Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শার্লক হোমস সমগ্র ২ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    লেখক এক পাতা গল্প1414 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    শার্লক হোমসের মৃত্যুশয্যায়

    [ দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ডাইং ডিটেকটিভ ]

    শার্লক হোমসের বাড়িউলি মিসেস হাডসন বেচারির হাড় ভাজা-ভাজা হয়ে গিয়েছিল ওইরকম একখানা ভাড়াটেকে বাড়িতে ঢুকিয়ে। একে তো রাজ্যের আজেবাজে লোক হানা দিয়েছে। দোতলার ফ্ল্যাটে, তার ওপর ভাড়াটের সৃষ্টিছাড়া খ্যাপামি আর উলটোপালটা অভ্যেসের দরুন নিশ্চয়ই ধৈর্যের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছিলেন ভদ্রমহিলা।

    একদিকে যেমন অবিশ্বাস্য রকমের অগোছালো, অন্যদিকে তেমনি রাতবিরেতে গান-বাজনার গিটকিরি। এ ছাড়াও আছে ঘরের মধ্যে বসে রিভলভার ছুঁড়ে হাত পাকানো আর দুর্গন্ধময় বৈজ্ঞানিক গবেষণা। সর্বোপরি সবসময়ে বিপদ আর দাঙ্গাহাঙ্গামার হাওয়ায় সারাবাড়ি যেন থমথমে। সব মিলিয়ে এত জঘন্য ভাড়াটে সারালন্ডন শহরে আর দুটি নেই। পক্ষান্তরে টাকাকড়ি দেওয়ার ব্যাপারে রাজারাজড়ার মতো দিলখোলা হোমস। এত টাকা ভাড়া বাবদ সে গুনেছে, আমার তো মনে হয়, সে-টাকায় অনায়াসেই বাড়িটা কিনে নিতে পারত সে।

    গা জ্বালানো অভ্যেস আর সৃষ্টিছাড়া খ্যাপামি সত্ত্বেও ভাড়াটেকে যমের মতো ভয় করেন মিসেস হাডসন, ভুলেও কখনো নাক গলান না ওর ব্যাপারে। তবে ভালোও বাসেন। কেননা মেয়েদের মন জয় করার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল হোমসের। অদ্ভুত সৌজন্য আর কোমল শিষ্টাচার দিয়ে কাছে টেনে নিতে পারত যেকোনো মহিলাকে। মেয়েদের কিন্তু পছন্দ করত না, বিশ্বাস করত না–অথচ ছিল আশ্চর্য রকমের নারীপ্রিয়। শার্লক হোমস যে মিসেস হাডসনের শ্রদ্ধার পাত্র, আমি তা জানতাম বলেই আমার বিয়ের দ্বিতীয় বছরে যখন ভদ্রমহিলা আমার বাড়ি বয়ে এসে বন্ধুবরের মুমুর্ষ অবস্থা বর্ণনা করতে আরম্ভ করলেন, তখন উৎকর্ণ হয়ে না-শুনে পারলাম না।

    মিসেস হাডসন বললেন, আপনার বন্ধু যে মরতে চলেছেন, ডক্টর ওয়াটসন! তিন দিন ধরে তিল তিল করে এগিয়ে চলেছেন মৃত্যুর দিকে, আর একটা রাত পেরোবেন বলে মনে হয় না। ওদিকে ডাক্তারও আনতে দেবেন না আমাকে। আজ সকালে মুখ-চোখের চেহারা দেখে আর স্থির থাকতে পারলাম না। বললাম, মি. হোমস, আপনি বলুন চাই না-ই বলুন, আমি চললাম ডাক্তার ডাকতে। উনি শুনে বললেন, তাহলে বরং ওয়াটসনকেই ডাকুন। তাই দৌড়াতে দৌড়াতে আসছি। এখুনি চলুন, দেরি করলে আর জ্যান্ত দেখতে পাবেন কি না সন্দেহ।

    ভীষণ ভয় পেলাম। হোমসের শরীর যে এত খারাপ হয়েছে, কিছুই জানতাম না। কোট আর টুপি নিয়ে রওনা হলাম তৎক্ষণাৎ। গাড়িতে যেতে যেতে শুনলাম বাকি কাহিনি।

    আমিও কি ছাই সব জানি! মিসেস হাডসন বললেন, নদীর ধারে রোদারহিদেব গলিতে কী-একটা মামলা নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন উনি। ধুকছেন বুধবার বিকেল থেকে। বিছানা থেকে একদম উঠছেন না। এই তিনটে দিন একফোঁটা জল পর্যন্ত খাননি, দাঁতেও কিছু কাটেননি।

    গুড গড! ডাক্তারকে খবর দেননি কেন? অবাক হয়ে শুধোলাম।

    দিতে দিলে তো? জানেনই তো, উনি কারো কথায় চলেন না, সবাই চলে ওঁরই কথায়। কিন্তু আর বোধ হয় বেশিক্ষণ নয়, হয়ে এল মি. হোমসের! মুখের চেহারা দেখলেই বুঝবেন।

    নভেম্বরের কুয়াশাচ্ছন্ন ম্লান আলোয় ঘরের মধ্যে দেখলাম সেই শোচনীয় দৃশ্য। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে শার্লক হোমসের দীর্ঘ শীর্ণ কঙ্কালসার মুর্তি। কোটরাগত দুই চক্ষুর চাহনি আমার ওপর নিবদ্ধ হতেই মেরুদণ্ড পর্যন্ত শিউরে উঠল আমার। এ কী দেখছি আমি? এই কি আমার প্রিয়বন্ধু শার্লক হোমস? এ কী হাল হয়েছে তার? ঠোঁটের দুই কোণে কালচে ফেনা জমে গেছে, জ্বরের ঘঘারে চোখ ঘোলাটে হয়ে এসেছে, গাল লাল হয়ে গেছে দেহের উত্তাপে, লেপের ওপর হাড়-বার-করা হাতের আঙুল বিকারগ্রস্ত রুগিরমতো থরথর কাঁপছে, মোচড় খাচ্ছে বিরামবিহীনভাবে, থেকে থেকে গলা থেকে দমকে দমকে ব্যাঙের ডাকের মতো কেঁ-কে কাতরানি ঠিকরে আসছে। আমি ঘরে ঢুকতেই আমায় চিনতে পেরেছে মনে হল, ঈষৎ উজ্জ্বল হল দুই চক্ষু।

    বললে সে ক্ষীণ কণ্ঠে, ওয়াটসন, সময় বড়ো খারাপ যাচ্ছে।

    ভাই হোমস! রুদ্ধকণ্ঠে কথাগুলি বলে ওর দিকে এগোতেই চিলের মতো তীক্ষ্ণ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল হোমস, কাছে এস না! কাছে এস না। এলে কিন্তু দূর করে দেব বাড়ি থেকে।

    সংকটে পড়লে চিরকালই এমনি তুঘলকি মেজাজ দেখায় হোমস।

    ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, কিন্তু কেন?

    কেন আবার? আমার ইচ্ছা, সেটাই কি যথেষ্ট নয়?

    ঠিকই বলেছেন মিসেস হাডসন। আগের মতোই হুকুম চালিয়ে যাচ্ছে হোমস–কারো হুকুমে চলতে সে রাজি নয়। কিন্তু এই ছোট্ট হুকুমটা চালাতে গিয়ে যেভাবে বেদম হয়ে পড়ল যে দেখে বড়ো কষ্ট হল।

    যা বলি, তা-ই করো। তাতেই বেশি কাজে লাগবে!

    বেশ তো, বলো।

    একটু নরম হল যেন হোমস। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বললে, রাগ করলে না তো?

    হায় রে! ওই অবস্থায় কাউকে দেখে তার ওপর রাগ করা যায়?

    কো-কেঁ করতে করতে ফের বলল সে, তোমার ভালোর জন্যেই কাছে আসতে বারণ করলাম।

    আমার ভালোর জন্যে?

    হ্যাঁ। আমি তো জানি আমার কী হয়েছে। সুমাত্রার কুলিদের রোগ। মারাত্মক, কেউ বাঁচে না। আর সাংঘাতিক ছোঁয়াচে। ওলন্দাজরা খবর রাখে এ-রোগের, কিন্তু বাঁচবার পথ আজও বের করতে পারেনি। হাড়-বার-করা আঙুল নাড়তে নাড়তে জ্বরের ঘোরে অতিদ্রুত যেন প্রলাপ বকে চলল হোমস, খবরদার কাছে আসবে না। দারুণ ছোঁয়াচে রোগ। দূরে থাকো।

    হোমস, ছোঁয়াচে রোগ বলে আমার কর্তব্য করতে দেবে না? অচেনা মানুষও যদি ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে আসে তো ডরাই না, আর তুমি হলে আমার কদ্দিনের বন্ধু! বলে যেই আবার এগোতে গেছি বিছানার দিকে, গনগনে চোখে কটমট করে তাকিয়ে বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠল হোমস, আর এক পা এগোলে তাড়িয়ে দেব ঘর থেকে, একটা কথাও আর বলবে না।

    হোমসকে আমি বরাবরই অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি বলে কখনো তার হুকুমের উলটো কাজ করি না, তা সে যত অপ্রিয় আদেশই হোক না কেন। কিন্তু এ-ব্যাপারটা আলাদা। এখন তার গুরুগিরি মানতে আমি রাজি নই, রুগির ঘরে ডাক্তারই গুরু–আমিই এখন তার মনিব। কর্তব্য আমাকে করতেই হবে। বললাম, হোমস, তুমি এখন অসুস্থ, মোটেই ধাতস্থ নও। অসুখে পড়লে রুগিমাত্রই শিশু হয়ে যায়। তখন তাকে সেইভাবেই চিকিৎসা করতে হয়। কাজেই এখন তোমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের ধার ধারি না আমি, তোমার নাড়ি আমাকে দেখতেই হবে, ওষুধপত্রের ব্যবস্থাও করতে হবে।

    বিষ মাখানো চোখে চাইল হোমস। বললে, তাহলে এমন ডাক্তার ডাকব, যার ওপর আমার আস্থা আছে।

    তার মানে আমার ওপর তোমার আস্থা নেই?

    তোমার বন্ধুত্বে আস্থা আছে, ডাক্তারি বিদ্যেতে নেই। সামান্য জেনারেল প্র্যাকটিশনার তুমি, সীমিত অভিজ্ঞতা আর অতি মামুলি ডিগ্রি নিয়ে ডাক্তারি কর। জানি, তোমার কষ্ট হচ্ছে শুনতে, কিন্তু বলতে তুমিই বাধ্য করলে।

    মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেল। বললাম, হোমস, তোমার মুখে এ-কথা কোনোদিন শুনব ভাবিনি। বেশ, আমার বিদ্যেবুদ্ধিতে যদি তোমার আস্থা না-থাকে, তো লন্ডন শহরের সেরা ডাক্তারদের ডেকে আনছি। স্যার জ্যাসপারসিক বা পেনরোজ ফিশার বা বিখ্যাত কোনো বিশেষজ্ঞকে এখুনি ডেকে আনছি। কিন্তু চোখের সামনে এভাবে তোমাকে কষ্ট পেতে দেব না।

    যেন গুঙিয়ে উঠল হোমস, যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল আমার আবেগরুদ্ধ এই কথায় বললে, তাহলে হাতেনাতে দেখিয়ে দিচ্ছি তোমার বিদ্যের দৌড় কত কম। তাপানুলি জ্বরের নাম কখনো শুনেছ? জান কি ব্ল্যাক ফরমাশা ব্যাধি কাকে বলে?

    জীবনে নাম শুনিনি।

    প্রাচ্যদেশে এইরকম অনেক অজানা ভয়ংকর রোগ আছে, ওয়াটসন। কেউ তার খবর রাখে। আমি জেনেছি রোগগুলো অপরাধ-সংক্রান্ত বলেই। তদন্ত করতে গিয়ে নিজেই রোগে পড়েছি। প্রত্যেকটা শব্দ অতি কষ্টে থেমে থেমে দম নিয়ে নিয়ে কোনোমতে বলল হোমস, তাই বলছিলাম, তুমি পারবে না আমাকে ভালো করতে।

    বেশ তো, ট্রপিক্যাল রোগে সেরা বিশেষজ্ঞ ডক্টর এইন্সট্রে এখন লন্ডনে আছেন। তোমার সঙ্গে তার আলাপও আছে। বাজে কথায় সময় নষ্ট না-করে চললাম তাকে ডাকতে। বলে পা বাড়ালাম দরজার দিকে।

    এ-রকম শক জীবনে পাইনি। আচম্বিতে মৃত্যুপথের পথিক শার্লক হোমস বাঘের মতো লাফ দিয়ে উঠল বিছানা থেকে, আমার আগেই ছিটকে গেল দরজার সামনে, কড়াৎ করে দরজায় চাবি নিয়ে চাবিটা হাতে নিয়ে ফের গিয়ে আছড়ে পড়ল বিছানায়। প্রাণশক্তির আচমকা বিস্ফোরণে হাপরের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে সে নেতিয়ে রইল শয্যায়।

    খানিক বাদে বললে, ওয়াটসন, এখন চারটে বাজে। ঠিক ছ-টার সময় ছাড়া পাবে ঘর থেকে। চাবিটা গায়ের জোরে কাছ থেকে নিতে যেয়ো না, যেখানে আছে, সেখানেই থাক।

    হোমস, এ যে বদ্ধ পাগলামি!

    কথা দিচ্ছি, ঠিক দু-ঘণ্টা পরে তোমায় ছেড়ে দেব। ঠিক ছটায়। রাজি?

    রাজি না হয়ে আর তো উপায় দেখছি না।

    কাছে এস না। দূরে থাকো। শোনো, লন্ডন শহরে একজনই আমাকে আরাম করতে পারে। যার নাম বলব, তুমি তার কাছে যাবে।

    নিশ্চয়ই যাব।

    এতক্ষণে বুদ্ধিমানের মতো কথা বললে। ছ-টা পর্যন্ত বই পড়ো। এখন আর কথা বলবার শক্তি আমার নেই। ঠিক ছটায় আবার কথা বলব।

    কিন্তু তার আগেই আবার প্রাণশক্তি আর বাক্যশক্তির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ছাড়ল মরণপথের পথিক শার্লক হোমস। আঁতকে উঠলাম তার বর্জনাদে। ঘটনাটা ঘটল এইভাবে।

    চেয়ে দেখি মুখ পর্যন্ত লেপ চাপা দিয়ে বোধ হয় ঘুমুচ্ছে হোমস।

    মনের এই অবস্থায় বই পড়া যায় না। তাই ঘুরে ঘুরে দেওয়ালে ঝোলানো কুখ্যাত ক্রিমিনালদের ছবি দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছোলাম ম্যান্টলপিসের সামনে। দেখলাম, খানকয়েক পাইক, তামাকের থলি, ইঞ্জেকশন নেওয়ার সিরিঞ্জ, কাগজকাটা ছুরি, রিভলভারের কার্তুজ এবং অন্যান্য হাবিজাবি জিনিসের স্তুপের মধ্যে পড়ে আছে একটা সাদা-কালো আইভরি কৌটো। হাতির দাঁতের ভারি সুন্দর কৌটোটা দেখে যেই সেদিকে হাত বাড়িয়েছি, অমনি বিকট বীভৎস একটা চিৎকারে গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। ভয়াবহ সেই আর্তনাদ রাস্তার লোকেও শুনেছিল নিশ্চয়। মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে গেল আমার অবর্ণনীয় সেই আর্তনাদে। ফিরে দেখি, বিকৃত উন্মত্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার মুমূর্ষু বন্ধু। কৌটোটা হাতে নিয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রুগির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি স্থাণুবৎ।

    একটু বাদেই হোমসের হুমকি কানে এল, নামিয়ে রাখ ওয়াটসন, যেখানকার জিনিস এখুনি রেখে দাও সেখানে।

    ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে হাবিজাবি স্তুপে কৌটোটা রেখে দিতেই পরম স্বস্তিতে পাঁজর-খালি-করা নিশ্বাস ছেড়ে ফের বালিশে এলিয়ে পড়ল হোমস। বললে, ওয়াটসন, আমি চাই না, আমার জিনিসপত্রে কেউ হাত দিক। তুমি তা জান, জেনেও আমাকে মারতে বসেছ! আমার সহ্যশক্তির বাঁধ ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছ! ডাক্তার হয়ে আমাকে পাগলাগারদে ঢোকানোর মতো কাজ করছ। বোসো, বোসসা, বলছি। একটু জিরোতে দাও আমাকে!

    ঘটনাটা নাড়া দিয়ে গেল আমার ভেতর পর্যন্ত। হোমসের কথাবার্তা চিরকালই মাজাঘষা, মসৃণ। কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর প্রচণ্ডতা, ওর ভয়াবহ উত্তেজনা দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল, মস্তিষ্কের সুস্থতা একেবারেই হারিয়েছে বন্ধু। শরীর যায় যাক, কিন্তু একটা উঁচুদরের মহৎ মনের এই দূরবস্থা দেখা যায় না। দু-ঘন্টার মেয়াদ উত্তীর্ণ না-হওয়া পর্যন্ত বসে রইলাম চুপচাপ।

    আমার মতোই ঘড়ির দিকে হোমসও নজর রেখেছিল নিশ্চয়ই। কেননা ছ-টা বাজতে-বাজতেই ঠিক আগের মতো জ্বরগ্রস্ত বিকারের ঘোরে উত্তেজিত গলায় বললে, ওয়াটসন, খুচরো পয়সা আছে পকেটে?

    আছে।

    রুপোর খুচরো?

    বেশ কিছু?

    আধক্রাউন ক-টা?

    পাঁচটা!

    মাত্তর! কী কপাল! কী কপাল! যাকগে, ঘড়ির পকেটে রাখো আধক্রাউনগুলো, বাকি খুচরো রাখো বাঁ-দিকের প্যান্টের পকেটে।… ধন্যবাদ! এতক্ষণে ব্যালেন্সে এলে তুমি।

    বদ্ধ উন্মত্ততা সন্দেহ নেই। মাথার একদম ঠিক নেই ওর। থরথর করে একবার কেঁপে উঠেই ফের কাশি আর ফোপানি জাতীয় অদ্ভুতভাবে কাতরে উঠল হোমস। বললে, গ্যাসের আলোটা জ্বালাও ওয়াটসন। বেশি না, অর্ধেকের বেশি না। খুব সাবধান … ঠিক আছে। চমৎকার হয়েছে। না, না, জানলার খড়খড়ি বন্ধ করার দরকার নেই। এবার দয়া করে খানকয়েক চিঠি আর কাগজ এনে আমার হাতের কাছের এই টেবিলটায় রাখ।… ধন্যবাদ! এবার ম্যান্টলপিস থেকে কিছু হাবিজাবি জিনিস এনে রাখো তো… চমৎকার হয়েছে ওয়াটসন! চিনির ডেলা তোলার চিমটেটা ওইখানে আছে, ওটা দিয়ে আইভরি কৌটোটা তুলে এনে রাখো কাগজপত্তরের ওপর।… বাঃ, বাঃ, বেশ হয়েছে। এবার যাও, তেরো নম্বর লোয়ার বার্ক স্ট্রিট থেকে মি. কালভার্টন স্মিথকে ডেকে আনো।

    হোমসের প্রলাপ শুনে এই অবস্থায় ওকে ফেলে যাওয়া যে বিপজ্জনক, তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলাম বলেই ডাক্তার ডাকার উৎসাহ উবে গিয়েছিল আমার। যাই হোক, আগে ডাক্তারের নাম শুনে ও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছিল, এখন তবু একজনকে ডাকতে বলছে। কিন্তু এ-নাম জীবনে আমি শুনিনি। হোমসকে সে-কথা বলতে ও বললে, কী করে শুনবে বল! এ-রোগে পণ্ডিত বলতে যাঁকে বোঝায়, তিনি ডাক্তার নন মোটেই, চাষবাসের কাজ করেন সুমাত্রায়। খেত-খামারে বিচিত্র এই কালব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। ডাক্তার পাওয়া সেখানে দুষ্কর। তাই নিজেই রোগটা নিয়ে গবেষণা করেন ইনি এবং বেশ কিছু মাশুল গোনবার পর ভয়ংকর এই ব্যাধির অনেক বৃত্তান্ত সংগ্রহ করেন মি. কালভার্টন স্মিথ। এই মুহূর্তে ইনি রয়েছেন লন্ডনে। ভদ্রলোক বড়ো গোছালো মানুষ, ঘড়ি ধরে কাজ করেন, সব ব্যাপারে নিয়ম মেনে চলেন। ছ-টার আগে গেলে তাকে পেতে না বলেই বসিয়ে রেখেছিলাম তোমাকে। রোগটা নিয়ে উনি শখের খাতিরে গবেষণা করছেন বলেই তোমাকে পাঠাচ্ছি তার কাছে। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যেভাবেই হোক তাকে নিয়ে এসো আমার কাছে।

    কী কষ্টে যে এতগুলো কথা বলে গেল হোমস, চোখে না-দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না। হাঁপাতে হাঁপাতে প্রত্যেকটা শব্দ দেহ আর মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে উচ্চারণ করে দু-হাতে কাঁপা আঙুল দিয়ে লেপ খামচে ধরে যেভাবে বলে গেল, তা থেকেই স্পষ্ট বুঝলাম ভেতরে ভেতরে কী সাংঘাতিক যন্ত্রণায় শেষ হয়ে আসছে শার্লক হোমস। এই দু-ঘণ্টার মধ্যে আরও অবনতি ঘটেছে ওর চেহারার চোখ আরও কোটরে বসে গেছে, অন্ধকার গর্তের মধ্যে আগের চাইতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে উভ্রান্ত দুই চক্ষু। বিন্দু বিন্দু ঘাম চকচক করছে কালচে কপালে। কথা বলছে। অবশ্য আগের মতো ঝুঁকি মেরে মেরে বাদশাহি মেজাজে। নাঃ দেখছি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওর এই নবাবি মেজাজ চালিয়ে যাবে ও, কারো কাছে মাথা নোয়বে না। ফের বললে, আমাকে যেভাবে দেখে গেলে, ঠিক সেইভাবে আমার দূরবস্থা ফুটিয়ে তুলবে ওঁর কাছে। বলবে, আমি মরতে চলেছি! শরীর বিছানায় মিশে গেছে, পাগলের মতো প্রলাপ বকছি। আমাকে যেরকম তোমার মনে হচ্ছে, তোমার কথায় তারও যেন সেইরকম মনে হয়। আহা রে, গোটা সমুদ্রটা যদি শুক্তিতে বোঝাই হত, কী মজাই না হত তাহলে! কী বলছিলাম যেন ওয়াটসন?

    মি. কালভার্টন স্মিথের কাছে গিয়ে কী বলব, তা-ই বলছিলে।

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আমার মরণ-বাঁচন নির্ভর করছে এঁর ওপর। তুমি তাঁকে বুঝিয়ে বলবে, দরকার হলে হাতে-পায়ে ধরে নিয়ে আসবে। আমার ওপর তিনি চটে আছেন। তার ভাইপোর একটা ব্যাপারে একটা বিশ্রী জিনিস আমি আঁচ করেছিলাম, শেষকালে ভয়ানকভাবে মারা যায় ছেলেটা। সেই থেকে আমার নাম পর্যন্ত সইতে পারেন না উনি। তুমি তাকে ঠান্ডা করবে। কাকুতিমিনতি করবে, হাতে পায়ে ধরবে, যেভাবেই হোক এখানে নিয়ে আসবে। আমাকে বাঁচানোর ক্ষমতা একমাত্র তারই আছে জানবে।

    আমি আশ্বাস দিলাম, ঘাবড়িয়ো না বন্ধু, দরকার হলে তাকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে আসব।

    খবরদার! হোমস শাসিয়ে উঠল, এসব করতে যেয়ো না! ওঁকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেবে, আগে চলে আসবে তুমি। একসঙ্গে এস না, পইপই করে বারণ করছি, একসঙ্গে এস না। এ-ব্যাপারে ভুল যেন না হয়। তোমার ওপর আস্থা আছে বলেই বলছি এত কথা। ঠিক যেমনটি বললাম, তেমনটি করবে। আহা রে, শুক্তিগুলোর শত্রু দেখছি বেড়েই চলেছে। সারাপৃথিবীটা যদি ওরা ছেয়ে ফেলে! না, না! কী ভয়ংকর! কী ভয়ংকর! যা বললাম, ঠিক সেইভাবে বলবে ওয়াটসন। আমি জানি, তোমাকে যা বলি, কখনো তার অন্যথা হয় না।

    পাছে বিকারের ঘোরে ফের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় হোমস, এই ভয়ে চাবিটা সঙ্গে নিয়ে এলাম। আসবার সময় দেখে এলাম একটা অসাধারণ অতুলনীয় মেধা কীভাবে কচি খোকার মতো আধো-আধো স্বরে আবোল-তাবোল বকে চলেছে আপন মনে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলাম, আচমকা উচ্চকণ্ঠে তীক্ষ্ণ্ণ সরু গলায় মন্ত্রপাঠ আরম্ভ করেছে হোমস। মিসেস হাডসনের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখলাম ভদ্রমহিলা ভয়ে দুঃখে কাঁপছেন আর কাঁদছেন।

    রাস্তায় নেমে শিস দিয়ে ভাড়াটে গাড়ি ডাকতেই কুয়াশার মধ্যে থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ও মশাই, মিস্টার হোমস আছেন কেমন?

    লোকটাকে চিনি; স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইনস্পেকটর মর্টন। এখন গেরস্তর মতো টুইডের সুট পরে হাওয়া খাচ্ছে।

    বললাম, খুবই খারাপ।

    অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইল মর্টন। আবছা আলোয় মনে হল, যেন একটা পৈশাচিক উল্লাস চকিতের জন্যে ভেসে গেল তার মুখের ওপর দিয়ে। বললে, হু গুজবও সেইরকমই।

    গাড়ি এসে গেল, উঠে বসলাম আমি।

    লোয়ার বার্ক স্ট্রিট রাস্তাটা নটিংহিল আর কেনসিংটনের মাঝামাঝি জায়গায়। সারি সারি সুন্দর বাড়ি। যে-বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াল, সেটি পুরেনো আমলের লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা বেশ জমকালো ধরনের ভাজ-করা বিরাট পাল্লাওয়ালা দরজার বাড়ি। কপাটে চকচকে তামার কারুকাজ। ঘণ্টা বাজাতেই গম্ভীরবদন বাটলার এসে কার্ড নিয়ে গেল ভেতরে। কিন্তু আমার সামান্য নাম আর খেতাব মনঃপূত হল না মি. কালভার্টন স্মিথের, আধাখোলা দরজার মধ্যে দিয়ে শুনলাম তাঁর তীক্ষ্ণ্ণ চড়া কণ্ঠস্বর, লোকটা কে? কী চায়? কতবার বলব তোমাকে, আমার কাজের সময়ে যেন কেউ বিরক্ত না-করে?

    বিড়বিড় করে কী যেন সাফাই গাইল বাটলার। কিন্তু তাতে ঠান্ডা না হয়ে আরও জ্বলে উঠলেন মি. স্মিথ, চিৎকার করে বললেন, বলে দাও, আমি বাড়ি নেই। খুব বেশি দরকার থাকলে যেন কাল সকালে আসে। যাও। কাজের সময়ে যত উৎপাত।

    আবার বিড়বিড় করে কী যেন বলল বাটলার।

    যা বললাম, তা-ই বলো গিয়ে। কাল সকালে যেন আসে। কাজের সময় ঝগড়া আমি পছন্দ করি না।

    আমার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল হোমসের ছটফটানি, রোগযন্ত্রণা, প্রলাপের ঘোরে উন্মত্ত আচরণ। মিনিটে আয়ুক্ষয় হচ্ছে তার, মিনিটে মিনিটে সে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর দিকে। এখন আর সৌজন্য বা শিষ্টাচার দেখাবার সময় নয়। মি. স্মিথের ধমকে জবুথবু বাটলার এসে পৌঁছোনোর আগেই আমি পেয়ে গেলাম তার পাশ দিয়ে সোজা ভেতরের পড়ার ঘরে।

    আগুনের পাশে রাখা চেয়ার থেকে ভীষণ রাগের আতীক্ষ্ণ চিৎকার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এক ব্যক্তি। হলদে মুখ, চামড়ায় অজস্র ভাজ, ভারী দু-পাটকরা তেলতেলে চিবুক। ঝোঁপের মতো ঘন বালিরঙা একজোড়া ভুরুর তলা থেকে দুটো পিলেচমকানো ধূসর চোখের গনগনে চাহনি যেন পলকের মধ্যে দগ্ধ করে দিতে চাইল আমার নশ্বর দেহকে। লোকটার মাথায় বিরাট টাকের ওপর হেলিয়ে বসানো একটা ভেলভেটের টুপি। মগজের সাইজ নিঃসন্দেহে প্রকাণ্ড, করোটির সাইজেই তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু অবাক হলাম সেই অনুপাতে তাঁর ছোট্ট ধড়টা দেখে। হাত-পা লিকলিকে, ছেলেবেলায় যেন রিকেটি রোগে ভুগে ডিগডিগে হয়ে গিয়েছেন।

    বিষম বিকট আর্ত চিৎকারের ধরনে উনি বললেন, মানেটা কী? কে বলেছে আপনাকে এভাবে ঘরে ঢুকতে? বলে পাঠালাম না কাল সকালে আসবেন?

    দুঃখিত। সময় একদম নেই। মি. শার্লক হোমস–

    নামটা শোনার সঙ্গেসঙ্গে অসাধারণ পরিবর্তন এল লোকটার চোখে-মুখে, মিলিয়ে গেল ক্রোধের অভিব্যক্তি, নিমেষ মধ্যে টানটান হয়ে গেল মুখের প্রতিটি রেখা। আমায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, হোমসের কাছ থেকে আসছেন নাকি?

    সোজা আসছি সেখান থেকে।

    আছে কীরকম?

    মরতে চলেছে। ভীষণ অসুখ। সেইজন্যেই এসেছি।

    হাত নেড়ে আমাকে বসতে হলে নিজেও বসলেন ভদ্রলোক। বসতে গিয়ে তাঁর মুখটা অন্যদিকে একটু ঘুরে গিয়েছিল বলে উলটোদিকে আয়নায় দেখতে পেলাম হলদে মুখের প্রতিফলন। চোখের ভুল নিশ্চয়ই অবিশ্বাস্য রকমের পৈশাচিক একটা উল্লাস ফুটে উঠতে দেখলাম যেন সে-মুখের পরতে পরতে। চোখের ভুলই, কেননা পরমুহূর্তেই যখন আমার দিকে ফিরলেন, তখন তার মুখের চেহারায় দেখলাম আত্যন্তিক উদবেগের অভিব্যক্তি। বললেন, খুবই দুঃসংবাদ। হোমসের সঙ্গে কর্মসূত্রে একবার আলাপ হয়েছিল আমার। ওর ধীশক্তি, ওর চরিত্রকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি যেমন অসুখবিসুখের শখের গবেষণা নিয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলেছি, হোমস তেমনি হাজারো অপরাধ নিয়ে শখ মিটিয়ে চলেছে। ওর জীবনের লক্ষ্য দুনিয়ার পাপীকে খাঁচায় পোরা, আমার জীবনের লক্ষ্য জীবাণুদের সবংশে ধ্বংস করা। ওই দেখুন, ওদের জন্যে কেমন খাঁচা বানিয়ে রেখেছি।

    একটা টেবিলে সারি সারি সাজানো বোতল আর বয়েম দেখিয়ে উনি বললেন, দুনিয়ার অত্যন্ত জঘন্য কয়েকটা জীবাণু কীরকম প্রায়শ্চিত্ত করছে দেখুন জিলেটিনের মধ্যে।

    এই কারণেই আপনার সাহায্য চায় হোমস। লন্ডন শহরে আপনি ছাড়া এ-ব্যাপারে বড়ো বিশারদ আর দ্বিতীয় নেই। আপনার ওপর অসীম শ্রদ্ধা আর আস্থা আছে বলেই ও পাঠিয়েছে

    আমাকে।

    চমকে উঠলেন খুদে ব্যক্তি, টাক মাথা থেকে ভেলভেটের টুপিখানা সুড়ুৎ করে পিছলে পড়ে গেল মেঝেতে। বললেন, আমার সাহায্য চায় হোমস, আঁ? সে আবার কী কথা? ওকে আমি সাহায্য করব কী করে তা কি বলেছে হোমস?

    প্রাচ্যরোগে আপনার বিশেষ জ্ঞান আছে বলেই সাহায্য করতে পারবেন।

    কিন্তু রোগটা প্রাচ্যমুলুক থেকে নিয়ে এসেছে, এমন ধারণাটা তার হল কেন?

    জাহাজঘাটায় কিছু প্রাচ্যদেশীয় খালাসির সঙ্গে একটা তদন্ত নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল হোমসকে, তখনই সংক্রামিত হয়েছে রোগটা।

    প্রসন্ন হেসে মেঝে থেকে টুপিটা কুড়িয়ে নিলেন স্মিথ। বললেন, তা-ই নাকি? তা, ভুগছে কদ্দিন?

    দিন তিনেক।

    প্রলাপ বকছে কি?

    মাঝে মাঝে।

    আরে সর্বনাশ! এ-অবস্থায় ওর পাশে না-যাওয়াটা জানোয়ারের মতো কাজ হবে। যদিও কাজের ক্ষতি হবে আমার, তাহলেও আপনার সঙ্গে আমি যাব ডক্টর ওয়াটসন।

    হোমসের নিষেধাজ্ঞা মনে পড়ল আমার। বললাম, আমার আর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

    তাহলে আমি নিজেই যাচ্ছি, ঠিকানা কাছেই আছে। আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।

    বুকভরা হতাশা নিয়ে ফিরলাম বেকার স্ট্রিটের বাসায়। ভেবেছিলাম, এইটুকু সময়ের মধ্যেই নিশ্চয়ই হোমসের আরও সাংঘাতিক অবনতি দেখব। কিন্তু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম ওর অবস্থার উন্নতি হয়েছে দেখে। চেহারা আগের মতোই বিবর্ণ, কিন্তু প্রলাপ আর বকছে না। কথা বলল খুব ক্ষীণ কণ্ঠে স্বভাবমতো রসিয়ে রসিয়ে, দেখা হল, ওয়াটসন?

    হয়েছে। আসছেন উনি।

    চমৎকার! তুমিই আমার সেরা দূত।

    উনি আমার সঙ্গেই আসতে চেয়েছিলেন।

    অসম্ভব! তা হতেই পারে না। রোগটা জুটিয়েছি কোত্থেকে জানতে চাননি?

    উত্তরে আমি যা বলেছি তা জানাতে হোমস সোল্লাসে বললে, ঠিক বলেছ! ওয়াটসন, খাঁটি বন্ধুর কাজ করে এলে। এবার সরে পড়ো।

    হোমস, ওঁর মতামতটা শুনে তারপর যাব।

    নিশ্চয়ই শুনবে। তবে কী জান, উনি প্রাণ খুলে মতামত প্রকাশ করবেন শুধু আমার সাক্ষাতে। অন্য কেউ থাকলে মন খুলে কথা বলবেন না বলেই জানি। আমার এই খাটের মাথার দিকে একটা ছোট্ট ঘর আছে, ওইখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকো।

    হোমস! কী আবোল-তাবোল বকছ!

    যা বলছি, তা-ই করো। ঘরটা লুকিয়ে থাকার উপযুক্ত নয় বলেই উনি সন্দেহ করবেন না ওখানে কেউ আছে বলে। এ ছাড়া আর উপায় নেই, ওয়াটসন।

    বলতে বলতে আচম্বিতে সটান উঠে বসে হোমস বললে চাপা তীক্ষ্ণ্ণ গলায়, গাড়ির চাকার আওয়াজ শুনছি। এসে গেলেন বলে। যাও, ওয়াটসন, যাও! সত্যিই যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো, যাও, গিয়ে লুকিয়ে পড়ো! কুইক! শুধু কান খাড়া করে শুনে যাবে, যা-ই ঘটুক না কেন, একটা কথাও বলবে না। মনে থাকে যেন, শুধু শুনবে, নড়বে না, কথা বলবে না!

    বলেই হোমস ঝপ করে পড়ে গেল বিছানায়। আচমকা উত্তেজনার পরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজ্যের অবসাদ। আবার শুরু হল তার বিড়বিড় প্রলাপ বকুনি।

    লাফ দিয়ে কোনোমতে লুকিয়ে পড়লাম ছোট্ট খুপরিটার মধ্যে। সিঁড়িতে শোনা গেল পায়ের আওয়াজ, শোবার ঘরের দরজা খুলল এবং বন্ধ হল। তারপর আর শব্দ নেই, নৈঃশব্দ্যের মধ্যে কেবল হাপরের মতো হাঁপানির আওয়াজ… মুমূর্মুর শ্বাসটানার চেষ্টা! বেশ বুঝলাম, খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হোমসের দিকে চেয়ে আছেন মি. স্মিথ। একটু বাদেই ভঙ্গ হল নীরবতা। উচ্চকণ্ঠে বললেন দর্শনার্থী, হোমস! হোমস! শুনতে পাচ্ছ? হোমস!

    ঠিক যেন ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে অর্ধ অচেতন মুমূর্ষুর ঘোর কাটানোর চেষ্টা, সেই রকমই খসখস আওয়াজও শুনলাম।

    ফিসফিস করে হোমস বললে, মি. স্মিথ, আপনি! আমি ভেবেছিলাম আপনি আসবেন না।

    হেসে উঠলেন স্মিথ, তা অবশ্য ঠিক। তবু দেখ, এসেছি। কয়লার আগুন, হোমস, কয়লার আগুন।

    আপনার অসীম দয়া। আপনাকে আমি সমীহ করি আপনার বিশেষ কাজের জন্যে।

    চাপা হাসি হেসে উঠলেন মিস্টার স্মিথ। বললেন, বটে! এ-খবর কিন্তু লন্ডনের একজনই রাখে–তুমি। জান কী হয়েছে তোমার?

    সেই রোগ?

    আচ্ছা! লক্ষণগুলো চিনতে পেরেছ তাহলে?

    হাড়ে হাড়ে।

    হোমস, তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছ। লক্ষণ সেই একই। ভিক্টর বেচারা চারদিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এশিয়ার কালব্যাধি লন্ডনের বুকে একজনকে শেষ করে দেয় কীভাবে ভেবে খুবই অবাক হয়েছিলে তুমি, বিশেষ করে যে-রোগ নিয়ে শুধু আমিই বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছি। তবে কী জান, রোগটার উৎপত্তি আর পরিণতি নিয়ে মন্তব্য প্রকাশ করতে গিয়েই তুমি মরেছ।

    আমি তো জানি, ভিক্টরকে আপনিই শেষ করেছেন।

    জান নাকি? এতই যদি জান, তত ফের আমাকে ডেকেছ কেন বাঁচবার জন্যে? আমার সম্বন্ধে কুৎসা রটিয়ে ফের পায়ে ধরে ডেকে এনেছ কেন শুনি? মতলবটা কী?

    রুদ্ধ নিশ্বাসে খাবি খেতে খেতে হোমস বললে, একটু জল দিন!

    আর বেশি দেরি নেই তোমার। কিন্তু কাজের কথাটা শেষ হওয়ার আগে তোমাকে মরতে দিতে চাই না বলেই জল দিচ্ছি। উঁহু, ঢকঢক করে খেয়ো না, একটু খাও।–ঠিক আছে। কী বললাম বুঝেছ?

    গুঙিয়ে উঠল হোমস। বলল ফিসফিস করে, আমাকে বাঁচান! কথা দিচ্ছি, এ নিয়ে আর কোনো কথা বলব না। আমাকে সারিয়ে তুলুন, দেখবেন, সব ভুলে গেছি।

    কী ভুলে যাবে?

    ভিক্টর স্যাভেজের মৃত্যু। মৃত্যুর কারণ যে আপনি, এইমাত্র নিজের মুখেই তা স্বীকার করেছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওসব কথা আর মনে রাখব না।

    কাঠগড়ায় সাক্ষী হয়ে এ-জীবনে আর তোমাকে দাঁড়াতে হবে না। কাজেই তুমি মনে রাখলে কি রাখলে না, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কীভাবে মারা গেছে আমার ভাইপো, তা নিয়েও আমার মাথাব্যথা নেই। আমার যত মাথাব্যথা, শুধু তোমার জন্যে, বুঝেছ, শুধু তোমার জন্যে।

    আমি জানি, আমার জন্যে।

    নিজের ব্রেন নিয়ে অহংকারে মটমট কর বলেই আজ তোমার এই অবস্থা। তোমার ধারণা, তোমার মতো ধারালো মগজ দুনিয়ায় আর কারো নেই। বড্ড স্মার্ট মনে কর নিজেকে। প্রাচ্যদেশীয় খালাসিদের মারফত সংক্রামিত হওয়া ছাড়াও এ-রোগ তোমার শরীরে ঢুকতে পারে ভেবে দেখেছ কি?

    ভাববার শক্তি আর নেই। আমাকে বাঁচান!

    এখনও বাঁচতে চাও! মরবার আগে বরং জেনে যাও কোত্থেকে জীবাণুটা ঢুকল তোমার শরীরে।

    বড় যন্ত্রণা হচ্ছে! যা হয় একটা ওষুধ দিন!

    তা-ই নাকি? খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। কুলিগুলোও শেষের দিকে ইঁদুরের মতো চি-চি করত। হাতে-পায়ে খিচ ধরছে, তাই-ই না?

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, খিঁচ ধরছে!

    ধরুক, কিন্তু কানে তো খিঁচ ধরেনি, কথা এখনও শুনতে পাচ্ছ। এখন যা বলি শোনো। রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ঠিক আগে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা মনে পড়ে?

    না তো।

    ভালো করে ভেবে দেখো।

    ভাববার মতো মাথা আর নেই। বড্ড কষ্ট হচ্ছে।

    বেশ, বেশ, তাহলে আমিই বরং ধরিয়ে দিচ্ছি। ডাকযোগে কিছু পেয়েছিলে?

    ডাকযোগে?

    ধর একটা কৌটো?

    মনে করতে পারছি না… জ্ঞান হারাচ্ছি… উঃ, মা গো!

    হোমস! হোমস! আমার কথা শোনো।

    স্পষ্ট শুনলাম, মুমূর্ষু হোমসকে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকুনি দেওয়া হচ্ছে। কী কষ্টে যে হাত পা গুটিয়ে বসে রইলাম, তা শুধু আমিই জানি।

    স্মিথের গলা ভেসে এল, আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। হাতির দাঁতের একটা কৌটোর কথা মনে পড়ছে? বুধবার ডাকপিয়োন এসে দিয়ে গিয়েছিল। তুমি খুলেছিলে, মনে পড়ছে?

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুলেছিলাম বটে। ভেতরে একটা ছুঁচোলো স্প্রিং ছিল। ইয়ার্কি করে কেউ নিশ্চয়ই–

    ইয়ার্কি নয় হে, ইয়ার্কি নয়। জীবন দিয়ে এখুনি সেটা টের পাবে। মাথায় তোমার গোবর আছে বলেই বুঝতে পারনি, এমনি ইডিয়ট তুমি। এই বুদ্ধি নিয়ে আমাকে ঘাঁটাতে এসেছিলে কোন সাহসে? তেমনি দিয়েছি পালটা মার!

    আবার খাবি খেতে খেতে হোমস বললে, হ্যাঁ,হা, মনে পড়েছে! কৌটো খুলতেই স্প্রিংয়ের খোঁচায় আঙুল থেকে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল। এই তো সেই কৌটো টেবিলেই রয়েছে।

    হ্যাঁ এই সেই কৌটো। থাক এটা আমার পকেটে। সঙ্গে নিয়ে যাব, কোনো প্রমাণ আর থাকবে না। ভিক্টরের মৃত্যু সম্পর্কে বেশি খবর জেনে ফেলেছিলে বলেই তোমাকে মরণ দাওয়াই দিতে হল আমাকে। আর বেশিক্ষণ আয়ু নেই তোমার। শেষ নিশ্বাসটা দেখে তারপর যাব। বসে বসে দেখে যাই কীভাবে অক্কা পাও তুমি।

    এবার হোমসের কণ্ঠস্বর এত ক্ষীণ হয়ে গেল যে, না-শোনারই শামিল। স্মিথ বললেন, কী বললে? গ্যাসের আলো বাড়িয়ে দেব? চোখে অন্ধকার দেখছ বুঝি? শুরু হয়ে গেছে তাহলে। বেশ, বেশ, আলো বাড়িয়ে দিচ্ছি।

    পায়ের আওয়াজ গেল জানলার কাছে, তারপর হঠাৎ জোরালো আলো দেখা গেল ঘরে, সেইসঙ্গে ভেসে এল স্মিথের গলা, বলো, বন্ধু, বলো, শেষ মুহূর্তে তোমার আর কী সেবায় লাগতে পারি বলে ফেলো।

    সিগারেট আর দেশলাইটা দিন।

    আর একটু হলেই বিস্ময়ে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতাম আমি। একটু কাহিল গলায় হলেও বেশ স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে হোমস। এ-স্বর আমি চিনি। বেশ কিছুক্ষণ থমথমে হয়ে রইল, কোনো শব্দ নেই। বেশ বুঝলাম, বিষম অবাক হয়ে হাঁ করে হোমসের দিকে চেয়ে আছেন মি. কালভার্টন স্মিথ।

    তার পরেই শুনলাম তাঁর শুষ্ক কাটা-কাটা কণ্ঠস্বর, এর মানে কী?

    স্রেফ অভিনয়। অভিনয়টা মর্মস্পর্শী করার জন্যে অবশ্য গত তিনদিন জল বা খাবার কিছুই খাইনি। আপনার হাত থেকে ওই প্রথম একটু জল খেলাম। তবে কী জানেন, ধুমপানটা আমার কাছে আরও উপাদেয়। এই তো পেয়েছি সিগারেট।

    দেশলাইয়ের কাঠি জ্বলে ওঠার আওয়াজ পেলাম। তারপরই হোমসের গলার আওয়াজ, আঃ কী আরাম! আরে, আরে! পুরোনো বন্ধুর পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি মনে হচ্ছে!

    পায়ের আওয়াজ শোনা গেল বাইরে, খুলে গেল দরজা, কে যেন ঘরে ঢুকল ভারী বুটের আওয়াজ তুলে।

    হোমস বললে, মর্টন, এই তোমার আসামি।

    ইনস্পেকটর মর্টন রুটিনমাফিক গাওনা গাইল, মি. স্মিথ, ভিক্টর স্যাভেজকে খুন করার অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করছি।

    খুক খুক করে হেসে উঠল হোমস। বললে, সেইসঙ্গে আর একটা চার্জ জুড়ে দিয়ে হে, শার্লক হোমসকে খুন করার চেষ্টাও ইনি করেছিলেন। তবে মুমুর্মুর মুখ চেয়েই বোধ হয় মি. কালভার্টন স্মিথ একটা উপকারও করেছেন, নিজেই গ্যাসের আলো বাড়িয়ে সিগন্যাল দিয়ে ডেকে এনেছেন তোমাকে। ওঁকে তাই আগে ভারমুক্ত করো। ওঁর কোটের ডান পকেটে একটা ছোট্ট কৌটো আছে, আগে ওটা বার করে নাও, ধন্যবাদ! এখানে রাখো কৌটোটা, নাড়াচাড়া করতে যেয়ো না, মারা পড়বে। কোর্টে মামলা উঠলে কৌটোটা কাজে লাগবে।

    আচমকা ধাবমান পদশব্দ, ধস্তাধস্তি, লোহায় লোহায় ঠোকাঠুকির ঝনৎকার এবং যন্ত্রণাবিকৃত চিৎকার শোনা গেল।

    ইনস্পেকটর বললে, খামোখা মার খেয়ে মরছেন, সিধে হয়ে দাঁড়ান।

    কড়াং করে আওয়াজ হল হাতকড়া লাগিয়ে দেওয়ার।

    হিংস্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন স্মিথ, খুব ফাঁদে ফেললে দেখছি! হোমস, কাঠগড়ায় শেষ পর্যন্ত তোমাকেই উঠতে হবে, আমাকে নয়। রোগ সারানোর নাম করে ডেকে এনে পাগলের মতো যা-তা বলে আমাকে ফাসাতে যেয়ো না, বিপদে পড়বে। মিথ্যে সন্দেহকে গল্প বানিয়ে প্রমাণ করা যায় না, পাগলের প্রলাপ বলবে সবাই।

    আরে ওয়াটসন ফে! আমি বেরিয়ে আসতে সোল্লাসে বললে হোমস, কী ভুলো মন দেখেছ আমার, তোমার কথা একদম খেয়ালই ছিল না। ভায়া, এক হাজার এক বার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। মি. স্মিথের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আর দরকার আছে কি? আজ বিকেলেই তো সে-পালা চুকিয়ে এসেছ। গাড়ি আছে তো নীচে? মহামান্য অতিথিকে নিয়ে তোমরা এগোও, আমি জামাকাপড় পালটে যাচ্ছি। থানায় আমার থাকা দরকার।

    মুখ-হাত পোয়র ফাঁকে ফাঁকে এক গেলাস ব্র্যান্ডির সঙ্গে খানকয়েক বিস্কুট খেয়ে নিয়ে হোমস বললে, আঃ বাঁচলাম। এমনিতে বড়ো অগোছালো আমি, তার ওপর এত বড় ধকল গেলে শরীরপাত হয়ে যাবে। অথচ দেখ, এসব না-করলেও চলত না। মিসেস হাডসনকে যদি বিশ্বাস করাতে না-পারতাম যে মরতে চলেছি, তোমাকে ঠিক সেইভাবে উনি বোঝাতে পারতেন না। তোমার মনে সেই বিশ্বাস আনতে না-পারলে ধুরন্ধর স্মিথকে তুমি এখানে আমার খপ্পরে টেনে আনতে পারতে না। আমি জানতাম, নিজের কীর্তি স্বচক্ষে দেখবার জন্যে ছুটে সে আসবেই। এত লুকোচুরির জন্যে ভাই কিছু মনে কোরো না। তোমার ওপর আমার প্রচণ্ড আস্থা, তোমার বিদ্যেবুদ্ধির ওপর আমার দারুণ ভরসা।

    কিন্তু হোমস, তোমার মুখটা ওইরকম বীভৎস ফ্যাকাশে হল কী করে?

    তিনদিন পেটে দানাপানি না-পড়লে কেউই খুব সুস্থ থাকে না। বাকিটুকু সাজাতে একটা স্পঞ্জই যথেষ্ট। কপালে একটু ভেসলিন, চোখে বেলেডোনা, গালের হাড়ে রুজ আর ঠোঁটের কোণে একটু মোম, ব্যস, যে কেউ আঁতকে উঠবে সেই চেহারা দেখলে। বুঝলে, ধোঁকা দেওয়াও একটা আর্ট। মাঝে মাঝে আধক্রাউন আর শুক্তি নিয়ে বকবকানি জুড়ে দিলে মনে হবে, ঠিক যেন প্রলাপ বকুনি। ছলনা-শিল্প নিয়ে একটা প্রবন্ধ লেখবার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের।

    বেশ, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু সত্যিই যখন ছোঁয়াচে রোগ হয়নি তোমার, তখন আমাকে কাছে ঘেঁষতে দিলে না কেন?

    কৃত্রিম হতাশায় কপালে কপট করাঘাত করে হোমস বললে, হায় রে, তাও কি আমাকে বলে দিতে হবে! চার ফুট দূর থেকে আমি ধোঁকা দিতে পারি একজন ঝানু ডাক্তারকে, কিন্তু আমার গায়ে হাত দিলে কি সঙ্গেসঙ্গে ধরা পড়ে যেতাম না? জ্বর কোথায় আমার? নাড়ি তো অচঞ্চল! মুমূষুর মতো অবস্থা যে আমার নয়, তা তো গায়ে হাত দিলেই বোঝা যায়। তোমার মনে অবিশ্বাস এসে গেলে ধড়িবাজ স্মিথকে বিশ্বাস করিয়ে আমার খপ্পরে কি নিয়ে আসতে পারতে? তুমি কি ভাব, তোমার ডাক্তারি বিদ্যেবুদ্ধির উপর আমার সত্যিই অশ্রদ্ধা আছে? তোমাকে কি আমি চিনি না? উঁহু ওয়াটসন, কৌটোয় হাত দিয়ো না। পাশ থেকে ডালাটা সামান্য ফাঁক করে দেখতে পার, বিষধর সাপের দাঁতের মতো স্প্রিংয়ের ডগাটা উঁকি দিচ্ছে কোনখান থেকে, তার বেশি নয়। ঠিক এই কায়দায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে স্যাভেজ বেচারাকে, এই পিশাচটার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মাশুল সে দিয়েছে নিজের জীবন দিয়ে! অনেকরকম চিঠিপত্র আসে আমার কাছে, তাই প্যাকেট খোলার সময় আমি হুঁশিয়ার থাকি। কিন্তু আমি শয়তানটাকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলাম যে, সত্যি সত্যিই যেন ওর মরণ-মারে ঘায়েল হয়েছি, যাতে উল্লাসের চোটে বাহাদুরি নিতে গিয়ে নিজের মুখেই স্বীকার করে নিজের কীর্তি। তা অভিনয়টা কীরকম করেছি বল? পাকা শিল্পীর মতোই ছলনার প্যাঁচে কুপোকাত করে ছেড়েছি মহাপাপিষ্ঠ এক শয়তানকে। ধন্যবাদ ওয়াটসন, নাও, কোটটা পরিয়ে দাও। থানার কাজ শেষ হলে সিম্পসনের রেস্তোরাঁয় গিয়ে পুষ্টিকর কিছু খাবার আহার করে আসা যাবেখন।

    ———-

    টীকা

    শার্লক হোমসের মৃত্যুশয্যায় : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ডাইং ডিটেকটিভ ১৯১৩-র ডিসেম্বর সংখ্যার স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়।

    টাকাকড়ি দেওয়ার ব্যাপারে রাজারাজড়ার মতো দিলখোলা হোমস : এ স্টাডি ইন স্কারলেট উপন্যাসে দেখা গিয়েছিল একা ভাড়া গুনতে না-পারায় বাড়িতে অন্য ভাড়াটে এনে অর্থ সাশ্রয় করতে চেষ্টা করছেন শার্লক হোমস। বোঝা যায় যে এই ক-বছরে যথেষ্ট সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন বিশ্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দাটি। তবে সেই সময়ে অর্থনৈতিক দূরবস্থা ছিল বলেই হোমস-ওয়াটসনের সাক্ষাৎ হয় এবং শার্লক হোমসের কীর্তিকলাপ গোচরে আসে সাধারণ মানুষের।

    সুমাত্রা : ইন্দোনেশিয়ার বৃহত্তম দ্বীপ সুমাত্রার দখল ঊনবিংশ শতকের প্রায় সম্পূর্ণ জুড়ে লড়াই চলে ইংরেজ এবং ওলন্দাজদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ওলন্দাজরা এখানে তাদের অধিকার কায়েম করতে সক্ষম হয়।

    কুলি : হিন্দিতে কুলি শব্দের অর্থ মজুর, তামিল ভাষায় মজুরি। অর্থাৎ শব্দটি খাঁটি ভারতীয় এবং ইংলন্ডে এশীয় বা আফ্রিকান মজুরদের বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করা হত। সম্ভবত ১৮৪০-এ ক্রীতদাস-প্রথা রদ হওয়ার পর এশিয়া বা আফ্রিকা থেকে কম মজুরির শ্রমিক আনা শুরু হয়। এদের নিয়ে আসা হত পাঁচ বা তার বেশি বছরের চুক্তিতে। এদের নিয়ে আসা বা বসবাসের ব্যবস্থা যেভাবে করা হত, তা ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর এবং তার ফলে বহু মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হত। পরের দিকে এইভাবে কুলি নিয়ে আসার ওপর বাধানিষেধ আরোপ করতে শুরু করে বিভিন্ন দেশ।

     

    জীবনে নাম শুনিনি : দুটি অসুখের নামই কাল্পনিক।

    ইঞ্জেকশন নেওয়ার সিরিঞ্জ : নিশ্চয়ই কোকেন সেবন করবার জন্য রাখা ছিল।

    কয়লার আগুন : সম্ভবত বাইবেলে সেন্ট পলের উক্তির উদ্ধতি : … for ।n so do।ng thou shalt heap coals of f।re on h।s head. (রোমানস ১২: ২১)।

    আরে ওয়াটসন যে : লুকোনো সাক্ষী রেখে অপরাধীকে দিয়ে দোষ কবুল করানোর ঘটনা দেখা গিয়েছে দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য মাজারিন স্টোন গল্পে।

    বেলেডোনা : বেলেডোনা বা নাইটশেড এক ধরনের বিষাক্ত ভেষজ। লালচে গাছড়ায় জন্মানো কালো জাম-গোছের ফলের সুগন্ধী রস থেকে বেলেডোনা আহরিত হয়। অ্যাট্রোপিন সালফেট জাতীয় ওষধি তৈরি হয় এই রস থেকে।

    মোম : সে-যুগের ইংলন্ডে মোম লাগিয়ে গোঁফ চকচকে এবং শক্ত রাখার প্রচলন ছিল।

    সিম্পসনের রেস্তোরাঁ : লন্ডনের স্ট্র্যান্ডে স্যামুয়েল রীসের ১৮২৮-এ প্রতিষ্ঠা করা গ্র্যান্ড সিগার ডিভান, ক্রমে একটি কফির দোকানে পরিণত হয়। তা ছাড়া, এখানকার পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে এটি একটি দাবা খেলার আড়াও হয়ে ওঠে অচিরে। ১৮৪৮-এ এর অংশীদার হিসেবে যোগ দেন বিখ্যাত খাদ্য পরিবেশক বা ক্যাটারার, জন সিম্পসন এবং এর নতুন নাম হয় সিম্পসন্স গ্র্যান্ড সিগার ট্যাভার্ন। বেঞ্জামিন ডিসরেইলি, উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন, চার্লস ডিকেন্স প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল এই আড্ডায়।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ – আরিফ আজাদ
    Next Article শার্লক হোমস সমগ্র ১ – অনুবাদ : অদ্রীশ বর্ধন

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }