Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শুভদা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প182 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    শুভদা

    দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

    জয়াবতী মরিয়াছে, কিন্তু তাহার মা বাঁচিয়া আছে। নারায়ণপুরের কিছু উত্তরে বাসপুর গ্রামে জয়াবতীদের বাটী। সেইখানে জয়া ও তাহার জননী থাকিত। কেমন করিয়া যে তাহাদিগের গ্রাসাচ্ছাদন চলিত তাহা তাহারাই জানিত। আর শুনিতে পাই গ্রামের দুই-চারিজন মন্দ লোকও তাহা জানে, কিন্তু আমাদিগের তাহা জানিয়া কোন লাভও নাই, শুনিতে বাসনাও নাই। যাউক সে কথা। এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইল, তাহার পর জানি না কি উপায়ে জয়াবতী নারায়ণপুরের জমিদারবাবুর নিজ ভবনের একাংশে স্থান পাইল। যখন সে পাইল তখন তাহার মাতাও আসিল; তখন দুইজনে ঘরকন্না পাতাইয়া দিল; কিন্তু জয়ার মার অদৃষ্ট ভাল ছিল না, তাই মাসপাঁচেক যাইতে না যাইতেই মাতা কন্যার কলহ হইতে লাগিল। কিছু দিন পরে এরূপ হইল যে, দু জনে দুসন্ধ্যা রীতিমত চিৎকার করতঃ উভয়ে উভয়ের মঙ্গল-কামনা এবং আশু সংসার-বন্ধন মুক্ত হইবার বিশেষ প্রার্থনা না করিয়া জলগ্রহণ করিত না। এরূপেও দিন কাটিতে লাগিল, আরো ছয় মাস কাটিল। তাহার পর জয়ার মা প্রাসাদ-বাস-লালসা পরিত্যাগ করিয়া তাহার পরিত্যক্ত পুরাতন ভবনে চলিয়া গেল। বোধ হয় তাহাকে সেখানে যাইতে নিতান্ত বাধ্য করা হইয়াছিল, কেননা যাইবার কালীন সে যেরূপ নির্মমভাবে বুক চাপড়াইতে চাপড়াইতে এবং কন্যা ও তাহার—কল্যাণ-ভিক্ষা করিতে করিতে গিয়াছিল তাহা দেখিলে কিছুতেই বোধ হয় না যে, ইচ্ছাসুখে সে এ আবাস পরিত্যাগ করিয়া যাইতেছে। সেই অবধি সুরেন্দ্রবাবুর নিষেধ ছিল যেন সে মাগী কিছুতেই আর এবাড়িতে না ঢুকিতে পায়। কিন্তু তাহা হইত না। সে মাগী আবার আসিত, আবার প্রবেশ করিত। কিন্তু ফল কিছুই হইত না। বহুবিধ গালিগালাজ, শাপশাপান্ত, অশ্রুপাত, বুকে দারুণ চপেটাঘাত, মস্তকের কেশোৎপাটন এবং পরিশেষে ভৃত্যহস্তের ‘অর্ধচন্দ্র’, এই লইয়া জয়ার মাকে বাসপুরে ফিরিয়া যাইতে হইত। প্রতি দুইমাস-একমাস ব্যবধানে ইহা নিশ্চয় ঘটিত। বোধ হয় ইহাতে তাহার ভিতরে ভিতরে কিছু লাভ ছিল, না হইলে শুধু এইগুলির জন্যই সে অত পরিশ্রম করিয়া এতদূরে আসিত না; সে যেরূপ চরিত্রের লোক ছিল তাহাতে এগুলি আর কোথায় অনেক কম ক্লেশে উপার্জন করিয়া লইতে পারিত। যাক একথা—এমনও হইতে পারে যে, সে কন্যারত্নকে অতিশয় স্নেহ করিত, এইজন্য বিপথগামিনী হইলেও মায়া কাটাইতে পারিত না—দেখিতে আসিত। এইরূপে চলিত। তাহার পর যখন সে শুনিল যে, জয়াবতী গঙ্গায় ডুবিয়া ভবলীলা সাঙ্গ করিয়াছে তখন চিৎকার শব্দে বাসপুরের অর্ধেক প্রতিবাসীকে আপনার বাটীর সম্মুখে একত্র করিয়া ফেলিল।
    বাসপুরে অধিকাংশই ছোটলোকের বাস, সেজন্য অধিকাংশ চাষাভুষা লোকের বাটীস্থ বৃদ্ধা, প্রৌঢ়া, আধবয়সী, যুবতী প্রভৃতি দর্শকবৃন্দে জয়ার মার দাওয়া দেখিতে দেখিতে ভরিয়া গেল। তখন সকলে বিস্ময়-বিস্ফারিত নয়নে, বাক্‌শক্তিহীন হইয়া এ কাহিনী শুনিল যে, জয়াবতীর গ্রামজোড়া জাহাজখানা প্রায় পাঁচশত দাসদাসীর সহিত কলিকাতার অতল জলতলে মগ্ন হইয়া গিয়াছে।

    তখন জয়ার মা বলিল, যারা দেখেচে, তারা বলচে যে অত বড় জাহাজ কলকাতা শহরে নেই।

    একজন বৃদ্ধা প্রত্যুত্তরে বলিল, তা ত নেই-ই।

    একজন আধবয়সী বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিয়া ফেলিল, কত দাম ছিল?

    আর বাছা দামের কি আর নেখা-জোখা আছে?

    সে চুপ করিল।

    জয়ার মা কহিল, নিজে লাটসাহেব পর্যন্ত দেখতে এসেছিল।

    যুবতীরা কান খাড়া করিয়া উঠিয়া বসিল।

    নিজে লাটসাহেব পর্যন্ত কেঁদে সারা—বাছাকে সবাই ভালবাসত কিনা!

    এইখানে জয়ার মা চোখের কোণে অঞ্চলটা রগড়াইয়া লইল। আর শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকেই মনে মনে প্রার্থনা করিল যে, কি সুকৃতি-বলে পরজন্মে জয়াবতীরূপে জন্মগ্রহণ করা যায়।

    জয়ার রূপের কি আদি-অন্ত ছিল? সাক্ষেৎ দুর্গা-প্রতিমে—আহা; কিবা নাক, কিবা চক্ষু, কি ভুরুর ছিরি, কি গড়ন-পেটন, কোনখানে একতিল খুঁত ছিল কি?

    যুবতীরা চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু বৃদ্ধা, প্রৌঢ়া, এমন কি দুইজন আধবয়সীও স্বীকার করিল যে ইহা স্বতঃসিদ্ধ।

    বাবু কি কম ভালবাসতেন? যখন যা বলেচে তখনই তাই পেয়েচে। অত বড় রাজাতুল্য লোকের নজরে পড়া কি সোজা কথা!

    একথা মনে মনে প্রায় সকলেই স্বীকার করিল।

    আমিও আর বেশিদিন বাঁচব না—এ শোক কি বরদাস্ত হবে?

    ইহাতে কাহারও হয়ত সন্দেহ ছিল, কিন্তু সহানুভূতি প্রকাশ করিতে কেহ ছাড়িল না।

    একজন জিজ্ঞাসা করিল, জমিদারবাবুর কি হল?

    তিনি ভাল আছেন; আলাদা জাহাজে ছিলেন কিনা তাই রক্ষা পেয়েচেন।

    দুজনে কি তবে আলাদা জাহাজে ছিল?

    তা ছিল বৈ কি, না হলে কুলুবে কেন? লোকজন ত সঙ্গে কম যায়নি!

    তাদের কি হল?

    আহা! সবাই ডুবেচে।
    সে বেলাটা এমনই কাটিল। ‘সন্ধ্যা হয়, ঘরকন্নার কাজ পড়ে আছে’ বলিয়া ‘কি আর কোরবে বল? তবে এখন আসি’, সকলেই একে একে প্রস্থান করিল। জয়ার মাও একটা যা-তা করিয়া সিদ্ধ পাক করিয়া লইয়া সকাল সকাল দ্বার বন্ধ করিল, আর যতক্ষণ নিদ্রা না আসিল ততক্ষণ মধ্যে মধ্যে চিৎকার করিয়া প্রতিবাসিনীগণের অন্তঃকরণে সেই গ্রামজোড়া জাহাজ আর লাটসাহেবের কান্নার কথা জাগাইয়া দিতে লাগিল।

    পরদিন প্রাতঃকাল হইবামাত্রই জয়ার মা নারায়ণপুর অভিমুখে রওনা হইয়া পড়িল। ক্রমে সে নারায়ণপুরে প্রবেশ করিল। সেই পথ, সেই ঘাট, সেই বৃক্ষের শ্রেণী, সেইসব—সমস্ত পরিচিত। জয়ার মার মনে পড়িল যে, এই পথ দিয়াই সে চলিত, আবার এই পথ দিয়াই বক্ষে আঘাত করিতে করিতে ফিরিয়া আসিত। আর সে নাই, তেমন ঝগড়া আর কখন হইবে না, তেমন করিয়া বুক পিটিতেও আর পাইবে না। শত বেদনায় তাহার হৃদয় আকুল হইয়া উঠিল; সহস্রগুণ চিৎকারে তাহা শমিত করিতে করিতে জয়ার মা চলিল। যাহার বাটীর সম্মুখ দিয়া যাইতে লাগিল, তাহাকে শতকর্ম ফেলিয়াও অন্ততঃ একবার জানালার নিকট আসিতে হইল। ক্রমে সুরেন্দ্রবাবুর অট্টালিকা ঐ সম্মুখে! জয়ার কত স্মৃতি তাহাতে মাখান আছে; জয়ার মা আকুলভাবে ক্রন্দনের তোড় আরো সহস্রগুণ বৃদ্ধি করিয়াছিল। সম্মুখের গেট দিয়া পূর্বে সে ঢুকিতে পাইত না; কারণ বাবুর নিষেধ ছিল, কিন্তু এখন সে যেরূপ ব্যাঘ্রিনীর ন্যায় ছুটিতে ছুটিতে প্রবেশ করিয়া পড়িল যে, দ্বারবানদিগের বাধা দিতে কিছুতেই সাহস হইল না। সকলেই প্রায় দশহস্ত পিছাইয়া দাঁড়াইল।

    সুরেন্দ্রবাবু তখন আহারান্তে বিশ্রাম করিবার প্রয়াস করিতেছিলেন, চিৎকার শব্দে বুঝিলেন জয়ার মা ঝড়ের মত আসিয়া পড়িল। আসিয়াই সে জয়াবতীকে ফিরাইয়া পাইবার জন্য অন্ধভাবে এক আবেদন করিয়া নিকটেই উপবেশন করিল, তাহার পর আর এক আবেদন, আর এক আবেদন, কথা শেষ না হইতেই পুনঃপুনঃ শতসহস্র আবেদন, ভিক্ষা প্রার্থনা, কৈফিয়ৎ, তলব ইত্যাদি—নানাপ্রকারে সুরেন্দ্রনাথকে একবারে বিহ্বল করিয়া ফেলিল; তৎপশ্চাদ্বর্তী মস্তক ঠোকন, দারুণ বক্ষাঘাত ও সমুষ্টি কেশাকর্ষণ প্রভৃতি আর যাহা ঘটিল তাহা সম্যক বিস্তারিত বলিবার ক্ষমতা আমাদের নাই।
    সর্বশেষে জয়ায় মা এই বলিয়া শেষ করিল যে, তাহার আর একটি পয়সাও খাইতে নাই, এবং দয়া না করিলে হয় সে অনাহারে মরিবে, নাহয় এইখানে গলায় দড়ি বাঁধিয়া তাহার জয়াবতী যেখানে গিয়াছে সেইখানেই যাইবে।

    সুরেন্দ্রবাবু বলিলেন, যা হইবার হইয়াছে, এখন কি হইলে তোমার চলে?
    জয়ার মা চক্ষু মুছিয়া বলিল, বাবা, আমার সামান্যতেই চলিবে—আমি বিধবা, কেউ নাই—কত আর আমার লাগিবে?

    সু। তবু কত টাকা চাও?

    জ-মা। পনের টাকা মাসে পেলেই আমার চলে।

    সু। তাই পাইবে। যতদিন বাঁচিবে, মাসে মাসে কাছারি হইতে ঐ টাকা লইয়া যাইয়ো।

    তখন জয়ার মা অনেক আশীর্বাদ করিল, অনেক প্রীতিপ্রদ কথা কহিল, তাহার পর প্রস্থান করিল। যাইবার সময় সে আর তেমন করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে গেল না, বরং আরো অনেক কথা ভাবিতে ভাবিতে গেল। জয়াবতী মরিয়াছে, মা হইয়া সে অন্তঃকরণে ক্লেশ অনুভব করিয়াছে, কিন্তু কিছু সুবিধাও হইয়াছে, যাইবার সময় জয়ার মা একথা মনে করিতে ভুলিল না।

    জয়ার মা সুরেন্দ্রবাবুর নিকট বিদায় লইয়া একেবারে চলিয়া গেল না। যেস্থানে দাসদাসীরা থাকে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। তথায় পরিচিত দাসদাসী অনেকেই ছিল, জয়ার মার দুঃখে তাহাদের মধ্যে অনেকেই দুঃখ প্রকাশ করিল, দুই-একজন কাঁদিয়া ফেলিল। জয়ার মা অনেক গল্প করিল, সুরেন্দ্রবাবুর দয়ার কথাও প্রকাশ করিল; কিন্তু কথায় কথায় ক্রমশঃ যখন সে শুনিল যে, তাহার জয়াবতীর স্থানে আর একজন সদ্য অভিসিক্ত হইয়া আসিয়াছে, এবং বাবু তাহাকে বহু সমাদরে বাগানবাটীতে স্থান দিয়াছেন, তখন জয়ার মা অন্য আকৃতি ধারণ করিল। চক্ষু দিয়া আগুন বাহির হইতে লাগিল; স্থান কাল বিবেচনাহীন হইয়া সেইখানেই বাগানবাটী-অধিকারিণীর উদ্দেশে বহুবিদ হীনবাক্য গালিগালাজ আরম্ভ করিয়া দিল। ক্রন্দনের ধ্বনি ক্রমশঃ বাড়িয়া উঠিতে লাগিল; অদম্য উৎসাহে নবীন করিয়া পুনরায় সেই কেশাকর্ষণ, সেই বুক-চাপড়ানি। দাসদাসীরা ভীত হইল, শান্ত হইবার জন্য অনেক বুঝাইল, শেষে বাবুর ভয় পর্যন্ত দেখাইল, রাগ করিয়া বাবু টাকা বন্ধ করিয়া দিবেন তাহাও বলিল, কিন্তু জয়ার মা বহুক্ষণাবধি তাহাতে কর্ণপাতও করিল না। পরিশেষে তাহারা বাধ্য হইয়া অন্য উপায় উদ্ভাবন করিয়া জয়ার মার হস্ত হইতে বহু ক্লেশে নিষ্কৃতি লাভ করিল।
    পথে আসিয়া জয়ার মা বাগানবাটী অভিমুখে চলিল। কন্যাশোক তাহার চতুর্গুণ উথলিয়া উঠিয়াছে, হিংসানল পঞ্জরে পঞ্জরে অগ্নি জ্বালাইয়া দিয়াছে। তাহার মনে হইতে লাগিল, তাহার কন্যাকে এ মাগী ডুবাইয়া দিয়া বলপূর্বক সে স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছে। গর্জাইতে গর্জাইতে তখন জয়ার মা বাগানবাটীতে প্রবেশ করিল। যে দাসী সম্মুখে পড়িল তাহার পানে ক্রোধকষায়িত নয়নে চাহিয়া বলিল, সে ডাইনী কোথা?

    সে বেচারী নূতন লোক, ভয়ে ভয়ে পিছাইয়া বলিল, ঐ হোথা।

    সে যেমন প্রশ্ন করিয়াছিল, তেমনি উত্তর পাইল। সেও প্রশ্নের অর্থ বুঝিতে পারে নাই, জয়ার মাও উত্তরের অর্থ বুঝিতে পারিল না। আর একবার তাহার পানে সেইরূপ চাহিয়া বলিল, কোথা?

    সে অঙ্গুলি হেলাইয়া যথেচ্ছা একটা দিক দেখাইয়া দিয়া সরিয়া পড়িল। জয়ার মা সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিল। সেখানে কক্ষে কক্ষে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল—কাহারও সহিত সাক্ষাৎ হয় না। কিন্তু এ কি শোভা! কি আসবাব, কি বহুমূল্য সাজসজ্জা! সে পূর্বে সুরেন্দ্রবাবুর বাটীতে অনেকদিন ছিল, সেখানে বহু দ্রব্য দেখিয়াছে, কিন্তু এমন কখনও দেখে নাই। যত দেখিতে লাগিল, তত ক্রুদ্ধ সর্পের মত ফোঁস ফোঁস করিতে লাগিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, এ সকল সমস্তই জয়াবতীর হইত, আর কে জানে—হয়ত কোন সময়ে তাহারই বা হইতে পারিত না? এইরূপে মনে মনে তর্কবিতর্ক করিতে করিতে সে একটা কক্ষে একজন স্ত্রীলোকের দেখা পাইল। পশ্চাৎ হইতে তাহাকে দেখিয়া জয়ার মা একজন পরিচারিকা স্থির করিল। ডাকিয়া কহিল, ওগো, তোদের গিন্নী কোথায়? অস্বাভাবিক কর্কশবচনে সে ফিরিয়া চাহিল। জয়ার মা দেখিল তাহার সামান্য বস্ত্র, গাত্রে অলঙ্কারের নামমাত্র নাই—কিন্তু মুখ দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল, কর্কশ কণ্ঠস্বর নরম হইয়া আসিল; বলিল, তুমি কে গা?

    আমি এইখানে থাকি। আপনি বসুন।

    জয়ার মা। তুমি কতদিন আসিয়াছ?

    স্ত্রীলোক। প্রায় একমাসের কিছু অধিক।

    জয়ার মা। তোমাদের গিন্নী কোথায়? তুমি বুঝি তারি সঙ্গে এসেচ?

    স্ত্রীলোকটা মাথা নাড়িয়া বলিল, তাঁর সঙ্গে কিছু প্রয়োজন আছে কি?

    প্রয়োজন আমার ঢের আছে। সেই ডাইনী হারামজাদীর মুণ্ডুটা আজ চিবিয়ে খাব। বলিতে বলিতে তাহার সেই পূর্বভাব, সেই রুক্ষ মুখশ্রী, সেই অমানুষিক চোখের ভাব সমস্তই ফিরিয়া আসিল—জানিস আমি কে? আমি জয়ার মা, আমাকে দেশসুদ্ধ লোক চেনে। হারামজাদী ডাইনী আমার মেয়েকে খেয়েচে—আজ আমি তাকে খাব—খাব—খাব (দন্তে দন্ত ঘর্ষণ) খাব, তবে যাব, খাব—খাব—খাব—সব শেষ কোরে তবে যাব।
    স্ত্রীলোকটি রুদ্ধশ্বাসে সে অলৌকিক ভঙ্গি দেখিতে লাগিল।

    ওরে হারামজাদী তোকে খাব (বক্ষে চপেটাঘাত)—ওরে আবাগী—শতেক খোয়ারি—ছেনাল—ডাইনী (মস্তকের কেশাকর্ষণ) তোকে খাব—তোকে খাব—তোকে খাব—মা-কালীর পায়ে বুক চিরে রক্ত দেব—আর এমনি কোরে মাথা খুঁড়ে হাড় দেব (ভূমিতলে মস্তক ঠোকন)—ওরে আবাগী, এমনি কোরে—এমনি কোরে (দন্তে দন্ত ঘর্ষণ)— কই, কোথা সে?

    যাহার উদ্দেশে এত হইতেছিল, সেই সুমুখে বসিয়াছিল; জয়ার মা কিন্তু তাহা জানিত না, জানিলে বোধহয় সেদিন কিছু একটা ঘটিয়া যাইত।

    মালতী নিকটে আসিয়া হাত ধরিল, ধীরে ধীরে বলিল, আপনি চুপ করুন—

    আমি চুপ কোরব! তুই হতভাগী সেকথা বলবার কে? আমার মেয়েকে খেয়েচে, আর আমি চুপ কোরে থাকব? (পুনরায় ভূমিতলে মস্তকাঘাত)

    মালতী বুঝিল, অত মোটা কার্পেট না থাকিলে জয়ার মা সেদিন আস্ত মাথা লইয়া বাটী ফিরিয়া যাইতে পারিত না। কহিল, তিনি আজ এখানে নাই।
    এখানে নাই?
    মা। না।
    জয়ার মা। আমি কিন্তু এক পাও এখান থেকে নোড়ব না—হারামজাদীকে দেখব, খাব—তবে যাব!
    মালতী অল্প হাসিয়া বলিল, যাবেন কেন? স্বচ্ছন্দে এখানে থাকুন। কিন্তু অনেক বেলা হল, খাওয়া-দাওয়া ত এখনও আপনার হয় নাই?
    জয়ার মা। খাওয়া-দাওয়া? তা তখন একেবারেই কোরব।
    মা। আহা, মেয়ের শোক! মার প্রাণ যে কি কোরচে তা আমিই জানি।
    জয়ার মা ঈষৎ নরম হইল, বলিল, তাই বুঝে দেখ বাছা!
    মা। তা কি আর বুঝিনে! কিন্তু কি করবেন বলুন—মুখেও ত কিছু দুটো দিতে হয়, পোড়া পেট ত আর মানে না।
    জয়ার মা। তা সত্যি কথা।
    মা। তাই বলচি, এখানেই দুটো জোগাড় করে দিই—
    জয়ার মা। দিবি? তা দে বাছা।
    মা। আহা! জয়াদিদি আপনার কথা কত বোলতেন।
    জয়ার মা। বোলত? তা বলবে বৈ কি! তুই তাকে দেকেচিস!
    মা। আহা—কতদিন একসঙ্গে এলাম—তাঁকে আর দেখিনি?
    জয়ার মা। তুই বুঝি তার সঙ্গে ছিলি?
    মা। হাঁ, তিনি আমাকে আমার দেশ থেকে তুলে নিয়েছিলেন।কত কথা বোলতেন—তার মধ্যে আপনার কথাই বেশি হোত।
    জয়ার মা। তা হবে বৈ কি! সে আমার তেমন মেয়ে ছিল না।
    মা। তিনি খুব ভাল লোক ছিলেন।
    জয়ার মা। আহা, অমন মেয়েও মরে! কিন্তু তোদের এ ডাইনী কোত্থেকে উঠল?
    মা। কলকাতা থেকে।
    জয়ার মা। মাগী বুঝি বাবুকে ওষুধ করেচে?
    মা। শুনতে ত পাই।
    জয়ার মা। কিন্তু আমি তার ওষুধ করা আজ ভেঙ্গে দেব।
    মা। দিও—মাগী যেমন—তেমনি শোধ দিয়ে তবে যেয়ো।
    জয়ার মা। তা যাব। মাগী মন্তর-তন্তর কিছু জানে?
    মা। মন্তর-তন্তর? শুনতে পাই কামিখ্যে থেকে শিখে এসেছিল। মানুষকে ভেড়া কোরে রাখতে পারে। এই বাবুকে এমনি করেচে যে, ইনি উঠতে বললে ওঠেন, বসতে বললে বসেন।
    জয়ার মার মুখখানা কিছু বিবর্ণ হইয়া গেল। শুষ্কমুখে বলিল, তা মন্তর-তন্তর আমিও জানি।
    মা। জানবে না কেন? তা আজ দুপুরবেলা যখন আসবে তখন দেখিয়ে দেব।

    জয়ার মা। বাণ মারতে জানে?
    মা। জানে বৈ কি!
    জয়ার মা। কখন আসবে?
    মা। দুপুরবেলা।
    জয়ার মা জানালা দিয়া বাহিরে চাহিয়া দেখিল। বোধ হইল যেন দুপুর হইতে অধিক বিলম্ব নাই। ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, আজ কিন্তু আমার ঢের বরাত আছে—আজ তবে এখন যাই, কাল আসব। জয়ার মা উঠিয়া দাঁড়াইল।
    মা। না, না, আজ এখানে খেয়ে-দেয়ে যান।
    জয়ার মা।বড় দেরি হবে যে।
    মা। কিছুই দেরি হবে না!
    জয়ার মা। তবে শীগ্‌গির শীগ্‌গির নে মা। তোর নামটি কি বাছা?
    মা। আমার নাম মালতী।
    জয়ার মা। আহা বেশ নাম।
    জয়ার মা তখন নীচে আসিয়া তাড়াতাড়ি করিয়া কিছু আহার করিয়া লইল। মালতী নিকটে বসিয়া দেখিল যে, জয়ার মার আহারে তেমন সুবিধা হইল না, উঠিয়া বলিল, তবে এখন যাই মা।
    মা। একটা কথা আপনাকে এখনো বলা হয়নি—জয়াদিদির কাছে আমি দশ টাকা ধার নিয়েছিলাম—তা তিনি ত নেই, এখন আপনি যদি দয়া করে আমাকে ঋণমুক্ত করেন।
    জয়ার মা ভাল বুঝিতে পারিল না। বলিল, কি করি?
    মা। সেই দশ টাকা আপনি নিন।
    জয়ার মা। আমাকে তুমি দেবে?
    মা। হাঁ।
    মালতী উপর হইতে দশ টাকা আনিয়া তাহার হাতে দিল।
    জয়ার মা অনেকক্ষণ ধরিয়া মালতীর মুখপানে চাহিয়া রহিল। তাহার পর ধীরে ধীরে বলিল, বাছা, তুই নিশ্চয় ভদ্দরঘরের মেয়ে।
    মালতী মৃদু হাসিয়া বলিল, আমি দুঃখী লোক।
    জয়ার মার চোখের কোণে একটু জল আসিল। বলিল, তা হোক—তবুও তুই ভদ্দরের মেয়ে না হলে—এই দেখ্‌ না কেন—তা সত্যি কথাই বলি, আমার জয়ার হাতে এত টাকা ছিল, কিন্তু মা বলে দশ টাকা কখন একসঙ্গে এমন করে হাতে তুলে দেয়নি। জয়ার মা চোখের কোণ মুছিল।
    মা। আমরা দুঃখী লোক, কিন্তু ধর্ম ত আছেন।
    জয়ার মা। আছেন; কিন্তু সবাই কি তা জানে?
    মা। তা হোক—কাল তবে আসবে?
    জয়ার মা। হ্যাঁ—তা—হ্যাঁ আসব বৈ কি।
    মা। আমাদের ঠাকরুনকে তোমার কথা আজ তবে বলে রাখব কি?
    জয়ার মা। হ্যাঁ—তা—না তা আর বলে কাজ নেই।

    কামরূপ হইতে শিক্ষা করা ‘বাণমারা’ বিদ্যাটা জয়ার জননীর মনে বড় শান্তি দিতেছিল না, মালতী তাহা বুঝিতে পারিয়াছিল।
    জয়ার মা শুষ্ক হইয়া বলিল, তবে এখন আসি, মাঝে মাঝে তোর কাছে আসব এখন।
    মা। এসো!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশেষ প্রশ্ন
    Next Article বিরাজবৌ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }