Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শিউলিমালা – কাজী নজরুল ইসলাম

    কাজী নজরুল ইসলাম এক পাতা গল্প86 Mins Read0

    জিনের বাদশা

    জিনের বাদশা

    ফরিদপুর জেলায় ‘আরিয়ল খাঁ’ নদীর ধারে ছোট্ট গ্রাম। নাম মোহনপুর। অধিকাংশ অধিবাসীই চাষি মুসলমান। গ্রামের একটেরে ঘরকতক কায়স্থ। যেন ছোঁয়াচের ভয়েই ওরা একটেরে গিয়ে ঘর তুলেছে।

    তুর্কি ফেজের উপরের কালো ঝাণ্ডিটা যেমন হিন্দুত্বের টিকির সাথে আপস করতে চায়, অথচ হিন্দুর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারে না, তেমনই গ্রামের মুসলমানেরা কায়স্থপাড়ার সঙ্গে ভাব করতে গেলেও কায়স্থ-পাড়া কিন্তু ওটাকে ভূতের বন্ধুত্বের মতোই ভয় করে।

    গ্রামের মুসলমানদের মধ্যে চুন্নু ব্যাপারী মাতব্বর লোক। কিন্তু মাতব্বর হলেও সে নিজে হাতেই চাষ করে। সাহায্য করে তার সাতটি ছেলে এবং তিনটি বউ। কেন যে সে আর একটি বউ এনে সুন্নত আদায় করেনি, তা সে-ই জানে। লোকে কিন্তু বলে, তার তৃতীয় পক্ষটি একেবারে ‘খর-দজ্জাল’ মেয়ে। এরই শতমুখী অস্ত্রের ভয়ে চতুর্থ পক্ষ নাকি ও-বাড়ি মুখো হতে পারেনি। এর জন্য চুন্নু ব্যাপারীর আপশোশের আর অন্ত ছিল না। সে প্রায়ই লোকের কাছে দুঃখ করে বলত, ‘আরে, এরেই কয় – খোদায় দেয় তো জোলায় দেয় না! আল্লা মিয়াঁ তো হুকুমই দিছেন চারড্যা বিবি আনবার, তা কপালে নাই, ওইব কোহান থ্যা!’ বলেই একটু ঢোক গিলে আবার বলে, ‘ওই বিজাত্যার বেডিরে আন্যাই না এমনডা ওইল!’ বলেই আবার কিন্তু সাবধান করে দেয়, ‘দেহিয়ো বাপু, বারিত গিয়া কইয়্যা দিয়ো না। হে বেডি হুনল্যা এক্কেরে দুপুর‍্যা মাতম লাগাইয়া দিব!’

    এই তৃতীয় পক্ষেরই তৃতীয় সন্তান ‘আল্লারাখা’ আমাদের গল্পের নায়ক। গল্পের নায়কের মতোই দুঃশীল, দুঃসাহসী, দুঁদে ছেলে সে। গ্রামে কিন্তু এর নাম ‘কেশরঞ্জন বাবু’। এ নাম এর প্রথম দেয় ওই গ্রামের একটি মেয়ে। নাম তার ‘চান ভানু’ অর্থাৎ চাঁদ বানু। সে কথা পরে বলছি।

    চুন্নু ব্যাপারীর তৃতীয় পক্ষের দুই-দুইবার মেয়ে হবার পর তৃতীয় দফায় যখন পুত্র এল, তখন সাবধানী মা তার নাম রাখলে আল্লারাখা। আল্লাকে রাখতে দেওয়া হল যে ছেলে, অন্তত তার অকালমৃত্যু সম্বন্ধে – আর কেউ না হোক মা তার নিশ্চিন্ত হয়ে রইল। আল্লা হয়তো সেদিন প্রাণ ভরে হেসেছিলেন। অমন বহু ‘আল্লারাখা’কে আল্লা ‘গোরস্থান-রাখা’ করেছেন, কিন্তু এর বেলায় যেন রসিকতা করেই একে সত্যিসত্যিই জ্যান্ত রাখলেন! মনে মনে বললেন, ‘দাঁড়া, ওকে বাঁচিয়ে রাখব, কিন্তু তোদের জ্বালিয়ে মেরে ছাড়ব!’ সে পরে মরবে কিনা জানি না, কিন্তু এই বিশটে বছর যে সে বেঁচে আছে, তার প্রমাণ গাঁয়ের লোক হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। তার বেঁচে থাকাটা প্রমাণ করার বহর দেখে গাঁয়ের লোক বলাবলি করে, ও গুয়োটা আল্লারাখা না হয়ে যদি মামদোভূত হত, তা হলেও বরং ছিল ভালো। ভূতেও বুঝি এত জ্বালাতন করতে পারে না!

    ওকে মুসলমানরা বলত, ‘ইবলিশের পোলা’, কায়েতরা বলত, ‘অমাবস্যার জম্মিৎ!’ বাপ বলত, ‘হালার পো’, মা আদর করে বলত – ‘আফলাতুন!’

    এইবার যে মেয়েটির কল্যাণে ওর নাম কেশরঞ্জন বাবু হয়, সেই চানভানুর একটু পরিচয় দিই।

    মেয়েটি ওই গাঁয়েরই নারদ আলি শেখের। নারদ আলি নামটা হিন্দু-মুসলমান মিলনের জন্য রাখা নয়। নারদ আলি অসহযোগ আন্দোলনের অনেক আগের মানুষ। অসহযোগ আন্দোলন যদ্দিনের, তা ওর হাঁটুর বয়েস! বাম পায়ের হাঁটুর বয়েস! বাম পায়ের হাঁটু আর বললাম না, ওটা অতিরঞ্জন হবে!

    নারদ আলি, শেখ রামচন্দ্র, সীতা বিবি প্রভৃতি নাম এখনও গাঁয়ে দশ-বিশটে পাওয়া যায়। অবশ্য হনুমানুল্লা, বিষ্ণু হোসেন প্রভৃতি নামও আছে কিনা জানিনে।

    নারদ আলি গাঁয়ের মাতব্বর না হলেও অবস্থা ওর মন্দ নয়। যা জমি-জায়গা আছে তার, তারই উৎপন্ন ফসলে দিব্যি বছর কেটে যায়। ও কারুর ধারও ধারে না, কাউকে ধার দেয়ও না।

    দিব্যি শান্তশিষ্ট মানুষটি! কিন্তু ওর বউটি ঝগড়া-কাজিয়া না করলেও কাজিয়ার ভান করে যে মজা করে, তা অন্তত নারদ আলির কাছে একটু অশান্তিকর বলেই মনে হয়। লোক খ্যাপানো বউটার স্বভাব। কিন্তু সে রসিকতা বুঝতে না পেরে অপর পক্ষ যখন খেপে ওঠে, তখন সে বেশ কিছুক্ষণ কোঁদল করার ভান করে হঠাৎ মাঝ উঠানে ধামাচাপা দিয়ে বলে ওঠে, ‘আজ রইল কাজিয়া ধামাচাপা, খাইয়া লইয়া আই, তারপর তোরে, দেখাইব মজাডা! এই ধামারে যে খুলব, তার লল্লাটে আল্লা ভাসুরের সাথে নিকা লিখছে!’ বলেই এমন ভঙ্গির সাথে সে ধামাটা চাপা দেয়, এবং কথাগুলো বলে যে, অন্য লোকের সাথে – যে ঝগড়া করছিল সেও হেসে ফেলে! অবশ্য, রাগ তাতে তার কমে না।

    এদেরই একটি মাত্র সন্তান চানভানু। পুথির কেসসা শুনে মায়ের আদর করে রাখা নাম!

    চানভানু যেন তার মায়েরই ঈষৎ পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ! চোখে মুখে কথা কয়, ঘাটে মাঠে ছুটোছুটি করে, আরিয়ল খাঁর দল ওর ভয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে চায়!

    চোদ্দো বছর বয়স হয়ে গেল, অথচ বাপে বললেও মায়ে বিয়ের নাম করতে দেয় না। বলে, চান চলে গেলে থাকব কি করে আঁধার পুরীতে। নারদ আলি বেশি কিছু বললে বউ তার তাড়া দিয়ে বলে ওঠে, ‘তোমার খ্যাচ-খ্যাচাইবার ওইব না, আমার মাইয়্যা বিয়া বসব না – জৈগুন বিবির লাহান উয়ার হানিপ যদ্দিন না আয়ে!’

    মোহনপুরের জৈগুন বিবি – চানভানুর ‘হানিফ’ বীরের কিন্তু আসতে দেরি হল না এবং সে হানিফ আমাদের আল্লারাখা।

    একদিন হঠাৎ আল্লারাখার ‘সোনাভানের’র পুথি পড়তে পড়তে মনে হল, চানভানুই সে সোনাভানবিবি এবং সে গাজি হানিফা। তার কারণ, চানের চেয়ে সুন্দরী মেয়ে গাঁয়ে ছিল না। সে সোনাভান বিজয়ের জন্য জয়-যাত্রার চিন্তা করতে করতে পড়ে যেতে লাগল –

    ‘হানিফার আওয়াজ বিবি শুনিল যখন,
    নাসতা করিয়া নিল থোড়া আশি মন।
    লক্ষ মনের গোর্জ বিবির হাজার মনের ঢাল,
    বারো ঘোড়ায় চড়ে বলে তুলব পিঠের খাল!’

    বাপপুরে! এ যে হানিফার বাবা! এ আবার আশি মন নাশতা করে, বারোটা ঘোড়ায় এক সাথে চড়ে! চানভানুও ওই রকম কিছু করবে নাকি? আল্লারাখা রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। কিন্তু হেরে হেরেও তো হানিফাই শেষে কেল্লা-ফতে করেছিলেন! যা থাকে কপালে! আল্লারাখা তার বাবরি চুলের মাঝে একটা এবং দুদিকে দুটো – এই তিন তিনটে সিঁথি কেটে, চুলে, গায়ে, ময় জামায় বেশ করে কেশরঞ্জন মেখে, গালে বেশ করে পান ঠুসে সোনাভান ওরফে চানভানুকে জয় করতে বেরিয়ে পড়ল।

    এইখানে বলে রাখি, আমাদের আল্লারাখা পুথি পড়ে যতদূর আধুনিক হবার – তা হয়ে উঠেছিল। সে ঠিক চাষার ছেলের মতো থাকত না, পরিষ্কার ধুতি-জামা-জুতো পরে লম্বা চুলে তেড়ি কেটে, পান সিগারেট খেতে খেতে গাঁয়ের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিত এবং কার কি অনিষ্ট করবে তারই মতলব আঁটত। কিন্তু বয়স তার যৌবনের ‘ফ্রন্টিয়ার’ ক্রস করলেও মেয়েদের ওপর কোনো অত্যাচার কোনোদিন করেনি। তার টার্গেট ছিল বেশিরভাগ বুড়ো-বুড়ির দল ; বাড়ির, মাঠের ফল-ফসল ; গাছের আগা, ঘরের মটকা এবং রাত্রে বাঁশঝাড়, তেঁতুল গাছ, তালগাছ ইত্যাদি।

    অকারণে বলদ ঠ্যাঙানো বা তাদের দড়ি খুলে দিয়ে বাবাকে লোকের গাল খাওয়ানো ছাড়া বাবার চাষবাসে অন্য বিশেষ সহায়তা সে করেনি। দু-বার সে মাঠ তদারক করতে গেছিল, তাতে একবার মাঠের পাকা ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, আর একবার সমস্ত ধান কেটে অন্যের খেতে রেখে এসেছিল। এর পর তার বাবা আর তাকে সাহায্য করতে ডাকেনি।

    তার বিলাসিতার টাকা যখন তার মা একদিন বন্ধ করলে এবং বাবার কাছে চেয়েও তার বাবা যখন ওরই বদলে গড়পড়তা হিসেব করে তার পৃষ্ঠে বেশ কিছু কষে দিলে পাঁচনী দিয়ে, তখন সে বাড়ি থেকে পালিয়েও গেল না, কাঁদলেও না, কারুর কাছে কোনো অনুযোগও করলে না। সেইদিন রাত্রে চুন্নু ব্যাপারীর বাড়িতে আগুন লেগে গেল। আল্লারাখা সেই আগুনে সিগারেট ধরিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ধূম্র উদগিরণ করতে করতে যা বলে উঠল, তার মানে – আজ দিয়াশলাই কিনবার পয়সা ছিল না, ভাগ্যিস ঘরে তাদের আগুন লেগেছিল তাই সিগারেটটা ধরানো গেল!

    তার বাবা যখন আল্লারাখাকে ধরে দুরমুশ-পেটা করে পিটোতে লাগল, সে তখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মার খেতে খেতে বলতে লাগল, যে, সকালে মার খেয়ে বড্‌ডো পিঠ ব্যথা করতেই তো সে পিঠে সেঁক দেবার জন্য ঘরে আগুন লাগিয়েছে! আজ আবার যদি পিঠে বেশি ব্যথা করে, পাড়ার কারুর ঘরে আগুন লাগিয়ে ও-ব্যথায় সেঁক দিতে হবে।

    এই কবুল জবাব শুনে ওর বাবার যেটুকু মারবার হাত ছিল, তাও গেল ফুরিয়ে। সে ছেলের পায়ে মাথা কুটতে কুটতে বলতে লাগল, ‘তোর পায়ে পড়ি পোড়াকপ্যালা, হালার পো, ও-কম্মডা আর করিস নে, হক্কলেরে জেলে যাইবার অইবো যে!’ যাক, সেদিন গ্রামের লোকের মধ্যস্থতায় সন্ধি হয়ে গেল যে, অন্তত গ্রামের কল্যাণের জন্য ওর বাবা ওর বাবুয়ানার খরচটা চালাবে। আল্লারাখা গম্ভীর হয়ে সেদিন বলেছিল, ‘আমি বাপকা বেটা, যা কইবাম, তা না কইর‍্যা ছারতাম না!’ সকলে হেসে উঠল, এবং যে বাপের বেটা সে, সেই বাপ তখন ক্রোধে দুঃখে কেঁদে ফেলে ছেলেকে এক লাথিতে ভূমিসাৎ করে চিৎকার করে উঠল – ‘হুনছ নি হালার পোর কতা! হালার পো কয়, বাপকা বেডা! তোর বাপের মুহে মুতি!’ এবার আল্লারাখাও হেসে ফেললে।

    যাক- যা বলছিলাম। ধোপ-দোরস্ত হয়ে আল্লারাখা অবলীলাক্রমে নারদ আলির উঠোনে গিয়া ঠেলে উঠে ডাকতে লাগল – ‘নারদ ফুফা, বারিত আছনি গো!’ এই চির পরিচিত গলার আওয়াজে বাড়ির তিনটি প্রাণী এক সাথে চমকে উঠল! চানের মা বলে উঠল, ‘উই শয়তানের বাচ্চাডা আইছে!’

    চানভানু তখন দাওয়ায় বসে একরাশ পাকা করমচা নিয়ে বেশ করে নুন আর কাঁচা লঙ্কা ডলে পরিপূর্ণ তৃপ্তির সাথে টাকরায় টোকর দিতে দিতে তার সদ্ব্যবহার করছিল। সে তার টানা টানা চোখ দুটো বার দুয়েক পাকিয়ে আল্লারাখার তিন তেড়িকাটা চুলের দিকে কটাক্ষ করে বলে উঠল, ‘কেশরঞ্জন বাবু আইছেন গো, খাডুলিডা লইয়া আইও।’ বলেই সুর করে বলে উঠল –

    ‘এসো-কুডুম বইয়ো খাটে,
    পা ধোও গ্যা নদীর ঘাটে,
    পিঠ ভাঙবাম চেলা কাঠে!’

    বলেই হি হি করে হেসে দৌড়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল।

    আল্লারাখা এ অভিনব অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে রণে ভঙ্গ দিল। মোহনপুরের হানিফের এই প্রথম পরাজয়!

    এ কথাটা চানভানুর মায়ের মুখ হতে মুখান্তরে ফিরে গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেল। এর পর থেকেই আল্লারাখাকে দেখলে, সকলে, বিশেষ করে মেয়েরা বলে উঠত – ‘উ-ই কেশরঞ্জন বাবু আইত্যাছেন!’

    অপমান করলে চানভানু এবং আল্লারাখা তার শোধ তুললে সারা গাঁয়ের লোকের উপর। আল্লারাখা পান-সিগারেট খাইয়ে গাঁয়ের কয়েকটি ছেলেকে তালিম দিয়ে দিয়ে প্রায় তৈরি করে এনেছিল। তাদেরই সাহায্যে সে রাত্রে সে গ্রামের প্রায় সকল ঘরের দোরের সামনে যে সামগ্রী পরিবেশন করে এল, তা দেখলেই বমি আসে –শুঁকলে তো কথাই নেই!

    গ্রামের লোক বহু গবেষণাতেও স্থির করতে পারলে না, অত কলেরার রুগি কোত্থেকে সে রাত্রে গ্রামে এসেছিল! তা ছাড়া তেঁতুলপাতা খেয়ে যে মানুষর বদহজম হয়, এও তাদের জানা ছিল না। গো-বর, নর-বর ও পচানী ঘাঁটার সাথে গাঁদাল পাতার সংমিশ্রণের হেতু না হয় বোঝা গেল; কিন্তু ও মিকশচারের সাথে তেঁতুল পাতার সম্পর্ক কী? কিন্তু এ রহস্য ভেদ করতে তাদের দেরি হল না, যখন তারা দেখল – আর সব দ্রব্য অল্প আয়েসে উঠে গেলেও তেঁতুলপাতা কিছুতেই দোর ছেড়ে উঠতে চাইল না! বহু সাধ্যসাধনায় বিফলকাম হয়ে দোরের মাটি শুদ্ধ কুপিয়ে তুলে যখন তিন্তিড়ি পত্রের হাত এড়ানো গেল, তখন সকলে একবাক্যে বললে – না ; ছেলের বুদ্ধি আছে বটে! তেঁতুল পাতার যে এত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, তা সেদিন প্রথম গ্রামের লোক অবগত হল!

    সারা গ্রামে মাত্র একটি বাড়ি সেদিন এই অপদেবতার হাত থেকে রেহাই পেল। সে চানভানুদের বাড়ি। নিজের বাড়িকেও যে রেহাই দেয়নি, সে-যে কেন বিশেষ করে চানভানুরই বাড়িকে – যার ওপর আক্রোশে ওর এই অপকর্ম – উপেক্ষা করলে, এর অর্থ বুঝতে অন্তত চানভানুর আর তার মা-র বাকি রইল না!

    সে যেন বলতে চায় – দেখলে তো আমার প্রতাপ! ইচ্ছে করলেই তোমার অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারতাম, কিন্তু নিলাম না! তোমাকে ক্ষমা করলাম।

    এই কথা ভাবতে ভাবতে পরদিন সকালে চানভানু হঠাৎ কেঁদে ফেললে! ক্রোধে অপমানে তার শুক্লপক্ষের চাঁদের মতো মুখ – কৃষ্ণপক্ষের উদয়-মুহূর্তের চাঁদের মতো রক্তাভ হয়ে উঠল। তার মা মেয়েকে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে বলে উঠল, ‘চান’ কাঁদছিস কিয়ের ল্যাইগ্যা রে! তোর বাপে বকছে?’ চানভানুর বাপ-মায়ের একটি মাত্র সন্তান বলে যেমন আদুরে, তেমনই অভিমানী। তার মা মনে করলে ওর বাবা বুঝি মাঠে যাবার আগে মেয়েকে কোনো কারণে বকে গেছে।

    চান আরো কেঁদে উঠে যা বলে উঠল তার মানে – কেন আল্লারাখা তাদের এ অপমান করবে। সকলের বাড়িতে অপকর্মের কীর্তি রেখে ওদেরে বাদ দিয়ে ও গ্রামবাসীকে জানাতে চায় সে ওদের উপেক্ষা করে – ক্ষমার্হ ওরা! এর চেয়ে ওর অপমান যে ঢের ভালো ছিল!

    মা মেয়েকে অনেকক্ষণ ধরে বুঝাল। কাল অমন করে ওকে অভ্যর্থনা করার দরুনই যে সে এসব করেছে তাও বললে। চানভানুর মন কিন্তু কিছুতেই আর প্রসন্ন হয়ে উঠল না। আল্লারাখা কাঁটার মতো তার মনে এসে বিঁধতে লাগল।

    আল্লারাখা হানিফের মতোই তিরন্দাজ। তার প্রথম তির ঠিক জায়গায় গিয়ে বিঁধেছে।

    সেদিন দুপুরে যখন চানভানু আরিয়লখাঁতে স্নান করতে যাচ্ছিল, তখন তার ম্লান মুখ দেখে আল্লারাখা যেমন বিজয়ের আনন্দে নেচে উঠল, তেমনই তার বুকে কাঁটার মতো কী একটা ব্যথা যেন খচ করে উঠল। আহা! ওর মুখ মলিন! নাঃ, চানভানুও সোনাভানের মতোই তির ছুঁড়তে জানে! তারও অলক্ষ্য লক্ষ্য ঠিক জায়গায় এসে বিঁধল!

    আল্লারাখার চোখে চোখ পড়তেই ম্লানমুখী চানভানুর হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। এ-হাসির জন্য সে একেবারে প্রস্তুত ছিল না। এত বড়ো শয়তানের এমন চুনিবিল্লির মতো মুখ। এতে যে মরা মানুষেরও হাসি পায়।

    কিন্তু হেসেই সে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। এ-হাসির যদি আল্লারাখা অন্য মানে করে বসে। ছি ছি ছি ছি!

    কিন্তু চানভানুকে এ-লজ্জার দায় বেশিক্ষণ পোহাতে হল না। ওর হাসির ছুরি একটু চিকচিকিয়ে উঠতেই আল্লারাখা রণে পৃষ্ঠভঙ্গ দিল। সে মনে করলে, এ-হাসির বিজলির পরেই বুঝি ভীষণ বজ্রপাত হবে! চান দেখতে পেল, অদূরে বিরাট বহুকালের পুরানো অশ্বত্থ গাছে আল্লারাখা তর তর করে উঠে একেবারে আগডালে গিয়ে বসল। কী ভীষণ ছেলে বাবা! ও গাছে যে সাপ আছে সবাই বলে! যদি সাপে কামড়ে দেয়, যদি ডাল ভেঙে পড়ে যায়! চানভানু খানিক দাঁড়িয়ে ওর কীর্তিকলাপ দেখে এই ভাবতে ভাবতে নদীর জলে স্নান করতে নামল।

    নদীতে নেমেই তার মনে হল, ছি ছি, সে করেছে কী! কেন সে ওই বাঁদরটাকে অতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে! ও যে আস্কারা পেয়ে মাথায় চড়ে বসবে! না জানি সে এতক্ষণ কী মনে করছে!

    তার আর সেদিন সাঁতার কাটা হল না। আরিয়লখাঁর জল আজ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! চানভানু চুপ করে গলাজলে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল।

    সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আজ তার এই প্রশ্নই মনে বারে বারে উদয় হয়েছে – কেন আল্লারাখা ওদের বাড়ি কাল এমন করে গিয়েছিল! ও তো কারুর বাড়ির ভিতর সহজে যায় না। কেন সে ওকে দেখে অমন করে তাকিয়ে ছিল। তারপর সারা গাঁয়ের লোকের উপর অত্যাচার করে কেনই বা তার অপমানের প্রতিশোধ নিলে, ওকেই বা কিছু বললে না কেন! ও শুধু বাঁদর নয়, ও বুঝি পাগলও!

    ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হল, সে বুঝি অশ্বত্থ গাছ থেকে তাকে দেখছে। অনেকটা দূরে অশ্বত্থ গাছটা। তবু সে স্পষ্ট দেখতে পেল, অশ্বত্থ গাছটার ওধারের ডাল থেকে কখন সে এধারের ডালে এসে ওরই দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। কী বালাই! চানভানুর মনে হতে লাগল, ও বুঝি আর কিছুতেই জল ছেড়ে উঠতে পারবে না! ওকে তো আরও কতবার দেখেছে, ওরই সামনে সাঁতরেওছে এই নদীতে ; কিন্তু এ লজ্জা – এ সংকোচ তো ছিল না ওর। কী কুক্ষণে কাল-সন্ধ্যায় সে ওদের বাড়িতে পা দিয়েছিল!

    ও যেন কালবোশেখির মেঘের মতো, যত ভয় করে, তত দেখতেও ইচ্ছে করে!

    এবারেও তাকে আল্লারাখা মুক্তি দিল। চানভানু দেখলে, আল্লারাখা গাছ থেকে নেমে যাচ্ছে।

    এইবার তার ভীষণ রাগ হল ওই হতচ্ছাড়ার উপর। সে মনে করে কী। সে কি মনে করে, সে গাছে বসে থাকলে ও স্নান করে উঠে যেতে পারে না? তাই সে দয়া করে নেমে গেল! ও কি মনে করেছিল,পথে দাঁড়িয়ে থাকলে চানভানু আর নদীতে যেতেই পারবে না, ভয়ে লজ্জায়? তাই সে পথ ছেড়ে চলে গেছিল? চান নিষ্ফল আক্রোশে ফুলতে লাগল। আজ সে দেখিয়ে দেবে যে, যত বড়ো শয়তান হোক সে, তাকে চানভানু থোড়াই কেয়ার করে! জলের মধ্যে তার শরীর যেন জ্বলতে লাগল। তাড়াতাড়ি স্নান করে উঠে সে জোরে জোরে পথ চলতে লাগল। এবার যদি পথে দেখা পায় তার, তাহলে দেখিয়ে দেবে কেমন করে ওর নাকের তলা দিয়ে চান হনহনিয়ে চলে যেতে পারে। ওকে সে মানুষের মধ্যেই গণ্য করে না!

    কিন্তু কোথাও কেশরঞ্জনবাবুর কেশাগ্রও সে দেখতে পেল না। এবারেও সেই অপমান, সেই দয়া? ওকে চান ঘৃণা করে – সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে! কিন্তু একী, ওকে একটু অপমান করতে পারল না বলেই কি মনটা এমন হঠাৎ মলিন হয়ে উঠল? ওকে পথে দেখতে পেল না বলে মনটা ক্রমে অপ্রসন্ন হয়ে উঠল কেন? যে জোরে সে নদী থেকে আসছিল, পায়ের সে জোর গেল কোথায়? এ কী হল আজ চানের? ওর ঘাড়ে কি তবে ভূত চাপল?

    পঞ্চশরের ঠাকুরটির শরে কেউটে সাপের মতোই হয়তো তীব্র বিষ মাখানো থাকে। শর বিঁধবা মাত্র এ বিষ সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীর ছেয়ে মাথায় গিয়ে ওঠে! নইলে এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে চানের অবস্থা এমন সঙিন হয়ে উঠত না। ওকে ভুলতেও পারে না, মনে করতেও শরীর রাগের জ্বালায় তপ্ত হয়ে ওঠে।

    আজ প্রথম চানভানুর আহারে অরুচি হল। মা প্রমাদ গুনলে। আইবুড়ো মেয়ে বেশি বড়ো হলে কেন যে ভূতগ্রস্ত হয় – মা যেন আজ তা বুঝতে পারল। গোপনে চোখ মুছে মনে মনে বললে, ভূতে নজর দিয়েছে মা! – আর তোকে রাখা যাবে না, এইবার তোর মায়া কাটাতে হবে!

    নারদ আলি আশ্চর্য হয়ে গেল, যখন তার বউ মেয়ের পাত্র-সন্ধানের জন্য বলল তাকে। কোনো কথা হল না, দুই জনারই চোখে জল গড়িয়ে পড়ল।

     

    ২

    চানভানুর বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। আর মাসখানেক মাত্র বাকি। পাশের গাঁয়ের ছেরাজ হালদারের ছেলের সাথে বিয়ে।

    মোহনপুরের হানিফা, আল্লারাখা চানভানুর কেশরঞ্জনবাবু – এ-সংবাদে একেবারে ‘মরিয়া হইয়া’ উঠল। ইসপার কী উসপার! তার চানভানুকে চাই-ই-চাই। সে জানত, চানভানুর বাপ-মা কিছুতেই তার সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে না। কাজেই বিয়ের প্রস্তাব করা নিরর্থক। তার মাথায় তখন জৈগুন সোনাভানের কাহিনি হরদম ঘুরপাক খাচ্ছে। সে চানভানুকে হরণ করে দেশান্তরী হয়ে যাবে! কিন্তু ও পথের একটা মুশকিল এই যে, ওতে চানভানুর সম্মতি থাকা দরকার। কী করে ওর সম্মতি নেওয়া যায়?

    দেখতে দেখতে দশটা দিন কেটে গেল, কিন্তু সে সুযোগ আর ঘটল না, এগারো দিনের দিন আল্লা আল্লারাখার পানে যেন মুখ তুলে চাইলেন।

    এর মধ্যে কতদিন দেখা হয়েছে চানভানুর সাথে তার, কিন্তু কিছুতেই একেবারের বেশি দু-বার ওর চোখের দিকে সে তাকাতে পারেনি। যার ভয়ে সারা গ্রাম থরহরি কম্পমান, তার কেন এত ভয় করে এইটুকু মেয়েকে – আল্লারাখা ভেবে তার কূল-কিনারা পায় না। কিন্তু আর তো সময় নাই, আর তো লজ্জা করলে চলে না। কত মতলবই সে ঠাউরালে। কিন্তু কিছুতেই কোনোটা কাজে লাগাবার সুযোগ পেল না।

    আজ বুঝি আল্লা মুখ তুলে চাইলেন। সেদিন সন্ধ্যায় চানভানু যখন জল নিতে গেল নদীতে, তখন নদীর ঘাট জনমানবশূন্য।

    চানভানু নদীর জলে যেই ঘড়া ডুবিয়েছে – অমনি একটু দূরে ভুস করে একটা জল দানোর মুখ মালসার মতো ভেসে উঠল এবং সেই মুখ থেকে আনুনাসিক স্বরে শব্দ বেরিয়ে এল – ‘তুই যদি আল্লারাখারে ছাইর‍্যা আর কারেও শাদি করিস, হেই রাত্রেই তোদের ঘাড় মটকাইয়া আমি রক্ত খাইয়া আইমু!’ চানভানু ওই স্বর এবং ওই ভীষণ মুখ দেখে একবার মাত্র ‘মা গো’ বলে জলেই মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল! এই শুভ অবসর মনে করে জলদানো নদী হতে উঠে এল এবং তার মাথা থেকে নানা রঙের বিচিত্র মালসাটা খুলে নদীর জলে ডুবিয়ে দিয়ে চানভানুকে কোলে করে ডাঙায় তুলে আনলে। এ জলদানো আর কেউ নয়, এ আমাদের সেই বিচিত্রবুদ্ধি আল্লারাখা ওরফে কেশরঞ্জনবাবু!

    মিনিট কয়েকের মধ্যেই চানভানুর চৈতন্য হল। চৈতন্য হতেই সে নিজেকে আল্লারাখার কোলে দেখে – লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ‘তুমি কোহান থ্যা আইলে।’ ঝরবার সময় বাঁশপাতা যেমন করে কাঁপে, তেমনি করে সে কাঁপতে লাগল। আল্লারাখা বললে, ‘এই দিক দিয়া যাইতেছিলাম, দেহি কেডা জলে ভাসতে আছে, দেইহ্যা ছুড্যা জলে লাফ দিয়া পরলাম, তুইল্যা দেহি তুমি! আল্লারে আল্লা, খোদায় আনছিল আমারে এই পথে, নইলে কি অইত! কী অইছিল তোমার?

    দু চোখ-ভরা কৃতজ্ঞতার অশ্রু নিয়ে চানভানু আল্লারাখার মুখের দিকে চেয়ে রইল! তার পর জলদানোর বাণীগুলি বাদ দিয়ে বাকি সব ঘটনা বললে…।

    আল্লারাখা যখন চানভানুকে নিয়ে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সব কথা বললে – তখন তাদের বাড়িতে হই চই পড়ে গেল। চানভানুর বাপ-মা কাঁদতে কাঁদতে প্রাণ ভরে আল্লারাখাকে আশীর্বাদ করল। আল্লারাখা তার উত্তরে শুধু চানভানুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললে, ‘কেমন! তোমার কেশরঞ্জনবাবুর পিঠ ভাঙবানি চেলা কাঠ দিয়া?’

    আজ হঠাৎ যেন খুশির উথলে উঠেছিল চানভানুর মনে। এই খুশির মুখে হঠাৎ তার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘খোদায় যদি হেই দিন দেয়, ভাঙবাম পিঠ!’ বলেই কিন্তু লজ্জায় তার মাটির ভিতরে মুখ লুকিয়ে মরতে ইচ্ছা করতে লাগল। ও কথার অর্থ তো আল্লারাখার কাছে অবোধ্য নয়! কিন্তু সেদিন তো খোদা দেবেন না। কুড়ি দিন পরে যে সে হালদার বাড়ির বউ হয়ে চলে যাচ্ছে! এ কী করল সে! সে দৌড়ে ঘরে ঢুকেই বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল! তার কেবলই ডুকরে ডুকরে কান্না পেতে লাগল।

    আল্লারাখাও সেই মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। চানভানুর বাপ-মা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এ কী হল! কী এর মানে?

    আল্লারাখা আনন্দে প্রায় উন্মাদ হয়ে নদীর ধারে ছুটে গেল। তখন চতুর্দশীর চাঁদ উঠেছে আকাশের সীমানা আলো করে। আল্লারাখার মনে হল ও চাঁদ নয়, ও চানভানু – ওরই মনের আকাশ আলো করে উঠেছে আজ সে!

    রাত্রি দশটা পর্যন্ত নদীর ধারে বসে বসে তারস্বরে চিৎকার করে সে গান করলে। তারপর বাড়ি ফিরে সে ভাবতে লাগল – শুধু জলদানোর কথা নয়, জল-দানো যা যা বলেছে, সে কথাগুলো চান নিশ্চয় তার বাপ-মাকে বলেছে। কালই হয়তো ও সম্বন্ধ ভেঙে দিয়ে ওর বাপ-মা আমাদের বাড়িতে এসে বিয়ের কথা পাড়বে। আর তা যদি না করে, নদীতে যদি আর না যায়, ডাঙার ভূত তো বেঁচে আছে।

    কিন্তু আরও দুটো দিন পেরিয়ে গেলেও যখন সেরকম কোনো কিছু ঘটল না, তখন আল্লারাখার বুঝতে বাকি রইল না যে, চানভানু লজ্জায় বা কোনো কারণে জলদানোর উপদেশগুলো তার বাপ-মাকে জানায়নি। তাহলে ওর বাপ-মা অমন নিশ্চিন্ত হয়ে উঠোনে বিয়ের ছানলা তুলতে পারত না। বিফলতার আক্রোশ ক্রোধে সে পাগলের মতো হয়ে উঠল। আর দেরি করলে সব হারাবে সে, এইবার ভূতেদের মুখ দিয়ে সোজা ওর বাপ-মাকেই সব কথা জানাতে হবে!

    সেদিন গভীর রাত্রে একটা অদ্ভুত রকম কান্নার শব্দে নারদ আলিদের ঘুম ভেঙে গেল! মনে হল – ওদেরই উঠোনে বসে কে যেন বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। নারদ আলি মনে করলে আজও বুঝি পাশের বাড়ির সোভান তার বউকে ধরে ঠেঙিয়েছে। সেই বউটা ওদের বাড়ি এসে কাঁদছে। তবু সে একবার জিজ্ঞাসা করলে – ‘কেডা কাঁদে গো, বদনার মা নাকি’ কোনো উত্তর এল না। তেমনি কান্না।

    কেরোসিনের ডিবাটা হাতে নিয়ে নারদ আলি বাইরে বেরিয়েই ‘আল্লাগো’ বলে, চিৎকার করে, ঘরে ঢুকে খিল লাগিয়ে দিল। চানের মা কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল – ‘কি গো, কি অইলো! কেডা?’ নারদ আলি আর উত্তর না দিয়ে ১০৫ ডিগ্রি জ্বরের ম্যালেরিয়া রুগির মতো ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কেবলই ‘কূলহুআল্লাহ’ পড়ে বুকে ফুঁ দিতে লাগল। তার মাথার চুলগুলো পর্যন্ত তখন ভয়ে শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠছে। যত হি-হি-হি-হি করে, তত ‘তৌবাআস্তাগফার’ পড়ে, তত সে আল্লার নাম নিতে যায় – কিন্তু আল্লার ‘ল’ পর্যন্ত এসে ভয়ে জিভে জড়িয়ে যায়।

    চানভানুর ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে, কিন্তু ভূতের নাম শুনে সে বিছানা কামড়ে ভয়ে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে আছে!

    অনেকক্ষণ পরে একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে নারদ আলি বলতে লাগল, – ‘আল্লারে আল্লা! (নাকে কানে হাত দিয়ে) তৌবা আস্তগ ফারুল্লা! তৌবা তৌবা! আউজবিল্লা (নাউজবিল্লা নয়।) বিসমিল্লা। আরে আমি বারাইয়া দেহি তাল গাছের লাহান একডা বুইর‍্যা মাথায় পগ্‌গ বাঁইন্দ্যা খারাইয়া আছে! দশ-হাত-লন্বা তার দাড়ি! আল্লারে আল্লা! ও জিনের বাদশা আইছিল আমাগো বারিত!’

    শুনে চান এবং তার মা দুই জনেরই ভিরমি লাগবার মতো হল। উক্ত তালগাছ-প্রমাণ লন্বা বৃদ্ধ জিনের বাদশা তখনও উঠোনে দাঁড়িয়ে কিনা, তা দেখবারও সাহস হল না কারুর। পাড়ার কাউকে চিৎকার করে ডাকবার মতো স্বরও কন্ঠে অবশিষ্ট ছিল না। গলা যেন কে চেপে ধরেছে ওদের! তার ওপরে লোক ডাকলে যদি জিনের বাদশা চটে যায়! ওরে বাপরে, তাহলে আর রক্ষে আছে! তিনজনে বাতি জ্বালিয়ে বসে বসে কাঁপতে কাঁপতে আল্লার নাম জপতে লাগল!

    জিনের বাদশা সে-রাত্রে আর কোনো উপদ্রব করলে না। আস্তে আস্তে জিনের বাদশা সামনের আম বাগানে ঢুকে ইশারা করতেই তিন চারটি বিচিত্র আকৃতির ভূত বেরিয়ে এল। তারা জিনের বাদশার বেশ-বাস খুলে নিতে লাগল।

    সে বেশ এইরূপ ছিল! –

    প্রকাণ্ড দীর্ঘ একটা বাঁশের সাথে স্বল্প দীর্ঘ আর একটা বাঁশ আড়াআড়ি করে বাঁধা, দীর্ঘ বাঁশটার আগায় একটা মালসা বসিয়ে দেওয়া; সে মালসায় নানারকম কালি দিঠে বীভৎসরকম একটা মুখ আঁকা, সেই মালসার ওপর একটা বিরাট পাগড়ি বাঁধা। মালসার মুখে পাট দিয়ে তৈরি য়্যা লম্বা দাড়ি ঝুলানো, আড়াআড়ি বাঁশটা যেন ওর হাত, সেই হাতে দুটো কাপড় পিরানের ঝোলা হাতের মতো করে বেঁধে দেওয়া; লম্বা বাঁশটার দুই দিকে দুটো সাদা ধুতি ঝুলিয়ে দেওয়া; সেই ধুতি দুটোর মাঝে দাঁড়িয়ে সেই বাঁশটা ধরে চলা। এত বড়ো লম্বা একটা লোককে রাত্রিবেলায় ওইরকমভাবে চলে যেতে দেখলে ভূতেরাই ভয় পায়, মানুষের তো কথাই নাই!

    জিনের বাদশার পোশাক খুলে নেবার পর দেখা গেল – সে আমাদের আল্লারাখা!

    ভূতের সর্দার আল্লারাখা তার চেলাচামুণ্ডা আসবাবপত্র নিয়ে সরে পড়ল। যেতে যেতে বলল, ‘আজ আর না, আজ জিন দেখল, কাল গায়েবি খবর হুনবো!’

    সকালে গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেল – কাল রাত্রে চানভানুদের বাড়ি জিনের বাদশা এসেছিলেন। নারদ আলি বলেছিল, তালগাছের মতো লম্বা, কিন্তু গাঁয়ের লোক সেটাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে আশমান-ঠেকা করে ছাড়লে। মেয়েরা বলতে লাগল, ‘আইবো না, এত বড়ো মাইয়া বিয়া না দিয়া থুইলে জিন আইবো না?’

    কেউ কেউ বলল চানভানুর এত রূপ দেখে ওর ওপর জিনের আশক হয়েছে, ওর ওপর জিনের নজর আছে। আহা, যে বেচারার বিয়ে হবে ওর সাথে, তাকে হয়তো বাসরঘরেই মটকে মারবে!

    সেদিন সারাদিন মোল্লাজি এসে চানভানুর বাড়িতে কোরান পড়লেন। রাত্রে মউলুদ শরিফ হল। বলাবাহুল্য ভূতেরাও এসে মউলুদ শরিফে শরিক হয়ে শিন্নি খেয়ে গেল। সেদিন রাত্রে সোভান এবং আরও দু-একজন ওদের বাড়িতে এসে শুয়ে থাকল।

    গভীর রাত্রে বাড়ির পেছনের তালগাছের একটা বাঁশি বেজে উঠল। ঘুম কারুরই হয়নি ভয়ে। সকলে জানলা দিয়ে দেখতে পেল, তালগাছটায় ওপর থেকে প্রায় বিশ হাত লম্বা কালো কুচকুচে একটা পা নিচের দিকে নামছে। খড়খড় খড়খড় করে তালগাছের পাতাগুলো নড়ে উঠল। সাথে সাথে ঝরঝর ঝরঝর করে এক রাশ ধুলোবালি তালগাছ থেকে নারদ আলি টিনের চালের উপর পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে পাশের ছয়-সাতটা সুপারি গাছ একসঙ্গে ভীষণভাবে দুলতে লাগল। যেন ভেঙে পড়বে! অথচ গাছে কিছু নেই! এর পরে কী হয়েছিল, তার পরদিন সকালে আর কেউ বলতে পারল না, তার কারণ ওইটুকু পর্যন্ত দেখার পর ওরা ভয়ে বোবা, কালা এবং অন্ধ হয়ে গেছিল!

    এর পরেও যেটুকু জ্ঞান অবশিষ্ট ছিল, তা লোপ পেয়ে গেল – যখন একটা কৃষ্ণকায় বেড়াল তালগাছের ওপর থেকে তাদের জানালার কাছে এসে পড়ল!

    সেইদিন রাত্রে ভূতেদের কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, আর ওদের ভয় দেখানো হবেনা দু চারদিন, তা হলে ওরা গাঁ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে। তালগাছ থেকে আনা ভূতের পা বা কালো কাপড়-মোড়া বংশদণ্ডটা নাড়তে নাড়তে ভূতেদের সর্দার আল্লারাখা বললে, ‘আমি এই বুদ্ধি ঠাওরাইছি!’ ভূতের দল উদগ্রীব হয়ে উঠল শুনবার জন্য।

    আল্লারাখা যা বলল তার মানে – সে ঠিক করেছে কলকাতা থেকে একটা চিঠি ছাপিয়ে আনবে। আর সেই চিঠি আর একদিন স্বয়ং জিনের বাদশা নারদ আলির বাড়িতে দিয়ে আসবে। বাস, তাহলেই কেল্লা ফতে।

    এইসব ব্যাপারে চানভানুর বিয়ের দিন গেল আরও মাসখানিক পিছিয়ে। নানান গ্রামের পিশাচ-সিদ্ধ মন্ত্র-সিদ্ধ গুণীরা এসে নারদ আলির বাড়ির ভূতের উপদ্রব বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে গেল। চারপাশের গ্রামে একটা হই চই পড়ে গেল।

    সাত আট দিন ধরে যখন আর কোনো উপদ্রব হল না, তখন সবাই বললে, এইসব তন্ত্রমন্ত্রের চোটেই ভূতের পোলারা ল্যাজ তুলে পালিয়েছে। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

    এদিকে – দ্বিতীয় দিনের ভৌতিক ক্রিয়াকাণ্ডের পরদিন সকালে, আল্লারাখা কলকাতার পুথি-ছাপা এক প্রেসের ঠিকানা সংগ্রহ করে সেখানে বহু মুসাবিদার পর নিম্নলিখিত চিঠি ও তার যা ছাপা হবে কপি পাঠিয়ে দিল। প্রেসের ম্যানেজারকে লিখিত চিঠিটি এই :

    শ্রীশ্রীহকনাম ভরসা

    মহাশয়,

    আমার ছালাম জানিবেন। আমার এই লেখাখানা ভালো ও উত্তমরূপে ছাপাইয়া দিবেন। আর জদি গরিবের পত্রখানা পাইয়া ৩/৪ দিনের মধ্যে ছাপাইয়া না দিবেন আর জদি গবিলতি করেন তবে ঈশ্বরের কাছে ঢেকা থাকিবেন। আর ছাপিবার কত খরচ হয় তাহা লিখিয়া দিবেন। হুজুর ও মহাশয় গবিলতি করিবেন না। আর এমন করিয়া ছাপিয়া দিবেন চারিদিক দিয়া ফেসেং ও অতি উত্তম কাগজে ছাপিবেন। ইতি। সন ১৩৩৭ সাল ১০ বৈশাখ

    আমাদের ঠিকানা
    আল্লারাখা ব্যাপারী
    উরফে কেশরঞ্জন বাবু। তাহার হতে পঁহচে।
    সাং মহনপুর,
    পোং ড্যামুড্যা
    জিং ফরিদপুর। (যেখানে আরিয়লখাঁ নদী সেইখানে পঁহচে।)

    চিঠির সাথে জিনের বাদশা যে গৈবী বাণী ছাপতে দিল, তা এই :

    বিসমিল্লা আল্লাহো আকবর
    লা এলাহা এল্লেল্লা
    গায়েব

    হে নারদ আলি শেখ

    তোরে ও তোর বিবিরে বলিতেছি।
    তোর ম্যায়্যা চানভানুরে,

    চুন্ন ব্যাপারীর পোলা আল্লারাখার কাছে বিবাহ দে। তার পর তোরা যদি না দেছ তবে বহুৎ ফেরেরে পরিবি। তোরা যদি আমার এই পত্রখানা পড়িয়া চুন্নু ব্যাপারীর কাছে তোরা যদি প্রথম কছ তবে সে বলিবে কি এরে এইখানে বিবাহ দিবি। তোরা তবু ছারিছ না। তোরা একদিন আল্লারাখারে ডাকিয়া আনিয়া আর একজন মুনশি আনিয়া কলেমা পড়াইয়া দিবি।

    খবরদার খবরদার

    মাজগাঁয়ের ছেরাজ হালদার ইচ্ছা করিয়াছে তার পোলার জন্যে চানুভানুরে নিব। ইহা এখনও মনে মনে ভাবে। খবরদার খবরদার। খোদাতাল্লার হুকুম হইয়াছে আল্লারাখার কাছে বিবাহ দিতে। আর যদি খোদাতাল্লার হুকুম অমান্য করছ তবে শেষে তোর ম্যাইয়্যা ছেমরি দুস্কু ও জালার মধ্যে পরিবে।

    খবরদার – হুঁশিয়ার – সাবধান আমার এই পত্রের উপর ইমান না আনিলে কাফের হইয়া যাইবি।

    তোর আল্লারাখার কাছে বিবাহ দেছ বিবাহের শেষে স্বপনে আমার দেখা পাইবি। চানভানু আমার ভইনের লাহান। আমি উহারে মালমাত্তা দিব। দেখ তোরে আমি বারবার বলিতেছি – তোর ম্যায়ার আল্লারাখা ছেমরার কাছে শাদি বহিবার একান্ত ইচ্ছা। তবে যদি এ-বিবাহ না দেছ, তবে শেষে আলামতদেখিবি। ইতি

    জিনের বাদছা
    গায়েবুল্লা।

    এই কপির কোনাতেও বিশেষ করে সে অনুরোধ করে দিল যেন ছাপার চারি কিনারায় ‘ফেসেং’ হয়।…

    কলকাতা শহর, টাকা দিলে নাকি বাঘের দুধ পাওয়া যায়। এই গৈব বাণীও আট-দশ দিনের মধ্যে প্রেস থেকে ছাপা হয়ে এল। আল্লারাখার আর আনন্দ ধরে না।

    আবার ভূতের কমিটি বসল। ঠিক হল সেই রাতেই ছাপানো গৈবী বাণী নারদ আলির বাড়িতে রেখে আসতে হবে। জিনের বাদশার সেই পোশাক পরে আল্লারাখা যাবে ওদের বাড়িতে। যদি কেউ জেগে উঠে, ওই চেহারা দেখে, তার দাঁতে দাঁত লাগতে দেরি হবে না।

    সেদিন রাত্রে জিনের বাদশার গৈবী বাণী বিনা বাধায় চালের মটকা ভেদ করে চানভানুর বাড়ির ভিতরে গিয়ে পড়ল। সকাল হতে না হতেই আবার গ্রামে হই চই পড়ে গেল।

    নারদ আলি ভীষণ ফাঁপরে পড়লে। জিনের বাদশার হুকুম মতে বিয়ে না দিলেই নয় আল্লারাখার সাথে, ওদিকে কিন্তু ছেরাজ হালদারও ছাড়বার পাত্র নয়। ভূত, জিন, পরি এত রটনা সত্ত্বেও ছেরাজ তার ছেলেকে এই মেয়ের সাথেই বিয়ে দেবে দৃঢ় পণ করে বসেছিল।মাজগাঁ এবং মোহনপুরের কোনো লোকই তাকে টলাতে পারে নি। সে বলে, ‘খোদায় যদি হায়াত দেয়, আমার পোলারে কোনো হালার ভূতের পো মারবার পারব না। একদিন তো ওরে মরবারই অইবো, অর কপালে যদি ভূতের হাতেই মরণ লেহা থায়ে তারে খণ্ডাইব কেডা?’

    আসল কথা, ছেরাজ অতিমাত্রায় ধূর্ত ও বুদ্ধিমান। সে বুঝেছিল চানভানু বাপ-মার একমাত্র সন্তান, তার ওপর সুন্দরী বলে কোনো বদমায়েশ লোক সম্পত্তি আর মেয়ের লোভে এই কীর্তি করছে। অবশ্য, ভূত যে ছেরাজ বিশ্বাস করত না, বা তাকে ভয় করত না – এমন নয়। তবে সে মনে করছিল, যে লোকটা এই কীর্তি করছে – সে নিশ্চয় টাকা দিয়ে কোনো পিশাচ-সিদ্ধ লোককে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছে। কাজেই বিয়ে হয়ে গেলে অন্য একজন পিশাচ-সিদ্ধ গুণীকে দিয়ে এ সব ভূত তাড়ানো বিশেষ কষ্টকর হবে না! এত জমির ওয়ারিশ হয়ে আর কোন মেয়ে তার গুণধর পুত্রের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে!

    ছেরাজের পুত্রও পিতার মতোই সাহসী, চতুর এবং সেয়ানা। সে মনে করেছিল, বিয়েটা হয়ে যাক – তারপর ভূতটুতগুলো ভালো করে গুণী দিয়ে ছাড়িয়ে পরে বউয়ের কাছে ঘেঁষবে।

    তারা বাপ-বেটায় পরামর্শ করে ঠিক করলে – শুধু বিয়েটা হবে ওখানে গিয়ে। রুয়ৎ বা শুভদৃষ্টিটা কিছুদিন পরে হবে এবং শুভদৃষ্টির পরে ওরা বউ বাড়িতে আনবে। ‘রুয়ৎ’ না হওয়া পর্যন্ত চানভানু বাপের বাড়িতেই থাকবে।

    নারদ আলি ছেরাজ হালদারকে একবার ডেকে পাঠাল তার কাছে। পাশেই গ্রাম। খবর শুনে তখনই ছেরাজ হালদার এসে হাজির হল। ছাপানো ‘গৈবী বাণী’ পড়ে সে অনেকক্ষণ চিন্তা করলে। তার পর স্থির কন্ঠে সে বলে উঠল, ‘তুমি যাই ভাব বেয়াই আমি কইতাছি – এ গায়েবের খবর না, এ ওই হালার পোলা আল্লারাখার কাজ। হালায় কোন ছাপাখানা থেইয়া ছাপাইয়া আনছে। জিনের বাদশা তোমারে ছাপাইয়া চিঠি দিব ক্যান? জিনের বাদশারে আমি সালাম করি। কিন্তু বেয়াই, এ জিনের বাদশার কাম না। ওই হালার পোলা হালার কাম যদি না অয়, আমি পঞ্চাশ জুতা খাইমু!’

    সত্যই তো এ দিকটা ভেবে দেখেনি ওরা। কিন্তু জিনের বাদশাকে যে সে নিজে চোখে দেখেছে! ওরে বাপরে ঘর সমান উঁচু মাথা, এক কোমর দাড়ি, মাথায় পাগড়ি! সে অনেক অনুরোধ করল ছেরাজ হালদারকে – হাতে পায়ে পর্যন্ত পড়ল তার, তবু তাকে নিরস্ত করতে পারল না। ছেরাজ বলল, মরে যদি তারই ছেলে মরবে, এতে নারদ আলির ক্ষতিটা কী!

    শেষে যখন ছেরাজ ক্ষতিপূরণের দাবি করে চুক্তিভঙ্গের নালিশ করবে বলে ভয় দেখালে, তখন নারদ আলি হাল ছেড়ে দিলে।

    চানভানুর মা এতদিন কোনো কথা বলে নি। তার মুখে আর পূর্বের হাসি রসিকতা ছিল না। কী যেন অজানা আশঙ্কায় এবং এই সব উৎপাতে সে একেবারে মুষড়ে পড়েছিল। মা-মেয়ে ঘর ছেড়ে আর কোথাও বেরোত না। জল-দানো দেখার পর থেকে মেয়েকে জল তুলে এনে দিত মা, তাতেই চানভানু নাইত। আর সে নদীমুখো হয়নি। তাবিজে কবজে চানের হাতে কোমরে গলায় আর জায়গা ছিল না। শোলা বেঁধে যেন ডুবন্ত জাহাজকে ধরে রাখার চেষ্টা!

    চানও দিন দিন শুকিয়ে ম্লান হয়ে উঠেছিল। সকলের কাছে শুনে শুনে তারও বিশ্বাস হয়ে গেছিল, তার উপর জিন বা ‘আসেবের’ ভর হয়েছে। ভয়ে দুর্ভাবনায় তার চোখের ঘুম গেল উড়ে, মুখের হাসি গেল মুছে, খাওয়া-পরা কোনো কিছুতেই তার কোনো মন রইল না। কিন্তু এতো বড়ো মজার ভূত! ভূতই যদি তার ওপর ভর করবে – তবে সে ভূত আল্লারাখার কথা বলে কেন? ভূতে তো এমনটি করে না কখনও! সে নিজেই আগলে থাকে – যার ওপর ভর করে। তবে কি এ ভূত আল্লারাখার পোষা? না, সে নিজেই এই ভূত?

    এত অশান্তি দুশ্চিন্তার মাঝেও সে আল্লারাখাকে কেন যেন ভুলতে পারে না। ওর অদ্ভুত আকৃতি-প্রকৃতি যেন সর্বদা জোর করে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

    যত মন্দই হোক, চানদের তো কোনো অনিষ্টই করেনি সে। অতচ কী দুর্ব্যবহারই না চান করেছে ওর সাথে। ওর মনে পড়ে গেল, এর মাঝে একদিন পাড়ার অন্য একটি বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়ি আসবার সময় আল্লারাখাকে সে পড়ে ছটফট করতে দেখেছিল। রাস্তায় আর কেউ ছিল না তখন। সে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করায় আল্লারাখা বলেছিল, তাকে সাপে কামড়েছে! কোনখানে কামড়েছে জিজ্ঞাসা করায় আল্লারাখা তার বক্ষস্থল দেখিয়ে দিয়েছিল। সত্যই তার বুকে রক্ত পড়ছিল। চানভানুর তখন লজ্জার অবসর ছিল না। একদিন তো এই আল্লারাখাই তার প্রাণদান করেছিল নদী থেকে তুলে। সে আল্লারাখার বুকের ক্ষত-স্থান চুষে খানিকটা রক্ত বের করে ফেলে দিয়ে, আবার ক্ষতস্থানে মুখ দেবার আগে জিজ্ঞাসা করেছিল – কী সাপে কামড়েছে? আল্লারাখা নীরবে চানভানুর চোখ দুটো দেখিয়ে দিয়েছিল। তার পর কেমন করে টলতে টলতে চানভানু বাড়ি এসে মূর্ছিত হয়ে পড়েছিল আজ আর চানের সে কথা মনে নাই। কিন্তু একথা চানভানু আর আল্লারাখা ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তি কেউ জানে না।

    চানভানু বুঝেছিল – প্রতারণা করে আল্লারাখা তার বুকে চানের মুখের ছোঁওয়া পেতে ছুরি বা কিছু দিয়ে বুক কেটে রক্ত বের করেছিল, সাপের কথা একেবারেই মিথ্যা, তবু সে কিছুতেই আল্লারাখা উপর রাগ করতে পারল না। যে ওর একটু ছোঁওয়া পাবার জন্য – হোক তা মুখের ছোঁওয়া – অমন করে বুক চিরে রক্ত বহাতে পারে, তার চেয়ে ওকে কে বেশি ভালোবাসে বা বাসবে! হয়তো তার হবু শ্বশুর ছেরাজ যা বলে গেল – তার সবই সত্য, তবু ওই গ্রামের লোকের চক্ষুশূল ছোঁড়াটার জন্য ওর কেন এমন করে মন কাঁদে! কেন ওকে দিনে একবার দেখতে না পেলে ওর পৃথিবী শূন্য বলে মনে হয়!

    সত্যিসত্যিই তাকে জিনে পেয়েছে, ভূতে পেয়েছে – হোক সে ভূত, হোক সে জিন, তবু তো সে তাকে ভালোবাসে, তার জন্যই তো সে একবার হয় জিনের বাদশা, একবার হয় তালগাছের একানোড়ে ভূত! চানের মনে হতে লাগল, সাপে আল্লারাখাকে কামড়ায়নি, কামড়েছে তাকে, বিষ ওর মন জর্জরিত হয়ে উঠল।

    মা-র মন অন্তর্যামী। সেই শুধু বুঝল মেয়ের যন্ত্রণা, তার এমন দিনে দিনে শুকিয়ে যাওয়ার ব্যথা। সেও এতদিনে সত্যকার ভূতকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও আর ফেরবার উপায় নেই। মেয়ে নিজে হাতে জবাই করতে হবে! দুর্দান্ত লোক ছেরাজ হালদার, এ সম্বন্ধ ভাঙলে সে কেলেঙ্কারির আর শেষ থাকবে না!

    বাপ, মা মেয়ে তিনজনেই অসহায় হয়ে ঘটনার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল।

     

    কিছুতেই কিছু হল না। জীবনে যে পরাজয় দেখেনি, সে আজ পরাজিত হল। জিনের বাদশা, তার গৈবী বাণী, যত রকম ভূত ছিল – একানোড়ে, মামদা, সতর চোখির মা, বেহ্মদোত্তি, কন্ধকাটা – সব মিলেও তারা পরাজয় নিবারণ করতে পারলে না! তা ছাড়া আল্লারাখার আর পূর্বের মতো সে উৎসাহও ছিল না। যে দিন চানভানু তার চাঁদমুখ দিয়ে ওর বুকের রক্ত স্পর্শ করেছিল সেই দিন থেকে তার রক্তের সমস্ত বিষ – সমস্ত হিংসা দ্বেষ লোভ ক্ষুধা – সব যেন অমৃত হয়ে উঠেছিল। তার মনের দুষ্ট শয়তান সেই একদিনের সোনার ছোঁওয়ায় যেন মানুষ হয়ে উঠেছিল। পরশমণির ছোঁওয়া লেগে ওর অন্তরলোক সোনার রং-এ রেঙে উঠেছিল। তার মনের ভূত সেই দিনই মরে গেল।

    চানভানুর বিয়ে হয়ে গেল। বর তার কেমন হল, তা সে দেখতে পেলে না। দেখবার তার ইচ্ছাও ছিল না। বরও কনেকে দেখলে না ভয়ে – যদি তার ঘাড়ের জিন এসে তার ঘাড় মটকে দেয়। ভালো ভালো গুণীর সন্ধানে বর সেই দিনই বেরিয়ে পড়ল।

    চানভানুর যে রাত্রে বিয়ে হয়ে গেল, তার পরদিন সকালে আল্লারাখার বাপ মা ভাই সকলে আল্লারাখাকে দেখে চমকে উঠল। তার সে বাবরি চুল নেই, ছোটো ছোটো করে চুল ছাঁটা, পরনে একখানা গামছা, হাতে পাঁচনি, কাঁধে লাঙ্গল! তার মা সব বুঝলে। তার ছেলে আর চানভানুকে নিয়ে গ্রামে যা সব রটেছে, সে তার সব জানে। মা নীরবে চোখ মুছে ঘরে চলে গেল। তার বাপ আর ভাইরা খোদার কাছে আল্লারাখার এই সুমতির জন্য হাজার শোকর ভেজল।…

    দূরে হিজল গাছের তলায় আরও দুটি চোখ আল্লারাখার কৃষাণ-মূর্তির দিকে তাকিয়ে সেদিনকার প্রভাতের মেঘলা আকাশের মতোই বাষ্পাকুল হয়ে উঠল – সে চোখ চানভানুর। সে দৌড়ে গিয়ে আল্লারাখার পায়ের কাছে পড়ে কেঁদে উঠল, ‘কে তোমারে এমনডা করল?’ আল্লারাখা শান্ত হাসি হেসে বলে উঠল – ‘জিনের বাদশা!’

    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছায়ানট – কাজী নজরুল ইসলাম
    Next Article রিক্তের বেদন – কাজী নজরুল ইসলাম

    Related Articles

    কাজী নজরুল ইসলাম

    অগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    চক্রবাক – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    ভাঙার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    বাঁধনহারা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    মৃত্যুক্ষুধা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    দোলনচাঁপা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.