Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সত্যার্থ প্রকাশ – দয়ানন্দ সরস্বতী

    দয়ানন্দ সরস্বতী এক পাতা গল্প919 Mins Read0

    ০৩. ব্রহ্মচর্য্য, পঠন পাঠন ব্যবস্থা, সত্য ও অসত্য গ্রন্থসমূহের নাম এবং অধ্যয়ন অধ্যাপনার রীতি

    ব্রহ্মচর্য্য, পঠন পাঠন ব্যবস্থা, সত্য ও অসত্য গ্রন্থসমূহের নাম এবং অধ্যয়ন অধ্যাপনার রীতি

    অথ তৃতীয় সমুল্লাসারম্ভঃ
    অথাধ্যয়নাধ্যাপনবিধিং ব্যাখ্যাস্যামঃ

    অতঃপর তৃতীয় সমুল্লাসে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার নিয়ম লিখিত হইতেছে। সন্তানদিগের উত্তম বিদ্যা, শিক্ষা এবং গুণ-কর্ম স্বভাবরূপ ভূষণে বিভূষিত করা মাতা, পিতা, আচাৰ্য্য ও আত্মীয়স্বজনদের প্রধান কর্ম। স্বর্ণ, রৌপ্য, হীরা, মাণিক্য, মুক্তা এবং প্রবালাদি রত্নমণ্ডিত অলঙ্কার ধারণ করিলে মানবাত্মা কখনও সুভূষিত হইতে পারে না। কেননা, অলঙ্কার ধারণ কেবল দেহাভিমান, বিষয়াসক্তি, তস্করাদির ভয় এবং মৃত্যু পর্যন্ত হইতে পারে। সংসারে অলঙ্কার ধারণের জন্য দুর্বৃত্তদের হস্তে শিশুদের মৃত্যু ঘটিতে দেখা যায়।

    বিদ্যাবিলাসমনসো ধৃতিশীলশিক্ষা, সত্যব্রতা রহিতমান মলাপহারাঃ ॥ সংসারদুঃখদলনেন সুভূষিতা য়ে, ধন্যানরাবিহিতকর্মপরোপকারাঃ ॥ [অর্থঃ] যে সকল ব্যক্তির মন বিদ্যাবিলাসে তৎপর, যাঁহারা সুন্দর শীল ও স্বভাব সম্পন্ন, এবং সত্যাভাষণাদি নিয়ম পালনে রত, অভিমান ও অপবিত্রতা রহিত অপরের মলিনতা নাশক সত্যোপদেশ, বিদ্যাদান করিয়া সাংসারিক লোকের দুঃখ দূর করেন বলিয়া সুভূষিত; বেদবিহিত কর্মদ্বারা পরোপকারে নিরত সেইসকল নরনারী ধন্য। এই জন্য আট বৎসর বয়সেই বালকদিগকে পাঠশালায় প্রেরণ করিবে। দুরাচারী অধ্যাপক এবং দুরাচারিণী অধ্যাপিকা দ্বারা শিক্ষাদান করাইবে না; কিন্তু যাঁহারা পূর্ণ বিদ্বান ও ধার্মিক র্তাহারাই অধ্যাপনা ও শিক্ষাদানের উপযুক্ত। দ্বিজ স্বগৃহে বালকদের যজ্ঞোপবীত এবং বালিকাদের সমুচিত সংস্কার করিয়া তাহাদিগকে যথোক্ত আচাৰ্য্যকুলে, অর্থাৎ স্ব স্ব পাঠশালায় প্রেরণ করিবে।

    বিদ্যা অধ্যয়নের স্থান নিভৃত প্রদেশে হওয়া উচিত। বালক বালিকাদের পাঠশালা দুই ক্রোশ ব্যবধানে থাকা আবশ্যক। সেখানে যে সমস্ত অধ্যাপক, ভৃত্য ও অনুচর থাকিবে তাহাদের মধ্যে স্ত্রী, কন্যা-পাঠশালায় এবং পুরুষ, বালকদের পাঠশালায় থাকিবে। বালিকাদের পাঠশালায় পাঁচ বৎসরের বালক এবং বালকদের পাঠশালায় পাঁচ বৎসরের বালিকাও যাইবে না; অর্থাৎ যতদিন বালকগণ ব্রহ্মচারী এবং বালিকারা ব্রহ্মচারিণী থাকিবে, ততদিন তাহারা স্ত্রী-পুরুষ দর্শন, স্পর্শন, একান্ত সেবন, বিষয়ালাপ, পরস্পর ক্রীড়া, বিষয়চিন্তা এবং সঙ্গ এই অষ্টবিধ মৈথুন হইতে দূরে থাকিবে। অধ্যাপকগণ তাহাদের সকলকে ঐ সমস্ত হইতে রক্ষা করিবেন, তাহারা যেন উত্তম বিদ্যা, শিক্ষা, শীল স্বভাব এবং শারীরিক ও আত্মিক শক্তিসম্পন্ন হইয়া সর্বদা আনন্দবর্ধনে সমর্থ হয়। নগর অথবা গ্রাম হইতে পাঠশালা এক যোজন অর্থাৎ চারি ক্রোশ দূরে থাকিবে। রাজকুমার হউক, কিম্বা দরিদ্রের সন্তান হউক, সকলকে একরূপ বস্ত্র, খাদ্য, পানীয় ও আসন দিতে হইবে। সকলকে তপস্বী হইতে হইবে। সন্তানের মাতা ও পিতা নিজ নিজ সন্তানদের সহিত যাহাতে দেখা সাক্ষাৎ ও পরস্পর কোনপ্রকার পত্র ব্যবহার করিতে না পারে, তাহারা যেন সাংসরিকচিন্তাশূন্য হইয়া কেবল বিদ্যোন্নতিতে যত্নবান থাকে। যখন তাহারা ভ্রমণ করিতে যাইবে, তখন তাহাদের সঙ্গে অধ্যাপক থাকিবেন, তাহারা যেন কোন প্রকার কুচেষ্টা, আলস্য এবং প্রমাদ করিতে না পারে।

    কন্যানং সম্প্রদানং চ কুমারাণাং চ রক্ষণম্ ৷ মনুঃ ৭।১৫২ ॥

    ইহার অভিপ্রায় এই যে, এই বিষয়ে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় নিয়ম থাকা উচিত। পঞ্চম অথবা। অষ্টম বৎসরের পর কেহ নিজ পুত্র কন্যাদিগকে গৃহে রাখিতে পারিবে না পাঠশালায় অবশ্যই প্রেরণ করিতে হইবে অন্যথা সে দণ্ডিত হইবে। বালকের প্রথম যজ্ঞোপবীত গৃহে, দ্বিতীয় পাঠশালায় বা আচাৰ্য কুলে হইবে। মাতা, পিতা বা অধ্যাপক তাহাদের বালক-বালিকা বা বিদ্যার্থীদের অর্থ সহিত গায়ত্রী মন্ত্রের উপদেশ দিবেন। মন্ত্রটি এইরূপ–

    ওম ভূর্ভুবঃ স্বঃ। তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভর্গোদেবস্য ধীমহি। ধিয়ো গো না প্রচোদ্দয়াৎ ॥ যজু ৩৬। ৩

    এই মন্ত্রের প্রথমে যে “ওম” আছে, তাহার অর্থ প্রথম সমুল্লাসে লিখিত হইয়াছে, সে স্থলে জানিয়া লইবে। এক্ষণে তিন মহাব্যাহৃতির অর্থ সংক্ষেপে লিখিত হইতেছে। “ভূরতি বৈ প্রাণ, য়ঃ প্রাণয়তি চরা চরং জগৎ স ভূঃ স্বয়ম্ভরীশ্বরঃ” যিনি সমস্ত জগতের জীবনাধার, প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় এবং স্বয়ম্ভু উহা প্রাণবাচক বলিয়া ভূঃ পরমেশ্বরের নাম। ভূবরিত্যপানঃ’, য়ঃ সর্বংদুঃখমপানয়তি সোপানঃ। যিনি সর্বদুঃখ রহিত, যাঁহার সংসর্গে জীব সর্বদুঃখ বিমুক্ত হয়, অতএব পরমেশ্বরের নাম ভুবঃ। স্বরিতি ব্যান’–য়ো বিবিধং জগদ ব্যানয়তি ব্যারোতি স ব্যানঃ। যিনি নানাবিধ জগতে ব্যাপক হইয়া সকলকে ধারণ করেন, এই কারণে সেই পরমেশ্বরের নাম স্বঃ’। এই তিনটি বচনই তৈত্তিরীক আরণ্যকে (সবিতুঃ) য়ঃ সুনোত্যুৎপাদয়তি সর্বং জগৎ স সবিতা তস্য যিনি সমস্ত জগতের উৎপাদক এবং সবৈশ্বৰ্য্যদাতা (দেবস্য) ‘য়ো দীব্যতি দীব্যতে বা স দেবঃ — যিনি সর্ব সুখদাতা এবং সকলে যাঁহার প্রাপ্তি কামনা করে, সেই পরমাত্মা যাহা (বরেণ্য) বর্মী’ –স্বীকার করিবার যোগ্য, অতিশয় শ্রেষ্ঠ (ভর্গঃ) শুদ্ধ স্বরূপ শুদ্ধস্বরূপ, এবং পবিত্রতা সম্পাদনকারী চেতন ব্রহ্মস্বরূপ (তৎ) সেই পরমাত্মার স্বরূপকে আমরা (ধীমহি) ‘ধরেমহি’ ধারণ করি। কোন্ প্রয়োজনে? (যঃ) জগদীশ্বরঃ–যিনি সবিতা এবং দেব পরমাত্মা (নঃ) অস্মাকম’ আমাদের (ধিয়ঃ) বুদ্ধীঃ বুদ্ধি সমূহকে (প্রচোদ্দয়াৎ) ‘প্রেরয়েৎ প্রেরণা দান করেন, অর্থাৎ কু কর্ম হইতে মুক্ত করিয়া সুকর্মে প্রবৃত্ত করেন।

    “হে পরমেশ্বর! হে সচ্চিদানন্দানন্তস্বরূপ! হে নিত্য শুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব! হে কৃপানিধে! ন্যায়কারি হে অজ নিরঞ্জন নির্বিকার! হে সর্বান্তয়ামি! হে সর্বাধার জগৎপিতে সকল জগদুৎপাদক! হে অনাদে বিশ্বম্ভর সর্বব্যাপি! হে করুণামৃতবারিধে! সবিতুর্দেবস্য তব য়দোম্ভভুবঃ স্বর্বরেণ্যং ভর্গো স্তি তদ্বয়ং ধীমহি দধীমহি ধরেমহি ধ্যায়েম বা কম্মৈ প্রয়োজনায়েত্যাহ,-হে ভগব৷ য়ঃ সবিতা দেবঃ পরমেশ্বরো ভবানুস্মাকং ধিয়ঃ প্রচোদ্দয়াৎ স এবাম্মাকং পূজ্য উপাসনীয় ইষ্টদেবো ভবতু। নাতোনিং ভবলং ভবতোষ ধিকং চ কঞ্চিৎ কদাচিম্মন্যামহে”।

    হে মনুষ্যগণ। যিনি সমস্ত সমর্থকদের মধ্যে সমর্থ; সচ্চিদানন্দ অনন্তস্বরূপ, নিত্যশুদ্ধ নিত্য বুদ্ধ, নিত্য মুক্তস্বভাব যুক্ত,যিনি কৃপাসাগর, যথার্থ ন্যায়কারী, জন্ম মরণাদি ক্লেশ রহিত, নিরাকার, সর্বঘটের জ্ঞাতা, সকলের ধৰ্ত্তা, পিতা, উৎপাদক, অনাদি বিশ্ব পোষণকারী (সর্বব্যাপক), সবৈশ্বৰ্য্যশালী, জগন্নির্মাতা, শুদ্ধস্বরূপ এবং প্রাপ্তির কামনা যোগ্য, সেই পরামাত্মার যাহা শুদ্ধ চেতনস্বরূপ, আমরা তাঁকেই ধারণ করি। প্রয়োজন এই যে, সেই পরমেশ্বর আমাদের আত্মা ও বুদ্ধির অন্তর্যামি স্বরূপ, তিনি যেন আমাদের সকলকে দুষ্টাচার অধর্মযুক্ত পথ হইতে দূরে রাখিয়া শ্রেষ্ঠাচার রূপ সত্যমার্গে পরিচালিত করেন। তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য কোন বস্তুর ধ্যান। করা আমাদের উচিত নহে। কারণ তাঁহার তুল্য কেহ নাই এবং তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠও কেহ নাই। তিনিই আমাদের পিতা এবং সর্বসুখদাতা।

    এইরূপে গায়ত্রী মন্ত্রের উপদেশ প্রদান করিয়া, স্নান, আচমন এবং প্রাণায়াম প্রভৃতি সন্ধ্যোপাসনার ক্রিয়া শিক্ষা দিবে। প্রথমে স্নান এইজন্য যে, তদ্বারা শরীরের বাহ্য অবষয়গুলির শুদ্ধি এবং আরোগ্যদি লাভ হয়। এ বিষয়ে প্রমাণ —

    অদ্ভিগ্নাত্রাণি শুধ্যন্তি, মনঃ সত্যেন শুধ্যতি। বিদ্যাতপোভ্যাংভূতাত্মা, বুদ্ধিজ্ঞানেন শুধ্যতি৷ ইহা মনুর শ্লোক ॥

    জলের দ্বারা শরীরের বাহ্যাবয়বগুলি, সত্যাচরণ দ্বারা মন; বিদ্যা ও তপ অর্থাৎ সর্ব প্রকার কষ্ট সহ্য করিয়াও ধর্মানুষ্ঠান করিলে জীবাত্মা, জ্ঞান অর্থাৎ পৃথিবী হইতে পরমেশ্বরের পর্যন্ত যাবতীয় পদার্থের বিবেক দ্বারা বুদ্ধি, দৃঢ়নিশ্চয়ও পবিত্র হয়। এইজন্য আহারের পূর্বে অবশ্যই স্নান করিবে।

    দ্বিতীয় প্রাণায়াম’, এ বিষয়ে প্রমাণঃ– প্রাণায়ামাদশুদ্ধিক্ষয়ে জ্ঞানদীপ্তিরাবিবেকখ্যাতেঃ। ইহা যোগশাস্ত্রের সূত্র।

    যখন মনুষ্য প্রাণায়াম করে তখন প্রতিক্ষণে উত্তোরত্তর কালে অশুদ্ধির নাশ এবং জ্ঞানের প্রকাশ হইতে থাকে। যে পৰ্য্যন্ত মুক্তি না হয় সে পৰ্য্যন্ত আত্মার জ্ঞান নিরন্তর বৃদ্ধি পাইতে থাকে।

    দহ্যন্তে স্বায়মানানাং ধাতুনাং হিয়থামলাঃ। তথেন্দ্রিয়াণাং দহ্যন্তে দোষাঃ প্রাণস্য নিগ্রহাৎ ॥ ইহা মনুস্মৃতির শ্লোক৷

    অর্থঃ- যেরূপ অগ্নিতে তপ্ত করিলে সুবর্ণাদি ধাতুর মল নষ্ট হওয়ায় উহা শুদ্ধ হয়, সেইরূপ প্রাণায়াম করিলে মন প্রভৃতি ইন্দ্রিয় সমূহের দোষ ক্ষীণ হইয়া নির্মল হইয়া থাকে।

    প্রাণায়ামের বিধি :– প্রচ্ছদ্দনবিধারণাভ্যাং ব্য প্রাণস্য ॥ যোগ সূত্র ॥

    অত্যন্ত বেগের সহিত বমন করিলে যেরূপ অন্নজল বাহির হইয়া যায়, সেইরূপ প্রাণকে বলপূর্বক বহির্নিক্ষেপ করিয়া যথাশক্তি বাহিরেই নিরুদ্ধ করিবে। যখন বাহির করিতে ইচ্ছা করিবে, তখন মূলেন্দ্রিয়কে উর্ধদিকে আকর্ষণ করিয়া বায়ুকে বাহিরে নিক্ষেপ করিবে। যতক্ষণ মূলেন্দ্রিয়কে উর্ধদিকে আকর্ষণ করিয়া রাখিবে তত সময় পর্যন্ত প্রাণ বাহিরে থাকিবে। এইরূপে প্রাণ অধিক সময় বাহিরে থাকিতে সমর্থ হইবে। যখন অস্থিরতা বোধ হইবে, তখন ধীরে ধীরে বায়ুকে ভিতর। আনিয়া পুনরায় সামর্থ্য ও ইচ্ছানুসারে সেইরূপ করিতে থাকিবে, এবং মনে মনে ওম’ জপ। করিতে থাকিবে। এইরূপ করিলে আত্মা ও মনের পবিত্রতা ও স্থিরতা হয়। প্রথম বাহ্যবিষয়’ অর্থাৎ প্রাণকে বহুক্ষণ বাহিরেই নিরোধ করা। দ্বিতীয়–”অভ্যন্তর” অর্থাৎ প্রাণকে ভিতরে যতক্ষণ নিরোধ করা বায়, ততক্ষণ নিরোধ করা, তৃতীয়–স্তম্ভবৃত্তি’ অর্থাৎ একই সঙ্গে যে স্থানের প্রাণ সেই স্থানে যথাশক্তি রোধ করা। চতুর্থ –’বাহ্যাভ্যন্তর ক্ষেপী’ অর্থাৎ যখন প্রাণ ভিতর হইতে বহির্গত হইতে থাকিবে, তখন, তাহার বিরুদ্ধে তাহাকে বাহির হইতে না দিয়া, বাহির হইতে ভিতরে আনিবে। যখন প্রাণ বাহির হইতে ভিতরে আসিতে আরম্ভ করিবে, তখন তাহাকে ভিতর হইতে বাহিরের দিকে ধাক্কা দিয়া রোধ করিতে থাকিবে। এইরূপে একের বিরুদ্ধে অন্যের ক্রিয়া করিলে, উভয়ের গতি রুদ্ধ হওয়াতে প্রাণ নিজ বশে আসিলে মন তথা ইন্দ্রিয়ও স্বাধীন হয়। বল এবং পুরুষকার বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া বুদ্ধি তীব্র ও সূক্ষ্মরূপ হয়, যাহার ফলে অত্যন্ত কঠিন ও সূক্ষ্ম বিষয় শীঘ্র গ্রহণ করিতে সক্ষম হয়। ইহাতে মানব শরীরে বীৰ্য্যবৃদ্ধির ফলে স্থৈর্য, বল, পরাক্রম, জিতেন্দ্রিয়তা এবং অল্পকালের মধ্যেই সকল শাস্ত্র বুঝিয়া আয়ত্ত করিবার সামর্থ্য জন্মিবে। স্ত্রীলোকেরাও এইরূপ যোগাভ্যাস করিবে।

    ভোজন, পরিধান, উপবেশন, উত্থান, সম্ভাষণ এবং জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠদিগের সহিত যথোচিত ব্যবহার সম্বন্ধেও উপদেশ দিবে। সন্ধ্যোপাসনাকে ব্রহ্মযজ্ঞও বলা হয়। যে পরিমাণ জল কণ্ঠের নীচে হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে;– অধিক বা নূন নহে, সেই পরিমাণ জল করতলে লইয়া উহার মূলে ও মধ্যস্থলে ওষ্ঠ লাগাইয়া ‘আচমন’ করিবে। তাহাতে কণ্ঠস্থ কফ এবং পিত্তের কিঞ্চিৎ নিবৃত্তি হয়। তাহার পর ‘মার্জন’ করিতে অর্থাৎ মধ্যমা ও অনামিকা অঙ্গুলির অগ্রভাগ দ্বারা নেত্রাদি অঙ্গে জল ছিটাইবে। তাহাতে আলস্য দূর হয়। যদি আলস্য না থাকে এবং জল পাওয়া না যায়, তবে করিবে না। পুনরায় মন্ত্র সহিত ‘প্রাণায়াম’, মনসা পরিক্রমণ’, ‘উপস্থান’, করিয়া পরমেশ্বরের ‘স্তুতি’, ‘প্রার্থনা’ ও ‘উপাসনা’র রীতি শিক্ষা দিবে। অতঃপর ‘অঘমর্ষণ’ অর্থাৎ পাপ করিবার ইচ্ছাও কখনও করিবে না। এই সন্ধ্যোপাসনা নিভৃত স্থানে একাগ্র চিত্তে করিবে।

    অপাং সমীপেনিয়তো নৈত্যকং বিধিমাস্থিতঃ। সাবিত্রীমপ্যধীয়ীতগত্বারণ্যং সমাহিতঃ ॥ ৮ ॥ ইহা মনুস্মৃতির বচন।

    অরণ্যে, অর্থাৎ নির্জন স্থানে যাইয়া সাবধানে জলাশয় সমীপে উপবেশন পূর্বক নিত্য কর্মে ব্ৰত থাকিয়া সাবিত্রী অর্থাৎ গায়ত্রী মন্ত্রের উচ্চারণ, ও অর্থজ্ঞান এবং তদনুসারে আচরণ করিবে। কিন্তু এই জপ মনে মনে করাই উত্তম।

    দ্বিতীয় দেবযজ্ঞ — অগ্নিহোত্র এবং বিদ্বান্ ব্যক্তিদের সংসর্গ ও সেবাদি যত্ন দ্বারা হইয়া থাকে। সন্ধ্যা ও অগ্নিহোত্র সায়ং প্রাতঃ দুই বেলায় করিবে। দুই বেলা দিন রাত্রির সন্ধি বেলা, অন্য কোন সময় নহে। কমপক্ষে এক ঘন্টা কাল অবশ্যই ধ্যান করিবে। যোগিগণ যেরূপ সমাধিস্থ হইয়া পরমাত্মার ধ্যান করেন, সেইরূপ সন্ধ্যোপাসনাও করিবে। সূর্যোদয়ের পূর্বে অগ্নিহোত্র করিবার সময়। অগ্নিহোত্রের জন্য কোন ধাতু অথবা মৃত্তিকা নির্মিত বেদী (যজ্ঞকুণ্ড) এইরূপে প্রস্তুত করিবে :–বেদীর উপরিভাগ দ্বাদশ অথবা ষোড়শ অঙ্গুলি (চতুষ্কোণ) থাকিবে অর্থাৎ উপরিভাগ যে পরিমাণ প্রশস্ত হইবে, নিম্নভাগ তাহার এক চতুর্থাংশ হইবে। উহাতে চন্দন, পলাশ অথবা আম্র প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ কাষ্ঠ খণ্ড সমূহ সেই বেদীর পরিমাণে ছোট বড় করিয়া রাখিবে। তন্মধ্যে অগ্নি স্থাপন করিয়া পুনরায় উহাতে সমিধা অর্থাৎ পূর্বোক্ত ইন্ধন রাখিয়া দিবে। এইরূপ একটি প্রোক্ষণী পাত্র, এইরূপ প্রণীতা পাত্র, এবং এই প্রকারের আর একটি আজস্থালী অর্থাৎ ঘৃত রাখিবার পাত্র এবং এইরূপ চমসা–স্বর্ণ, রৌপ্য অথবা কাষ্ঠ নির্মিতও হইতে পারে। প্রণীতা ও প্রোক্ষণীতে জল থাকিবে এবং এই ভাবে আজ্যস্থালীতে অর্থাৎ ঘৃত পাত্রে ঘৃত রাখিয়া উহাকে তপ্ত করিয়া তরল করিয়া লইবে। জল রাখিবার জন্য প্রণীতা এবং প্রোক্ষণী এই জন্য যে, ইহা দ্বারা হস্ত প্রক্ষালনের জল লইবার সুবিধা হয়। তাহার পর, ঘৃতকে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিবে এবং নিম্নলিখিত মন্ত্র দ্বারা হোম করিবে —

    এইরূপ অগ্নিহোত্রের প্রতিটি মন্ত্র পাঠ করিয়া এক একটি আহুতি দিবে। যদি অধিক আহুতি দিতে হয় তাহা হইলে :

    ওম্ভূরগ্নয়ে প্রাণায় স্বাহা ৷ ভূবৰ্বায়বেপানায় স্বাহা। স্বরাদিত্যায় ব্যানায় স্বাহা। ভূভুর্বঃস্বরগ্নিবায়বাদিত্যেভঃ প্রাণাপানব্যানেভ্যঃ স্বাহা ॥

    এইরূপ অগ্নিহোত্রের প্রতিটি মন্ত্র পাঠ করিয়া এক একটি আহুতি দিবে। আর যদি অধিক। আহুতি দিতে হয় তাহা হইল : বিশ্বানি দেব সবিদূরিতানি পরাসুব। য়দ্‌ ভদ্ৰন্তন্ন আ সুব।

    এই মন্ত্রটি এবং পূর্বোক্ত গায়ত্রী মন্ত্র দ্বারা আহুতি প্রদান করিবে। ওম, ভূঃ এবং প্রাণ প্রভৃতি পরমেশ্বরের নাম। ইহাদের অর্থ পূর্বে ব্যাখ্যাত হইয়াছে। ‘স্বাহা’ শব্দের অর্থ এই যে, আত্মাতে যেরূপ জ্ঞানের উদয় হয়, জিহ্বা দ্বারা সেইরূপেই বলিবে, বিপরীত বলিবে না, পরমেশ্বর যেরূপ সকল প্রাণীর সুখের জন্য জগতে সমস্ত পদার্থ রচনা করিয়াছেন, মনুষ্যেরও সেইরূপ পরোপকার করা কর্ত্তব্য।

    প্রশ্ন– হোম করিলে কী উপকার হয়?

    উত্তর–সকলেই জানে যে, দুর্গন্ধময় বায়ু ও জল হইতে রোগ জন্মে, রোগ হইতে প্রাণীদিগের দুঃখ হয়। সুগন্ধিত বায়ু ও জল দ্বারা আরোগ্য এবং রোগনাশ হওয়ায় সুখলাভ হয়।

    প্রশ্ন –চন্দনাদি ঘর্ষণ করিয়া কাহারও দেহে লেপন করিলে, অথবা ঘৃতাদি ভক্ষণ করিতে দিলে বহু উপকার হয়। সেই ঘৃত অগ্নিতে বৃথা নিক্ষেপ করিয়া নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাৰ্য্য নহে।

    উত্তর –পদার্থবিদ্যা বিষয়ে তোমার জ্ঞান থাকিলে এরূপ কথা কখনও বলিতে না, কারণ কোনও দ্রব্যের কদাপি অভাব হয় না। দেখ, যে স্থানে হোম হয়, সেই স্থান হইতে দূরস্থ ব্যক্তি নাসিকা দ্বারা সুগন্ধ গ্রহণ করে। এইরূপে দুর্গন্ধও গ্রহণ করিয়া থাকে। ইহা দ্বারাই বুঝিয়া লও যে, অগ্নিতে অর্পিত পদার্থ সূক্ষ্মাকারে বিস্তৃত হইয়া বায়ুর সহিত দূরদেশে বিস্তৃত হইয়া দুর্গন্ধ নাশ করে।

    প্রশ্ন –যদি এইরূপই হয়, তবে কেসর, কস্তুরী, সুগন্ধ পুষ্প এবং আতর প্রভৃতি গৃহে রাখিলে বায়ু সুগন্ধময় হইয়া সুখকর হইবে।

    উত্তর –সুগন্ধিত দ্রব্যাদির এরূপ সামর্থ্য নাই যে, গৃহের বায়ুকে সে বাহির করিয়া বিশুদ্ধ বায়ু প্রবেশ করাইবে। কারণ ইহাতে ভেদক শক্তি নাই, কিন্তু ঐ বায়ু এবং দুর্গন্ধময় পদার্থকে ছিন্ন ভিন্ন এবং হাল্কা করিয়া বাহির করিবার তথা পবিত্র বায়ু প্রবেশ করাইবার সামর্থ্য অগ্নিরই আছে।

    প্রশ্ন –তবে মন্ত্রপাঠ করিয়া হোম করিবার প্রয়োজন কী?

    উত্তর –মন্ত্র সমূহে যাহা ব্যাখ্যাত আছে উহা দ্বারা হোমানুষ্ঠানের উপকারিতা জানা যায়, আবৃত্তির দ্বারা মন্ত্রগুলি কণ্ঠস্থ থাকে এবং বেদের পঠন পাঠনও রক্ষিত হয়।

    প্রশ্ন– হোম না করিলে কি পাপ হয়?

    উত্তর –অবশ্যই হয়। কেননা, মনুষ্যের শরীর হইতে যে পরিমাণ দুর্গন্ধ উৎপন্ন হইয়া জল বায়ুকে দূষণ করে এবং রোগেৎপত্তির কারণ হইয়া প্রাণীদের পক্ষে দুঃখকর হয়, সেই মনুষ্যের সেই পরিমাণ পাপও হইয়া থাকে। এইজন্য সেই পাপ নিবারণাৰ্থ সেই পরিমাণ অথবা তদপেক্ষা অধিক সুগন্ধ বায়ু ও জলের মধ্যে ছড়াইয়া দেওয়া আবশ্যক। পানাহারের দ্বারা কেবল ব্যক্তি বিশেষের সুখ হইয়া থাকে। কিন্তু একজন লোক যে পরিমাণ ঘৃত এবং সুগন্ধ পদার্থদি ভোজন। করে, সেই পরিমাণ দ্রব্যের হোম দ্বারা লক্ষ লক্ষ লোকের উপকার হইয়া থাকে। কিন্তু যদি মনুষ্য উত্তম ঘৃতাদি উত্তম বস্তু ভোজন না করে তাহা হইলে তাহাদের শারীরিক ও আত্মিক বলবৃদ্ধি হইতে পারে না। অতএব উত্তম ভোজ্য এবং পানীয় গ্রহণ করানও আবশ্যক। কিন্তু তদপেক্ষা অধিক পরিমাণে হোম করা উচিত। অতএব হোম করা অত্যাবশ্যক।

    প্রশ্ন –প্রত্যেক ব্যক্তি কত আহুতি দিবে এবং প্রত্যেক আহুতির পরিমাণ কত হওয়া উচিত?

    উত্তর –প্রত্যেক ব্যক্তি ষোলটি করিয়া আহুতি দিবে এবং প্রত্যেক আহুতির পরিমাণ ন্যূনকল্পে ছয় মাষা ঘৃতাদি হওয়া উচিত। আর যদি অধিক করা হয়, তবে অতি উত্তম। এইজন্য আৰ্য্যবর শিরোমণি মহাশয়, ঋষি, মহর্ষি, রাজা, মহারাজারা অনেক হোম করিতেন ও করাইতেন। যতদিন এই হোম দেশে প্রচলিত ছিল, ততদিন পর্যন্ত আর্যাবর্ত দেশ নীরোগ ও সুখপূর্ণ ছিল। এখনও যদি হোমের পুনঃ প্রচার হয় তাহা হইলে সেইরূপ হইবে। এই দুইটি যজ্ঞের মধ্যে (প্রথমটি) অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, সন্ধ্যোপাসনা, ঈশ্বরের স্তুতি, প্রার্থনা এবং উপাসনা –ব্রহ্মযজ্ঞ। (দ্বিতীয়) অগ্নিহোত্র হইতে অশ্বমেধ পৰ্য্যন্ত যজ্ঞ এবং বিদ্বান্ব্যক্তিদের সেবা ও সংসর্গ লাভকরা–’দেবযজ্ঞ। পরন্তু ব্রহ্মচর্য্যে কেবল ব্রহ্মযজ্ঞ এবং অগ্নিহোত্রই করিতে হইবে।

    ব্রাহ্মণস্ত্রয়াণাং বর্ণনামুপনয়নং কর্মতি। রাজন্যোদ্বয়স্য। বৈশ্যো বৈশ্যস্যৈবেতি। শূদ্রমপিকুলগুণসম্পন্নং মন্ত্রবজ্জমনুপনীতমধ্যাপয়েদিত্যেকে ॥ ইহা সুশ্রুতের সূত্রস্থানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের বচন।

    অর্থ : –ব্রাহ্মণ তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য; ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এবং বৈশ্য কেবল মাত্র বৈশ্যের যজ্ঞোপবীত দিয়া অধ্যাপনা করিতে পারে। শূদ্র কূলীন ও শুভ লক্ষণযুক্ত হইলে তাহাকে মন্ত্রসংহিতা ব্যতীত সকল শাস্ত্র পড়াইবে। অনেক আচার্যের মত এই যে, শূদ্র বিদ্যা শিক্ষা করিবে কিন্তু তাহার উপনয়ন হইবে না। এই বিধির পর পঞ্চম অথবা অষ্টমবর্ষ হইতে বালকেরা বালকদের এবং বালিকারা বালিকাদের পাঠশালায় যাইবে ও নিম্নলিখিত নিয়মানুসারে অধ্যয়ন আরম্ভ করিবে–

    ষট্‌ত্রিংশদাব্দিকং চয়ং গুরৌ ত্রৈবৈদিকং ব্ৰতম্। তদধিকং পাদিকং বা গ্রহণান্তিকমেব বা ৷ মনু ৩।১ ॥

    অর্থ :–অষ্টম বর্ষের পর ৩৬ বৎসর পর্যন্ত (ব্রহ্মচর্য্য) অর্থাৎ সাঙ্গোপাঙ্গ এক একটি বেদের অধ্যয়নে দ্বাদশ দ্বাদশ বৎসর করিয়া ৩৬ বৎসর, উহার সহিত আট যোগ দিয়া ৪৪ বৎসর; অথবা ১৮ বৎসর কাল ব্রহ্মচর্য্য, ইহার সহিত পূর্বের আট বৎসর যোগ করিয়া ২৬ বৎসর; অথবা নয় বৎসর অথবা যতকাল পর্যন্ত বিদ্যা সম্পূর্ণ আয়ত্ত না হয়, ততকাল ব্রহ্মচর্য পালন করিবে।

    পুরুষো বাব যজ্ঞস্তস্যয়ানি চতুর্বিষ্ট শতি বর্ষাণি তৎ প্রাতঃসবনং, চতুর্বিশত্যক্ষরা গায়ত্রী গায়ত্রং প্রাতঃসবনং তদস্য বসবোয় স্বায়ত্তাঃ প্রাণা বাব বসব এতে হীদওঁ সর্বংবাসয়ন্তি ॥ ১ ॥

    তৎ চেদেতস্মিন্বয়সি কিঞ্চিপতপেৎস ক্ৰয়াপ্রাণা বসব ঈদং মে প্রাতঃসবনং মাধ্যন্দিন সবনমনুসন্তনুতেতিমাহং প্রাণানাং বসুনাংমধ্যে য়জ্ঞে বিলোপসীয়েত্যুদ্ধৈব তত এত্যগদো হভবতি ॥ ২ ॥

    অথয়ানি চতুশ্চত্বারিংশদ্বর্ষাণি তন্মধ্য দিনওঁসবনং চতুশ্চত্বারিং শদক্ষরা ত্রিষ্টুপ্ ত্ৰৈষ্ঠুভং মাধ্যন্দিন সবনং তদস্য রুদ্রা অন্বায়ত্তাঃ প্রাণা বাব রুদ্রা এতে হীদ সর্বং রোদয়ন্তি ॥ ৩ ॥

    তং চেদেতস্মিন্বয়সিকিঞ্চিদুপতপেৎ স ক্ৰয়াৎ প্রাণারুদ্ৰা ইদং মে মাধ্যন্দিন সবনং তৃতীয়সবনমনুসন্তনুতেতি মাহং প্রাণানা রুদ্রাণাং মধ্যে যজ্ঞো বিলোপসীয়েZদ্ধৈব তত এত্যগদো হ ভবতি ॥ ৪ ॥

    অথয়ান্যষ্টাচত্বারিংশদ্বাণিতত্ত্বতীয়সবনমষ্টাচত্বারিশদক্ষরা জগতী জাগতং তৃতীয়সবনং তদস্যাদিত্য অন্বায়ত্তাঃ প্রাণা বাবাদিতা এতে হীদওঁ সৰ্বৰ্মদদতে ॥৫ ॥

    তং চেদেতস্মিন্বয়সি কিঞ্চিপতপেৎসক্ৰয়াৎ প্রাণা আদিত্যা ঈদং মে তৃতীয়সবনমায়ুরনুসন্তনুতেতি মাহং প্রাণানামাদিত্যানাং মধ্যে যজ্ঞো বিলোপসীয়েzদ্ধৈব তত এত্যগদো হৈব ভবতি ॥ ৬ ॥

    ইহা ছান্দোগ্যোপনিষদের বচন। ব্রহ্মচর্য্য ত্রিবিধ। কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তম। ইহাদের মধ্যে কনিষ্ঠ –যে পুরুষ অন্ন রসময় দেহ ও পুরি অর্থাৎ দেহেশয়নকারী জীবাত্মা, যজ্ঞ অর্থাৎ অত্যন্ত শুভগুণ সংযুক্ত এবং সকৰ্ত্তব্যপরায়ণ, সে ২৪ বৎসর পর্যন্ত জিতেন্দ্রিয় অর্থাৎ ব্রহ্মচারী থাকিয়া বেদাদি বিদ্যা এবং সুশিক্ষা গ্রহণ করিবে। যদি সে বিবাহ করিয়াও লম্পটের আচরণ না করে, তা হইলে তাহার শরীরে প্রাণ বলবান হইয়া সমস্ত শুভগুণের অধিষ্ঠাতা হইয়া উঠে ॥১॥

    যাহাতে সে [ব্রহ্মচারী] এই প্রথমে বয়সে নিজেকে বিদ্যাভ্যাসের তপস্যায় সন্তপ্ত রাখে, আচাৰ্য্য। সেইরূপ উপদেশ দিবেন। ব্রহ্মচারী এইরূপ নিশ্চিত ধারণা পোষণ করিবে –‘আমি যদি প্রথম

    অবস্থায় যথার্থ ব্রহ্মচারী থাকি, তবে আমার শরীর ও আত্মা সুস্থ ও বলিষ্ঠ এবং আমার প্রাণ শুভগুণ। সমূহের অধিষ্ঠাতা হইবে।’ সে বলিবে–”হে মনুষ্যগণ! তোমরা এইরূপে সকলে সুখের বিস্তার কর। যাহাতে আমি আমার ব্রহ্মচর্য ভঙ্গ না করি। যদি আমি ২৪ বৎসরের পর গৃহাশ্রম অবলম্বন করি, তবে নিশ্চয় নীরোগ থাকিব এবং আমার আয়ুও ৭০ বা ৮০ বৎসর পর্যন্ত থাকিবে’ ॥ ২ ॥

    মধ্যম ব্রহ্মচর্য –যে মনুষ্য ৪৪ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচারী থাকিয়া বেদাভ্যাস করে, তাহার প্রাণ, ইন্দ্রিয় এবং অন্তঃকরণ এবং আত্মা বলবান হইয়া দুষ্ট ব্যক্তিদের রোদন করায় এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের পালনকারী হয় ॥৩ ॥

    [ব্রহ্মচারী আচাৰ্য্যকে বলিবে] –যদি আপনার উপদেশ অনুসারে আমি এই প্রথম বয়সে। কিঞ্চিৎ তপশ্চৰ্য্যা করি, তাহা হইলে আমার রুদ্ররূপ প্রাণযুক্ত মধ্যম ব্রহ্মচর্য সিদ্ধ হইবে। [আচার্য্য ব্রহ্মচারীদিগকে বলিবে] –’হেব্রহ্মচারিগণ! তোমরা এই ব্রহ্মচর্য্যকে বৃদ্ধি কর। আমি যেমন ব্রহ্মচর্য্য ভঙ্গ না করিয়া যজ্ঞস্বরূপ হইয়া আচাৰ্য্যকুল হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছি এবং নিজেকে নীরোগ। রাখিয়াছি, সেইরূপ এইসব ব্রহ্মচারী তোমারাও শুভকর্ম করিয়া সেইরূপ করিতে থাক’ ॥ ৪ ॥

    উত্তম ব্রহ্মচর্য –৪৮ বৎসর পর্যন্ত তৃতীয় প্রকারের ব্রহ্মচর্য্য যেরূপ জগতী [ছন্দ] ৪৮ অক্ষরযুক্ত, সেইরূপ যে ৪৮ বৎসর পর্যন্ত যথাবৎ ব্রহ্মচর্য পালন করে, তাহার প্রাণ অনুকূল হইয়া। সর্বপ্রকার বিদ্যা গ্রহণ করে। ৫ ॥

    যদি আচার্য্য এবং মাতা পিতা স্বীয় সন্তানদিগকে প্রথমে বিদ্যা ও গুণ গ্রহণের জন্য তপস্বী করিয়া সেই বিষয়েই উপদেশ প্রদান করেন, তাহা হইলে সন্তানগণ স্বভাবতঃই অখণ্ডিত ব্রহ্মচর্য্য সেবন দ্বারা এবং তৃতীয় উত্তম ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া পূর্ণ অর্থাৎ চারি শত বৎসর পর্যন্ত আয়ু বৃদ্ধি। করিবে। তোমরাও সেইরূপ বৃদ্ধি কর। কারণ যে মনুষ্য এই ব্রহ্মচর্য্যকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া উহার লোপ না করে, সে সর্ববিধ রোগ রহিত হইয়া ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোঞ্চ লাভ করিয়া থাকে ॥ ৬ ॥

    চতস্রোবস্থাঃ শরীরস্য বৃদ্ধিয়ৌবনং সম্পূর্ণতা কিঞ্চিৎপরিহাণিশ্চেতি৷ আষোডশাবৃদ্ধি। আপঞ্চবিংশতেয়ৌবন। আচত্বারিংশতঃ সম্পূর্ণতা। ততঃ কিঞ্চিৎপরিহাণিশ্চেতি ॥ পঞ্চবিংশে ততো বর্ষে পূমা নারী তু ষোড়শে। সমত্বাগতবীয়ে তৌ জানীয়ৎকুশলো ভিষক ॥

    এটা সুশ্রুতের সূত্র স্থানের বচন। এই শরীরের চারিটি অবস্থা। প্রথম বৃদ্ধি ষোড়শ বর্ষ হইতে পঞ্চবিংশতি বর্ষ পর্যন্ত সকল ধাতুর বৃদ্ধি হইতে থাকে। দ্বিতীয় যৌবন–পঞ্চবিংশতি বর্ষের শেষ এবং ষড়বিংশতি বর্ষের আরম্ভে যুবাবস্থার আরম্ভ হয়। তৃতীয় সম্পূর্ণতা–পঞ্চবিংশতি বর্ষ হইতে চত্বারিংশ বর্ষ পৰ্য্যন্ত সকল ধাতুর পুষ্টি হয়। চতুর্থ কিঞ্চিৎ পরিহাণি–শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ধাতু পুষ্ট হইয়া পূর্ণতা হইবার পর যে ধাতুবৃদ্ধি হয়, তাহা শরীরে থাকে না; কিন্তু স্বপ্নে এবং ঘর্মাদি দ্বারা বাহির হইয়া যায়। সেই চত্বারিংশ বর্ষই বিবাহের উত্তম সময়। তবে অষ্টচত্বারিংশ বর্ষে বিবাহ সর্বাপেক্ষা উত্তম।

    প্রশ্ন –ব্রহ্মচর্য্যের নিয়ম কি স্ত্রী পুরুষ উভয়ের সম্বন্ধে সমান?

    উত্তর — না। যদি পুরুষ ২৫ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন করে, তবে কন্যা ১৬ বৎসর পৰ্য্যন্ত; যদি পুরুষ ৩০ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন করে, তবে স্ত্রী ১৭ বৎসর পর্যন্ত, যদি পুরুষ ৩৬ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচারী থাকে, তবে স্ত্রী ১৮ বৎসর পর্যন্ত; যদি পুরুষ ৪০ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচাৰ্য্য পালন করে, তবে স্ত্রী ২০ বৎসর পর্যন্ত; যদি পুরুষ ৪৪ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন করে, তবে ২২ বৎসর পর্যন্ত; আর যদি পুরুষ ৪৮ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন করে, তবে স্ত্রী ২৪ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালন করিবে; অর্থাৎ ৪৮ বৎসরের পর পুরুষের এবং ২৪ বৎসরের পর স্ত্রীর ব্রহ্মচর্য পালন করা উচিত নহে; কিন্তু যে সকল স্ত্রী পুরুষ বিবাহ করিতে ইচ্ছুক, তাহাদের সম্বন্ধে এই ব্যবস্থা। যাহারা বিবাহ করিতেই অনিচ্ছুক, তাহারা আমরণ ব্রহ্মচারী থাকিতে পারিলে থাকুক –ভাল কথা। কিন্তু এরূপ ব্যবস্থা পূর্ণ বিদ্বান, জিতেন্দ্রিয় ও নির্দোষ যোগী স্ত্রী-পুরুষের জন্য। কারণ কামবেগকে দমন করিয়া ইন্দ্রিয় সমূহকে আত্মবশে রাখা অতীব কঠিন কাৰ্য্য।

    ঋতং চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। সত্যং চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। তপশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। দমশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। শমশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। অগ্নয়শ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। অগ্নিহোত্রং চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। অতিথয়শ্চ স্বাধ্যয়প্রবচনে চ। মানুষং চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। প্রজা চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। প্রজনশ্চ স্বাধ্যায় প্রবচনে চ। প্রজাতিশ্চ স্বাধ্যায়প্রবচনে চ। তৈত্তিরীয় ৭। ৯

    অর্থ : ইহা পঠন পাঠনকারীদের নিয়ম –(ঋতং০) যথার্থ আচরণ সহকারে পড়িবে ও পড়াইবে। (সত্যং) সত্যাচরণ সহকারে সত্যবিদ্যা সমূহ পড়িবে ও পড়াইবে। (তপঃ) তপস্বী অর্থাৎ ধর্মানুষ্ঠান-সহকারে বেদাদি শাস্ত্র পড়িবে ও পড়াইবে (দমঃ০) অসদাচরণ হইতে বাহ্য ইন্দ্রিয় নিরুদ্ধ করিয়া পড়িবে ও পড়াইবে। (শমঃ০) মনোবৃত্তি সমূহকে সর্বপ্রকার দোষ হইতে নিবৃত্ত করিয়া পড়িবে ও পড়াইবে। (অগ্নয়ঃ০) আহবনীয়াদি অগ্নি এবং বিদ্যুৎ প্রভৃতির তত্ত্ব জানিয়া পড়িবে ও পড়াইতে থাকিবে। (অগ্নিহোত্রং০) অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান সহকারে পঠন পাঠন করিবে। (অথিতয়ঃ০) অতিথি-সেবা আচরণ সহকারে পড়িবে ও পড়াইবে। (মানুষং০) যথাযোগ্য মনুষ্যোচিত আচরণ সহকারে পড়িবে ও পড়াইবে। (প্রজাঃ০) সন্তান পালন ও রাজ্যরক্ষা সহকারে পড়িবে ও পড়াইবে। (প্রজনং০) বীর্যরক্ষা ও বীর্যবৃদ্ধি সহকারে পড়িবে ও পড়াইবে। (প্রজাতিঃ০) নিজ সন্তান ও শিষ্যদের সকলকে প্রতিপালন করিবে পড়িয়া ও পড়াইবে।

    য়মান সেবেত সততংন নিয়মা কেবলা বুধঃ। য়মা পতত্যকুর্বাণো নিয়মান্ কেবলাভজন্৷ মনু। যম পাঁচ প্রকারের। তত্রাহিংসাসত্যাস্তেয়ব্রহ্মচয়্যাপরিগ্রহায়মাঃ। যোগ০ সূত্র।

    অর্থাৎ (অহিংসা) বৈরত্যাগ; (সত্য) সত্যমানা, সত্য কথা বলা এবং সত্যানুষ্ঠান করা; (অস্তেয়) অর্থাৎ মন, বচন ও কর্মের দ্বারা চৌর্য্য ত্যাগ, (ব্রহ্মচর্য্য) অর্থাৎ উপস্থেন্দ্রিয়ের সংযম, (অপরিগ্রহ) অতি লোভ ও আত্মাভিমান না থাকা, এই পঞ্চবিধ ‘যম’ সর্বদা সেবন করিবে। কেবল নিয়ম সেবন অর্থাৎ,

    শৌচসন্তোষপঃস্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ ॥ যোগ সূত্র ৷

    (শৌচ) অর্থাৎ স্নানাদি দ্বারা পবিত্র থাকা, (সন্তোষ) সম্যক্ররূপে প্রসন্ন হইয়া নিরুদ্যম থাকা সন্তোষ নহে, কিন্তু যথাসাধ্য পুরুষকার করা এবং হানি-লাভে-শোক বা হর্ষ প্রকাশ না করা, (তপঃ) অর্থাৎ কষ্ট সহ্য করিয়াও ধর্মযুক্ত কর্মের অনুষ্ঠান করা, (স্বাধ্যায়) অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা। (ঈশ্বর প্রণিধান) ঈশ্বরের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তিতে আত্মাকে অর্পিত রাখা–এই পাঁচটি নিয়ম।

    যম ব্যতীত কেবলমাত্র নিয়ম সেবন করিবে না। কিন্তু ‘যম নিয়ম’ উভয়ই সেবন করিবে। যে। ব্যক্তি যম পরিত্যাগ করিয়া কেবল নিয়ম সেবন করে, সে উন্নতি লাভ করিতে পারে না, বরং অধোগতি অর্থাৎ সংসারে পতিত অবস্থায় থাকে–

    কামাত্মতা প্রশস্তান চৈবেস্ত্যকামতা। কাম্যো হি বেদাধিগমঃ কর্ময়োগশ্চ বৈদিকঃ ॥ । মনু ০।

    অর্থ –অত্যন্ত কামাতুরতা এবং নিষ্কামতা কাহারও পক্ষে প্রশস্ত নহে। কারণ কামনা ব্যতীত বেদজ্ঞান এবং বেদবিহিত কর্মাদি উত্তম কর্ম কাহারও দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারে না। অতএব

    স্বাধ্যয়েন ব্রতৈহোমৈস্ত্রৈবিদ্যেনেজ্যয়া সুতৈঃ। মহায়জ্ঞৈশ্চয়শ্চৈ ব্রাহ্মীয়ং ক্রিয়তে তনুঃ ॥। মনু ০।

    অর্থ –(স্বাধায়) সকল বিদ্যার পঠন পাঠন; (ব্রত) ব্রহ্মচাৰ্য্য ও সত্যভাষণাদি নিয়মপালন; (হোম); অগ্নিহোত্রাদি হোম, সত্যগ্রহণ, অসত্য বর্জন এবং সত্যবিদ্যা দান; (ত্রৈবিদ্যেন) বেদস্থ কর্ম, উপাসনা, জ্ঞান, বিদ্যাগ্রহণ; (ইজ্যায়া) পক্ষেষ্টি যজ্ঞ প্রভৃতি কর্ম; (সুতৈঃ) সুসন্তানোৎপত্তি; (মহায়জ্ঞৈ) ব্রহ্ম, দেব, পিতৃ, বৈশ্বদেব এবং অতিথিদের সেবারূপ পঞ্চমহাযজ্ঞ এবং (অজ্ঞৈঃ)। অগ্নিষ্টোমাদি, শিল্পবিদ্যা, ও বিজ্ঞানাদি যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা এই শরীরকে ব্রাহ্মী অর্থাৎ বেদ ও পরমেশ্বরের ভক্তির আধার স্বরূপ ব্রাহ্মণ-শরীর করা যায়। এই সকল সাধন ব্যতীত ব্রাহ্মণ-শরীর হইতে পারে না।

    ইন্দ্রিয়াণাংবিচরতংবিষয়েপহারিষু। সংয়মে য়ত্নমাতিষ্ঠেদ্বিদ্বান্ য়ন্তে বাজিমা। মনু ০।

    অর্থ –বিদ্বান সারথি যেরূপ অশ্ব সমূহকে নিয়মে রাখে সেইরূপ মন এবং আত্মাকে হীনকর্মে আকর্ষণকারী ও বিষয় মধ্যে বিচরণশীল ইন্দ্রিয় সমূহের নিগ্রহার্থে সর্ব প্রকার যত্ন করিবে। কারণ;

    ইন্দ্রিয়াণাং প্রসঙ্গেন দোষমৃচ্ছত্যসংশয়ম্ ॥ সংনিয়ম্য তু তান্যেব ততঃ সিদ্ধিং নিয়চ্ছতি৷। মনু ০। অর্থ –জীবাত্মা ইন্দ্রিয় সমূহের বশীভূত হইয়া নিশ্চয়ই নানা প্রকার বড় বড় দোষ প্রাপ্ত হয়। এবং যখন সে ইন্দ্রিয় সমূহকে নিজের বশীভূত করে, তখনই সিদ্ধিলাভ হয়।

    বেদাস্ত্যাগশ্চয়জ্ঞাশ্চ নিয়মাশ্চ তপাংসি চ ॥ ন বিদুষ্টভাবস্য সিদ্ধিং গচ্ছন্তি কহিঁচিৎ ॥ মনু।

    যে ব্যক্তি দুরাচারী ও অজিতেন্দ্রিয় তাহার বেদ, ত্যাগ, যজ্ঞ, নিয়ম, তপ এবং অন্যান্য সৎকর্ম কখনও সিদ্ধ হয় না;–

    বেদোপকরণে চৈব স্বাধ্যায়ে চৈব নৈত্যকে। নানুরোধোম স্ত্যনধ্যায়ে হোমমন্ত্রে চৈব হি ॥ ১। মনু। নৈত্যকে নাস্তানধ্যায়ে ব্রহ্মসংহি তৎ মৃতম্। ব্রহ্মাহুতিহুতং পূণ্যমনধ্যায়বকৃতম্ ॥ ২। মনু।

    বেদের পঠন, পাঠন, সন্ধ্যোপাসনাদি পঞ্চ মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠানে এবং হোমমন্ত্র সম্বন্ধে অধ্যায় অনুরোধ (আগ্রহ) নাই ॥১ ॥ কেননা নিত্যকর্মে অধ্যায় হয়না যেরূপ সর্বদা শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করিতে হয় কখনও বন্ধ করা যায় না, সেইরূপ প্রতিদিন নিত্যকর্ম কৰ্ত্তব্য। নিত্যকর্ম একদিনও পরিত্যাগ করিবে না। কেননা অনধ্যায়েও অনুষ্ঠিত অগ্নিহোত্রাদি উত্তম কর্ম পুণ্যকর। যেরূপ মিথ্যা বলিলে সর্বদা পাপ এবং সত্য বলিলে সর্বদা পুণ্য হয়, সেইরূপ কুকর্মে সর্বদা অনধ্যায় ও সুকর্মে সর্বদা স্বাধ্যায়ই হইয়া থাকে ॥২ ॥

    অভিবাদনশীলস্য নিত্যংবৃদ্বোপসেবিনঃ ॥ চত্বারি তস্য বর্ধন্ত আয়ুবিদ্যা যশোবলম্ ॥ ৷ মনু।

    যে সর্বদা নম্র, সুশীল এবং বৃদ্ধসেবী, তাহার আয়ু, বিদ্যা, কীৰ্ত্তি এবং বল– এই চারটি সর্বদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। আর যে ব্যক্তি এইরূপ করে না তাহার আয়ু প্রভৃতি চারিটি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না।

    অহিংসয়ৈব ভূতানাংকায়ং শ্রেয়োচনুশাসনম্ ॥ বাক্ চৈব মধুরাক্ষণা প্রয়োজ্যা ধৰ্ম্মমিচ্ছতা ॥১॥ য়স্য বাঙমনসে শুদ্ধে সম্যগুপ্তে চ সর্বদা ॥ স বৈ সর্বৰ্মবাপ্নোতি বেদান্তোপগতং ফলম্ ॥ ২ ॥ মনু

    বৈরবুদ্ধি পরিত্যাগ করিয়া সকলকে কল্যাণ মার্গের উপদেশ প্রদান করা বিদ্বান্ এবং বিদ্যার্থীদের কৰ্ত্তব্য। উপদেষ্টা সর্বদা সুশীলতা যুক্ত বাণী বলিবেন। যিনি ধর্মের উন্নতি কামনা করেন, তিনি সত্যপথে চলিবেন এবং সত্যেরই উপদেশ দিবেন ॥১ ॥ যাঁহার বাণী এবং মন শুদ্ধ ও সুরক্ষিত, তিনিই সমস্ত বেদান্ত অর্থাৎ সমগ্র বেদের সিদ্ধান্ত রূপ ফল প্রাপ্ত হন ॥ ২ ॥

    সম্মানাব্রাহ্মণো নিত্যমুদ্বিজেত বিষাদিব ॥ অমৃতস্যের চাকা দেবমানস্য সর্বদা ৷ মনু

    যিনি সর্বদা সম্মানকে বিষবৎ ভয় করেন এবং অপমানকে অমৃতবৎ কামনা করেন, সেই ব্রাহ্মণই সমগ্র বেদ এবং পরমেশ্বরকে জানিতে পারেন।

    অনেন ক্ৰময়োগেন সংস্কৃতাত্মা দ্বিজঃ শনৈঃ। গুরৌ বসন্সঞ্চিনুবাদ্ৰব্ৰহ্মাধিগামিকং তপঃ ॥মনু

    এইরূপ কৃপেনয়ন দ্বিজ ব্রহ্মচারী কুমার এবং ব্রহ্মচারিণী কন্যা ধীরে ধীরে বেদার্থজ্ঞানরূপ উত্তম তপশ্চয্যাকে বৃদ্ধি করিতে থাকিবে।

    যো নধীত্য দ্বিজো বেদমন্যত্র কুরুতে শ্রম। স জীবন্নেব শূদ্রত্বমাশু গচ্ছতি সান্বয়ঃ ॥ মনু।

    যে (দ্বিজ) বেদাধ্যয়ন না করিয়া অন্যত্র পরিশ্রম করে, সে শ্রীঘ্রই নিজ পুত্র-পৌত্রাদির সহিত শূদ্র প্রাপ্ত হয়।

    বর্জয়েম্মধুমাংসঞ্চ গন্ধং মাল্যং রসান্ স্ক্রিয়ঃ। শুক্তানিয়ানি সর্বাণি প্রাণিণাং চৈব হিংসন ॥ ১৷ অভ্যঙ্গমঞ্জং চাষ্ফোরুপানচ্ছত্রধারণম্। কামং ক্রোধং চ লোভং চ নৰ্ত্তনং গীতবাদন ॥ ২॥ দূতং চ জনবাদং চ পরিবাদং তথানৃিতম্। স্ত্রীণাং চ প্রেক্ষণালম্ভমুপঘাতং পরস্য চ ॥ ৩ ॥ একঃ শয়ীত সর্বত্র ন রেতঃ স্কন্দয়েত্ত্বচিৎ। কামাদ্ধি স্কন্দয় রেতো হিনস্তি ব্রতমাত্মনঃ ॥ ৪ ॥ মনু।

    ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মচারিণী মদ্য, মাংস, মাল্য, রস, স্ত্রী-পুরুষ সংসর্গ সর্বপ্রকার অশ্ল, প্রাণি হিংসা ॥ ১ ॥

    অঙ্গ-মর্দন, অকারণ উপস্থেন্দ্রিয় স্পর্শ, নেত্রাঞ্জন, জুতা-ছত্র ধারণ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ভয়, শোক ঈর্ষা, দ্বেষ ও নৃত্য, গীত, বাদ্য বাদন ॥ ২ ॥

    দ্যুত, পরচর্চা, নিন্দা, মিথ্যাভাষণ,স্ত্রী দর্শন, পরনির্ভরশীলতা এবং পরের অপকার ইত্যাদি কুকর্ম সর্বদা পরিত্যাগ করিবে ॥ ৩ ॥

    সর্বত্র একাকী শয়ন করিবে, কখনও বীর্য স্থলন করিবে না। যদি কামনা বশতঃ কেহ বীৰ্য্য স্থলন করে, সে তাহার নিজের ব্রহ্মচর্য ব্রত নাশ করিয়াছে জানিবে ॥ ৪ ॥

    বেদমনুচ্যাচায়োন্তেবাসিনামনুশাস্তি। সত্যং বদ। ধর্মং চর। স্বাধ্যায়াম্মা প্রমদঃ। আচাৰ্য্যায় প্রিয়ং ধনমান্ধত্য প্রজাতন্তুং ব্যবচ্ছেদসীঃ। সত্যান্ন প্রমদিতব্য। ধর্মান্ন প্রমদিতব্য৷ কুশলান্ন প্রমদিতব্য। স্বাধ্যায়প্রবচনাভ্যাংন প্রমদিব্যম্ ॥ ১ দেবপিতৃকায়্যাভ্যাংন প্রমদিতব্য। মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব। আচার্য্যদের ভব। অতিথিদেবো ভব। য়াননবদ্যানি কমাণিতানি সেবিতব্যানি নোইতরাণি।য়ান্যস্মাকওঁ সুচরিতানিতানি ত্বয়োপাস্যানি নোইতরাণি ॥ ৷২৷ য়ে কেচাস্মচ্ছেয়াংসো ব্রাহ্মণাস্তেষাং ত্বয়াসনেন প্রশ্বসিতব্য। শ্রদ্ধয়া দেয়ম, অশ্রদ্ধয়া দেয়ম। শ্রিয়া দেয়। হ্রিয়া দেয়৷ ভিয়া দেয়। সংবিদা দেয়। অথ যদি তে কর্মবিচিকিৎসা বা বৃত্তবিচিকিৎসা বা স্যাৎ ॥ ৩ ॥ য়ে তত্র ব্রাহ্মণাঃ সম্মুর্শিনে য়ুক্তা অয়ুক্তা অক্ষা ধর্মকামাঃ সূয়থা তে তত্র বৰ্ত্তের। তথা তত্র বৰ্তেথাঃ। এষ আদেশঃ এব উপদেশঃ এষা বেদোপনিষৎ। এতদনুশাসন। এবমুপাসিতব্য। এবমুচৈতদুপাস্যম, ॥ ৪৷ তৈত্তিরীয় (প্রপাঃ১ অনুঃ ১১ কং ১/২/৩৪)

    আচাৰ্য্য অন্তেবাসী অর্থাৎ নিজ শিষ্য ও শিষ্যদিগকে এইরূপ উপদেশ দিবেন –তুমি সর্বদা। সত্য বলিবে, ধৰ্মৰ্চারণ করিবে, পূর্ণ ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা সমস্ত বিদ্যাগ্রহণ করিবে এবং আচাৰ্য্যকে প্রিয়ধন প্রদান পূর্বক বিবাহ করিয়া সন্তানোৎপত্তি করিবে। প্রমাদ বশতঃ কখনও সত্য পরিত্যাগ করিও না। প্রমাদ বশতঃ কখনও ধর্ম পরিত্যাগ করিও না। প্রমাদ বশতঃ আরোগ্য ও নিপুণতা হারাইও না প্রমাদ বশতঃ কখনও পঠন-পাঠন পরিত্যাগ করিও না। যেরূপ বিদ্বান ব্যক্তিদের সম্মান করিবে, সেইরূপ মাতা, পিতা আচার্য্য এবং অতিথিদেরও সর্বদা সেবা করিতে থাকিবে। ইহা ছাড়া মিথ্যা ভাষণদি কখনও করিবেনা। আমাদের সুচরিত্র অর্থাৎ ধর্মযুক্ত কর্ম গ্রহণ করিবে এবং আমাদের পাপাঁচরণ কখনও গ্রহণ করিবে না। আমাদের মধ্যে যাঁহারা উত্তম বিদ্বান ও ধর্মাত্মা ব্রাহ্মণ, তাহাদেরই সমীপে উপবেশন করিবে এবং তাহাদের সকলকে বিশ্বাস করিবে। শ্রদ্ধার সহিত দান করিবে। অশ্রদ্ধার সহিত দান করিবে। শোভনতার সহিত দান করিবে। লজ্জার সহিত দান করিবে। ভয়ের সহিত দান করিবে। প্রতিজ্ঞা বশতঃ দান করিবে। কর্মশীল, উপাসনা ও জ্ঞান সম্বন্ধে কখনও কখনও সংশয় উপস্থিত হইলে বিচারশীল, পক্ষপাতশূণ্য, যোগী অথবা অযোগী কোমল চিত্ত ধর্মাভিলাষী এবং ধৰ্ম্মাত্মাগণ যে যে ধর্মপথে থাকেন তুমিও সেই পথে থাকিবে। ইহাই আদেশ, ইহাই আজ্ঞা, ইহাই উপদেশ, ইহাই বেদোপনিষদ্ এবং ইহাই শিক্ষা। এইরূপ আচরণ করা এবং স্বীয় আচরণকে সংশোধিত করা কর্তব্য।

    অকামস্য ক্রিয়া কাচিদ নেহ কৰ্হিচিৎ। যদ্যদ্ধি কুরুতে কিঞ্চিৎ তত্তৎকামস্য চেষ্টিতম্‌ ৷ মনু

    মনুষ্যের নিশ্চয় জানা আবশ্যক যে, নিষ্কাম ব্যক্তির নেত্রের সংকোচ ও বিকাশ হওয়াও সর্বথা অসম্ভব। অতএব সিদ্ধ হইতেছে যে, যাহা যাহা করা হয় সে সব কর্ম কামনা ছাড়া নহে।

    আচারঃ পরমা ধর্মঃ শ্রুত্যক্তঃ স্মাৰ্ত্ত এব চ ॥ তস্মাদস্মিন্ সদা য়ুক্তো নিত্যং স্যাদাত্মবান্ দ্বিজঃ ॥১॥ আচারদ্বিচ্যুতে বিপ্রো ন বেদলমশ্নুতে। আচারণে তু সংয়ুক্ত সম্পূর্ণফলভা ভবেৎ ॥ ২ ॥ মনু

    বেদ কথন, শ্রবণ, শ্রাবণ, পঠন এবং পাঠনের ফল ইহাই যে, বেদ ও বেদানুকুল স্মৃতি প্রতিপাদিত ধর্মাচরণ করিবে। সুতরাং ধর্মাচরণে সর্বদা রত থাকিবে। ১ ॥ কেননা যে ধর্মচারণ রহিত, সে বেদপ্রতিপাদিত ধর্ম হইতে উদ্ভূত সুখরূপ ফল লাভ করিতে পারে না। যে ব্যক্তি বিদ্যাধ্যয়নে রত থাকিয়া ধর্মাচরণ করে, সে ব্যক্তি সুখ লাভ করে। ২ ॥

    য়ো বমন্যেত তেমূলে হেতুশাস্ত্রশ্রয়াদ দ্বিজঃ। স সাধুভির্বহিষ্কায়ো নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ ॥মনু।

    যে বেদ, বেদানুকুল ও আপ্ত-পুরুষ রচিত শাস্ত্র সমূহের অবমাননা করে, সেই বেদনিন্দক নাস্তিককে সমাজ, পতি এবং দেশ হইতে বহিষ্কার করা উচিত। কারণ —

    শ্রুতিঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ ।
    এতচ্চতুর্বিধং প্ৰাহুঃ সাক্ষাৎ ধর্মস্য লক্ষণ ॥ মনুঃ

    শ্রুতিঃ = বেদ, স্মৃতি, বেদানুকূল আপ্তোক্ত মনুস্মৃতি প্রভৃতি শাস্ত্র, সৎপুরুষদের আচার, অর্থাৎ যাহা সনাতন বা বেদ দ্বারা পরমেশ্বর প্রতিপাদক কর্ম, এবং নিজ আত্মার প্রিয় কর্ম অর্থাৎ যাহা আত্মার বাঞ্ছিত, যথা সত্য ভাষণ,- এই চারটি ধর্মের লক্ষণ;অর্থাৎ এতদ্বারাই ধর্মাধর্মের নির্ণয় হইয়া থাকে। পক্ষপাত রহিত ন্যায়, সত্যের গ্রহণ ও সর্বথা অসত্যের বর্জনরূপ আচরণ উহারই নাম ধর্ম এবং ইহার বিপরীত, পক্ষপাতযুক্ত অন্যায় আচরণ, সত্যবর্জন এবং অসত্য গ্রহণরূপ যে কর্ম উহাকে “অধর্ম’ বলে।

    অর্থকামেম্বসত্তানাং ধর্মজ্ঞানং বিধীয়তে। ধর্মং জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতি ॥ মনু

    যে ব্যক্তি (অর্থ) সুবর্ণাদি রত্ন এবং (কাম) স্ত্রীসংসর্গাদিতে আবদ্ধ হন না, তাঁহারই ধর্মজ্ঞান লাভ হয়। যিনি ধর্মজ্ঞান লাভ করিতে ইচ্ছা করেন, তিনি বেদদ্বারা ধর্ম নির্ণয় করিবেন। কেননা বেদ ব্যতীত ধর্মাধর্মের নির্ণয় যথাযথভাবে হয় না।

    আচাৰ্য্য নিজ শিষ্যকে এইরূপ উপদেশ দিবেন এবং বিশেষ করিয়া রাজা অন্যান্য ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রদের সকলকেও বিদ্যাভ্যাস অবশ্য করাইবেন। কেননা, ব্রাহ্মণ যদি কেবল বিদ্যাভ্যাস করে, আর ক্ষত্রিয়াদি না করে, তাহা হইলে বিদ্যা, ধর্ম, রাজ্য এবং ধনাদির বৃদ্ধি কখনও হইতে পারে না। কেননা, ব্রাহ্মণ তো কেবল অধ্যয়ণ ও অধ্যাপনার দ্বারা ক্ষত্রিয়াদির নিকট হইতে জীবিকার্জন করিয়া জীবন ধারণ করিতে পারে। কিন্তু জীবিকার অধীন, এবং ক্ষত্রিয়াদির আজ্ঞাদাতা, ও যথাবৎ পরীক্ষক এবং দণ্ডদাতা না থাকিলে ব্রাহ্মণাদি সকল বর্ণ ভণ্ডামিতে জড়াইয়া পড়িবে আর ক্ষত্রিয়াদি বিদ্বান্ হইলে ব্রাহ্মণগণও অধিক বিদ্যাভ্যাস করিবে এবং ধর্মপথে চলিবে। তাহারা বিদ্বান্ ক্ষত্রিয়াদির সম্মুখে ভণ্ডামি ও মিথ্যা ব্যবহার করিতে পারিবে না।

    যখন ক্ষত্রিয়াদি বিদ্যাহীন হয় তখন তাহাদের মনে যাহা ইচ্ছা হয় তাহাই করে ও করাইয়া থাকে। অতএব যদি ব্রাহ্মণগণ নিজ কল্যাণ কামনা করেন, তবে ক্ষত্রিয়াদিকে বেদাদি সত্যাশাস্ত্রের অভ্যাস অধিক যত্নের সহিত করাইবেন। কারণ ক্ষত্রিয় প্রভৃতিই বিদ্যা, ধর্ম, রাজ্য এবং লক্ষ্মীর বৃদ্ধিকারী, তাহারা কখনও ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেন না, সুতরাং বিদ্যা-ব্যবহার বিষয়ে ইহারা পক্ষপাতও করিতে পারেন না। যখন সকল বর্ণের মধ্যে বিদ্যা ও সুশিক্ষার প্রচলন থাকে তখন। কেহই ভণ্ডামিরূপ অধর্মযুক্ত মিথ্যা ব্যবহারের প্রচলন করিতে পারে না। ইহার দ্বারা প্রমাণিত হইল যে ক্ষত্রিয়বর্গকে নিয়মানুসারে পরিচালন করিবেন ব্রাহ্মণ ও সন্ন্যাসী, আর ব্রাহ্মণ ও সন্ন্যাসীদিগকে সুনিয়মে পরিচালন করিবেন ক্ষত্রিয়াদি। এই জন্য সকল বর্ণের নরনারীদের মধ্যে বিদ্যা ও ধর্মের প্রচার হওয়া আবশ্যক।

    এবার যে যে বিষয় পড়িবে পড়াইবে উহা উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া পড়ান উচিত। পরীক্ষা পাঁচ প্রকারের যথা–

    প্রথম — যাহা ঈশ্বরের গুণ-কৰ্মস্বভাব ও বেদের অনুকূল, সেই সবই সত্য, এবং যাহা উহাদের বিপরীত তাহা অসত্য।

    দ্বিতীয় –যাহা যাহা সৃষ্টি ক্রমের অনুকূল, সেই সবই সত্য, এবং যাহা সৃষ্টিক্রমের বিরুদ্ধ সেই সবই অসত্য। যথা –যদি কেহ বলে যে, মাতা পিতার সংযোগ ব্যতীত সন্তান জন্মিয়াছে, এরূপ উক্তি সৃষ্টিক্রমের বিরুদ্ধ বলিয়া সর্বথা অসত্য।

    তৃতীয় –“আপ্ত”অর্থাৎ যাহা ধার্মিক, বিদ্বান, সত্যবাদী এবং অকপট ব্যক্তিদিগের আচরণ ও উপদেশের অনুকূল, সেই সব ‘গ্রাহ্য এবং যাহা যাহা তদ্বিরুদ্ধ উহাদের সব ‘অগ্রাহ্য।

    চতুর্থ –যাহা নিজ আত্মার পবিত্রতা বিদ্যার অনুকূল, অর্থাৎ যেরূপ নিজের সুখ প্রিয় এবং দুঃখ অপ্রিয়, সেইরূপ সর্বত্র বুঝিতে হইবে, যদি আমি কাহাকেও দুঃখ বা সুখ দিই তাহারও দুঃখ বা সুখ হইবে।

    পঞ্চম –আট প্রমাণ যথা :–প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দ, ঐতিহ্য, অর্থাপত্তি, সম্ভব এবং অভাব।

    তন্মধ্যে (প্রথম) প্রত্যক্ষ প্রভৃতির লক্ষণ যে সব সূত্র নিম্নে লিখিত হইবে, সে সব ন্যায়শাস্ত্রের প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের অন্তর্গত জানিবে।

    ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষোৎপন্নং জ্ঞানমব্যপদেশ্যামব্যভিচারিব্যবসায়াত্মকং প্রত্যক্ষম ॥

    ন্যায় সু ॥ অ০১। আহ্নিক ১। সূত্র ৪ ॥

    শ্রোত্র, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা এবং ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধের সহিত অব্যবহিত অর্থাৎ আবরণ রহিত সম্বন্ধ থাকে। এইসব ইন্দ্রিয়ের সহিত মনের এবং মনের সহিত আত্মার সংযোগ বশতঃ যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাহাকে প্রত্যক্ষ বলে। কিন্তু যাহা ব্যপদেশ্য অর্থাৎ সংজ্ঞা-সংজ্ঞীর সম্বন্ধ হইতে উৎপন্ন হয়, সে সমস্ত জ্ঞান নহে। অর্থাৎ যদি কেহ কাহাকেও বলে ‘তুমি জল আনয়ন কর’। সে জল আনিয়া নিকটে রাখিয়া বলিল, “এই জল। কিন্তু সে স্থলে ‘জল’ এই দুই অক্ষরের সংজ্ঞাকে জল আনয়নকারী এবং জল আনয়নের আজ্ঞাদাতা দেখিতে পায় না। কিন্তু যে পদার্থের নাম জল, তাহাই প্রত্যক্ষ হয়। আর শব্দ হইতে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহা শব্দ প্রমাণের বিষয়। অব্যভিচারী’–যেমন কেহ রাত্রিকাল স্তম্ভ দেখিয়া উহাকে পুরুষ বলিয়া স্থির করিল। যখন সে উহা দিবাভাগে দেখিল, তখন রাত্রির পুরুষ-জ্ঞান নষ্ট হইয়া স্তম্ভ জ্ঞান হইল। এইরূপ বিনাশী জ্ঞানের নাম ব্যভিচারী, (ইহাকে প্রত্যক্ষ বলে )। ব্যবসায়াত্মক’–কেহ দূর হইতে নদীর বালুকা দেখিয়া বলিল, ঐ স্থানে বস্ত্র শুকাইতেছে, অথবা জল? বা অন্য কিছু আছে ॥ ‘দেবদত্ত দাঁড়াইয়া আছে? অথবা যজ্ঞদত্ত’? যতক্ষণ একটা নির্ণয় না হয়, ততক্ষণ উহা প্রত্যক্ষ জ্ঞান। নহে। কিন্তু যে জ্ঞান অব্যপদেশ্য, অব্যভিচারী এবং নিশ্চয়ত্মক, তাহাকেই ‘প্রত্যক্ষ বলে।

    দ্বিতীয় অনুমান –অথ তৎপূর্বকং ত্রিবিধমনুমানং পূর্ববচ্ছেৎসামান্যতোদৃষ্টঞ্চ। ন্যায় অ০ ॥ আ০১। সু ৫ ॥

    যাহা প্রত্যক্ষ পূর্বক অর্থাৎ যাহার কোন এক দেশ অথবা সম্পূর্ণ দ্রব্যটি কোন স্থানে বা কালে প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে, উহা দূর দেশ হইতে সহচারী এক দেশের প্রত্যক্ষ হওয়ায় অদৃষ্ট অবয়বীর জ্ঞান হওয়াকে অনুমান বলে; যেমন–পুত্রকে দেখিয়া পিতার, পর্বতাদিতে ধূম দেখিয়া অগ্নির এবং জগতের সুখ-দুঃখ দেখিয়া পূর্বজন্মের জ্ঞান হইয়া থাকে। এই অনুমান তিন প্রকারের যথা –প্রথম ‘পূর্ববৎ’ যেমন মেঘ দেখিয়া বর্ষার, বিবাহ দেখিয়া সন্তানোৎপত্তির, পাঠ রত বিদ্যার্থীদিগের দেখিয়া বিদ্যা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা হয়। এইরূপ যে সকল স্থানে কারণ দেখিয়া কাৰ্য্যের জ্ঞান হয় তাহা ‘পূর্ববৎ’। দ্বিতীয়–’শেষবৎ’অর্থাৎ যে স্থলে কাৰ্য্য দেখিয়া কারণের জ্ঞান হয়, যেমন নদী প্রবাহের বৃদ্ধি দেখিয়া উপরে (পর্বতোপরি) বৃষ্টি-বর্ষণের, পুত্রকে দেখিয়া পিতার, সৃষ্টিকে দেখিয়া অনাদি কারণের ও কৰ্ত্তা ঈশ্বরের এবং পাপ ও পুণ্যের আচরণ দেখিয়া সুখ ও দুঃখের জ্ঞান হয়। ইহাকে ‘শেষবৎ’ বলে। তৃতীয় সামান্যতোদৃষ্ট’ যাহা কাহারও কাৰ্য্য বা কারণ নহে, কিন্তু পরস্পরের মধ্যে কোনরূপ সাধ্য থাকে, যেমন কোন ব্যক্তির গমন না করিয়া অন্য স্থানে যাইতে না পারা, সেইরূপ অন্যেরও গমন ব্যতীত স্থানান্তরে যাওয়া অসম্ভব। অনুমান শব্দের অর্থ এই যে, অনু অর্থাৎ প্রত্যক্ষস্য পশ্চান্মীয়তে জ্ঞায়তে য়েন তদনুমান যাহা প্রত্যক্ষের পরে উৎপন্ন, যথা ধূমের প্রত্যক্ষ দর্শন ব্যতীত অদৃষ্ট অগ্নির জ্ঞান কখনও হইতে পারে না।

    তৃতীয় উপমান– প্রসিদ্ধসাধমাৎসাধ্যসাধনমুপান৷ ন্যায়, অ০১। আ০১। সু০ ৬ ॥

    যাহা প্রসিদ্ধ প্রত্যক্ষ ‘সাধ’ দ্বারা সাধ্যের অর্থাৎ সিদ্ধ করিবার যোগ্য জ্ঞানের সিদ্ধির সাধন তাহাকে উপমান’ বলে। উপমীয়তে য়েন তদুপমানম। যথা; কেহ কোন ভৃত্যকে বলিল, ‘তুমি দেবদত্ত সদৃশ বিষ্ণুমিত্রকে ডাকিয়া আনো। সে বলিল, “আমি তাহাকে কখনও দেখি নাই’, তাহার প্রভু বলিল- যেমন এই দেবদত্ত তেমনই সেই বিষ্ণুমিত্র, অথবা যেমন এই গাভী তেমনই গবয় অর্থাৎ নীল গরু। যখন ভৃত্য সেস্থানে গেল এবং দেবদত্তের সদৃশ তাহাকে দেখিয়া নিশ্চয় করিল যে, এই ব্যক্তিই বিষ্ণুমিত্র, এবং তাহাকে সে লইয়া আসিল। অথবা কোন বনে যে পশুকে গো সদৃশ দেখিল, তাহারই নাম গবয় বলিয়া সে স্থির করিয়া লইল।

    চতুর্থ শব্দ প্রমাণ–
    আপ্তোপদেশঃ শব্দঃ ॥ ন্যায় অ০ ॥ আ০১। আ ০২। সু০৭ ॥

    যিনি আপ্ত অর্থাৎ পূর্ণ বিদ্বান, ধম্মাত্মা, পরোপকারপ্রিয়, সত্যবাদী, পুরুষকার সম্পন্ন এবং জিতেন্দ্রিয়, তিনি নিজ আত্মায় যাহা জানেন এবং যদ্বারা সুখ পাইয়া থাকেন তাহাই প্রকাশ করার ইচ্ছা দ্বারা প্রেরণা পাইয়া সকলের কল্যাণার্থে উপদেষ্টা হইয়া থাকেন, অর্থাৎ যিনি পৃথিবী হইতে পরমেশ্বর পর্যন্ত যাবতীয় পদার্থের জ্ঞানলাভ করিয়া উপদেষ্টা হইয়া থাকেন, এইরূপ পুরুষের উপদেশকে এবং পূর্ণ আপ্ত পরমেশ্বরের উপদেশস্বরূপ বেদকে শব্দপ্রমাণ’ বলিয়া জানিবে।

    পঞ্চম ঐতিহ্য –

    ন চতুষ্টমৈতিহার্থাপত্তিসম্ভবাভাবপ্রামাণ্যাৎ। ন্যায় অ০ ২। আ০ ২। সু ০১ ॥

    যাহা ইতি হ অর্থাৎ এইরূপ ছিল, সে এইরূপ করিয়াছিল অর্থাৎ কাহারও জীবন চরিত্রের নাম ‘ঐতিহ্য’।

    ষষ্ঠ অর্থাপত্তি–

    অর্থাদাপদ্যতে সা অর্থাপত্তিঃ কোচিদুচ্যতে-সৎসুঘনেযু বৃষ্টিঃ, সতিকারণে কায়ংভবতীতি কিমত্র প্রসজ্যতে। অসৎসু ঘনেষু বৃষ্টিরসতি কারণে(চ)–কার্য্যং ন ভবতি। যেমন, কেহ কাহাকেও বলিল, “মেঘ হইলে বৃষ্টি এবং কারণ থাকিলে কাৰ্য্য উৎপন্ন হয়। এস্থলে, না বলা সত্ত্বেও, অন্য একটি কথা সিদ্ধ হইল যে, মেঘ ব্যতীত বৃষ্টি এবং কারণ ব্যতীত কাৰ্য্য কখনও হইতে পারে না।

    সপ্তম সম্ভব–

    সম্ভবতিয়স্মিন্ স সম্ভবঃ। যদি কেহ বলে মাতাপিতা ব্যতীত সন্তানোৎপত্তি হইয়াছে, কেহ মৃতকে পুনর্জীবিত করিয়াছে, পর্বত উত্তোলন করিয়াছে, সমুদ্রে প্রস্তর ভাসাইয়াছে, চন্দ্রকে খণ্ড খণ্ড করিয়াছে, পরমেশ্বরের অবতার হইয়াছে, মনুষ্যের শিঙ দেখিয়াছে এই সব কথা সৃষ্টিক্রমের বিরুদ্ধ। যাহা সৃষ্টিক্রমের অনুকূল তাহাই সম্ভব।

    অষ্টম অভাব—’ন ভবতি য়স্মিন্ সো ভাবঃ’। যেমন কেহ কাহাকেও বলিল, ‘হস্তী আনয়ন কর’। সে সেস্থানে হস্তীর অভাব দেখিয়া যে স্থানে হস্তী ছিল, সে স্থান হইতে তাহা আনয়ন করিল।

    এই আটটি প্রমাণ। তন্মধ্যে ঐতিহ্যকে শব্দ প্রমাণের অন্তর্গত এবং অর্থাপত্তি, সম্ভব ও অভাবকে অনুমানের অন্তর্গত গণনা করিলে চারিটি প্রমাণ থাকিয়া যায়। পূর্বোক্ত পঞ্চবিধ পরীক্ষা দ্বারা। মনুষ্য সত্যাসত্য নির্ণয় করিতে পারে, অন্যথা নহে।

    ধর্মবিশেষ প্রসূতাদূদ্রব্যগুণকর্মসামান্য বিশেষ সমবায়ানাংপদার্থানাং তত্ত্বজ্ঞনান্নিঃ-শ্রেয়সম্ ॥ বৈশেষিক অ০ ১।১।৪ ॥

    যখন মনুষ্যের যথাযোগ্য ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা পবিত্র হইয়া ‘সাধ’ অর্থাৎ যাহা তুল্যধর্ম বিশিষ্ট যেমন পৃথিবী জড়, তদ্রপ জল ও জড়; বৈধৰ্ম অর্থাৎ পৃথিবী কঠিন, কিন্তু জল তরল, এইরূপে দ্রব্য গুণ, কর্ম সামান্য বিশেষ এবং সমবায় এই ছয় পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান বা স্বরূপ হয় তখন উহা দ্বারা ‘নিঃশ্রেয়সম্’ মোক্ষপ্রাপ্তি হইয়া থাকে।

    পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরাকাশংকালো দিগাত্মা মন ইতি দ্রব্যাণি ৷ বৈশ০ অ০ ১। আ০ ১। সু০ ৫৷

    পৃথিবী, জল,তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মা এবং মন–এই নয়টি ‘দ্রব্য।

    ক্রিয়াগুণবৎসমবায়িকারণমিতি দ্রব্যলক্ষণ ॥ বৈ অ০ ২। আ০ ১। সুঃ ১৫ ॥

    ক্রিয়াশ্চ গুণাশ্চ বিদ্যন্তে য়স্মিংস্তৎ ক্রিয়াগুণবৎ যাহাতে ‘ক্রিয়া’ ‘গুণ এবং কেবল গুণ’ থাকে, তাহাকে দ্রব্য বলে। এই সকলের মধ্যে পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, মন এবং আত্মা–এই ছয়টি দ্রব্য ক্রিয়া ও গুণ বিশিষ্ট। আর আকাশ, কাল এবং দিক–এই তিনটি ক্রিয়ারহিত গুণ বিশিষ্ট। (সমবায়)–”সমবেতুং শীলং য়স্য তৎ সমবায়ি প্রাগবৃত্তিত্বং কারণং সমবায়ি চ তকারণং চ সমবায়িকারণম্। লক্ষ্যতে য়েন তল্লক্ষণম্ যাহা মিলন স্বভাবযুক্ত ও যাহা কাৰ্য্য হইতে পূর্বকালস্থ কারণ তাহাকে দ্রব্য বলে। যদ্বারা লক্ষ্য জানা যায়, তাহাকে ‘লক্ষণ’ বলে; যথা চক্ষু দ্বারা রূপের জ্ঞান।

    রূপরগন্ধস্পর্শবতী পৃথিবী ॥ বৈশ অ০ ২। আ০ ১। সু০ ১ ॥

    পৃথিবী–রূপ, রস, গন্ধ এবং স্পর্শ বিশিষ্ট। তাহাতে রূপ, রস এবং স্পর্শ অগ্নি, জল এবং বায়ুর সংযোগে থাকে।

    ব্যবস্থিতঃ পৃথিব্যাং গন্ধঃ ॥ বৈশ অ০ ২। আ০ সু০ ২ ॥

    পৃথিবীতে গন্ধগুণ স্বাভাবিক। সেই রূপ জলে রস, অগ্নিতে রূপ, বায়ুতে স্পর্শ অগ্নি এবং আকাশে শব্দ স্বাভাবিক।

    রূপরস স্পর্শবত্য আপোদ্রবাঃ স্নিগ্ধাঃ ॥

    রূপ, রস ও স্পর্শযুক্ত, দ্রবীভূত ও কোমল ইহাকে জল বলে। কিন্তু উহাতে জলের রস স্বাভাবিক গুণ, তথা রূপ, স্পর্শ, অগ্নি এবং বায়ুর যোগ হইতে হয়।

    অঙ্গুশীততা ॥ বৈশ০ অ০ ২। আ০ সু০ ৫ ॥

    আর, জলে শীতলত্ব গুণও স্বাভাবিক।

    তেজো রূপম্পৰ্শবৎ ॥ বৈশ অ০ ২। আ০ ১। সু০ ৩ ॥

    যাহা রূপ ও স্পর্শযুক্ত তাহা তেজ। কিন্তু ইহাতে রূপ স্বাভাবিক এবং স্পর্শ বায়ুর যোগ বশতঃ আছে।

    স্পর্শবান্ বায়ুঃ ॥ বৈশ অ০ ২ ॥ আ০১ সু ৪ ॥

    ‘বায়ু’ স্পর্শগুণ-বিশিষ্ট। কিন্তু ইহাতেও তেজ ও জলের যোগবশতঃ উষ্ণতা ও শীতলতা থাকে।

    ত আকাশে ন বিদ্যন্তে৷ বৈশ অ০ ২। আ০১। সু ৫ ॥

    রূপ, রস গন্ধ এবং স্পর্শ আকাশে নাই, কিন্তু শব্দই ‘আকাশের’ গুণ।

    নিক্ৰমণং প্রবেশনমিত্যাকাশস্যলিঙ্গ। বৈ০ অ০ ২। অ০ ১। সু০ ২০।

    যাহাতে প্রবেশ এবং নিষ্ক্রমণ হয়, তাহা আকাশের লিঙ্গ বা চিহ্ন।

    কায়ান্তরাপ্রাদুর্ভাব্বাচ্চ শব্দঃ স্পর্শবতামগুণঃ ॥ বৈ অ০ ২। আ০ ১। সু০ ২৫।

    অন্য পৃথিব্যাদি কার্য সমূহ হইতে প্রকট হয় না বলিয়া শব্দ স্পর্শগুণ বিশিষ্ট; ভূমি প্রভৃতির গুণ নহে। কিন্ত শব্দ আকাশেরই গুণ।

    অপরস্মিন্নপরংয়ুগপচ্চিরং ক্ষিপ্রমিতি কাললিঙ্গানি৷ বৈ০ অ০ ২। সু০ ৬ ॥

    যাহাতে অপর পর যুগপৎ=একসঙ্গে, চির=বিলম্ব, ক্ষিপ্র=শীঘ্র, ইত্যাদি প্রয়োগ হইয়া থাকে, তাহাকে কাল’ বলে।

    নিত্যে স্বভাবাদনিত্যেষু ভাবাক্কারণে কালাখ্যেতি। বৈ অ০ ২। সু০ ৯ ॥

    যাহা নিত্য পদার্থে থাকে না এবং অনিত্য পদার্থে থাকে, এইজন্য কারণেরই কাল’ সংজ্ঞা হইয়া থাকে।

    ইত ইদমতি য়তস্তৰ্দিশ্যং লিঙ্গ। বৈ অ০ ২। আ০ ২। সু০ ১০ ॥

    এখান হইতে ইহা পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর, উৰ্দ্ধ এবং অধঃ, যাহাতে এইরূপ ব্যবহার হইয়া থাকে, তাহাকে “দিশা’ বলে।

    আদিত্যসংয়োগা ভূতপূর্বাৎ ভবিষ্যতো ভূতাচ্চ প্রাচী৷ বৈ অ০ ২। আ০ ২। সু০ ১৪ ॥

    যে দিকে প্রথম আদিত্য সংযোগ সূর্যোদয় হইয়াছিল, হইয়াছে এবং হইবে, তাহাকে পূর্বদিশা’ বলে। যে দিকে সূর্যাস্ত হয়, তাহাকে পশ্চিম বলে। পূৰ্বাভিমুখী ব্যক্তির ডানদিককে ‘দক্ষিণ’ এবং বাম দিককে ‘উত্তর দিক বলে।

    এতেন দিগন্তরালানি ব্যাখ্যাতানি৷ বৈ অ০ ২। আ০ ২। সূ০ ১৬ ॥

    পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকের মধ্যবর্তী দিশাকে আগ্নেয়ী’, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের মধ্যবর্তী দিশাকে ‘নৈঋত’ পশ্চিম ও উত্তরের মধ্যবর্তীকে ‘বায়বী’ এবং উত্তর ও পূর্বদিকের মধ্যবর্তীকে ‘ঐশানী’ দিশা বলে।

    ইচ্ছাদ্বেষপ্রয়সুখদুঃখজ্ঞানান্যাত্মনো লিঙ্গমিতি ॥ ন্যায় অ০১।সূ ১০ ॥

    যাহাতে ইচ্ছা=রাগ, দ্বেষ=বৈর, প্ৰয়ত্ন=পুরুষকার; সুখ;দুঃখ; জ্ঞান=জ্ঞাত হইবার গুণ আছে, উহা জীবাত্মা’; বৈশেষিকে এইগুলি অধিক আছে–

    প্রাণা পাননিমেষোন্মেষজীবনমনোগতীন্দ্রিয়ান্তর্বিকারাঃ সুখদুঃখেচ্ছাদ্বেষপ্রয়াশ্চাত্মনো লিঙ্গানি৷ বৈ০ অ০। আ০২। সু০৪ ॥

    (প্রাণ)=ভিতর হইতে বায়ুকে বাহিরে নিক্ষেপ করা, (অপান)=বাহিরে হইতে বায়ুকে ভিতরে আনা, (নিমেষ)=চক্ষুকে নিমীলিত করা, (উন্মেষ)=চক্ষুকে উন্মীলিত করা, (মনঃ) =মনন বিচার অর্থাৎ জ্ঞান, (গতি)=ইচ্ছা মত গমনাগমন করা (ইন্দ্রিয়)=ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয়ের প্রতি পরিচালনা করা, তদ্বারা বিষয় সমূহ গ্রহণ করা, (অন্তর্বিকার)=ক্ষুধা, তৃষ্ণা, জ্বর এবং পীড়াদি বিকার, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ এবং প্রযত্ন–এই সকল আত্মার লিঙ্গ অর্থাৎ কর্ম ও গুণ।

    যুগপজ্ঞানানুৎপত্তিৰ্মনসো লিঙ্গম্ ॥ ন্যায় অ০ ১।১।১৬ ॥

    একই কালে দুই পদার্থের গ্রহণ বা জ্ঞান যাহাতে হয় না তাহাকে ‘মন’ বলে। ইহা দ্রব্যের স্বরূপ ও লক্ষণ বলা হইল। এবার গুণ বলা হইতেছে

    রূপরগন্ধস্পর্শাঃ সংখ্যাঃ পরিমাণানি পৃথত্বংসংয়োগবিভাগে পরাত্বপরত্বে বুদ্ধয়ঃ সুখদুঃ খেচ্ছাদ্বেষৌ প্রয়াশ্চ গুণাঃ ॥ বৈ অ০ ১। আ০ ১। সূ০ ৬।

    রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা,দ্বেষ, প্রযত্ন, গুরুত্ব, দ্রবত্ব, স্নেহ, সংস্কার, ধর্ম, অধর্ম, এবং শব্দ–এই ২৪টিকে ‘গুণ’ বলে ॥

    দ্রব্যাশ্রয়্যগুণবান্ সংযোগবিভাগেম্বকারণমনপেক্ষ ইতি গুণ লক্ষণম্ ॥ বৈ অ০ ১।২।১৬৷

    যাহা দ্রব্যকে আশ্রয় করিয়া থাকে, অন্য গুণকে ধারণ করে না, যাহা সংযোগ ও বিভাগের কারণ নহে এবং যাহা অনপেক্ষ অর্থাৎ একে অন্যের অপেক্ষা করেনা তাহাকে ‘গুণ’ বলে।

    শ্রোত্রোপলব্ধিবুদ্ধিনির্গাহঃ প্রয়োগেণাচভিজ্বলিত আকাশদেশঃশব্দঃ ॥ মহাভাষ্য (১১। ১)

    যাহা শ্রোত্র দ্বারা উপলব্ধ, বুদ্ধি দ্বারা গ্রহণীয় ও প্রয়োগ দ্বারা প্রকাশিত এবং আকাশ যাহার দেশ তাহাকে শব্দ বলে। যাহা নেত্র দ্বারা গৃহীত হয় তাহা রূপ’; যাহা জিহ্বা দ্বারা মধুরাদি নানা প্রকারের যে জ্ঞান গৃহীত হয় তাহা ‘রস’; যাহা নাসিকা দ্বারা গৃহীত হয় তাহা ‘গন্ধ এবং যাহা ত্ব দ্বারা গৃহীত হয় তাহা স্পর্শ। যদ্বারা এক দুই ইত্যাদি গণনা করা হয় তাহা সংখ্যা। যদ্বারা পরিমাণ অর্থাৎ গুরুলঘু জানা যায়, তাহা ‘পরিমাণ’; একে অন্য হইতে পৃথক হওয়া পৃথকত্ব’, একে অন্যের সহিত যুক্ত হওয়া সংযোগ’,একে অন্যের সহিত মিলিত অবস্থায় পর অনেক খণ্ড হইয়া যাওয়া বিভাগ। ইহা হইতে যাহা পূর্বে তাহা ‘পর। ইহা হইতে যাহা পরে তাহা অপর’। যদ্বারা ভালো মন্দ জ্ঞান হয় তাহা বুদ্ধি’। আনন্দের নাম সুখ। ক্লেশের নাম ‘দুঃখ’। (ইচ্ছা) রাগ, বিরাগ, (প্রয়ত্ন) অনেক প্রকারের বল ও পুরুষকার, (গুরুত্ব) ভার, (দ্রবত্ব) দ্রব হওয়া, (স্নেহ) প্রীতি এবং মসৃণতা, (সংস্কার) অন্যের সংযোগ বশতঃ বাসনা উৎপন্ন হওয়া, (ধর্ম) ন্যায়াচরণ এবং কঠিনৰ্বাদি, (অধর্ম) অন্যায়াচরণ ও কঠিনতার বিপরীত কোমলতা–এই চব্বিশটি গুণ।

    উৎক্ষেপণমবক্ষেপণামাকুঞ্চনং প্রসারণং গমনমিতি কর্মাণি ॥ বৈ০ ১১৭

    উৎক্ষেপণ’=উৰ্দ্ধচেষ্টা করা, অবক্ষেপণ’= অধঃচেষ্টা করা, আকুঞ্চন’=সংকোচ করা, ‘প্রসারণ’= বিস্তার করা’, ‘গমন’=যাওয়া। আসা এবং ভ্রমণাদি এই গুলিকে কর্ম’ বলে।

    এবার কর্মের লক্ষণ একদ্রব্যমগুণং সংযোগবিভাগেনপেক্ষকারণমিতি কর্মলক্ষণ ॥ বৈ ১।১।১৭ ॥ ‘একং দ্রব্যমাশ্রয় আধারো য়স্য তদেকদ্রব্যং, ন বিদ্যতে গুণো য়স্য অস্মিন বা তদগুণং সংয়োগেষু বিভাগেযু চাপেক্ষা রহিতং কারণং তৎকৰ্ম-লক্ষণ’ অথবা

    ‘য়ৎক্রিয়তে তৎকর্ম, লক্ষ্যতে যেন তল্লক্ষণ, কর্মণো লক্ষণং কর্মলক্ষণম্ এক দ্রব্যের আশ্রিত, গুণরহিত এবং সংযোগ বিভাগে অপেক্ষা রহিত কারণ থাকায়, তাহাকে কর্ম’ বলে।

    দ্রব্যগুণকৰ্মণাং দ্রব্যং কারণং সামান্য ॥ বৈ০ অ০ ১। আ০ ২। সু০ ১৮ ॥

    যাহা কাৰ্য-দ্রব্য, গুণ এবং কর্মের কারণ, তাহাকে সামান্য দ্রব্য বলে।

    দ্রব্যাণাং দ্রব্যং কায়ং সামান্যম্ ॥ বৈ অ০ ১। আ০ সূ০ ২৩ ॥

    যাহা দ্রব্যসমূহের কাৰ্য-দ্রব্য, উহা কাৰ্য্যত্ব অনুসারে সকল কাৰ্য্যে সামান্য।

    দ্রবত্বং গুণত্বাং কর্মত্বঞ্চ সামান্যানি বিশেষাশ্চ ॥ বৈ০ অ০ ২। সু০ ৫ ॥

    দ্রব্যসমূহের মধ্যে দ্রব্যত্ব, গুণসমূহের মধ্যে গুণত্ব এবং কর্মসমূহের মধ্যে কর্মত্ব- এই সকলকে ‘সামান্য এবং বিশেষ’ বলে। কেননা, দ্রবে দ্রব্যত্ব সামান্য এবং গুণত্ব কর্মত্ব হইতে বিশেষ। এইরূপ সর্বত্র জানিবে ॥

    সামান্যং বিশেষ ইতি বুদ্ধ্যপেক্ষ৷ বৈ০ অ০ ২। সু০ ৩ ॥

    সামান্য এবং বিশেষ, বুদ্ধির অপেক্ষা দ্বারা সিদ্ধ হইয়া থাকে যথা–মনুষ্যদের মধ্যে মনুষ্যত্ব সামান্য এবং উহা পশুত্বাদির হইতে বিশেষ। সেইরূপ স্ত্রীত্ব ও পুরুষত্ব ইহাদের মধ্যে ব্রাহ্মণত্ব, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যত্ব এবং শূদ্রত্বও বিশেষ। ব্রাহ্মণ মধ্যে ব্রাহ্মণত্ব সামান্য এবং ক্ষত্রিয় প্রভৃতি হইতে বিশেষ। এইরূপ সর্বত্র জানিবে।

    ইহেদমিতিয়তঃ কাৰ্য্যকরণয়োঃস সমবায়ঃ ॥বৈ অ০৭। আ০ ২। সু০ ২৬ ॥ ইহা এইরূপ যথা দ্রব্যে ক্রিয়া, গুণীতে গুণ, ব্যক্তিতে জাতি, অবয়ব সমূহের মধ্যে অবয়বী, কাৰ্য্য সমূহের মধ্যে। (কারণ অর্থাৎ) ক্রিয়া ও ক্রিয়াবান, গুণ ও গুণী, জাতি ও ব্যক্তি কাৰ্য্য ও কারণ, অবয়ব ও অবয়বী–এই সকলের মধ্যে যে নিত্য সম্বন্ধ বিদ্যামান তাহাকে সমবায়’ বলে। আর অন্য দ্রব্য সমূহের যে পরস্পর সম্বন্ধ উহা সংযোগ অর্থাৎ অনিত্য সম্বন্ধ।

    দ্রব্যগুণয়য়াঃ সজাতীয়ারম্ভকত্বং সাধর্ম৷ বৈ অ০১। আ০ ১। সু ৯

    দ্রব্য ও গুণের সমানজাতীয়ক কার্য্যের যে আরম্ভ তাহাকে সাধ’ বলে। যথা–পৃথিবীতে যেরূপ জড়ত্ব ধর্ম ও ঘটাদি কাৰ্য্য উৎপাদকত্ব স্ব-সদৃশ-ধর্ম আছে; সেইরূপ জলে জড়ত্ব এবং শীতলতা আদি স্বসদৃশ কার্য্যের আরম্ভ, পৃথিবীর তুল্য ধর্ম আছে; অর্থাৎ ‘দ্রব্য গুণয়োর্বিজাতীয়ারম্ভকত্বং ‘বৈধৰ্মম,ইহা দ্বারা জানা গেল যে, যাহা দ্রব্য ও গুণের বিরুদ্ধ ধর্ম ও কাৰ্য্যের আরম্ভ, তাহাকে ‘বৈধ’ বলে। যথা– পৃথিবীতে কঠিনত্ব, ও শুষ্কত্ব ও গন্ধত্বধর্ম। জলের বিরুদ্ধ এবং জলের দ্রব্য, কোমলত্ব ও রস গুণযুক্ততা পৃথিবীর বিরুদ্ধ।

    কারণভাবাকায়ভাবঃ ॥ বৈ০ অ০ ৪। আ০ ১। সূ০ ৩ ॥ কারণ থাকিলেই কাৰ্য্য হয়। ন তু কায়াভাবাৎকারণভাবঃ ॥ বৈ০ অ০ ১। আ০ ২। সূ০ ২ ॥ (কিন্তু) কাৰ্য্যের অভাব হইলে কারণের অভাব হয় না।

    কারণা ভাবাকায়া ভাবঃ ॥৷ বৈ অ০ ১ আ০ ২। সূ ১। কারণ না হইলে কাৰ্য কখনও হয় না। কারণগুণপূর্বকঃ কাৰ্যগুণো দৃষ্টঃ ॥ বৈ অ০ ১। সূ০ ২৪ ॥ কারণে যাদৃশ গুণ থাকে কাৰ্য্যেও তাদৃশ গুণ থাকে। পরিমাণ–দুই প্রকার অনুমহদিতি তস্মিন্বিশেষভাবান্বিশেষভাবাচ্চ৷ বৈ অ০ ৭ ॥ আ০ ১। সু০ ১১।

    (অণু) সূক্ষ্ম, (মহৎ) বিশাল, সাপেক্ষ। যেরূপ ত্রসরেণু লিক্ষা (চারি এস রেণু) অপেক্ষা ক্ষুদ্র, কিন্তু দ্বণুক অপেক্ষা বড়, এবং পর্বত পৃথিবী অপেক্ষা ছোট কিন্তু বৃক্ষ অপেক্ষা বড়।

    সদিতি যতো দ্রব্যগুণকর্মসু সা সত্তা ॥ বৈ ম০ ১। আ০ ২। সূ০ ৭ ॥

    যাহা দ্রব্য, গুণ এবং কর্ম সমূহে সৎ’ শব্দ যুক্ত থাকে, অর্থাৎ (সদ দ্রব্যম্ সৎ গুণঃ সকর্ম) সদ্রব্য, সৎগুণ, সৎকর্ম, অর্থাৎ বর্তমান কালবাচী শব্দের অন্বয় সকলের সহিত থাকে।

    ভাবোচ নুবৃত্তেরেব হেতুত্বাৎসামান্যমেব ॥ বৈ অ০ ১। আ০ ২। সূ০ ৪ ॥

    যাহা সকলের সহিত অনুবর্তমান, (সহ-স্থায়ী) হওয়ায় সত্তা, রূপ ভাব বিদ্যমান থাকে,তাহাকে মহাসামান্য’ বলে। ভাবরূপ দ্রব্যের এইরূপ ক্রম। আর যে অভাব উহা পাঁচ প্রকার।

    প্রথম-ক্রিয়াগুণব্যপদেশাভাবাপ্রাগসৎ ॥ বৈ০ অ০ ৯। আ০ ১। সূ০১।

    যাহা ক্রিয়া এবং গুণের বিশেষ নিমিত্তের অভাব হেতু প্রাক্ অর্থাৎ পূর্বে (অসৎ) ছিল না। যথা ঘট ও বস্ত্রাদি উৎপত্তির পূর্বে ছিল না। ইহার নাম ‘প্রাগভাব।

    দ্বিতীয়–সদসৎ ॥ বৈ০ অ০ ৯। আ০ ১। সূ০ ২ ॥ যাহা হইয়া থাকে না, ঘট উৎপন্ন হইবার পর নষ্ট হইয়া যায়। ইহাকে ‘প্ৰধ্বংসাভাব’ বলে। তৃতীয়–সচ্চাসৎ ॥ বৈ অ০ ৯ ॥ আ০ ১। সূ০ ৪৷ যাহা যেটি সে অপরটি নহে, যথা “অগৌরশ্বোS নশ্বে গৌঃ এই অশ্ব গো নহে, আবার গো অশ্ব নহে। অর্থাৎ অশ্বে গরুর এবং গরুতে অশ্বের ‘অভাব’ কিন্তু গরুতে গরুর এবং অশ্বতে অশ্বের ভাব আছে। ইহাকে অন্যোন্যাভাব’ বলে।

    চতুর্থ–য়চ্চান্যদসদস্তদসৎ ॥ বৈ০ অ০ ৯ ॥ আ০ ১। সূ০ ৫ ॥ যাহা পূর্বোক্ত ত্রিবিধ অভাব হইতে ভিন্ন, তাহাকে অত্যন্তাভাব’ বলে। যেমন, নরশৃঙ্গ’ অর্থাৎ মনুষ্যের শিং; ‘খপুষ্প’ = আকাশ-কুসুম এবং বন্ধ্যাপুত্র’= বন্ধ্যার পুত্র ইত্যাদি।

    পঞ্চম– নাস্তি ঘটো গেহ ইতি সতে ঘটস্য গেহসংসর্গপ্রতিষেধঃ ॥  বৈ০ অ০ ৯ ॥ আ০ ১। সূ০ ১০ ॥

    গৃহে ঘট নাই অর্থাৎ অন্যত্র আছে গৃহের সহিত ঘটের সম্বন্ধ নাই (ইহা ‘সংসর্গাভাব)। এই সমস্ত পঞ্চবিধ অভাব।

    ইন্দ্রিয়দোষাৎ সংস্কারদোষাচ্চাবিদ্যা ॥ বৈ অ০ ৯ ॥ আ০ ২। সূ০ ১০ ॥

    ইন্দ্রিয় সমূহ এবং সংস্কারের দোষ হইতে ‘অবিদ্যা’ উৎপন্ন হয়। তদ দুষ্টং জ্ঞান৷ অ০ ৯। সূ১১।

    যাহা দুষ্ট অর্থাৎ বিপরীত জ্ঞান, তাহাকে ‘অবিদ্যা’ বলে। অদুষ্টং বিদ্যা ॥ বৈ০ অ০ ৯। আ০ ২। সূ০ ১২ ॥

    যাহা অদুষ্ট অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান তাহাকে ‘বিদ্যা’ বলে।

    পৃথিব্যাদিরূপরসগন্ধস্পর্শা দ্রব্যাচ নিত্যত্বাদনিত্যাশ্চ ॥ বৈ অ০ ৭। আ০ ১। সূ০ ২ ॥ এতেন নিত্যেষু নিত্যত্বমুক্ত ॥ বৈ০ আ০ ৭। আ০ ১। সূ০ ৩ ॥

    যে কাৰ্য্যরূপ পৃথিবাদি পদার্থ এবং তন্মধ্যে যে রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ গুণ রহিয়াছে সে সকল কাৰ্য্য দ্রব্য সমূহ অনিত্য হওয়ায় উহা অনিত্য। আর কারণরূপ পৃথিবী আদি নিত্য দ্রব্য সমূহে যে সকল গন্ধ্যাদি গুণ আছে, উহা ‘নিত্য ॥

    সদকারণবন্নিত্যম ॥ বৈ অ০ ৪ ॥ আ০ সূ০ ১।

    যাহা বিদ্যমান আছে এবং যাহার কোন কারণ নাই উহা নিত্য’, অর্থাৎ সৎকারণবদনিত্য যাহা কারণ-বিশিষ্ট কাৰ্য্যরূপ দ্রব্য গুণ আছে, উহা অনিত্য।

    অস্যেদং কায়ংকারণং সংয়োগিবিরোধিসমবায় চেতি লৈঙ্গিক ॥ বৈ অ০ ৯। আ০ ২। সূ০ ১ ॥

    ইহার এই কাৰ্য্য বা কারণ ইত্যাদি সমবায়ি, সংযোগি, একার্থ সমবায়ি এবং বিরোধি– এই চারি প্রকার ‘লৈঙ্গিক অর্থাৎ লিঙ্গ লিঙ্গীর সম্বন্ধ হইতে জ্ঞান হইয়া থাকে। “সমবায়ি”– যথা আকাশ পরিমাণ বিশিষ্ট। সংয়োগি’ –যথা শরীর ত্ব বিশিষ্ট, প্রভৃতির পরস্পর নিত্য সংযোগ আছে। একার্থ সমবায়ি’–এক বস্তুতে দুই গুণ থাকা, যথা কাৰ্য্যরূপ স্পর্শ, কার্যের লিঙ্গ জ্ঞাপক। ‘বিরোধি’ যথা–অতীতের বৃষ্টি, ভাবী বৃষ্টির বিরোধী লিঙ্গ।

    ব্যাপ্তি নিয়তধর্মর্সাহিত্যমুভয়োরেকতরস্য বা ব্যাপ্তিঃ ॥ নিজশক্তৃদ্ভবমিত্যাচায়াঃ ॥ আধেয়শক্তিয়োগ ইতি পঞ্চশিখঃ ॥ সাংখ্যসূত্র ॥ (অঃ ৫। সূঃ) ২৯, ৩১/৩২ ॥

    যাহা দুই সাধ্য-সাধন, অর্থাৎ যাহা সিদ্ধ করিবার যোগ্য এবং যদ্বারা সিদ্ধ করা যায়, সেই দুটি অথবা একটি মাত্র সাধনের নিশ্চিত ধর্মের যে সহচার, তাহাকে ‘ব্যাপ্তি’ বলে। যথা ধূম ও অগ্নির সহচার আছে ॥ ২৯ ॥

    তথা ব্যাপ্য যে ধূম উহার নিজ শক্তি হইতে উৎপন্ন হয়, অর্থাৎ যখন ধূম দূর স্থানান্তরে গমন করে, তখন অগ্নি সংযোগ ব্যতীতও সে ধূম স্বয়ং থাকে। তাহারই নাম ব্যাপ্তি অর্থাৎ অগ্নির ছেদন, ভেদন সামর্থ্য দ্বারা জলাদি পদার্থ ধূমরূপে প্রকট হয় ॥৩১ ॥

    যথা–মহত্তত্বাদিতে প্রকৃতি আদির ব্যাপকতা, বুদ্ধ্যাদিতে ব্যাপ্যতা ধর্মের সম্বন্ধের নাম ‘ব্যাপ্তি। যথা–শক্তি আধেয় রূপ এবং শক্তিমান আধার রূপের সম্বন্ধ ॥৩২ ॥

    এইসকল শাস্ত্রীয় প্রমাণাদিদ্বারা পরীক্ষা করিয়া পঠন পাঠন করিতে হইবে। অন্যথা বিদ্যার্থীদিগের কখনও সত্যবোধ হইতে পারে না। যে যে গ্রন্থ পড়াইতে হইবে, সেই সকল গ্রন্থ পূর্বোক্ত পরীক্ষা করিবার পর, যে যে গ্রন্থ সত্য বলিয়া নিশ্চিত হইবে সেই সব গ্রন্থ পড়াইবে। কেন না লক্ষণপ্রমাণাভ্যাং বস্তুসিদ্ধি ॥

    লক্ষণ যথা “গন্ধবতী পৃথিবী” যাহা পৃথিবী তাহা গন্ধবতী। এইরূপ লক্ষণ এবং প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ দ্বারা এই সকল সত্যাসত্যের নির্ণয় হইয়া থাকে। এতদ্ব্যতীত কিছুই হয় না।

    অথ পঠন পাঠন বিধিঃ ॥ এবার পঠন পাঠনের বিধি লিখিত হইতেছে, যাহা প্রথমতঃ পাণিনি মুনি কৃত শিক্ষা’ সূত্ররূপ আছে, উহার রীতি শিক্ষা করিবে। অর্থাৎ এই অক্ষরের এই স্থান, এই প্রযত্ন, এই কারণ। যথা ‘প’ উচ্চারণের স্থান ওষ্ঠ, প্রযত্ন সৃষ্ট এবং প্রাণ ও জিহ্বার ক্রিয়াকে ‘করণ’ বলে। এইভাবে মাতা, পিতা এবং আচাৰ্য যথোযোগ্যভাবে সকল অক্ষরের উচ্চারণ বিধি পূর্বক শিক্ষা দিবেন।

    তদনন্তর ‘ব্যাকরণ’ অর্থাৎ প্রথমে অষ্টাধ্যায়ীর সূত্রগুলি পাঠ, যথা বৃদ্ধিরাদৈ’। (অষ্টাধ্যায়ী অ০ ১। পা০১ সূ০১) পরে পদচ্ছেদ, যথা বৃদ্ধি, আৎ, ঐচ বা আদৈ ইহার পর ‘সমাস আচ্চ ঐচ্চ আদৈ এবং অর্থ যথা আদৈচাং বুদ্ধি-সংজ্ঞা ক্রিয়তে’ অর্থাৎ আ, ঐ, ঔ ইহার বৃদ্ধি সংজ্ঞা (করা হয়), তঃ পরো য়স্মাৎ স তপস্তাদপি পরস্তপরঃ ‘ত’ কার যাহার পরে থাকে এবং যাহা ‘ত’ কার হইতেও পরে থাকে তাহাকে “তপর” বলে। ইহাতে সিদ্ধ হইল যে, ‘আ’কারের পর ৎ এবং ‘ৎ’য়ের পরে “ঐ” উভয়ই “তপর”। তি’পরের প্রয়োজন এই যে হ্রস্ব ও প্লুতের বৃদ্ধি সংজ্ঞা হইল না।

    উদাহরণ- (ভাগঃ) এস্থলে ‘ভজ’ ধাতুর উত্তর ‘ঘ’ প্রত্যয়ের পর ‘ঘ’ ‘‘ এর ইৎ সংজ্ঞা হইয়া লোপ হইল। অতঃপর ‘ভজ+ অ, এস্থলে ‘জ’ করের পূর্ববর্তী “ভ” কারোত্তর ‘অ’ কারের বৃদ্ধি সংজ্ঞক “আ” কার হইল। সুতরাং “ভাজ” হইল। পুনরায় ‘জ’ স্থানে ‘গ’ হইয়া ‘অ’কারের সহিত মিলিয়া “ভাগঃ” এইরূপ প্রয়োগ হইল।

    ‘অধ্যায়ঃ, এস্থলে অধিপূর্বক ইঙ’ ধাতুর হ্রস্ব ই’ স্থানে ‘ঘ’ প্রত্যয়ের পর ‘ঐ’ বৃদ্ধি এবং তৎস্থলে ‘আয় মিলিত হইয়া অধ্যায়ঃ হইল।

    নায়কঃ এস্থলে নী’ ধাতুর দীর্ঘ ঈকারের স্থানে ‘খুল’ প্রত্যয়ের পরে ‘ঐ’ বৃদ্ধি (এবং) পরে উহা ‘আয়’ হইবার পর মিলিত হইয়া নায়কঃ’ হইল।

    পুনঃ ‘স্তাবকঃ, এস্থলে ‘স্তু ধাতুর উত্তর খুল’ প্রত্যয় হইয়া হ্রস্ব উকারের স্থানে ‘ঔ’ বৃদ্ধি (এবং) ‘আব’ আদেশ হইয়া আকারের সহিত মিলিত হইয়া ‘স্তাবকঃ হইল।

    (কারকঃ) কৃঞ’ ধাতুর উত্তর খুল’ প্রত্যয়, তাহার ণ, ল এর ইৎ সংজ্ঞা হইয়া লোপ, বু’ এর স্থানে ‘অক’ আদেশ এবং ঋকারের স্থানে আর বুদ্ধি হইয়া কারকঃ’ সিদ্ধ হইল।

    যে যে সূত্র পূর্বাপর প্রযুক্ত হয়, সেইগুলির কাৰ্য্য প্রভৃতি বলিয়া দিতে হইবে এবং শ্লেট অথবা কাষ্ঠ ফলকে দেখাইয়া মূলরূপ লিখিয়া; যথা–ভজ+ঘ+সু’ এইরূপে রাখিয়া প্রথমে ধাতুর অকারের লোপ, পরে ঘূ কারের লোপ পরে ‘ঞ’- র লোপ হইয়া–’ভজ + অ + সু’ এইরূপ রহিল। পুনরায় (অকারের আ বৃদ্ধি এবং) ‘জ’ এর স্থানে ‘গ’ হওয়াতে ‘ভা+অ+সু’ পুনঃ অকারের সহিত মিলিয়া যাওয়াতে ‘ভাগ+সু’ রহিল। এবার উকারের ইৎ’সংজ্ঞা, ‘স্ এর স্থানে ‘রু হইয়া পুনঃ উকারের ইৎ সংজ্ঞা লোপ পাওয়াতে ‘ভাগর’ হইল। এইবার রেফের স্থানে (৫) বিসর্জনীয় হইয়া ভাগঃএই রূপ সিদ্ধ হইল।

    যে যে সূত্রানুসারে যে যে কাৰ্য্য হয় সেই সেই সূত্রের বারংবার পাঠ করাইয়া এবং বারংবার লিখাইয়া অভ্যাস করাইতে থাকিবে। এইরূপ পঠন পাঠন দ্বারা অতি শীঘ্র দৃঢ় বোধ হয়। একবার এইরূপে অষ্টাধ্যায়ী পড়াইয়া অর্থ সহিত ধাতুপাঠ এবং দশ ‘ল’ কারের রূপ তথা প্রক্রিয়া সহিত সূত্রগুলি উৎসর্গ অর্থাৎ সামান্যসূত্র শিক্ষা দিতে হইবে। যথা–কর্মণ্যণ’ (অষ্টা ৩২।১)কর্ম-উপপদ যুক্ত থাকিলে ধাতু মাত্রেই অত্ প্রত্যয় হয়। যথা–”কুম্ভকারঃ”। তাহার পর অপবাদ সূত্র শিক্ষা করাইতে হইবে। যথা–”আতোনুপসর্গে কঃ (অষ্টা ৩। ২। ৩) উপসর্গ ভিন্ন কর্ম উপপদ যুক্ত থাকিলে আকারান্ত ধাতুর উত্তর ‘ক’ প্রত্যয় হইবে। অর্থাৎ যাহা বহুব্যাপক যথা, কর্ম উপপদবিশিষ্ট হইলে ধাতুর উত্তর অপ্রাপ্ত হয়। তদপেক্ষা বিশেষ অর্থাৎ অল্পবিষয় সেই পূর্ব সূত্রের বিষয় হইতে আকারন্ত ধাতুর ‘ক’ প্রত্যয় গ্রহণ করিল। উৎসর্গ বিষয়ে যেরূপ অপবাদ সূত্রের প্রবৃত্তি হয়, সেইরূপ অপবাদ সূত্র বিষয়ে উৎসর্গ সূত্রের প্রবৃত্তি হয় না। যথা, চক্রবর্তী রাজার রাজ্যাধীন মালিক এবং ভূস্বামী থাকে, কিন্তু মাণ্ডলিক রাজার অধীনে চক্রবর্তী রাজা থাকে না।

    এইরূপেই মহর্ষি পাণিনি সহস্র শ্লোকের মধ্যে অখিল শব্দ, অর্থ : সম্বন্ধ বিষয়ক বিদ্যা প্রতিপাদন করিয়াছেন। ধাতু পাঠের পর উণাদিগণ পাঠের সময় সমস্ত সুবন্ত বিষয় উত্তমরূপে পড়াইয়া, পুনরায় দ্বিতীয়বার সংশয়, সমাধান, বাৰ্ত্তিক, কারিকা এবং পরিভাষার প্রয়োগ সহকারে অষ্টাধ্যায়ীর দ্বিতীয়ানুবৃত্তি পড়াইবে। তদনন্তর মহাভাষ্য পড়াইবে। যদি কোন বুদ্ধিমা, পুরুষকার-সম্পন্ন, অকপট, ও বিদ্যোনুতিকামী ব্যক্তি নিত্য পঠন-পাঠন করে, তবে সে দেড় বৎসরে অষ্টাধ্যায়ী এবং দেড় বৎসরে মহাভাষ্য অধ্যয়ন করিয়া তিন বৎসরে পূর্ণ বৈয়াকরণ হইয়া বৈদিক ও লৌকিক শব্দাবলীর ব্যাকরণজ্ঞানের সাহায্যে অন্য শাস্ত্রগুলির শীঘ্র সহজে পড়িতে ও পড়াইতে সক্ষম হইবে।

    কিন্তু, ব্যাকরণে যেমন কঠিন পরিশ্রম করিতে হয়, অন্য শাস্ত্রে সেরূপ পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। এইগুলি অধ্যয়ন করিলে তিন বৎসরে যে পরিমাণ জ্ঞান জন্মিবে, কুগ্রন্থ অর্থাৎ সারস্বত, চন্দ্রিকা, কৌমুদী এবং মনোরমাদি অধ্যয়ন করিলে পঞ্চাশ বৎসরেও সে পরিমাণ জ্ঞান জন্মিতে পারিবে না। কারণ, মহাশয় মহর্ষিগণ যেরূপে গম্ভীর বিষয় গুলি সরল ভাবে স্ব স্ব গ্রন্থে প্রকাশ করিয়াছেন, ক্ষুদ্রাশয় মনুষ্যগণের কল্পিত গ্রন্থে সেইরূপ প্রকাশ করা কীরূপে সম্ভব হইতে পারে? মহর্ষিদের ভাব যথাসম্ভব সুগম এবং অল্প সময়ে আয়ত্ত করা যায়। কিন্তু ক্ষুদ্রাশয় ব্যক্তিগণের ইচ্ছা। এই যে, যতদূর সম্ভব রচনাকে কঠিন করা, যাহাতে বহু পরিশ্রমের সহিত পাঠ করিয়া অল্প লাভ হয়। ইহা যেন পাহাড় কাটিয়া কপর্দক লাভ। আর আর্য গ্রন্থ পাঠ করা কীরূপ– উহা যেন একটি বার ডুব দিয়াই মূল্যবান মণি-মুক্তা লাভ করা।

    ব্যাকরণ পাঠ করিয়া ছয় বা আট মাসে যাস্কমুনি কৃত ‘নিঘন্টু’ও ‘নিরুক্ত’ অর্থ সহিত পড়িবে ও পড়াইবে। অন্য নাস্তিক কৃত অমরকোষাদি অন্যান্য গ্রন্থে বহু বৎসর বৃথা নষ্ট করিবে না। তাহার পর পিঙ্গলাচার্যকৃত ছন্দো গ্রন্থ সাহায্যে বৈদিক ও লৌকিক ছন্দের পরিজ্ঞান, আধুনিক নবীন রচনা এবং শ্লোক রচনার প্রণালীও যথোচিত ভাবে শিখিবে। এইরূপে গ্রন্থ, শ্লোক রচনা এবং বিস্তার চার মাসে শিক্ষা করিয়া পঠন পাঠনে সমর্থ হইবে। বৃত্তরত্নাকর প্রভৃতি অল্পবুদ্ধি প্রকল্পিত সমূহে বহু বৎসর নষ্ট করিবে না।

    অতঃপর মনুস্মৃতি, বাল্মিকী রামায়ণ এবং মহাভারতের উদ্যোগ পর্বান্তৰ্গত বিদুরনীতি প্রভৃতি উৎকৃষ্ট প্রকরণগুলি পাঠ করিবে। ইহাতে দুষ্ট ব্যসন দূর হইবে এবং উৎকর্ষ ও সভ্যতা লাভ হইবে। অধ্যাপকগণ কাব্যরীতি অনুসারে অর্থাৎ পদচ্ছেদ, পদার্থোক্তি, অন্বয়, বিশেষ্য, বিশেষণ ও ভাবার্থ বুঝাইতে থাকিবেন এবং বিদ্যার্থীগণ এই সকল শিক্ষা করিতে থাকিবে। এক বৎসরের মধ্যে এইগুলি অধ্যয়ন শেষ করিবে।

    তাহার পর পূর্ব মীমাংসা, বৈশেষিক, ন্যায়, যোগ, সাংখ্যও বেদান্ত–অর্থাৎ যতদূর সম্ভব ততদূর ঋষিকৃত ব্যাখ্যা অথবা শ্রেষ্ঠ বিদ্বাদিগের সরল ব্যাখ্যা সহ পঠন পাঠন করিবে। কিন্তু বেদান্তসূত্র অধ্যয়নের পূর্বে ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মণ্ডুক, মাণ্ডুক্য, ঐতরেয়, তৈত্তিরেয়ী, ছান্দোগ্য এবং বৃহদারণ্যক–এই দশ উপনিষদ্ অধ্যয়ন করিবে। ছয় শাস্ত্রের সূত্র সমূহের ভাষ্য ও বৃত্তিসহ সূত্র দুই বৎসরের মধ্যে পড়াইবে এবং পড়িবে। ইহার পর ছয় বৎসরের মধ্যে চারি ব্রাহ্মণ, অর্থাৎ ঐতরেয়, শতপথ, সাম, গোপথ ব্রাহ্মণ, চর্তুবেদ, স্বর, শব্দ সহিত অর্থ, সম্বন্ধ এবং ক্রিয়াজ্ঞান। সহিত অধ্যয়ন করিবে। এ বিষয়ে প্রমাণ ও

    স্থাণুরয়ং ভারাহারঃকিলাভূদধীত্য বেদংন বিজানাতি যোর্থম্‌ ॥ য়োর্থজ্ঞইৎসকলং ভদ্রমতে নাকমেতি জ্ঞানবিধূতপামা ॥ নিরুক্ত ১১৮

    অর্থ :- এই মন্ত্রটি নিরুক্তে আছে। যিনি বেদের স্বর ও পাঠমাত্র পড়িয়া অর্থ জানিতে অক্ষম, তিনি শাখা, পত্র এবং ফল পুষ্পের ভার বহনকারী বৃক্ষ ও ধান্যাদির ভার বহনকারী পশুর ন্যায় ভারবাহ অর্থাৎ ভার বহনকারী। আর যিনি বেদপাঠ করেন এবং বেদার্থ সম্যকরূপে জানেন, তিনিই সম্পূর্ণ আনন্দ প্রাপ্ত হইয়া দেহান্তের পর জ্ঞানবলে পাপমুক্ত হইয়া পবিত্র ধর্মাচরণ প্রতাপে সর্বানন্দ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।

    উত ত্বঃ পশ্যন্ন দদর্শ বাচমুত ত্বঃ শৃন্বন্ন শৃণোত্যেনা। উতো ত্বস্মৈ তন্বং১ বিসস্রে জায়েব পত্য উশতী সুবাসা ৷ ঋ ০১০৭১৪ ॥

    অর্থ : যে অবিদ্বান্ ব্যক্তি সে শুনিয়াও শুনেনা, দেখিয়াও দেখে না, বলিয়াও বলেনা, অর্থাৎ অবিদ্বান্ ব্যক্তিরা এই বিদ্যাবাণীর রহস্য জানিতে পারে না। কিন্তু, যেমন সুন্দর বস্ত্রালঙ্কার পরিধান করিয়া স্বীয় পতিকে কামনা করিয়া স্ত্রী স্বীয় পতির নিকট নিজ শরীর ও স্বরূপ প্রকাশ করিয়া থাকে, তদ্রপ বিদ্যাও শব্দ, অর্থ এবং সম্বন্ধ জ্ঞাত বিদ্বানের নিকট স্বীয় স্বরূপ প্রকাশ করিয়া থাকে, কিন্তু বিদ্যাহীন ব্যক্তির নিকট করে না।

    ঋচো অক্ষরে পরমে বোমান্যস্মিদেবা অধি বিশ্বে নিষেদুঃ ॥ য়স্তন্ন বেদ কিমৃচা করিষ্যতিয় ইদ্বিদুস্তইমে সমাসতে ॥ ঋ০১। ১৬৪/৩৯ ॥

    অর্থ –যে ব্যাপক, অবিনাশী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পরমেশ্বরে সমস্ত বিদ্বান্ ব্যক্তি এবংপৃথিবী সূৰ্য্যাদি সব লোক অবস্থিত, যাঁহাতে সকল বেদের মুখ্য তাৎপৰ্য্য, যিনি সেই ব্রহ্মকে জানেন না, তিনি কি ঋগ্বেদাদি হইতে কোন আনন্দ প্রাপ্ত হইতে পারেন? না, না। কিন্তু যাঁহারা বেদাধ্যয়ন পূর্বক ধম্মাত্মা ও যোগী হইয়া সেই ব্রহ্মকে জানেন, তাহারা সকলে পরমেশ্বরে স্থিতি লাভ করিয়া মুক্তিরূপী পরমানন্দ লাভ করেন। এই জন্যে অর্থজ্ঞান সহকারেই পঠন পাঠন হওয়া আবশ্যক।

    এইরূপে সকল বেদ অধ্যয়নের পর আয়ুর্বেদ অর্থাৎ চরক এবং সুশ্রুত প্রভৃতি ঋষি প্রণীত চিকিৎসা শাস্ত্রের অর্থ, ক্রিয়া, শস্ত্র, ছেদন, ভেদন, লেপ, চিকিৎসা, নিদান, ঔষধ, পথ্য, শরীর, দেশ, কাল এবং বস্তুর গুণ, জ্ঞানপূর্বক জানিয়া ৪ (চার) বৎসরের মধ্যে পঠন পাঠন সমাপ্ত করিবে। অনন্তর ধনুর্বেদ অর্থাৎ রাষ্ট্র সম্বন্ধীয় কাৰ্য। ইহা দ্বিবিধ, প্রথম–নিজ রাজপুরুষ সম্বন্ধীয়, দ্বিতীয়–প্রজা সম্বন্ধীয়। রাজকার্য্যে সভা, সৈন্যাধ্যক্ষ শস্ত্ৰাস্ত্রবিদ্যা সম্বন্ধে জানিবে এবং নানাপ্রকার ব্যুহ রচনা অভ্যাস অর্থাৎ আজকাল যাহাকে ‘কবায়দ’ বলে, শক্রর সহিত যুদ্ধকালে যাহা করিতে হয় তাহা সম্যকরূপে শিক্ষা করিবে। প্রজাপালন, প্রজাবৃদ্ধি প্রণালী শিক্ষা করিয়া ন্যায়ানুসারে প্রজাদিগকে সন্তুষ্ট রাখিবে। দুষ্টদিগের সমুচিত দণ্ডদান এবং শ্রেষ্ঠদিগের পালন সম্বন্ধে সর্ববিধ ব্যবস্থা শিক্ষা করিবে।

    এই রাষ্ট্রবিজ্ঞান দুই বৎসরে শিক্ষা করিয়া গান্ধর্ববেদ যাহাকে ‘গানবিদ্যা’ বলে উহা এবং তৎসংক্রান্ত স্বর, রাগ, রাগিণী, সময়, তাল, গ্রাম, তান, বাদিত্র, নৃত্য এবং গীত আদি সম্যকরূপে শিক্ষা করিবে। কিন্তু প্রধানরূপে সামবেদের গান বাদ্যযন্ত্র সহকারে শিক্ষা করিবে এবং নারদ সংহিতা প্রভৃতি আর্ষগ্রস্থ অধ্যয়ন করিবে। কিন্তু লম্পট, বেশ্যা, বৈরাগীদিগের বিষয়াসক্তি উৎপন্নকারী গর্দভ শব্দবৎ ব্যর্থ-সঙ্গীতালাপ কখনও করিবে না।

    অর্থবেদ যাহাকে ‘শিল্পবিদ্যা বলে তাহার দ্বারা পদার্থসমূহের গুণ, বিজ্ঞান, ক্রিয়া, কৌশল, বিবিধ বস্তুনির্মাণ এবং পৃথিবী হইতে আকাশ পর্যন্ত যাবতীয় পদার্থবিষয়ক বিদ্যা অর্থাৎ ঐশ্বৰ্য্য বর্ধক সেই বিদ্যা শিক্ষা করিয়া এবং দুই বৎসরের মধ্যে জ্যোতিষ শাস্ত্র’ সূৰ্য্যসিদ্ধান্ত প্রভৃতি তদন্তৰ্গত বীজগণিত, অঙ্ক, ভূগোল, খগোল এবং ভূগর্ভ বিদ্যা সম্যক্রপে শিক্ষা করিবে। তাহার পর সর্ববিধ হস্তশিল্প ও যন্ত্রকলা প্রভৃতি শিক্ষা করিবে; কিন্তু গ্রহনক্ষত্র, জন্মপত্র, রাশি এবং মুহূর্ত প্রভৃতির ফল বিধায়ক যে সব গ্রন্থ আছে সেগুলিকে মিথ্যা জানিয়া কখনও পঠন পাঠন করিবে না, করাইবেও না।

    বিদ্যার্থী এবং অধ্যাপকগণ এইরূপ চেষ্টা করিবেন যাহাতে বিংশ বা একবিংশ বৎসরের মধ্যে সর্ব প্রকার এবং উত্তম শিক্ষা লাভ করিয়া মনুষ্যগণ কৃতকৃত্য হইয়া সর্বদা আনন্দে থাকে। এই রীতি অনুসারে বিংশ বা একবিংশ বর্ষে যে পরিমাণ বিদ্যালাভ হইতে পারিবে অন্যরীতি অনুসারে একশত বৎসরেও সে পরিমাণে বিদ্যালাভ করিতে পারিবে না।

    ঋষিপ্রণীত গ্রন্থ এই জন্য পাঠ করিবে যেহেতু তাহারা পরম বিদ্বান, সর্ব শাস্ত্রবিদ এবং ধর্মাত্মা। ছিলেন। আর যাঁহারা অনৃষি অর্থাৎ অল্পশাস্ত্র পড়িয়াছেন ও যাঁহাদের আত্মা পক্ষপাতদুষ্ট তাহাদের রচিত গ্রন্থও সেইরূপ হইবে।

    পূর্ব মীমাংসার ব্যাস মুনিকৃত ব্যাখ্যা, বৈশিষিকের গৌতম মুনিকৃত প্রশস্তপাদ ভাষ্য, ন্যায়। সূত্রের বাৎসায়ন মুনিকৃত ভাষ্য, পতজ্ঞলি মুনিকৃত সূত্রের ব্যাস মুনিকৃত ভাষ্য, কপিল মুনিকৃত সাংখ্য সূত্রের ভাণ্ডরিমুনিকৃত ভাষ্য, ব্যাস মুনিকৃত বেদান্ত সূত্রের বাৎস্যায়ন মুনিকৃত ভাষ্য, অথবা বৌধায়ন মুনিকৃত ভাষ্যবৃত্তি সহিত পড়িবে ও পড়াইবে। এই সকল সূত্রকে কল্প এবং অঙ্গের। মধ্যেও গণনা করিবে। যেরূপ ঋক, যজুঃ, সাম এবং অথর্ব–এই চারি বেদ ঈশ্বরকৃত, তদ্রপ ঐতরেয় শতপথ, সাম এবং গোপথ–এই চারি ব্রাহ্মণ; শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ নিঘন্টু, নিরুক্ত, ছন্দ এবং জ্যোতিষ–এই ছয়টি বেদাঙ্গ। মীমাংসাদি ছয় শাস্ত্র বেদের উপাঙ্গ। আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ এবং অর্থবেদ এই চারিটি বেদের উপবেদ। এইগুলি ঋষি মুনিকৃত গ্রন্থ, এ সকলের মধ্যেও যেগুলি বেদ বিরুদ্ধ প্রতীত হইবে সেগুলিকে পরিত্যাগ করিবে। কারণ, বেদ ঈশ্বরকৃত বলিয়া অভ্রান্ত ও স্বতঃপ্রমাণ অর্থাৎ বেদের প্রমাণ বেদ হইতেই হইয়া থাকে। ব্রাহ্মণ প্রভৃতি সমস্ত গ্রন্থ। পরতঃ প্রমাণ বেদাধীন। বেদের বিশেষ ব্যাখ্যা ‘ঋগ্বেদাদি ভাষ্য ভূমিকায় দ্রষ্টব্য। এই গ্রন্থেও উহা। পরে লিখিত হইবে।

    এখন পরিত্যাজ্য গ্রন্থগুলির পরিগণনা সংক্ষেপে করা যাইতেছে। নিম্নে অর্থাৎ নিম্নলিখিত যে সমস্ত গ্রন্থ লিখিত হইবে সেগুলিকে জাল গ্রন্থ বলিয়া জানিবে–

    ব্যাকরণের মধ্যে কাতন্ত্র’, ‘সারস্বত’, ‘চন্দ্রিকা’, মুগ্ধবোধ’, ‘কৌমুদী’, ‘শেখর’এবং মনোরমা’ ইত্যাদি। অভিধানের মধ্যে ‘অমরকোষ’ প্রভৃতি। ছন্দোগ্রন্থের মধ্যে বৃত্তরত্নাকর’ প্রভৃতি। শিক্ষার মধ্যে’অথ শিক্ষাং প্রবক্ষ্যামি পাণিনীয়ং মতংয়থা ইত্যাদি জ্যোতিষের মধ্যে শীঘ্রবোধ’, মুহূর্তচিন্তামণি’ আদি। কাব্যের মধ্যে নায়িকা ভেদ’ ‘কুবলয়ানন্দ’, ‘রঘুবংশ’, ‘মাঘ’, ‘কিরাতাৰ্জ্জুন প্রভৃতি। মীমাংসার মধ্যে ধর্মসিন্ধু’, ‘ব্রতার্ক প্রভৃতি। বৈশেষিকের মধ্যে তর্কর্সংগ্রহ প্রভৃতি। ন্যায়ের মধ্যে জাগদীশী’ প্রভৃতি। যোগের মধ্যে হঠপ্রদীপিকা’ প্রভৃতি। সাংখ্যের মধ্যে সাংখ্যতত্ত্ব-কৌমুদী’আদি। বেদান্তের মধ্যে যোগবাশিষ্ঠ’, ‘পঞ্চদশী’ ইত্যাদি বৈদ্যক মধ্যে শার্ধর প্রভৃতি। স্মৃতি মধ্যে মনুস্মৃতির প্রক্ষিপ্ত শ্লোক সমূহ ও অন্য সমস্ত স্মৃতি, সব তন্ত্রগ্রন্থ, সব পুরাণ, সব উপপুরাণ এবং তুলসীদাস কৃত রামায়ণ, রুক্মিণীমঙ্গল’ প্রভৃতি ভাষায় লিখিত যাবতীয় গ্রন্থ। এইগুলি কপোলকল্পিত ও মিথ্যা গ্রন্থ।

    প্রশ্ন–এই সকল গ্রন্থে কি কোন সত্য নাই?

    উত্তর—- অল্প সত্য আছে। কিন্তু তৎসঙ্গে বহু অসত্যও আছে, অতএব ‘বিষসম্পৃক্তান্নবত্যাজ্যা’। যেরূপ অত্যুত্তম অন্ন বিষ-মিশ্রিত হইলে তাহা ত্যাজ্য সেইরূপ এইসকল গ্রন্থও ত্যাজ্য।

    প্রশ্ন–আপনি কি পুরাণ ইতিহাসকে মানেন না?

    উত্তর-হা, মানি। কিন্তু সত্যকে মানি, মিথ্যাকে নহে।

    প্রশ্ন –কোনটি সত্য, আর কোনটি মিথ্যা?

    উত্তর –ব্রাহ্মণানীতিহাসান্ পুরাণানি কল্পান্ গাথা নারাশাংসীরিতি ॥

    ইহা গৃহ্যসূত্রাদির বচন। যাহা ঐতরেয়, শতপথ প্রভৃতি ব্রাহ্মণ গ্রন্থে লিখিত হইয়াছে উহাদের ইতিহাস, পুরাণ, গাথা, নারাশংসী এই পাঁচটি নাম। শ্রীমদ্ভাগবতাদির নাম পুরাণ নহে।

    প্রশ্ন –ত্যাজ্য গ্রন্থ সমূহের মধ্যে যে সত্য আছে, তাহা গ্রহণ করেন না কেন?

    উত্তর– তন্মধ্যে যাহা সত্য, তাহা বেদাদি সত্যশাস্ত্রের এবং মিথ্যা সমূহ তাহাদের নিজের। বেদাদি সত্য শাস্ত্র স্বীকার করিলে সকল সত্য গৃহীত হয়। যদি কেহ এই সকল মিথ্যা গ্রন্থ হইতে সত্য গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে মিথ্যাও তাহার গলায় জড়াইয়া যাইবে। অতএব–’অসত্যমিশ্রং সত্যং দূরতস্ত্যাজ্যমিতি’ অসত্যমিশ্রিত গ্রন্থকে বিষমিশ্রিত অন্নের ন্যায় পরিত্যাগ করা কর্তব্য।

    প্রশ্ন– আপনার মত কী?

    উত্তর –বেদ অর্থাৎ বেদে যাহা যাহা গ্রহণ ও বর্জন করিতে ও পরিত্যাগ করিতে শিক্ষা দিয়াছে সেগুলি যথাবৎ পালন করা ও বর্জনীয়কে বর্জন করা উচিত বলিয়া মানি। যেহেতু বেদ আমাদের মান্য, সেই হেতু আমাদের মত বেদ। এইরূপই মানিয়া সকল মনুষ্যের বিশেষতঃ আৰ্যদের একমত হইয়া থাকা উচিত।

    প্রশ্ন –সত্যের সহিত অসত্যের এবং এক গ্রন্থের সহিত অপর শাস্ত্রের বিরোধ আছে। উদাহরণ স্বরূপ সৃষ্টি বিষয়ে ছয় শাস্ত্রের মধ্যে বিরোধ আছে, যথা –মীমাংসা কর্ম হইতে, সাংখ্য প্রকৃতি হইতে এবং বেদান্ত ব্রহ্ম হইতে সৃষ্টির উৎপত্তি স্বীকার করে। ইহা কি বিরোধ নহে?

    উত্তর– প্রথমতঃ-সাংখ্যা এবং বেদান্ত ব্যতীত অন্য চারটি শাস্ত্রে সৃষ্টির উৎপত্তি সম্বন্ধে স্পষ্টরূপে কিছুই লিখিত নাই। দ্বিতীয়তঃ- এই সকল শাস্ত্রের মধ্যে বিরোধ নাই। বিরোধ এবং অবিরোধ সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান নাই। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি,বিরোধ কোন স্থলে হইয়া থাকে? ইহা কি কেবল এক বিষয়ে,–না ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে হইয়া থাকে?

    প্রশ্ন –এক বিষয়ে অনেকের পরস্পর বিরুদ্ধ কথন হইলে তাহাকে ‘বিরোধ’ বলে। এস্থলেও সৃষ্টি–এক বিষয়।

    উত্তর –বিদ্যা এক বা দুই? যদি এক হয়, তবে ব্যাকরণ, চিকিৎসা শাস্ত্র এবং জ্যোতিষ প্রভৃতি ভিন্ন বিষয় হইবার কারণ কী? যেরূপ একই বিদ্যার অনেক অবয়ব একটি অপরটি হইতে পৃথক বলিয়া প্রতিপাদিত হয়, সেইরূপ সৃষ্টিবিদ্যার ভিন্ন ভিন্ন ছয় অবয়ব শাস্ত্র সমূহে প্রতিপাদিত হওয়ায় ইহার মধ্যে বিরোধ নাই। যেরূপ কোন ঘট নির্মাণ বিষয়ে কর্ম, সময়, মৃত্তিকা, বিচার, সংযোগ-বিয়োগাদির পুরুষার্থ, প্রকৃতির গুণ এবং কুম্ভকার কারণ সেইরূপ সৃষ্টির যে কর্ম কারণ, উহার ব্যাখা মীমাংসায়, সময়ের ব্যাখ্যা বৈশেষিকে, উপাদান কারণের ব্যাখ্যা ন্যায়ে, পুরুষার্থের ব্যাখ্যা যোগে, তত্ত্বসমূহের অনুক্রমানুসারে পরিগণনার ব্যাখ্যা সাংখ্যে এবং নিমিত্ত কারণ যে পরমেশ্বর তাহার ব্যাখ্যা বেদান্তশাস্ত্রে আছে। ইহাতে কোনও বিরোধ নাই। সেরূপ চিকিৎসা শাস্ত্রে, নিদান, চিকিৎসা, ঔষধদান এবং পথ্যের প্রকরণ পৃথক পৃথক বলা হইয়াছে, কিন্তু প্রত্যেকটির উদ্দেশ্যই রোগ নিবৃত্তি সেইরূপ ছয়টিকারণ, তাহাদের মধ্যে এক একটি কারণের ব্যাখ্যা এক একশাস্ত্রকার করিয়াছেন। অতএব ইহাদের মধ্যে কোনও বিরোধ নাই। ইহার বিশেষ ব্যাখ্যা সৃষ্টি প্রকরণে বলা হইবে।

    বিদ্যা পঠন পাঠনের যাহা বিঘ্নস্বরূপ উহা পরিত্যাগ করিবে। যথাঃ- কুসঙ্গ অর্থাৎ দুষ্ট বিষয়াসক্ত লোকের সংসর্গ; দুষ্ট ব্যসন,–যেমন মদ্যাদি সেবন এবং বেশ্যা গমনাদি, বাল্য বিবাহ অর্থাৎ পঁচিশ বৎসরের পূর্বে পুরুষের এবং ষোল বৎসরের পূর্বে স্ত্রীলোকের বিবাহ; পূর্ণ ব্রহ্মচাৰ্য্য পালন না করা; রাজা, মাতাপিতা ও বিদ্বদগণের বেদাদি শাস্ত্র প্রচারের প্রতি অনুরাগ না থাকা, অতি ভোজন; অতি জাগরণ; পড়িতে পড়াইতে, পরীক্ষা গ্রহণ করিতে এবং পরীক্ষা দিতে আলস্য ও কপটতা করা, সর্বোপরি বিদ্যাকে সর্বপেক্ষা লাভজনক মনে না করা; ব্রহ্মচর্য দ্বারা বল, বুদ্ধি, পরাক্রম, আরোগ্য, রাজা ও ধন বৃদ্ধি হয়, ইহা স্বীকার না করা, ঈশ্বরের ধ্যান পরিত্যাগ করিয়া অন্য জড় ও পাষাণ মূৰ্ত্তির দর্শন এবং পূজায় বৃথা সময় নষ্ট করা; মাতা, পিতা, অতিথি, আচাৰ্য্য এবং বিদ্বান ব্যক্তিদের সত্যমূৰ্ত্তি মনে করিয়া তাহাদের সেবা এবং সঙ্গলাভ না করা। বর্ণাশ্রমধর্ম ত্যাগ করিয়া উৰ্দ্ধপুন্ড্র, তিলক, কণ্ঠী ও মালা ধারণ করা; একাদশী প্রভৃতি ব্রত করা; কাশী প্রভৃতি তীর্থ এবং রাম, কৃষ্ণ, নারায়ণ, শিব, ভগবতী ও গণেশাদির নাম স্মরণে পাপ বিনাশ হয় বলিয়া বিশ্বাস করা; ভণ্ডাদির উপদেশানুসারে বিদ্যা শিক্ষায় শ্রদ্ধা না করা; বিদ্যা, ধর্ম, যোগাভ্যাস ও পরমেশ্বরের উপাসনা ত্যাগ করিয়া মিথ্যা পুরাণ নামক ভাগবতাদির পাঠ শ্রবণে মুক্তি হইবে স্বীকার করা; লোভবশতঃ ধনাদিতে প্রবৃত্ত হইয়া বিদ্যায় প্রীতি না রাখা এবং ইতস্ততঃ বৃথা ভ্রমণ করিতে থাকা। এই সকল মিথ্যা ব্যবহারে আবদ্ধ হইয়া এবং ব্রহ্মচর্য্য ও বিদ্যালাভে বঞ্চিত হইয়া। তাহারা রুগ্ন ও মুগ্ধ হইয়া থাকে।

    আজকালকার সাম্প্রদায়িক ও স্বার্থপর ব্রাহ্মণাদি অপর ব্যক্তিদের বিদ্যা ও সৎসঙ্গ হইতে বঞ্চিত করিয়া এবং তাহাদের সকলকে নিজেদের জালে আবদ্ধ করিয়া দেহ, মন এবং ধন নষ্ট। করে এবং মনে করে যে, যদি ক্ষত্রিয়াদি বর্ণ লেখাপড়া শিক্ষা করিয়া বিদ্বান্ হয়, তাহা হইলে তাহাদের ছলচাতুরি হইতে মুক্ত হইয়া এবং স্বার্থপরদের শঠতা জানিতে পারিয়া তাহারা তাহাদিগকে অপমান করিবে। রাজা ও প্রজাবর্গ এই সকল বিঘ্ন দূর করিয়া আপন আপন পুত্রকন্যার বিদ্যাশিক্ষার্থে কায়মনোবাক্যে সচেষ্ট থাকিবেন।

    প্রশ্ন –স্ত্রী শূদ্রও কি বেদপাঠ করিবে? ইহারা যদি বেদপাঠ করে তবে আমরা কী করিব? আর ইহাদের বেদপাঠ বিষয়ে কোনও প্রমাণও নাই, বরং নিষেধ আছে স্ত্রীশূদ্রৌ নাধীয়াতামিতি শ্রুতেঃ স্ত্রী ও শূদ্র পড়িবে না, ইহা শ্রুতির বচন।

    উত্তর –স্ত্রী-পুরুষ সকলের অর্থাৎ মনুষ্যমাত্রেই বেদ পড়িবার অধিকার আছে। তুমি অধঃপাতে যাও। এই শ্রুতি তোমার কপোল কল্পিত। ইহা কোনও প্রামাণিক গ্রন্থের উদ্ধরণ নহে । সকলের। যে বেদাদি শাস্ত্র পড়িবার ও অধিকার আছে, সে বিষয়ে যজুর্বেদের ষড়বিংশতি অধ্যায়ের দ্বিতীয় মন্ত্র প্রমাণ; যথা :

    রথেমাং বাচংকল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ। ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাঃশূদ্রায় চাৰ্য্যায় চ স্বায় চারণায় ॥ যজু০ ২৬২ ॥

    অর্থঃ –পরমেশ্বর বলিতেছেন (যথা) যেমন আমি (জনেভ্যঃ) সকল মনুষ্যের সুখের জন্য। (ইমা) এই (কল্যাণী) কল্যাণ অর্থাৎ সাংসারিক এবং মুক্তি সুখ প্রদায়িণী (বাচ) ঋগ্বেদাদি চারি বেদের বাণী (আবদানি) উপদেশ করিতেছি সেইরূপ তোমরাও উপদেশ করিতে থাক।

    এই স্থলে কেহ যদি এরূপ প্রশ্ন করে যে, জন’ শব্দ দ্বিজ অর্থে গ্রহণ করা উচিত, কারণ স্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থে লিখিত আছে যে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যেরই বেদপাঠে অধিকার আছে, স্ত্রী ও শূদ্রাদি বর্ণের নাই।

    উত্তর- (ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাম) ইত্যাদি। দেখ! পরমেশ্বর স্বয়ং বলিতেছেন, আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, (অৰ্য্যায়) বৈশ্য, (শূদ্রায়) শূদ্র এবং (স্বায়) নিজের ভৃত্য বা স্ত্রী আদি এবং (অরণায়) অতি ক্ষুদ্রাদির জন্যও বেদ প্রকাশ করিয়াছি। অর্থাৎ সকল মনুষ্য বেদের পঠন পাঠন এবং শ্রবণ-শ্রাবণ দ্বারা বিজ্ঞান বৃদ্ধি করিয়া সদ্বিষয় গ্রহণ এবং অসদ্বিষয় বজ্জন পূৰ্ব্বক দুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া আনন্দ লাভ করুক।

    এবার বল, তোমার কথা মানিব না, পরমেশ্বরের? পরমেশ্বরের কথা অবশ্যই মানিতে হইবে। এত কথার পরেও যদি কেহ না মানে, তবে তাহাকে নাস্তিক’ বলিতে হইবে। কারণ, নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ যে ব্যক্তি বেদের নিন্দা করে এবং বেদ মানে না,সে নাস্তিক।

    পরমেশ্বর কি শূদ্রদের মঙ্গল করিতে ইচ্ছা করেন না? তিনি কি পক্ষপাতী যে, বেদের অধ্যয়ন এবং শ্রবণ শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ এবং দ্বিজদের জন্য বৈধ করিলেন? যদি শূদ্রদের সকলকে বেদ পড়াইবার ও শুনাইবার অভিপ্রায় তাহার না থাকিত তাহা হইলে তিনি শূদ্রদের শরীরে বাক, শ্রোত্রেন্দ্রিয় রচনা করিলেন কেন? পরমাত্মা যেমন সকলের জন্য পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূৰ্য্য এবং অন্নাদিযাবতীয় পদার্থ সৃষ্টি করিয়াছেন, সেইরূপ বেদও সকলের জন্য প্রকাশ করিয়াছেন। যে স্থলে নিষেধ আছে সে স্থলে নিষেধের অভিপ্রায় এই যে, যাহাকে পড়াইলেও কিছুই শিখিতে পারে না, সে নিৰ্ব্বোধ এবং মুখ হওয়ায় তাহাকে শুদ্র’ বলা হয়। তাহার পড়া ও তাহাকে পড়ান নিষ্ফল, আর তোমরা যে স্ত্রীলোকদের বেদপাঠ করিতে নিষেধ করিতেছ তাহা তোমাদের মূর্খতা, স্বার্থপরতা এবং নির্বুদ্ধিতার প্রভাব। কন্যাদের বেদ পাঠ সম্বন্ধে প্রমাণ– ব্রহ্মচয়েণ কন্যা৩য়ুবানং বিন্দুতে পতিম্ ॥ অথর্ব ১১।৩।১৮

    যুবক যেরূপ ব্রহ্মচর্য সেবন দ্বারা পূর্ণ বিদ্যা এবং সুশিক্ষা লাভ করিয়া যুবতী বিদূষী স্বীয় অনুকূল প্রিয় [তৎ] সদৃশ স্ত্রীকে বিবাহ করে, সেইরূপ (কন্যা) কুমারী (ব্রহ্মচয়েণ) ব্রহ্মচর্য সেবন দ্বারা বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং পূর্ব বিদ্যা ও উত্তম শিক্ষা লাভ করিয়া যুবতী অবস্থায় পূর্ণ যৌবনে নিজের সদৃশ প্রিয় এবং বিদ্বান্ (য়ুবান) পূর্ণ যৌবন সম্পন্ন পুরুষকে (বিতে) লাভ করুক। অতএব স্ত্রীলোকেরাও অবশ্যই ব্রহ্মচর্য পালন করিবে এবং বিদ্যাগ্রহণ করিবে।

    প্রশ্ন –স্ত্রীলোকেরাও কি বেদ পাঠ করিবে? উত্তর –অবশ্যই পাঠ করিবে। দেখ শৌত্রসূত্রাদিতে–ইমং মন্ত্রং পত্নী পঠেৎ’।

    অর্থাৎ স্ত্রী যজ্ঞে এই মন্ত্র পাঠ করিবে। যদি বেদাদি শাস্ত্র না পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে যজ্ঞে স্বর সহিত মন্ত্রোচ্চারণ এবং সংস্কৃত-ভাষণ কীরূপে করিতে পারিবে? ভারতীয় নারীদিগের ভূষণস্বরূপিণী গার্গী বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া পূর্ণ বিদুষী হইয়াছিল। ইহা শতপথ ব্রাহ্মণে’ স্পষ্ট লিখিত আছে।

    দেখ, যদি পুরুষ বিদ্বান্ এবং স্ত্রী অবিদুষী, অথবা স্ত্রী বিদুষী ও পুরুষ অবিদ্বান্ হয়, তবে নিয়ত ‘দেবাসুর’সংগ্রাম লাগিয়া থাকিবে, তাহাতে সুখ কোথায়? অতএব স্ত্রীলোকেরা অধ্যয়ন না

    করিলে বালিকাদিগের পাঠশালায় তাহারা অধ্যাপিকা হইবে কীরূপে? সেইরূপ রাজকাৰ্য্য, বিচার কাৰ্য, গৃহাশ্রমের কাৰ্য্য, পতি ও পত্নির পরস্পর পরস্পরকে প্রসন্ন রাখা এবং সমস্ত গৃহকর্ম স্ত্রীর অধীনে রাখা ইত্যাদি কর্ম, বিদ্যা ব্যতীত কখনও উত্তমরূপে সম্পাদিত হইতে পারে না।

    দেখ,–আৰ্য্যাবর্তের রাজপুরুষদের স্ত্রীগণ ধনুর্বেদ অর্থাৎ যুদ্ধ বিদ্যাও ভালভাবে জানিতেন। যদি তাঁহারা না জানিতেন তাহা হইলে দশরথ প্রভৃতির সহিত কৈকেয়ী প্রভৃতি যুদ্ধে কেমন করিয়া যাইতেন এবং যুদ্ধ করিতে পারিতেন। অতএব ব্রাহ্মণী কে সর্বপ্রকার বিদ্যা, ক্ষত্রিয়াকে সর্বপ্রকার । বিদ্যা এবং যুদ্ধ তথা রাজবিদ্যা বিশেষ, বৈশ্যাকে ব্যবহারবিদ্যা এবং শূদ্রাণীর রন্ধনাদি সেবাবিদ্যা অবশ্যই শিক্ষা করা উচিত।

    পুরুষদের পক্ষে যেরূপ ব্যাকরণ, ধৰ্ম্মশাস্ত্র এবং ব্যবহারবিদ্যা অন্ততঃপক্ষে কিছু কিছু শিক্ষা করা অবশ্য কর্ত্তব্য, সেইরূপ স্ত্রীদেরও ব্যাকরণ, ধৰ্ম্মশাস্ত্র, চিকিৎসা, গণিত এবং শিল্পবিদ্যা অবশ্যই শিক্ষা করা কর্তব্য। কারণ, সেই সকল বিদ্যা শিক্ষা না করিলে সত্যাসত্যের নির্ণয়, স্বামী ও অন্যান্য। সকলের প্রতি অনুকূল ব্যবহার, যথাযোগ্য সন্তানোৎপত্তি, সন্তানদিগের পালন–পোষণ ও সুশিক্ষাদান, গৃহের সকল কাৰ্য্য যথোচিত সম্পাদন ও পরিচালন, চিকিৎসা, বিদ্যানুযায়ী ঔষধবৎ খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুত করা ও করান যাইতে পারেনা। ইহাতে গৃহে কখনও রোগ প্রবেশ করিবে না ও সকলে আনন্দ থাকিবে।

    শিল্পবিদ্যা না জানিলে গৃহনির্মাণ করান, বস্ত্র ও অলঙ্কারাদি প্রস্তুত করা এবং করান,গণিতবিদ্যা। ব্যতীত সমস্ত হিসাব বুঝা ও বুঝান তথা বেদাদি শাস্ত্রজ্ঞান ব্যতীত ঈশ্বর ও ধর্মকে না জানিয়া অধর্ম হইতে রক্ষা পাওয়া অসম্ভব। অতএব যাঁহারা ব্রহ্মচর্য্য, সুশিক্ষা ও বিদ্যা দ্বারা নিজ সন্তানদের শরীর ও আত্মার বলবুদ্ধি করেন, তাঁহারই ধন্যবাদাহঁ, তাঁহারাই কৃতকৃত্য। অতএব তাহারা সন্তান, মাতা, পিতা, পতি, শ্বশুর, রাজা, প্রজা, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন এবং সন্তানাদির সহিত যথাযোগ্য ধর্মাচরণ করিতে সমর্থ হইবেন।

    বিদ্যা অক্ষয় ভাণ্ডার। ইহা যতই ব্যয়িত হইবে, ততই বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে। ব্যয় করিলে অন্য সমস্ত ধনভাণ্ডার কমিয়া যায় এবং উত্তরাধিকারিগণও উহা ইহতে নিজ নিজ অংশ গ্রহণ করে, কিন্তু চোর বা উত্তরাধিকারিগণ ইহা গ্রহণ করিতে পারে না, প্রজাবৰ্গ বিশেষতঃ রাজা এবং প্রজাবর্গ এই কোষের বৃদ্ধিকারী ও রক্ষক।

    কন্যান্যাং সম্প্রদানং চ কুমারাণাং চ রক্ষণম্ ॥ মনু ৭।১৫২

    রাজার উচিত বালক বালিকাদিগের উক্ত সময় হইতে উক্ত সময় পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য্যে রাখিয়া বিদ্বান করা। রাজার যদি কেহ অনুশাসন মান্য না করে তবে মাতা পিতা দণ্ডনীয় হইবে অর্থাৎ রাজার আজ্ঞানুসারে আট বৎসর বয়সের পর কাহারও পুত্র কন্যা গৃহে থাকিতে পারিবে না। কিন্তু তাহারা আচাৰ্য কুলে থাকিবে এবং সমাবর্তনের সময় না আসা পর্যন্ত বিবাহ করিতে পারিবে না।

    সর্বোমেব দানানাংব্ৰহ্মদানং বিশিষ্যতে ॥ বায়ম্নগোমহীবাসস্তিকাঞ্চনসর্পিষা ॥ মনু০ ৪। ২৩৩

    সংসারে জল, অন্ন, গো, ভূমি, বস্ত্র, তিল, সুবর্ণ এবং ঘৃতাদি যত প্রকার দান আছে, তন্মধ্যে। বেদ বিদ্যাদান অতিশ্রেষ্ঠ। অতএব কায়মনোবাক্যে যথাসম্ভব বিদ্যাবুদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা করা কর্তব্য। যে দেশে যথাযোগ্য ব্রহ্মচর্য্য বিদ্যা ও বেদোক্ত ধর্মের প্রচার হইয়া থাকে, সেই দেশই সৌভাগ্যবান্ হইয়া থাকে।

    ব্রহ্মচর্যাশ্রমের এই শিক্ষা সংক্ষেপে লিখিত হইল। অতঃপর চতুর্থ সমুল্লাসে সমাবর্তন এবং গৃহাশ্রমের শিক্ষা সম্বন্ধে লিখিত হইবে।

    ইতি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামিকৃতে সত্যার্থ প্রকাশে
    সুভাষাবিভূষিতে শিক্ষাবিষয়ে তৃতীয়ঃ
    সমুল্লাসঃ সম্পূর্ণ ॥ ৩

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশুনছ, কোথাও আছো কি কেউ?
    Next Article টোটেম ও টাবু – সিগমুন্ড ফ্রয়েড (ভাষান্তর : ধনপতি বাগ)
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.