Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শেষ বিকেলের মেয়ে – জহির রায়হান

    জহির রায়হান এক পাতা গল্প115 Mins Read0

    ০২. নাহার

    নাহার

    কাসেদের আপনি বোন নয় নাহার।

    মায়ের দূর সম্পৰ্কীয় এক খালাতো বোনের মেয়ে। ছােটবেলায় ওর মা মারা যান। ওর বাবা তখন কি একটা কোম্পানীতে চাকরি করতেন।

    স্ত্রীকে হয়তো বড় ভালবাসতেন। তিনি, তবুও কিছুদিন পরে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মিলিটারীতে চলে যান। নাহারকে রেখে যান মায়ের কাছে। মাঝে মাঝে চিঠি আসতো।

    কখনো মাদ্রাজ থেকে। কখনো পেশোয়ার থেকে। কখনো কানপুর।

    শেষ চিঠি এসেছিলো আরাকান থেকে।

    তারপর তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি।

    কেউ বলেছে যুদ্ধে মারা গেছে।

    কেউ বলেছে, জাপানীরা ধরে নিয়ে গেছে টোকিওতে।

    লড়াই শেষ হলো।

    সন্ধি হলো শত্ৰু-মিত্ৰে।

    তারপর আরো কত বছর গেলো নাহারের বাবা আর ফিরে এলেন না।

    মা বলতেন, আমার কোন মেয়ে নেই, তুই আমার মেয়ে। তোকে মানুষ করে বড় ঘরে বিয়ে দেবো। আমি। তোর ঘরের নাতি-পুতি দেখবো, তবে মরবো।

    বাবা বলতেন, বেশ হলো, এতদিনে মেয়ের সখ মিটলো তোমার।

    মা বলতেন, মিটবে না। খোদার কাছে কত কেঁদেছি, কত বলেছি আমায় একটা মেয়ে দাও। দেখলেতো, খোদার কাছে যা চাওয়া যায়। তাই পাওয়া যায়। তবু তুমি এক বেলা নামাজ পড় না। কেন পড়ােনা বলতো? তোমার কি পরকালের একটুও ভয় হয় না?

    আবার ইহকাল পরকাল নিয়ে এলে কেন বলতো? বাবা ক্ষেপে উঠতেন, বেশ তো কথা হচ্ছিলো।

    মা স্নান হেসে বলতেন, নামাজের নাম নিলেই তোমার গায়ে জ্বর আসে কেন বলতে পারো?

    বাবা কিছু বলতেন না, শুধু সরোষ দৃষ্টিতে এক পলক তাকাতেন মায়ের দিকে। মা আফসোস করে বলতেন, তুমি আমাকে দোজখে না নিয়ে ছাড়বে না। বাবা নির্বিকার গলায় জবাব দিতেন, বেহেস্তের প্রতি আমার লোভ নেই। তোমার যদি থেকে থাকে তুমি যেও, আমি তোমার পথ আগলে দাঁড়াবো না। এরপর মা থেমে যেতেন, অবুঝ স্বামীর সঙ্গে তর্ক করা নিরর্থক তা তিনি ভালো করেই জানতেন।

    সামনে খোলা খাতাটার দিকে চোখ পড়তেই কাসেদ বিব্রত বোধ করলো। কবিতা লিখতে বসে খাতার মধ্যে এতক্ষণ সব কি লিখছে সে? ইকবাল, জাহানারা, বিয়ে, নাহার, মিলিটারী, কানপুর, নামাজ, শিউলি। একটার পর একটা হিজিবিজি লেখা। সাদা কাগজটা আরো অনেক শব্দের ভরে ভরে উঠছে। খাতা থেকে পাতাটা ছিড়ে নিয়ে বাইরে ফেলে দিলো কাসেদ।

    দরজার দিকে চােখ পড়তে দেখলাে, নাহার দাঁড়িয়ে।

    কি ব্যাপার কিছু বলবে?

    নাহার বললো, মা ডাকছেন। বলে চলে গেল সে।

    মা তখনো গল্প করছিলেন খালুর সঙ্গে। খালু একটা মোড়ার ওপর বসে। মা চৌকির ওপর পা ছড়িয়ে খালুর পান বানাচ্ছেন, আর কি যেন আলাপ করছেন।

    নাহার একপাশে দাঁড়িয়ে।

    কাসেদ আসতে মা বললেন, বস।

    খালু বললেন, তুমি কি সেই কেরানীগিরির চাকরিটা এখনো আঁকড়ে রেখেছো নাকি?

    কাসেদ সায় দিয়ে বললো, হ্যাঁ।

    খালু বললেন, অন্য কোথায় ভালো দেখে একটা কিছু পাওয়া যায়। কিনা চেষ্টা-চরিত্র করো। এ দিয়ে কতদিন চলবে।

    খালু নিজে এককালে কেরানী ছিলেন; তাই কেরানীগিরির বেদনা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন।

    কাসেদকে চুপ থাকতে দেখে তিনি আবার বললেন, ধোপার গাধা আর কোম্পানীর অফিসের কেরানীর মধ্যে পার্থক্য নেই বুঝলো? এতে না আছে কোন রোজগার, না আছে সম্মান।

    কাসেদ বললো, তিনজন মানুষ আমরা, এ রোজগারেই চলে যাবে। টাকা টাকা করে, টাকা দিয়ে করবো কি?

    মা বললেন, শোন, ছেলের কথা শোন। যেন সংসার এই থাকবে। ঘরে আর বউ ছেলে আসবে না। বলি তুই এমন হলি কি করে বলতো, তোর বাবা তো এমনটি ছিলেন না। কাসেদ কোন উত্তর দেবার আগেই খালু বললেন, ‘এ নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। বড়বু’। মাথায় বোঝা চাপলে আপনা থেকেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে একগাল হাসলেন তিনি। নাহার হঠাৎ বললো, মা ভাত দেবো?

    মা ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, তাইতো, কথায় কথায় দেখছি অনেক রাত হয়ে গেছে। যাও ভাত বেড়ে না ও, তোমার খালুও এখানে খাবেন।

    খালু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, না বড়বু, আমি বাসায় গিয়ে খাবো। ওরা সবাই বসে থাকবে।

    মা হেসে বললেন, মেয়ে আসছে বেড়াতে, বাসায় নিশ্চয়ই খুব ভালো পাক-শাক হচ্ছে। আমাদের এখানে ডাল-ভাত কি আর মুখে রুচবে?

    কি যে বলেন বড়বু, খালু বিনয়ের সঙ্গে বললেন, বাসায় কি আর আমরাও কোর্মা পোলাও খাই, ডাল ভাত সব জায়গায়। এখন চলি, আরেক দিন এসে খেয়ে যাবো। যাবার উদ্যোগ করতে করতে আবার থেমে গেলেন খালু। কাসেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সালমা এসেছে ঢাকায়। বড়বু’কে বলে গেলাম রোববার দিন ওকে নিয়ে বাসায় এসো। কাসেদ অবাক হয়ে বললো, রোববার দিন কেন?

    মা বললেন, তোমাদের দাওয়াত করে গেলেন উনি। নাতিনের আকিকা হবে। প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না কাসেদ। যখন বুঝতে পারলো তখন আরো চিন্তিত হলো সে, সালমার মেয়ে হয়েছে নাকি?

    মা পরীক্ষণে বললেন, ওমা তুই জানিসনে? বলতে গিয়ে কথাটা গলার মধ্যে আটকে গেলো তার। ঢোক গিলে আবার বললেন, আজ তিন মাস হতে চললো, তা তুই জানবি কোথেকে, আত্মীয়-স্বজন কারো খোঁজ কি তুই রাখিস। কি যে হলি বাবা।

    খালু হেসে বললেন, ও কিছু না বড়বু। এ হলো কেরানী রোগ।

    আর কারো কথা মনে থাকে না, সব ভুলে যেতে হয়।

    আরেকটা পান মুখে পুরে দিয়ে একটু পরে বিদায় নিলেন খালু।

    পাকঘরে বসে খাওয়ার আয়োজন করছে নাহার।

    মা কলতলায় বসে বসে অজু করছেন। এশার নামাজ না পড়ে। ভাত মুখে দেন না তিনি।

    কাসেদ তখনো মায়ের বিছানায় বসে।

    নীরব।

    নীরবে ভাবছে সে।

    কি আশ্চৰ্য, সালমা মা হয়েছে।

    সেই সালমা–

     

    পরনে কালো ডোরাকাটা ফ্রক। মাথায় সাপের মত সরু একজোড়া বিনুনী। পায়ে স্লিপার।

    অপরিসর বারান্দায় রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

    পেছন থেকে পা টিপে টিপে এসে ওর চোখজোড়া দু’হাতে চেপে ধরলো কাসেদ।

    এই কি হচ্ছে, হাতজোড়া ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো সালমা। কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সে সহসা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, সেই কখন থেকে বসে আছি। আর উনি এতক্ষণে এলেন।

    ওর একটা বিনুনীতে টান মেরে কাসেদ বললো, এই তোকে একশো বার নিষেধ করে দিয়েছি না মিথ্যে কথা বলিসনে।

    সালমা অবাক হয়ে বললো, বা-রে মিথ্যে কথা কই বললাম।

    এই তো বললি।

    কই, কখন?

    এইতো একটু আগে।

    ইস, উনি বললেই হলো, ঠোঁট উল্টে মুখ ভেংচালো সালমা।

    ওর বেণী জোড়া ধরে আবার টান দিলো কাসেদ, বসে আছি বললি কেন, তুই তো আসলে দাঁড়িয়েছিলি।

    চুলে টান পড়ায় যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো সালমা। তারপর চিৎকার করে উঠে বললো, বলবো, একশোবার মিথ্যে কথা বলবো আমি। তাতে তোর কি শুনি।

    কাসেদ ক্ষেপে গিয়ে ওর মাথাটা রেলিঙের সঙ্গে ঠকে দিয়ে বললো, তুই করে বললি কেন রে, আমি কি তোর ছোট না বড়?

    সালমা ততক্ষণে কাঁদতে শুরু করেছে।

    ওকে কাঁদতে দেখে কাসেদ বিব্ৰতবোধ করলো। বার কয়েক হাফপ্যান্টে হাত মুছলো সে। তারপর কাছে এসে দাঁড়িয়ে কোমল গলায় বললো, লেগেছে না-রে?

    সালমা কোনো জবাব দিলো না।

    একটু পরে ওর পিঠের উপর ভয়ে ভয়ে একখানা হাত রেখে কাসেদ শুধালো, পার্কে যাবি না?

    এক ঝটিকায় ওর হাতখানা দূরে সরিয়ে দিলো সালমা।

    কাসেদ আবার রেগে গিয়ে বললো, এই এক দুই করে আমি দশ পর্যন্ত গুনবো; এর মধ্যে যদি তুই না যাস তাহলে আমি চললাম। বলে জোরে জোরে এক দুই গুনতে শুরু করলো সে। ন’য়ে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো কাসেদ। সালমা তখনো কাঁদছে। কাসেদকে চুপ করে থাকতে দেখে একবার শুধু আড়চোখে তাকালো সালমা।

    কাসেদ অতি কষ্টে দশ উচ্চারণ করলো; কিন্তু সঙ্গে বললো; দেখ তোকে পনেরো পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দিলাম। এবার কিন্তু একটুও নড়াচড় হবে না। বলে আবার গুনতে শুরু করলো সে।

    পনেরো বলার পূর্ব মুহূর্তে সালমা চিৎকার করে উঠলো, তুই আমাকে মেরেছিস কেন?

    কাসেদ হেসে দিয়ে বললো, আর মারবো না, চল।

    ডান হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো সালমা। তারপর ফিক্‌ করে হেসে দিয়ে বললো, আজ কিন্তু আমাকে দোলনায় চড়াতে হবে।

    আর একদিন।

    তখন ফ্রক ছেড়ে সালওয়ার পায়জামা ধরেছে সালমা।

    বয়স বেড়েছে। হয়তো পনেরো কিম্বা ষোল।

    ঘুটফুটে সন্ধ্যা। আকাশে অসংখ্য মেঘের ভিড়। এই বুঝি বৃষ্টি এলো। কাঠের সিঁড়িগুলো বেয়ে উপরে উঠে এসে কাসেদ দেখলো, বাসায় কেউ নেই। শুধু সালমা ড্রয়িং রুমে একখানা চৌকির ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে কি একটা পত্রিকা পড়ছে।

    কে কাসেদ ভাই, এই সন্ধ্যাবেলা কোত্থেকে?

    মহাবিদ্যালয় মানে কলেজ থেকে, বাসায় কি কেউ নেই?

    না, ওরা সবাই সিনেমায় গেছে।

    তুমি যাওনি? যাইনি সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। পত্রিকাটা বন্ধ করে উঠে বসে সালমা বললো, শরীরটা সেই সকাল থেকে ভালো নেই।

    কেন, কি হয়েছে? ওর সামনে চৌকিতে এসে বসলো কাসেদ।

    সালমা বললো, অসুখ করেছে।

    কি অসুখ?

    সালমা ফিক্‌ করে হেসে দিলো এবার যান, অতো কথার জবাব দিতে পারবো না। একটা কিছু পেলেই হলো, অমনি সেটা নিয়ে প্রশ্ন আর প্রশ্ন। কি বিশ্ৰী স্বভাব আপনার। কাসেদ গম্ভীর হয়ে গেলো। একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, বিশ্ৰী স্বভাব দিয়ে তোমায় আর ব্যতিব্যস্ত করবো না, চলি এবার।

    মুহুর্তে ওর পথ আগ্‌লে দাঁড়ালো সালমা। যাবেন কি করে, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।

    হােক, তাতে তোমার কি?

    সালমা মুখ টিপে হাসলো একটুখানি। তারপর বললো, ইস, এত রাগ নিয়ে আপনি চলেন কি করে।

    সহসা ওর খোলা চুলের গোছা ধরে একটা জোরে টান মারলো কাসেদ। রাগে ফেটে পড়ে বললো, ফাজিল মেয়ে কোথাকার। ইয়ার্কির আর জায়গা পাও না, তাই না?

    সালমার মুখখানা মান হয়ে গেলো। দেখতে না দেখতে চোখজোড়া পানিতে টলমল করে উঠলো। ওর। সামনে থেকে সরে গিয়ে নিঃশব্দে আবার কোঁচের উপরে বসলো সে। পরীক্ষণে ডুকরে কেঁদে উঠলো সালমা, আমি এমন কি করেছি যে, আপনি সব সময় আমার সঙ্গে আমন দুব্যবহার করেন?

    চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েও থমকে দাঁড়ালো কাসেদ।

    সালমা কাঁদছে।

    কৌচের ওপর উপুড় হয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে সে।

    খোলা জানােলা দিয়ে আসা বাতাসে নয়, কান্নার আবেগে দেহটা কাঁপছে তার।

    খোলা চুলগুলো পিঠময় ছড়ানো।

    ধীরে ধীরে ওর পাশে এসে বসলো কাসেদ।

    সালমা, সে ডাকলো ভয়ে ভয়ে।

    সালমা কোনো উত্তর দিলো না।

    ওর মাথার উপর আস্তে করে একখানা হাত রাখলে সে। সালমা। সহসা উঠে বসলো। সালমা তীব্র দৃষ্টিতে তাকালো এক পলক ওর দিকে। তারপর তীব্ৰ বেগে ছুটে পাশের ঘরে চলে গেল সে।

    কাসেদ ডাকলো, সালমা।

    সালমা সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

    তারপর আর কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেলো না তার।

    সেদিন অনেকক্ষণ এক ঘরে বসেছিলো কাসেদ। ভেবেছিলো হয়তো এক সময় রাগ পড়ে গেলে বাইরে আসবে সালমা।

    সালমা আসেনি।

     

    অন্যদিন।

    খালুজী তখন বরিশালে বদলী হয়ে গেছেন।

    সালমা কলেজে পড়ে।

    অফিসের কি একটা কাজে বরিশাল যেতে হলো তাকে।

    তিন দিন ছিলো।

    যেদিন রাতে সে চলে আসবে সেদিন সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়া হলো, কিন্তু সালমাকে আশেপাশে কোথাও খুঁজে পেল না।

    খালাম্মাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, কি জানি কোথায় গেলো। বোধ হয়। ছাদে, বলে বার কয়েক ওর নাম ধরে ডাকলেন তিনি।

    কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেলো না।

    কিছুক্ষণ পরে ছাদে এসে কাসেদ দেখলো, সালমা দাঁড়িয়ে। ছাদের এক কোণে, চুপচাপ।

    পরনের কালো শাড়িটা গাঢ় অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেছে তার। চুলগুলো এলো খোঁপা করা।

    দূরে, স্টিমার ঘাটের দিকে তাকিয়ে কি যেন গুনগুন করছে সে।

    হয়তো কোনো গানের কলি কিম্বা কোনো অপরিচিত সুর।

    কাসেদ ডাকলো, সালমা।

    সালমা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকালো ওর দিকে। কিছু বললো না।

    কাসেদ বললো, আমি যাচ্ছি সালমা।

    সালমা পরক্ষণে বললো, যাবেন বৈ-কি, আপনাকে তো কেউ ধরে রাখে নি।

    কাসেদ অপ্ৰস্তৃত গলায় বললো, না, তা নয়, তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলাম।

    সালমা মৃদু গলায় বললো, বেশ বিদায় দিলাম।

    কাসেদ চলে যাচ্ছিলো, সালমা পেছন থেকে ডাকলো তাকে, শুনুন, এখুনি কি যাচ্ছেন?

    হ্যাঁ।

    এত সকাল সকাল গিয়ে কি হবে।

    সকাল কোথায়, স্টিমারের সময় হয়ে গেছে।

    কে বললো, এখনো দুঘণ্টা বাকি।

    বাজে কথা।

    চলুন, ঘড়ি দেখবেন।

    কাসেদের সঙ্গে নিচে নেমে এলো সালমা।

    ড্রয়ার থেকে খালুজীর ঘড়িটা বের করে এনে দেখালো তাকে। বললো, আমার কথা বিশ্বাস করেন নি তো, এই দেখুন, এখন মাত্ৰ নটা বাজে। স্টিমার ছাড়বে এগারোটার সময়।

    ঘড়ি দেখে অবাক হলো কাসেদ। সেই কখন সন্ধ্যা হয়েছে; এতক্ষণে নাটা। সালমা কোনো জবাব দিল না। ঘড়িটা আবার ড্রয়ারে রেখে দিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খোপাটা খুলে চুলে চিরুনি বুলোতে লাগলো। সে। সহসা পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে শুধালো, যাবার জন্যে আমন হন্যে হয়ে উঠছেন কেন শুনি।

    কাসেদ বললো, চিরকাল থাকবো বলে আসিনি নিশ্চয়। কাজে এসেছিলাম, সারা হলো, চলে যাচ্ছি।

    চোখজোড়া বড় বড় করে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সালমা।

    তারপর মুখখানা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে মৃদু গলায় বললো, আপনাকে চিরকাল এখানে থাকতে বলছেই বা কে।

    বললেও হয়তো আমি থাকতাম না।

    নিজেকে আপনি কি ভাবেন বলুন তো? হঠাৎ ফোঁস ফোঁস করে উঠলো সালমা।

    কাসেদ শান্ত স্বরে বললো, একজন অধম কেরানী।

    কেরানীর অত দেমাক কেন?

    কবি বলে।

    সালমা চুপ করে গেলো। চিরুনিটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। চুলগুলো আবার খোঁপায় বাঁধলো। বন্ধ জানালাটা খুলে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলো সে। বাইরে আজ বৃষ্টি নেই। মেঘ নেই। আছে শুধু অন্ধকার। সীমাহীন অন্ধকারে ঢাকা দূরের দিগন্ত।

    জানালা থেকে মুখখানা সরিয়ে নিয়ে এলো সালমা। চুপ করে বসে আছেন কেন, আপনার স্টিমারের সময় হয়ে গেছে। একটু পরে গিয়ে দেখবেন, ওটা আর ঘাটে নেই।

    তা নিয়ে তোমার আর মাথা ঘামাতে হবে না। কাসেদ আস্তে করে বললো, স্টিমার ছাড়ার এখনো অনেক দেরি।

    সালমা স্নান হাসলো। তারপর ড্রয়ার থেকে ঘড়িটা বের করে এনে মৃদু গলায় বললো, ওটা আমি এক ঘণ্টা স্লো করে দিয়েছিলাম।

    কেন?

    আমার ইচ্ছে হয়েছিল তাই। বলে সামনে থেকে সরে গেল সালমা।

    ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

    আর এলো না।

     

    মা, নামাজ পড়া শেষ করে এসে ছেলের দিকে নীরবে তাকিযে রইলেন কিছুক্ষণ।

    হাতের তালুতে মুখ রেখে ওপাশের দেয়ালের কি যেন দেখছে সে।

    চোখের মণিজোড়া স্থির নিম্পলক।

    কি রে ভাত খাবি না?

    মায়ের ডাকে চোখের পলক নড়ে উঠলো তার। উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তোমরা বসে। পড় আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।

    একখানা মাদুরের ওপর পাশাপাশি দুটাে থালা সাজানো। সামনে একটা বড় পেয়ালার মধ্যে তরকারি। আর অন্য একটি থালায় বাড়তি ভাত ঢালা। নাহার এখন খাবে না।

    ওদের দু’জনের খাওয়া হয়ে গেলে তারপর সে বসবে খেতে।

    আজকে নয়। বহুদিন থেকে এই রীতি চলে আসছে তার।

    যেদিন রাতে কাসেদের ফিরতে দেরি হয় সেদিন মা ঘুমিয়ে পড়লেও সে ঘুমোয় না। উঠে দরজাটা খুলে দেয়। সাবান, তোয়ালে আর পানির বদনাটা নিয়ে রেখে আসে কলতলায়। খাবারগুলো সাজিয়ে দেয় টেবিলের ওপর। তারপর যতক্ষণ কাসেদ খায় নাহার নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার পাশে। মাঝে শুধু একবার জিজ্ঞেস করে, আর কিছু দেবো?

    না।

    সে চুপ।

    খাওয়া শেষ হয়ে গেলে থালাবাসনগুলো নিয়ে কালতলায় চলে যায় সে।

    কলতলায় পানি পড়ার শব্দ শোনা যায় অনেকক্ষণ ধরে।

    আজ খেতে বসে মা শুধোলেন, কাল জাহানারা কেন এসেছিলো রে?

    আবার জাহানারা!

    কাসেদ সংক্ষেপে বললো, এমনি।

    মা বললেন, মেয়েটা বড় ভালো, লেখাপড়া শিখেছে তাই বলে নাক উঁচু নয়। আস্তে আস্তে কথা বলে। চেহারাটাও বেশ মিষ্টি। ওর বাবা করে কিরে?

    কাসেদ মুখ না তুলেই বললো, উকিল।

    মা আর কোন প্রশ্ন করলেন না। নীরবে খাচ্ছেন তিনি। হয়তো কিছু ভাবছেন। এ মুহূর্তে তাঁর মনে কিসের ভাবনা রয়েছে তা ঠিক বলে দিতে পারে কাসেদ। ভাবছেন জাহানারার মত একটি মেয়েকে যদি বউ সাজিয়ে ঘরে আনা যেতো।

     

    অফিসে থাকাকালীন সময়টা মন্দ কাটে না কাসেদের।

    কাজের চাপে তখন বাইরের দুনিয়ার কথা মনে থাকে না। এটা হলো ফাইল, টাইপ রাইটার, চিঠিপত্র আর কাগজ কলমের পৃথিবী। এখানে জাহানারা, শিউলি, সালমা, সেতার কিম্বা কবিতার প্রবেশ নিষেধ।

    এখানকার প্রথম কথা হলো কাজ।

    দ্বিতীয় কথা হলো তোয়াজ।

    তৃতীয় কথা হলো ফাঁকি।

    এ তিনের অপূর্ব মিশ্রণে অফিসের সময়টুকু বেশ কাটে ওর।

    কর্মচারীর সংখ্যা নেহায়েৎ নগণ্য নয়।

    বড় সাহেব আছেন একজন। সবার বড়। বয়স তাঁর ত্ৰিশের কোঠায়। সুন্দরী বউ আছে বাড়িতে আর একটি ফুটফুটে ছেলে। বড় সাহেব ভীষণ পরিশ্রমী। কাজ করে কখনো ক্লান্ত হন না। তিনি। কাউকে অলসভাবে বসে থাকেত দেখলে ধমকে উঠেন, বলেন, এই জন্যে আমাদের জীবনে কিছু হলো না, হবেও না। এই যে দেখছেন অফিসের বড় কর্তা হয়ে বসেছি, গাড়ি, বাড়ি করেছি, এগুলি নিশ্চয় খোদা আকাশ থেকে ফেলে দেননি, এর জন্যে অসুরের মত খাটতে হয়েছে আমায়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তবে না বলে থেমে যান। সাহেব। পরিমিত হাসেন। সে হাসির অর্থ ধরে বাকি কথাটা বুঝে নিতে হয়।

    বড় সাহেবের পরে যার স্থান তিনি পঞ্চাশোের্ধ বৃদ্ধ। সামনের কয়েকটা দাঁত ঝরে গেছে বহু আগে। যত কাজ করেন। তার দ্বিগুণ পান খান, আর তার চেয়েও অনেক বেশি কথা বলেন। কথা না বললে নাকি তার কাজের মুড় আসে না। গৃহী মানুষ। এই বৃদ্ধ বয়সেও বিরাট পরিবারের ভার বহন করে চলেছেন। ছেলেমেয়েদের সংখ্যা নেহায়েৎ নগণ্য নয়, তার ওপর নাতিনাতনী আছে অনেক।

    বুড়ো মকবুল সাহেবের পাশে যার আসন তিনি টাকা-আনা-পাইয়ের হিসেব নিয়ে সারা দিন ব্যস্ত।  একাউনটেন্ট নওশের আলী এখনো বিয়ে করেন নি। করবেন বলে ভাবছেন। রোজ ভাবেন। কিন্তু টাকা-আনা-পাইয়ের হিসেবও মিলছে না। আর তাঁর বিয়ে করাও হয়ে উঠছে না। এরপর, কাসেদকে বাদ দিলে আরো চারটে প্রাণী আছে অফিসে। প্রথম দু’জন কেরানী, কাসেদের সমগোত্রীয়। এক গোয়ালের গরু নাকি এক সঙ্গে ঘাস খায় না। এক গোত্রীয় মানুষগুলোর পক্ষেও একতালে চলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই, তিন কেরানীর মধ্যে কথাবার্তা খুব কম হয়। মেলামেশা তার চেয়েও কম।

    একটি দারোয়ান। খোদাবক্স তার নাম। পশ্চিমে বাড়ি ছিল তার, বিহার কিম্বা উড়িষ্যায়। দেশ বিভাগের পর পূর্ব দেশে হিজরত করেছে। সঙ্গে এসেছে দু’টি বউ আর একটা রামপুরী ছাগল। অফিসের পাশেই ওরা থাকে। সারাদিন কলহ করে ডাল-রুটি আর স্বামী সোহাগ নিয়ে। খোদা বক্স নির্লিপ্ত পুরুষ। নীরবে বসে বসে গোঁফের ডগা জোড়া মসৃণ করে আর খইনি খায়।

    আজ অফিসে ঢুকবার পথে খোদাবক্স টুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা সালাম ঠুকলো তাকে। কাসেদ বুঝতে পারলো ও কিছু বলতে চায়। কেমন আছো খোদাবক্স, কিছু বলবে?

    খোদাবক্স বিনয়ের সঙ্গে শুধালো, মেরা দরখাস্ত কী কুচ হুয়া সাহেব?

    কিছুদিন আগে বেতন বাড়াবার জন্যে বড় সাহেবের কাছে একটা দরখাস্ত পাঠিয়েছিলো। সে দুটি বউ আর এক ছাগলের সংসার পঞ্চাশ টাকায় চলে না তাই লিখে জানিয়েছিলো।

    কাসেদ মৃদু হেসে বললো, হবে হবে, আর কিছুদিন অপেক্ষা করো খোদা বক্স।

    বড় সাহেব নিশ্চয় এবার তোমার বেতন বাড়িয়ে দেবেন। খোদা বক্স খুশি হয়ে আর একটা সালাম ঠুকলো। বললো, আপকা মেহেরবানী হুজুর।

    কাসেদ ওকে শুধরে দিলে বললো, আমায় নয়, বড় সাহেবেরে বলো। বলে ভেতরে চলে এলো সে।

    বড় সাহেব ইতিমধ্যে এসে পড়েছেন। রুমে বসে দু’নম্বর কেরানীর সঙ্গে কথা বলছেন তিনি।

    নওশের আলী ফাইলে মুখ ঢুকিয়ে হিসেব নিয়ে ব্যস্ত।

    মকবুল সাহেব মুখের মধ্যে একজোড়া পান গুঁজে দিয়ে বললেন, এই যে, তিন নম্বর কেরানী আপনি তিন মিনিট লেট করে এসেছেন, ঘড়ি দেখুন।

    কারো ওপর রাগ করলে তার নাম নিতে ভুলে যান। তিনি, মনগড়া কতগুলো নম্বর ধরে সম্বোধন করেন। এতে রাগ করার যথেষ্ট কারণ থাকলেও কেউ কিছু মনে করে না, বলে–লোকটার মাথায় ছিট আছে। কাসেদ ঘড়ি দেখলো সত্যি সে তিন মিনিট লেট।

    কিছু না বলে চুপচাপ তার চেয়ারটায় গিয়ে বসলো কাসেদ। ফাইলগুলো টেনে নিলো সামনে। ওপরের ফাইলটার এককোণে টানা হাতে লেখা একটা নাম–’জাহানারা’।

    কোন অসতর্ক মুহুর্তে হয়তো লিখে রেখেছিলো সে।

    কলামটা তুলে নিয়ে সাবধানে নামটা কালি দিয়ে ঢেকে দিলো সে।

    চারপাশে তাকালো এক পলক।

    মকবুল সাহেব এখনো তার তিন মিনিট লেট হওয়া নিয়ে চাপা স্বরে রাগ প্রকাশ করছেন। হঠাৎ ছাতার কথা মনে পড়ে গেল কাসেদের। নিজের টেবিল থেকে গলা বাড়িয়ে বললো, মকবুল সাহেব, আমার ছাতাটা?

    প্রথমে ওর দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালেন মকবুল সাহেব, সহসা লজ্জা পেয়ে বললেন, এই দেখুন। আপনার ছাতাটা আনতে গিয়ে রোজ ভুলে যাই। আপনি এক অদ্ভুত লোক তো সাহেব, অফিস থেকে যাবার সময় আমায় একটু মনে করিয়ে দিলে পারেন।

    কাসেদ আস্তে করে বললো, কি করব বলুন, আমিও ভুলে যাই।

    মকবুল সাহেব তাঁর পান-খাওয়া দাঁতগুলো বের করে হাসলেন। বললেন, বেশ লোক তো। আপনি, বলে একটুখানি থামলেন। তিনি, থেমে বললেন, আজ বিকেলে মনে করিয়ে দেবেন; কাল নিশ্চয় নিয়ে আসবো।

    ফাইলগুলো খুলে কাজে মন দিলো কাসেদ। অনেকগুলো চিঠি টাইপ করতে হবে আজ।

    তারপর বড় সাহেবের স্বাক্ষর নিয়ে সেগুলো পাঠিয়ে দিতে হবে বিভিন্ন কোম্পানীর অফিসে। পিয়ন-বইতে নাম, ঠিকানা সব তুলে রাখতে হবে।

    কাসেদ সাহেব।

    জী।

    এক কাজ করুন না, আজ অফিস ছুটি হলে আমার সঙ্গে চলে আসুন বাসায়। ছাতাটা নিয়ে যাবেন। গোল কৌটােটা খুলে আর একটা পান বের করলেন মকবুল সাহেব।

    কাসেদ আস্তে করে বললো, আচ্ছা সে তখন দেখা যাবে।

    আজ নতুন নয়। এর আগেও অনেকবার তাকে বাসায় যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মকবুল সাহেব। আজ যাবো কাল যাবো করে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। লোকে বলে, বাসায় নেমন্তন্ন করার পেছনে নাকি কন্যাদায় মুক্ত হওয়ার একটা গোপন আকুতি রয়েছে।

    কথাটা সত্য কি মিথ্যে কাসেদ জানে না।

    শুধু এই জানে, বিবাহযোগ্য তিনটি মেয়ে রয়েছে তার। তাদের বিয়ে দিতে হবে। বিত্তশালী পাত্রের কল্পনা নেই, চলনসই হলেই হলো। ওদের কথা মাঝে মাঝে আলোচনা করেন মকবুল সাহেব। তখন তাকিয়ে দেখলে হঠাৎ করে মনে হয়। ভদ্রলোকের বয়স আরো বেড়ে গেছে।

    চােয়ালের হাড়জোড়া আরো উঁচু। দু’চােখ আরো কোটরাগত। বৃদ্ধ কেরানী সহসা মুমূর্ষ। রোগীর মত হয়ে যায়।

    একবার এই অফিসের একটি ছেলেকে নাকি জামাতা বানাবার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ করে এনেছিলেন তিনি।

    বড় মেয়েটির সঙ্গে বিশেষ ভাবও জন্মে গিয়েছিলো ছেলেটির।

    কিন্তু বিয়ে হলো না।

    ছেলেটি রাজী হলো না বিয়ে করতে।

    কেন?

    কেউ জানে না।

    শুধু জানে, ছেলেটি নাকি মকবুল সাহেবের কাছ থেকে কিছু নগদ কড়ি দাবি করেছিলো।

    মকবুল সাহেব রাজী হন নি। বরং ক্ষেপে গিয়ে বড় সাহেবকে ধরে কনিষ্ঠ কেরানীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছেন।

    তারই জায়গায় পরে কাসেদকে নেয়া হয়েছে।

     

    মেশিনটা টেনে নিয়ে দ্রুত টাইপ করে চলল কাসেদ। অফিসে এখন সবাই চুপ।।

    টাইট-রাইটারের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

    বড় সাহেব বার কয়েক টহল দিয়ে গেছেন। প্রত্যেকের টেবিলে এসে নীরবে দেখে গেছেন, কে কি করছে।

    এখন তিনি ফিরে গেছেন তাঁর চেম্বারে।

    কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। পকেট থেকে রুমালটা বের করে ঘামগুলো মুছলো কাসেদ।

    স্যার।

    কিরে?

    সাহেব ডেকেছেন। আপনাকে?

    মুখ তুলে বেয়ারাটার দিকে তাকালো কাসেদ।

    সজাগ সাহেব বুঝি কিছু লক্ষ্য করে গেছেন কে জানে। সবার সামনে তিনি কাউকে কিছু বলেন না। নিজের চেম্বারে ডেকে বলেন। হয়তো মানুষের আত্মসম্মান বোধের প্রতি তাঁর দৃষ্টি রয়েছে, তাই।

    মানুষ মাঝে মাঝে অনেক কিছু ভাবে। কখনো তার অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। কখনো যায় না। তবু তার ভাবনার শেষ হয় না।

    দু’নম্বর কেরানীর টেবিল থেকে বড় সাহেবের চেম্বারে আসতে হলে মাত্র উনিশটি পদক্ষেপের প্রয়োজন। কিন্তু, এর মধ্যে আকাশ-পাতাল কত কিছুই না চিন্তা করেছে কাসেদ। চাকরীর প্রমোশন থেকে বরখাস্ত কোন কিছুই বাদ যায় নি।

    বড় সাহেব এইমাত্র একটা সিগারেট ধরিয়েছেন।

    সামনে রাখা একটা গোটা বইয়ের উপর নীরবে চােখ বুলোচ্ছেন তিনি।

    মুখ না তুলেই আস্তে করে বললেন, আপনার ফোন।

    টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখা রিসিভারটার দিকে তাকালো কাসেদ।

    সহসা বুঝতে পারল না এ সময় কে ফোন করতে পারে তাকে।

    হ্যালো।

    হ্যালো–অন্য প্ৰান্ত থেকে মিহি কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো।

    বিব্রত কাসেদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আড়চোখে একবার এক পলক তাকালো বড় সাহেবের দিকে। তিনি নির্লিপ্ত।

    হ্যালো, আপনি কে বলছেন? সাহস সঞ্চয় করে মহিলার নাম জানতে চাইলো সে।

    অন্য পক্ষের হাসির শব্দ শোনা গেলো। আমাকে চিনতে পারছেন না বুঝি?

    না, না-তো।

    একটু চিন্তা করুন, ঠিক চিনতে পারবেন।

    রিসিভারটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো কাসেদ।

    চিন্তা করলো, কিন্তু চিন্তা করে সময় সময় সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় না।

    পেলেও সকল ক্ষেত্রে তা সত্য হয় না।

    হ্যালো, অন্য পক্ষ আবার ডাকলো।

    কাসেদ এবার জিজ্ঞেস করলো, আপনি কাকে চান?

    আপনাকে। মহিলা আবার হেসে উঠলেন।

    আপনাকে? বলতে গিয়ে বার কয়েক ঢোক গিললো কাসেদ। কিন্তু কেন বলুন তো?

    একটা কবিতা শোনাবার জন্য। শোনাবেন কি?

    রিসিভারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পালাতে পারলে বাঁচে কাসেদ। এ কার পাল্লায় পড়লো ca

    কিন্তু পরীক্ষণে ওর মনে হলো, জাহানারা নয়তো?

    হ্যালো, হ্যালো।

    না, জাহানারার গলার স্বরটা কোন মতেই এত মিহি নয়। দু’একবার ফোনে ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো কাসেদের। কখনো এমন তো মনে হয় নি।

    হ্যালো, চুপ রইলেন যে?

    চুপ না থেকে কি করবো বলুন।

    বললাম তো একটা কবিতা আবৃত্তি করুন।

    কাসেদ আরেক বার তাকালো বড় সাহেবের দিকে। মনে হলো তাঁর মুখে বিরক্তির ছাপ, কাজের সময় কোন মেয়ের সঙ্গে খুনসুটি করাটা তাঁর কাছে ভাল ঠেকছে না।

    হ্যালো।

    হ্যালো।

    বলুন।

    আমি শিউলি বলছি।

    শিউলি। যার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিলো জাহানারাদের বাসায়, জন্মদিনের আসর থেকে এক সঙ্গে বাসায় ফিরেছিলো ওরা।

    আপনি কোথেকে বলছেন?

    কলেজ থেকে।

    ক্লাস নেই বুঝি।

    না।

    তাহলে বসে বসে একটা কবিতার বই পড়লেই পারেন। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো কাসেদ।

    বড় সাহেব এতক্ষণে মুখ তুলে এক পলক তাকালেন ওর দিকে। তাঁর চোখে বিরক্তি নেই। আছে কৌতুহল। যেন আলাপটা নীরবে উপভোগ করছিলেন তিনি। কান পেতে শুনছিলেন সব।

    ফোনের ওপর হাত রেখে তখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে কাসেদ। শিউলির সঙ্গে আমন অভদ্র ব্যবহার না করলেও পারতো। সে। কে জানে কি ভাবছে। জাহানারার সঙ্গে দেখা হলে হয়তো সব কিছু খুলে বলবে সে। বলবে, তোমার কেরানী বন্ধুটিকে ভদ্রতা শিখতে বলে।

    জাহানারা কি মনে করবে। কে জানে। হয়তো খুশি হবে। বলবে কাসেদকে তুমি চেনো না শিউলি, তাই অতবড় অপবাদ দিতে পারলে।

    ওর মত মানুষ হয় না।

    কিম্বা জাহানারা রেগে যাবে। ভ্রূজোড়া বাঁকিয়ে বলবে, কেরানী তো, ভদ্রতা শিখবে কোথেকে।

    না, জাহানারা অমন কথা বলতে পারে না। সে তার মনের মানুষ। তার মুখ দিয়ে অমান একটা রূঢ় মন্তব্য কল্পনা করতেও পারে না কাসেদ। কিন্তু ওর জন্যে একটা সেতারের মাস্টার এখনো ঠিক করা গেলো না। আজ বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে প্রথম কাজ হবে। যে কোন একজন ভালো সেতারীর সঙ্গে আলাপ করা। লোকটার কার্তিকের মত চেহারা হলে চলবে না, তাকে বুড়ো হতে হবে কিম্বা কুৎসিত। জাহানারা হাসবে, হেসে লুটিয়ে পড়বে বিছানায়। মুখখানা বিকৃত করে বলবে, লোকটা দেখতে কেমন বিচ্ছিরি, তাই না? তোমার মত সুপুরুষ আর একটিও দেখলাম না জীবনে। এত রূপ তুমি কোথায় পেলে বল না গো।

    দুলিচাঁদের কাছে লেখা চিঠিটা কি টাইপ করা হয়ে গেছে? জাহানারা নয়–বড় সাহেব।

    হ্যাঁ, স্যার। ওটা তৈরি আছে, নিয়ে আসবো কি?

    আমার প্রয়োজন নেই, পাঠিয়ে দেবার বন্দোবস্তু করুন, আর শুনুন, আজ অফিস শেষে চট করে চলে যাবেন না। অনেক কাজ পড়ে আছে, সেগুলো শেষ করতে হবে, আমিও থাকবো। এখানে। বলে, ক্ষয়ে যাওয়া সিগারেটটা ছাইদানীতে রেখে দিলেন বড় সাহেব। সামনে খুলে রাখা বইটির প্রতি আবার মনােযোগ দিলেন তিনি।

    কাজ বিশেষ কিছু নেই তা জানতো কাসেদ।

    এমনি হয়। অতীতেও হয়েছে।

    অফিস ছুটি হয়ে যাবার পরেও নিজের চেম্বারে চুপচাপ বসে থাকে বড় সাহেব। কখনো বই পড়েন। কখনো চিঠিপত্র লেখেন বসে বসে। সব সময় একা একা ভালো লাগে না বলে মাঝে মাঝে অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে কোন একজনকে রেখে দেন সঙ্গে। কথা বলেন, এটা, সেটা কাজ করান। গল্প করেন, নিজের জীবনের গল্প। বাবা বড় গরিব ছিলেন। প্রাইমারি স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার। বেতন পেতেন মাসে পনেরো টাকা। তাও নিয়মিত নয়। ছােটবেলা কত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখতে হয়েছে তাঁকে।

    দূর গাঁয়ে জায়গীর থাকতেন বড় সাহেব। তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতেন। ফিরে আসতে অনেক রাত হয়ে যেতো। তখন দু’পায়ে ব্যথা করতো ভীষণ।

    পরের বাড়িতে ঠিকমত খাওয়া জুটতো না। বই কেনার পয়সাও ছিলো না তাঁর। সহপাঠিদের কাছ থেকে চেয়ে এনে পড়তেন। রাত জেগে পড়বার উপায় ছিলো না। ওতে তেল খরচ হয়। তেল কেনার টাকা কোথায়?

    তবু কোনদিন দমে যাননি বড় সাহেব। হতাশা আসতো মাঝে মাঝে, তখন চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতেন। তিনি। কান্না পেতো, কাঁদতেন, চোখের পানি ধীরে ধীরে চোখেই শুকিয়ে যেতো।

    কিন্তু কান্নারও শেষ আছে বুঝলেন? সামনে ঝুঁকে পড়ে বড় সাহেব বললেন, জীবনে এত কষ্ট করেছি বলেই তো সুখের মুখ দেখতে পেয়েছি। এখন আমার মতো সুখে ক’টি লোক আছে বলুন?

    বড় সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে সহসা কাসেদের মনে হলো, সত্যি কি লোকটা সুখে আছে?

    অফিসের লোকজন বলে, সুখে যদি থাকবে তাহলে এই কাঁচা বয়সে চুলে পাক ধরেছে। কেন বলতে পারো।

    এক নম্বর কেরানী বলে, চিন্তায় পেকেছে। মানুষ যত বড় হয়, ওদের চিন্তা তত বড়।

    একাউন্টেন্ট বলেন, চিন্তা নয় দুশ্চিন্তা। তা হবে না কেন, ঘরের বউ যদি পরপুরুষের সঙ্গে হল্লা করে বেড়ায় তাহলে কার মন-মেজাজ ঠিক থাকে বলো।

    বড় সাহেবের গিনীকে অনেকদিন আগে একবার দেখেছিলো কাসেদ। সারা মুখে কৃত্রিমতা মেখে অফিসে এসেছিলেন তিনি, স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে। দৈহিক লাবণ্যের প্রদর্শনী দেখিয়ে মহিলা সেই যে গেলেন আর আসেননি কোনদিন।

    দারওয়ানকে দিয়ে চা-নাশতা আনলেন বড় সাহেব।

    ইতিমধ্যে দু’-একখানা ফাইলও নাড়াচাড়া হলো।

    চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সহসা বড় সাহেব শুধোলেন, ঢাকায় ফুচকা পাওয়া যায়?

    কাসেদ অপ্ৰস্তুত হয়ে গিয়ে বললো, যায় বই কি।

    আপনি ফুচকা খান?

    না।

    খেয়েছেন কোনদিন?

    না।

    আমি খেয়েছি। অনেক খেতাম ছোটবেলায়। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে বড় ভালো লাগতো।

    বড় সাহেব চুপ করে গেলেন। আজকের বিত্তবান দিনগুলোর চেয়ে হয়তো ছেলেবেলাকার অনটনে ভরা, ফুচকা-খাওয়া দিনগুলোকে আজও অনেক প্রিয় বলে মনে হচ্ছে তাঁর।

    আশ্চর্য মানুষের মন। সে যে কখন কি চায় তা নিজেও বলতে পারে না। কিসে তার সুখ আর কিসে তার অসুখ এর সত্যিকার জবাব সে নিজেও দিতে পারে না কোনদিন।

    জাহানারা, যদি কোনদিন সময় মেলে, তোমার মনের অর্গল তুমি খুলে দিয়ো আমার কাছে। তোমার অনেক চাওয়ার পাশে আমার অনেক পাওয়ার স্বপ্নগুলোকে থরেথরে সাজিয়ে নেবো। গরমিল চাইনে জীবনে, দেখছে না, মিলের অভাবে মানুষগুলো কেমন মরোমরো হয়ে আছে। এ তোমার ভুল ধারণা কাসেদ। জাহানারা আস্তে করে বললো, অভাবটা মিলের নয়, রঙের। আমাদের জীবনে রঙ নেই।

    রঙ। রঙ সে আবার কি?

    ওর প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসলো জাহানারা। মুখখানা ঈষৎ হেলিয়ে বললো, এর কোনাে আকার নেই। থাকলে, আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতাম। আসলে ওটা একটা অনুভূতি যা মানুষের চেহারায় আনে উজ্জ্বলতা, মনে যোগায় আনন্দ, দেহকে দেয় উষ্ণতা আর প্রাণকে করে সজীব।

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআরেক ফাল্গুন – জহির রায়হান
    Next Article দামেস্কের কারাগারে – এনায়েতুল্লাহ্ আলতামাশ

    Related Articles

    জহির রায়হান

    আরেক ফাল্গুন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    হাজার বছর ধরে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আর কত দিন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    একুশে ফেব্রুয়ারী – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    কয়েকটি মৃত্যু – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    তৃষ্ণা – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }