Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প1414 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    তিন গেলাসের রহস্য

    [ দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য অ্যাবি গ্যাঞ্জ ]

    ১৮৯৭ সালের শীতকাল। তুষার পড়ছিল সেরাত্রে। কনকনে ঠান্ডায় হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠছিল। ভোররাতের দিকে কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিয়ে কে আমায় ঘুম ভাঙিয়ে দিলে। দেখি হোমস। হাতের মোমবাতির আলো ঝিকমিকিয়ে উঠছিল তার মুখের ওপর। সতর্ক ব্যগ্র মুখে আগ্রহের দীপ্তি আর তার ঝুঁকে পড়ার ভঙ্গিমা দেখে এক নজরেই বুঝলাম, শুরু হয়েছে নতুন কোনো ঝামেলা।

    আমি চোখ মেলতেই চেঁচিয়ে উঠল ও, উঠে পড়ো, ওয়াটসন, উঠে পড়ো। ডাক এসে গেছে, খেলা শুরু হল বলে। একটা কথাও নয়! ধড়াচুড়ো এঁটে নিয়ে চলে এসো চটপট!

    দশ মিনিট পরেই আমাদের নিয়ে নিস্তব্ধ পথ কাঁপয়ে একটা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি ছুটে চলল শেরিং ক্রস স্টেশনের দিকে। ভোরের প্রথম আলো তখন সবে দেখা দিচ্ছে পুব দিগন্তে। মাঝে মাঝে দু-একজন শ্রমিকের আবিল আবছা মূর্তি অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লন্ডনের শ্বেতপাথরের মতো অস্বচ্ছ ধোঁয়ার মধ্যে। ভারী কোট জড়িয়ে চুপচাপ বসে ছিল হোমস। আমারও সেই অবস্থা। প্রথমত, হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়া। তার ওপর পেটে কিছু না-দিয়েই রওনা হতে হয়েছে দুজনকে। কাজেই মুখ বুজে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকাই শ্রেয় মনে করলাম। স্টেশনে পৌঁছে কিছু গরম চা পেটে পড়বার পর কেন্ট-অভিমুখী একটা ট্রেনে জাঁকিয়ে বসে বেশ আরাম বোধ করলাম। আর তখনই কথা ফুটল হোমসের মুখে। পকেট থেকে একটা চিরকুট বার করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে শুরু করল বন্ধুবর :

    অ্যাবি গ্র্যাঞ্জ, মার্শহ্যাম, কেন্ট, রাত সাড়ে তিনটে।

    মাই ডিয়ার মি. হোমস, আপনার সাহায্য এখুনি দরকার এবং তা পেলে খুবই খুশি হব। কেসটা অত্যন্ত আশ্চর্য রকমের। আপনার এক্তিয়ারেই পড়ছে। শুধু লেডিকে রেহাই দেওয়া ছাড়া আপনি না-আসা পর্যন্ত কোনো জিনিস নাড়াচাড়া করা হবে না। তাকে মুক্তি না-দিলেই নয়। কিন্তু দোহাই আপনার, একটা মুহূর্তও আপনি অযথা নষ্ট করবেন না। কেননা, স্যার অস্টেসকে এভাবে ফেলে রাখা খুবই কষ্টকর ব্যাপার।

    আপনার বিশ্বস্ত
    স্ট্যানলি হপকিনস।

    হোমস বললে, একটা কথা কিন্তু না-বলে পারছি না, ওয়াটসন। কেস নির্বাচন তোমার ঠিকই হয় না। এর যথাবিহিত প্রায়শ্চিত্ত হওয়া দরকার। সব কিছুই তুমি গল্প লেখার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখ। এই মারাত্মক অভ্যাসেই মাটি করেছে কেসগুলো। তা না-করে যদি বৈজ্ঞানিক চোখ নিয়ে দেখতে, তাহলে বোধ হয় এ-রকম সর্বনাশ হত না ঘটনাগুলোর।

    নিজে লিখলেই তো পার? তিক্ত স্বরে বলি আমি।

    লিখব মাই ডিয়ার ওয়াটসন, লিখব। ইচ্ছে আছে, জীবনের শেষ বছরগুলোয় এমন একটা বই লিখে যাব যার মধ্যে কেন্দ্রীভূত হবে গোয়েন্দাগিরির যাবতীয় আর্ট। বর্তমান কেসটা মনে হচ্ছে খুনের ব্যাপারে।

    তুমি কি তাহলে মনে কর স্যার অস্টেস মারা গেছেন?

    তাই তো মনে হচ্ছে। হপকিনসের লেখার মধ্যে রয়েছে প্রচুর উদবেগ। কিন্তু জানই তো, আবেগপ্রবণ মানুষ নয় সে। খুনখারাপি নিশ্চয় একটা কিছু হয়েছে। লাশটাকেও রেখে দিয়েছে আমাদের পরীক্ষার জন্যে। নিছক আত্মহত্যার কেস হলে আমার কাছে আসার পাত্র সে নয়। শোচনীয় দৃশ্য দেখে পাছে আঘাত পান লেডি, তাই বোধ হয় তাকে তালাচাবি দিয়ে রেখেছে। ঘরে। ওয়াটসন, খুবই অভিজাত মহলে চলেছি আমরা। খড়মড়ে কাগজে, E.B. মনোগ্রাম, বংশের প্রতীক চিহ্ন আর ছবির মতো সুন্দর ঠিকানা–সবগুলিরই মানে এক। আমার তো মনে হয় বন্ধুবর হপকিনসের সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকবে এযাত্রা এবং আমাদেরও সকালটা মন্দ কাটবে না। খুনটা হয়েছে গতরাত্রে বারোটার আগে।

    কী করে বুঝলে তুমি?

    ট্রেনগুলোর গতিবিধি লক্ষ করে আর সময়ের দিকে নজর রেখে। স্থানীয় পুলিশ ডাকতে হয়েছে, তারা এসে খবর দিয়েছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে, হপকিনসকে বেরোতে হয়েছে, তারপর সে খবর পাঠিয়েছে আমাকে। রাত ভোর হয়ে যায় এত কাজ করতে গেলে। যাক, চিশলহাস্ট স্টেশন এসে গেছে। সব সন্দেহ ভঞ্জন করা যাবে এবার।

    গ্রামাঞ্চলের অলিগলির মধ্যে দিয়ে প্রায় মাইল দুয়েক পেরিয়ে এলাম ঘোড়ার গাড়িতে। তারপর পৌঁছোলাম একটা পার্কের ফটকে। খোলা দরজায় আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন ইনস্পেকটর স্ট্যানলি হপকিনস। যৌবনরসে টলমল তার দেহে আর সতর্ক চোখে-মুখে লক্ষ করলাম নিবিড় আগ্রহের দ্যুতি।

    মি. হোমস, আপনি এসেছেন দেখে সত্যিই বড়ো খুশি হলাম! ড. ওয়াটসন, আপনিও এসেছেন দেখছি। হাতে সময় থাকলে আপনাদের আর কষ্ট দিতাম না। ভদ্রমহিলার জ্ঞান ফিরে আসার পর তার মুখেই ঘটনার এমন পরিষ্কার একটা বিবরণ শুনলাম যে আপনাদের আর কিছু করণীয় আছে বলে মনে হয় না আমার। লুইহ্যামের সিঁধেল চোরেদের দলটার কথা মনে আছে আপনার?

    বল কী! আবার সেই তিন র্যান্ড্যাল?

    ধরেছেন ঠিক। বাপ আর দুই ছেলে। এ-কাজ তাদেরই। এ-সম্বন্ধে তিলমাত্র সন্দেহ আমার নেই। দিন পনেরো আগে সিডেনহ্যামে একটা গোলমাল করেছে এই তিনজনে। সেই সময়ে যারা ওদের দেখেছে, তারাই বর্ণনা দিয়েছে ওদের চেহারার। এত তাড়াতাড়ি এবং কাছাকাছি আবার যে ওরা তৎপর হয়ে উঠবে, তা কি আর ভাবতে পেরেছিলাম আমি। আশ্চর্য বুকের পাটা! বাহাদূর বটে! কিন্তু যাই বলুন, এ-কাজ তাদেরই। এবার ওদের বরাতে জানবেন ফাঁসির দড়ি ঝুলছে।

    স্যার অস্টেস তাহলে মারা গেছেন? হ্যাঁ। চুল্লি খোঁচাবার লোহার ডান্ডায় চুরমার হয়ে গেছে তার মাথার খুলি।

    স্যার অস্টেস ব্র্যাকেনস্টল? কোচোয়ানের মুখে শুনলাম। ওঁর স্ত্রী এখন শোকে ভেঙে পড়ছেন। বেচারি। বড়ো ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়েছে ওঁকে। প্রথমে এসে তো প্রায় আধমরা দেখেছিলাম ভদ্রমহিলাকে। আমার মনে হয় আপনার উচিত প্রথমেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে ঘটনাটি আদ্যোপান্ত শুনে নেওয়া। তারপর, সবাই মিলে খাওয়ার ঘরটা পরীক্ষা করা যাবে।

    লেডি ব্র্যাকেনস্টল সাধারণ মহিলা নন। এ-রকম আভিজাত্যপূর্ণ তনু, রমণীয় কান্তি আর এত সুন্দর মুখ কদাচিৎ চোখে পড়ে। বরবর্তিনী যুবতী। বড়ো মিষ্টি, ফুরফুরে চেহারা তাঁর। সোনা-সোনা চুল। নীল নীল চোখ! চুল-চোখের সাথে গায়ের রংও নিশ্চয় মানানসই ছিল কাল রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আগে পর্যন্ত। তার আতঙ্ক-বিহুল উদ্ৰান্ত মুখের সঙ্গে যেন আঁখি-কেশ-তনুর সৌন্দর্য খাপ খাচ্ছিল না মোটেই। উপদ্রব শুধু মনের ওপর নয়, দেহের ওপরেও গেছে। চোখের ঠিক ওপরে কিশমিশ রঙের বীভত্স একটা ফুলো দেখলাম। অতি যত্নে ভিনিগার আর জল দিয়ে একনাগাড়ে ফুলোটা ধুয়ে দিচ্ছিল পরিচারিকা। মুখে তার তপঃকৃশ রুক্ষতার ছাপ। মাথায় বেশ লম্বা। কোচের ওপর শ্রান্তদেহে আড় হয়ে শুয়ে ছিলেন লেডি ব্র্যাকেনস্টল। আমরা ঘরে ঢোকামাত্র তার চকিত সন্ধানী চাহনি আর সুন্দর চোখে সতর্কতার প্রতিচ্ছবি থেকে বুঝলাম, এমন ভয়ানক অভিজ্ঞতার পরেও সাহস বা উপস্থিত বুদ্ধি বিন্দুমাত্র লোপ পায়নি। নীলচে রুপালি রঙের ঢিলে ড্রেসিং গাউনে আবৃত ছিল তার বরতনু। কিন্তু পাশের কোচের ওপর ঝুলছিল রুপপার চাকতি দিয়ে সেলাই করা কালো রঙের একটা ডিনারের পরিচ্ছদ।

    শ্রান্তকণ্ঠে বললেন উনি, মি. হপকিনস, সবই তো বললাম আপনাকে। আমার হয়ে এঁদের আপনি বললেই তো পারতেন? বেশ, যদি দরকার মনে করেন, আবার না হয় বলছি। খাওয়ার ঘরে গিয়েছিলেন এঁরা?

    বন্দোবস্ত যা করার তাড়াতাড়ি করুন। ওভাবে ওঁকে ওখানে ফেলে রাখতে চাই না আমি। ও-দৃশ্য ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। বলতে বলতে সত্যি সত্যিই থর থর করে কেঁপে উঠে দুহাতে মুখ ঢাকলেন লেডি ব্র্যাকেনস্টল। সঙ্গেসঙ্গে হাতের ওপর থেকে গাউনের ঢিলে হাতা খসে পড়তেই বিস্ময়ে অস্ফুট চিৎকার করে উঠল হোমস।

    ম্যাডাম, শুধু চোখের ওপর নয়, হাতেও আঘাত পেয়েছেন দেখছি। এটা কী?দুটো সুস্পষ্ট লাল বিন্দু পাশাপাশি ফুটে উঠেছিল শুভ্র, পেলব হাতে। ঝটিতি গাউনের হাতা দিয়ে বিন্দু দুটো ঢেকে ফেললেন লেডি ব্র্যাকেনস্টল।

    ও কিছু না। গতরাতের বীভৎস ব্যাপারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আপনারা বসুন। আমি বলছি আমার কাহিনি :

    আমি স্যার অস্টেস ব্র্যাকেনস্টলের স্ত্রী। বছরখানেক হল বিয়ে হয়েছে আমাদের। গোপন করে কিছু লাভ হবে বলে মনে হয় না, তাই বলছি, মোটেই সুখের হয়নি আমাদের বিয়ে। এ-রকম মাতালের সঙ্গে এক ঘণ্টা থাকাও খুব সুখকর নয়। আর, যে-মেয়ের অনুভূতি আছে, অন্তরে তেজ আছে, আছে অফুরন্ত প্রাণরস, তাকে যদি এ-রকম একটা লোকের সঙ্গে দিনের পর দিন রাতের পর রাত বিয়ের বাঁধনে বাঁধা থাকতে হয়, তখন তার অবস্থাটা কী হতে পারে কল্পনা করতে পারেন আপনি।

    গতরাতের কথাই বলি আপনাদের। জানেন বোধ হয়, এ-বাড়ির চাকরবাকরেরা নতুন তৈরি অংশটায় ঘুমোয়। মাঝখানের ব্লকটায় থাকি আমরা। পেছনদিকে রান্নাঘর। ওপরে শোয়ার ঘর। আমার ঘরের ওপরেই ঘুমোয় আমার এই পরিচারিকা থেরেসা। আর কেউ থাকে না এদিকটায়। এখানকার কোনো শব্দই দূরের ব্লকে পৌঁছোয় না, কাজেই কারো ঘুম ভাঙাও সম্ভব নয় সেখানে। এসব খবর নিশ্চয় জানত ডাকাতগুলো। তা না হলে ওভাবে ওরা কাজ সারতে পারত না।

    রাত প্রায় সাড়ে দশটায় শুতে যান স্যার অস্টেস। চাকরেরা আগেই চলে গেছিল তাদের কোয়াটারে। পাছে আমার কোনো দরকার পড়ে, তাই থেরেসা ঘুমোয়নি। বাড়ির একদম ওপরে জেগে বসে ছিল সে। এই ঘরেই বসে বই পড়ছিলাম আমি। রাত এগারোটা বাজার পর উঠে পড়লাম। ওপরতলায় ওঠার আগে সব ঠিক আছে কি না দেখে নেওয়ার জন্যে এক পাক ঘুরতে বেরোলাম। এ-কাজ আমিই করি। কারণ তো বললাম। স্যার অস্টেসকে সবসময়ে বিশ্বাস করা চলে না। প্রথমে গেলাম রান্নাঘরে। সেখান থেকে প্যান্ট্রিতে। তারপর গানরুম, বিলিয়ার্ড রুম। ড্রয়িং রুম। সবশেষে খাওয়ার ঘরে। ঘরের জানলাটা সবসময়ে পুরু পর্দায় ঢাকা থাকে। ঘরে ঢুকে এই জানলার কাছেই এগুচ্ছি, এমন সময়ে মুখের ওপর বাতাসের ঝাঁপটা অনুভব করায় বুঝলাম, জানলাটা বন্ধ নেই, খোলা রয়েছে। একটানে পর্দাটা সরিয়ে ফেলতেই মুখোমুখি হয়ে গেলাম একটা চওড়া কাঁধ লোকের সঙ্গে। বয়স হয়েছে লোকটার। সবে ঘরের মধ্যে পা দিয়েছিল সে। জানলাটা লম্বা আকারের ফ্রেঞ্চ উইনডো, নামে জানলা হলেও দরজার মতোই তার মধ্যে দিয়ে যাওয়া যায় লনের ওপর। আমার হাতে ছিল শোয়ার ঘরের জ্বলন্ত মোমবাতি। বাতিটা তুলে ধরতেই প্রথম লোকটার পেছনে আরও দুজনকে দেখলাম। তারাও ঢোকার উদ্যোগ করছিল। দেখেই, কয়েক পা পিছিয়ে এলাম আমি। কিন্তু চকিতে প্রৌঢ় লোকটা বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। প্রথমে আমার কবজি ধরেছিল সে। তারপর ধরল গলা। আমি হাঁ করলাম চিৎকার করবার জন্যে। তখন লোকটা জানোয়ারের মতো প্রচণ্ড একটা ঘুসি মারল আমার চোখের ওপর। এক ঘুসিতেই ছিটকে পড়লাম আমি। নিশ্চয় অজ্ঞান হয়ে ছিলাম কয়েক মিনিটের জন্যে। কেননা, জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর দেখলাম, ঘণ্টাটানার দড়িটা ছিঁড়ে নিয়ে একটা ওক কাঠের চেয়ারের সঙ্গে বেশ শক্ত করে ওরা আমায় বেঁধে ফেলেছে। ডাইনিং রুমে টেবিলের মাথার দিকে থাকে এই চেয়ারটা। এমন আঁট করে বেঁধেছিল যে নড়াচড়া করার ক্ষমতাও ছিল না। পাছে চিৎকার করি, তাই একটা রুমাল দিয়ে পেঁচিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল মুখটা। ঠিক এই সময়ে ঘরে ঢুকলেন আমার দুর্ভাগা স্বামী। নিশ্চয় সন্দেহজনক কোনো শব্দ উনি শুনতে পেয়েছিলেন, তাই এ ধরনের দৃশ্যের জন্য তৈরি হয়েই এসেছিলেন। পরনে শার্ট আর ট্রাউজার্স। একহাতে তার প্রিয় ব্ল্যাকথন কাঠের ছড়ি। তিরবেগে একজনের দিকে ছুটে যেতেই, আধবুড়ো লোকটা চুল্লির ভেতর থেকে আগুন খোঁচাবার লোহার ডান্ডাটা নিয়ে প্রাণপণ শক্তিতে বসিয়ে দিলে তার মাথার ওপর। ওঃ সে কী মার! এতটুকু গোঙানি শুনলাম না তাঁর কণ্ঠে। ধপ করে পড়ে গেলেন মেঝেতে এবং সঙ্গেসঙ্গে নিস্পন্দ হয়ে গেল দেহ। আর একবার অজ্ঞান হয়ে গেলাম আমি। এবারও নিশ্চয় কয়েক মিনিটের জন্যে চেতনা ছিল না আমার। চোখ মেলার পর দেখলাম সাইডবোর্ড থেকে রুপোর বাসনপত্রগুলো নামিয়ে জড়ো করে রেখেছে ওরা। এক বোতল মদ ছিল, তাও নামিয়েছে। প্রত্যেকের হাতে একটা গেলাস দেখলাম। একটু আগেই আপনাদের বললাম না, তিনজনের একজনের বয়স হয়েছে? তার আবার একগাল দাড়িও আছে। বাকি দুজন ছেলেমানুষ–মুখে গোঁফ দাড়ির বালাই নেই। দেখে মনে হল, বাপ তার দুই ছেলেকে নিয়ে বেরিয়েছে রাতের শিকারে। ফিসফিস করে কিছুক্ষণ কথা হল তিন মূর্তিতে। তারপর আমার কাছে এসে দেখাল বাঁধন শক্ত আছে কি না। এরপর, একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ওরা। যাওয়ার সময়ে বন্ধ করে গেল জানলার পাল্লাটা। মিনিট পনেরো ধস্তাধস্তি করার পর মুখের বাঁধন খসিয়ে ফেললাম আমি। কয়েকবার সজোরে চিৎকার করে উঠতেই থেরসা নেমে এসে বাঁধন খুলে দিল আমার। অন্যান্য চাকরবাকরদেরও ঘুম ভাঙানো হল তখুনি। লোক্যাল পুলিশকেও খবর পাঠালাম। খবর পেয়ে ওরা তৎক্ষণাৎ সরাসরি যোগাযোগ করলে লন্ডনের সঙ্গে। এ ছাড়া আর কিছু বলার নেই আমার। আমার বিশ্বাস, এ বুকফাটা কাহিনির পুনরাবৃত্তি করারও আর প্রয়োজন হবে না।

    কোনো প্রশ্ন করবেন মি. হোমস? হপকিনস জিজ্ঞেস করলে।

    না, এঁকে আর বিরক্ত করার ইচ্ছে নেই আমার। ধৈর্যের সীমা আছে, সময়েরও মূল্য আছে। বললে হোমস। তারপর ফিরল থেরেসার দিকে, খাওয়ার ঘরে যাওয়ার আগে তোমার মুখেই শুনে যেতে চাই কাল রাতের ঘটনার বিবরণ।

    শুরু করে থেরসা, এ-বাড়িতে লোকগুলো ঢোকার আগেই ওদের আমি দেখেছিলাম। জানলার সামনে বসে ছিলাম। বাইরের ফুটফুটে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম দূরে লজের ফটকের সামনে তিনজন লোককে। কিন্তু তখন ও নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাইনি। তারপর ঘণ্টাখানেক গেছে। হঠাৎ শুনলাম গিন্নিমার আর্ত চিৎকার। শুনেই এক দৌড়ে নেমে এসে যা দেখলাম, ওক কাঠের চেয়ারটায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা বেচারি। আর, ঘরময় ছড়িয়ে রক্ত আর টুকরো টুকরো মগজ। রক্তের ছোপ ছোপ দাগ হতভাগিনীর পোশাকেও লেগে ছিল। ওইরকম বাঁধা অবস্থায় চোখের সামনে ওই দৃশ্য দেখলে যেকোনো মেয়েরই বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাওয়া স্বাভাবিক। এমনকী পাগল হতেও বিশেষ দেরি লাগে না। কিন্তু অ্যাডেলেড-এর মিস ফ্রেজারের এবং অধুনা অ্যাবি গ্র্যাঞ্জ-এর লেডি ব্র্যাকেনস্টলের সাহসের অভাব কোনোদিনই হয়নি। ওকে অনেক সওয়াল করেছেন আপনারা। এবার রেহাই দিন। নিজের ঘরে গিয়ে এবার একটু বিশ্রাম নিক বেচারি।

    মায়ের মতো স্নেহ কোমল হাতে আলগোছে গৃহকত্রীর কোমর জড়িয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল থেরেসা।

    হপকিনস বললে, জন্মাবধি এক মুহূর্তের জন্যেও লেডি ব্র্যাকেনস্টলের কাছছাড়া হয়নি থেরেসা। শিশু অবস্থায় ধাইমার কাজ করেছে। তারপর, আঠারো মাস আগে ওঁরা যখন সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে ইংলন্ডে আসেন, থেরেসাও এসেছিল সঙ্গে। ওর পুরোনাম থেরেসা রাইড। এ ধরনের পরিচারিকা আজকাল বড়ো একটা দেখা যায় না মি. হোমস।

    সুনিবিড় আগ্রহের দীপ্তি মুছে গেছিল হোমসের ভাবব্যঞ্জক মুখ থেকে। রহস্যের সঙ্গে সঙ্গে তিরোহিত হয়েছিল কেসটার যাবতীয় আকর্ষণ। এখন বাকি শুধু একটা গ্রেপ্তার করার। কিন্তু এই জাতীয় অতি সাধারণ বদমাশ ঘেঁটে সে কি তার হাত কলঙ্কিত করতে চাইবে? বিশেষ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ গম্ভীর প্রকৃতির মহাপণ্ডিত কোনো চিকিৎসাবিদকে সামান্য হাম জ্বরের জন্যে ডেকে আনলে তার মুখে যেমন অপরিসীম বিরক্তি ফুটে ওঠে, আমার বন্ধুটির মুখেও সেদিন অবিকল সেইরকম প্রতিচ্ছবিই দেখলাম। কিন্তু তবুও, অ্যাবি গ্র্যাঞ্জ-এর খাওয়ার ঘরে ঢুকে ওই বিচিত্র দৃশ্য দেখার পর আবার জাগ্রত হয় তার ক্ষীয়মাণ আগ্রহ, একাগ্র হয়ে ওঠে তার অন্তর।

    বিশাল ঘর। আর ঠিক সেই অনুপাতে অনেকটা উঁচু। ওক কাঠের কারুকার্য করা সিলিং, ওক কাঠের প্যানেল এবং দেওয়াল জুড়ে সারি সারি হরিণের মাথা আর প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্রাদির সমাবেশ। লম্বা আকারের ফ্রেঞ্চ-উইনডোটা দেখলাম দরজার অপর প্রান্তে। ডান দিকের ছোটো সাইজের তিনটি জানলা দিয়ে শীতের হিমেল রোদূর এসে আলোকিত করে তুলেছিল ঘরটা। বাঁ-দিকে খুব গভীর আর মস্তবড়ো একটা ফায়ার প্লেস। ওক কাঠের তৈরি অতিকায় ম্যান্টলপিসের কিনারাটা বেরিয়ে এসেছিল ফায়ার প্লেসের ওপরে। চুল্লির বাঁ-দিকে ওক কাঠের একটা হাতলওলা ভারী চেয়ার–তলার কাঠ দুটো ক্রস করা। লাল টকটকে একটা দড়ি জড়ানো চেয়ারের চারদিকে। দড়ির দুই প্রান্ত নীচের ক্রস করা কাঠ দুটোয় বাঁধা। লেডি ব্র্যাকেনস্টল বন্ধনমুক্ত হওয়ার পর ঢিলে হয়ে পড়েছিল দড়িটা, কিন্তু যেমন তেমন বাঁধা ছিল গিটগুলো। এসব খুঁটিনাটি আমরা পরে দেখেছিলাম। কেননা, ঘরে ঢোকামাত্র আমাদের চিন্তাধারা একমুখী হয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল ফায়ার-প্লেসের সামনের বিছানো বাঘের চামড়ার ওপর হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা ভয়াবহ বস্তুটির দিকে।

    দেহটি এক দীর্ঘকায়, সুগঠিত পুরুষের। বছর চল্লিশ বয়স তার। সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে চিত হয়ে পড়ে ছিল তাঁর দেহ। কুচকুচে কালো ছোটো দাড়ির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে ছিল ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি, যেন মুখ খিচিয়ে রয়েছেন বিকটভাবে। মুঠো করা হাত ছিল মাথার ওপরদিকে ব্ল্যাকথন কাঠের একটা ছড়ি আড়াআড়িভাবে পড়ে ছিল দু-হাতের মধ্যে। প্রতিহননের ইচ্ছায় আর প্রবল ঘৃণায় দুমড়ে মুচড়ে গেছিল তার মলিন কিন্তু সুশ্রী মুখের ধারালো নাক, চোখ আর প্রতিটি রেখা। নিপ্রাণ মুখের পরতে পরতে জমাট বেঁধে ছিল একটা পৈশাচিক বিভীষিকা। নীচের আওয়াজ শুনে সচকিত হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত শয্যায় ছিলেন উনি। কেননা, পরনে দেখলাম এমব্রয়ডারি করা একটা সূচীসুন্দর শৌখিন রাত্রিবাস, আর ট্রাউজার্সের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা পা দুটো সম্পূর্ণ নগ্ন। মাথার আঘাত অতি ভয়াবহ। এক আঘাতেই প্রাণবায়ু শুন্যে মিলিয়েছিল। সে-আঘাত যে কতখানি মারাত্মক, পাশবিক আর প্রচণ্ড তার প্রমাণ ঘরের চারিদিকে চোখ বুলোলেই পাওয়া যায়। আঘাতের প্রচণ্ডতায় বেঁকে যাওয়া লোহার ভারী ডান্ডাটা পড়ে ছিল পাশেই। ডান্ডা আর ডান্ডা রচিত ধ্বংসাবশেষ–দুটোই পরীক্ষা করল হোমস।

    র‍্যান্ডালদের দলপতি আধবুড়ো হলেও গায়ে বেশ শক্তি রাখে দেখছি, মন্তব্য করল ও।

    হপকিনস বললে, হ্যাঁ, তা রাখে। লোকটা সম্বন্ধে কিছু রেকর্ড তো আমার দপ্তরেই আছে। বেজায় চোয়াড়ে লোক।

    তাহলে তাকে পাকড়াও করতে মোটেই বেগ পাওয়া উচিত নয় তোমার।

    নিশ্চয় নয়। এ-কাণ্ড হওয়ার আগে থেকেই ওর খোঁজখবর নিচ্ছিলাম আমরা। অনেকের ধারণা ছিল, ও নাকি আমেরিকায় পালিয়েছে। এখন তো দেখছি পুরো দলটাই রয়েছে এখানে। এবার তো বাছাধনেরা চোখে সর্ষেফুল দেখবে আমাদের চোখে ধুলো দিতে। বন্দরে বন্দরে খবর চলে গেছে। আজ সন্ধের আগেই একটা পুরস্কারও ঘোষণা হবে। আমার খটকা লাগছে শুধু একটা কথা ভেবে। ওরা জানত, ওদের চেহারার নিখুঁত বর্ণনা যথাসময়ে লেডি ব্র্যাকেনস্টলের মুখে শুনতে পাবে পুলিশ এবং সে-বর্ণনা শুনলে তিনজনকে শনাক্ত করতে মোটেই বেগ পেতে হবে না। এসব জেনেও এ-রকম উন্মাদের মতো কাণ্ডটা ওরা কেন করল?

    এগজ্যাক্টলি। এ-ঘটনা শুনলেই মনের মধ্যে একটা খটকা থেকে যায় যে ভদ্রমহিলাকে শেষ করে ফেললেই তো গোল চুকে যেত।

    আমি বললাম, ওরা হয়তো ধারণাও করতে পারেনি যে আবার জ্ঞান ফিরে পেতে পারেন উনি।

    তা হলেও হতে পারে। অজ্ঞান অবস্থায় দেখে ভদ্রমহিলাকে হত্যার চেষ্টা করেনি ওরা। ভালো কথা, হপকিনস, স্যার অস্টেস সম্বন্ধে খবর-টবর কিছু রাখ? ওঁর সম্বন্ধে আশ্চর্য কিছু কিছু গল্প আমার কানে এসেছে বলেই জিজ্ঞেস করছি।

    মেজাজ ঠান্ডা থাকলে বিলক্ষণ মায়া দয়া থাকত তার অন্তরে। কিন্তু নেশা জমলে আর রক্ষে নেই–পুরোপুরি পিশাচের পর্যায়ে পৌঁছে যেতেন উনি। একদিন মদ রাখার ডিক্যান্টার ছুঁড়ে মেরেছিলেন থেরেসাকে। এ নিয়েও কম গণ্ডগোল হয়নি। আপনাকেই শুধু বলে রাখি, স্যার অস্টেস-এর অবর্তমানে সুখেই থাকবেন এ-বাড়ির সবাই। কী দেখছেন?

    জানু পেতে বসে পড়ে চেয়ারের চারিদিকে জড়ানো লাল দড়ির গিটগুলো পরীক্ষা করছিল হোমস! মুখের প্রতিটি রেখায় নিবিড় তন্ময়তার নিখুঁত অভিব্যক্তি। টান মেরে দড়িটাকে ছিঁড়েছিল চোরের দল। গিটগুলো দেখা শেষ হবার পর শুয়ো বার করা ছেড়া প্রান্তটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে আরম্ভ করল ও।

    তারপর বলল, দড়িটা ছেড়ার সময়ে বেশ জোরেই টানতে হয়েছিল। ফলে, রান্নাঘরের ঘণ্টাটাও নিশ্চয় বেজে উঠেছিল দারুণ শব্দে।

    বাজলেও কেউ তা শুনতে পায়নি। রান্নাঘরটা এ-বাড়ির একদম পেছনদিকে।

    কিন্তু চোরেরা জানলে কী করে যে কেউ শুনতে পাবে না? এ-রকম বেপরোয়াভাবে ঘণ্টার দড়ি টানার সাহস ওরা পেল কোত্থেকে?

    ঠিক বলেছেন, মি. হোমস, ঠিক বলেছেন। আমি নিজেও এ-প্রশ্ন বার বার করেছি নিজেকে। লোকটা যে বাড়ির সব খবরই রাখত, সে-বিষয়ে কোনোরকম সন্দেহরই অবকাশ থাকতে পারে না। খুব ভালো করেই সে জানে যে বাড়ির প্রতিটি চাকর সে সময়ে শুতে চলে যায় দূরের কোয়ার্টারে। রান্নাঘরের ঘণ্টার আওয়াজ কারো কানে পৌঁছোনোই সম্ভব নয়। চাকরবাকরদের কারো সঙ্গে নিশ্চয় যোগসাজশ ছিল ওর। হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয় তাই। এ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু ব্যাপার কী জানেন, বাড়ির আটজন চাকরের প্রত্যেকেরই স্বভাবচরিত্র ভালো।

    হোমস বললে, আর কারো কথা জানি না, কিন্তু একজনের ওপর আপনা হতেই সন্দেহ এসে পড়ছে। সে হল থেরেসা–যার মাথা লক্ষ করে ডিক্যান্টার ছুঁড়ে মেরেছিলেন স্যার অস্টেস। কিন্তু সে আবার লেডির একান্ত অনুগত এবং প্রতিহিংসা নিতে যাওয়া মানেই তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। খুবই তুচ্ছ পয়েন্ট এটা। র্যান্ড্যালকে হাজতে পোরার পর তার দুষ্কর্মের সঙ্গীদের খুঁজে বার করতেও বিশেষ বেগ পেতে হবে তোমায়। লেডি ব্র্যাকেনস্টলের কাহিনি একেবারে সত্যি। ঘরের প্রতিটি জিনিসই তার চাক্ষুষ প্রমাণ। বলতে বলতে ফ্রেঞ্চ-উইনডোর সামনে গিয়ে জানলাটা খুলে দিলে সে। এখানেও কোনো চিহ্ন নেই। জমি লোহার মতো শক্ত, পায়ের ছাপ পাওয়ার আশা দুরাশা। ম্যান্টলপিসের ওপরে রাখা মোমবাতিগুলো জ্বালানো হয়েছিল দেখছি।

    হ্যাঁ, হয়েছিল। ওই আলোয় আর লেডির শোয়ার ঘরের মোমবাতির আলোয় পথ চিনে চম্পট দিয়েছে চোরেরা।

    যাওয়ার সময়ে কী কী নিয়ে গেছে?

    বেশি কিছু নয়। সাইডবোর্ডে রাখা মাত্র আধডজন প্লেট। লেডির মতে, স্যার অস্টেসের মৃত্যুতে ওরা এমনই বিচলিত হয়ে পড়েছিল যে সারাবাড়ি লুঠ করা আর হয়ে ওঠেনি। অন্য সময় হলে অবশ্য এত অল্পের ওপর রেহাই দিত না।

    খাঁটি কথাই বলেছেন। ওরা তো মদও খেয়েছে, তাই না?

    নার্ভ শক্ত রাখার জন্যে।

    ঠিক। সাইডবোর্ডের ওই গেলাস তিনটেতে কেউ হাত দেয়নি তো?

    না। বোতলটা ওরা যেভাবে ফেলে গেছে, সেইভাবেই রেখেছি আমি।

    তাহলে ওইগুলোই দেখা যাক। আরে, আরে! এ কী?

    পাশাপাশি তিনটে গেলাস সাজানো ছিল সাইডবোর্ডে। মদের দাগ লেগে ছিল প্রত্যেকটার ভেতরে। অনেকদিন রেখে দেওয়ার ফলে বহু পুরোনো মদে দ্বিতীয়বারের মতো যে সর পড়ে, তারই খানিকটা তলানি দেখলাম একটা গেলাসের নীচে। তিন ভাগের দু-ভাগ ভরতি বোতলটা ছিল পাশেই। সুরার রঙে গভীরভাবে রাঙানো লম্বা আকারের একটা ছিপি পড়ে ছিল একদিকে। ছিপি আর বোতলের গায়ে ধুলোর পুরু স্তর দেখেই বুঝলাম, দ্রাক্ষারসটি সাধারণ মদিরা নয় এবং সেরা জিনিসটিই চেখে গেছে খুনিরা।

    আকস্মিক পরিবর্তন এসেছিল হোমসের আচরণে। নিরুদ্যম ভাব অন্তর্হিত হয়েছিল নিমেষের মধ্যে। কোটরাগত সজাগ দুই চোখে আবার জেগে উঠেছিল আগ্রহ আর সতর্কত। ছিপিটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করতে লাগল সে। তারপর জিজ্ঞেস করল, ছিপিটা খুলল কেমন করে?

    আধখোলা একটা ড্রয়ার দেখিয়ে দিলে হপকিনস। টেবিল মোছার খানিকটা কাপড় আর ছিপি খোলার বড়ো সাইজের একটা প্যাচানো স্তু ছিল ভেতরে।

    কিন্তু এই স্ক্র দিয়েই ছিপিটা খোলা হয়েছিল কি না, তা কি লেডি স্বচক্ষে দেখেছেন?

    না, বোতলটা খোলার সময়ে তার জ্ঞান ছিল না।

    ঠিক বলেছ। সত্যি কথা বলতে কী, কোনো কাজেই লাগানো হয়নি এই স্ক্রটিকে। ছিপিটা খোলা হয়েছে একটা পকেট ভ্রু দিয়ে। যতদূর মনে হয় ছুরির সঙ্গে লাগানো ছিল স্কুটা এবং তা লম্বায় দেড় ইঞ্চির বেশি নয়। ছিপির ওপরটা লক্ষ করলেই দেখতে পাবে, তিন-তিনবার স্কুটাকে ভেতরে ঢোকানোর পর তবে খোলা গেছে ছিপিটা। তিনবার ঢুকিয়েও কিন্তু কোনোেবারই এফেঁড়-ওফোঁড় করতে পারেনি। কিন্তু এই বড়ো ভ্রু দিয়ে তা করা যেত এবং এক টানেই ছিপিটাকে খুলে আনা যেত বাইরে। হপকিনস, লোকটাকে গ্রেপ্তার করতে পারলে তার পকেটে একটা ছুরি পাবে। ছুরিটার ফলা একটা নয়–অনেকগুলো এবং অনেক রকমের।

    চমৎকার! উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে হপকিনস।

    কিন্তু, হপকিনস, ওই গেলাস দুটোই যে আমার বুদ্ধিশুদ্ধি ঘুলিয়ে দিচ্ছে! লেডি সত্যিই তিনজনকে সুরা পান করতে দেখেছিলেন, তাই না?দেখেছিলেন শব্দটার ওপর সামান্য জোর দেয় হোমস।

    নিশ্চয়। এ-সম্পর্কে কোনোরকম অস্পষ্টতা নেই তার জবানবন্দিতে।

    তাহলে যবনিকা পড়ুক এ-প্রসঙ্গে। তা ছাড়া কী আর করা যায় বল? কিন্তু গেলাস তিনটে যে রীতিমতো অসাধারণ, তা তোমায় মেনে নিতেই হবে, হপকিনস। কী বললে? আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই দেখতে পাচ্ছ না? বেশ, বেশ, ইতি করে দাও এ-আলোচনার। আমার মতো কেউ যদি কোনো বিশেষ জ্ঞান বা বিশেষ ক্ষমতাকে বিশেষভাবে রপ্ত করে থাকে, তখন হয় কি, সোজা জিনিসকে ঠিক চোখে সে দেখে উঠতে পারে না। হাতের কাছে থাকা সহজ সমাধান উপেক্ষা করে। জটিল আর দুর্বোধ্য উত্তরের পেছনেই ধাওয়া করার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে তার মনে। আমার হয়তো সেই দশাই হয়েছে। এমনও হতে পারে, গেলাসগুলো নিশ্চয় দৈবের দেওয়া নিছক একটা সুযোগ। গুড মর্নিং, হপকিনস। এ-ব্যাপারে তোমায় বিশেষ সাহায্য করতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। তা ছাড়া, কেসটা সম্পর্কে তোমার নিজের মনেও কোনো অস্বচ্ছতা, আবিলতা দেখছি না। র্যান্ডালকে গ্রেপ্তার করতে পারলে অথবা নতুন কিছু ঘটলে খবর পাঠিয়ে আমাকে। আমার তো বিশ্বাস, শিগগিরই এ-কেসের সফল সমাপ্তির জন্যে তোমাকে অভিনন্দন জানাতে আসতে হবে। এসো হে ওয়াটসন, আমরা বরং ঘরে বসে অমূল্য সময়ের সদ্ব্যবহার করি। তাতে লাভ বই ক্ষতি হবে না।

    ফেরার পথে হোমসের চোখ-মুখ দেখে মনে হল রীতিমতো হতবুদ্ধি হয়ে গেছে সে। অ্যাবি গ্র্যাঞ্জ-এ এমন কিছু দেখে এসেছে ও, যা ভাবতে গিয়ে বারে বারে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে ওর যুক্তিতর্কের ইমারত। বার বার দেখছিলাম, জোর করে এই হতবুদ্ধি ভাবটা ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করছিল সে। ঘটনাটা যেন জলের মতোই নির্মল, এমনিভাবেই আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছিল। কিন্তু প্রতিবারেই মনের ওপর চেপে বসছিল প্রচ্ছন্ন সন্দেহটা। ওর ললাটরেখা আর তন্ময় দৃষ্টি দেখেই বুঝতে পারছিলাম, মনে মনে হোমস আবার ফিরে গেছে অ্যাবি গ্রাঞ্জ-এর সুবিশাল খাওয়ার ঘরে–মধ্যরাতের ট্র্যাজেডি যে ঘরের মন্থর আবহাওয়াকে শিহরিত করে তুলেছে আপন ভয়াবহতায়। শহরতলির একটা স্টেশন থেকে ধীরগতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের ট্রেনটা। ঠিক এমনি সময়ে আচম্বিত আবেগের আচমকা কশাঘাতে ও তড়াক করে লাফিয়ে পড়ল প্ল্যাটফর্মে। আমাকেও টেনে আনল কামরার ভেতর থেকে।

    ক্ষমা করো আমায়, বাঁকের আড়ালে, অপস্রিয়মাণ শেষ কামরাটার দিকে তাকিয়ে বলল ও। ভাবছ, নিছক খেয়ালের ঝেকে কষ্ট দিচ্ছি তোমায়। কিন্তু ঈশ্বরের দিব্যি ওয়াটসন, কেসটা আমি এ-অবস্থায় রেখে যেতে পারছিনা, কিছুতেই না। আমার সমস্ত সত্তা, প্রতিটি অনুভূতি বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। ওয়াটসন, ভুল–আগাগোড়া ভুল–আমি শপথ করে বলছি–সমস্ত ভুল। তুমি হয়তো বলবে, কী করে তা সম্ভব? লেডি ব্র্যাকেনস্টলের কাহিনিতে কোনো খুঁত নেই। থেরেসার রিপোর্টে রয়েছে সে-কাহিনির পূর্ণ সমর্থন। খুঁটিনাটিগুলো মোটামুটি নির্ভুল। এসবের বিরুদ্ধে খাড়া করার মতো মালমশলা কী? না, তিনটে মদের গেলাস। ব্যস, আর কিছু না। কিন্তু কারো ওপর নির্ভর না-করে যদি সরাসরি কেসটা হাতে নিতাম আমরা, কারো কাটছাঁট গল্প শুনে নিজের মনকে আবৃত না-করতাম, সরেজমিন তদন্তে এসে প্রথম থেকেই সব কিছু মেনে না-নিয়ে হুঁশিয়ার হয়ে তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করে দেখতাম সব কিছু তাহলে কি তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার মতো এর চাইতেও জোরালো কোনো পয়েন্ট আমি আবিষ্কার করতে পারতাম না? নিশ্চয় পারতাম। বেঞ্চটায় বসে পড়ো ওয়াটসন। আমাদের ট্রেন না-আসা পর্যন্ত বসে বসে শোনো। তার আগে একটা আবেদন আছে। লেডি অথবা তার পরিচারিকার কাহিনির যে নির্ভেজাল সত্যি হতেই হবে, এ-রকম ধরনের কোনো ধারণা যদি তোমার মাথায় থেকে থাকে, তবে অবিলম্বে বিনা দ্বিধায় তাকে নির্বাসন দাও। ভদ্রমহিলার মন ভোলানো ব্যক্তিত্ব যেন আমাদের বিচারবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন না করে।

    এমন কতকগুলো পয়েন্ট রয়েছে লেডির কাহিনিতে যা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় একটু ভাবলেই সন্দেহ হয়। মাত্র দিন পনেরো আগে সিডেনহ্যামে বেশ বড় রকমের একটা কাণ্ড করে এসেছের্যান্ডাল বাহিনী। এদের কীর্তিকলাপের বিবরণ এবং দৈহিক বর্ণনা কাগজে বেরিয়েছিল। কাজেই, কেউ যদিমনগড়া গল্পের মধ্যে ওই চোরদের দিয়ে কোনো দৃশ্য অভিনীত করাতে চায়, তাহলে সহজেই এরা এসে পড়বে সেইসব চরিত্রে। কিন্তু আসলে কী হয় জান, চোরেরা যদি বেশ কিছুদিন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোনোর মতো মোটা দাঁও পিটতে পারে, তাহলে নতুন কোনো বিপদের মধ্যে নাক না-গলিয়ে নিশ্চিন্ত মনে নিরুপদ্রবে চোরাই অর্থ নিজেদের ভোগে লাগিয়ে নিতে চায় পরম শান্তিতে। এইটাই নিয়ম। আবার দেখ, রাত গভীর হতে-না-হতেই এত সকাল সকাল তৎপর হয়ে ওঠাটা চোরেদের পক্ষে খুবই অস্বাভাবিক। স্ত্রীলোকের চেঁচানি বন্ধ করার জন্যে ঘুসি মারাও চোরদের পক্ষে অস্বাভাবিক। কেননা, সবাই জানে চিকারটা তাতেই বরং বেশি হওয়া স্বাভাবিক। খুন করাও তাদের পক্ষে অস্বাভাবিক। বিশেষ করে ওরা যখন সংখ্যায় বেশি। একজনকে কাবু করে ফেলা এমন কিছু কঠিন নয় তিন তিনটে পুরুষের পক্ষে। নাগালের মধ্যে প্রচুর লোভনীয় জিনিস থাকা সত্ত্বেও এত অল্পে সন্তুষ্ট থাকাটাও তাদের পক্ষে অস্বাভাবিক। সবশেষে, দামি দুষ্প্রাপ্য মদের অর্ধেকও না-খেয়ে ফেলে রেখে যাওয়াটা তাদের মতো লোকদের পক্ষে রীতিমতো অস্বাভাবিক।ওয়াটসন, এবার বল এতগুলো অস্বাভাবিকতা। শুনে কী মনে হয় তোমার?

    অস্বাভাবিকতাগুলোর সম্মিলিত ফলাফল নিশ্চয় ভাববার মতো। তা ছাড়া, আলাদা আলাদা ভাবে দেখতে গেলে আবার প্রতিটাই সম্ভব। সবচেয়ে অস্বাভাবিক ব্যাপার অন্তত আমার কাছে যা মনে হয়, তা হল ভদ্রমহিলাকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রেখে যাওয়া।

    এ-সম্পর্কে অবশ্য আমি নিশ্চিত নই, ওয়াটসন। কেননা, দুটি পথ খোলা ছিল দুবৃত্তদের সামনে। হয় ওঁকে খতম করে দেওয়া, না হয় এমনভাবে বেঁধে রেখে যাওয়া যাতে ওদের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে উনি শোরগোল তুলতে না-পারেন। সে যাই হোক, লেডি ব্র্যাকেনস্টলের কাহিনিতে কোথাও-না-কোথাও অবিশ্বাসের একটা কণিকা যে লুকিয়ে আছে, তা আমি দেখতে পেয়েছি। তাই নয় কি? আর এখন এসব কিছুর ওপরে আসছে তিনটে মদের গেলাসের রহস্য।

    মদের গেলাসের রহস্য?

    মনের চোখ দিয়ে গেলাসগুলো দেখতে পাচ্ছ তো?

    ছবির মতো।

    লেডি ব্র্যাকেনস্টল বলেছেন, গেলাসগুলো নিয়ে মদ খেয়েছে তিনজন পুরুষ। জবানবন্দির এই অংশটুকুর সম্ভবপরতা সম্বন্ধে তোমার মনে কি কোনো খটকা জাগছে?

    সম্ভবই-বা নয় কেন শুনি? প্রত্যেকটা গেলাসেই তো মদ ছিল।

    মোটেই না। সরে ভরতি ছিল বোতলটা। কাজেই প্রথম দুটো গেলাসে কোনো সর পড়ল না, কিন্তু তৃতীয়টায় পড়ল প্রচুর পরিমাণে এ-রকম উদ্ভট ধারণা মনে আনতেও কষ্ট হয়। দুটি—মাত্র দুটি ব্যাখ্যা আছে এ-রহস্যের। একটা হল, দ্বিতীয় গেলাসটা ভরবার পর বেশ জোরে কঁকিয়ে নেওয়া হয়েছিল বোতলটা। তাই সরগুলো পড়েছে শেষের গেলাসে। কিন্তু এ-সম্ভাবনা কষ্টকল্পিত এবং মোটেই সম্ভব বলে মনে হয় না। না, না, ওয়াটসন আমার অনুমানই সত্য। কোনো ভুল নেই তাতে।

    তোমার অনুমান কী শুনি।

    মদ খাওয়া হয়েছে মাত্র দুটি গেলাস থেকে। ঘটনাস্থলে যে তিনজন হাজির ছিল, এমনি একটা মিথ্যা ধারণা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে দুটি গেলাসের তলানি ঢেলে দেওয়া হয়েছে তৃতীয় গেলাসে। তাহলেই, সমস্ত সর এসে পড়েছে শেষের গেলাসে। তাই নয় কি? হ্যাঁ, তাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাই। কিন্তু এই ছোট্ট কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপারটার সত্য ব্যাখ্যা যদি আবিষ্কার করতে পেরে থাকি তাহলেই কেসটা এক লাফে সাধারণ থেকে উঠে আসছে রীতিমতো অসাধারণের পর্যায়ে। কেননা, এসব কিছুর একমাত্র সহজ সরল ব্যাখ্যা হল এই যে, লেডি ব্র্যাকেনস্টল এবং তার পরিচারিকা থেরেসা স্বেচ্ছায় এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে সম্পূর্ণ মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে একটা আষাঢ়ে গল্প শুনিয়েছেন আমাদের এবং এ-গল্পের একটা বর্ণও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসল অপরাধীকে এভাবে আড়াল করে রাখার পেছনে নিশ্চয় কোনো বড় রকমের কারণ আছে ওঁদের। এ-রহস্যের সন্তোষজনক মীমাংসায় পৌঁছোতে হলে তাদের কোনোরকম সাহায্য না-নিয়ে নিজেদেরই গড়ে তুলতে হবে তদন্তের বনিয়াদ। বর্তমানে এইটাই হল আমাদের একমাত্র কর্তব্য। ওয়াটসন, আমাদের ট্রেন এসে গেছে।

    আমাদের আবার ফিরে আসতে দেখে অবাক হয়ে গেল অ্যাবি গ্র্যাঞ্জ-এর অধিবাসীরা। কিন্তু শার্লক হোমস যখনই শুনলে লেসট্রেড হেড কোয়ার্টারে গেছে রিপোর্ট পেশ করতে, সঙ্গেসঙ্গে কাল বিলম্ব না-করে দখল করে বসল খাওয়ার ঘরটা। ভেতর থেকে তালা এঁটে দিয়ে শুরু হল ঝাড়া দু-ঘণ্টা ধরে অত্যন্ত সূক্ষ্ম আর শ্রমসাধ্য তদন্ত পর্ব। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, ঠিক এমনি ধরনের মজবুত বনিয়াদের ওপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে অবরোহ পদ্ধতি অনুসারে পাওয়া শার্লক হোমসের অতি উজ্জ্বল অনুমান-ইমারত। জটিল বৈজ্ঞানিক তথ্য হাতেনাতে প্রমাণ করার সময়ে অনুগত ছাত্র যেমন অধ্যাপকের দিকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আমিও ঘরের কোণে বসে নিঃশব্দে তার তাক লাগানো গবেষণার প্রতিটি ধাপ অনুসরণ করতে লাগলাম একাগ্র মনে। জানলা, পর্দা, কার্পেট, চেয়ার, দড়ি পরপর প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল হোমস। প্রতিবার পরীক্ষা শেষে তন্ময় হয়ে রইল চিন্তায়। ব্যারনেটের দেহ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ঘর থেকে। এ ছাড়া ঘরের আর কোনো জিনিস নাড়াচাড়া করা হয়নি। তারপর হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে অতিকায় ম্যান্টলপিস বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল হোমস। ওপরে ওঠার পরেও মাথা থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে ঝুলতে লাগল লাল দড়ি এতটুকু একটা প্রান্তভাগ। তারের সঙ্গে তখনও দড়িটুকু লেগে ছিল। বেশ কিছুক্ষণ নির্নিমেষে দড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল হোমস। তারপর আরও কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টায় হাঁটু ঠেস দিলে দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা একটা কাঠের ব্র্যাকেটের ওপর। ফলে হাতের নাগালের কয়েক ইঞ্চির মধ্যেই পৌঁছে গেল দড়ির ছোঁড়া টুকরোটা। কিন্তু শুধু দড়ি নয়, ব্র্যাকেটটাও ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বলে মনে হল। সবশেষে, একটা পরিতৃপ্তির শব্দ শুনলাম ওর কণ্ঠে এবং পরমুহূর্তেই লাফিয়ে নেমে পড়ল হোমস মেঝের ওপর।

    সব ঠিক আছে, ওয়াটসন। হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছি কেসটাকে। যতগুলো চমক লাগানো কেস আছে আমাদের সংগ্রহে, তাদের মধ্যে অন্যতম হবে অ্যাবি গ্রাঞ্জ-এর রহস্য। কিন্তু কী মুশকিল বল তো? আমার বুদ্ধিশুদ্ধি যে এত মন্থর হয়ে এসেছে তা কে জানত! আর একটু হলেই মস্ত ভুল করে ফেলেছিলাম আর কি! সারাজীবনেও সে-ভুল শোধরানোর সুযোগ পেতাম না। কিন্তু এখন আর কোনো কুয়াশা নেই আমার চোখের সামনে। আর কয়েকটা হারিয়ে যাওয়া অংশ পেলেই সম্পূর্ণ হয়ে যায় আমার যুক্তি বিচার ও বক্তব্য।

    লোকগুলোর হদিশ পেলে?

    লোক, ওয়াটসন, লোক। মাত্র একজন কিন্তু অতি ভয়ংকর লোক। সিংহের মতো শক্তিমান সে। দেখছ না, এক আঘাতেই কতখানি দুমড়ে গেছে লোহার ডান্ডাটা। মাথায় ছ-ফুট তিন ইঞ্চি, কাঠবেড়ালের মতো চটপটে, আঙুলের কাজেও রীতিমতো পটু। আরও আছে–উপস্থিত বুদ্ধি তার অসাধারণ। কেননা, সমস্ত আষাঢ়ে গল্পটা তারই মগজ থেকে বেরিয়েছে। হ্যাঁ, ওয়াটসন, হ্যাঁ। একজন অতি আশ্চর্য লোকের চাতুর্যের প্রদর্শনীর মধ্যে এসে পড়েছি আমরা। কিন্তু ঘণ্টা টানার ওই দড়িটার মধ্যে এমন একটা সূত্র রেখে গেছে সে, যা দেখলে আর তিলমাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

    সূত্রটা পেলে কোথায়?

    ওয়াটসন, ঘণ্টা টানার দড়ি ছেড়ার জন্যে যদি নীচে থেকে টান মার, তাহলে দড়িটা কোথায় ছেড়া উচিত? না, তারের সঙ্গে যেখানে লাগানো আছে, ঠিক সেইখানে। ওপর থেকে তিন ইঞ্চি নীচুতে ছেড়া কি সম্ভব? কিন্তু এক্ষেত্রে হয়েছে তাই।

    তার কারণ ওই জায়গায় শুয়ো উঠে যাওয়ায় নিশ্চয় পলকা হয়ে গেছিল দড়িটা।

    ঠিক বলেছ। দেখতেই তো পাচ্ছ, হাতের প্রান্তটায় শুয়ো উঠে উঠে রয়েছে। মহা ধড়িবাজ লোক। ছুরি দিয়ে শুয়ো তুলে এই অবস্থা করে রেখে গেছে সে। কিন্তু অপর প্রান্তটা শুয়ো-ওঠা নয়। এখান থেকে তা দেখতে পাবে না। ম্যান্টলপিসের ওপর দাঁড়ালেই দেখবে ছুরি দিয়ে পরিষ্কারভাবে কাটা হয়েছে দড়িটাকে। শুয়োর কোনো চিহ্নই দেখতে পাবে না। আচ্ছা, এবার অনায়াসেই সমস্ত ঘটনাটিকে নতুন করে ঢেলে গড়ে নিতে পার তুমি। দড়ির দরকার হয়েছিল লোকটার। ছিঁড়ে নামানো সম্ভব নয়–ঘণ্টা বাজার শব্দে লোকজন সচকিত হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে কী করা উচিত তার? ম্যান্টলপিসের ওপর লাফিয়ে উঠেও দড়ির নাগাল পেল না সে। তখন হাঁটু ঠেস দিলে দেওয়ালের কাঠের ব্র্যাকেটের ওপর। ফলে, ছাপ পড়ল ধুলোর ওপর। ব্র্যাকেটটায় একবার চোখ বুলিয়ে এলেই দাগটা দেখতে পাবে তুমি। তারপর সে ছুরি বার করলে দড়িটা কাটার জন্যে। দেখতেই তো পেলে, কম করে ইঞ্চি তিনেকের জন্যে দড়িটার নাগাল পেলাম না আমি। সেই কারণেই বললাম, লোকটা আমার থেকে অন্ততপক্ষে তিন ইঞ্চি লম্বা। ওক কাঠের চেয়ারে বসবার জায়গাটা লক্ষ করেছ? কী দেখছ?

    রক্ত।

    নিঃসন্দেহে রক্ত এবং শুধু এই রক্তের দাগ দিয়েই আদালতে প্রমাণ করে দেওয়া যায় যে, ভদ্রমহিলা যা বলেছেন আমাদের সামনে, তা নিছক একটা বানানো গল্প ছাড়া আর কিছু নয়। ওঁর কথামতো খুনের সময়ে উনি যদি চেয়ারেই বসা থাকতেন, তাহলে রক্তের দাগ ও জায়গায় এল

    কী করে শুনি? না, না, আগে নয়–স্বামী মারা যাওয়ার পরেই চেয়ারে বসেছিলেন উনি। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, কালো পোশাকটা যদি পরীক্ষা করা যায়, তাহলে এই দাগের সঙ্গে মিলে যায় এমনি একটা রক্তের দাগ তাতে তুমি পাবে। ওয়াটসন, ওয়াটসন, ওয়াটারলুতে এখনও পৌঁছোতে পারিনি বটে, কিন্তু এই হল আমাদের মারেনগো৬, কেননা, পরাজয় দিয়ে শুরু করে বিজয় গৌরবের মধ্যে শেষ হল আমাদের তদন্ত-পর্ব। এবার দু-একটা কথা বলা দরকার থেরেসার সঙ্গে। যে-সংবাদের প্রয়োজন এখন, তা পেতে হলে আরও কিছুক্ষণ একটু হুঁশিয়ার হয়ে থাকতে হবে আমাদের।

    কঠোর মূর্তি অস্ট্রেলিয়ান নার্স থেরেসা মানুষ হিসেবে কিন্তু ভারি ইন্টারেস্টিং। স্বল্পভাষী, অনুদার সন্দিগ্ধমনা হলেও শেষ পর্যন্ত হোমসের মিষ্টি ব্যবহার আর কথাবার্তায় কাজ হল। বিনা প্রতিবাদে সরলভাবে সবই শুনে যাচ্ছিল হোমস। বেশ কিছুক্ষণ পর এহেন থেরেসার চিত্তও নরম হয়ে এল। হোমসের স্বভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন মধুর হয়ে উঠল তার আচরণ। ঠিক তখনই লোকান্তরিত অন্নদাতার বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ ছড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না সে।

    হ্যাঁ, স্যার, সত্যিই আমার দিকে ডিক্যান্টার ছুঁড়ে মেরেছিলেন উনি। লেডিকে একটা বিশ্রী গালি দিতেই তা আমার কানে যায়। আমি তখন বলেছিলাম ওর ভাই হাজির থাকলে এ-শব্দ উচ্চারণ করার ক্ষমতাও হত না তার। তাইতেই রাগে কাঁপতে কাঁপতে ডিক্যান্টারটা উনি ছুঁড়ে মারেন আমার দিকে। আরও ডজনখানেক ডিক্যান্টার হাতের কাছে হাজির থাকলে সবকটাই ছুঁড়তে দ্বিধা করতেন না উনি। বিয়ের শুরু থেকেই ভদ্রলোক অতি জঘন্য ব্যবহার করে আছেন লেডির সাথে। মেয়েটিরও স্বভাব এমন যে মরে গেলেও এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাইত না। এমনকী, আমার কাছেও সব কথা বলত না। আজ সকালেই ওর হাতে ওই দাগ দুটো দেখলেন, ও-সম্বন্ধেও আমায় কিছু বলেনি। কিন্তু আমি জানি ও-দাগ হয়েছে হ্যাট-পিনের খোঁচায়। শয়তান কুকুর কোথাকার। মরে গেছে লোকটা, তাই তাকে এভাবে গালাগাল দেওয়ার জন্যে ঈশ্বর ক্ষমা করুন আমায়। সারাদুনিয়ায় কিন্তু ওর মতো শয়তান আর দুটি দেখা গেছে কিনা সন্দেহ। আঠারো মাস আগে ওঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় আমাদের। তখন কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর ছিল ওঁর স্বভাব। চমৎকার মানুষ ছিলেন উনি। তারপর, এই আঠারো মাস যেন আঠারোটা দীর্ঘ বছরের মতোই মনে হয়েছে আমাদের কাছে। সবে লন্ডনে পৌঁছেছিল লেডি। হ্যাঁ, এই তার প্রথম সমুদ্রযাত্রা। বাড়ি থেকে আগে কখনো বেরোয়নি। খেতাব, টাকা আর লন্ডনের ভুয়ো আদবকায়দার চমক দেখিয়ে বেচারির চিত্ত জয় করে ফেললেন উনি। ভুল যদি সে করে থাকে তবে খেসারতও দিয়েছে। বড়ো বেশি দিয়েছে। কোনো স্ত্রীলোক এভাবে আর দিয়েছে কিনা জানি না। কোন মাসে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমাদের? এখানে পৌঁছোনোর ঠিক পরেই। জুন মাসে পৌঁছেছিলাম আমরা। দেখা হয়েছিল জুলাইয়ে। গত বছরের জানুয়ারিতে বিয়ে হয় ওদের। হ্যাঁ, হা শোকে এখন ড়ুবে আছে ও। আপনারা গেলে তবুও দেখা করবে নিশ্চয়। কিন্তু একটা কথা, ওকে বেশি প্রশ্ন করবেন না। রক্তমাংসের মানুষ তো! নির্যাতনও বড়ো কম যায়নি কাল রাত থেকে।

    কোচে আড় হয়ে শুয়ে ছিলেন লেডি ব্র্যাকেনস্টল। আগের থেকে বেশ সপ্রতিভ মনে হল তাঁকে। চোখ-মুখের ঔজ্জ্বল্য যেন অনেকটা ফিরে এসেছে। থেরেসা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঢুকেছিল। ভিনিগার আর জল দিয়ে আবার সে ধুইয়ে দিতে বসল লেডির কালশিটে পড়া ফুলোটা।

    আমরা ঘরে ঢুকতেই বলে উঠলেন, আশা করি, আবার জেরা করতে আসেননি?

    না। খুব নরম সরে উত্তর দিলে হোমস। আপনি যে পরিশ্রান্ত, তা আমি জানি, লেডি ব্র্যাকেনস্টল। তাই আপনাকে বিব্রত করার কোনো অভিপ্রায় নেই। আমি শুধু একটি জিনিস চাই এবং তা হল আপনি যাতে কোনো বিড়ম্বনায় না পড়েন। তাই, সব জটিলতার জট খুলে ধরে সমস্ত ঘটনাকে সরল করে তুলে ধরায় আমার এত আগ্রহ। আমাকে বন্ধু হিসেবে নিন। আমাকে বিশ্বাস করুন। পরিণামে হয়তো দেখবেন সত্যিই আপনার আস্থাভাজন হতে পেরেছি আমি।

    কী করতে বলেন আমাকে?

    যা সত্য, তাই বলুন।

    মি. হোমস!

    না, না লেডি ব্র্যাকেনস্টল, ওতে কোনো সুবিধে হবে না। আমার যৎসামান্য নামযশের কিছু কিছু হয়তো শুনে থাকবেন। এই সামান্য ক্ষমতার সবটুকু দিয়ে আমি প্রমাণ করে দেব, যে-কাহিনি আমাদের শুনিয়েছেন, তা আগাগোড়া বানানো।

    বিবর্ণ মুখে এবং ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে লেডি ব্র্যাকেনস্টল এবং থেরেসা দুজনেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন হোমসের পানে।

    তারপরই চেঁচিয়ে ওঠে থেরেসা, আপনার ধৃষ্টতা তো দেখছি কম নয়। আপনি কি বলতে চান, লেডি মিথ্যে বলেছে?

    চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল হোমস, কিছু বলার নেই আপনার?

    সবই তো বলেছি আপনাকে।

    আর একবার ভাবুন লেডি ব্র্যাকেনস্টল! অকপটে সমস্ত খুলে বললে ভালো হত না কি?

    মুহূর্তের দ্বিধার ছায়া দুলে ওঠে লেডির ছবির মতো সুন্দর মুখে। পরক্ষণেই তার চাইতেও এক গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় তা। মুখোশের মতোই স্থির হয়ে আসে মুখের প্রতিটি রেখা।

    যা জানি, সবই বলেছি আপনাকে।

    টুপি তুলে নিলে হোমস। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললে, আমি দুঃখিত। আর দ্বিতীয় শব্দটি উচ্চারণ–করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল বাড়ির বাইরে। পার্কে একটা পুকুর দেখেছিলাম। হোমস এই পুকুরটার দিকেই নিয়ে গেল আমায়। ওপরের জল জমে বরফ হয়ে গেছে। তবু একটিমাত্র ছিদ্র দেখলাম তার মাঝে। ঠিক যেন একটা রাজহাঁস ড়ুব দিয়েছে বরফের স্তর ভেদ করে। ছিদ্রটির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলে হোমস। তারপর গেল বাড়ির ফটকে। সেখানে দাঁড়িয়ে স্ট্যানলি হপকিনসের জন্যে ছোটো একটা চিরকুট লিখে বৃদ্ধ পাহারাদারকে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।

    চলতে চলতে বললে, অন্ধকারে ঢিল ছুড়লাম ওয়াটসন। লাগলেও লেগে যেতে পারে। কিন্তু বন্ধুবর হপকিনসের জন্যেও তো কিছু করা দরকার। বিশেষ করে দ্বিতীয়বার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর। এখনও কিন্তু ওকে আমি দলে টানতে রাজি নই। যা দেখলাম, যা শুনলাম, তা গোপন থাকুক আমাদের দুজনের মধ্যেই। আমার তো মনে হয়, এরপর আমাদের তৎপর হওয়া দরকার একটি বিশেষ যাত্রাপথের জাহাজ অফিসে। ওখানে একটু খোঁজখবর নেওয়া প্রয়োজন। যতদূর মনে হয়, অফিসটা পলমলের একদম শেষের দিকে। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া আর ইংলন্ডের মধ্যে আরও একটা লাইনে স্টিমার যাতায়াত করে। কিন্তু আপাতত অনেকখানি জায়গা জুড়ে আরম্ভ করা যাক অনুসন্ধান আর তদন্ত।

    হোমসের কার্ড ম্যানেজারের কাছে পৌঁছোনোমাত্র ডাক পড়ল। প্রয়োজনীয় খবর সংগ্রহ করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। ১৮৯৫ সালের জুন মাসে স্বদেশের বন্দরে পৌঁছেছে মাত্র একটি স্টিমার। জাহাজের নাম, রক অব দি জিব্রালটার–এ-কোম্পানির সবচেয়ে বড়ো আর সবচেয়ে ভালো জলপোত এইটাই। যাত্রীতালিকায় চোখ বুলোতেই পাওয়া গেল অ্যাডিলেডের মিস ফ্রেজার আর তার পরিচারিকার নাম। দুজনেই সাগর পাড়ি দিয়েছে রক অব দি জিব্রালটার-এ। জাহাজটা এখন অস্ট্রেলিয়ার পথে। সুয়েজ খালের দক্ষিণে কোথাও তাকে পাওয়া যেতে পারে। ১৮৯৫ সালে যে যে অফিসারেরা জাহাজে ছিলেন, এখনও তাঁরাই আছেন শুধু একজন ছাড়া। ফার্স্ট অফিসার মি. জ্যাক ক্রোকার এখন ক্যাপ্টেন হয়েছেন। দিন দুয়েকের মধ্যেই সাদাম্পটন থেকে তাদের নতুন জাহাজ বাস রক পাড়ি জমাবে সাগরের বুকে। এই জাহাজেরই চার্জ বুঝে নেবেন মি. ক্রোকার। উনি থাকেন সিডেনহ্যামে। কিন্তু ওইদিন সকালে তার আসার কথা আছে নির্দেশ বুঝে নেওয়ার জন্যে। দরকার মনে করলে আমরা অপেক্ষা করতে পারি তার জন্যে।

    না, তাঁর সঙ্গে দেখা করার কোনো অভিপ্রায় হোমসের নেই। তবে ভদ্রলোকের কাজের রেকর্ড আর চরিত্র সম্বন্ধে আরও বিশদ খবর পেলে বিলক্ষণ খুশি হবে সে।

    অতি চমৎকার তার কাজের রেকর্ড। যোগ্যতার দিক দিয়ে ক্যাপ্টেন ক্রোকারের ধারেকাছে আসার মতো অফিসার কোম্পানির অতগুলি জাহাজের মধ্যে একজনও নেই।

    আর চরিত্র? ডিউটিতে বহাল থাকার সময়ে ওঁর মতো বিশ্বস্ত কর্মচারী আর দুটি পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। কিন্তু জাহাজের ডেকের বাইরে গেলেই উনি অন্য পুরুষ। দূরন্ত দুর্বার বেপরোয়া। তখন একটুতেই মাথা গরম হয়ে যায়। অতি সহজেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। চকিতে লোপ পায় কাণ্ডজ্ঞান। কিন্তু এসব সত্ত্বেও উনি অনুগত এবং সৎ। অন্তরে মায়াদয়ার অভাব হয় না কখনো। সব খবরের সার-খবর এই তথ্যটি জোগাড় করে অ্যাডিলেড-সাদাম্পটন কোম্পানির অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল হোমস। একটা ভাড়াটে গাড়ি নিয়ে এল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সামনে। ভেতরে কিন্তু ঢুকল না! গাড়ির মধ্যেই বসে রইল তন্ময় হয়ে। কুঞ্চিত জ্ব যুগল আর ললাট রেখায় দেখলাম নিবিড় চিন্তার ছায়া। ওখান থেকে গাড়ি নিয়ে পৌঁছোল সে শেরিং ক্রস টেলিগ্রাফ অফিসের সামনে। কার নামে একটা খবর পাঠালে সেখান থেকে। সব শেষে, সোজা ফিরে এল বেকার স্ট্রিটের বাসায়।

    না হে ওয়াটসন, পারলাম না, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল হোমস। শমন একবার বেরিয়ে গেলে দুনিয়ার আর কারো ক্ষমতা থাকবে না ওকে বাঁচানোর। আমার এ-কর্মজীবনেই আমি দেখেছি, দু-একবার অপরাধী অপরাধ করে যত না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সত্যিকারের ক্ষতি করেছি ক্রিমিনালকে আবিষ্কার করে। কিন্তু এখন আমি সাবধান হয়ে গেছি। শিখেছি এসব পরিস্থিতিতে কীভাবে হুঁশিয়ার হয়ে চলতে হয়। বিবেককে ছলনার চাইতে বরং ইংলন্ডের আইনকানুনের সঙ্গেই লুকোচুরি খেলা যাক। চরম ব্যবস্থা নেওয়ার আগে আমাদের আরও কিছু জানা দরকার।

    সন্ধে হওয়ার আগেই এসে গেল ইনস্পেকটর স্ট্যানলি হপকিনস। কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, মোটেই সুবিধা করতে পারছে না বেচারি।

    মি. হোমস, আমার বিশ্বাস নিশ্চয় ভেলকি-টেলকি কিছু জানেন আপনি। মাঝে মাঝে সত্যিই আমি ভাবি, ভোজবাজির যেসব নমুনা দেখিয়ে আমাদের তাক লাগিয়ে দেন, তা কখনো মাটির মানুষের থাকতে পারে না। চোরাই রুপোর বাসন যে পুকুরের নীচে আছে তা, আপনি কী করে জানলেন বলুন তো।

    আমি জানতাম না।

    কিন্তু আপনিই তো আমায় লিখে পাঠালেন পুকুরের তলাটা পরীক্ষা করে দেখতে?

    পেয়েছ তাহলে?

    নিশ্চয়!

    তোমাকে সাহায্য করতে পেরেছি জেনে সত্যিই খুব খুশি হলাম।

    সাহায্য আর করলেন কোথায়! উলটে আরও জটিল করে তুললেন সমস্ত ব্যাপারটাকে। কী ধরনের চোর এরা? এত কাঠ খড় পুড়িয়ে রুপোর বাসন চুরি করার পর চোরাই মাল ফেলে যায় সবচেয়ে কাছের একটা পুকুরের জলে?

    বাস্তবিকই, বড়ো উৎকট কাণ্ড! দেখে শুনে এদের মাথা-পাগলের দল ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। রুপোগুলো যদি নেহাতই ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়ে থাকে এবং বাসনগুলো নেওয়ার কোনো দরকারই থাকে না লোকগুলোর, তাহলে স্বভাবতই চোরাই মাল ঝটপট পাচার করে ফেলে ঝাড়া হাত-পা হওয়ার জন্যেই উদবিগ্ন হয়ে ওঠা স্বাভাবিক তাদের পক্ষে।

    কিন্তু এ ধরনের ভাবনাই-বা আপনার মাথায় আসছে কেন, তাই তো বুঝলাম না?

    মনে হল, তাই বললাম। এমনটা হলেও তো হতে পারে। খোলা জানলা গলে বেরিয়ে আসার পরেই সামনে পড়ল পুকুরটা। বরফের মধ্যে ছোট্ট ছাদাটি লুব্ধ করে তুলল ওদের। এর চাইতে লুকোনোর ভালো জায়গা পাওয়া কি আর সম্ভব ছিল তখন?

    লুকোনোর জায়গা ঠিক বলছেন। সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে হপকিনস, ঠিক, ঠিক! এখন বুঝছি সব! ভোর হয়ে আসছিল, লোকজন বেরিয়ে পড়েছিল পথে! সে সময়ে অত বাসন-কোসন নিয়ে রাস্তায় বেরোনো মানেই লোকের চোখে পড়া। তাই, পুকুরের তলায় গচ্ছিত রেখে গেল ওদের চোরাই মাল। ইচ্ছে ছিল, পরে, সুযোগমতো সরিয়ে নিয়ে যাবে মালগুলো। এক্সেলেন্ট মি. হোমস। আপনার ওই ধোঁকা দেওয়ার থিয়োরির চাইতে আমার থিয়োরি কিন্তু অনেক ভালো।

    হ্যাঁ, বাস্তবিকই, প্রশংসা করার মতো থিয়োরি তোমার। আমার চিন্তাধারা যে একটু বক্সাছাড়া বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল, সে-বিষয়ে এখন আমি নিঃসন্দেহ কিন্তু যতই বিশৃঙ্খল হোক না কেন, ভেবেচিন্তেই যে রুপোগুলো আবিষ্কার করেছি, তা তুমিও অস্বীকার করতে পারবে না হপকিনস।

    তা সত্যি, স্যার। সবই তো আপনি করলেন। আমাকে কিন্তু হোঁচট খেতে হয়েছে।

    হোঁচট খেতে হয়েছে?

    হ্যাঁ, মি. হোমস। আজ সকালে পুরো র্যান্ডাল দলটা ধরা পড়েছে নিউইয়র্কে।

    সর্বনাশ। তাহলে তোমার থিয়োরিটাই যে বানচাল হয়ে গেল, হপকিনস। ওরাই যে কাল রাতে কেন্টে খুন করে গেছে, এ-ধারণা তবে নস্যাৎ হয়ে গেল।

    মারাত্মক, মি, হোমস, ওদের এই গ্রেপ্তার সংবাদ মারাত্মক আমার থিয়োরির পক্ষে। খবরটা পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আমার থিয়োরি। কিন্তু আশা ছাড়িনি। র্যান্ডালরা ছাড়াও তিনজনের দল তো আরও থাকতে পারে। অথবা পুলিশ নাম শোনেনি, এমন কোনো নতুন দলও হতে পারে এরা।

    ঠিক বলেছ। খুবই সম্ভব তাই। কিন্তু, একী, চললে নাকি?

    হ্যাঁ, মি. হোমস। এ-ব্যাপারের কিনারা না-করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। দেওয়ার মতো আর কোনো খোঁজখবর আছে নাকি আপনার?

    একটা তো দিয়েছি।

    কোনটা?

    ওই যে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা।

    কিন্তু কেন, মি. হোমস, কেন?

    হ্যাঁ, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। কিন্তু এ-সমস্যা তোমার ওপরেই ছেড়ে দিলাম এবারের মতো। মাথা ঘামিয়ে এই ধোঁয়ার আড়ালে একটা কিছু আবিষ্কার করে ফেলা নিশ্চয় কঠিন কাজ হবে।

    তোমার পক্ষে। ডিনারের জন্যে থেকে যাবে না? বেশ, গুডবাই। কাজ কীরকম চলছে জানাতে ভুলো না কিন্তু।

    ডিনার শেষ হল। টেবিলও পরিষ্কার হল। তারপর আবার এই প্রসঙ্গ নিয়ে শুরু করল হোমস। পাইপটা ধরিয়ে নিয়েছিল ও। চটি পরা পা দুটো এগিয়ে দিয়েছিল আগুনের চুল্লির দিকে। আগুনের মিষ্টি তাতের আমেজটুকু মনপ্রাণ দিয়ে আমিও উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকালে ও, ওয়াটসন, নতুন কিছুর আশা করছি আমি।

    কখন?

    এখুনি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই। কী ভাবছ? স্ট্যানলি হপকিনসের সঙ্গে বড়ো খারাপ ব্যবহার করলাম?

    তোমার বিচারবুদ্ধির ওপর আস্থা আছে আমার।

    খুবই সংগত উত্তর, ওয়াটসন। দেখ আমি যা জানি, তা বেসরকারি। আর ও যা জানে, তা সরকারি। ব্যক্তিগত ন্যায়বিচারের অধিকার আমার আছে, কিন্তু তার নেই। সে যা জানে, তার প্রতিটি অক্ষর প্রকাশ করতে সে বাধ্য, তা না হলে কর্মকর্তার কাছে সে বিশ্বাসঘাতক। এ ধরনের দ্বিধাযুক্ত ব্যাপারে তাকে আমি অযথা কষ্ট দিতে চাই না। তাই, কেসটা সম্পর্কে আমার নিজের মন পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমার তথ্য আমার কাছেই রেখে দিতে চাই।

    কিন্তু কতক্ষণ? কেসটা পরিষ্কার হবে কখন?

    সময় হয়ে গেছে। ছোটোখাটো কিন্তু আশ্চর্য একটা নাটকের দৃশ্যে এবার তোমায় হাজির থাকতে হবে ওয়াটসন।

    সিঁড়ির ওপর কীসের আওয়াজ শুনলাম। তারপরেই, দরজা খুলে ধরলেন মিসেস হাডসন এবং খোলা দরজার ভিতর দিয়ে যিনি ঢুকলেন, তাঁর মতো ব্যক্তিত্বময় নিখুঁত পৌরুষব্যঞ্জক মূর্তি এ-ঘরের চৌকাঠ আর কোনোদিন পেরোয়নি। ভদ্রলোকের চেহারা বেজায় লম্বা। বয়সে যুবক। সোনালি রঙের গোঁফ। নীল নীল চোখ। নিরক্ষীয় অঞ্চলের কড়া রোদে গায়ের রং তামাটে হয়ে। গেছে। হালকা পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, অতবড়ো দেহটা শুধু বলশালীই নয়, রীতিমতো ক্ষিপ্র। ঘরে ঢুকে প্রথমেই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন উনি। তারপর ফিরে দাঁড়ালেন আমাদের দিকে। মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত আর ঘন নিশ্বাসে উথালিপাথালি বুক দেখে মনে হল যে কোনো এক প্রবল আবেগ অভিভূত করে ফেলার চেষ্টা করছে ওঁকে। কিন্তু উনি তা দাবিয়ে রাখছেন প্রাণপণ শক্তিতে।

    বসুন, ক্যাপ্টেন ক্রোকার। আমার টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন?

    হাতলওয়ালা একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন ক্যাপ্টেন ক্রোকার। তারপর জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন আমাদের দুজনের পানে।

    টেলিগ্রাম পেয়েছি। যে সময়ে আসতে বলেছিলেন, সেই সময়তেই এসেছি। শুনলাম, অফিসেও গিয়েছিলেন আপনি। দেখছি, রেহাই নেই আপনার হাত থেকে। খারাপ খবর যদি কিছু থাকে, বলুন! আমি সব শুনছি। কী করতে চান আপনি আমায় নিয়ে? গ্রেপ্তার? বলুন, বলুন! চুপচাপ বসে আপনি যে আমার সঙ্গে ইঁদুর-বেড়ালের খেলা খেলবেন, তা আমি হতে দেব না।

    হোমস বললে, ওঁকে একটা সিগার দাও, ওয়াটসন। কামড়ে নিন, ক্যাপ্টেন ক্রোকার। নার্ভাস হয়ে যাবেন না। একটা কথা শুনে রাখুন আপনাকে যদি সাধারণ ক্রিমিনাল বলে ভাবতাম, তাহলে একসঙ্গে বসে কখনো ধূমপান করতাম না। খোলাখুলি কথা বলুন। আপনার ভালো করব। চালাকি করতে গেলেই শেষ করে ফেলব।

    কী করতে বলেন আমাকে?

    সত্যি বলতে বলি। গতরাতে অ্যাবি-গ্র্যাঞ্জ-এ যা যা ঘটেছে, তার অবিকল বিবরণ শোনাতে বলি। মনে রাখবেন, যা বলবেন, তা সত্য হওয়া চাই। একটা অক্ষরও নড়চড় হলে চলবে না। একটা শব্দও জুড়তে পারবেন না, বাদ দিতে পারবেন না। এ-ব্যাপারে আমি এত বেশি জেনে ফেলেছি যে, আপনি যদি সোজা পথ ছেড়ে এক ইঞ্চিও বেঁকে যান, তাহলেই জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাজাব এই পুলিশ হুইসল এবং চিরকালের মতো আমার আওতার বাইরে চলে যাবে এ-কেস।

    মুহূর্তের জন্যে চিন্তা করলেন ক্যাপ্টেন। তারপরে, রোদে পোড়া ভারী হাতে সশব্দে সজোরে পায়ের ওপর এক ঘুসি মেরে চেঁচিয়ে উঠলেন জোর গলায়, দেখা যাক কপাল ঠুকে। আশা করি, আপনার কথার দাম আছে। তার ওপরে, আপনি সাদা চামড়ার মানুষ। সমস্ত কাহিনিটা আপনাকে আমি বলছি। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলে রাখি, কথাটা আমার প্রসঙ্গে। নিজের সম্বন্ধে আমি বিন্দুমাত্র চিন্তা করি না, কারো পরোয়াও করি না। কৃতকর্মের জন্যে তিলমাত্র অনুশোচনা আমার নেই। যা করেছি, তার জন্যে আমি গর্বিত। সুযোগ পেলে আবার তা করতে মুহূর্তের জন্যেও কুণ্ঠাবোধ করব না। অভিসম্পাত দিন ওই জানোয়ারটাকে। বেড়ালের মতো মরেও যদি সে না মরে তবে প্রতিবার ওকে নিকেশ করতে পেছপা হব না। আমার কিন্তু যত ভাবনা লেডির জন্যে। মেরি মেরি ফ্রেজার। ওর ওই অভিশপ্ত নাম ধরে কোনোদিনই ওকে আমি ডাকতে পারব না। অথচ ওর ওই মিষ্টি মুখে একটুকরো হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্যে প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি। তাই যখনই ভাবি, কতকগুলো অবাঞ্ছিত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চলেছে ও বুক ভেঙে যায় আমার। মাথা ঠিক রাখতে পারি না। কিন্তু কিন্তু এ ছাড়া আর কীই-বা করার ছিল আমার? আগে আপনাদের শোনাই আমার কাহিনি। সব শোনার পর আপনারাই বলবেন, এর চাইতে নির্দোষ আর কিছু করণীয় আমার ছিল কি না।

    একটু পিছিয়ে যেতে হবে আমায়। আপনি তো সবই জানেন বলেই মনে হচ্ছে। ওর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা রক অব জিব্রালটারে। আশা করি, এ-খবরও রাখেন। সে-জাহাজে মেরি ছিল প্যাসেঞ্জার। আর আমি ফার্স্ট অফিসার। প্রথম আলাপেই ভালোবেসেছিলাম। সেই দিনটি থেকে আমার মনের আকাশ জুড়ে ওকে ছাড়া আর কোনো নারীকে আমি দেখিনি। ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে প্রতিদিন তাকে দেখেছি। যতবার দেখেছি, ততবারই যেন আরও গভীরভাবে ভালোবেসেছি। তার ফুল-কোমল চরণ ডেকের যে যে অংশ মাড়িয়ে যেত দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে ডিউটিতে থাকার সময়ে কতবার হাঁটু গেড়ে বসে চুম্বন করেছি ডেকের সেইসব বিশেষ অংশ। বিয়ের প্রসঙ্গ কোনোদিনই ওঠেনি। পুরুষ হিসেবে নারীর কাছ থেকে যেরকমটি মার্জিত ব্যবহার আশা করা যায়, তার কাছ থেকে তাই পেয়েছিলাম। এ-সম্পর্কে কোনো অভিযোগ নেই আমার। প্রেম ছিল শুধু আমার দিকেই। আর, তার দিকে ছিল শুধু নিকষিত নির্মল বন্ধুত্ব আর মধুর সাহচর্য। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর, আগের মতোই ও রইল স্বাধীন, বন্ধনহীন। আমি কিন্তু পারলাম না, পারলাম না মনের দিগন্তকে মুক্তির রঙে রাঙিয়ে নিতে।

    পরের বার সাগর থেকে ফিরে আসার পর পেলাম তার বিয়ের সংবাদ। মনের মতো মানুষকে বিয়ে করেছে সে। আর কেনই-বা করবে না? তার মতো মেয়েকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে উপাধি আর অর্থের চাইতে শ্রেষ্ঠতর বাহন আর আছে কি? যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মনোরম, তাদের জন্যেই তো ওর জন্ম। তাই ওর বিয়ের খবর শুনে অযথা কষ্ট দিলাম না মনকে। ও-রকম স্বার্থপর আমি নই। সৌভাগ্যের রুদ্ধ দুয়ার খুলে গেছে ওর জীবনে। তাই তো সে কপর্দকহীন নাবিকের জীবনে নিজেকে জড়িয়ে ভবিষ্যৎ নষ্ট করেনি। এইসব ভেবে আনন্দে ভরে উঠল আমার অন্তর। এমনিভাবেই ভালোবেসেছিলাম আমি মেরি ফ্রেজারকে।

    তার সঙ্গে যে আবার দেখা হবে, তা কিন্তু ভাবিনি। গতবার সাগর পাড়ি দেওয়ার পর পদোন্নতি হল আমার। নতুন জাহাজ তখনও পর্যন্ত না-পৌঁছোননায় সিডেনহ্যামে আমার আত্মীয় স্বজনের কাছে কয়েক মাসের জন্যে রইলাম আমি। একদিন একটা গলির মধ্যে দেখা হয়ে গেল মেরির বুড়ি পরিচারিকা থেরেসার সঙ্গে। সব কথাই বলল সে। মেরির কথা, তার স্বামীর কথা। কিছুই বাদ গেল না। সব শোনার পর আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম। মাতাল কুকুর কোথাকার! যে নারীর জুতোর ফিতে বাঁধার যোগ্যতা তার নেই, তারই গায়ে কিনা যখন-তখন সে হাত তোলে! আবার দেখা হল থেরেসার সঙ্গে। তারপর, দেখা করলাম স্বয়ং মেরির সাথে একবার নয়, পরপর দুবার। অবশ্য তারপর আর দেখা করতে চাইলে না মেরি। সেদিন নোটিশ পেলাম কোম্পানির, হপ্তাখানেকের মধ্যে আবার পাড়ি দিতে হবে সাগরের বুকে। নোটিশ পেয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম, যেনতেনপ্রকারেণ রওনা হওয়ার আগে তাকে অন্তত একবার দেখা দিয়ে যেতে হবে। প্রথম থেকেই থেরেসার সঙ্গে আমার সম্ভাব। মেরিকে ও ভালোবাসত। আর, আমার মতোই মনেপ্রাণে ঘৃণা করত ওই পিশাচটাকে। বাড়ির কোথায় কী আছে জেনেছিলাম ওরই মুখে। নীচের তলায় ছোট্ট ঘরটায় বসে পড়াশুনা করত মেরি। গতরাতে গুড়ি মেরে গিয়ে আঁচড় কাটলাম জানলায়। প্রথম তো জানলাই খুলতে চাইল না ও। কিন্তু আমি জানতাম, মুখে যাই বলুক না কেন, অন্তরে সে সত্যিই ভালোবাসতে শুরু করেছে আমায়। তাই, ওই তুষারঝরা রাতে আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফিসফিস করে আমাকে সামনের বড়ো জানলাটার নীচে আসতে বলল ও। জানলা খোলা পেয়ে ঢুকলাম খাওয়ার ঘরে। আবার ওর মুখে শুনলাম সেই কাহিনি। আবার ফুটে উঠল আমার রক্ত। যে-পশু আমার প্রিয়তমা নারীর সঙ্গে এতখানি দুর্ব্যবহার করে চলেছে, তার বিরুদ্ধে শাপশাপান্ত বর্ষণ করলাম প্রচুর। জানলার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম দুজনে–ঈশ্বর সাক্ষী আছেন, কোনোরকম অশোভন আচরণ আমরা করিনি। ঠিক এমনি সময়ে উন্মত্তের মতো তিরবেগে ঘরে ঢুকল ওর স্বামী। ঢুকেই এমন একটা কুৎসিত গালি দিলে মেরিকে, যা শুনলেও কানে আঙুল দিতে হয়। পরমুহূর্তেই হাতের লাঠিটা দিয়ে সজোরে এক ঘা বসিয়ে দিলে ওর মুখের ওপর। এক লাফে চুল্লির সামনে গিয়ে তুলে নিলাম চুল্লি খোঁচাবার লোহার ডান্ডাটা। শুরু হল দ্বন্দ্ব যুদ্ধ। হাতটা দেখুন, এইখানেই আমায় প্রথম চোট দেয় ও। তারপর এল আমার পালা। ডান্ডাটা মনে হল যেন পচা লাউয়ের মধ্যে বসে গেল। ভাবছেন বুঝি আমি দুঃখিত? না, মশাই, না! মরণ-বাঁচন যুদ্ধ তখন, দুজনের একজনকে মরতে হতই। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা কি জানেন, এ মরণ বাঁচন শুধু আমাদের দুজনের নয়। ওদের দুজনের বেলাও প্রযোজ্য। কেননা ওই উন্মাদ লোকটার খপ্পরে মেরিকে ফেলে আসা আমার পক্ষে তখন সম্ভব ছিল কি? তাই, ওকে খুন করেছি আমি। ভুল হয়েছে আমার? এ-রকম পরিস্থিতিতে আপনাদের দুজনের একজনও যদি থাকতেন তাহলে এ ছাড়া আর কী করতেন বলতে পারেন?

    ছড়ি দিয়ে মারার সময়ে আর্ত চিৎকার করে উঠেছিল মেরি, তাই শুনেই ওপরের ঘর থেকে বুড়ি থেরেসা নেমে এসেছিল। এক বোতল মদ ছিল সাইডবোর্ডে। বোতল খুলে একটু ঢেলে দিলাম মেরির ঠোঁটে। শক পেয়ে প্রায় আধমরা হয়ে গিয়েছিল বেচারি। নিজেও এক ঢোক খেলাম। থেরেসা কিন্তু আগাগোড়া বরফের মতো ঠান্ডা। প্লটটা শুধু আমার নয়, তারও বটে। ঠিক করলাম, এমনভাবে দৃশ্যটাকে সাজিয়ে রাখতে হবে যাতে দেখলে মনে হয় একদল চোরের কাজ। গল্পটা বার বার মেরিকে শোনাতে লাগল থেরেসা। ইতিমধ্যে, আমি ফায়ার প্লেসের ওপর উঠে দড়িটা কেটে নামিয়ে আনলাম। তারপর ওকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলে দড়ির কাটা দিকটায় শুয়ো বার করে দিলাম ছুরি দিয়ে। এ না-করলে ছুরি দিয়ে কাটা দড়ি দেখলেই টনক নড়বে পুলিশের। এত কসরত করে ওপরে উঠে দড়ি কেটে আনে, না-জানি সে কী ধরনের চোর। তারপর জড়ো করলাম কতকগুলো রুপোর বাসনপত্র। লোকে দেখলে যেন ভাবে নিছক চুরি করতেই এসেছিল খুনিরা। তারপর বেরিয়ে পড়লাম। যাওয়ার আগে নির্দেশ দিয়ে গেলাম মিনিট পনেরো বাদে যেন শোরগোল তোলে ওরা। ততক্ষণে নাগালের বাইরে চলে যাব আমি। রুপপার বাসনগুলো জলে ফেলে দিয়ে রওনা হলাম সিডেনহ্যামের দিকে। মনে আমার এতটুকু গ্লানি ছিল না। শুধু অনাবিল আনন্দ। জীবনের অন্তত একটা রাতকে সত্যিকারের সৎ কাজ দিয়ে ভরিয়ে তুলতে পেরেছি। মি. হোমস, সত্য শুনতে চেয়েছিলেন, সত্যই বললাম। এক বর্ণ মিথ্যে নেই, খাদ নেই, অতিরঞ্জন নেই। জানি না, এ-সত্যের মূল্য আমার গর্দান দিয়ে দিতে হবে কি না। কপালে যাই থাকুক, অকপটে সবই বললাম আপনাকে।

    কিছুক্ষণ নীরবে ধূমপান করল হোমস। তারপর উঠে দাঁড়াল। ঘরের এদিক থেকে ওদিকে গিয়ে করমর্দন করল ক্যাপ্টেন ক্রোকারের সাথে।

    বলল, এইরকমটাই ভেবেছিলাম আমি। জানি, আপনার কাহিনির প্রতিটি বর্ণ সত্য। কেননা, আমি যা জানি না, সে-রকম কথা আপনি বিশেষ কিছু বলেননি। ব্যায়ামবিদ বা নাবিক ছাড়া ব্র্যাকেটের ওপর উঠে ঘণ্টার দড়িতে যে-গিট দেখেছি, সে-গিটও নাবিক ছাড়া আর কারো পক্ষে রপ্ত করা সম্ভব নয়। জীবনে একবারই নাবিকদের সংস্পর্শে এসেছিলেন লেডি ব্র্যাকেনস্টল এবং তা সাগর পাড়ি দেওয়ার সময়ে। জীবনের যে-স্তরে উনি মানুষ, এই নাবিকটিও সেই স্তরের। খুনিকে আড়াল করার ওঁর প্রয়াস থেকেই জেনেছি এই তথ্যটি। আরও জেনেছি, তাঁকে উনি ভালোবাসেন। সঠিক সূত্র ধরে তদন্ত শুরু করতে পেরেছিলাম বলেই তো এত সহজে আপনার নাগাল পেয়েছি, ক্যাপ্টেন।

    আমি ভেবেছিলাম পুলিশ কোনোদিনই আমাদের ফাঁকি ধরে উঠতে পারবে না।

    এবং পারেনি। আমার যতদূর বিশ্বাস পারবেও না। ক্যাপ্টেন ক্রোকার, ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা বিষয় আপনার সামনেই স্বীকার করছি আমি। চরম আক্রমণের সম্মুখীন হলে যেকোনো পুরুষের পক্ষে যা করা স্বাভাবিক আপনিও তাই করছেন। নিজের জীবন বাঁচাতে গিয়ে আপনি যা করেছেন, তা যে আইনানুগ নয়, এমন রায়ও কেউ দেবে বলে মনে হয় না আমার। যাইহোক, এ নিয়ে মাথা ঘামাবে ব্রিটিশ জুরিরা। ইতিমধ্যে আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি, আপনার ওপর সহানুভূতি এতই গভীর যে আপনি যদি আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারেন, তাহলে আপনার পিছু ধাওয়া করবে না।

    আর তারপরেই সব প্রকাশ পাবে? নিশ্চয়।

    সবই প্রকাশ পাবে।

    রাগে রক্তিম হয়ে ওঠেন ক্যাপ্টেন, এ কী ধরনের প্রস্তাব? এ-প্রস্তাব কি কোনো পুরুষের কাছে করা চলে? আইন আমি যতটুকু জানি, তাতে অন্তত এইটুকু বুঝি যে, বিচার চলার সময়ে মেরিকেও দুষ্কর্মের সঙ্গিনী হিসেবে গণ্য করা হবে। আপনি কি ভাবেন তাকে এই বিষম বিপদের মধ্যে একলা ফেলে রেখে আমি বেমালুম গা ঢাকা দিয়ে মজা দেখব আড়াল থেকে? ওরা যা করতে চায়, আমাকে নিয়ে করুক। কিন্তু ঈশ্বরের দোহাই, মি. হোমস এমন একটা উপায় বাতলান যাতে বেচারি মেরিকে আদালতের জাঁতাকলে না পড়তে হয়।

    দ্বিতীয়বার ক্যাপ্টেনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল হোমস।

    যাচাই করে দেখছিলাম আপনাকে, ক্যাপ্টেন ক্রোকার। প্রতিবারেই দেখছি, আপনি নিখাদ সোনা। যাক, এ বড়ো গুরুদায়িত্ব নিতে হচ্ছে আমায়। কিন্তু হপকিনসকে একটা চমৎকার ইঙ্গিত দিয়েছি। সে যদি তার যথাযথ ব্যবহার না করতে পারে, আমার কিছু করার নেই। ক্যাপ্টেন ক্রোকার, যা করতে চাই তা আইনমাফিক হোক। আপনি আসামি। ওয়াটসন, তুমি ব্রিটিশ জুরি। ব্রিটিশ জুরি হওয়ার মতো তোমার চাইতে যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষের সঙ্গে এর আগে দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না আমার। আমি বিচারপতি। এবার শুরু হোক। জুরি মহোদয়গণ, এজাহার আপনারা শুনলেন। আসামি দোষী না নির্দোষ?

    নির্দোষ, মাই লর্ড, বললাম আমি।

    জনগণের ইচ্ছাই ঈশ্বরের বাণী। ক্যাপ্টেন ক্রোকার, আপনি মুক্ত। আইনের কবলে আর কোনো নিরপরাধ না-পড়া পর্যন্ত আমার কাছে আপনি নিরাপদ। বছরখানেকের মধ্যেই ফিরে আসুন লেডির কাছে। আজকের রাতে ন্যায়বিচারের পর যে রায় আমরা দিলাম, তার মর্যাদা প্রমাণ করুন আপনার এবং তাঁর মিলিত ভবিষ্যতের মধ্য দিয়ে।

    ——–

    টীকা

    তিন গেলাসের রহস্য : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দি অ্যাবি এ্যাঞ্জ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সংখ্যার স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে এবং ৩১ ডিসেম্বর ১৯০৪-এর কলিয়ার্স উইকলি পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।

    অ্যাবি এ্যাঞ্জ, মার্শহ্যাম : চিল্লহাস্ট-এর কাছাকাছি অ্যাবি উড নামে একটি ছোটো গ্রাম আছে। এর দূরত্ব লন্ডন থেকে কমবেশি এগারো মাইল। আবার নরফোকে আছে মার্শহাম নামের একটি গ্রাম।

    লিখব মাই ডিয়ার ওয়াটসন, লিখব : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ব্ল্যাশড সোলজার এবং দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য লায়ন্স মেন–এই দুটি গল্প লিখেছিলেন শার্লক হোমস নিজে। কিন্তু দু-বারই তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে তার লিখনশৈলি ওয়াটসনের লেখার মতো জনপ্রিয় নাও হতে পারে।

    বিয়ের বাঁধনে বাঁধা থাকতে হয় : ১৮৫৭ সালে ডিভোের্স অ্যান্ড ম্যাট্রিমনিয়াল কজেস অ্যাক্ট পাশ হলেও, হোমসের সমকালে আধুনিক যুগের মতো সহজে ডিভোর্স পাওয়া সম্ভব ছিল না।

    যে সর পড়ে : পোর্ট বা ওই ধরনের মদ পুরোনো হলে তাতে একটা সর পড়ে। যারা পোর্ট বা তদনুরূপ মদ পছন্দ করেন তারা বোতল ঝাঁকিয়ে বা উলটো করে ধরে সরটিকে ভাঙতে চান না। তবে অ্যাবি গ্যাঞ্জের খাওয়ার ঘরে রাখা বোতলটিতে কী-জাতের মদ ছিল, ওয়াটসন তা জানাননি।

    মারেনগো : ওয়াটারলুর যুদ্ধ ফরাসি জেনারেল নেপোলিয়ন বোনাপার্টের শেষ যুদ্ধ। ইংরেজ বাহিনির সঙ্গে ফরাসিদের এই যুদ্ধে ইংলন্ডের সেনাপতি ছিলেন লর্ড নেলসন। মারেনগোর যুদ্ধে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন অস্ট্রিয়ান জেনারেল মাইকেল ফ্রিডরিশ ভন মেলাস। উত্তর ইতালির পিয়েডমন্টের কাছে অবস্থিত মারেনগো গ্রামের এই যুদ্ধে প্রথম চোটে ফরাসিদের হটিয়ে দিতে পেরেছিলেন মেলাস। কিন্তু তারপর তিনি নিজের বাহিনীর ভার এক অধস্তন অফিসারের হাতে দিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে এগিয়ে যান। সেই সময়ে ফরাসি বাহিনী জেনারেল লুই দিশে-র অধিনায়কত্বে প্রতিআক্রমণ করলে অস্ট্রিয়ান সৈন্যদল পর্যদস্ত হয়ে যায়। মারেনগোর যুদ্ধে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও, নেপোলিয়ন এটিকে একটি স্মরণীয় যুদ্ধ জয় হিসেবে চিহ্নিত করেন। জনগণের ইচ্ছাই ঈশ্বরের বাণী : The vo।ce of the people ।s the vo।ce of the God, বলেছিলেন দ্বাদশ শতকের উইলিয়াম অব ম্যাসবেরি।

    ন্যায়বিচার : ১৮৯৭-এর ঘটনা ১৯০৪-এ প্রকাশ করলেন ওয়াটসন। তখনও কিন্তু ক্রকার, লেডি ব্র্যাকেনস্টল এবং থেরেসা প্রত্যেকেই স্যার অস্টেসকে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার হতে পারত। শুধু তাই নয়, দোষী সাব্যস্ত হতে পারতেন শার্লক হোমস-ও, ঘটনার পর খুনিকে পালাতে সাহায্য করবার জন্য।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ – আরিফ আজাদ
    Next Article শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }