Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প712 Mins Read0

    দুর্যোধনের প্রতিহিংসা

    দুর্যোধনের প্রতিহিংসা

    দুর্যোধন মণ্ডল খালিশপুরের হাটে গোরু বিক্রি করতে যাচ্ছিল।

    যাচ্ছিল ভালোই–বেশ খুশিমনে। গোরুটা দুবেলায় তিন সের দুধ দেয়– বিক্রি করে মোটা টাকা আসবে। সেই টাকা দিয়ে চাষের কাজের জন্যে একটা দামড়া বাছুর কিনবে, কিছু বাড়তি পয়সাও হাতে থাকবে তার। হাট ভালোই হবে, একটা পাঁঠাও কেনা যেতে পারে। বহুদিন আশ মিটিয়ে মাংস খাওয়া হয়নি।

    গ্রাম থেকে মাইল চারেক হেঁটে শিলাই নদী। এখন শুকনার সময় নদীতে বুক পর্যন্ত ডোবে। দুর্যোধন গোরুর পিঠে চেপেই নদী পার হয়ে গেল। খালিশপুরের হাট আর ক্রোশখানেক মাত্র।

    কিন্তু নদী পার হয়েই বাধল গণ্ডগোল। শিলাইয়ের খেয়াঘাটের মাঝি গোবরা এসে খপ করে কাঁধটা চেপে ধরল তার।

    বলি, ও মোড়লের পো, গুটিগুটি পায়ে পালাচ্ছ যে বড়?

    দুর্যোধন চটে গিয়ে বললে, পালাব ক্যানে–অ্যাঁ? কার চুরি করিছি যে পালাব?

    গোবরা একটা টকটকে লাল শালুর ফালি যোগাড় করে তাই দিয়ে পেল্লায় পাগড়ি বেঁধেছে মাথায়। আর সেই পাগড়ি বেঁধেই তার মেজাজ একেবারে আদালতের পেয়াদার মতো সপ্তমে চড়ে উঠেছে।

    –চুরি করোনি তো কী?–গোবরা খ্যাঁক-খ্যাঁক করে বললে, খেয়ার পয়সা না দিয়েই সটকাচ্ছ?

    -খেয়ার পয়সা!–দুর্যোধন আকাশ থেকে পড়ল : গোরুর পিঠে চড়ে পার হইচি, তোমার নায়ে পা-ও তো ঠেকাইনি। পয়সা দেব ক্যানে?

    নদী পেরুলেই পয়সা দিতে হবে–তা তুমি গোরুতে চেপেই যাও, কি ডানা মেলে উড়েই যাও। নইলে গোরু আটকে রাখব–এই সাফ কথা বলে দেলাম।

    গোবরা ষণ্ডা লোক, দুর্যোধন প্যাঁকাটির মতো রোগা। কাজেই পয়সা না দিয়ে পার পাওয়া গেল না। গুনে-গুনে চারটে পয়সা নিয়ে, সেগুলোকে ভালো করে দেখে গোবরা দুর্যোধনকে ছেড়ে দিলে। আর ঠাট্টা করে বললে, ভেবেছিলে চালাকি করে পেলিয়ে যাবে! তুমি তো তুমি–ঘাটের পয়সা না দিয়ে একটা মাছি পর্যন্ত পেরুতে পারবেকনি, এইটেই মনে করিয়ে দিচ্ছি।

    চারটে পয়সা গেল, সেটা বড় কথা নয়–অপমানটা বিঁধল তার চাইতেও বেশি। রাগে দুর্যোধনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলতে লাগল। এমন কি মাথাটা চিড়বিড়ও করতে লাগল, মনে হল কেউ সেখানে লঙ্কাবাটা ঘষে দিয়েছে। বড় বাড় বেড়েছে গোবরাটা। মানুষকে আর সে গণ্যিই করে না। কিন্তু লোকটাকে কিছু বলবারও জো নেই। ইয়া তাগড়াই জোয়ান-বেশি চ্যাঁ-ভ্যাঁ করতে গেলে এক চড়ে দাঁতকপাটি লাগিয়ে দেবে।

    হুঁকোর মতো মুখ করে দুর্যোধন খালিশপুরের হাটে গেল।

    প্রথমেই এক ঠোঙা গরম-গরম জিলিপি কিনে খেলে, কিন্তু রাগের চোটে জিলিপিগুলো চিরতার মতো তেতো লাগল। কচুরি খেতে গিয়ে মনে হল কচুপোড়া খাচ্ছে তাও বুনো কচু–গলার ভেতরে কুটুর কাটুর করে কামড়াচ্ছে।

    ময়রাকে বললে, এ-সব কী খাবার করেছ হে? মুখে দেওয়া যায় না যে একটুও?

    ময়রা রেগে বললে, হাটসুদ্ধ খেয়ে শাবাশ শাবাশ বলছে, আর তোমারই পছন্দ হলনি? বলি, মুখখানা কি সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে এয়োচ? দোকানে বসে মিছে বদনাম কোরোনি।

    গোরুটা তখন চোখ বুজে শালপাতার ঠোঙা চিবুচ্ছিল–তার নড়বার ইচ্ছে ছিল না। মেঠাইগুলো দুর্যোধনের যেমনই লাগুক, গোরুটার কিন্তু অমৃত মনে হচ্ছিল। আর খেতে হবেনি এই ছোটলোকটার ঠোঙা বলে গোরুটাকে এক চড় লাগিয়ে দুর্যোধন সেটাকে টানতে টানতে গো-হাটায় নিয়ে গেল।

    মেজাজ চড়েই ছিল, দু-চারজন খদ্দেরের সঙ্গে গোড়ার দিকে খিটিমিটিই হয়ে গেল খানিকটা। শেষে একজন যখন নগদ পঞ্চাশ টাকায় গোটা কিনে নিলে, তখন দুর্যোধন একটু শান্ত হল। হাট করল, মস্ত একটা বোয়াল মাছ কিনল। পাঁঠাও কিনবার ইচ্ছে ছিল, তারপরেই মনে হল, গোবরা হয়তো পাঁঠার পারানি বাবদ দুআনা পয়সাই আদায় করে নেবে। বিশ্বাস নেই ওকে।

    একটা বটগাছতলায় বসে গায়ের গামছাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খাচ্ছিল দুর্যোধন। বেলাবেলিই হাট হয়ে গেছে, এখনও চড়া রোদ্র চারদিকে। রোদটা একটু পড়লেই সে রওনা হবে।

    এমন সময় গো-হাটার দিকে তার নজর পড়ল। এক জায়গায় বিস্তর লোক জড়ো হয়েছে, খুব হইচই হচ্ছে সেখানে। একটা ঝোল্লা গোঁফওলা লোক হাত-পা নেড়ে কী সব যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে। দুটো দুষ্টু ছেলে পিছন থেকে তাকে বক দেখাচ্ছিল–লোকটা কষে একটা তাড়া দিতেই তারা দৌড়ে পালিয়ে গেল।

    দুর্যোধনের মনে হল, ব্যাপারটা জানা দরকার। বোয়াল মাছ আর হাটের বোঁচকা চেনা আলুওলার দোকানে জিম্মা করে দিয়ে সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।

    ব্যাপার আর কিছু নয়–ভিড়ের মাঝখানে শাদায়কালোয় মেশানো এক পেল্লায় যাঁড় দাঁড়িয়ে। মস্ত কুঁজ, মস্ত-মস্ত শিং, গলার চামড়া ঝালরের মতো ঝুলে পড়েছে। তার চেহারা দেখেই আত্মারাম চমকে ওঠে। গলায় দড়ি বাঁধা, ঝোল্লা গোঁফওলা লোকটা ধরে রয়েছে সেটা। আর ফোঁসফোঁস শব্দ করে ষাঁড়টা একটা বিরাট পচা বাঁধাকপি খেয়ে চলেছে।

    কিন্তু আসল ব্যাপার ষাঁড়টা নয়। সেই গুঁফো লোকটাই রেলগাড়ির ক্যানভাসারের মতো সমানে একটানা গলায় বলে যাচ্ছিল, চারদিকের মানুষগুলো তাই শুনছিল কান পেতে।

    হাসি-মস্করার কথা নয় মশাই-এটি সোজা ষাঁড় নন। এনার আস্তানা ছেলো কাশীর বিশ্বনাথের গলিতে। ইনি হলেন সাক্ষাৎ মহাদেবের ষাঁড়ের বংশধর। শিং দুখানার চেহারা একবার দ্যাখেন?

    –তা বিশ্বনাথের গলি ছেড়ে খালিশপুরের হাটে পচা কপি চিবুতে এলেন ক্যানে?–ভিড়ের ভেতর থেকে একজন জানতে চাইল।

    লীলে-দেবতার লীলে!–গুঁফো লোকটা একবার কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করল, ষাঁড়কে না বিশ্বনাথকে-কে জানে। তারপর আবার শুরু হল বক্তৃতা : সে হল গে অনেক কালের কথা। তখন যুদ্ধ চলছে। তখন ইনি ছেলেন নেহাত নাবালক-বিশ্বনাথের গলিতে ঘুরতেন। এর-তার দোকানে মুখ দিয়ে কারুর গজা, কারুর চমচম লোপাট করতেন। তা মিঠাই খেতি-খেতি অরুচি ধরে গিয়েছিল বলে একদিন এক বেনারসী শাড়ির দোকানে মুখ বাড়িয়ে দুখানা শাড়ি খেয়ে ফেলেছিলেন।

    -দুখানা বেনারসী শাড়ি খেলেন ইনি? সেই কচি বয়েসে?–একজন প্রায় খাবি খেল : তা হলে এখন তো এক ডজন সতরঞ্চি খেয়ে ফেলতি পারেন।

    –পারেন বই কি।–ঝোল্লাগুঁফো লোকটা মিটির-মিটির হেসে বললে, ইনি শিবের ষাঁড়ের বংশধর-এনার অসাধ্যি কী আছে! নিয়ে এস না সতরঞ্চি, হাতে হাতে দেখিয়ে দিচ্ছি।

    বয়ে গেছে আমার। এখন আমি ষাঁড়ের জন্যি সতরঞ্চি কিনতি যাই আর কি।

    পিছন থেকে সেই দুষ্টু ছেলেদুটো আবার বক দেখাচ্ছিল। লোকটা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, অ্যাও। ত্যাখোন থেকে যে আমায় বক দেখাচ্ছিস, ভেবেছিস কী! এক্ষুনি ষাঁড়ের মুখে ধরে দেব, আধখানা চিবিয়ে দেবে-বুঝবি মজাটা।–বলেই সে ওদের ধরবার জন্যে হাত বাড়াল।

    বাবা গো, গিছি গিছি বলে ছেলে দুটো পাঁই-পাঁই করে ছুটে পালাল। ভিড়ের মানুষগুলো অধৈর্য হয়ে উঠল : কই, কাশী থেকে ইনি ক্যামন করে এলেন, তা তো বললে না।

    –আহা, তাই তো বলছিনু–লোকটা একবার গোঁফে তা দিয়ে নিলে : তা তোমরা বলতি দিচ্ছ কই? সেই-যে বেনারসীওলা–সে ছেলো মহা ফিচেল আর বেজায় ঘুঘু। রাতের বেলা ইনি এক মুদির দোকানের নীচে শুয়ে জাবর কাটছেন, কোখাও জন-মনিয্যি নেই–ত্যাখোন বেনারসীওলা আর তার তিনটে ষণ্ডা ছেলে এসে এনাকে পিটতে-পিটতে বড় রাস্তায় নিয়ে এল। সেখানে গোরা মিলিটারিরা গাড়ি নিয়ে খাপ পেতে বসেছেল–তারা তক্ষুনি এনাকে গাড়িতে উঠিয়ে ফেললে। ওদের মতলব, এনাকে দিয়ে কালিয়া বানিয়ে খাবে।

    রাম-রাম–থু-থু-সবাই কানে আঙুল দিলে।

    ষাঁড়টা পচা বাঁধাকপিটা শেষ করে এবার গলা খুলে আওয়াজ ছাড়ল : গুরর ঝাঁই–গুরর ঝাঁই

    –এই দ্যাখো–গুঁফো লোকটা মাথা নেড়ে বললে, সেই কথা শুনে ইনি এখনও কত কষ্ট পাচ্ছেন–তাই জানিয়ে দেলেন।

    একজন বললে, বাপরে কী গলাখান। যেন মেঘ ডাকছে।

    –তা, ইনি কালিয়া হতে গিয়ে বেঁচে এলেন কেমন করে?–বোকাসোকা চেহারার একটি রোগা লোক জানতে চাইল।

    –এনাকে রান্না করে খাবে এমন কেউ আছে নাকি দুনিয়ায়? তা সে গোরা মিলিটারিই হোক আর যাই হোক। রেলগাড়িতে চাপিয়ে এনাকে তো আসাম না কোথায় পাচার করছিল। কী একটা ইসটিশানে গাড়ি থেমেছে আর ইনি দড়ি ছিঁড়ে এক লাফে নেমে পড়েছেন। একজন মিলিটারি এ গোরু ভাগো মৎ বলে ধরতে এয়েছেলে, তাকে ঢুঁসিয়ে চিত করে ফেললেন। তারপর এক ছুটে মাঠের মধ্যি হাওয়া হয়ে গেলেন।

    -তারপর?

    তারপর আর কী? ছিষ্টি চষে বেড়াতে লাগলেন। আজ এর খ্যাত সাবড়ে দ্যান, কাল ওর খামার আধাসাট করেন, পরশু হয়তো ধোপারা কোথাও কাপড় কাঁচতে দিয়েছে ইনি এসে হাজির হলেন–খেলে খেলে বলতি-না বলতি ডজনখানিক শাড়ি জামা এনার পেটের গভভরে চালান হয়ে গেল।

    তার চাইতে ইনি মিলিটারির পেটের গভভরে গেলিই তো ভালো হত–একটা মন্তব্য ভেসে এল।

    –কে বললে, কে বললে একথা?–গুঁফো লোকটা চটে উঠল : মহাপাপী তো! মরে নরকে যাবে–তারপর গো-ভূতেরা এসে গুঁতিয়ে-গুঁতিয়ে তোমার ভুতুড়ি বের করে দেবে, দেখে নিয়ে।

    কথাটা যে বলেছিল, তার আর সাড়া পাওয়া গেল না।

    –তা, তুমি এনাকে পেলে কী করে?–আর-একজনের জিজ্ঞাসা।

    লোকটা আবার হাত তুলে মাথায় ঠেকালে : গুরুর দয়া।

    -গোরুর দয়া?

    ধুত্তোর! গুঁফো লোকটা আবার চটে গেল : গুরু আর গোরুর তফাত বোঝো না–কোথাকার বুদ্ধু হে?

    –যেতি দাও, যেতি দাও–সেই বোকাসোকা মানুষটা আবার বললে, তুমি কী করে এনাকে পেলে, তাই বলো।

    তাই তো বলছি। একদিন রাত্তিরে স্বপন দ্যাখলাম, তোর দোরগড়ায় শিবের ষাঁড়ের বংশধর রয়েছেন বরণ করে নে–একজন সাধু যেন আমায় বলছেন। আমি বললাম, বাবা, তিনি আমার দোরে এলেন কী করে? ত্যাখন সাধু আমায় সব কথা খুলে বললেন। আমি বললুম, বাবা, এনাকে খাওয়াব কী? সাধু বললেন, যা দিবি, তাই খাবেন তারপর নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেবেন। তুই শুধু এনাকে গোয়ালে থাকতে দিস। দেখিস, তোর ভালো হবে। ঘুম ভেঙে দেখি, ইনি দোর জুড়ে শুয়ে রয়েছেন য্যানো গন্ধমাদন। বললুম, বাবা-দরজা ছেড়ে দ্যাও-নইলে তো বেরুতি পারব না। তার চে গোয়ালে চলে এসো। তক্ষুনি ঝাঁ-গুড়-গুড় বলে জয়টাকের মতো আওয়াজ ছেড়ে দাঁড়ালেন, আর সুড়সুড়িয়ে গোয়ালে এলেন।

    তারপর?

    –তারপর যা হল, কী বলব! একটা হাঁস দুবচ্ছর ডিম দিচ্ছিল না, একরাতে সেটা ছটা ডিম পেড়ে ফেললে–

    দূর!–একজন প্রতিবাদ করল : বাজে কথা বললিই শুনব? এক রাত্রে হাঁসে ছটা ডিম পাড়তি পারে কখনও?

    –পারে। গুরুর দয়া হলিই

    –গুরুর দয়া নয়, গোরুর দয়া বলল মোড়ল।

    -আচ্ছা আচ্ছা গোরুর দয়া না হয় হল। কিন্তু হাঁসে ছটা ডিম পাড়ল, একটা মরা আমগাছ ভরে বউল এল, আমার খুড়ো কোমরের বাতে এক বচ্ছর বিছনায় পড়েছেলে তিনি তিড়িং করে উঠে মাঠে দৌড়ে গেল যে। বললে পেত্যয় যাবে না–তক্ষুনি জমিতে চাষ দিয়ে এল। একটা ভোঁদড় রোজ পুকুরের মাছ খেয়ে যাচ্ছিল, একদিন একটা চেতল মাছ তার ঠ্যাঙে অ্যায়সা কামড়ে দিলে যে সেটা খোঁড়া হয়ে চিল্লোতে চিল্লোতে দেশ ছেড়ে পালাল।

    একেই বলে গোরুর দয়া।–এতক্ষণে কথা বললে দুর্যোধন।

    –তবেই বুঝে ন্যাও। এ-ষাঁড় যার ঘরে যাবে–তার লক্ষ্মী একেবারে বাঁধা। কিনে ফেল কিনে ফেল।–গুঁফো লোকটা বেশ জোরে-জোরে হাঁক ছাড়ল।

    বিলিয়ে দাও না ক্যানে? পড়ে-পাওয়া ষাঁড় বেচতে এয়েচ? ঘরের লক্ষ্মীই বা বিদেয় করছ কেনে?–দুর্যোধন জানতে চাইল।

    –স্বপ্নাদেশ পেলাম যে! একদিন আবার সেই সাধু এসে বললেন, রাখোহরি হাজরা কাজটা তো ভালো হচ্চেনি, বাছা! ইনি এয়েছেন সক্কলের ভালো করবার জন্যি–তুই একাই এনাকে দখল করে রাখবি? এবার ছেড়ে দে। তাই হাটে বেচতে এনু।

    -বেচবে ক্যানে? এমনিই দিয়ে দ্যাও–দুর্যোধন বললে।

    বাঃ, শিবপুজো দিতে হবে না? পঞ্চাশ টাকা খরচ করতি হবে–সাধু বলে দিয়েচেন।

    –পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ষাঁড়! বলি পাগল না পেট-খারাপ?

    –একটু লোকসান করেও দিতি পারি–দেবতার জিনিস। চল্লিশ টাকা হলিও নিতি পারো!

    –বোকা ভুলোবার জায়গা পাওনি আর?–এইবারে একজনের প্রতিবাদ শোনা গেল : গাঁজাখুরি গপ্পো শুনিয়ে টাকা নেবে? পয়সা দিয়ে কেউ ষাঁড় কেনে? |

    রাখোহরি হাজরা চটে গেল : তুমি তো ভারি পাপী লোক হে। মরে নরকে যাবে আর গো-ভূতে

    ধ্যাত্তোর গো-ভূত।–সে-লোকটা সবাইকে ডেকে বললে, চলো হে চলো। ওসব বিশ্বাস করতি নেই।

    রাখোহরি দাঁত খিঁচিয়ে বললে, এতক্ষণ দিব্যি কানখাড়া করে শুনছিলে; আর পয়সার বেলাতেই অমনি বিশ্বাস করতি নেই! যাও যাও! অনেক পুণ্যি থাকলে শিবের ষাঁড় কিনতি পায়-তোমার বরাতে থাকলি তো!

    দলবল নিয়ে অবিশ্বাসীটা চলে গেল, কিছু লোক দাঁড়িয়ে রইল তখনও। আর রাখোহরি সমানে গলা চড়িয়ে বলতে লাগল : লিয়ে যাও–লিয়ে যাও–শিবের ষাঁড়। ঘরে থাকলিই লক্ষ্মীঠাকরুন বাঁধা। খাবার-দাবারের ভাবনা নেই কলামুলো, ছেঁড়া কাপড় যা দেবে তাই খাবেন। শুধু গোয়ালে বেঁধে রাখলেই গোরুতে কেঁড়ে-ভর্তি দুধ দেবে, খেত ভরে ফসল হবে, খুড়োর বাত সেরে যাবে, একটা হাঁসে ছটা করে ডিম পাড়বে

    দুর্যোধন ফিরে যাচ্ছিল, হঠাৎ কানে এল : শুধু একটি জিনিস সাবধান। সেটি দেখলেই ওনার মেজাজ বিগড়ে যায়। সেটি হল–

    আর সেটি যে কী, তাই শুনেই দুর্যোধন ঘুরে এল ষাঁড়ওলার কাছে। একসঙ্গে তার অনেকগুলো কথা মনে পড়ে গেল।

    -পাঁচ সিকে দিতে পারি, ষাঁড় দেবে?

    –পাঁচ সিকে! তা কী করে হয়?রাখোহরি বললে, অন্তত পাঁচ টাকা হলেও

    না, পাঁচ সিকের এক পয়সাও বেশি নয়।

    –আচ্ছা ন্যাও তবে। ব্যাজার হয়ে রাখোহরি বললে, বিনি পয়সাতেই লক্ষ্মী ছেড়ে দিলাম। তোমার বরাত ভালো, মোড়ল–নির্ঘাত শেয়াল বাঁয়ে রেখে হেঁটে এসেছিলে।

    পাঁচ সিকে দিয়ে ষাঁড় কিনে, দড়ি ধরে দুর্যোধন রওনা হল বাড়ির দিকে। দড়ি টানতে হল না, ষাঁড় আপনিই সুড়সুড় করে চলতে লাগল তার সঙ্গে। হাটের লোক তার বোকামো দেখে নানারকম ঠাট্টা করতে লাগল, কোত্থেকে সেই ত্যাঁদড় ছেলে দুটো এসে পেছন থেকে বক দেখাতে লাগল। কিন্তু দুর্যোধন ভ্রূক্ষেপও করল না–গম্ভীরভাবে এগিয়ে চলল।

    পথে শিবের ষাঁড় বিশেষ গোলমাল করল না। শুধু এক ফাঁকে দুর্যোধনের কাঁধ থেকে নতুন নীল গামছাটা নিয়ে খেয়ে ফেলল, তার হাটের বোঁচকা থেকে একটা লাউয়ের বোঁটা বেরিয়েছিল–সেটা টেনে অনেকক্ষণ ধরে চিবুল, একজন হাটুরে একবোঝা শাক নিয়ে যাচ্ছিল–ঝাঁ করে তার অর্ধেকটাই মুখে তুলে নিলে। সে গালাগাল করতে লাগল, দুর্যোধন ফিরেও চাইল না।

    তারপর দুর্যোধন খেয়াঘাটে পৌঁছুল। নৌকোয় উঠল না–যাঁড়ের ঘাড়ে চেপে নদীতে নামল। ষাঁড় এক-আধবার আপত্তি করল, ঝেড়ে ফেলতে চাইল কিন্তু দুর্যোধন শক্ত করে কুঁজটা পাকড়ে আছে বিশেষ সুবিধে করতে পারল না। শুধু দু-একবার চটাং-চটাং করে ল্যাজের ঘা লাগাল, চাবুকের ঘায়ের মতোই লাগল সেটা। দুর্যোধন মুখ নাক সিঁটকে বসে রইল।

    আর, তাই দেখে-ঘাট-মাঝির চালার ভেতরে বসে, মুচকে-মুচকে হাসল গোবরা গড়াই : বটে-বটে। এবারেও ঘাটের পয়সা না দিয়ে পালাবার মতলব। দাঁড়াও-দাঁড়াও—

    এবারে উঠে রাস্তার দিকে পা বাড়াতেই সেই টকটকে লাল পাগড়ি মাথায় চড়িয়ে আদালতের পেয়াদার মতো মেজাজ নিয়ে গোবরা তেড়ে এল : বলি, পয়সা না দিয়ে

    আর বলতে হল না। গরর-গুরর ঝা–ঝাং বলে এক গগনভেদী হাঁক ছাড়ল বিশ্বনাথের ষাঁড়। তারপর সামনের পা দিয়ে দুবার বালি খুঁড়েই–মাথা নামিয়ে সেই মস্ত-মস্ত শিং বাগিয়ে গোবরাকে তাড়া করল।

    বাবা গো গিছি–মেলে–মেলে–মেলে (মারলে–মারলে)–বলতে বলতে গোবরা প্রাণপণে ছুটল, ষাঁড়ও ছুটল পিছনে-পিছনে। সে কী দৌড়! যেন একখানা গাড়ি নিয়েই পঞ্জাব মেল ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে ছুটে চলল। চোখের পলকে মাঠ-ঘাট বনবাদাড় পেরিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে গেল তারা। পঞ্জাব মেলের সঙ্গে কেবল তফাত এই যে, এর ইঞ্জিনটা পিছন দিকে।

    দুর্যোধন মনে-মনে বললে, ছোটো গোবর্ধন-ছোটো। শিবের ষাঁড়–দৌড় করাতে করাতে তোমায় কৈলাসে নিয়ে যাবে। ঘাটের পয়সা আর নিতে হচ্ছেনি।

    হাঁ, খেয়াঘাটের চার পয়সা বাঁচানোর জন্যেই পাঁচ সিকেতে ষাঁড় কিনেছে দুর্যোধন, দেড় টাকার গামছা আর দুআনার লাউটাও গেছে। কারণ, রাখোহরি বলেছিল, এনার সব ভালো–কেবল টকটকে নাল (লাল) কাপড় দেখলিই খেপে যান। আর তাই শুনেই গোবরার লাল পাগড়িটার কথা দুর্যোধনের মনে পড়ে গিয়েছিল।

    গোবরা এবং ষাঁড় এতক্ষণে কত দূরে কে জানে। হয়তো কৈলাসের কাছাকাছিই গিয়ে পৌঁছেছে। খরচ একটু বেশিই হল, কিন্তু প্রতিশোধের দামটাই কি কম।

    একটা বিড়ি ধরিয়ে, গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ি চলল দুর্যোধন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    Related Articles

    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.