Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প1414 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    লোমহর্ষক প্যাকেটের মর্মান্তিক কাহিনি

    শার্লক হোমসের কাহিনি নির্বাচন করতে গিয়ে একটা বিষয়ে সজাগ থেকেছি বরাবর। চাঞ্চল্যকর ঘটনা যথাসম্ভব পরিহার করেছি–এমন কীর্তিকাহিনি লিখেছি যার ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে–আমার এই আশ্চর্য বন্ধুটির অসাধারণ প্রতিভা। সবসময়ে অবশ্য তা সম্ভব হয় না–নইলে সত্যের অপলাপ হয়। নীচের লোমহর্ষক অদ্ভুত ঘটনাটি এইরকমই একটি কাহিনি।

    অগাস্টের এক তপ্ত দিবস।* বেকার স্ট্রিটে গা ঢেলে বসে আছি আমি আর হোমস। আফগানিস্তানে থাকার ফলে গরম আমার গা-সওয়া। হোমস কিন্তু সোফায় কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে সকালের ডাকে আসা একটা চিঠি–বার বার পড়ে চলেছে।

    এই সময়ে হোমস আমাকে চমকে দিলে মনে মনে কী ভাবছি তার হুবহু বর্ণনা দিয়ে। পরে অবশ্য বুঝিয়ে দিলে কী করে তা বুঝল শুধু আমার মুখের ভাব আর চোখের চাউনি অনুধাবন করে। (রেসিডেন্ট পেশেন্ট কাহিনি দ্রষ্টব্য।)

    তারপর বললে, এই তো গেল আমার চিন্তা পঠন বিদ্যার নমুনা। কিন্তু আজ সকালের খবরের কাগজে একটা আশ্চর্য কার্ডবোর্ড বাক্সর যে-খবরটা বেরিয়েছে, তা এত সহজে সমাধান করা যাবে বলে মনে হয় না। ক্রয়ডনের ক্রসস্ট্রিট নিবাসিনী মিস কাশিং ডাকে পেয়েছেন বাক্সটা। দেখেছ?

    না তো।

    এই নাও। জোরে পড়ো বলে সেদিনের খবরের কাগজটা এগিয়ে দিল হোমস। আমি পড়লাম :

    লোমহর্ষক প্যাকেট

    ক্রয়ডনের ক্রসস্ট্রিট নিবাসিনী মিস সুশান কাশিংয়ের সঙ্গে অত্যন্ত বিটকেল ধরনের একটা গাড়োয়ানি ইয়ার্কির খবর পাওয়া গেছে নিছক রঙ্গ না হয়ে এর পেছনে কুটিল কোনো ষড়যন্ত্র থাকাও বিচিত্র নয়। গতকাল দুপুর দুটোয় ডাকপিয়োন ব্রাউন কাগজে মোড়া একটা ছোট্ট প্যাকেট দিয়ে যায় তাকে। মোটা দানার নুন ঠাসা একটা কার্ডবোর্ড বাক্স ছিল ভেতরে। বাক্স খুলে মিস কাশিং আঁতকে ওঠেন মানুষের সদ্যকাটা দুটি কান দেখে। তার আগের দিন সকাল নাগাদ বেলফার্স্ট থেকে পাঠানো হয়েছে বাক্সটা। মিস কাশিং পঞ্চাশ বছরের অনূঢ় মহিলা, একা থাকেন, আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধব বলতে গেলে কেউ নেই–বাক্সটাকে কে পাঠিয়েছে তাই ধরা যাচ্ছে না। বছর কয়েক আগে পেঞ্জেতে থাকবার সময়ে উনি তিনজন ডাক্তার ছাত্রকে ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের উৎপাতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বের করে দেন বাড়ি থেকে। পুলিশের সন্দেহ এই তিন ছোকরাই লাশ কাটা ঘর থেকে এই দুটি কান সংগ্রহ করে মিস কাশিংকে পাঠিয়েছে ধাত ছাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে। এই অনুমানের খানিকটা সম্ভাবনা আছে একটা কারণে : তিন বিটলের মধ্যে একজন নাকি উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের মানুষ মিস কাশিংয়ের যদ্র জানা আছে–বেলফাস্টে থাকে। ইত্যবসরে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অন্যতম সুদক্ষ চৌকস ডিটেকটিভ–মি. লেসট্রেড তদন্তভার গ্রহণ করেছেন এবং তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন।

    পড়া শেষ হল। হোমস বললে, এই গেল গিয়ে ডেলি ক্রনিক-এর খবর। লেসট্রেডের কাছ থেকে আজ সকালে একটা চিরকুট পেয়েছি। ও লিখেছে : কেসটা খুবই সহজ বলে মনে হয়, নিজেরাই ফয়সালা করে ফেলব এ-বিশ্বাস আছে কিন্তু কোত্থেকে শুরু করব এই নিয়ে একটু ধাঁধায় পড়েছি। বেলফাস্টে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলাম পার্সেলটা পাঠিয়েছে কোন মহাপ্রভু কিন্তু সারাদিন এত পার্সেল ওদের ওখানে জমা পড়ে যে বিশেষ এই পার্সেল কে এনেছে, তা তাদের মনে নেই। শনাক্ত করাও সম্ভব নয়। হানিডিউ তামাকের আধ পাউন্ড বাক্স এটা দেখে কিছুই ধরা যাচ্ছে না। ডাক্তারি ছাত্রদের অনুমিতিটা আমার কাছে খুবই সম্ভবপর বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু আপনি যদি ঘণ্টাকয়েক সময় খরচ করতে পারেন তাহলে আপনার সঙ্গে একটু বসা যেত। আমি সারাদিন হয় অফিস, নয় বাড়িতে থাকব।

    কী হে ওয়াটসন, যাবে নাকি? না, গরমে বসে বসে ঝিমোবে?

    কিছু একটা করার জন্যে উশখুশ করছি অনেকক্ষণ থেকে।

    তাহলে ঘণ্টা বাজিয়ে বুট আনাও, গাড়ি ডাকতে বলল। আমি ড্রেসিং গাউন পালটে চুরুটের বাক্সটা ভরে এলাম বলে।

    ট্রেনে যাওয়ার সময়ে বৃষ্টি হয়ে গেল এক পশলা। ক্রয়ডন পৌঁছে দেখলাম লন্ডনের মতো অত ভ্যাপসা গরম নয় ওখানে। চির চটপটে লেসট্রেড হাজির ছিল স্টেশনে। মিনিট পাঁচেক হেঁটে পৌঁছে গেলাম ক্রসস্ট্রিটে মিস কাশিংয়ের বাড়িতে।

    দু-পাশে ইটের তৈরি দোতলা বাড়ির দীর্ঘ সারি। একটা দরজায় টোকা মারতেই কমবয়েসি ঝি এসে দরজা খুলে দিল–নিয়ে গেল সামনের ঘরে। মিস কাশিং কোলের ওপর কাজ করা চাদর বিছিয়ে বসে ছিল পাশের টুলে বাস্কেট বোঝাই রঙিন সিল্ক। ভদ্রমহিলার মুখটি ধীর, শান্ত; চোখ দুটি নিস্তরঙ্গ, বিশাল মাথার দু-পাশ দিয়ে ঝুলছে তেল চকচকে চুলের রাশি।

    লেসট্রেড ঘরে ঢুকতেই বললে, বিকট বাক্সটা বারবাড়িতে আছে। দয়া করে নিয়ে যাবেন।

    নিশ্চয় নিয়ে যাব মিস কাশিং। এখানে রেখেছিলাম আপনার সাক্ষাতে মিস্টার শার্লক হোমসকে দেখাব বলে।

    আমার সাক্ষাতে কেন?

    প্রশ্ন যদি করতে চান, তাই।

    বললাম তো কিছু জানি না। প্রশ্ন করে কী হবে?

    স্নিগ্ধকণ্ঠে হোমস বললে, ঠিক বলেছেন, ম্যাডাম। দেখতেই পাচ্ছি দারুণ বিচলিত হয়েছেন–তাই আর এ নিয়ে কথাবার্তা চাইছেন না।

    দেখুন মশাই, আমি নিঝাট জীবনযাপন করি। কারো সাতেপাঁচে থাকি না। খবরের কাগজে আমার নাম বেরোক এ আমি চাই না। পুলিশের হাঙ্গামাও আমার দু-চোখের বিষ। মি. লেসট্রেড, আপনি বারবাড়িতে গিয়ে ওগুলো দেখুন।

    বাড়ির পেছনে ছোটো বাগানের শেষে একটা ছাউনিতে ঢুকল লেসট্রেড। বেরিয়ে এল একটা কার্ডবোর্ড বাক্স, খানিকটা ব্রাউন কাগজ, আর একটা সুতো নিয়ে। বাগানের বেঞ্চিতে বসে জিনিসগুলো একে একে পরীক্ষা করল হোমস।

    আলোর দিকে সুতোটা তুলে গন্ধ শুকল। বলল, খুবই ইন্টারেস্টিং বস্তু। লেসট্রেড, কী বুঝলে?

    আলকাতরা মাখানো হয়েছে সুতোটায়।

    হ্যাঁ, আলকাতরায় ডোবানো টোয়াইন সুতো! কাঁচি দিয়ে কেটেছেন মিস কাশিং–দেখছ না একদিকে দু-বার শুয়ো উঠে রয়েছে।

    গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।

    কোনো গুরুত্বই চোখে পড়ছে না আমার, বললে লেসট্রেড।

    গিটটা খোলা হয়নি এবং সেইজন্যেই দেখা যাচ্ছে গিঁটের বিচিত্র চেহারা–পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ সেই কারণেই।

    নির্বিকারভাবে লেসট্রেড বললে, তাও দেখেছি। চমৎকারভাবে বাঁধা হয়েছে গিঁটটা।

    হাসল হোমস। বলল, সুতো পর্ব তাহলে এখানেই শেষ হল। এবার ব্রাউন কাগজ। কফির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ঠিকানাটা লেখা হয়েছে জাবড়াভাবে : মিস এস কাশিং, ক্রসস্ট্রিট, ক্রয়ডন। খুব সম্ভব নিব বা ওই জাতীয় চওড়া মুখ নিব দিয়ে লেখা কালিটা খুবই নিকৃষ্ট শ্রেণির। ক্রয়ডন বানান লিখতে গিয়ে মাঝখানে আগে লিখে পরে কেটে লেখা হয়েছে। কাজেই পার্সেল যে পাঠিয়েছে সে একজন বেটাছেলে–পুরুষালি লেখাটাই তার প্রমাণ পেটে বিদ্যে তেমন নেই, ক্রয়ডনে নতুন এসেছে বলেই শহরের বানানটা পর্যন্ত জানে না। বাক্সটা হলুদ রঙের, হানিডিউ তামাকের আধ পাউন্ড বাক্স, বাঁ-দিকের কোণে স্পষ্ট দুটো আঙুলের ছাপ। পশু চামড়া সংরক্ষণের জন্যে যে ধরনের মোটা দানার নুন ব্যবহার করা হয়, বাক্সের মধ্যেও সেই সস্তা নুন ঠাসা হয়েছে।

    বলতে বলতে বাক্স থেকে ভয়ংকর বস্তু দুটো বার করে কোলের ওপর রাখল হোমস। চেয়ে রইল নির্নিমেষে। দু-পাশ থেকে চেয়ে রইলাম আমি আর লেসট্রেড। কান কেটে উপহার পাঠানোর মতো বদ রসিকতা যে করতে পারে, সে যে কী ধরনের রসিক ভেবে পেলাম না। কিছুক্ষণ পরে কান দুটো বাক্সতে ভরে ধ্যানস্থ হয়ে চেয়ে রইল হোমস।

    অবশেষে বলল, লক্ষ করেছ নিশ্চয় কান দুটো দুজন লোকের–একজনের নয়?

    করেছি। লাশটাকে ঘর থেকে জোগাড় করা হয়েছে তো। দুজনের দুটো কান জোগাড় করা ওদের পক্ষেই সম্ভব।

    লেসট্রেড এর মধ্যে ইয়ার্কি-টিয়ার্কি একদম নেই।

    আপনি ঠিক জানেন?

    ডিসেকটিং রুম-এ এ-কান যদি কাটা হত, তাহলে এর গায়ে আরক লেগে থাকত। যাতে পচে না-যায় তাই আরক ড়ুবিয়ে রাখার নিয়ম আছে ডিসেকটিং রুমে। তা যখন নেই, তখন কোনো ডাক্তারি ছাত্র এর মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া কান কাটা হয়েছে ভেঁতা ছুরি দিয়ে, ডাক্তারি ছাত্র হলে ধারালো ছুরি দিয়ে কাটত। তারপর কার্বলিক বা রেক্টিফায়েড স্পিরিটে ড়ুবিয়ে রেখে কান পাঠাত–নুনের মধ্যে করে পাঠাত না। না হেনা, এর পেছনে ইয়ার্কি নেই–আছে একটা পৈশাচিক অপরাধ।

    শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। বন্ধুবরের চেয়ালের হাড় শক্ত হয়ে উঠেছে লক্ষ করলাম। লেসট্রেড কিন্তু পুরো বিশ্বাস করতে পারল না।

    বলল, ঠাট্টা যদি কেউ না করে তো অপরাধই-বা করতে যাবে কেন? ভদ্রমহিলা পেঞ্জেতে নিঝঞাটে থেকেছেন অনেক দিন। এখানেও আছেন বিশ বছর-একদিনের জন্যেও বাড়ি ছাড়া হননি। অন্যের কান কেটে তাকে পাঠিয়ে কার কী লাভ বলতে পারেন? মুখ দেখে বুঝছেন না আমাদের মতোই উনিও অন্ধকারে? বড়ো দরের অভিনেত্রী হলে অবশ্য আলাদা কথা।

    হোমস বললে, আমি কিন্তু তদন্ত শুরু করব ডবল মার্ডারের ভিত্তিতে। একজন পুরুষ আর একজন নারীকে খুন করা হয়েছে। একটা কান ছোটো, নিখুঁত। লতিতে দুল পরার ছাদা—অর্থাৎ কোনো মেয়ের কান। আর একটা কানেও ছাদা আছে রিং পরানোর জন্যে কিন্তু রোদে পোড়া বেটাছেলের কান। দুজনেই এখন পরলোকে ধরে নিতে পারি–নইলে কান কাটাদের খবর অনেক আগেই কানে আসত। আজ হল শুক্রবার প্যাকেট পাঠানো হয়েছে বেস্পতিবার সকালে। খুনটা হয়েছে বুধবার কি মঙ্গলবার কি তারও আগে। খুন যে করেছে কান দুটো সে-ই উপহার পাঠিয়েছে মিস কাশিংকে–সে ছাড়া অন্য কেউ পাঠাতে যাবে কেন বলতে পার? পার্সেল যে পাঠিয়েছে, খুনও সে-ই করেছে ধরে নিতে পার। কিন্তু মিস কাশিংকে এ-রকম উপহার পাঠানোর পেছনে জবরদস্ত কারণ একটা নিশ্চয় আছে। কী সেই কারণ? কাম ফতে–এইটাই কি জানতে চেয়েছে খুনি? না, শুধুই মানসিক যন্ত্রণা দিতে চেয়েছে? তাহলে তো মিস কাশিংয়ের জানা উচিত লোকটাকে। কিন্তু সত্যিই কি জানেন উনি? সন্দেহ আছেআমার। জানলে কি পুলিশ ডেকে হাটে হাঁড়ি ভাঙতে যেতেন? কান দুটো কোথাও পুঁতে ফেললেই ল্যাটা চুকে যেত–কাকপক্ষীও টের পেত না। ক্রিমিনালকে আড়াল করতে চাইলে ঠিক এমনটিই করতেন মিস কাশিং। আড়াল করতে যদি না-চাইতেন, লোকটার নামটা তাহলে বলতেন। এই জটটা আগে পরিষ্কার করা দরকার। বাগানের বেড়ার দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে এতক্ষণ উচ্চ দ্রুত কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছিল হোমস। এবার তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে।

    বললে, মিস কাশিংকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

    লেসট্রেড বললে, আমি তাহলে ফাড়িতে চললাম। ওঁকে আর জিজ্ঞেস করার কিছু নেই আমার।

    স্টেশনে যাওয়ার পথে দেখা করে যাব, বলে হোমস ঢুকল সামনের ঘরে। উদাসীন ভদ্রমহিলার কোলের ওপর চাদর রেখে তখনও ছুঁচের কাজ করছিল তন্ময় হয়ে। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই সরল নীল চোখে জিজ্ঞাসা তুলে ধরে তাকাল আমাদের পানে।

    বলল, পুলিশ ভদ্রলোককে বার বার বলেছি, নিশ্চয় কেউ ভুল করে পার্সেলটা পাঠিয়েছে আমাকে। উনি কিন্তু হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। দুনিয়ায় আমার শত্রু বলে কেউ নেই—কাটা কান পাঠিয়ে রগড় করার মতো কাউকেই জানি না।

    আমারও তাই মনে হচ্ছে,বলে ভদ্রমহিলার পাশের চেয়ারে গিয়ে বসল হোমস। এবং আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম ওর কাণ্ড দেখে। তন্ময় হয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগল মিস কাশিংয়ের মুখশ্রী। যুগপৎ বিস্ময় আর সন্তোষ নৃত্য করে উঠল ওর তীক্ষ্ণ্ণ চোখে। হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়ার কারণ দেখার জন্যে মিস কাশিং ঘাড় ঘোরানোর সঙ্গেসঙ্গেই কিন্তু ফের নির্বিকার হয়ে গেল শার্লক হোমস। ভদ্রমহিলার শান্ত মুখশ্রী, তেল চকচকে পরিষ্কার আঁচড়ানো চুল, কানের লতিতে গিল্টি করা ছোটো ইয়ার-রিং দেখে আমি কিন্তু বুঝে উঠলাম না অকস্মাৎ এত উত্তেজিত হল কেন হোমস।

    দুটো প্রশ্ন আছে—

    আবার প্রশ্ন! খেঁকিয়ে উঠল মিস কাশিং।

    আপনার দুজন বোন আছে, তাই না?

    আপনি জানলেন কী করে?

    ঘরে ঢুকেই জেনেছি। ম্যান্টলপিসের ছবিতে তিন মহিলার একজন আপনি বাকি দুজন নির্ঘাত আপনার আত্মীয়া–চেহারায় মিল রয়েছে।

    ঠিক ধরেছেন। সারা আর মেরি আমার বোনই বটে।

    আমার কনুইয়ের কাছে এই যে একটা ফটো দেখছি, এটি কিন্তু অবিবাহিত অবস্থায় আপনার ছোটো বোনের ছবি। স্টুয়ার্ডের ইউনিফর্ম পরা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন।

    আপনার চোখ তো দেখছি খুব ধারালো।

    আমার ব্যাবসাই যে তাই।

    ওই ছবি তোলার দিনকয়েক পরেই বিয়ে হয়ে যায় ওদের। মি. ব্রাউনার তখন সাউথ আমেরিকান জাহাজে কাজ করত। কিন্তু বউ অন্ত প্রাণ হওয়ায় সে চাকরি ছেড়ে লিভারপুল-লন্ডনে জাহাজে কাজ নেয়।

    কনকারার জাহাজে নিশ্চয়?

    না, মে-ডে জাহাজে। একবার এখানে এসেছিল জিম আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। তারপর মদ ধরল। পেটে একটু মদ পড়লে আর রক্ষে থাকত না খ্যাপা ষাঁড়ের মতো যা কাণ্ড করত যে বলবার নয়। ডাঙায় থাকলেই মদ খাওয়া চাই। আমার কাছে আসা বন্ধ হল সবার আগে, তারপর ঝগড়া করল সারার সঙ্গে, এখন তো মেরিও চিঠি লেখা বন্ধ করেছে জানি না কীভাবে আছে ওরা।

    প্রসঙ্গটা যে খুবই নাড়া দিয়েছে মিস কাশিংকে, তা বোঝা গেল হঠাৎ তার মুখের আগল খুলে যাওয়ায়। একলা থাকলে মানুষমাত্রেই একটু কম কথা বলে নিজের ঘরের কথা বলতে মুখে আটকায়। কিন্তু প্রাণের প্রসঙ্গ ওঠার মুখে যেন কথার ফোয়ারা ছোটাল মিস কাশিং। কত কথাই না বলল ভগ্নীপতি সম্পর্কে, তারপর বলল তিনি ডাক্তার ছাত্রের বিবিধ উচ্চুঙ্খলতার কাহিনি–তাদের নাম-ঠিকানা, হাসপাতালের নাম পর্যন্ত বলে গেল গড়গড় করে। প্রত্যেকটা শব্দ খুব মন দিয়ে শুনল হোমস। মাঝে মাঝে টুকটাক শব্দ করে চালু রাখল বাক্যস্রোত।

    তারপর বলল, আপনার মেজোবোন সারাও তো বিয়ে-থা করেননি। তা সত্ত্বেও আপনারা দু-বোন এক সংসারে থাকেন না দেখছি।

    সারার মেজাজ তো আপনি জানেন না, জানলে এ-প্রশ্ন আর তুলতেন না। নিজের বোন সম্বন্ধে বেশি কথা বলতে চাই না–চিরকালই বড়ো ঝগড়াটে কিছুতেই মন ওঠে না। ক্রয়ডনে এসে ওকে এনে রেখেছিলাম–দু-মাস আগেও ছিল ওখানে কিন্তু একসঙ্গে থাকা গেল না।

    লিভারপুলের আত্মীয়দের সঙ্গেও ঝগড়া করেছিল বুঝি?

    ওরাই তো এককালে ওর সেরা বন্ধু ছিল বেশ কিছুদিন। এখন তো জিম ব্রাউনারের নামে গালাগাল না-দিয়ে জল গ্রহণ করে না। শেষ ছ-মাস এখানে থাকার সময়ে উঠতে বসতে শুনেছি জিমের নিন্দে। আসলে সারার কুঁদুলে স্বভাবটা ধরে ফেলেছিল বোধ হয় জিম দিয়েছে আচ্ছা করে রগড়ে। যা বদমেজাজ–রেগে গেলে তো কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।

    উঠে দাঁড়াল হোমস, ধন্যবাদ মিস কাশিং। খামোখা এ-কেসে আপনাকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সারার ঠিকানাটা কী বলুন তো? নিউ স্ট্রিটে, ওয়ালিংটন। গুড বাই।

    রাস্তায় বেরিয়েই একটা ছ্যাকড়াগাড়ি ডাকল হোমস। গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানল ওয়ালিংটন এখান থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। গাড়িতে উঠে বসে বললে, চলো তাহলে। যাওয়ার পথে টেলিগ্রাফ অফিস হয়ে যাব।

    কাকে যেন একটা টেলিগ্রাম পাঠাল হোমস। বাকি পথটা রোদ থেকে মুখ বাঁচানোর জন্যে নাকের ওপর টুপি টেনে নামিয়ে বসে রইল চুপচাপ। সারা কাশিংয়ের বাড়ির সামনে পৌঁছে কড়ায় হাত দিল হোমস কিন্তু নাড়বার আগেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল গম্ভীরবদন কৃষ্ণবসন একজন যুবা পুরুষ। মাথায় বেজায় চকচকে টুপি।

    মিস কাশিং বাড়ি আছেন? জিজ্ঞেস করল হোমস।

    মিস কাশিং এখন শয্যাশায়ী। ভীষণ অসুস্থ। কাল থেকে মস্তিষ্ক প্রদাহে ভুগছেন। আমি তার ডাক্তার। কারো সঙ্গে এখন দেখা করা সম্ভব নয়। আপনি দশ দিন পরে আসবেন। বলে হনহন করে রাস্তায় বেরিয়ে গেল যুবক চিকিৎসক।

    প্রফুল্ল কণ্ঠে হোমস বললে, দেখা না হলে আর কী করা যায়! চলো যাই।

    দেখা হলেও ভদ্রমহিলা কথা বলতে পারতেন কি? বললাম আমি।

    কথা বলার জন্যে দরকার হত না–মুখখানা শুধু দেখলেই হত। যাকগে, তারও আর দরকার নেই–বুঝে ফেলেছি। ওহে, একটা হোটেলে নিয়ে চলো। গাড়িতে উঠে বসে গাড়োয়ানকে হুকুম দিল হোমস।

    হোটেলে পৌঁছে খেতে খেতে শার্লক হোমস গল্প জুড়ল ওর স্ট্রাডিভেরিয়াস বেহালা নিয়ে। বেহালাটার দাম হওয়া উচিত পঁচিশ গিনি–কিন্তু একজন ইহুদি বন্ধকি কারবারির কাছ থেকে কিনেছে মাত্র পঞ্চান্ন শিলিংয়ে। এই প্রসঙ্গ থেকে এল আশ্চর্য মানুষ পাগানিনির গল্প। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল, তখন উঠল জায়গা ছেড়ে। থানায় গেলাম দুই বন্ধু।

    একটা টেলিগ্রাম বাড়িয়ে ধরে লেসট্রেড বললে, আপনার টেলিগ্রাম।

    জবাব এসে গেছে তাহলে। খামের মুখ ছিঁড়ে চোখ বুলিয়ে দলা পাকিয়ে পকেটে পুরে হোমস বললে, ব্যস, আর কিছু চাই না।

    জবর খবর পেয়েছেন মনে হচ্ছে?

    সব খবর পেয়েছি বলতে পার।

    সেকী! ঠাট্টা করছেন নাকি? ছানাবড়ার মতো চোখ বড়ো বড়ো করে বললে লেসট্রেড। ঠাট্টা কী হে! জীবনে এত সিরিয়াস হইনি। সাংঘাতিক একটা ক্রাইমের সব খবর এখন আমার হাতের মুঠোয়।

    কিন্তু ক্রিমিনালটাকে কি মুঠোয় আনতে পেরেছেন?

    হোমস নিজের ভিজিটিং কার্ডের পেছনে কয়েকটা শব্দ লিখে লেসট্রেডের হাতে নিয়ে বললে, এই হল তার নাম। কিন্তু কাল রাতের আগে তাকে ছুঁতে পারবে না। কেসটা জলের মতো সোজা–এর মধ্যে আমার নামগন্ধ যেন না-থাকে–তোমার নাম থাকলেই যথেষ্ট। জটিল কেস ছাড়া কোনো কেসের মধ্যে আমি জড়িত থাকা পছন্দ করি না! এসো ওয়াটসন। বেরিয়ে গেলাম রাস্তায়। হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল লেসট্রেড। দুই চোখ উল্লাসে নাচতে লাগল কার্ডে লেখা কথাগুলো পড়ে।

    বেকার স্ট্রিটে বসে চুরুট টানতে টানতে শার্লক হোমস বললে, এই ঘরে বসে চুরুট খেতে খেতেই কেসটার সুরাহা করে ফেলেছিলাম। দু-একটা যা তথ্য এখনও হাতে আসেনি, তা লেসট্রেড বার করে ফেলবে লোকটাকে পাকড়াও করার পর। ওর ঘটে বুদ্ধি কম থাকলেও স্বভাবটা ডালকুত্তার মতো। এই গুণের জন্যেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে এত উন্নতি ও করেছে।

    কেস তাহলে এখনও সম্পূর্ণ হয়নি? বললাম আমি।

    প্রায় সম্পূর্ণ বলতে পার। তোমার কী মনে হয়?

    জিম ব্রাউনার লোকটাকে তুমি সন্দেহ কর?

    সন্দেহ কী হে, তার চাইতেও বেশি।

    কিন্তু কেন?

    খোলা মন দিয়ে কেসটাকে প্রথম থেকে দেখেছিলাম বলে আগে থেকেই কাউকে সন্দেহ করে বসিনি বলে। মিস কাশিংকে দেখলাম নিরীহ সাদাসিধে শান্ত স্বভাবের মহিলা। কিন্তু একটা ফটোগ্রাফে দেখলাম তিন বোনের ছবি। দেখেই আঁচ করলাম, বাক্সটা পাঠানো হয়েছে বাকি দুজনের একজনকে। সে জনটি কে, সেটা সঙ্গেসঙ্গে ঠিক করার চেষ্টা না-করে আশ্চর্য বাক্সর ভয়ংকর বস্তু দুটো দেখলাম বাগানে গিয়ে।

    আলকাতরা মাখানো এ ধরনের সুতো জাহাজি নাবিকরা ব্যবহার করে, ওই ধরনের বিশেষ জাহাজি গিট দিতে জাহাজি নাবিকরাই অভ্যস্ত। দেখেই নাকে যেন সমুদ্রের হাওয়া লাগল। বাক্সটাও পাঠানো হয়েছে একটা সমুদ্রবন্দর থেকে এবং পুরুষের কানের ছাদা দেখে বুঝলাম বেচারা নিজেও জাহাজে জাহাজে নাবিকের কাজ করেছে—কান ছাদা তারাই করে রিং পরার জন্যে–ডাঙার পুরুষরা করে না। বুঝলাম, বিকট এই নাটকের সব ক-জন অভিনেতাই সমুদ্রে যাতায়াতের জীবিকা বেছে নিয়েছে।

    ঠিকানা লেখা হয়েছে মিস এস কাশিং। বড়োবোনের নাম এস কাশিং ঠিকই। অন্য বোনের নামও এস দিয়ে শুরু হওয়া বিচিত্র নয়। এই খবরটা জানবার জন্যে বাড়ির ভেতরে ঢুকেই থমকে গেলাম একটি জিনিস দেখে। তোমার মনে আছে বোধ হয় কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েই থেমে গিয়েছিলাম আমি।

    ওয়াটসন, তুমি নিজে ডাক্তার। তুমি জান, মানুষের কানের মতো গড়ন বৈচিত্র্য অন্য কোনো প্রত্যঙ্গে বড়ো একটা দেখা যায় না। এক একটা কান এক-এক ধরনের একটা কান আর একটা কানের সঙ্গে হুবহু মেলে না। গতবছর অ্যানথ্রোপলজিক্যাল জার্নালে এ সম্পর্কে দুটো প্রবন্ধ লিখেছি, পড়ে নিয়ো। মিস কাশিংয়ের কানের দিকে লক্ষ করে তাই অত চমকে উঠেছিলাম, অবাক হয়েছিলাম, খুশি হয়েছিলাম। কার্ডবোর্ডের বাক্সে যে মেয়েলি কান দেখে এসেছি–চোখের সামনে দেখলাম হুবহু সেই কান। ওপর দিকটা সেইরকম চওড়া, লতি সেইরকম ছোটো, ভেতরের তরুণাস্থি সেইরকম বাঁকা–সব দিক দিয়ে একই কান।

    পয়েন্টটা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তৎক্ষণাৎ তা বুঝেছিলাম বলে সঙ্গেসঙ্গে তাঁর বোনেদের নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করেছিলেন। কেননা, কাটা কান যার, নিশ্চয় সে মিস কাশিংয়ের রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয় এবং খুবই কাছের পরিজন।

    অনেক দরকারি খবর বেরিয়ে এল আলোচনার ফলে। জানা গেল, সারা কাশিংয়ের ঠিকানা দু-মাস আগেও একই বাড়িতে ছিল–ভুলটা হয়েছে সেই কারণে। পার্সেল-প্রেরক সারা কাশিংকেই পাঠিয়েছে কাটা কান–সে জানত না সারা আর ও-বাড়িতে নেই। অনেকদিন খবর রাখেনি বলেই সারার ঠিকানা পালটানোর খবর সে পায়নি। তারপর জানলাম, ছোটোবোনের সঙ্গে জিম ব্রাউনারের বিয়ে হওয়ার পর সারা ভগ্নীপতির বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে উঠেছিল–তারপর ঝগড়া করে চলে এসেছে চিঠিপত্র পর্যন্ত লেখালেখি হয়নি। এ-অবস্থায় যদি ব্রাউনারকে পার্সেল পাঠাতে হয় সারার নামে০০পুরোনো ঠিকানাতেই তা পাঠাতে হবে।

    অদ্ভুতভাবে জট পরিষ্কার হয়ে এল এইখান থেকে। জিম ব্রাউনার জাহাজের স্টুয়ার্ড, দারুণ আবেগপ্রবণ, মাথায় ঝোক চেপে বসলে তা করা চাই–বউকে ভালোবাসে বলে ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়েছে সেই কারণেই। এর ওপর আছে মদ খেয়ে পাঁড় মাতাল হওয়ার অভ্যেস তখন আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। এ থেকেই ধরে নিলাম স্রেফ ঈর্ষার বশে নিশ্চয় এই জিম ব্রাউনারই খুন করেছে তার বউকে সেইসঙ্গে জাহাজে কাজ করে এমন একজন পুরুষকে। মিস সারা কাশিংকে কাটা কান দেখতে পাঠানোর কারণ নিশ্চয় এই কুৎসিত ব্যাপারের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল সারা নিজে–ভগ্নীপতির বাড়িতে থাকার সময়ে, সেই কারণেই ঝগড়া হয়েছে, আর টিকতে পারেনি। মে-ডে জাহাজ বেলফার্স্ট, ডাবলিন, ওয়ারটারফোর্ড ছুঁয়ে যায়। ব্রাউনার তাই বেলফার্স্ট থেকে বাক্স পাঠিয়েছে সারাকে।

    আর একটা সম্ভাবনাও অবশ্য ছিল। জিম ব্রাউনারকে আর তার প্রাণাধিক বউকে খুন করেছে। অন্য কোনো পুরুষ। সম্ভাবনাটা যাচাই করার জন্যে লিভারপুলে আমার বন্ধু আলগারকে টেলিগ্রাম করে জানতে চাইলাম মিসেস ব্রাউনার বাড়ি আছে কি না, আর মিস্টার ব্রাউনার মে-ডে জাহাজে বেরিয়ে পড়েছে কি না। টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দেখা করতে গেলাম সারা কাশিংয়ের সঙ্গে।

    আসলে আমি কিন্তু দেখতে গিয়েছিলাম তার কানের গড়নটা। একই বংশে তিন সহোদরার কানই হুবহু একরকম হয় কি না দেখার প্রচণ্ড কৌতূহল ছিল। দেখাসাক্ষাৎ হলে খবর-টবরও মিলত নিশ্চয়। কিন্তু শুনলাম, পার্সেল যেদিন এসেছে বড়দির কাছে, সেইদিন থেকেই মস্তিষ্ক প্রদাহে সে বিছানা নিয়েছে। খবরটা সারা ক্রয়ডন জেনে গিয়েছে–কাটা কান কাকে দেখতে পাঠানো হয়েছে, আর কেউ না-বুঝলেও সারা বুঝেছে বলেই প্রচণ্ড আঘাতে বিছানা নিয়েছে। কিন্তু আরও কিছুক্ষণ না-গেলে তার মুখ থেকে আসল কাহিনি শোনা যাবে না।

    কিন্তু আলগারের টেলিগ্রাম পাওয়ার পর তারও আর দরকার নেই। আলগার জানিয়েছেন, মিসেস ব্রাউনারের বাড়িতে তিনদিন ধরে তালা ঝুলছে প্রতিবেশীদের বিশ্বাস সে দক্ষিণে গেছে আত্মীয়দের কাছে। মিস্টার ব্রাউনার মে-ডে জাহাজে ডিউটিতে গেছে। হিসেব করে দেখলাম, আগামীকাল রাতে জাহাজ আসবে টেমস-এ। লেসট্রেড থাকবে সেখানে খুনিকে যোগ্য সমাদর করার জন্যে। সব খবর তখন পাওয়া যাবে।

    নিরাশ হতে হল না শার্লক হোমসকে। দু-দিন পরে একটা ভারী লেফাফা এল ওর নামে। ভেতরে লেসট্রেডের লেখা একটা ছোট্ট চিঠির সঙ্গে অনেকগুলো ফুলক্যাপ কাগজে টাইপ করা সুদীর্ঘ একটা এজাহার। চোখ বুলিয়ে নিয়ে হোমস বললে, লেসট্রেড পাকড়াও করেছে আসল লোককে। শোনো কী লিখেছে।

    মাই ডিয়ার হোমস,

    যে-থিয়োরিটা আমরা খাড়া করেছিলাম, তা যাচাই করার জন্য গতকাল সন্ধে ছটার সময়ে অ্যালবার্ট ডকে গিয়ে মে-ডে জাহাজে উঠেছিলাম। (ওয়াটসন, লক্ষ করেছ, থিয়োরিটা নাকি আমরা খাড়া করেছি!) খোঁজ নিয়ে জানালাম, জেমস ব্রাউনার নামধারী স্টুয়ার্ড জাহাজ ছাড়ার পর থেকে এমন অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকে যে বাধ্য হয়ে ক্যাপ্টেন তাকে ঘরে বসিয়ে রেখেছে–ডিউটি দেয়নি। ঘরে গিয়ে দেখি লোকটা একটা কাঠের সিন্দুকের ওপর বসে দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে সামনে পেছনে একনাগাড়ে দুলছে। দাড়ি গোঁফ পরিষ্কার কামানো, বিরাট চেহারা, দারুণ গাঁট্টাগোট্টা শরীর–জাল ধোপাকে ধরতে গিয়ে অ্যালড্রিজ আমাদের সাহায্য করেছিল মনে পড়ে?–অনেকটা সেইরকম দেখতে। আমাকে দেখেই এমন লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল যে আর একটু হলে বাঁশি বাজিয়ে বসতাম–নদী-পুলিশ বাইরেই ছিল। কিন্তু তার আর দরকার হল না। লোকটা নিজেই দু-হাত বাড়িয়ে দিলে হাতকড়া পরার জন্যে। থানায় এসে ইনস্পেকটরের সামনে নিজে থেকেই এজাহার দিলে। তিন কপি টাইপ করেছিলাম। এক কপি আপনাকে পাঠালাম। গোড়া থেকেই বলেছি আপনাকে কেসটা জলের মতো সোজা। তবে তদন্তে আপনি সাহায্য করেছেন বলে ধন্যবাদ জানাই।

    শ্রদ্ধাসহ,
    আপনার একান্ত
    জি. লেসট্রেড

    জলের মতো সোজা কেস! টিপ্পনী কাটল হোমস।কেসটা হাতে আসার সময়ে তা মনে হয়নি। যাকগে ভায়া। জিম ব্রাউনার নিজের জবানিতে কী বলেছে, এবার তা শোনা যাক।

    অনেক কথাই বলার আছে–সবই বলব। শোনবার পর ফাঁসি দিতে হয় দিন। থোড়াই কেয়ার করি। এ-কাজ করার পর থেকে চোখ মুদে ঘুমোতে আর পারছি না। জেগে থেকেই অষ্টপ্রহর দেখছি দুটো মুখ। হয় সেই বেটাচ্ছেলেকে, নইলে আমার প্রাণাধিকাকে। বেশির ভাগই দেখছি বউকে। তার নাগরটি ভুরু কুঁচকে মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মেরি তাকিয়ে আছে অবাক চোখে–মৃত্যুকে সামনে দেখে চমকে উঠেছে, অবাক হয়েছে।–যে-চোখে ভালোবাসা ছাড়া কিছু দেখিনি, সে-চোখে এখন দেখছি মৃত্যুভয়।

    দোষটা কিন্তু সবটা আমার নয়–সারার। মদ ধরেছিলাম ঠিকই। মদ আমাকে পশু করে তুলত, তাও মানছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেরি আমাকে ক্ষমা করত আমাকে কাছে টেনে নিত–যদি ওই মেয়েছেলেটা অশুভ গ্রহের মতো আমাদের সুখের সংসারে আগুন জ্বালাতে না-আসত। সারা আমাকে ভালোবাসত শেষকালে সে-ভালোবাসা বিষ হয়ে গেল দারুণ ঘৃণায়। কেননা, সারা জেনেছিল ওর দেহ আর মনের চাইতে স্ত্রীর পদযুগলও আমার কাছে অনেক প্রিয়।

    ওরা তিন বোন। বড় বোন সাধ্বী, মেজো একটা আস্ত ডাইনি, ছোটো সাক্ষাৎ দেবী। বিয়ে যখন করি, মেরির বয়স তখন উনত্রিশ, সারার তেত্রিশ। দিনসাতেকের জন্যে সারাকে নেমন্তন্ন করেছিলাম লিভারপুলের নতুন সংসারে। সাত দিনের জায়গায় একমাস থাকার পর দেখা গেল সারা আমাদেরই একজন হয়ে গিয়েছে।

    তখন মদ স্পর্শ করতাম না।

    একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছিলাম। তখন কি ভেবেছিলাম শেষটা হবে এইরকম?

    হপ্তা শেষে প্রায় বাড়ি ফিরতাম। কখনো-সখনো জাহাজে মাল ওঠানো হত একটানা দিনসাতেক–আমি বাড়ি বসে থাকতাম। শ্যালিকাকে কাছ থেকে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম তখনই। ছিপছিপে তন্বী চটপটে খর প্রকৃতি, দু-চোখে চকচকির ফুলকি, ঘাড় বেঁকিয়ে চলা দেখলেই বোঝা যেত কী ধরনের গরবিনি মেয়েছেলে সে। মেরি থাকলে কিন্তু সারার কথা মনেও পড়ত না। ঈশ্বর সাক্ষী।

    মাঝে মাঝে ও যেন আমার সঙ্গে একলা থাকতে চায় আমার সঙ্গে একা বেড়াতে যেতে চায়। কিন্তু এর পেছনে যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে, ভাবিনি কোনোদিন। কিন্তু একদিন চোখ খুলল আমার। সন্ধে নাগাদ জাহাজ থেকে ফিরে দেখি মেরি বাড়ি নেই। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় গেছে? সারা বললে, দোকানে টাকা দিতে গেছে। অধীরভাবে পায়চারি করতে লাগলাম ঘরময়। সারা বললে, জিম, মেরিকে ছেড়ে পাঁচটা মিনিটও কি থাকতে পার না? লোকে আমাকে নিন্দে করবে না? আমার সঙ্গ কি তোমার একেবারেই ভালো লাগে না? কী যে বল, বলে ওকে ভুলোনার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম সামনে। সারা সঙ্গেসঙ্গে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল আমার হাতখানা–সতৃষ্ণ নয়নে চাইল চোখে আমার হাত যেন পুড়ে গেল ওর হাতের উত্তাপে চোখের মধ্যে দিয়ে যেন ছুটে এল কামনার হলকা। নিমেষ মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেল ওর অভিপ্রায়। হাত টেনে নিলাম আমি। সেকেন্ড কয়েক কোনো কথা না-বলে পাশে দাঁড়িয়ে রইল সারা। তারপর অদ্ভুতভাবে হেসে দুর, বোকা! বলে ছুটে পালিয়ে গেল ঘর থেকে।

    এরপর থেকেই মনেপ্রাণে আমাকে ঘৃণা করে চলল সারা। পাছে মেরি আঘাত পায়, তাই এ-ব্যাপার ওর কানে তুলিনি। কিন্তু কিছুদিন পরেই লক্ষ করলাম, মেরি যেন একটু একটু করে পালটে যাচ্ছে। সন্দেহবাতিকে পেয়ে বসেছে। কোথায় যাই, কার কাছ থেকে চিঠিপত্র আসে, পকেটে কী থাকে–এইরকম ছোটোখাটো বাজে ব্যাপার নিয়ে খিটিমিটি লেগেই রইল দুজনের মধ্যে। একটু একটু করে দূরত্ব বেড়ে চলল আমার আর মেরির মধ্যে, কিন্তু নিকটত্ব বজায় রইল মেরি আর সারার মধ্যে। নির্বোধ আমি। তখনই বোঝা উচিত ছিল তিল তিল করে মেরির কানে বিষ ঢালছে ডাইনি সারা। একটু একটু করে ওর মন ভেঙে দিয়ে ওকে সরিয়ে নিচ্ছে আমার কাছ থেকে। মন আমারও ভাঙছিল। তাই মদ ধরলাম, মেরি যদি তখনও কাছে চলে আসত, মদকে দূরে সরিয়ে দিতাম। মেরি কিন্তু আরও দূরে সরে গেল–তারপর ধূমকেতুর মতো কোখেকে এসে জুটল আলেক ফেয়ারবার্ন আরও ঘোরালো হল পরিস্থিতি।

    প্রথম প্রথম সারাকে দেখবার জন্যে বাড়ি বয়ে আসত ফেয়ারবার্ন–তারপর আসত আমাদের সবাইকে দেখতে। মানুষের মন জয় করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ওর। আধখানা পৃথিবী সে দেখেছে, আশ্চর্য অভিজ্ঞতার গল্প রসিয়ে বলবার ক্ষমতাও ছিল, দেখতে শুনতেও সুন্দর। কথাবার্তা অত্যন্ত মিষ্টি নাবিকদের মধ্যে যা একান্ত বিরল। মাসখানেক যাতায়াত চলল বাড়িতে। ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এর ফলে সর্বনাশ ঘনিয়ে আসতে পারে সংসারে। একদিন একটা ব্যাপারে সন্দেহ জাগল। সেইদিন থেকে মন থেকে শান্তি জিনিসটা একেবারেই বিদায় নিল।

    ব্যাপারটা ছোট্ট! হঠাৎ একদিন বাড়ি ফিরেছি–ফেরার কথা তখন নয়, বারান্দা পেরিয়ে দরজার কাছে আসতেই দেখলাম সাগ্রহ মুখে এগিয়ে আসছে মেরি। পরক্ষণেই কিন্তু মুখটা অন্যরকম হয়ে গেল আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল অন্যদিকে। বুঝলাম, পায়ের শব্দ ভুল করেছে মেরি। বুকভরা আশা নিয়ে যাকে অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে এসেছিল সে আমি নয় অন্য পুরুষ। এবং নিঃসন্দেহে ফেয়ারবার্ন। চক্ষের নিমেষে মাথায় খুন চাপল আমার। রেগে গেলে আমি আমার মধ্যে থাকি না। আমার মুখের চেহারা দেখেই দৌড়ে এসে মেরি কান্না জড়ানো গলায় বললে, জিম, জিম, দোহাই তোমার! আমি শুধু বললাম, সারা কোথায়? ও বললে, রান্নাঘরে। রান্নাঘরে গিয়ে আমি বললাম, সারা, এই ফেয়ারবার্ন লোকটা যেন এ-বাড়ির চৌকাঠ আর না-মাড়ায়। ও বললে, আমার বন্ধু যদি এ-বাড়িতে আদর না-পায়, তাহলে আমাকেও এ-বাড়ি ছাড়া হতে হবে। আমি বললাম, যা খুশি তুমি করতে পার, কিন্তু ফেয়ারবার্ন এ-বাড়িতে ফের এলে তার একখানা কান কেটে তোমাকে পাঠিয়ে দেব আলমারিতে তুলে রাখার জন্যে। আমার মুখ দেখে ভয়ে কীরকম যেন হয়ে গেল সারা। মুখের ওপর আর কোনো কথা বলল না। সেই রাতেই চলে গেল বাড়ি ছেড়ে।

    কিন্তু এতবড়ো শয়তান মেয়েছেলে আমি আর দেখিনি। আমার মন যাতে মেরির ওপর আরও বিষিয়ে যায়, এই মতলবেই বোধ হয় একটু দূরেই একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে জাহাজি নাবিকদের ঘর ভাড়া দেওয়া শুরু করল সারা। ফেয়ারবার্ন সেখানেই থাকত। মেরি যেত দিদি আর নাগরের সঙ্গে চা খেতে। কতবার এইভাবে গেছে আমি জানি না। একদিন কিন্তু পেছন পেছন নিয়ে সদর দরজা দিয়ে যেই ঢুকছি, পেছনের বাগানের পাঁচিল টপকে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গেল ফেয়ারবার্ন। মেরিকে সেইখানেই শাসালাম, ফের যদি ফেয়ারবার্নের সঙ্গে তাকে দেখি, খুন করব নির্ঘাত। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কাগজের মতো সাদা হয়ে গিয়ে আমার সঙ্গে বাড়ি ফিরে এল মেরি–দুজনের মধ্যে ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও আর রইল না। আরও বেশি মদ খেতে লাগলাম, আরও বেশি ঘৃণা করতে লাগল মেরি।

    লিভারপুলে থেকে পেট চালানো দায় হচ্ছে দেখেই বোধ হয় ক্রয়ডনে বড়দির কাছে ফিরে গেল সারা। তার পরেই গত হপ্তায় ঘটল সব সর্বনাশের শেষ সর্বনাশ।

    ঘটল এইভাবে। দিন সাতেকের মধ্যে মে-ডে জাহাজে ডিউটি দিতে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু ইঞ্জিনে সামান্য গোলমাল দেখা দেওয়ায় ফিরে আসতে হল জাহাজঘাটায় ঘন্টা বারো মতো নিশ্চিন্তি। তারপর জাহাজ ছাড়বে। বাড়ি ফিরছি আর ভাবছি হঠাৎ এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে দেখে বউ নিশ্চিয় খুশি হবে। ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনের রাস্তায় যেই এসেছি, পাশ দিয়ে একটা ছ্যাকড়াগাড়ি বেরিয়ে গেল উলটোদিকে। গাড়ির মধ্যে দেখলাম হাসতে হাসতে গায়ে গড়িয়ে পড়ছে মেরি আর ফেয়ারবার্ন। ওরা আমাকে দেখেনি। আমি কিন্তু ফুটপাতে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম সেই দৃশ্য।

    বিশ্বাস করুন, সেই মুহূর্ত থেকে আমি আর আমার মধ্যে ছিলাম না। কে যেন আমাকে দিয়ে সব করিয়ে নিয়েছে। ইদানীং খুব বেশি মদ খাচ্ছিলাম, তার ওপর স্বচক্ষে দেখলাম ওই দৃশ্য। দুয়ে মিলে আমার মধ্যে সব কিছু উলটেপালটে দিল। তখন আমার ব্রেনের মধ্যে সমানে যেন দুরমুশ পড়ছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে মগজের মধ্যে আস্ত নায়গারার বজ্রনাদ শুনেছিলাম।

    আমার হাতে তখন ওক কাঠের একটা ভারী ছড়ি ছিল। খুন করার জন্যে সেই ছড়ি নিয়ে দৌড়োলাম গাড়ির পেছন পেছন। কিছুদূর দৌড়োনোর পরেই অবশ্য বুদ্ধি খুলে গেল। ওরা যেন দেখতে না-পায়, সেইভাবে ভিড়ের মধ্যে গা মিলিয়ে রেলস্টেশনে এলাম। ওরা নিউ ব্রাইটনের টিকিট কাটল। আমি উঠলাম তিনখানা কামরা পেছনে। ওরা নিউ ব্রাইটন পেঁৗছে প্যারেডে গিয়ে নৌকো ভাড়া করে জল বিহার করতে বেরোল খুব সম্ভব গরমে প্রাণটা আইঢাই করছিল বলে।

    কিন্তু এইভাবেই আমার মুঠোয় এসে পড়ল দুজনে। কুয়াশার মধ্যে কয়েকশো গজের বেশি দেখা যাচ্ছিল না। আমিও একটা নৌকো নিয়ে জলে ভাসলাম। ডাঙা থেকে মাইলখানেক দূরে এসে ওদের ধরে ফেললাম। কুয়াশার জন্যে দেখতে পায়নি আমি পেছন পেছন আসছি। হঠাৎ কুয়াশার মধ্যে থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল দুজনেই, দাঁড় তুলে আমাকে মারতে গেল ফেয়ারবার্ন। ওর আর দোষ কী–আমার চোখে নিজের মৃত্যু দেখেছিল বলেই বাঁচতে গিয়েছিল আমাকে মেরে। আমি পাশ কাটিয়ে মার বাঁচিয়ে ছড়ির এক ঘায়ে পিণ্ডি পাকিয়ে দিলাম মাথাটা। মেরিকে ছেড়ে দিতাম কিন্তু মরা ফেয়ারবার্নকে জড়িয়ে ধরে আলেক বলে কেঁদে উঠতেই ছড়ি বসিয়ে দিলাম ওর মাথাতেও। শেষ হয়ে গেল দুজনে। আমার মাথায় তখন খুন নাচছে–সারাকে সামনে পেলে তারও ঘিলু বার করে ছাড়তাম। ছড়ি রেখে ছুরি বার করে দুজনের একটা করে কান কাটলাম সারাকে ভেট পাঠাব বলে–দারুণ আনন্দ হল কাটা কান দেখে সারার মুখের অবস্থাটা কল্পনা করে তার নষ্টামির জন্যেই আজ খতম হয়ে গেল দু-দুটো মানুষ। তারপর লাশ দুটোকে একসঙ্গে নৌকোর সঙ্গে বেঁধে, নৌকোর তক্তা ভেঙে জলে ড়ুবিয়ে দিলাম। জানি তো নৌকো ফেরত না-এলে মালিক ভাববে বুঝি কুয়াশায় দিকভ্রষ্ট হয়ে বারদরিয়ায় ভেসে গেছে নৌকো। গা থেকে রক্ত আর ঘিলু ধুয়ে ফিরে এলাম ডাঙায়, উঠলাম নিজের জাহাজে। কাকপক্ষীও টের পেল না কী করে এলাম সমুদ্রে। সেই রাতেই সারার জন্যে প্যাকেট বেঁধে পরের দিন পাঠিয়ে দিলাম বেলফার্স্ট থেকে।

    এই হল সব ব্যাপার কিছু লুকোলাম না। এখন যা খুশি করতে পারেন আমাকে নিয়ে, ফাঁসিও দিতে পারেন কিন্তু যে-শাস্তি পেয়ে গেছি, তার সমান শাস্তি আর দিতে পারবেন না। চোখ বন্ধ করতে পারি না। করলেই দেখি ওরা দুজনে আমার দিকে পালা করে তাকিয়ে আছে–কুয়াশার মধ্যে থেকে হঠাৎ আমার নৌকো বেরিয়ে আসতে দেখে যেভাবে তাকিয়েছিল–ঠিক সেইভাবে। ওদের আমি চোখের পলক ফেলবার আগে মেরেছিলাম, ওরা আমাকে মারছে। তিলেতিলে। এভাবে আর একটা রাত কাটাতে হলে কাল সকালেই হয় পাগল হয়ে যেতাম, না হয় মারা যেতাম। আমাকে একলা রাখবেন না জেলখানায়–দোহাই আপনাদের।

    কাগজগুলো আস্তে করে নামিয়ে রেখে ধীর গম্ভীর স্বরে হোমস বললে, ওয়াটসন, এই শোক দুঃখ খুনোখুনি আতঙ্কর শেষ কোথায় বলতে পার? চক্রবৎ এই পরিবর্তনের শেষ কি নেই? শেষ যদি না হয়, বিশ্বসংসারের শেষ পরিণতিটাও যে ভাবা যায় না। মানুষের যুক্তিবুদ্ধি কোনোদিনই খেই খুঁজে পাবে না চিরন্তন এই রহস্যের।

    ———-

    * কন্যান ডয়ালও ভুল করলেন। মেমোয়ার্স অফ শার্লক হোমস গ্রন্থে রেসিডেন্ট পেশেন্ট গল্পের শুরু করেছেন হুবহু এইভাবে। অগাস্টের এক তপ্ত দিবস না-বলে আরম্ভ করেছেন অগাস্টের এক বাদলা দিন বলে। তারপর হোমসের পর্যবেক্ষণ শক্তির নমুনা দেখাতে গিয়ে যে-ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন, সেটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় বর্তমান কাহিনির সঙ্গে। খুবই আশ্চর্য ভুল। কী করে ডয়ালের চোখ এড়িয়ে গেল বোঝা যাচ্ছে না। পুনরুক্তি করলাম না সেই কারণেই। অনুগ্রহ করে পাঠক রেসিডেন্ট পেশেন্ট গল্পটিকে দেখে নেবেন।–অনুবাদক

    ———-

    টীকা

    লোমহর্ষক প্যাকেটের মর্মান্তিক কাহিনি : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য কার্ডবোর্ড বক্স স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ১৮৯৩ সংখ্যায় এবং হার্পার্স উইকলির ১৪ জানুয়ারি ১৮৯৩ সংখ্যায়। এটি মেমোয়ার্স অব শার্লক হোমস সিরিজে সিলভার ব্লেজ গল্পের ঠিক পরে এবং ইয়েলো ফেস গল্পের আগে রচিত এবং প্রকাশিত হলেও কোনো কারণে স্যার আর্থার এটিকে মেমোয়্যার্স অব শার্লক হোমস গ্রন্থে সংকলিত করেননি। অথচ বইটির প্রথম মার্কিন সংস্করণে এটিকে রাখা হলেও ওই প্রকাশনের পরবর্তী সংস্করণ এই গল্প বাদ দিয়ে প্রকাশিত হয়। গল্পটিকে গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত না-করার কারণ হিসেবে অনেক গবেষক মনে করেন এই কাহিনিতে পরকীয়া প্রেম জাতীয় প্রাপ্তবয়স্ক উপাদানের উপস্থিতি।

    রেসিডেন্ট পেশেন্ট কাহিনি দ্রষ্টব্য : এই গল্পটি গ্রন্থে সংকলিত না হওয়ায় লেখক সজ্ঞানে এই অংশটিকে রেসিডেন্ট পেশেন্ট গল্পে জুড়ে দেন।

    ক্রয়ডন : সাধারণভাবে বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত এই অঞ্চলে ১৯২০ সালে লন্ডনের প্রথম বিমানবন্দরটি স্থাপিত হয়।

    পেঞ্জে : শার্লক হোমসের সমকালে লন্ডনের মফস্সল এলাকা। বর্তমানে বৃহত্তর লন্ডনের অংশভুক্ত। শেরিং ক্রন্স থেকে দূরত্ব মাইল সাতেক।

    হানিডিউ তামাক : কৃত্রিমভাবে মিষ্টি যুক্ত করা তামাক। যেমনভাবে এদেশে গুড় দিয়ে তামাক মিষ্টি করা হয়ে থাকে।

    ডিসেকটিং রুম : শব ব্যবচ্ছেদের প্রচলন ঊনবিংশ শতকে শুরু হলেও বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কাল পর্যন্ত ইংলন্ডে শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া অপরাধীদের দেহই ব্যবচ্ছেদ করতে পারতেন ডাক্তার বা ডাক্তারির ছাত্ররা। ফলে মৃতদেহের অভাবে চুরি করা মৃতদেহ কালোবাজারে বিক্রির ব্যাবসা ফেঁদেছিল একদল লোক।

    মে-ডে জাহাজ : কনকারার এবং মে-ডে, এই দুটি জাহাজই ছিল সেকালের লিভারপুল, ডাবলিন অ্যান্ড লন্ডন স্টিম প্যাকেট কোম্পানির মালিকানাধীন।

    স্ট্রাডিভেরিয়াস : প্রথম খণ্ডে আ স্টাডি ইন স্কারলেট উপন্যাসের টীকা দ্রষ্টব্য।

    পাগানিনি : ইতালির জেনোয়া শহরের বাসিন্দা নিকোলো পাগানিনি (১৭৮২-১৮৪০) অল্পবয়স থেকেই ছিলেন সংগীত জগতের বিস্ময়। ভায়োলিনবাদক হিসেবে বিশ্বখ্যাত হলেও তিনি গান গাইতেন এবং পারদর্শী ছিলেন গিটার এবং ভায়োলা বাদনেও।

    অ্যানথ্রোপলিক্যাল জার্নাল : এই জার্নাল বাস্তব হলেও এ-ধরনের কোনো লেখা এখানে প্রকাশিত হয়নি। বরং স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ১৮৯৩-এর অক্টোবর ও নভেম্বর সংখ্যায় এই বিষয়ক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।

    অ্যালবার্ট ডক : রয়্যাল ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট ডক-এর চলতি নাম অ্যালবার্ট ডক।

    নিউ ব্রাইটন : আইরিশ সাগরের তীরে, উইরাল উপদ্বীপের উত্তরতম প্রান্তে ওয়ালসি শহরের অংশভুক্ত নিউ ব্রাইটন বিখ্যাত সাগরতীরের পর্যটন ক্ষেত্র বা সি-রিসর্ট হিসেবে। পূর্বতন ব্রিটিশ শাসকরা বাংলার দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত দীঘার সঙ্গে ব্রাইটনের তুলনা করতেন।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ – আরিফ আজাদ
    Next Article শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }