Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৫ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৭ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শিল্পী

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প20 Mins Read0

    শিল্পী

    হরিধন অনেক ভেবেচিন্তে উস্কোখুস্কো চুলগুলোয় উকুনের সন্ধান করতে করতে বলে—

    —আজ্ঞে ওই যা বল্লাম বারো টাকা, এর কমে কিছুতেই হবে না?

    হরিধন-এর মুখে ওই সঠিক দরের হিসাব শুনে লোকটা বলে সে কি হে? হরিধন-এর সংসার ফুটপাথেই।

    একটা অযত্নে গড়ে ওঠা ছাতিম গাছ তার মতই বিবর্ণ ধূলিধূসর। পাতাগুলোয় চেকনাই নেই। ওর মধ্যেই আবার দু-তিনটে কাকদম্পতি বাসা বেঁধেছে। তাদের বাসা থেকে খড় কুটো শুকনো বিষ্ঠাও পড়ে হরিধনের আদুড় খড়িওঠা পিঠে। হরিধনের এ-সব নিয়ে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।

    মাঝে মাঝে শুধু চীৎকার করে—

    —হেই-ই

    পরক্ষণেই খদ্দেরের কথায় বলে হরিধন—আজ্ঞে খড় কাঠির দাম বেড়েছে, সুতলির দাম তো আকাশছোঁয়া। তায় বড় মানুষের মাল বানাতে হবে। বলেন খটা পড়বে না? তাও কম বলেছি। খদ্দের ভদ্রলোক এদিক ওদিকে চাইল। কলকাতায় জনস্রোত বয়ে চলেছে, বাস ট্রাম চলছে। লোকজনের ভিড়েরও কমতি নেই। একটু পরেই শুরু হবে খেল। তার দল এর মধ্যে দূরে কোন পার্কে জমায়েত করছে লোকজনদের। তারা এর মধ্যে ফেস্টুন লাঠির ডগে ফ্লাগ-টল্যাগ নিয়ে শোভাযাত্রা করে এদিকে আসবে।

    বর্তমানে এসপ্লানেডের এই দিগকার রাস্তাটা পরিণত হয়ে ওঠে সভাস্থলে। ওখানে তাদের দল এসে জুটবে রং-বেরং এর পতাকা সাজসজ্জা নিয়ে। পুলিশও রীতিমত সেজেগুজে ঢাল নিয়ে এসে দাঁড়াবে ওদিকে। গুপীনাথের দল অবশ্য ওদের আদৌ ঘাঁটাবে না। তার দলের নির্দেশও সেই রকম, ওরা দাঁড়িয়ে থাকবে, এরা থাকবে এদিকে।

    আর শ্লোগান অর্থাৎ বাক্যযুদ্ধ চলবে। অফিস যাত্রীদের ভিড় জমবে, নাকাল হবে তারা। তারপর প্রেসের লোকজন এসে ছবি তুলবে, গলায় মালা দিয়ে ওদিকে গরম গরম লেকচার দিয়ে কারোর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হবে।

    তারপর খেল খতম।

    সেদিনের মত যে যার বাড়ির পথ ধরবে।

    হরিধনের বাজার এখন বেশ চড়া।

    পুজোর আগে বাজার চড়ে। মিটিং, প্রশেসন-এর ভিড় বাড়ে। আর ছুতো-নাতায় দেশ-বিদেশে সব বড় মানুষের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।

    হরিধন এখন কোন সাহেবের কুশপুত্তলিকা গড়ছে।

    স্বদেশে? কোথায় সে কোন নাগরিকদের উপর কি করেছে, এখানে দল হঠাৎ ক্ষেপে উঠে তাদের এমব্যাসির সামনে দাহ করবে সেই সাহেবের কুশপুত্তলিকা।

    মরগে তোরা। হরিধন বাঁশের ডগায় তখন খড় আর সুতলি পেঁচিয়ে সাহেব বানাতে ব্যস্ত।

    এদিকে গুপী শোনায়—তাহলে পুরো দশই কর হরিপদ, কত কুশপুত্তলিকা নিই বল তোর কাছে?

    হরিধন তা জানে।

    গুপীনাথ-এর কত দল কে জানে। হপ্তায় দু-তিনটে মাল তো নেয়ই। আর তার দরও আলাদা।

    হরিধনের হাতে দশ টাকা দিয়ে বলে গুপী—

    —এটাতে মার্জিন থাকবে না রে। করে দে খুব সিম্পল করে বানিয়ে দে। বৈকালে আসছি, নিয়ে যাবো।

    হরিধন বলে—দু’দিন আগে অর্ডার না দেলে মাল দেবে কেমনে? দেখছনি কত মাল-এর অর্ডার লাগছে—

    গুপী এবার পকেট থেকে মোড়কটা বের করে।

    হরিধনের নজরও পড়েছে তাতে। জোঁকের মুখে যেন চুন পড়েছে।

    গুপী বলে—নে, খাস নেপালের জিনিস। এক নম্বর?

    টেনেটুনে মৌজ করে হাত লাগা।

    —তাহলে এসো বৈকালে তবে ডেরেস নি আসবে। কি ডেরেস পরাবে তোমরাই জানো। অর্থাৎ মূর্তি কি করবেন সেটা ওদেরই দিতে হবে।

    গুপী চলে যেতে হরিধন এবার হাঁক পাড়ে।

    —কচি। এ্যাই কচি—

    মেয়েটা ওদিকে বসে সুতলির তাল পাকাচ্ছিল। ওসব সংগৃহীত হয় কলকাতার রাস্তা থেকে। ভোটের সময় হলে তো কথাই নেই। ফেষ্টুন রঙীন কাগজ-এর সাজগোজ করে সুতলিতে বেঁধে রাস্তা গলি ছেয়ে ফেলে।

    কাগজ কুড়োনোর দল কাগজ আর সুতলির তাল টেনে-টুনে আনে, এখানেই ঝেড়ে দেয় নামমাত্র মূল্যে।

    হরিধন জানে কচির মেজাজ।

    মেয়েটাকে দেখছে ক বছর ধরেই। পথেই পেয়েছিল ওকে।

    তেজী। ফণা তোলা মেয়ে। হরিধনের চোখে পড়েছিল কচি।

    গঙ্গার ধারে থাকতো মেয়েটা ওর বাপ-মায়ের সঙ্গে। গঙ্গামাটি বেচত কুমারটুলি এলাকায়।

    হরিধন তখন কুমারটুলিতে কাজ করে পটো পাড়ায়। পুরো নাম হরিধন পাল। তখন হরিধন সবে এসেছে ঘূর্ণি থেকে, জাত ব্যবসার কাজও শিখেছে। পটো পাড়ায় কুমুদ পালের ওখানে কাজ ধরেছে। মাটে ছানা-খড়ে মেড় বাঁধা। মেড়ের জন্য গরাণ ডাল আসে বাদাবন থেকে, সেই সব কাঠ সাইজ মত করে খড় জড়িয়ে সুতলি বেঁধে প্রতিমার কাঠামো তৈরি করতে হয়। বুড়ো কুমুদ পাল বলে মূর্তির আসল হলো এই খরের মেড়, পুত্তলিকা। এর উপরই এই ছাদে মাটি দিয়ে সব হবে। মেড় বাঁধতে শেখ বাপধন। সব হবে!

    মেয়েটাও মরসুমের সময় পটোপাড়ায় ফুরোণে গা গতর নেড়ে মাটি ছানতো, খড়-তুষ মিশিয়ে মাটি বানাতো। খড় সাইজ করে দিত মেড় বাঁধার জন্য। আর ওই করতে গিয়েই তাদের দু-জনের পরিচয়টা হয়।

    ক্রমশ জমে ওঠে দু জনে।

    হরিধন বলে তুই বড় সোন্দর রে। ওস্তাদের হাতে পিতিমের মতন পান পাতা সাইজে মুখখানা তোর। আর মুখে যেন ঘামতেল লাগানো। চকচকে— হাসতো কচি—

    বলে—তা সোন্দর হলে তো দেখতে গো?

    পথের মেয়েটাও মনে মনে চেয়েছিল ঘরের ঠিকানা।

    হরিধন তখন মেড় গড়তে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। দুর্গা-কালী-সরস্বতী মায় অসুর-জগদ্ধাত্রী সব কিছুরই মেড় বাঁধছে। পয়সাও পায় কিছু।

    কচির কথায় বলে সে।

    —দেখতে তো চাই রে।

    হাসে কচি—তাই নাকি। কিন্তু দেখতে গেলে যে খটা লাগে গো। আর বাপু ভেসে বেড়াতে চাই না।

    হরিধনও স্বপ্ন দেখে। নোতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন।

    —কচির ঘেন্না ধরে গেছে।

    তাই নোতুন করে বাঁচার জন্যেই হরিধনকে কাছে পেতে চায়। হরিধন-এর কথাগুলো শুনছে সে স্বপ্নরঙীন মন দিয়ে। সেও স্বপ্ন দেখে।

    —সত্যি বলছো কারিগর?

    হরিধন বলে—হ্যাঁ রে।

    তবু কচির সন্দেহ যায় না। মানুষকে সে বিশ্বাস করে না। করতে পারে না।

    বলে কচি—

    —শেষমেশ গাং-এ ডোবাবে না তো গো?

    হরিধন বলে এবার মরসুমের পরই দেখবি ঘর নিচ্ছি।

    কিন্তু ব্যাপারটা ওদের অনেকের চোখে পড়ে যায়।

    যায়।

    আড়ালে-আবডালে অনেকে অনেক কিছুই করে। তাই বলে ঠাকুরের মূর্তি গড়ার চালাতে পটোপাড়ার আটনে এমনি অনাচার চলতে দিতে চায় না ওরা।

    কুমুদ পাল সেদিন গর্জে ওঠে।

    —কুমোরের ঘরের ছেলে হয়ে কারিগর হয়ে তুই একটা পথের মেয়ের সঙ্গে কি করিস রে? আর কুমুদ সেদিন ওই মাটিছানা কচির চুলের মুঠি ধরে গর্জায়—নষ্টামির জায়গা পাসনি?

    মেয়েটা কাঁদছে।

    গর্জে ওঠে হরিধন—ওকে মারবা নাই ওস্তাদ।

    কুমুদ পাল বাধা পেয়ে এবার হাতের গরাণ শূলো উঠিয়ে সপাটে মারতে যায় হরিধনকেই।

    কুমুদ পাল হরিধনকেই ধরেছে এবার মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে। কিন্তু বলিষ্ঠ হরিধনের হাতের ধাক্কায় বুড়ো কুমুদ ওই ছানা কাদার মধ্যে পড়ে যায়। সর্বাঙ্গে কাদা মাখা, মেয়েটাও ওস্তাদের এই হাল দেখে হাসছে।

    পটোপাড়ার আরও দু-চার জন জুটে গেছে। তারাই এবার কুমুদ পালের মত প্রবীণ কারিগরের ওই ছেলেটার হাতে এমনি হেনস্তা দেখে এগিয়ে আসে।

    হরিধনকে তারাই বেশি করে শাসায়—বেরো। ফের কোনদিন এ পাড়ায় দেখলে জান খেয়ে নোব।

    হরিধনকে ওরা বেশ যুৎ করে পিটিয়েছে। মুখ কপাল ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে তুলেছে। বের হয়ে আসে হরিধন।

    এতদিনের তার আশ্রয়, কারিগর হবার স্বপ্ন সব হারিয়ে যায়। কোথায় যাবে জানে না। এতবড় কলকাতা শহরে তার আপনজন, আশ্রয়, কোথাও কিছু নেই। রাতে আহত হরিধন এসে আশ্রয় নেয় পার্কের একটা বেঞ্চে। গা হাতে পায়ে ব্যাথা। কপাল মাথা টনটন করছে।

    হঠাৎ কার ডাকে চাইল।

    —কচি! তুই!

    মেয়েটা তার জন্যে শালপাতায় মোড়া কখানা রুটি আর মাটির ভাড়ে একটু তরকারী এনেছে কোন হোটেল থেকে।

    বলে কচি—দিনভোর কিছু খাওনি। এটা খেয়ে নাও!

    ওঠো!

    কচির কথায় উঠে বসল হরিধন।

    কচি বলে—এমনি করে মারলো ওরা কারিগর?

    —কারিগর!

    —ওসব স্বপ্ন ঘুচে গেছে রে! এখন বাঁচবো কি করে তাই ভাবছি।

    কচি বলে—জীব দেছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি!

    কচির কথায় যেন এই অন্ধকারেও আশ্বাস খোঁজে হরিধন।

    তারপর কয়মাস কষ্টেই কেটেছে। কোন কাজ নেই—ঠিকানা নেই। কচিই সেদিন ঝিগিরি করে দিন চালিয়েছে।

    শেষ অবধি হঠাৎ বুদ্ধিটা মাথায় এসে যায় হরিধনের। সেদিন কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে কারা যেন। লক্ষ্যভ্রষ্টের মত ঘুরছে হরিধন। এসপ্লানেড এলাকায় এসে ওই কাণ্ড দেখে বলে—খড় কাঠ দ্যান—মেড় বানাই দিচ্ছি।

    —পারবি?

    —হ্যাঁ।

    খড় কাঠ এসে গেলো।

    নগদ দু খানা দশটাকার নোট দিয়ে বসে।

    তারপর থেকেই হরিধনের ব্যবসা জমতে শুরু করেছে।

    পটোপাড়ার মত এখানে খাটতে হয় না। সেখানে মেড় বাঁধা, মাটি ছানা— এক মেটে, দু মেটে করা মূর্তি তৈরীর কত কাজ।

    এখানে ওসব নেই। বাঁধা খড়—লাবড়া ও সুতলি দিয়ে আর পোশাক পরিয়ে সাজিয়ে মাল ডেলিভারী দাও। রোজকার কাজ রোজ রোজ নগদ দাম। কোথায় কোন পণপ্রথা-বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করতে হবে। গরম গরম বক্তৃতার পর কুশপুত্তলিকা দাহ না করলে আন্দোলন জমে না।

    তাই দরকার এসবের।

    ওরা বলে—তাই দেব! যানা—

    —এ্যাডভাস দাও!

    অর্থাৎ আগাম চাই! ওরা অবাক হয়।

    —সে কি রে আগাম দিতে হবে?

    হরিধন বলে—তা দিতে হবে বৈকি।

    তারপর একই ডায়ালগ বলে যায়।

    — বাঁশ, খড়, সুতলির কত দাম বেড়েছে। মাল-এর খরচাও বেড়ে গেছে। ওদিকে প্রশাসন তখন রাস্তা বন্ধ করে চলেছে। টেম্পো চড়েছে। ওদেরই একজন পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে বলে—জলদি বানা। সভা শুরু হয়ে গেছে।

    —হবে গো!

    হরিধন, কচি এবার বিদ্যুৎগতিতে হাত চালাচ্ছে। পটোপাড়ার সেই মেড় বাঁধার বিদ্যা দিয়ে একদিন কারিগর হবার স্বপ্ন দেখেছিল সে। তার মূর্তি গড়া সার্থক হবে। দেখিয়ে দেবে সেও বড় কারিগর। কিন্তু সে সব স্বপ্ন আজ মন থেকে নিঃশেষে মুছে গেছে।

    আজ হরিধন মূর্তি গড়ার কাছে পৌঁছতে পারেনি। খড়ের বিকৃত মেড় বেঁধে সমাজের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে যেন আগুনের জ্বালায় প্রকাশ করার পথই নিয়েছে।

    কচি তবু রাতের অন্ধকারে সেই বিবর্ণ ছাতিম গাছের নীচে বসে বলে— মূর্তি গড়বে না কারিগর? শুধু এই আগুন জ্বালা কুশের মেড়ই বাঁধবে? মাটি-রং দে মূর্তি গড়বে না কোনদিন? হাসে হরিধন!

    —মানুষ আর দেখেছিস এখানে? সব খ্যাড় গোঁজা ওই কুশপুতুলের দল। তাই আমিও তাই গড়ছি! দিব্যি খাওয়া পরা হচ্ছে। ওরা যত বেশী লম্ভ-ঝম্ভ করবে—ততই আমাদের আমদানী হবে। আবার মূর্তি-ফূর্তি দে কি হবে?

    নে! রাত হয়েছে ঘুমো। কাল আবার দু খান বড় মানুষের কুশপুতুল চাই। ভোরবেলা থেকে হাত লাগাতে হবে।

    শিল্পী

    অবনীশ ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। অয়েল পেন্টিং। একজন মাঝবয়সি সুপুরুষ ভদ্রলোকের পোর্ট্রেট। অবনীশের স্টুডিওর এক কোনায় আরও আট-দশটা ছবির পিছনে দাঁড় করানো ছিল। অবনীশের আঁকা প্রথম অয়েল পোর্ট্রেট। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে সে দু বছর হল পাশ করে বেরিয়েছে। ছাত্র অবস্থায় অবিশ্যি সে আরও পোর্ট্রেট করেছে। এবং তাতে বেশ নামও হয়েছিল। অবনীশের ইচ্ছা সে ছবি আঁকাকেই পেশা হিসেবে নেবে। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

    অবনীশের বাড়িতে তার বাবা-মা আছেন। একটি বোন ছিল, তার সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। বাবা হিমাংশু বোস ব্যারিস্টার এবং ভাল প্র্যাকটিস। ছেলেকে তিনি চিরকালই উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। তিনি একদিন অবনীশকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই তো আর্টিস্ট হবি?

    তাই তো ইচ্ছে আছে, বলল অবনীশ।

    তোর আঁকার সরঞ্জাম সব রয়েছে?

    কিছু ক্যানভাস, একটা ইজেল, আর কিছু রঙ কিনতে পারলে ভাল হত।

    বেশ তো–কিনবিখন। কত লাগবে বলিস। আমি টাকা দিয়ে দেব।

    সেসব সরঞ্জাম কেনা হয়ে গেছে, কিন্তু অবনীশ এখনও ছবি আঁকতে শুরু করেনি। ইজেলে সাদা ক্যানভাস খাটানো রয়েছে, তাতেই ছবি ফুটে উঠবে, কিন্তু কবে বা কী ছবি তা অবনীশ এখনও ভেবে পায়নি।

    অম্বিকা সেনগুপ্তর পোর্ট্রেট আঁকার আইডিয়াটা নিখিলই দেয়। নিখিল অবনীশের অনেকদিনের বন্ধু, যদিও সে আর্টিস্ট নয়। তারা দুজনে একসঙ্গে স্কুলে পড়েছে। তারপর দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেলেও বন্ধুত্ব রয়েই গেছে। নিখিলের বাবা রজনী দত্ত ডাক্তার। নিখিল একদিন এসে সাদা ক্যানভাস দেখে বলল, কী রে, এখনও আঁকা আরম্ভ করিসনি?

    অবনীশ মাথা চুলকে বলল, কী আঁকব সেটা ঠিক করলে তবে তো আঁকা শুরু হবে।

    কেন? পোর্ট্রেট। তোর যেটা স্পেশালিটি।

    কার পোর্ট্রেট? রাস্তা থেকে তোক ধরে এনে তো পোর্ট্রেট করা যায় না। আর আজকাল ফোটোগ্রাফিক যুগে অয়েল পোর্ট্রেট করানোর রেওয়াজ প্রায় উঠেই গেছে।

    আমাকে দুদিন ভাববার সময় দে।

    দুদিন বাদে নিখিল এসে অবনীশকে জিজ্ঞেস করল, অম্বিকা সেনগুপ্তর নাম শুনেছিস?

    অবনীশ শোনেনি।

    স্টিফেন অ্যান্ড গিলফোর্ড কোম্পানির একজন চাঁই। বাবার বিশেষ বন্ধু। একদিন ক্লাবে নাকি আক্ষেপ করে বাবাকে বলেছিলেন, পুরনো রেওয়াজ সব উঠে যাচ্ছে–এটা অত্যন্ত আফসোসের ব্যাপার। বাবার একট পোর্ট্রেট আছে আমাদের ড্রইং রুমে–পঞ্চাশ বছর আগে বিখ্যাত প্রবোধ চৌধুরীর করা। চমৎকার। ফোটোতে ওই আভিজাত্যই নেই। বাবা তাতে বললেন, তুমি একটা নিজের পোর্ট্রেট করাও না। বাধাটা কোথায়? সেনগুপ্ত নাকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, সেরকম আর্টিস্ট কোথায়?

    এ গল্প নিখিল গতকাল বাবার মুখে শোনার পরেই তার মাথায় বুদ্ধিটা খেলে।

    পোর্ট্রেট তুই খুব ভাল পারবি–একেবারে ভেটারেন আর্টিস্টের মতো। আমি বাবাকে তোর কথা বলেছি। বাবা বলেছেন সেনগুপ্তকে বলবেন।

    তিনদিন বাদে নিখিল অবনীশের কাছে এল। বলল, তোর ডাক পড়েছে।

    কোথায়?

    সাত নম্বর রয়েড স্ট্রিট। অম্বিকা সেনগুপ্তের বাড়ি।

    কবে, কখন যেতে হবে?

    রবিবার সকাল নটায়।

    দুরু দুরু বুকে যথাসময়ে অবনীশ গিয়ে হাজির হল সাত নম্বর রয়েড স্ট্রিটে। বেয়ারা বসবার ঘরে বসালো অবনীশকে। তিন মিনিটের মধ্যেই আসল লোকের আবির্ভাব। সত্যিই ছবি আঁকার মতো চেহারা।

    তুমি অয়েল পোর্ট্রেট করো? ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

    আজ্ঞে হ্যাঁ।

    তোমার খুব প্রশংসা করছে আমার বন্ধু ডাক্তার রজনী দত্তর ছেলে। কদিন নাও তুমি একটা পোর্ট্রেট করতে?

    দিন দশেকের বেশি লাগে না।

    তা হলে কালই শুরু করে দাও। আমার আবার কলকাতার পাট গুটিয়ে দিল্লির আপিসে চলে যেতে হতে পারে। আমার এখানেই আসবে। সকাল আটটা থেকে নটা পর্যন্ত টাইম দেব তোমায়। তোমার রেট কত?

    আমি তো প্রোফেশনাল কাজ শুরুই করিনি; কাজেই যা ভাল বোঝেন তাই দেবেন।

    শ পাঁচেক?

    ঠিক আছে।

    আরেকটা কথা–তিনদিনের দিন যদি দেখি ছবি আমার পছন্দ হচ্ছে না, গ হলে সেইখানেই থামতে হবে। তোমার এক্সপেনসেস আমি দিয়ে দেব। তবে স্বভাবতই পুরো পারিশ্রমিক পাবে না।

    এতেও অবনীশ বলল, ঠিক আছে।

    পরের দিনই কাজ শুরু হয়ে গেল। অবনীশকে একটা রিকশা ভাড়া করতে হয়েছিল সরঞ্জাম আনবার জন্য। অম্বিকা সেনগুপ্ত ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ঠিক আটটার সময় হাজির হলেন বৈঠকখানায়।

    কোথায় বসাবে আমাকে? ভদ্রলোক এসেই জিজ্ঞেস করলেন।

    আজ্ঞে এই উত্তরের জানলাটার পাশে হলে ভাল হয়। নর্থ লাইটটা পোর্ট্রেটের পক্ষে সবচেয়ে ভাল লাইট।

    হাতে বই-টই কিছু লাগে না? পাশে টেবিল থাকবে না?

    আজকাল ওসব উঠে গেছে। আমি আপনার যাকে বলে আবক্ষ পোর্ট্রেট করব। আপনি এই চেয়ারটায় বসবেন। দাঁড়াবার দরকার নেই।

    বাঃ–এ তো তেমন কঠিন ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না।

    তিনদিনেই দেখা গেল ছবিতে মিস্টার সেনগুপ্তকে চেনা যাচ্ছে। ভদ্রলোক কাজ দেখে অবনীশের পিঠে দুটো মৃদু চাপড় মেরে বললেন, এক্সেলেন্ট! ক্যারি অন। অবনীশের শাঁধ থেকে একটা বোঝ নেমে গেল।

    কিন্তু তার পরের দিনই এক দুঃসংবাদ। তোমাকে আর তিনদিনের বেশি সময় দিতে পারছি না, অবনীশ।বললেন অম্বিকা সেনগুপ্ত। আমাকে বুধবার–অর্থাৎ আজ থেকে চারদিন পরে–দিল্লি চলে যেতে হচ্ছে। তলপি-তলপা গুটিয়ে। কদিনের জন্য তা বলতে পারব না। বছর দু-এক তো বটেই। আমকে মাঝে মাঝে আসতে হতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে তোমায় সময় দিতে পারব না।

    অবনীশের মনটা ভেঙে গেল। সে নিজেও বুঝতে পারছিল যে কাজটা খুব ভাল এগোচ্ছে। তিনদিনে যে ছবি শেষ হবে না তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

    তা হলে আপনি কি অসমাপ্ত ছবিই সঙ্গে নিয়ে যাবেন?

    সে আর কী করে হয়। যতদূর করতে পারো সেই অবস্থাতেই তোমার কাছে থাকবে ছবিটা। অবিশ্যি তোমার পারিশ্রমিক তুমি পাবে।

    তিনদিনে মনের জোরের সঙ্গে হাতের জোর মিলিয়ে অবনীশ ছবির বারো আনা শেষ করে ফেলল। অম্বিকা সেনগুপ্ত এবার দেখে বললেন, ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট! তোমার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল, অবনীশ। আমি টাকা সঙ্গেই এনেছি। এই নাও তোমার পারিশ্রমিক।

    অবনীশ দেখল মিস্টার সেনগুপ্ত তাকে পাঁচশোর জায়গায় সাতটা করকরে একশো টাকার নোট দিয়েছেন।

    অম্বিকা সেনগুপ্তর পোর্ট্রেটের পর্ব এখানেই শেষ হল।

    এবার অবনীশ তার পেশাদারি শিল্পীজীবনের জন্য তৈরি হল। ছবি এঁকে রোজগার তাকে করতেই হবে। বাপের অনুগ্রহে আর কতদিন চলে? কী ঢঙে ছবি আঁকবে সে; সাবেকি না আধুনিক–সেই নিয়ে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে, যদিও তার উত্তর সে এখনও খুঁজে পায়নি।

    অম্বিকাবাবুর চলে যাওয়ার মাসখানেক পরে চিত্রকুট গ্যালারিতে আধুনিক ভারতীয় শিল্পীদের একটা প্রদর্শনী হল। অবনীশ গেল দেখতে, এবং দেখে সে হতবাক হয়ে গেল। যে ছবির না আছে মাথা না আছে মুণ্ডু, তার দাম আকাশছোঁয়া। আর সেই দামে লোকে সে ছবি কিনছে বাড়িতে টাঙিয়ে রাখার জন্য। চল্লিশটার মধ্যে উনিশটা ছবির ফ্রেমে লাল গোল কাগজ আঁটা। তার মানে ছবি বিক্রি হয়ে গেছে, অথচ আজ সবে প্রদর্শনীর চতুর্থ দিন।

    মিনিট পনেরো থেকে অবনীশ গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এল। সে মনস্থির করে ফেলেছে। চুলোয় যাক মডার্ন আর্ট। সে তার নিজের ঢঙেই ছবি আঁকবে–সে ছবি লোকে নিক বা না নিক।

    ছমাসে অবনীশ বত্রিশখানা ছবি আঁকল। কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকার জন্য তাকে বাইরেও যেতে হয়েছিল–পুরী, ঘাটশিলা, গ্যাংটক। সে বুঝেছে ল্যান্ডস্কেপেও তার হাত খারাপ নয়।

    নিখিল এল একদিন ছবি দেখতে। দেখে-টেখে বলল, দুর্দান্ত হয়েছে তোর ছবি। তবে ভয় হয় কী জানিস? আজকাল ছবির চেহারা আর লোকের রুচি এত পালটে গেছে যে, তোর ছবি বাজারে চলবে কিনা তাই ভাবছি। তুই একজিবিশন করবি তো?

    ইচ্ছে তো আছে। ছবি বিক্রি না হলে রোজগার হবে কী করে?

    একটা গ্যালারির নাম হয়তো তুই শুনেছিস–রূপম। তার মালিক পুরুষোত্তম মেহরা বাবার পেশেন্ট। খুব কঠিন ব্যারাম থেকে বাবা ওঁকে সারিয়ে তুলেছিলেন। মেহরা মোটামুটি সেকেলে লোক, যদিও ছবি যা দেখায় সবই মডার্ন। আমি ওঁকে ফোন করে রাখছি। তুই তোর গোটা দু-এক ছবি নিয়ে গিয়ে এঁকে দেখা। ভদ্রলোক হয়তো প্রদর্শনী করতে রাজিও হয়ে যেতে পারেন।

    অবনীশ নিখিলের কথামতো মেহরার সঙ্গে টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তিনটে বাছাই ছবি সঙ্গে নিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করল।

    মিঃ মেহরা ছবিগুলোর দিকে মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে বললেন, এ তো দেখছি সবই চিনতে পারছি–মানুষের মতো মানুষ। বাড়ির মতো বাড়ি। গাছের মতো গাছ। আজকাল তো আর কেউ এমন আঁকে না।

    অবনীশ মৃদুস্বরে বলল, আজ্ঞে, আমি এরকমই আঁকতে ভালবাসি।

    মেহরা বললেন, দেখেন অবনীশবাবু–আমি আপনাকে ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, আমরা নামকরা আর্টিস্টের ছাড়া কারও ছবি এগজিবিট করি না। ছবি বিক্রি হবে এই গ্যারান্টি আমাদের চাই, কারণ কি ছবি বিক্রির তিন ভাগের এক ভাগ টাকা আমরা কমিশন নিই; এ থেকে আমাদের ব্যবসা চলে। শুধু আমাদের নয়–অল কমার্শিয়াল গ্যালারিজ।

    আর যদি ছবি বিক্রি না হয়?

    তা হলে আমাদের লোকসান। বিক্রি হবে জেনেই তো আমরা ওয়েলনোন আর্টিস্ট ছাড়া কারুর ছবি দেখাই না।

    তা হলে আমার ছবি আপনি দেখাবেন না? নৈরাশ্যের সুরে বলল অবনীশ।

    মিঃ মেহরা অবনীশের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, আপনি অন্য কেউ হলে আপনাকে রিফিউজ করে দিতাম, কিন্তু ডক্টর দত্তর ছেলে আমাকে রিকুয়েস্ট করেছে বলে আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিতে পারছি না। তা ছাড়া এরকম ছবির মার্কেট আছে কিনা সেটাও দেখা যাবে। তবে আপনাকে কিন্তু আমাদের টার্মস মেনে নিতে হবে।

    নিশ্চয়ই।

    এই ঘটনার এক মাস পর অবনীশের প্রদর্শনী শুরু হল রূপম গ্যালারিতে। দশ দিন চলবে, বত্রিশখানা ছবি। তার মধ্যে অম্বিকা সেনগুপ্তর পোর্ট্রেটটাও ছিল, তবে সেটা নট ফর সেল। তার জীবনের প্রথম পেশাদারি কাজ অবনীশ হাতছাড়া করবে না।

    প্রদর্শনীতে প্রথম তিনদিন বিশেষ লোক হয়নি। তারপর থেকে দর্শকের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে লাগল। অবনীশ অবাক হয়ে দেখল যে, তার ছবি বিক্রিও হচ্ছে। প্রথমবার বলে সে ছবির দাম বেশ কমই রেখেছিল, তাও চোদ্দখানা ছবি বিক্রি হয়ে কমিশন বাদে তার হাতে এল সাড়ে চার হাজার টাকা। মিঃ মেহরাও তাকে কনগ্রাচুলেট করলেন এবং কথা দিলেন যে ভবিষ্যতেও রূপম অবনীশের ছবির এগজিবিশন করবে।

    কিন্তু একটা ব্যাপারে অবনীশকে চোট পেতে হল। সেটা হল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার প্রদর্শনীর সমালোচনা। বেশিরভাগ সমালোচকই বলেছে যে অবনীশের মস্ত দোষ হল সে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলছে না। একজন বলেছে, আজ যদি কোনও লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের ঢঙে উপন্যাস লেখে তা হলে কি সেটা একটা প্রশংসনীয় ব্যাপার হবে?

    এইসব সমালোচকের নাম অনেকেই জানে না। যার নাম জানে, এবং যার সমালোচনা সকলেই পড়ে সেহল কৃষ্টি সাপ্তাহিকের সমালোচক আনন্দ বর্ধন। অবনীশ জানে যে নামটা ছদ্মনাম, কিন্তু এই নামের পিছনে আসল ব্যক্তিটি কে সেটা সে জানে না। এর সমালোচনার শিরোনাম হল মান্ধাতার আমল। তীরের মতো চোখা চোখা শব্দের ব্যবহারে সমালোচক অবনীশের প্রদর্শনীকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছেন। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে আটের চেহারাও যে আমূল পালটেছে, সে খবর যে এই শিল্পী রাখেন।

    সেটা এর ছবিগুলির দিকে এক ঝলক দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়, লিখছেন আনন্দ বর্ধন। ক্যানভাস ও তেল রঙ আজকাল দুল্য। তাদের এই অপব্যবহার কোনওমতেই বরদাস্ত করা যায় না। প্রদর্শনীর কথা চিন্তা না করে শিল্পী যদি আজকের শিল্পরীতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রয়াস করেন তা হলে হয়তো এর একটা ভবিষ্যৎ গড়ে উঠতে পারে, কারণ রঙ তুলির ব্যবহার যে উনি একেবারে জানেন না তা নয়।

    এই সমালোচনা শুধু অনীশ নয়, তার বাবা এবং তার বন্ধু নিখিলও পড়ল। বাবা বললেন, শিল্পীকে গালমন্দ করাটা, সমালোচকদের একটা হ্যাবিট, কারণ পাঠক প্রশংসার চেয়ে নিন্দাটা বেশি উপভোগ করে। তুই নিরুদ্যম হোস না।

    নিখিল বলল, এই আনন্দ বর্ধন ছদ্মনামের আড়ালে কে লুকিয়ে রয়েছে সেটা বার করে সেই ব্যক্তিকে ধোলাই দিতে হবে।

    অবনীশ কিন্তু সমস্যায় পড়ে গেল। সে অনুভব করল আনন্দ বর্ধনের বাক্যবাণ অনবরত তার মনে বিধছে। সে অত্যন্ত গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগল তার আঁকার ঢং পালটিয়ে সে আধুনিকের দলে চলে আসবে কি না। বারবার সমালোচকের তিরস্কার ও বিদ্রূপ সে সহ্য করতে পারবে না। মডার্ন আর্ট জিনিসটা কী ও কেন, সেটা সে এতদিন জানার চেষ্টা করেনি, এবার করবে।

    প্রদর্শনীর পর ছটা মাস অবনীশ ছবিই আঁকল না; তার বদলে রোজ ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে মডার্ন আর্ট সম্বন্ধে যত বই পাওয়া যায়, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল এবং পড়ল। তার ফলে সে জানল যে বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই প্রধানত ফ্রান্সে কিছু শিল্পীর প্রভাবে আর্টের জগতে এক বিপ্লব ঘটে। তার ফলে ছবির চেহারা একেবারে বদলে যায়, এবং বিপ্লবের প্রভাব ক্রমে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এইসব বইয়ে তার নিজের ঢং-এর একটি ছবিও খুঁজে পেল না অবনীশ।

    এর পরে অবনীশ লাইব্রেরিতে যাওয়া বন্ধ করে ড্রইং-এর খাতায় প্যাস্টেল দিয়ে নতুন রীতিতে ছবি আঁকার চেষ্টা আরম্ভ করল। এভাবে প্রায় ত্রিশখানা খাতা ছবিতে ভরে গেল। ইজেলে সাদা ক্যানভাস খাটানো রয়েছে, কিন্তু তাতে একটা আঁচড়ও পড়েনি।

    নিখিল একদিন এসে বলল, কী রে, তুই কি ছবি আঁকা ছেড়ে দিলি নাকি?

    অবনীশ বলতে বাধ্য হল যে, সে তার ছবির ভোল পালটে আজকের দিনের শিল্পীদের দলে আসার চেষ্টা করছে।

    মডার্ন আর্ট তো খুব সোজা, বলল নিখিল, একটা ক্যানভাস খাটিয়ে তাতে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং এঁকে ভরিয়ে দেব্যস। হয়তো হাজার টাকায় বিক্রিও হয়ে যেতে পারে সেই ছবি।

    অবনীশ তার বন্ধুর কথা খুব পছন্দ করল না। সে বুঝেছে মডার্ন আর্ট অত সোজা নয়। সেটা ঠিকভাবে করতে গেলে শিল্পীর দেশ-বিদেশের সাবেকি আর্ট ও লোকশিল্পের সঙ্গে পরিচয় থাকা চাই। সে পরিচয়ের জন্য সময় লাগে, অধ্যবসায় লাগে। তা হোক–অবনীশ বুঝেছে যে তাকে এই পথেই যেতে হবে। আনন্দ বর্ধনকে বলতে হবে–হ্যাঁ, অবনীশ বোস সার্থক শিল্পী। তার ছবিকে আর অবজ্ঞা করা চলে না।

    দু বছর ধরে অবনীশ আধুনিক ছবি আঁকল। একবার ইজেলে ক্যানভাস খাটিয়ে অয়েল পেন্টিং। এই সময়ের মধ্যে স্বভাবতই তার কোনও রোজগার হয়নি। বাবা আবার তাকে সাহায্য করলেন। বললেন, তোর ছবি এখন আর বুঝতে পারছি না, কিন্তু এটা বুঝেছি যে তুই একটা তাগিদ অনুভব করছিস। তুই যদ্দিন আবার এগজিবিশন না করছিস, তদ্দিন কী খরচ লাগছে না-লাগছে সেটা আমাকে জানাতে দ্বিধা করিস না।অবনী বুঝল এমন বাপ না থাকলে তার শিল্পীজীবন এখানেই শেষ হয়ে যেত।

    আজকাল অবনীশের এক-একটা ছবি আঁকতে বেশ সময় লাগে। একটু বড় ক্যানভাস হলে দুমাসও লেগে যায়। তাই দুবছরে তার ছবির সংখ্যা হল মাত্র বাইশ।

    এই সময় একদিন মেহরার কাছ থেকে একটা ফোন এল। কী খবর অবনীশবাবু? আপনি কি ছবি আঁকা স্টপ করে দিয়েছেন? অবনীশ বলল সে এখনও নিয়মিত ছবি আঁকছে। তা হলে একদিন আপনার বাড়ি গিয়ে দেখি আপনার নতুন ছবি।

    মেহরা এলেন এক রবিবার সকালে। অবনীশ তাঁকে তার স্টুডিওতে নিয়ে গেল।

    এ আপনার কাজ? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মিঃ মেহরা।

    আজ্ঞে হ্যাঁ।

    আপনি স্টাইল একদম চেঞ্জ করে ফেলেছেন?

    কেমন লাগছে বলুন।

    আমি তো নিজে আর্ট বুঝি না। তবে দ্য কালারাস আর ভেরি গুড। আজকাল বড় খদ্দেররা এরকম জিনিসই চায়। এগুলোর সঙ্গে তাদের মডার্ন ফানির্চার খুব ভাল ম্যাচ করে।

    সব ছবির উপর মেহরা একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কিছু বেশ বড় ছবিও ছিল। এই বাইশটাতেই যে রূপম ভরে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।

    অবনীশের প্রদর্শনীর দিন ঠিক হয়ে গেল। এবারও দশদিনের মেয়াদ। এই দশদিনে বাইশটার মধ্যে সতেরোখানা ছবিই বিক্রি হয়ে গেল। বেপরোয়া হয়ে অবনীশ ছবিগুলোর দাম বেশ চড়াই রেখেছিল; সেই দাম দিতেও লোকে দ্বিধা করল না। যা টাকা এল, তাতে অবনীশের দুবছরের সংস্থান হয়ে গেল।

    আর সমালোচনা? অবনীশ দেখল তার বাবাই ঠিক বলেছিলেন। পথে এসো বাবা। লিখেছেন আনন্দ বর্ধন। তবে এই নতুন পথে চলাটা শিল্পীর পক্ষে এখনও সহজ হয়নি। এইভাবে আরও পাঁচ বছর লেগে থাকলে হয়তো অবনীশ বোস শিল্পী আখ্যা পেতে পারেন।

    অবনীশ পত্রিকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। সেই সঙ্গে এই ছদ্মনামধারী ব্যাক্তিটির আসল পরিচয়টা জানবার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। নিখিল বলল, কৃষ্টির একজনের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। সে যদি এখনও থেকে থাকে, তা হলে তাকে ভজিয়ে ছদ্মনামের পেছনে লোকটা কে সেটা হয়তো জানা যেতে পারে।

    এর মাসখানেক পরে একদিন সকালে অবনীশ তার স্টুডিওতে কাজ করছে, এমন সময় চাকর গোবিন্দ এসে ঘরে ঢুকল।

    কী ব্যাপার, গোবিন্দ? জিজ্ঞেস করল অবনীশ।

    আজ্ঞে একটি বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

    কে এল আবার? খদ্দের নাকি? ইতিমধ্যে অবনীশের বাড়িতে লোক এসে তার ছবি কিনে নিয়ে গেছে। গুজরাতি ভদ্রলোক।

    নাম বলেছেন?

    আজ্ঞে না, বললেন জরুরি দরকার।

    বসবার ঘরে বসাও, আমি আসছি।

    অ্যাপ্রন খুলে নিয়ে একটা ন্যাকড়ায় হাতের রঙটা মুছে অবনীশ বৈঠকখানায় গিয়ে হাজির হল। সোফা থেকে একজন চশমা পরা বছর পঁয়ত্রিশ ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন।

    নমস্কার করে ভদ্রলোক বললেন, আমার পরিচয় দিলে হয়তো আপনি চিনবেন। আমার নাম হিমাংশু সেনগুপ্ত। আমি অম্বিকা সেনগুপ্তর বড় ছেলে।

    আপনার বাবার মৃত্যুসংবাদ সেদিন কাগজে পড়লাম।

    আপনি আমার বাবার একটা অয়েল পেপাট্রেট করেছিলেন।

    হ্যাঁ–কিন্তু সে সময় তোত আপনাকে দেখিনি।

    আমি তখন দিল্লি ছিলাম। আমিও ফিরলাম আর বাবাও গেলেন।

    আই সি।

    এই পোর্ট্রেটটা নিয়েই একটু কথা বলতে এসেছি।

    কী ব্যাপার?

    কাল সন্ধ্যায় বাবার স্মৃতিসভা আছে শিশির মঞ্চে। অনেক খুঁজেও বাবার এমন একটাও ফোটো পাইনি যেটা এনলার্জ করে সভায় রাখা যেতে পারে। তাই ভাবছিলাম আপনি যদি একদিনের জন্য আপনার ওই ক্যানভাসটা ধার দেন।

    নিশ্চয়ই, বলল অবনীশ। এ নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। আপনি কি এটা এখনই নিয়ে যেতে চান?

    হাতের কাছে আছে কি? আমার ঠিক একদিনের জন্য দরকার।

    আপনি পাঁচ মিনিট বসুন। আমি নিয়ে আসছি।

    অবনীশ জানত ছবিটা কোথায় আছে। সেটা বার করে আবার ধুলো ঝেড়ে একটা খবরের কাগজে মুড়ে এনে হিমাংশু সেনগুপ্তর হাত দিল। ভদ্রলোক সেটা নিয়ে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন।

    অবনীশ স্টুডিওতে ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় নিখিল এসে ঢুকল।

    কাকে বেরোতে দেখলাম রে? প্রশ্ন করল নিখিল।

    অবনীশ একটু ম্লান হাসি হেসে বলল, আমার প্রথম অয়েল পোর্ট্রেটের সাবজেক্টের ছেলে। অর্থাৎ অম্বিকা সেনগুপ্তর ছেলে।

    বটে? নাম বলেছে?

    হ্যাঁ। হিমাংশু।

    ছবিটা নিল কেন?

    ওঁর বাবার স্মৃতিসভা আছে, ভাল ফোটোগ্রাফ পায়নি, তাই ও পোর্ট্রেটটা রাখবে।

    তুই খুব ভুল করেছিস।

    কীসে?

    ছবিটা দিয়ে।

    কেন?

    ও-ই  বলেছিল মান্ধাতার আমল।

    অ্যাঁ!

    ইয়েস স্যার। আনন্দ বর্ধন হিমাংশু সেনগুপ্তর ছদ্মনাম।

    .

    অবনীশের মুখ থেকে অবাক ভাবটা কেটে গিয়ে একটা বিশেষ ধরনের হাসি ফুটে উঠল। তারপর চাপা স্বরে কথাটা বেরোল

    পথে এসো বাবা, পথে এসো।

    সন্দেশ, বৈশাখ ১৩৯৭

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদুই বন্ধু
    Next Article অক্ষয়বাবুর শিক্ষা

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    ফেলুদা এণ্ড কোং – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৫ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ৭ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.