Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প1414 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    সুন্দরীর শতেক জ্বালা!

    [ দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সলিটারি সাইক্লিস্ট ]

    তীক্ষ্ণ চোখে মিস ভায়োলেট স্মিথের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হোমস বললে, এটুকু বুঝছি স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো মাথাব্যথা আপনার নেই এবং সে-রকম কোনো কারণ নিয়ে আপনার আগমন নয়। এ-রকম উৎসাহী বাইসাইক্লিস্টের তো অফুরন্ত এনার্জি থাকাই স্বাভাবিক, না, কী বলেন আপনি?

    আশ্চর্য হয়ে নিজের পায়ের দিকে মিস স্মিথ তাকাতে আমারও চোখ পড়ল পেডালের ঘষা লেগে পাশের দিকে সামান্য ক্ষয়ে যাওয়া জুততার সোল দুটো।

    আপনি ধরেছেন ঠিকই, মি. হোমস। সাইকেল চালানোয় আমার উৎসাহ একটু বেশি এবং আজকে আপনার কাছে এসেছি বলতে গেলে এই কারণেই।

    হোমস মিস স্মিথের দস্তানাহীন অনাবৃত হাতটা তুলে নিয়ে এমন নির্বিকারভাবে অনন্যমনা হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে দিল যেন কোনো নমুনা পরীক্ষা করতে বসেছে আত্মভোলা বিজ্ঞানী।

    কিছু মনে করবেন না, এই আমার ব্যাবসা, হাতটা নামিয়ে রেখে বললে বন্ধুবর। আর একটু হলেই ভুল করে ফেলেছিলাম আর কি। আপনাকে টাইপিস্ট মনে করেছিলাম। কিন্তু এখন আর কোনো ভুল নেই–পেশাটা গান-বাজনার। সামনের দিকে চেপটা বর্শার ফলার মতো আঙুলগুলো লক্ষ করেছ ওয়াটসন? টাইপিস্ট আর বাজনাদারদের আঙুলই এ-রকম হয়ে থাকে। কিন্তু মুখেতে দেখছি পরমার্থ-নিষ্ঠার হালকা প্রতিচ্ছবি, বলে আলতোভাবে আলোর দিকে মিস স্মিথের মুখটি ঘুরিয়ে দিয়ে সে বললে, টাইপিস্টের চোখে-মুখে এ-রকম অমূর্ততার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। ইনি মিউজিশিয়ান!

    হ্যাঁ মি. হোমস, আমি গানের মাস্টারি করি।

    গ্রামাঞ্চলে, আপনার গায়ের রং দেখে তাই মনে হচ্ছে।

    হ্যাঁ, ফার্নহ্যামের কাছে, সারের সীমানায়।

    বড় সুন্দর পরিবেশ। এখন বলুন দিকি, সারের সীমানায় ফার্নহ্যামের কাছে কী ঝামেলায় পড়েছেন আপনি?

    মি. হোমস, বেশ কিছুদিন হল, আমার বাবা আমাদের মায়া কাটিয়েছেন। বাবার নাম জেমস স্মিথ। ইম্পিরিয়াল থিয়েটারে অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করতেন। বাবা মারা গেলে একেবারে জলে পড়লাম বললেই চলে। সংসারে আত্মীয় বলতে ছিল এক কাকা, রালফ স্মিথ। পঁচিশ বছর আগে আফ্রিকায় অ্যাডভেঞ্চার করতে গেছিলেন কাকা এবং এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তার কাছ থেকে আর সাড়াশব্দ পাইনি। বাবার মৃত্যুর পরে অভাব-অনটনের সংসার নিয়ে যখন জ্বলে-পুড়ে মরছি আমি আর মা, ঠিক এই সময়ে শুনলাম আমরা কোথায় আছি তা জানার জন্যে দ্য টাইমস-এ কারা বিজ্ঞাপন দিয়েছে। খবরটা কানে আসার পর আমাদের আনন্দ-উত্তেজনা খানিকটা অনুমান করতে পারেন আপনি। ভাবলাম, শেষ পর্যন্ত বুঝি বরাত খুলল, কারো সম্পত্তি-টম্পত্তির ওয়ারিশ হয়ে বসেছি আমরা দুই হতভাগিনী। কাগজে আইনজ্ঞের নাম ছিল–কাজেই সিধে হাজির হলাম তার অফিসে। সেখানে গিয়ে আলাপ হল মি. ক্যারুথার্স আর মি. উডলি নামে দুই ভদ্রলোকের সাথে। সাউথ আফ্রিকা দেশ থেকে বেড়াতে এসেছিলেন ওঁরা। শুনলাম কাকা এঁদের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। কয়েকমাস আগে জোহানেসবার্গে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে মারা গেছেন উনি। মৃত্যুশয্যায় এঁদেরকে মিনতি করে যান যেন দেশে ফিরে তার আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে বার করে তাদের যাতে কোনো অভাব না-থাকে তার ব্যবস্থা তারা করেন। শুনে ভারি আশ্চর্য লেগেছিল এই কারণে যে, যে-কাকা জীবিতকালে আমরা বেঁচে আছি কি মরে আছি সে খোঁজটুকুও নেওয়া দরকার মনে করেননি, মৃত্যুর পর যাতে আমাদের গায়ে আঁচড়টি না-লাগে সে-ব্যবস্থা করার জন্যে এত মাথাব্যথা হয়েছিল তার মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে। কিন্তু মি. ক্যারুথার্স সব বুঝিয়ে বললেন। বললেন, বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েই নাকি খুব মুষড়ে পড়েছেন কাকা। আমাদের এ দুর্গতির জন্যে নিজেকে দায়ী করেন এবং উঠে-পড়ে লাগলেন প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে।

    মাপ করবেন, বাধা দিয়ে বলল হোমস, এসব কথাবার্তা কবে হয়েছিল?

    গত ডিসেম্বরে–মাস চারেক আগে।

    তারপর?

    মি. উডলি লোকটা অতি যাচ্ছেতাই। যখন-তখন আমার পানে তাকিয়ে তার চোখ টেপার বহরটা যদি দেখতেন তো আপনারও আপাদমস্তক জ্বলে যেত। চেহারাটা রুক্ষ, ফুলো ফুলো মুখ, লাল গোঁফ, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল কপালের দু-পাশে লেপটানো। ছোকরা বয়স। কিন্তু অতি কদর্য প্রকৃতির লোক এবং রীতিমতো ন্যক্কারজনক। এ-রকম লোকের সঙ্গে আমার আলাপ আছে শুনলেও খুশি হবে না সিরিল।

    ওহো, তার নাম বুঝি সিরিল! হাসিমুখে বলল হোমস।

    একটু লাল হয়ে ওঠে মিস ভায়োলেট স্মিথ, তারপরেই ফিক করে হেসে ফেলে বললে, হ্যাঁ মি. হোমস, সিরিল ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার গ্রীষ্মের শেষাশেষি বিয়ে করার ইচ্ছে আমাদের। কী মুশকিল, ওর কথা আবার শুরু করলাম কখন? আমি যা বলতে চাইছিলাম তা এই মি. উডলি লোকটা ন্যক্কারজনক হলেও মি. ক্যারুথার্স কিন্তু অতটা নয়। ভদ্রলোকের বয়সও বেশি, গায়ের রং ময়লা পাঙাশ-পানা, দাড়িগোঁফ পরিষ্কার কামানো, কথাবার্তা খুব অল্প বলেন। স্বল্পভাষী হলেও ভদ্রলোকের ব্যবহার খুব মার্জিত এবং ভদ্র, হাসিটাও মিষ্টি। মোটের ওপর মি. ক্যারুথার্সকে অনায়াসেই বরদাস্ত করা চলে। একান্ত শুভানুধ্যায়ীর মতো আমাদের খোঁজখবর নিতে লাগলেন ভদ্রলোক। আমরা বড়ো গরিব শুনে উনি প্রস্তাব করলেন তার বাড়িতে থেকে তাঁর দশ বছরের মেয়েকে গান শেখানোর। আমি মাকে ছেড়ে থাকতে রাজি নই। শুনে উনি বললেন প্রত্যেক শনিবার আমি না হয় মার কাছে আসব। বছরে এক-শো পাউন্ড দিতে রাজি হলেন উনি। বলা বাহুল্য, প্রস্তাবটা খুব খারাপ নয়, বিশেষ করে তখন আমাদের যা অবস্থা–এ যেন আকাশের চঁদ হাতে পাওয়া। আমতা আমতা না-করে রাজি হয়ে গেলাম। তারপর একদিন তল্পিতল্পা নিয়ে আস্তানা গাড়লাম ফার্নহ্যাম থেকে প্রায় মাইল ছয়েক দূরে শিলটার্ন গ্রাঞ্জ-এ। মি. ক্যারুথার্স বিপত্নীক। তাই ঘরকন্নার কাজ দেখাশুনা করার জন্যে মিসেস ডিক্সন নামে একজন বর্ষীয়সী লেডি-হাউসকিপারকে এনেছিলেন সংসারে। মিসেস ডিক্সনকে দেখলেই বোঝা যায়, বেশ সম্রান্ত ঘরে তার জন্ম। আমার ছাত্রীটিও বড়ো ভালো। মোটের ওপর সব দেখেশুনে খারাপ লাগল না এবং রাতারাতি নসিব খুলে যাওয়ার জন্যে অবাক হলাম খুবই। মি. ক্যারুথার্সের চমৎকার ব্যবহারের কথা আর কী বলব। এ ছাড়া গান-বাজনার ওপর তার অনুরাগও বড়ো কম ছিল না। প্রতিটি সন্ধে তাই ফুরফুরে প্রজাপতির মতো হাসিখুশি ডানা মেলে উড়ে যেতে লাগল আমার মনকে আনন্দের আভায় উজ্জ্বল করে দিয়ে। প্রত্যেক শনিবার শহরে আসতাম মাকে দেখবার জন্যে।

    আমার এ সুখের জীবনে প্রথম অশান্তির সূত্রপাত হল লাল-গুফো মি. উডলির ধূমকেতুর মতো আবির্ভাবে। লোকটা এসেছিল মাত্র মাসখানেক থাকার জন্যে। কিন্তু আমার কাছে এই একটি মাসই তিনমাসের মতো লম্বা মনে হয়েছে। শুধু পয়লা নম্বরের বজ্জাত বললে অল্প বলা হয়, অতি ভয়ংকর চরিত্রের লোক এই মি. উডলি। ইতরের মতো প্রত্যেকের সাথেই ব্যবহার কিন্তু, আমার কাছে সে ইতরের চাইতেও অধম। তার গা-ঘিনঘিনে প্রেম নিবেদন, টাকাপয়সার দম্ভ এবং তাকে বিয়ে করলে লন্ডনের সবচেয়ে সেরা হিরের উপহারের লোভনীয় প্রস্তাবেও যখন কাজ হল না, তখন একদিন ডিনারের পর আমাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে দিব্যি করে সে বললে তাকে চুমু না-খাওয়া পর্যন্ত রেহাই নেই আমার। কী আসুরিক শক্তি লোকটার গায়ে, ঠিক এই সময় মি. ক্যারুথার্স এসে না-পড়লে শেষ পর্যন্ত কী যে হত ভগবান জনেন। উনি এসেই আগে আমায় মুক্ত করলেন লোকটার ক্লেদাক্ত সাপের মতো বাহুপাশ থেকে, তারপর এক ঘুসিতে তাকে শুইয়ে দিলেন মেঝের ওপর। সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড। কিন্তু এই আসাই লোকটার যে শেষ আসা, তা নিশ্চয় বুঝেছেন। পরের দিন মাপ চাইলেন মি. ক্যারুথার্স। আর কোনোদিন যে এভাবে আমাকে লাঞ্ছিত হতে হবে না, সে-আশ্বাসও দিলেন। সেইদিন থেকে আর মি. উডলির শ্রীমুখ দেখিনি আমি।

    মি. হোমস, এবার আসা যাক আসল ব্যাপারে। অর্থাৎ যে-কারণে আপনার কাছে আসা পরামর্শের জন্যে। প্রথমেই বলি, প্রতি শনিবার দুপুর বারোটার আগেই সাইকেলে করে আমায় ফার্নহ্যাম স্টেশন আসতে হয়, বারোটা বাইশের ট্রেন ধরে আসার জন্যে। শিলটার্ন এ্যাঞ্জ থেকে স্টেশনে আসার পথটা বড়ো নির্জন। বিশেষ করে এক জায়গায় তো বলতে গেলে চব্বিশ ঘণ্টাই খাঁ খাঁ রাস্তাটা। শার্লিংটন হলের চারিদিক ঘিরে একটা জঙ্গল আছে। এই জঙ্গলের কিনারা থেকে শার্লিংটন হিথ পর্যন্ত মাঝের মাইলখানেক রাস্তায় দিনদুপুরেও জনপ্রাণীর সাড়া পাওয়া যায় না–এত নির্জন। কসবেরি হিল-এর কাছে হাইরোডে না-পৌঁছানো পর্যন্ত দু-একটা গাড়িঘোড়া কি চাষি-মজুরের দেখা পাওয়া সম্ভব নয়–এ-রকম ফাঁকা রাস্তা সচরাচর দেখা যায় না। হপ্তা দুয়েক আগে এই জায়গাটা দিয়ে যাওয়ার সময়ে হঠাৎ পেছনে তাকাতে দেখলাম প্রায় দু-শো গজ দূরে একটি লোককে তারও বাহন একটা দু-চাকার সাইকেল। লোকটার গালে কুচকুচে কালো ছোটো দাড়ি। বয়সের দিক দিয়ে না বুড়ো না জোয়ান বলেই মনে হল। ফার্নহ্যাম পৌঁছানোর আগে আর একবার পেছনে তাকিয়ে তাকে আর দেখতে পেলাম না, কাজেই এ-সম্বন্ধে আর কিছু ভাবিনি! কিন্তু মি. হোমস, আশ্চর্য হলাম তখনই যখন সোমবার ফেরার পথে একই লোককে দেখলাম একই রাস্তায় একই দ্বি-চক্রানে। বিস্ময় আরও বাড়ল যখন একই ব্যাপারটা ঠিক আগের মতোই ঘটল পরের শনিবারে আর সোমবারে। তার আর আমার মধ্যেকার ব্যবধানটা রেখে দিলে লোকটা। আমার উপর নির্যাতনেরও কোনো চেষ্টা করলে না, তবুও জানি কীরকম বেয়াড়া লাগল সমস্ত ঘটনাটা। মি. ক্যারুথার্সকে বললাম সব। আদ্যোপান্ত শুনে ভদ্রলোকের খুব আগ্রহ জেগেছে মনে হল। আমায় বললেন আমার কোনো আশঙ্কার কারণ নেই। কেননা, এ-রাস্তা দিয়ে যাতে আমাকে আর সঙ্গীহীন অবস্থায় না যেতে হয়, এজন্যে তিনি ইতিমধ্যে একটা ঘোড়ার গাড়ির অর্ডার দিয়েছেন।

    এই হপ্তাতেই ঘোড়ার গাড়ি এসে পৌঁছোনোর কথা। কিন্তু কী কারণে জানি না, তা এল। কাজেই, আবার সাইকেলে করে রওনা দিতে হল স্টেশনের দিকে। আমি কিন্তু আজ সকালের কথাই বলছি। শার্লিংটন হিথের কাছে এসে পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম। তাকাতেই চোখে পড়ল সেই লোকটাকে গত দুটো হপ্তায় যেভাবে তাকে দেখেছি, ঠিক সেইভাবে শ-দুয়েক গজের ব্যবধানে সাইকেল চালিয়ে পিছু নিয়েছে সে। দূরত্বটা সমান রেখেছিল যাতে ভালো করে তার মুখ না দেখতে পাই। কিন্তু লোকটা যে আমার চেনাজানা নয়, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। পরনে গাঢ় রঙের সুট, মাথায় কাপড়ের টুপি। কুচকুচে কালো দাড়িটা ছাড়া মুখের আর কিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না। আজকে আর তেমন ভয় পাইনি, উলটে কৌতূহল হল খুবই। ঠিক করলাম, লোকটা কে এবং কী তার অভিপ্রায়, তা আমায় জানতেই হবে যেনতেনপ্রকারেণ। গতি কমিয়ে আনলাম সাইকেলে, দেখলাম তার গতিও কমে এসেছে। থেমে গেলাম, সে-ও পেডাল ঘোরানো বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেল রাস্তার ওপর। ফাঁদটা পাতলাম তখনই। রাস্তাটা এক জায়গায় আচমকা মোড় নিয়েছে জানতাম। তিরবেগে সাইকেল চালিয়ে মোড়টা ঘুরেই থেমে গেলাম–প্রতীক্ষায় রইলাম দাড়িওয়ালা লোকটার। জানতাম, সে-ও তিরবেগে মোড় ঘুরেই আমাকে পেরিয়ে যাবে, থামবার অবসর পাবে না। কিন্তু আর টিকি দেখতে পেলাম না লোকটার। আবার ফিরে এলাম মোড় ঘুরে, মাইলখানেকের মতো রাস্তার মধ্যে লোকটার ছায়াও দেখতে পেলাম না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানেন, আমি যে-জায়গাটার কথা বলছি, সেখানে রাস্তাটা দু-পাশে কোনো শাখাপ্রশাখা না-রেখে লম্বালম্বি এসে মোড় নিয়েছে। কাজেই, তার ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যাওয়া দেখে আমার তখনকার অবস্থাটা আপনি খানিকটা অনুমান করতে পারবেন মি. হোমস।

    নিঃশব্দে একচোট হেসে নিয়ে দু-হাত ঘষতে ঘষতে বলল হোমস, কেসটায় বেশ কিছু ভাবনার খোরাক আছে দেখছি। প্রথমবার মোড় ঘোরার পর থেকে, লোকটা উধাও হয়ে গেছে। দেখার আগে পর্যন্ত ব্যবধানটা কত মিনিটের বলুন তো?

    মিনিট দু-তিন তো বটেই।

    মিনিট দু-তিনের মধ্যে তো লোকটার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া সড়কটার দু-পাশে অন্য কোনো রাস্তাও নেই, তাই না?

    না।

    তাহলে যেকোনো একদিকের পায়ে-চলা রাস্তায় নেমে পড়াই স্বাভাবিক।

    না তা সম্ভব নয়। শার্লিংটন হিথ-এর পাশে সে যেখানেই ঘাপটি মেরে থাকুক না কেন, আমার চোখ এড়াত না।

    তাহলে, বাদসাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত রইল শুধু একটাই এবং তা হচ্ছে এই শার্লিংটন হল যদি রাস্তার আর এক প্রান্তে হয়, তাহলে সেদিকেই সটকেছে লোকটা। আর কিছু বলবেন নাকি?

    না, মি. হোমস। দিনদুপুরে ওই কাণ্ড দেখে আমি এমনই ঘাবড়ে গেলাম যে মনে হল সিধে আপনার কাছে এসে আপনার পরামর্শ না-নেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাব না মনে। তাই—।

    কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইল হোমস।

    তারপর শুধাল, যে-ভদ্রলোকের সাথে আপনার বিয়ের সম্বন্ধ পাকাঁপাকি হয়ে রয়েছে, তিনি থাকেন কোথায়?

    কভেনট্রিতে মিডল্যান্ড ইলেকট্রিক কোম্পানিতে কাজ করে ও।

    আচমকা দেখা দিয়ে আপনাকে চমকে দেওয়ার মতলব নেই তো তার?

    মি. হোমস, আপনি তাঁকে চেনেন না!

    আপনার আর কোনো স্তাবক আছে নাকি?

    সিরিলের সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে কয়েকজন ছিল।

    তারপর?

    তারপর ধরুন, এই উডলি নামধারী বিকট লোকটা অবশ্য ওকে স্তাবক শ্রেণিতে ফেলবে কি না, সে-বিচার আপনার।

    আর কেউ?

    আমতা আমতা করতে থাকে মিস স্মিথ।

    কে সে? শুধাল হোমস।

    আমার মনের ভুল হতে পারে মি. হোমস, কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন জানি মনে হয়েছে মি. ক্যারুথার্স আমার সম্বন্ধে একটু বেশি রকমের সচেতন। একই বাড়িতে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর বাজনা-টাজনাগুলো আমিই বাজাই। মুখ ফুটে কোনোদিনই কিছু বলেননি। সেদিক দিয়ে উনি নিখুঁত ভদ্রলোক। কিন্তু মেয়েদের মন তো, ধুলো দেওয়া বড়ো কঠিন।

    হ্যাঁ! গম্ভীর হয়ে উঠল হোমস। ভদ্রলোকের কাজ কারবার কী?

    খুব বড়োলোক বলেই জানি। গাড়িঘোড়া তো নেই?

    না-থাকলেও খুব সচ্ছল অবস্থা। হপ্তায় দু-দিন উনি শহরে যান। দক্ষিণ আফ্রিকায় সোনার শেয়ার নিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন বললেই চলে।

    মিস স্মিথ, নতুন কিছু ঘটলেই আমাকে জানাবেন। আপাতত আমি খুবই ব্যস্ত, তবুও কথা দিচ্ছি আপনার কেসটা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় আমার হবে। ইতিমধ্যে আমাকে–জানিয়ে হট করে কিছু করে বসবেন না যেন। গুড বাই, সুখবর শোনার আশায় রইলাম।

    মিস স্মিথের পায়ের শব্দ সিঁড়িতে মিলোনোর আগেই হারিয়ে যাওয়া চিন্তার খেই ধরতেই যেন পাইপটার দিকে হাত বাড়িয়ে হোমস বললে, কেসটার কতকগুলো পয়েন্ট আর ইঙ্গিত লক্ষ করার মতো।

    একটা পয়েন্ট আমিও লক্ষ করেছি। একই জায়গায় বার বার রোডসাইড রোমিয়ে দেখা দিচ্ছে কেন, এই তো?

    এগজ্যাক্টলি। যাক, প্রথমেই আমাদের জানা দরকার, শার্লিংটন হল-এর বাসিন্দারা কারা, তারপর মি. ক্যারুথার্স আর উডলির আচারব্যবহার দেখে বোঝা যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ দুজনে। তাই যদি হয় তাহলে ওদের মধ্যকার আসল সম্পর্কটাই-বা কী, আর রালফ স্মিথের আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেওয়ার বেলায় ওদের দুজনেরই-বা এত আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। কেন? আর একটা পয়েন্ট। দ্বিগুণ বেতন দিয়ে যিনি গভর্নেস নিয়ে আসেন বাড়িতে, বাড়ি থেকে দু-মাইল দূরের স্টেশনে যাতায়াত করার জন্যে তিনি গাড়িঘোড়া রাখেন না এ কেমনতরো ব্যবস্থা, ওয়াটসন? সত্যিই, কীরকম খাপছাড়া লাগছে, তাই না?

    তুমি যাবে নাকি?

    না হে না, গেলে তোমাকেই যেতে হবে। এসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমি আমার মূল্যবান গবেষণার ব্যাঘাত করতে চাই না। সোমবার সকাল সকাল ফার্নহ্যামে পৌঁছে শার্লিংটন হিথ-এর কাছাকাছি কোথাও ঘাপটি মেরে বসে থাকবে।

    সোমবার সকালে ফার্নহ্যাম স্টেশনে নেমে শার্লিংটন হিথ খুঁজে বার করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। মিস স্মিথের শনি-সোমবারের অ্যাডভেঞ্চারের সিনটি দেখলে ভুল হওয়া অসম্ভব।

    এমন জায়গায় দাঁড়ালাম, য়াতে হলের দু-দিকের তোরণ ছাড়াও দু-পাশে প্রসারিত রাস্তার বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। এতক্ষণ জনপ্রাণীর সাড়া ছিল না রাস্তায়। আমি ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতেই যেদিক দিয়ে এসেছি, তার উলটো দিকের রাস্তায় দেখলাম একটা চলন্ত সাইকেল। সাইকেলটা আসছে আমার দিকেই। চালকের পরনে কুচকুচে কালো সুট, একগাল কালো দাড়িও চোখে পড়ল। শার্লিংটন জমির শেষাশেষি এসে লাফিয়ে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল কৃষ্ণবেশ সাইক্লিস্ট। সাইকেলটাকে টেনে নিয়ে ঝোঁপের একটা ফাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

    মিনিট পনেরো চুপচাপ। তারপরেই দেখা গেল আর একটা সাইকেল। স্টেশনের দিক থেকে আসছে মিস স্মিথ।

    এদিকে সেদিকে তাকাতে তাকাতে শালিংটন ঝোপ-এর কাছাকাছি আসতেই লুকোনো জায়গা থেকে কৃষ্ণবেশ লোকটা চট করে বাইরে বেরিয়ে এসে লাফিয়ে উঠল সাইকেলের ওপর এবং শুরু হল মিস স্মিথের পিছু নেওয়া। ধু-ধু মাঠের মধ্যে ফিতের মতো রাস্তার ওপর চোখে পড়ল শুধু এই দৃশ্যই। ধাবমান দুটি মূর্তি। রানির মতো মাথা তুলে সিটের ওপর সিধে হয়ে বসে মিস স্মিথ, আর তার পেছনে হ্যান্ডেলবারের ওপর একটু ঝুঁকে পড়ে কালো সুট পরা রহস্যময় লোকটা–হাবভাব তার বিচিত্র, ঠিক যেন চোরের মতো। পেছন ফিরে একবার তাকাল মিস স্মিথ, তাকিয়ে স্পিড কমিয়ে দিল। সঙ্গেসঙ্গে পেছনের সাইকেলেরও স্পিড কমল। দাঁড়িয়ে গেল মিস স্মিথ। কালোদাড়িও ব্রেক কষে দাঁড়াল মাঝখানে রইল অন্ততপক্ষে শ-দুই গজের ব্যবধান। এরপরেই মিস স্মিথ যা করল তা যেমনই অপ্রত্যাশিত, তেমনই চমকপ্রদ। সাহসের বলিহারি যাই মেয়েটার। আচমকা সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে তিরবেগে লোকটার দিকে ছুটে এল সে। কালোদাড়িও কম চটপটে নয়। চোখের পলক ফেলার আগেই সে-ও সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে বোঁ বোঁ করে ছুটল যেদিক থেকে আসছিল সেইদিকে। পড়ি কি মরি করে সে পালানোর দৃশ্য দেখার মতোই বটে। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য আবার ফিরে এল মিস স্মিথ। এবার পেছনকার নীরব সঙ্গীকে উপেক্ষা করে সিধে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। তার সিধে হয়ে সামনের দিকে তাকানোর ভঙ্গিমা দেখে মনে হল, দম্ভ ওই মেয়েকেই মানায় বটে। লোকটাও ছিনেজোঁকের মতো আবার পিছু পিছু আসছিল–মাঝখানের ব্যবধান সেই দু-শো গজ! তারপর পথের বাঁকে দুজনেই হারিয়ে গেল আমার চোখের সামনে থেকে।

    আমি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে না পড়ে তখনও ঘাপটি মেরে রইলাম আমার লুকোনো জায়গায়। থেকে ভালোই করেছিলাম। কেননা, কিছুক্ষণের মধ্যে দেখলাম আস্তে আস্তে ফিরে আসছে লোকটা। হল-এর তোরণের দিকে মোড় নিয়ে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল সে। গাছপালার ফাঁকে তাকে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। দু-হাত তুলে বোধ হয় নেকটাই ঠিক করছিল। তারপর আবার সাইকেল চালিয়ে হলের দিকে চলে গেল সে। আমি গাছগাছড়া গুল্মের মধ্য দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে উঁকি দিলাম সেদিকে। অনেক দূরে দেখতে পেলাম ধোঁয়া ধোঁয়া রঙের অনেক পুরোনো বাড়ি, অনেক উঁচু পর্যন্ত ঠেলে উঠেছিল টিউডর চিমনিগুলো; কিন্তু রাস্তাটা এমন একটা ঘন ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে যে গেছে লোকটার টিকিও আর দেখতে পেলাম না।

    না পেলাম, কিন্তু বলতে নেই কাজটা আমার বৃথা যায়নি। কাজ হয়েছে যথেষ্ট, সুতরাং বেশ খুশি খুশি মনে হাঁটা দিলাম ফার্নহ্যামের দিকে। লোক্যাল হাউস-এজেন্ট শার্লিংটন হল সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গ খবর দিতে পারল না আমায়, তবে পল-মলের একটা নাম করা ফার্মের রেফারেন্স দিলে। বাড়ি আসার পথে সেখানে ঢু মেরে এলাম। রিপ্রেজেন্টেটিভের কাছে শুনলাম, এ-গরমে আর শার্লিংটন হল পাওয়া সম্ভব নয়। বড়ো দেরি হয়ে গেছে। মাসখানেক আগে মি. উইলিয়ামসন নামে এক ভদ্রলোক ভাড়া নিয়েছেন বাড়িটা। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে এবং চেহারা দেখলে হেঁজিপেজি বলেও মনে হয় না। এজেন্ট-ভদ্রলোকের বিনয় মাটি স্পর্শ করে বটে, কিন্তু এর বেশি আর কিছু সে বলতে রাজি হল না। কেননা, মি. উইলিয়ামসনের সব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা তার শোভা পায় না।

    সেদিন সন্ধ্যায় আমার সুদীর্ঘ রিপোর্ট পেশ করলাম মি. শার্লক হোমসের কাছে। কান খাড়া করে সব শুনল হোমস। আশা করেছিলাম, ছোটোখাটো দু-একটা শাবাশ কি বাহবা, অথবা ব্র্যাভো, মাই ডিয়ার ওয়াটসন–এ-রকম জাতীয় কিছু কিছু প্রশংসা শুনতে পাব ওর মুখ থেকে। কিন্তু সেসবের ধার দিয়েও গেল না হোমস। উলটে ওর রসকষহীন মুখ আরও বেশি কঠোর হয়ে উঠতে লাগল আমার বর্ণনার তালে তালে এবং আমি যা করেছি আর যা করিনি, তার ওপর এমন চোখা চোখা মন্তব্য ছাড়তে শুরু করলে যে কহতব্য নয়।

    মাই ডিয়ার ওয়াটসন, তোমার লুকোনো জায়গা নির্বাচনই ভুল হয়েছে। ঝোঁপের পেছনে থাকা উচিত ছিল না তোমার; তাতে লোকটাকে কাছ থেকে ভালো করে দেখতে পেতে। বেশ কয়েকশো গজ দূর থেকে যা দেখছ, মিস স্মিথ দেখেছে তার থেকেও অনেক বেশি–সুতরাং তোমার রিপোর্টে বেশি তথ্যের আশা করা অন্যায়। মিস স্মিথের ধারণা লোকটাকে সে চেনে না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে চেনে। তা না হলে লোকটা অমন মরিয়া হয়ে পালাবার চেষ্টা করবে কেন? পাছে, মেয়েটা তার কাছাকাছি এসে তাকে চিনে ফেলে, ভয় সেটাই, তাই না? লোকটা হ্যান্ডেল বারের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল বললে। তাহলেই দেখ, এখানেও নিজের মুখ আড়াল করবার প্রচেষ্টা। বাস্তবিকই ওয়াটসন, যাচ্ছেতাই রকমের বাজে কাজ করে এসেছ তুমি। লোকটা বাড়ির দিকে ফিরে যেতেই তোমার খেয়াল হল লোকটার পরিচয় জানার। আর, তাই তুমি এলে লন্ডন হাউস-এজেন্টের কাছে!

    একটু গরম হয়ে উঠি আমি, তা ছাড়া আমার কী করার ছিল শুনি?

    কাছাকাছি কোনো পাবলিক-হাউসে যাওয়া। গাঁ অঞ্চলে সবরকম মুখরোচক আলোচনার কেন্দ্র হল পাবলিক হাউস।

    পরের দিন সকালে মিস স্মিথের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। আমি যা যা দেখেছি তারই সংক্ষিপ্ত অথচ নির্ভুল বর্ণনা ছিল চিঠিতে! কিন্তু রিপোর্টের সারাংশ তাতে নেই, ছিল তলাকার ছোট্ট পুনশ্চতে :

    মি, হোমস, অকপটে সব কথা আপনাকে খুলে লিখছি এবং আমার বিশ্বাস এদিক দিয়ে আপনার ওপর আমার অগাধ আস্থা কোনোদিনই ক্ষুণ্ণ হবে না। এখানে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠছে না। মি. ক্যারুথার্স বিয়ের প্রস্তাব করেছেন। আমার প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা যে সত্যই নিখাদ সে-বিষয়ে আমার তিলমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি যে বাগদত্তা। আমার প্রত্যাখ্যান খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছেন মি. ক্যারুথার্স, কিন্তু কোনোরকম উচ্ছ্বাস বা উত্তেজনা দেখাননি। খুব ভদ্রভাবে শুনেছেন আমার বক্তব্য। বুঝতেই পারছেন, এরপর থেকে পরিস্থিতি বড়ো জটিল হয়ে উঠেছে।

    চিঠি পড়া শেষ হলে চিন্তাঘন চোখে হোমস বললে, আমাদের ইয়ং ফ্রেন্ড দেখছি ক্রমশই গভীর জলে তলিয়ে যাচ্ছে। না হে, আমার একটু গাঁয়ে যাওয়া দরকার। আজই বিকেলে রওনা হয়ে ছায়াঢাকা পাখিডাকা সুনিবিড় শান্তির নীড় গাঁয়ের হাওয়া খাওয়ার সাথে সাথে আগে থেকেই ভেবে রাখা দু-একটা থিয়োরিও পরখ করে দেখতে হবে।

    ছায়াঢাকা পাখিডাকা সুনিবিড় শান্তির নীড়ে হোমসের অভিযান যে শান্তিময় হয়নি, তা ওকে দেখামাত্র বুঝলাম। রাত করে বাড়ি ফিরল ও। এক ঠোঁট কাটা, কপালের ওপর একটা বিরাট ঢিপি। তা ছাড়া, চেহারাময় এমন একটা উঞ্ছ ঞ্ছ ভাব যে ওকে দেখামাত্র স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড উল্লসিত হয়ে উঠত একটা তদন্তের সুযোগ পাওয়া গেছে ভেবে। হোমস কিন্তু এই আজব অ্যাডভেঞ্চারে বিলক্ষণ পুলকিত। সব কথা বলতে বলতে কতবার যে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল তার আর ইয়ত্তা নেই।

    তোমাকে আগেই বলেছিলাম, পাড়া-গাঁ অঞ্চলে পাঁচজনে বসে আড্ডা মারে এমন জায়গা খুঁজে বার করতে। ফার্নহ্যামে নেমে এ-রকম জায়গা বার করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না আমায়। মদের আড্ডায় গিয়ে বসতে যে-লোকটার সঙ্গে আলাপ হল তার আবার কিছু নিজস্ব জায়গাজমি বাড়ি ঘরদোর আছে। একটু বেশি বকা স্বভাব লোকটার। কাজেই যা চাইছিলাম, সবই শুনলাম তার কাছে। উইলিয়ামসন লোকটার সাদারঙের একগাল দাড়ি আছে, সামান্য কয়েকটা চাকরবাকর নিয়ে শার্লিংটন হল-এ একলাই থাকেন ভদ্রলোক। গুজব, ভদ্রলোক এককালে পাদরি ছিলেন অথবা এখনও আছেন। কিন্তু হল-এ থাকতে থাকতে তাঁর কীর্তিকলাপের দু-একটা নমুনা যা শুনলাম, তা জপতপ ধর্মকর্ম যাঁর কাজ, তাঁর পক্ষে শোভা পায় না। ক্লারিক্যাল এজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে জানলাম এরকম একটা নাম তাদের অর্ডারেও এককালে ছিল। কিন্তু লোকটার কাজকর্মের রেকর্ড অতি জঘন্য, শোনার মতো নয়। বাচাল লোকটার পেট থেকে আরও কথা বার করে নিলাম। প্রতি হপ্তায় শনি রোববার নাগাদ অনেকের আগমন ঘটে শার্লিংটন হল-এ। বিশেষ করে একজনের কথাই বললেন ভদ্রলোক। লোকটার নাম মি. উডলি, লাল লাল গোঁফ অনেকদিন পর্যন্ত তাকে, একনাগাড়ে হল-এ থাকতে দেখা গেছে। ঠিক এই সময়ে হল বিপত্তি। যার সম্বন্ধে এত কথা, সেই মি. উডলি যে স্বয়ং পাশের ঘরে পিপে থেকে গড়িয়ে বিয়ার খাচ্ছিল, তা কি আর আমি জানি ছাই। শুধু মদ্যপানই করেনি, আড়ি পেতে আমাদের সব কথাই শুনেছে। কথার মাঝেই গট গট করে ঢুকেই শুরু হল অশ্রাব্য গালিগালাজের সঙ্গে অজস্র প্রশ্নবাণ! কে আমি? কী আমার অভিপ্রায়? এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেসা করার মানে কী? কথাবার্তা বেশ বলে লোকটা। সে কী বচনের তোড়! বিশেষণগুলোও বড়ো চোখাচোখা। বৃষ্টির মতো গালিবর্ষণ শেষ হল মোক্ষম একটা ঘুসি ঝেড়ে। পেছন দিক দিয়ে হাত ঘুরিয়ে তার মারখানা দেখার মতো। বরাত মন্দ, ঘুসিটা একেবারে এড়িয়ে যেতে পারলাম না। তার পরের মিনিট ক-টা কিন্তু অতি উপাদেয়। বাঁ-হাতের সিধে মার, ওই একবারই। পাকা বদমাশ হলে কী হবে, মি. উডলিকে বাড়ি। যেতে হল গাড়িতে! আর আমার অবস্থাটা তো দেখছই! গায়ের অভিযান শেষ হল বটে, তবে স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সময়টা ভালো কাটালেও লাভ বিশেষ কিছু হয়নি। সারে বর্ডার থেকে তুমি যা জেনেছ, তার থেকে এমন কিছু বেশি জানিনি আমি।

    বেস্পতিবার আর একটা চিঠি পেলাম মিস স্মিথের কাছ থেকে।

    মি. হোমস, শুনে নিশ্চয় খুব বেশি অবাক হবেন না–আমি মি. ক্যারুথার্সের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। মুঠো মুঠো টাকা মাইনে দিলেও এ-রকম অস্বচ্ছন্দ আবহাওয়ার মধ্যে এত আড়ষ্টভাবে আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব নয়। শনিবার শহরে আসছি এবং আর ফেরার ইচ্ছে নেই। মি. ক্যারুথার্স গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন। কাজেই ফাঁকা রাস্তায় বিপদের আশঙ্কা আর নেই। সত্যিকারের বিপদ-আপদ কোনোকালে ছিল কি না তা অবিশ্যি আমার জানা নেই।

    শুধু মি. ক্যারুথার্সের সঙ্গে মন কষাকষি হওয়ার জন্যেই চাকরি আমি ছাড়ছি না, আরও একটা বিশেষ কারণ আছে। মি. উডলি নামে ন্যক্কারজনক লোকটা আবার দেখছি এসে জুটেছে। জন্ম থেকেই লোকটাকে দেখতে যেমন কুৎসিত, তেমনি ভয়ংকর। কিন্তু ইদানীং দেখছি ওর এই বীভৎস রূপ আরও খোলতাই হয়েছে। নিশ্চয় কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল লোকটার, মুখের আদলটাই পালটে গেছে মনে হল, চেনা মুশকিল। জানলায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ দেখলাম মি. ক্যারুথার্সের সঙ্গে খুবই উত্তেজিতভাবে হাতমুখ নেড়ে কথা বলছে সে। অনেকক্ষণ ধরে কথা হল দুজনের, শেষকালে যেন মি, ক্যারুথার্সও বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন মনে হল।

    গম্ভীরভাবে হোমস বলল, ওয়াটসন, যা ভয় করেছিলাম তাই। মেয়েটাকে ঘিরে একটা গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছে আমাদের কর্তব্য এখন শেষবারের মতো স্টেশন আসার সময়ে বেচারির ওপর কেউ যেন উৎপাত না-করে তা দেখা। ভায়া, আগামী শনিবার সকালে আমরা দুজনেই রওনা হচ্ছি। এ-রকম একটা আশ্চর্য অথচ অসম্পূর্ণ তদন্তের পরিশেষটা আর যাই হোক, অবাঞ্ছিত যাতে না হয়, তা তো আমাদের দেখা দরকার।

    বালি ঢাকা চওড়া রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আমি আর হোমস বুক ভরে সকালের তাজা বাতাস নিয়ে পাখি পাখালির মিষ্টি গান শুনতে শুনতে বসন্তের ছোঁয়া অনুভব করলাম দেহের অণু-পরমাণুতে।কসবেরি হিল-এর কাছের রাস্তাটা একটু ওপরদিকে উঠে গেছিল, এইখান থেকে চোখে পড়ল লম্বা লম্বা পুরোনো ওকগাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে কালো কুটিল চেহারার শার্লিংটন হল। ওক গাছগুলো তো পুরোনো বটেই, কিন্তু তাদের থেকেও আরও বেশি স্থবির মনে হচ্ছিল হলটাকে, যার প্রতিটি ইটে প্রতিটি পাথরে অগুনতি বছরের অনেক ইতিহাস লেখা! সবুজ গাছপালা আর বাদামি রঙের ঝোপঝাড়ের মাঝখানকার লালচে হলদে ফিতের মতো সুদীর্ঘ পথটা আঙুল দিয়ে দেখাল হোমস। অনেক দূরে দেখলাম ছোট্ট একটা কালো ফুটকি একটা গাড়ি। আসছে আমাদের দিকেই। দেখেই অসহিষ্ণুভাবে এই যা বলে চিৎকার করে উঠল হোমস।

    আধঘণ্টার মতো সময় হাতে রেখেছিলাম। কিন্তু ও-গাড়ি যদি মিস স্মিথের হয়, তাহলে তো দেখছি অনেক সকাল সকালই বেরিয়ে পড়েছে সে আগের ট্রেনটা ধরার আশায়। ওয়াটসন, শার্লিংটনে ওর সঙ্গে দেখা হবে বলে মনে হয় না আমার–আমরা পৌঁছোনোর আগেই শার্লিংটন পেরিয়ে যাবে ওর গাড়ি।

    চড়াইটা পেরিয়ে আসার পর থেকেই গাড়িটা আর দেখতে পাচ্ছিলাম না বটে, কিন্তু গতিবেগ আমাদের এমনই বেড়ে গেল যে আমার মতো কুঁড়ে মানুষের, চব্বিশ ঘণ্টাই যার হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকা কাজ, আত্মারাম তো খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। বলাবাহুল্য, পিছিয়ে পড়লাম। আমি। হোমসের কথা আলাদা। প্রথমত এ-রকম দৌড়ঝাঁপ করার ঝামেলা তো তাকে বলতে গেলে বারোমাসই পোহাতে হয়, তা ছাড়া ওর ওই অফুরন্ত নার্ভাস এনার্জির ভাণ্ডার ভাঙিয়ে যেভাবে খুশি যতক্ষণ খুশি নিজের উদ্যমশক্তিকে জিইয়ে রাখতে পারে ও। কাজেই তার ক্যাঙারুর মতো লাফিয়ে চলার এতটুকু মন্দগতি দেখা গেল না। আমাদের মধ্যকার ব্যবধান তখন প্রায় শ-খানেক গজ, আচমকা স্তব্ধ হল ওর ক্যাঙারু লাফ। মুহূর্তেই দু-হাত শূন্যে ছুঁড়ে এমন ভাব করলে যেন নিরাশায় দুঃখে নিঃশেষ হয়ে গেল ও। ঠিক সেই মুহূর্তে পথের বাঁকে দেখা গেল দু-চাকার একটা ঘোড়ার গাড়ি। কদম চালে মোড় ঘুরেই গড় গড় ঝন ঝন শব্দে তির বেগে গাড়িটা ধেয়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে।

    দৌড়োতে দৌড়োতে চিৎকার করে উঠল হোমস, ইস, ভীষণ দেরি হয়ে গেছে, ওয়াটসন, দারুণ দেরি করে ফেলেছি আমরা। আমিও ততক্ষণে হাপরের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়োচ্ছি ওর পাশে পাশে।গাধা, বোকা গাধা আমি, আগের ট্রেনের জন্যে তৈরি হয়ে আসা উচিত ছিল আমার। মেয়েটাকে ওরা গুম করল, ওয়াটসন–গুম করল! খুনও করতে পারে! ভগবান জানেন কী ওদের মর্জি! রাস্তা জুড়ে দাঁড়াও! থামিয়ে দাও ঘোড়াটাকে। ঠিক আছে, উঠে পড়ো, চটপট! দেখা যাক এবার আমার কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করা যায় কি না।

    লাফ মেরে গাড়িটায় দুজনে উঠে পড়ার পর হোমস লাগাম ধরে মুখ ঘুরিয়ে দিলে ঘোড়ার তারপরেই শন করে বাতাস কেটে চাবুকের এক ঘা। যেন উড়ে চললাম আমরা। বাঁকটা ফেরার সঙ্গেসঙ্গে শার্লিংটন হল আর ঝোঁপের মধ্যেকার সুদীর্ঘ রাস্তাটা ভেসে উঠল চোখের সামনে।

    সজোরে হোমসের হাত আঁকড়ে ফিসফিসিয়ে উঠলাম, হোমস, এই সেই লোক।

    থামুন! সাইকেলটা টেনে এনে আমাদের রাস্তা বন্ধ করে চিৎকার করে উঠল লোকটা।

    আমার কোলে লাগামটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ল হোমস।

    আপনাকেই খুঁজছিলাম। মিস ভায়োলেট স্মিথ কোথায়? দ্রুত অথচ পরিষ্কার গলায় বলে গেল হোমস।

    আমিও তাই জিজ্ঞেস করছি আপনাকে। তারই গাড়ি হাঁকিয়ে এলেন আর জানেন না সে কোথায়?

    এদিকে আসতে আসতে রাস্তায় চোখে পড়ল গাড়িটা ফাঁকা, কাউকে ভেতরে দেখিনি। মিস স্মিথ বিপদে পড়েছেন ভেবে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে এলাম এদিকে।

    হে ভগবান! হে ভগবান, এ কী হল, কী করি আমি এখন? হতাশায় একেবারে যেন খুঁড়িয়ে ভেঙে গেল দাড়িওলা আগন্তুক। শেষ পর্যন্ত ওই কুত্তা উডলি আর পাজির পাঝাড়া গাঁইয়া পাদরিটার খপ্পরেই পড়ল মেয়েটা। আসুন, আসুন, সত্যিই যদি ওর বন্ধু হয়ে থাকেন আপনারা তাহলে চলে আসুন আমার পেছনে পেছনে। আমার পাশটিতে শুধু থাকুন, যেভাবেই হোক, বাঁচাব ওকে। তাতে যদি শার্লিংটন-এর বনে লাশও পড়ে থাকে, এ-শর্মা পেছোবে না।

    উদ্ভ্রান্তের মতো এক হাতে পিস্তল নিয়ে ঝোঁপের মাঝে একটা ফাঁকের দিকে দৌড়াল লোকটা। হোমস তার পিছু নিল, আমিও ঘোড়াটাকে ঘাস খাওয়ার সুযোগ দিয়ে লেগে রইলাম তার পেছনে। কাদা-চটচটে রাস্তার ওপর কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখিয়ে হোমস বললে, এই তো, এই পথেই ওরা এসেছে দেখছি। আরে আরে এ কী! দাঁড়ান, দাঁড়ান, এক মিনিট দাঁড়িয়ে যান। ঝোঁপের মধ্যে এ কে? বছর সতেরো বয়সের একটা ছোকরা রক্তাক্ত মুখে পড়েছিল ঝোঁপের মাঝে।

    আগন্তুক উত্তেজিতভাবে বললেন, এ যে দেখছি পিটার! এই ছোকরাই তো মিস স্মিথের গাড়ি চালিয়ে আনল এইমাত্র। জানোয়ারগুলো ওকে শুধু টেনেই নামায়নি, ডান্ডার ঘায়ে সাংঘাতিক জখমও করেছে দেখছি। বেচারি, কিন্তু ওকে এখন এইভাবেই ফেলে রেখে যেতে হবে। আমরা ওর পাশে থেকেও তো এখন কিছু করতে পারছি না। মেয়েটাকে আমাদের বাঁচাতেই হবে, নারীজীবনের চরমতম দুর্ভাগ্যের হাত থেকে যেভাবেই হোক তাকে রক্ষা করতে হবে।

    গাছপালার ফাঁক দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে ক্ষিপ্তের মতো দৌড়াতে লাগলাম আমরা। চারদিক ঘেরা বাগানের কাছাকাছি গিয়ে হোমস দাঁড়িয়ে গেল।

    বাড়ির দিকে ওরা যায়নি। এই তো বাঁ-দিকে পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে এই যে এদিকে, লরেল ঝোঁপের পাশে। ওই শোন, ওই শোন, যা ভয় করেছিলাম! আচম্বিতে আকাশ বাতাস ফালা ফালা হয়ে গেল এক আতীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকারে, নিঃসীম বিভীষিকায় যেন রিনঝিন করে উঠল সে-চিৎকার। শব্দটা এল আমাদের সামনেই ফুলে ফুলে ঢাকা ঘন সবুজ ঝোঁপের ভেতর থেকে। কেঁপে কেঁপে উঠছিল চিৎকারটা। তারপরেই আচমকা সব চুপ হয়ে গেল, শুধু শুনলাম গলার মধ্যকার চাপা ঘড় ঘড় শব্দ, যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার।

    এদিকে! এদিকে! খেলার মাঠে আছে ওরা! চেঁচাতে চেঁচাতে ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে পাগলা হাতির মতো ছুটে গেল আগন্তুক।কাপুরুষ কুকুর কোথাকার! পেছনে আসুন, আপনারা আমার পেছনেই থাকুন! ওঃ, বড়ো দেরি হয়ে গেছে, বড়ো দেরি হয়ে গেছে! হায়, এ কী হল!

    আচম্বিতে শেষ হয়ে গেল ঝোপঝাড়ের বাধা, এসে পড়লাম ভেলভেটের মতো নরম সবুজ ঘাসের আস্তরণ বিছানো একটুকরো খোলা জমির ওপর। সবুজ আয়নার মতো টুকরো জমিটার চারপাশে বড়ো বড়ো বহু পুরোনো ওক গাছের সারি। জমির ওদিকের প্রান্তে দৈত্যের মতো বিরাট একটা ওকগাছের ছায়ায় তিনজন লোকের ছোট্ট একটি দল দাঁড়িয়ে। তিনজনের মধ্যে একটা মেয়ে মিস স্মিথ, সামনের দিকে মাথা ঝুলে পড়েছিল তার এবং মনে হল জ্ঞান নেই। রুমাল দিয়ে মুখটাও বাঁধা দেখলাম। উলটোদিকে দাঁড়িয়ে পাশবিক চেহারার হোঁতকামুখখা লাল-গুফো একজন জোয়ান। বোম লাগানো চামড়ার গেইটার পরা, দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে সে, এক হাত কোমরে, আর এক হাতে দুলছে একটা ঘোড়ার চাবুক। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তার দেহের প্রতিটি অংশে ভাবে ভঙ্গিমায় নিষ্ঠুর বিজয়োল্লাস, অপরিসীম ঔদ্ধত্য যেন লিকলিকে চাবুকের মতোই হিল হিল করে উঠছিল। ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে আর একজন পুরুষ। লোকটার বয়স হয়েছে। ধোঁয়াটে রঙের একগাল দাড়ি, হালকা টুইড সুটের ওপর ধবধবে সাদা খাটো আলখাল্লা। মাঠের কিনারায় আমরা দেখা দিতেই প্রার্থনার বইটা এমনভাবে সে পকেটে পুরল যেন এইমাত্র বরকনের বিয়ে সাঙ্গ হল। তারপর মহাফুর্তিতে ক্রূর-প্রকৃতি বরবাবাজির পিঠ চাপড়ে অভিনন্দন জানাতেও ভুল করল না।

    রুদ্ধশ্বাসে বললাম আমি, বিয়ে হয়ে গেল ওদের!

    আমাদের গাইড শুধু বললে, চলে আসুন! চলে আসুন!

    বলতে বলতে সবুজ ঘাসজমির ওপর দিয়ে উল্কা বেগে সে ধেয়ে গেল সামনের দিকে। পেছনে আঠার মতো লেগে রইলাম হোমস আর আমি। ছুটতে ছুটতে দেখলাম মিস স্মিথ টলমলিয়ে উঠে গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে সামলে নিলে নিজেকে। ততক্ষণে আর আমার বুঝতে বাকি নেই যে সাদা আলখাল্লা পরা ধোঁয়াটে দাড়ি আধবুড়ো লোকটাই উইলিয়ামসন–এককালে কিছু সময়ের জন্যে পাদরিগিরিও সে করেছে। আমাদের দেখেই শ্লেষভরে বিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখাল সে বাতাসে মাথা ঠুকে বো করে। ইতর চেহারার উডলি লোকটাও মাঠবন কাঁপিয়ে অট্টহাস্য করে উঠল জানোয়ারের মতো। এ-হাসি শুধু বিদ্রুপের নয়, বিজয়োল্লাসের। হাসতে হাসতে চাবুক দোলাতে দোলাতে সে এগিয়ে এল আমাদের পানে।

    বলল, ওহে বব, তোমার দাড়িটা এবার সরিয়ে নাও। তোমাকে যখন আমি হাড়েহাড়েই চিনি, তখন ও-জিনিসটা রেখে আর হাসিয়ো না আমাকে। যাই হোক, সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ঠিক সময়ে এসে পড়েছ দেখছি। এসো, মিসেস উডলির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই তোমাদের। এ-কথার উত্তর আমাদের গাইড যেভাবে দিলে তাতে তাক লেগে গেল আমার। পলক ফেলার আগেই ছদ্মবেশ খসিয়ে ফেলল সে। এক হ্যাচকা টানে কয়লা কালো কুচকুচে দাড়ির বোঝা সরিয়ে নিতেই বেরিয়ে পড়ল পরিষ্কার দাড়িগোঁফ কামানো পাঙাশপানা লম্বাটে ধরনের একটি মুখ। দাড়িটা মাঠের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রিভলভার তুলে এবার লক্ষ করলে গোয়ার জাহবাজকে–কেউটে সাপের মতো হাতের ঘোড়ার চাবুকটা দোলাতে দোলাতে বিপজ্জনকভাবে যে তখনও এগিয়ে আসছিল আমাদের পানে।

    আমাদের দোস্ত বলল, হ্যাঁ, আমিই বব ক্যারুথার্স। আর মেয়েটিকে যেভাবেই হোক উদ্ধার করব আমি। সেজন্যে এমন কিছুই নেই এ-দুনিয়ায় যা আমি করতে প্রস্তুত নই। আমি তোমায় আগেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম–ওর গায়ে হাত দিলে কিন্তু ভগবানের দিব্যি, আমার কথার নড়চড় হবে না জেনে রেখো!

    উঁহু, বড়ো দেরি করে ফেলেছ তুমি, ভায়োলেট এখন আমার বউ।

    না, তোমার বিধবা।

    চকিতে খানিকটা আগুন ঝলসে উঠল তার রিভলভারের নলটাতে। ফায়ারিংয়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই উডলির ওয়েস্টকোটের সামনেটা ফিনকি দিয়ে বেরোনো রক্তে দেখতে দেখতে ভিজে গেল। আর্ত চিৎকার করে এক পাক ঘুরে গেল সে, তারপরেই চিৎপাত হয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়ল মাঠের ওপর কদর্য মুখের রক্তাভা চকিতে মিলিয়ে গিয়ে ফুটে উঠল বিচিত্র ফ্যাকাশে ভয়াবহতা। আধবুড়ো লোকটা তখনও তার সাদা ধড়াচুড়ো নামায়নি। নিমেষের মধ্যে এ-কাণ্ড হয়ে যেতে এমন অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করে দিলে যা শোনার দুর্ভাগ্য সারাজীবনে আমার হয়নি। পরক্ষণেই টেনে বার করলে নিজের রিভলভার, কিন্তু তা তুলে ধরার আগেই তার চোখ পড়ল হোমসের উদ্যত রিভলভারের ব্যারেলের ওপর।

    কঠিন স্বরে বললে হোমস, যথেষ্ট হয়েছে। পিস্তল ফেলুন। ওয়াটসন, তুলে নাও! ওরই মাথা লক্ষ করে দাঁড়াও! ধন্যবাদ। ক্যারুথার্স, আপনার রিভলভারটাও দিন আমাকে। মারপিটের আর দরকার নেই। এগিয়ে আসুন, দিয়ে যান রিভলভার।

    কে আপনি?

    আমার নাম শার্লক হোমস।

    গুড লর্ড!

    আমার নাম শুনেছেন দেখছি। পুলিশ না-আসা পর্যন্ত তাদের কর্তব্যই করতে হবে আমায়। এই, এদিকে এসো! ঝোপঝাড় ঠেলে ফাঁকা মাঠের ওপর এসে দাঁড়িয়েছিল ভয়ার্ত গাড়োয়ানটা। তাকেই চিৎকার করে ডাকল হোমস। এদিকে এসো। যত তাড়াতাড়ি পার এই চিরকুটটা নিয়ে যাও ফার্নহ্যামে। নোটবুকের পাতা ছিঁড়ে খস খস করে কয়েক লাইন লিখল হোমস। পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সুপারিনটেন্ডেন্টকে দেবে চিঠিটা। উনি এসে না-পৌঁছানো পর্যন্ত আপনাদের প্রত্যেককেই আমার হেফাজতে থাকতে হবে।

    অত্যন্ত কড়া আর প্রভুত্বময় ব্যক্তিত্ব হোমসের। স্বল্প কথার খবরদারিতে চকিতের মধ্যে অমন একটি খুনখারাপির দৃশ্যও এসে গেল তার হাতের মুঠোয়। আমরা প্রত্যেকেই যেন তার হাতের পুতুল হয়ে গেলাম। উইলিয়ামসন আর ক্যারুথার্স আহত উডলিকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। আমি নিয়ে এলাম মিস স্মিথকে–বেচারি দারুণ ঘাবড়ে গেছিল কাণ্ডকারখানা দেখে। আহত উডলিকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। হোমসের অনুরোধে তাকে পরীক্ষা করে রিপোের্টটা দিতে এলাম। মান্ধাতা আমলের পর্দা ঝোলানো ডাইনিং রুমে দুই বন্দিকে সামনে বসিয়ে সিধে হয়ে বসে ছিল হোমস।

    বললাম, বেঁচে যাবে লোকটা।

    কী!তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠল ক্যারুথার্স। ওপরে গিয়ে ওকে শেষ করি আগে–তারপর অন্য কথা। আপনি কি বলতে চান ডানাকাটা পরির মতো অমন সুন্দরী মেয়েটির সারাজীবন ওই জানোয়ার রোরিং জ্যাক উডলির সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে?

    হোমস বললে, এ নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তার কোনো দরকার নেই। মস্ত দুটো কারণে কোনোমতেই উডলির বউ হওয়া সম্ভব নয় মিস স্মিথের পক্ষে। প্রথমেই আমরা অনায়াসেই মি. উইলিয়ামসনকে জিজ্ঞেস করতে পারি যে আদপে বিয়ে দেওয়ার মতো কোনো ক্ষমতা তার আছে কি না।

    চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠল বুড়ো রাসকেল উইলিয়ামসন, আলবত আছে।

    ছিল এবং পরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

    একবার যে পুরুত হয়, চিরকাল সে পুরুতই থাকে।

    আমার তা মনে হয় না। লাইসেন্স আছে?

    বিয়ের জন্যে একটা লাইসেন্স আনিয়েছি। আমার পকেটেই আছে।

    তাহলে তা চালাকি করেই আনানো হয়েছে বলব। সে যাই হোক, জোর করে দেওয়া বিয়েকে বিয়ে তো বলেই না, উলটে এ মহাপাতকের কাজ যারা করতে যায়, তাদের অপরাধের গুরুত্ব যে কতখানি, তা টের পাবেন শিগগিরিই। এ-ব্যাপার নিয়ে ভাববার জন্যে কম করে বছর দশেক সময় তো পাবেনই, অন্তত আমার তো তাই বিশ্বাস। মি. ক্যারুথার্স, পিস্তলটা পকেটে রেখে দিলেই বুদ্ধিমানের কাজ করতেন আপনি।

    এখন তা বুঝেছি, মি. হোমস। জীবনে আমি একবারই ভালোবেসেছি এবং আমার এ ভালোবাসা, বুঝতেই পারছেন, মিস স্মিথকে ঘিরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে এতদিন ধরে। তাই সবরকমভাবে তাকে আড়াল করবার চেষ্টা করেছি। সম্ভব অসম্ভব যাবতীয় বিপদের ধাক্কা থেকে। কিন্তু এত করেও যখন দেখলাম যার সংস্পর্শে এসে ভালোবাসা কাকে বলে জেনেছি, সে পড়েছে এমন একজনের খপ্পরে, যার নামে কিমবারলি থেকে জোহানেসবার্গ পর্যন্ত আবালবৃদ্ধবনিতা শিউরে ওঠে, সারা আফ্রিকায় যার জুড়িদার হওয়ার মতোও মানুষ-পশু আর খুনে গুন্ডা আর দুটি নেই, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না, চিন্তাবুদ্ধিবোধে সমস্ত আচ্ছন্ন হয়ে গেল উন্মাদ রাগে। মি. হোমস, বেশি কথা কী, আমার চাকরিতে মিস স্মিথকে বহাল করার পর থেকে একটি দিনের জন্যেও ওঁকে আমি বাড়ির চৌহদ্দি ছেড়ে বাইরে বেরোতে দিইনি–কেননা, এই রাসকেলগুলো যে অষ্টপ্রহর ওত পেতে রয়েছে তার জন্যে, তা আর কেউ না-জানলেও আমি তো জানি। এমনকী বাড়ি ছেড়ে যেখানেই সে একলা রওনা হয়েছে, আমিও সাইকেলে তার পাছু নিয়েছি, পাছে কেউ তার ওপর হামলা করে বসে এই ভয়ে। অবিশ্বাস্য লাগছে, তাই না? বেশ কিছুটা তফাতে থেকে সাইকেল চালিয়েছি এবং পাছে চিনে ফেলে তাই নকল দাড়ি লাগিয়ে ছদ্মবেশও ধারণ করতে হয়েছে। হয়তো এসবের দরকার হত না যদি আর পাঁচটা মেয়ের মতো হত মিস স্মিথ। কিন্তু তার মতো তেজি মেয়ে বড়ো একটা দেখা যায় না, কাজেই রাস্তাঘাটে বেরোলেই আমি তার পাছু নিই জানলে আর এক মুহূর্তও আমার চাকরিতে সে থাকত না।

    টেলিগ্রামটা আসার পরেই বুঝলাম আর সবুর করা সম্ভব নয় ওদের পক্ষে, এসপার কি ওসপার, যা হয় একটা কিছু ওরা এবার করবেই।

    কীসের টেলিগ্রাম?

    পকেট থেকে একটা টেলিগ্রাম বার করল ক্যারুথার্স।

    এই দেখুন!

    খুবই সংক্ষিপ্ত টেলিগ্রাম।

    বুড়ো অক্কা পেয়েছে।

    হোমস বললে, হুম। বুঝছি, এবার জলের মতোই সব বুঝছি। এবং এ-টেলিগ্রাম পাওয়ার পর কেন তারা উঠে পড়ে লেগেছে, তাও আর অস্পষ্ট নেই আমার কাছে। দয়া করে উৎকর্ণ হয়ে শুনুন তারপর বলুন আর কিছু গোপন রইল কি না। প্রথমেই বলি, আপনারা তিনজনেই–মানে, আপনি উইলিয়ামসন, আপনি ক্যারুথার্স আর উডলি–এসেছেন সাউথ আফ্রিকা থেকে।

    পয়লা নম্বরের কাঁচা মিথ্যে বুড়ো ঘুঘু বলে উঠল সঙ্গেসঙ্গে, মাসকয়েক হল এদের আমি দেখেছি, তার আগে এদের চন্দ্রবদন দেখার সৌভাগ্য আমার কোনোদিনই হয়নি। তা ছাড়া আফ্রিকায় আমি জীবনে যাইনি। কাজেই, মি. ব্যস্তবাগীশ হোমস, আপনার মূল্যবান তদন্তফল পাইপে ভরে কিছুক্ষণ ধূমপান করলে বিলক্ষণ খুশি হব!

    ক্যারুথার্স বললে, মিথ্যে বলেনি উইলিয়ামসন।

    বেশ, বেশ, না হয় আপনারা দুজনেই এসেছেন আফ্রিকা থেকে। প্রভুপাদকে তাহলে আমাদের স্বদেশি মালই বলব। সাউথ আফ্রিকায় রালফ স্মিথের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আপনাদের। আপনারা জানতেন বেশিদিন বাঁচবে না সে। আর জানতেন, বুড়ো অক্কা পেলে তার সব সম্পত্তিই পাবে তার ভাইঝি! কীরকম–ঠিক হচ্ছে তো?

    ক্যারুথার্স মাথা হেলিয়ে সায় দিলে আর শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করে আর এক পশলা গালিগালাজ সৃষ্টি করলে বুড়ো উইলিয়ামসন।

    এইভাইঝিই তার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। আরও একটা জিনিস আপনারা জানতেন–বুড়ো কোনো উইলই করবে না।

    ক্যারুথার্স বললে, লিখতে পড়তেই জানত না।

    কাজে কাজেই আপনারা দুজনে কষ্ট করে সাগর লঙ্ঘন করে এলেন এদেশে, উদ্দেশ্য মেয়েটাকে খুঁজে বার করা। আপনার মতলব ছিল অভিনব। একজন বিয়ে করতেন মেয়েকে আর একজন বখরা নিতেন লুটের সম্পত্তির। যেকোনো কারণেই হোক, উডলিকে স্বামী নির্বাচন করা হয়। কেমন, ঠিক হচ্ছে তো?

    জাহাজে আসার সময়ে বাজি ফেলে তাস খেলেছিলাম–উডলিই জিতে নিলে মিস স্মিথকে।

    বটে। এখানে এসে কায়দা করে চাকরিতে বহাল করলেন মিস স্মিথকে, ঠিক হল এই সুযোগ নিয়ে তার সঙ্গে প্রেম করা শুরু করবে উডলি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আপনাদের, মাতাল উডলিকে চিনতে বেশি দেরি হল না মিস স্মিথের এবং এ-রকম একটা গোঁয়ার জানোয়ারের সঙ্গে প্রেম তো দূরের কথা, কথা বলাও যে সম্ভব নয় তার পক্ষে, তাও বোঝা গেল শিগগিরই। ইতিমধ্যে আপনার সব বন্দোবস্তই ভণ্ডুল হয়ে গেল একটি কারণে আপনি নিজেই মিস স্মিথের প্রেমে পড়ে গেলেন। কাজেই একটা ইতর লোক আপনার ওপর টেক্কা মেরে তাকে জিতে নিয়ে যাবে, এ-চিন্তাও আপনার কাছে বিছের কামড়ের মতো যন্ত্রণাময় হয়ে উঠল।

    না, না, কিছুতেই হতে পারে না!

    তাই একদিন ঝগড়ঝাঁটি হল দুজনের মধ্যে। আপনার ওপর গনগনে রাগ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে এবং শুরু হল আপনাকে বাদ দিয়েই ভায়োলেট হরণের আয়োজন।

    শুকনো হেসে ক্যারুথার্স বলল, উইলিয়ামসন, এ-ভদ্রলোকের কাছে আর কিছু চেপে রেখে লাভ আছে কি? হ্যাঁ, দারুণ ঝগড়া হয়ে গেছিল আমাদের মধ্যে। আমাকে ঘুসি মেরে পেড়ে ফেললে উডলি। এদিক দিয়ে আমিও কম যাই না। কাজেই শোধ নিলাম তখনই। তারপর থেকে যেন উবে গেল উডলি। এই পাদরি হতভাগার সঙ্গে তখনই যোগসাজশ হয় ওর। লক্ষ করলাম, মিস স্মিথ যে-পথ দিয়ে স্টেশনে যায়, তারই ধারে দুজনে ঘাঁটি পেতেছে একসাথে। তখন থেকেই মিস স্মিথের ওপর নজর রাখা শুরু করলাম আমি, কেননা হাওয়া সুবিধের মনে হল না। ওদেরকেও চোখে চোখে রাখলাম, কেননা ওদের আসল ফন্দিটা যে কী, তা ঠিক বুঝে উঠছিলাম না। দিনদুয়েক আগে বাড়ি বয়ে এসে এই টেলিগ্রামটা দেখাল উডলি। বুড়োর মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার পরেই ও জিজ্ঞেস করলে, এর পরেও চুক্তি অনুসারে আমি কাজ করব কি না। আমি সোজা না বলে দিলাম। ও আবার জিজ্ঞেস করলে, মেয়েটাকে আমি বিয়ে করে তাকে টাকার বখরা দেব কি না। আমি বললাম, বিয়ে করতে পারলে তো খুশিই হতাম, কিন্তু সে রাজি হবে না। ও বললে, আগে ওর বিয়েটা লাগিয়ে দাও তো, তারপর হপ্তাখানেক কি দুয়েক পরে দাওয়াই দিলে সব সিধে হয়ে যাবে। আমি বলে দিলাম, ওসব জোর জবরদস্তির কথা শুনতে আমি রাজি নই। রাগে আগুন হয়ে কদর্য গালিগালাজ করতে করতে চলে গেল উডলি। ওর মতো ছোটোলোক ইতরের মুখে অবশ্য ও ধরনের গালাগালি বেমানান নয় মোটেই। যাবার সময়ে শাসিয়ে গেল যে ছলে বলে কৌশলে মেয়েটাকে সে নিজের কোটরে পুরবেই। এই হপ্তার শেষের দিকেই তার এ-চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। স্টেশন পর্যন্ত একটা গাড়ির ব্যবস্থাও করেছিলাম আমি। কিন্তু মন মানল না, তাই নিজেই সাইকেলে পাছু নিয়েছিলাম তার। সবে রওনা হয়েছিল সে। আমিও নিরাপদ ব্যবধান বজায় রেখে পাছু নেওয়া শুরু করেছি, কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। যখনই দেখলাম দুজন ভদ্রলোক তার গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসছে, বুঝতে আর কিছুই বাকি রইল না আমার।

    উঠে দাঁড়িয়ে সিগারেটের টুকরোটা আগুনের চুল্লিতে টোকা মেরে ফেলে দিয়ে হোমস বললে, ইদানীং মাথাটা আমার বড়োই মোটা হয়ে গেছে, ওয়াটসন! যখনই তোমার রিপোর্ট পেশ করার সময়ে বললে দাড়িওলা সাইক্লিস্ট তোমার দিকে পিছন করে বাগানের ঝোঁপের মধ্যে দুহাত তুলে বোধ হয় নেকটাই ঠিক করছিল, তখনই আমার সব বুঝে নেওয়া উচিত ছিল।

    কেসটার পাণ্ডুলিপির তলায় দেখছি অনেকদিন পরে নিজেই আরও দু-একটি কথা লিখে রেখেছিলাম। মিস ভায়োলেট স্মিথ বিপুল সম্পত্তি পেয়েছিল উত্তরাধিকার সূত্রে এবং এখন সে ওয়েস্টমিনস্টারের নামকরা ফার্ম মর্টন অ্যান্ড কেনেডির পার্টনার সিরিল মর্টনের বধূ।

    অপহরণ আর লাঞ্ছনার অভিযোগে উইলিয়ামসন আর উডলি দুজনেই শাস্তি পেয়েছে ধর্মাধিকরণ থেকে। উইলিয়ামসন সাত বছরের আর উডলি দশ বছরের।

    ———

    টীকা

    সুন্দরীর শতেক জ্বালা : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সলিটারি সাইক্লিস্ট আমেরিকায় কলিয়ার্স উইকলির ২৬ ডিসেম্বর ১৯০৩ সংখ্যায় এবং ইংলন্ডে জানুয়ারি ১৯০৪ সংখ্যায় স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়।

    ইম্পিরিয়াল থিয়েটার : ওয়েস্টমিনস্টারের রয়্যাল অ্যাকোয়ারিয়ামের অংশ, ইম্পিরিয়াল থিয়েটারের হল-এ গান-বাজনা সংক্রান্ত অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হত। ১৮৯৯-এ এই থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অভিনেত্রী লিলি ল্যাংট্রি এটি আবার খোলবার ব্যবস্থা করেন ১৯০১-এ। এখানে অভিনীত মঞ্চ-সফল প্রযোজনাগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল আর্থার কন্যান ডয়ালের লেখা ব্রিগেডিয়ার জেরাদ (১৯০৬)।

    জোহানেসবার্গ : দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়াটার্সর্যান্ড অঞ্চলের স্বর্ণখনি এলাকার প্রশাসন-কেন্দ্র হিসেবে জোহানেসবার্গ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৬ সালে। বর্তমানে এটি দক্ষিণ আফ্রিকার এক গুরুত্বপূর্ণ শহর।

    কভেনট্রিতে মিডল্যান্ড ইলেকট্রিক কোম্পানিতে : কভেনট্রিতে মিডল্যান্ড ইলেকট্রিকাল ফ্যাকটর্স লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে।

    দ্বিগুণ বেতন দিয়ে : ১৮৯৫-এ গভর্নেসের চলতি বেতন পঞ্চাশ পাউন্ড, আজকের বাজারে ৩২০০ পাউন্ডেরও বেশি। তা ছাড়া থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও থাকত এর সঙ্গে। জানিয়েছেন হোমস-গবেষক লেসলি ক্লিংগার।

    সিটের ওপর সিধে হয়ে বসে : ভিক্টোরীয় যুগের ইংলন্ডে মেয়েদের সাইকেল চালাতে হত গোড়ালি পর্যন্ত স্কুলের স্কার্ট, পেটিকোট, ঊর্ধ্বাঙ্গে জ্যাকেট এবং মাথায় টুপি পরে। মনে হয় না যে তারা খুব সাবলীল থাকতে পারতেন।

    পিছিয়ে পড়লাম : দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস উপন্যাসে ওয়াটসনকে একবার বেশ জোরেই দৌড়াতে দেখা গিয়েছিল, স্যার হেনরির সঙ্গে। অনেক সমালোচকের মতে ওয়াটসনের পায়ে আফগানিস্তানের লাগা আঘাতের ব্যথা চাগাড় দেওয়াতেই তিনি দৌড়াতে পারেননি এইবার।

    একবার যে পুরুত হয়, চিরকাল সে পুরুত থাকে: বুড়ো বজ্জাত উইলিয়ামসন কিন্তু এই কথাটা ঠিকই বলেছে। চার্চ অব ইংলন্ডের নিয়মে এমন পুরুত শাস্তির যোগ্য, কিন্তু তাতে বিয়ে ভাঙে না। অবশ্য, এক্ষেত্রে মিস স্মিথ-এর এ-বিয়েতে মত না থাকায় বিয়ে ভাঙতে বাধ্য।

    কিমবারলি : ১৮৭০-এ এক বিশাল হিরের খনি আবিষ্কার হলে ১৮৭১-এ কিমবার্লি শহর প্রতিষ্ঠা করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার খনি অঞ্চলে। কিমবার্লির হিরের খনি কৃষিজীবী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে একে একটি খনিপ্রধান রাষ্ট্রে পরিণত করে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ – আরিফ আজাদ
    Next Article শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }