Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শ্রেষ্ঠ গল্প – ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলন এক পাতা গল্প513 Mins Read0

    রাজা বদমাস

    জগৎসংসারে রাজার কেউ ছিল না। চোখ খুলে রাজা দেখেছে বাজার মতন একটা জায়গা। বিস্তর দোকানপাট, বিস্তর মানুষজন। চৌপর দিন কোলাহল লেগে থাকে জায়গাটায়। অদূরে রেললাইন। লাইনের কাছে গলিঘুচি মতন জায়গাটা বেশ্যাপাড়া। সন্ধের মুখেই জমে ওঠে। চলে রাত দিন প্রহর অব্দি।

    চৌদ্দপনের বছর বয়সে রাজা বেশ্যাদের সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। মদ খেতে শেখে, জুয়া খেলতে শেখে। জীবনটা শুরু হয় এইভাবে।

    জন্ম থেকে রাজার বা পাটা খাটো। রাজা হাঁটে ত্যাড়া হয়ে। ধড়খানা দশাসই। কিন্তু মুখখানা বিভৎস রাজার। ওপরের ঠোঁট কাটা। ফলে কোদালের মতো তিনটি দাঁত বেরিয়ে থাকে। কথা যায় জড়িয়ে। এই দেখিয়ে ভিখ মাগত রাজা। তাঁকে খাওয়ার পয়সাটা এসে গেলে বেশ্যাপাড়ায় ঢুকে ঘুরঘুর করত। জুয়ার আসরে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসত। খেলুড়েরা তাকে দিয়ে ফুটফরমাস খাটায়, পানটা বিড়িটা আনায়। রাতেরবেলা আনায় বাংলা মদ। এই করে হাত সাফাইয়ের কাজটা শেখে রাজা। বোর্ডে বসলে পয়সা-পাতির হিসেব দেখে না জুয়াড়িরা। তিন আনার জিনিস কিনে রাজা সিকির হিসেব দেখায়! এক বোতল বাংলা কিনে আধলিটা কমিশন পায়। কিন্তু পয়সা পাতির হিসেবে রাজা খুবই কাঁচা। গুলিয়ে ফেলে। মাথার ভেতর কী যেন একটা নেই তার।

    তবুও ব্যবসাটা রাজা ধরে ফেলে। আনিটা দোআনিটা করে আসে মন্দ না। ভর পেটে খাওয়া হয়ে যায়। জীবনে কত যে ঘোরপ্যাঁচ, কত যে গলিঘুচি! ঘোরপ্যাঁচ বুঝতে শেখে রাজা, গলিঘুচি দিয়ে চলতে শেখে। মদ মেয়েমানুষ আর জুয়া এই তিনটি জিনিস পুরোপুরি কজা করতে রাজার বয়স পঁচিশ পেরিয়ে যায়।

    বেশ্যাপাড়ার বাংলা মদের দোকান করত মাউরা তেওয়ারী। গলিঘুচির ভেতর খুপরি মতন ঘর। সামনের দিকটায় ঝাঁপ খুলে বসে থাকত তেওয়ারীর বাচ্চা ছেলেটা। হরদম। বিক্রি হত দোকানটায়। একবোতল মাল আধাবোতল পানি মিশিয়ে একটু কম রেটে বিক্রি করত বলে তেওয়ারীর দোকানে ভিড়ভাট্টা লেগেই থাকত। বাচ্চা ছেলেটা ঝটপট বোতল তুলে দিত গাহাকের হাতে, দামও নিত চটপট। দেখেশুনে তেওয়ারী ভাবল বেটা হামার কামের আছে। মালুম হয় দোকানটা ঠিকঠাক চালিয়ে নিবে। হামি দোসরা বিজিনিস দেখি।

    দোকান ঘরটার মাঝখানে বুকা বেড়ার পার্টিশান দিয়ে পেছনে জুয়ার বোর্ড বসাল তেওয়ারী। পার্টনার নিল রাজাকে। বোর্ড থেকে দেদার পয়সা আসতে লাগল তেওয়ারীর। রাজা তোলে নাল। পার বোর্ড একটা করে দোআনি।

    দিনে দিনে উন্নতি করে ফেলল রাজা। তিন মাসের মাথায় চেহারাসুরৎ গেল পালটে। পয়সাপাতি যা পায়, তিন বেলা ভরপেট খেয়েও থেকে যায় বিস্তর। হররোজ মদ খেতে লাগল।

    পাড়ার সবচে সুন্দরী ও কম-বয়সী বেশ্যা কমলারানী। রাজা যখন তখন তার ঘরে যায়। পয়সাপাতি সব উজাড় করে দেয় কমলারানীর পায়ে। দেখেশুনে তেওয়ারী গেল ঘাবড়ে। কথা ছিল নালের পয়সা রাজা যা তুলবে তার অর্ধেকটা পাবে তেওয়ারী। রাজা ওসবের ধার ধারে না। হিসেব দেয় না ঠিকঠাকমতো। সারাদিনে কটা বোর্ড হয়, কটা দোআনি ওঠে তার হিশেব কি তেওয়ারী রাখতে পারে।

    এই নিয়ে রাজার সঙ্গে একটু আধটু খিটিমিটি হয় তেওয়ারীর। রাজা যে তেওয়ারীকে কিছু দেয় না তা নয়। তো বিশ টাকা পেলে দুটাকা, এই রকম। ফলে দিনকে দিন খিটিমিটিটা বেড়ে যায় তেওয়ারীর সঙ্গে। রাজা ভাবে, আমি হালায় বইয়া বইয়া জান খারাপ কইরা পয়ছা ওঠামু, অর ভাগবি মাউরার পুতেরে দেওন লাগবে। হালায় বোড থনে ছয়ে টেকা পায় তাওবি নালের পয়ছার দিকে নজর! দিমু না! এক পয়ছা বি দিমু না। দেহি হালায় কী করে? তেওয়ারী ভাবে, ছালা বিকমাঘা জারুয়াকে হামি রাজা বানালাম। আর ও ছালা দেবে আমার উপর টেক্কা। দেকে লিব ছালাকে।

    একদিন বোর্ড বসেছে, রাজা কমলারানীর ঘরে রাত কাটিয়ে গেছে নাল তুলতে। জেব ফাক্কা, পয়সাপাতির দরকার। পয়লা বোর্ডে হাত দিয়েছে, তেওয়ারী বলল, নাল বনদ। রাজা মিয়া হামার বোর্ডে আত দিবা না। থতমত খেয়ে হাত সরিয়ে আনে রাজা। তারপর কোদালের মতো তিন দাঁত নিচের ঠোঁট কামড়ে, চোখ ট্যারা করে তেওয়ারীর দিকে তাকায়, ক্যালা?

    না নালের পয়ছা হামার লাগবে না। বদনামি হোয়।

    রাজা আর কোনও কথা না বলে ওঠে চলে আসে। তারপর একটা বিড়ি ধরিযে টানতে টানতে পুরো ব্যাপারটা খোলসা করে ভাবে। তেওয়ারী চাল করে তাকে সরিয়ে দিল। রাজা এতটা নালায়েক নয়। বোঝে সবকিছু। মনটা খারাপ হয়ে যায় রাজার। পকেটে একটা পয়সা নেই। চলবে কী করে! তাছাড়া আজকাল পাড়ায় বেশ একটা পজিশান হয়েছে রাজার। যার তার কাছে হাত যায় না, বাকিবক্কা চাওয়া যায় না। বিড়ি টানতে টানতে রাজা যায় তেওয়ারীর বেটার কাছে। গিয়ে একটা চালবাজি করে। পাঁচঠো রুপেয় দেবে বাচ্চু। ত্যারা বাপ মাঙ্গা।

    বাচ্চু জানে রাজা তার বাপের পার্টনার। টাকাটা দেয়। রাজা বেজায় খুশি হয়ে সেই সকালবেলাই একটা পাইট কেনে। পুরোটা ভেঙে খায় কমলরাণীর ঘরে বসে। তারপর টানা ঘুম দিয়ে ওঠে সন্ধেবেলা কী আবার যায় তেওয়ারীর আখড়ায়। কী করবে মাল খেতে খেতে ঠিক করে রেখেছিল রাজা।

    আখড়ায় যাওয়ার আগে বাবুয়ার দোকান থেকে বহুকাল বাদে বাকিতে এক কাপ চা খায় রাজা। সারাদিন ঘুম পেড়ে মাথাটা ভারি হয়ে আছে। চা খেয়ে আরাম হয়।

    চায়ের দোকানের সঙ্গে পানবিড়ির দোকান সোনামিয়ার। রাজা এক প্যাকেট কুম্ভিপাতার বিড়ি নিয়ে বলল, পয়সা পরে পাবি বে। সোনামিয়া হাত কচলে বলল, দিয়েন। রাজা আর কথা বলে না। বিড়ি টানতে টানতে হাঁটে। তেওয়ারীর দোকানের সামনে এসে দেখে বাছুর সঙ্গে হুজ্জতি করছে কালু। বাকিতে মাল চাইছে। এক বোতল দেওনই লাগব। নইলে হালা মাইরার বাচ্চা দোকান কর কেমনে দেইখা লমু।

    একটু একটু করে পা টলছে কালুর। মুখে পান। ঠোঁটের কষ বেয়ে চিপটি ঝরছে। মাল খেয়ে টাল হয়ে আছে শালা।

    রাজা বিড়ি টানতে টানতে কালুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কী রে কাউলা, হুজ্জত করচ ক্যালা? রাজাকে দেখেই উর্দু মেশানো ভাষায় নালিশ দেয় বাচ্চু। রাজা মনোযোগ দিয়ে শোনে, তারপর কালুকে সরিয়ে এনে বিড়ি খুঁজে দেয় ঠোঁটে। জেবে মালপানি নাই? কালু বিড়ি টানতে টানতে বলে, না বে। তারপর একটু থেমে বলে, তুমি হালায় তো মোজে আছ। নালের পয়ছা কামাও।

    শুনে রাজা হাসে। তারপর তেওয়ারীর কীর্তি খুলে বলে, মাউরার পুতে হালায় বহুত রহব দেহায়। ল ধরি হালারে। পামু ফিপটিফিপটি।

    কালুকে পাড়ায় বেশ জমা-খরচ দেয় লোকজন। রাজাকেও দেয় খানিকটা। মাথায় কি যেন একটা নেই রাজার। তবুও কালুকে হাত করে নেয় ঠিকই। মাঝরাতে গিয়ে তেওয়ারীর আখড়ায় হানা দেয় দুজনে। তেওয়ারী তো অবাক। রাজা মিয়া তুম?

    রাজা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পান চিবুচ্ছে, বিড়ি টানছে। কালুর পেট ভর্তি মাল, পা টলছে। তবুও বলল, মাল ছাড় ছালা মাউড়ার বাচ্চা। বোর্ড চলছিল। কালুর ডায়লেগ শুনে নিঃশব্দে রাজা গিয়ে তার খাটো পা টা চাপিয়ে দেয় বোর্ডের ওপর। নাল না উডাইবার দিলে বোড বনদ।

    জুয়াড়িরা ভয় পেয়ে সরে যায়। রাজার বয়সী চানমিয়া সাহস করে বলল, হুজ্জত করতাছচ ক্যালা রে।

    শুনে রাজা ঘাড় ত্যাড়া করে বলল, চোপ খানকির পোলা টেংরি লইয়া লমু।

    চানমিয়া আর কথা বলে না। দেখে তেওয়ারী সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যায়। হাত জোড় করে কালুকে বলে, দশটো রুপেয়া লিয়ে কালুজি।

    শুনে কালু খ্যাখ্যা করে হাসে। আমি কিছু জানি না, রাজারে কও।

    তেওয়ারী এসে রাজার হাতে পায়ে ধরে। রাজা মিয়া, দশ রুপেয়া লিয়ে যাও। হুজ্জত মাত কর।

    রাজা গম্ভীর গলায় বলে, নাল তুলবার দিলা না ক্যালা?

    সে হামার কসুর হয়েছে। মাফি মাংতা।

    শেষ পর্যন্ত নগদ বিশ টাকা নিয়ে ওঠে রাজা। তেওয়ারীর সঙ্গে পাকাপাকি হয়ে গেল। রাজা আর নাল তুলবে না, কিন্তু বোর্ড থেকে বিশ টাকা করে পাবে রোজ। দিনে রাতে যখন ইচ্ছে রাজা এসে টাকাটা নিয়ে যাবে।

    আখড়া থেকে বেরিয়ে দশ টাকা করে ভাগ করে নেয় দুজনে। ফিপটিফিপটি। টাকাটা কালুর হাতে দিতে রাজা টের পায় তার সাহসের কমতি নেই। যা ইচ্ছে তাই সে করতে পারে। ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে কালুকে নিয়ে যায় সে বাচ্চুর দোকানে। আবে বাচ্চু মাল দে এক বেতাল। পয়সা দিব তর বাপে।

    রাজার গলায় কী ছিল কে জানে, বাচ্চু ভয়ে ভয়ে একটা বোতল বের করে দেয়। কালুকে নিয়ে বোতলটা ভেঙে খায় রাজা।

    এইভাবে কালুর সঙ্গে তার বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়ে যায়।

    লাইনের ধারে মালগাড়ির বগি ভাঙার একটা দল ছিল। ওঠতি পোলাপান সব। বাবুয়ার চায়ের দোকানে তাদের আড্ডা বসে সন্ধ্যের পর। খবর পেয়ে একদিন কোমরে ছয় ইঞ্চি ডেগার, কালুকে নিয়ে রাজা যায় বাবুয়ার দোকানে। ছেলেগুলো সব পেছনের দিকের একটা টেবিলে বসে আছে। ফুকুর ফুকুর করে চা খাচ্ছে, কেউ বিড়ি টানছে। আশি আশি সুতোর সাদা লুঙি পরা, গায়ে হাফশার্ট কিংবা স্যান্ডো গেঞ্জি, কোমরে গামছা বাঁধা দুজনের। ফুসুর ফুসুর কথা বলছে, হাসছে। রাজা সোজা গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ায়। সাহস অনেক বেড়ে গেছে রাজার। কোমরে ডেগার আছে।

    দলের সর্দার মতন ছেলেটার নাম ব্রিটিশ। রাজা তাকে চেনে। এই মুহূর্তে চোখ মেরে কালুকেও চিনিয়ে দেয়। এই হালায় অইল লিডার। আমাগ যুদি দলে না লয় তাইলে আইজই অইয়া যাইব।

    রাজা বলল, হোন বে বিটিস, আমরা বি তগ লগে থাকবার চাই।

    শুনে ছেলেগুলো সব একত্রে রাজার দিকে তাকায়। খিটখিট করে হেসে ওঠে একজন। রাজা পাত্তা দেয় না।

    কিন্তু ব্রিটিশ চালু মাল। খাতির করে বসায় তার পাশে। কালুকে ডাকে। তারপর হাত ইশারায় কাকে কী বলে রাজা দেখতে পায় না। চা আসে দুকাপ। চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, লও চা খাও।

    রাজা চা খায় না। গম্ভীর গলায় বলে, কতাডা কানে লইছস বে?

    ব্রিটিশ হাসে। দলে তো এমনেই ম্যালা পোলাপান। তাওবি থাকবার পার। মাগার তোমার পোছাইব না।

    ওইডা আমি বুজুম। রাজা চায়ে চুমুক দেয়, বিড়ি ধরায়। ব্রিটিশ বলল, লাইনডা খারাপ অইয়া গেছে। গাড়িআলাগ দিয়া দিতে অহে হাফ। আরও বহুত গেঞ্জাম আছে। পয়ছাপাতি টেকে না। রাজা সব শুনে যায়। কথা বলে না। পুরো ব্যাপারটাই তার জানা। ড্রাইভারের সঙ্গে লাইন করা থাকে। জায়গামতো গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে যায়। বুট ঝামেলা নেই, আরামছে বগি ভাঙ্গ। মাল খারিজ কর। মহাজনদের সঙ্গেও পাকা বন্দোবস্ত। জায়গামতোট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে। মাল ভরে দিলে ক্যাশ চলে আসে হাতে। রাজা দলে ভিড়ে যায়।

    কিন্তু ভেতরে রাজার একটা চালবাজি ছিল। বগি ভাঙার দলে সে বেশিদিন থাকবে না। একদিন পুরো মাল একা সাবড়ে কেটে পড়বে। কিছু ক্যাশ চাই রাজার। থোক কিছু। টাকা পেলে কমলরাণীকে নিয়ে সে পালাবে। লাইন ছেড়ে দেবে। কমলরাণী কথা দিয়েছে, টাকা নিয়ে এলে রাজার হাত ধরে পালাবে। কথাটা গোপন রেখেছে রাজা। কালুকেও জানায়নি। মাথার ভেতর কী যেন একটা নেই। অনেক কিছুই ঠিকঠাক মেলাতে পারে না। তবুও চেষ্টাটা সে করে যায়।

    সুযোগ আসে।

    জায়গামতো গাড়ি দাঁড়িয়েছে একরাতে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ছিল। চারদিকে ঝুপসি গাছপালা, ঝোপঝাড়। কাছে পিঠে লোকবসতি নেই। লাইনের দুধারে গাছপালার জঙ্গল। তারপর ফসলের মাঠ, জলাভূমি। মালগাড়ির ইঞ্জিনের ফোঁসফোসানি ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না। দলের সামনে ছিল ব্রিটিশ। হাতে টর্চ জ্বেলে দেখিয়ে দিল কোনটা ভাঙতে হবে।

    খাটো পায়ে দলের সঙ্গে হাওয়া হয়ে যায় রাজা। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার তবুও বিশ-বাইশ মিনিটের মাথায় মাল সব খারিজ। জায়গামতো পৌঁছে যাওয়ার আগেই অন্ধকার কুঁড়ে কোত্থেকে বিশাল কিরিচ হাতে এসে দাঁড়ায় কালু। মাল যাইব না।

    কালুর সঙ্গে প্যাক্ট করা ছিল রাজার। হুঙ্কার শুনে কোমর থেকে ডেগার বের করে। রাজার মালে হাত দিলে ভুরি ঝুলাইয়া হালামু।

    শুনে পর পর দুবার টর্চ জ্বালে ব্রিটিশ। চালু মাল। ব্যাপার বুঝতে টাইম লাগে না। সঙ্গে সঙ্গে মুখে আঙুল পুরে সিটি দেয় সে। পর পর তিনবার। রাজা কিছু বুঝতে পারে না। বুঝে যায় কালু। কিরিচ ফেলে অন্ধকারে দৌড় মারে সে। আর সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে রাজাকে জাপটে ধরে। লোকটার গায়ে শুয়োরের মতো শক্তি। রাজা নড়তে পারে না। তখন আবার তিনটে সিটি দেয় ব্রিটিশ। সেই শব্দে আড়াইমণি চালের বস্তা মাথায় ঝটপট অন্ধকারে হাওয়া হয়ে যায় ছেলেগুলো। পাঁচ সাত মিনিটে বেবাক মাল লাপাত্তা। রাজার তখন গামছা দিয়ে মুখ বাঁধা হয়েছে। হাতে ডেগার ছিল, উজবুকের মতো ধরে রেখেছে। মাথায় কী একটা নেই রাজার।

    এই মুহূর্তে কী করা উচিৎ রাজা বুঝতে পারে না। ব্রিটিশরা তিনজন তাকে ঠেলে নিয়ে আসে পাড়ায়। তারপর পুলিশ ডেকে কোমরে টাকার বান্ডিল দেখিয়ে ব্রিটিশ বলল, আমারে ডেগার ঠেকাইছিল, টেকার লেইগা।

    রাজার হাতে তখন ডেগারটা ধরা। প্রমাণ। পুলিশ রাজাকে ধরে নিয়ে যায়। পাক্কা সাত বছর জেল খেটে আসে রাজা।

    .

    সে একটা দিনকাল গেছে। ফিরে এসে কোমরে ডেগার খুঁজে ঘুরছে রাজা। ব্রিটিশদের দলের কাউকে আর খুঁজে পায়নি। সাত বছরে রাজার শরীর খুব ভেঙে পড়েছিল। একটু কুঁজো হয়ে চলে রাজা। খাটো পা টা আর আগের মতো চলতে চায় না। বীভৎস মুখটা গেছে আরো বীভৎস হয়ে। জুলপির কাছে আরো পাকন ধরেছে। কমলরাণী যে কমলরাণী সেও রাজাকে চিনতে পারে না।

    এজন্য রাজার কোন দুঃখ ছিল না। সময়ে অসময়ে একটা কথা কেবল মনে হত তার, আল্লাহ তার মাথার ভেতর কী যেন একটা জিনিসের অভাব রেখে দিয়েছেন। নয়ত জীবনটা অন্যরকম হয়ে যেত রাজার।

    ইতিউতি ঘুরে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে দিল রাজা। কোন লাইন পেল না। সাত বছরে জগত সংসার ম্যালা পাল্টেছে। রাজাকে কেউ চিনতে চায় না। হতাশ হয়ে রাজা তেওয়ারীর দোকানের সামনে ঘুরঘুর করে। মাটিতে বসে থাকে। তেওয়ারী মারা গেছে বহুদিন। বাচ্চু এখন জোয়ানমর্দ পুরুষ। বাপের ব্যবসাটা ধরে রেখেছে। উন্নতি করেছে ম্যালা। রাজা বাছুর কাছে ঘুরঘুর করে বিড়িটা, সিগারেটটা চেয়ে খায়। সময়ে দুচারটি পয়সা দেয় বাচ্চু। রাজা খুশি হয়। বাছুটা বড় দয়ালু। কমলরাণীকে নিয়ে পালালে রাজারও আজ একআধটা ছেলে থাকত। আহা বাচ্চুর মতো তারও যদি একটা ছেলে থাকত!

    মাথার ভেতর চিন করে শব্দ হয় রাজার। কী যেন একটা নেই মাথায়। রাজা সব গুলিয়ে ফেলে।

    বাচ্চু এক দুপুরে ভরপেট খাইয়ে বলল, রাজাচাচা একঠো কাম কর। বাবুয়ার দোকানের সামনে ঘর লিয়ে দিই। বোতল চালাও। আমি তো একলা। দোসর কই নাই।

    রাজা একবারেই রাজি। এখন যে কোনও কাজ পেলে করে সে। বয়স হয়ে গেছে। বদমাসি আর পোষায় না। ঝুটঝামেলা আর ভালো লাগে না। শরীরে যৌবনকালের তেজটাও আর নেই। রক্ত ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছে দিনকে দিন।

    বাচ্চুর সাথে সমঝোতায় এল রাজা। থোক কিছু টাকা দিয়ে ঘরটা নিয়ে দিল বাচ্চু। ছোট খুপরি ঘর। একটা মানুষ বসতে পারে এমন একটু জায়গা দোকানমতো হল আর মাঝামাঝি বুকাবেড়ার পার্টিশন দিয়ে রাজার থাকার জায়গা। সন্ধ্যেবেলা দোকান খুলে বসে রাজা। টিমটিমে কুপি জ্বালিয়ে ভোলা চোখে গাহাকের আশায় তাকিয়ে থাকে। তো গাহাক আসে এক আধজন। রাজার উৎসাহের তখন সীমা পরিসীমা থাকে না।

    দিনেরবেলা আজার থাকতে হয়। দিনকাল বদলে গেছে। পাড়ায় আজকাল ম্যালা ঝুটঝামেলা। যখন তখন পুলিশ এসে নাস্তানাবুদ করে যায়। মাতাল পেলে ধুম প্যাদানি লাগায়। দিনের বেলা দোকান বন্ধ করে ইতিউতি ঘুরে বেড়ায় রাজা। দূর থেকে কমলরানীকে দেখে আসে। কমলরানী সেই আগের মতোই আছে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও বার বছরের রূপবান কন্যার মতো রূপ ধরে রেখেছে শরীরে।

    কিন্তু দূর থেকে দেখে বলে একটা জিনিস রাজার ঘোলা চোখ এড়িয়ে যায়। কমলরানীর চেহারায় বয়স আর ক্লান্তি এক সঙ্গে ছায়া ফেলেছে।

    রাজা ফিরে আসে।

    কিন্তু দিনের বেলায় আজার, সময় আর কাটতে চায় না রাজার। সন্ধের আশায় বসে থাকে। সন্ধ্যেবেলা দোকান খুলে বসলে রাজার আর কিছু মনে থাকে না। আজার থাকলে মাথার ভেতর কত কথা যে বিনবিন করে, কত কী যে মনে পড়ে! যৌবনকালের কথা, কমলরানীর কথা। রাজা আবার বাচ্চুর কাছে যায়। আর কিছু পয়ছাপাতি দেবে বাচ্চু। দিনে পান বিড়ি বেচুম।

    শুনে বাচ্চু খুব খুশি। টাকা দেয়। রাজা মহাউৎসাহে মদের দোকানেই পান বিড়ির দোকান লাগায়। মদ রাখে লুকিয়ে চুরিয়ে। একই জায়গায়। বাইরে থেকে দেখা যায় না। চব্বিশ ঘন্টার কারবার চলে রাজার। আস্তেধীরে উন্নতি করে ফেলে রাজা। বছর ঘুরতে না ঘুরতে লাভসহ বাচ্চুর সব টাকা শোধ। দোকানের মালিকানা পেয়ে যায় রাজা। দেখে শুনে লোকে বলে, সাবাস রাজা।

    রাজা কাটা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। দোয়া কইরেন।

    এইভাবে দিন যায়।

    সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল একদিন। সারাদিন গিয়ে সন্ধ্যের দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। রাজা জুবুথুবু হয়ে বসেছিল দোকানে। গায়ে পুরনো কালের একটা চাদর। বিক্রিবাটা ছিল না দোকানে। বাদলার দিনে কে আসে বেশ্যাপাড়ায়।

    চাদর গায়ে বিড়ি টানে রাজা। একাকী বসে থাকলে কত কী যে মনে পড়ে। যৌবনকালের কথা, কমলরাণীর কথা। আর গাঢ় অন্ধকার একটা রাতের কথা। লাইনে দাঁড়িয়ে মালগাড়িটা ফুঁসছে। ওই ছালা মালগাড়ি জিন্দেগী বরবাদ কইরা দিয়া গেল আমার।

    রাজা যখন এসব কথা ভাবছে, তখন লাট মিয়া এসে দাঁড়ায় দোকানের সামনে। দুইডা ফুল বোতল লাগা রাজা।

    গাহাক পেলে খুশির সীমা পরিসীমা থাকে না রাজার। কাটা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে। কার লাইগা বে লাট।

    কমলরাণীর গরে গাহাক বইছে।

    কয়জন?

    চাইরজন। আইজকাইলকার রংবাজ। পিচ্চিপাচ্চি পোলাপান। ঐ হালারাই তো রংবাজ আইজকাইল। জেব ভরা মাল। আমরা রংবাজি করতাম ডেগার কিরিচ লইয়া, হালারা ওইচবের ধার ধারে না। পিস্তল লইয়া আহে।

    হারা রাইতঐ থাকবনি বে?

    হ। ওই হালারা একবার আইলে তো রাইত কাবার কইরাঐ যায়।

    তারপর খ্যাখ্যা করে হাসে লাট মিয়া। ওই রাজা বুঝলি, চুতমারানিগ দেখলে আমার পোন জইলা যায়। রংবাজি করে হালারা। অগো লাহান কত পোলা তর আমার লুঙ্গিতে ছুকাইয়া গেছে। কইবার পারি না কিছু। জেব ভরা নোট, পিস্তল। কতা কইলে মাইনাস অইয়া যামু গা।

    রাজা এসব শোনে না। কেন যে মনটা ভারী হয়ে যায়। পান বিড়ির ডালার ওপাশ থেকে দুরকমের দুটো বোতল বের করে দেয়। বাচ্চুর হাতে বানানো মাল। এক বোতল মালে আধ বোতল পানি। ফেরিঅলাদের কাছ থেকে সস্তায় বোতল কিনে তাতে মাল ভরে রাখে বাচ্চু। ফলে বিভিন্ন রকমের বোতল। তো এই নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ। মালে নেশা ট্যাবলেট গুলে দেয় বাচ্চু। এক সিপে মাথা খারাপ। লোকে ভাবে জবর মাল।

    চলে যাওয়ার সময় বিড়ি চায় লাট মিয়া। দেয় রাজা। লাট মিয়ার জন্যে মায়া লাগে। কমলরানীর ভাউরা। একদিন রাজাও ছিল। লাট মিয়া লাইনটা ধরে রেখেছে। রাজা পারেনি। একটা মালগাড়ি জিন্দেগীটা বরবাদ করে দিয়ে গেছে রাজার। মদ, মাগিবাজি, জুয়া সব ছেড়ে দিয়েছে রাজা। ভালোমানুষ হয়ে গেছে।

    লাট মিয়া চলে যাওয়ার পরও মনে মনে লাট মিয়ার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যায় রাজা। একাকি বিড়বিড় করে। দিনকাল এইরকম থাকব না বে লাট। লাইন ছাইরা দে। নইলে আমার লাইন বিলা অইয়া যাবি একদিন। তারপর আবার উদাস হয়ে যায় রাজা। কমলরাণীর কথা মনে পড়ে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও কমলরাণী ঠিকঠাক চালিয়ে নিচ্ছে। ঘরে এখনও গাহাক বসায়।

    বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে রাজার। মাথার ভেতর কী যেন একটা নেই তার। জীবনের সব চালে ভুল হয়ে যায় রাজার। পরিকল্পনা তালগোল পাকিয়ে যায়। নইলে জিন্দেগী অন্যরকম হয়ে যেত রাজার। আল্লাহ তাকে সব দিয়েও কী যেন একটা জিনিসের অভাব রেখে দিলেন মাথার ভেতরে। চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর বয়সে আজকাল আজার থাকলেই রাজার এসব কথা মনে হয়। আর বুকের ভেতর যৌবনকালের হিংস্রতাটা আস্তেধীরে জেগে ওঠে। কোদালের মতো দাঁত তিনটে নিচের ঠোঁটে বসে যায়। চোয়াল যায় শক্ত। হয়ে। কে জানে কার উদ্দেশ্যে রাজা তখন গালাগাল করে। ছালা মামদার পো, দেইখা নিমু একদিন।

    আস্তে ধীরে রাত বেড়ে যায়। বাদলার রাত। লোকজন ঘর ছেড়ে বেরোয় না খুব। তবুও বেশ্যাপাড়া বলে হল্লাচিল্লার একটা শব্দ থাকেই। সেই শব্দটা এখন কমে আসছে। রাস্তার লোকজন দেখা যায় না। রাত কত হল?

    দুজন নাইটগার্ড এসে খানিক ঘুরঘুর করে। তারপর চলে যায়। রাজা দোকান খুলে। বসেই থাকে। বয়স হয়ে গেছে। ঘুম আসে না সহজে। বাইরে রাত বাড়ে। বাদলা হাওয়া নেড়ি কুত্তার মতো ঘুরে ঘুরে ফেরে। শীত করে রাজার। চাদর জড়িয়ে তবুও বসে থাকে। বিড়ি টানে। গাহাক যদি আইয়া পড়ে।

    মাল দে বে।

    বাইরে কুপির ধোয়ার মতো অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ছায়ার মতো কারা এসে দাঁড়িয়েছে। রাজার দোকানের সামনে। ঘোলা চোখ রাজার ঠিকঠাক মালুম হয় না কিছু। তবুও হাসে রাজা। কয়ডা?

    দিবার থাক না মামদার পো।

    কুপির আলোয় রাজার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় একজন। অল্পবয়েসী নালায়েক ছোঁকরা। লতাপাতা আঁকা শার্ট আর প্যান্টালুন পরা। মাথায় বাবড়ি চুল, নিচের ঠোঁট অব্দি লম্বা জুলপি।

    গালটা সেই দিয়েছে।

    শুনে রাজার বুকের ভেতরটা একটু চমকায়। যৌবনকালের হিংস্রতাটা একটুখানি নড়েচড়ে ওঠে। তবুও কথা বলে না রাজা। হাত পাতে টাকার জন্যে।

    ছেলেটা একটু টলছিল। রাজার হাত পাতা দেখে আবার গালাগাল দেয়। আগে মাল দে শুয়োরের ছানা।

    রাজা এবার ঠাণ্ডা গলায় বলল, গাইল দিও না মিয়া। রাজা কুন হালার বাপের চাকর না। ছেলেটা এবার বাদলা রাত কাঁপিয়ে ঠা ঠা করে হেসে ওঠে। সঙ্গের তিনজন এসে তখন কুপির আলোয় রাজার চোখের সামনে দাঁড়ায়। এই রকমই দেখতে। লাট মিয়া বলে গেছে, আইজকাইলকার রংবাজ।

    অন্য একটা ছেলে বলল, কিবে খানকির পো, কতা কানে লাগে না। মাল দে।

    মাথার ভেতর চিন করে শব্দ হয় রাজার। কী যেন একটা নেই সেখানে। তবুও বাঘের মতোন হুঙ্কার দিয়ে লাফ দিয়ে দোকান থেকে নামে রাজা। যৌবনকালের হিংস্রতাটা বেরিয়ে এসেছে। রাজার লগে রংবাজি করো শুয়োরের ছানারা।

    প্রথম ঘুষিটা এসে লাগল রাজার কাটা ঠোঁটটার ওপর। দেড়মণি ওজনের লোহার বলের মতো। ফলে কাটা ঠোঁটটা আরো কেটে যায় রাজার। কোদালের মতো দাঁত তিনটি আলগা হয়ে যায়। চায়ের মতো গরম রক্ত বেরয়, রাজা টের পায়। মাথাটা ঘুরে ওঠে তার। বহুকাল লাইনে নেই রাজা। সইতে পারে না, টলে যায়। তবুও হাত চালায় রাজা। কিন্তু কারো গায়ে লাগে না। সাটসাট সরে যায় ওরা। তারপর চারজন চারদিক থেকে মারে। সইতে পারে না রাজা। মাথার ভেতর দিকটা অন্ধকার হয়ে আসছে। মিহিন একটা শব্দ হয় সেখানে। চিন চিন।

    গভীর রাতে জ্ঞান পায় রাজা। মাথার অন্ধকারটা কেটে যায়। ওঠে বসে রাজা। মুখটা চনমন করছে, দাঁতের গোড়ায় গোড়ায় ব্যথা, ঠোঁট জ্বলছে। বয়সী হাড়ে জমে গেছে ব্যথা। মাটিতে পড়েছিল বলে সারা শরীরে পাক কাদার লেপটালেপটি। তবুও মাটিতে খানিকটা বসে থাকে রাজা। তারপর দোকানে ওঠে।

    পানবিড়ির ডালাটা উল্টে পড়ে আছে দোকানের ভেতর। কুপিটা ছিল বেড়ার সঙ্গে কায়দা করে বাঁধা। সেখানে বসেই জ্বলছে। রাজা দেখে তার চাদরটা পড়ে আছে পানবিড়ির ডালার সঙ্গে। মালের বোতলগুলো নেই। তিন চারটে ভেঙে কাঁচ আর মাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দোকানের ভেতর। হাওয়ায় বাংলা মদের ঝাজালো গন্ধ। শালারা সব লুটেপুটে নিয়েছে।

    রাজা মার খাওয়া বুড়ো কুত্তার মতোন দোকানে বসে থাকে। হাওয়ায় মদের গন্ধ ভাসে। সেই গন্ধে রাজার বুকের ভেতর যৌবনকালের হিংস্রতাটা আবার জাগতে থাকে। মাথার ভেতর চিনচিন করে শব্দ হয়।

    মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল রাজা। আজ কেন যে কথাটা ভুলে যায়। বুকা বেড়ার পার্টিশনের এক দিক ভোলা। সেখানে গিয়ে ভেতরে এক মানুষ শোয়ার জায়গা, রাজার ঘর। আবছা একটা ঘরের মধ্যে রাজা তার ঘরে যায়। সেখানে কিছু বোতল স্টক রাখে রাজা। বহুকাল বাদে রাজা কি আজ আবার……।

    হাতড়ে হাতড়ে বোতলগুলো বের করে রাজা। তারপর যৌবনকালের মতো একটা বোতল ভাঙ্গে। ঢকঢক করে ঢেলে দেয় গলায়। বুক জ্বলে যায় রাজার। মাথার ভেতর জমে ওঠে অন্ধকার বহুকাল বাদে। রাজা আবার লাইনে আসে। ঢকঢক মদ গেলে আর হি হি করে হাসে। তারপর খানিক কাঁদে। মাথার ভেতর কী যেন একটা নেই রাজার। মিহিন একটা শব্দ হয় সেখানে।

    রাজা তখন ডেগারটা খোঁজে। হন্যে হয়ে খোঁজে। যখন পেয়ে যায় তখন আবার হাসি। হি হি হি হি। তারপর আর একটা বোতল ভাঙে। একহাতে বোতল, একহাতে খোলা ছ ইঞ্চি ডেগার। বহুকালের পুরনো। জঙ ধরে গেছে। রাজা খেয়াল করে না। লাফ দিয়ে দোকান থেকে বেরোয়। বাদলা রাত। হু হু হাওয়া বইছে বাইরে। অন্ধকারে মানুষজনের চিহ্ন নেই। তবুও ডেগার হাতে, মদের বোতল হাতে টালমাটাল পায়ে হাঁটে রাজা। বাঘের মতো হুঙ্কার ছাড়ে। এক বাপের পয়দা অইলে সামনে আয় শুয়োরের জানা।

    কার উদ্দেশ্যে গালাগালটা দেয় রাজা, কেউ জানে না। মাথার ভেতর কী একটা নেই রাজার। অনবরত চিনচিন শব্দ হয় সেখানে। রাজা সব গুলিয়ে ফেলে। ঢকঢক মদ খায়। তারপর বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে, হুঙ্কার দিয়ে ডেগার চালায় হাওয়ায়। আয়, আয় মামদার পো। সাহস থাকলে সামনে আয়, ভুড়ি জুলাইয়া হালামু। টেংরি লইয়া লমু। কতকাল জালাইবা। রংবাজি পাইছ। রাজার লগে রংবাজি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনূরজাহান – ইমদাদুল হক মিলন
    Next Article প্রিয় – ইমদাদুল হক মিলন

    Related Articles

    ইমদাদুল হক মিলন

    ইমদাদুল হক মিলনের বিবিধ রচনা

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    অন্তরে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    এসো – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    দুই বাংলার দাম্পত্য কলহের শত কাহিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদিত

    July 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.