Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শ্রেষ্ঠ গল্প – ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলন এক পাতা গল্প513 Mins Read0

    ফুলের বাগানে সাপ

    শহরে শিশুচুরি হঠাৎ খুব বেড়ে গেল। প্রথমদিকে মাসে দু একটি শিশুচুরির কথা খবরের কাগজের মাঝের পাতায় ছাপা হত। ইদানিং প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হয়। নার্সিংহোম থেকে, হাসপাতাল থেকে সদ্যজাত শিশু উধাও হয়ে যাচ্ছে। একই হেডিঙের তলায় চার পাঁচ কিংবা আট নটি শিশু চুরি যাওয়ার খবর ছাপা হচ্ছে একেক দিন। প্রথমদিকে শুধুমাত্র সদ্যজাত শিশুই চুরি হত। কদিন ধরে চারপাঁচ বছর বয়সের শিশুও হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে, হাসপাতাল থেকে, রাস্তাঘাট থেকে। ফলে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। একজনও শিশুচোর ধরা পড়ছে না।

    এইসব শিশুরা যাচ্ছে কোথায়?

    দুতিনদিন আগে একটি খবরের কাগজে পোস্ট এডিটরিয়াল বেরিয়েছে শিশুচুরি নিয়ে। পত্রিকাটি বলেছে, শিশু চুরির পেছনে নিশ্চয় বড় রকমের কোনও সংঘবদ্ধ দল কাজ করছে। দেশের প্রতিটি শহরে বন্দরে যাদের অনুচররা গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। দলটির পেছনে বিদেশি শক্তির প্রভাব থাকাও বিচিত্র নয়। কারণ, যে সব শিশু চুরি যাচ্ছে, পত্রিকাটির অভিমত, সেই সব শিশুর বেশির ভাগই পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা এবং স্ক্যান্ডেনেভিয়ান কান্ট্রিগুলোয় নিঃসন্তান দম্পতির সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সেসব দেশের দম্পতিরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে শিশু ক্রয়ের দিকে ঝুঁকেছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো থেকে প্রচুর শিশু উধাও হয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে কাজ করছে অত্যন্ত ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী এবং সংঘবদ্ধ একটি দল। তৃতীয় বিশ্বের বেশকিছু দেশে যাদের এজেন্ট রয়েছে। সম্প্রতি বহির্বিশ্বের কয়েকটি দেশে তৃতীয় বিশ্বের শিশু প্রতিপালিত হচ্ছে এ ধরনের সংবাদ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকায় ছবিসহ ছাপা হতে দেখা গেছে।

    পোস্ট এডিটরিয়ালটা পড়ার পর থেকে বাপ্পাকে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা খুব বেড়ে গেছে। বাপ্পা আমার একমাত্র সন্তান। চার বছর বয়স। এ বছরই বাপ্পাকে আমি শহরের একটি অভিজাত কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়েছি। ফলে বাপ্পাকে নিয়ে আমার একটা বাড়তি উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। ভোরবেলা বাপ্পাকে স্কুলে পৌঁছে দেয়া, এগারটার সময় অফিস থেকে গাড়ি পাঠিয়ে বাপ্পাকে বাড়ি নেয়া।

    বাপ্পাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে প্রথম প্রথম দুটো কাজই আমাকে করতে হত। ভোরবেলা। ওঠে বাপ্পাকে সাজগোজ করিয়ে দিত আয়া। আমি নিজে ড্রাইভ করে বাপ্পাকে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসতাম বাড়ি। বাপ্পাটা আমাকে ছাড়া নড়তেই চাইত না। কান্নাকাটি জুড়ে দিত। আস্তেধীরে বাপ্পার সেই অভ্যেসটা পাল্টেছে। আজকাল ভোরবেলা আয়া বাপ্পাকে সাজগোজ করিয়ে, কাঁধে ব্যাগ দিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। ড্রাইভার স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসে। এগারটার সময় গিয়ে নিয়ে আসে। ভোরবেলা স্কুলে যাওয়ার সময় বাপ্পার ঘুম ভেঙে যায়। এসে টুক করে আমার গালে একটা চুমু খায়। আমি স্কুলে যাচ্ছি পাপা।

    আর আমার যেদিন ঘুম ভাঙে না, সেদিন বাপ্পা এসে আমাকে ডেকে তোলে তারপর চুমু খেয়ে স্কুলে চলে যায়। তারপর হাজার চেষ্টা করলেও আমি আর ঘুমুতে পারি না। আমার খুব রেহনুমার কথা মনে পড়ে। রেহনুমা থাকলে বাপ্পাকে নিয়ে আমার কোনও উৎকণ্ঠা থাকত না। রেহনুমা কেন যে অমন করে চল গেল!

    সকালবেলা বাপ্পা স্কুলে যাওয়ার পর আমার বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিছু করার থাকে না। বিছানায় শুয়ে পরপর দুকাপ চা খাই। খবরের কাগজ পড়ি। তারপর ওঠে বারান্দায় গিয়ে অকারণে বাগানটার দিকে তাকিয়ে থাকি। এক বিঘে জমির ওপর আমার বাড়ি। ছোট্ট দোতলা একটা বিল্ডিং। একপাশে বাগানের মুখে গ্যারেজ। পেছনে একতলা সার্ভেন্ট কোয়ার্টার। এইসব মিলিয়ে কাঠা ছসাত জমি। বাকিটা বাগান। কত রকমের যে গাছপালা লাগিয়েছিল রেহনুমা, কত রকমের যে ঝোপঝাড় লাগিয়েছিল! দিনে দিনে বাগানটা ছেয়ে গেল। এখন দিনেরবেলাও বাগানের কিছু কিছু ঝোপে রীতিমতো অন্ধকার জমে থাকে। একজন মালী রাখতে হয়েছে, সারাদিন বাগানটার তদারকি করে সে। আগাছা পরিষ্কার করে। জলটল দেয়। সিজনাল গাছপালা এনে লাগায়। ফলে সবসময় কিছু না কিছু ফুল থাকেই বাগানটায়।

    রেহনুমার ছিল গোলাপের শখ। বাগানের মাঝখানটায় আলাদা ঘের দেয়া একটা জায়গা করিয়েছিল সে। কাঠাখানেক জমি। তাতে শুধু গোলাপ। ইয়া বড় বড় একেকটা। একটা কালো গোলাপের চারা আনল একবার। প্রচুর টাকা খরচ করে। তারপর মাস তিনেক সেই চারাটি নিয়ে কী ব্যস্ততা তার! সারাদিন মেতে থাকত। রাতেরবেলা আমাদের দাম্পত্য আলাপের সময়ও গোলাপচারাটির কথা বলত। কখনও কখনও আমি খুব বিরক্ত হতাম।

    সেই চারাটি এখন মস্ত ঝোপ হয়ে গেছে। কলম কেটে মালী তা থেকে দশবারটি নতুন কালো গোলাপের গাছ করেছে। এখন তাতে থরেবিথরে ফুটে থাকে গোলাপ। গাছগুলোর দিকে তাকালেই আমার রেহনুমার কথা মনে পড়ে। এতসব ফেলে রেহনুমা যে কেন চলে গেল!

    দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি তারপর বারান্দা থেকে ফিরে আসি। বাথরুম ইত্যাদি সেরে খাবার। টেবিলে গিয়ে বসি। ঝি-চাকররা নাশতা রেডি করে রাখে। চটপট খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। অফিস।

    অফিস কর্মচারীরা সব আসে নটায়। আমি বেরিয়ে পড়ি পৌণে আটটা, আটটার মধ্যে। তারপর নিজের রুমে ঢুকে, এককাপ চায়ের কথা বলে জরুরি ফাঁইলপত্র নিয়ে বসি। ঘণ্টাখানেক এইভাবে কেটে যায়!

    বাপ্পাকে স্কুলে দেয়ার আগে আমি কখনও দশটার আগে অফিসে যেতাম না। সকালবেলা বাপ্পার সঙ্গে হেসেখেলে ভালোই কেটে যেত। সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছুকাল। যতদিন যাচ্ছে আমার একাকিত্ব ততই বেড়ে যাচ্ছে। আজকাল বুঝতে পারি, বাপ্পা যত বড় হতে থাকবে, আমাদের মাঝখানকার দূরত্ব তত দীর্ঘ হয়ে যাবে। কোনও উপায় নেই। এটাই নিয়ম।

    অফিসে বসে, খুব মনোযোগ দিয়ে ইমপরট্যান্ট ফাঁইল দেখতে দেখতেও এসব কথা মনে হয় আমার। মন খারাপ হয়ে যায়। রিভলবিং চেয়ারে হেলান দিয়ে উদাস হয়ে সিগ্রেট টানতে থাকি। ব্যবসা ইদানীং মন্দা যাচ্ছে। দুটো কন্ট্রাক্ট পেয়েছিলাম। একটা আশি লাখ টাকার আর একটা সাতষট্টি। দুটোই ছেড়ে দিতে হয়েছে। ব্যাংক থেকে ম্যালা চেষ্টা করেও ওডি নেয়া যায়নি। এত টাকা ক্যাশ ম্যানেজ করাও সম্ভব হয়নি। কাজ দুটো এখন করছে অন্য পার্টি। আমাকে লামসাম একটা এমাউন্ট ধরিয়ে দিয়েছিল। লাখ দুয়েক। ছসাত মাসে এটুকুই ব্যবসা হয়েছে। এতে কি চলে!

    ব্যবসাটা শুরু করেছিলাম বিয়ের বছর পাঁচেক আগে। তখন দুরুমের একটা অফিস ছিল। একজন ম্যানেজার, একজন টাইপিস্ট, দুজন ক্লার্ক, একজন অ্যাকাউনট্যান্ট আর দুজন পিয়ন, এই ছিল কর্মচারী। আমি এক রুমে বসতাম আর অন্যরুমে কর্মচারীরা। সেই সময় অবশ্য অফিসে বেশিক্ষণ বসা হত না। একটা ফোক্সভাগেন ছিল আর একটা ব্রিফকেস। তাতে থাকত সব কাগজপত্র। চেক বই সিল প্যাড আর কত কী। ড্রাইভার রাখার সামর্থ্য ছিল না। ব্রিফকেসটা ড্রাইভিং সিটে পাশে ফেলে টো টো করে গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। কত রকমের কাজ যে করেছি! পাঁচ হাজার থেকে পাঁচ লাখ পর্যন্ত। ছাড়াছাড়ি নেই। যা পাই তাই করি। ব্যবসা মানে লেগে থাকা, কথাটা শুরুতেই বুঝে গিয়েছিলাম। ফলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চেহারা পাল্টে গেল। সস্তায় পেয়ে ছরুমের এই অফিসটা নিয়ে ফেললাম। কর্মচারীও গেল বেড়ে। ড্রাইভার, দারোয়ান, পিএ কত লোক। ব্যবসাও আসতে লাগল।

    সে একটা সময় গেছে। আজকাল একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয়, মানুষের জীবনে গোল্ডেন টাইম বলে একটা ব্যাপার আছে। যা আসে, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই আসে, ধরে রাখতে পারলে, ব্যাস। ওঠে গেল।

    ধরে রাখতে আমি পেরেছিলাম। তো শেষপর্যন্ত একটু টাল খেয়ে গেল। আমার উদাসীনতার কারণে, অমনোযোগিতার কারণে। এসবের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেহনুমার।

    বছর দুয়েক ব্যবসা করে এক বিঘার এই প্লটটা কিনেছিলাম। খুবই সস্তায়। ঐ যে বললাম, গোল্ডেন টাইম ছিল। হাতদে যা ছুঁই সোনা হয়ে যায়। নয়তো শহরের এই এলাকা এত মূল্যবান হয়ে যাবে, কে জানত! তাহলে তো যাবতীয় ব্যবসা বন্ধ করে। আশেপাশে যত খোলা জমি ছিল সব কিনে ফেলতাম। আর কিছু করতে হত না। আমি কেন, বাপ্পা এবং বাপ্পার পরের আরো ছ জেনারেশান পায়ের ওপর পা তুলে আরামসে বসে খেতে পারত। ফালতু ব্যবসাবাণিজ্যের কথা ভাবতে হত না।

    মানুষের কতরকমের পিছুটান থাকে! মা, বাবা, ভাই, বোন দরিদ্র অনাথ আত্মীয়স্বজন। একটা জীবন তাদের গতি করতে করতেই কেটে যায়। গোল্ডেন টাইমটা কখন আসে, কখন নিঃশব্দে চলে যায়, টের পাওয়া যায় না। আমার ওরকম ছিল না। আমরা দুটো ভাই। মা মারা গেছেন আমাদের ছেলেবেলায়। বাবা ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মচারী। তাঁর রিটায়ারমেন্টের আগেই ভাইয়া চলে গেলেন কানাডায় পিএইচডি করতে। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। পাস করে বেরিয়ে কী করবো কী করব ভাবছি, বাবা মারা। গেলেন। ভাইয়া বিদেশে। বাবার মোটামুটি ভালো এমাউন্টের ব্যাংক ব্যালান্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটি, ইন্সিউরেন্স ইত্যাদি মিলিয়ে আমার হাতে টাকা এল লাখখানেকের ওপর। ঐ দিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম।

    পিএইচডি করে ভাইয়া কানাডায়ই সেটেল করলেন। বিয়েশাদি করে এখন সে পুরোদস্তুর কানাডিয়ান। একজোড়া ছেলেমেয়ে। বাচ্চাগুলো বাংলা বলতে পারে না। ওদের শেষ দেখছিলাম বিয়ের সময়। ভাইয়া এসে মাসখানেক থেকে গিয়েছিলেন। রেহনুমাকে ভাইয়ার খুব পছন্দ হয়েছিল।

    বিয়ের আগেই বাড়িটা আমি তৈরি করে ফেলেছিলাম। তখন এলাকাটি এতটা মূল্যবান হয়ে ওঠেনি। দুচারটে বাড়িঘর হচ্ছে। সামনের বড় রাস্তাটা তখন কাঁচা। গাড়ি নিয়ে এলে ধুলোয় কাঁচ ঘোলা হয়ে যেত। কিন্তু রেহনুমার ভারি পছন্দ হয়েছিল বাড়িটা। আমি তখন এই বাড়িতে এসে উঠিনি। সেপারেট একটা একতলায় ভাড়া থাকতাম। সেই বাড়িতেই বিয়ে হয়েছিল। সেটেল ম্যারেজ। প্রেমের বিয়ে হলে আগেই রেহনুমাকে আমার সব ঐশ্বর্যের পরিচয় করিয়ে দেয়া যেত।

    বাড়িটায় তখন টু-লেট ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। যদি সামান্য কিছু ভাড়া পাওয়া যায়! একদিন এই বাড়ি দেখতে এসে রেহনুমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আর একদিনও দেরি করা যাবে না। কালই আমি এই বাড়িতে এসে ওঠব। এই রকম বাড়ি থাকতে কে থাকে ভাড়া বাসাতে।

    একজন বুড়ো কেয়ারটেকার ছিল বাড়িটায়। রেহনুমা তাকে আদেশ করল, এক্ষুনি টু লেট নামিয়ে ফেল। আর ঘরদোর সব পরিষ্কার কর। আমরা কালই চলে আসব।

    মনে আছে, সেই বিকেলে রেহনুমা পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে প্ল্যান করেছিল, কোথায় গ্যারেজ হবে, খালি জায়গাটা সম্পূর্ণ তাকে দিয়ে দিতে হবে। সে তার ইচ্ছেমতো বাগান করবে। আমি বলেছিলাম, যাও, দিয়ে দিলাম।

    শুনে রেহনুমা যে কী খুশি! বলেছিল, তুমি খুব ভালো। খুব ভালো।

    আজকাল মনে হয়, আমি আসলেই খুব ভালো। নয়তো রেহনুমা চলে যায় কেমন করে! আমি তাকে চলে যেতে দিলাম কেমন করে।

    এই বাড়িতে এসে ওঠার পর, মাস তিনেক যেতে না যেতেই বাড়িটার চেহারা পাল্টে গেল। রেহনুমার ইচ্ছেমতো গ্যারেজ হল, সার্ভেন্ট কোয়ার্টার হল, বাড়ির পেছনটায়। আর সবচে যত্নে, ম্যালা টাকা খরচ করে যে জিনিসটা হল, সেটা এই বাগান। কী রকম যে মেতে ওঠেছিল রেহনুমা এই বাগান করতে। প্রতিদিন অফিসে গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে হত আমায়। গাড়ি নিয়ে রেহনুমা যেত শহরের নামকরা নার্সারিগুলোতে। আজ অমুক গাছের চারা আনছে, কাল অমুক ফুলের বীজ। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাগানটার চেহারা গেল চমৎকার হয়ে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগেনি। ব্যবসায়ী মানুষ তো, গাছপালার পেছনে এত টাকা ব্যয় হচ্ছে দেখে, গোপনে গোপনে বুকে বড় ব্যথা পেতাম। আর এলাকাটা আস্তেধীরে মূল্যবান হয়ে যাচ্ছিল দেখে আমার মাথায় একটা ব্যবসায়ী বুদ্ধিও খেলেছিল। বাড়িটার মাঝামাঝি দেয়াল তুলে অপরাংশে আর একটা চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ি করে ভাড়া দেব। কিন্তু রেহনুমাকে সে কথা বলার সাহস ছিল না। রেহনুমাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। বড় ভয় পেতাম। ভালোবাসার মানুষকে কে না ভয় পায়।

    রেহনুমা খুব সুন্দর ছিল। বাগানটা যখন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল, গাছপালায় ঝোপঝাড়ে যখন পরিপূর্ণ হয়ে উঠল, যখন দিনমান বাগানের ভেতর খেলা করতে লাগল মিঠেল ছায়া, উড়তে লাগল প্রজাপতি, দিনেদুপুরে ডাকতে শুরু করল ঝিঁঝি পোকা, পাখপাখালি, তখন বাগানের দিকে তাকিয়ে আমার বেশ লাগত। রেহনুমাকে মুগ্ধ গলায় প্রায়ই বলতাম, চমৎকার

    একটা কাজ করেছ। রেহনুমা বলত, আমার ছেলেবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল মনের মতো একটি বাগান করব। আমাদের বাড়িতে জায়গা ছিল না বলে করা হয়নি। তবুও আমার ঘরে ছিল মানিপ্লান্ট, ব্যালকনির টবে ছিল গোলাপ চারা। স্কুলের টিফিনের পয়সা কলেজ ইউনিভার্সিটি খরচ বাঁচিয়ে এসব করতাম আমি।

    শুনে আমি একদিন ঠাট্টা করে বলেছিলাম, পরীক্ষার খাতায় তুমি তাহলে একটি রচনাই লিখেছ সবসময়। আমার বাগান।

    রেহনুমা খুব হেসেছিল সেদিন।

    আমাদের বিয়ের দুবছর পর বাপ্পা হল। বাপ্পার জন্ম নিয়েই রেহনুমার সঙ্গে আমার প্রথম লেগেছিল। রেহনুমা চায়নি এত তাড়াতাড়ি আমাদের সন্তান হোক। বিয়ের অন্তত পাঁচ বছর পর প্রথম সন্তান হবে। রেহনুমা এরকম ভেবে রেখেছিল। এই পাঁচটা বছর উদ্যম জীবনযাপন করবে। মধ্যবিত্ত ঘরের ইউনিভার্সিটি পড়া মেয়ে রেহনুমা। স্বামীর প্রচুর টাকাপয়সা, গাড়িবাড়ি এসব দেখে রেহনুমার প্রচুর বন্ধুবান্ধব জুটেছিল। তাদের নিয়ে হৈ-হুঁল্লোড় করতে রেহনুমা খুব পছন্দ করত। পিকনিকে যাও, সি বিচে চল পনের দিনের জন্যে, বছরে দুবার অযথা বিদেশ বেড়াতে যাওয়া, এই করে করে আমি হাঁপিয়ে ওঠেছিলাম।

    আমি একটু একাচোরা স্বভাবের মানুষ। নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করি। রেহনুমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে আমার আপত্তি ছিল না। আপত্তি কেবল ঐসব দলবলের। লোকগুলোকে, মেয়েমানুষগুলোকে আমার পছন্দ হত না। জোর করে প্রথমে কিছুদিন মেশার চেষ্টা করেছিলাম। নিজের বিরুদ্ধে কাহাতক যুদ্ধ করা সম্ভব! পরে নিঃশব্দে সরে গেছি। রেহনুমা একা একাই ওদের সঙ্গে চলাফেরা করত। গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে চলে যেত, পিকনিকে যেত। আর যেদিন বাইরে কোনও প্রোগ্রাম না থাকত সেদিন বিকেলে সবগুলো এসে জুটত বাড়িতে। বাগানে চেয়ারটেবিল পাতা ছিল। সেখানে বসে বিকেলবেলা কী হইচই! চা-কফি খাওয়া। কোনও কোনও দিন ডিনার। ডিনারের আগে ড্রিংকস। বাড়ির দুনম্বর ফ্রিজটা ভরা থাকত ড্রিংসে। ব্যাপারটা আমার একদমই পছন্দ ছিল না। দুচার বার আপত্তি করেছি। রেহনুমা পাত্তা দেয়নি। পরে এই সবের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে ভেবেছি, বাগানের এলাকাটিতে চারতলা ফ্ল্যাটটা করে ফেলব। রেহনুমাকে একদিন বললাম। শুনে সে কী রাগ তার! তুমি একটা ইডিয়েট। অত সুন্দর বাগান কেউ নষ্ট করে। আমি এত কষ্ট করে করলাম। সবকিছু নিয়ে তুমি ব্যবসা করতে চাও কেন?

    জবাব দেয়া হয়নি। ভয়ে এবং ভালোবাসায়।

    পরে ভাবলাম, রেহনুমাকে একটা সন্তান দেওয়া উচিত। বাচ্চাকাচ্চা হলে এইসব ব্যাপার আপছে কেটে যাবে। বাচ্চার মুখের দিতে তাকিয়ে কোনও মেয়ে অন্যকিছু ভাবতে পারে না। কিন্তু এই কথাটা রেহনুমাকে আমি লুকিয়ে গেলাম। গোপনে একদিন ঘটে গেল ব্যাপারটা। দেখে আমি গোপনে শ্বাস ফেলে বাঁচি। যাক একটা উপায় হল এবার।

    কিন্তু মাসখানেকের মাথায় শুরু হল রেহনুমার রিয়্যাকশান। আমি ডাক্তারের কাছে যাব। এত তাড়াতাড়ি ওসব ঝামেলা আমার পোষাবে না। তুমি ইচ্ছে করে এমন করেছ। চাও না আমি ফ্রি থাকি।

    আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, এই প্রথম শুনলাম কোনও মেয়ে সন্তান চায় না। সাধারণত পুরুষমানুষরা চায়, সন্তান দেরি করে আসুক। মেয়েরাই জোর করে আগে নেয়। তোমার দেখছি সম্পূর্ণ উল্টো। ঠিক আছে একটা বাচ্চা হোক, পরে না হয় আর না হবে।

    রেহনুমা বলল, তোমার চালাকি আমি বুঝি। তুমি আমাকে ঘরে আটকে রাখতে চাও। বাচ্চা হলে বন্ধুবান্ধবরা আগের মতো ভিড়তে পারবে না। হৈহল্লা করতে পারবে না।

    আমি হেসে বলেছিলাম, এসব ছেলেমানুষি কথা। বাচ্চা হলেই কি মানুষের জীবন পাল্টে যায়। তুমি তোমার ইচ্ছেমতোই চলতে পারবে।

    রেহনুমা তারপর খুব কান্নাকাটি করেছিল। আমি চাই না, আমি চাই না। এটা হবে আন ওয়ান্টেড চাইল্ড। এই বাচ্চার জন্যে আমার ভালোবাসা থাকবে না।

    আমি কোনও কথা বলিনি।

    মাস তিনেকের মাথায় একরাতে কোনও এক পার্টি থেকে মাতাল হয়ে ফিরল রেহনুমা। আমি আর পারছি না। অসম্ভব। আমি ডাক্তারের কাছে যাব। এবরসন করাব। শুনে আমার যে কী হল, হঠাৎ দুহাতে অবিরাম চড় মারতে লাগলাম রেহনুমাকে। প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রেহনুমা। নেশা কেটে গেল। তারপর বিছানায় পড়ে বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে লাগল।

    সেই রাতে আমরা দুজন দুখাটে ঘুমিয়েছিলাম।

    পরদিন থেকে রেহনুমার আচারআচরণ পাল্টে গেল। হঠাৎ বড় চুপচাপ হয়ে গেল। আমার সঙ্গে কথা বলে কম। বাড়ির চাকর-বাকরকে আগে খুব ধমকাধমকি করত, সেটা বন্ধ হয়ে গেল। এবং বন্ধু-বান্ধব আনাগোনা গেল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকে। বিকেলবেলা বাগানে ঘুরে বেড়ায়। গাছ-পালার তদারকি করে। দেখে আমি ভাবলাম, যাক বন্ধুবান্ধব বাদ দিয়ে রেহনুমা যদি বাগানটা নিয়ে আবার মেতে ওঠে তাহলে বেশ হয়। বাগানে নতুন ফুল ফোঁটানোর ব্যাপারে রেহনুমা যদি ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়ে তাহলে হয়তো বা পেটের সন্তানের প্রতিও তার ভালোবাসা জন্মাবে। বাগানে ফুল ফোঁটানো আর সন্তান জন্ম দেয়া তো একই ব্যাপার।

    বাপ্পা হওয়ার মাসখানেক আগে রেহনুমা চলে গেল বাপের বাড়ি। এই সময় মেয়েরা নাকি বাপের বাড়ি থাকে। আমি রেহনুমাকে প্রতিদিন দেখতে যাই। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ওষুধপথ্য পৌঁছে দিয়ে আসি। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে অবাক হই। রেহনুমা আগের মতো উচ্ছল গলায় আমার সঙ্গে কথা বলে না। কেমন বিষণ্ণ হয়ে থাকে। ব্যাপারটা খেয়াল করে, আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি জোর করে বাচ্চা দিয়ে রেহনুমার অন্য কোনও ক্ষতি করছি না তো!

    কিন্তু তখন আর সময় নেই। কিছু করার উপায় নেই।

    অভিজাত একটা নার্সিংহোমে বাপ্পা জন্মাল। ওজন সাত পাউন্ড চার আউন্স। নার্সিংহোমে বাপ্পার মখ দেখে আমার পথিবী খুব সুন্দর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রেহনুমার মুখ দেখে মনটা গিয়েছিল খারাপ হয়ে। রেহনুমা কেমন উদাস, কেমন বিষণ্ণ।

    সাতদিনের মাথায় রেহনুমাকে বাড়ি নিয়ে এলাম। বাড়ি এসেই রেহনুমা বলল, বাচ্চার জন্যে আয়া রাখ। আমার পক্ষে বাচ্চার প্রতিপালন সম্ভব নয়। অত কিছু আমি পারব না। দুদিন পর এই আয়াকে আমি ঠিক করলাম। নিঃসন্তান, মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলা। এই বাড়িতে ঢুকেই বাপ্পাকে বুকে তুলে নিল। আজও বাপ্পা তার বুকেই আছে। মায়ের মতো বুক দিয়ে বাপ্পাকে আগলে রেখেছে সে।

    বাপ্পার জন্মের পরও আড়াই বছর একত্রে থেকেছি আমরা। তারপরই ঘটে গেল সেই অমোঘ ব্যাপারটি। নিয়তি এ রকমই ছিল।

    জন্মের সাতদিন পরই বাপ্পা চলে গিয়েছিল আয়ার হাতে। তার ঘরেই বাপ্পাকে ঘের দেয়া ছোট্ট খাট দোলনা। দুধ, ফিডার, জামা-কাপড় সব। দিনরাত মহিলা আছে বাপ্পার সঙ্গে সঙ্গে। মায়ের মতো আদরযতে সে প্রতিপালন করতে লাগল বাপ্পাকে। রেহনুমা দিনে একবারও বাচ্চাটি ছুঁয়ে দেখে না। কান্নাকাটি করলেও বুকে তুলে নেয় না। এসব দেখে। মাস তিনেকের মাথায় রেহনুমার সঙ্গে আমার আবার একদিন লেগে গেল। তুমি কেমন। মা হলে, নিজের সন্তানকে কোনও মেয়ে অবহেলা করে, এরকম কথা তো গল্প উপন্যাসেও পড়িনি।

    মনে আছে, তখন বিকেলবেলা। বাপ্পাকে প্যারামবুলেটরে চড়িয়ে আয়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল বাগানে। রেহনুমা সেদিকে তাকিয়ে বলল, মনেই হয় না বাচ্চাটা আমার। তুমি জোর করে আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছ। আন ওয়ান্টেড চাইল্ড। কথাটা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে আমার। স্পর্শ করলে মনে হয় এ অন্যের সন্তান।

    আমার আর কিছু বলার ছিল না। সারাবিকেল মন খারাপ হয়ে থাকে। একের পর এক সিগ্রেট খাই। এ আমি কী করলাম। বাপ্পার জীবনটা বিষাক্ত করে ফেললাম। বাপ্পা যদি বড় হয়ে এ ব্যাপারে আমাকে অভিযুক্ত করে।

    এই অপরাধবোধ থেকেই বাপ্পাকে আমি মায়ের মতো কাছে টেনে নিলাম। আমি যতক্ষণ বাড়ি থাকি, বাপ্পা আমার কাছে থাকে। বিকেলবেলা প্যারামবুলেটরে চড়িয়ে বাপ্পাকে নিয়ে আমিই বাগানে ঘুরে বেড়াই। রেহনুমা সাজগোজ করে বেরিয়ে যায়। কোথায় যায় কে জানে। ফেরে অনেকটা রাত করে। মাতাল হয়ে।

    এই বাড়িতে ঢুকেই ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিল আয়া। থাকাখাওয়া বাদে মাসে মাইনে দেড়শো টাকা তার। এ ছাড়া অন্য কোনও ব্যাপারে নাক গলায়নি সে। মহিলার সিনসিয়ারিটি দেখে ক্রমান্বয়ে আমি তার মাইনে বাড়িয়েছি। এখন চারশো টাকা।

    তবুও রেহনুমা থাকল না। বাপ্পার যখন আড়াই বছর বয়স, যখন সারাবাড়ি ছুটোছুটি করে বাপ্পা, বিকেলে আয়ার সঙ্গে বাগান চষে ফেরে, তখন এক রাতে রেহনুমা বলল, আমি কাল চলে যাচ্ছি।

    বাপ্পার জন্মের পর থেকেই আমরা দুজন আলাদা রুমে থাকি। আমি বাপ্পাকে নিয়ে মেতে থাকি, আর রেহনুমা তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে। পাশাপাশি থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা। জীবন আমাদের। তবুও আমি কখনও ভাবিনি রেহনুমা চলে যাবে কিংবা চলে যেতে পারে। শুনে চমকে ওঠেছিলাম।

    কোথায়?

    আপাতত আমাদের বাসায় থাকব কিছুদিন। তারপর দেখব, কী করা যায়।

    আমি আর কথা বলিনি। পরদিন সকালবেলা রেহনুমা তার সুটকেস ইত্যাদি নিয়ে চলে গেল। এসবের দিন পনের পর এল ডিভোর্স লেটার।

    তারপর থেকে আমার একলা জীবন। অফিস আর বাড়ি। ব্যবসা আর বাপ্পা। সকালবেলাটা কাটাই বাপ্পার সঙ্গে, বিকেলবেলাটা কাটাই বাগানে। বিকেলে বাপ্পার হাত ধরে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে আমার খুব রেহনুমার কথা মনে পড়ে। বাপ্পা ছুটোছুটি করে বাগানে আর আমি বেঞ্চে বসে উদাস হয়ে সিগ্রেট টানি।

    রেহনুমা চলে যাওয়ার পর আমি আবার বাগান ভেঙে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি করতে চেয়েছিলাম। বাপ্পার কথা ভেবে করা হয়নি। বাগানটা বাপ্পার খেলার জায়গা হয়ে ওঠেছে। বিকেলবেলা আজকাল রাবারের বল নিয়ে বাপ্পা বাগানে যায়। ধাম ধাম বলে লাথি মারে। আমাকে দেয়। পাপা, তুমিও খেল। আমি সব ভুলে বাপ্পার বয়সী খেলোয়াড় হয়ে যাই।

    রেহনুমা এখন ব্যাংককে আছে। ব্যাংককে সেটেল এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে চলে গেছে। লোকটা শুনেছি ইমপোর্টেন্ট। রেহনুমার কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি। মাস ছয়েক ধরে রেহনুমা আমাকে খুব চিঠি লিখছে, বাপ্পাকে আমি চাই। আমি বাপ্পাকে আমার কাছে নিয়ে আসব। তুমি না দিলে জোর করে আনব। আমার অনেক লোকজন আছে তোমাদের আশেপাশে। প্রয়োজন হলে চুরি করে আনব বাপ্পাকে।

    ফলে আমি সারাক্ষণ একটা ভয়ের মধ্যে থাকি আজকাল। বাপ্পাকে চোখে চোখে রাখি। স্কুলে পাঠিয়ে স্বস্তি পাই না। এমনিতেই প্রচুর শিশু চুরি যাচ্ছে শহর থেকে। সে এক ভয়। আরেক ভয় রেহনুমা। আমার আশে-পাশে নাকি তার ম্যালা লোকজন রয়েছে। সত্যি সত্যি বাপ্পাকে যদি সে চুরি করে নিয়ে যায়! গড, আমি তাহলে পাগল হয়ে যাব।

    .

    সকালবেলা হায়াত এল পৌনে দশটার দিকে। আমি তখন কী একটা ফাঁইল দেখছি। হাতে সিগ্রেট জ্বলে যাচ্ছে, সামনে চায়ের কাপ। দু-এক চুমুক দেয়া হয়েছে। রুমে ঢুকেই হায়াত বলল, সরি দেরি হয়ে গেছে, তোর সব রেডি? আমি ফাঁইলের ভেতর এতটা ডুবেছিলাম, খানিক কিছু বুঝতে পারি না। অবাক হয়ে বলি, কী?

    ড্রাফট তিনটে করিয়েছিস?

    ও।

    গতকালই হায়াতের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। হায়াত আজ এক জায়গায় টেন্ডার দেবে। নেগোসিয়েশান করেছে। কেউ টেন্ডার দেবে না। আটজন কন্ট্রাক্টর শিডিউল কিনেছিল। প্রত্যেককে পনের হাজার করে দিয়ে শিডিউলগুলো নিয়ে নিয়েছে হায়াত। এখন আর্নেস্টমানি নেই। ড্রাফট করাতে হবে তিনটে। লাখ দুয়েক টাকার ব্যাপার। কাল বিকেলে হায়াত এসেছিল আমার কাছে। তুই ড্রাফটগুলো করিয়ে দে।

    আমি ব্যবসায়ী মানুষ। বললাম, কাজটায় আমাকে শেয়ার রাখ!

    হায়াত খুশি হয়ে বলল, গুড প্রোপোজাল। চল। এত বড় কাজ আমার পক্ষে তো করা কঠিন। হায়াতের সঙ্গে বহুক্ষণ ধরে কাজটার ব্যাপারে কথা হয়েছে। আমি আর্নেস্টমানি দেব এবং কাজ করতে যা লাগে তার ফিফটি পার্সেন্ট দেব। প্রফিট ফিফটি ফিফটি। আজ সকালের মধ্যে হায়াতকে তিনটে ড্রাফট করিয়ে দেব কথা হয়েছিল। এখন অবার লাগছে, ভুলে গিয়েছিলাম কেন! সকালবেলা এসেই তো অ্যাকাউনট্যান্ট সাহেবকে ব্যাংকে পাঠাবার কথা।

    হায়াতকে দেখে আমার সব মনে পড়ে। বেল টিপে নিয়নকে বলি, তাড়াতাড়ি অ্যাকাউনট্যান্ট সাহেবকে ডাক। আর এখানে এক কাপ চা দাও।

    হায়াত বলল, এখন ব্যাংকে পাঠাসনি! এগারটার মধ্যে আমাকে ড্রাফট নিয়ে পৌঁছুতে হবে।

    হয়ে যাবে। তুই বোস। অ্যাকাউনট্যান্ট সাহেব তোর সঙ্গে যাবে। মিনিট দশেক লাগবে ড্রাফট করাতে।

    কিন্তু পিয়নটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমি খুব রেগে যাই। ডাকলি না?

    যুবক পিয়ন কাচুমাচু গলায় বলল, স্যার অ্যাকাউনট্যান্ট সাহেব তো অফিসে আসে নাই।

    কেন?

    তার ছোড পোলাডা বলে হারাইয়া গেছে।

    শুনে আমি আপাদমস্তক চমকে উঠি। মুহূর্তে বাপ্পার কথা মনে পড়ে আমার। উদভ্রান্তের মতো জিজ্ঞেস করি, কবে হারাল? কীভাবে?

    কাইল বিকালে হারাইছে। চাইর পাঁচ বছরের পোলা। বাড়ির সামনের মাঠে খেলতে গেছিল।

    অ্যাকাউনট্যান্ট সাব বাড়িত গিয়া দ্যাহে বেবাকতে কানতাছে। সকালবেলা হেয় লোক পাডাইছিল। আইজ অফিসে আইব না।

    আমার কানে এসব কথা ঢোকে না। পিয়নকে বললাম, মাসুম সাহেবকে পাঠা।

    মাসুম সাহেব অ্যাকাউন্টস অ্যাসিসট্যান্ট। তাকে দুলাখ টাকার চেক দিয়ে বললাম, হায়াত সাহেবের সঙ্গে যাও। তিনটি ড্রাফট করে দেবে।

    হায়াতকে বললাম, তুই কাল আসিস হায়াত। আমি এখন একটু বেরুব।

    আমি তারপর গাড়ি নিয়ে সোজা বাপ্পার স্কুলে। আমার তখন অন্যকিছু খেয়াল ছিল শহরে শিশু চুরি বেড়ে গেছে। তার ওপর বাপ্পাকে নিয়ে আছে রেহনুমার ব্যাপার। দূরে থেকে, ইমপোর্টেন্ট স্বামী দেখে রেহনুমা এখন সন্তানের ব্যাপারে সিরিয়াস। বলেছে, তার ম্যালা তোক ছায়ার মতো ঘুরছে বাপ্পার চারপাশে। আমি রাজি না হলে বাপ্পাকে সে চুরি করে নিয়ে যাবে।

    গাড়িতে বসে আমি মনে মনে রেহনুমার উদ্দেশে বলি, পারবে না, বাপ্পাকে তুমি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আমি বাপ্পাকে বুক দিয়ে আগলে রাখব।

    .

    বাপ্পার স্কুলের সামনে ম্যালা ভিড়। অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়েছে। কিছু রিকশা আছে, হোন্ডা আছে। আর আছে মহিলারা। সন্তানের অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সন্তান। স্কুল থেকে বেরুলে তাকে নিয়ে বাড়ি যাবে।

    মহিলাদের দেখে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। রেহনুমা থাকলে এইভাবে বাপ্পার অপেক্ষায় থাকত, বাপ্পার জন্যে আমার টেনশন থাকত না। হায়রে জীবন।

    ড্রাইভার গাড়ি থামিয়েছে স্কুলের বেশ দূরে। মিনিটখানেকের পথ। দেখে আমি বললাম, তুমি বাপ্পাকে ডেকে আনো। আমি এখানে দাঁড়াই।

    আমি তারপর গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে উদাস ভঙ্গিতে সিগ্রেট টানতে থাকি।

    মিনিট দশেক পর বাপ্পা আসে। দূর থেকে আমি বাপ্পাকে দেখি, পরনে সাদা হাফহাতা শার্ট, নীল হাফপ্যান্ট, পায়ে লম্বা সাদা মোজা হাঁটু অব্দি। আর কেডস। বাপ্পার পিঠে স্কুলের ব্যাগ। গাড়ির সামনে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দূর থেকে বাপ্পা চেঁচিয়ে ডাকে, বাপ্পা। তারপর ড্রাইভারের হাত ছাড়িয়ে ছুটতে থাকে।

    আমি দুহাত বাপ্পার দিকে বাড়িয়ে দিই। সন্তান, আমার সন্তান।

    বাপ্পা ছুটে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে।

    বাপ্পাকে নিয়ে আমি তারপর সোজা বাড়ি চলে আসি। অফিসে টেলিফোন করে বলে দেই, আমি আজ আর অফিসে যাব না।

    বিকেলবেলা বাপ্পা আর আমি বাগানে ঘুরে বেড়াই। বাপ্পার হাতে ছিল হলুদ রাবারের বল; থেকে থেকে বলে লাথি মারছিল সে। তারপর ছুটে গিয়ে নিজেই কুড়িয়ে আনছিল বলটা। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে বাপ্পাকে দেখি। উদাস ভঙ্গিতে বাগানময় পায়চারি করি, সিগ্রেট টানি। বাগানটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে। হাওয়ায় কত রকমের যে গন্ধ! বিকেলের কোমল রোদ পড়েছিল ঘের দেয়া গোলাপ বনে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে কোমল রোদে গোলাপ দেখি। স্বপ্নের মতো ফুটে আছে। আর প্রজাপতিগুলো হেলিকপ্টারের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে চারপাশে। দেখে আমার রেহনুমার কথা মনে পড়ে। চলে গিয়েও রেহনুমা আমার সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকল ছেড়েও ছাড়ল না। নয়তো আমার পক্ষে দ্বিতীয় বিয়ে করা সম্ভব ছিল। বাপ্পাকে দেখেও অনেকে রাজি হত। আমি প্রতিষ্ঠিত একজন লোক। বাড়ি, গাড়ি, বিজনেস। কোনও পিছুটান নেই। শুধু বাপ্পা। তবুও বিয়ে করতে আমার আটকাত না। দুএকবার ভেবেও ছিলাম। এগুইনি ভয়ে। আবার যদি নতুন করে কোনও সমস্যা তৈরি হয়। কিংবা দ্বিতীয়জনও এসে যদি বাপ্পাকে অবহেলা করে।

    এসব ভাবছি, ঠিক তখুনি বাপ্পা চেঁচিয়ে ওঠে, পাপা, পাপা সাপ।

    শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা ঘুরে যায়। কিছু মনে থাকে না। পাগলের মতো ছুটে যাই বাপ্পার কাছে। কোথায়, কোথায় সাপ?

    বলটা দুহাতে বুকে জড়িয়ে বাপ্পা দাঁড়িয়েছিল বাগানের শেষপ্রান্তে। হাসনুহেনা ঝোপের কাছে। হাসনুহেনা ঝোপটা বিশাল হয়ে ওঠেছে কোন ফাঁকে আমি কখনও খেয়াল করিনি। বিকেলবেলাই আবছা অন্ধকার জমে গেছে ঝোপের তলায়। ঝিঁঝি ডাকছে। আমি ওসব খেয়াল না করে বাপ্পাকে জড়িয়ে ধরি। কোথায় সাপ?

    বাপ্পা আঙুল তুলে ঝোপের তলাটা দেখায়। সেখানে পড়েছিল, একটা সাপের খোলস। একটা সাপ আছে বাগানে। খোলস পাল্টেছে। দেখে আমি চমকে উঠি। বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। আমার সাজানো বাগানে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে আততায়ী সাপ! বাপ্পা যখন তখন বাগানে আসে। বাপ্পাকে যদি দংশায়।

    আমি আর ভাবতে পার না। দুহাতে পাগলের মতো বাপ্পাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। তারপর বাগান ভেঙে ছুটতে থাকি। বাপ্পাকে নিয়ে বহুদূরে চলে যাব আমি, সম্পূর্ণ নিরাপদ কোনও জায়গায় যেখানে অশুভ কোনও ছায়া বাপ্পাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনূরজাহান – ইমদাদুল হক মিলন
    Next Article প্রিয় – ইমদাদুল হক মিলন

    Related Articles

    ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলনের বিবিধ রচনা

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    অন্তরে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    এসো – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    দুই বাংলার দাম্পত্য কলহের শত কাহিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদিত

    July 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.