Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প813 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৫. স্মৃতিমন্থন

    নভেম্বরের শেষ। আর্দ্র; কুয়াশাচ্ছন্ন রাত। বেকার স্ট্রিটের বসবার ঘরে জ্বলন্ত চুল্লির দু-পাশে বসে আমি আর হোমস। ডেভনশায়ের চূড়ান্ত শোচনীয় পরিণতির পর দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেস নিয়ে ব্যস্ত ছিল হোমস। প্রথম কেসে ননপ্যারিউ ক্লাবের বিখ্যাত তাস কেলেঙ্কারির ব্যাপারে কর্নেল আপউডের বর্বরোচিত আচরণ ও ফঁস করে দেয়। দ্বিতীয় কেসে খুনের দায় থেকে বাঁচিয়ে দেয় হতভাগিনী ম্যাডাম পেসিয়ারকে। সৎ-মেয়ে ক্যারারকে নাকি তিনি খুন করেছিলেন বলে রটনা হয়েছিল। সবাই জানেন, ছমাস পরে তরুণী সৎ-কন্যাকে জীবন্ত এবং বিবাহিতা অবস্থায় দেখা গিয়েছিল নিউইয়র্কে। পর-পর কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেসে সাফল্য লাভ করায় বন্ধুবর খোশমেজাজে রয়েছে দেখে বাস্কারভিল রহস্যের আলোচনার জন্যে একটু উসকে দিলাম। আমি তো চিনি ওঁকে। একটা কেসকে কখনোই আর একটা কেসের ঘাড়ে চাপতে দেবে না। যুক্তিনিষ্ঠ পরিষ্কার মনকে কখনোই অতীত কেসের স্মৃতি দিয়ে ঘুলিয়ে দেবে না বর্তমান কেস থেকে মনকে সরতে দেবে না। তাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছি এতদিন। স্যার হেনরি আর ডক্টর মর্টিমার এখন লন্ডনে আছেন। স্যার হেনরির বিধ্বস্ত স্নায়ুকে চাঙ্গা করে তোলার জন্যে দীর্ঘ পর্যটনের সুপারিশ অনুযায়ী লন্ডনে এসেছেন দু-জনে এখান থেকে শুরু হবে বিশ্বপর্যটন। ওই দিনই বিকেলে দেখা করে গেছেন ওঁরা আমাদের সঙ্গে তাই এ-প্রসঙ্গে আলোচনা এখন খুবই স্বাভাবিক।

    হোমস বলল, স্টেপলটন নামে যিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন। গোড়া থেকেই তিনি সব কিছুই অত্যন্ত সোজাসুজি সরাসরি করে গেছেন। কিন্তু প্রথম দিকে আমরা তার উদ্দেশ্য ধরতে পারিনি, ঘটনাগুলোও আংশিকভাবে জেনেছিলাম–ফলে আমাদের কাছে সব ব্যাপারটাই দারুণ জটিল মনে হয়েছে। মিসেস স্টেপলটনের সঙ্গে দু-বার কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছিল। পুরো কেসটা তারপর থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে এর মধ্যে আর কোনো গুপ্তরহস্য আছে বলে মনে হয় না আমার। এ-ব্যাপারে কিছু ঘটনা আমি টুকে রেখেছি আমার তদন্ত-তালিকার B শীর্ষক সূচীপত্রে।

    ঘটনাগুলো পরপর কীরকম ঘটেছিল মন থেকে যদি একটু বল তো ভালো হয়।

    নিশ্চয় বলব, তবে সব ঘটনা মনে রাখতে পেরেছি, এমন গ্যারান্টি দিতে পারব না। অত্যন্ত নিবিড় মনঃসংযোগের ফলে অতীত ঘটনা অদ্ভুতভাবে মুছে যায় মন থেকে। নখদর্পণে সব ঘটনা রেখে যে-ব্যারিস্টার নিজ বিষয়ে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করে যেতে পারেন, দু-এক হপ্তা কোর্টে যাওয়ার পর দেখা যায় বেমালুম সেসব ভুলে গিয়েছেন। ঠিক সেইভাবে আমার মাথার মধ্যেও একটা কেস আর একটা কেসকে হটিয়ে দেয়। বাস্কারভিল রহস্যের স্মৃতিও ফিকে হয়ে এসেছে কুমারী ক্যারারের আবির্ভাবে। আগামীকাল হয়তো ছোটোখাটো নতুন সমস্যার আবির্ভাবে মানসপট থেকে হটে যেতে বাধ্য হবে সুন্দরী ফরাসি মহিলা এবং কুখ্যাত আপউড। হাউন্ড কেসের ব্যাপারে যা-যা ঘটেছিল বলবার চেষ্টা করব বটে, কিন্তু যদি দেখো কিছু ভুলে গেছি, ধরিয়ে দিয়ো।

    আমার তদন্তের ফলে প্রশ্নাতীতভাবে একটা সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল–পারিবারিক প্রতিকৃতি কখনো মিথ্যে বলতে পারে না। লোকটা সত্যিই নিজেই একজন বাস্কারভিল। স্যার চার্লসের ছোটো ভাই রোজার বাস্কারভিল কুখ্যাতি মাথায় নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় পালিয়েছিলেন। শোনা যায় অবিবাহিত অবস্থায় সেখানে তিনি মারা যান। আসলে তিনি বিয়ে করেছিলেন, একটি ছেলেও হয়েছিল। এই লোকটি সেই ছেলে–আসল নামটা বাপের নামে। কোস্টা রিকা-র ডাকসাইটে সুন্দরী বেরিল গারসিয়াকে ইনি বিয়ে করেন এবং বেশ কিছু ধন-অর্থ আত্মসাৎ করে নাম পালটে ভ্যানডেলর হন। তারপর পালিয়ে যান ইংলন্ডে। ইয়র্কশায়ারের পূর্বে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বিশেষ ধরনের এই ব্যবসা পত্তনের একটা কারণ ছিল। দেশে ফেরার পথে একজন ক্ষয়রোগী শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ হয়। এর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে স্কুল ব্যাবসা দাঁড় করিয়ে ফেলেন। ফ্রেজার, মানে, ক্ষয়রোগী সেই শিক্ষক মারা যাওয়ার পর আস্তে আস্তে সুনাম হারিয়ে দুর্নামের পাঁকে ডুবে কুখ্যাতি অর্জন করে বসল স্কুল। ভ্যানডেলর দম্পতি দেখল আবার নাম পালটানোর দরকার হয়েছে। কাজেই ভ্যানডেলর হয়ে গেল স্টেপলটন। স্কুলের সম্পদ পকেটস্থ করে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে এলেন দক্ষিণ ইংলন্ডে সঙ্গে এল কীটবিদ্যার শখ। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এ-বিদ্যার তিনি একজন স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। ইয়র্কশায়ারে থাকার সময় বিশেষ একটা মথ পোকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়ার জন্যে পাকাপোক্তভাবে ভ্যানডেলর নামকরণ হয়েছে পোকাটার।

    তার জীবনের যে-অংশে আমাদের তীব্র কৌতূহল, এবার সেই জীবন নিয়ে কথা বলা যাক। তিনি যে যথেষ্ট খোঁজখবর নিয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, মূল্যবান একটা জমিদারির মালিক হওয়ার অন্তরায় মাত্র দু-টি জীবন। ডেভনশায়ারে গিয়ে যখন উঠলেন, তখন নিশ্চয় খুবই আবছা অবস্থায় ছিল পরিকল্পনাটা। তবে গোড়া থেকেই যে নষ্টামির প্ল্যান করেছেন, তার প্রমাণ স্ত্রীকে কাজে লাগানোর মতলবটা মাথায় ঘুর ঘুর করেছে তখন থেকেই। কিন্তু চক্রান্ত কীভাবে সাজাবেন, তখনও তা স্পষ্ট করে ভেবে উঠতে পারেননি। সব শেষে জমিদারিটা যেন হাতে আসে–এই তঁার চরম লক্ষ্য। এবং এ-লক্ষ্যে পৌঁছতে যেকোনো ঝুঁকি নিতে বা যেকোনো ব্যক্তিকে যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে তিনি পেছপা ছিলেন না। এজন্যে প্রথমেই দুটি কাজ করতে হল তাঁকে। একটি হল পূর্বপুরুষদের ভিটের যথাসম্ভব কাছে আস্তানা গেড়ে বসা। দ্বিতীয়টি স্যার চার্লস বাস্কারভিল এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি।

    ফ্যামিলি হাউন্ডের গল্প ব্যারনেট নিজেই শোনালেন স্টেপলটনকে এবং নিজের মৃত্যুর পথ পরিষ্কার করলেন। স্টেপলটন–এখনও এই নামেই ডাকব এঁকে–জানতেন বৃদ্ধের হার্টের অবস্থা সঙিন। আচমকা মানসিক ধাক্কায় মারাই যাবেন। এ-খবরটা জোগাড় করেছিলেন ডক্টর মর্টিমারের কাছ থেকে। এটাও শুনেছিলেন, যে স্যার চার্লস কুসংস্কারে বিশ্বাসী এবং ভয়ানক কিংবদন্তিটা গভীর দাগ কেটেছে তাঁর মনে। উর্বর মস্তিষ্কে সঙ্গেসঙ্গে গজিয়ে উঠল হত্যার পরিকল্পনা। এমনই অভিনব পরিকল্পনা যে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না–ব্যারনেট মরবেন, কিন্তু আসল খুনিকে কেউ ভুলেও সন্দেহ করতে পারবে না।

    পরিকল্পনা স্থির হয়ে যাওয়ার পর অত্যন্ত সুচারুভাবে তা সম্পন্ন করতে উদ্যোগী হলেন স্টেপলটন। সাধারণ চক্রী একটা হিংস্র হাউন্ড লেলিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হত। ইনি কিন্তু কৃত্রিম পন্থায় জানোয়ারটাকে পৈশাচিক করে তুলেছেন এবং প্রতিভার চমক দেখিয়েছেন। লন্ডনের ফুলহ্যাম রোডে রস অ্যান্ড ম্যাঙ্গল-এর দোকান থেকে কুকুরটাকে কিনে নিয়ে যান উনি। এর চাইতে হিংস্র আর শক্তিমান কুকুর ওদের কাছে আর ছিল না। নর্থ ডেভন লাইনে উনি কুকুর নিয়ে যান এবং বাদার ওপর দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে বাড়ি পৌঁছেন–ফলে কোনোরকম উত্তেজিত মন্তব্য শোনা যায়নি। পোকামাকড়ের খোঁজে বেরিয়ে গ্রিমপেন পঙ্কভূমির মাঝ দিয়ে যাওয়ার পথ উনি আগেই বার করে ফিলেছিলেন–প্রাণীটাকে নিরাপদে লুকিয়ে রাখার মতো জায়গার অভাবও তাই ঘটল না। নিরালা দুর্গম সেই দ্বীপে কুকুরশালা বানিয়ে ওত পেতে রইলেন সুযোগের প্রতীক্ষায়।

    কিন্তু বেশ সময় লাগল। কোনো প্রলোভনেই রাত্রে বাড়ির বাইরে বার করা গেল না বৃদ্ধকে। বেশ কয়েকবার হাউন্ড নিয়ে চারপাশে টহল দিলেন স্টেপলটন, কিন্তু কাজ হল না।এহেন নিফল অন্বেষণের সময়ে তঁাকে, তার চাইতে বরং বলা যাক তার স্যাঙাতটাকে, কয়েকজন চাষা দেখে ফেলে। দানব কুকুরের কিংবদন্তি যে তাহলে নিছক অলীক নয়, এরপর থেকেই তা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। উনি আশা করেছিলেন, স্ত্রীকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে স্যার চার্লসকে মৃত্যুর মুখে টেনে নিয়ে আসবে। কিন্তু প্রত্যাশিতভাবে এই একটি ব্যাপারে বেঁকে বসলেন গৃহিণী–নিজের মতে শক্ত রইলেন। ভাবাবেগে জড়িয়ে একজন বৃদ্ধকে শত্রুর জালে টেনে আনতে তিনি নারাজ। ভয় দেখিয়ে এমনকী চড়চাপড় ঘুসি মেরেও টলানো গেল না ভদ্রমহিলাকে। এ-ব্যাপারে কোনো সাহায্যই তিনি করবেন না। সাময়িকভাবে অচলাবস্থায় পড়লেন স্টেপলটন।

    সুরাহা পাওয়া গেল স্যার চার্লসেরই দেওয়া সুযোগের মধ্যে থেকে। হতভাগিনী মিসেস লরা লায়ন্সের ক্ষেত্রে স্টেপলটনের হাত দিয়েই দান-ধ্যান করতেন স্যার চার্লস। বৃদ্ধের সঙ্গে খুবই বন্ধুত্ব জমিয়ে নিয়েছিলেন স্টেপলটন। মিসেস লায়ন্সের কাছে নিজেকে অবিবাহিত হিসেবে হাজির করেছিলেন। কথা দিয়েছিলেন যদি স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন, তাহলে তাকে বিয়ে করবেন। মিসেস লায়ন্সকে এইভাবেই একেবারে মুঠোর মধ্যে এনে ফেলেন স্টেপলটন। চক্রান্ত হঠাৎ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোল যখন শুনলেন ডক্টর মর্টিমারের এহেন পরামর্শ অনুযায়ী বাস্কারভিল হল ছেড়ে যাচ্ছেন স্যার চার্লস। ডক্টর মর্টিমারের এহেন পরামর্শে সায় দেওয়ার ভান করে গেলেন স্টেপলটন। আর দেরি করা যায় না, শিকার নাগালের বাইরে চলে যেতে বসেছে–যা করবার এখুনি করতে হবে। তাই চাপ দিয়ে মিসেস লায়ন্সকে দিয়ে একখানা চিঠি লেখালেন স্যার চার্লসকে লন্ডন যাওয়ার আগের রাতে দেখা করার প্রার্থনা জানালেন কাকুতি-মিনতি করে। তারপর অবশ্য যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে ভদ্রমহিলার যাওয়া বন্ধ করলেন। বলাবাহুল্য যুক্তিটা সংগত মনে হলেও সত্য নয়। যাই হোক, এতদিন যে-সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলেন, এবার তা পাওয়া গেল।

    ঠিক সময়ের আগেই গাড়ি নিয়ে চলে এলেন কুমবে ট্রেসি থেকে, হাউন্ডের ডেরায় পৌছোলেন, গায়ে সেই নারকীয় রং লাগালেন। হাঁটিয়ে নিয়ে এসে ফটকের অদূরে দাঁড়ালেন। এই গেটেই পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা বৃদ্ধ স্যার চার্লসের। প্রভুর উসকানি পেয়ে প্রচণ্ড খেপে গিয়ে এক লাফে খাটো গেট পেরিয়ে এল কুকুরটা এবং তাড়া করল ভাগ্যহীন ব্যারনেটকে– উনি তখন আর্ত চিৎকার করতে করতে দৌড়োচ্ছেন ইউ-বীথি বরাবর। ওইরকম একটা বিষাদাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গপথে লকলকে আগুন ঘেরা চোয়াল আর জ্বলন্ত চোখ নিয়ে অতিকায় কালো একটা প্রাণী যদি লম্বা লম্বা লাফ মেরে পেছনে তেড়ে আসে তাহলে ভয় পাবারই কথা। ভয়াবহ দৃশ্য সন্দেহ নেই। হৃদরোগ আর আতঙ্কের দরুন বেশিদূর যেতে হল না স্যার চার্লসকে, ইউ-বীথির প্রান্তে প্রাণ হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন। উনি দৌড়েছিলেন রাস্তা বরাবর, হাউন্ড দৌড়েছিল ঘাসের পটি বরাবর। তাই স্যার চার্লসের পায়ের ছাপ ছাড়া আর কোনো পায়ের ছাপ দেখা যায়নি। শিকারকে চুপচাপ পড়ে থাকতে দেখে সম্ভবত ওকে দেখার জন্যে কাছে গিয়েছিল প্রাণীটা, কিন্তু মারা গিয়েছেন দেখে ফের ফিরে যায়। এই সময়ে মাটিতে তার থাবার ছাপ পড়ে–ডক্টর মর্টিমার স্বচক্ষে তা দেখেন। স্টেপলটন ডেকে নিলেন হাউন্ডকে, নিয়ে গেলেন গ্রিমপেন পঙ্কভূমির আস্তানায়। আশ্চর্য এই রহস্যের কিনারা করতে না-পেরে মাথা ঘুরে গেল কর্তাদের, ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল স্থানীয় বাসিন্দাদের। শেষ পর্যন্ত কেসটা এসে পৌছোল আমাদের তদন্তের আওতায়।

    এই হল গিয়ে স্যার চার্লস বাস্কারভিলের মৃত্যুর বিবরণ। শয়তানি সেয়ানাপনাটা নিশ্চয় লক্ষ করেছ। আসল খুনির বিরুদ্ধে কেস দাঁড় করানো সত্যিই অসম্ভব। দোসর ওঁর একজনই–যে কখনোই ওঁকে ধরিয়ে দেবে না। পদ্ধতিটা কিম্ভুতকিমাকার আর অকল্পনীয় বলেই বেশি কার্যকর। এ-কেসে জড়িত দু-জন মহিলাই তীব্র সন্দেহ করে এসেছেন স্টেপলটনকে। মিসেস স্টেপলটনই জানতেন বৃদ্ধকে ঘিরে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে স্বামীরত্নহাউন্ডের অস্তিত্বও তিনি জানতেন। মিসেস লায়ন্স এসব কিছুই জানতেন না বটে, কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল হওয়ার পরে ঠিক ওই সময়ে স্যার চার্লসের অস্বাভাবিক মৃত্যু তাঁর মনে সন্দেহের উদ্রেক করে অ্যাপয়েন্টমেন্টের খবর স্টেপলটন ছাড়া আর কেউ জানতেন না। কিন্তু দুই মহিলাকে একেবারে কবজা করে রেখেছিলেন স্টেপলটন দু-জনের কারোর দিক থেকেই আশঙ্কার কারণ ছিল না। ষড়যন্ত্রের প্রথম পর্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে এখন বাকি আরও কঠিন পর্বটুকু।।

    এমনও হতে পারে কানাডায় একজন উত্তরাধিকারী রয়ে গেছেন, স্টেপলটন তা জানতেন না।–জানলেও খবরটা অচিরেই তিনি জেনে গেলেন ডক্টর মর্টিমারের মুখে—স্যার হেনরি বাস্কারভিল কবে কখন আসছেন, সে-খবরও সংগ্রহ করলেন ডাক্তার বন্ধুর কাছ থেকে। স্টেপলটনের প্রথম মতলব ছিল কানাডা-প্রত্যাগত এই তরুণ আগন্তুককে লন্ডনেই খতম করে দেওয়া–ডেভনশায়ারে পা দেওয়ার আগেই। স্যার চার্লসকে ফাঁদে ফেলতে চায়নি বলে স্ত্রীকে আর বিশ্বাস করতেন না। বেশিদিন চোখের আড়ালেও রাখতে ভরসা পেতেন না–পাছে কবজির বাইরে চলে যায় এই কারণে স্ত্রীকে নিয়ে এলেন লন্ডনে। খবর নিয়ে জেনেছি ওঁরা উঠেছিলেন ক্র্যাভেন স্ট্রিটের মেক্সবরো প্রাইভেট হোটেলে। আমার চর কিন্তু এ-হোটেলেও খোঁজ নিয়েছিল। হোটেলের একটা ঘরে স্ত্রীকে আটকে রেখে নিজে গালে দাড়ি লাগিয়ে ছদ্মবেশ ধরে ডক্টর মর্টিমারকে অনুসরণ করে বেকার স্ট্রিট পর্যন্ত গিয়েছিলেন, পরে স্টেশনে গিয়েছিলেন, তারপর নর্দামবারল্যান্ড হোটেলে গিয়েছিলেন। স্বামীর বদমতলবের কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন স্ত্রী। কিন্তু যমের মতো ভয় পেতেন তাকে ভয়টা পাশবিক উৎপীড়নের। সেই ভয়েই বিপদাপন্ন মানুষটিকে চিঠি লিখেও হুঁশিয়ার করতে সাহসে কুলোয়নি। চিঠি যদি স্টেপলটনের হাতে পড়ে, তাহলে ওঁর নিজের প্রাণ নিয়েই টানাটানি পড়তে পারে। শেষ পর্যন্ত আমরা জানি কীভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে খবরের কাগজ থেকে শব্দ কেটে নিয়ে পত্ররচনা করেছিলেন এবং হস্তাক্ষর গোপন করে ঠিকানাটা লিখেছিলেন! চিঠি পৌঁছোয় ব্যারনেটের হাতে এবং আসন্ন বিপদের প্রথম সতর্কবাণী তিনি পান।

    স্টেপলটন দেখলেন, স্যার হেনরির ব্যবহার করা ধড়াচূড়ার কোনো একটা বস্তু না-জোগাড় করলেই নয়। শেষ পর্যন্ত যদি কুকুরটাকেই ব্যবহার করতে হয়, গন্ধ শুকিয়ে পেছনে লেলিয়ে দেওয়ার জন্যে চাই এমন একটা জিনিস। ক্ষিপ্রতা আর স্পর্ধা ওঁর চরিত্রে দুটো বড়ো বৈশিষ্ট্য। ফলে কাজ আরম্ভ করে দিলেন তৎক্ষণাৎ। হোটেলের জুতো পরিষ্কার করে যে-ছোকরা অথবা বিছানা পেতে দেয় যে ঝি-টি–এদের কাউকে মোটা ঘুস দিয়ে নিশ্চয় কাজ উদ্ধার করেন স্টেপলটন। কপালক্রমে প্রথমে যে-বুটটা পেলেন, তা আনকোরা নতুন কাজে লাগবে না। তাই নতুন বুট ফেরত দিয়ে তার বদলে জোগাড় করলেন পুরোনো বুট। ঘটনাটা চোখ খুলে দিল আমার। স্পষ্ট বুঝলাম, আসল হাউন্ডের সঙ্গেই লড়তে হবে আমাদের। নতুন বুটের প্রতি এত ঔদাসীন্য এবং পুরোনো বুটের জন্যে উদবেগের এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা হয় না। ঘটনা যত বিচিত্র আর কিম্ভুতকিমাকার হবে, ততই জানবে তা সাবধানে পরীক্ষা করা দরকার। যে-বিষয়টা সবচেয়ে জট পাকাচ্ছে বলে মনে হবে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে তা ঠিকমতো বিচার করলে দেখবে জট-ছাড়ানোর পক্ষে সেটাই সবচেয়ে মোক্ষম বিষয়।

    পরের দিন সকালে বন্ধুরা এলেন আমাদের এখানে পেছন পেছন ছায়ার মতো কিন্তু গাড়ি নিয়ে লেগে রয়েছেন স্টেপলটন। আমাদের এই বাড়ির হদিশ তিনি জানেন, আমাকে দেখলেই তিনি চিনতে পারেন এবং তার নিজের কাজকর্মও সুবিধের নয়–এই তিনটে বিষয় থেকে অনায়াসেই ধরে নিতে পারি বাস্কারভিল হলের অপরাধটাই তাঁর অপরাধ জীবনের একমাত্র কুকীতি নয়। ইঙ্গিতপূর্ণ কতকগুলি ঘটনা বলছি শোনো। গত তিন বছরে পশ্চিম ইংলন্ডে চারটে বড়ো রকমের চুরির কোনো কিনারা আজও হয়নি। গভীর রাতে বাড়িতে ঢুকে সর্বস্ব নিয়ে পালিয়েছে চোর। চোর ধরা পড়েনি। শেষ চুরিটা ঘটে মে মাসে ফোকস্টোন কোর্টে। ঘটনাটা চাঞ্চল্যকর আরও একটা কারণে। ছোকরা চাকর হঠাৎ ঢুকে পড়ে চমকে দিয়েছিল চোরকে। চোর একবার এসেছিল, মুখে মুখোশ ছিল। খুব ঠান্ডা মাথায় ছোকরাকে গুলি করেছিল চোর। আমার বিশ্বাস সঞ্চিত ধন যখনই ফুরিয়ে এসেছে, এইভাবেই তা নতুন করে পূরণ করে নিয়েছেন স্টেপলটন। বহু বছর ধরেই উনি বিপজ্জনক এবং বেপরোয়া।

    আমাদের হাত ফসকে যেদিন পালালেন, সেদিনই ওঁর আশ্চর্য উপস্থিত বুদ্ধির নমুনা আমরা দেখেছি। ধৃষ্টতা যে কতখানি, সে-প্রমাণও পেয়েছি গাড়োয়ানের মারফত আমারই নাম আমার কাছে পাঠানোর ব্যাপারে। সেই মুহূর্ত থেকেই উনি বুঝেছিলেন, লন্ডনে কেসটা গ্রহণ করেছি আমি। কাজেই এখানে আর সুবিধে হবে না তাই ডার্টমুরে ফিরে গিয়ে ওত পেতে রইলেন ব্যারনেটের জন্যে।

    এক মিনিট! বললাম আমি। পর পর বললে ঠিকই, একটা বিষয় কিন্তু খোলসা করলে না। মনিব যখন লন্ডনে, হাউন্ডকে তখন কে দেখত?

    এ-ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করেছি আমি। সত্যিই বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্টেপলটনের যে একজন দোসর ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু পুরো বিশ্বাস করেনি তাকে। ষড়যন্ত্রে আদ্যোপান্ত বললে পাছে তার খপ্পরে পড়তে হয়, তাই সব কথা বলেননি। মেরিপিট হাউসে একজন বৃদ্ধ ভৃত্য ছিল। নাম তার অ্যান্টনি। লোকটার সঙ্গে স্টেপলটনদের সম্পর্ক অনেক দিনের – স্কুলজীবন পর্যন্ত খোঁজ নিয়ে জেনেছি অ্যান্টনি তখনও ওঁদের সঙ্গে ছিল। তার মানে, মনিব আর মনিবানি যে আসল স্বামী স্ত্রী অ্যান্টনি তা জানত। লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেছে–দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। নামটা কিন্তু লক্ষ করার মত। অ্যান্টনি নাম ইংলন্ডে সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু স্পেন বা স্পেনীয় অ্যামেরিকান অঞ্চলে অ্যানটোনিও নামটা আকছার শোনা যায়। মিসেস স্টেপলটনের মতো সে-ও দিব্যি ইংরেজি বলত–কিন্তু অদ্ভুত রকমের আধো-আধো উচ্চারণে। গ্ৰিমপেন পঙ্কভূমির মাঝখান দিয়ে যে-রাস্তায় চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলেন স্টেপলটন, নিজের চোখে দেখেছি, সেই রাস্তা দিয়ে ভেতরে যাচ্ছে এই বুড়ো? মনিবের অনুপস্থিতিতে খুব সম্ভব সে-ই হাউন্ডের তত্ত্বাবধান করেছে। যদিও জানত না কী কাজে লাগানো হয় জানোয়ারটাকে।

    স্টেপলটন ডেভনশায়ার ফিরে গেল, স্যার হেনরিকে নিয়ে তুমি পৌছোলে তার পরেই। সেই সময়ে আমি কী করছিলাম এবার বলা যাক। তোমার মনে থাকতে পারে, ছাপা শব্দ সাঁটা চিঠির কাগজের জলছাপ খুঁটিয়ে দেখবার জন্যে কাগজখানা আমি চোখের ইঞ্চিকয়েক দূরে এনেছিলাম। সেই সময়ে নাকে একটা হালকা সুগন্ধ ভেসে আসে। গন্ধটা জুইয়ের। পঁচাত্তর রকম সেন্ট আছে বাজারে। প্রত্যেকটা গন্ধ আলাদাভাবে চেনার ক্ষমতা থাকা চাই অপরাধ-বিশেষজ্ঞের। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, গন্ধ শুকেই সেন্টের নাম চট করে বলে দেওয়ার ওপর বহু জটিল কেসের আশু সমাধান নির্ভর করেছে। এই ক্ষেত্রেও সেন্টের গন্ধ শুকেই বুঝতে পারলাম, কেসটায় একজন মহিলাও জড়িয়ে আছেন। তখন থেকেই আমার চিন্তা ধেয়ে গেল স্টেপলটনদের দিকে। হাউন্ড সম্বন্ধে এইভাবেই নিশ্চিন্ত হলাম এবং পশ্চিম ইংলন্ডে যাওয়ার আগেই অনুমান করে নিলাম অপরাধী আসলে কে!

    এবার শুরু হল আমার খেলা–স্টেপলটনকে নজরবন্দি রাখার খেলা। বুঝতেই পারছ, তোমার সঙ্গে থাকলে এ-কাজ আমি করতে পারতাম না। বেশি সাবধান হয়ে যেতেন স্টেপলটন। তাই সবাইকে ঠকালাম, তোমাকেও বাদ দিলাম না। যখন আমার লন্ডনে থাকার কথা, তখন গোপনে চলে এলাম অকুস্থলে। তুমি যতটা ভেবেছ, ততটা ধকল সইতে হয়নি আমায়। তদন্তে নেমে এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালে তদন্ত করা যায় না। বেশির ভাগ সময় কুমবে ট্রেসিতে থাকতাম। কুকীর্তি যেখানে অনুষ্ঠিত হবে, সেই জায়গাটা দেখবার দরকার হলে কুটিরে চলে আসতাম। কার্টরাইট এসেছিল আমার সঙ্গে। গাঁইয়া ছোকরার ছদ্মবেশে অনেক সাহায্য করেছিল। খাবার আর পরিষ্কার পোশাকের জন্যে ওর ওপর নির্ভর করতে হত আমায়। আমি যখন স্টেপলটনকে নজরে রাখতাম, কার্টরাইট তখন প্রায়ই তোমাকৈ নজরে রাখত। এইভাবেই হাতের মুঠোয় রেখেছিলাম সবক-টা সুতো।

    আগেই বলেছি, তোমার সব রিপোর্টই খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেত আমার কাছে। বেকার স্ট্রিট থেকে তৎক্ষণাৎ ফিরিয়ে দেওয়া হত কুমবে ট্রেসিতে। খুব কাজে লেগেছিল রিপোর্টগুলো–বিশেষ করে পাঁচ কথার মধ্যে স্টেপলটনের খাঁটি আত্মজীবনী খানিকটা লিখে ফেলে ভালো করেছিলে। ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাকে শনাক্ত করে ফেললাম সহজেই এবং বুঝলাম কতটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে কেস। পলাতক কয়েদি আর ব্যারিমুর দম্পতির সঙ্গে তার আত্মীয়তার ব্যাপারে বেশ জটিল হয়ে উঠেছিল কেসটা। খুব চমৎকারভাবে এ-জট তুমি ছাড়িয়েছিলে, যদিও একই সিদ্ধান্তে তোমার আগেই পৌছেছিলাম স্বচক্ষে সব দেখার পর।।

    জলার কুটিরে আমাকে যখন ধরে ফেললে, তখন কেসটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে আমার কাছে। কিন্তু জুরিদের সামনে নিয়ে হাজির হওয়ার মতো নিটোল অবস্থায় তখনও কেস পৌছোয়নি। সেই রাত্রে স্যার হেনরিকে মারতে গিয়ে ভুল করে কয়েদি বেচারার মৃত্যু ঘটানোর পরেও খুনের দায়ে স্টেপলটনকে ধরা সম্ভব হল না–প্রমাণ কই? হাতেনাতে ওঁকে ধরা ছাড়া আর পথ দেখলাম না। স্যার হেনরিকে একলা ছেড়ে দিয়ে টোপ ফেলতে হল। অরক্ষিত মনে করানো হল বটে, কিন্তু আমরা রইলাম আড়ালে। হাতেনাতে ধরলাম ঠিকই, কিন্তু মূল্য দিতে হল অনেক। সাংঘাতিক মানসিক আঘাত পেলেন আমাদের মক্কেল। নিপাত গেলেন স্টেপলটন। এ-রকম একটু ঝুঁকির মধ্যে স্যার হেনরিকে ঠেলে দেওয়ার জন্যে স্বীকার করছি গঞ্জনা দেওয়া উচিত আমারই পরিচালন ব্যবস্থাকে; কিন্তু জানোয়ারটা যে ওইরকম আতঙ্ক-ধরানো দেহমন-পঙ্গু-করা প্রেতমূর্তির আকারে বেরিয়ে আসবে–এটা কিন্তু দিব্য চোখে দেখিনি। তা ছাড়া কুয়াশার দরুন আচমকা বেরিয়ে আসার ফলে যে এত কম সময় পাব–তাও আগে থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারিনি। যে-মূল্যের বিনিময়ে সফল হয়েছি, বিশেষজ্ঞ এবং ডক্টর মর্টিমার দু-জনেই বলেছেন তা সাময়িক। দীর্ঘ পর্যটনের ফলে স্যার হেনরি যে কেবল বিধ্বস্ত স্নায়ুকেই চাঙ্গা করে ফেলবেন তা নয়–আহত অনুভূতির স্মৃতি থেকেও মুক্তি পাবেন। ভদ্রমহিলাকে উনি আন্তরিকভাবে, গভীরভাবে ভালোবাসতেন। কদর্য এই কেসের ব্যাপারটা তাকে সবচেয়ে বেশি দুঃখ দিয়েছে, তা হল এই প্রতারণা। ভদ্রমহিলার এই প্রবঞ্চনা বড়ো বেশি আঘাত হেনেছে তাঁর বুকে।

    আগাগোড়া কী ভূমিকায় অভিনয় করে গিয়েছেন এই ভদ্রমহিলা, এবার তা দেখা যাক। এঁর ওপর স্টেপলটনের প্রভাব ছিল এবং তা নিয়ে সন্দেহ করার কারণ দেখি না। প্রভাবটা ভালোবাসার দরুন হতে পারে, অথবা স্বামীকে ভয় পাওয়ার দরুনও হতে পারে। অথবা দুইয়ের যোগফলের জন্যেও হতে পারে। দু-জনের আবেগের তীব্রতা যে একরকম ছিল না, তা তো ঠিক। স্বামীর হুকুমেই তাঁকে সহোদরার ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে হয়েছে। প্রভাবটা কিন্তু এক জায়গায় গিয়ে ঠেকে গেল যখন স্টেপলটন দেখলেন খুনের ব্যাপারে সরাসরি হাত মেলাতে স্ত্রী নারাজ। স্বামীকে না-ফাঁসিয়ে সাধ্যমতো স্যার হেনরিকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন ভদ্রমহিলা এবং বার বার সে-চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। স্ত্রীকে ব্যারনেট প্রেমনিবেদন করেছেন দেখে ঈর্ষায় জ্বলে গিয়ে ফেটে পড়েছিলেন স্টেপলটন স্বয়ং অথচ জিনিসটা ঘটছিল তারই পরিকল্পনা মাফিক। কিন্তু প্রচণ্ড আবেগ সামলাতে না-পেরে ফেটে পড়ার ফলে ছদ্ম সংযমের আড়ালে সুকৌশলে লুকোনো তার ভীষণ প্রকৃতি নগ্ন হয়ে উঠেছিল কিছুক্ষণের জন্যে। তারপর ঘনিষ্ঠতাকে প্রশ্রয় দিলেন স্টেপলটন যাতে ঘনঘন মেরিপিট হাউসে আসেন স্যার হেনরি। তাহলে দু-দিন আগে হোক কি পরে তোক ইচ্ছা পূরণের সুযোগ ঠিক পেয়ে যাবেন। কিন্তু মহাসংকটের সেই বিশেষ দিনটিতেই আচমকা রুখে দাঁড়ালেন স্ত্রী। কয়েদির মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, সে-খবর উনি পেয়েছিলেন সেইসঙ্গে জেনেছিলেন, স্যার হেনরি যে-রাত্রে ডিনার খেতে আসছেন, সেই রাত্রে হাউন্ডটাকে এনে রাখা হয়েছে আউট হাউসে। খুনের মতলবের দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন স্বামীকে। ফলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল দুজনের মধ্যে এবং সেই প্রথম স্ত্রীকে স্টেপলটন জানালেন প্রেমের ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। মুহূর্তের মধ্যে নিদারুণ ঘৃণায় পর্যবসিত হল অন্তরের অনুরাগ। স্টেপলটন দেখলেন স্ত্রী-ই এবার বেইমানি করবেন। তাই বেঁধে রাখলেন বউকে যাতে স্যার হেনরি এলে সাবধান করতে না-পারেন। মনে মনে এই আশাও নিশ্চয় ছিল যে ব্যারনেটের মৃত্যুর জন্যে পারিবারিক অভিশাপকেই দায়ী করবেন তল্লাটের প্রতিটি মানুষ করতও তাই–তারপর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভবিতব্যকে মেনে নিতে বাধ্য করতেন স্ত্রীকে–মুখে চাবি দিয়ে থাকতেন ভদ্রমহিলা। আমার মনে হয় এই একটি ব্যাপারে হিসেব ভুল করে ফেলেছেন স্টেপলটন। আমরা যদি নাও পৌঁছতাম, ভদ্রলোকের জাহান্নামে যাওয়া আটকানো যেত না। স্পেনীয় রক্ত বইছে যার ধমনীতে এ-ধরনের আচার এত হালকাভাবে তিনি নিতে পারেন না। আমার লেখা টীকাটিপ্পনি না-দেখে কেসটা সম্বন্ধে এর বেশি কিছু মন থেকে আর বলতে পারব না। তা ছাড়া কিছু বাদ দিয়েছি বলেও তো মনে হচ্ছে না।

    ভূতুড়ে হাউন্ড লেলিয়ে বৃদ্ধ পিতৃব্যকে ভয় দেখিয়ে মেরেছেন বলে স্যার হেনরির ক্ষেত্রেও তাই ঘটবে, এমনটা নিশ্চয় আশা করেননি?

    জানোয়ারটা একে হিংস্র, তার ওপর আধপেটা খাইয়ে রাখা হয়েছিল। ওই চেহারা দেখে ভয়ের চোটে মৃত্যু না-হলেও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তো কেড়ে নেওয়া যায়।

    তা ঠিক। আর একটা খটমট ব্যাপার। সম্পত্তির উত্তরাধিকারী যদিও না-হতেন স্টেপলটন, অন্য নামে গোপনে সম্পত্তির এত কাছে বসবাসের কী কারণ দর্শাতেন উনি? সন্দেহ বা তদন্তের সূচনা না-ঘটিয়ে সম্পত্তি দাবি করতেন কী করে?

    সমস্যাটা সাংঘাতিক। সমাধানটা জিজ্ঞেস করে খুব বেশি আশা করছ আমার কাছে। অতীত আর বর্তমানই কেবল আসে আমার তদন্তের আওতায়। কিন্তু ভবিষ্যতে কে কী করবে, তার জবাব দেওয়া বড়ো শক্ত। সমস্যাটা নিয়ে স্বামীকে অনেকবার আলোচনা করতে শুনেছেন মিসেস স্টেপলটন। তিনটে সম্ভাব্য পথ ছিল। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সম্পত্তি দাবি করতে পারতেন, সেখানকার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেকে শনাক্ত করে ইংলন্ডে না-এসেই সম্পত্তি হাতিয়ে নিতেন। অথবা, লন্ডনে যেটুকু সময় থাকা দরকার, সেটুকু সময়ের জন্যে নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণ করতেন। অথবা, কোনো দোসরকে কাগজপত্র প্রমাণের সাহায্যে নিজের উত্তরাধিকারী দাঁড় করিয়ে সম্পত্তির আয় থেকে নিজে খানিকটা অংশ রাখতেন। ওঁকে যদূর চিনেছি, তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, উপায় একটা ঠিকই বার করতেন। যাই হোক, ভায়া ওয়াটসন, বেশ কয়েক সপ্তাহ দারুণ কাজের ধকল গিয়েছে। মনোরম খাতে চিন্তাকে ঢেলে দেওয়ার জন্য একটা সন্ধ্যা ব্যয় করা উচিত বলে আমি মনে করি। লা হুগুনট-এ একটা বক্স বুক করেছি। ডা. রেসজেকস কখনো শুনেছ? আধঘণ্টার মধ্যে তাহলে তৈরি হয়ে নিতে পারবে? যাওয়ার পথে মার্সিনিতে ডিনার খেয়ে নেবখন!

    ——–

    যে-কিংবদন্তি অবলম্বনে হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিলস লিখেছিলেন কন্যান ডয়াল, তা যে নিছক কিংবদন্তি নয়–লোমহর্ষক সত্য— নীচের অনুরূপ কাহিনিটা তার প্রমাণ।

     

    ডার্টমুরের অশরীরী হাউন্ড

    ডার্টমুরের গা ছমছমে পরিবেশে অশরীরী হাউন্ডের পাল্লায় পড়েছিলেন এক ভদ্রমহিলা। প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন কোনোমতে। গল্পটা তার জবানিতেই শোনা যাক:

    ডার্টমুরের ঠিক মাঝে পচা পাক আর কাদাভরতি বিরাট অঞ্চলে কখনো কোনো আওয়াজ শোনা যায় না। চরাচর নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে দু-একটা পাখিকে উড়তে দেখা যায় মাথার ওপর। পায়ের তলায় ছলছল করে বয়ে চলে কালো জলসোত পচা আগাছা আর পাঁকের মধ্যে এঁকেবেঁকে প্রায় নিঃশব্দে বয়ে চলে জলের ধারা। মাইলের পর মাইল হেঁটে গেলেও বাতাসের সোঁ সোঁ চাপা গজরানি ছাড়া আর কিছু শুনতে পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে অবশ্য কালো জলে পা ডুবে গেলে ছপাৎ ছপাৎ আওয়াজে চমকে উঠতে হয় নিজেকেই। রোদুর থাকলে ভালোই লাগে এই শব্দহীনতা শব্দময় জগৎ থেকে যেন একটু নিষ্কৃতি পাওয়া যায় এখানে এলে। মাথার ওপর দিয়ে হু-হু করে ভেসে যায় ধূসর মেঘ কখনো গাঢ় কুয়াশা এসে ঢেকে দেয় দু-হাত দূরের দৃশ্যও। ঠিক সেই মুহূর্তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, বুকের রক্ত ছলকে ওঠে এবং ঠিক তখনই শ্বাসরোধী নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দিয়ে বায়ুবেগে শিকারের পেছনে ধাওয়া করে অশরীরী হাউন্ড। এ-অঞ্চলে এদের নাম উইজ হাউন্ড (Wish Hound)। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ওয়াইল্ড হান্ট হাউন্ড অথবা গ্যাব্রিয়েলের হাউন্ডের মতোই উইজ হাউন্ড একটা মূর্তিমান আতঙ্ক।

    উইজ হাউন্ডের জিভ নেই বলে আওয়াজ করতে পারে না। মাথাও নেই। বিরাট কালো ঘাড়ের কাছে দেখা যায় কেবল নীলচে আগুনের লকলকে শিখা! পচা আগাছা আর কাদার ওপর ভারী ভারী পা পড়লেও কোনো শব্দ শোনা যায় না।

    উইজ হাউন্ড স্রেফ একটা গল্প–এই বিশ্বাস নিয়েই চ্যাগফোর্ড থেকে হেঁটে যাচ্ছিলাম জলার ঠিক মাঝখানে ক্র্যানমিয়ার পুলের দিকে। সুন্দর দিন। চ্যাগফোর্ড মার্কেট থেকে কিছু প্যাসট্রি কিনেছি খিদে পেলে খাব বলে। এ ছাড়া সঙ্গে আছে একটা ম্যাপ আর একটা কম্পাস। সরু গলি দিয়ে গিডলি এলাম। সেখান থেকে বাদায় এসে পড়লাম। পাথুরে চত্বর দিয়ে হাঁটছি। বেশ লাগছে হাঁটতে।।

    প্রথমে গেলাম থির্লস্টোন পাহাড়ের দিকে। কালো, কর্কশ, এবড়োখেবড়ো চোখাচোখা পাথরে পাহাড়। এ-অঞ্চলে এসব পাহাড়কে টর বলা হয়। ডার্টমুর ছাড়া টর কোথাও দেখা যায় না।

    থির্লস্টোন টর কিন্তু দেখবার মতো পাহাড়। বিরাট বিরাট খিলেনগুলোর মধ্যে দিয়ে যেন হু-হু করে বয়ে গেছে আস্ত একটা সমুদ্র। ক্ষয়ে চূর্ণ হয়ে গেছে, ছুরির মতো ধারালো হয়ে গেছে কিনারাগুলো।

    থির্লস্টোন চূড়ায় উঠে লাঞ্চ খেয়ে নিলাম। দেখলাম, পূর্বদিকে মাইলের পর মাইল কেবল জঙ্গল আর তেপান্তরের মাঠ দৃষ্টির শেষ সীমায় অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে হ্যালডন হিলের মাথার ওপরকার টাওয়ার।

    থির্লস্টোন থেকে বাদার দিকে নামতে শুরু করলেই কিন্তু দিগন্তব্যাপী শূন্যতা চেপে বসে মনের মধ্যে। বড়ো একলা মনে হয় নিজেকে। যেদিকে দু-চোখ যায়, প্রাণের অস্তিত্ব কোথাও নেই–একা আমি চলেছি জনহীন জলার বুকে অজানার উদ্দেশে। পেছনে খাড়া পাহাড় কাজেই বাদার ওদিকে কী আছে আর দেখা যায় না। দুষ্কর হয়ে ওঠে নির্বিঘ্নে হাঁটা। এক ঘাসের চাপড়া থেকে আরেক ঘাসের চাপড়ায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হয়–একটু পা ফসকালেই পচা আগাছা আর কাদায় ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে জেনে দুরদুর করতে থাকে বুকের ভেতরটা।

    আকাশ এতক্ষণ মোটামুটি পরিষ্কার ছিল। থির্লস্টোন হিল আর হ্যাংগিঙস্টোন হিলের মাঝের উপত্যকা পেরোনোর সময়ে কোখেকে ছুটে এল রাশি রাশি মেঘ। ট হীড বাদা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতলবে আমি হ্যাংগিঙস্টোন হিলের দিকেই এগোচ্ছি। পশ্চিমের দামাল হাওয়ায় ভর দিয়ে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোটা আছড়ে পড়ল মুখে। তারপরেই কুয়াশায় বেশিদূর আর দেখতে পেলাম না। শুধু কুয়াশা নয়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে এল নীচু মেঘ আর বৃষ্টির ধারা–সব কিছু ঢেকে গেল সেই যবনিকার। তা সত্ত্বেও আমি এগিয়ে চললাম ক্র্যানসিয়ার আর ওয়েস্ট ওকমন্ট নদীর দিকে নদী বরাবর এগোতে পারলে পৌছে যাব বাদার উত্তর প্রান্তে সৈন্য চলাচলের রাস্তায়।

    ঠিক জানি না কখন টের পেলাম কী যেন পেছন পেছন আসছে আমার। আমি তখন কম্পাসের কাঁটা দেখে সোজা পথ চলতে ব্যস্ত। লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে হচ্ছে এক ঘাসের চাপড়া থেকে আরেক ঘাসের চাপড়ায়–তটস্থ হয়ে রয়েছি। পাছে দুর্গন্ধময় কাদায় পা বসে যায়। দিভ্রম যাতে না হয়, অন্যদিকে যেন না-চলে যাই–তাই ঘন ঘন দেখছি কম্পাসের দিকনির্দেশ। ঠিক তখনই কেন জানি মনে হল এই বিজন প্রান্তরে আমি আর একা নই–আমার পেছন পেছন কারা যেন নিঃশব্দ চরণে ছুটে আসছে। প্রথমটা অকারণ গা ছমছমানিকে পাত্তা দিইনি। কিন্তু একটু একটু করে গা শিরশির করতে লাগল, নার্ভাস হয়ে পড়লাম। পেছন ফিরে দেখলাম সত্যিই কেউ পেছন নিয়েছে কিনা। প্রথমে বাদা আর প্রান্তর ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না তাও অস্পষ্টভাবে, বৃষ্টি আর কুয়াশায় সব ঝাঁপসা হয়ে গিয়েছে। তারপরেই একটা পাথরের মতো কী যেন দেখলাম–অথচ সেখানে পাথর থাকার কথা নয়। ভাবলাম কুয়াশা আর বৃষ্টিতে ভুল দেখছি। তাই সাহসে বুক বেঁধে ফের এগিয়ে চললাম সামনে। কিছুদূর গিয়েই কিন্তু ফের বুকের মধ্যে গুর গুর করতে লাগল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল এবং ফের পেছন ফিরে তাকালাম। এবার স্পষ্ট দেখলাম তিনটে গাঢ় রঙের বস্তু পেছন পেছন আসছে এবং অনেকটা কাছে এসে গিয়েছে।

    এবার আর সন্দেহ রইল না। সত্যিই আমার পেছন পেছন আসছে কালো বস্তু তিনটে। বিচারবুদ্ধি লোপ পেল নিমেষের মধ্যে। প্রাণের ভয়ে বিষম আতঙ্কে দৌড়োতে লাগলাম আমি। পেছনের শত্রুও তো তাই চায়। তাতে ওদেরই তো সুবিধে। দৌড়ে ওদের ছাড়িয়ে যেতে আমি কখনোই পারব না–বরং ওরাই যেকোনো মুহূর্তে নাগাল ধরে ফেলবে আমার পচা কাদার ওপর দিয়ে বাতাসে ভর করেই প্রায় ছুটে আসবে অকল্পনীয় বেগে অথচ কালো কাদায় পায়ের ছাপ একদম পড়বে না। কিন্তু ওরা তো আমাকে ধরতে চায় না, আমার ক্ষতিও করতে চায় না। ওরা চায় আমি যেন ভয় পেয়ে এইভাবেই দৌড়োই, দৌড়োতে দৌড়োতে দিশেহারা হয়ে পা ফসকে বাদায় গিয়ে পড়ি, সবুজ পাঁকের গর্তে পড়ে তলিয়ে যাই–একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই। জলাভূমিতে এই ধরনের সবুজ নরম পচা পাঁকে ভরতি গর্তকে বলা হয় ফেদার-বেড। পাখির পালকের মতোই নরম মোলায়েম ডুবলে আর ওঠা যায় না কোনো চিহ্নও থাকে না।

    তাই ওরা যা চায়, আমিও প্রথমে তাই করে বসলাম। ওরা যেন আমাকে নিয়ে দেখতে লাগল। আতঙ্কে বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেল উধ্বশ্বাসে দৌড়োতে লাগলাম। বৃষ্টি আর কুয়াশার মধ্যে দিয়ে কালো বস্তুগুলো নিঃশব্দে সামনে তাড়া করে এল পেছন পেছন। কম্পাস এখন কোনো কাজে লাগছে না। বৃষ্টির ঝাঁপসা আর কুয়াশার পর্দায় চোখ চলছে না–ক্ল্যান মিয়ারের আশেপাশে খাড়া উঁচু উঁচু টর-গুলোও দেখা যাচ্ছে না। কম্পাস দেখবার জন্য মাঝে মাঝে দাঁড়ানো দরকার। কিন্তু সে-প্রশ্নই আর ওঠে না–ঝড়ের মতো ছুটছি… ছুটছি.. ছুটছি! অন্ধের মতো ধেয়ে চলেছি হাওয়ার বিপরীত দিকে। দামাল হাওয়া আছড়ে পড়ছে মুখে, ছুঁচের মতো বৃষ্টির ফলা বিধছে মুখে। হাউন্ডগুলো সমান বেগে নিঃশব্দে তাড়া করে আসছে পেছন পেছন। এখন ওরা সংখ্যায় বেড়েছে প্রায় দশ বারোটা কালো বস্তু নরকের পুঞ্জীভূত অন্ধকারের মতো অবিকল সংকল্পে আসছে তো আসছেই!

    ছুটতে ছুটতে কিন্তু ভাবছিলাম কী করা যায়। একটু একটু করে সহজ বুদ্ধি ফিরে এল মাথায়! দেখলাম পরিত্রাণের একমাত্র পথ হচ্ছে ডাইনে মোেড় নিয়ে উত্তর দিকে মিলিটারি রাস্তার দিকে ছুটে যাওয়া। একবার রাস্তায় পা দিতে পারলে নির্বিঘ্নে ফিরে যেতে পারব লোকালয়ে পেছনে মূর্তিমান পিশাচরা আমাকে বাদায় ডুবিয়ে মারতে পারবে না।

    সঙ্গেসঙ্গে ফিরলাম ডান দিকে। কিন্তু পেছনের কালান্তক হাউন্ডরা আমার মতলব বুঝেই চক্ষের নিমেষে হাজির হল একই পথে দৌড়ে চলল সামনে সামনে। আমি যেদিকে ছুটছি, পথ আটকে ওরা ছুটছে সেইদিকে। পালাবার পথ বন্ধ দেখে আমি যেন কীরকম হয়ে গেলাম। আগে যেদিকে ছুটেছিলাম আবার ছুটতে লাগলাম সেদিকে। ক্ল্যানমিয়ারে যাওয়ার ইচ্ছে বিসর্জন দিলাম। উদ্দেশ্য এখন একটাই : যেভাবেই হোক ক্রুর কুটিল মহাভয়ংকর হাউন্ডদের খপ্পর থেকে সরে যেতে হবে আমাকে–তা সে যেদিকেই হোক না কেন?

    ক্ল্যানমিয়ার আমার লক্ষ্য ছিল না ঠিকই কিন্তু আমি ছিটকে গেলাম সেইদিকে। হুড়মুড় করে গিয়ে পড়লাম একটা ঢালু গভীর গর্তের মধ্যে পুকুর নয় মাটি দেবে গিয়ে গর্তের মতো হয়ে গিয়েছে মাঝে একটা পোস্টবক্স আর তেকোনা এবড়োখেবড়ো পাথরের খাঁজে ভিজিটর্স বুক। আমার কিন্তু সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর একদম সময় নেই তখন। দম নেওয়ার জন্য দাঁড়াতে বাধ্য হলাম, হাউন্ডগুলোও দাঁড়িয়ে গেল গর্তের কিনারায় মাথা তুলে রইল বাতাসের দিকে যেন পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য নাক তুলে গন্ধ শোকবার চেষ্টা করছে।

    হাওয়া পালটে গেল ঠিক এই সময়ে। আচমকা মোড় ঘুরে গেল হাওয়ার হু-হু করে বইতে লাগল পশ্চিম থেকে উত্তরে–সঙ্গে টেনে নিয়ে গেল বাদলাকে। মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সূর্যদেব এবং রোদুর ঝিকমিকিয়ে উঠল বৃষ্টি-ধোওয়া পাথর আর পাহাড়ে। ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে গেল হাউন্ডগুলো পাহাড়ের ঢালে লেগে মেঘমালা যেভাবে গোলে মিলিয়ে যায়–অবিকল সেইভাবে।

    বিজন প্রান্তরে আবার আমি একা। আগের মতোই আবার হাঁটতে পারি যেদিকে খুশি। পায়ের কাছে বইছে শিশু স্রোতস্বিনী ওয়েস্ট ওকমেন্ট। পাড় বরাবর কিছুদূর যাওয়ার পর তা ঢলঢলে নদীর চেহারা নিল স্রোতের টান কী! এবার কম্পাসের সাহায্যে পৌছে গেলাম মিলিটারি রোডে ওকস্পটনে

    পৌছোবো এই সড়ক ধরে গেলে।

    দ্রুত সূর্য ডুবছে ইয়েস টর-এর পেছনে। ওত পেতে রয়েছে ঢেলা ঢেলা ছায়ার দল যেন যেকোনো মুহূর্তে চঞ্চল হবে, লাফিয়ে তেড়ে আসবে পেছন পেছন। সত্যিই ভয় হল আমার। হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে ঘন ঘন তাকাতে লাগলাম পেছনে। কিন্তু আমার কপাল ভালো ছায়ারা আর তেড়ে আসেনি। নির্বিঘ্নে পৌছে গেলাম ওকহাস্পটনে। তারপর প্রতিজ্ঞা করেছি ঝকঝকে রোদুরেও ডার্টমুর আর মাড়াব না।

    -ক্যাথলিন হন্ট

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন
    Next Article When the World Screamed – Arthur Conan Doyle

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }