Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প712 Mins Read0

    রোমাঞ্চকর বন্দুক

    রোমাঞ্চকর বন্দুক

    হলধরদা নাক-টাক কুঁচকে আমাকে বলল, কেন পেছনে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছিস প্যালা! এসব বন্দুক ছোঁড়া তোর কাজ নয়। রীতিমতো বুকের পাটা চাই–গায়ের জোর চাই। ওই পালাজ্বরের পিলে নিয়ে ধাষ্টামো করতে চেষ্টা করিসনি প্যালা–মারা যাবি, স্রেফ বেঘোরে মারা যাবি।

    হলধরদার লেকচার শুনে আমার গা জ্বলে গেল। ইস–নিজে কী একখানা গামা পালোয়ান রে। রোগা ডিগডিগে শরীর–ঘাড়টা সব সময়ে ঝুঁকে রয়েছে সামনের দিকে। সম্পত্তির মধ্যে খরগোশের মতো দুটো খাড়া কান–তাদের একটার ওপর আবার জড়ুল–যেন মাছি বসে আছে। গলায় সর্বজ্বরহর মাদুলি দুলছে, সেটার রং কালো, মনে হয় একটা পকেট-ডিকশনারি ঝুলিয়ে রেখেছে। আমার তো তবু পালাজ্বর; ম্যালেরিয়া জ্বর, ডেঙ্গু জ্বর কী নেই হলধরদার?

    ইচ্ছে করলে আমি হলধরদাকে এক্ষুনি ল্যাং মেরে ফেলে দিতে পারি। নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু তা হলে হলধরদার বন্দুকটা আর হাতে পাওয়া যাবে না। কাজেই গায়ের ঝাল গায়ে মেরে বললাম, সে তো বটেই। তোমার মতো জোয়ান লোকের হাতেই তো বন্দুক মানায়। রোজ সকালে তুমি পাঁচশো করে ডন-বৈঠক দাও, আধসের করে ছোলা খাও–তোমার নাম শুনলে ভীম-ভবানী পর্যন্ত দৌড়ে পালায়…

    শুনে, হলধরদা কিছুক্ষণ কটকট করে আমার দিয়ে চেয়ে রইল।

    –ইয়ার্কি দিচ্ছিস নাকি?

    বললাম, সর্বনাশ, একে তুমি সাক্ষাৎ হলধরদা, তায় তোমার হাতে বন্দুক। তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি দিয়ে কি শেষে পৈতৃক প্রাণটা খোয়াব?

    হলধরদা বললে, হঁ! তারপর হনহন করে আমবাগানের দিকে হাঁটতে শুরু করে দিলে।

    আমিও সঙ্গ ছাড়ি না। গুটিগুটি পায়ে পেছনে চলেছি তো চলেইছি। একটা বন্দুক কিনে কী ডাঁটই হয়েছে হলধরদার–আমাদের আর মানুষ বলেই গ্রাহ্য করে না। অথচ লোকটা কী অকৃতজ্ঞ দ্যাখো একবার। এই সেদিনও ঠাকুরমার ঘর থেকে আমসত্ত্ব আর আচার চুরি করে এনে ওকে খাইয়েছি, কথা ছিল বন্দুক কিনলেই আমাকে একবার ছুঁড়তে দেবে। কিন্তু নাকটাকে এখন সোজা আকাশের দিকে তুলে হাঁটছে–আমাদের যেন চিনতেই পারছে না।

    হলধরদা পেছন ফিরে তাকাল।

    –ও কি, আবার সঙ্গে আসছিস যে?

    আমি কান চুলকে বললাম, না না, এমনিই। মানে, তুমি যখন পাখি-টাখি মারবে, তখন সেগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে একজন লোকও চাই তো! সেইজন্যেই সঙ্গে যাচ্ছি।

    –গোলমাল করবি না?

    –না।

    –পাখি উড়িয়ে দিবি না?

    রামচন্দ্র! পাখি ওড়ালে তুমি আমার কান উড়িয়ে দিয়ো।

    –শিকারের ভাগ চাইবি নাকি?

    ছিঃ ছিঃ! তুমি মারবে পাখি–তাই দেখেই আমার স্বর্গীয় আনন্দ! তুচ্ছ ভাগের কথা কেন তুলছ হলধরদা? মনে মনে বললাম, তুমি যা পাখি মারবে সে তো আমি জানিই! সব বাসায় গিয়ে মরে থাকবে।

    হলধরদার বোধহয় এতক্ষণে আমার ওপর একটুখানি করুণা হল।

    –ইয়ে, কথাটা কী জানিস? ছেলে তুই নেহাত খারাপ নোস–সে আমি জানি। একবার তোকে বন্দুক ছুঁড়তে দিতেও আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু তোর তো ওই পালাজ্বরের পিলে হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে যদি উড়ে যাস–

    কীসের ধাক্কা? কোথায় উড়ে যাব?

    –এ, তুই একটা ছাগল। কিছু জানিসনে। বন্দুক ছোড়বার সময় পেছন দিকে একটা ভয়ঙ্কর ধাক্কা লাগে। সে ধাক্কায় যারা রোগা-পটকা তারা যে কে কোথায় ছিটকে পড়ে কেউ বলতে পারে না। বলে ডিগডিগে পালোয়ান হলধরদা সগর্বে নিজের বন্দুকের দিকে তাকাল।

    –তাই নাকি?

    -হেঁ হেঁ–তবে আর বলছি কী! সেবার গোয়ালন্দে বুঝলি, একটা রোগা-পটকা সায়েব বন্দুক নিয়ে চখাচখি মারতে গিয়েছিল। যেই ধ্রাম করে গুলি ছুঁড়েছে, তার পরেই কী হল বল তো?

    –তুমিই বলো। আমি তো কখনও গোয়ালন্দে যাইনি।

    –যাসনি? তা হলে তোর বেঁচে থাকাই মিথ্যে। ঢাকার ইস্টিমারও দেখিসনি? সে এক পেল্লায় ব্যাপার। তোদের কলকাতার চাঁদপাল ঘাটের জাহাজগুলো তার কাছে একেবারেই তুচ্ছ।

    –তা হোক তুচ্ছ।–আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, ধ্রাম করে গুলি ছোঁড়ার পরে কী হল তাই বলো।

    –হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই বলছি। গুলি ছুঁড়েছে, ধোঁয়া বেরিয়েছে সবই হয়েছে। কিন্তু সায়েবের আর পাত্তা নেই। বন্দুক, টুপি, সব পড়ে রয়েছে, শুধু সায়েবই নেই। নেই তো নেই–কোত্থাও নেই। একেবারে বেমালুম ভ্যানিশ!

    ভ্যানিশ! নিজের গুলিতে নিজেই উড়ে গেল বুঝি?

    –থাম না–কেন বাজে বকছিস? সায়েব তো নেই। চারদিকে হইচই। থানা, পুলিশ, টেলিগ্রাম, ফৌজ–সে এক কাণ্ড! ওদিকে মেমসাহেবের ঘন ঘন ফিট হচ্ছে। শেষে সেই সায়েবের পাত্তা পাওয়া গেল পদ্মার ওপারে। বালুচরের ওপর দাঁতকপাটি লেগে পড়ে রয়েছে। তিন দিন পরে তার জ্ঞান আসে। বন্দুকের এক ধাক্কাতেই পদ্মা পেরিয়ে গেল–নৌকোয় চড়লে না, স্টিমারে চড়লে না, কিছু না! এরই নাম বন্দুক ছোড়া বুঝলি? বলে হলধরদা আমার মুখের দিকে তাকাল, খাড়া নাক কান দুটো পর্যন্ত নড়ে উঠল তার।

    ইস, কী বোম্বাই চালটাই দিলে। বলতেও যাচ্ছিলাম সে কথা, কিন্তু বুদ্ধি করে সামলে নিলাম। খামকা চটিয়ে লাভ কী? বন্দুকটা একবার হাতে পাওয়ার আশা এখনও ছাড়িনি।

    হলধরদা বললে, নেঃ রাস্তার মধ্যে আর বকিসনি। সঙ্গে যাবি তো চল। কিন্তু আগেই সাবধান করে দিচ্ছি–যদি পাখি উড়িয়ে দিস

    তা হলে বন্দুকের ঘায়ে আমাকে সুদ্ধ উড়িয়ে দিয়ো–আমিই বলে দিলাম শেষটা।

    আমবাগানের মধ্যে দিয়ে টিপি-টিপি পায়ে দুজনে চলেছি। বন্দুক বাগিয়ে হলধরদা পাখি খুঁজছে। আর আমি যথাসাধ্য ওকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছি।

    হঠাৎ আমি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলাম : হলধরদা, ওই যে একজোড়া ঘুঘু!

    কই, কোথায়? বলে আরও চেঁচিয়ে উঠল হলধরদা!

    ব্যস, আর দেখতে হল না। সেই চিৎকারেই ঘুঘু দুটো উড়ে পালাল। হলধরদা রুখে দাঁড়াল আমার দিকে।

    –চ্যাঁচালি যে?

    –চ্যাঁচালাম কই? তোমাকে তো পাখি দেখালাম।

    –তাই বলে চ্যাঁচাবি? অমন গাধার মতো ডাক ছাড়বি?

    বাঃ রে, তুমিও তো ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলে। তাই তো পালিয়ে গেল।

    –এঃ, ভারি ভুল হয়ে গেছে। হলধরদা টাকটা চুলকে নিলে; তোরই দোষ। তুই চেঁচিয়ে উঠেই আমাকে এমন ঘেবড়ে দিলি যে কেমন সব গোলমাল হয়ে গেল। শোন–এর পরে পাখি দেখলে আর চ্যাঁচাবি না।

    -তবে কী করব?

    –এই, একটা খোঁচা-টোঁচা, কিংবা একটা চিমটি–বুঝেছিস তো?

    বিলক্ষণ! এ বুঝতে আর বাকি থাকে। আমি পটলডাঙার প্যালারাম, চিমটি কাকে বলে টেনিদার দৌলতে তা ভালোই বুঝি। সানন্দে মাথা নাড়লাম।

    আরও খানিকটা এগিয়ে হলধরদা বললেন : এঃ, আবার ভুল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে তো হাঁটা চলবে না। হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে।

    বলো কী! চারদিকে কাঁটা, বিছুটি–তার মধ্যে হামাগুড়ি দিতে হবে?

    –তুই শিকার করতে এসেছিস, না মোগলাই পরোটা খেতে এসেছিস? হলধরদা ভেংচি কাটল; অত আরাম চলবে না। নে–হামা দে। এইটেই নিয়ম। আমি অনেক শিকারিকে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে দেখেছি।

    –শিকার সামনে না থাকলেও হামা দিতে হবে?

    হ্যাঁ, দিতে হবে। বেশি বকিসনি প্যালা, যা বলছি তাই কর।

    ইঃ, এ আবার কী ফ্যাচাং রে বাপু! আর সেই আমবাগানে হামা দেওয়া কি চারটিখানি কথা! তিন হাত না-যেতেই হাঁটুর ছাল যাবার জো। কেটে পড়া দরকার কি না ভাবছি, তার আগেই লাফিয়ে উঠল হলধরদা : উরে-বাপ-গেছি গেছি!

    বলে বন্দুকটা নামিয়ে প্রাণপণে পা চুলকোতে লাগল।

    কী হল?

    বিছুটি। ইস কী জ্বলছে রে! দাঁতমুখ খিঁচিয়ে এমনভাবে পা চুলকে চলল যে মনে হল ছাল-টাল সব তুলে ফেলবে।

    –তাহলে আর হামা দিয়ে দরকার নেই বোধহয়? আমি জানতে চাইলাম।

    না—না–না! হলধরদা মুখ সিঁটকে বললে, ওসব আনাড়ি শিকারির জন্যে। ভালো শিকারিরা বুক চিতিয়েই হাঁটে। বলে বন্দুক তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলে। অবশ্য সবটা বুক চিতিয়ে নয়, মাঝে মাঝে থেমে দাঁড়িয়ে পা চুলকে নিতে হচ্ছিল।

    একটু পরেই সামনে একটা জলা। সেই জলার দিকে যেই আমার চোখ পড়েছে, অমনি আমি হলধরদার পিঠে কটাং করে চিমটি দিয়েছি একটা।

    –উরেঃ বাপস! বলে হলধরদা লাফিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে জলা থেকে তিনটে পাখি উড়ে পালাল একসঙ্গে।

    চোখ পাকিয়ে হলধরদা আমাকে বললে, এটা কী হল–আঁ? বলি, এটা কী হল?

    –কেন, কী করেছি? গো-বেচারার মতো আমি জানতে চাইলাম।

    কী করেছি? হলধরদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, অমন করে রাম-চিমটি দিলি যে? পিঠের মাংস প্রায় তুলে নিয়েছিস এক খাবলা! উঃ উঃস্-সস! একে পায়ের জ্বলুনিতে মরছি, তার ওপরে–

    বললাম, আমার কী দোষ? পাখি দেখলে তুমি চিমটি দিতে বলেছিলে। আমি দেখলাম, জলায় তিনটে জলপিপি বসে আছে–

    -তাই বলে অত জোরে চিমটি কাটবি?

    –আচ্ছা, এবার থেকে আস্তে কাটব।

    –থাক, হয়েছে। চিমটি কেটে আর দরকার নেই তোমার। এবার একটা ধাক্কা দিবি বুঝেছিস তো?

    বুঝেছি।

    জলা পার হয়ে একটা জাম-জারুল-গামারের বন। চারদিকে ছায়া-ছায়া ঠাণ্ডা। সেখানে ঢুকেই হলধরদা দেখি সোজা মাথার ওপর বন্দুক তাক করছে।

    পাখি পেলে বুঝি? আমি চেঁচাতে যাচ্ছিলাম, হলধরদা আরও জোরে চেঁচিয়ে বললে, চুপ কর, বলছি! গাছের ওপরে দুটো লাল পাখি দেখা যাচ্ছে।

    লাল পাখি দুটো ভালো–এত চেঁচানোতেও পালাল না। তাকিয়ে দেখে আমার কেমন সন্দেহ হল। সে কথা বলতেও যাচ্ছি, এমন সময় : ধ্রুম ধ্রাস্!

    দ্রুম্ হল বন্দুক–আর ধ্রাস–হলধরদা। অর্থাৎ গুলি ছুঁড়েই কুঁদোর ঘা খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

    -এঃ–এঃ—

    কিন্তু তার আগেই লাল পাখি দুটো পড়েছে। একটা আমার নাকে আর একটা হলধরদার টাকে। টিপ আছে হলধরদার!

    কিন্তু রাম রাম, কী বিচ্ছিরি পাখি! পড়েই ফটাস করে ফাটল। কী সব বদগন্ধওয়ালা কালো কালো জিনিস আমার নাকে-মুখে ঢুকে গেল, আর হলধরদার টাকের যে বাহার খুলল সে আর কী বলব!

    পাখি নয়–দুটো টুকটুকে পাকা মাকাল। গাছের অনেক ওপরে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না, তাই খানিকক্ষণ আমরা দুজনেই চুপচাপ। আমি শোকে মুহ্যমান আর হলধরদা কাঁকাল চেপে ধরে বসে আছে–টাকটা পর্যন্ত মুছতে পারছে না। হলধরদার বন্দুকই ওঁকে একখানা মোক্ষম কুঁদোর ঘা বসিয়েছে।

    প্রায় পাঁচ মিনিট পরে হলধরদা উঠে দাঁড়াল। অবস্থা দেখে দয়া হল আমার। কয়েকটা শুকনো পাতা দিয়ে টাকটা সাফ করে দিলাম।

    –যাত্রাটাই খারাপ।–না হলধরদা? দুটো মাকাল শিকার করলে, তার ওপরে কুঁদোর ঘা! ভাগ্যিস ধাক্কাটা ওপুর দিক থেকে এসেছিল, নইলে এতক্ষণে হয়তো তোমাকে গঙ্গার ওপারে নিয়ে ফেলত।

    এত করে যে টাক পরিষ্কার করে দিলাম, তার কোনও কৃতজ্ঞতা আছে নাকি? হলধরদা যাচ্ছেতাই রকমের ভেংচি কেটে বললে, থাম-থাম, ওস্তাদি করিসনি। তুই-ই তো গোলমাল করে দিলি–তাইতেই বেসামাল হয়ে কোমরে কুঁদোর ঘা লেগে গেল। কিন্তু হাতের টিপ দেখেছিস তো? মাকাল দুটোকে ঠিক নামিয়েছি!

    –তা নামিয়েছ। আর পড়েওছে ঠিক তাক-মাফিক। আমার নাকে আর তোমার টাকে।

    খুব হয়েছে। চল এখন। পাখি না মেরে আজ কিছুতেই ফিরছি না! তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বাহাদুরির হাসি হাসল : আরে, আমি কি আর জানিনে যে ও-দুটো মাকাল? হাতের টিপ কীরকম, সেইটেই দেখিয়ে দিলাম তোকে।

    আমার নাকটা ব্যথা করছিল। ক্ষুণ্ণ হয়ে বললাম, তা বটে, তা বটে।

    আবার খানিক দূর এগোতেই আমি দেখতে পেলাম–একটা ঘাসঝোপের পাশে একজোড়া পাখি চরছে। তিতির–নির্ঘাত তিতির।

    আর তখুনি ধাক্কা দিলাম হলধরদাকে।

    কিন্তু হলধরদা যে এমন পলকা তা কে জানত! ধাক্কা খেয়েই বোঁ করে সামনের দিকে ছুটল। তিতির-টিতির সব টপকে, একেবারে ঘাস-ঝোপটায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

    উঠে দাঁড়িয়েই হলধরদা চেরা গলায় সিংহনাদ করলে–প্যালা!

    আমি তখন কাছে এগিয়ে এসেছি। বললাম, কী আদেশ সেনাপতি?

    –থাম, আর মস্করা করতে হবে না। কী আক্কেলে অমন ধরে ধাক্কা দিলি ইস্টুপিড কোথাকার

    বাঃ, তুমিই তো পাখি দেখলে ধাক্কা দিতে বলেছিলে। আমি দেখলাম একজোড়া তিতির

    তাই আমাকে ভেবেছিলি বুঝি গুলতির গুলি? ভেবেছিলি, একেবারে সোজা ঠেলে পাখির গায়ে ফেলে দিবি? ইস্টুপিড গাধা! তোকে সঙ্গে এনেই ভুল হয়েছে! চলে যা এখান থেকে, আমি আর তোর মুখদর্শনও করতে চাইনে!

    –এবার মাপ করো হলধরদা। আমি হাতজোড় করলাম।

    –আর চ্যাঁচাবি না?

    –না।

    –আর চিমটি কাটবি না?

    কক্ষনো না।

    –পাঞ্জাব মেলের ইঞ্জিনের মতো পেছন থেকে ধাক্কা দিবি না?

    ছিঃ ছিঃ–আবার!

    –বেশ, কথা রইল। শুধু সঙ্গে থাকবি আর কিছু করতে হবে না।

    –একেবারে কিছুই না?

    –না–না। হলধরদা চেঁচিয়ে উঠল : এক নম্বরের ভণ্ডুলরাম তুই। যা বলব, ঠিক উলটোটি করে বসে থাকবি। তোকে কিছু করতে হবে না, শুধু পাখি পড়লেই কুড়িয়ে নিবি।

    –আচ্ছা, আচ্ছা তাই হবে–মাথা নেড়ে আমি সম্মতি জানিয়ে দিলাম।

    .

    হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে।

    এতক্ষণ শিকার কিছু হয়নি। সত্যি বলছি, আমি চাঁচাইনি, কিচ্ছু করিনি–একেবারে মুখ বুজে পেছনে পেছনে চলে এসেছি। তবু হতচ্ছাড়া পাখিগুলো যে কী করে টের পেয়েছে, ওরাই জানে। আমাদের দেখার সঙ্গে সঙ্গেই হাওয়া। একটা ডাহুক একটু সময় দিয়েছিল, কিন্তু হলধরদা-ওই যে ওই যে বলে লাফিয়ে ওঠায় সেটা পালিয়ে গেল।

    হলধরদা বলেছিল, যখন তুই সঙ্গে এসেছিস, তখনই জানি আজকের শিকারের নামে লবডঙ্কা।

    আমি বলেছিলাম, একবার আমার হাতে যদি বন্দুকটা দিতে

    ইঃ, আম্বা দ্যাখো না? আমার মতো বড় শিকারিই জেরবার হয়ে গেল, আর এই পুঁটিরাম এসেছেন শিকার করতে!

    হলধরদা একেবারে দমিয়ে দিয়েছিল আমাকে।

    শেষে এসে গেলাম নদীর ধারে।

    হলধরদা নিজেই দেখল এবার জলের ধারে একজোড়া বক।

    বক মারব প্যালা?

    বক মেরে কী হবে? কেউ তো খায় না।

    –আরে, পালক ছাড়িয়ে নিয়ে গেলে বকও যা, বুনো হাঁসও তাই। না হয়, তোকেই দিয়ে দেব।

    আহা, কী দয়া রে! আমাকে বক দেখাচ্ছেন! দু-একটা ঘুঘু হরিয়াল মেরে দিলেও নয় বোঝা যেত, বক দান করে আর দরকার নেই।

    আমি ব্যাজার হয়ে বললাম, আচ্ছা, আচ্ছা, বকের ব্যবস্থা পরে হবে। আগে মারো তো দেখি।

    -আরে, মারা আর শক্ত কী! ওরা তো মরেই রয়েছে। বলে হলধরদা বললে, আমার কোমরটা জাপটে ধর দেখি প্যালা।

    –আবার কোমর জাপটাব কেন?

    বলা তো যায় না বন্দুকের মর্জি! এক ধাক্কায় যদি

    তার মানে আমাকে সুষ্ঠু ওড়াতে চাও? ওসবে আমি নেই হলধরদা! বলে আমি সরে দাঁড়ালাম।

    –মাইরি প্যালা, লক্ষ্মী ভাইটি, এবারটি কথা শোন। তোর মনের ব্যথা আমি বুঝেছি। যদি একটা বকও মারতে পারি, তাহলে তোকে একবার আমি বন্দুকটা ছুঁড়তে দেব। দিব্যি গেলে বলছি–হলধরদার স্বর করুণ হয়ে এল।

    –ঠিক বলছ?

    –ঠিক বলছি।

    –মা কালীর দিব্যি?

    মা কালীর দিব্যি।

    আমি হলধরদার কোমর সাপটে ধরলাম, প্রাণপণে।

    হলধরদা বন্দুক বাগাল। বললে, জয় মা রক্ষাকালী, জোড়া বক দিস মা

    দ্রুম্! তারপরেই ধপাস আর ঝপাস।

    আবার মোক্ষম ঘা মেরেছে বন্দুকের কুঁদো। হলধরদা ক্যাঁক করে উঠল, তারপরে আমাকে নিয়ে সোজা ডিগবাজি খেয়ে পড়ল একেবারে নদীর মধ্যে।

    যেমন কনকনে ঠাণ্ডা জল–তেমনি স্রোত। প্রায় কুড়ি হাত সাঁতরে উঠতে হল ডাঙায়। আমি আবার বেশ খানিক জল গিলেও খেয়েছি, একটু হলেই মহাপ্রাণটি বেরিয়ে যেত।

    ডাঙায় উঠে দশ মিনিট ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম দুজনে। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমি বললাম, হলধরদা, তোমার বন্দুক?

    ও হতচ্ছাড়াকে নদীতেই বিসর্জন দিলাম! উঃ, পাঁজরায় এমন লেগেছে যে সাতদিনে সে ব্যথা সারলে হয়। তার ওপর যা ঠাণ্ডা নিমোনিয়ায় না পড়লেই বাঁচি!

    মাথার ওপরে উড়ন্ত বকজোড়া ক্যাঁ ক্যাঁ করে উঠল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    Related Articles

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.