রী সানন্দে আপনার সেবা করে যাব। নতুন পরিস্থিতিতে কিন্তু এ-বাড়িতে চাকর-বাকর আরও দরকার।

    নতুন পরিস্থিতিটা আবার কী?

    স্যার চার্লস অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন বলে আমরা দুজনেই তার সেবার পক্ষে যথেষ্ট ছিলাম। আপনি কিন্তু নিশ্চয় আরও সঙ্গীসাথি চাইবেন, ঘরকন্নার কাজেও পরিবর্তন আসবে।

    তুমি আর তোমার স্ত্রী কি কাজ ছেড়ে দিতে চাও?

    আপনি যখন সুবিধে বুঝবেন, তখন।

    তোমাদের ফ্যামিলি কিন্তু কয়েক পুরুষ ধরেই রয়েছে এ-বাড়িতে, তাই না? এত পুরোনো একটা পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন করে যদি থাকতে হয় এখানে, খুবই দুঃখ পাব জানবে।

    খাস চাকরের সাদা মুখে যেন আবেগের লক্ষণ দেখলাম বলে মনে হল আমার।

    স্যার, একইরকম মনের অবস্থা দাঁড়িয়েছে আমার আর আমার স্ত্রীর। কিন্তু সত্যি কথাটা কী জানেন, স্যার চার্লসকে আমরা দুজনেই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম। বড়ো আঘাত পেয়েছি তাঁর মৃত্যুতে। বুক ফেটে যাচ্ছে এই পরিবেশে থাকতে। বাস্কারভিল হলে জীবনে আর কখনো সহজ মনে থাকতে পারব বলে মনে হয় না।

    কিন্তু করবেটা কী?

    ব্যাবসা করলে দাঁড়িয়ে যাব, এ-বিশ্বাস স্যার আছে। মূলধন তো দয়া করে দিয়েই গেছেন স্যার চার্লস। আসুন স্যার, আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিই।

    সেকেলে হলের মাথার ওপর দিয়ে ঘিরে রয়েছে একটা চৌকোনা ব্যালাস্ট্রেড রেলিং দিয়ে যুক্ত ছোটো ছোটো পিলপের সারি। জোড়া সোপান শ্রেণি বেয়ে উঠতে হয় সেখানে। এর মাঝ থেকে দুটো লম্বা অলিন্দ বিস্তৃত বাড়ি যদ্র লম্বা, তদূর পর্যন্ত এই অলিন্দের দু-পাশে রয়েছে সারি সারি শয়নকক্ষ। আমার আর স্যার হেনরির শোবার ঘর পড়েছে বাড়ির একদিকে এবং প্রায় পাশাপাশি। বাড়ির মাঝের অংশের চেয়ে এই অংশটি অনেক আধুনিক। অসংখ্য মোমবাতি আর ঝকমকে কাগজের দৌলতে নিরানন্দ ভাবটা অনেকটা কম এখানে–এ-বাড়ি ঢুকেই যে-ছাপ মনে দাগ কেটেছে, এদিকে তা অনেকটা ফিকে।

    কিন্তু ডাইনিংরুমে বিরাজ করেছে ছায়া আর বিষণ্ণতা। হল ঘর থেকেই যেতে হয় খাবার ঘরে। লম্বাটে ঘর, একদিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় উঁচু মঞ্চে। এখানে বসত ফ্যামিলির লোকজন, আশ্রিত ব্যক্তিদের পৃথক ব্যবস্থা। মাথার ওপরে কালো কড়িকাঠের পর কড়িকাঠ–তারও ওদিকে ধোঁয়া-মলিন সিলিং। সুদূর অতীতে এখানে সারি সারি মশাল জ্বলত–সেই আলোয় আলোকিত পরিবেশে বর্ণ আর অমার্জিত উল্লাস হয়তো অনেক কোমল হয়ে আসত; কিন্তু একটিমাত্র চাকা দেওয়া ল্যাম্পের স্বল্প আলোক-বলয়ের মধ্যে কৃষ্ণবেশে দুই ভদ্রলোক বসতেই একজনের গলা খাটো হয়ে এল অজান্তেই, আর একজনের বুক দমে গেল ভীষণভাবে। বিবিধ পরিচ্ছদে সজ্জিত সারি সারি নির্বাক পূর্বপুরুষরা শুধু স্থির চাহনি নিক্ষেপ করেই বুক কাঁপিয়ে ছাড়ল আমাদের! এলিজাবেথের আমলের নাইট থেকে আরম্ভ করে রাজপ্রতিনিধির শাসনকালের বাবু ব্যক্তিরাও আছেন সেই সারিবদ্ধ আদিপুরুষের মধ্যে। কথা বললাম খুবই কম, খাওয়া শেষ হতেই স্বস্তির নিশ্বেস ফেলে বাঁচলাম এবং আধুনিক বিলিয়ার্ড-রুমে গিয়ে সিগারেট টানতে লাগলাম।

    স্যার হেনরি বললেন, তাই বলুন, খুব একটা সুখের জায়গা এটা নয়। থাকলে হয়তো সয়ে যায়, আমি কিন্তু এই মুহূর্তে খাপ খাওয়াতে পারছি না। এ-রকম বাড়িতে একেবারে একলা ছিলেন বলেই ছায়া দেখেও চমকে উঠতেন কাকা। যাই হোক, রাত হয়েছে। বলেন তো শুতে যাওয়া যাক। কাল সকালে হয়তো অনেকটা সুখকর মনে হতে পারে জায়গাটা।

    বিছানায় ওঠার আগে পর্দা সরিয়ে তাকালাম জানলার বাইরে। হলের দরজার সামনেই যে ঘাসছাওয়া প্রশস্ত চত্বর, এ-জানলা থেকে তা দেখা যায়। তার ওদিকে দু-সারি গাছ ক্রমাগত দুরন্ত হাওয়ার টানে দুলছে আর ককিয়ে উঠছে। দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেন মেঘের দল, ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে আধখানা চাদ। হিমশীতল চন্দ্রকিরণে চোখে পড়ল বৃক্ষসারির অনেক দূরে ভাঙাচোরা শৈলশ্রেণি এবং টানা, লম্বা, তরঙ্গায়িত বিষণ্ণ জলাভূমি। বন্ধ করে দিলাম জানালা। হাড়ে হাড়ে বুঝলাম, প্রথম উপলব্ধির সঙ্গে এই শেষের উপলব্ধির কোনো ফারাক নেই।

    তা সত্ত্বেও বলব, এইটাই আমার শেষ উপলব্ধি নয়। ঘুমোতে পারছিলাম না। অসীম ক্লান্তি সত্ত্বেও এপাশ-ওপাশ করছিলাম। সাধনা করেও ঘুমকে চোখে আনতে পারছিলাম না। অনেক দূরে পনেরো মিনিট অন্তর শোনা যাচ্ছে একই সুরে মেলানো অনেক ঘণ্টার ঐকতান বাজনা এ ছাড়া বিরাট বাড়িখানায় বিরাজ করছে মৃত্যুপুরীর স্তব্ধতা! আর তারপরেই আচম্বিতে, নিথর নিস্তব্ধ সেই নিশুতি রাতে, একটা শব্দ ভেসে এল আমার কানে সুস্পষ্ট সে-শব্দ শুনতে এতটুকু ভুল আমার হয়নি বাতাসের মধ্য দিয়ে অনুরণন আর প্রতিধ্বনি জাগিয়ে শব্দটা আছড়ে পড়ল আমার কানের পর্দায়। ফুঁপিয়ে কাঁদছে একটি স্ত্রী-কণ্ঠ, বুকফাটা দুঃখ যেন চাপা হাহাকার হয়ে বেরিয়ে আসছে নিরুদ্ধ নিশ্বাসে কেঁদেই চলেছে। উঠে বসলাম বিছানায়, কানখাড়া করে শুনলাম সেই কান্না। শব্দের উৎস খুব দূরে নয়, বাড়ির মধ্যে প্রতিটি স্নায়ু টান টান করে ঝাড়া আধঘণ্টা এইভাবে বসে রইলাম, কিন্তু ঘণ্টাশ্রেণির মিলিত ঐকতান বাজনা আর দেওয়ালের গায়ে আইভির খস খস শব্দ ছাড়া নতুন কোনো আওয়াজ কানে এল না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন
    Next Article When the World Screamed – Arthur Conan Doyle

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }