Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প1414 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    গোরুর খুরের রহস্য

    [ দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য প্রায়রি স্কুল ]

    বেকার স্ট্রিটে আমাদের ছোট্ট রঙ্গমঞ্চে অনেকরকম নাটকীয় আসা যাওয়াই দেখেছি, কিন্তু ড. থনিক্রফট হাক্সটেবল, এম. এ., পি, এইচডি, ইত্যাদির প্রথম আবির্ভাবের মতো চমকপ্রদ ও আকস্মিক আর কিছু মনে পড়ছে না। রাশি রাশি ডিগ্রির অনুপাতে অত্যন্ত পুঁচকে একটা কার্ড আসার কয়েক সেকেন্ড পরেই ঘরে ঢুকলেন ভদ্রলোক। চেহারাখানা যেমন বিপুল তেমনি জমকালো। সব মিলিয়ে দেখলে শ্রদ্ধা জাগে, মনে হয় এমন দশাসই বপু যাঁর, তিনি আর যাই হোক অন্তঃসারশূন্য নন এবং আত্মবিশ্বাসেরও অভাব নেই তার। কিন্তু আশ্চর্য এমন চেহারা সত্ত্বেও দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে প্রথমেই সামনের টেবিলটা ধরে টলমল করে উঠলেন ভদ্রলোক, তারপরেই গিয়ে দড়াম করে পড়লেন মেঝের ওপর। আগুনের চুল্লির পাশে বিছানো ভালুকের চামড়ার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রইল তাঁর জ্ঞানহীন বিশাল বনেদি বপু।

    হোমস ব্যস্ত হয়ে উঠে তাড়াতাড়ি একটা কুশন এনে খুঁজে দিল তাঁর মাথার নীচে। আমি ফোঁটা ফোঁটা ব্র্যান্ডি ঢালতে লাগলাম দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে।

    নাড়ি দেখলাম। জীবনের ধারা অত্যন্ত ক্ষীণভাবে ধুকধুক করে বয়ে চলেছে সুতোর মতো সরু এতটুকু অংশ দিয়ে। বললাম, খুব সম্ভব খিদে আর ক্লান্তিতে একেবারেই ভেঙে পড়েছেন–শেষ শক্তিবিন্দুটুকু ব্যয় করেছেন এখানে আসার জন্যে।

    ঘড়ির পকেট থেকে রেলের টিকিট বার করে হোমস বললে, উত্তর ইংলন্ডের ম্যাকলটন থেকে এসেছেন দেখছি–রিটার্ন টিকিট। এখনও তো বারোটা বাজেনি। অর্থাৎ ভদ্রলোককে খুব সকাল সকালই রওনা দিতে হয়েছে বাড়ি থেকে।

    কুঁচকোনো চোখের পাতা অল্প অল্প কেঁপে উঠল, তারপরেই একজোড়া শূন্য-দৃষ্টি ধূসর চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকালে আমাদের পানে। পরমুহূর্তেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক, লজ্জায় অরুণ হয়ে উঠেছিল তার মুখ।

    আমার এ-দুর্বলতা মাপ করবেন, মি. হোমস, ভেতরে ভেতরে একেবারে ফোপরা হয়ে গেছি চিন্তায় ভাবনায়। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, এক গেলাস দুধ আর আর একটা বিস্কুট পেলেই আবার চাঙা হয়ে উঠব বলে মনে হয়।

    দুধ বিস্কুট খাওয়া শেষ ডা. হাক্সটেবলের। ধীরে ধীরে লালাভ হয়ে উঠল তার গাল; আলো ফিরে এল তার চোখে। চেয়ারে বেশ করে জাঁকিয়ে বসে স্বচ্ছন্দ, সাবলীল ভঙ্গিমায় গড়গড় করে বলে চললেন তার কাহিনি। উচ্চারণ আর বর্ণনাভঙ্গির মধ্যে যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়তে লাগল নতুন উদ্দীপনা, নতুন প্রাণশক্তি।

    জেন্টলমেন, প্রথমেই আপনাদের জানিয়ে রাখি যে প্রায়রি একটা প্রিপেরেটরি স্কুল অর্থাৎ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রস্তুতি হয় এইখানেই, তিন হপ্তা আগে যখন ডিউক অফ হোল্ডারনেস তার সেক্রেটারি মি. জেমস ওয়াইল্ডারকে পাঠালেন তাঁর একমাত্র ছেলে এবং উত্তরাধিকারী দশ বছরের লর্ড স্যালটায়ারকে আমার স্কুলে ভরতি করার জন্যে, তখন আনন্দে আমার মন ভরে উঠেছিল এই কথা ভেবে যে সত্যসত্যই আমার স্কুলের সুনাম তাহলে চরমে পৌঁছোবে! তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে আমার জীবনের চরমতম দুর্ভাগ্যের সূচনা আঁকা হয়েছিল সেদিনই।

    মে মাসের প্রথম তারিখে পৌঁছোলো ছেলেটি। গ্রীষ্মের পাঠক্রম শুরু হল সেদিনই। ভারি মিষ্টি স্বভাব তার–দু-দিনেই আমাদের সঙ্গে একেবারে মিশে গেল সে। অবিবেচক নই, মি. হোমস এবং এ-কেসে আধাআধি বিশ্বাস করাটাও সমীচীন নয়। তাই অকপটে সব খুলে বলছি। ছেলেটি বাড়িতে খুব সুখে ছিল না। ডিউকের বিবাহিত জীবন যে মোটেই শান্তিময় হয়নি, এ গুপ্ত কথা জানে না এমন কেউ নেই। শেষ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর সম্মতি অনুসারে বিচ্ছেদ হয় দুজনের মধ্যে ডাচেস চলে যান দক্ষিণ ফ্রান্সে। এসব ব্যাপার তো এই সেদিনকার। মাকে খুবই ভালোবাসত ছেলে এবং ডিউক-ডাচেসের বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও আগাগোড়া মা পেয়ে এসেছে ছেলের গভীর সহানুভূতি। এসব কথা সবাই জানে। এবং শুধু এই কারণেই ডিউক তাকে আমাদের প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দিন পনেরোর মধ্যেই আমাদেরই একজন হয়ে উঠল ছোট্ট লর্ড স্যালটায়ার এবং বাইরে থেকে দেখে যতটা বোঝা যায়, মনেপ্রাণে সুখী হয়েছিল সে।

    তেরোই মে রাত্রে অর্থাৎ গত সোমবার রাত্রে তাকে শেষবারের মতো দেখা যায় প্রায়রিতে। ওর ঘর তিনতলায়। সে-ঘরে ঢুকতে হলে আরও একটা বড়ো ঘরের মধ্যে দিয়ে আসতে হয়। দুজন ছেলে এই ঘরটায় সে রাতে ঘুমিয়ে ছিল। ঘরের মধ্যে দিয়ে কাউকে যেতে দেখেনি তারা, কোনো শব্দও শোনেনি। কাজেই, স্যালটায়ার যে এ-ঘর দিয়ে যায়নি এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই রইল না। তার নিজের ঘরের জানলা খোলা ছিল। জানলা থেকে মাটি পর্যন্ত মোটা আইভি লতা থাকায় আমরা পায়ের ছাপ খুঁজেছিলাম মাটিতে কিন্তু কিছু পাইনি। না-পেলেও বেরোবার সম্ভাব্য পথ শুধু এইটাই এবং এ-সম্পর্কে দ্বিমত থাকারও কোনো কারণ নেই।

    মঙ্গলবার সকাল সাতটায় আমরা জানতে পারলাম যে রাতারাতি ঘর থেকে উধাও হয়েছে লর্ড স্যালটায়ার। বিছানা নিভাঁজ নয় দেখে বুঝলাম সে ঘুমোচ্ছিল। যাওয়ার আগে স্কুলের যা পোশাক, কালো ইটন জ্যাকেট আর গাঢ় ধূসর রঙের ট্রাউজার পরে নিয়েছে। ঘরে যে কেউ ঢুকেছিল সে-রকম কোনো চিহ্নই পাওয়া গেল না। ধস্তাধস্তি বা চেঁচামেচির শব্দও কান এড়াত না কটারের। মাঝের বড়ো ঘরটায় শুয়েছিল কনটার।ওর ঘুম খুব পাতলা, বয়সও এদের চাইতে একটু বেশি।

    লর্ড স্যাটায়ারের অন্তর্ধানের খবর কানে আসবামাত্র আমি স্কুলের প্রত্যেককে ডেকে আনলাম নাম ডেকে মিলিয়ে নেওয়ার জন্যে ছাত্র, শিক্ষক, চাকরবাকর –কেউ বাদ গেল না।

    তখনই জানা গেল যে লর্ড স্যালটায়ার একলা পালায়নি।

    জার্মান মাস্টার হেইডেগারও নিপাত্তা। তার ঘরও তিনতলায়, বাড়ির একদম শেষপ্রান্তে, লর্ড স্যালটায়ারের ঘরের মুখোমুখি। বিছানা দেখে বুঝলাম হেইডেগারও ঘুমিয়ে ছিলেন। কিন্তু মেঝের ওপর পড়ে থাকা শার্ট আর মোজা দেখে মনে হল ধরাচুড়ো অর্ধেক চাপিয়েই বেরিয়ে পড়তে হয়েছে তাঁকে। হেইডেগার কিন্তু আইভি লতা বেয়ে নেমেছেন। কেননা, লনের ওপর যেখানে উনি নেমেছেন সেখানে তার পায়ের ছাপ পেয়েছি আমরা। লনের পাশে ছোট্ট একটা শেডে তার বাইসাইকেল থাকত। শেড খুলে দেখলাম হেইডেগারের সঙ্গে তাঁর সাইকেলও উধাও হয়েছে।

    বছর দুয়েকের মতো আমার স্কুলে রয়েছেন হেইডেগার। খুব নির্ভরযোগ্য সুপারিশ দেখে তাকে কাজে বহাল করেছিলাম আমি কিন্তু সবসময়ে বড়ো মুষড়ে পড়তেন ভদ্রলোক, কথাবার্তাও বড়ো একটা বলতেন না। ছাত্র বা শিক্ষক সবার কাছ থেকেই দূরে দূরে থাকার ফলে কেউই তাকে আপন বলে ভাবতে পারত না। যাই হোক, আজ পর্যন্ত ওঁদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার আমরা যে-তিমিরে ছিলাম আজ বেস্পতিবার সকালেও সে-তিমির থেকে। একচুলও এগোতে পারিনি।হোলডারনেস হল-এ খোঁজ নিয়েছিলাম তখুনি। প্রায়রি স্কুল থেকে হোলডারনেস হলের দূরত্ব মাত্র কয়েক মাইল। ভেবেছিলাম হঠাৎ হয়তো বাড়ির জন্যে মন কেমন করায় বাবার কাছেই ফিরে গেছে লর্ড স্যালটায়ার। কিন্তু সেখানেও কোনো খবর পাওয়া গেল না তার। উদবেগ-উত্তেজনায় ডিউকের অবস্থা কী হয়েছে, তা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন। আর নিজের চোখেই দেখলেন আপনারা, এই তিনদিনের মধ্যে উৎকণ্ঠা আর দায়িত্ববোধ কুরে কুরে শেষ করে এনেছে আমার নার্ভের শক্তি।

    নোটবুক বার করে কয়েকটা পয়েন্ট টুকে নিল হোমস। তারপর কড়া সুরে বললে, এত দেরিতে আমার কাছে এসে খুবই অন্যায় করেছেন আপনি। অত্যন্ত গুরুতর অসুবিধার মধ্যে দিয়ে আমায় এখন তদন্ত করতে হবে। যেমন ধরুন না কেন, তিনদিন পর আইভি বা লন দেখে কোননা বিশেষজ্ঞের পক্ষেই কিছু বুঝে ওঠা সম্ভব নয়।

    মি. হোমস, আমার কোনো দোষ নেই। হিজ গ্রেস নিজেই প্রকাশ্য কেলেঙ্কারি এড়ানোর জন্যে এ-খবর পাঁচ কান হতে দেননি। পারিবারিক অশান্তি দুনিয়ার লোকে জানুক, এ তার ইচ্ছা নয়। শুধু ইচ্ছা নয় বললে অল্প বলা হবে, এ ধরনের কিছু ভাবতেও শিউরে ওঠেন উনি।

    পুরো তিনটে দিন বিলকুল বাজে নষ্ট হয়েছে। বাস্তবিক ড. হাক্সটেবল, প্রথম থেকেই এ-কেস নিয়ে যা করেছেন আপনারা, তা অতি যাচ্ছেতাই, ক্ষমার অযোগ্য।

    আমিও তা বুঝতে পারছি।

    কিন্তু তবুও এ-সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। কেসটা আমি নিলাম, ড. হাক্সটেবল। ভালো কথা, লর্ড স্যাটায়ার আর জার্মান মাস্টারের মধ্যে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন কি?

    একেবারেই না।

    ছেলেটি কি মাস্টারের ক্লাসেই ছিল?

    না। যতদূর জানি দুজনের মধ্যে কোনোরকম কথাবার্তাই হয়নি।

    ভারি আশ্চর্য তো! ছেলেটারও বাইসাইকেল আছে নাকি?

    না।

    আর কোনো সাইকেল উধাও হয়েছে?

    না।

    ঠিক তো?

    হ্যাঁ!

    ভালো কথা। আপনি কি তাহলে মনে করেন মাঝরাতে জার্মান মাস্টার ছেলেটাকে কোলে নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন?

    নিশ্চয় না। তাহলে আপনার থিয়োরিটা কী শুনি?

    বাইসাইকেলটা নিছক ধোঁকা ছাড়া কিছু নয়। সাইকেলটা কোথাও লুকিয়ে রেখে দুজনেই হাঁটা দিয়েছে কোনো গোপন জায়গার দিকে।

    ঠিক। কিন্তু ধোঁকাটা একটু বিদঘুটে রকমের মনে হচ্ছে, তাই না? শেডে অন্য কোনো সাইকেল ছিল নাকি?

    কয়েকটা ছিল।

    আপনার থিয়োরি অনুসারে দুজনেই যে সাইকেলে চড়ে গা-ঢাকা দিয়েছে, এ-ধারণাই যদি আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকে হেইডেগারের, তাহলে তার পক্ষে একটা না–লুকিয়ে একজোড়া সাইকেল লুকোনোই স্বাভাবিক নয় কি?

    মনে তো হয় তাই।

    আমার শুধু মনে হয় না, আমার বিশ্বাস যে এইটাই স্বাভাবিক। আপনাকে ধোঁকা দেওয়ার থিয়োরি এখানে খাটবে না, ডক্টর। তদন্ত শুরু করার পক্ষে ঘটনাটির গুরুত্ব কিন্তু অনেকখানি। আস্ত একটা সাইকেল বেমালুম লোপাট করে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখা বা নষ্ট করে ফেলাটাও খুব সোজা কাজ নয়। আর একটা প্রশ্ন। অদৃশ্য হওয়ার আগের দিন কেউ কি ছেলেটির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?

    না।

    কোনো চিঠিপত্র এসেছিল তার নামে?

    একটা এসেছিল বটে।

    কার কাছ থেকে?

    বাবার কাছ থেকে।

    ছেলেদের চিঠি আপনি খোলেন নাকি?

    না।

    কী করে জানলেন চিঠিটা তার বাবার কাছ থেকে?

    খামের ওপর হোলডারনেস বংশের প্রতীক-চিহ্ন ছিল। তা ছাড়া, ডিউক নিজের হাতে ঠিকানা লিখেছিলেন–ও-রকম অদ্ভুত আড়ষ্ট হাতের লেখা ডিউক ছাড়া যে আর কারো নয়, তা আমি জানি। সবচেয়ে বড়ো কথা, এ-চিঠির কথা ডিউকেরও মনে আছে।

    এ-চিঠি পাওয়ার আগে আবার কবে সে চিঠি পেয়েছে?

    বেশ কিছুদিন পর্যন্ত তো নয়ই।

    ফ্রান্স থেকে কোনো চিঠি এসেছিল তার নামে?

    না। কোনোদিনই না।

    এসব প্রশ্নের পেছনে আমার উদ্দেশ্যটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন আপনি।হয় লর্ড স্যালটায়ারকে জোরজবরদস্তি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা নইলে সে নিজেই গেছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, তার মতো ছেলেমানুষের পক্ষে বাইরের জগৎ থেকে কোনোরকম উৎসাহ বা প্রেরণা না-পেলে এ ধরনের ডানপিটের মতো কাজ করাও সম্ভব নয়। কেউ যদি দেখা করতে না-এসে থাকে, তাহলে নিশ্চয় চিঠিপত্রের ভেতর দিয়েই এ-উৎসাহ সে পেয়েছে। সেই কারণেই আমি জানতে চাইছি কে কে তাকে চিঠি লিখেছিলেন।

    এ-সম্পর্কে আপনাকে খুব বেশি সাহায্য করতে পারব বলে মনে হয় না মি. হোমস। যতদূর জানি, বাবা ছাড়া আর কেউ তাকে প্রায়রিতে চিঠি লেখেননি।

    এবং যেদিন ছেলে উধাও হয়ে গেল, সেদিনই এল তার চিঠি। বাপছেলের মধ্যে সম্পর্ক কীরকম ছিল, ডক্টর? বন্ধুর মতো কি?

    হিজ গ্রেস কারোর সঙ্গেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখেন না। দেশের এবং দশের কাজ নিয়েই অহরহ তাকে ড়ুবে থাকতে হয়–কাজেই সাধারণ মানুষের মধ্যে যেসব আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখি, তার নামগন্ধও পাওয়া যায় না তার মধ্যে। তবে ওরই মাঝে ছেলের প্রতি তাঁর স্নেহ-ভালোবাসার অন্ত ছিল না। তাঁর কড়া স্বভাবের নমুনাও কোনোদিন পায়নি লর্ড স্যাটায়ার।

    কিন্তু লর্ড স্যাটায়ার বেশি ভালোবাসত তার মাকে?

    তা সত্যি।

    কোনোদিন সে-কথা তার নিজের মুখে শুনেছেন?

    না।

    ডিউকের মুখে?

    সর্বনাশ! না, মশাই না!

    তাহলে জানলেন কী করে?

    হিজ গ্রেসের সেক্রেটারি মি. জেমস ওয়াইল্ডারের সঙ্গে আমার কিছু গোপন কথাবার্তা হয়েছিল। মায়ের ওপর লর্ড স্যালটায়ারের দুর্বলতার খবর তার মুখেই আমি শুনেছি।

    বটে। লর্ড স্যালটায়ার নিখোঁজ হওয়ার পর তার নামে আসা ডিউকের শেষ চিঠিটা ঘরে পেয়েছেন কি?

    না, যাবার সময়ে চিঠিটা নিয়ে গেছে সে। মি. হোমস, আর তো দেরি করা যায় না, এবার রওনা হওয়া যাক।

    ঘোড়ার গাড়ি আনতে বলে দিই। মিনিট পনেরোর মধ্যে তৈরি হয়ে নিচ্ছি আমরা। ড. হাক্সটেবল, রওনা হওয়ার আগে বাড়িতে টেলিগ্রাম পাঠানোর ইচ্ছে থাকলে আপনার প্রতিবেশী মহলে বেশ করে এই কথাটা ছড়িয়ে দিন যে পুলিশ এখনও লিভারপুল বা অন্য কোথাও তদন্ত চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে ধীরেসুস্থে আমরা কিছু কাজ সেরে নেব অকুস্থলে পৌঁছে। গন্ধ এখনও এমন ফিকে হয়ে যায়নি যে ওয়াটসন আর আমার মতো দু-দুটো বাঘা হাউন্ডের নাকে তা ধরা পড়বে না।

    সেদিন সন্ধ্যায় পীক কাউন্ট্রির শীত-শীত স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ায় এসে পৌঁছোলাম আমরা। ড. হাক্সটেবলের বিখ্যাত স্কুল এই অঞ্চলেই। স্কুলে পৌঁছোতেই আঁধার ঘন হয়ে এল চারদিকে। টেবিলের ওপর একটা কার্ড পড়ে ছিল। ড. হাক্সটেবল ঘরে ঢুকতেই বাটলার এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে তাঁর কানে কী বললে। শুনেই রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে আমাদের দিকে তাকালেন ডক্টর।

    বললেন, ডিউক এসেছেন। সেক্রেটারি মি. ওয়াইল্ডারকে নিয়ে উনি স্টাডিতে অপেক্ষা করছেন আমার জন্যে। আপনারা আসুন, আলাপ করিয়ে দিই ওঁর সাথে।

    অতি বিখ্যাত এই রাজনীতিবিদের ছবির সঙ্গে অবশ্য আমি আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম। কিন্তু ছবিতে শুধু মুখের আদলই দেখেছি–আসল মানুষটির সঙ্গে ছবির মানুষের আকাশ-পাতাল তফাত। দীর্ঘ সম্ভ্রান্ত চেহারায় উগ্র আভিজাত্যের ছাপ, পোশাক-পরিচ্ছদ নিখুত এবং সুরুচির পরিচয় বহন করে, পাতলা মুখ, কিন্তু বেশ গম্ভীর, দীর্ঘ নাক–সামনের দিকে অদ্ভুতভাবে বাঁকা। মরা মানুষের মতো ফ্যাকাশে মুখের ওপর লাল টকটকে দাড়িটা কীরকম জানি বেমানান লাগে। সুদীর্ঘ দাড়ি সাদা ওয়েস্ট কোটের ওপরেও ঝুলে পড়েছিল ঝালরের মতো ফাঁক দিয়ে ঝিকমিক করছিল ঘড়ির চকচকে চেনটা। রাজপুরুষের মতোই জমকালো চেহারা ভদ্রলোকের। আগুনের চুল্লির সামনে বিছানো পশুর চামড়ার ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন উনি। ঘরে ঢুকতেই পাথরের মতো কঠিন চোখে তাকালেন আমাদের পানে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন খুবই অল্প বয়সের একজন তরুণ–তিনিই যে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি ওয়াইল্ডার তা কেউ না-বললেও বুঝে নিলাম। ছোটোখাটো চেহারা ভদ্রলোকের, নার্ভাস, কিন্তু আকাশের মতো হালকা নীল-নীল চোখ আর চটপটে হাবভাব দেখলেই বোঝা যায় আকারে খাটো হলেও সতর্কতায় আর বুদ্ধির তীক্ষ্ণ্ণতায় অনেককেই হার মানিয়ে দিতে পারেন তিনি। আমরা ঘরে ঢুকতে-না-ঢুকতেই ইনিই অনাড়ষ্ট তীক্ষ্ণ্ণ স্বরে কথাবার্তা শুরু করে দিলেন।

    ড, হাক্সটেবল, আজ সকালেই আমি এসেছিলাম আপনার লন্ডনে যাওয়া বন্ধ করতে। কিন্তু একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল আমার। শুনলাম আপনার লন্ডনে যাওয়ার উদ্দেশ্য মি. শার্লক হোমসকে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাকে এ-কেসের তদন্তভার দেওয়া। হিজ গ্রেস অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেছেন, ড. হাক্সটেবল–এ ধরনের কিছু করার আগে তাঁর সঙ্গে আপনার পরামর্শ করা উচিত ছিল।

    যখনই শুনলাম যে পুলিশও ব্যর্থ হয়েছে—

    পুলিশ যে ব্যর্থ হয়েছে এ-কথা হিজ গ্রেস মোটেই বিশ্বাস করেন না।

    কিন্তু মি. ওয়াইল্ডার—

    আপনি তো ভালো করেই জানেন, ড. হাক্সটেবল, প্রকাশ্য কেলেঙ্কারি এড়ানোর জন্যে কতখানি উদবিগ্ন হিজ গ্রেস। এই কারণেই তিনি মনে করেন এ-ব্যাপার যত অল্প লোকে জানে ততই মঙ্গল।

    ভ্রুকুটি করে ডক্টর বললেন, যাক, যা হবার তা হয়েছে। এবার প্রতিকারের কথা ভাবা যাক। কাল ভোরের ট্রেনে মি. শার্লক হোমস লন্ডনে ফিরে গেলেই সব ঝামেলা মিটে যায়।

    নির্বিকার নিরুত্তাপ সুরে হোমস বলে উঠল, উঁহু, ডক্টর, এত তাড়াতাড়ি লন্ডনে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। উত্তর দেশের এই তাজা ফুরফুরে হাওয়ায় মনটা এত হালকা লেগেছে যে কয়েকটা দিন আপনার জলাভূমিতে কাটিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে আমার। আপনার ছাদের তলায় মাথা গুজতে না-পারি গাঁয়ের সরাইখানা তো আছেই। অবশ্য সে-ব্যাপারে আপনি যা বলবেন তাই হবে।

    মহা ফাঁপরে পড়লেন ড. হাক্সটেবল। বেচারির দোনামোনা ভাব দেখে বড়ো মায়া হল আমার। কিন্তু এই শাঁখের করাতের মতো অবস্থা থেকে উদ্ধার করলেন ডিউক নিজেই। ডিনার-ঘণ্টার মতো গুরুগম্ভীর গমগমে গলায় কথা বলে উঠলেন উনি।

    ড. হাক্সটেবল, মি. ওয়াইল্ডারের বক্তব্যের সাথে আমি একমত। যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে আপনার পরামর্শ করা উচিত ছিল। কিন্তু মি. শার্লক হোমসকে যখন সব জানানোই হয়েছে, তখন তাঁর সাহায্য না-নেওয়ার কোনো মানেই হয় না। মি. হোমস, সরাইখানায় না-গিয়ে আমার হোলডারনেস হল-এ ক-দিন গেলে আমি খুবই খুশি হব।

    ধন্যবাদ, ইয়োর গ্রেস। তদন্তের সুবিধার জন্যে লর্ড স্যাটায়ার যে-জায়গা থেকে অদৃশ্য হয়েছেন, সেখানে থাকাটাই আমার পক্ষে সমীচীন হবে।

    যা ভালো বোঝেন। আমার বা মি. ওয়াইল্ডারের কাছে যদি কোনো খবর আশা করেন তো জিজ্ঞেস করতে পারেন।

    হোমস বললে, আপনার সঙ্গে হয়তো হল-এ দেখা করার দরকার হবে আমার। এখন স্যার শুধু একটা প্রশ্নই করব আপনাকে। আপনার ছেলের এই রহস্যজনক অন্তর্ধানের কোনো কারণ কি আপনি ভেবেছেন?

    না মশাই, কোনো কারণই পাইনি!

    মাপ করবেন, আপনার পক্ষে বেদনাদায়ক দু-একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করা ছাড়া উপায়ান্তর দেখছি না। আপনার কি ধারণা এ-ব্যাপারে ডাচেসের কোনো হাত আছে?

    রীতিমতো দ্বিধায় পড়লেন মন্ত্রীমশায়।

    অবশেষে বললেন, আমার তা মনে হয় না।

    তাহলে বাকি থাকে আর একটি সম্ভাবনা। মোটা টাকা দাও মারার জন্যে কেউ হয়তো আপনার ছেলেকে গুম করেছে। এ ধরনের দাবিদাওয়া নিয়ে লেখা কোনো চিঠি আপনি পেয়েছেন?

    না।

    আর একটি প্রশ্ন ইয়োর গ্রেস। শুনলাম, যেদিন লর্ড স্যালটায়ার উধাও হয়, সেইদিনই আপনি তাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন।

    না, তার আগের দিন লিখেছিলাম।

    এগজ্যাক্টলি। কিন্তু চিঠিটা তার হাতে সেদিনই পড়ে?

    হ্যাঁ।

    আপনার চিঠিতে এমন কিছু ছিল কি যা পড়ার পর বেসামাল হয়ে পড়তে পারে সে অথবা এই ধরনের কাজ করার মতো প্রবৃত্তি মনে জাগতে পারে?

    না, না, সে-রকম কিছুই ছিল না।

    চিঠিটা কি আপনি নিজেই ডাকে দিয়েছিলেন?

    ডিউক উত্তর দেওয়ার আগেই বেশ একটু গরম হয়ে কথা বলে উঠলেন তার সেক্রেটারি, নিজের হাতে চিঠি ডাকে দেওয়ার মতো অভ্যাস হিজ গ্রেসের এখনও হয়নি, অন্যান্য চিঠির সঙ্গে এ-চিঠিও স্টাডি টেবিলে রেখেছিলেন উনি–আমি নিজে পোস্ট ব্যাগে ফেলে দিয়ে আসি চিঠিগুলো।

    এ-চিঠিটাও সেসবের মধ্যে যে ছিল সে-বিষয়ে আপনার কোনো সন্দেহ নেই তো?

    নিশ্চয় না, চিঠিটা আমি লক্ষ করেছিলাম।

    সেদিন হিজ গ্রেস ক-টি চিঠি লিখেছিলেন?

    বিশ থেকে তিরিশটা। চিঠিপত্র আমাকে একটু বেশিই লিখতে হয়। কিন্তু এসব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে না?

    পুরোপুরি নয়, বলল হোমস।

    এবার ডিউক বলে উঠলেন, আমি পুলিশকে বলে দিয়েছি দক্ষিণ ফ্রান্সে তদন্ত চালানোর জন্যে। আগেই বলেছি আপনাকে, এ-রকম নোংরা কাজ ডাচেস কোনোদিনই প্রশ্রয় দেবেন না। কিন্তু ছেলেটার মাথাটাকে উদ্ভট খেয়ালের একটা কারখানা বললেই চলে। হয়তো জার্মান মাস্টারের সাহায্য নিয়ে সে মায়ের কাছে পালিয়েছে। ড. হাক্সটেবল, আমরা এবার হল-এ ফিরব।

    হোমসের মুখ দেখে বুঝলাম আরও কয়েকটা প্রশ্ন করার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু মন্ত্রীমশাই এমনই আচম্বিতে কথাবার্তার ওপর যবনিকা টেনে দিলেন যে তারপর প্রশ্ন তো দূরের কথা, সাধারণ আলাপ-আলোচনাও আর সম্ভব নয়। তার মতো উগ্ৰ অভিজাত পুরুষের পক্ষে একান্ত ঘরোয়া ব্যাপার নিয়ে একজন আগন্তুকের সাথে আলোচনা করা যে একেবারেই অসহ্য, তা বুঝতে কারোরই বাকি রইল না। আরও একটা ভয় তিনি করেছিলেন। হোমসের নতুন নতুন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হয়তো তার ডিউক-জীবনের ইতিহাস-প্রসঙ্গও এসে যাবে, আর, অতি সংগোপনে যেসব অন্ধকারময় কোণগুলো এতদিন ধরে ঢেকে রেখেছেন ফ্যামিলির চৌহদ্দির মধ্যে, তা আর গুহ্য থাকবে না–সাধারণ লোকের মুখরোচক আলোচনার বস্তু হয়ে দাঁড়াবে।

    সেক্রেটারিকে নিয়ে ডিউক চোখের আড়ালে যেতেই হোমস আর একটুও দেরি করলে না, স্বভাবমতো সঙ্গেসঙ্গে পরম আগ্রহে শুরু করে দিলে।

    লর্ড স্যালটায়ারের ঘর তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করেও কোনো সুরাহা হল না।

    জানলা ছাড়া যাওয়ার যে রাস্তা আর নেই, এ-বিশ্বাস আরও দৃঢ় হল সব কিছু দেখার পর। জার্মান মাস্টারের ঘর থেকেও নতুন কোনো সূত্র পাওয়া গেল না। ভদ্রলোকের দেহের ভারে আইভি লতাগুচ্ছের গোড়ায় মাটির ওপর তার গোড়ালির ছাপও পেলাম। ছোটো ছোটো সবুজ ঘাসের ওপর শুধু ওই একটি খাঁজ–গভীর রাতে রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধানের পার্থিব সাক্ষী শুধু ওইটুকুই আর কোনো ছিদ্র লনের ওপর পাওয়া গেল না।

    শার্লক হোমস একলাই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল কোথায়, ফিরল রাত এগারোটার পর। দেখলাম কার কাছ থেকে এ-অঞ্চলের মস্ত বড়ো একটা সামরিক মানচিত্র জোগাড় করে এনেছে সে। আবার ঘরে এসে বিছানার ওপর ম্যাপটা বিছিয়ে ঠিক মাঝখানে ল্যাম্পটা রাখল ও। তারপর শুরু হল ধূমপান। মাঝে মাঝে পাইপের ধূমায়িত অঙ্গারের দিকটা দিয়ে আগ্রহের সঞ্চার করে এমনি জায়গাগুলো দেখিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার কায়দায় কথা বলে চলল সে।

    কেসটা আমায় পেয়ে বসেছে, ওয়াটসন।সত্যিই কয়েকটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট আছে এ-ব্যাপারে। প্রথমেই কিছু ভূগোল-তত্ত্ব বুঝে রাখ, তদন্তের সময় খুবই কাজে আসবে এসব খুঁটিনাটি।

    ম্যাপটা দেখছ তো। এই কালো রঙের চৌকোনা জায়গাটা হল প্রায়রি স্কুল। আলপিন গেঁথে রাখলাম এখানে। আচ্ছা, এই যে লাইনটা দেখছ, এটা প্রধান সড়ক। দেখতেই পাচ্ছ, সড়কটা স্কুলের পাশ দিয়ে পুব আর পশ্চিমে চলে গেছে। দু-দিকেই মাইলখানেকের মধ্যে রাস্তাটা থেকে কোনো শাখাপ্রশাখা বেরোয়নি। জার্মান মাস্টার ছেলেটিকে নিয়ে যদি রাস্তা দিয়ে গিয়ে থাকে। তাহলে এটাই সে-রাস্তা।

    ঠিকই বলেছ।

    সৌভাগ্যক্রমে, সেদিন রাতে এই রাস্তা দিয়ে যা কিছু গেছে, তার একটা মোটামুটি হিসেব আমি পেয়েছি। আমার পাইপটা যেখানে রয়েছে এইখানে রাত বারোটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত একজন চৌকিদার পাহারায় ছিল। দেখতেই পাচ্ছ, পুবদিকের প্রথম শাখা-রাস্তা এইটাই। চৌকিদারটা দিব্যি গেলে বলছে যে এক মুহূর্তের জন্যেও চৌকি ছেড়ে এদিকে-ওদিকে যায়নি সে এবং তার চোখে ধুলো দিয়ে কোনো ছেলে বা লোকই এ-রাস্তা দিয়ে সেরাত্রে যায়নি। কনস্টেবলটার সঙ্গে কথা বলে দেখলাম তাকে অনায়াসেই বিশ্বাস করা চলে। কাজেই, পুবদিকের তদন্তে এইখানেই ইতি। এবার আসা যাক অন্যদিকে। দেখছ, এদিকে রেড বুল নামে একটা সরাইখানা রয়েছে, রেড বুল-এর ল্যান্ডলেডির শরীর অসুস্থ ছিল সেরাতে। ম্যাকলটন থেকে ডাক্তার ডেকে আনার জন্যে লোক পাঠিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা। কিন্তু অন্য কেস নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ডাক্তার এলেন পরের দিন সকালে। কাজেই সারারাত সজাগ থাকতে হয়েছে সরাইখানার লোকেদের। শুধু সজাগ নয়, ডাক্তারের প্রতীক্ষায় রাস্তার ওপরও নজর রাখতে হয়েছে প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত। সেরাতে রাস্তা দিয়ে কোনো প্রাণীই যে যায়নি, এ-খবর বেশ জোর দিয়েই জানালে ওরা। সুতরাং ওদের সাক্ষ্য সত্য বলেই মেনে নিয়ে আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে পশ্চিমদিকের তদন্তে দাঁড়ি টেনে দিলাম। তাহলে সংক্ষেপে আমরা পাচ্ছি কী? না, চম্পট দেওয়ার সময়ে পলাতকেরা প্রধান সড়ক একেবারেই ব্যবহার করেনি।

    কিন্তু সাইকেলটা? প্রতিবাদ জানালাম আমি।

    ঠিক ঠিক। সাইকেল প্রসঙ্গেও আসছি এখুনি। আপাতত শুধু যুক্তি দিয়ে আলোচনা করা যাক। এরা যদি রাস্তা দিয়ে না-গিয়ে থাকে, তাহলে বাড়ির উত্তর বা দক্ষিণ দিক বরাবর এদের রওনা হতে হয়েছে রাতারাতি এ-অঞ্চল পেরিয়ে যাওয়ার জন্যে। আচ্ছা, এবার এই দুটো সম্ভাবনা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা যাক। বুঝতেই পারছ, বাড়ির দক্ষিণ দিকে এই বিরাট অঞ্চলটা আসলে মস্তবড় একটা আবাদি জমি ছাড়া আর কিছু নয়। চাষের সুবিধের জন্যে চাষিরা পাথরের দেওয়াল দিয়ে নিজেদের মধ্যে টুকরো টুকরো জমিতে ভাগ করে নিয়েছে অতবড়ো জমিটা। এ-পথ দিয়ে সাইকেল যাওয়া অসম্ভব, কাজেই নাকচ হয়ে গেল এদিককার সম্ভাবনা। এবার এসো উত্তর দিকে। এদিকে দেখছি লম্বা লম্বা গাছের ছোটোখাটো একটা কুঞ্জবন—নাম লেখা রয়েছে এবড়ো-খেবড়ো উপবন। আরও উত্তরে দেখছি ধু-ধু জলাভূমি, লোয়ার গিল মূর!মস্তবড়ো জলাভূমি। বিস্তারে কম করে মাইল দশেক তো বটেই, আস্তে আস্তে ঢাল পথে উঠে গেছে ওপরদিকে। এই ধু-ধু। তেপান্তরের একধারে হোলডারনেস হল, রাস্তা বরাবর গেলে পুরো দশ মাইল, জলাভূমির মধ্যে দিয়ে গেলে মাত্র ছ-মাইল। বড়ো অদ্ভুত জায়গা, এ-রকম জনবসতিবিরল জায়গা সাধারণত দেখা যায় না। মাঝে মাঝে কৃচিৎ কয়েকটা মাথা গুঁজবার মতো ঠাঁই, জলাভূমির চাষিরা গোরু ছাগল চরাবার জন্যে এ-রকম চালা বানিয়ে রেখেছে এদিকে-সেদিকে। এ ছাড়া সমস্ত অঞ্চলটা ঘুরলে শুধু প্লোভার আর কারলু পাখির দঙ্গল ছাড়া আর কিছুই তুমি দেখতে পাবে না। চেস্টারফিল্ড হাই রোডে আসার পর আবার শুরু হল জনবসতি। একটা গির্জে, কয়েকটা কুঁড়েঘর আর একটা সরাইখানা। এর পরেই আচমকা খাড়াই হয়ে উঠেছে পাহাড়ের শ্রেণি। কাজেই বুঝতে পারছ ওয়াটসন, আমাদের তদন্ত শুরু করতে হবে উত্তর দিক থেকেই।

    কিন্তু সাইকেলটা? আমি লেগে থাকি নাছোড়বান্দার মতো।

    অসহিষ্ণুস্বরে হোমস বললে, আরে গেল যা! ওস্তাদ সাইক্লিস্ট কখনো রাস্তার বাছবিচার করে না এবং বড়োরাস্তাকে সে বাদ দিয়ে গলিঘুজির ভেতর দিয়েও অনায়াসেই চালাতে পারে তার দ্বি-চক্রযান। জলাভূমিতেও অজস্র সরু সরু রাস্তার অভাব নেই, তা ছাড়া সেরাত্রে আবার জোছনার ফুটফুটে আলোয় স্পষ্ট ছিল না কিছু। আরে, আরে, একী!

    কে যেন দারুণ উত্তেজিত হয়ে খটাখট শব্দে টোকা দিলে দরজায়। পরমুহূর্তেই ঘরে ঢুকলেন ড. হাক্সটেবল স্বয়ং। হাতে একটা নীল রঙের ক্রিকেট খেলোয়াড়ের টুপি। টুপির ওপরের অংশে সাদা জমির ওপর সোনালি জরি দিয়ে আঁকা উলটোনো V মার্কা মর্যাদাসূচক অলংকরণ।

    পেয়েছি, শেষ পর্যন্ত একটা সূত্র আমরা পেয়েছি! জয় ভগবান, এবার পাওয়া গেছে। ছেলেটার হদিশ। এ-টুপি লর্ড স্যালটায়ারের।

    কোথায় পেলেন?

    জলায় একদল জিপসি আস্তানা গেড়েছিল, তাদের ভ্যানে। মঙ্গলবার পাততাড়ি গুটোয় ওরা। আজকে পুলিশ ওদের পিছু নিয়ে ক্যারাভান তল্লাশ করতেই এ-টুপি পাওয়া যায়।

    ওরা কী বলছে?

    ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে ছাড়া কী আর বলবে! মঙ্গলবার সকালে ওরা নাকি টুপিটাকে জলাভূমিতে পড়ে থাকতে দেখেছিল। রাসকেল কোথাকার! সব জানে ওরা, ছেলেটাকে কোথায় গুম করে রাখা হয়েছে, সে-খবর ওরা ছাড়া কেউই দিতে পারবে না। আপাতত তো হাজতে পচুক হতভাগারা। তারপর, আইনের চোখরাঙানি তো আছেই। তাতেও না হলে ডিউকের টাকার জোরে মুখ খুলবে ওদের।

    আনন্দে আটখানা হয়ে ডক্টর বেরিয়ে যাওয়ার পরেই হোমস বললে, খবরটা মোটামুটি খুব খারাপ নয়, ওয়াটসন। সূত্র হিসেবে এর মূল্য কতখানি জানি না, কিন্তু এ থেকে যে থিয়োরি পাওয়া যাচ্ছে, তার মূল্য অনেক। সমস্ত তৎপরতা লোয়ার গিল মূরেই সীমিত রাখতে হবে–আর কোথাও নয়। জিপসিদের গ্রেপ্তার ছাড়া পুলিশ এ অঞ্চলে সত্যিকারের কোনো কাজই করতে পারেনি। ওয়াটসন, দেখেছ? জলার ওপর দিয়ে একটা জলের ধারা বয়ে গেছে। ম্যাপেতেই তো দাগ দিয়ে রাখা হয়েছে দেখছি। মাঝে মাঝে ধারাটা চওড়া হয়ে গিয়ে মিশেছে। নীচু জলা জায়গায়। ধারাটা বিশেষ করে দাগানো হয়েছে স্কুল আর হোলডারনেস হল-এর মাঝামাঝি জায়গায়। এখন আবহাওয়া যা শুকনো, তাতে জলাভূমির অন্যদিকের মাথা খুঁড়লেও পায়ের দাগ-টাগ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না আমার। চিহ্ন-টিহ্ন পাওয়া যেতে পারে শুধু এই জলে স্যাৎস্যাতে জায়গাটাতেই। কাল ভোরেই তোমায় ডাক দেব, ওয়াটসন। দুজনে মিলে দেখা যাক এ-রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারি কি না।

    সবে পাখির ডাক শুরু হয়েছে, রক্তরাগের আভা দেখা দিয়েছে পুবে, হোমস এসে টেনে তুলল আমায়। চোখ মেলেই দেখলাম শয্যার পাশে ওর দীর্ঘ মূর্তি দাঁড়িয়ে। অত ভোরেও সেজেগুঁজে তৈরি হয়ে নিয়েছে ও। মনে হল, ইতিমধ্যে এক চক্কর ঘোরাও হয়ে গেছে।

    আমি চোখ খুলতেই ও বলল, লন আর সাইকেল রাখার শেডটা দেখে এলাম, ওয়াটসন। এবড়ো-খেবড়ো উপবনএর মধ্যে দিয়েও এক পাক ঘুরে এলাম। পাশের ঘরে তোমার কোকো তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। চটপট তৈরি হয়ে নাও, বিস্তর কাজ সারতে হবে আজকে।

    দু-টুকরো হিরের মতো ঝকঝক করছিল ওর চোখ দুটো। কাজে হাত দেওয়ার আগে ওস্তাদ কারিগরের চোখ যেমন নিবিড় উৎসাহের রোশনাইতে জ্বলে ওঠে, এ যেন ঠিক তেমনি। এ যেন আর এক হোমস। বেকার স্ট্রিটের আত্মসমাহিত হোমস, দু-চোখে যার বিরং স্বপ্নালু তন্ময়তা; আর আজকের চটপটে, তৎপর হোমস, চোখে-মুখে দেহে মনে যার শুধু কাজের দীপ্তি–চেনা যায় না, যেন দু-রকমের ধাতুতে তৈরি দুজনে। মানসিক শক্তিতে ভরপুর সেই দীর্ঘ নমনীয় মূর্তির দিকে তাকিয়ে মনে হল, বাস্তবিকই আজ বড়ো কঠোর পরিশ্রমের দিন।

    কিন্তু তবু চরম নিরাশার মধ্যে দিয়েই শুরু হল আমাদের অভিযানের প্রথম পর্ব। বুকভরা আশা নিয়ে গেছিলাম জলাভূমিতে গাছপালার পচা শিকড়ে বোঝাই রাঙামাটির ওপর দিয়ে ব্লাড হাউন্ডের মতোই এগিয়ে গেলাম, ভেড়া যাতায়াতের অজস্র পথে শতধা বিভক্ত জলাভূমির গোলকধাঁধার মতো গলিখুঁজিতে বৃথাই ঘুরে বেড়ালাম, তারপর এসে পড়লাম জলাভূমির আর হোলডারনেসের মধ্যেকার চওড়া হালকা সবুজ রঙের বৃত্তাকার নীচু জলা জায়গায়। ছেলেটা যদি বাড়ির দিকেই গিয়ে থাকে, তাহলে তাকে এ-পথ মাড়িয়েই যেতে হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে কোনো রকম চিহ্ন না-রেখে তার পক্ষে যাওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়। কিন্তু সে তো নয়ই, এমনকী জার্মান মাস্টারও যে কস্মিনকালে এ-পথ দিয়ে গেছিল, তার কোনো নিশানা দেখলাম না। মুখ কালো করে হোমস সবুজ জলাভূমির কিনারা বরাবর হাঁটতে লাগল–প্যাঁচপেচে জমির ওপর কোনোরকম কাদা-চটচটে চিহ্ন দেখার প্রবল আশা তার আকুল চোখে। ভেড়া যাতায়াতের চিহ্ন দেখতে পেলাম বিস্তর কয়েক মাইল ধরে এক জায়গায়, গোরুর পায়ের ছাপও পেলাম। কিন্তু ওই পর্যন্ত–নতুন কিছুই ধরা পড়ল না আমাদের ব্যগ্র সন্ধানী চোখে।

    খুবই মুষড়ে পড়ল হোমস। শূন্য চোখে জলাভূমির ধু-ধু বিস্তারের পানে তাকিয়ে বললে, এদিকটা তো কোনোরকমের হল, এখন ওদিকে রয়েছে আর একটা নীচু জলা জায়গা, মাঝামাঝি এক ফালি জমিও দেখতে পাচ্ছি। আরে! আরে! একী দেখছি, একী দেখছি এখানে!

    কালো ফিতের মতো সরু একটা রাস্তার ওপর এসে পড়েছিলাম আমরা। ঠিক মাঝখানে ভিজে মাটির উপর দেখলাম সুস্পষ্ট সাইকেলের চাকার দাগ।

    হুররে। পেয়েছি। পেয়েছি। এবার উল্লসিত হওয়ার পালা আমার।

    কিন্তু হোমস যেন হতভম্ব হয়ে গিয়ে মাথা নাড়তে লাগল আপন মনে, চোখে-মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাসের বদলে দেখলাম নতুন কিছু পাওয়ার আশা।

    বলল, সাইকেল তো বটেই, কিন্তু সেই সাইকেলটা নয়। টায়ারের বিয়াল্লিশ রকমের বিভিন্ন ছাপের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। দেখতে পাচ্ছ। এ-ছাপটা ডানলপ টায়ারের, বাইরের কভারের ওপর একটা দাগও আছে। কিন্তু হেইডেগারের পামার টায়ার লাগানো আছে। ভিজে মাটির ওপর লম্বালম্বি স্ট্রাইপের ছাপ পড়ে তার সাইকেলের টায়ারে। এ-বিষয়ে গণিতের পণ্ডিত র্যাভেলিংয়ের অগাধ বিশ্বাস। কাজে কাজেই, এ-সাইকেল হেইডেগারের সাইকেল নয়।

    তাহলে নিশ্চয় ছেলেটার?

    তা হত যদি প্রমাণ করতে পারতাম যে তারও দখলে ছিল আরও একটি সাইকেল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা আমরা পারিনি। এই দাগটার সৃষ্টি যার সাইকেল, সে কিন্তু স্কুলের দিক থেকেই এসেছে।

    স্কুলের দিকেও তো যেতে পারে?

    আরে না, না, মাই ডিয়ার ওয়াটসন। যে-ছাপটা গভীর হয়ে ফুটে ওঠে মাটির ওপর, সেইটাই কিন্তু পেছনকার চাকার, কেননা ভারটা তো বেশির ভাগ পেছনের চাকার ওপরেই পড়ে। কয়েক জায়গায় লক্ষ করলেই দেখবে পেছনের চাকাটা অনেক বার সামনের চাকার হালকা অগভীর ছাপের ওপর দিয়ে গেছে। সুতরাং স্কুলের দিক থেকেই আসছিল সাইকেলটা। আমাদের বর্তমান তদন্তের সঙ্গে এ-ব্যাপারের সম্পর্ক থাকুক আর না-থাকুক, আমরা দাগ বরাবর গিয়ে দেখব কোথা থেকে এসেছে সাইকেলটা।

    করলাম তাই। কয়েকশো গজ যাওয়ার পরেই জলাভূমির ভিজে মাটি ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই টায়ারের দাগও গেল মিলিয়ে। আবার পিছিয়ে এলাম খানিকটা। এক জায়গার দাগের ওপর দিয়ে ঝির ঝির করে বয়ে চলেছিল ঝরনা। এখানে পেলাম আবার সাইকেলের দাগ। কিন্তু গোরুর খুরের অজস্র ছাপে দাগ প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে বললেই চলে। এরপর আর কোনো ছাপ নেই। রাস্তাটা কিন্তু সিধে চলে গেছে স্কুলের পেছন দিককার এবড়োখেবড়ো উপবনের ভেতরে। বুঝলাম, সাইকেলের আবির্ভাব ঘটেছে এই উপবনের ভেতর থেকেই। হাতের ওপর চিবুক রেখে একটা পাথরের চাঁইয়ের ওপর বসে পড়ল হোমস। পর পর দুটো সিগারেট শেষ করে ফেললাম, কিন্তু পাথরের খোদাই করা মূর্তির মতো ওর মধ্যে এতটুকু স্পন্দন দেখলাম না।

    দু-দুটো সিগারেট ছাই হয়ে যাওয়ার পর হোমস বললে, এমনও তো হতে পারে যে, অচেনা ছাপ ফেলার উদ্দেশ্যে কোনো চতুরচূড়ামণি সাইক্লিস্ট রওনা হওয়ার আগে টায়ার দুটো পালটে নিয়েছে। এ ধরনের বুদ্ধি যে-ক্রিমিনালের মাথায় আসে, তার সঙ্গে বুদ্ধির পাঞ্জা কষেও আনন্দ আছে। আপাতত এ-প্রশ্নের সমাধান না-করে জলাভূমির দিকেই ফিরে যাই চলো। এখনও অনেক কাজ বাকি ওদিকে।

    ভিজে ভিজে জমির ওপর আবার শুরু হল আমাদের অভিযান, চোখে অণুবীক্ষণ লাগিয়ে ধুলো থেকে সোনা খোঁজার মতোই তন্নতন্ন করে অতি নগণ্য জিনিসও খুঁটিয়ে দেখতে কসুর করলাম না। অচিরেই আমাদের এত পরিশ্রম হল সার্থক, ফলাফল পেলাম হাতে হাতে।

    জলাভূমির নীচের অংশে আড়াআড়ি একটা পাঁকাল রাস্তা চোখে পড়ায় সেদিকে এগুচ্ছি, এমন সময় খানিকটা তফাত থেকেই সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল হোমস। পথটার ঠিক মাঝখানেই একগোছা টেলিগ্রাফের সূক্ষ্ম তারের মতো একটা লম্বা ছাপ। পামার টায়ার।

    মহা খুশিতে রীতিমতো চেঁচামেচি জুড়ে দিল হোমস, এই হল হের হেইডেগারের সাইকেল! এবার আর ভুল হবার জো নেই। কী হে ওয়াটসন আমার যুক্তি-টুক্তিগুলো খাঁটি মনে হচ্ছে না?

    আমার অভিনন্দন রইল।

    কিন্তু এখনও যে অনেক দূর যেতে হবে, বন্ধু। দয়া করে রাস্তা ছেড়ে হাঁটো। এবার শুরু হোক পামার টায়ার অনুসরণ পর্ব। বেশি দূর যেতে হবে বলে তো মনে হয় না।

    কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম, জলাভূমির একদিককার অংশে নরম মাটির টুকরো টুকরো জমির সংখ্যা বড়ো কম নয়। কাজেই মাঝে মাঝে পামার টায়ার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল চোখের সামনে থেকে, কিন্তু একেবারে নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম সামনের দিকে এগিয়ে গেলেই।

    হোমস বললে, একটা জিনিস লক্ষ করেছ ওয়াটসন? লোকটা সাইকেলের গতিবেগ কিন্তু এবার বাড়িয়ে দিয়েছে। না, কোনো সন্দেহই নেই সে-বিষয়ে। এই ছাপটা দেখ, দুটো টায়ারের দাগই পরিষ্কার উঠেছে এখানে।লক্ষ করেছ, দুটো ছাপই সমান গভীর। তার মানে কী? হেইডেগার হ্যান্ডেলবারের ওপর দেহের ভর দিয়ে সাইকেল চালিয়েছে। তিরবেগে সাইকেল চালাতে গেলে সামনের দিকে এইভাবেই ঝুঁকে পড়তে হয়। সর্বনাশ একবার আছাড়ও খেয়েছে দেখছি।

    বেশ কয়েক গজ পর্যন্ত টায়ারের সুস্পষ্ট ছাপ নষ্ট হয়ে গেছে অনেকটা জুড়ে একটা ধ্যাবড়া। দাগে। এরপর কতকগুলো পায়ের ছাপ। ঠিক তার পরেই আবার দেখা দিয়েছে পামার টায়ার।

    পাঁকের ওপর চাকা পিছলে গেছে মনে হচ্ছে, বললাম আমি।

    দোমড়ানো-মোচড়ানো কাটা-ফুলের একটা শাখা তুলে ধরলে হোমস। সভয়ে দেখলাম টুকটুকে লাল রঙের ছাপ লেগেছে হলুদ কুঁড়িগুলোয়। এমনকী রাস্তার ওপরে আর ছোপের মধ্যেও দেখলাম চাপ চাপ জমাট রক্তের কালো দাগ।

    খারাপ। ভারি খারাপ! বিড়বিড় করতে থাকে হোমস।সরে দাঁড়াও ওয়াটসন। এলোমেলো পায়ের ছাপ আর একটিও নয়! কী দেখছি জান? আহত হয়ে পড়ে গেলেন হেইডেগার, তবুও দাঁড়িয়ে উঠলেন রক্তাক্ত দেহে, বসলেন সাইকেলের সিটে, শুরু হল যাত্রা। কিন্তু নতুন দাগ তো আর দেখছি না। পাশের সরু পথটায় গোরু ঘোড়া মোষ ভেড়া চলার চিহ্ন তো দেখছি অনেক। ষাঁড়ের গুতো-টুতো খাননি তো? অসম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় প্রাণীর চিহ্নও তো দেখছি না হে। ওয়াটসন, চল এগিয়ে যাই, যা থাকে কপালে। রক্তের দাগ আর চাকার ছাপ এই আমাদের সম্বল, চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়া এবার আর সম্ভব নয় বাছাধনের পক্ষে।

    এবারের অনুসন্ধান পর্ব হল খুবই সংক্ষিপ্ত। ভিজে ভিজে চকচকে পাথরের ওপর দিয়ে হঠাৎ মাতালের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেল পামার টায়ার। তার পরেই সামনের দিকে তাকাতে আচম্বিতে আমার চোখে পড়ল ঘন কাটাঝোঁপের মধ্যে ঝকঝকে ধাতুর মতো কী-একটা জিনিস। ভেতর থেকে টেনে বার করলাম পামার টায়ার লাগানো একটা সাইকেল। একটা প্যাডেল দুমড়ে গেছে। সামনের দিকটা আগাগোড়া ভিজে গেছে টস টস করে ঝরে পড়া রক্তে। বীভৎস! ঝোঁপের অন্যদিকে আকাশমুখো একটা জুতো দেখে ঘুরে দৌড়োলাম আমরা। সাক্ষাৎ মিলল হতভাগ্য সাইক্লিস্টের। বেশ লম্বা চেহারা ভদ্রলোকের, একমুখ ঘন দাড়ি, চোখের চশমার একটা কাচের আর পাত্তা পাওয়া গেল না। মাথার ওপর প্রচণ্ড আঘাত পাওয়ায় মৃত্যু হয়েছে তার খুলির সামনে দিকটা একেবারেই চুরমার হয়ে গেছে সেই সাংঘাতিক ঘায়ে। এ-রকম মারাত্মক আঘাত পাওয়ার পরেও যে-পুরুষ এতটা পথ আবার সাইকেল চালিয়ে আসতে পারে তার প্রাণশক্তি আর সাহসের প্রশংসা করতে হয় সহস্ৰমুখে। ভদ্রলোকের পায়ে জুতো আছে বটে, কিন্তু মোজা নেই, বুক খোলা কোটের নীচে দেখলাম রাত্রে পরার একটা নাইট-শার্ট। না, কোনো সন্দেহই নেই, এ-লাশ পলাতক জার্মান মাস্টার হেইডেগারেরই।

    সশ্রদ্ধভাবে মোলায়েম হাতে দেহটা উলটে ফেলে অনন্যমনা হয়ে কিছুক্ষণ পরীক্ষা করল হোমস। তারপর কিছুক্ষণ ড়ুবে রইল গভীর চিন্তায়। কুঁচকানো কপালের অজস্র রেখা দেখে বেশ বুঝলাম, এই শোচনীয় আবিষ্কারে আমাদের সত্যিকারের সমস্যার সুরাহা হয়নি কিছুই এবং আমরা যে-তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই আছি।

    বেশ কিছুক্ষণ পরে ও বললে, কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না, ওয়াটসন। আমার নিজের অভিমত হচ্ছে তদন্ত চালিয়ে যাওয়া। ইতিমধ্যেই পামার টায়ার রহস্য নিয়ে এত সময় নষ্ট করে ফেলেছি যে আর একটা ঘণ্টাও বাজেভাবে কাটাতে রাজি নই আমি। পক্ষান্তরে পুলিশের কানেও এখনকার খবর পৌঁছে দেওয়ার কর্তব্য আমাদেরই। হতভাগ্য মাস্টারের দেহটার গতি যাতে হয় সে-ব্যবস্থাও তো করা দরকার।

    খবর নিয়ে আমিই ফিরে যেতে পারি।

    কিন্তু তোমার সঙ্গ আর সাহায্য আমার এখন বিশেষ দরকার। সবুর। ওদিকে ওই যে লোকটা পচা শেকড় মেশানো মাটি কাটছে–ডাকো ওকে, ওকে দিয়েই খবর পাঠানো যাক।

    চাষি লোকটাকে ডেকে আনলাম। খুনখারাপি দেখে তো ভয়ের চোটে তার ধাত ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম। হোমস একটা চিরকুট লিখে তার হাতে দিল ডা. হাক্সটেবলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে।

    লোকটা বিদেয় হলে হোমস বললে, ওয়াটসন, আজ সকালে তাহলে মোট দুটো সূত্র পেলাম। এক নম্বর হচ্ছে পামার টায়ার লাগানো বাইসাইকেল। তদন্ত শুরু করার আগে একবার ভেবে নেওয়া যাক আমাদের হাতে এই মুহূর্ত পর্যন্ত কী কী তথ্য এসেছে। যে-তথ্য নিছক দৈবাৎ, তা বাদ দেব, হাতে রাখব শুধু নিতান্ত প্রয়োজনীয় পয়েন্টগুলো।

    সবার আগে একটা বিষয় তোমায় বলে রাখি,ওয়াটসন। ছেলেটা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় পালিয়েছে স্কুল ছেড়ে। নিজেই জানলা গলে আইভিলতা বেয়ে নীচে নেমেছে সে, যাবার সময়ে হয় একলা গেছে, আর না হয় সঙ্গে কাউকে নিয়েছে। এ-বিষয়ে কোনোরকম সন্দেহ আমার নেই।

    আমিও একমত হলাম হোমসের সাথে।

    বেশ, এবার তাহলে আসা যাক হতভাগ্য জার্মান মাস্টারের প্রসঙ্গে। যাওয়ার সময়ে ফিটফাট হয়ে বেরিয়েছে ছেলেটি। তার মানে, সে জানত কী করতে চলেছে সে। কিন্তু হেইডেগার মোজা না-পরেই বেরিয়ে পড়লেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে তাকে তৈরি হয়ে নিতে হয়েছে–মোজা পরার সময় বা সুযোগ হয়নি সেই কারণেই।

    নিঃসন্দেহে।

    কিন্তু হেইডেগার গেলেন কেন? কারণ শোবার ঘরের জানলা থেকে ছেলেটার পলায়ন-দৃশ্য উনি দেখতে পেয়েছিলেন। সাইকেলে পিছু নিয়ে ওকে ধরে ফেলে ফিরিয়ে আনার অভিপ্রায় নিয়েই শুরু হয়েছে ওঁর নিশা-অভিযান। তাই তাড়াতাড়ি সাইকেল বার করে বেরিয়েছিলেন উনি। কিন্তু ওই বেরোনোই হল ওঁর কাল।

    আমার তাই মনে হয়।

    এবার আসছি বিতর্কের সবচেয়ে গোলমেলে অংশে। একটা ছেলের পিছু নেওয়ার ইচ্ছে থাকলে যেকোনো পুরুষের পক্ষে পেছন পেছন দৌড়ানোই স্বাভাবিক। কেননা, দৌড়ে তাকে টেক্কা দেওয়া তো আর ছোটো ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অবাক কাণ্ড, জার্মান মাস্টার এই সহজ পথ না-নিয়ে শরণ নিলেন সাইকেলের। শুনেছি, ভদ্রলোক ওস্তাদ সাইক্লিস্ট ছিলেন এবং উনি কখনোই তার দ্বি-চক্র্যানের সাহায্য নিতেন না যদি-না উনি দেখতেন যে ছেলেটি চম্পট দেওয়ার জন্যে শরণ নিয়েছে কোনো বেগবান বাহনের।

    আর একটা বাইসাইকেলের সম্ভাবনা এসে গেল কিন্তু।

    দেখাই যাক না যুক্তির পথে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। স্কুল থেকে পাঁচ মাইল দূরে খুন হলেন হেইডেগার। মনে রেখো, মৃত্যু কিন্তু বুলেটের চুম্বনে নয়। শক্তিশালী হাতের অত্যন্ত বর্বরোচিত আঘাতে। বুলেট ছুঁড়ে মানুষ খুন করা যেকোনো ছেলেমানুষের পক্ষেই সম্ভব, কিন্তু মাথার খুলি গুঁড়ো করার মতো পাশবিক আঘাত হানার ক্ষমতা তার হাতে নেই। কাজেই, ছেলেটির নৈশ-পলায়নের সঙ্গী ছিল একজন। এবং অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এই পাঁচ মাইল পেরিয়ে এসেছে তারা–কেননা, এই সুদীর্ঘ পথেও হেইডেগারের মতো পাকা সাইক্লিস্ট তাদের পেরিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু অকুস্থল পর্যবেক্ষণ করে, আশেপাশের জায়গা-জমি তন্নতন্ন তরে দেখেও আমরা পাচ্ছি কী? গোরু, মোেষ, ভেড়ার আনাগোনার চিহ্ন ব্যস, আর কিছুই নয়। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে ঘুরে এসেও পঞ্চাশ গজের মধ্যে কোনো পথঘাটের সন্ধান পেলাম না। খুনের সঙ্গে আর একজন সাইক্লিস্টের কোনো সম্পর্কই নেই। এমনকী, কোনো মানুষের পায়ের ছাপও নজরে এল না।

    হোমস, কী বলছ তুমি, এ যে অসম্ভব!

    শাবাশ! খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য! অসম্ভব বটে, হয় আমার বলার ভঙ্গিমাই ভুল, আর না হয় ভুল লুকিয়ে আছে যা বলেছি তার মধ্যে। কিন্তু নিজের চোখেই তো তুমি সব দেখলে, যুক্তিতর্কের কোনো কারচুপি নিয়ে তোমার খটকা লাগছে?

    আছাড় খাওয়ার সময় মাথার খুলি ভেঙে যায়নি তো?

    এইরকম একটা জলা জায়গায়, ওয়াটসন?

    ভাই, আমার বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে যাচ্ছে।

    আরে ছ্যাঃ, কী বলছ। অনেকগুলো ঘোরালো সমস্যার সমাধান করলাম আমরা। মালমশলা পেয়েছি বিস্তর–এখন শুধু তাদের কাজে লাগানোই বাকি। পামার-পর্ব তো শেষ হল, এবার এসো ডানলপের পিছু নিয়ে দেখা যাক কোথায় পৌঁছেই আমরা।

    শুরু হল ডানলপের চিহ্নিত পথে শিকারী কুকুরের মতো আমাদের অভিযান। কিছু দূরে যাওয়ার পরেই জলাভূমি ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে উঠে গেল ওপর দিকে, জলের ধারা পেছনে ফেলে এসে পড়লাম গুল্মসমাকীর্ণ বৃত্তাকার সুদীর্ঘ একটা অংশের ওপর। এ-রকম জায়গায় কোনো চিহ্নই পাওয়া আর সম্ভব নয়। শেষবারের মতো যেখানে ডানলপের চিহ্ন দেখলাম, সেখান থেকে হোলডারনেস হলের দিকে যাওয়া যায়। কয়েক মাইল দূরে বাঁ-দিকে হল-এর আকাশছোঁয়া জমকালো চূড়াগুলো চোখে পড়ছিল। আবার সামনের দিকে চেস্টারফিল্ডের হাইরোডের পাশে ধূসর গ্রামটার দিকে যাওয়াও সম্ভব।

    শ্রীহীন, অপরিচ্ছন্ন সরাইখানার দিকে এগুচ্ছি দুজনে, দূর থেকেই দরজারওপর লড়ায়ে-মোরগের প্রতীকটা দেখা যাচ্ছিল, এমন সময়ে আচমকা গুঙিয়ে উঠে আমার কাধ চেপে ধরে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলে হোমস। বেকায়দায় গোড়ালি মচকে গেলে যেমন অসহায় হয়ে পড়ে মানুষ, তারও অবস্থা হল তাই। অতি কষ্টে খোঁড়াতে খোঁড়াতে দরজার সামনে পৌঁছোল ও ময়লা রঙের স্থূল চেহারার একজন প্রৌঢ় কালো মাটির পাইপে ধূমপান করছিল আসনসিঁড়ি হয়ে বসে।

    কেমন আছেন, মি. রিউবেন হেইজ? জিজ্ঞেস করে হোমস।

    কে আপনি? আমার নামটাই-বা জানলেন কোত্থেকে? একজোড়া ধূর্ত চোখে সন্দেহের বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

    আপনার মাথার ওপর বোর্ডেই তো লেখা রয়েছে নামটা! আর, বাড়ির মালিককে দেখলে তত চিনতে কোনো অসুবিধে হয় না। আপনার আস্তাবলে ঘোড়ার গাড়ি বা এ-জাতীয় কিছু আছে নাকি?

    না নেই।

    যন্ত্রণায় মাটির ওপর পা-টাও রাখতে পারছি না আমি।

    তাহলে রাখবেন না।

    হাঁটতেও পারছি না।

    তাহলে লাফান।

    মি. রিউবেন হেইজের হাবভাব আর যাই হোক বরদাস্ত করার মতো নয়। কিন্তু বলিহারি যাই হোমসের, যেন নিছক রঙ্গ-পরিহাস করছে অভদ্র লোকটা, এমনিভাবে দিব্যি কথাবার্তা চালিয়ে গেল ও।

    বলল, আরে মশাই, দেখতেই তো পাচ্ছেন কীরকম বেকায়দায় পড়েছি আমি। যানবাহন না হয় একটা পেলেই হল, ও নিয়ে আমি অত ভাবি না।

    আমিও না, গম্ভীর মুখে বলে সরাইখানার মালিক।

    এত হালকাভাবে নেবেন না, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণে এখুনি আমার একটা সাইকেল দরকার এবং ভাড়া হিসাবে একটা গিনি দিতে রাজি আছে আমি।

    কান খাড়া করে মি. রিউবেন হেইজ, কোথায় যেতে চান?

    হোলডারনেস হলে।

    ডিউকের চ্যালাচামুণ্ডা মনে হচ্ছে? আমাদের কাদামাখা পোশাকের ওপর সবিদ্রুপ চাহনি বুলিয়ে নেয় লোকটা।

    হো হো করে হেসে ওঠে হোমস। বলে, ডিউকের সঙ্গে আমাদের দেখা হলে তার আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকবে না।

    কেন শুনি?

    তার হারানো ছেলের খবর এনেছি বলে।

    দস্তুরমতো চমকে ওঠে মি. রিউবেন হেইজ।

    ছেলেটার পিছু পিছু এখানে এসে পৌঁছেছেন নাকি?

    খবর এসেছে, লিভারপুলে রয়েছে সে। যেকোনো মুহূর্তে পুলিশ তাকে পাকড়াও করার আশা রাখছে।

    চকিতে মুখচোখের ভাব পালটে যায় লোকটার। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফভরা ভারী মুখে আচম্বিতে ফুটে ওঠে বিনয়ের পরাকাষ্ঠা।

    বলে, ডিউককে অভিনন্দন জানানোর ইচ্ছে মোটেই নেই আমার এবং তার কারণ আছে। এক সময়ে তার প্রধান কোচোয়ান ছিলাম আমি। কিন্তু বড়ো জঘন্য ব্যবহার করেছিলেন আমার সাথে। একটা মিথ্যেবাদী ভুট্টাওলার কথা বিশ্বাস করে আমায় বরখাস্ত করেছিলেন উনি। কিন্তু লিভারপুলে লর্ড স্যাটায়ারের খোঁজ পাওয়া গেছে শুনে খুশি হলাম। আমি দেখছি যাতে আপনি

    এ-খবর হল-এ নিয়ে যেতে পারেন।

    হোমস বললে, ধন্যবাদ। প্রথমেই পেটে কিছু দানাপানি পড়া দরকার। সাইকেলটা তার পরে আনবেন।

    আমার কোনো সাইকেল নেই।

    একটা গিনি বার করে হোমস।

    আরে মশাই, বললাম তো আমার সাইকেল নেই। হল পর্যন্ত যাওয়ার জন্যে দুটো ঘোড়া আমি দিচ্ছি আপনাদের।

    ঠিক আছে, ঠিক আছে, আগে কিছু খেয়ে নিই, তারপর হবেখন এসব কথা।

    এবড়োখেবড়ো পাথরে বাঁধানো রান্নাঘরে বসিয়ে মি. রিউবেন হেইজ বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পলক ফেলার আগেই বেমালুম সেরে গেল হোমসের গোড়ালির মচকানি।

    দিনের আলো নিভে আসতে বিশেষ দেরি নেই। সেই কোন সকালে বেরিয়েছি দুজনে, সারাদিন দাঁতে কুটোটি কাটবার সময় বা সুবিধে হয়নি। তাই, প্রথমেই কিছুটা সময় ব্যয় করলাম খাওয়ার জন্যে। চিন্তাচ্ছন্ন মুখে হোমস বার কয়েক জানলার কাছে গিয়ে সাগ্রহে তাকালে বাইরে। নোংরা উঠানটার খানিকটা নজরে পড়ছিল খোলা জানলা দিয়ে। দূরে এককোণে কামারশালার কাজ করছিল কালিঝুলিমাখা একটা ছোকরা। আর একদিকে রয়েছে আস্তাবল। দ্বিতীয়বার জানলা থেকে ঘুরে এসে আবার বসে পড়েছিল হোমস, তারপরেই আচমকা চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল ও।

    ওয়াটসন, ওয়াটসন, পেয়েছি! হ্যাঁ, তাঁ, যা ভেবেছি, তাই। ওয়াটসন আজকে গোরুর খুরের ছাপ দেখেছ বলে মনে পড়ে তোমার?

    এন্তার দেখেছি।

    কোথায়?

    কোথায় নয়? জলা জায়গায় দেখেছি, দেখেছি রাস্তার উপর, বেচারা হেইডেগার যেখানে শেষ ঘুমে শুয়েছেন সেখানেও দেখেছি বলে মনে পড়ছে।

    এগজ্যাক্টলি। আচ্ছা, ওয়াটসন, জলাভূমিতে আজ ক-টা গোরু দেখেছ বলো তো?

    আদৌ দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না।

    আশ্চর্য, ওয়াটসন, সত্যি আশ্চর্য! যেখান দিয়ে যেখান দিয়ে গেছি, দেখেছি এন্তার গোরুর পদাঙ্ক, কিন্তু সারাজলাভূমিতেও দেখিনি একটাও গোরু। আশ্চর্য! অদ্ভুত! কি বল, ওয়াটসন?

    আশ্চর্যই বটে।

    এবার একটু মাথা খাটাও দিকি ব্রাদার। মনটাকে পাঠিয়ে দাও জলাভূমিতে! রাস্তার ওপর দাগগুলো দেখতে পাচ্ছ তো?

    তা পাচ্ছি।

    তোমার মনে পড়ে কি খুরের ছাপগুলো একবার ছিল এক রকম, বলে অনেকগুলো টুকরো রুটি এইভাবে সাজালে সে—ঃঃঃঃঃ–আর একবার ছিল এইরকম–ঃº ঃº ঃº ঃº –এবং মাঝে মাঝে ছিল এইরকম–০º০º০º কি, মনে পড়ছে তোমার?

    না, ভাই।

    কিন্তু আমার মনে আছে। দিব্যি গেলে বলতে পারি ভুল হয়নি আমার। যাই হোক, অবসরমতো ফিরে গিয়ে যাচাই করে দেখলেই হবেখন। আমি একটা অন্ধ গর্দভ, ওয়াটসন। তখনই আমার সমাধানে পৌঁছোনো উচিত ছিল।

    সমাধানটা কী, তাই শুনি?

    সমাধান শুধু একটাই–এবং তা হচ্ছে একটা পরমাশ্চর্য গোরুর পদাঙ্কদর্শন! এ-গোরু দিব্যি হাঁটে, কদম চালে চলে, আবার দরকার হলে, লম্বা লম্বা লাফ মেরে ছুটতেও কসুর করে না। ওয়াটসন, আমি শপথ করে বলতে রাজি আছি, এ-জাতীয় ধোঁকাবাজি যার মগজে আছে, তাকে আর যাই হোক, গাঁইয়া বলা চলে না। কামারশালার ওই ছোকরাটা ছাড়া পথ পরিষ্কার হবে বলে মনে হচ্ছে না। চলো হে, টুক করে বেরিয়ে গিয়ে দেখে আসি কী ব্যাপার।

    আস্তাবলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল দুটি ঘোড়া। কর্কট চুল উশকোখুশকো–যেন দলাইমলাই হয়নি কতদিন। একটা ঘোড়ার পেছনের পা তুলে ধরে সজোরে হেসে উঠল হোমস।

    পুরোনো খুর, কিন্তু লাগানো হয়েছে নতুন পুরোনো নাল, কিন্তু পেরেকগুলো নতুন। ক্লাসিক কেসের পর্যায়ে ফেলা যায় এ-কেসটাকে। চলো, কামারশালায় একবার টু মেরে আসি।

    আমাদের গ্রাহ্যের মধ্যে না-এনে একমনে কাজ করে চলল ছোকরাটা। মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়ে ছিল লোহা আর কাঠের বিস্তর টুকরো। দেখলাম ডাইনে বাঁয়ে সামনে ঘুরছে হোমসের সন্ধানী দৃষ্টি এইসব আবর্জনার মধ্যে। আচম্বিতে পেছনে পায়ের শব্দ শুনেই চমকে ফিরে তাকিয়ে মুখোমুখি হয়ে গেলাম স্বয়ং রিউবেন হেইজের সাথে; ঝোঁপের মতো পুরু কালো কুচকুচে ভুরুজোড়া নেমে এসেছিল শ্বাপদের মতো জ্বলন্ত চোখ দুটোর ওপর, সমস্ত দেহ ফুলে ফুলে উঠেছিল অবরুদ্ধ ক্রোধে।

    ধাতুর টুপি লাগানো একটা খাটো লাঠি হাতে সাক্ষাৎ কালান্তকের মতো এমন ভঙ্গিমায় সে এগিয়ে এল আমাদের পানে যে তৎক্ষণাৎ পকেটের মধ্যে রিভলভারটাকে আঁকড়ে ধরে স্বস্তিবোধ করলাম আমি।

    শয়তান স্পাই কোথাকার! কী করছেন এখানে? বাজের মতো চিৎকার করে ওঠে লোকটা।

    নিরীহ স্বরে হোমস বললে, আরে মশাই, আপনার রকম-সকম দেখে তো লোকে ভাববে–জানি কী গোপন কথাই ফাঁস হয়ে গেল আপনার।

    প্রবল প্রচেষ্টায় নিজেকে সংযত করে নিলে মি. রিউবেন হেইজ। কুটির চাইতেও ভয়ংকর হয়ে উঠল তার মুখের সেঁতো হাসি।

    কামারশালায় কিছু দেখার ইচ্ছে থাকলে দেখতে পারেন, কোনো আপত্তি নেই আমার। কিন্তু মিস্টার আমার চোখের আড়ালে আমার বাড়িতে ঘুরঘুর করাটা একবারেই পছন্দ করি না আমি। চটপট পাওনা মিটিয়ে দিয়ে সরে পড়ুন এখান থেকে, তাহলেই খুশি হই আমি।

    হোমস বললে, ঠিক আছে, মি. হেইজ আপনার কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে আমাদের নেই। আপনার ঘোড়াগুলো একটু দেখছিলাম। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে হেঁটেই যেতে পারব আমরা–খুব দূর নয়, কী বলেন?

    হলের ফটক এখান থেকে দু-মাইলের বেশি নয়। বাঁ-দিকের ওই রাস্তা ধরে এগিয়ে যান। বাড়ি থেকে বেরিয়ে না-আসা পর্যন্ত কুতকুতে চোখে আমাদের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল বর্বর লোকটা।

    রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার পর মোড় ঘুরে মি. রিউবেন হেইজের চোখের আড়ালে আসতেই দাঁড়িয়ে গেল হোমস।

    বলল, বেশ গরম ছিলাম সরাইখানার ভেতর। যতই দূরে যাচ্ছি, ততই যেন ঠান্ডাটা জাঁকিয়ে বসছে আমার ওপর। না, না, ও-জায়গা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমি বললাম, আমার দৃঢ় বিশ্বাস রিউবেন হেইজ এ-রহস্যের সব খবর রাখে। এরকম ধরনের মূর্তিমান যমের মতো বদমাশ খুব অল্পই দেখেছি আমি ওর চেহারাই ওর মনের ছবি।

    আহা! লোকটার মধ্যে শুধু ওইটুকুই দেখলে তুমি? ঘোড়াগুলো রয়েছে কামারশালাটা রয়েছে–এসব কিছুই নয়? না, হে, না, লড়ায়ে মোরগওলা এমন খাসা সরাইখানা ছেড়ে যেতে মন সরছে না আমার ভারি ইন্টারেস্টিং জায়গা কিন্তু। চলো, গায়ে পড়ে আর একবার দেখে আসি ভেতরটা।

    ঢালু হয়ে পাহাড়টা উঠে গেছিল ওপরদিকে, বড়ো বড়ো চুনাপাথরের ধূসর রঙের চাই পড়ে ছিল বিস্তর। রাস্তা ছেড়ে এই পাহাড় বেয়ে সবে উঠতে শুরু করেছি ওপরে, এমন সময় হোলডারনেস হল-এর দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের পানে বেগে ছুটে আসছে একটা সাইকেল।

    বসে পড়ো, ওয়াটসন, বসে পড়ো!সজোরে আমার কাঁধে চাপ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল হোমস। পাথরের আড়ালে লুকোতে-না-লুকোতেই ঝড়ের মতো এগিয়ে এসে সাঁ করে আমাদের পেরিয়ে গেল লোকটা। কুণ্ডলীপাকানো রাশিরাশি ধুলোর মেঘের মতো এগিয়ে এসে সাঁ করে লহমার জন্যে চোখে পড়ল উদবেগ থর থর ফ্যাকাশে একটা মুখ মুখের পরতে পরতে প্রকট হয়ে উঠেছে অপরিসীম আতঙ্ক; হাঁ হয়ে গেছে মুখ, চোখ দুটো যেন উন্মাদ আবেগ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে। গতরাতে চটপটে চালাকচতুর যে জেমস ওয়াইল্ডারকে আমরা দেখেছি, এ যেন তাঁর এক কিম্ভুতকিমাকার প্রতিচ্ছবি, বিকট রূপ দেখিয়ে সঙের মতো লোক হাসানোর প্রচেষ্টা।

    ডিউকের সেক্রেটারি? চেঁচিয়ে ওঠে হোমস।নেমে এসো ওয়াটসন, দেখা যাক ভদ্রলোক যান কোথায়।

    পাথরের চাঁই ধরে ধরে খানিকটা নেমে এমন একটা জায়গায় এলাম যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় সরাইখানার সামনের দরজাটা। দেওয়ালে হেলান রাখা ওয়াইল্ডারের বাইসাইকেলটা চোখে পড়ল। বাড়ির মধ্যে কাউকে নড়াচড়া করতে দেখলাম না, জানলাতেও দেখতে পেলাম না কারো মুখ। হোল্ডারনেস হল-এর সুউচ্চ চুড়োগুলোর ওপাশে সূর্য হেলে পড়তেই নেমে এল। গগাধূলির ম্লান বিষাদাভা। তারপর, আলো আঁধারির মাঝে আস্তাবলের সামনে উঠোনে একটা ঘোড়ার গাড়ির দু-পাশের আলো দুটো জ্বলে উঠতে দেখলাম এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই শুনলাম অশ্বখুরধ্বনি। খটাখট শব্দে রাস্তার ওপর বেরিয়ে এল গাড়িটা এবং প্রচণ্ড বেগে যেন উড়ে গেল চেস্টারফিল্ডের দিকে।

    কী মনে হয়, ওয়াটসন, ফিসফিস করে ওঠে হোমস।

    সরে পড়ল মনে হচ্ছে?

    দু-চাকার গাড়িতে শুধু একজনকেই বসে থাকতে দেখেছি আমি এবং তিনি জেমস ওয়াইল্ডার নন এই কারণেই যে, দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রলোক।

    একটা লাল চৌকো আলো ভেসে উঠেছিল অন্ধকারের সমুদ্রে। ফ্রেমে-আঁটা ছবির মতো লালের পটভূমিকায় দেখলাম সেক্রেটারির কালো মূর্তি সামনের দিকে মাথা বাড়িয়ে অন্ধকারের বুকে উঁকি মেরে কী যেন খুঁজছেন। হাবভাব দেখে মনে হল, কারো প্রতীক্ষায় রয়েছেন মি. ওয়াইল্ডার। বেশ কিছুক্ষণ পরে রাস্তার ওপর শোনা গেল কার পদশব্দ। আলোর পটভূমিকায় মুহূর্তের জন্যে আবির্ভূত হল দ্বিতীয় একটি মূর্তি, বন্ধ হয়ে গেল দরজা এবং সঙ্গেসঙ্গে নিচ্ছিদ্র তমিস্রায় হারিয়ে গেল সব কিছু। পাঁচ মিনিট পরে দোতলার ঘরে একটা বাতি জ্বলে উঠল।

    হোমস বললে, লড়ায়ে মোরগের আস্তানায় দেখছি অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা ঘটে রাতের অন্ধকারে?

    মদ খাওয়ার জায়গাটা কিন্তু বাড়ির অন্যদিকে।

    ঠিক বলেছ। এখন যাঁদের দেখছি, তাদের তাহলে প্রাইভেট অতিথি বলা উচিত। কিন্তু ভায়া, এত রাত্রে এ রকম একটা নোংরা সরাইখানায় মি. জেমস ওয়াইল্ডারের কী হেতু আগমন এবং চুপিসারে তার সাথে ওই যে লোকটা দেখা করতে এল, সে-ই বা কে না-জানা পর্যন্ত তো আমি শান্তি পাব না। চল, ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। সাহস করে কাছে গিয়ে দেখে আসতে হবে কী ব্যাপার।

    কসরত করে দুজনে রাস্তার ওপর নেমে গুড়ি মেরে এগিয়ে গেলাম সরাইখানার দিকে। দরজার পাশে দেওয়ালের গায়ে হেলান দেওয়া ছিল বাইসাইকেলটা। ফস করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে পেছনের চাকার কাছে ধরল হোমস। আলো এসে পড়ল ডানলপ টায়ারের ওপর। নিঃশব্দে হেসে ওঠে ও।

    মাথার ওপরেই আলোকিত জানলাটা দেখিয়ে হোমস বললে, ওয়াটসন ঘরের ভেতরে উঁকি–দিয়ে আমি নড়ছি না এখান থেকে। দেওয়াল ধরে পিঠ পেতে দাঁড়াও তুমি, তারপর যা করবার আমি করছি!

    সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে আমার কাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে উঠল হোমস এবং দাঁড়াতেনা-দাঁড়াতেই লাফিয়ে নেমে পড়ল নীচে।

    বন্ধু এবার যাওয়া যাক। সারাদিন বড়ো খাটাখাটুনি গেছে বটে, কিন্তু সবরকমের পয়েন্ট জোগাড় করতে পেরেছি বলেই আমার বিশ্বাস। স্কুল এখান থেকে অনেকটা দূরে–কাজেই চল, আর অযথা দেরি না-করে রওনা হওয়া যাক।

    সুদীর্ঘ পথে আর বিশেষ কোনো কথা বলল না হোমস। কাদা-প্যাঁচপেচে জলাভূমি পেরিয়ে এলাম, শ্রান্ত অবসন্ন দেহ, কিন্তু সারাপথে প্রায় বোবা হয়ে রইল ও। স্কুলে পেঁৗছে ভেতরে না-ঢুকে গেল ম্যাকলিটন স্টেশনে। সেখান থেকে কয়েকটা টেলিগ্রাম পাঠানোর ব্যবস্থা করে ফিরে এল স্কুলে। আরও রাত গভীর হলে শুনলাম বেচারি ড. হাক্সটেবলকে সান্ত্বনার বাণী শোনাচ্ছে সে। মাস্টারের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকে ভদ্রলোক শয্যা নিয়েছিলেন। এবং এরপরেও যখন সে আমার ঘরে ঢুকল তখন তাকে দেখে অবাক না-হয়ে পারলাম না। ভোরবেলা চোখ মেলে শয্যার পাশে সতর্ক-চক্ষু প্রাণরসে ভরপুর যে-মানুষটিকে দেখেছিলাম, সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রমের পরেও দেখলাম অবিকল সেই মানুষটিকে। এতটুকু বিরক্ত হয়নি, অফুরন্ত প্রাণরসে টলমল তার মুখচ্ছবি। ঘরে ঢুকেই খুশি খুশি গলায় ও বললে, বন্ধু হে, হাওয়া অনুকূলে। কাল সন্ধে হওয়ার আগেই এ-রহস্যের সমাধান সম্পূর্ণ করে ফেলব–কথা দিচ্ছি তোমায়।

    পরের দিন সকাল বেলা এগারোটা নাগাদ শার্লক হোমস আর আমি হোলডারনেস হল-এর সুবিখ্যাত ইউ বীথিকার মাঝ দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে হাজির হলাম রানি এলিজাবেথ আমলের জমকালো তোরণের সামনে। সেখান থেকে পৌঁছোলাম হিজ গ্রেসের স্টাডিতে। মি. জেমস ঘরে ছিলেন। আমাদের দেখেই সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। বাইরে থেকে দেখে ভদ্রলোককে একটু গম্ভীর মনে হলেও গতরাতের বুনো আতঙ্কের ফিকে রেশ যেন তখনও লেগে ছিল তার চোরা নজর আর থেকে থেকে কেঁপে ওঠা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে।

    হিজ গ্রেসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? দুঃখিত, ডিউক এখন অত্যন্ত অসুস্থ। খারাপ খবরটা শোনার পর থেকেই উনি খুবই উতলা হয়ে পড়েছেন। গতকাল বিকেলে ড. হাক্সটেবলের টেলিগ্রামে আপনার আবিষ্কারের কাহিনি জেনেছি আমরা।

    মি. ওয়াইল্ডার, ডিউকের সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে।

    উনি এখন ওঁর ঘরে…

    তাহলে তার ঘরেই যাব আমরা।

    খুব সম্ভব শুয়ে আছেন এখন।

    সেই অবস্থাতেই তার সঙ্গে দেখা করব আমি।

    হোমসের নিরুত্তাপ কিন্তু অটল ভাবভঙ্গি দেখে সেক্রেটারি বুঝলেন যে তার সঙ্গে তর্ক করে লাভই হবে না।

    ভালো কথা। আপনারা এসেছেন, এ-খবর আমি নিজেই দিচ্ছি ওঁকে।

    আধঘণ্টা পর ঘরে ঢুকলেন, অভিজাত মহলের মুকুটমণি ডিউক স্বয়ং। আগের চাইতেও বিরং, বিবর্ণ, হতশ্রী মনে হচ্ছিল তাঁকে, যেন প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে এই অল্প সময়ের মধ্যে। কাঁধ দুটো ঝুলে পড়েছে আগের দিন যাকে দেখেছিলাম, তিনি যেন ইনি নন। এক লাফে যেন বেশ কয়েকটা বছর বয়স বেড়ে গেছে তাঁর। রাজকীয় সৌজন্য আর শিষ্টাচার শেষ হলে পর লাল দাড়ি টেবিলের উপর লুটিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলেন উনি।

    তারপর? কী খবর, মি. হোমস? গুরুগম্ভীর গলায় শুধোলেন ডিউক।

    কিন্তু শার্লক হোমস দেখি একদৃষ্টে তাকিয়েই আছে সেক্রেটারির পানে, ডিউকের চেয়ারের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ভদ্রলোক।

    ওইভাবে তাকিয়েই বলল ও, ইয়োর গ্রেস, আমার মনে হয় মি. ওয়াইল্ডার না-থাকলেই বরং আমি খোলাখুলিভাবে কথা বলতে পারব।

    যেন আর এক পোচ ছাই রং চড়ল মি. ওয়াইল্ডারের মুখের ওপর। বিষাক্ত চোখে হোমসের পানে তাকালেন উনি।

    ইয়োর গ্রেস যদি ইচ্ছে করেন—

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি এখন এস। এবার বলুন, মি. হোমস, কী বলার আছে আপনার?

    সেক্রেটারি বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ না-হওয়া পর্যন্ত চুপ করে রইল বন্ধুবর।

    তারপর বলল, ইয়োর গ্রেস, ড. হাক্সটেবল আমাকে এবং আমার সহকর্মী ড. ওয়াটসনকে একটা খবর দিয়েছিলেন। আপনি নাকি একটা মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন এ-ব্যাপারে। খবরটা আপনার মুখ দিয়েই আমি যাচাই করে নিতে চাই।

    তা করেছিলাম বই কী, মি. হোমস।

    শুনেছি, আপনার ছেলে কোথায় আছে, এ-খবর যে দিতে পারবে, তাকে আপনি দেবেন পাঁচ হাজার পাউন্ড? এগজ্যাক্টলি। আর এক হাজার দেবেন যে বলতে পারবে আপনার ছেলেকে কে বা কারা লুকিয়ে রেখেছে, তাকে?

    এগজ্যাক্টলি।

    দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, তাকে যারা গুম করেছে তাদের নাম ছাড়াও তার এই অবস্থার জন্যে ষড়যন্ত্রে যাঁরা লিপ্ত, তাদেরকেও নিশ্চয় ধরেছেন?

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, অধীরভাবে চিৎকার করে ওঠেন। মি. শার্লক হোমস, আপনার কাজ যদি সন্তোষজনক হয়, তাহলে কৃপণতা করেছি, এ ধরনের অভিযোগ করার কোনো কারণ আপনার থাকবে না।

    এমন লোভাতুরভাবে দু-হাত ঘষতে লাগল হোমস যে দেখেশুনে তাজ্জব বনে গেলাম আমি। ওর পরিমিতি রুচির খবর আর কেউ না-জানলেও আমি তো জানি।

    চকচকে চোখে হোমস বললে, ইয়োর গ্রেসের চেকবইটা টেবিলের ওপরে রয়েছে মনে হচ্ছে। ছ-হাজার পাউন্ডের চেক আমার নামে লিখে দিলে খুবই খুশি হব আমি। ক্রস করে দেওয়াই ভালো। দ্য ক্যাপিটাল অ্যান্ড কাউন্টিস ব্যাঙ্কের অক্সফোর্ড স্ট্রিট ব্রাঞ্চ আমার এজেন্ট।

    ঋজু দেহে অত্যন্ত কঠোর ভঙ্গিমায় বসে পাথরের মতো চোখে বন্ধুবরের পানে তাকালেন হিজ গ্রেস।

    তামাশা করছেন নাকি, মি. হোমস? রসিকতা করার মতো বিষয় এটা নয়।

    নিশ্চয় নয়, ইয়োর গ্রেস। জীবনে এতখানি উৎসুক আর আমি হইনি।

    আমি বলতে চাই যে, পুরস্কারটা আমারই প্রাপ্য। আপনার ছেলে কোথায় আছে, তা আমি জানি। যাঁরা তাকে আটকে রেখেছেন, তাঁদের অন্তত কয়েকজনকেও আমি চিনি।

    কাগজের মতো অস্বাভাবিক সাদা মুখের পটভূমিকার ডিউকের উগ্র লাল দাড়ি যেন আরও টকটকে হয়ে ওঠে।

    কোথায় সে? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করেন উনি।

    আপনার পার্ক-গেট থেকে মাইল দুয়েক দূরে লড়ায়ে-মোরগের প্রতীক লাগানো সরাইখানার কাছে, সে অন্তত গতকাল রাত পর্যন্ত ছিল সেখানে।

    চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন ডিউক।

    অপরাধী সাব্যস্ত করছেন কাকে?

    স্তম্ভিত হয়ে গেলাম শার্লক হোমসের উত্তর শুনে। চট করে এগিয়ে এসে ডিউকের কাঁধ স্পর্শ করে ও বললে, আপনাকে। ইয়োর গ্রেস, চেকটার জন্যে এবার একটু কষ্ট দেব আপনাকে।

    ডিউকের সে-মূর্তি আমি জীবনে ভুলব না। হোমসের কথা ফুরোতে-না-ফুরোতেই তোক করে লাফিয়ে উঠে এমনভাবে বাতাস আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলেন যেন পাতালের অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন উনি কুটো আশ্রয় করার মতোও অবলম্বন না-পেয়ে। পরক্ষণেই অসাধারণ সংযমবলে নিজেকে সামলে নিলেন। এ-রকম আতীব্র আবেগকে চকিতে দমন করে ফেলে সহজ হয়ে ওঠার মতো আশ্চর্য ক্ষমতা বোধ হয় শুধু তার মতো অভিজাত পুরুষেরই থাকে। চেয়ারের ওপর নিজেকে এলিয়ে দিয়ে দু-হাতে মুখ লুকোলেন উনি। বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেল নীরবতার মধ্যে দিয়ে।

    তারপর, হাত থেকে মুখ না-তুলেই জিজ্ঞেস করলেন, কতখানি জানেন আপনি?

    গত রাতে আপনাদের সবাইকে আমি দেখেছি।

    আপনার বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানে এ-কথা?

    না, কাউকে আমি বলিনি।

    কাঁপা আঙুলে কলম তুলে নিয়ে চেকবই খুললেন ডিউক।

    আমার কথার এতটুকু নড়চড় হবে না মি. হোমস। আপনার আনা সংবাদ আমার কাছে যতই অপ্রীতিকর আর অবাঞ্ছিত হোক না কেন, চেক আমি লিখে দিচ্ছি। পুরস্কার ঘোষণা করার সময়ে আমি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনি এ-রকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে আমায়। আপনি আর আপনার বন্ধু, দুজনেই তো স্বাধীন, কারো অধীন নন, তাই না মি. হোমস?

    ঠিক বুঝতে পারলাম না, ইয়োর গ্রেস।

    আরও সরল করেই তাহলে বলি, এ-ঘটনা যদি কেবলমাত্র আপনারা দুজনেই জেনে থাকেন, তাহলে তা শুধু আপনাদের মধ্যেই সীমিত থাকুক। আপনারা যখন কারো অধীন নন, তখন তা তৃতীয় ব্যক্তির কানে যাওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। তাহলে, বারো হাজার পাউন্ড আপনাকে আমায় দিতে হবে, কী বলেন মি. হোমস?

    কিন্তু হোমস শুধু হাসল। মাথা নেড়ে বললে, ইয়োর গ্রেস, এত সহজে এ কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়া যাবে বলে তো মনে হয় না আমার। স্কুলমাস্টারের মৃত্যুর কারণ আমাদের দর্শাতেই হবে।

    কিন্তু জেমস সে-ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গ জানে না। এজন্যে তো আপনি তাকে দায়ী করতে পারেন না। এ-কাজ ওই জানোয়ার বদমাশটার। অবশ্য জেমসই তাকে কাজে লাগিয়েছিল ছেলেটাকে রাতারাতি পাচার করার জন্যে।

    ইয়োর গ্রেস, একবার যদি কোনো অপরাধের পথে কেউ আগুয়ান হয়, তাহলে পথ চলতে গিয়ে আরও পাঁচটা অপরাধের উদ্ভব হলে ন্যায়ত তাকেই সব কিছুর জন্যে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তাই নয় কি?

    ন্যায়ত, মি. হোমস। ঠিক বলেছেন আপনি। কিন্তু আইনত নিশ্চয় নয়। খুনের দৃশ্যে হাজির–থাকলে আপনি কোনো মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন না। বিশেষ করে, আপনার আমার মতোই খুনকে যে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে, খুনের কথা শুনলেও যে শিউরে ওঠে, তাকে তো নয়ই। এ-খবর তার কানে আসামাত্র আতঙ্কে, অনুতাপে ভেঙে পড়ে সেই মুহূর্তে অকপটে সমস্ত আমার কাছে স্বীকার করেছে সে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই খুনেটার সঙ্গে সব সম্পর্ক চিরকালের মতো চুকিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। মি. হোমস ওকে বাঁচান–ওকে আপনি বাঁচান। আমার একান্ত অনুরোধ, ওকে আপনি এ-বিপদ থেকে বাঁচান।

    ভেঙে পড়ে তার সংযমের বাঁধ। মুখের পরতে পরতে আকুল আকুঞ্চনের মধ্যে দিয়ে আতীব্র আকিঞ্চন ফুটিয়ে তুলে মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত শূন্যে ছুঁড়ে অস্থিরভাবে ঘরের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত পায়চারি করতে থাকেন উনি। কিছুক্ষণ পরে আবার সংযমের নিগড়ে বেঁধে ফেললেন নিজেকে। টেবিলের সামনে বসে পড়ে বললেন, আর কারো কাছে না গিয়ে আমার কাছে আসার জন্যে আপনার বিবেচনা আর বুদ্ধির তারিফ করছি আমি। এ জঘন্য কেলেঙ্কারি যাতে আর পাঁচ কান হয়, সে-সম্বন্ধে আসুন সবাই মিলে পরামর্শ করে একটা কিছু বন্দোবস্ত করা যাক।

    ইয়োর গ্রেস, আমার বিশ্বাস আমরা পরস্পরের কাছে অসংকোচে এবং অকপটে যদি সরল হতে পারি, তাহলে আপনি যা বললেন, তা সম্ভব হবে বলে তো মনে হয় না আমার। আমার ক্ষমতা যতদূর কুলোয়, ইয়োর গ্রেসকে সাহায্য করতে আমি রাজি আছি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে কোনো কিছুই গোপন না-থাকা উচিত এবং প্রতিটি খুঁটিনাটি শুনে বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধেও আমার ওয়াকিবহাল থাকা দরকার। আপনার কথা শুনে এটুকু বুঝলাম যে আপনার সেক্রেটারি মি. জেমস ওয়াইল্ডার খুনি নন।

    না, খুনি এখন আমাদের নাগালের বাইরে।

    গম্ভীরভাবে একটু হাসল শার্লক হোমস।

    ইয়োর গ্রেস আমার সামান্য নাম-যশের বিশেষ কিছু শুনেছেন বলে মনে হয় না। শুনলে পরে এমন কথা বলতেন না। আমার চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়া এত সহজ নয়। গতকাল রাত এগারোটায় আমার নির্দেশমতো চেস্টারফিল্ডে গ্রেপ্তার হয়েছে মি. রিউবেন হেইজ। আজ সকালে স্কুল থেকে রওনা হওয়ার আগেই এ-সম্পর্কে একটা টেলিগ্রাম পেয়েছি ওখানকার পুলিশের বড়োকর্তার কাছ থেকে।

    চেয়ারের পিঠে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে বিস্ফারিত চোখে সবিস্ময়ে বন্ধুবরের পানে তাকালেন ডিউক।

    আশ্চর্য! আপনি তো দেখছি অমানবিক ক্ষমতার অধিকারী। রিউবেন হেইজ তাহলে এখন হাজতে? শুনে সত্যিই সুখী হলাম আমি। অবশ্য জানি না এর ফলাফল জেমসকে স্পর্শ করবে কি না।

    আপনার সেক্রেটারি?

    না মশায়, না। আমার ছেলে।

    এবার অবাক হওয়ার পালা হোমসের।

    ইয়োর গ্রেস, আমি স্বীকার করছি এ-খবর আমার কাছে একেবারেই নতুন। আর একটু খুলে বলবেন কি?

    কিছুই লুকোব না আপনার কাছে। এ-বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমি একমত। জেমসের বোকামো আর ঈর্ষার পরিণামস্বরূপ যে-সংকটে আমরা পড়েছি, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় অকপটে সব কথা খুলে বলা। যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন, তবু আমি কিছু গোপন করব না। মি. হোমস, যৌবনে আমি একজনকে ভালোবেসেছিলাম। যে-ভালোবাসা জীবনে কেবল একবারই আসে মনের কোণে চির বসন্তের ফুল ফোঁটাতে এ সেই ভালোবাসা। ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম আমি, কিন্তু তিনি রাজি হননি পাছে এ-বিয়ের ফলে আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়। তিনি বেঁচে থাকলে জীবনে আমি আর কাউকে বিয়ে করতাম না। মারা গেলেন তিনি, আমার হাতে সঁপে গেলেন শিশু জেমসকে। ওকে আমি মানুষ করেছি। শুধু ওর মায়ের কথা ভেবে। দুনিয়ার সামনে ওর পিতৃত্ব আমি স্বীকার করতে পারিনি বটে, কিন্তু ওকে আমি উচ্চশিক্ষা দিয়েছি, তারপর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সবসময়ে রেখেছি একান্ত কাছটিতে। কী কৌশলে জানি না, আমার গুপ্ত কথা জেনে ফেলে ও। তারপর থেকেই তার অনেক আবদার আমি মেনে নিয়েছি। আমার ওপর ওর প্রকৃত অধিকার কী, তা তার অজানা নয়। এ নিয়ে একটা কেলেঙ্কারি সৃষ্টি করার ক্ষমতাও যে তার আছে, এবং তাহলে সমাজে যে আমার মাথা তোলার উপায় থাকবে না, তাও সে জানে ভালো করেই। বিবাহিত জীবনে আমি সুখী হইনি–সেজন্য জেমসই কতকাংশে দায়ী। সবচেয়ে বড়ো কথা কি জানেন, প্রথম থেকেই আমার একমাত্র আইন-অনুজ্ঞাত উত্তরাধিকারীকে ও সমানে ঘৃণা করে এসেছে। অনুক্ষণ এই ঘৃণায় এতটুকু বিরাম দেখিনি আমি। আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন, এত কাণ্ডর পরও কেন জেমসকে আমারই কাছে কাছে আমি রেখেছি। উত্তরে আমি বলব, এ দীর্ঘ যন্ত্রণা সহ্য করছি শুধু ওর মায়ের জন্যে। ওর মুখের মধ্যে আমি ওর মায়ের মুখ দেখি, আমার প্রথম যৌবনের প্রথম ভালোবাসার ছবি দেখি; ওর প্রতিটি হাবভাব, চালচলন ঠিক ওর মায়ের মতোই এতটুকু অমিল এতদিনেও দেখিনি আমি। তাই ওর মধ্যে দিয়ে অতীতকে দেখি চোখের সামনে। এই কারণেই, ওকে আমি চোখের আড়াল করতে পারিনি। কিন্তু পাছে আর্থারের মানে, লর্ড স্যালটায়ারের কোনো ক্ষতি করে বসে ও, তাই ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ড. হাক্সটেবলের স্কুলে নিছক নিরাপত্তার খাতিরে।

    হেইজ লোকটা আমার প্রজা ছিল এককালে। জেমস তখন আমার এজেন্ট হিসাবে কাজ করত, তখনই ওদের আলাপ হয়। চিরকালই লোকটা পয়লা নম্বরের পাকা বদমাশ। কিন্তু কী বিচিত্র কারণে জেমসের সঙ্গে ওর নিবিড় সখ্যতা গড়ে ওঠে। বার বার লক্ষ করেছি, নীচ সঙ্গের দিকে ওর কেমন জানি কেঁক আছে। লর্ড স্যালটায়ারকে গুম করার পরিকল্পনা ওর মাথায় আসার পর এই লোকটাকেই কাজে লাগাল জেমস। আপনার মনে আছে নিশ্চয়, আগের দিন আর্থারকে একটা চিঠি লিখেছিলাম আমি। জেমস খামটা খুলে একটা চিরকুট ভরে দেয় ভেতরে। চিরকুটে লেখা ছিল, আর্থার যেন অমুক দিনে অমুক সময়ে স্কুলের কাছে এবড়োখেবড়ো উপবন-এ দেখা করে তার সঙ্গে। চিরকুটে ডাচেসের নাম থাকায় আর্থার আর দ্বিধা করেনি। সেদিন সন্ধ্যায় জেমস সাইকেল চালিয়ে গেল সেখানে আমাকে ও যেমনটি বলেছে, ঠিক সেইরকমভাবে বলছি আপনাকে বনের মধ্যে নিরালায় আর্থারকে বললে যে তার জন্যে তার মায়ের মন কেমন করছে বলে তার সঙ্গে তিনি দেখা করতে চান। জলাভূমিতে আর্থারের জন্যে তিনি অপেক্ষা করছেন। মাঝরাতে বনে এলে ঘোড়া নিয়ে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবে সে। সে-ই তাকে পৌঁছে দেবে তার মায়ের কাছে। আর্থার বেচারা ফাঁদে পা দিলে। নির্দিষ্ট সময়ে উপবনে এসে হেইজকে দেখলে একটা ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। দুজনেই সওয়ার হল একই ঘোড়ার পিঠে। কিন্তু জার্মান মাস্টার যে তাদের পিছু নিয়েছিলেন, এ-খবর জেমস শুনলে মাত্র গতকাল। হাতের লাঠি দিয়ে হেইজ তার মাথায় মারতে পথের ওপরেই মারা যান ভদ্রলোক। সরাইখানায় আর্থারকে আনার পর দোতলার একটা ঘরে নজরবন্দি রাখা হয় মিসেস হেইজের তত্ত্বাবধানে। ভদ্রমহিলার মনটি বড়ো ভালো, কিন্তু জানোয়ার স্বামীর কোনো আদেশ ঠেলে ফেলবার মতো ক্ষমতা তার নেই।

    মি. হোমস, দু-দিন আগে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার সময়ে আপনি যা জানতেন, তার থেকে একতিলও বেশি জানতাম না আমি। আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করবেন, এ ধরনের অপকর্ম করার পেছনে জেমসের মোটিভ কী? উত্তরে আমি বলব, আমার আইনত উত্তরাধিকারীর প্রতি ওর উন্মাদ ঘৃণার মধ্যে যুক্তির কোনো বালাই ছিল না। ওর ধারণায়, আমার যাবতীয় সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ নাকি সে-ই হতে পারে। কিন্তু সামাজিক নিয়মকানুনের জন্যে তা সম্ভব নয়। তাই এদিক দিয়েও সীমা নেই তার বিদ্বেষের। এসব ছাড়াও তার একটা বিশেষ মোটিভ ছিল। তার প্রবল ইচ্ছে ছিল যে, আমি ওয়ারিশ পরিবর্তন করি এবং তার মতে আমার নাকি সে-ক্ষমতা আছে। এই সম্পর্কেই আমার সঙ্গে দরাদরি করতে চেয়েছিল ও। আর্থারকে যদি সে উদ্ধার করতে পারে, তাহলে আমি পুরস্কারস্বরূপ আর্থারের নাম খারিজ করে ওয়ারিশ হিসেবে সমস্ত সম্পত্তি উইল করে দেব তাকে! ও বেশ জানে, স্বেচ্ছায় আমি তাকে কোনোদিনই পুলিশের হাতে তুলে দেব না। কিন্তু দরাদরি করার আর সময় পেল না জেমস। এ-প্রস্তাব আমার কাছে আসার আগেই অপ্রত্যাশিত ঘটনার আকস্মিকতা ওকে দিশেহারা করে তুললে। ফলে, পরিকল্পনামতো কাজ করার সুযোগই পেল না ও।

    ওর সমস্ত প্ল্যান বানচাল হয়ে গেল আপনার আবিষ্কারে। জলায় হেইডেগারের মৃতদেহ পেয়েছেন আপনারা–এ-খবর শোনামাত্র আতঙ্কে নীল হয়ে গেল জেমস। গতকাল এই ঘরে আমরা বসে রয়েছি, এমন সময়ে ড. হাক্সটেবলের টেলিগ্রামে খবরটা পেলাম। শোকে উদ্‌বেগে এমনই অভিভূত হয়ে পড়ল জেমস যে দেখেই খটকা লাগল আমার। সত্য কথা বলতে কী, প্রথম থেকেই ওর সম্বন্ধে আমার সন্দেহ ছিল। ওর ওইরকম মুহ্যমান অবস্থা দেখামাত্র সন্দেহ পরিণত হল স্থির বিশ্বাসে এবং তখনই ওকে চাপ দিলাম আমি। কাজ হল তৎক্ষণাৎ। স্বেচ্ছায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করল জেমস। করার পর আমাকে অনুনয় করলে যে, দিন তিনেকের জন্যে আমি যেন মুখ বন্ধ করে থাকি, ইতিমধ্যে তার দুষ্কর্মের সঙ্গী গা-ঢাকা দিক। রাজি হলাম আমি। এইভাবেই চিরকাল ওর কাকুতিমিনতির কাছে সঁপে দিয়েছি নিজেকে। সঙ্গেসঙ্গে ও ছুটল সরাইখানায় হেইজকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে রাতারাতি তাকে এ-অঞ্চল থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। দিনের আলোয় সবার চোখের সামনে দিয়ে আমি যেতে পারলাম না, কিন্তু অন্ধকার হতে-না-হতেই রওনা হলাম মাই ডিয়ার আর্থারকে দেখতে। দেখলাম নিরাপদেই আছে সে। শরীরও সুস্থ। তবে চোখের সামনে ওই বীভৎস খুন দেখার পর থেকে আতঙ্ক যেন ওর অণু-পরমাণুতেও শেকড় গেড়েছে–কী পরিমাণে যে ভয় পেয়েছে ও, তা আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না, মি. হোমস। প্রতিশ্রুতি অনুসারে অনিচ্ছাসত্তেও তিন দিনের জন্যে মিসেস হেইজের হেপাজতে রেখে এলাম ওকে। কেননা, পুলিশকে সংবাদ দিতে গেলেই তাদেরকে প্রথমে জানাতে হবে এতদিন তাকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল এবং সঙ্গেসঙ্গে তারাই জানতে চাইবে, হত্যাকারী কে। হত্যাকারীর সমুচিত শাস্তির আয়োজন করতে গেলে হতভাগ্য জেমসের সর্বনাশ ডেকে আনা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এইসব ভেবেই তিন দিন চুপচাপ থাকাই বিধেয় বলে মনে করলাম। আপনি অকপটে সরল হতে বলেছিলেন, মি. হোমস। তাই কোনোরকম বাগাড়ম্বর বা কোনো কিছু লুকোবার চেষ্টা না-করে অসংকোচে সব খুলে বললাম। আপনার কথায় নির্ভর করে আমার কথা রেখেছি। এবার আপনার পালা আমাকে সাহায্য করার।

    এবং আমি তা করব, বলল হোমস। ইয়োর গ্রেস, প্রথমেই একটা কথা না-বলে পারছি না। আইনের চোখে নিজেকে অত্যন্ত গুরুতর পরিস্থিতিতে এনে ফেলেছেন আপনি। একটা মহাপাতককে আপনি সহ্য করেছেন এবং একজন খুনে গুন্ডাকে গা-ঢাকা দেওয়ার সহায়তা করছেন। এ-কথা বললাম এই কারণে যে, রাতারাতি এ-অঞ্চল থেকে শাকরেদকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে জেমস ওয়াইল্ডারের যত অর্থের প্রয়োজন হয়েছে, তা যে আপনার পকেট থেকেই গেছে, এ-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

    মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালেন ডিউক।

    বাস্তবিক ব্যাপারটা বড়োই সিরিয়াস। ইয়োর গ্রেস, তার চেয়েও নিন্দনীয় হচ্ছে আপনার ছোটো ছেলের প্রতি আপনার অসংগত আচরণ। তিন দিনের জন্যে একটা নোংরা আস্তানায় তাকে আপনি ফেলে এসেছেন।

    কিন্তু প্রতিশ্রুতি রয়েছে–

    এ ধরনের লোকদের কাছে প্রতিশ্রুতির মূল্য কতটুকু? জেমস ওয়াইল্ডার যে আবার নতুন উৎসাহে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে না, এ-রকম কোনো গ্যারান্টি কি কেউ কাউকে দিতে পারে? অপরাধী বড়ো ছেলেকে খুশি করার জন্যে নিরপরাধ ছোটো ছেলেকে অনাবশ্যক অথচ আসন্ন বিপদের মধ্যে আপনি ফেলে এসেছেন, আপনার এই আচরণ অত্যন্ত অসংগত এবং অন্যায়।

    নিজের হলে দাঁড়িয়ে এভাবে ধমকধামক খাওয়ার মতো দুর্দিন হোলডারনেসের দর্পিত লর্ডের জীবনে কোনোদিন আসেনি। উন্নত ললাট রাঙা হয়ে উঠল রক্তোচ্ছাসে, কিন্তু তবুও উনি মূক হয়ে রইলেন বিবেকবুদ্ধির তর্জনী হেলনে।

    একটিমাত্র শর্তে আপনাকে সাহায্য করব আমি। শর্তটা এই–ঘণ্টা বাজিয়ে আপনারা পেয়াদাকে ডেকে পাঠান এবং আমার খুশিমতো তাকে আদেশ দেওয়ার অনুমতি আমাকে দিন।

    একটি কথাও না-বলে বৈদ্যুতিক বোতাম টিপলেন ডিউক। ঘরে ঢুকল একজন পরিচারক।

    হোমস বললে, সুখবর আছে তোমাদের জন্যে লর্ড স্যালটায়ারকে পাওয়া গেছে। ডিউকের ইচ্ছে এই মুহূর্তে যেন একটা গাড়ি লড়ায়ে মোরগওলা সরাইখানায় গিয়ে তাকে এখানে নিয়ে আসে।

    আনন্দে আটখানা হয়ে পেয়াদা বেরিয়ে যেতেই হোমস বলল, ভবিষ্যতের ব্যবস্থা পাকা করে নেওয়ার পর এবার অতীত নিয়ে পড়া যাক। আমি সরকারি কাজ করি না এবং যতক্ষণ সুবিচারের সম্ভাবনা রয়েছে, আমি যা জানি তা প্রকাশ করারও কোনো কারণ দেখি না। হেইজ সম্বন্ধে আমার কিছু বলার নেই। ফাঁসি তার হবেই এবং তা থেকে তাকে বাঁচানোর কোনো প্রচেষ্টা আমি করব না। সে কী ফাঁস করবে-না-করবে, তা আমি জানি না। তবে ইয়োর গ্রেস তাকে অনায়াসেই সমঝে দিতে পারেন যে, বোবা হয়ে থাকাটাই তার স্বার্থের অনুকূল হবে। পুলিশ জানবে মোটা দাঁওয়ের লোভেই লর্ড স্যালটায়ারকে গুম করেছিল সে। আসল তথ্য যদি তারা নিজেরাই খুঁজে না পায়, তাহলে যেচে তাদেরকে সব কথা বলার কোনো কারণ দেখছি না আমি। ইয়োর গ্রেস, এক বিষয়ে আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি। এর পরেও যদি মি. জেমস ওয়াইল্ডার আপনার কাছে থাকেন, তাহলে আরও অনেক নতুন সংকটের সৃষ্টি হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।

    আমিও তা বুঝেছি, মি. হোমস। এ-বিষয়ে আমাদের কথা হয়ে গেলে জেমস অস্ট্রেলিয়ায় যাবে ভাগ্যান্বেষণে।

    তাই যদি হয়, ইয়োর গ্রেস, তাহলে আরও একটা কথা বলব। আপনি নিজেই বলেছিলেন আপনার বিবাহিত জীবনের অশান্তির জন্যে জেমস ওয়াইল্ডারই কতকাংশে দায়ী। আমার মতে, এতদিন ডাচেসের প্রতি যে-অবিচার করা হয়েছে, তা সুরাহা করার ব্যবস্থা এবার আপনি করুন এবং চরম অশান্তির ভেতর দিয়ে যে-সম্পর্কে ছেদ পড়েছিল নিতান্ত আকস্মিকভাবে, আবার তা নতুন করে স্থাপন করার আয়োজন আপনার দ্বারাই হোক!

    সে-ব্যবস্থাও আমি করেছি হোমস। আজ সকালেই ডাচেসকে চিঠি লিখেছি আমি।

    হোমস উঠতে উঠতে বললে, তাহলে আমি এবং আমার বন্ধু নিজেদেরকেই অভিনন্দন জানাতে পারি এই কারণে যে, উত্তর দেশে এত অল্প সময়ের জন্যে বেড়াতে এসেও অনেকগুলো অত্যন্ত সুখময় পরিণতির সূচনা করে যেতে পারলাম। ছোট্ট একটা পয়েন্ট সম্পর্কে আমার খটকা কিন্তু এখনও যায়নি। হেইজ ঘোড়ার খুরে কতকগুলো আশ্চর্য নাল লাগিয়েছিল। ফলে হয়েছে কী, মাটির ওপর ঘোড়ার খুরের ছাপ না-পড়ে পড়েছে গোরুর খুরের ছাপ। এ ধরনের অসাধারণ পদ্ধতি কি জেমস ওয়াইল্ডারই শিখিয়েছিলেন তাকে?

    ক্ষণকাল চিন্তাচ্ছন্ন মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন ডিউক। তারপরেই চোখের তারায় নিবিড় হয়ে উঠল বিস্ময়। দরজা খুলে মিউজিয়ামের মতো সাজানো মস্ত একটা ঘরে নিয়ে গেলেন আমাদের। কোণের দিকে মাথা রাখা একটা কাচের আলমারির কাছে গিয়ে আঙুল তুলে দেখালেন ভেতরে পাথরের ওপর খোদাইকরা কয়েক ছত্র বিবরণের দিকে।

    বিবরণটা এই : হোলডারনেসের হলের পরিখা খনন করে এই নালগুলি পাওয়া গেছে, নালগুলি ঘোড়ার পায়ে লাগানোর জন্যে। কিন্তু অনুসরণকারীদের বিভ্রান্ত করে দেওয়ার জন্যে তলার লোহা বিশেষভাবে খণ্ডিত। অনুমান, মধ্যযুগে হোলডারনেসের কয়েকজন লুঠেরা ব্যারনের আমলে এদের সৃষ্টি।

    কেসটা খুলে ফেলল হোমস, তারপর থুথু দিয়ে আঙুল ভিজিয়ে নিয়ে আলগোছে বুলিয়ে নিলে একটা নালের ওপর দিয়ে। টাটকা কাদার একাট পাতলা স্তর উঠে এল আঙুলে।

    কাচের ডালাটা বন্ধ করতে করতে ও বলল, ধন্যবাদ। উত্তর দেশে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বস্তু যা দেখলাম, তার মধ্যে এইটাই হল দ্বিতীয়।

    আর প্রথমটা?

    চেকটা ভাঁজ করে সন্তর্পণে নোটবইয়ের মধ্যে রেখে দিলে হোমস। তারপর সস্নেহে বারকয়েক হাত বুলিয়ে নিয়ে আমি বড়ো গরিব বলে ভেতরকার পকেটের কোনায় বইটা চালান করে দিলে ও।

    ———–

    টীকা

    গোরুর খুরের রহস্য : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য প্রায়রি স্কুল ইংলন্ডে প্রথম প্রকাশিত হয় স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ সংখ্যায় এবং আমেরিকায় কলিয়ার্স উইকলির ৩০ জানুয়ারি ১৯০৪ সংখ্যায়।

    ম্যাকলটন : লেসলি ক্লিংগার জানিয়েছেন, এই গল্পের পাণ্ডুলিপিতে ম্যাকলটন-এর বদলে ডার্বিশায়ারের ক্যাসলটন-এর নাম লিখেছিলেন কন্যান ডয়্যাল। পরে তা বদলে দেন।

    ইটন জ্যাকেট : কোমরের ওপর পর্যন্ত খাটো ঝুলের এই জ্যাকেট প্রথম ব্যবহার করত ইটন স্কুলের ছাত্ররা। পরে অন্যান্য স্কুলের ইউনিফর্মে এই ধরনের জ্যাকেট ব্যবহৃত হতে থাকে।

    ওয়াটসন আর আমার মতো দু-দুটো বাঘা হাউন্ডের : শার্লক হোমস কি সত্যিই এ-কথা বলেছিলেন, নাকি ওয়াটসন নিজেকে জাহির করতে লিখেছেন এই কথা।

    এটা প্রধান সড়ক : পাণ্ডুলিপিতে দেখা যায় প্রথমে লেখা হয়েছিল, ম্যাঞ্চেস্টার থেকে বাক্সটন যাওয়ার প্রধান সড়ক।

    ডানলপ টায়ার : ইংলন্ডে হাওয়া ভরা টায়ারের প্রথম পেটেন্ট ১৮৪৫ সালে রবার্ট উইলিয়ম থমসন নিয়ে থাকলেও, হাওয়া ভরা বা নিউম্যাটিক সাইকেল টায়ারের পেটেন্ট নেন জন বয়েড ডানলপ ১৮৮৮ সালে। পরের বছর তার কোম্পানি বায়ার্ন ব্রাদার্স ইন্ডিয়া রাবার কোম্পানি লিমিটেড এই টায়ার প্রস্তুত করতে শুরু করে এবং তা প্রবল জনপ্রিয় হয়। ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডানলপ রাবার কোম্পানি লিমিটেড। গাড়ির টায়ার এই কোম্পানি বাজারে আনে ১৯০৬ সালে।

    পরপর দুটো সিগারেট শেষ করে ফেললাম : ওয়াটসন কি নিয়মিত সিগারেট খেতেন? প্রশ্ন তুলেছেন কয়েকজন হোমস-গবেষক। কারণ, এই গল্প ছাড়া শুধুমাত্র দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস উপন্যাসে তাকে সিগারেট খেতে দেখা গিয়েছে।

    দ্য ক্যাপিটাল অ্যান্ড কাউন্টিস ব্যাঙ্ক : এই ব্যাঙ্কের উল্লেখ পাওয়া যায় দ্য ম্যান উইদ দ্য টুইস্টেড লিপস এবং দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ব্রুস-পার্টিংটন প্ল্যানস গল্পে। আর্থার কন্যান ডয়্যাল নিজেও ছিলেন এই ব্যাঙ্কের গ্রাহক। এই ব্যাঙ্ক ১৯১৮-তে লয়েডস ব্যাঙ্কের সঙ্গে একত্রিত হয়। লয়েডস ব্যাঙ্কের এখনকার নাম লয়েডস টি. এস. বি. ব্যাঙ্ক।

    বারো হাজার পাউন্ড : ওয়াটসনের মুখ বন্ধ রাখতে আরও ছয় হাজার?

    নালগুলি পাওয়া গেছে : সিভিল ওয়ারের সমসাময়িক ঠিক এই ধরনের নাল, যাতে ঘোড়ার খুরের ছাপকে গোরুর খুরের বা শিশুদের পায়ের ছাপ মনে হবে, কয়েকটি পাওয়া গিয়েছে টিউসবেরির কাছাকাছি অঞ্চলে অবস্থিত বার্টসমর্টন কোর্টে। (দ্রষ্টব্য : মে ১৯০৩-এ স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন)।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ – আরিফ আজাদ
    Next Article শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }