Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প712 Mins Read0

    ভালোয়-ভালোয়

    ভালোয়-ভালোয়

    ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে সোজা ধড়াস করে প্ল্যাটফর্মের উপর একটা আছাড় খেলো বটুকেশ্বর সামন্ত। গড়িয়ে গেল বাজারের ঝাঁকা-থেকে-পড়ে যাওয়া একটা ছাঁচিকুমড়োর মতো।

    –আহা-হা মারা গেল বুঝি লোকটা।–চারদিক থেকে হাহাকার উঠল একটা।

    বাঙালগুলো এমনি করেই মরে, বুঝলেন!–কোথা থেকে একজন সবজান্তা ঘোষণা করলেন।

    বটুক ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। ব্যথার চাইতে অপমানের জ্বালাতেই গা জ্বলছে বেশি।

    আস্তিন গুটিয়ে বটুক বললে, মুখ সামলে কথা কইবেন মশাই! বাঙাল! জানেন, কলকাতার হাটখোলায় আমাদের চোদ্দপুরুষের বাস?

    –চোদ্দপুরুষ কলকাতায় বাস হলেও বাঙাল বাঙালই থাকে। সেই সবজান্তা আবার জানালেন। চটে আগুন হয়ে গেল বটুক। ইচ্ছে হল লোকটার কান ধরে বারকয়েক ওঠ-বোস করিয়ে দেয়। কিন্তু সাহস হল না। অচেনা জায়গা–সবাই শত্রুপক্ষ। চাঁদা করে সবাই যদি এক ঘা বসিয়ে দেয়, তা হলেই আর দেখতে হবে না। একদম কাঁচাগোল্লা বানিয়ে দেবে।

    সুতরাং কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

    গোঁ-গোঁ করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছিল–স্টেশন-মাস্টার পথ আটকালেন–একটু দাঁড়িয়ে যান না দাদা।

    –কেন, হঠাৎ আবার আপনার এই রসালাপ কিসের?

    স্টেশন মাস্টার নাক চুলকে বললেন, ইয়ে–দেখুন দাদা, আমার স্টেশনে নামতে গিয়ে আপনার হাত-পা ছড়ে গেল, তাই বলছিলাম, একবার অফিস-ঘরে আসুন, একটু আইডিন লাগিয়ে দি। আপনারা স্যার কলকাতার লোক, গিয়ে হয়তো বদনাম গাইবেন—

    বটুক দাঁত খিঁচিয়ে বললে, চুপ করুন মশাই। আর ভালোমানুষি করতে হবে না। আধ মিনিট ট্রেন থামে না আপনার স্টেশনে, আপনি আবার স্টেশনমাস্টার। আপনি একটা পয়েন্টসম্যান, বুঝলেন? স্রেফ পয়েন্টসম্যান।

    কী, পয়েন্টসম্যান। রোঁয়া-তোলা বেড়ালের মতো স্টেশন-মাস্টার ফ্যাঁচ করে উঠলেন : পয়েন্টসম্যান! এত বড় কথা! আমি আপনার নামে মানহানির মামলা করব।

    –মানহানি, প্রাণহানি, কানহানি যা খুশি করুন। যে-চুলোয় খুশি যান–বটুক গটগট করতে করতে বেরিয়ে গেল স্টেশন থেকে।

    ইস। যাত্রাটাই মাটি।

    স্টেশনের বাইরে এসে বটুক একবার করুণ চোখে নিজের দিকে তাকাল।

    হাঁটুর কাছে ফেঁসে গেছে অমন খাসা শান্তিপুরী ধুতিটা। গিলে করা পাঞ্জাবিটা এখানে-ওখানে ময়লা হয়ে গেছে। এই পোশাক নিয়ে কখনও জামাই-ষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া যায়।

    শ্বশুরেরও যেন আর খেয়ে-দেয়ে কাজ ছিল না। রিটায়ার করে কলকাতা ছেড়ে একেবারে এই ধ্যাধ্যেড়ে ঘোড়াডাঙায় এসে আস্তানা নিয়েছেন। পৈতৃক বাড়ি। নিকুচি করেছে অমন পৈতৃক বাড়ির! যেখানকার স্টেশনে আধ মিনিটের বেশি গাড়ি দাঁড়ায় না আর যেখানকার লোকগুলো এমন অসভ্য-সেখানে কোনও ভদ্রলোক আসে?

    কিন্তু এসেই যখন পড়া গেছে–তখন কী আর করা যাবে। তা ছাড়া শাশুড়ি খাওয়ান ভালো–পাকা কইয়ের কালিয়া, কচি পাঁঠার মুড়ো, বাটি ভরা ক্ষীর-ইস। ইস! ভাবতেও বটুকের জিভে জল এল। আশা হল, বেশ একটা জাঁকালো খাওয়ার উপরেই পথের কষ্টটা পুষিয়ে নেওয়া যাবে।

    কিন্তু ঘোড়াডাঙা? কোথায় সেই ঘোড়ার ডিমের ঘোড়াডাঙা?

    স্টেশনের বাইরে একটা নিমগাছের তলায় তিনখানা গোরুর গাড়ি। বটুককে দেখেই গাড়োয়ানরা হইচই করে তেড়ে এল।

    না, ঠ্যাঙাবার জন্য নয়।

    –কোথায় যাবেন বাবু? কোথায়?

    ঘোড়াডাঙা।

    আসুন, আমার গাড়িতে আসুন—

    –এ-গাড়িতে আসুন বাবু–তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেব!

    –আমার গাড়িতে চলুন মশাই! গোরু তো নয়–পক্ষিরাজ ঘোড়া। উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

    বটুক থতমত খেয়ে গেল।

    দুদিক থেকে দুই গাড়োয়ান হাত চেপে ধরেছে। আর-একজন পেছন থেকে জামা ধরে টানছে।

    –আমার গাড়িতে উঠুন বাবু-

    -এ-গাড়িতে আসুন বাবু

    আমার তো গোরু নয় মশাই, পক্ষিরাজ ঘোড়া—

    কানের কাছে তিন গাড়োয়ান সমানে চিৎকার করতে লাগল। বটুকের প্রায় ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, প্রাণ যাওয়ার দাখিল।

    -এই, কী হচ্ছে সব? ভদ্রলোককে নিয়ে মস্করা পেয়েছিস?

    একটা বাঁজখাই গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াল একটা লোক। ছ-হাতের মতো লম্বা, কটকটে কালো গায়ের রঙ–গরুড়ের ঠোঁটের মতো নাকটা মুখের উপর যেন আধ হাত আন্দাজ ঝুলে পড়েছে। গায়ে আধ ময়লা শার্ট–আস্তিন গোটানো। ছোটখাটো একটা দৈত্যবিশেষ!

    যেন জাদুমন্ত্রের কাজ হল। বটুককে ছেড়ে তিন পা পেছনে সরে গেল গাড়োয়ানগুলো।

    বিরাট লোকটা আবার বিকট গলায় বললে, দেখছিসনে কেমন ধোপদুরস্ত কলকাতার বাবু? তোদের ও-সব ঝরঝরে গোরুর গাড়িতে চড়তে যাবে কেন র‍্যা?-লোকটা বটুককে বগলের মধ্যে চেপে ধরল–আসুন স্যার আমার সঙ্গে।

    -তুমি আবার কে হে বাপু?–লোকটার বগলদাবা থেকে বটুক প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতে লাগল।

    –কেউ নই স্যার।–অতিকায় লোকটা প্রায় দেড় মাইল চওড়া একখানা হাসি হাসল : অধীনের নাম পানকেষ্ট পাড়ুই। আপনার দাসানুদাস।

    দাসানুদাস। নিজেকে ছাড়াবার বৃথা চেষ্টা করে বটুক রুদ্ধশ্বাসে বললে, তা হলে অমন করে জাপটে ধরেছ কেন?

    –একবার হাতে পেলে কি আর স্যার সহজে ছাড়ি?–আবার একখানা দেড় মাইল হাসি দেখা দিল পানকেষ্ট পাড়ুইয়ের মুখে।

    ভয়ে সর্বাঙ্গ হিম হয়ে গেল বটুকের : তোমার মতলবখানা কী হে?

    ঘাবড়াবেন না স্যার–আমি লোক খারাপ নই। চেহারাটা আমার এমনি দেখছেন বটে, কিন্তু মনখানা একেবারে মাখনের মতো নরম। গাড়োয়ান ব্যাটারা আপনার হাঁড়ির হাল করছিল, দেখে আর সইতে পারলাম না ছুটে এলাম।

    –যথেষ্ট অনুগ্রহ করেছ, এবার ছেড়ে দাও। হাঁপাতে হাঁপাতে বটুক বললে।

    –ছাড়ব কী স্যার, আপনি যে আমার সোয়ারি। ছাড়লেই হল? ছাড়াটা কি ইয়ার্কি নাকি? কত পুণ্যি করলে আপনাদের মতো লোক পাওয়া যায়। চলুন স্যার–কোথায় যাবেন। আমার ট্যাক্সি করে পৌঁছে দিচ্ছি।

    ট্যাক্সি! কোথায় ট্যাক্সি?

    –ওই যে আমগাছ তলায়, দেখছেন না?

    তা বটে! কিন্তু না বলে দিলে মোটর গাড়ি বলে চেনা মুস্কিল। ধুলোয় মলিন বাঁকা-ট্যারা একখানা একশো বছরের পুরনো অস্টিন। হুডটা ছিঁড়ে গিয়ে ঝালরের মতো ঝুলছে চারিদিকে।

    –ওইটে?

    -হাঁ স্যার। পানকেষ্ট আবার বত্রিশটা দাঁতের ঝলক দেখিয়ে দিলে; একটু পুরনো বটে, কিন্তু একদম সাচ্চা জিনিস। আজকালকার শৌখিন গাড়ির মতো ঠুনকো নয়। নাম দিয়েছি ‘দোদুল-দোলা’। একবার চড়েই দেখুন না স্যার–দু মিনিটের মধ্যে আমেজে ঘুম এসে যাবে।

    বটুক কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলার আর সুযোগ পেল না। একটা হ্যাঁচকা টানে তাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল পানকেষ্ট। হাজির করল একেবারে দোদুল-দোলার সামনে। মরচে-পড়া দরজাটা নারকোলের দড়ি দিয়ে বাঁধা। দড়ির ফাঁস খুলে পানকেষ্ট বললে, উঠুন।

    –উঠব? কোথায় উঠব?–ভেতর দিকে তাকিয়ে হাঁ করে রইল বটুক।

    –ভেতরে উঠবেন স্যার সিটে গিয়ে বসবেন। আমি কি নইলে হুডের উপর চাপতে বলছি আপনাকে?

    –সিট কোথায় হে! বটুক বারকয়েক খাবি খেল। এটা একটা প্রশ্ন বটে। সিটের উপর গদি-টদির বিশেষ বালাই নেই। একরাশ খোঁচা খোঁচা স্প্রিং, আর তার সঙ্গে জড়ানো নারকোলের ছিবড়ে। সিট নয় শরশয্যা!

    -ওর ওপরে কেমন করে বসব হে?

    –স্প্রিং-এর কথা বলছেন? আজ্ঞে, ও তো তুলোর মতো নরম। একবার বসলেই বুঝতে পারবেন।

    –পাগল পেয়েছ আমাকে? বটুক এবারে দাঁত খিঁচল–কেউ কখনও বসতে পারে ওর ওপর?

    একটা প্রকাণ্ড হ্যান্ডেল নিয়ে গাড়ির সামনে ঘটর-ঘটর করে স্টার্ট দেবার চেষ্টা করছিল পানকেষ্ট। এবার ব্যাজার মুখ করে এগিয়ে এল।

    –আপনার স্যার বড় বায়নাক্কা। পাড়াগাঁয়ে এর চেয়ে ভালো ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। এতে চাপিয়ে কত রাজা-মহারাজাকে পার করিয়ে দিলুম, আর আপনি খুঁত ধরছেন।

    ইঞ্জিনের কাছ থেকে একটা ছেঁড়া চট এনে দু-ভাঁজ করে পেতে দিলে পানকেষ্ট : নিন, বসুন এবার।

    বটুক ভাবছিল, এ-ট্যাক্সির চাইতে গোরুর গাড়িও ছিল ভালো। কিন্তু তারপরেই মনে পড়ল, ঘোড়াডাঙা অনেকখানি রাস্তা। গোরুর গাড়িতে চাপলে কবে যে গিয়ে পৌঁছুবে ঠিক নেই। একটু কষ্ট করলেও তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যাবে অন্তত।

    চটের ওপরেই অগত্যা চেপে বসল। বিলক্ষণ লাগছে।

    কই হে, আরাম হচ্ছে না তো?

    হবে স্যার, আস্তে আস্তে পানকেষ্ট আবার হাসল :সময়ে বুঝতে পারবেন।

    ঝরঝরে গাড়িটা এতক্ষণে স্টার্ট নিয়েছে। বিরাট ভূমিকম্পের মতো সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে তার। ড্রাইভারের সিটে লাফিয়ে উঠে বসে পানকেষ্ট বারকয়েক হর্ন বাজাল। সে-হর্নের শব্দে দুকান চেপে ধরল বটুক। মাথার ওপর থেকে কতকগুলো কাক কা-কা করে উড়ে গেল–দেখা গেল মাঠের ভেতর দিয়ে একপাল গোরু ল্যাজ তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিয়েছে।

    দোদুল-দোলা রওনা হল।

    কিন্তু হাতকয়েক এগিয়েই গাড়ি প্রায় দু-হাত লাফিয়ে উঠল শূন্যে–তারপরেই ধপাৎ করে পড়ল।

    –গেছি, গেছি। চেঁচিয়ে উঠল বটুক।

    –এখুনি গেলে চলবে কেন স্যার? ড্রাইভারের সিট থেকে ফিরে তাকাল পানকেষ্ট–একেবারে ঘোড়াডাঙা গিয়ে তবে ছুটি।

    –ঘোড়াডাঙা যাবার আগেই যে তুমি আমাকে গো-ভাগাড়ে পৌঁছে দেবে হে।

    –ও একই কথা স্যার–পানকেষ্ট আবার দন্তরুচি বিকাশ করল : আপনার গেঁটেবাত আছে স্যার?

    –না।

    –হেঁড়ে বাত?

    –না।

    –মাজার বাত?

    — না–না বটুক চটে উঠল : কিছু নেই ওসব। ওসবের ধার ধারি না আমি।

    –থাকলে বড় ভালো হত স্যার।–পানকেষ্ট যেন ব্যথা পেল।

    –মানে?

    পানকেষ্ট আবার বিকট শব্দে হর্ন বাজাল–একটা ধোপার গাধা আচমকা ভয় পেয়ে কোথায় তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।

    -মানে? পানকেষ্ট বললে : থাকলে সেরে যেত আর কি। এইজন্যেই তো দোদুল-দোলার এত নাম স্যার। কত লোক যে এ-গাড়িতে চড়ে বাত সারাতে আসে।

    –তোমার মুণ্ডু।–চটে মুখ ভ্যাংচাল বটুক।

    –আমার মুণ্ডু নয় স্যার, আপনার বাত।–পানকেষ্ট আবার হর্নের শব্দে কানে তালা ধরিয়ে দিলে।

    পথে লোক নেই জন নেই, খামকা অমন করে হর্ন বাজাচ্ছ কেন হে?

    দোদুল-দোলা যাচ্ছে স্যার, লোককে একটু হুঁশিয়ার তো করে দিতে হয়। ব্রেকটা আবার ভাল নেই কিনা, ঝট করে কেউ সামনে এসে পড়লে আবার সামলানো যাবে না।

    বল কি হে! অবিশ্রাম ঝাঁকুনির অসহ্য যন্ত্রণা এতক্ষণ যদি-বা সইছিল, বটুক এবার আঁতকে উঠল–মেরে ফেলবে না তো শেষ পর্যন্ত।

    আজ্ঞে না স্যার, ঘাবড়াবেন না।–পানকেষ্ট অভয় দিলে : আজ পাঁচ বৎসর দোদুল-দোলা চালাচ্ছি, এর মধ্যে কুড়িজনের বেশি সোয়ারি খতম করতে পারিনি। আপনি হয়তো বেঁচেও যেতে পারেন।

    থামাও, থামাও।–বটুক চেঁচিয়ে উঠল : আমি এখনই নেমে পড়ব।

    –থামাতে চাইলেই তো এ-গাড়ি থামবে না স্যার। যখন তেল ফুরুবে, নামতে গেলে সেই তখন।

    তার মানে? তাহলে ঘোড়াভাঙায় গিয়ে থামবে কী করে?

    পানকেষ্ট বিরক্ত হয়ে বললে, একটু-আধটু এদিক-ওদিক হয়ে যেতে পারে।

    –এদিক-ওদিক?–এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় মারাত্মক ঝাঁকুনি আর স্প্রিং-এর খোঁচায় যেন প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। বিকৃত মুখে বটুক বললে, কতটা এদিক-ওদিক?

    –ঠিক নেই।–পানকেষ্ট আবার সেই প্রচণ্ড হর্নটা বাজাল : আমাকে বেশি বকাবেন না মশাই, অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।

    -আঁ!–বটুক চুপ করল।

    বেবি অস্টিন পাগলের মতো ছুটছে। ঝড়াংঝড়াং শব্দে একবার লাফিয়ে উঠছে আর একবার ধপাৎ করে নেমে পড়ছে মাটিতে। বটুক ইষ্টনাম জপ করতে লাগল।

    মাথা ঘুরছে, চোখে ঝিম ধরছে। একবার শুধু দুর্বল গলায় বটুক জানতে চাইল : শেষ

    কিছু বলা যায় না স্যার–তবে চেষ্টা করে দেখব–পানকেষ্টর জবাব এল। ভগবানের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েই মড়ার মতো ঝিম মেরে রইল বটুক।

    কতক্ষণ ওই অবস্থায় ছিল ঠিক নেই। হঠাৎ কানে এল পানকেষ্টর চিৎকার : ঘোড়াডাঙায় এসে গেছে স্যার! এই যে ঘোড়াডাঙা

    বটুক ধড়মড় করে নড়ে উঠল। একটা গ্রামের ভেতর দিয়ে গাড়ি তীরবেগে বেরিয়ে যাচ্ছে।

    থামাও। থামাও! বটুক চেঁচিয়ে উঠল।

    –তেল না ফুরলে থামবে না স্যার।–প্রশান্ত জবাব পানকেষ্টর।

    তা হলে? ঘোড়াডাঙা যে ছাড়িয়ে গেল।

    –তা গেল। কিন্তু সেজন্য ভাবছেন কেন? মাইল পাঁচেক আগে একটা বাঁক আছে, ওখান থেকে ঘুরিয়ে আনছি। এর মধ্যে তেল ফুরিয়ে যাবে। পেছনে পড়ে রইল ঘোড়াডাঙা-গাড়ি মাঠের ভেতর দিয়ে সমানে বনবন করে ছুটছে।

    যদি না ফুরোয়?

    আবার স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসব। ফের তেল নেব।

    –তারপর আবার যে ঘোড়াডাঙা পেরিয়ে যাবে?

    –আবার ঘুরিয়ে আনব। পানকেষ্ট জবাব দিলে।

    –খুনে। ডাকাত। বটুক চেঁচিয়ে উঠল।

    -খামকা গালাগালি করবেন না স্যার।–গর্জে উঠল পানকেষ্ট। দৈত্যের মতো ভয়ঙ্কর মুখে একটা বীভৎস ভঙ্গি ফুটে বেরুল : তা হলে সোজা ওই জামগাছে ধাক্কা দিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে দেব—হ্যাঁ! তখন আমার দোষ দিতে পারবেন না।

    বটুক কাঠ হয়ে বসে রইল।

    ঝড়ের বেগে গাড়ি একটা চৌমাথায় পৌঁছল। তারপর বাঁদিকে খানিকটা ঘুরে আবার ফেলে-আসা পথ ধরল।

    এবার ঘোড়াডাঙায় গিয়ে থামবে তো?

    বলা যায় না স্যার। তেল মাপবার যন্ত্রটা নষ্ট হয়ে গেছে। গাঁজার নেশায় সকালে কতখানি তেল ঢেলেছি খেয়াল নেই।

    কী সর্বনাশ।

    –অত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন মশাই? আজ হোক কাল হোক–ঘোড়াডাঙার সামনে গাড়ি আমার থামবেই, তবে আমার নাম পানকেষ্ট পাড়ুই।

    –আজ হোক, কাল হোক! বটুক হাঁ করে রইল।

    পরশুও হতে পারে। তরশু হওয়াও অসম্ভব নয়। কী করে ঠিকমতো বলব স্যার? আমি তো আর জ্যোতিষী নই?

    বটুক আবার সেই খোঁচা-খাওয়া স্প্রিং-এর সিটে এলিয়ে পড়ল। জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন খাওয়ার সাধ চিরদিনের মতো মিটে গেছে। এখন প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলে হয়।

    –ঘোড়াডাঙায় গিয়ে আমার কাজ নেই, স্টেশনেই নিয়ে চল।

    –স্টেশনে গেলেই যে গাড়ি থামবে, একথা কী করে বলব মশাই?

    বটুক অজ্ঞানের মতো পড়ে রইল।

    –ঘোড়াডাঙা যাচ্ছে–ঘোড়াডাঙা যাচ্ছে। আবার পানকেষ্টর চিৎকার!

    থামছে না যে! এবারেও যে থামছে না!বটুক হাহাকার করে উঠল।

    –তেল বেশি আছে বোধহয়। পানকেষ্টর জবাব।

    কিন্তু আর নয়। এবার এসপার কি ওসপার। মাথায় যেন খুন চেপে গেল বটুকের!

    পেরিয়ে যাচ্ছে ঘোড়াডাঙা! ছাড়িয়ে যাচ্ছে একটা বন্দুকের গুলির মতো!

    জয় মা কালী!

    চলতি গাড়ি থেকে বটুক ঝাঁপ মারল।

    করেন কী–করেন কী মশাই।–বলতে না বলতে পানকেষ্টর দোদুল-দোলা দু-মাইল রাস্তা পার হয়ে গেল।

    গাঁয়ের ডাক্তার, টিংচার আইডিন আর লোকজন নিয়ে শ্বশুর ধারেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আশঙ্কা ছিল, শহুরে জামাই বটুক হয়তো ট্যাক্সির লোভ সামলাতে পারবে না।

    তাঁরা ছুটে এলেন। ধরাধরি করে রাস্তা থেকে তুললেন বটুককে।

    ডাক্তার প্রথমেই ডান পা-টা পরীক্ষা করলেন। বললেন, একটু ভেঙেছে। দিন-সাতেকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।

    শ্বশুর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন : যাক, ভালোয়-ভালোয় পৌঁছেছে তাহলে।

    ভালোয়-ভালোয় বইকি! লোকের কাঁধে চেপে জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন খেতে যেতে যেতে একবার করুণ কণ্ঠে বটুক জিজ্ঞাসা করলে, কিন্তু ট্যাক্সি-ভাড়াটা? ট্যাক্সি-ভাড়া নেবে না পানকেষ্ট?

    –নেবে বইকি। যেদিন তেলের হিসেব করে ঘোড়াডাঙার সামনে থামতে পারবে–সেইদিন। আজ হোক, কাল হোক, একমাস পরে হোক।–শ্বশুর জবাব দিলেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    Related Articles

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.