Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শ্রেষ্ঠ গল্প – ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলন এক পাতা গল্প513 Mins Read0

    খেলোয়াড়

    বল এখন বীরুর পায়ে। বীরু প্রতিপক্ষের রক্ষণসীমানায় ঢুকে গেছে। চমৎকার চমৎকার বীরু ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছে পেনালটি সীমানার দিকে। বাধা দিল প্রতিপক্ষের স্টপার নাসিম। নাসিমকে ডস দিয়ে গোলমুখে ঢুকে গেছে বীরু। ডানপায়ে তীব্র শট। গোল, গোল।

    দূরাগত শব্দের মতো হামিদ ভাইয়ের ভরাট গলার এরকম কমেনট্রি হচ্ছিল মাথার খুব ভেতরে। স্টেডিয়াম ভরা দর্শক আজ। খেলা শেষ হতে তিন চার মিনিট বাকি। দর্শক ধরে নিয়েছে খেলাটি ড্র হবে। কিন্তু আজ খেলতে নেমেই আমার জেদ চেপে গিয়েছিল। গোল দেবই। সুযোগ আসেনি। হাফটাইম পেরিয়ে যায়। গোলশূন্য অমীমাংসিত। দেখেশুনে আমার মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। অবশ্য আমি তেমন নামকরা প্লেয়ার নই। ক্লাব আমার ওপর খুব একটা ডিপেন্ডও করে না। সাপোর্টাররা কেউ কেউ হয়ত করে।

    কিন্তু আমার আজ প্রথম থেকেই জেদ ছিল, গোল দেব। চান্স আসে। সাপোর্টারদের করতালিতে স্টেডিয়াম ভেঙে পড়ে। সাপোর্টারদের মধ্য থেকে কে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, বাকআপ বীরুদা। আমার মনে হয় মাথার অনেক ভেতর থেকে আসছে শব্দটা। চোখে দেখি ঝাপসা কুয়াশায় সামনেই হা করে আছে বিশাল গোলপোস্ট। তার মাঝমধ্যিখানে লিলিপুটের মতো একটা মানুষ। প্রতিপক্ষের গোলকিপার। তখন মাথার ভেতর থেকে আবার সেই শব্দ, বাকআপ বীরুদা। ডান পায়ে তীব্র শট নিই। অবলীলায় গোল হয়ে যায়। আ এই সময়টা আমার খুব প্রিয়।

    গোল হতেই গ্যালারি করতালিতে ভেঙে পড়ে। শুরু হয় তুমুল হৈ চৈ। দলের খেলোয়াড়রা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। চার পাঁচজন শূন্যে তুলে দোলায়। সেই অবস্থায় আমি গ্যালারির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ি। হাসি। সিকি মিনিটে সিকি শতাব্দী সময় পেরিয়ে যায়।

    প্রতিপক্ষের তিনজন খেলোয়াড় মধ্যমাঠে সার ধরে দাঁড়িয়েছে। সেন্টার হয়ে গেল। বল আফসানের পায়ে। আফসান লম্বা শট করল। আমার এখন আর কোনও উত্তেজনা নেই। বলটা চড়ুই পাখির মতো মধ্যমাঠে নাচানাচি করছে। প্রতিপক্ষ খুব উইক হয়ে গেছে। ড্র হলেও মানইজ্জত থাকত! এখন সময়ও নেই। গোল শোধ করার প্রশ্নই ওঠে না।

    হঠাৎ দেখি বলটা আমার দিকে ছুটে আসছে। কে পাস দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারিতে হৈ চৈ। পাবলিক সিওর হয়ে গেছে, বীরুর পায়ে বল এলেই গোল। কিন্তু আমি গা করি না। আর গোল দিয়ে কী হবে। জিতে তো গেছিই।

    ডান পায়ে আলতো করে বলটা ধরে রাখি। প্রতিপক্ষের কামালকে দেখি গুলতির গুলির মতো ছুটে আসছে। বলটা নইমকে পাস দিই আমি। তখুনি রেফারির বাঁশি বেজে ওঠে। খেলা শেষ। গ্যালারিতে আরেক রাউন্ড হৈ চৈ। আমাদের সাপোর্টাররা একতালে হাততালি বাজাতে থাকে। আমরা আস্তেধীরে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসি।

    কী আশ্চর্য, খেলার সময় টের পাইনি বুটের ভেতর ডানপায়ের পাতায় মৃদু একটা ব্যথা। এখন হাঁটার তালে নেচে ওঠছে ব্যথাটা। কী হল?

    আজ তো মারেনি কেউ!

    রঞ্জু ভাই, ক্লাব সেক্রেটারি বললেন, বীরু আজ তুই ক্লাবেই থেকে যা। রাতে হেভি চলবে।

    আমি কথা বলি না। একটা মাত্র গোল দিয়ে ক্লাবকে আমি আজ জিতিয়েছি। আমার আজ খাতির হবে অন্যরকম। রাতেরবেলা ক্লাবের সব এডভাইজাররা আসবেন। খাওয়া-দাওয়া হবে। পরে চলবে ড্রিংকস আর রাতভর ফ্লাশ খেলা। দারুণ কাটবে রাতটা। যদিও আমি মদ খাই না, ফ্লাশ খেলার তো প্রশ্নই ওঠে না! টাকা কই! আমি তো আর পয়সাঅলা বাপের পোলা নই।

    তবুও ক্লাবে থাকলে আড্ডাফাজ্ঞা মেরে ভালো কাটত রাতটা! উপায় নেই। ক্লাবে থাকলে বাবা রাগ করেন। অথচ ক্লাবে থাকলে কত সুবিধে ছিল। সিঙ্গেল রুম পেতাম। রেগুলার প্রাকটিসটা হত ভালোভাবে। অন্তত ফুটবল সিজনটা। কিন্তু বাবা একদম নারাজ। ব্যাকডেটেড লোক। তার ধারণা খেলাধুলা জিনিসটাই খারাপ। তার ওপর ক্লাবে থাকলে চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে।

    শালা চরিত্র।

    বাবার ইচ্ছে ছিল আমি ডাক্তার হব। কিন্তু লেখাপড়ায় আমি কখনও তেমন ভালো ছিলাম না। টেনেটুনে ক্লাশ ডিঙাতাম। তবুও বাবার ইচ্ছেয় ইন্টারমিডিয়েট পড়েছিলাম সায়েন্স নিয়ে। বায়োলজি মেইন সাবজেক্ট। পর পর তিনবার পরীক্ষা দিয়েও ইন্টারমিডিয়েট পাস করা আমার হয়নি। বলতে কি লেখাপড়া ব্যাপারটা আমি কখনও তেমন সিরিয়াসলি নিইনি। আমার ভালো লাগত না।

    ছেলেবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি অদ্ভুত টান ছিল আমার। মনে আছে, আমি যখন খুব ছোট, পাড়ার পাঠশালায় পড়ি, তখন আমাদের মিলব্যারাক মাঠে রেগুলার খেলাধুলা হত। ফুটবল সিজনে ফুটবল, ক্রিকেট সিজনে ক্রিকেট। আমি পাঠশালায় না গিয়ে, বগলে বইশ্লেট, শীতকালের সকালে মাঠে চলে যেতাম ক্রিকেট খেলা দেখতে। বাবা কতদিন ডিসপেন্সারি থেকে ফেরার পথে আমাকে কান ধরে বাড়ি নিয়ে এসেছেন।

    তারপর আরো বড় হয়ে, যখন গেণ্ডারিয়া হাই স্কুলে পড়ি, তখন থেকে তো আমি হায়ারে খেলি। পাড়ার ভালো প্লেয়ার, স্কুল টীমের এক নম্বর প্লেয়ার। সবাই বেশ খাতির টাতির করে। সেই বয়সে আমি স্কুল পালিয়ে রেললাইন ধরে স্টেডিয়াম চলে যেতাম খেলা দেখতে। শুনে বাবা আমাকে কম মারধোর করেননি। সেই মারের কথা ভাবলে এখনও সিরসির করে ওঠে।

    একদিন, তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি, টেস্ট পরীক্ষার দুমাস বাকি। বাবা মাস্টার রেখে দিয়েছেন। বিকেলবেলা আমি সেই মাস্টার, আমাদের স্কুলের সবচে ভালো টিচার ফখরুল স্যারের বাসায় গিয়ে পড়ে আসি। স্যারের বাসায় পড়তে যেতাম ঠিকই, কিন্তু আমার একদম ভাল্লাগত না। ফখরুল স্যার এক অঙ্ক কী যে যত্নে তিন চারবার করে বোঝাতেন। আমার মাথায় ঢুকত না। আসলে হত কি, ফখরুল স্যার অঙ্ক করিয়ে যেতেন, আমি সেই অঙ্কের পরিবর্তে খাতায় দেখতাম উদাস একটা মাঠের ছবি। বাইশজন প্লেয়ার ফুটবল খেলছে সেই মাঠে। এই সুন্দর বিকেলে আমি ফখরুল স্যারের কাছে বন্দি হয়ে আছি, আর সবাই খেলছে। আমার খুব মন খারাপ হয়ে যেত। একদিন। অঙ্ক করতে না গিয়ে বইখাতা নিয়ে চলে গেলাম মাঠে। সেদিন মিলব্যারাক মাঠে ধুপখোলা ভার্সাস মিলব্যারাক খেলা। আমি মাঠে যেতেই সবাই চেপে ধরল, বীরু তোকে খেলতে হবে। পাড়ার প্রেস্টিজ। শুনে আমি একটু কাইকুই করি। আমার পরনে লুঙি, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। লুঙি পরে কি খেলা যায়। অবশ্য বাসায় আমার খেলার প্যান্ট আছে, বুট নেই কিন্তু এনক্লেট আছে। কিন্তু বাসায় এখন যাওয়া যাবে না।

    আমি লুঙি কাছা দিয়ে, বইখাতা পাড়ার পোলাপানের হাতে দিয়ে খালি পায়ে খেলতে নামি। ইস কী খেলা যে খেলেছিলাম সেদিন! হাফ টাইমের সময় মাঠে হাত পা ছড়িয়ে বসে দুপয়সা দামের আইসক্রিম খাচ্ছি। আমার চারপাশে ছোটখাটো ভিড় লেগে আছে। ভিড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখি বাবা আসছেন। নিশ্চয় কোনও রোগীকে ইনজেকশান দিতে যাচ্ছেন। দেখে আমার হয়ে যায়। যে ছেলেটির হাতে আমার বইখাতা ছিল, তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ছোঁ মেরে বইখাতাগুলো নিয়ে ভোঁ দৌড়। মাঠের সবাই তো হা। কিন্তু বাবা ততক্ষণে আমাকে দেখে ফেলেছেন। ব্যাপারটা বুঝতে পাড়ার ছেলেদের দেরি হয় না।

    সেদিন আমার পরিবর্তে কে খেলেছিল মনে নেই। তবে একটা কথা স্পষ্ট মনে আছে, ধুপখোলা গ্রুপ হাফ টাইমের পর আমার দেয়া তিনটে গোল শোধ করেও আরো একটি গোল দিয়ে গিয়েছিল। এই কারণে পাড়ার ছেলেরা ম্যালা দিন আমার বাবার ওপর বিলা হয়েছিল। পাড়ার দেয়ালে দেয়ালে বাবার নামে খাতারনাক পোস্টার পড়েছিল। মিলব্যারাক মাঠে বাবার নামে চলবে না চলবে না জাতীয় শ্লোগানও দিয়েছে ছেলেরা। বাবা কেয়ার করেননি। কিন্তু আমাকে হেভি ধোলাই দিয়েছিলেন। মনে পড়লে এখন বুক কাঁপে। তবুও খেলা আমায় ছাড়েনি। কিংবা আমি খেলাকে।

    ক্লাবে এসে বুট খুলে দেখি পায়ে ব্যথার কোনও চিহ্ন নেই। বুটের বাইরে এসে পা দুটো বেশ আরাম পাচ্ছে। কিন্তু ব্যথাটা আছেই। থেকে থেকে চাপা দেয়। আমি ডানপায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। চাপা পড়া ঘাসের মতো রঙ হয়েছে পায়ের। এক সময় প্রায় এরকম গায়ের রঙ ছিল আমার। খেলতে খেলতে রঙটা পাল্টে গেছে। এখন আমার গায়ের রঙ তামাটে।

    আমি দেখতে মোটামুটি চলনসই। লম্বা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। বুকের মাপ চৌত্রিশ। পাতলা গোঁফ আছে। আমার চুল উনিশশো একষট্টি সাল স্টাইলে ছাঁটা।

    একাত্তরের পর থেকে আমাদের জেনারেশানের ছেলেদের লম্বা চুল রাখা চালু হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কখনও রাখিনি। বারবার ইচ্ছে হয়েছে, রাখা হয়নি বাবার জন্যে। বাবা পছন্দ করেন না। মাসে একবার চুল ছাঁটাতে হবে। এটা বাবার কথা। এই সেদিনও মাসের প্রথমদিকে বাবার সঙ্গে আমাকে সেলুনে যেতে হত। নরসুন্দর সাহেব বাবার। ডিরেকশানে আমার চুল হেঁটে দিতেন। আজকাল বাবা অবশ্য সেলুন পর্যন্ত যান না। কিন্তু চুল হেঁটে এসে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাবাকে এখন দেখাতে হয়। অবশ্য দেখে বাবা কখনও খুশি হন না। দুএকবার চুল হেঁটে এসেও আমাকে আবার সেলুনে যেতে হয়েছে। বাবার পছন্দ হয়নি।

    একটা জিনিস আমি এই তেইশ বছর বয়সেও বুঝতে পারি না, অত নিয়মের ভেতর থেকে কী হয় জীবনে। বাবাকে তো জন্মের পর থেকে দেখছি ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন। বাড়ির কাছে বুড়িগঙ্গা, ওঠে সোজা চলে যান নদীতে। তার আগে আমাদের সব ভাইবোনকে ডেকে তুলে পড়তে বসান। ডিসপেন্সারিতে যান কাঁটায় কাঁটায় সাতটায়। এর কোনও ব্যতিক্রম দেখিনি। কিন্তু লোকটা জীবনে পেয়েছে কী? সারাজীবন বজলু ডাক্তারের কম্পাউন্ডার। মাস মাইনে চারশো সত্তর টাকা। ফাউ পাওনা বছরে একজোড়া পাজামা, একজোড়া চার পকেটঅলা ফুলহাতা শাদা শার্ট আর একজোড়া বাটার স্যান্ডেল। ছাতা আছে একটা। কমপক্ষে দশটা তালি পড়েছে তাতে। বিক্রমপুরে কানি দুয়েক জমি ছিল এককালে। স্বাধীনতার পর পরই বিক্রি হয়ে গেছে। থাকার মধ্যে সাতটি ছেলেমেয়ে, চারশো সত্তর টাকা মাইনের কম্পাউন্ডারি আর কালীচরণ সাহা স্ট্রিটের একটা তিনতলা বিরাট বাড়ির নিচের তলায় ত্রিশ ফুট বাই বার ফুট মাপের লম্বাটে একটা রুম। গাদাগাদি করে আমরা নটি মানুষ ওই স্যাঁতস্যাঁতে ড্যাম্পপড়া রুমটির ভেতর জীবনযাপন করছি।

    এই বাড়িটার একটা ইতিহাস আছে। মালিক ধলেশ্বর বাবুর কোনও উত্তরাধিকারী ছিল না। জীবদ্দশায় ধলেশ্বরবাবু থাকতেন চিলেকোঠায়। বাড়ির ভাড়াটে। সবই হিন্দু। দোতলা তিনতলা মিলে ছত্রিশটা রুম। প্রতি রুমে একটা করে ফ্যামিলি। বেঁচে থাকতে ধলেশ্বরবাবু মাস ভাড়া দিতেন। যে যা দেয়। কিন্তু কে কত করে দিত ধলেশ্বরবাবু ছাড়া অন্য কেউ তা জানত না। বাবা এই চান্সটা নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন। আজ ত্রিশ বছর ধলেশ্বরবাবু মারা গেছেন। বহুকাল। সে কথা আমার মনে নেই। গল্পটা মার কাছে শোনা।

    আমার মা, সে আরেক ক্যারেক্টার। মহিলাকে আমি কখনও উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি। নিঃশব্দে কাঁদতে দেখেছি বহুবার। ভোর পাঁচটা থেকে রাত দশটা অব্দি টানা কাজ করেন। দিনে তাঁকে কখনো ঘুমুতে দেখিনি। অসুখ বিসুখে পড়ে থাকতে দেখিনি। একটার পর একটা ভাইবোন হয়েছে আমার। এই ঘরের ভেতরই সন্তানের জন্ম দিয়ে। দিন দুয়েক বিছানায় থেকেছেন তিনি, তারপর আবার সংসারের কাজ।

    কেমন করে যে পারেন। ভাবলে মাথার ভেতর অন্ধকার ঢুকে যায়।

    রঞ্জু ভাই বললেন, কী হয়েছে বীরু?

    আমি ডান পা দেখিয়ে বলি, ভীষণ ব্যথা করছে।

    কেউ মেরেছিল?

    না তো!

    তাহলে?

    বুঝতে পারছি না। রঞ্জু ভাইর হাতে সিগারেট ছিল, টান দিয়ে বললেন, এমনিতেও অনেক সময় ব্যথা হয়। বাড়ি গিয়ে গরম জলে স্যাঁক দে, ঠিক হয়ে যাবে।

    আমি একটা সোফার ওপর কাৎ হয়ে শুয়ে আছি। চানটান করে এখন বেশ ফ্রেশ লাগছে। জার্সি খুলে নিজের হাওয়াই শার্ট আর বেলবটম প্যান্ট পরেছি। এর মধ্যে দু রাউন্ড চা হয়ে গেছে। এখন আসবে বিরিয়ানি। আমার আজ খাতিরই অন্যরকম, যা বলব তাই হবে।

    কিন্তু পার ব্যথাটা..

    বিরিয়ানিটা খেয়েই কেটে পড়ব। বাড়ি দিয়ে গরমজলে বরিক পাউডার ফেলে স্যাঁক দিতে হবে। কিন্তু সাইকেল চালিয়ে যেতে পারব তো?

    ধুৎ শালা মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমি রঞ্জু ভাইর কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাই। আমি সিগারেট খাই না। আমার বাবাও না। বাবা খান না পয়সার অভাবে, আমি অন্য। কারণে। সিগারেট খেলে দম নষ্ট হয়ে যায়। খানিক দৌড়লেই টায়ার্ড লাগে। প্লেয়ারদের সিগারেট খেতে নেই।

    কিন্তু এখন খাচ্ছি আমার মুড অফ হয়ে আছে বলে। সিগারেট খেলে যদি ভালো হয়। আমি সিগারেট খাচ্ছি, কোত্থেকে ইউসুফ ছুটে আসে। কী বে সিগ্রেট খাস ক্যালা?

    শুনে আমি হাসি। ইউসুফ ঢাকাইয়া পোলা, খেলে ভালো। কথা বলে যাচ্ছেতাই ভাষায়। আর হেভি মাল টানে।

    আমি ইউসুফের কথার জবাব দিই না। একটা সিগারেট খেলে কী হয়! আমি তো কাল সকাল ওঠেই কালিচরণ সাহা রোড থেকে শুরু করে সতীশ সরকার রোড হয়ে, লোহারপুল বাঁয়ে রেখে ভাট্টিখানা হয়ে সোজা ডিস্টিলারী রোড, ধুপখোলা মাঠের চারদিকে ঘুরে দীননাথ সেন রোড ধরে মিলব্যারাক মাঠ পর্যন্ত আমার রেগুলার দৌড়টা দৌড়ে নেব। ফাঁকে শুধু একবার, শুধু একবার স্বপ্নের মতো সেই বাড়িটার সামনে দাঁড়াব। জানালায় আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে সেই মেয়ে। তার রুমে তখনও জ্বলবে নীল ডিমলাইট। লো ভলমে বাজবে ভারি সুন্দর একটা মিউজিক। একটা। সিগারেটের কারণে কি কাল সকালের আমি একটা রোড কম দৌড়াব! ভেবে আমার খুব হাসি পায়।

    ঠিক তখুনি কাঁঠালপাতার ঠোঙায় বিরিয়ানি আসে। সঙ্গে সঙ্গে হৈ চৈ, থাবাথাবি। পায়ের ব্যথাটা আছে বলে আমি নড়ি না। সোফায় কাৎ হয়ে শুয়েছিলাম। শুয়েই থাকি। আজ তো আমি হিরো। একমাত্র গোলটি দিয়ে দল জিতিয়ে দিয়েছি। কেউ না কেউ আমার ঠোঙাটা এগিয়ে দেবেই।

    দেয়। স্বয়ং রঞ্জু ভাইই। আমি কাৎ হয়ে শুয়ে বিরিয়ানি খাই। খাচ্ছি, খাচ্ছি, নয়ন এসে হাজির।

    যাবি না রে?

    যাব।

    তাড়াতাড়ি খা।

    আমি বলি, এক গ্লাস জল দে তো।

    পানি ক। নইলে দিমু না।

    আমি মৃদু হেসে বলি, আচ্ছা পানিই দে।

    নয়ন জল এনে দেয়। ও একটু পাগলা টাইপের। আমাদের এলাকায়ই থাকে। নিজে খেলে না কিন্তু সব খেলায় আছে। আমাদের ক্লাবের মহাভক্ত। প্লেয়ারদের সবার সঙ্গে ওর তুই তুকারি সম্পর্ক।

    নয়নটা পাগলাটে হলে কী হবে, কথা বলে খুব মজা করে। যেমন হিন্দুদেরকে এদেশের লোকে মালাউন বলে গাল দেয়। কিন্তু নয়ন বলে ফেরাউন। শুনে আমার বেশ মজাই লাগে।

    আমি নয়নকে বললাম, আমার ডান পায়ে খুব ব্যথা হচ্ছে দোস্ত, সাইকেল চালিয়ে বোধহয় যেতে পারব না।

    নয়ন বলল, ঠিক হ্যায় আমি চালিয়ে নিয়ে যাব। তুই তোর বোচকাবাচকি ওঠা। তোয়ালে আর ঘামে ভেজা মোজা এসব নিয়ে আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সাইকেলটার সামনে আসি। জিনিসগুলো কেরিয়ারে রেখে তালা খুলে বলি, চল।

    .

    হারিকেনটা টিমটিম করে জ্বলছে। ঘরের ভেতর আবছা আলোছায়া। ভ্যাপসা গরম পড়েছে কদিন। আর খুব মশা। ভাইবোন সব গাদাগাদি শুয়ে আছে। মা বসে বসে পাঁচ বছরের ছোট ছেলেটিকে বাতাস করছে।

    আমি বারান্দায়, আমার রুমে রুম বলতে এক চিলতে বারান্দার দুদিকে বুকা বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি হাত দশেক জায়গা। সরু দুজন মানুষ এক সঙ্গে নড়তে পারবে না, এমন। সাইকেলটা রাখতে রাখতে বলি, একটু গরম জল কর মা।

    মা নিঃশব্দে ঘরের কোণে স্টোভ জ্বালেন। সাড়া পেয়ে দিদিও ওঠেছে। দিদির কাশির শব্দ পাই। দিদি আমারচে তিন বছরের বড়। আমার এখন তেইশ দিদির ছাব্বিশ। বাঙালী মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি। দিদি বুড়ি হয়েছে ছবছর আগে। দিদির এখনও বিয়ে হয়নি। দিদিটা দেখতে খুব খারাপ। হোঁকা টাইপের শরীর। কালো মোটা ঠোঁট, দাঁত উঁচু। হাসলে বিচ্ছিরি দেখায়। আজ পর্যন্ত কতজন যে দিদিকে দেখে গেল। শুধু দেখাই। কাজ হয়নি। কোন গরিব পাট্টি রাজি হলেও ডিমান্ড করে হেভি। আমার কম্পাউন্ডার বাপ সেসব শুনে ভিরমি খায়। এসব ভাবতে ভাবতে তোয়ালে জাঙে মোজা। অন্ধকার বারান্দায় মেলে দিই। শব্দ পেয়ে খাঁচার ভেতর টিয়েটা শিস দিয়ে ওঠে। পাখিটা তিন বছর এই সংসারে আছে। ছোলাটোলা আজকাল বাবাও এনে দেন। অভ্যেস হয়ে গেছে।

    মা বললেন, জল নে।

    আমি লুঙি পরতে পরতে দিদিকে বলি, জলটা আন তো। আর একটা কুপি জ্বালিয়ে দিস। এক হাতে টিনের কুপি আরেক হাতে গরম জলের বাটি নিয়ে আসে। কুপিটা চৌকির ওপর রেখে বলল, খাবি না?

    নারে, ক্লাবে খেয়েছি।

    জিতেছিস?

    হা। একটা গোলে। গোলটা আমিই দিয়েছি।

    দিদি চলে গেলে আমি এই প্রথম দিদির ভেতর কেমন একটা বিষণ্ণতা খেয়াল করি। দিদিটা কেমন ম্লান হয়ে গেছে আজকাল। আগে খানিকটা উজ্জ্বল ছিল। একটু হাসতটাসত। বহুকাল দিদিকে হাসতে দেখি না। দিদির জন্যে আমার বুকের ভেতরটা। হঠাৎ কেমন তোলপাড় করে।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি তার পর আমার পুরনো ছেঁড়া গামছার খানিকটা ভিজিয়ে পায়ে স্যাঁক দিতে থাকি।

    রাত বাড়ে। কিন্তু ব্যথাটা কমে না। বাবা এখনও ফেরেন নি। ফিরে যদি দেখেন আমি বসে বসে পা স্যাঁকছি, রাগ করবেন। আমি বাবাকে এসব দেখাতে চাই না। আবার দিদিকে ডাকি। দুটো ব্যথাফ্যাথার ট্যাবলেট দে।

    আমাদের ঘরে ব্যথাফ্যাথার ট্যাবলেট কিছু থাকেই। বাবা বিনিমাগনা নিয়ে আসেন। কখন কার লাগে।

    দিদি ট্যাবলেট এনে দিলে, খেয়ে কুপি নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। দোতলার কোনও ঘরে একটা বাচ্চা কেঁদে ওঠে। তখন অন্ধকার বারান্দায় টিয়েটা মৃদু একটা শিস দেয়। কানের কাছে প্যানপোন করে রাষ্ট্রীয় মশা। টায়ার্ড লাগে তবুও ঘুম আসে না। বাবার কথা মনে হয়। দশটার বেশি বাজে। বাবা এখনও ফেরেন নি। কম্পাউন্ডার মানুষ। বুড়ো ডাক্তার সাহেব চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ ডিসপেন্সারি খুলে বসে থাকেন।

    বাবা চেয়েছিলেন আমাকে দিয়ে সাধ পূরণ করতে। আমারও হল না।

    বাবা হেরে গেছেন।

    প্রথমবার ইন্টারমিডিয়েট ফেল করার পর বাবার মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন ফুটবল সিজনে ইতিউতি পঞ্চাশ একশো টাকা খ্যাপ মেরে বেড়াই। সেই টাকায় নিজে চলি। মাকে দিদিকে দিই কিছু। বাবাকে জানতে দিই না। অবশ্য তখন থেকেই জানতাম পাশটাশ আমার হবে না। সিজনে খেলে দুপয়সা কামাতে পারব। একটু ভালো খেললে বড় টিমে চান্স। ইয়ারলি কন্ট্রাক্ট। ম্যালা টাকা।

    কিন্তু সে কবে?

    এসব ভেবে একটা টিউশানি যোগাড় করেছিলাম। তনুগঞ্জ লেনে। ক্লাস এইটের ছাত্রী দিপু। দিপু খুব সুন্দর ছিল। দিপুকে প্রথম দিন দেখেই আমি আমার ছোট্ট নোট খাতায় লিখেছিলাম, দিপু খুব সুন্দর। লেখাটি দিদি কেমন করে দেখে ফেলে। তারপর আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, দিপু কে রে?

    আছে একজন।

    শুনে ঠোঁট টিপে হেসেছিল।

    মাস ছয়েক চালিয়েছিলাম টিউশনি। ততদিন আমার আশা ছেড়ে বাবা চোখ দিয়েছেন। হিরুমিরুর দিকে। ওদের কারো যদি হয়। কিন্তু ওদুটো আরো বাজে ছাত্র। সেভেন এইটেই ফেল করে। ছোট বোনগুলোও গাধা। কাউকে দিয়ে বাবার আশা পূরণ হবে না। বাবা একদম হারু পাট্টি।

    অন্ধকার বিছানায় শুয়ে এসব ভাবছি। পায়ে ব্যথা। ঘুম আসে না। বাবার জন্যে দুঃখে মন ভরে যায়। সংসারে কিছু কিছু লোক আছে যাদের কোনও স্বপ্নই সত্য হয় না। বাবা সেই দলের ক্যাপটেন। হারু ক্যাপটেন। দুয়ো।

    .

    ভোররাতে ঘুম ভেঙে যায়। লোহারপুল মসজিদে তখন আজানের শব্দ। এই শব্দটা বরাবরই আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু আজ ঘুম ভাঙতেই টের পাই ডান পায়ে অসম্ভব ব্যথা। শরীরটাও গরম হয়ে গেছে। আর কেমন একটা অস্বস্তিভাব। গা চুটপুট করে। ব্যথায় জ্বর এসে গেছে।

    ওঠে বসব, পারি না। ডান পাটা একদম নাড়তে পারি না।

    লোহারপুলের বিমের মতো ভারি হয়ে গেছে।

    বিছানায় শুয়ে থেকেই দেখি আবছা অন্ধকারে বাবা চান করতে যাচ্ছেন বুড়িগঙ্গায়।

    ভাইবোনরাও সব ওঠে পড়েছে। গুনগুন করে পড়ছে শব্দ পাওয়া যায়।

    আমাদের ঘরটা একদম খুপরি। অনেকটা বেলা হলেও বোঝা যায় না। সারাদিন ঘাপটি মেরে থাকে অন্ধকার। সাড়ে সাতটা আটটা পর্যন্ত হারিকেন জ্বালিয়ে, কুপি জ্বালিয়ে পড়াশুনা করে ভাইবোনগুলো। বৃষ্টিবাদলার দিনে সারাদিন হারিকেন জ্বলে ঘরে।

    রোজ এসময় আমিও ওঠে পড়ি। ওঠে খেলার প্যান্ট পরি, ডোরাকাটা গেঞ্জি আর কেডস পরে দৌড়াতে বেরুই। কালীচরণ সাহা রোড থেকে শুরু করে সতীশ সরকার রোড হয়ে লোহারপুর বাঁয়ে রেখে ভাট্টিখানা হয়ে সোজা ডিস্টিলারি রোড। তারপর ধূপখোলা মাঠের চারদিক ঘুরে দীননাথ সেন রোড হয়ে মিলব্যারাক মাঠ। দৌড়লে দম বাড়ে। প্র্যাকটিস করতে সাইকেল নিয়ে ক্লাবের মাঠে যাই বিকেলবেলা। গত দুবছর এর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আজ আমি ডান পা নড়াতেই পারছি না। দৌড়তে যাব কেমন করে!

    খারাপ লাগে। সে আমার অপেক্ষায় জানালায় দাঁড়িয়ে থাকবে। ঘরে তার নীল ডিম লাইট জ্বলবে। মিষ্টি সুরে বাজবে মিউজিক। এই তেইশ বছরের জীবনে ওই একটিমাত্র সুন্দর দৃশ্য আমার অপেক্ষায় থাকে। হায় কতদিন যে ওই প্রিয় দৃশ্যটির কাছে আমার। ফিরে যাওয়া হবে না!

    রাগে-দুঃখে আমার কান্না পেতে থাকে।

    .

    দুপুরবেলা বাবা গম্ভীরমুখে আমাকে একটা ইনজেকশান দিলেন। হিরু বোধহয় ডিসপেন্সারিতে গিয়ে বাবাকে খবর দিয়েছিল। সকাল থেকে আমার বেঘোর জ্বর। পায়ের ব্যথাটা মারাত্মক হয়ে গেছে। কেন যে এরকম ব্যথা হল, কিছু বুঝতে পারি না। ব্যথায় সারা সকাল ককিয়েছি। চায়ের সঙ্গে দুটো ব্যথার বড়ি খেয়েছি। কাজ হয়নি। মার তো আর আমার দিকে চোখ দেয়ার সময় নেই। দিদি আমার সঙ্গে আছে। সকাল থেকে কতবার যে গরম জলে বরিক পাউডার দিয়ে পায়ে স্যাক দিয়েছে। তাতে ব্যথাটা খানিক কমে। স্যাক বন্ধ হলেই আবার বাড়ে। দিদিকে কাহাতক বলব লজ্জা করে।

    বাবা ইনজেকশান দেয়ার পর ব্যথাটা আস্তেধীরে কমে আসে। মা পাতলা ট্যালট্যালে বালি দেন খেতে। চোখ বুজে খেয়েই নিই। বালি খাওয়ার অভ্যেস আছে আমার। জন্মে। আমি কখনও দুধ পাইনি। মার বুকের দুধ ছাড়া। আমার কোনও ভাইবোনও পায়নি। ছেলেবেলায় বার্লির সঙ্গে মা আমাদের চালের আটা গুলে খাওয়াত। রাতের বেলা শোয়ার আগে মাকে রেগুলার দেখতাম দুমুঠো চাল ভিজিয়ে রাখতেন। সকালবেলা সেই চাল বেটে বার্লির সঙ্গে জ্বাল দিয়ে রাখতেন। ছেলেবেলায় ওই ছিল আমাদের সারাদিনের খাদ্য।

    বিকেলের মুখে, বেরিয়ে যাবার সময় বাবা এক পলক আমাকে দেখে যান। কথা বলেন না। ইনজেকশান দেবার সময়ও বাবা আমাকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করেননি।

    বাবার কি আমার উপর রাগ! বহুকাল বাবা আমার সঙ্গে কথা বলেন না।

    আজ বাবা যখন আমাকে ইনজেকশান দিচ্ছিলেন তখন সেই মারাত্মক ব্যথা এবং জ্বরের ঘোরেও আমি বাবাকে একটু খেয়াল করে দেখি। বহুকাল বাবাকে এত কাছ থেকে দেখা হয়নি। বাবার চেহারাটা কেমন ভেঙে গেছে। দেখে আমার বুকটা কেমন করে। বাবার কত স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হব। দিদির ভালো জায়গায় বিয়ে হবে। কোনও স্বপ্নই সত্য হয়নি। লোকটা চিরকাল হেরে গেল।

    .

    পাঁচ দিনের মাথায় আমি একটু একটু হাঁটাচলা করতে পারি। ব্যথাটা কমে গেছে। জ্বরও। তবুও মা আমায় বেরুতে দেন না। পাঁচদিন প্র্যাকটিসে যাইনি বলে পরশুদিন রঞ্জু ভাই এসেছিলেন। এসে দেখেন আমি বিছানায়। দেখে তো হা। অনেক প্যাচাল পাড়লেন। ভাগ্য ভালো শিঘ্র আমাদের কোনও খেলা নেই। রঞ্জু ভাই বললেন, আরো সপ্তাহখানেক রেস্ট নে। তারপর তিনশো টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে চলে গেলেন। আমার পথ্যটথ্য লাগবে। বুঝতে পারি এ সবই সেদিনের গোল দেয়ার ফল। কাল বিকেলে বিছানা ছেড়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়িময় খানিকটা হাঁটাহাঁটি করেছি। আজ বিকেলে কেন যেন মনে হয় আমার বুঝি পুনর্জন্ম হল। কাল থেকে নতুন করে আমি আবার সব শুরু করব। অবশ্য আরো দুচারদিন ফ্রিলি দৌড়তে পারব না। তবুও কাল সকালে আমাকে বেরুতেই হবে।

    আমার অপেক্ষায় সেকী এখনও জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে! নাকি পাঁচ দিনের পা ব্যথা আমার জীবন থেকে প্রিয়তম দৃশ্যটা হরণ করেছে।

    সন্ধের মুখে মুখে যখন দিদি ধুপতি জ্বালিয়ে দিয়েছে হিরুর বইপত্র রাখার বাক্সটার ওপর, যেখানে দেয়ালের সঙ্গে ঝুলছে ফুটপাথ মার্কা কালীর বাঁধানো ছবি, তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তারপর দুচাত নমস্কারের ভঙ্গিতে বুকে কাছে তুলে মনে মনে কালীকে বলি, মা মাগো সে যেন আমার অপেক্ষায় থাকে।

    কী আশ্চর্য, কথাটা মনে মনে উচ্চারণ করি আর আমার চোখ জলে ভরে আসে, কেন যে!

    .

    সকালবেলার পৃথিবী খুব সুন্দর লাগছে আজ। ফুরফুরে একটা হাওয়া আছে, ট্যালট্যালে বার্লির মতো আলো ফুটো করে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরিয়েই বহুকাল বাদে মনটা বড় ভালো হয়ে যায় আমার।

    আজ আমি কেডস পরিনি, খেলার প্যান্ট গেঞ্জি পরিনি। সবুজ রঙের পুরনো লুঙি আর বাঁ বগলের কাছে ফেঁসে যাওয়া পাতলা পাঞ্জাবি পরে বেড়িয়েছি। এখনও ভালো করে হাঁটতে পারি না। ডান পাটা টেনে টেনে হাঁটি। ভালো করে পা ফেললে ব্যথাটা চিলিক দিয়ে ওঠে।

    খুঁড়িয়ে হাঁটছি। তবুও আমার মন খারাপ হয় না। কতদিন দেখি না তাকে। আজ দেখা হবে। মা কালীর আশীর্বাদে দোতলার জানালায় ছবির মতো দাঁড়িয়ে থাকবে সে। ঘরের ভেতর জ্বলবে নীল পাতলা আলো। ক্যাসেটে বাজবে মিষ্টি মিউজিক। আহ।

    দীননাথ সেন রোডে সেই সুন্দর বাড়ি। ছবির মতন। শাদা দোতলা। সামনে চমৎকার বাগান। বাগানে কত যে ফুল ফুলের মতো ফুটে আছে। বারান্দায় একটা এলসেশিয়ান, গ্যারাজে একটা নীল গাড়ি।

    নীল কি এ বাড়ির প্রিয় রঙ!

    এসব ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির মুখোমুখি লাইটপোস্টটির তলায় গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু গেটের সামনে একটা লালহোন্ডায় বসে আছে রাজপুত্রের মতো এক যুবক। একটা পা মাটিতে নামানো। কালো প্যান্ট আর সাদার ওপর চক্রাবক্রা শার্ট পরা। বুকের কাছে দুটো বোতাম খোলা, গলায় সোনার চেন। বুকের কাছে লেপটে আছে আধুলির মতো লকেট। হাতে দামি সিগারেট, থেমে থেমে টানছে সে।

    এত সকালে এই যুবক কী করছে এখানে! এ বাড়ির কাউকে নিয়ে যুবকের কি দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা!

    ঠিক তখুনি দোতলা থেকে চারদিকের পৃথিবী সুন্দর করে নেমে আসে সেই মেয়ে। পরনে তার সমুদ্র রঙের শাড়ি। ব্লাউজ নীল রঙের। কপালে চাঁদের মতো টিপ। নীল রঙের। দেখে আমি সব ভুলে তাকিয়ে থাকি। ঘোর লেগে যায়।

    যুবকের হোন্ডার সামনে এসেই মিষ্টি করে হাসল সে। তারপর কী বলে, আমার সে কথা কানে যায় না। আমি অবাক হয়ে তাকে দেখি। ঈশ্বর এত সুন্দর মানুষও তৈরি করেছেন পৃথিবীতে! তার হাসিতে আমি দেখতে পাই, এইমাত্র মনোরম আলোয় ভরে গেল পৃথিবী। কিন্তু সেই মেয়ে একবারও আমার দিকে তাকায় না। সেকি আমায় চিনতে পারে না! সে ততক্ষণে যুবকের হোন্ডার পেছনে চড়ে বসেছে। আমি তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি নীল সুন্দর স্যান্ডেল পরা। শাড়ি একটুখানি ওঠে আছে। আহ পায়ের রঙ কী তার। পাকা সবরি কলার মতো। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি।

    বারান্দা থেকে এলসেশিয়ানটা এসে দাঁড়িয়েছে গেটের সামনে। যুবক হোন্ডা স্টার্ট দিতেই সে ডান হাতে যুবকের কোমর জড়িয়ে বলল, গুডবাই।

    আমি মনে মনে বলি, গুডবাই। মুহূর্তে চোখের ওপর থেকে দৃশ্যটা হারিয়ে যায়। তখন বুঝতে পারি সে গুডবাই দিয়েছিল কুকুরটাকে।

    বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

    সেই সময় চার পাঁচজন বৃদ্ধ, সৌম্য সম্রান্ত চেহারায়, দামি লাঠি হাতে দ্রুত আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। বেচে থাকার নেশা। ভোরবেলা হাঁটাহাঁটি করলে পরমায়ু দীর্ঘ হয়ে যায়। এই মুহূর্তে আমি ঠিক বুঝতে পারি না, মানুষ যে কেন দীর্ঘকাল পৃথিবীতে বেচে থাকতে চায়।

    আমি আস্তেধীরে সেই বাড়ির সামনে থেকে ফিরে আসি। ফিরে সোজা মিলব্যারাক মাঠ। মাঠে হাঁটাহাঁটি করছে দুএকজন, তাদের চার পাশে আবছা মতন কুয়াশা ঝুলে আছে, আমার চোখে মাঠটা বড় দুঃখী, বড় উদাস দেখায়।মাঠের কোণে স্যান্ডেল দুটো খুলে আমি রাখি। তারপর লুঙি কাছা মেরে, সেই ছেলে বেলা একবার যেমন খেলতে নেমেছিলাম, হুবুহু সেই স্টাইলে মাঠে নামি। ডান পাটা ব্যথা করে। তবু আমার আবার শুরু করতে হবে। আমি আস্তেধীরে দৌড়াতে থাকি। দৌড়াতে থাকি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনূরজাহান – ইমদাদুল হক মিলন
    Next Article প্রিয় – ইমদাদুল হক মিলন

    Related Articles

    ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলনের বিবিধ রচনা

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    অন্তরে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    এসো – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    দুই বাংলার দাম্পত্য কলহের শত কাহিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদিত

    July 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.