Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সন্ধ্যা – কাজী নজরুল ইসলাম

    কাজী নজরুল ইসলাম এক পাতা গল্প46 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    যৌবন

    যৌবন

    দুনিয়াখানা যৌবনের বশ।

    এক বুড়ো প্রায়ই আক্ষেপ করত, আর বলো কেন ভায়া, দুনিয়া তার যৌবন যার।

    ছেলেবেলায় এই যৌবনটির জন্য ভিতরে ভিতরে একটা লোভনীয় প্রতীক্ষা ছিল। বোধহয় সকলেরই থাকে। কিন্তু সময়ের বেড়া বাঁধা এই রম্য বাগিচায় পা ফেলার পর তার অনেক চটক চোখে পড়ে না। যাই হোক, ওই দুর্লভ গণ্ডীর মধ্যে বিচরণকালে তার মহিমা সম্পর্কে আমি নিজে অন্তত ধ্ব সচেতন ছিলাম না।

    ক্রমে প্রৌঢ় ব্যবধানে সরে আসার পর আজ আবার সকৌতুকে চেয়ে চেয়ে দেখছি, যৌবন চটকদার বস্তু বটে। শুধু তাই নয়, দি ওয়ার্লর্ড ইজ ফর দি ইয়ং–সেই বুড়োর ভাষায়, দুনিয়া তার যৌবন যার।

    এক নামজাদা দার্শনিক বলে গেছেন, যৌবন অনেক সময় কাণ্ডজ্ঞানশূন্য, কিন্তু কদাপি ধী-শূন্য নয়। সর্বকৃত্রিমতার ওপর তার তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি–সে ধোঁকা বা ফাঁকি ধরতে জানে। কিন্তু আজকের বাস্তব দুনিয়ার দার্শনিক এই বাসি প্রসঙ্গ নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাবেন কিনা সন্দেহ। তিনি বরং উত্তর-যৌবন সম্পর্কে কিছু দর্শন বচন। শোনাতে পারেন। কারণ এ-যুগের এটাই বড় সমস্যা।

    কেন?

    কারণ দি ওয়ার্লর্ড ইজ ফর দি ইয়ং। যৌবন যার দুনিয়া তার। এতে দ্বিমত কেউ নয়।

    অতএব আজকের দার্শনিক বলেন যদি কিছু, যৌবনের বদলে সম্প্রসারিত যৌবনের কথা বলবেন। অর্থাৎ কাল ফুরালেও যে যৌবনের বহিরঙ্গ অনেক কাল পর্যন্ত অটুট রাখা যায়–তার কথা। আর বলবেন বোধ হয় একেবারে উল্টো কথাই। বলবেন, টেনে বাড়ানো এ যৌবন ধী-শূন্য যদিবা, কাণ্ডজ্ঞানশূন্য কদাপি নয়। সর্বকৃত্রিমতা আড়াল করার প্রতি তার তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিধোঁকা আর ফাঁকি তার একমাত্র পুঁজি।

    খবরের কাগজে সেদিন একটা কার্টুন দেখে আপনারা অনেকে হাসাহাসি করেছেন জানি।…এক ভিড়ের ট্রাম থেকে একজন মহিলা নেবে যাচ্ছেন, তার চুলের (পরচুলের) বোঝা এক ভদ্রলোকের ছাতায় আটকে আছে, আর ভদ্রলোক তাকে চেঁচিয়ে ডাকছেন, ও ম্যাডাম, আপনার সব চুল যে আমার ছাতায় আটকে থাকল, নিয়ে যান, নিয়ে যান! ২০০

    যাঁরা হেসেছেন তারা হেসেছেন, কিন্তু আমার ধারণা, যদি কোনো ম্যাডামের বরাতে অমন দুর্দৈব ঘটেই, তার পুঁজি খোয়ানোর দুঃখে আজকের দিনে কাদবার লোকেরও অভাব হবে না।

    যাক, আমি কোনো গুরু-গম্ভীর তত্ত্ব বিস্তারে বসিনি। যৌবন আগলে রাখার প্রেরণা বা তাড়নার বহু বিচিত্র নজির সকলেই হামেশা দেখছেন। অবকাশ সময়ে আমিও দেখি। আমার দেখার রঙ্গপট একটি হাল-ফ্যাশনের চুলছাটার সেলুন। নাম প্রসাধনী। প্রসাধনীর হেড কারিগর যে, মালিকও সেই। নাম অমল, বয়েস এখন তিরিশ-বত্রিশ হবে। চৌকস চটপটে ছেলে। আমি তাকে গত বারো বছর ধরে দেখছি। তখন বাড়িতে এসে চুল ছেটে দিয়ে যেত। নিজের উদ্যমে দোকান করেছে, তারপর কবছরের মধ্যে সেটাকে এমন ঝকঝকে করে তুলেছে। আশপাশের দুটো সেলুন কমপিটিশনে টিকতে না পেরে উঠে গেছে। তাদের বাছাই-করা তিনটি কারিগর প্রসাধনীতে কাজ পেয়েছে। অমলের আশা অদূর ভবিষ্যতে সেলুনটাকে সে এয়ার কণ্ডিশন করে ফেলতে পারবে। আর তার একটা বড় খেদ, এ লাইনে একটিও দিশি মেয়ে-কারিগর মেলে না। তাহলে আলাদা একটু পার্টিশন করে মেয়েদের ব্যবস্থাও রাখত। দোকান জমজমাট হত তাহলে। এ তো আর সাহেব-পাড়ার দোকান নয় যে মেয়েরা এসে পুরুষ কারিগরের হাতে। চুলের বোঝা ছেড়ে দেবে! মেয়েরা না থাকলে কোনো ব্যাপারই ঠিক কমপ্লিট হয় না, কী বলেন সার?

    ওর হাত যেমন চলে, রসালো জিভখানাও তেমনি অবিরাম নড়ে। আমাকে দেখলে আরো বেশি নড়ে। গল্প উপন্যাস লিখি ও জানে। একটু-আধটু পড়ে। তাই দেখামাত্র অন্য। খদ্দেরদের শুনিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। তারপর সোৎসাহে বলে, আপনার অমুক লেখাটা পড়ছি স্যার। ওমুক বইটা খুঁজছি, বা আপনার ওমুক ছবিটা দেখলাম, হাই ক্লাস!

    গোড়ায় গোড়ায় বিড়ম্বনা বোধ করতাম, বিরক্তও হতাম। কিন্তু ও সেটাও খুব। সহজেই বুঝত। তাই ফাঁক পেলেই গলা খাটো করে বলত, কিছু মনে করবেন না। স্যার, এরকম বললে আপনার তো কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু আমার বড় উপকার। হয়–কতজন এসে আপনার কথা জিজ্ঞেস করে আপনি জানেন না স্যার।

    প্রসাধন-কলা ছেড়ে তোষামোদ-কলাতেও লোকটা যে কম পটু নয়, এ বোধহয়। ওর শত্রুও স্বীকার করবে।

    ওর বচনের জ্বালায় হোক বা ভিড় এড়ানোর জন্যে হোক, ইদানীং প্রতি মাসে। আমি রাত্রের নিরিবিলিতে আসি। তখনো যে খদ্দের একেবারে থাকে না এমন নয়, তবু অপেক্ষাকৃত কমই থাকে। যাই হোক, এখান থেকে মানুষের যৌবনপ্রীতির অনেক সকৌতুক নজির আমি দেখছি। আর এই দেখাটুকু লক্ষ্য করেই অমল খদ্দেরদের অনেক মজাদার কাণ্ডকারখানা আমাকে শোনায়। এই নিয়ে আমি একবার একটা হাসির গল্প। লিখেছিলাম। এরপর থেকে ওকে আর পায় কে! রসদ যোগাবার তরল আনন্দে ও আপনা থেকেই মুখর হয়ে ওঠে।

    সেদিন রাত নটা নাগাদ গিয়ে দেখি, অমলের দোরে ঝকঝকে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। ভিতরে অমল অপরিমিত মনোযোগ সহকারে এক সৌখিন ভদ্রলোকের চুলে কলপ লাগাচ্ছে। বলতে ভুলে গেছি, সাদা চুল পরিপাটিভাবে তকতকে কালো করাটাও প্রসাধনীর এক বড় আকর্ষণ। অমল বলে, এ কাজে ও স্পেশ্যাল ট্রেনিং নিয়েছে। চুল কালো করার মাশুল দু-টাকার থেকে পাঁচ টাকা–অর্থ্যাৎ খদ্দের বুঝে যেমন আদায় করা যায়। ব্যাপার লক্ষ্য করেছি প্রায় একই, শুধু একটু যত্ন-আত্তি আর তোষামোদের যা তফাত।

    ভদ্রলোককে দেখে আর অমলের সুতৎপর তন্ময় মনোযোগ দেখে বুঝলাম, পাঁচ টাকার খদ্দের তো বটেই, বেশিও হতে পারে। ভদ্রলোকের বয়েস ষাটের কাছাকাছি। মোটামুটি সুপুরষ। হাতে সোনার ঘড়ি, আঙুলে মুক্তো আর নীলার আংটি, জামায় হারের বোতাম।

    ভদ্রলোকের চুল কতটা সাদা ছিল সঠিক বোঝা গেল না। কারণ কলপ-বিন্যাসপর্ব প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। এখন অমল যা করছে সেটা বাড়তি। স্ফীত অঙ্কের কিছু প্রাপ্তির আশা তার। আমাকে দেখেই চোখের ইশারায় একটু অপেক্ষা করতে বলল, এবং অন্য কারিগর আমার দিকে এগিয়ে আসতে ইশারায় তাকেও নিষেধ করল। অর্থাৎ হাত খালি হলে সে নিজেই কাজ ধরবে বুঝলাম, আমাকে শোনানোর মতই কিছু রসদ তার কাছে জমা আছে।

    আরো মিনিট দশেকের মধ্যে ওদিকের কেশবিন্যাস শেষ। অমল তাড়াতাড়ি এগিয়ে। গিয়ে পুশ-ডোর ঠেলে দাঁড়িয়ে আরো একটু বাড়তি সম্ভ্রম দেখালো। ভদ্রলোক পকেট থেকে বড়সড় মানিব্যাগ বার করতে করতে পুশ-ডোরের ওধারে চলে গেলেন।

    দরজা ঠেলে অমল আবার ফিরে আসতে দেখি চাপা খুশিতে তার মুখখানা ডগমগ করছে। হাতের দশটাকার নোটখানা ভাজ করে কাঠের বাক্সে রাখতে রাখতে সামনের দেয়াল-ঘড়িটার দিকে তাকালো একবার। তারপর দ্বিতীয় কর্মচারীটিকে বলল, সাড়ে নটা বেজে গেছে, এই রাতে আর কেউ আসবে না, তুমি যাও।

    আমার গলায় বুকে কাপড়ের এপ্রন জড়িয়ে চিরুনি কাচি হাতে পিছনে এসে। দাঁড়াল।–স্যার, এই যে ভদ্রলাকটি চলে গেলেন…চিনলেন?

    কাঁচি চলছে, মাথা নাড়ার উপায় নেই, বললাম, না।

    –মস্ত লোক, আপনার তো চেনার কথা। জণ্ড দত্ত…থিয়েটার কোম্পানীর মালিক।

    নামটা চেনা। ওই রাজ্যের মস্ত লোকই বটে।–তোমার খদ্দের হয়েছেন?

    –হ্যাঁ, দুমাস ধরে। পাকা হাতের কলপ মাসে একবার লাগালেই চলে, কিন্তু উনি পনের দিন অন্তর অন্তর আসছেন–এই দুমাসে চারবার এলেন।

    আমি নিরীহ প্রশ্ন ছুঁড়লাম, কেন, চুল খুব বেশি সাদা?

    –সাদাই বটে, তবে ভয়ে আর অশান্তিতে ভেতরটা আরো বেশি সাদা, বুঝলেন?

    পরের বিশ মিনিটের মধ্যে বুঝতে আর কিছু বাকি থাকল না। অমল বেশ রসিয়ে সাদা চুলের ভয় আর অশান্তির ব্যাপারটার বিস্তার শুরু করল। তার সারমর্ম: জঙ দত্তর বয়েস এখন ষাট ছুঁয়েছে। তার চারটে বাড়ি তিনটে গাড়ি আর অঢেল টাকা। অবস্থাজনিত আনুষঙ্গিক গুণাবলীও আছে। তার মধ্যে একটি সত্যিকারের গুণও অস্বীকার করা যায় না। নিজের একটি ছোট ভাই আছে, নাম সুবল দত্ত-কম করে কুড়ি বছরের ছোট তার থেকে। এই ভাইটিকে বাপের মত মানুষ করেছেন তিনি, সত্যিই ভালবাসেন তাঁকে। বিষম গোল বাধল প্রিয়বালা আসার পর থেকে।

    –প্রিয়বালাকে দেখেছেন নিশ্চয় স্যার! ওঃ। স্টেজে ঢোকে যখন সে তামাম হলখানার হাওয়া বদলে যায়!

    দুমাস হল প্রিয়বালা জগুবাবুর থিয়েটারে যোগ দিয়েছে। পশ্চিমের ডাটালো মেয়ে, আগে কেউ তাকে কলকাতার কোনো থিয়েটারে দেখেনি। সেই থেকে জগুবাবু অমলের খদ্দের।

    ওই প্রিয়বালা জগুবাবুর চোখের মণি। বাড়ি-ঘর ছেড়ে দিনরাত তার কাছেই পড়ে থাকতেন। কিন্তু ফ্যাসাদ বাঁধল আদরের ছোট ভাই সুবল দত্তকে নিয়ে। সেও প্রিয়বালার প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেতে লাগল। ফলে রাগে দুঃখে নিজের মাথার চুল ছেড়েন জগু দত্ত। ষাট বছরের সঙ্গে চল্লিশ বছরের রেষারেষি। ওদিকে উদার হয়ে। ভাইটিকে বেশ একটা মোটা অঙ্কের টাকা অনেক আগেই দিয়ে বসেছিলেন। তার বিষ-গাছ গজাচ্ছে এখন। শোনা যাচ্ছে, সেই টাকা দিয়ে সুবল দত্ত প্রিয়বালাকে নিয়ে আলাদা থিয়েটার খুলবে।

    –জগু দত্তর বন্দুক আছে স্যার, বুঝলেন। আর তার মাথায়ও রক্ত চড়েই আছে। একবার ভাবেন, ভাইকে গুলী করে মারবেন, আর একবার ভাবেন প্রিয়বালাকে।

    …আমার মনে হয়, ওই বন্দুক দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক নিজের মাথারই খুলি ওড়াবেন…কি বলেন স্যার?

    আমি কিছু বলিনি। কিছুদিন বাদে ভেবে-চিন্তে আর রাখা-ঢাকা করে একটা মামুলী গল্প লিখেছিলাম। সেই প্রেমের গল্পে ষাট বছরের সঙ্গে চল্লিশ বছরের রেষারেষিতে স্থল দৃষ্টিতে চল্লিশ বছরকেই জিতিয়ে দিয়েছিলাম বটে, কিন্তু সূক্ষ্ম বিচারে হৃদয়ের দিক থেকে ষাট বছরই অনেক বড় হয়ে উঠেছিল।

    গল্পটা অমলের আদৌ পছন্দ হয়নি। সে বলেছে, এটা কি করলেন স্যার, ষাট বছর ওই অভিনেত্রীর জন্য তার চারটে বাড়ি আর তিনটে গাড়ির একটা করে খসালেই তো অনায়াসে তাকে হাতের মুঠোয় পুরতে পারত! আর জণ্ড দত্ত যদি কোনদিন জানতে পারে এই গল্পের খোরাক আমি জুগিয়েছি, আমাকে একেবারে জ্যান্ত পুঁততে চাইবে।

    ভাবলাম, ষাট বছর জিতলে ও বোধহয় মোটা বকশিশই পেত তাঁর কাছ থেকে।

    মাস দুই পরের কথা। প্রসাধনীতে চুকে সেই রাতে বিপরীত গোছের দৃশ্য দেখলাম। অর্থাৎ যেমনটি সচরাচর দেখা যায় না। রাতের নিরিবিলিতে মাথার একরাশ শনের মত সাদা চুল কালো করতে বসেছে নিতান্ত ক্লিষ্ট চেহারার একটি লোক। গায়ের রং রোদে-পোড়া কালচে-কপালের দুদিকে ফুটে ওঠা নীল শিরা দুটো দূর থেকে দেখা যায়। সর্বাঙ্গে দারিদ্র্য আর মেহেনতের ছাপ। পরনে তেলচিটে খাকি হাফপ্যান্ট, গায়ে বিবর্ণ একটা ফতুয়া। তবু বয়েস যাই হোক, দেহের কাঠামো তেমন শীর্ণ নয়।

    – এ-হেন মূর্তির মাথার সাদা চুল কালো করার তাগিদটা ভারী অদ্ভুত লাগল। অমল তার ঝাকড়া চুলের মাথাটা নিজের দু-হাতের দখলে টেনে এনে গজগজ করে উঠেছে–স্থির হয়ে বসুন, অত ছটফট করলে কালোর ভেতর দিয়ে অনেক সাদা। চুল দাঁত বার করে হাসবে। এই সরব-দৃশ্যে আমার পদার্পণ।

    অমল বিব্রত মুখ করে বলল, একটু বসুন সার, ভোলা চা খেতে গেছে, এলো। বলে—

    ওর হাত জোড়া থাকলে ভোলাই আমার চুল কেটে থাকে। আমি মাথা নেড়ে অদূরে বসে সকৌতুকে অমলের ওই খদ্দেরটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। অমল সেটা লক্ষ্য করল এবং বার দুই-তিন আমার দিকে ফিরে তাকালো। বিরক্তি গিয়ে তার চোখেও বেশ সরস কৌতুক নেচে উঠেছে। সাদা চুলের গোছায় হাত চলাতে চালাতে সামনের আয়না দিয়ে লোকটার মুখখানা ভালো করে দেখছে আর চাপা খুশিতে দাঁতে করে নিজের ঠোঁটের কোণ কামড়াচ্ছে। এবারেও গল্প আছে কিছু, হাবভাবে অমল যেন সেটাই আমাকে বোঝাতে চাইছে।

    ভোলা আসতেই গম্ভীর মুখে অমল তাকে ডাকলো, এই এদিকে আয়, এঁর কাজটা ধর–খুব ভালো করে বানিয়ে দিবি, চুল দিয়ে কালো জেল্লা বেরোয় যেন

    সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে বলল, কিছু ভাবনা নেই মশায়, ও আমার থেকে অনেক ভালো কাজ করবে–জাপান থেকে চুল কালো করার ট্রেনিং নিয়ে এসেছে।

    সংশয়-ভরা চোখে লোকটা একবার ভোলার দিকে তাকালো শুধু। কোনরকম প্রতিবাদ করল না।

    অমল সোজা এগিয়ে গিয়ে লম্বা ঘরের ওধারের কোণের একেবারে শেষ চেয়ার আর আয়নার সামনে গিয়ে আমাকে ডাকল, ইদিকে আসুন স্যার

    উঠে গেলাম। এই ব্যবধান রচনার উদ্দেশ্য বুঝেও বললাম, ওকে ছেড়ে এলে কেন, ভোলাই তো কাটতে পারত

    আমার গলায় চাদর জড়াতে জড়াতে অস্ফুট একটা শব্দ বার করল গলা দিয়ে। তারপর চাপা ব্যঙ্গস্বরে বলল, দুটাকা রেট, দুদিন রাতদুপুরে এসে দরকষাকষি করে আজ দেড় টাকায় কাজ সেরে যাচ্ছে।

    আমি ফিসফিস করে বলে উঠলাম, এমন অবস্থায় চুল কালো করার সখ!

    –প্রাণের দায় যে। চুলে ক্লিপ চালিয়ে খাটো গলায় অমল লঘু উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করল, যেখানে মেয়েমানুষ সেখানেই গোল, বুঝলেন স্যার! খুব মজার ব্যাপার…আপনাকে বলব বলেই এদিকে নিয়ে এলাম…কিন্তু লিখতে গেলে এবারে আপনার পক্ষেও খুব মুশকিল হবে–

    আড়চোখে যতটুকু সম্ভব ঘাড় ফিরিয়ে একবার লোকটার ওধারের দিকে তাকালাম। কোনো দিকে হুশ নেই, তন্ময় আগ্রহে আয়নায় নিজের সাদা চুলের ওপর ভোলার হাতের কসরৎ দেখছে।

    চুলে কাঁচি চালাতে চালাতে অমল তেমনি চাপা গলায় আর চাপা আনন্দে মজার ব্যাপারটা বলে গেল।লোকটা কলে কাজ করে, আর বয়েস তো দেখতেই পাচ্ছেন। ঘরে একগাদা ছেলেপুলে, নিজের প্রথম পরিবার অনেক আগেই খতম হয়েছিল। ওর বড় জোয়ান ছেলেটাকেও মিলে ঢুকিয়ে তার বিয়ে দেবার চেষ্টায় এগিয়েছিল। কিন্তু ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে নিজেরই মুণ্ডু ঘুরে গেল–চালাকি করে ও ব্যাটা নিজেই তাকে বিয়ে করে বসল। তারপর থেকেই বিষম ফ্যাসাদ। বাপে-ছেলেয় সাপ-বেজির সম্পর্ক, আর ওই ছেলের দিকেই বউটার গোপন টান।

    …হবে না তো কি, বউটাকে তো আমি স্বচক্ষে দেখেছি–প্রথম দিন ওকে দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে আমার সঙ্গে চুল কালো করার দরদস্তুর করতে এসেছিল। বড় ছেলেকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েও বউকে বিশ্বাস করে না বলেই সঙ্গে এনেছিল নিশ্চয়। তখন দেখেছি। কালো পাথরে কোঁদা চেহারা–সর্বঅঙ্গে স্বাস্থ আর ইয়ে যেন চুঁইয়ে পড়েছে। এই বুড়ো অমন মেয়েমানুষ বশে রাখবে কী করে!

    আমি নীরব শ্রোতা। একটু চুপ করে থেকে তেমনি খাটো গলায় অমল যেন প্রায় শ্লেষে কেটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মারল। কিন্তু এবারে লিখলে বুড়োর বদলে আপনি ওই ছোঁড়াটাকে জেতাবেন কী করে–মা-ছেলে সম্পর্ক যে!

    জবাব দিইনি। লেখারও বাসনা ছিল না।

    কিন্তু তা হবার নয় বলেই বোধহয় দেড় মাস বাদে এই রঙ্গমঞ্চে আবার এক রাতে এই বুড়োর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা দেখা। আরো ক্লিষ্ট আরো ঝড়ো মূর্তি। অমলের হাতে তার চুল কালো করার কাজ চার ভাগের তিন ভাগ শেষ।

    অতএব ভোলা এসে আমার মাথা দখল করল। আর সেই দখল ছাড়ার মিনিটখানেক আগে ট্র্যাক থেকে সন্তর্পণে খুচরা পয়সা গুনে অমলের হাতে দিয়ে বুড়ো প্রস্থান করল।

    আমি বাইরে এসে দেখি অদূরের লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে ফতুয়ার পকেট থেকে একটা ক্ষুদে আয়না বার করে বুড়োটা নিবিষ্টমনে তার কালো পালিশ-করা চর্চকে চুল পর্যবেক্ষণ করছে। ঘরের অত আলোতে দেখেও সে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারেনি।

    পাশ কাটাতে গিয়েও আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। গম্ভীর অথচ লঘু বিদ্রুপের সুরে বলে ফেললাম, চমৎকার হয়েছে, কেউ বুঝতে পারবে না।

    অবাক চোখে লোকটা ঘুরে দাঁড়ালো, তারপরেই মুখে বোকা-বোকা হাসি।-হা হুজুর…তবে বড় খরচ।

    হুজুর শুনে হোক বা খরচের কথায় বিমর্ষ শুকনো মুখ দেখে হোক, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম কী?

    –আজ্ঞে কার্তিক দোলুই। এত কাছ থেকে মুখখানা যেন আরো ক্লিষ্ট বিমর্ষ লাগছে। আমার মনের অগোচরে কোনো খটকা লেগেছিল কিনা জানি না।–এখানে থাকো কোথায়?

    –ফুটপাথে।

    –আমি অবাক! আর কে থাকে?

    –এখানে কেউ থাকে না হুজুর, বউ আর বাল-বাচ্চারা দেশে থাকে।

    সত্যিই খটকা লাগছে।–দেশ কোথায়?

    আমাকে সদয় ভেবেই লোকটার বিষণ্ণ মুখে কৃতজ্ঞতার আভাস।–মেদিনীপুর।

    –তা অত খরচ করে পাকা চুল কালো করবার দরকার কী?

    দুটো গর্তের করুণ দৃষ্টিটা আমার মুখের ওপর থমকালো।–কী করব, পেটের দায়–ভিক্ষে করতে মন সরে না।

    -কেন? কী করো তুমি?

    –আজ্ঞে হুজুর রিকশা টানি।…আমার সাদা চুল দেখে কেউ আমার রিকশায় উঠেতে চায় না, সব জোয়ানদের রিকশায় ওঠে।

    কপালে হাত ঠেকিয়ে সেলাম করে লম্বা শ্রান্ত দেহটা টেনে টেনে লোকটা চলে যাচ্ছে।

    লাইটপোস্টের নাচে আমি হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরিক্তের বেদন – কাজী নজরুল ইসলাম
    Next Article দোলনচাঁপা – কাজী নজরুল ইসলাম

    Related Articles

    কাজী নজরুল ইসলাম

    অগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    চক্রবাক – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    ভাঙার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    বাঁধনহারা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    মৃত্যুক্ষুধা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    দোলনচাঁপা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }