Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প712 Mins Read0

    প্যাঁচা ও পাঁচুগোপাল

    প্যাঁচা ও পাঁচুগোপাল

    ছেলেবেলা থেকেই পাঁচুগোপালের দুর্দান্ত বৈজ্ঞানিক কৌতূহল।

    না হয়ে যায় কোথায়! তিনদিন তিনরাত পাঁচুঠাকুরের দোরগোড়ায় ধরনা দিয়ে তবে পাঁচুগোপালের আবির্ভাব। যখন জন্মেছিল তখন তার হাত-পা ছিল কাঠির মতো সরু সরু–তিন নম্বরী ফুটবলের মতো তার মস্ত মাথাটাই চোখে পড়ত তখন। আরও কী আশ্চর্য–পুরো একটি বছর মাথায় একগাছা চুল গজায়নি পর্যন্ত।

    প্রতিবেশীর কাছে পাঁচুগোপালের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে হাপুস হুপুস করে কেঁদেই সারা হয়ে যেতেন ক্ষেমঙ্করী পিসিমা।

    –আহা, পাঁচু আমাদের ক্ষণজন্মা! এখন বরাতে টিকলে হয়!–ওর মাথায় কেন চুল গজায়নি, জানো? বাছার মাথায় এত বুদ্ধি যে সেই বুদ্ধির গরমে আর চুল গজাতে পারেনি। সাক্ষাৎ পাঁচুঠাকুর আমাদের ঘরে জন্মেছেন গো! এসব তাঁরই নীলে (লীলা)-আবেগের চোটে শেষ পর্যন্ত ক্ষেমঙ্করী পিসিমার হিক্কা উঠতে থাকে। তখন পাড়াপড়শিরা তাঁর মাথায় জল ঢেলে তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।

    তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে।

    আগ্নেয়গিরির আগুনও একদিন ঠাণ্ডা হয়–পাঁচুগোপালের মগজ তো কোন্ ছার! যথাসময়ে সে-মাথায় উলুবনের মতো চুল গজিয়েছে। শুধু গজায়নি, সে-চুল ছাঁটতে এখন পাঁচুগোপালের করকরে নগদ দুটি করে টাকা খরচ। আর জুতসই করে টেরি বাগাতে কোন্ না দুটি ঘণ্টাদৈনিক কাবার হয়ে যায় তার?

    আর ওই টেরি বাগাতে গিয়েই যত ঝামেলা! রোজ ইস্কুলে লেট হয়ে যায়। লেট হতে হতে একেবারে ফেল–ট্রেন নয়, ম্যাট্রিকুলেশন। পাক্কা তিনটি বার ঠোক্কর খেয়ে পাঁচুগোপাল এখন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় রত।

    পোকা-মাকড়, টিকটিকি, আরশোলা, পাখি–এইসব তার গবেষণার বিষয়বস্তু। আর সে-গবেষণার চোটে স্বয়ং ক্ষেমঙ্করী পিসিমারই হাঁড়ির হাল!

    কুঁড়োজালির মধ্যে হাত দিয়েছেন–ফরফর করে একঝাঁক আরশোলা উড়ে বেরিয়ে করকরে ঠ্যাঙে তাঁর গায়ে হাঁটতে শুরু করল–পিসিমার তো হাই-মাই চিৎকার। পাঁচু তার ঝুলির মধ্যে আরশোলা পুষতে চেয়েছিল। আর-একবার ঘরে ঢুকতে দেখলেন–চারদিকের দেওয়ালে সুতো বাঁধা সাত-আটটা জ্যান্ত টিকটিকি ঝুলছে।

    –এ কী রে মুখপোড়া! এ কী!–পিসিমা চেঁচিয়ে উঠলেন—

    একগাল হেসে পাঁচু বললে, ঘাবড়াচ্ছ কেন পিসিমা, দিব্যি বিনি-পয়সার ঘড়ি, সারা দিনরাত টিকটিক করবে।

    –তোর ঘড়ির নিকুচি করেছে অনামুখো!–হাতের কাছে একটা ধামা কুড়িয়ে পেয়ে তাই নিয়ে পাঁচুকে তাড়া করলেন ক্ষেমঙ্করী পিসিমা।

    কিন্তু যে-ছেলে ছাইচাপা আগুন, তাকে ধামাচাপা দেওয়া অতই সস্তা? রামচন্দ্র! ততক্ষণে তুফান মেল আসানসোল পার–মানে, পাঁচুগোপাল বেমালুম ভ্যানিশ!

    .

    ক্ষেমঙ্করী পিসিমার পাঁচুগোপাল, আর পাঁচুগোপালের ক্ষেমঙ্করী পিসিমা–ত্রিসংসারে দুজনের আপন বলতে আর কেউ নেই। পাঁচু জন্মাবার অল্প কয়েক বছর পরেই ওর বাবা-মা মারা গেলে নিঃসন্তান বিধবা পিসিমাই পরম যত্নে পাঁচুগোপালকে মানুষ করে আসছেন।

    হাওড়া বাজেশিবপুরে বলাই ঢ্যাং লেনে ক্ষেমঙ্করী পিসিমার বাড়ি। পিসিমা পূর্বজন্মে বোধহয় গোটাকয়েক হাঁড়িচাঁচা ভাজা খেয়ে থাকবেন, তাই এ-জন্মে একেবারে মোক্ষম গলা নিয়ে জন্মেছেন। গলা থেকে তো আওয়াজ বেরোয় না–বেরোয় নিনাদ। আচমকা সে-চিৎকার কানে গেলে রোগা পটকা লোকের হার্টফেল হয়ে যেতে পারে।

    লোকে বলে ওই গলা আছে তাই বাঁচোয়া। ক্ষেমঙ্করী পিসিমা সাক্ষাৎ যক্ষী বুড়ি। তার টাকায় ছাতা পড়েছে। আধপেটা খেয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমিয়েছে বুড়ি। এই গলা দিয়েই পিসিমা সে-টাকা পাহারা দেন। পিসিমা মরলে সে-টাকা লাগবে পাঁচুগোপালের ভোগে।

    কিন্তু তার আগেই যা অবস্থা–পিসিমাকে জেরবার করে ফেলেছে পাঁচুগোপাল।

    ব্যাপার আর কিছুই নয়–সেরেফ সেই বৈজ্ঞানিক কৌতূহল।

    পাঁচুগোপাল বায়না ধরে বসেছে, সে প্যাঁচা পুষবে।

    প্যাঁচা পুষবে! কথাটা শুনে আধঘণ্টা প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে থেকেছেন ক্ষেমঙ্করী পিসিমা। পাগল না পাহারাওলা!

    পাঁচুগোপাল নাছোড়বান্দা।

    –ওরে গোমুখ্যু, এ কী বুদ্ধি তোর? প্যাঁচা কি কেউ পোষে? শিস দেয় না– রা কাড়ে, শুধু রাতদুপুরে ‘হুদ্দুমদুম’ করে এমন বিটকেল আওয়াজ ছাড়ে যে আত্মারাম খাঁচাছাড়া! না না–ওসব চলবে না–ক্ষেমঙ্করী পিসিমা ঘোষণা করছেন।

    পাঁচুগোপালের মুখে-চোখে ফুটে বেরিয়েছে গভীর একটা সংসার-বৈরাগ্য : প্যাঁচা পুষতে দেবে না? বেশ, ভালো কথা। আমিও তাহলে ছাই মেখে সন্নিসি হয়ে হিমালয়ে চলে যাব। এ-সংসারে কেই বা কার!

    শুনে কেঁদে ফেলেছেন ক্ষেমঙ্করী পিসিমা : ওরে অমন অলক্ষুণে কথা বলিসনি! সংসারে তুই আমার, আমিই তোর; সন্নিসি হয়ে তোর কাজ নেই বাবা-তোর চাঁদমুখে একরাশ দাড়ি দেখলে আমি সইতে পারব না! তুই প্যাঁচা পোষ বাবা, বাদুড় পুষতে পারিস, চামচিকে পুষলেও আপত্তি নেই। দোহাই বাপধন পাঁচুগোপাল, সন্নিসি হোসনি!

    এতক্ষণে একগাল হেসেছে পাঁচুগোপাল। তারপর লম্বা একটা শিস দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে প্যাঁচার সন্ধানে।

    যোগাড় করতে অবিশ্যি খুব কষ্ট হয়নি। গলির মোড়ের বিড়িওলা এজলাস মিঞাকে আটগণ্ডা পয়সা দিতেই একটা প্যাঁচার বাচ্চা এনে দিলে দমদমা থেকে।

    নতুন-কেনা খাঁচায় নতুন প্যাঁচার ছানা নিয়ে বিজয়গর্বে বাড়ি ঢুকল পাঁচুগোপাল।

    –পিসিমা, পিসিমা!

    ক্ষেমঙ্করী পিসিমা তখন কুঁড়োজালি জপবার নাম করে চোখ বুজে টাকার হিসেব করছিলেন। পাঁচুর ডাকে চমকে উঠলেন।

    কী রে মুখপোড়া, হয়েছে কী? অমন চাঁচাচ্ছিস কেন?

    –পিসিমা, চিড়িয়া আ গিয়া–আনন্দের চোটে পাঁচুর মুখ দিয়ে হিন্দী বেরিয়ে পড়ল।

    –চিঁড়ে! আবার চিঁড়ে দিয়ে কী হবে? এই তো একটু আগে একধামা মুড়ি-মুড়কি খেয়ে গেলি।–বলতে বলতে খাঁচার দিকে নজর পড়ল পিসিমার : ওগো মাগো, এটা আবার কী গো।

    –ওগো এটা প্যাঁচা গো। চিঁড়ে নয়, চিঁড়ে নয়, এটাই চিড়িয়া গো–পিসিমার স্বরের অনুকরণে জানাল পাঁচুগোপাল।

    মরণ! মুখ কুঁচকে পিসিমা বললেন, তোর চিঁড়ে-মুড়ি নিয়ে ধুয়ে খা, ওসব অনাছিষ্টি কাণ্ডের মধ্যে আমি নেই!

    এবার পাঁচুগোপাল লেগে গেল তার চিঁড়ে-মুড়ি অর্থাৎ চিড়িয়া মানে প্যাঁচার পরিচর্যায়।

    আহা, কী রূপ! রূপে একেবারে চারিদিক অন্ধকার করে রেখেছে। সারা গায়ে ছাই রঙের পালক ফুলে আছে। থ্যাবড়া গোল মুখ–ধারালো ঠোঁট। সমস্ত মুখটায় এমন বিচ্ছিরি বিরক্তি যে মনে হয় প্যাঁচাটা বুঝি এইমাত্তর এক-গেলাস চিরতা খেয়ে এসেছে। আফিংখোরের মতো সারাটা দিন বসে বসে ঝিমুচ্ছে, এক-আধবার যখন চোখ মেলছে, তখন ভাঁটার মতো সে-চোখ দেখে হৃদকম্প হচ্ছে লোকের। কেউ কাছে গিয়ে ঝিমুনি ভাঙানোর চেষ্টা করলেই খ্যাঁচ-খ্যাঁচ করে এক ঠোকর–একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড!

    তার আসল পরাক্রম প্রকাশ পায় রাত্তিরবেলায়।

    –হুদ্দুমদুম–হুদ্দুম–দুদুম সারা রাত সে ভুতুড়ে চিৎকার ছাড়ে। দুটো আগুনের গোলার মতো চোখ তার জ্বলজ্বল করে জ্বলে-খাঁচার মধ্যে সে পাখা ঝাপটে ঝাপটে উড়তে চেষ্টা করে। আর সারাদিন ধরে যেসব আরশোলা, ব্যাঙ আর টিকটিকি পাঁচু তার খাঁচায় জোগাড় করে রেখেছে, একটার পর একটা সেগুলোই সে গিলতে থাকে টপাটপ করে।

    এক-একদিন খেপে ওঠেন পিসিমা।

    -গেরস্ত বাড়িতে এ কী সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড গো। সাতজন্মে এমন কথা কেউ শুনেছে। ও যমের অরুচি প্যাঁচাকে বাড়ি থেকে আজ বিদায় করে ছাড়ব।

    পাঁচু আঁতকে ওঠে : সর্বনাশ, বলছ কী পিসিমা। প্যাঁচা তাড়াবে?

    –তাড়াব না? প্যাঁচা আমার কোন্ নাতজামাই শুনি? মাগো, কী বিতিকিচ্ছি ডাক! শুনলে ভূত পালায়! না, প্যাঁচা আমি বাড়িতে রাখব না–

    –পিসিমা, ছি-ছি!–পাঁচুর গলা হঠাৎ গম্ভীর : জানো, প্যাঁচা কে?

    –কে আবার? দুনিয়ার অখাদ্যি জন্তু-পিসিমার প্রত্যুত্তর।

    –না পিসিমা, তা নয়।–পাঁচু থিয়েটারি ভঙ্গিতে বলতে থাকে, তুমি কি জানো না পিসিমা, প্যাঁচা লক্ষ্মীর বাহন? যদি প্যাঁচাকে তাড়িয়ে দাও লক্ষ্মী এসে কোথায় বসবেন? বরং প্যাঁচা ঘরে থাকলে তার পিঠে চেপে থাকবেন–একদম অচলা। এমন সুযোগ হেলায় হারিয়ো না পিসিমা-সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলো না।

    অকাট্য যুক্তি। খানিকক্ষণ মাথা চুলকে পিসিমা দেখলেন, এর প্রতিবাদ করা যাবে না। অগত্যা মনে মনে প্যাঁচার মৃত্যু কামনা করতে করতে পিসিমা ছাদে ঘুঁটে দিতে চললেন। পেছনে পাঁচু শিস দিয়ে প্যাঁচাকে শোনাতে লাগল : পড়ো বাবা আত্মারাম, নিতাই-গৌর রাধেশ্যাম

    প্যাঁচা, পাঁচু ও পিসিমার এমনি দুঃখে সুখে যখন দিন কাটছিল, তখন ঘটনাস্থলে গুরুপুত্তুরের আবির্ভাব হল।

    সাতপুরুষ আগে ক্ষেমঙ্করী পিসিমার কোন্ এক আত্মীয় গুরুপুত্তুরের কোন পূর্বপুরুষের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। সেই সুবাদে বছরে একবার এই গুরুপুত্তুরদের আবির্ভাব হয়। দশটি টাকা, একজোড়া ধুতি আর পর্বত-প্রমাণ খাওয়া-দাওয়া করে তাঁরা বিদায় নেন। ক্ষেমঙ্করী পিসিমা মনে মনে বিরক্ত হন–কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না। হাজার হোক–গুরুর বংশ! তাকে চটানো মানেই গোখরো সাপের ল্যাজ দিয়ে কান চুলকোনো। কখন ফোঁস করে অভিসম্পাত দিয়ে বসবে, ব্যস তাহলেই সর্বনাশ।

    সন্ধেবেলা দর্শন দিলেন গুরুপুত্তুর।

    এর আগে যে বুড়ো আসতেন, এ তাঁর ছেলে। বুড়ো গুরু মানুষটি মোটের ওপর মন্দ ছিলেন না। গত বছর তিনি মারা গেছেন। তাই এবার তাঁর ছেলে এসেছে বার্ষিক প্রণামী আদায়ের ফিকিরে।

    ছেলেটির চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, এক নম্বরের পাখোয়াজ। বছর আঠারো-উনিশ বয়স হবে। মাথায় টেরির কায়দাটি এমন নিপুণ যে, পাঁচুগোপালও লজ্জা পায়। নাকের নীচে বাটারফ্লাই গোঁফ, কানে সিগারেট গোঁজা।

    এসেছে দিব্যি রসকলি কেটে। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ বলতে বলতে বাড়ি ঢুকল। যেন সাক্ষাৎ বৃন্দাবনের গোঁসাই।

    গুরুপুত্তুরকে দেখেই ক্ষেমঙ্করী পিসিমার মেজাজ খিঁচড়ে গেছে। কিন্তু আর কী করেন, মহা সমাদরে বসালেন। হাজার হোক গুরুপুত্তুর। গোখরো সাপ না হোক তার ল্যাজ তো বটে।

    গুরুপুত্তুর বয়সে পিসিমার চাইতে চল্লিশ বছরের ছোট। কিন্তু কী আসে যায়–গোখরোর ল্যাজ কিনা। কান থেকে সিগারেট নামিয়ে সেটাকে ধরাল, তারপর কায়দা করে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললে, কই হে ক্ষেমঙ্করী, এবার সেবার ব্যবস্থা করো।

    পিসিমার পিত্তি জ্বলে গেল। তবু গলবস্ত্র হয়ে সবিনয়ে বললেন, কী সেবা হবে বাবা?

    পোলাও আর পাঁঠার কালিয়া। যাও–চটপট। ভারি খিদে পেয়েছে।

    পিসিমা বললেন, সে কী ঠাকুর! আপনি তো বোষ্টমের সন্তান। পাঁঠার কালিয়া খাবেন কী করে? আমি বরং কাঁচকলার কারি তৈরি করে দিচ্ছি

    –ড্যাম ইয়োর কাঁচকলার কারি–তেড়ে উঠলেন গুরুপুত্ত্বর। ওসব কাঁচকলা-ফাঁচকলার মধ্যে আমি নেই। পাঁঠার কালিয়ায় একটু তুলসীপাতা ফেলে দিয়ো, তা হলে তা শুদ্ধ হয়ে যাবে–একদম মালসা-ভোগ। যাও, দেরি কোরো না। Hurry up!

    ‘হারি আপ’ শুনে হাঁড়ির মতো মুখ করে পিসিমা উঠে গেলেন। ইচ্ছে করছিল পাঁঠার নয়, মুড়ো ঝাঁটার কালিয়া খাইয়ে দেন। কিন্তু হাজার হোক

    পাঁচুগোপাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুরুপুত্তুরের লীলা দেখছিল। এবার গুরুপুত্তুর তার দিকে মনোনিবেশ করলেন।

    -এই, তোর নাম কী রে?

    –পাঁচুগোপাল।

    –পাঁচুগোপাল! গুরুপুত্তুর দাঁত খিঁচিয়ে বলেন, পাঁচু না, পেঁচো। যা তোর মুখের শ্রী–তুই আবার পাঁচু–গোপাল। নে চলে আয়–গুরুপুত্তুর একখানা পা পাঁচুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, টেপ।

    -টিপব?

    –হ্যাঁ–হ্যাঁ–টিপবি বইকি। গুরুর পা টিপলে স্বর্গে যাবি। নে, চলে আয়, দেরি করিসনি-গুরুপুত্তুর আবার মুখভরা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লেন।

    পেঁচোর মতোই মুখ করে পাঁচু পা টিপতে বসল। মনে মনে স্বগতোক্তি করলে : আচ্ছা দাঁড়াও। পা টেপানো তোমার বার করে ছাড়ব–তবে আমি পাঁচুগোপাল।

    সেইদিন মাঝরাত্রে গুরুপুত্তুরের হাঁউমাউ চিৎকারে পিসিমা লাফিয়ে উঠলেন। পাড়ার লোকজন লাঠি ঠ্যাঙা নিয়ে তেড়ে এল। হইহই কাণ্ড!

    রাত্তিরে প্যাঁচাটাকে কে ছেড়ে দিয়েছিল কে জানে। গুরুপুত্তুর যেই গুটিগুটি ঘর থেকে বেরিয়েছেন, অমনি কোত্থেকে সেটা এসে তাঁকে আক্রমণ করেছে। দুটো জ্বলজ্বলে আগুনের মতো চোখ দেখে আর মাথার ওপর তিনটে ঠোকর খেয়েই একবার চিৎকার ছেড়ে তাঁর পতন ও মূর্ছা।

    মাথায় দশ বালতি জল ঢালবার পরে তবে তাঁর চৈতন্য হল। গোঙাতে গোঙাতে তিনি তখনও বলছেন : ভু–ভূ-ভূত।

    –ভূত না, প্যাঁচা। পাঁচুর প্যাঁচা।–পিসিমা জানাল।

    –আঁ, প্যাঁচা। ভদ্রলোকের বাড়িতে প্যাঁচা।–গুরুপুত্তুর উঠে বসলেন।

    -হ্যাঁ, পোষা।–আবার সভয়ে জ্ঞাপন করলেন পিসিমা।

    –পোষা। প্যাঁচা কেউ পোষে।–গুরু চেঁচিয়ে উঠলেন : তাড়িয়ে দাও। একটু হলেই আমার মহাপ্রাণ বেরিয়ে গিয়েছিল।

    –পাঁচুর পোষা প্যাঁচা বাবা। ও লক্ষ্মীর বাহন–ওকে তাড়াতে পারব না। ব্যাজার মুখে পিসিমা বললেন।

    –তবে অন্তত ওটাকে খাঁচায় আটকাও।–গুরুপুত্তুর বললেন, নইলে এবাড়িতে একদণ্ড আমি থাকব না–অভিসম্পাত দিয়ে চলে যাব।

    অভিসম্পাত। পিসিমা শিউরে উঠলেন। গোখরা সাপের ল্যাজ খেপে উঠেছে। ভয়ে ভয়ে বললেন, বাবা পাঁচু, তোর প্যাঁচা সামলা।

    পাঁচু নীরবে দেখছিল ব্যাপারটা। মন্দ হয়নি–পা টেপানোটা আদায় করা গেছে সুদে-আসলে। প্যাঁচাটার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকল : আয় আয় আত্মারাম–চুঃ–

    প্যাঁচাটা উড়ে এসে তার হাতে বসল।

    কিন্তু গুরুপুত্তুর কেন প্যাঁচাকে সামলাতে বলেছিলেন, তার উত্তর পাওয়া গেল পরদিন সকালে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে তাঁর টিকিও দেখা গেল না। আর সেইসঙ্গে দেখা গেল না পিসিমার বাক্সের নগদ তিনশো টাকা, একরাশ বাসন আর পাঁচুগোপালের একজোড়া নতুন সিল্কের পাঞ্জাবি।

    বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগলেন পিসিমা : হায় হায়। প্যাঁচাই ঠিক বুঝেছিল। কেন প্যাঁচাকে খাঁচায় বন্ধ করতে গেলাম! হায় হায়। প্যাঁচাই আমার ঘরের লক্ষ্মী, কেন প্যাঁচাকে আটকাতে বললাম!

    এক বছর পরের কথা।

    হাথরাস জংশন। ওয়েটিং রুমের এক প্রান্তে বসে মথুরার ট্রেনের প্রতীক্ষা করছিলেন পিসিমা আর পাঁচুগোপাল। তীর্থ করতে এসেছেন তাঁরা।

    পাঁচুর হাতের ওপর প্যাঁচা ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে।

    ওয়েটিং রুমের আর-এক পাশে দাড়িওয়ালা এক সাধুবাবা একদল গ্রাম্য লোককে উপদেশ দিচ্ছেন। কারও হাত দেখছেন, কাউকে তাবিজ দিচ্ছেন, কাউকে বিতরণ করছেন ধর্মোপদেশ। দুটি একটি করে টাকা জমছে পায়ের কাছে বেশ ব্যবসা ফেঁদেছেন সাধুবাবা।

    কিন্তু কেমন যেন খটকা লাগছে পিসিমার। সাধুবাবার গলাটা যেন চেনা! কোথায় শুনেছেন?

    কিছুতে মনে করতে পারলেন না।

    কিন্তু প্যাঁচাটার মনে পড়ল।

    ওয়েটিং রুমটার ওপর থেকে দিনের আলো নিবে গিয়ে যেই এল সন্ধ্যার অন্ধকার, অমনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠল প্যাঁচাটা। চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলে উঠল তার। তারপর হঠাৎ ফড়াৎ করে উড়ে গিয়ে প্রচণ্ড বেগে কয়েকটা ঠোকর মারল সাধুবাবার মাথার ওপর।

    সাধু হাঁইমাই করে উঠলেন। হট্টগোলে ভরে গেল ওয়েটিং রুম। আর সেই গোলমালে সাধুরাবার নকল গোঁফদাড়ি খসে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল—গুরুপুত্তুর!

    পুলিস এসে পড়ল। সাধুর ঝোলা থেকে বেরুল সিঁধকাঠি, সেইসঙ্গে একগাদা চোরাই মাল। দুজন শিষ্য সঙ্গে ছিল, তারাও ধরা পড়ল। জানা গেল, তারা এ অঞ্চলের দু’জন নামকরা দাগি চোর!

    প্যাঁচা ততক্ষণে ভালো মানুষটির মতো পাঁচুগোপালের হাতে এসে বসেছে।

    সম্প্রতি ইউ. পি. গভর্নমেন্ট ক্ষেমঙ্করী পিসিমাকে একখানা চিঠি দিয়েছেন। সে-চিঠিতে জানানো হয়েছে, তিনটে নামকরা চোরকে ধরিয়ে দেবার জন্যে পাঁচুগোপালের প্যাঁচাকে একটা সোনার মেডেল আর একবাক্স নেংটি ইঁদুর পুরস্কার দেওয়া হবে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    Related Articles

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.