Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প712 Mins Read0

    দুরন্ত নৌকা-ভ্রমণ

    দুরন্ত নৌকা-ভ্রমণ

    কতগুলো কসাই মরলে একটা মাসিকপত্রের সম্পাদক হয়ে জন্মায় কে জানে!

    আমি–পটলডাঙার প্যালারাম–আমার জানা তো দূরে থাকা, আমাদের দুরন্ত দুর্বার ইরম্মদ কবি হারাধন হাওলাদার অবধি জানেন না। দেশে অস্ত্র-আইন না থাকলে তিনি একটা পিস্তল কিনতেন এবং তাই দিয়ে দিনে একটা করে সম্পাদক সাবাড় করতেন–এই তাঁর বাসনা। এবং সে বাসনাটা তিনি প্রকাশ করেছেন আমারই ঘরের তক্তপোশে বসে–উত্তেজনায় একটা প্রচণ্ড চাঁটি হাঁকড়েছেন এক পেয়ালা গরম চায়ের ওপর এবং হাত পুড়িয়ে গেছিগেছি রবে আর্তনাদ তুলে লাফাতে লাফাতে নেমে গেছেন সদর রাস্তায়।

    একে প্রাণের জ্বালা, তার ওপর হাতের জ্বালা! হারাধন হাওলাদার মরিয়া হয়ে গেলেন।

    দৈনিক গোটা দশেক করে কবিতা লেখেন। ভাবের আবেগ যেদিন দুর্বার বেগে বেরিয়ে আসে, সেদিন পঁচিশ-তিরিশটা পর্যন্ত লিখে ফেলেন। যেদিন প্রথম স্বাধীনতা এল, সেদিন মারাত্মক প্রেরণায় সাড়ে-পঁয়তাল্লিশটা কবিতার জন্ম দিয়েছিলেন। বাকি আধখানা আর লেখা হয়নি তাঁর ছোট ছেলে মন্টু হামাগুড়ি দিয়ে এসে সেটাকে চিবিয়ে ফেলেছিল। ওই সাড়ে পঁয়তাল্লিশ তাঁর রেকর্ড।

    কিন্তু কৃতঘ্ন নরাধম সম্পাদকেরা কি একটা কবিতাও ছাপল। ছাপল না। না ছাপুক, বন্ধু বান্ধবেরা! তাদের ওপরেও ঘেন্না ধরে গেছে তাঁর। বিস্তর চপকাটলেটের লোভ দেখিয়ে যদিবা কবিতা শোনাতে ডেকে আনলেন–ভরপেট খাওয়ার পরে তাদেরই নাক ডাকতে লাগল। তাদের নাক কাকে ডাকতে লাগল কে জানে, কিন্তু হারাধনের কবিতাকে যে নয়–এব্যাপারে সন্দেহমাত্র নেই।

    সুতরাং মরিয়া হয়ে হারাধন দেশত্যাগ করলেন।

    যাওয়ার আগে শুধু আমার সঙ্গে দেখা করে গেলেন : সংসারে আমার ব্যথা একমাত্র তুই-ই বুঝলি, প্যালা। একমাত্র তোকেই আমার সাত হাজার সাতষট্টিটা কবিতা শোনাতে পেরেছি। মাঝে-মাঝে তুইও ঝিমিয়েছিস বটে, কিন্তু কখনও নাক ডাকাসনি। তাই তোকেই দেখা দিয়ে গেলাম।

    কিন্তু কেন যে হারাধনের ওই সাত হাজার সাতষট্টিটা কবিতাকে হজম করে গেছি, সে তো আমি জানি! অনুরোধে লোকে একটা ঢেঁকি গিলতে পারে কিন্তু কবি হারাধনের প্রতিটি কবিতাই এক-একটি ঢেঁকি–কেরোসিন কাঠের নয়–রেগুলার শালকাঠের চেঁকি। কতবার শুনতে শুনতে কান বোঁ-বোঁ করে উঠেছে, মাথা ঝিমঝিম করেছে, বুক ধড়ফড় করে হার্ট বন্ধ হবার জো হয়েছে–তবু তাঁর কবিতা শুনেছি আমি। কেন আর? একবার ওঁর কাছ থেকে পঁচিশ টাকা ধার করেছিলাম–পাছে ফস করে সে টাকাটা চেয়ে বসেন–সেই ভয়ে।

    আজ শুধু উনি দেশ ছাড়ছেন তাই নয়। মনকে ডেকে বললাম : হে আত্মারাম, এতদিনে তোমারও ভূত ছাড়ল। আরও কিছুদিন তা হলে বেঁচে রইলে। ফস করে হার্ট-ফেল হবার ভয় রইল না।

    মুখখানাকে যতদূর সম্ভব করুণ করে, করুণতর স্বরে বললাম : আর ফিরবেন না, হারাধনদা?

    ফিরব না মানে? হারাধনদার চোখ দপদপ করে উঠল। আমার বুকভরা আশা ধুক করে নিবিয়ে দিয়ে বললেন, ফিরব–এই বাঙলা দেশেই ফিরব-প্রতিভার লেলিহান আগুন জ্বেলে ফিরব! কবিতার অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে পুড়িয়ে মারব হতচ্ছাড়া সম্পাদক আর বিশ্বাসঘাতক বন্ধুদের। শুধু তুই বেঁচে যাবি, প্যালা। বলতে বলতে হারাধনদার সর্বাঙ্গ ম্যালেরিয়ার রোগীর মতো কাঁপতে লাগল, গলার স্বর সরস্বতী পূজার অ্যামপ্লিফায়ারের মতো গগনভেদী হয়ে উঠল : ফিরব সুর্যের মতো, উল্কার মতো, ধূমকেতুর মতো

    বলতে বলতে উড়নতুবড়ির মতো মিলিয়ে যেতে চাইলেন তিনি। কিন্তু তার আগে ফুটপাথে একটা পচা আমে পা দিয়ে ধপাস করে আছাড় খেলেন, তারপর লোকে আহা-আহা করে ওঠার আগেই ট্রামে চড়ে দিগন্তে-মানে, শিয়ালদা স্টেশনের দিকে বিলীন হয়ে গেলেন।

    ফিরেছেন মাস-দুই পরে।

    প্রলয়ের আগুন হয়ে নয়, সূর্য ধূমকেতু উল্কা–নিদেনপক্ষে একটা তুবড়ি হয়েও নয়। তুবড়ে একটা নেংটি ইঁদুর হয়ে ফিরেছেন হারাধন হাওলাদার সাতদিন কলে আটকে থাকা নেংটি ইঁদুর।

    ব্যাপার কী, হারাধনদা?–আমি আকাশ থেকে পড়লাম।

    ব্যাঁপার? ব্যাঁপার সাংঘাতিক হারাধনদা চিঁচিঁ করে বললেন, সঁব খুঁলে বঁলছি। তাঁর আঁগে এঁক কাঁপ চা–আর দুঁটো মাঁপাক্রিন!

    -ম্যাপাক্রিন!

    –হ্যাঁ হ্যাঁ–ম্যাঁপাক্রিন। আঁর বাঁকাসনি প্যাঁলা। আঁগে নিয়ে আঁয়–তাঁরপরে বঁলছি।

    চা আর ম্যাপাক্রিন আনলাম। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে কোঁত-কোঁত করে দুটো ম্যাপাক্রিন গিললেন হারাধনদা। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন বুঁদ হয়ে। তারপর শুরু করলেন এক মর্মভেদী করুণ কাহিনী। সে কাহিনী হারাধনদার ভাষাতেই আমি তুলে দিলাম। (শুধু প্রেসের সুবিধের জন্যে অতিরিক্ত চন্দ্রবিন্দুগুলো বাদ দিয়ে দিলাম–তোমরা ইচ্ছেমতো বসিয়ে নিতে পারো।)

    হারাধনদা বললেন :

    ভাবলাম, কলকাতায় থেকে আমার কিচ্ছু হবে না। রবি ঠাকুরেরও হয়নি। এখানে জ্বালাতন হয়ে তিনি নৌকো করে পদ্মায় চলে গেলেন–আর বোটে বসে এনতার কবিতা লিখলেন। তাইতেই অত নাম আর নোবেল প্রাইজ।

    সঙ্গে সঙ্গে পটাং করে জ্ঞানচক্ষুর উন্মোচন হল। আমিও যদি ওইরকম চড়ে নদীতে বেড়াতে পারি, তাহলে আমাকে পায় কে! এমন দুরন্ত দুর্ধর্ষ বেগে কবিতা বেরুতে থাকবে যে পড়ে হৃদকম্প হবে লোকের! একেবারে লম্ফ দিয়ে উঠবে দেশটা!

    কিন্তু সেকম্প আর লম্ফ যে আমারই কপালে লেখা ছিল তা কি আমিই জানতাম!

    জানিস তো-সাতপুরুষ কলকাতায় থাকি। কলকাতা থেকে মাইল-তিরিশেক দূরে আমাদের পৈতৃক বাড়ি। আমি তো আমি–ম্যালেরিয়ার ভয়ে আমার ঠাকুর্দা-ইস্তক কেউ কোনওদিন ও-তল্লাট মাড়ায়নি।

    এতদিনে বুঝলাম, কী ভুলটাই করেছি! দেশে নদী-নালা-খানা-খন্দ বিস্তর–ওখানে গেলেই কবিতা মগজের ভেতরে বিজবিজ করে গজাতে থাকবে। আহা-হা, দেশের মতো কি আর জিনিস আছে? খাল-বিল বনবাদাড়–ও-ই তো কবিতার ডিপো। সাধে কি কবি লিখেছেন, ও আমার দেশের মাটি, তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা? কার লাইন রে? রবি ঠাকুরের? বিদ্যাসাগরের লেখা নাকি? না ‘মেঘনাদ বধ’-এ আছে?

    যার লাইনই হোক–সে এক নম্বরের ধাপ্পাবাজ। নির্ঘাত ধাপ্পাবাজ। তোকে একটা কথা বলে রাখি প্যালা, দেশের মাটিতে কখনও মাথা নোয়াতে যাসনি। নুইয়েছিস কি শুইয়ে ছাড়বে–মাটি নেওয়াবে একদম!

    ছ’রিম কাগজ, ছ’টা ফাউন্টেন পেন আর ছ’বোতল কালি নিয়ে আমি দেশে গেলাম।

    গিয়ে দেখি–সারা গাঁ ভোঁ-ভোঁ। জন-মনিষ্যির বালাই নেই বললেই চলে। চারিদিকে ভাঙাচুরো বাড়ি আর কোমর-ভর আসামলতার জঙ্গল। যে-দু-চারজন আছে, তারা তো হাঁটে না–যেন বাদাড়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায়। ভাবলাম–খাসা! কানের কাছে ভ্যাঁপ ভ্যাঁপ করে মোটরের হর্ন বাজবে না, পাশের বাড়ির লোক্যাল সেট রেডিওটা পেত্নীর কান্না জুড়বে না, পথে-ঘাটে পকেট কাটা যাবে না। নিশ্চিন্ত মনে, নির্লিপ্ত হয়ে কবিতার নিরঙ্কুশ স্রোতে ভেসে যাব।

    কিন্তু রাত্রেই টের পেলাম–আরও কিছু আছে।

    মশারি ফুটো করে সারারাত মশারা আনন্দে বিউগল বাজাতে লাগল। গায়ের থেকে এক পর্দা চামড়াই খুবলে নিল বলতে গেলে। কোত্থেকে গোটা দুই আরশোলা এসে নাকে সুড়সুড়ি দিতে লাগল, আর রাত জেগে শুনতে লাগলাম বাড়ির উঠনে সাপে ব্যাং ধরেছে।

    প্রথম রাতেই দমে গেলাম খানিকটা। কিন্তু জানিস তো–দশ হাজার সাড়ে বাহান্নটা কবিতা লিখেছি–এত সহজেই হটবার বান্দা নই আমি। ঠিক করলাম– না, ঘর আমার জন্যে নয়। কালই নৌকো নিয়ে নদীতে ভেসে পড়ব। তারপর রবি ঠাকুরের একদিন কি আমারই একদিন!

    সকালেই বেরুলাম নদী আর নৌকোর সন্ধানে।

    নদী? হ্যাঁ–পাওয়া গেল বইকি। হাত-বিশেক চওড়া। হাঁটুসমান কাদার ভেতরে আঁজলা-আঁজলা জল। নৌকো চড়ে পার পাওয়া যায় না, নৌকোকে কাঁধে চড়িয়ে পার করতে হয়।

    দুত্তোর ছাই–এর জন্যে কাল সারারাত মশার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করলাম! চুলোয় যাক–কালই কলকাতায় ফিরব।

    প্যালা রে, তাই যদি ফিরতাম!

    পরদিন সকাল বাগদীদের এক ছোকরা বাগিয়ে ফেলল আমাকে। সকালে ঘর থেকে বেরুতেই দেখি, একমুখ দন্তবিকাশ করে দোরগোড়ায় সে দাঁড়িয়ে। রোগা ডিগডিগে, পেটভরা পিলে, একমাথা ধামার মতো চুল।

    সম্ভাষণটা সে-ই করল।

    কর্তার বুঝি লৌকোয় বেড়াবার সাধ হয়েছে?

    সাধ! হতভাগা বলে কী! জ্বলন্ত কাব্য লেখবার দুরন্ত আবেগে আমি ফুটন্ত কেটলির মতো টগবগ করছি, আর বলে কিনা সাধ!

    কিন্তু মূর্খটাকে সেকথা বোঝানো যাবে না। সংক্ষেপে বললাম, হুঁ। তোর নৌকো আছে?

    –আজ্ঞে।

    –সেটার চাকা আছে তো?

    –আজ্ঞে কী যে বলেন!–ছোকরা জিভ কাটল : আপনি দেখছি একলম্বরের ভোম্বল। রেলগাড়ির চাকা থাকেন আজ্ঞে, লৌকোর নয়।

    সাহস কত–আমাকে বলে ভোম্বল। আমি চটে গেলাম : রেলগাড়ির যে চাকা থাকেন, তা আমিও জানি। কিন্তু তোমাদের দেশের নদীতে তো জল নেই–নৌকো ডাঙা দিয়ে চলেন। চাকা নইলে যাবেন কী করে?

    –আজ্ঞে, এ তো মরা নদী। উদিকে বড় লদী রয়েছে।

    –তাই নাকি? কত বড় নদী?

    -খুব বড়। চলুন না একবার। গেলেই বুঝতে পারবেন।

    মনে-মনে খুশি হয়ে উঠলাম। বললাম, তোর নদী যদি পছন্দ হয়, তাহলে একদিন-দুদিন নয়, একদম তিন মাস নৌকোয় থেকে যাব, বুঝলি? যা ভাড়া চাস, তাই পাবি।

    শুনে ছোকরা হাঁ করল : তিন মাস লৌকোয় থাকবেন?

    হুঁ।

    ছোকরা শেয়ালের মতো খিকখিক করে হেসে উঠল : তিন মাস খামকা লৌকোয় থাকবেন! আপনি কর্তা এক নম্বরের ভোম্বল!

    –চুপ কর, বকবক করিসনি। চল দেখি তোর নদী।

    ছ’রিম কাগজ, ছ’টা ফাউন্টেন পেন আর ছ’বোতল কালি নিয়ে আমি ছোকরার পেছনে পেছনে বেরুলাম।

    ছোকরার নাম ঝাঁটু। ঝাঁটার অপভ্রংশ বোধহয়। পরে বুঝেছিলাম, আমাকে ঝাঁটানোর জন্যেই তার আবির্ভাব!

    সেই সাত-সকালে পাক্কা সাতটি মাইল হাঁটাল। কচুবন আর বিছুটির জঙ্গল মাড়িয়ে সারা গা চিড়বিড়িয়ে জ্বলতে লাগল, জুতোর ফোস্কা পড়ল, পায়ের জুতো হাতে চড়ল। খালি বলে : উই দেখা যাচ্ছে।

    হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, উই আমি বিস্তর দেখেছি, তোর নদী গেল কোথায়?

    –উই তো লদী।

    সাত মাইল পরে উই লদী’ পাওয়া গেল। ততক্ষণে আমার আধ হাত জিভ বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু নদী দেখে মনটা আশ্বাস পেল। বেশ বড়ই হবে। স্রোত আছে কি নেই বোঝা যায় না দিব্যি টলটলে জল। এক ধারে আসশ্যাওড়ার বন, আর একদিকে ধানের খেত। ঝাঁটুর ছোট নৌকোটা পারেই বাঁধা। ঝাঁটু কোঁচড় থেকে এক খাবলা মুড়ি নিয়ে চিবোতে-চিবোতে নৌকোয় উঠল। বললে, উঠুন কর্তা। কত বেড়াতে পারেন, দেখব।

    ছ’টা কলম একসঙ্গে বাগিয়ে আমি নৌকোয় চড়লাম। ঝাঁটু লগি তুলে নৌকো ছাড়ল।

    -হ্যাঁরে প্যালা, তোদের রবি ঠাকুর গুল দেয়নি তো? নৌকোয় বসে সত্যিই কখনও লেখা যায় নাকি? এই দুলছে তো সেই দুলছে। কলম একবার ঘ্যাঁচ করে এদিকে যাচ্ছে, আর একবার ওদিকে। খানিক বাদেই দেখি, এক লাইনও লেখা হয়নি–একরাশ ছবি আঁকা হয়ে গেছে খাতার ওপর।

    বললাম, ওরে ঝাঁটু, নৌকো থামা। যে জন্য এত খেদমদ, তাই যে হচ্ছে না! এক লাইনও লিখতে পারছি না!

    ঝাঁটু শেয়ালের মতো খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসল।

    –লৌকোয় বসে কেউ লেখাপড়া করে নাকি! আপনি কর্তা এক-লম্বরের

    ভোম্বল বলার আগেই আমি একটা বোম্বাই ধমক দিলাম ওকে–একেবারে খাম্বাজ রাগিণীতে। বললাম, তুই চুপ কর বলছি। নৌকো বাঁধ।

    ঝাঁটু ম্রিয়মাণ হয়ে বললে, আপনার পাঁঠা আপনি ল্যাজেই কাটুন আর মুড়োতেই কাটুন, আমার কী।–এই বলে লগি ডুবিয়ে মাঝনদীতে সে নৌকো থামাল। তারপরেই সোজা তালগোল পাকিয়ে শুয়ে পড়ল গলুইয়ের ওপর। আর কী আশ্চর্য, জানিস প্যালা, দুমিনিটের মধ্যে তার নাক ডাকতে লাগল। আমার কবিতা শোনবার আগেই ওর নাক ডাকতে লাগল!

    ওর নাক ডাকুক দুনিয়াসুদ্ধু লোকের নাক ডাকতে থাকুক, আমার কিছু আর আসে যায় না। আমি লিখতে লেগে গেলাম। ধানখেত, মাঠ, নদী, আকাশ, বাতাস–এর ভেতর থেকে কবিতা যেন দলে-দলে মারমার করে বেরিয়ে আসতে লাগল। আমাকে মারে আর-কি?

    দিস্তে-ছয়েক কাগজ যখন শেষ করেছি, তখন খেয়াল হল, আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে অন্ধকার নেমেছে। রাত ঘনিয়েছে নির্জন নদীর ওপর।

    আচমকা নাক-ডাকা বন্ধ হল ঝাঁটুর–তড়াক করে উঠে পড়ল।

    –এই সেরেছে! রাত হয়ে গেল যে! আমাকে জানাননি কেন? কর্তা, আপনি এক লম্বরের

    –থাম তো তুই। চল, এবার ঘরে ফিরি। রাত হয়ে গেছে। বড্ড খিদেও পেয়েছে।

    –ঘরে ফিরবেন? ঝাঁটু খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে উঠল : আজ রেতে লয় আজ্ঞে। আর খিদে পেয়েছে? পেটে কিল মেরে পড়ে থাকুন।

    বলে কী! শুনে কবিতা মাথায় উঠল।

    –মস্করা করিসনি, ফিরে চল শিগগির! খিদেয় প্রাণ যায় ব্যাটা ইয়ার্কি জুড়েছে!

    -ইয়ার্কি লয় আজ্ঞে! ঝাঁটু জলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললে, আপনি কর্তা বসে বসে ভ্যারাণ্ডা ভেজেছেন, আর এই ফাঁকে কচুরির ঝাঁক ভেসে এসে চারদিক ছেয়ে ফেলেছে! পেল্লায় ঝাঁক-সারা রাতেও ফুরুবে না। আর এই ঝাঁক ঠেলে লৌকো নিয়ে যাওয়া–আমি তো আমি, গোটা বাগদীপাড়ার সাধ্যি লয়, কর্তা!

    খেয়াল করে দেখি, সত্যিই তাই! নদীর আর চিহ্নমাত্র নেই। অন্ধকারে যদ্দুর চোখ যায় তিন হাত প্রমাণ উঁচু কচুরির ঝাঁক মাথা নাড়ছে।

    খিদের জ্বালায় আমার কান্না পেল : কী হবে ঝাঁটু?

    ঝাঁটু একটা বিড়ি ধরাল।

    –বিশেষ কিছু লয় আজ্ঞে। সারারাত এখন এখানে বসে মশার ফলার হবেন। মাঝরাতে আবার ডাকাতও পড়তে পারেন।

    –অ্যাঁ–ডাকাত! আমার হৃৎপিণ্ড ততক্ষণে বরফ হয়ে গেছে।

    –আজ্ঞে।

    কাটে-টাটে না তো?

    –তা কাটেন। ঝাঁটু নিশ্চিন্তে বিড়িতে টান দিল : প্রায়ই কাটেন। কিন্তু আমার আর কী লেবে–এই ভাঙা লৌকোই সম্বল; ভয়টা আপনারই কর্তা–জায়গাটাও ডাকাতে-হাতিপুর।

    আমি কেঁদে ফেললাম।

    –হ্যাঁরে ঝাঁটু, এখান থেকে পালাবার কোনও উপায় নেই?

    আজ্ঞে না। শান্ত গলায় জবাব দিয়ে সে আবার শোয়ার উদ্যোগ করল।

    ইচ্ছে করছিল, ডাকাতের হাতে সাবাড় হওয়ার আগে ঝাঁটুকেই সাবাড় করি আমি। কিন্তু পৈতৃক প্রাণের মায়া কাটানো অত সহজ নয়! আমি ঝাঁটুকে জাপটে ধরলাম : দশ টাকা দেব, পনেরো টাকা দেব, পঁচিশ টাকা দেব ঝাঁটু–আমাকে অপঘাত মৃত্যু থেকে বাঁচা, বাপধন!

    পঁচিশ টাকা দেবেন? ঝাঁটু উঠে বসল–চোখ মিটমিট করতে লাগল তার।

    কালীর দিব্যি! তোর গা ছুঁয়ে বলছি!

    শুনেই নৌকো থেকে গুণের দড়ি গুছিয়ে নিয়ে ঝাঁটু ঝপাং করে সেই কচুরি বনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল।

    –এই, পালাচ্ছিস নাকি?–আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।

    –পালাব কেন? আপনি কর্তা একলম্বরের ভোম্বল! আমি ডাঙায় চড়ে গুণ টানি–আপনি লগি ঠেলুন। লৌকো ঠিক বার করে নিয়ে যাব।

    লগি ঠেলব? আচ্ছা! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি লগি তুললাম।

    কখনও লগি ঠেলেছিস, প্যালা? আমি বলছি, ঠেলিসনি। লগির মতো বিশ্বাসঘাতক কিছু নেই! হেঁইয়ো করে যেই ঠেলা দিয়েছি, পায়ের তলা থেকে নৌকোটা সাঁৎ করে বেরিয়ে গেল। আর আমি? লগির ওপর শূন্যে সেকেন্ড-দুই ঝুলে থেকেই ঝপাং করে একেবরে কচুরিবনের মধ্যে। তারপর একবুক জলে। ডাঙা থেকে ঝাঁটুর খ্যাঁক-খ্যাঁক হাসি শোনা গেল।

    -আপনি কর্তা–কী আর বলব। নিন–উঠে পড়ুন ঝটপট।

    নৌকোর একটা মজা দেখেছিস, প্যালা? ডাঙা থেকে পা বাড়ালেই চড়া যায় কিন্তু জল থেকে উঠতে গেলেই দেখবি, সেটাই মাথার ওপরে চড়তে চায়। সেই বিচ্ছিরি কচুরিবনের মধ্যে ভিজে ভূত হয়ে গেছি, নাকে-মুখে পিরপির করে মশা আর পোকা ঢুকছে, কিন্তু যেই চড়তে যাই–নৌকোটা কাত হয়ে আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।

    ঝাঁটু পাড় থেকে চিৎকার ছাড়ল; আপনার জন্যে কি সারা রাত দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাব? উঠুন উঠে পড়ুন

    মরিয়া হয়ে নৌকোয় ভর দিয়ে চড়তে গেছি ব্যস, আর কথা নেই। সঙ্গে সঙ্গে নৌকো কাত হয়ে আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে ফস করে সেই কচুরিবনের মধ্যে ডুবে গেল।

    হায় হায় ডুবিয়ে দিলেন লৌকোটা? ঝাঁটু গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল : আপনি দেখছি একলম্বরের গম্বোল! (গম্বোল মানে কী রে, প্যালা?)।

    কিন্তু শুধু কি নৌকো ডুবল? সেইসঙ্গে ডুবল ছ’রিম কাগজ, ছ’টা ফাউন্টেন পেন, ছ’বোতল কালি আর ছত্রিশটা কবিতা! ডুবে গেল বাঙলা সাহিত্যের ছত্রিশটা অ্যাটম বোমা!

    আমি ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বললাম, চুলোয় যাক নৌকো, আমি ডাঙা দিয়ে হেঁটেই চলে যাব।

    হেঁটে যাবেন! মানে? আমার নৌকো ডুবিয়ে দিয়ে হেঁটে যাবেন? চালাকি নয়–লৌকো তুলে দিতে হবে।

    কী করে তুলব?

    –ডুবে-ডুবে। আমিও ধরছি।–বলে ঝাঁটু ঝপাত করে জলে নামল।

    –আমি পারব না।

    –পারবেন না মানে? আপনি দেখছি একলম্বরের ডম্বোল। (ডম্বোল মানে বুঝি আরও খারাপ, না রে, প্যালা?) ওসব চলবে না কর্তা! এখনি তবে হাঁক ছাড়ব আর লাঠি-সড়কি রাম-দা নিয়ে লোক জড়ো হয়ে যাবে। এ-গাঁয়ের নাম ডাকাতে-হাতিপুর।

    -থাক বাপু, আর হাঁক ছাড়তে হবে না। তুলে দিচ্ছি নৌকো।

    তার পরেরটুকু বর্ণনা করবার ভাষা নেই প্যালা। সমস্ত রাত সেই কচুরিবনের মধ্যে ডুবে-ডুবে নৌকো তুললাম ভোরবেলায়। সে-সুখের তুলনা নেই! মশা, ঠাণ্ডা জল আর কাদার মধ্যে এক রাত ডুবে থাকতে কী আরাম–সে শুধু আমিই জানি। আর জানতে ইচ্ছে করছে সেই লোকটাকে-যে লিখেছিল : ও আমার দেশের মাটি–

    সকালে ডাঙায় উঠে বেহুঁশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। আর সঙ্গে সঙ্গে কম্প দিয়ে জ্বর এল। একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর! দেশের ম্যালেরিয়া–একসঙ্গে লম্ব আর কম্প দুই-ই।

    আজ দেড়মাস পরে জ্বর থেকে উঠে কলকাতায় ফিরেছি, প্যালা। না, আর কবিতা নয়। যে কবিতা লেখে সে শুধু ভোম্বল নয়–এক নম্বরের ডম্বোল!

    হারাধনদা থামলেন। তারপর চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে চিঁ-চিঁ করে বললেন : আঁর এক কাঁপ চা, প্যাঁলা–আর দুটো ম্যাঁপাক্রিন!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    Related Articles

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.