Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প813 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৯. ডক্টর ওয়াটসনের দ্বিতীয় রিপোর্ট : জলায় আলো

    বাস্কারভিল হল, পনেরোই অক্টোবর

    ভায়া হোমস,

    আমার এই দৌত্য-পর্বের প্রথম দিকে খুব একটা খবর তোমায় দিতে পারিনি। সময় যা নষ্ট করেছি, এখন তা পূরণ করে দিচ্ছি। ঘটনা এখন পরপর ঘটছে এবং ভিড় করে আসছে চারপাশে। আমার গত চিঠি শেষ করেছিলাম জানলায় ব্যারিমুরের রহস্যজনক দাঁড়িয়ে থাকা দিয়ে। এবার যে ঘটনা-ফর্দ হাতে এসেছে, আমি জানি তা শুনলে তুমি দারুণ অবাক হয়ে যাবে। ঘটনাস্রোত যে এইভাবে মোড় নেবে, ভাবতে পারিনি। গত আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে একদিক দিয়ে ঘটনামালা যেমন অধিকতর স্বচ্ছ হয়েছে, আর একদিক দিয়ে তেমনি আরও জটিল হয়েছে। যাই হোক, সব বলব তোমাকে, বিচার যা করবার তুমিই করবে।

    ব্যারিমুর যে-ঘরে আগের রাতে ঢুকেছিল, নৈশ অ্যাডভেঞ্চারের পরের দিন সকালে প্রাতরাশ খাওয়ার আগে করিডর দিয়ে গিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা করলাম সেই ঘরটা। লক্ষ করলাম, পশ্চিমের যে-জানলা দিয়ে জলার দিকে তীক্ষ্ণ্ম চোখে তাকিয়েছিল ব্যারিমুর, এ-বাড়ির অন্য জানলা থেকে সে-জানলার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে–জলার খুব কাছের চেহারা এখান থেকে দেখা যায় না। অন্য যেকোনো জানলায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে জলার দূরের দৃশ্য। কিন্তু এ-জানলায় দাঁড়ালে দুটো গাছের ফাঁক দিয়ে জলার ভেতর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই : ব্যারিমুর জানে এ-জানলায় দাঁড়ালে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে; তার মানে নিশ্চয় জলার বুকে কিছু বা কাউকে দেখার আশায় সে দাঁড়িয়ে ছিল। ভেবে পেলাম না, ওইরকম নিকষ কালো রাতে কাউকে দেখতই-বা কী করে। গোপন প্রেমের ষড়যন্ত্র চলেছে বোধ হয়। চোরের মতো পা টিপে টিপে যাওয়া এবং স্ত্রী বেচারার কান্নাকাটির এইটাই একমাত্র সম্ভাব্য ব্যাখ্যা। লোকটার চেহারায় আকর্ষণ আছে, যেকোনো গ্রাম্যবালার মন কেড়ে নেওয়ার মতো। অনুমিতিটাও সেই কারণে খাপ খেয়ে যাচ্ছে মনে হল! আমি ঘরে ফিরে আসার পর তালার ফোকরে চাবি ঘোরানোর আওয়াজ শুনেছিলাম। অর্থাৎ, ব্যারিমুর গোপন অভিসারে বেরিয়েছিল নিশ্চয়। এইভাবেই মনে মনে যুক্তিতর্ক করলাম সকালবেলা। সন্দেহ কোনদিকে বইছে, তাও শুনলে। শেষকালে অবশ্য কোনো সন্দেহই ধোপে টেঁকেনি।

    ব্যারিমুরের রহস্যজনক গতিবিধির ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, আমি দেখলাম ব্যাপারটা চেপে রাখতে গিয়ে পুরো দায়িত্ব আমাকেই নিতে হচ্ছে সঠিক ব্যাখ্যাও আমার জানা নেই। তাই আর পারলাম না। প্রাতরাশ খাওয়ার পর স্যার হেনরির পড়ার ঘরে গিয়ে বললাম আমি কী দেখেছি! যতটা অবাক হবেন ভেবেছিলাম, দেখলাম ততটা হলেন না।

    বললেন, ব্যারিমুর যে রাতবিয়েতে বাড়িতে টহল দেয়, আমি তা জানি। ওকে এ নিয়ে জিজ্ঞেসও করব ভাবছিলাম। আপনি যে সময়ের কথা বললেন, ঠিক ওই সময়ে বার দু-তিন ওর আসা যাওয়ার শব্দ আমি শুনেছি।

    তাহলে বোধ হয় রোজ রাতে বিশেষ ওই জানলার সামনেই যায়। বললাম আমি।

    বোধ হয় যায়। তাই যদি হয়, পেছন পেছন গিয়ে দেখব ও কী করে সেখানে। আপনার বন্ধু হোমস এখানে থাকলে কী করতেন বলুন দিকি?

    আপনি যা বললেন, আমার মনে হয় ঠিক তাই করত। ব্যারিমুরের পেছন পেছন গিয়ে দেখত কী করে সে।

    তাহলে আমরাও তাই করব।

    কিন্তু ও তো পায়ের আওয়াজ শুনে ফেলবে।

    লোকটা কানে একটু কালা। সে যাই হোক, ঝুঁকি একটু নিতেই হবে। আজ রাতে আমার ঘরে বসব দু-জনে। পায়ের আওয়াজ পেলেই পেছন ধরব। আনন্দে দু-হাত ঘষলেন স্যার হেনরি। জলার শান্ত জীবনযাত্রার মধ্যে বৈচিত্র্য হিসেবে মনে মনে তিনি যে এখন অ্যাডভেঞ্চার চাইছেন, স্পষ্ট বুঝলাম তাঁর আনন্দ দেখে।

    স্যার চার্লসের নির্দেশে নকশা যিনি এঁকেছিলেন সেই স্থপতির সঙ্গে পত্রালাপ করছিলেন স্যার হেনরি। লন্ডনের এক কনট্রাকটরের সঙ্গেও পত্র-বিনিময় চলছিল। শিগগিরই বিরাট পরিবর্তন দেখা যাবে এ-অঞ্চলে। প্লিমাউথ থেকে ডেকরেটর আর আসবাবপত্র নির্মাতা আসছে। বন্ধুটির মাথার ভেতরে বড়ো বড়ো পরিকল্পনা ঘুরছে নিশ্চয়। ফ্যামিলির হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে অর্থ বা সামর্থ্যর কাপর্ণ করবেন না। মেরামতের পর বাড়ি নতুন চেহারা নিলে এবং ঘরে ঘরে হালফ্যাশানের আসবাবপত্র এসে গেলে বাকি থাকবে একজন স্ত্রী–তাহলেই সম্পূর্ণ হবে সব আয়োজন। শুধু তোমাকেই বলছি, গিন্নীর যে অভাব হবে না, তার সুস্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা শুধু রাজি হলেই হয়। সুন্দরী প্রতিবেশিনী মিস স্টেপলটনকে দেখে স্যার হেনরি যেমন মোহিত হয়েছেন, নারী সন্দর্শনে সেভাবে মোহিত হতে কোনো পুরুষকে খুব একটা এর আগে দেখিনি। তবে কী জানো, খাঁটি প্রেম কখনো মসৃণ পথে যায় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে এঁদের ভালোবাসাও অনেক বাধা পাবে। যেমন ধরো, আজ সকালে একটা বাধা এমন অপ্রত্যাশিতভাবে মাথা চাড়া দিয়েছে যে যুগপৎ বিষম বিরক্তি এবং পরে পড়েছেন আমাদের বন্ধু।

    ব্যারিমুর সম্পর্কে কথাবার্তার পর মাথায় টুপি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন স্যার হেনরি। যথারীতি আমিও উঠলাম।

    বিচিত্র চাহনি নিক্ষেপ করলেন স্যার হেনরি। বললেন, ওয়াটসন, আপনি আসছেন নাকি?

    জলার দিকে যদি যান, তাহলে আসব।

    তাই তো যাচ্ছি।

    জানেন তো কী নির্দেশ আছে আমার ওপর জোর করে যাচ্ছি বলে দুঃখিত। কিন্তু কী করব বলুন। আপনি নিজে শুনেছেন, পইপই করে হোমস আমাকে আপনার সঙ্গ ছাড়া হতে বারণ করেছে বিশেষ করে জলায় আপনাকে একা ছাড়া একেবারেই বারণ।

    স্মিতমুখে আমার কাঁধে হাত রাখলেন স্যার হেনরি।

    বললেন, ভায়া, হোমস কিন্তু আমি জলায় পা দেওয়ার পর কী কী ঘটবে সেটা কী করে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করবেন বলুন? বুঝেছেন কী বলছি? আমি জানি অন্য লোকের আনন্দ উপভোগে বাধা আর যেই দিক, আপনি অন্তত দেবেন না। একাই যাব আমি।

    বিষম বিড়ম্বনায় পড়লাম। কী করা উচিত অথবা কী বলা উচিত, ভেবে পেলাম না। মনস্থির করার আগেই উনি বেতের ছড়ি আর টুপি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

    পরে যখন ভাবতে বসলাম, বিবেকের দংশনে অস্থির হয়ে পড়লাম। কোনো ছলছুতোতেই তাকে আমার চোখের আড়ালে যেতে দেওয়া উচিত হয়নি। তোমার নির্দেশ অমান্য করার ফলে যদি কোনো শোচনীয় ঘটনা ঘটে যায়, তখন কী মুখে তোমার সামনে ফিরব ভেবে গাল লাল হয়ে গেল আমার। খুব দেরি হয়নি যদিও, এখনও বেরিয়ে পড়লে নাগাল ধরে ফেলা যাবে। তাই তাড়াতাড়ি রওনা হলাম মেরিপিট হাউস অভিমুখে।

    হন হন করে এলাম বটে, কিন্তু রাস্তায় কোথাও স্যার হেনরিকে দেখলাম না। জলার রাস্তা মূল রাস্তা থেকে যেখানে বেরিয়েছে, সেখানে পৌঁছে ভাবলাম হয়তো ভুল পথে চলেছি। তাই একটা পাহাড় বেয়ে উঠলাম ওপর থেকে দেখে নেব বলে। এই সেই পাহাড় যেখানে পাথর খাদ খুঁড়েছে প্রাগৈতিহাসিক মানবরা। এই পাহাড়ের ওপর থেকেই দেখতে পেলাম ওঁকে। প্রায় সিকি মাইল দূরে জলার রাস্তায় হাঁটছেন, পাশে একজন ভদ্রমহিলা মিস স্টেপলটন ছাড়া কেউ নন। স্পষ্ট বোঝা গেল, দু-জনের মধ্যে এর মধ্যেই একটা সমঝোতার সৃষ্টি হয়েছে এবং দিন-ক্ষণ-স্থান ঠিক করেই তবে দু-জনে এসেছেন দেখা করতে। গভীর কথোপকথনে নিমগ্ন দু-জনে, হাঁটছেন ধীর চরণে। মিস স্টেপলটনের দ্রুত হাত নাড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে ব্যাকুলভাবে কী বোঝাতে চাইছেন, তন্ময় হয়ে শুনছেন স্যার হেনরি, দু-একবার যেন কথা একেবারেই মনঃপূত না-হওয়ায় মাথা নাড়লেন। পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম দু-জনকে। আমার তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। কী যে করব, ভেবে পাচ্ছি না। মূর্তিমান উৎপাতের মতন ওদের কথার মাঝে আবির্ভূত হওয়া যায় না, অথচ ওঁকে চোখের আড়াল হতে দিতে বিবেকের সায় নেই। মুহূর্তের জন্যেও দৃষ্টির অন্তরাল হতে দেব না এই তত আমার সুস্পষ্ট কর্তব্য। বন্ধুর ওপর গুপ্তচরের মতন নজর রাখাটাও ঘৃণ্য ব্যাপার। শেষকালে দেখলাম, পাহাড়ের ওপর থেকে ওঁকে নজরবন্দি রাখা ছাড়া আর পথ নেই, পরে না হয় অকপটে সব স্বীকার করে নিয়ে নিজের বিবেককে ঠান্ডা করা যাবে। এটাও ঠিক যে আচম্বিতে কোনো বিপদ এসে হাজির হলে এতদূর থেকে আমি কিসু করতে পারব না। তবে আমার অসুবিধেটা তুমি নিশ্চয় উপলব্ধি করবে। এ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আমার।

    ভদ্রমহিলা এবং স্যার হেনরি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গিয়ে গভীর আলোচনায় তন্ময় হয়ে রয়েছেন, সহসা আমি সচেতন হলাম আর একজনের উপস্থিতিতে। বিজনে দু-জনের মিলনের সাক্ষী কেবল আমিই নই, আর একজন রয়েছেন। শূন্যে ভাসন্ত সবুজ আটির মতো কী যেন একটা চোখের কোণে ভেসে উঠল। ভালো করে তাকাতেই দেখি জিনিসটা উড়ছে একটা লাঠির ডগায় এবং লাঠিটা বয়ে নিয়ে ভাঙা জমির ওপর হাঁটছে একটা লোক। প্রজাপতির জাল নিয়ে চলেছেন স্টেপলটন। আমার চেয়ে উনি যুগলমূর্তির অনেক নিকটে এবং মনে হল হাঁটছেনও সেইদিকে। ঠিক সেই সময়ে আচমকা স্যার হেনরি মিস স্টেপলটনকে পাশে টেনে নিলেন এবং আলিঙ্গন বদ্ধ করলেন। মিস স্টেপলটনকে মনে হল মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে আলিঙ্গনমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন গায়ের জোরে। স্যার হেনরির মাথা ঝুঁকে পড়ল তাঁর মাথার ওপর, এক হাত তুলে যেন প্রতিবাদ জানালেন মিস স্টেপলটন। পরমুহূর্তেই দেখলাম প্রিংয়ের পুতুলের মতো দু-জন দু-দিকে ছিটকে গেলেন এবং বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ালেন। বাধা পড়েছে স্টেপলটনের জন্যে। পাগলের মতো ভদ্রলোক দৌড়োচ্ছেন এঁদের দিকে–উদ্ভট জালটা দুলছে পেছনে। অঙ্গভঙ্গি করে বিষম উত্তেজনায় প্রায় নাচতে লাগলেন প্রেমিকযুগলের সামনে। দৃশ্যটার মানে কী হৃদয়ঙ্গম করতে পারলাম না। শুধু মনে হল, স্যার হেনরিকে গালাগাল দিচ্ছেন স্টেপলটন, বোঝাতে চেষ্টা করছেন স্যার হেনরি, স্টেপলটন বুঝতে চাইছে না, আর খেপে যাচ্ছেন স্যার হেনরি! পাশে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা উদ্ধত, নীরব। অবশেষে বেগে ঘুরে দাঁড়ালেন স্টেপলটন, প্রভুত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে ডাকলেন বোনকে। স্যার হেনরির পানে দোনামোনা চোখে বারেক তাকিয়ে ভাইয়ের পাশে পাশে হাঁটতে লাগলেন বোন। প্রকৃতিবিদের রাগত অঙ্গভঙ্গি দেখে বোঝা গেল অসন্তোষের আওতায় ভদ্রমহিলাও রয়েছেন। মিনিটখানেক সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ব্যারনেট। যে-পথে এসেছিলেন সেই পথেই মাথা হেঁট করে আস্তে আস্তে ফিরে চললেন–মূর্তিমান বিষাদ যেন।

    মানে কী এসবের, মাথায় এল না। তবে বন্ধুর অজ্ঞাতসারে এইরকম একটা ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখে ফেলার জন্যে লজ্জা পেলাম। দৌড়ে নেমে এলাম পাহাড় থেকে, সানুদেশে। দেখা হয়ে গেল ব্যারনেটের সঙ্গে। মুখ ক্ৰোধারুণ, ললাটে কুটি–কী করা উচিত যেন ভেবে পাচ্ছে না।

    বললে, আরে ওয়াটসন যে! আকাশ থেকে পড়লেন নাকি? বারণ করা সত্ত্বেও পেছন পেছন এসেছেন মনে হচ্ছে?

    খুলে বললাম সব কিছু; ওঁকে একলা ছেড়ে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বাড়িতে বসে থাকতে না-পেরে কীভাবে পেছন পেছন ছুটে এসেছিলাম এবং না-দেখতে পেয়ে পাহাড়ে উঠে কী কী দেখে ফেলেছি–সব বললাম। মুহূর্তের জন্য দপ করে জ্বলে উঠলেন বটে, কিন্তু আমার প্রাণখোলা স্বীকারোক্তিতে রাগ জল হয়ে গেল নিমেষে; হাসলেন–অন্তরের জ্বালা ফুটে উঠল সেই হাসিতে।

    বললেন, মানুষমাত্রই আশা করে এ-রকম একটা খাঁ-খাঁ মাঠের মাঝে গিয়ে অন্তত কিছু প্রাইভেট কথা বলা যাবে। কিন্তু কী আশ্চর্য! গোটা অঞ্চলটা দেখছি হুমড়ি খেয়ে পড়েছে আমার প্রেমনিবেদন দেখতে তার ওপর এইরকম একটা যাচ্ছেতাই প্রেম নিবেদন। কোন সিটে বসেছিলেন?

    আমি ছিলাম ওই পাহাড়ে।

    একেবারে পেছনের সিটে দেখছি! ভাইটা তো দেখলাম একেবারে সামনের সিটে! কীভাবে তেড়ে এল দেখেছেন?

    হ্যাঁ দেখেছি।

    মাথায় ছিট-টিট কখনো দেখেছিলেন? ভাইটার কথা বলছি।

    আগে তো কখনো দেখিনি।

    আমিও দেখিনি। সুস্থমস্তিষ্ক বলেই ভেবেছিলাম–আজকে দেখি মোটেই তা নয়–হয় আমার আর না হয় ওর পাগলা গারদে যাওয়া দরকার। আমার মধ্যে কোনো গোলমাল কি দেখেছেন? বেশ কয়েক সপ্তাহ একসঙ্গে তো কাটালেন। স্পষ্ট বলুন ওয়াটসন! যে-নারীকে ভালোবাসি, তার স্বামী হওয়ার মতো অযোগ্যতা কি আমার মধ্যে দেখেছেন?

    না, একেবারেই না।

    আমার পার্থিব সম্পদ নিয়ে নিশ্চয় আপত্তি ওঠে না–উঠেছে আমাকে নিয়েই। আমার দোষটা কী দেখেছে বলতে পারেন? চেনাজানা কাউকে ইহজীবনে আঘাত দিইনি। তা সত্ত্বেও বোনের আঙুল পর্যন্ত ছুঁতে দেবে না আমাকে!

    তাই বললেন নাকি?

    শুধু তাই নয়, আরও অনেক কথা। ওয়াটসন, ক-দিনই বা দেখেছি ভদ্রমহিলাকে কিন্তু প্রথম থেকেই মনে হয়েছে ওঁর সৃষ্টি হয়েছে আমার জন্যে উনি নিজেও তা বুঝেছেন, বুঝেছেন বলেই আমার সঙ্গসুখ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছেন আমি তা বুঝি। মেয়েদের চোখে এমন একটা স্ফুলিঙ্গ আছে যা মুখের কথার চেয়ে বেশি কথা বলে। কিন্তু কিছুতেই দু-জনকে কাছাকাছি হতে দেবেন না ভাই ভদ্রলোক। আজকেই কেবল একটা সুযোগ পেয়েছিলাম নিরালায় দুটো কথা বলবার: আমার সঙ্গ পেয়ে কী খুশিই-না হলেন উনি, কিন্তু আরম্ভ করলেন একেবারেই অন্য কথা–ভালোবাসার কথার ধার দিয়েও গেলেন না বরং আমি তা বলতে গেলে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। বার বার বলতে লাগলেন একটাই কথা। এ-জায়গা নাকি সাংঘাতিক বিপজ্জনক। আমি এখান থেকে না-যাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাবেন না। আমি বললাম, তাকে দেখবার পর থেকে এত তাড়াতাড়ি এ-জায়গা ছেড়ে যাবার কোনো বাসনাই আমার নেই; তবে হ্যাঁ যেতে পারি যদি উনিও আমার সঙ্গে যান–এ ছাড়া স্থানত্যাগ কোনোমতেই সম্ভব নয়। এর পর যথাসম্ভব গুছিয়ে বললাম, আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। উনি জবাব দেওয়ার আগেই পাগলের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে কোত্থেকে এসে গেলেন এই ভাইটা। মুখের চেহারাও দেখলাম বদ্ধ উন্মাদের মতন। রাগের চোটে বিলকুল সাদা, দাউ দাউ করে যেন আগুন জ্বলছে হালকা রঙের দু-চোখে। কী করেছি এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে? আমার সাহস তো কম নয়? কার মন কাড়ার চেষ্টা আমি করেছি? আমার কি জানা নেই এ-জিনিস ভদ্রমহিলা দু-চক্ষে দেখতে পারেন না? কী ভেবেছি আমি? ব্যারনেট বলে যা খুশি করব? সহোদর যদি না-হতেন, ভদ্রলোককে জবাব দিতে হয় কী করে, সেটা দেখিয়ে দেওয়া যেত। যাই হোক, বললাম তার সহোদরার প্রতি আমার আবেগে অনুভূতির জন্যে বিন্দুমাত্র লজ্জিত আমি নই এবং আমি আশা করি আমার স্ত্রী হয়ে আমাকে উনি সম্মানিত করবেন। এই কথার পরেও যখন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটল না, আমিও মেজাজ খারাপ করে ফেললাম, গরম গরম দু-চার কথা শুনিয়ে দিলাম–ভদ্রমহিলা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই চুপচাপ থাকাটা ঠিক মনে করলাম না। ফলটা হল কী আপনি দেখলেন। বোনকে নিয়ে বিদেয় হলেন ভাই। আর ভ্যাবাচাকা খেয়ে আমি চলেছি আমার পথে–এ-রকম শোচনীয় অবস্থা এ-তল্লাটে আর কারো হয়েছে বলে মনে হয় না। ওয়াটসন, বলুন দিকি এর মানে কী–বলুন চিরকাল ঋণী থাকব আপনার কাছে।

    দু-একটা ব্যাখ্যা হাজির করবার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু সুবিধে করতে পারলাম না। কেননা আমি নিজেই রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়েছি। খেতাব, সম্পত্তি, বয়স, চরিত্র এবং আকৃতি–সবই বন্ধুটির পক্ষে। বিপক্ষে আছে এমন কিছুই আমার জানা নেই, বংশের দুর্ভাগ্যকে যদি ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। ভদ্রমহিলার ইচ্ছে অনিচ্ছের পরোয়া না-করেই বন্ধুর প্রস্তাব এইভাবে প্রত্যাখ্যান এবং বিনা প্রতিবাদে ভদ্রমহিলারও সব মেনে নেওয়া সত্যিই চরম বিস্ময়কর। যাই হোক, আন্দাজ আর অনুমানের অবসান ঘটালেন স্টেপলটন নিজেই এলেন সেইদিনই বিকেলে। রুক্ষ ব্যবহারের জন্য মাপ চাইতে এসেছেন উনি। স্যার হেনরির সঙ্গে পড়ার ঘরে প্রাইভেট কথাবার্তা বললেন দীর্ঘক্ষণ। বেরিয়ে আসার পর বোঝা গেল, ক্ষত নিরাময় হয়েছে। হৃদ্যতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার নিদর্শন স্বরূপ পরের সপ্তাহে রাতের আহার করতে যাব মেরিপিট হাউসে।

    স্যার হেনরি বললেন, স্টেপলটন ছিটগ্রস্ত নন, এখনও কিন্তু তা বলব না। আজ সকালেই যেভাবে তেড়ে এসেছিলেন এবং চোখের যে-চেহারা দেখিয়েছিলেন, কোনোদিন তা ভুলব না। তবে এটাও মানতে হবে, এমন সুন্দরভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতেও কাউকে দেখিনি।

    অভব্য আচরণের কারণ দর্শিয়েছেন।

    বললেন, সহোদরাই ওঁর জীবনের সব কিছু। খুবই স্বাভাবিক, বোনের মূল্যায়ন করতে পেরেছেন দেখে খুশিই হলাম। চিরটাকাল একসাথে থেকেছেন দু-জনে। বোন না-থাকলে উনি বড়ো নিঃসঙ্গ। তাই বোনকে হারাতে হবে ভাবলেই মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। আমি যে তাঁর বোনের প্রতি অনুরক্ত হয়েছি, উনি বোঝেননি। তাই স্বচক্ষে তা দেখে যখন খেয়াল হল বোনকে তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হবেই, এমন মারাত্মক মানসিক আঘাত পেলেন যে, কী বলেছেন অথবা করেছেন তার জন্যে তাকে সেই মুহূর্তের জন্যে দায়ী করা চলে না। যা হয়ে গেছে, তার জন্যে আন্তরিক দুঃখিত। এটাও উপলব্ধি করেছেন যে ওঁর সহোদরার মতন পরমাসুন্দরীকে নিজের কাছে সারাজীবন ধরে রেখে দেওয়ার কল্পনাও কতখানি বোকামি বা স্বার্থপরতা। বোনকে যদি কাছছাড়া করতেই হয়, তবে আমার মতো প্রতিবেশীর জন্যেই তা করবেন আর কারো জন্যে নয়। কিন্তু ওঁকে সময় দিতে হবে। এই আঘাত সামলে নিতে, মনকে প্রস্তুত করতে বেশ কিছু সময় ওঁকে দিতে হবে। উনি কোনো বাধাই দেবেন না। যদি আমি কথা দিই তিন মাস আর এগোব না; এই তিন মাস কেবল ভদ্রমহিলার বন্ধু হয়ে থাকব, প্রেমের কথা একদম বলব না। আমি কথা দিয়েছি। কাজেই ঝামেলার নিষ্পত্তি ঘটেছে।

    একটা ছোট্ট রহস্য তাহলে পরিষ্কার হল। আমরা যেন পাঁকের গর্তে হাতড়ে মরছি, তলদেশে হাত ঠেকল এইমাত্র। এখন বুঝছি, স্যার হেনরির মতো যোগ্য পাত্রও সহোদরার প্রতি আকৃষ্ট হলে কেন চটে যেতেন স্টেপলটন। জটপাকানো সুতো টেনে সোজা করছি, নিশীথ রাত্রে ফুঁপিয়ে কান্না, মিসেস ব্যারিমুরের অশ্রুকলঙ্কিত মুখ এবং পশ্চিমের জানলায় খাস ভৃত্যের গোপন অভিযানের রহস্য এবার ব্যাখ্যা করছি। ভায়া হোমস, অভিনন্দন জানাও আমাকে, প্রতিনিধি হিসেবে তোমাকে যে হতাশ করিনি, তা স্বীকার করে। আমাকে এখানে পাঠিয়ে যে-আস্থা আমার প্রতি দেখিয়েছ, তার জন্যে যে তোমাকে পরিতাপ করতে হচ্ছে না, তা এবার মুখ ফুটে বলো। এতগুলো রহস্য একরাতেই সাফ করে দিয়েছি।

    এক রাতে বললাম বটে, আসলে দুটো রাত লেগেছে; কেননা, প্রথম রাতটা স্রেফ ফক্কা হাতে ফিরতে হয়েছে। স্যার হেনরির ঘরে রাত তিনটে পর্যন্ত বসেই রইলাম, কিন্তু সিঁড়ির ওপরকার টাইমিং ক্লকে একই সুরে মিলানো ঐকতান বাজনা ছাড়া আর কিছু শুনলাম না। বড়ো বিষণ্ণ এই জাগরণের অবসান ঘটল চেয়ারে বসেই নিদ্রাদেবীর আরাধনায়। দু-জনেই ঘুমোলাম অকাতরে। কপাল ভালো, হতাশ হইনি কেউই। পণ করলাম, আবার রাত জাগব। পরের রাতে লক্ষ কমিয়ে রেখে নিঃশব্দে সিগারেট টেনে চললাম। সময় যে এত মন্থরগতি, বিশ্বাস করাই যেন যায় না। তা সত্ত্বেও বসে রইলাম ঝানু শিকারির মতন ফাঁদে শিকার পড়তে চলেছে, এই প্রতীক্ষায় শিকারি যেভাবে উন্মুখ হয়ে থাকে, আমরাও বসে রইলাম সেইভাবে। একটা বাজল, দুটো বাজল, নিঃসীম হতাশায় দ্বিতীয়বারের মতোও হাল ছেড়ে দেব কিনা ভাবছি, এমন সময়ে দু-জনেই সটান খাড়া হয়ে বসলাম চেয়ারে, ফের সজাগ হয়ে উঠল ক্লান্ত ইন্দ্রিয়গুলো। অলিন্দপথে পা ফেলার মচাৎ শব্দ শুনেছি দু-জনেই।

    কান খাড়া করে শুনলাম, মার্জারের মতো লঘু চরণের পদধ্বনি দরজার সামনে দিয়ে গিয়ে বিলীন হল দূরে। উঠে দাঁড়ালেন ব্যারনেট, আলতোভাবে খুললেন দরজা, শুরু হল অনুসরণপর্ব গ্যালারি ঘুরে ছায়ামূর্তি ওদিককার অন্ধকার গলিপথে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। পা টিপে টিপে এলাম ওদিককার মহলে। পলকের জন্য দেখলাম দীর্ঘকায়, কালো দাড়িওয়ালা একটা মূর্তি পা টিপে টিপে চলছে অলিন্দ বরাবর দু-কাঁধ গোল হয়ে গিয়েছে অতি সাবধানতার দরুন। পরমুহূর্তেই সেই বিশেষ দরজা দিয়ে ভেতরে অন্তর্হিত হল সে, ভেতরকার আলোয় আলোকিত দরজার ফ্রেমটা কেবল স্পষ্ট হয়ে রইল অন্ধকারের বুকে, একটিমাত্র হলুদ রশ্মি এলিয়ে রইল বিষণ্ণ করিডরের কালো বুকে। সতর্কভাবে এগিয়ে চললাম সেইদিকে, প্রতি পদক্ষেপে ভয় হল এই বুঝি আর্তনাদ করে উঠবে পায়ের তলার তক্তা। ভয়ের চোটে ভর দিতেও পারছি না তক্তায়–পা ফেলার আগে পা দিয়ে টিপে পরখ করে নিচ্ছি আওয়াজ হয় কিনা। যদিও বুট খুলে এসেছি, তবুও পুরোনো তক্তা মচ মচ ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করতে ছাড়ল না পায়ের তলায়। মাঝে মাঝে মনে হল, এত আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে না ব্যারিমুর, হতেই পারে না। সৌভাগ্যক্রমে লোকটা কানে বেশ খাটো, তার ওপরে নিজের কাজেই তন্ময়। অবশেষে পৌঁছোলাম দরজাটার সামনে। উঁকি মারলাম। দেখলাম, গত দু-রাতের মতো আজও সে জানলার সামনে জ্বলন্ত মোমবাতি ধরে সাগ্রহে সাদা মুখখানা চেপে রয়েছে শার্সির কাঁচে।

    অভিযানের পরিকল্পনা স্থির করা ছিল না, কিন্তু ব্যারনেটের স্বভাবই হল যা করবেন, একেবারে সোজাসুজি করবেন। সোজা পথের মানুষ বলতে যা বোঝায় আর কী, গটমট করে ঘরে ঢুকলেন উনি। ঢোকার সঙ্গেসঙ্গে সশব্দে শ্বাস টেনে জানলার সামনে থেকে ছিটকে সরে এসে সামনে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল ব্যারিমুর। মুখ তো নয়, যেন সাদা মুখোশ। জ্বলজ্বলে দুই কালো চোখে বিমূর্ত আতঙ্কে এবং বিস্ময় নিয়ে পর্যায়ক্রমে দৃষ্টি বুলোতে লাগল আমার এবং স্যার হেনরির ওপর।

    ব্যারিমুর, কী করছ এখানে?

    কিছু না, স্যার, অপরিসীম উত্তেজনার দরুন ভালোভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। সে, কম্পিত মোমবাতির কম্পমান আলোয় লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে নিজেরই ছায়া। এই জানলাটা, স্যার। রাতে ঘুরে ঘুরে দেখি সব জানলা বন্ধ আছে কিনা।

    দোতলার জানলাও?

    আজ্ঞে হ্যাঁ, সব জানলা।

    কড়া গলায় বললেন স্যার ব্যারিমুর, আসল কথাটা আজ তোমার মুখ থেকে বার করব বলেই এসেছি। ঝামেলা বাড়িয়ো না। যত তাড়াতাড়ি পারে বলে ফেলল। বললা। একদম মিথ্যে বলবে না! কী করছিলে জানলায়?

    অসহায় চোখে আমাদের পানে চেয়ে এমনভাবে দু-হাত মোচড়াতে লাগল লোকটা, যেন দ্বিধা আর দুর্দশার শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে।

    কোনো অনিষ্ট করিনি, স্যার। জানলায় মোমবাতি ধরেছিলাম।

    জানলায় কেন মোমবাতি ধরেছিলে?

    আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না, স্যার হেনরি–আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না! বিশ্বাস করুন, গোপন এই রহস্যটা আমার নয়, কাজেই আমার মুখ দিয়ে তা ফাঁস হবে না। ব্যাপারটা যদি শুধু আমারই হত, আর কেউ যদি এতে জড়িয়ে না-থাকত, আপনার কাছে নিশ্চয় লুকোতাম না।

    হঠাৎ একটা ব্যাপার মাথায় খেলে গেল। জানলার গোবরাটে মোমবাতি রেখেছিল ব্যারিমুর। আমি গিয়ে তুলে নিলাম।

    বললাম, নিশ্চয় সংকেত করছিল কাউকে। দেখি জবাব পাওয়া যায় কিনা।

    যেভাবে ও ধরেছিল মোমবাতি, আমিও ধরলাম সেইভাবে, দৃষ্টি প্রসারিত করলাম নিশীথ রাতের বুকে। চাঁদ মেঘে ঢাকা পড়েছে, তাই আবছামতো কালো গাছের রেখা আর তার চাইতে হালকা রঙের জলার আদিগন্ত বিস্তৃতি অস্পষ্টভাবে ভাসছে সামনে। তারপরেই চেঁচিয়ে উঠলাম সোল্লাসে। অন্ধকারের অবগুণ্ঠন ফুটে সহসা জাগ্রত হয়েছে পিনের ডগার মতো একটা হলুদ আলো–অনির্বাণভাবে জ্বলছে জানলার ফ্রেমের চৌকোনো কালো পটভূমিকায়।

    ওই তো। বললাম চেঁচিয়ে।

    না, না, স্যার, ও কিছু নয়–কিছু নয়, ভেঙে পড়ল খাসভৃত্য, বিশ্বাস করুন, স্যার—

    ওয়াটসন, জানলার সামনে আলোটা নাড়ান। চিৎকার করে বললেন ব্যারনেট। দেখুন, ও-আলোটাও নড়ছে। বদমাশ কোথাকার, সংকেত ছাড়া এটা কী? আর অস্বীকার করতে পারবে? বলো, আর কেন? মুখ খোলো এবার! স্যাঙাতটা কে? কী ষড়যন্ত্র চলছে এখানে?

    অবাধ্যতা এবার খোলাখুলিভাবে ফুটে উঠল ব্যারিমুরের মুখে। ব্যাপারটা আমার, আপনার নয়। আমি বলব না।

    তাহলে আমার চাকরি তোমায় এখুনি ছাড়তে হবে।

    খুব ভালো কথা, স্যার। একান্তই যদি ছাড়তে হয়, ছাড়ব বই কী।

    এবং চরম অসম্মানের মধ্যে বরখাস্ত হবে। কী আশ্চর্য! লজ্জা হওয়া উচিত ছিল তোমার। এক-শো বছরেরও ওপর তোমার ফ্যামিলি এই বাড়িতে কাটিয়েছে, আর আজকে কিনা আমারই বিরুদ্ধে নোংরা চক্রান্ত করছ তুমি।

    না, না, স্যার; আপনার বিরুদ্ধে নয়!

    কথাগুলো নারীকণ্ঠের, স্বামীর চাইতেও আরও ফ্যাকাশে আরও ত্ৰাসকম্পিত মুখে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মিসেস ব্যারিমুর। শাল আবৃত এবং স্কার্ট আচ্ছাদিত গুরুভার বপু দেখে অন্য সময় হলে হাসির উদ্রেক ঘটত, কিন্তু মুখাবয়বের আতীব্র আবেগ আর অনুভূতির দরুন হাসি এল না।

    বাটলার বললে, এলিজা, চাকরি আর নেই। সব শেষ। জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও।

    জন, জন, আমার জন্যেই তোমার এই হাল হল। স্যার হেনরি, এসব আমার কীর্তিআমার কাজ ও যা কিছু করেছে আমি বলেছি বলেই করেছে, আমার মুখ চেয়েই করেছে।

    তাহলে তুমিই বলো! মানে কী এসবের?

    আমার অভাগা ভাইটা না-খেয়ে জলায়। দরজার সামনেই অনাহারে তাকে মরতে দিতে পারি না। আলো জ্বালিয়ে সংকেতেবলি–খাবার তৈরি। সে আলো জ্বালিয়ে সংকেত জানায়–কোথায় খাবার নিয়ে যেতে হবে।

    তোমার ভাই তাহলে—

    পলাতক কয়েদি, স্যার–ক্রিমিন্যাল সেলডেন।

    কথাটা সত্যি স্যার, বললে ব্যারিমুর। এইজন্যেই বলছিলাম, গোপন রহস্যটা আমার নয়, আমি বলতে পারব না। যার সিক্রেট, তার মুখেই সব শুনলেন। এখন বিচার করে দেখুন চক্রান্তটা আপনার বিরুদ্ধে কিনা।

    নিশীথ রাতে চোরের মতো অভিযানে বেরিয়ে জানলায় আলো দেখানোর ব্যাখ্যা তাহলে এইটাই। সবিস্ময়ে আমি এবং স্যার হেনরি দু-জনেই চেয়ে রইলাম স্ত্রীলোকটির দিকে। বোকাসোকা সচ্চরিত্রা এই মেয়ের ধমনীতে এ-অঞ্চলের সবচেয়ে কুখ্যাত অপরাধীর রক্তও বইছে, এও কি সম্ভব?

    আজ্ঞে, হ্যাঁ, বিয়ের আগে আমার নামও সেলডেন ছিল। ও আমার ছোটো ভাই। ছোটো থেকেই আদর দিয়ে বাঁদর করেছি ওকে। যা চেয়েছে, তাই দিয়েছি। শেষকালে ওর ধারণা হয়ে গেল, গোটা দুনিয়াটাই সৃষ্টি হয়েছে কেবল ওর ফুর্তির জন্যে। যা খুশি করবে, যা খুশি চাইবে। বড়ো হওয়ার পর অনেক কুসঙ্গী জুটল, কাঁধে শয়তান ভর করল, মায়ের বুক ভেঙে দিলে, আমাদের নাম ডোবালো। একটার পর একটা জঘন্য অপরাধ করতে করতে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে স্রেফ ভগবানের কৃপায় ফাঁসির দড়ি থেকে এযাত্রা বেঁচে গেছে; আমার কাছে কিন্তু সে এখনও সেই ছোট্ট দস্যি ছেলে, চুলগুলো কোঁকড়া। বড়ো বোন আমি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি ছোট্ট ভাইটিকে। ও জানে আমরা এখানে আছি। আমাদের কাছে এলে ঠেলে ফেলে দেব না কোনোমতেই। তাই একদিন রাত্রিতে অনাহারে ক্লান্তিতে টলতে টলতে আশ্রয় নিতে এল, ওয়ার্ডাররা প্রায় ধরে ফেলে আর কী, কী করব তখন বলতে পারেন? ঠাঁই দিলাম, খেতে দিলাম, শুশ্রুষা করলাম। তারপর, স্যার, আপনি এলেন। স্বামী বললে, জলায় থাকলেই বরং এখন নিরাপদে থাকবে। হইচই কমে গেলে অন্য কোথাও চলে যাবেখন। তাই লুকিয়ে আছে ওখানে। কিন্তু একরাত অন্তর জানলায় আলো জ্বেলে দেখি এখনও জলায় আছে কিনা। যদি জবাব আসে, স্বামী কিছু রুটি আর মাংস দিয়ে আসে। প্রতিদিনই ভাবি এবার বুঝি চলে গেছে। যদ্দিন না-যায়, তদ্দিন তো ওকে না-খাইয়ে রাখতে পারি না। স্যার, এই হল গিয়ে আসল ব্যাপার। এর মধ্যে একটুও মিথ্যে নেই। আমি ধর্মভীরু খ্রিস্টান। দোষ যদি কিছু হয়ে থাকে, সে-দোষ আমি করেছি, আমার স্বামী করেনি।

    প্রত্যেকটা কথার মধ্যে সুগভীর আন্তরিকতা ফুটে বেরোল–সেইসঙ্গে শ্রোতাদের কানে বয়ে নিয়ে এল দৃঢ় বিশ্বাস।

    ব্যারিমুর, সব সত্যি?

    হ্যাঁ, স্যার হেনরি, বর্ণে বর্ণে সত্যি।

    স্ত্রীর জন্যে যা করেছ, তার জন্যে তোমাকে দোষ দেওয়া যায় না। যা বলেছি ভুলে যাও। ঘরে যাও। কাল সকালে এ-প্রসঙ্গে আরও কথা হবেখন।

    চলে গেল দু-জনে। জানলা দিয়ে ফের তাকালাম বাইরে। দু-হাট করে পাল্লা খুলে ধরেছেন স্যার হেনরি, মুখে আছড়ে পড়ছে জলার ঠান্ডা কনকনে বাতাস। অনেক দূরে নিবিড় অন্ধকারে টিমটিম করে জ্বলছে হলুদ আলোর ক্ষুদ্র বিন্দু।

    সাহস আছে বটে, বললেন স্যার হেনরি।

    হয়তো এমনভাবে রেখেছে যাতে কেবল এখান থেকেই দেখা যায়।

    খুব সম্ভব তাই। কতদুরে হবে বলে মনে হয়?

    ফাটল ধরা পাহাড়টার দিকে।

    মাইলখানেক কি দুয়েক বড়ো জোর।

    তাও নয়।

    ব্যারিমুরকে খাবার নিয়ে যেতে হয়, কাজেই বেশিদূর হতেই পারে না। মোমবাতির পাশেই বসে পথ চেয়ে আছে শয়তান। ওয়াটসন, চললাম ওকে ধরতে!

    একই বাসনা আমার মাথার মধ্যেও এসেছিল। ব্যারিমুর তো স্বেচ্ছায় কিছু বলেনি বিশ্বাস করে একটা কথাও ভাঙেনি। জোর করে পেট থেকে আদায় করতে হয়েছে গোপন কথা। লোকটা সমাজ-শত্রু এবং বিপজ্জনক। বদমাইশির প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। সুতরাং তাকে ক্ষমা বা দয়া করার কথাই ওঠে না। এমন জায়গায় এ-লোককে রাখা দরকার যেখান থেকে কারো অনিষ্ট সে করতে পারবে না। আমরা সেই চেষ্টাই করে দেখব। যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকি, মূল্য দিতে হবে অন্য লোককে পাশবিক, প্রচণ্ড ওই প্রকৃতির সামনে নিরাপদ কেউই নয়। যেকোনো রাতে যেকোনো প্রতিবেশীর ওপর হামলা জুড়তে পারে এই মহাশয়তান এবং হয়তো স্টেপলটন ভাইবোনও বাদ যাবে না। এই কথাটা মাথায় আসতেই বোধ হয় অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় চনমন করে উঠলেন স্যার হেনরি।

    আমি আসছি, বললাম আমি।

    তাহলে যান বুট পরে নিন, রিভলবার আনুন। যত তাড়াতাড়ি বেরোই, ততই মঙ্গল। নইলে আলো নিভিয়ে সরে পড়তে পারে।

    পাঁচ মিনিটেই বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়, শুরু হল অভিযান। কালো গুল্মর মাঝ দিয়ে পথ করে দ্রুত এগিয়ে চললাম আলোর দিকে। খস খস করে উড়তে লাগল ঝরাপাতা–শরতের হাওয়ার চাপা গোঙানির শব্দ আছড়ে পড়ছে মুখে! স্যাঁৎসেঁতে আর পচা গন্ধে ভারী রাতের হাওয়া। মাঝে মাঝে ছুটন্ত মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরেই লুকিয়ে পড়ছে চাঁদ। জলায় পা দিতে-না-দিতেই শুরু হল ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। আলোটা তখনও স্থিরভাবে জ্বলছে সামনে।

    আপনি সশস্ত্র? জিজ্ঞেস করি আমি।

    ঘোড়ার চাবুক এনেছি।

    চক্ষের নিমেষে কাছে চলে যেতে হবে। শুনেছি, লোকটা দারুণ বেপরোয়া। আচমকা আঁপিয়ে কাবু করতে হবে বাধা দেওয়ার সুযোগ দেব না।

    ব্যারনেট বললে, ওয়াটসন, হোমস শুনলে কী বলবেন? অশুভ শক্তিদের নরকগুলজার এই সময়েই শুরু হয় না?

    প্রত্যুত্তর স্বরূপই যেন আচম্বিতে জলার বিশাল বিষণ্ণতার মধ্য থেকে জাগ্রত হল সেই ভয়াল গজরানি। সুবিশাল গ্রিমপেন পঙ্কভূমির কিনারায় দাঁড়িয়ে এর আগে রক্ত জমানো এ-ডাক আমি একবার শুনেছি। তখন শুনেছিলাম দিনের আলোয়, এখন শুনলাম রাতের অন্ধকারে। নিশীথ রাতের নৈঃশব্দ্য খান খান করে দিয়ে কনকনে হাওয়ায় ভর দিয়ে ডাকটা যেন ভেসে এল জলার বুক বিদীর্ণ করে বিরামবিহীন এক টানা গম্ভীর গজরানি, তারপর ধাপে ধাপে তা বেড়ে গেল রক্ত-হিম-করা হিংস্র গর্জনে যেন আকাশ বাতাস ফালা ফালা হয়ে গেল, পরমুহূর্তেই ফের নেমে এল খাদে, করুণ কান্নার মতো গুঙিয়ে মিলিয়ে গেল এক সময়ে। আবার জাগ্রত হল চাপা গর্জন। আবার ক্রুদ্ধ গর্জন, আবার বুকফাটা হাহাকার। তীক্ষ্ণ্ম, কর্কশ, বন্য এবং লোমহর্ষক সেই অপার্থিব চিৎকার বারংবার ভেসে এল নিশীথ রাতের বুক বিদীর্ণ করে ফাটিয়ে দিল যেন কানের পর্দা। বাতাস পর্যন্ত স্পন্দিত হল শব্দ-তরঙ্গে, শিউরে উঠল পাহাড়-পর্বত-গাছপালা। সভয়ে জামার আস্তিন খামচে ধরলেন ব্যারনেট। অন্ধকারেও দেখলাম মুখ সাদা হয়ে গিয়েছে।

    হে ভগবান! এ কীসের আওয়াজ, ওয়াটসন?

    জানি না। জলায় এ-আওয়াজ শোনা যায়। আমি আগে একবার শুনেছি।

    ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে অবশেষে একেবারেই থেমে গেল দীর্ঘ বিলাপের ধ্বনি। অখণ্ড নীরবতা চেপে বসল কানের ওপর। উত্তীর্ণ হয়ে রইলাম, কিন্তু নিবিড় নৈঃশব্দ্য ফুড়ে আর কোনো আওয়াজ ভেসে এল না।

    ওয়াটসন, বললেন ব্যারনেট, এ তো হাউন্ডের ডাক।

    শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা বরফের স্রোত নেমে গেল কথাটা শুনে। গলা ভেঙে গিয়েছে ব্যারনেটের। আচমকা আতঙ্কে সাহস হারিয়ে ফেলেছেন।

    আওয়াজটাকে ওরা কী বলে? শুধোলেন উনি।

    কারা?

    এ-অঞ্চলের লোকেরা।

    ওরা মুখ–ওদের কথা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?

    ওয়াটসন, বলুন আমাকে কী বলে ওরা?

    ইতস্তত করলাম, কিন্তু প্রশ্নটা এড়াতে পারলাম না।

    ওঁদের কথায় এই নাকি বাস্কারভিল কুকুরের ডাক।

    গুঙিয়ে উঠলেন ব্যারনেট, চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ।

    অবশেষে বলেন, কুকুরই বটে। ডাকটা কিন্তু বহু মাইল দূর থেকে ভেসে এল।

    কোত্থেকে এল, তা বলা মুশকিল।

    হাওয়ার ওঠানামার সঙ্গে আওয়াজটা উঠেছে নেমেছে। ওইদিকেই তো বিরাট সেই গ্রিমপেন পঙ্ক?

    হ্যাঁ।

    ওইখানেই রয়েছে। ওয়াটসন, কুকুরের ডাক ছাড়া একে আর কী বলে মনে হয় আপনার? আমি কচি খোকা নই। সত্যি বলতে ভয়টা কীসের?

    গতবার যখন শুনি আওয়াজটা, স্টেপলটন ছিলেন সঙ্গে। উনি বললেন অদ্ভুত কোনো পাখির ডাক হতে পারে।

    না, না, এ-ডাক হাউন্ডের। হে ভগবান, সত্যিই কি তাহলে এসব নিছক গল্প নয়? সব সত্যি? অলক্ষুণে এই ডাকের পেছনে কি ওত পেতে রয়েছে ভয়ানক বিপদ–পরিত্রাণ নেই আমার? আপনি নিশ্চয় এসব বিশ্বাস করেন না। ওয়াটসন, করেন কি?

    আরে না, না।

    তবুও দেখুন লন্ডনে বসে এ নিয়ে হাসিঠাট্টা করা এক জিনিস, জলার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বিকট এই ডাক শোনা আর এক জিনিস। তারপর ধরুন আমার কাকার মৃত্যু। মৃতদেহের পাশে হাউন্ডের পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছিল। সব মিলে যাচ্ছে। ওয়াটসন, আমি কাপুরুষ নই, কিন্তু আওয়াজটা আমার রক্ত পর্যন্ত যেন জমিয়ে দিয়েছে। হাত ছুঁয়ে দেখুন।

    মার্বেল পাথরের মতো হিমশীতল তার হাত।

    কাল সকালেই ঠিক হয়ে যাবেন।

    মাথার মধ্যে থেকে এ-ডাক তাড়াতে পারব বলে মনে হয় না। কী করা উচিত এখন বলুন তো? ফিরে যাব?

    না কক্ষনো না। যাকে ধরতে এসেছি, তাকে ধরবই। কয়েদির পেছনে আমরাই ছুটেছি, আমাদের পেছনে পিশাচ-কুকুর ছুটছে না। আসুন। এ-জলার সমস্ত ভূতপ্রেত পিশাচ-দানো বেরিয়ে এসে তাণ্ডবনাচ আরম্ভ করলেও ওকে আমরা ধরবই।

    অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চললাম। এবড়োখেবড়ো পাহাড়গুলো অস্পষ্ট কালো বিরাট চেহারা নিয়ে ভয় দেখাতে লাগল সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে। হলুদ আলোর বিন্দু সামনে জ্বলতে লাগল সমানে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বোঝা যায় না আলো কতদূরে আছে; মরীচিকার মতো কখনো মনে হয় এই বুঝি কয়েক গজ দূরে, আবার কখনো মনে হয় দিগন্তপারে; শেষকালে অবশ্য দেখা গেল কোথায় জ্বলছে আলোটা! বুঝলাম সত্যিই অনেক কাছে এসে পড়েছি। পাহাড়ের খাঁজে আটকানো একটা মোমবাতি থেকে ফোঁটা ফোঁটা মোম গলে পড়ছে। দু-পাশে পাথরের আড়াল থাকায় দুটো কাজ হচ্ছে। হাওয়ায় নিভছে না এবং বাস্কারভিল হলের দিক ছাড়া অন্য দিক থেকে দেখা যাচ্ছে না। একটা গোলাকার গ্র্যানাইট পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে সংকেত-বর্তিকার পানে চেয়ে রইলাম নির্নিমেষে। আশ্চর্য দৃশ্য সন্দেহ নেই। বিজন জলার বুকে জ্বলছে একটিমাত্র মোমবাতি ধারেকাছে নেই প্রাণের লক্ষণ–শুধু একটা সোজা, হলুদ শিখা–দু-পাশের পাথরের আড়াল চকচক করছে সেই আলোয়।

    বলুন এখন কী করি? ফিসফিস করলেন স্যার হেনরি।

    অপেক্ষা করা যাক। নিশ্চয় আলোর কাছেই আছে। চেহারাটা দেখা যায় কিনা দেখা যাক।

    মুখ থেকে কথাটা বেরুতে-না-বেরুতে দু-জনেই দেখলাম তাকে। পাথরের যে-ফাটলে মোমবাতি জ্বলছে, সহসা সেই খাঁজের উপর থেকে আবির্ভূত হল একটা মুণ্ডু, কুটিল একটা হলদেটে ভয়ংকর জন্তুর মতো মুণ্ডু, মুখের পরতে পরতে অজস্র ক্ষতচিহ্নের মতো দগদগ করছে ভয়াল ইন্দ্রিয়াবেগ। জটপাকানো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর মুখময় নোংরা পাঁকের দাগ যেন সে এ-যুগের মানুষ নয়–বহু যুগের ওপার হতে প্রস্তরযুগের বর্বর বুঝি আবার ফিরে এসেছে। আপন ডেরায়। নীচ থেকে আলো গিয়ে ঠিকরে যাচ্ছে ছোটো ছোটো ধূর্ত চোখজোড়া থেকে ডাইনে বাঁয়ে ভয়ংকরভাবে ঘুরছে চক্ষুগোলক উঁকি দিচ্ছে অন্ধকারের বুকে ঠিক যেন আগুয়ান শিকারি পদশব্দে সচকিত হয়েছে মহাধড়িবাজ গুহাবাসী কোনো শ্বাপদ।

    নিশ্চয়, কোনো কারণে সন্দেহের উদ্রেক ঘটেছে লোকটার। হয়তো ব্যারিমুরের নিজস্ব কোনো সংকেত ছিল—আমরা যা জানি না। অথবা হয়তো কোনো কারণে সে বুঝেছে হাওয়া অনুকূল নয়। আমি কিন্তু তার শয়তান মুখে দেখলাম ভয়ের রেখা। যেকোনো মুহূর্তে আলোর বৃত্ত থেকে ছিটকে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে নীর তমিস্রায়। সবেগে ধেয়ে গেলাম সামনে, দেখাদেখি স্যার হেনরিও লাফিয়ে এলেন পেছনে। সেই মুহূর্তে বিকট তীক্ষ্ণ্ণ গলায় গালাগাল দিয়ে একটা পাথর ছুঁড়ে মারল কয়েদি–টুকরো টুকরো হয়ে গেল গোল গ্রানাইটে লেগে–যার আড়ালে লুকিয়েছিলাম এতক্ষণ। চকিতের জন্যে দেখলাম বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোট্টা, মোটাসোটা, একটা মূর্তি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ছুটবার জন্যে। ঠিক সেই মুহূর্তেই কপাল খুলে গেল আমাদের, মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল চন্দ্রদেব। খাড়া পাহাড়ের কিনারার উপর দিয়ে ঝড়ের মতো ধেয়ে গেলাম আমরা। দেখলাম অন্যদিকে দুর্দান্ত বেগে নেমে যাচ্ছে পলাতক, এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফিয়ে নামছে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়–ঠিক যেন পাহাড়ি ছাগল। রিভলবার বার করে গুলি চালালে কপালজোরে একটা-না-একটা গুলি গায়ে লাগতই। পঙ্গু করে দিতে পারতাম কিন্তু হাতিয়ার এনেছি আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার জন্যে, নিরস্ত্র অবস্থায় যে-পালাচ্ছে তাকে গুলি করবার জন্যে নয়।

    আমরা দুজনেই মোটামুটি ভালো দৌড়বাজ, শরীরও মজবুত। তা সত্ত্বেও পলাতকের নাগাল ধরবার কোনো স্বভাবনাই নেই দেখলাম। চাদের আলোয় অনেকক্ষণ ধরে অনেকদ্দূর পর্যন্ত দেখা গেল তাকে, তারপর বহুদূরের একটা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বড়ো বড়ো পাথরের ওপর দিয়ে দ্রুত বেগে লাফাতে লাফাতে বিন্দুর মতো ছোট্ট হয়ে এল তার পলায়মান আকৃতি। পুরোপুরি বেদম না-হওয়া পর্যন্ত দৌড়েই গেলাম দু-জনে, কিন্তু দেখলাম ক্রমশই ব্যবধান বাড়ছে আমাদের আর পলাতকের মাঝখানে। শেষকালে দাঁড়িয়ে গিয়ে দু-জনে দুটো পাথরে হাঁপাতে লাগলাম হাপরের মতন–চোখের সামনে দিয়ে দূর হতে দূরে ছোট্ট হয়ে গেল। একসময়ে কয়েদি। এবং ঠিক এই সময়ে একটা অত্যন্ত বিচিত্র, অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত জিনিস দেখা গেল। পশ্চাদ্ধাবন নিষ্ফল জেনে পাথর থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম বাড়ি ফিরব বলে। চাঁদ ঝুলে রয়েছে ডান দিকে, খোঁচা খোঁচা গ্রানাইট পাহাড়ের একটা এবড়োখেবড়ে চুড়ো রয়েছে। রুপোলি চাকতির তলার দিকে। উজ্জ্বল পটভূমিকায় আবলুস কাঠে তৈরি মূর্তির মতো মিশমিশে কালো একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের চূড়ায়। হোমস, চোখের ভ্রম ভেবো না। বিশ্বাস করো, জীবনে এর চাইতে স্পষ্ট কিছু দেখিনি। যদূর মনে হল, মুর্তিটা একজন দীর্ঘকায়, ছিপছিপে পুরুষ মানুষের। দু-পা ঈষৎ ফাঁক, বুকের ওপর দু-হাত ভঁজ করা, মাথা হেঁট। সামনের দিগন্ত বিস্তৃত জলাভূমির পচা উদ্ভিজ পদার্থ আর গ্র্যানাইট রাশি নিয়ে ভাবছে যেন গুম হয়ে। ভয়াল ভয়ংকর এই অঞ্চলের অশরীরী আত্মা যেন সে স্বয়ং। না কয়েদি সে নয়। পলাতক অদৃশ্য হয়েছে যেখানে, এ-লোকটা দাঁড়িয়ে সেখান থেকে অনেক দূরে। তা ছাড়া, এ-লোক অনেক বেশি ঢ্যাঙা। সবিস্ময়ে চিৎকার করে আঙুল তুলে ব্যারনেটকে দেখালাম স্ট্যাচুমুর্তি–কিন্তু ওঁর হাত খামচে ধরতে গিয়ে যেটুকু সময় লাগল তার মধ্যেই নিমেষ মধ্যে অন্তর্হিত হল সে। চাদের তলার দিকে গ্রানাইটের ধারালো চূড়া যেন কেটে বসেছে, কিন্তু শীর্ষদেশে দণ্ডায়মান সেই নিস্পন্দ, নীরব মূর্তিটি কেবল নেই।

    আমার ইচ্ছে ছিল ওদিকে গিয়ে পাহাড়টা খুঁজে আসি, কিন্তু দেখলাম বেশ খানিকটা যেতে হবে। অপার্থিব সেই ডাক শুনে ব্যারনেটের স্নায়ু তখনও কাঁপছে। বাস্কারভিল বংশের করাল অভিশাপ কাহিনি অণুতে পরমাণুতে বিভীষিকা জাগিয়েছে, নতুন অ্যাডভেঞ্চারের অভিলাষ খুব একটা দেখলাম না। পাহাড়চূড়ার নিঃসঙ্গ মূর্তি উনি দেখেননি। দেখেননি বলেই উপলব্ধি করতে পারছেন না। লোকটার বিচিত্র উপস্থিতি এবং কর্তৃত্বময় ভঙ্গিমা কী ধরনের রোমাঞ্চ জাগিয়েছে আমার প্রতিটি লোমকুপে। বললেন, নিশ্চয় কোনো ওয়ার্ডার। কয়েদিটা পালানোর পর থেকে জলা ছেয়ে ফেলেছে এরা। হয়তো উনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু আরও প্রমাণ পেলে আমি খুশি হব। আজ প্রিন্সটাউন কর্তাদের চিঠি লিখব ভাবছি। কোথায় খুঁজলে পলাতককে পাওয়া যাবে, জানিয়ে দেব। কিন্তু আমাদের পাথরচাপা কপাল, হাতের মুঠোয় পেয়েও তাকে ধরে আনতে পারলাম না বিজয়তিলক থেকে বঞ্চিত হলাম। এই হল গিয়ে আমাদের গত রাতের অ্যাডভেঞ্চার বৃত্তান্ত ভায়া হোমস। রিপোর্টের মতো রিপোর্ট আজ দিতে পেরেছি–নিশ্চয় তা মানবে। অনেক কথাই তোমার কাছে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু আমি দরকারি অদরকারি সব ঘটনাই বিবৃত করলাম, যাতে তুমি নিজের বিচারবুদ্ধি খাঁটিয়ে উচিত সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারো। সত্যিই অনেকটা এগোতে পেরেছি। ব্যারিমুরদের রহস্য অনেকাংশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে, কেননা ওদের মোটিভ জানা গেছে। কিন্তু বিচিত্র বাসিন্দা এবং বিবিধ রহস্য সমেত জলা এখনও দুয়েই রয়ে গেল। পরের বারে হয়তো এ-ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আলোক নিক্ষেপ করতে পারব। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি তুমি নিজেই চলে আসো।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন
    Next Article When the World Screamed – Arthur Conan Doyle

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }