Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প1414 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    উইসটেরিয়া লজের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি

    [ দি অ্যাডভেঞ্চার অফ উইসটেরিয়া লজ ]

    ১. কিম্ভুতকিমাকার অভিজ্ঞতা

    ১৮৯২ সালের মার্চ মাস। দিনটা বড়ো বিষণ্ণ, ঝোড়ো বাতাস বইছে একনাগাড়ে। লাঞ্চ খেতে বসে হোমস একটা টেলিগ্রাম পেয়ে তৎক্ষণাৎ তার জবাবও লিখে দিয়েছে। তারপর এ নিয়ে আর কথা বলেনি বটে, তবে আগুনের চুল্লির ধারে দাঁড়িয়ে পাইপ টানতে টানতে এক মনে তা নিয়ে ভাবছে আর মাঝে মাঝে টেলিগ্রামের বয়ানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। এক সময়ে সে আচমকা ফিরে দাঁড়াল আমার দিকে। দেখলাম, দুষ্টুমি নাচছে তার দুই চোখে। বলল, ওয়াটসন, হাজার হলেও তুমি একজন সাহিত্যিক। কিম্ভুতকিমাকার শব্দটার সংজ্ঞা কী বলতে পার?

    অদ্ভুত। আশ্চর্য–বললাম আমি।

    সংজ্ঞাটা পছন্দ হল না হোমসের। মাথা নেড়ে বললে, তার চাইতেও বেশি। এ-শব্দের পেছনে ছায়ার মতো যেন লেগে আছে অতি ভয়ংকর বিয়োগান্তক কিছু একটা ব্যাপার। অপরাধীর ক্ষেত্রে এই কিম্ভুতকিমাকার শব্দটা যে কতখানি গভীর তোমার লেখা আমার আগেকার কাহিনিগুলোর মধ্যে তার প্রমাণ পাবে। লালচুলো লোকদের ঘটনাটা মনে করে দেখ। প্রথম দিকে তা কিম্ভুতকিমাকার ঠেকলেও শেষের দিকে দেখা গেল বেপরোয়া ডাকাতির কেস। পাঁচটা কমলাবিচির সেই অত্যন্ত কিম্ভুতকিমাকার কেসটার কথাই ধরো না কেন। কেস শেষ হল খুনের ষড়যন্ত্রে। কিম্ভুতকিমাকার শব্দটা শুনলেই তাই সজাগ হই।

    টেলিগ্রামে শব্দটা আছে বুঝি? শুধোই আমি।

    হোমস তখন পড়ে শোনাল টেলিগ্রামটা : এইমাত্র একটা অবিশ্বাস্য আর কিম্ভুতকিমাকার অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। আপনার পরামর্শ পাব কি?–স্কট ইক্লিস, পোস্ট অফিস, শেরিং ক্রস।

    পুরুষ না মহিলা?

    পুরুষ তো বটেই। মহিলারা কখনো রিপ্লাই-পেড টেলিগ্রাম পাঠায় না, সশরীরে হাজির হয়।

    দেখা করবে তো?

    ভায়া ওয়াটসন, তুমি তো জান কর্নেল ক্যারুথার্সকে খাঁচায় পোরার পর থেকে কীরকম একঘেয়ে ভাবে দিন কাটছে আমার। আমার এই মনটা হল ছুটন্ত ইঞ্জিন, যে-কাজের জন্যে সৃষ্টি সে-কাজের মধ্যে না-থাকলে নিজের মনেই ছুটতে ছুটতে ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়। জীবন বড়ো মামুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে, খবরের কাগজগুলোয় অপরাধ-জীবাণুর চিহ্নমাত্র নেই, হঠাৎ বড়ো বিশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। অপরাধ দুনিয়া থেকে রোমান্স আর ঔদ্ধত্য যেন হঠাৎ চিরবিদায় নিয়েছে। কাজেই যত তুচ্ছ হোক না কেন, কোনো মামলাই পায়ে ঠেলতে এখন রাজি নই। হুম, মক্কেল ভদ্রলোক এসে গেলেন মনে হচ্ছে।

    সিঁড়ির ওপর হিসেবি পায়ের আওয়াজ শুনলাম। তারপরেই হৃষ্টপুষ্ট দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি ঘরে ঢুকলেন। গালপাট্টায় পাক ধরেছে, চেহারার মধ্যে অভিজ্ঞতা মাখানো। ভারী মুখ আর জাঁকালো আচরণের মধ্যেই ফুটে উঠেছে জীবনের ইতিহাস। গোড়ালি ঢাকা কাপড় থেকে আরম্ভ করে সোনার চশমা পর্যন্ত সর্বত্র লেখা একই কাহিনি : ভদ্রলোক সনাতনী, গির্জেভক্ত, সংরক্ষণশীল, গোঁড়া এবং আদর্শ নাগরিক। কিন্তু আশ্চর্য কোনো অভিজ্ঞতার আক্রমণে বেশ বিপর্যস্ত। মনের ওপর দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। চুল খাড়া, মুখ লাল, সাধারণ হাবভাব উত্তেজিত। ঘরে ঢুকেই ঝটপট শুরু করে দিলেন কাজের কথাবার্তা। রাগে ফুলতে ফুলতে বললেন, মি. হোমস, জীবনে এ-রকম পরিস্থিতিতে পড়িনি। অভিজ্ঞতাটা যেমন অস্বস্তিকর, তেমনি আশ্চর্য। অত্যন্ত অন্যায়, অত্যন্ত যাচ্ছেতাই। এ কী উৎপাত বলুন তো। আমি এর মানে জানতে চাই।

    স্নিগ্ধকণ্ঠে হোমস বললে, মশাই, আগে বসুন। তারপর বলুন প্রথমেই আমাকে স্মরণ করলেন কেন?

    আরে মশাই, এ-কেস পুলিশের আওতায় আসে বলে মনে হয় না আমার। সব ঘটনা শুনলে আপনিও বুঝবেন। এমনিও ফেলে রাখা যায় না, কিছু একটা করা দরকার। যদিও প্রাইভেট ডিটেকটিভদের ওপর বিন্দুমাত্র সহানুভূতি আমার নেই, কিন্তু আপনার নাম শোনবার পর…

    বেশ, বেশ। এবার বলুন তো সঙ্গেসঙ্গে এলেন না কেন?

    কী বলতে চান?

    ঘড়ি দেখল হোমস। বলল, এখন সোয়া দুটো। একটা নাগাদ পাঠিয়েছিলেন টেলিগ্রাম। কিন্তু আপনার প্রসাধন আর পরিচ্ছদের অবস্থা দেখে একমাত্র অন্ধ ছাড়া প্রত্যেকেই বলবে, ঘুম ভাঙার পর থেকেই ঝাটে পড়েছেন আপনি।

    হাত দিয়ে অবিন্যস্ত চুল সমান করে নিয়ে না-কামানো গালে হাত বোলালেন ভদ্রলোক। তারপর বললেন, বলেছেন ঠিক, মি. হোমস। প্রসাধন-পারিপাট্য নিয়ে ভাববার মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না। আমি তখন ওইরকম একখানা বাড়ি থেকে বেরোতে পারলে বাঁচি। তারপর থেকে আপনার কাছে আসা পর্যন্ত ক্রমাগত দৌড়োচ্ছি নানান তত্ত্ব তল্লাশি নিয়ে। হাউস এজেন্টের কাছে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মি. গারসিয়াকে বাড়িভাড়া দেওয়াই আছে, উইসটেরিয়া লজের ব্যাপারে কোনোরকম লটঘট নেই।

    মি, স্কট ইক্লিস, আপনি দেখছি আমার বন্ধু ডক্টর ওয়াটসনের মতো উলটোভাবে গল্প শুরু করেন, শেষের কাহিনি আগে বলে দেন। বড়ো বাজে অভ্যেস। ভাবনাচিন্তাগুলো আগে মনে মনে সাজিয়ে নিন। তারপর পর পর যেভাবে যা-যা ঘটেছিল সব বলে যান। বলুন কেন চুল না-আঁচড়ে দাড়ি না-কামিয়ে, বুট আর ওয়েস্টকোটের বোম পর্যন্ত ঠিকমতো না-লাগিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড়ে এসেছেন আমার পরামর্শ আর সাহায্য নিতে।

    মক্কেল ভদ্রলোক হতাশ মুখভঙ্গি করে তাকালেন নিজের বিপর্যস্ত চেহারার দিকে। বললেন, কী করব বলুন, জীবনে এ-রকম ঝামেলায় পড়িনি। খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। গোড়া থেকে বলছি শুনুন। শোনবার পর বুঝবেন কেন এইভাবে আপনার সামনে–

    ভদ্রলোকের কথা শেষ হল না, বাইরে একটা হুড়মুড় আওয়াজ, মিসেস হাডসনের ঝটিতি দ্বার উন্মোচন এবং ঝড়ের মতো রঙ্গস্থলে গাঁট্টাগোট্টা দুই পুলিশ অফিসারের প্রবেশ। এদের একজনকে আমি চিনি–স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইনস্পেকটর গ্রেগসন। অত্যুৎসাহী, সাহসী কিন্তু বুদ্ধিমত্তার দৌড় সীমিত। শার্লক হোমসের সঙ্গে সঙ্গী অফিসারের পরিচয় করিয়ে দিল গ্রেগসন। সারে কন্সট্যাবুলাবির ইনস্পেকটর বেলেজ।

    তারপর বললে, মি. হোমস, শিকারের পিছু নিয়ে ছুটে এসেছি এখানে। অতঃপর তার ডালকুত্তা-চক্ষু নিবদ্ধ হল দর্শনার্থীর ওপর আপনার নাম মি. জন স্কট ইক্লিস, নিবাস লী-এর পপহ্যাম হাউসে, কেমন?

    অবশ্যই।

    সকাল থেকে আপনাকে ফলো করছি আমরা।

    টেলিগ্রামটা দেখে বুঝলেন যে, এখানে এসেছেন উনি? বললে হোমস।

    ঠিক ধরেছেন। শেরিং ক্রস পোস্ট অফিসে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম কার দরজা মাড়িয়েছেন। তারপর সোজা চলে এলাম।

    কিন্তু ফলো করছেন কেন? কী চান? দর্শনার্থীর প্রশ্ন।

    আপনার জবানবন্দি। উইসটেরিয়া লজ নিবাসী মি. অ্যালয়সিয়াস গারসিয়া কাল রাতে মারা গেছেন কীভাবে, সেই সম্পর্কে আপনার বক্তব্য শুনতে চাই।

    বিস্ফারিত চোখে সোজা হয়ে বসলেন মক্কেল ভদ্রলোক। বিস্মিত মখ থেকে তিরোহিত হল যাবতীয় বর্ণ। অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, মারা গেছেন? বলছেন কী? মারা গেছেন?

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, মারা গেছেন।

    কিন্তু কীভাবে? অ্যাক্সিডেন্ট নাকি?

    খুন হয়েছেন।

    ও গড! কী সাংঘাতিক! আপনি… আপনি কি তাহলে আমাকে সন্দেহ করছেন?

    নিহত ব্যক্তির পকেটে আপনার লেখা চিঠি পাওয়া গেছে। আপনি লিখেছিলেন, কাল রাতটা তার বাড়িতে থাকবেন।

    হ্যাঁ লিখেছিলাম।

    আচ্ছা! লিখেছিলেন তাহলে!

    ফস করে বেরিয়ে পড়ল পুলিশ নোটবই। এক সেকেন্ড, গ্রেগসন। বাধা দিল শার্লক হোমস, তুমি চাও সাদাসিধে একটা জবানবন্দি, কেমন?

    সেইসঙ্গে মি. স্কট ইক্লিসকে হুঁশিয়ারও করে দিতে চাই–জবানবন্দি তার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হতে পারে।

    তুমি ঘরে ঢোকার পূর্বমুহূর্তে সব কথাই বলতে যাচ্ছিলেন মি. ইক্লিস। ওয়াটসন, একটু ব্র্যান্ডি আর সোডা দাও ওঁকে। মি. ইক্লিস, এবার যা বলতে যাচ্ছিলেন। ঘরে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ঠিক যেভাবে শুরু করছিলেন, ওইভাবে চালিয়ে যান।

    কোঁত করে ব্র্যান্ডি-সোডা গিলে নিলেন দর্শনার্থী। রং ফিরে এল মুখে। সন্দিগ্ধ চোখে ইনস্পেকটরের নোটবইয়ের দিকে তাকিয়ে শুরু করলেন অসাধারণ জবানবন্দি।

    আমি বিয়ে করিনি। মিশুকে বলে এন্তার বন্ধুবান্ধব। এদের মধ্যে একটি ফ্যামিলির নাম মেলভিল। এককালে এদের ড্রিঙ্কসের কারবার ছিল, এখন রিটায়ার করেছে। থাকে কেনসিংটনের অ্যালবামারলে ম্যানসনে। কয়েক হপ্তা আগে এর বাড়িতেই টেবিলে আলাপ হল একজন ইয়ংম্যানের সঙ্গে, নাম তার গারসিয়া। শুনলাম, জন্মসূত্রে সে স্পেনের মানুষ। দূতাবাসের সঙ্গেও কীরকম একটা যোগসূত্র আছে। চমৎকার ইংরেজি বলে, ব্যবহার বড়ো মধুর, দেখতেও বড়ো মিষ্টি। এমন অপূর্ব চেহারা জীবনে দেখিনি।

    বন্ধুত্ব নিবিড় হল ইয়ংম্যানের সঙ্গে। বেশ লাগত গারসিয়াকে। আমার লীয়ের বাড়িতে এল আলাপ যেদিন হল সেইদিনই। তারপর আমাকে নেমন্তন্ন করল ওর বাড়ি উইসটেরিয়া লজে দিন কয়েক কাটিয়ে আসার জন্যে। বাড়িটা এশার আর অক্সশটের মাঝামাঝি জায়গায়। গতকাল সন্ধ্যায় এশার গেলাম কথামতো।

    বাড়ির খবর আগেই শুনেছিলাম গারসিয়ার মুখে। দেশোয়ালি একটি চাকরের সঙ্গে থাকে গারসিয়া। খুব বিশ্বাসী লোক। গারসিয়ার যাবতীয় কাজকর্ম সে করে। ইংরিজিটা বলে ভালো, সংসার ঠেলে নিজের হাতে। এ ছাড়া আছে একজন পাঁচক–দেশে দেশে বেড়াতে গিয়ে পথে কুড়িয়ে পাওয়া বলতে পারেন–শিক্ষাদীক্ষা খুব একটা নেই, কিন্তু রাঁধে চমৎকার। কথার ফাঁকেই জেনেছিলাম এসব। গারসিয়া আরও বলেছিল, সারে-র বুকে অদ্ভুত এই গেরস্থালির মধ্যে থাকতে হয় তাকে। গেরস্থালিটা যা শুনেছিলাম তার চাইতে যে ঢের বেশি অদ্ভুত, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম পরে।

    এশারের মাইল দুয়েক দক্ষিণাঞ্চলে গাড়ি হাঁকিয়ে গেলাম আমি। মাঝারি সাইজের বাড়ি, রাস্তা থেকে বেশ ভেতরে, বাড়ির সামনের পথটার দু-পাশে উঁচু উঁচু চির সবুজ গাছের সারি। বেশ সেকেলে বাড়ি, জরাজীর্ণ অবস্থা, মেরামত হয়নি অনেকদিন। ঘাসছাওয়া পথ মাড়িয়ে ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়াল ছাতলা পড়া রোদ আর বৃষ্টিতে বিবর্ণ দরজার সামনে। গারসিয়া নিজে দরজা খুলে বেশ খাতির করে আমাকে নিয়ে গেল ভেতরে। মালপত্র বয়ে নিয়ে গেল চাকরটা। দেখলুম কীরকম যেন মিইয়ে পড়া বিমর্ষ চেহারা তার। গারসিয়া আগে দেখাল আমার শোবার ঘর। পুরো বাড়িটাই যেন বুকের ওপর চেপে বসে, মন যেন দমে যায়। খেতে বসে গারসিয়া সমানে বকে চললেও লক্ষ করলাম, কথার মধ্যে সংগতি নেই। ঝাঁপসা আবোল-তাবোল বকুনির মাথামুণ্ডু বুঝতে পারলাম না। এক নাগাড়ে টেবিলে আঙুলের টরে টক্কা বাদ্যি বাজিয়ে, কখনো নখ কামড়ে নানারকমভাবে গারসিয়া বুঝিয়ে দিলে, ভেতরে ভেতরে ও যেন দারুণ ঘাবড়ে গিয়েছে। খাবার-টাবারও খুব ভালো রান্না হয়নি, পরিবেশনের মধ্যেও খুঁত রয়েছে। বিষণ্ণ আর কাঠখোট্টা চাকরটা হাজির থাকায় খাওয়ার আনন্দটাও যেন মাঠে মারা গেল। বেশ কয়েকবার ভাবলাম, ছুতোনাতা করে সরে পড়ি, ফিরে যাই লীতে।

    আপনারা দুজনে যে-ব্যাপারে তদন্ত করতে নেমেছেন, একটা ঘটনা শুনলে সে-ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত ঘটতে পারে। তখন অবশ্য এ নিয়ে একদম ভাবিনি। খাওয়া যখন শেষ হতে চলেছে, একটা চিরকুট এনে দিলে চাকরটা। লক্ষ করলাম, চিরকুটটা পড়েই যেন আগের চাইতে উন্মনা আর বিচিত্র হয়ে গেল গারসিয়া। এতক্ষণ জোর করে কথা বলে অতিথি আপ্যায়নের চেষ্টা করছিল। চিরকুট পাওয়ার পর সে-চেষ্টাও আর করল না। একটার পর একটা সিগারেট টানতে টানতে গুম হয়ে বসে রইল। চিরকুটে কী লেখা আছে, সে-সম্পর্কেও কিছু বলল না। এগারোটা নাগাদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম শোবার ঘরে গিয়ে। কিছুক্ষণ পর দরজায় এসে দাঁড়াল গারসিয়া। ঘর তখন অন্ধকার। জিজ্ঞেস করল আমি ঘন্টা বাজিয়ে চাকরকে তলব করেছি কি না। করিনি বললাম। এত রাতে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইল গারসিয়া। ওর মুখেই জানলাম, রাত কম হয়নি প্রায় একটা। এর পরেই ঘুমিয়ে পড়লাম। এক ঘুমেই রাত কাবার।

    এবার আসছি আমার কাহিনির সবচেয়ে অদ্ভুত জায়গায়। ঘুম যখন ভাঙল, রোদ তখন বেশ চড়চড়ে। ঘড়ি দেখলাম, প্রায় ন-টা বাজে। বলে রেখেছিলাম, আটটায় যেন তুলে দেওয়া হয় আমাকে। ডাকেনি দেখে অবাক হলাম। ঘন্টা বাজিয়ে ডাকলাম চাকরকে। সাড়া পেলাম না। ঘণ্টা বিগডোয়নি তো? ধড়ফড় করে কোনোমতে জামাকাপড় পরে নিয়ে হুড়মুড় করে নীচে নেমে এলাম গরম জল চাইতে। কাকপক্ষীকেও দেখতে পেলাম না। হল ঘরে গিয়ে ডাকাডাকি করলাম। কেউ জবাব দিল না। ঘরে ঘরে দৌড়োলাম। সব ঘরই ফাঁকা। আগের রাতে গারসিয়া দেখিয়েছেন কোন ঘরে শোয়। সেই ঘরে গিয়ে পাল্লা খুলে ঢুকলাম ভেতরে। ঘর খালি, বিছানায় কেউ শোয়নি–চাদর নিভঁজ! চাকরবাকর সমেত গৃহস্বামীও সটকেছে বুঝলাম। একরাতেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে পরদেশি রাঁধুনি, বিদেশি চাকর এবং ভিনদেশি গৃহস্বামী! উইসটেরিয়া লজে এর পর আর কেউ থাকে।

    দু-হাত ঘষতে ঘষতে আপনমনে খুকখুক করে হাসতে হাসতে বিচিত্র কাহিনি শ্রবণ করল শার্লক হোমস। বলল, আপনার অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে তুলনাবিহীন। এবার বলুন, তারপর কী করলেন।

    রেগে টং হলাম। প্রথমে ভাবলাম, নিশ্চয়ই গাড়োয়ানি ইয়ার্কি করা হচ্ছে আমার সঙ্গে। ব্যাগে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লাম এশারের দিকে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো ল্যান্ড এজেন্ট অ্যালান ব্রাদার্সের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম, বাড়িটা তাদের কাছ থেকেই ভাড়া নেওয়া হয়েছে। তখন মনে হল এত কাণ্ড নিশ্চয়ই আমাকে বোকা বানানোর জন্যে করা হয়নি, আসলে ভাড়া না-দিয়ে পালিয়েছে গারসিয়া। মার্চের প্রায় শেষ, শেষ কয়েকটা দিনের ভাড়া তো মেরে দেওয়া গেল। কিন্তু সে গুড়েও বালি পড়ল, যখন শুনলাম, ভাড়া আগেই মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরে ফিরে এসে গেলাম স্পেনের দূতাবাসে। গারসিয়াকে কেউ চেনে না সেখানে। গেলাম মেলভিলের বাড়িতে। কিন্তু দেখলাম, আমার চাইতেও সে কম খবর রাখে গারসিয়া সম্পর্কে। সবশেষে আপনার কাছ থেকে টেলিগ্রামের জবাব পেয়ে সটান চলে এলাম এখানে পরামর্শ নেওয়ার জন্যে। কিন্তু এখন ইনস্পেকটরদের মুখে শুনছি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটেছে উইসটেরিয়া লজে। যা বললাম, তা সত্যি এ ছাড়া কোনো খবরই আমি রাখি না। কিন্তু পুলিশকে সবরকমভাবে সাহায্য করতে চাই।

    অমায়িক স্বরে ইনস্পেকটর গ্রেগসন বলল, মি. স্কট ইক্লিস, আপনি যা যা বললেন, তার সবই প্রায় ঘটনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। যেমন ধরুন, ওই চিরকুটখানা, খাবার টেবিলে যা হাজির করেছিল। তারপর কী গতি হয়েছিল চিরকুটটার লক্ষ করেছিলেন কি?

    দলা পাকিয়ে আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল গারসিয়া।

    মি. বেনেজ, কী মনে হয় আপনার?

    মি. বেনেজ মৃদুমন্দ হাসল। পকেট থেকে বার করল একটা দলাপাকানো বিবর্ণ কাগজ। ভদ্রলোকের মোটাসোটা লালচে ফুলো মুখের চামড়ার ভাঁজে ঢাকা অত্যুজ্জ্বল অসাধারণ চক্ষু সত্যিই নজর কাড়বার মতো। বলল, মি. হোমস, গারসিয়া একটু বেশি জোরে ছুঁড়েছিল চিরকুটটা, চুল্লি টপকে গিয়ে ওটা পড়েছিল পেছনে। না-পোড়া অবস্থায় কুড়িয়ে পেয়েছি আমি।

    মৃদু হেসে তারিফ জানাল হোমস। বলল, এ-রকম একটা কাগজ যখন খুঁজে পেয়েছেন, তখন কি ধরে নিতে পারি, পুরো বাড়িটাই খুঁজেছেন তন্নতন্ন করে।

    আমার কাজের ধারাই সে-রকম, মি. হোমস। মি. গ্রেগসন, পড়ব?

    ঘাড় নেড়ে সায় দিল লন্ডন ইনস্পেকটর।

    কাগজটা সাধারণ ক্ৰীম-লেড পেপার। জলছাপ নেই। একটা কাগজের চার ভাগের এক ভাগ। ছোটো ফলাওলা কঁচি দিয়ে কাটা কাগজ। তিন ভাজ করে লাল গালা দিয়ে সিলমোহর করে একটা চেপটা ডিমের মতো জিনিস দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চাপা হয়েছে। ঠিকানাটা উইসটেরিয়া লজের মি. গালিসার নামে। চিঠির বয়ান :–আমাদের নিজেদের রং সবুজ আর সাদা। সবুজ খোলা, সাদা বন্ধ। মূল সিঁড়ি, প্রথম বারান্দা, ডাইনে সপ্তম, সবুজ উলের আচ্ছাদন। তাড়াতাড়ি। ডি। হাতের লেখা মেয়েলি, সরু মুখ কলমে লেখা। কিন্তু ঠিকানাটা হয় অন্য কলমে, না হয় অন্য কারো হাতে লেখা। বেশ মোটা, বলিষ্ঠ লেখা।

    চিরকুটে চোখ বুলিয়ে হোমস বলল, সত্যিই আশ্চর্য চিঠি। খুঁটিয়ে দেখার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। মি. বেনেজ, ছোটোখাটো দু-একটা ব্যাপার এর সঙ্গে জুড়ে দিতে চাই। ডিশের মতো জিনিসটা হল শার্টের কাফলিংক, সিলমোহর করা হয়েছে তা-ই দিয়ে। কঁচিটা নখকাটা কঁচি। দু-বার কচি মারা হয়েছে প্রতিবার, দু-বারেই দেখুন একইভাবে বেঁকে বেঁকে পড়েছে কাঁচির ফলা।

    শুকনো হাসি হাসল বেনেজ। বলল, ভেবেছিলাম, সব খবর বার করতে পেরেছি। চিঠির বয়ান সম্বন্ধে কিন্তু এখনও যে তিমিরে, সেই তিমিরে। শুধু বুঝছি, এর মধ্যে একটা চক্রান্ত আর সব কিছুর মুলে একজন স্ত্রীলোক রয়েছে।

    নড়েচড়ে বসলেন মি. ইক্লিস। বললেন, মি. গারসিয়ার কী হল তা কিন্তু এখনও শুনলাম না।

    গ্রেগসন বললে, বাড়ি থেকে প্রায় একমাইল দূরে অক্সশট কমনে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। গারসিয়াকে। ভারী বালির বস্তা বা এ-জাতীয় কোনো জিনিস দিয়ে মেরে তার খুলি ভেঙে একেবারে পিণ্ডি চটকে দেওয়া হয়েছে। জায়গাটা নির্জন, সিকি মাইলের মধ্যে কোনো বাড়ি নেই। প্রথমে মাথায় মারা হয়েছিল পেছন থেকে। মারা যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ ধরে থেঁতো করা হয়েছে মাথাটা। বড়ো ভয়ংকর আক্রমণ। কারো পায়ের ছাপ বা আততায়ীদের কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।

    উদ্দেশ্যটা ডাকাতি নয় তো?

    ডাকাতির কোনো চেষ্টা দেখা যায়নি।

    কাঁপা গলায় মি. ইক্লিস বললেন, কিন্তু আমার সঙ্গে গারসিয়ার মৃত্যুর কী সম্পর্ক? কিছুই তো জানি না। এর মধ্যে আমাকে জড়াচ্ছেন কেন?

    খুব সহজ কারণে বলল ইনস্পেকটর বেনেজ, নিহত ব্যক্তির কী নাম এবং কোন বাড়িতে থাকে, তা জানা গেছে একটা খামে লেখা নাম-ঠিকানা থেকে। চিঠিখানা লিখেছিলেন আপনি, পাওয়া গেছে তাও পকেটে। ঠিকানা অনুযায়ী ন-টার পর উইসটেরিয়া লজে পৌঁছে আপনার টিকি দেখতে না-পেয়ে মি. গ্রেগসনকে টেলিগ্রাম করে দিলাম, যেন লন্ডনে আপনাকে খোঁজ করা হয়। তারপর খানাতল্লাশি শুরু করলাম উইসটেরিয়া লজে। শেষকালে এলাম শহরে। দেখা করলাম মি. গ্রেগসনের সঙ্গে এবং হাজির হলাম এখানে।

    গ্রেগসন উঠে দাঁড়িয়ে বললে, এবার কর্তব্য করা যাক। মি. ইক্লিস, আপনি থানায় গিয়ে এজাহার দেবেন চলুন।

    নিশ্চয়ই যাব। মি. হোমস, আপনি কিন্তু এর পেছনে লেগে থাকুন, রহস্য ফাঁস করুন। আপনাকে আমি ছাড়ছি না।

    হোমস বলল, আচ্ছা মি. বেনেজ, আপনার সঙ্গে আমি তদন্ত চালিয়ে গেলে আপত্তি করবেন তো?

    সম্মানিত বোধ করব।

    ঠিক কোন সময়ে গারসিয়া মারা গেছে জানতে পেরেছেন? কোনো সূত্র?

    রাত একটা থেকে ছিল ওখানে। বৃষ্টি হয়েছিল একটা নাগাদ। মারা গেছে বৃষ্টির আগে।

    কিন্তু তা অসম্ভব, মি. বেনেজ। সবিস্ময়ে বললেন মি. ইক্লিস, গারসিয়ার গলা আমি চিনি। দিব্যি গেলে বলতে পারি, ঠিক ওই সময়ে শোবার ঘরে মুখ বাড়িয়ে কথা বলে গেছে ও।

    খুবই আশ্চর্য ব্যাপার সন্দেহ নেই, কিন্তু অসম্ভব নয়। হাসতে হাসতে বললে হোমস।

    সূত্র হাতে এসেছে মনে হচ্ছে? শুধোয় গ্রেগসন।

    কেসটা চমকপ্রদ। কিন্তু মোটেই জটিল নয়। তবে সব তথ্য না-জানা পর্যন্ত মুখ খোলা সমীচীন হবে না। ভালো কথা, মি. বেনেজ, বাড়ি তল্লাশ করে এই চিরকুট ছাড়া আর কিছু পেয়েছেন?

    অদ্ভুত চোখে বন্ধুর পানে তাকায় সরকারি ডিটেকটিভ। তারপর বলে, তা পেয়েছি। আশ্চর্য কয়েকটা জিনিস চোখে পড়েছে। থানার কাজ শেষ করে আপনাকে নিয়ে গিয়ে চাক্ষুষ দেখাবখন।

    ঘন্টা বাজিয়ে মিসেস হাডসনকে ডেকে একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে বললে হোমস, রিপ্লাই-পেড় টেলিগ্রাম। দুই ইনস্পেকটরকে নিয়ে মি. ইক্লিস গেলেন থানায়।

    চুপ করে বসে আছি দুজনে। হোমস চিন্তানিবিষ্ট, ভুরু কুঁচকে নেমে এসেছে সূচীতীক্ষ্ণ দুই চোখের ওপর, মাথা ঝুঁকে পড়েছে সামনে, ধূমপান করছে অনর্গল।

    হঠাৎ আমার দিকে ফিরে হোমস বলল, ওয়াটসন, কী বুঝলে?

    কিস্‌সু না। স্কট ইক্লিস যা নিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছেন, আমার কাছে এখনও তা রহস্যাবৃত।

    কিন্তু খুনটা তো আর অস্পষ্ট নয়।

    নিহত ব্যক্তির লোকজন পালিয়েছে যখন, বুঝতে হবে, খুনের সঙ্গে তারাও জড়িয়ে পড়েছে, পালিয়েছে পুলিশের ভয়ে।

    কিন্তু ভায়া, মনিবকে খুন করার জন্যে যেকোনো একটা রাত নির্বাচন করলেই তো হত, বাড়িতে যেদিন অতিথি হাজির, ঠিক সেদিনই খুন না-করলে কি চলত না?

    তাহলে পালাল কেন?

    তাও তো বটে। পালাল কেন? এটা যেমন একটা বিরাট ঘটনা, ঠিক তেমনি আর একটা বিরাট ঘটনা হল মি. স্কট ইক্লিসের আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। এই দুই ঘটনার যোগসূত্র হিসেবে যদি বিচিত্র ওই চিরকুটকে ধরে নিতে পারি, তাহলে কিন্তু সমাধানে পৌঁছোতে বেশি দেরি নাও হতে পারে।

    বুঝলাম। কিন্তু তোমার আন্দাজি যোগসূত্রটা কী, তা বলবে তো?

    অর্ধনিমীলিত চোখে চেয়ারে হেলান দিল হোমস। বলল, ওয়াটসন, গাড়োয়ানি ইয়ার্কির সম্ভাবনা বাদ দিতে পার। জলজ্যান্ত একটা মানুষ খুন হয়েছে অত্যন্ত নৃশংসভাবে এবং উইসটেরিয়া লজে মি, স্কট ইক্লিসকে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে।

    কী সম্পর্ক?

    পাটে পাটে ভাঁজ খোলা যাক। প্রথমে দেখা যাচ্ছে, স্পেনের এই ছোকরা হঠাৎ দারুণ ভাব জমিয়ে ফেলল ইংলন্ডের এক জমাটি ভদ্রলোকের সঙ্গে। আলাপ জমানোর ব্যাপারে অগ্রণী হয়েছে গারসিয়া নিজে। যেদিন প্রথম পরিচয়, সেইদিনই লন্ডনের অপর প্রান্তে গিয়েছে ইক্লিসের বাড়িতে। দু-দিন যেতে-না-যেতেই নেমন্তন্ন করে নিয়ে গেছে নিজের বাড়িতে। কিন্তু কেন? কী এমন আকর্ষণ আছে মি. স্কট ইক্লিসের মধ্যে? ব্যক্তিত্ব? বুদ্ধিমত্তা? সে-রকম কিছুই তো নেই। তা সত্ত্বেও লন্ডন শহরের এত লোকের মধ্যে থেকে স্কট ইক্লিসকে পছন্দ করেছে গারসিয়া নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে। কী গুণ দেখে জান? মি. স্কট ইক্লিস হলেন একজন খাঁটি মানী ইংরেজ, যা শোনামাত্র বিশ্বাস করবে যেকোনো ইংরেজ। দেখলে না ভদ্রলোকের আশ্চর্য কাহিনি নিয়ে বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস প্রকাশ করল না দুই দুঁদে পুলিশ অফিসার?

    কিন্তু বাড়িতে নিয়ে গেল কেন? কী দেখাতে?

    যা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল, তা আর দেখানো হয়নি। সব ভণ্ডুল হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস তা-ই।

    অন্যত্ৰস্থিতি, মানে, অ্যালিবির সাক্ষী হিসেবে নিশ্চয়ই?

    আরে ভায়া ঠিক ধরে ফেললে দেখছি। তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি, উইসটেরিয়া লজের প্রত্যেকেই একই চক্রান্তের চক্রী। মি. ইক্লিস মনে করেছেন, এগারোটায় শুতে গেলেন। আসলে গেছেন তার অনেক আগে। চালাকি করে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে তাকে দেখানো হয়েছে এগারোটা। তারপর গারসিয়া গিয়ে অন্ধকারে তাকে বলেছে, রাত একটা বাজে। সে আসলে গেছে বারোটা নাগাদ। অর্থাৎ বারোটায় বেরিয়ে একটার মধ্যে ফিরে আসত গারসিয়া। কোর্টে গিয়ে হলফ করে বলতেন মি. ইক্লিস, গারসিয়ার কণ্ঠস্বর শুনেছেন তিনি একটা নাগাদ। সব্বাই তা বিশ্বাস করত।

    কিন্তু বাড়ির সবাই হাওয়া হয়ে গেল কেন?

    সব ঘটনা না-জানা পর্যন্ত ফট করে কিছু বলতে চাই না।

    চিরকুটের বয়ান সম্বন্ধে কী বলবে?

    কী ছিল চিঠিতে? আমাদের নিজেদের রং সবুজ আর সাদা। কথাগুলো রেসের কথা মনে করিয়ে দেয় না কি? সবুজ খোলা, সাদা বন্ধ। নিশ্চয়ই একটা সংকেত। মূল সিঁড়ি, প্রথম বারান্দা, ডাইনে সপ্তম, সবুজ উলের আচ্ছাদন। অর্থাৎ বিশেষ একটা কাজের দায়িত্ব। সব কিছুর মূলে শেষ পর্যন্ত দেখব হয়তো ঈর্ষাকাতর কোনো ব্যক্তিকে। খুবই বিপজ্জনক কাজের দায়িত্ব, নইলে তাড়াতাড়ি শব্দটা লিখত না। ডি হল সেই ব্যক্তি যে এই নিশানা দিচ্ছে।

    ডি নামে হয়তো ডলোরেস, স্পেনে খুব চালু নাম। লোকটাও তো স্প্যানিয়ার্ড।

    বলেছ ভালো, কিন্তু ভায়া মোটেই ঠিক নয়। কেননা একজন স্প্যানিয়ার্ড যখন আরেকজন

    স্প্যানিয়ার্ডকে চিঠি লেখে, স্পেনের ভাষাতেই লেখে, ইংরেজিতে লেখে না। চিঠি যে লিখেছে, নিঃসন্দেহে সে ইংরেজ। ধৈর্য ধরো বন্ধু, ইনস্পেকটর কী খবর আনেন দেখা যাক।

    ইনস্পেকটর এসে পৌঁছোনোর আগেই এল হোমসের টেলিগ্রামের জবাব। পড়বার পর নোটবইয়ে রাখতে গিয়ে আমার সাগ্রহ মুখচ্ছবি দেখে হেসে ফেলল হোমস, টোকা মেরে সেটা এগিয়ে দিল আমার দিকে।

    তুলে নিলাম তারবার্তা। দেখলাম, সারি সারি অনেকগুলো অভিজাত নাম আর ঠিকানা : লর্ড হ্যারিংবি, দ্য ডিঙ্গল, স্যার জর্জ ফলিয়ট, অক্সশট টাওয়ার্স, মি. হাইনিজ, জে পি, পার্ডে প্লেস, মি. জেমস বেকার উইলিয়ামস, ফোটন ওল্ড হল, মি. হেনডারসন, হাই গেবল; রেভারেন্ড জোসুয়া স্টোন, নেদার, নেদার ওয়াল স্লিং।

    হোমস বললে, তদন্তক্ষেত্র বেশ সংকীর্ণ হয়ে এল হে। আশা করি বেনেজ ওর সাজানো মন নিয়ে ঠিক এই প্ল্যান অনুসারে তদন্ত চালাচ্ছে।

    স্পষ্ট বুঝলাম না।

    ভায়া, চিরকুট পাঠিয়ে কোনো একটা কাজের জন্যে বা দেখা করার জন্যে ডেকে পাঠানো হয়েছিল, এটা তো বোঝা গেল। তা-ই যদি হয়, তাহলে গারসিয়াকে কোনো একটা বাড়ির মূল সিঁড়ি বেয়ে উঠে বারান্দা বেয়ে উঠে ডান দিকের সপ্তম দরজায় ঢুকতে হত। অর্থাৎ বাড়িখানা বেশ বড়ো, আর অক্সশট থেকে দু-এক মাইলের মধ্যে, কেননা ওইদিকেই হাঁটছিল গারসিয়া এবং তাকে অ্যালিবি রক্ষার্থে একঘণ্টা মানে একটার মধ্যে ফিরে আসতে হত উইসটেরিয়া লজে। অক্সশটের কাছাকাছি পেল্লায় বাড়ি সংখ্যায় খুব বেশি নেই আশা করে মি. ইক্লিস-বর্ণিত ল্যান্ড এজেন্টের শরণাপন্ন হলাম এবং ফিরতি টেলিগ্রামে পেলাম এই লিস্ট।

    ছটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম এশারের সারে গ্রামে। সঙ্গে ইনস্পেকটর বেনেজ। রাত কাটানোর সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়েই এসেছিলাম। সরাইখানায় সেসব রেখে বেজেকে নিয়ে রওনা হলাম উইসটেরিয়া লজ অভিমুখে। তখন বৃষ্টি পড়ছে, জোরে হাওয়া দিচ্ছে। মার্চের কনকনে ঠান্ডা রাতে চোখে-মুখে সূচীতীক্ষ্ণ বৃষ্টির ঝাঁপটা সইতে সইতে অগ্রসর হলাম এক বিয়োগান্তক পরিণতির দিকে।

     

    ২. সান পেদ্রোর শার্দুল

    মাইল দুয়েক হেঁটে পৌঁছোলাম স্লেট-রঙা আকাশের পটভূমিকায় পিচের মতো কালো একটা বিমর্ষ বাড়ির সামনে। কাঠের ফটক থেকে গাড়ি যাওয়ার রাস্তার দুপাশে চেস্টনাট গাছের সারি। দরজার বাঁ-দিকের একটা জানলা থেকে ম্যাড়মেড়ে আলো পড়ছে বাইরে।

    একজন কনস্টেবল মোতায়েন রেখেছি বাড়িতে। বলে বেনেজ শার্সির কাচে আঙুল ঠুকল ঠকঠক করে। কুয়াশায় ঝাঁপসা কাচের মধ্যে দিয়ে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম, ঠকঠক আওয়াজ শুনেই আর্ত চিৎকার করে চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল একজন কনস্টেবল। প্রায় সঙ্গেসঙ্গে খুলে গেল দরজা। ঠকঠক করে কাঁপছে লোকটা, মুখ সাদা হয়ে গিয়েছে বিষম ভয়ে, হাতের মোমবাতি পর্যন্ত স্থির নেই।

    তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে বেনেজ, ওয়াল্টার্স, ব্যাপার কী?

    রুমাল বার করে কপাল মুছল ওয়াল্টার্স। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললে, তা-ই বলুন আপনারা এসেছেন! উফ! আমার নার্ভ আর সইতে পারছিল না।

    তোমার শরীরে নার্ভ আছে জানা ছিল না তো?

    কীরকম খাঁ খাঁ করছে দেখেছেন বাড়িটা? তার ওপরে রান্নাঘরে ওইসব অদ্ভুত জিনিস। কোথাও কোনো শব্দ নেই। এমন সময়ে শার্সিতে ঠকঠক আওয়াজ শুনে ভাবলাম, ওই রে, আবার বুঝি এসেছে!

    কে এসেছে?

    পিশাচ! জানলায় এসে দাঁড়িয়েছিল।

    কখন?

    ঘণ্টাদুয়েক আগে। দিনের আলো তখন কমে এসেছে। চেয়ারে বসে বই পড়ছি। হঠাৎ চোখ তুললাম। কেন তুললাম তা বলতে পারব না। দেখলাম, নীচের শার্সিতে মুখ চেপে ধরে পিশাচ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সে কী মুখ স্যার! স্বপ্নে দেখলেও আঁতকে উঠব!

    ছিঃ ওয়াল্টার্স! তুমি না পুলিশ কনস্টেবল?

    জানি, স্যার, জানি। কিন্তু ভয়ে আমার ধাত ছেড়ে গিয়েছে। মুখটা স্যার কালো নয়, সাদাও নয়, দুনিয়ার কোনো রং দিয়েই যেন তৈরি নয়। কাদায় দুধ গুলে দিলে যা হয়, অনেকটা যেন সেইরকম। সাইজে আপনার মুখের দু-গুণ। দু-চোখ ভাটার মতো ঘুরছে। দু-পাটি দাঁত হিংস্র জানোয়ারের মতো ঝকঝকে, খিদের চোটে যেন টসটস করে লাল ঝরছে জিভ দিয়ে। স্যার, বিকট বীভৎস সেই মুখ দেখে আঙুল পর্যন্ত নাড়াতে পারি না আমি। চেয়ে ছিলাম ফ্যালফ্যাল করে। তারপর সাঁৎ করে মুখটা সরে যেতেই ঝড়ের মতো বেরিয়ে এলাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম। ঝোপ পর্যন্ত খুঁজলাম। কিন্তু কারো টিকি দেখলাম না। ভাগ্যি ভালো, বেটা পালিয়েছে।

    ওয়াল্টার্স, তোমার রেকর্ড ভালো বলেই তোমার নামের পাশে উঁাড়া দিলাম না। অন্য কেউ হলে ছাড়তাম না। লজ্জা করে না তোমার পিশাচ বলে ভয় পেয়ে একজনকে ধরতে না-পারার জন্যে ভাগ্য ভালো বলে আস্ফালন করছ। মিথ্যে ভয় পেয়েছ, না, সত্যিই কিছু দেখেছ?

    তার ফয়সালা এখুনি হয়ে যাবে। পকেট-লন্ঠন জ্বালিয়ে নিয়ে বললে হোমস। ঘাসের চাপড়ার ওপর জুতোর ছাপ দেখে বলল, বারো নম্বর জুতো দেখছি। দানব বললেই চলে লোকটাকে।

    কিন্তু সে গেল কোথায়?

    ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে রাস্তায় সটকান দিয়েছে মনে হচ্ছে।

    বেনেজ বললে, চুলোয় যাক সে, কাজের কথায় আসুন। মি. হোমস, বাড়ি দেখবেন চলুন।

    শোবার ঘর, বসবার ঘরে তন্নতন্ন করে সার্চ করা হয়েছে দেখলাম। এ-বাড়িতে যারা ছিল, সঙ্গে তারা খুব বেশি মালপত্র আনেনি। মার্ক্স অ্যান্ড কোং, হাই হলবর্ন মার্কামারা কতকগুলো জামাকাপড় দেখে টেলিগ্রাম করা হয়েছিল মার্ক্স অ্যান্ড কোং-কে। তারা বলেছে, খদ্দেরের হাঁড়ির খবর তারা রাখে না, তবে টাকাকড়ি পেতে বেগ পেতে হয়নি মোটেই। খানদুয়েক স্প্যানিশ বই, নভেল, কয়েকটা তামাক খাওয়ার পাইপ, একটা সেকেলে পিনফায়ার পিস্তল আর একটা গিটার–এইসব ফেলে পালিয়েছে বাড়ির লোকজন।

    এর মধ্যে কিছু নেই মি. হোমস। মোমবাতি হাতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে যেতে বললে বেনেজ, চলুন, এবার রান্নাঘরে যাওয়া যাক।

    রান্নাঘরটা বাড়ির একদম পেছন দিকে। কড়িকাঠ খুব উঁচু। বিমর্ষ চেহারা। এককোণে একরাশ খড়, পাঁচক মশাইয়ের শোবার জায়গা বোধ হয়। টেবিলে এঁটো বাসনের কাড়ি।

    বেনেজ বললে, এদিকে দেখুন, মি. হোমস।… কী বুঝছেন?

    মোমবাতি তুলে ধরে বাসনের আলমারির পেছনে একটা অত্যন্ত বিচিত্র বস্তু দেখাল বেনেজ। বস্তুটা শুকিয়ে কুঁচকে এমনভাবে গুটিয়ে গেছে যে আসলে কী তা বোঝা মুশকিল। কালচে চামড়ার মতো, অনেকটা বামন চেহারার কোনো মানুষের মতো। প্রথমে মনে হল, নিগ্রো শিশুকে মমি করে রাখা হয়েছে। তারপর মনে হল, পুরাকালের বিকৃত কোনো বাঁদর হলেও হতে পারে। শেষকালে হাল ছেড়ে দিলাম–জানোয়ার, না মানুষ, ধরতে পারলাম না। জিনিসটা দাঁড়িয়ে আছে খাড়াভাবে এবং শাঁখের একজোড়া মালা ঝুলছে কোমরের কাছে।

    পৈশাচিক সেই প্রতীকের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করে হোমস বললে, ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখছি! আর কিছু আছে?

    বাসন ধোয়ার চৌবাচ্চার কাছে মোমবাতি হাতে গেল বেনেজ। দেখলাম, একটা বিরাট সাদা পাখিকে নৃশংসভাবে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে রাখা হয়েছে, তার মধ্যে রাশি রাশি পালক ছড়িয়ে আছে, ছিন্ন মস্তকে লেগে আছে ঝুঁটি। ঝুঁটি দেখে হোমস বললে, সাদা মোরগ। খুবই ইন্টারেস্টিং, খুবই অদ্ভুত ব্যাপার।

    কিন্তু এর চাইতে নারকীয় বস্তুগুলো সবশেষে দেখানোর জন্যে এতক্ষণ চুপ করে ছিল বেনেজ। এবার চৌবাচ্চার তলা থেকে টেনে বার করল এক গামলা রক্ত। মাংস কাটার টেবিল থেকে আর একটা বারকোশ এনে দেখাল স্তুপাকার একরাশ পোড়া হাড়। বলল, কাউকে খুন করে পোড়ানো হয়েছিল, এ-ই সন্দেহ করে সমস্ত বাড়ি আমরা সার্চ করেছি। সকাল বেলা ডাক্তার এসে বলে গেলেন, হাড় আর রক্ত মানুষের নয়।

    খুশি হল হোমস। দু-হাত ঘষে বললে, ইনস্পেকটর, অভিনন্দন রইল খুঁটিয়ে তদন্ত করার জন্যে। আপনার ক্ষমতার উপর্যুক্ত সুযোগ অবশ্য এ-অঞ্চলে কম, তাই না?

    তা যা বলেছেন, মি. হোমস। পাড়াগাঁ তো, ভালো কেসের অভাবে উপোসে দিন কাটে। এ ধরনের সুযোগ নমাসে-ছমাসে এক-আধটা আসে। হাড় দেখে কী বুঝলেন?

    হয় ছাগলছানা, নয় মেষশাবক।

    সাদা মোরগ দেখে কী বুঝলেন?

    অদ্ভুত, মি. বেনেজ, সত্যিই বড়ো অদ্ভুত। অদ্বিতীয়ও বলতে পারেন।

    যা বলেছেন। অদ্ভুত কতকগুলো মানুষ ঘাঁটি গেড়েছিল এ-বাড়িতে। সৃষ্টিছাড়া তাদের চালচলন। তাদের একজন অক্কা পেয়েছে। কে মারল তাকে? সঙ্গীরা? তা-ই যদি হয়, তা পালিয়ে তারা পার পাবে না। সবকটা বন্দরে পুলিশ নজর রেখেছে। তবে কী জানেন মি. হোমস আমার নিজের মত একদম অন্য। একেবারে আলাদা।

    তার মানে, মনে মনে একটা থিয়োরি খাড়া করেছেন?

    তা করেছি। কাজও করব সেই থিয়োরি অনুসারে। একাই করব, আপনার সাহায্য নেব না। লোকে জানবে যা করেছি, নিজেই করেছি, আপনার সাহায্য নিইনি।

    অট্টহাসি হাসল হোমস। বললে, বেশ তো, তা-ই হবেখন। আপনি আপনার লাইনে চলুন, আমি চলি আমার লাইনে, তবে দরকার হলেই আমার তদন্ত-ফল গ্রহণ করতে পারেন। আপাতত এ-বাড়িতে আর কিছু দেখার আছে বলে মনে হয় না। বিদায়। কপাল খুলে যাক আপনার।

    অন্যের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে, আমি কিন্তু হোমসের চোখে-মুখে এমন কতকগুলো চাপা লক্ষণ দেখলাম, যা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ডালকুত্তার মতো গন্ধ পেয়েছে আমার শিকারি বন্ধুটি। অন্যের চোখে তা অদৃশ্য, কিন্তু আমি তো ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি। ওর চাপা উত্তেজনা, চালচলনের ক্ষিপ্রতা আর ঔজ্জ্বল্য দেখেই বুঝলাম, খেল শুরু হতে আর দেরি নেই। অভ্যেস মতো মুখে চাবি দিল হোমস। আমার অভ্যেসমতো আমিও চুপ করে গেলাম, অযথা প্রশ্ন করে সমস্যা-আবিষ্ট মস্তিষ্ককে উৎপীড়িত করলাম না। জানি তো, যথাসময়ে সবই জানব।

    সেই কারণেই নীরবে অপেক্ষা করে গেলাম। কিন্তু সে-অপেক্ষা যে এত লম্বা হবে, কে জানত। দিন এল দিন গেল, হোমস এক পা-ও আর এগিয়েছে বলে মনে হল না। একদিন শুধু শহরে কাটিয়ে এল। কথাচ্ছলে শুনলাম ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়েছিল। এ ছাড়া বাকি দিন হয় স্রেফ বেড়িয়ে, হয় গ্রামের লোকজনের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে কাটিয়ে দিল।

    গ্রামে থাকা যে কত ভালো, এ নিয়ে জ্ঞান দিত আমাকে। উদ্ভিদবিজ্ঞানের বই, টিনের বাক্স আর খন্তা হাতে গাছপালার নমুনা সংগ্রহ করার এই হল মোক্ষম সুযোগ–বলে রোজ সরঞ্জাম নিয়ে বেরোত বটে, কিন্তু সন্ধে নাগাদ যেসব নমুনা নিয়ে ফিরত, তা দেখলে কোনো উদ্ভিদবিজ্ঞানীরই উৎসাহ বোধ করার কথা নয়।

    পল্লি-ভ্রমণে বেরিয়ে প্রায়ই দেখা হত ইনস্পেকটর বেনেজের সঙ্গে। হাতের কেস নিয়ে কোনো কথা না-ভাঙলেও হাসিতে কেঁচকানো লালচে মুখ আর কুতকুতে চোখের ঝিকমিকে রোশনাই লক্ষ করে বুঝতাম, তার তদন্ত বিলক্ষণ সন্তোষজনক।

    দিন পাঁচেক পরে একদিন সকাল বেলা খবরের কাগজ খুলে দারুণ অবাক হয়ে গেলাম। বড়ো বড়ো হরফে ছাপা হয়েছে এই খবরটা :

    অক্সশট রহস্য সমাধান
    সন্দেহভাজন গুপ্তঘাতক গ্রেপ্তার

    শিরোনাম পড়ে শোনাতেই চেয়ার থেকে এমনভাবে ছিটকে গেল হোমস, যেন বিছে কামড়েছে।

    কী সর্বনাশ! হল কী! বেনেজ ধরে ফেলেছে খুনিকে।

    তা-ই তো মনে হচ্ছে। বলে পড়ে শোনালাম পুরো খবরটা :

    অক্সশট হত্যা সম্পর্কে একজনকে গ্রেপ্তার করার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গেসঙ্গে এশার এবং নিকটবর্তী অঞ্চলে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। স্মরণ থাকতে পারে, কিছুদিন আগে অক্সশট কমনে নৃশংসভাবে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায় উইসটেরিয়া লজ নিবাসী মি. গারসিয়াকে। সেই রাতেই তার চাকর এবং পাঁচক চম্পট দেওয়ায় সন্দেহ করা হয়, খুনের ব্যাপারে তারাও জড়িত এবং দুজনের কেউই ধোয়া তুলসী পাতাটি নয়। অনুমান করা হয়েছিল, নিহত ব্যক্তির বাড়িতে নিশ্চয়ই দামি জিনিস ছিল, তাকে খুন করা হয়েছে এই জিনিসের লোভেই। এই অনুমানের কোনো প্রমাণ অবশ্য আজও পাওয়া যায়নি। পলাতকদের গোপন বিবর অন্বেষণের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন ইনস্পেকটর বেনেজ। তারা যে পালিয়ে বেশিদূর যায়নি এবং আগে থেকেই ঠিক করে রাখা কোনো ঘাঁটিতে লুকিয়ে আছে–ইনস্পেকটর বেনেজ তা সমস্ত অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতেন। গোড়া থেকেই তিনি জানতেন, পলাতকরা ধরা পড়বেই। কেননা রান্না করার লোকটিকে জনাকয়েক ফেরিওয়ালা রান্নাঘরের শার্সি দিয়ে দেখে বলেছে লোকটাকে দেখতে নাকি অতি কদাকার, বিরাটকায় নিগ্রো-জাতীয় চেহারা। জাতে মুলাটো, অসাধারণ তার হলদেটে আকৃতি। লোকটার স্পর্ধা কম নয়। খুন করার পরেও একদিন রাত্রে এসেছিল উইসটেরিয়া লজে। কনস্টেবল ওয়াল্টার্স তার পিছু নেয়। ইনস্পেকটর বেনেজ আঁচ করেছিলেন, লোকটা একবার যখন এসেছে, তখন আবার ফিরে আসবেই। তাই বাড়ি থেকে পাহারা তুলে নিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে লোক মোতায়েন করেন। এই ফাঁদেই পড়ে লোকটা গতরাতে। দারুণ কামড়ে দেয় কনস্টেবল ডাউনিংকে। আশা করা যাচ্ছে, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কয়েদিকে হাজির করার পর অনেক ঘটনাই ফাঁস হয়ে যাবে।

    টুপি নিতে নিতে উত্তেজিতভাবে হোমস বললে, চলো চলো, এখুনি চলো। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই বেনেজকে ধরতে চাই।

    ছুটতে ছুটতে এলাম গাঁয়ের পথে। বেনেজ তখন সবে বেরিয়েছে বাড়ির বাইরে। আমাদের দেখেই হাতের খবরের কাগজটা নাড়তে নাড়তে বললে, কাগজ পড়েছেন মি. হোমস?

    পড়েছি, বেনেজ। বন্ধুভাবে হুঁশিয়ার করতে এলাম, যদি কিছু মনে না করেন।

    হুঁশিয়ার করবেন! আমাকে?

    আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি বেলাইনে চলেছেন। আর এগোবেন না, গাড্ডায় পড়বেন।

    আপনার অশেষ দয়া, মি. হোমস।

    আপনার ভালোর জন্যেই বলছি, বেনেজ।

    কেন জানি মনে হল, কথাটা শুনে বেনেজের কুতকুতে চোখে চাপা দুষ্টুমি ঝলকে উঠেই মিলিয়ে গেল। বলল, কিন্তু মি. হোমস, আমরা যে ঠিক করেছি, যে যার লাইন অনুসারে তদন্ত চালিয়ে যাব।

    তাহলে তাই হোক। আমাকে দোষ দেবেন না।

    না, না, সে কী কথা! আপনি তো আমার মঙ্গলই চান। তবে কী জানেন, প্রত্যেকের নিজস্ব কার্যপদ্ধতি আছে। আপনার পদ্ধতির সঙ্গে আমার পদ্ধতি মিলবে কেন?

    এ নিয়ে আর কথা না-বলাই ভালো।

    আমার সব খবরই আপনি পাবেন, মি. হোমস। লোকটা একটা আস্ত বর্বর। গায়ে গাড়িটানা ঘোড়ার মতন শক্তি, হিংস্রতায় পিশাচকেও হার মানায়। কবজায় আনার আগেই ডাউনিংয়ের বুড়ো আঙুলটা চিবিয়ে প্রায় ছিঁড়ে এনেছে বললেই চলে। মুখে ইংরেজি বুলি একদম ফোটে না, ঘোঁতঘোঁত করা ছাড়া কোনো আওয়াজই করে না।

    প্রমাণ পেয়েছেন, এই লোকই খুন করেছে তার মনিবকে?

    আমি তা বলিনি মি. হোমস, মোটেই তা বলিনি। আপনি চলবেন আপনার লাইনে আমি চলব আমার লাইনে, এ-ই হল গিয়ে আমাদের কাজের চুক্তি।

    দু-কাঁধ কঁকিয়ে চলে এল হোমস। আমাকে বললে, বেনেজকে ঠিক ধরতে পারছি না। লোকটা জেনেশুনে গাড্ডায় পড়তে চলেছে। ঠিক আছে, ও যখন চায় যে যার লাইনে তদন্ত চালাই, তা-ই হোক। কিন্তু বেনেজের কথাবার্তা যেন কেমনতরো… খটকা লাগছে।

    সরাইতে ফিরে এলাম। হোমস বললে, ওয়াটসন, বোসসা। পরিস্থিতিটা এবার তোমার সামনে মেলে ধরতে চাই। কারণ আজ রাতে তোমার সাহায্য আমার দরকার হবে। কেসটা ধাপে ধাপে কোন পরিণতির দিকে এগোচ্ছে, কান খাড়া করে শোনো। মাঝখান থেকে এই লোকটাকে গ্রেপ্তার করায় সব গুবলেট না হয়ে যায়! ডিনারের সময়ে টেবিলে যে চিরকুট এসে পৌঁছেছিল, শুরু করা যাক সেখান থেকে। সেই রাতেই মারা যায় গারসিয়া। গারসিয়ার চাকরবাকর খুন করেছে মনিবকে–বেনেজের এই ধারণা মন থেকে সরিয়ে রাখো। প্রমাণ একটাই : গারসিয়া নিজে স্কট ইক্লিসকে বাড়িতে ডেকে এনেছিল অ্যালিবি খাড়া করার জন্যে। অ্যালিবির জন্যে যখন এত কাণ্ড সে করেছে, বুঝতে হবে বেআইনি কাজে বেরিয়েছিল গারসিয়া, তাই এত আটঘাট বেঁধেছিল। তার এই ক্রিমিনাল অভিযানের ফল হল নিজেই খুন হয়ে যাওয়া। কে তাকে খুন করতে পারে? নিশ্চয়ই সে, যার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল অভিযানে সে বেরিয়েছিল। চাকরবাকরের অন্তর্ধান-রহস্য এবার বোঝা যাচ্ছে। ওরা দুজনেই গারসিয়ার নৈশ ষড়যন্ত্রের সাগরেদ। ঠিক হয়েছিল, গারসিয়া একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাম ফতে করে ফিরে এলে ইংরেজ ভদ্রলোকের এজাহার অনুযায়ী গারসিয়ার অ্যালিবি প্রমাণিত হয়ে যাবে এবং কেউ আর তাকে সন্দেহ করতে পারবে না। কিন্তু যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে না ফেরে, তাহলে বুঝতে হবে বিপজ্জনক অভিযানে সে নিজে খতম হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোনো জায়গায় গিয়ে এই দুজনে লুকিয়ে থাকবে এবং সময় আর সুযোগমতো গারসিয়ার অসমাপ্ত অভিযান সমাপ্ত করতে নিজেরাই আবার বেরোবে।

    দুর্বোধ্য জট একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে এল আমার মনের মধ্যে। প্রতিবারের মতো এবারেও। মনে হল, ভারি সোজা তো! ঠিক এইরকমটাই তো হওয়া উচিত ছিল! বললাম, কিন্তু রান্না করার লোকটা ফিরে এল কেন?

    হয়তো তাড়াহুড়ো করে চম্পট দেওয়ার সময়ে এমন একটা দামি জিনিস ফেলে গিয়েছিল, প্রাণ গেলেও যা কাছছাড়া করতে সে রাজি নয়।

    তারপর?

    খেতে বসে একটা চিরকুট পেল গারসিয়া। কে লিখল চিরকুট? নিশ্চয়ই তার আর একজন স্যাঙাত। কোখেকে লিখল? আগেই বলেছি তোমাকে, একটা বড়ো বাড়ির নিশানা দেওয়া হয়েছিল চিঠির মধ্যে। এ-অঞ্চলে বড়ো বাড়ি খুব বেশি নেই। উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করার অছিলায় কয়েকটা দিন তল্লাট চষে ফেললাম, বড়ো বড়ো বাড়িগুলোর নাড়িনক্ষত্র বার করে ফেললাম, বাসিন্দাদের খবর সংগ্রহ করলাম। হাইগেবল-এর সুবিখ্যাত সুপ্রাচীন জ্যাকারিয়ান প্রাসাদটাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সবচেয়ে বেশি। বাড়িটা অক্সশট থেকে মাইলখানেক দূরে, অকুস্থল থেকে আধ মাইলের মধ্যে। অন্যান্য প্রাসাদের মালিকরা কাঠখোট্টা ধরনের মান্যগণ্য ব্যক্তি, রোমান্সের ধার ধারেন না। কিন্তু হাইগেবলের মি. হেলডারসন সব দিক দিয়ে বড়ো বিচিত্র পুরুষ, বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চার তাকেই মানায়। তাই তাঁর বাড়ির এবং বাড়ির লোকজনের ওপর আমার দৃষ্টি সংহত করলাম!

    —ওয়াটসন, বাড়ির সব লোকই যেন কেমনতরো। আশ্চর্য, সৃষ্টিছাড়া। সবচাইতে আশ্চর্য হলেন, হেনডারসন স্বয়ং। অছিলা করে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেছি আমি। ভদ্রলোকের কালো কোটরে-ঢোকানো ভাবালু চোখ দেখে বুঝেছি, আমার আসল মতলব তিনি ধরে ফেলেছেন। বছর পঞ্চাশ বয়স ভদ্রলোকের, চটপটে, শক্তসমর্থ চেহারা। চুল লৌহ-ধূসর, জটার মতো বিশাল ভুরু, পা ফেলেন হরিণের মতো, হাঁটেন সম্রাটের মতো। কর্তৃত্ব তার চলনেবলনে। মুখের পরতে পরতে ভীষণ প্রকৃতি আর ইচ্ছাশক্তি যেন ঠিকরে যায় স্ফুলিঙ্গের মতো। ভদ্রলোক হয় বিদেশি, না হয় দীর্ঘকাল গরমের দেশে থেকেছেন। সেই কারণেই চেহারা অত হলদে, শুকনো কিন্তু চাবুকের মতো শক্ত৷ সেক্রেটারির নাম মি. লুকাস। ইনি যে বিদেশি তাতে সন্দেহ নেই। কথাবার্তা মিষ্টি বিষের মতো মধুক্ষরা, চালচলন বেড়ালের মতো চটপটে পিচ্ছিল, গায়ের রং চকলেটের মতো বাদামি। ওয়াটসন, তাহলেই দেখ, এ-রহস্যের দু-দিকে দু-দল বিদেশিকে দেখছি। একদল উইসটেরিয়া লজে, আর একদল হাইগেবলে। মাঝের ফাঁক বন্ধ হতে বিশেষ দেরি নেই আর।

    একটু থেমে হোমস ফের বলতে থাকে, বাড়ির মধ্যে এই দুই ব্যক্তিই কেন্দ্রমণি বলতে পার। কিন্তু এ দুজন ছাড়াও একজন আছে, এই মুহূর্তে যার গুরুত্ব আমাদের কাছে অনেক বেশি। হেনডারসন দুই মেয়ের বাবা। একজনের বয়স এগারো, আর একজনের তেরো। গভর্নেসের নাম মিস বার্নেট। জাতে ইংরেজ, বয়স বছর চল্লিশ। এ ছাড়াও একজন বিশ্বস্ত চাকর আছে। বাড়ির মধ্যে আসল ফ্যামিলি বলতে এদেরকেই বোঝায়, কেননা হেনডারসন দেশ বেড়াতে খুব ভালোবাসেন। কখনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকেন না এবং এই চারজনে একসঙ্গে টোটো করেন দেশ হতে দেশান্তরে। বছরখানেক বাইরে কাটিয়ে কয়েক হপ্তা হল হেনডারসন হাইগেবল ফিরেছেন। ভদ্রলোক সাংঘাতিক বড়োলোক, যেকোনো খেয়াল চরিতার্থ করার মতো টাকা তাঁর আছে। এ ছাড়া বাড়িতে আছে খাসচাকর, ঝি, দারোয়ান ইত্যাদি, যেকোনো সচ্ছল ইংরেজ পরিবারে যা থাকে। গাঁয়ের লোকের গুলতানি শুনে আর নিজের চোখে দেখে সংগ্রহ করলাম এত খবর। সবচেয়ে বেশি খবর পাওয়া যায় চাকরিতে বরখাস্ত ক্ষুব্ধ চাকরের মুখে। আমার কপাল ভালো, এমনি একটা চাকরের সন্ধান পেলাম। কপাল ভালো বললাম বটে, কিন্তু ঠিক এই ধরনের লোক খুঁজেছিলাম বলেই পেয়ে গেলাম। নইলে বরাত খুলত না কোনোদিনই। বেনেজ তো বড়াই করে গেল, ওর কাজের পদ্ধতি আলাদা। আমারও কাজের পদ্ধতি কারো সঙ্গে মেলে না। বিশেষ এই পদ্ধতি অনুসারেই খুঁজে-পেতে বার করলাম জন ওয়ার্নারকে–এককালে হাইগেবলে মালী ছিল। বাদশাহি মেজাজে রাগের মাথায় দুর দুর করে তাড়িয়ে দেন। হেনডারসন। ওয়ার্নার সেই থেকে মহাখাপ্পা হেনডারসনের ওপর। বাড়ির অন্যান্য চাকরবাকরের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। মেজাজি মনিবের ভয়ে তারা সকলেই একজোট হয়েছে। ওয়াটসন, এইভাবে হাইগেবল রহস্যের চাবিকাঠির সন্ধান আমি পেলাম।

    হোমস থামল। আমি কিছু বলতে যাবার আগেই বলে উঠল, ঘাবড়িয়ো না বন্ধু একে একে বলছি সব। বুঝলে ভায়া, অদ্ভুত লোক বটে এরা! স্পষ্ট কিছুই এখনও বুঝে উঠিনি, শুধু বুঝেছি, এদের চালচলন সবই যেন সৃষ্টিছাড়া। বাড়িটায় দুটো অংশ। এক অংশ থেকে আর এক অংশে যাওয়ার দরজা একটাই। একদিকে থাকে চাকরবাকর, আর একদিকে ফ্যামিলি। হেনডারসনের বিশ্বস্ত চাকর ছাড়া দুই অংশের মধ্যে যাতায়াত কেউ করে না। ফ্যামিলির খাবার সে-ই নিয়ে যায় অন্দরে। মেয়েদের নিয়ে গভর্নেস বাগান ছাড়া কোথাও বেরোয় না। হেনডারসন কখনো একা হাঁটেন না। ছায়ার মতো পেছনে লেগে থাকে কুটিল সেক্রেটারিটা, চাকরবাকরেরা বলে, হেনডারসন নাকি অষ্টপ্রহর ভয়ে জুজু হয়ে থাকেন। কীসের এত আতঙ্ক, তা কেউ জানে না। তবে ওয়ার্নারের বিশ্বাস, খোদ শয়তানের কাছে নিজের আত্মা বিকিয়ে দিয়েছেন পাজির পাঝাড়া এই হেনডারসন। যেকোনো দিন কেনা জিনিসের দখল নিতে আসতে পারে শয়তান, এই ভয়ে নাক সিটিয়ে থাকেন হেনডারসন। ভদ্রলোক কোন চুলো থেকে এসেছে, আদত পরিচয় কী, কেউ জানে না। মেজাজ এদের প্রত্যেকেরই সপ্তমে চড়ে আছে, অত্যন্ত গনগনে স্বভাব। হেনডারসন নিজে দু-একবার কুকুর মারা চাবুক দিয়ে চাকরবাকরদের এমন ঠেঙিয়েছিলেন যে ব্যাপারটা নির্ঘাত আদালত পর্যন্ত গড়াত। কিন্তু স্রেফ টাকার জোরে ক্ষতিপূরণ দিয়ে সবার মুখ চেপে দেন ভদ্রলোক। ওয়াটসন, এই খবরের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়। চিঠিটা এসেছে অদ্ভুত এই গেরস্থালি থেকে, গারসিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে চক্রান্ত মাফিক কিছু একটা করার জন্যে। লিখেছে কে? নিশ্চয় মিস বানেট-গভর্নেস। যুক্তিতর্ক করে দেখা যাচ্ছে, সে ছাড়া এ-চিঠি লেখার মতো মেয়ে বাড়িতে আর কেউ নেই। অনুমান হিসেবে এই ধারণা নিয়ে তদন্তে নামা যাক, দেখা যাক। ঘটনার স্রোতে কতক্ষণ তা খাড়া থাকে। ভালো কথা ওয়াটসন, গোড়ায় তোমায় যে বলেছিলাম, এ-কাহিনিতে ঈর্ষার ব্যাপার আছে, সেটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।না, সে-রকম কিছু এখানে নেই। যাক, যে-কথা বলছিলাম। মিস বানেট যদি চিঠি লিখে ডেকে এনে থাকে গারসিয়াকে, তাহলে বুঝতে হবে, চক্রান্তের অন্যতম চক্রী সে নিজেও। তা-ই যদি হয়, গারসিয়ার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার। পর বুকে প্রতিহিংসার জ্বালা নিয়ে নিশ্চয়ই সে সুযোগ পায়ে ঠেলবে না। তাই আমার প্রথম প্রচেষ্টাই হল মিস বার্নেটের সঙ্গে দেখা করা এবং কথা বলা। কিন্তু মিস বার্নেট যেন হাওয়ায় উবে গিয়েছে গারসিয়া নিধনের রাত থেকেই। বেঁচে আছে কি না, তাও বোঝা যাচ্ছে না। গারসিয়ার সঙ্গে হয়তো তাকেও যমালয়ে পাঠানো হয়েছে, অথবা কোথাও কয়েদ করে রাখা হয়েছে। কিছু কখনো জানা যায়নি। ওয়াটসন, আশ্চর্য এই ধাঁধার সমাধান আমাদের করতেই হবে। কোর্ট থেকে ওয়ারেন্ট বার করে মিস বানেটকে খুঁজতে যাওয়া মূখতা। ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বাস করবেন না জলজ্যান্ত একটা মহিলাকে স্রেফ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে এমন একটা খানদানি বাড়িতে, যে-বাড়িতে একটানা কিছুদিন কাউকে দেখতে না-পাওয়াটা অদ্ভুত হলেও অসম্ভব কিছু নয়। অথচ দেখ, সৃষ্টিছাড়া এই বাড়িতে এই মুহূর্তে হয়তো ভদ্রমহিলা ধুকছে, প্রাণটা তার যেতে বসেছে। তাই ওয়ার্নারকে নিয়ে আড়াল থেকে ফটক পাহারা দেওয়া ছাড়া কিছুই আমি করতে পারিনি। আইনের সাহায্য নিয়ে যদি কিছু নাও করতে পারি, নিজেরাই ঝুঁকি নেব ঠিক করেছি।

    কী করতে চাও?

    ভদ্রমহিলার ঘর আমি চিনি। বারবাড়ির ছাদ থেকে যাওয়া যাবে। আমি চাই আজ রাতে তুমি আর আমি দুজনে হানা দেব রহস্যের ঠিক খাসমহলে।

    শুনে মিইয়ে গেলাম। একে তো ওই অদ্ভুত বাড়ি, লোকজনের প্রকৃতি ভীষণ, খুনের ছায়া জড়িয়ে রয়েছে বাড়ির আনাচেকানাচে, অজানা বিপদ পদে পদে, তাতে করে রাতবিরেতে বেআইনিভাবে ওইরকম একখানা ভয়ংকর বাড়িতে চোরের মতো ঢুকতে হবে শুনে মনের মধ্যে খুব একটা উৎসাহ পেলাম না। তারপর বিচার করে দেখলাম, হোমসের চাচাছোলা যুক্তি অনুযায়ী রহস্য সমাধান করার একমাত্র উপায় কিন্তু ওইটাই বাড়ির মধ্যে চুপিসারে ঢুকে পড়া। নীরবে তাই জড়িয়ে ধরলাম ওর দুই হাত, ঠিক হয়ে গেল নিশীথ রাতের ভয়ানক অভিযান।

    কিন্তু বিধি বাম, তাই এমন একটা অ্যাডভেঞ্চার মাঠে মারা গেল শেষ পর্যন্ত। বিকেল পাঁচটা নাগাদ মার্চের বিষণ্ণ সন্ধে যখন একটু একটু করে ঘোমটা ঢাকা দিচ্ছে পৃথিবীর ওপর, ছন্নছাড়া একটা লোক ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ছুটতে ছুটতে ঢুকল ঘরে।

    পালিয়েছে, মি. হোমস! পাখি উড়েছে। কিন্তু ভদ্রমহিলাকে নিয়ে যেতে পারেনি, রাস্তায় গাড়িতে বসিয়ে এসেছি।

    শাব্বাশ, ওয়ার্নার!তড়াক করে লাফিয়ে উঠল শার্লক হোমস, ওয়াটসন, মাঝের ফাঁকটা দেখছি খুব তাড়াতাড়িই জুড়ে আসছে।

    ভাড়াটে গাড়ির মধ্যে এলিয়ে থাকতে দেখলাম গরুড-নাসা শীর্ণকায়া এক ভদ্রমহিলাকে। স্নায়ুর ওপর অত্যন্ত ধকল যাওয়ায় যেন আধমরা হয়ে গেছে। বুকের ওপর এলিয়ে পড়েছে। মাথা। মাথা তুলে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম, চোখের তারা ছোটো হয়ে এসেছে দুটি বিন্দুর মতো, যেন দুটো কালচে ফোঁটা। বুঝলাম, আফিঙে বেহুঁশ রয়েছে মিস বানেট।

    বরখাস্ত মালী বললে, মি. হোমস, আপনার কথামতো নজর রেখেছিলাম ফটকের ওপর। গাড়িটা বেরিয়ে আসতেই পেছনে পেছনে গেলাম স্টেশন পর্যন্ত। মিস বার্নেট যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটছিলেন। সবাই মিলে ঠেলেঠুলে ট্রেনে তুলতে যাওয়ার সময়ে উনি সম্বিৎ ফিরে পেলেন। ধস্তাধস্তি করতে লাগলেন। জোর করে ঠেলে কামরায় তুলে দিতেই উনি ছিটকে বেরিয়ে এলেন বাইরে। আমি ঠুঁটো জগন্নাথের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। ওঁকে নিয়ে এনে বসলাম। ছ্যাকড়াগাড়িতে আসবার সময়ে কামরায় হলদে শয়তানটাকে যেভাবে কটমট করে তাকাতে দেখেছি, তাতে বুঝেছি, এদিকে ফের যদি ও আসে, তো আমার পরমায়ু আর বেশিদিন নেই।

    ধরাধরি করে ভদ্রমহিলাকে নিয়ে গেলাম ওপরতলায়। সোফায় শুইয়ে দিয়ে দু-কাপ কড়া কফি খাওয়াতেই আফিঙের রেশ কেটে গেল মগজ থেকে। খবর পাঠানো হল বেজেকে।

    সব শুনে আনন্দে আটখানা হয়ে হোমসের হাত জড়িয়ে ধরে বেনেজ বললে, কী কাণ্ড দেখুন! আরে মশাই, আমিও তো এঁকে খুঁজেছিলাম। গোড়া থেকেই আপনি যে লাইনে চলেছেন, আমিও সেই লাইনে চলেছি।

    তার মানে? আপনি হেনডারসনের ওপর নজর রেখেছিলেন?

    মি. হোমস, গাছের মাথায় বসে আপনাকে দেখছি, হাইগেবলের ঝোঁপের মধ্যে কী চমৎকার হামাগুড়ি দিচ্ছেন! দেখছিলাম কে আগে আসল সাক্ষীকে হাতে পায়।

    তাহলে মুলাটোকে গ্রেপ্তার করতে গেলেন কেন?

    খুকখুক করে হেসে উঠে বেনেজ বললে, হেনডারসন একটা ছদ্মনাম। ও জানত আমরা ওকে সন্দেহ করছি। ওকে আমরা নিশ্চিন্ত করার জন্যেই জাল পেতে মুলাটোকে ধরেছিলাম। বিপদমুক্ত হয়েছে না-ভাবা পর্যন্ত ও তো পালাবে না মিস বানেটকে নিয়ে, তাই নিরীহ লোকটাকে ইচ্ছে করেই গ্রেপ্তার করে চোখে ধুলো দিয়েছিলাম প্রত্যেকের।

    বেনেজের কাঁধে হাত রেখে হোমস বললে, জীবনে অনেক উঁচুতে আপনি উঠবেন। আপনার সহজাত বুদ্ধি আছে, দৃষ্টিশক্তি আছে।

    আনন্দে ঝিকমিক করে ওঠে বেনেজ। বলে, এই সাতদিন স্টেশনে সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন রেখেছিলাম। হাইগেবলের ফ্যামিলি যে চুলোতেই যাক না কেন, আমার চর পেছন পেছন যাবে। তবে মিস বানেট ছিটকে দলছাড়া হওয়ায় মহাফপরে পড়েছিল বেচারা। যাই হোক, মিস বার্নেটের এজাহার না-নেওয়া পর্যন্ত শয়তানটাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব নয়। আসুন, আগে ওঁর বক্তব্য লিখে নিই।

    গভর্নেসের চেহারাখানা একবার দেখে নিয়ে হোমস বললে, আগের চাইতে অনেক চাঙা হয়ে উঠেছেন ভদ্রমহিলা। বেনেজ, আরও বলুন হেনডারসন লোকটা আসলে কে।

    ডন মুরিলো, সান পেদ্রোর টাইগার নামে যাকে সবাই চিনত।

    সান পেদ্রোর টাইগার! বিদ্যুৎ ঝলকের মতো লোকটার সমস্ত ইতিহাস ঝলসে উঠল আমার স্মৃতির পটে। সান পেদ্রোর টাইগার! সভ্যতার মুখোশ পরে জঘন্য অত্যাচার আর রক্তাক্ত ইতিহাস রচনায় অদ্বিতীয় সেই ডন মুরিলো। অসীম তার মনোবল, নির্ভীক তার অন্তর, উদ্যম তার অপরিসীম, শক্তি তার অপরিমেয়। ভয়ে জুজু গোটা দেশকে একনাগাড়ে দশ-বারো বছর পায়ের তলায় রেখে দেওয়ার মতো গুণ তার মধ্যে ছিল। মধ্য আমেরিকায় তার নাম শুনলে আঁতকে উঠত না, এমন লোক কেউ নেই। দীর্ঘ একযুগ পরে জাগ্রত হল গণশক্তি। কিন্তু সাপের মতো পিচ্ছিল সে, শেয়ালের মতো ধূর্ত। জাগ্রত গণশক্তিকে কোনো সুযোগই সে দিল না। পট পালটাচ্ছে আঁচ করেই গুপ্ত ধনাগার অতি গোপনে জাহাজ বোঝাই করে পাচার করে দিল দেশের বাইরে। এ-ব্যাপারে সাহায্য করল অনুগত স্যাঙাতরা। পরের দিন মারমুখো জনতা হানা দিয়ে দেখল বাড়ি খালি পাখি উড়েছে, দুই মেয়ে আর সেক্রেটারিকে নিয়ে বলদর্পী একনায়ক১২ উধাও হয়ে গিয়েছে ধনরত্ন সমেত। সেই থেকেই ধরাতলে তার নাম আর শোনা যায়নি। ইউরোপের খবরের কাগজে অবশ্য প্রায়ই কটুকাটব্য শোনা গেছে তার সম্পর্কে।

    বেনেজ বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, এই সেই ডন মুরিলো, সান পেদ্রোর টাইগার। খোঁজ নিলে জানবেন, সান পেদ্রোর রং হল সবুজ আর সাদা, চিঠিতে যা লেখা ছিল। হেনডারসন ওর ছদ্মনাম। আমি কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছি, প্যারিস, রোম, মাদ্রিদ, বার্সিলোনায় ১৮৮৬ সালে গিয়েছিল ওর জাহাজ। প্রতিহিংসার জন্যে ওখানকার লোকেও খুঁজছে ওকে। অবশেষে হদিশ পেয়েছিল এইখানে।

    মিস বার্নেট উঠে বসে কান খাড়া করে শুনছিল কথাবার্তা। এখন বললে, এক বছর আগে ডন মুরিলোর সন্ধান পায় ওরা। একবার খতম করার চেষ্টাও হয়েছিল, কিন্তু যেন পৈশাচিক প্রেতাত্মারা আগলে রেখে দিয়েছে ওকে, কেশাগ্র স্পর্শ করা যায়নি। এবারেও দেখুন, ভালো মানুষের ছেলে দিলখোলা গারসিয়া খতম হয়ে গেল, কিন্তু আসল পিশাচ পার হয়ে গেল। কিন্তু সূর্য যেমন সত্যি, ডন মুরিলোকেও তেমনি একদিন খতম হতেই হবে। একজন গেছে, আবার একজন আসবে। সে না-পারলে আসবে আর একজন।

    বলতে বলতে অত্যন্ত ঘৃণায় কুঁচকে গেল মিস বার্নেটের শীর্ণ মুখ, মুষ্টিবদ্ধ হল শিরা-বার-করা সরু হাত।

    হোমস বললে, কিন্তু ইংরেজের মেয়ে হয়ে আপনি এই রক্তারক্তির ষড়যন্ত্রে ঢুকলেন কেন? পৃ

    থিবীর কোনো আইন বা আদালতে এতবড়ো অন্যায়ের বিচার করা যাবে না বলে। বহু বছর আগে সান পেদ্রোতে রক্তনদী বয়ে গেছে, জাহাজ-বোঝাই ধনরত্ন নিয়ে পিশাচ ডন মুরিলো। পালিয়ে এসেছে। তাতে ইংলন্ডের আইনরক্ষকদের কী এসে যায়? আপনাদের কাছে এসব ঘটনা অন্য গ্রহের ঘটনার শামিল। কিন্তু হাহাকার আর রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে আমরা জেনেছি, নরকের শয়তান যদি কোথাও থাকে, তা এই ডন মুরিলো। প্রতিহিংসা-পাগল সর্বহারারা যতদিন প্রতিহিংসা নিতে না-পেরে হাহাকার করে ফিরবে, ততদিন শান্তি আসবে না এ-পৃথিবীতে।

    ডন মুরিলো যে কী সাংঘাতিক লোক, আমি তা জানি মিস বার্নেট। কিন্তু আপনার গায়ে আঁচ লাগল কীভাবে?

    সব বলব। শয়তান ডন মুরিলো নানা অছিলায় পর পর মানুষ খুন করত। যখনই বুঝত অমুকের মধ্যে প্রতিভা আছে, ক্ষমতা আছে, বেশি উঠতে দিলে তার নিজের বিপদ হতে পারে, তাকেই ছুতোনাতা করে ডেকে এনে শেষ করে দিত। আমার আসল নাম সিগনোরা১৪ ভিক্টর ভোরান্ডো। আমার স্বামী লন্ডনে সান পেদ্রো মিনিস্টার ছিলেন। অমন মহৎ মানুষ জীবনে আর দেখিনি। আমাকে উনি লন্ডনে দেখেন এবং বিয়ে করেন। ডন মুরিলো যখন শুনল ওঁর সুনাম, ডেকে পাঠাল বাড়িতে, তারপর কুকুরের মতো গুলি করে ফেলে দিল লাশ। আমার স্বামী বুদ্ধি করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাননি, আঁচ করতে পেরেছিলেন বোধ হয় জীবন্ত আর ফিরতে হবে না। ডন মুরিলো ওঁর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে। স্বামীহারা আমি রাস্তার ভিখিরি হয়ে হাহাকার করে বেড়াতে লাগলাম সেই থেকে। তারপরেই পতন ঘটল পিশাচ ডন মুরিলোর, পালিয়ে গেল ধনরত্ন আর মেয়েদের নিয়ে। কিন্তু একদিন যাদের বুকে ও আগুন জ্বালিয়েছে, যাদের জীবন ধ্বংস করেছে, তারা ওকে ছেড়ে দিল না। সংঘবদ্ধ হল, সমিতি স্থাপন করল, প্রতিজ্ঞা করল, ডন মুরিলোর রক্ত দিয়ে হোলি খেলা না পর্যন্ত সমিতি টিকে থাকবে। হেনডারসন ছদ্মনামে শয়তানটা এখানে আস্তানা নিয়েছে শুনে ভার পড়ল আমার ওপর গভর্নেসের চাকরি নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে খবর চালান করার। পিশাচ ডন মুরিলো কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি, প্রত্যেকদিন যার সঙ্গে মুখোমুখি বসে খাবার খেয়েছে, তারই স্বামীকে মাত্র এক ঘণ্টার নোটিশে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনন্তের পথিক করে ছেড়েছে। আমি শুধু মনে মনে হেসেছি, ওর সঙ্গেও হেসে হেসে কথা বলেছি, মেয়েদের ওপর যথাকৰ্তব্য করেছি এবং সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছি। প্যারিসে একটা সুযোগ পাওয়া গেল, কিন্তু ও বেঁচে গেল। আমরা সারাইউরোপে ঝড়ের মতো এদিক-ওদিক করে বেড়ালাম যাতে কেউ পিছু নিতে না-পারে। তারপর ফিরে এলাম এখানে। ইংলন্ডে এসেই এই বাড়িটা নিয়েছিল ডন মুরিলো।

    একটু থেমে ফের বলতে শুরু করল মিস বার্নেট : কিন্তু এখানেও ওত পেতে ছিল বিচারকর্তারা। সান পেদ্রোর একজন উচ্চপদস্থ মান্যগণ্য ব্যক্তির ছেলে গারসিয়া দুজন একান্ত অনুগত অনুচরকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল ওকে বধ করার জন্যে। এই দুজনের জীবনেও কিন্তু সর্বনাশের আগুন জ্বালিয়েছে ডন মুরিলো। তাই প্রতিহিংসার আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল তিনজনেরই বুকে। কিন্তু দিনের বেলায় ওরা সুবিধে করে উঠতে পারছিল না ডন মুরিলো কখনো একা বেরোয় না বলে, অতীতের দুষ্কর্মের সঙ্গী লুকাস বা লোপেজ সবসময়ে থাকত সঙ্গে। রাতে কিন্তু একা ঘুমোত, ওকে নিঃশেষ করার মোক্ষম সময় তখনই। ধড়িবাজ ডন মুরিলো কিন্তু পর পর দু-রাত এক ঘরে শুত না, রোজই ঘর পালটাত। একদিন রাতে শোয়ার ব্যবস্থা আমার বন্ধুদের জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। ঠিক করলাম, দরজা খুলে রাখব, অবস্থা অনুকূল থাকলে জানলায় সবুজ আর সাদা আলোর সংকেত দেখাব। সেই সংকেত দেখা না-গেলে গারসিয়া যেন না-আসে। কিন্তু গেল সব ভণ্ডুল হয়ে। কী কারণে জানি না, সেক্রেটারি লোপেজ সন্দেহ করেছিল আমাকে। চিঠিটা সবে লেখা শেষ করেছি, এমন সময়ে পেছন থেকে লাফিয়ে পড়ল আমার ওপর। তারপর শুরু হল অমানুষিক অত্যাচার। বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যু। ডন মুরিলো তখনই ছুরি বসাত আমার বুকে, কিন্তু দুজনে মিলে শলাপরামর্শ করে ঠিক করলে, গারসিয়াকে আগে খতম করা দরকার। ডন মুরিলো আমার হাত পেছনে নিয়ে গিয়ে এমন মোচড় দিলে যে নামটা না-বলে পারিনি। তখন অবশ্য জানতাম না, গারসিয়াকে খুন করার জন্যেই নাম জানতে চাইছে। জানলে কখনোই বলতাম না, হাত ভেঙে গেলেও বলতাম না। চিঠিখানা খামে ভরে ঠিকানা লিখল সেক্রেটারি সিলমোহর করল আস্তিনের কাফলিং দিয়ে। গারসিয়ার বাড়ি পাঠিয়ে দিল চাকর জোসির হাতে। লোপেজ আমার পাহারায় ছিল বলেই আমার বিশ্বাস, গারসিয়াকে নিজের হাতে খুন করেছে ডন মুরিলো। বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে খুন করেনি পাছে তদন্তের সময়ে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যায় এই ভয়ে। কিন্তু ঝোঁপের মধ্যে গারসিয়ার মৃতদেহ পড়ে থাকলে পুলিশ কিছুই আঁচ করতে পারবে না, অথচ গারসিয়ার স্যাঙাতরা ভয় পেয়ে ডন মুরিলোর পিছু নেওয়া ছেড়ে দেবে। তারপর থেকে এই পাঁচদিন অকথ্য অত্যাচার চলেছে আমার ওপর. পেট ভরে খেতে দেওয়া হয়নি, পিঠে ছোরা দিয়ে খোঁচানো হয়েছে, দু-হাত দেখুন ক্ষতবিক্ষত করে ছেড়েছে, জানলা দিয়ে একবার চেঁচাতে গিয়েছিলাম বলে মুখের মধ্যে ন্যাকড়া ঠেসে দিয়েছে। আমার মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্যে যতরকম উপায় আছে, কোনোটাই বাকি রাখেনি। আজকে দুপুরে পেট ভরে হঠাৎ খেতে দেয়। খাবার পরেই বুঝলাম, আফিং মেশানো ছিল খাবারে। বেহুঁশ অবস্থায় মনে হল, যেন হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোথাও। গাড়িতে ওঠানোর পর সম্বিৎ ফিরল। দেখলাম এই শেষ সুযোগ, নইলে ইহজীবনে আর মুক্তি পাব না। ধস্তাধস্তি করলাম, ঠিকরে বেরিয়ে এলাম! তখন এই লোকটি দয়া করে আমাকে টানতে টানতে ওদের খপ্পর থেকে নিয়ে গাড়িতে চাপিয়ে এখানে এনে ফেললেন। ভগবান বাঁচিয়েছেন। ওদের ক্ষমতা নেই আর আমার ক্ষতি করার।

    নীরবে শুনলাম অত্যাশ্চর্য এই কাহিনি। নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করল হোমস। মাথা নেড়ে বললে, ঝামেলা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। পুলিশের কাজ মিটল বটে, শুরু হল আইনের কাজ।

    তা ঠিক। বললাম আমি, যত দুষ্কর্ম করে থাকুক না কেন ডন মুরিলো, এই দুষ্কর্মের সাজা তাকে পেতেই হবে। ভালো আইনজ্ঞের হাতে কেস পড়লে মামলা ঠিক সাজিয়ে ফেলবে। বোঝাবে, ডন মুরিলো যা কিছু করেছে, আত্মরক্ষার জন্যে করেছে।

    প্রসন্নকণ্ঠে বেনেজ বললে, আরে রাখুন, আইন জিনিসটা আমিও ভালো বুঝি। আত্মরক্ষা এক জিনিস, আর ঠান্ডা মাথায় একজনকে ভুলিয়ে এনে খুন করা আর এক জিনিস, তা সে যত বিপজ্জনক লোকই হোক না কেন। হাইগেবলের ভাড়াটে ভদ্রলোককে কাঠগড়ায় না দাঁড় করানো পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই জানবেন।

    কিন্তু আবার পুলিশ চরের চোখে ধুলো দিল মহাপাপিষ্ঠ জন মুরিলো। এডমন স্ট্রিটের একটা বাড়িতে ঢুকে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল কার্জন স্কোয়ারে। তারপর থেকে বেমালুম নিপাত্তা হয়ে গেল মুরিলো পরিবার, নাম পর্যন্ত আর শোনা গেল না ইংলন্ডে। ছ-মাস পরে মাদ্রিদের এসকুরিয়াল হোটেলে খুন হয়ে গেল মনটালভার মারকুইস আর তার সেক্রেটারি সিগনর রুলি। খুনিরা ধরা পড়ল না। লোকে বললে, নিহিলিস্টদের কুকর্ম। নিহতদের ছাপা। ছবি নিয়ে বেকার স্ট্রিটে এল ইনস্পেকটর বেনেজ। চুম্বকের মতো কালো চোখ, কর্তৃত্বব্যঞ্জক আকৃতি আর ঝোঁপের মতো ভুরু দেখেই চেনা গেল ডন মুরিলোকে। সেক্রেটারির কালচে মুখ। দেখেও চিনতে অসুবিধে হল না মোটেই। বুঝলাম, দেরিতে হলেও এতদিনে শেষ হল গুপ্তবিচার সমিতির একমাত্র কাজ।

    সন্ধের দিকে পাইপ খেতে খেতে হোমস বললে, ভায়া ওয়াটসন, কেসটা সত্যিই জবরজং টাইপের। দু-দিকে দুটো দেশ, দু-দেশে রহস্যজনক দুটো দল। মাঝে স্কট ইক্লিসের মতো নিরীহ ইংরেজ আর এই হুঁশিয়ার গারসিয়া। এখনও যদি কিছু বোঝার থাকে, তো বলল, বুঝিয়ে দিই।

    মুলাটো পাঁচক ফিরে এল কেন?

    রান্নাঘরে পাওয়া ওই অদ্ভুত মূর্তিটার জন্যে। লোকটা সত্যিই বর্বর, সান পেদ্রোর জঙ্গলের মানুষ। মূর্তিটাকে ও দেবতাজ্ঞানে পুজো করত। তাড়াহুড়ো করে পালানোর সময়ে ওর সঙ্গী ওকে নিতে দেয়নি প্রাণপ্রিয় আরাধ্য দেবতাকে। তাই কুসংস্কারের তাগিদে ফিরে এসেছিল পরের দিন। জানলা দিয়ে ওয়াটসনকে দেখে পালিয়েছে। তিন দিন পরে আবার এসে ধরা পড়েছে। বেনেজ বুঝেছিল, সে আসবে, তাই আমি বোঝবার আগেই ফাঁদ পেতে তাকে ধরেছে শুধু ডন মুরিলোকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে। আর কিছু?

    টুকরো টুকরো করে ছেড়া পাখি, গামলাভরতি রক্ত, বারকোশ-ভরতি পোেড়া হাড়, রান্নাঘরে অদ্ভুত এই জিনিসগুলো গেল কেন?

    মৃদু হেসে নোটবই খুলল হোমস। বলল, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে এ নিয়ে পড়াশুনা করেছি। নিগ্রোদের ধর্ম আর ডাকিনীবিদ্যা, তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক সম্বন্ধে একারম্যানের বই থেকে এই ক-টা লাইন লিখে এনেছি। শোনো : নোংরা দেবতাদের উপাসনা করার জন্যে ভুড়ু অর্থাৎ ডাকিনীবিদরা কিছু-না-কিছু বলি দেবেই। নরবলি পর্যন্ত দেওয়া হয়, তারপর মহামাংস নিয়ে ভোজোৎসব হয়। সবচেয়ে বেশি বলি হয় সাদা মোরগ জ্যান্ত ছিঁড়ে ফেলে। কালো ছাগল জবাই করে আগুনে পুড়িয়ে বলি দেওয়ার প্রথাও আছে এদের মধ্যে। তাহলেই দেখ, বর্বর পাঁচক অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পুজোআচ্চা করে গেছে রান্নাঘরে। আমাদের কাছে তা কিম্ভুতকিমাকার মনে হয়েছিল ঠিকই, এখন দেখলে তো, কিম্ভুতকিমাকার শব্দটার সঙ্গে ভয়ংকর শব্দটার তফাত খুব সামান্যই। আগেও তোমাকে এ নিয়ে বলেছি, তাই নয় কি?

    ———–

    টীকা

    উইসটেরিয়া লজের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি : ১৯০৮-এর পনেরোই অগাস্ট তারিখের কোলিয়ার্স ম্যাগাজিনে এই গল্পটি প্রকাশিত হয় দ্য সিঙ্গুলার এক্সপিরিয়েন্স অব মি. জে. স্কট একেলস নামে। আবার স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর ১৯০৮ দুটি সংখ্যায় দুটি কিস্তিতে প্রকাশিত এই গল্পের নাম দেওয়া হয়েছিল দ্য রেমিনিসেন্স অব মি. শার্লক হোমস। প্রথম কিস্তির শিরোনাম ছিল দ্য সিঙ্গুলার এক্সপিরিয়েন্স অব মি. জে. স্কট একেলস এবং দ্বিতীয় কিস্তির শিরোনাম দ্য টাইগার অব সান পেদো। পরে, গ্রন্থাকারে সংকলনকালে গল্পটির নামকরণ করা হয় দি অ্যাডভেঞ্চার অব উইসটেরিয়া লজ।

    ১৮৯২ সালের মার্চ মাস : তারিখটি সর্বৈব ভুল। কারণ ১৮৯১-এর এপ্রিল থেকে ১৮৯৪-এর এপ্রিল পর্যন্ত হোমস ছিলেন নিরুদ্দেশ। দ্য রিটার্ন অব শার্লক হোমস গ্রন্থের প্রথম গল্প দ্রষ্টব্য।

    পোস্ট অফিস, শেরিং ক্রস : হোমসের সমকালে মর্লেজ হোটেলের একতলায় অবস্থিত শেরিং ক্রস পোস্ট অফিস ইংলন্ডের একটি প্রাচীনতম পোস্ট অফিস। এটি সেই সময়ে রাতদিন খোলা থাকত।

    পুরুষ না মহিলা : কেউ ভাবতে পারেন স্কট পুরুষের নাম। আবার পদবিও হয়। এক্ষেত্রে নাম স্কট, পদবি একেলস (বা ইক্লিস)। কিন্তু ইংরেজ ওয়াটসন বুঝেছিলেন নামের আদ্যক্ষর জে পদবি স্কট একেলস, যেমন রায়চৌধুরি বা বসু মল্লিক বা ঘঘাষ দস্তিদার হয়ে থাকেন, সেইরকম।

    কর্নেল ক্যারুথার্স : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সলিটারি সাইক্লিস্ট গল্পে শার্লক হোমস খাঁচায় পুরেছিলেন বব কারুথার্সকে। তবে সে কর্নেল নয়।

    ইনস্পেকটর গ্রেগসন : এই গল্পে ছাড়া গ্রেগসনকে আর দেখা যায় আ স্টাডি ইন স্কারলেট উপন্যাসে এবং দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য গ্রিক ইন্টারপ্রেটার গল্পে।

    রাত একটা বাজে : অতিথির ঘুম ভাঙিয়ে গারসিয়া যখন সময় জানাল, তখন স্কট-একেলস নিজের ঘড়ি দেখলে কিন্তু গারসিয়ার সব পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যেত।

    রেসের কথা মনে করিয়ে দেয় : রেসের ঘোড়সওয়ার বা জকিদের পোশাকের রঙের কথা মাথায় রেখে সম্ভবতএই উক্তি করা হয়েছে।

    মুলাটো : যার বাবা এবং মায়ের মধ্যে একজন নিগ্রো এবং অপরজন শ্বেতাঙ্গ, তাদের মুলাটো (Mulato) বলা হয়। মুলাটো এবং শ্বেতাঙ্গর সন্তানকে বলা হয় কোয়াড্রন (Quadroon) এবং কোয়াড্রন এবং শ্বেতাঙ্গর সন্তান অক্টোরুন (Octoroon) নামে পরিচিত।

    ডন : সমাজের উঁচুস্তরের মানুষদের নামের আগে ব্যবহৃত স্প্যানিশ অভিধা।

    মধ্য আমেরিকায় : অধিকাংশ গবেষকের মতে সান পেদ্রো হল ব্রাজিল এবং ডন মুরিলো ব্রাজিলের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় পেদ্রো বা ডম পেদ্রো দে আলকান্তারা। রাজত্বকাল ১৮৩১ থেকে ১৮৮৯। ১৮৮৯-এ এক সামরিক অভ্যুত্থানে গদিচ্যুত হয়ে ইউরোপে পালিয়ে আসেন।

    বলদর্পী একনায়ক : ব্রাজিলের সম্রাট দ্বিতীয় পেদ্রো কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের যথেষ্টই প্রিয় ছিলেন।

    প্যারিস, নোম, মাদ্রিদ, বার্সিলোনা : ফ্রান্সে রাজধানী প্যারিস বা পারী, ইতালির রাজধানী রোম, স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ এবং স্পেনের বড়ো শহর বার্সিলোনা, কোনোটাই বন্দর নগরী নয়, যেখানে জাহাজ যেতে পারে।

    সিগনোরা : সিগনোরা ব্যবহৃত হয় ইতালীয় মহিলাদের নামের প্রারম্ভে; স্পেনীয় মহিলাদের নামের আগে বলা হয় সেনোরা।

    মারকুইস : একজন মারকুইস সম্মানে ডিউকের থেকে নীচুতে এবং আর্ল-এর ওপরে।

    সিগনর রুলি : এক্ষেত্রে, স্পেনীয় রুলির নামের আগে সিগনর নয়, সেনর থাকবার কথা। আবার, রুলি নামের কোনো স্পেনীয় পদবি দেখা যায় না বলে জানিয়েছেন কয়েকজন গবেষক।

    নিহিলিস্ট : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য গোল্ডেন প্যাসনে গল্পের টীকা দ্রষ্টব্য।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ – আরিফ আজাদ
    Next Article শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }