Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সমাপ্তি – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প93 Mins Read0

    ১. বিরাট ড্রইং রুম

    ০১.

    দোতলার এই বিরাট ড্রইং রুমটা চমৎকার সাজানো। সোফা, সেন্টার টেবিল, জয়পুরী কার্পেট, টিভি, মেরুন রঙের টেলিফোন, বিদরির কাজ-করা ফ্লাওয়ার ভাস–সেখানে যেটি থাকলে সবচাইতে ভালো দেখায় ঠিক সেখানেই সেটি রয়েছে। দরজায় কিংবা জানলায় ঝুলছে দামি পর্দা।

    আজ রবিবার। দুপুর পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ছুটির দিনের এই বিকেলে ড্রইং রুমে সবাই শ্বাসরুদ্ধের মতো অপেক্ষা করছিল। অবনীনাথ ঘরে এসে ঢুকলেন। তাঁর এখন একষট্টি চলছে। এই কমাস আগে গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে রিটায়ার করেছেন।

    ছফুটের মতো হাইট অবনীনাথের। এই বয়সেও মেরুদণ্ড সটান। চওড়া কপাল। পাতলা চুলের বেশির ভাগই রুপোর তার হয়ে গেছে। লম্বাটে মুখ তাঁর, দৃঢ় চিবুক, ধারালো নাক। গায়ের রং ফর্সাও না, কালোও না–দুইয়ের মাঝামাঝি। তবে ত্বক শিথিল হতে শুরু করেছে, লক্ষ করলে কপালে সরু সরু অগুনতি রেখা চোখে পড়ে। এটুকু ছাড়া সময় বা বয়স তাঁর শরীরে আর কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। মোটা ফ্রেমের বাইফোকাল লেন্সের ওপারে চোখে দুটি কিন্তু এখনও তাঁর ভারী উজ্জ্বল।

    অবনীনাথের পরনে পাতলা ধবধবে পাজামা এবং পাঞ্জাবি। এখন জানুয়ারি মাসের শেষাশেষি। হু হু করে শীতের উলটোপালটা হাওয়া বইছে। তাই পাঞ্জাবির ওপর কাশ্মীরি শাল।

    অবনীনাথ খুব ধীরে ধীরে সবাইকে একবার দেখে নিলেন। বড় ছেলে অভীক এবং তার গুজরাটি স্ত্রী মৃদুলা বাঁদিকে বসে আছে। অভীকের বয়স একত্রিশ-বত্রিশ। দারুণ সুপুরুষ চেহারা। তার দিকে তাকালে নিজের তরুণ বয়সের কথা মনে পড়ে যায় অবনীনাথের। তাঁর পুরো ছাঁচটাই বসানো রয়েছে ওর চেহারায়। তাঁর মতোই দুর্দান্ত ছাত্র ছিল অভীক। আপাতত আছে ফরেন সার্ভিসে। প্যারিসে ইন্ডিয়ান এমব্যাসিতে অভীক ফার্স্ট সেক্রেটারি। ওর স্ত্রী মৃদুলাও ভালো ছাত্রী। দেখতেও চমৎকার। ওরা কলকাতায় পঞ্চাশ বছর ধরে ডামিসাইড। মৃদুলা এবং অভীক একসঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজ আর ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। পড়তে পড়তেই প্রেম; তারপর অভীক ফরেন সার্ভিসে ঢোকার পর বিয়ে। ওদের এক ছেলে, এক মেয়ে।

    অভীকদের পরে বসে আছে বড় মেয়ে সুদীপা এবং তার স্বামী মৃন্ময়। সুদীপার বয়স আঠাশ; খুবই সুশ্রী চেহারা। ইকনমিসে পি এইচ ডি করেছে। ওর স্বামী মৃন্ময় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ওরা থাকে রাঁচিতে। ওখানকার একটা মাটিন্যাশনাল কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে মৃন্ময় ওয়াকর্স ম্যানেজার। সুদীপা একটা গার্লস কলেজে পড়ায়। ওদের দুই মেয়ে।

    আরেক দিকে বসে আছে ছোট ছেলে অঞ্জন এবং তার স্ত্রী চৈতী। অঞ্জন অবনীনাথের মতো হাইট বা চেহারা পায়নি। ও তার মায়ের মতো। মাঝারি উচ্চতা, গোলগাল মুখ, ঈষৎ মোটা নাক। তবে স্বাস্থ্য বেশ ভালো। বিজনেস ম্যানেজমেন্টে ডিগ্রি নিয়ে অঞ্জন বম্বের একটা ফার্মে এখন টপ একজিকিউটিভ। ওর স্ত্রী চৈতী হাসি-খুশি আদুরে ধরনের মেয়ে। বাংলায় মোটামুটি এম.এ-টা পাশ করে গেছে। ছাত্রী ব্রাইট না হলেও গানের গলা তার অসাধারণ, আকাশবাণীর বম্বে সেন্টার থেকে রেগুলার হিন্দুস্থানি ক্লাসিক গায়। ওদের একটা মেয়ে।

    অঞ্জনদের পর বসেছে ছোট মেয়ে রঞ্জনা এবং তার স্বামী চিরদীপ। রঞ্জনার বয়স তেইশ। ও আবার অবনীনাথের চেহারা পেয়েছে। এবছর যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে কম্প্যারাটিভ লিটারেচারে এম.এ পাশ করেছে। আর চিরদীপ কলকাতায় একটা বড় কলেজে ফিজিক্স পড়ায়। এখন থেকে ঠিক তিন মাস আগে ওদের বিয়ে হয়েছে।

    দুই ছেলে, দুই পুত্রবধূ, দুই মেয়ে এবং তাদের স্বামীরা ছাড়া আর কেউ নেই। এমনকী নাতি নাতনিদেরও দুঘণ্টার জন্য এ ঘরে প্রবেশ নিষেধ।

    অবনীনাথ নিজে আজকের এই পারিবারিক সভার আয়োজন করেছেন। নিজের ছেলেমেয়ে এবং তাদের স্ত্রী বা স্বামীরা ছাড়া আর কেউ যাতে এখানে না থাকে, আগে থেকেই সবাইকে তা বলে দিয়েছেন।

    ছোট মেয়ে রঞ্জনার বিয়ের পর থেকে এ রকম একটা পারিবারিক কনফারেন্সের কথা ভেবে আসছিলেন অবনীনাথ কিন্তু ছেলেমেয়েদের সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ দিন তিনেক আগে এক্সটার্নাল মিনিস্ট্রির কী একটা জরুরি দরকারে দিল্লিতে এসেছিল অভীক, এসেই অবনীনাথকে ফোন করেছিল। অভীককে পাওয়াই ছিল সবচাইতে বড় প্রবলেম। ফরেন সারভিসের কাজে ইন্ডিয়ার বাইরে যাদের থাকতে হয় তাদের পক্ষে ইচ্ছা করলেই হুটহাট দেশে ফেরা সম্ভব না।

    অভীকের ফোন পেয়েই অবনীনাথ স্থির করে ফেলেছিলেন, এই সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে না। তিনি মনে মনে যা ভেবে রেখেছেন তার জন্য ছেলেমেয়ে পুত্রবধু এবং জামাইদের প্রত্যেককে প্রয়োজন। এদের কাউকেই বাদ দেওয়া সম্ভব হবে না। অন্যদের সবাইকে ইচ্ছা করলে পাওয়া গেলেও অভীককে নিয়েই ছিল সমস্যা। যাই হোক, হঠাৎ তার ফোন পেয়ে খুশিই হয়েছিলেন অবনীনাথ এবং কদিনের জন্য কলকাতায় ঘুরে যেতে বলেছিলেন। অভীক বলেছিল, এবার কলকাতায় যাওয়ার অসুবিধা আছে। অবনীনাথ কোনো কথা শোনেননি। এমনিতেই কারো ওপরেই তিনি কখনও কোনো ব্যাপারেই চাপ দেন না কিন্তু জীবনে এই বোধ হয় দ্বিতীয় কি তৃতীয় বার জোর খাটালেন। তিনি বলেছিলেন, যত অসুবিধাই থাক অন্তত দুদিনের জন্য অভীককে কলকাতায় আসতেই হবে। কাল রাতের ফ্লাইটে ওরা দিল্লি থেকে কলকাতায় এসেছে; এখান থেকেই কাল দুপুরের ফ্লাইটে লন্ডন হয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনে প্যারিস চলে যাবে।

    অভীকের সঙ্গে কথা হয়ে যাবার পর সেদিনই রাঁচিতে বড় মেয়ে-বড় জামাই আর বম্বেতে ছোট ছেলে-ছোট বউমাকে টাঙ্ক কলে ধরে চলে আসতে বলেছেন। কারো কোনোরকম অসুবিধে বা আপত্তির কথা কানে তোলেননি। জোর না-খাটালেও অবনীনাথের ব্যক্তিত্ব এমনই প্রবল যে ছেলেমেয়েরা তার মুখের ওপর কথা বলতে পারে না। বড় মেয়ে-জামাই কাল বিকেলে রাঁচি থেকে চলে এসেছে। ছোট ছেলে-ছোট বউমা স্পেশাল লিভ নিয়ে আজ দুপুরের ফ্লাইটে এসেছে বম্বে থেকে। ছোট মেয়ে এবং ছোট জামাই-এর এদিক থেকে কোনো অসুবিধা নেই; ওরা কলকাতেই থাকে।

    হঠাৎ এভাবে ডেকে আনার জন্য ছেলেমেয়ে এবং তাদের স্ত্রী বা স্বামীরা খুবই অবাক হয়েছে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রচুর আলোচনাও হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ওদের মোটামুটি ধারণা হয়েছে, টাকা-পয়সা বা বাড়ি-টাড়ি সম্পর্কে উইলের জন্য অবনীনাথ ওদের আসতে বলেছেন। ছেলেমেয়েরা জানে কাকাতায় এই একটা তেতলা বাড়ি এবং ব্যাঙ্কে লাখ আড়াই টাকা ছাড়া অবনীনাথের আর কিছু নেই। তারা আগেই জানিয়ে দিয়েছে, পৈতৃক প্রপার্টি বা টাকাপয়সা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা নেই; এসব তিনি যাকে ইচ্ছে দিয়ে যেতে পারেন। কোনো চ্যারিটেবল প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে গেলেও তাদের আপত্তি নেই। কাজেই আবার মনে হয়েছে, উইলের জন্যই হয়তো এভাবে বাবা তাদের ডেকে আনেননি। নিশ্চয়ই অন্য কোনো জরুরি কারণ আছে।

    অবনীনাথ বলেছিলেন, কাঁটায় কাঁটায় চারটেয় সবাই যেন বসবার ঘরে চলে আসে। ছেলেমেয়েরা চারটের অনেক আগে থেকেই অপরিসীম কৌতূহল এবং কিছুটা উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছে।

    ঘরে একটা মাত্র সোফাই এখন খালি আছে। অবনীনাথ আস্তে আস্তে সেটায় গিয়ে বসলেন। এটায় বসলে অন্য সবাইকে দেখতে সুবিধা হয়। খুব সম্ভব এই কারণে তাঁর জন্য সোফাটা রেখে দিয়েছিল ওরা। অবনীনাথ কবজি উলটে ঘড়ি দেখলেন, চারটে বাজতে এখনও কয়েক সেকেন্ড বাকি। অভীকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ঠিক সময়েই এসে গেছি।

    ছেলেমেয়েরা জানে অবনীনাথ আজীবন ব্রিটিশ পাংচুয়ালিটি মেনে চলেছেন। একটু মজা করে অভীক বলল, আর্লিয়ার বাই ফিফটিন সেকেন্ডস।

    অবনীনাথ সামান্য হাসলেন। আরেকবার সবাইকে দেখলেন। অভীক অঞ্জন সুদীপা রঞ্জনা এবং তাদের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া মৃদুলা চৈতী মৃন্ময় আর চিরদীপ-তাঁর নিজের সৃষ্টি এই পরবর্তী জেনারেশনের সবাই কৃতী, সফল, কোনো-না-কোনো ভাবে ব্রিলিয়ান্ট। এদের সম্বন্ধে তাঁর কোনোরকম দুশ্চিন্তা বা সমস্যা নেই। সবাইকে জীবনে নিজের হাতে তিনি প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পেরেছেন। জীবনের লম্বা ম্যারাথন দৌড় শেষ করে এখন তিনি প্রায় ভারমুক্ত।

    অবনীনাথ বললেন তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ বিশেষ প্রয়োজন না হলে জোর করে তোমাদের এখানে টেনে আনতাম না। জানি, এভাবে ছুটে আসার জন্য তোমাদের অনেক অসুবিধে হয়েছে কিন্তু এ ছাড়া আমার উপায় ছিল না। একটু থেকে আবার শুরু করলেন, কী কারণে তোমাদের এখানে আসতে বলেছি, খুব সম্ভব আন্দাজ করতে পারছ না। যাই হোক, আমি তোমাদের আর সাসপেন্সের মধ্যে রাখতে চাই না। আমার বয়স এখন একষট্টি চলছে। ছমাস আগে রিটায়ার করেছি। পৃথিবীতে আমার জন্য নির্দিষ্ট সব কাজই প্রায় শেষ হয়েছে। তোমাদের সবাইকে মানুষ করতে পেরেছি। এ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা নেই। তোমাদের মা দশ বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। সেদিক থেকেও আমি মুক্ত। কোনো ব্যাপারেই আমার এখন আর দায়িত্ব বা বন্ধন থাকার কথা নয়। কিন্তু আমার ধারণা, এখনও একটা বড় কাজ আমার বাকি আছে। সেটা শেষ না হলে আমার লাইফের সাইকেল কমপ্লিট হবে না। অসীম গ্লানি আর পাপের কষ্ট নিয়ে আমাকে মরতে হবে।

    সবাই উদগ্রীব হয়ে অবনীনাথের দিকে তাকিয়ে ছিল। অভীক বিমূঢ়ের মতো জিগ্যেস করল, তোমার কী কাজ বাকি আছে?

    অবনীনাথ বললেন, সেটা বলার জন্যেই তোমাদের ডেকে এনেছি। জীবনের শেষ চ্যাপ্টারে পৌঁছে আমি নিজের সম্পর্কে একটা ভাইট্যাল ডিসিশন নিয়েছি।

    কীসের ডিসিশান?

    সেটা পরে বলব। তার আগে একটা প্লেন টুথ মানে সরল সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাই। কিন্তু তোমাদের মনে রাখতে হবে সত্য বড় নিষ্ঠুর।

    অঞ্জন বলল, তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা।

    অবনীনাথ ডান হাতটা সামান্য তুলে বললেন, একটু অপেক্ষা করো; সব বুঝতে পারবে। বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর সবাইকে দেখতে দেখতে আবার শুরু করলেন, আমি জানি তোমরা আমাকে কী চোখে দ্যাখো। তোমাদের কাছে আমি একজন সুপারম্যান-সৎ, মহৎ, কর্তব্যপরায়ণ। তোমরা হয়তো ভাবো একজন আইডিয়াল ফাদারের মডেল যা হওয়া উচিত, আমি হলাম তাই। মনে মনে দুহাজার ফুট ওপরে একটা বেদিতে আমাকে বসিয়ে ফুল-টুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছ। তোমরা আমাকে নিয়ে যে মিথ তৈরি করেছ তা ভাঙার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু মিথ-র চেয়ে সত্য অনেক বড়, অনেক বেশি পাওয়ারফুল। একদিন তার সামনে দাঁড়াতেই হয়। আমার এই একষট্টি বছর বয়সে সেই সময় এসেছে।

    অভীক, অঞ্জন, মৃদুলা বা চিরদীপ–কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই শ্বাসরুদ্ধের মতো বসে রইল।

    অবনীনাথ বলতে লাগলেন, আমি যেমন, তোমাদের বাবা তেমনই একজন রক্তমাংসের মানুষ। পৃথিবীর তিনশো কোটি ইনডিভিজুয়ালের আমি একজন। আমার এই শরীর বা মন কোনোটাই শুধুমাত্র কর্তব্যবোধ, আদর্শ, ন্যায় নীতি–এমনি ভালো ভালো পবিত্র জিনিস দিয়ে বোঝাই নয়। আর সব মানুষের মতো আমিও নানারকম প্রবৃত্তির স্প্রেভ। আমার মধ্যে কামনা, আকাঙ্ক্ষা, প্যাশান ছাড়াও এমন সব ইনস্টিংক্ট আছে যার কথা শুনলে তোমরা শিউরে উঠবে। তোমরা এত কাল যে অবনীনাথ চ্যাটার্জিকে আইডিয়াল গৃহস্থ, আইডিয়াল স্বামী, আইডিয়াল অধ্যাপক, আডিয়াল সামাজিক প্রাণী আর মডেল বাবা হিসেবে দেখে এসেছ, এগুলো তার ছদ্মবেশ। একটা লোক একই সঙ্গে একষট্টি বছর পর্যন্ত কত ভূমিকায় অভিনয় করে গেল, কিন্তু সে এতই দুর্দান্ত অ্যাক্টর যে কেউ আসল মানুষ্টাকে ধরতে পারল না; এমনকী তার সন্তানেরাও নয়। কিন্তু এখন বাইরের মেক আপ তুলে সবার সামনে নিজেকে দাঁড় করাবার সময় হয়েছে। তোমাদের কাছে আমার কিছু কনফেসান আছে। সব শুনে তোমরা ঠিক করবে আমি কতটা মহৎ বা কতটা ঘৃণ্য।

    সুদীপা এইসময় বলে, তুমি আমাদের চোখে ছোট হয়ে যাবে, এমন কোনও কথা আমরা শুনতে চাই না বাবা। তাকে খুবই বিচলিত দেখাতে লাগল।

    অঞ্জন বলল, একষট্টি বছর যা তুমি বলোনি, তা আজ না-ই বা বললে। যে উঁচু পেডেস্টালে তোমাকে আমরা বসিয়ে রেখেছি সেখান থেকে নামাতে গেলে আমাদের ভীষণ কষ্ট হবে।

    অভীক বলল, যা বললে আমরা দুঃখ পাব তা তুমি বোলো না বাবা।

    মৃদুলা রঞ্জনা চৈতী এবং মৃন্ময়ও একই কথা বলল। শুধু চিরদীপ-ই চুপ করে রইল। সবে তিনমাস তার বিয়ে হয়েছে; একেবারে আনকোরা নতুন জামাই। তার কী যে বলা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। ফলে তাকে ভীষণ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে।

    অবনীনাথ বললেন, বলতে আমাকে হবেই। এই বলার ওপর আমার সেই ডিসিশানটা নির্ভর করছে। একটু থেমে অন্যমনস্কর মতো আবার বললেন, টুথ ইজ ট্রুথ। তাকে ফেস করাই ভালো। ভেবে দেখো, আমার মৃত্যুর পর যদি কোনোরকমে আমার জীবনের একটা গোপন দিকের কথা তোমরা জানতে পারো তখন ভাববে আমরা এক শঠ প্রতারক চরিত্রহীন বাপের সন্তান হয়ে এই পৃথিবীতে বড় গ্লানি নিয়ে বেঁচে আছি। তখন সেলফ ডিফেন্স বা কৈফিয়ত দেবার জন্য আমি থাকব না। বেঁচে থাকতে থাকতেই নিজের কথা আমাকে বলে যেতেই হবে।

    ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ বা জামাইরা কেউ কিছু বলল না।

    খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর অবনীনাথ অদৃশ্য পর্দা সরিয়ে তাঁর জীবনের অজানা দিক উন্মোচন করতে শুরু করলেন।

    .

    অবনীনাথদের দেশ বীরভুম ডিস্ট্রিক্টে; রামপুরহাটের কাছাকাছি একটা গ্রামে তাঁর বাবা ছিলেন ফিউডাল যুগের শেষ প্রতিনিধিদের একজন।

    একদা সেই টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির গোড়ার দিকে প্রায় এক হাজার একর জায়গা জুড়ে ছিল অবনীনাথের পূর্বপুরুষদের বিশাল জমিদারি। তারপর তিন জেনারেশান জনবল পাঁচ গুণ বেড়ে যাওয়ায় এবং জমিজমা ক্রমাগত ভাগ হতে থাকায় অবনীনাথের বাবার অংশ একশো বিঘেতে এসে ঠেকেছিল।

    একশো বিঘে ফলবান ল্যান্ড প্রপার্টি কথার কথা নয়। ঠিকমতো কাজে লাগালে তাই দিয়ে আরও পাঁচশো বিঘে জমি বাড়ানো যায়। কিন্তু যার শরীরে কয়েক জেনারেশন ধরে সত্যিকারের ব্লু ব্লাড বইছে তার পক্ষে চাষবাস বা জমিজমার খোঁজ রাখা অনেক নীচু স্তরের কাজ। এই পৃথিবীতে সত্তর বছর বেঁচে গেছেন তিনি। এই দীর্ঘ সময়ে তিনটি কাজ দারুণ প্যাসান দিয়ে করেছেন। এক নম্বর, সন্তানের জন্মদান; অবনীনাথরা সবসুদ্ধ সাত ভাইবোন। দুনম্বর হল তন্ত্রসাধনা। বাবার জন্য অবনীনাথদের বাড়িটা তান্ত্রিক এবং কালীসাধকদের একটা হেড কোয়ার্টার হয়ে উঠেছিল। কাঁপালিকদের মতো বাবার কপালে গোলা সিঁদুরের প্রকাণ্ড ডগডগে ফোঁটা থাকত, গলায় ঝুলত রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে রুদ্রাক্ষের তাগা। তবে রক্তাম্বর পরতেন না। নিয়ম করে প্রতি সন্ধ্যায় দিশি মদ মায়ের প্রসাদি করে কারণবারি পান করতেন। সেই সঙ্গে প্রসাদি পাঁঠার মাংস। কারণ এবং মাংসের এই সেশানটা চলত মাঝরাত পর্যন্ত। দেশি মদের জন্যই কিনা কে জানে, যতক্ষণ জেগে থাকতেন বাবার চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে থাকত। বাবার তিন নম্বর অ্যাকটিভিটি হল যাত্রা। আশপাশের দশ-বিশটা মৌজার তাবৎ অ্যাক্টর জুটিয়ে একটা থিয়েটারের দল খুলেছিলেন তিনি। পুজোর সময়ে অষ্টমী আর নবমীর রাত্তিরে এবং পয়লা বৈশাখ মোট তিনখানা প্লে নামানো হত। তবে পুরোনো আমলের দো-মহলা বাড়ির বাইরের দিকের একটা ঘরে সারা বছর রিহার্সাল চলত।

    তিনটে বড় অ্যাকটিভিটির মধ্যে প্রথমটা অর্থাৎ ছেলেপুলে দিয়ে ঘরবাড়ি বোঝাই করার কাজটা বিনা খরচাতেই হয়ে যেত। কিন্তু বাকি দুটো ব্যাপারে অর্থাৎ তন্ত্র সাধনা এবং থিয়েটারে জলের মতো পয়সা বেরিয়ে যেত। বাবার দৌলতে বাড়ির অবস্থা দাঁড়িয়েছিল পাটিগণিতের সেই চৌবাচ্চার অঙ্কের মতো। সেই যে চৌবাচ্চাটা যার দশটা ফুটো দিয়ে অনবরত জল বেরোয় কিন্তু চৌবাচ্চাটা বোঝাই করার কল শুধু একটাই।

    তন্ত্র, থিয়েটার আর দিশি মদ নিয়ে দিনের পনেরো-ষোল ঘন্টা কেটে যেত বাবার। বাকি আট ঘণ্টা ঘুম বিশ্রাম স্নান খাওয়ার জন্য বরাদ্দ ছিল। এভাবে গোটা দিনটা যার কেটে যায় তাঁর পক্ষে ছেলেমেয়েদের দিকে নজর দেবার সময় থাকে না। বংশ পরম্পরায় এই ফ্যামিলিতে যা হয়েছে অবনীনাথ এবং তাঁর ভাই-বোনদের ভাগ্যেও তা-ই ঘটত। অযত্নে জঙ্গলের আগাছার মতোই তাঁরা বেড়ে উঠতেন। তারপর পুরুষানুক্রমে যা ঘটেছে বাপ ঠাকুরদার কার্বন কপি হয়ে তন্ত্র, দিশি মদ, প্রসাদি মাংস এবং থিয়েটারের দল নিয়েই কেটে যেত। কিন্তু তা হয়নি। তার কারণ মা।

    অবনীনাথের মা ছিলেন বাবার একেবারে উলটো। তিনি এসেছিলেন গরিব স্কুলমাস্টারের ঘর থেকে। পেটে কিঞ্চিৎ কালির অক্ষর ছিল তাঁর। সে আমলে আপার প্রাইমারি পাশ করেছিলেন মা।

    জীবন সম্পর্কে মা এবং বাবার অ্যাটিচুড ছিল একেবারে আলাদা। মা বুঝতে পেরেছিলেন অলস উড়নচন্ডী তান্ত্রিক এবং মদ্যপ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকার। যা করার নিজেকেই করতে হবে। সে আমলে মেয়েরা আজকালকার মতো এত প্রোগ্রেসিভ হয়নি। বাড়ি থেকে তাদের বাইরে বেরুবার চল ছিল না; বিশেষ করে গ্রামের দিকে। মা আড়ালে বসেই কিষাণ-টিষাণ লাগিয়ে চাষ-টাস করাতেন। জোর করেই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে আশি-নব্বই মাইল দূরে এক পড়তি ফিউডাল ফ্যামিলির পুরোনো বাড়ির অন্দরমহলে বসে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মারাত্মক সময় আসছে; সেখানে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে হলে ছেলেমেয়েদের পেটে কিছু লেখাপড়া ঢুকিয়ে দিতে হবে।

    কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সংসারের ধস তিনি ঠেকাতে পারেননি। প্রচণ্ড বদরাগী হঠকারী তান্ত্রিক স্বামী তাঁর খেয়ালখুশি মেটাতে যখন ইচ্ছা জমি বাঁধা দিতেন; তারপর চক্রবৃদ্ধিহারে সুদের দায়ে এক বিঘে দুবিঘে করে যেতে যেতে তাঁর অংশের জমি দ্রুত কমে আসতে শুরু করেছিল। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে মা-র প্রায়ই ঝগড়া লেগে থাকত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল জীবনভর যুদ্ধের। কিন্তু বেহিসাবি বেপরোয়া বাবাকে আটকাবার শক্তি মায়ের ছিল না।

    স্বামী সম্পর্কে হতাশ হবার পর মায়ের চোখ এসে পড়েছিল বড় ছেলে অবনীনাথের ওপর। ভেবেছিলেন সব জমিজামা একেবারে হাতছাড়া হবার আগেই যদি ছেলেটা মানুষ হয়ে যায়। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে গেলে বাকিগুলোকে সে-ই টেনে তুলবে।

    বাবা মনে করতেন, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার মতো একটা বাজে ব্যাপারে পয়সা খরচ করার কোনো মানে হয় না। কিন্তু মা প্রায় সব দিক থেকে হেরে গেলেও এই একটা জায়গা থেকে একচুল নড়েননি। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে যুদ্ধ করে গেছেন। দারুণ ছাত্র ছিলেন অবনীনাথ। ম্যাট্রিক পাশ করে বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হলেন তখন বাবার রক্তের তেজ শতকরা নব্বই ভাগ মরে গেছে। এদিকে জমিজমাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। টের পাওয়া যেত খুব কষ্টেই দিন চলছে তাঁদের।

    পর পর ভাইবোনগুলোও লেখাপড়া করে যাচ্ছিল। মায়ের শরীর তখন ভেঙে পড়েছে। কী করে যে সংসার চালিয়ে এতগুলো ছেলেমেয়ের লেখাপড়া টেনে গেছেন তিনিই একমাত্র জানেন।

    জীবনের একেবারে শেষ হরাইজনের কাছে পৌঁছে বাবাও বদলে যেতে শুরু করেছিলেন। টাকাপয়সা ঢালা যাচ্ছিল না বলে তান্ত্রিক কাঁপালিকরা অনেক আগেই উধাও হয়েছিল। থিয়েটারের দল কবেই ভেঙে গেছে। তবে বাজারের কেষ্ট সাহার দোকান থেকে রোজ এক পাট করে দিশি মদ আনিয়ে মা কালীর পটের সামনে মড়ার খুলিতে ঢেলে কারণ করে খেতেন বাবা। যাই হোক, গ্র্যাজুয়েট ছেলের দিকে তাকিয়ে তাঁর এত দিনে মনে হয়েছিল, তাঁর প্রচুর বাধা এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্ত্রী এই ছেলেটাকে অত্যন্ত মূল্যবান একটা অ্যাসেট তৈরি করে তুলেছে। জমিজমা সবই প্রায় গেছে, যাক। এই ছেলেটাকে ধরে সংসারটা আবার দাঁড়াতে পারে। গলার স্বরে বীরভূমের রুক্ষ অথচ মিষ্টি একটা টান দিয়ে বলেছিলেন, তুমার গর্ভধারিণী একটা কাজের মতন কাজ করেছে বটে। লিখাপড়া করতে না পাঠিয়ে আমি সর্বনাশটিই করে দিচ্ছিলাম। পুরানো চাল, পুরানো দিন চলে গেছে। এখন লেখাপড়াটা বড় দরকার হে। আমার আগে তুমার মার চক্ষু ফুটেছিল তাই রক্ষা।

    জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা বদলে যাবার পর নতুন চোখে পৃথিবীটাকে দেখতে শুরু করেছিলেন বাবা। গ্রামের দিকে তখন ঘরে ঘরে লেখাপড়ার চল। ভেবেছিলেন বাড়ির একটা ছেলেই না, অন্য সবাইও মানুষ হোক। কিন্তু ব্যাপারটা এত দেরিতে তিনি বুঝেছিলেন যে তখন ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করার ক্ষমতা ছিল না তাঁর। বাড়ি এবং অবশিষ্ট জমিজমা তখন পাশের গ্রামের এক উঠতি বড়লোকের কাছে বাঁধা পড়ে গেছে। সুদ আর আসল মিলিয়ে এমন একটা অঙ্ক দাঁড়িয়েছিল যাতে যে-কোনো দিন ক্রোকের নোটিশ এসে যাবার কথা।

    বাবার ইচ্ছে ছিল, বি.এটা পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতায় একটা চাকরি-টাকরি জুটিয়ে সংসারের দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিক অবনীনাথ কিন্তু মা কিছুতেই রাজি হননি। বি.এ-তে এত ভালো রেজাল্ট করার পর আচমকা মাঝপথে পড়াটা বন্ধ হয়ে যাবার কথা তিনি ভাবতেও পারেননি।

    কিন্তু কলকাতায় না গেলে এম.এ পড়া সম্ভব নয়। প্রায় একশো মাইল দূর থেকে ভেইলি প্যাসেঞ্জারি করে সেকালে কলকাতায় পড়তে আসার কথা ভাবা যেত না। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে হলে কলকাতায় থাকতে হয়। অবনীনাথের বাবা বলেছিলেন, কলকাতায় ছেলেকে রেখে পড়ার খরচ চালাবে কী করে?

    মা বলেছিলেন, যেভাবে হোক আর যত কষ্টেই হোক, দুটো বছর চালাতেই হবে। মনে আছে, মা অবনীনাথকে সঙ্গে করে নিয়ে কলকাতার বকুলবাগানে তাঁর এক জেঠতুতো দাদার বাড়িতে চলে এসেছিলেন।

    মায়ের এই দাদা অর্থাৎ অবনীনাথের মামা মানুষটি চমৎকার–যেমন হৃদয়বান তেমনি আমুদে আর হাসি-খুশি। মামিও ভারী ভালোমানুষ, খুবই স্নেহপ্রাণ। গোলগাল আদুরে ধরনের চেহারা। একটিমাত্র মেয়ে ওঁদের। বিয়ে হয়ে গেছে, তখন স্বামীর সঙ্গে টাটানগরে থাকত।

    হঠাৎ খুড়তুতো বোন এবং তাঁর ছেলেকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন মামারা। মা মামাকে বলেছিলেন, দাদা, অবুকে নিয়ে এসেছি। দুটো উপকার তোমাকে করে দিতে হবে।

    মামা হেসেছিলেন, উপকার আবার কী রে! কত বছর পর তোকে দেখলাম। দাদার সঙ্গে সম্পর্ক তো আর রাখিস না। এখন বল কী করতে হবে। যা বলবি তা-ই করে দেব।

    মা কাপড়ের একটা ঝোলা থেকে দেড়শো টাকা বার করে মামাকে দিতে দিতে বলেছিলেন, এটা রাখো। অবুকে এম.এতে ভর্তি করে দেবে আর ওর কলকাতায় থাকার জন্য একটা জায়গা ঠিক করে দিও। খুব বেশি টাকাপয়সা দিতে পারব না; আমাদের অবস্থা তুমি তো শুনেছ।

    মামা বলেছিলেন, একটা কাজ আমি পারব, আরেকটা কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।

    বিমূঢ়ের মতো, মা মামার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

    মামা বলেছিলেন, এম.এ.-তে দু-একদিনের মধ্যেই ভর্তি করে দিচ্ছি কিন্তু থাকার জন্য মেস-টেস খুঁজে দিতে পারব না।

    মা অবাক, অবু তাহলে থাকবে কোথায়?

    আমাদের কাছে। বলে একটু থেমে মামা ফের বলেছিলেন, তোর সাহস দেখে আমি থ হয়ে যাচ্ছি। দাদার কাছে ছেলেকে নিয়ে এসে বলছিস থাকার জায়গা খুঁজে দিতে।

    মা কুণ্ঠিত মুখে বলেছিলেন, কিন্তু

    মামি এবার বলেছিলেন, কোনো কিন্তু না। আমাদের না জানিয়ে অবুকে মেসে বা হস্টেলে রাখতে, সেটা নাহয় মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু সব জানার পর ওকে মেসে পাঠানো চলবে না।

    মামা বলেছিলেন, মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবার পর এত বড় বাড়িটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। অবু এখানে থাকলে আমাদের খুব ভালো লাগবে।

    এর পরও মা কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু মামা-মামি বলতে দেননি। সুতরাং অবনীনাথ বকুলবাগানেই থেকে গিয়েছিলেন।

    মনে আছে, দিন দুয়েক বাদে মাকে লোক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে মামা তাঁকে নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন।

    এর আগে কলকাতায় চার-পাঁচবারের বেশি আসেননি অবনীনাথ। বার দুই মাকে নিয়ে কালীঘাটে, একবার ছেলেবেলায় জ্ঞাতিকাকার সঙ্গে একবার চিড়িয়াখানা এবং মিউজিয়াম দেখতে, আর বার তিনেক আত্মীয়স্বজনের বিয়েতে। এখনকার মতো সেকালে গ্রাম-টাম থেকে কলকাতায় যাতায়াতের এত চল ছিল না।

    আগে যে কবার অবনীনাথ কলকাতায় এসেছিলেন তাতে এ শহরকে ভালোভাবে দেখার সুযোগ পাননি। পুরোনো গথিক স্ট্রাকচারের বিরাট বিরাট থাম আর সিঁড়িওলা সিনেট হল, দ্বারভাঙা বিল্ডিং, আশুতোষ বিল্ডিং, ইউনিভার্সিটি কম্পাউন্ডে মোটা মোটা পামের সারি, ঝকঝকে স্মার্ট চেহারার সব যুবক যুবতী এসব দেখতে দেখতে এ শহরে প্রায় আনকোরা মফস্সলের এক যুবক যতটা অবাক ঠিক ততটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল।

    ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার পর থেকেই অবনীনাথ লক্ষ করেছিলেন, চারপাশের ছেলেমেয়েদের অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে মজাদার ভঙ্গি করে হাসছে। আর কী যেন বলাবলি করছে। ব্যাপারটা মামার চোখেও পড়েছিল। কারণটা বুঝতে দুজনেরই অসুবিধা হয়নি।

    জন্মের পর থেকে গ্রামে থেকেছেন অবনীনাথ। কলেজে পড়বার সময় বাঁকুড়ায় অবশ্য কটা বছর থাকতে হয়েছে কিন্তু তখনকার বাঁকুড়া শহর একটা বড় ধরনের গ্রাম ছাড়া আর কিছু নয়। তার চরিত্র চালচালন বা জীবনযাত্রায় সাময়িক স্ট্যাম্প মারা ছিল না। তখন গ্রামে বা দূর মফস্সল শহরে টাউজার্স বা জামা-টামা ঢোকেনি। কলকাতার ফ্যাশন-ট্যাশন ছিল ওখানে অচ্ছুৎ।

    সেটা নাইটটিন থার্টি নাইন। সেকেন্ড গ্রেট ওয়ার তখনও শুরু হয়নি। তবে কলকাতায় বসে ইউরোপের বাতাসে বারুদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

    প্রায় চল্লিশ বছর আগে অবনীনাথ নামে যে যুবকটি সেদিন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে এসেছিল তার চেহারা এবং সাজপোশাক ছিল দেখবার মতো। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলে জবজবে করে তেল মাখা। মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথি চলে গেছে; নাকের তলায় মোটা গোঁফ। জুলপি বলতে কিছু নেই। একেবারে কানের কাছ থেকে নীচের দিকে চুল চেঁছে ফেলা হয়েছে। পরনের ডবল কাফ দেওয়া বেপ ফুল শার্ট আর খাটো ধুতি। শার্টটার হাতার বোতাম তো বটেই, গলার বোতাম পর্যন্ত আটকানো রয়েছে। বুক পকেটে ঘড়ি রাখার ফোঁকরও আছে। ধুতির কোঁচাটা সামনের দিকে ঝুলছে। এ ছাড়া পায়ে মোজা। এবং চল্লিশ বছর আগেকার বাংলাদেশের গাঁ অবনীনাথের সারা শরীরে তার মার্কা দিয়ে রেখেছে।

    মামা তাঁর দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলেছিলেন, এসব ড্রেস চলবে না অবু। হেড টু ফুট তোকে একেবারে বদলে ফেলতে হবে। নইলে ক্লাস করতে এসে ছেলেরা তোর পেছনে লাগবে। একটু থেমে পরক্ষণে আবার বলেছিলেন, আজ অফিস থেকে ফিরে টেলারের কাছে নিয়ে যাব। কটা টাউজার্স আর শার্ট করিয়ে দিতে হবে। কেড়স চলবে না; ওটার বদলে চপ্পল-টপ্পল কিনে ফেলব। আর চুলটার তো সর্বনাশ করে রেখেছিস। ওগুলো বড় না হলে জুলপি বানানো যাবে না। আর তোর ওই কাঁকড়া গোঁফটা একেবারে ইম্পসিবল; ওটা টোটালি মাইনাস করে দিতে হবে।

    গোঁফ সম্পর্কে খানিকটা মায়া ছিল অবনীনাথের কিন্তু কী আর করা যাবে। শরীরের একটা-দুটো জুলপি গজালে প্রফিট বা লস কোনোটাই নেই। ওটাও নাহয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে শার্ট, টাউজার্স আর চপ্পল-টপ্পল নিয়ে। এগুলো কিনতে পয়সা লাগে। অবনীনাথ নিজের অবস্থা জানেন। একে তো মামার কাছে আছেন। যদিও ওঁরা খুবই যত্নে এবং আদরের মধ্যে তাঁকে রেখেছেন, তাঁদের আন্তরিকতা এবং আপন-করা ব্যবহারে যদিও কোথাও বিন্দুমাত্র ক্রটি নেই তবু ভেতরে ভেতরে কিছুটা বিব্রত হয়েই থাকতেন অবনীনাথ। তার ওপর যদি মামা আবার এত সব পোশাক-টোশাক কিনে দেন, তা সেটা হবে খুবই লজ্জার ব্যাপার।

    অবনীনাথ উত্তর দেননি। অপরিসীম কুণ্ঠায় মুখ নীচু করে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আশুতোষ বিল্ডিংয়ের লম্বা করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।

    তাঁর মনোভাব কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন মামা। গভীর স্নেহে কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে বলেছিলেন, বোকা ছেলে, মামার কাছ থেকে নিতে লজ্জা কীসের? তোর বাবা দিলে নিতিস না?

    এর আর কিছু বলার থাকে না। অবনীনাথের মনে মামার সম্বন্ধে শ্রদ্ধা, মুগ্ধতা এবং কৃতজ্ঞতা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায় মাত্র।

    যাই হোক অবনীনাথের সাবজেক্ট ছিল ইংরেজি। হেড অফ দি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে দেখা করে তাঁর রেকমেন্ডেশন নিয়ে অ্যাডমিশন ফর্ম ফিল-আপ করে ভর্তির টাকা জমা দিতে দিতে ঘন্টাখানেক লেগে গিয়েছিল।

    অফিসে সেদিনে খুব জরুরি একটা কাজ ছিল মামার। আগে থেকেই তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন অবনীনাথকে ভর্তি করে সোজা অফিসে চলে যাবেন। আর অবনীনাথ বকুলবাগানে ফিরে আসবেন। কিন্তু একা একা কলকাতার রাস্তায় চলাফেরা অভ্যাস তখনও হয়নি তাঁর। মামা একটু চিন্তিতভাবেই জিগ্যেস করেছিলেন, বাসে তুলে দিলে বাড়ি ফিরতে পারবি তো?

    ভাবনা যে একেবারে হচ্ছিল না তা নয়। কিন্তু বাইশ বছরের একটি যুবকের কলেজ স্ট্রিট থেকে ভবানীপুরের বকুলবাগানে একা ফিরতে না পারাটা খুবই লজ্জার কথা। অবনীনাথ বলেছিলেন, পারব।

    চল তা হলে

    দ্বারভাঙা বিল্ডিং থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন মামা। তারপর খুশিতে প্রায় চেঁচিয়েই উঠেছিলেন, আরে অনুতাঁর চোখ-মুখে হাসি ঝকমকিয়ে উঠেছিল।

    ততক্ষণে অবনীনাথও দেখতে পেয়েছেন। তাঁরই প্রায় সমবয়সি একটি মেয়ে নীচ থেকে উঠে আসছিল। মামাকে দেখে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেছিল মেয়েটি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাছে চলে এসেছিল সে।

    মেয়েটির গায়ে রং আশ্বিনের রৌদ্র-ঝলকের মতো। পানপাতার মতো ভরাট মুখ, চোখ দুটো যেন রুপোর কাজললতা, ছোট কপালের ওপর থেকে ঘন চুলের ঘের, গলাটা নিভাঁজ মসৃণ। তার চোখে মুখে হাসির আভা লেগেই আছে। ঘড়ি ছাড়া সারা গায়ে গয়না বলতে কিছু নেই। কাঁধ থেকে চমৎকার কাজ করা একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে।

    মামা আবার বলেছিলেন, অ্যাডমিশানের জন্যে এসেছিস নাকি?

    বন্ধু আজ ভর্তি হবে। ও আসতে বলেছিল, তাই।

    তোদের ক্লাস কবে থেকে আরম্ভ হচ্ছে?

    এই তো সবে অ্যাডমিশান শুরু হল। এ সব মিটুক। এক মাসের আগে ক্লাস শুরু হবে। বলে তো মনে হয় না।

    মামা বলেছিলেন, তোমার ওপর আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করেছি বাপু।

    মেয়েটি হেসে বলেছিল, দশ-বারো দিন আপনার বাড়ি যাইনি বলে তো?

    হ্যাঁ। বি.এ-র রেজাল্ট বেরুবার পর সেই যে একবার এলি, তারপর আর পাত্তা নেই।

    কী করব কাকু, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি প্রণাম করতে যেতে হল। বন্ধু-বান্ধবরা দুবেলা আসতে লাগল। তাই।

    ঠিক আছে। এবার থেকে যেন রেগুলার দেখতে পাই।

    মেয়েটি ঘাড় কাত করে দিয়েছিল, রেগুলারই দেখতে পাবেন। একটু থেমে কী ভেবে ফের বলেছিল, কিন্তু কাকু, আপনি হঠাৎ ইউনিভার্সিটিতে?

    এতক্ষণে অবনীনাথের কথা খেয়াল হয়েছিল মামার। ব্যস্তভাবে তাঁকে দেখিয়ে মেয়েটিকে বলেছিলেন, ওর অ্যাডমিশানের ব্যাপারে এসেছিলাম। ওই দেখ, এখনও তোদের আলাপটাই করিয়ে দেওয়া হয়নি। এ হল আমার ভাগনে অবনী। মেয়েটি সম্বন্ধে অবনীনাথকে বলেছিলেন, আর এ হল অনু–অনীতা। এ বছর হিস্ট্রি অনার্স নিয়ে পাশ করেছে।

    অনীকে দেখার পর থেকেই পলকহীন তাকিয়ে ছিলেন অবনীনাথ। এমন স্মার্ট সাবলীল মেয়ে আগে আর কখনও দেখেননি তিনি।

    ওদিকে অনীতা একপলক তাকিয়ে হাতজোড় করে হাসিমুখে বলেছিল, নমস্কার।

    মেয়েদের সঙ্গে মেশার অভ্যাস ছিল না অবনীনাথের। তা ছাড়া অনীতার মতো মেয়ে আগে তিনি চোখেই দেখেননি। হকচকিয়ে গিয়ে কোনোরকমে দুহাত তুলে জড়ানো গলায় বলেছিলেন, নমস্কার।

    এদিকে একটা কথা মনে পড়ে গিয়েছিল মামার। অনীতাকে বলেছিলেন, তোর সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো হয়েছে। কতক্ষণ তুই ইউনিভার্সিটিতে থাকবি?

    বেশিক্ষণ না। কেন?

    সোজা বাড়ি চলে যাবি তো?

    হ্যাঁ।

    তা হলে এক কাজ করিস; অবুকে সঙ্গে করে নিয়ে যাস। আমাকে এক্ষুনি অফিসে ছুটতে হবে। অবুটা কলকাতায় একেবারে আনকোরা, রাস্তা-টাস্তা কিছুই চেনে না। আমাদের বাড়িতে ওকে একটু পৌঁছে দিস।

    চোখের কোণ দিয়ে অবনীনাথকে আবার দেখেছে অনীতা। তার চোখে গোপন কৌতুকের একটু হাসি চকমকিয়ে উঠেছিল। একটি বাইশ-তেইশ বছরের যুবক কলকাতার এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় একা যেতে পারে না, তার কাছে এটা দারুণ মজার ব্যাপার। ঠোঁটের কোণ কামড়াতে কামড়াতে সে বলেছিল, নিশ্চয়ই পৌঁছে দেব। আপনি চলে যান কাকু।

    অবনীনাথ কারো দিকে তাকাতে পারছিলেন না। চোখ নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। লজ্জায় নাক মুখ ঝাঁ ঝাঁ করছিল তাঁর। এমন বিশ্রী অবস্থায় আগে কখনও পড়েননি। মামা সরল মনে তাঁর ভালো করতে গিয়ে কী কাজ যে করে গিয়েছিলেন তিনি নিজেই জানেন না।

    যাই হোক। মামা আর দাঁড়াননি; অবনীনাথকে অনীতার হাতে গচ্ছিত রেখে চলে গিয়েছিলেন। আর অনীতা আরও দু-একবার অবনীনাথের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আসুন আমার সঙ্গে।

    সিঁড়ি ভেঙে অনীতার সঙ্গে আবার ওপরে উঠতে উঠতে অবনীনাথ টের পেয়েছিলেন, হৃদপিণ্ডের উত্থান পতন দ্রুততর হয়ে উঠছে। পা দুটো ভীষণ কাঁপছিল তাঁর।

    চলতে চলতে অনীতা বলেছিল, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেই চলে যাব। ম্যাক্সিমাম হাফ অ্যান আওয়ার কি ফর্টি মিনিটস এখানে থাকব। আপনার অসুবিধা হবে না তো?

    আড়ষ্ট গলায় অবনীনাথ কোনোরকমে বলেছিলেন, না।

    মনে আছে, প্রায় ঘণ্টাখানেক অনীতার পিছু পিছু দ্বারাভাঙা বিল্ডিং, আশুতোষ বিল্ডিং আর সেনেট হলে ঘুরেছিলেন অবনীনাথ কিন্তু যার জন্য এত ঘোরাঘুরি তাকে পাওয়া যায়নি। অনীতা একটু হতাশ এবং বিরক্ত হয়েই বলেছিল, দেখুন তো, বিশাখাটা এল না, শুধু আমাকে ছুটিয়ে আনল।

    অবনীনাথ অবস্থা গলায় কিছু একটা বলেছিলেন, বোঝা যায়নি।

    অনীতা বলেছিল, একবার দেখা হোক, বিশাখাকে মজা দেখিয়ে ছাড়ব। আমার অনেক কাজ ছিল, সব ফেলে এলাম। কোনো মানে হয়! যাক গে, আপনাকে দিয়ে অনেক সিঁড়ি ভাঙিয়েছি, আর না। চলুন–

    অনীতার মতো একটা ঝকঝকে মেয়ের সঙ্গে ওইরকম সাজপোশাক, চুলের ছাঁট, মাথায় মাঝ বরাবর সিঁথি, পায়ে লাল কেড়স নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একেবারে কুঁকড়ে ছিলেন অবনীনাথ। ভয়ে ভয়ে এবার বলেছিলেন, হয়তো কোনো কাজে আপনার বন্ধু আটকে গেছেন। আরেকটু অপেক্ষা করলে

    এক সেকেন্ডও আর ওয়েট করব না। চলুন তো

    ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ওঁরা সেনেট হলের উলটো দিকে যেতেই বাস এসে গিয়েছিল। সেই নাইনটিন থার্টি নাইনে একটা প্রাইভেট কোম্পানি কলেজ স্ট্রিট রুটে দোতলা বাস চালাত।

    কলকাতায় তখন পপুলেশন এক্সপ্লোসান হয়নি; রাস্তাঘাটে এখনকার মতো গিজগিজে ভিড় দেখা যেত না। কলকাতা তখন ছিমছাম পরিচ্ছন্ন মেট্রোপলিস। প্রাইড অফ দি ইস্ট, সেকেন্ড সিটি অফ দি ব্রিটিশ এম্পায়ার–সারা পৃথিবীতে তখন কত নাম-ডাক তার।

    দুপুরবেলা বাসটা প্রায় ফাঁকাই ছিল। একতলায় যদিও দু-চারটে লোক দেখা গেছে দোতলাটা একেবারে খালি। অনীতা অবনীনাথকে নিয়ে সোজা ওপরে উঠে একেবারে সামনের সিটে বসেছিল। অবনীনাথ অবশ্য অনীতার পাশে বসতে চাননি। পিছনের সিটটা দেখিয়ে বলেছিলেন, আমি ওখানে বসছি।

    অনীতা বলেছিল, বা রে, আপনার সঙ্গে ভালো করে আলাপই হল না। বসে যেতে যেতে গল্প করব ভাবলাম। আপনি পিছনে বসলে মুখ ফিরিয়ে কথা বলতে বলতে ঘাড় ব্যথা হয়ে যাবে। এখানে বসুন তত। একরকম জোর-জার করেই অবনীনাথকে কাছে বসিয়েছিল অনীতা।

    এভাবে একজন অনাত্মীয়া তরুণীর পাশাপাশি বসে আগে আর কোথাও যাননি অবনীনাথ। অনীতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে জড়সড় হয়ে থাকতে থাকতে টের পাচ্ছিলেন, সারা শরীর বেয়ে গল গল করে ঘাম বেরুচ্ছে। এক মিনিটের ভেতর জামা-টামা ভিজে সপসপে হয়ে গিয়েছিল।

    এক সময় বাস চলতে শুরু করেছিল। দুধারে নাইন্টিন থার্টিনাইনের কলকাতা। অনীতা বলেছিল, আপনি কী সাবজেক্টে অ্যাডমিশন নিলেন?

    অবনীনাথ বলেছিলেন, ইংরেজি।

    বি.এ-তে ইংলিশেই অনাস ছিল?

    হ্যাঁ।

    কোন ক্লাস পেয়েছিলেন?

    ফার্স্ট ক্লাস~~

    দ্রুত আরেকবার অবনীনাথের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়েছিল অনীতা। অনার্সে ফাস্ট ক্লাসের সঙ্গে তাঁর এই চেহারা এবং পোশাক-টোশাক যেন মিলিয়ে নিতে পারছিল না সে। আস্তে আস্তে তার চোখে সম্ভ্রমের ভাব ফুটে উঠতে শুরু করেছিল। অনীতা বলেছিল, কোন কলেজ থেকে অ্যাপিয়ার করেছিলেন?

    শুধু কলেজ সম্পর্কেই নয় অবনীনাথদের ফ্যামিলি এবং বাড়ি-টাড়ি সম্পর্কেও অনেক কথা জিগ্যেস করেছে অনীতা। অবনীনাথ শ্বাসরুদ্ধের মতো পাশে বসে উত্তর দিয়ে গেছেন।

    আধঘণ্টা বাদে হাজরার কাছে বকুলবাগানের স্টপেজ আসতেই অবনীনাথকে নিয়ে নেমে পড়েছিল অনীতা।

    মেইন রোড থেকে মামাদের বাড়িটা অল্প দূরে; মিনিট তিনেকের রাস্তা। বাড়ির কাছে এসে অনীতা রগড়ের গলায় বলেছিল, এবার যেতে পারবেন তো? ঠাট্টা যে অবনীনাথ বুঝতে পারেননি তা নয়। মজা করে একটা উত্তর দেবার ইচ্ছাও তার হয়েছিল। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোয়নি।

    অনীতা বলেছিল, আচ্ছা চলি। আশা করি আবার দেখা হবে। কাকিমাকে বলবেন দু-একদিনের ভেতর এসে হাজির হব। বলে আর দাঁড়ায়নি, রাস্তা ধরে সোজা সামনের দিকে চলে গিয়েছিল।

    ভদ্রতা করে অনীতাকে বাড়িতে আসার কথা বলা উচিত ছিল। এতটা রাস্তা সে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। সে জন্য একটা ধন্যবাদও ছিল তার প্রাপ্য। কিন্তু আগে কিছুই মনে পড়েনি। পরে যখন মনে পড়ল, রাস্তার বাঁক ঘুরে অনীতা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

    মনে আছে, দিন সাতেক পর একটা দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থায় আবার অনীতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

    ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরের দিনই মামা অবনীনাথকে নিয়ে নামকরা টেলারের দোকানে গিয়ে গোটাকতক শার্ট আর টাউজার্সের অর্ডার দিয়ে এসেছিলেন। মাঝখানে একদিন ট্রায়াল দিয়ে আসা হয়েছে। তারপর ঠিক এক সপ্তাহ বাদে সেদিন শার্ট-টার্ট ডেলিভারি আনা হয়েছিল।

    বাড়িতে এনে অবনীনাথকে একটা ট্রাউজার্স আর শার্ট পরিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন মামা আর মামি। এদিকে মামা আরেকটা কাণ্ড করেছিলেন, বাড়ি থেকে আসার পরই অবনীনাথের চুল কাটা আর দাড়ি কামানো তাঁর অর্ডারে পুরোপুরি বন্ধ। কদিনে ছোট ছোট চুল আরেকটু বড় হয়েছে, জুলপিও খানিকটা গজিয়ে গেছে। সেদিন মামার ডিরেকশানে জুলপি রেখে দাড়ি কামিয়েছেন অবনীনাথ। মাথার মাঝখান থেকে সিঁথিটা বাঁদিকে টান্সফার করা হয়েছিল।

    যাই হোক, টাউজার্স-ফাউজার্স পরিয়ে যখন অবনীনাথকে দেখা হচ্ছে সেই সময় কখন যে অনীতা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ লক্ষ করেননি।

    আচমকা উচ্ছ্বসিত হাসির শব্দে চমকে সবাই ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আর তাকিয়েই কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছিলেন অবনীনাথ।

    হাসতে হাসতে অনীতা বলেছিল, আরে বাবা, চেনাই যাচ্ছে না দেখছি। একেবারে টোটাল রেভলিউশানারি চেঞ্জ।

    মামাও হেসে হেসে বলেছিলেন, এখন থেকে কথাকাতায় থাকবে তো। অবুটার গায়ে শহরের বার্নিশ লাগাচ্ছি।

    অবনীনাথের মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। কদিন আগে ইউনিভার্সিটিতে এই মেয়েটির কাছে প্রচুর লজ্জা পেয়েছিলেন অবনীনাথ। সাত দিন বাদে আবার সেই ব্যাপার ঘটল।

    যাই হোক, অবনীনাথের নতুন সাজ-পোশাকের বহর বা তাঁর চুলের নতুন ছাঁট নিয়ে রগড়টা বেশি দূর এগোয়নি। মামা আর মামি একটু পরেই অনীতাকে নিয়ে পড়েছিল। মামি বলেছিলেন, কী রে মেয়ে, বি.এ পাশ করার পর তো বুঝি নতুন পা গজিয়েছে।

    অনীতা বুঝতে পারছিল মামি তাকে নিয়ে মজা করছে। ঘরে ঢুকে চোখে হাসি ফুটিয়ে সে বলেছিল, কী রকম?

    কত দিন তুই আমাদের বাড়ি আসিস না। সেদিন অবুকে বাড়ির দোর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলি। কিন্তু ভেতরে আসার সময় পেলি না–আঁ?

    অনীতা মুখ কাঁচুমাচু করে হাত কচলাতে কচলাতে বলেছিল, এই তো এলাম। এবার থেকে রোজ আসব। তোমরা তো জানো, তোমাদের এখানে এলে আমার কত ভালো লাগে।

    দেখব কেমন আসিস। এখন বল কী খাবি?

    কিচ্ছু না। একটা কথা বলেই আজ চলে যাব।

    মামা বলেছিলেন, কথাও বলবি, মিষ্টিও খাবি। আমরা এখনও বিকেলের চা-টা খাইনি। ভালোই হয়েছে; একসঙ্গে খাওয়া যাবে।

    মামি সবার জন্য চা আর খাবার-দাবার নিয়ে এসেছিলেন। খেতে খেতে অনীতা বলেছিল, আজ সন্ধেবেলা তোমরা আমাদের বাড়ি যাবে, বাবা বিশেষ করে বলে দিয়েছে। আমাদের ওখানে রাত্তিরে খেয়ে আসবে। বাবা একটা কাজে আটকে গেছেন বলে আসতে পারলেন না। অবনীনাথের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আপনিও যাবেন কিন্তু।

    মামা দারুণ খুশি হয়ে গিয়েছিলেন, যাক, একটা নেমন্তন্ন পাওয়া গেল। ডান হাতের ব্যাপারটা ভালোই হবে। কিন্তু হঠাৎ তোর বাবা লোক ধরে ধরে খাওয়াচ্ছে কেন রে? অকেশনটা কী?

    অনীতা বলেছিল, গেলেই দেখতে পাবেন।

    তুই তাহলে বলবি না! ঠিক আছে, সন্ধে পর্যন্ত সাসপেন্সেই থেকে যাই।

    অনীতা উত্তর না দিয়েই হেসেছিল একটু।

    মামা আবার বলেছিলেন, একটা কথা অন্তত বল–

    অনীতা জানতে চেয়েছে, কী?

    তোদের বাড়ি আজ কী মেনু হচ্ছে? আমি অতশত জানি না। তবে বাবাকে নিউ মার্কেট থেকে মুরগির মাংস আনতে দেখেছি।

    আজ আমাদের নিরামিষ হয়েছে। তোর কাকিমা ঘাট আর ডাঁটা চচ্চড়ি-মচ্চড়ি কী যেন বেঁধেছে। ওসবের নামে জ্বর আসছিল। যাক, ডাঁটার বদলে রাত্তিরে মুরগির ঠ্যাঙ চিবুনো যাবে। গ্রান্ড।

    মামি মামার সম্পর্কে বলেছিল খালি খাওয়া আর খাওয়া। লোকটার সারা শরীরে জিভ আর পেট ছাড়া আর কিছু নেই।

    কথাটা ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা সত্যি। মামা মানুষটির মনটা খুবই বড় মাপের। খেতে যেমন পারতেন তেমনি খাওয়াতেও। কদিনেই অবনীনাথ টের পেয়ে গিয়েছিলেন, নিজের হাতে বাজার করাটা ছিল তাঁর দারুণ শখ। বাজারে ঘুরে ঘুরে সেরা আনাজ, সেরা ফল আর সেরা মাছ কি মাংস তাঁর আনা চাই। তবে যেদিন অফিসে জরুরি কাজ থাকত সেদিন আর বাজারে যাওয়া হত না মামার।

    এলোমেলো আরও কিছুক্ষণ কথার পর অনীতা বলেছিল, এবার যাই। যেতে গিয়েও হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে সে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অবনীনাথের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, জানেন নিশ্চয়ই, নেক্সট উইক থেকে ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে।

    অবনীনাথ বলেছিলেন, কই না, শুনিনি তো।

    আমি কাল ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। জেনে এসেছি।

    অবনীনাথ এবার আর উত্তর দেননি।

    অনীতা ঠোঁট টিপে এবার বলেছিল, ক্লাস শুরু হলে আপনাকে কি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে? কৌতুকে তার দুচোখ চিকচকিয়ে উঠেছিল।

    মজাটা কোন দিক থেকে অনীতা করেছে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি অবনীনাথের। গ্রাম থেকে এসেছেন বলে তিনি একটা অপদার্থ নন যে একা একা বকুলবাগান থেকে কলেজ স্ট্রিট যেতে পারবেন না। আস্তে করে তিনি বলেছিলেন, নিয়ে যাবার দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারব।

    ফাইন। স্বাবলম্বী হওয়া ভালো।

    অবনী কী উত্তর দিয়েছিলেন, এতদিন পর আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে সন্ধেবেলা অনীতাদের বাড়ি যেতে হয়েছিল। তাঁর যাবার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। ভয় হয়েছিল, অনীতা হয়তো এমন কোনো মজার কথাটথা বলে বসতে যাতে লজ্জায় তিনি কারো দিকে তাকাতে পারবেন না। কিন্তু মামা-মামি ছাড়েননি, জোর করে তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন।

    অনীতাদের বাড়িটা খুব বেশি দূরে নয়। মামাদের বাড়ির সামনে দিকে যে রাস্তাটা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে সেটা ধরে মিনিট তিনেক হাঁটলে একটা বাঁক, বাঁকের পর চারখানা বাড়ি ছাড়িয়ে ওদের ছিমছাম ছোট্ট দোতলা বাড়িটা।

    একতলায় অনীতাদের বসবার ঘরটা বেশ বড় আর চমৎকার করে সাজানো। সেখানে কয়েকজন পুরুষ, মহিলা আর দু-তিনটে ছোট ছেলেমেয়ে গল্প করছিল।

    অবনীনাথরা ওখানে আসতেই মধ্যবয়সি সুপুরুষ চেহারার একটি ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আসুন আসুন ব্যানার্জিসাহেব, আসুন মিসেস ব্যানার্জি-অবনীনাথকে দেখিয়ে বলেছিলেন, এ নিশ্চয়ই আপনার ভাগ্নে।

    মামা বলেছিলেন, হ্যাঁ।

    ভদ্রলোক আবার বলেছিলেন, কারেক্ট ধরেছি। অনীতা যা ডেসক্রিপশান দিয়েছে তাতে চিনতে অসুবিধা হয়নি।

    অবনীনাথ আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, ইনি অনীতার বাবা। তবে ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। নিশ্চয়ই তাঁকে একটা ক্লাউন বানিয়ে সবাই খুব হাসাহাসি করেছে।

    যাই হোক, অবনীনাথরা বসার পর আলাপ পরিচয় শুরু হয়েছিল। ওই ঘরে এক মাত্র অনীতা ছাড়া আর সবাই ছিল তাঁর অচেনা। অনীতার বাবা রেলের অ্যাকাউন্টস অফিসার। এ ছাড়া ছিলেন অনীতার এক কাকা, এক পিসেমশাই আর পিসিমা, তিনজন কলেজের বন্ধু-লীলা, মালতী আর অরুন্ধতী, ছোট দুটি ভাই–পিন্টু ঝিন্টু এবং মা আর একটি কোট-প্যান্ট-টাই পরা ঘাড়ে-গানে ঠাস যুবক। যুবকটির নাম নবকুমার।

    অনীতার মায়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। অনীতা তাঁরই সমবয়সি অর্থাৎ বাইশ-তেশই হবে কিন্তু তার মায়ের বয়স খুব হলে ত্রিশ-বত্রিশ। ছোট দুই ভাইয়ের একজনের বয়স সাত-আট হবে, আরেক জনের বয়স বড়জোর চার পাঁচ। যত কম বয়েসেই সেকালে বিয়ে হোক তিরিশ বছর বয়সের মায়ের তেইশ বছরের তরুণী মেয়ে থাকা একেবারেই অসম্ভব।

    তা ছাড়া আরও দু-একটা ব্যাপার চোখে পড়েছিল অবনীনাথের। অনীতার বাবা তাঁদের দেখে যতটা খুশি বা উচ্ছ্বসিত, তার মা কিন্তু ঠিক ততটা নন। এমনিতে তাঁর ভদ্রতা বা সৌজন্যের মধ্যে কোনো ত্রুটি ছিল না, কিন্তু কোথায় যেন সূক্ষ্ম পর্দা টানা ছিল। টের পাওয়া যাচ্ছিল, তিনি ঠিক তাঁর স্বামীর মতো সবাইকে কাছে টানতে পারেন না। কেমন যেন গম্ভীর আর দূরবর্তী।

    এ তো গেল অনীতার মায়ের কথা। অনীতাকে তাদের বাড়িতে দেখেও কম অবাক হননি অবনীনাথ। যে বাইরে এত হাসিখুশি এবং আমুদে বাড়িতে নিজেকে সে অনেকখানি গুটিয়ে রেখেছিল। আর সেই ঘাড়ে গর্দানে ঠাসা যুবকটি যার নাম নবকুমার যে সুযোগ পেলেই জোঁকের মতো অনীতার গায়ে আটকে থাকতে চাইছিল; নইলে দূর থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখছিল। তাকানোর মধ্যেও যে এমন বিশ্রী ধরনের নোংরা লোভ আর হ্যাংলামি থাকতে পারে, এই যুবকটিকে না দেখলে বোঝা যেত না।

    অনীতার বাবা অনিমেষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, আমার নিজেরই আপনাদের বলে আসা উচিত ছিল কিন্তু বাড়ির কাজে আটকে ছিলাম, তাই অনুকে পাঠিয়েছিলাম।

    মামা বলেছিলেন, তাতে আমাদের এতটুকু অসম্মান হয়নি। অনু বলেছিল দুর্দান্ত খাওয়া-দাওয়ার নাকি ব্যবস্থা করেছেন। মুরগির মাংসের গন্ধ পেলে আমার নেমন্তন্নর দরকার হয় না। হাওয়া শুঁকে শুঁকে ঠিক হাজির হয়ে যাই।

    মামি বলেছিলেন, দিনরাত খাওয়া ছাড়া আর কোনো ভাবনা নেই। পেটটাই সর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    সবাই হেসে উঠেছিল।

    মামা আবার বলেছিলেন, কিন্তু অনিমেষবাবু, কী অকেশনে আজকের খাওয়া-দাওয়া সেটা কিন্তু এখনও জানি না। অনুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ও মিষ্টিরিয়াসলি হেসে অ্যাভয়েড করে গেল।

    অনিমেষ বললেন, মেয়েটা বি.এ-তে ভালো রেজাল্ট করেছে। সেই জন্য সবাইকে দুটি ডাল-ভাত খাওয়াবার ইচ্ছা হল।

    একসেলেন্ট। আশীর্বাদ করি এম.এ-তে ভালো রেজাল্ট করুক অনু, রিসার্চ করে ডক্টরেট হোক। যতবার ভালো রেজাল্ট তত বার গ্র্যান্ড ফিস্ট।

    প্রায় সবাই একসঙ্গে কোরাসে বলে উঠেছিল, এ প্রস্তাব আমরা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি।

    এরপর খানিকক্ষণ নানা ধরনের গল্প চলল। হিটলার, চেম্বারলেন, রাশিয়া, ইউরোপে যুদ্ধের অ্যাটমসফিয়র, কলকাতার বাজারদর–এমনি নানা টপিক নিয়ে আলোচনার ফাঁকে অনীতার বন্ধু অরুন্ধতী বলেছিল, এসব গল্প ভালো লাগছে না মেসোমশাই। খাওয়ার আগে অনীতার গান শুনতে চাই।

    ঘরের সবাই সমস্বরে সায় দিয়েছিল, গুড় প্রপোজাল। এতক্ষণ শুধু শুধু আজে-বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করা হল। অনু স্টার্ট করে দাও। অনেক দিন তোমার গান-টান শোনা হয়নি।

    অনীতা প্রথমে গাইতে চায়নি। কিন্তু ওর আরেক বন্ধু মালতী ততক্ষণে একটা হারমোনিয়াম এনে সেটার সামনে ওকে জোরজার করে বসিয়ে দিয়েছিল।

    অগত্যা গাইতেই হয়েছে অনীতাকে। সবই রবিবাবুর গান; এ ছাড়া দুটি করে অতুলপ্রসাদী আর ডি.এল. রায়ের গান।

    সেই নাইন্টিন থার্টি নাইনে অর্থাৎ যুদ্ধের আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত এত পপুলার হয়নি। রবিবাবুর গানের এত রেকর্ড তখন বেরোয়নি। এখনকার মতো রাস্তায় রাস্তায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের গানের স্কুল দেখা যেত না। ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা গীতবিতান আর হারমোনিয়াম নিয়ে বসত না। সায়গল, মালতী ঘোষাল, কণক দাস, পঙ্কজ মল্লিক বা আরও কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। তাঁদের গান তো আর সামনে বসে শোনা যেত না।

    অবনীনাথদের রামপুরহাটের বাড়ি থেকে শান্তিনিকেতন খুব দূর না। একবার রবীন্দ্রনাথকে দেখবার জন্য ওখানে গিয়ে সেখানকার ছেলেমেয়েদের বর্ষামঙ্গল না কীসের গান যেন শুনে এসেছিলেন তিনি। তারপর কাছে বসে সেদিন অনীতার মুখে আবার রবিবাবুর গান শুনলেন।

    নাম-করা আর্টিস্টদের রেকর্ড বাদ দিলে এমন ভরাট সুরেলা গলা আগে আর কখনও শোনেননি অবনীনাথ। সমস্ত ঘরের আবহাওয়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর আশ্চর্য এক পবিত্রতা এনে দিয়েছিল। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন অবনীনাথ।

    কে যেন অনীতাকে বলেছিল, এত সুন্দর গলা তোমার; একবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবিবাবুকে গান শুনিয়ে এসো। কবি খুব খুশি হবেন।

    অনীতা বলেছিল, যাবার খুব ইচ্ছে। সুযোগ পেলে একবার নিশ্চয়ই যাব।

    আরেকজন, খুব সম্ভব অনীতার পিসেমশাই বলে উঠেছিলেন, রেডিয়োতে একটা অডিশান দিয়ে দে অনু; নিশ্চয়ই তুই চান্স পেয়ে যাবি।

    অনীতা বলেছিল, দূর, আমি কী এমন গাই যে চান্স পাব।

    যেই যুবকটি–যার নাম নবকুমার, ধূর্ত লোভী চোখ নিয়ে সে প্রথম থেকে অনীতার দিকে তাকিয়ে ছিল, সে এবার বলেছে, রেডিয়োতে তোমাকে গাইতেই হবে অনু। ওখানে আমার জানাশোনা আছে। নেক্সট উইকেই তোমার অডিশানের অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেব।

    অনীতা বা তার বাবা অনিমেষ মুখোপাধ্যায় উত্তর দেননি। মুখ দেখে মনে হয়নি এ ব্যাপারে তাঁদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে।

    তবে অনীতার ত্রিশ-বত্রিশ বছরের তরুণী মা কিন্তু দারুণ উৎসাহের গলায় বলেছিলেন, নিশ্চয়ই করে দিবি। রেডিয়োতে যাওয়ার কত সম্মান

    অনীতার গাট-না সম্পর্কে কী কথা হয়েছিল, আজ আর মনে পড়ে না। খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মামি বলেছিলেন, কী সুন্দর গায়। মামা বলেছিলেন বড় ভালো মেয়েটা, কিন্তু বড় দুঃখী।

    অবনীনাথ অন্য কথা ভাবছিলেন। তাই মামা-মামির কথাবার্তা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন না। দুরমনস্কর মতো তিনি বলেছিলেন, একটা ব্যাপারে খুব অবাক হয়ে যাচ্ছি মামা–

    মামা জিগ্যেস করেছিলেন, কী রে?

    অনীতার মায়ের বয়স একেবারে বোঝা যায় না?

    কত বয়স বলে তোর মনে হয়?

    কত আর, ত্রিশ-বত্রিশ-

    মহিলার বয়স একজাক্টলি তা-ই।

    কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ছিলেন অবনীনাথ। তারপর বলেছিলেন, অত বড় মেয়ে যাঁর

    মামা বলেছিলেন, সত্যি, তুই একটা যা-তা। এতটুকু বুদ্ধিসুদ্ধি হল না। এতটা বয়স পর্যন্ত শুধু বই মুখস্থ করেই গেলি।

    কী বলবেন বুঝতে পারেননি অবনীনাথ। বিমূঢ়ের মতো শুধু মামার দিকে তাকিয়ে থেকেছেন।

    মামা এবার মজা করে বলেছেন, তোর কি ধারণা, বত্রিশ বছরের মহিলার বাইশ-তেইশ বছরের একটা মেয়ে থাকতে পারে?

    তা হলে উনি–এই পর্যন্ত বলে এবার থেমে গিয়েছিলেন অবনীনাথ।

    মামা বলেছিলেন, আরে বোকা, ওটা ওর সত্যা।

    ব্যাপারটা অনেক আগেই তাঁর মাথায় আসা উচিত ছিল। সে আমলে যৌবনের অনেকখানি সময় পর্যন্ত কী আশ্চর্য সরল, নাকি বোকা-ই ছিলেন তিনি!

    সৎমা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল অবীনাথের। হয়তো ওই মহিলাটি ভালো, স্নেহপ্রবণ তবু সত্মার সঙ্গে কী যেন এক দুঃখ জড়িয়ে আছে। অবনীনাথ আর কিছু বলেননি।

    ওদিকে মামা আর মামি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছিলেন।

    মামি বলছিলেন, দেখলে তো, নবকুমারটা আবার আসা-যাওয়া শুরু করেছে। অনুর বাবা ওকে বাড়িতে ঢুকতে বারণ করে দিয়েছিল?

    মামা বলেছিলেন, কী করবে! বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্ষা। স্ত্রী যাকে সাপোর্ট দিচ্ছে তাকে কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবে! অনুটার জন্যে বড় দুঃখ হয়।

    আর আগেও অনুর সম্পর্কে দুঃখী বা দুঃখ শব্দটা কানে এসেছে অবনীনাথের। কেন মেয়েটা দুঃখী বা কীসের তার দুঃখ, এসব কথা জিগ্যেস করতে গিয়েও পারেননি। অনীতার ব্যাপারে অকারণ আগ্রহ বা কৌতূহল দেখালে মামা-মামি কিছু বলতে পারেন। তবু নিজের অজান্তে বলে ফেলেছিলেন, ওই নবকুমার দত্ত লোকটা কে?

    মামা উত্তেজিত মুখে বলেছিলেন, একটা আস্ত রাসকেল। পায়ের তলা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত একটি প্রথম শ্রেণীর শুয়ারের বাচ্চা। বদ, লুচ্চা, হারামজাদা-কলকাতায় আসার পর মামাকে এরকম খিস্তি এবং উত্তেজিত হতে দ্যাখেননি অবনীনাথ। ভদ্র বিনয়ী আমুদে এবং হৃদয়বান মামার এভাবে খেপে ওঠার নিশ্চয়ই কারণ আছে কিন্তু তা জিগ্যেস করা যায়নি।

    এদিকে মামা অনবরত নবকুমার সম্পর্কে খারাপ খারাপ কথা বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটা কেন খারাপ সে সম্পর্কে কিছুই বলেনি। তবে অনীতার ব্যাপারে মনটা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।

    বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুমোতে পানেননি অবনীনাথ। বার বার অনীতার মুখটা আর তার গাওয়া রবীন্দ্রনাথের একটা গানের কলি দীপ নিভে গেছে মম-ঘুরে ঘুরে মনের ভেতর ছায়া ফেলে যাচ্ছিল।

    মামার বাড়িতে আসার পর অবনীনাথের একটা বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল একা একা অলিগলি বা বড় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কলকাতাকে চেনা। দিন দশ-বারো ঘোরাঘুরির পর এই সুবিপুল শহর সম্পর্কে খানিকটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে যে রাস্তাটা দিয়ে ইউনিভার্সিটি যাওয়া যায় সেটা দিয়ে দিনে চার-পাঁচ বার যাতায়াত করে সড়গড় করে নিয়েছিলেন।

    দেখতে দেখতে ইউনিভার্সিটির সেশান শুরু হয়ে গিয়েছিল।

    মনে পড়ে প্রথম দিন ক্লাস ছিল দেড়টায়। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর মামার দেওয়া শার্ট টাউজার্স পরে বড় রাস্তায় বাস স্টপজে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অবনীনাথ। দোতলা বাস এলেই উঠে পড়বেন। কিন্তু বাস আসার আগেই অনীতা এসে গিয়েছিল। তাকে দেখামাত্র নানা ধরনের ঢেউ অবনীনাথের মনের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। প্রথমত, তার সক্সার মুখ মনে পড়েছে, সেই সঙ্গে মামা-মামির বলা দুঃখী শব্দা। দ্বিতীয়ত, যা মনে হয়েছে অবনীনাথের পক্ষে তা খুবই অস্বস্তিকর। তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হলেই অনীতা এমন সব ঠাট্টা-টাট্টা বা রগড় করে যাতে লজ্জায় মাথা তুলতে পারেন না অবনীনাথ।

    একটু হেসে কাছে এগিয়ে এসেছিল অনীতা। বলেছিল, আজ থেকে আপনারও ক্লাস আরম্ভ হল বুঝি?

    অবনীনাথ বলেছিলেন, হ্যাঁ।

    আমারও। বলে একটু থেমে অনীতা আবার আরম্ভ করেছিল, আপনাদের বাড়ি হয়ে এলাম। শুনলাম, বেরিয়ে পড়েছেন। কদিনে আপনার খুব ইমপ্রুভমেন্ট হয়েছে। এখন আর কারো হেল্প আপনার দরকার নেই।

    অনীতার গলায় সেই রগড়ের সুর। অবনীনাথের ব্রিবত মুখে বলেছিলেন, না, মানে~~~

    অনীতা ফের বলেছিল, স্বাবলম্বনের চাইতে বড় কোয়ালিটি আর কিছু নেই। ভেরি গুড। তবে বলে পায়ের নুতন চঞ্চল থেকে চুলের ছাঁট পর্যন্ত চোখ কুঁচকে বার বার দেখে যাচ্ছিল সে।

    নিজেকে ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে নিতে নিতে ভয়ে ভয়ে অবনীনাথ জিগ্যেস করেছিলেন, কী দেখছেন?

    আপনাকে দেখতে দেখতে বঙ্কিমচন্দ্রের সেই কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে মা কী ছিলেন, আর কী হইয়াছেন–

    অনীতার আক্রমণটা কোন দিক থেকে আসছে তার কিছুটা বুঝতে পারছিলেন অবনীনাথ, সেই কারণে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন।

    অনীতা বলে যাচ্ছিল, একটা দারুণ ব্যাপার মিস করে ফেললাম। সেদিন ইউভার্সিটিতে আপনাকে যে ড্রেসে দেখেছিলাম তার একটা ফটো তুলে রাখা উচিত ছিল আর এখনকার একটা ফটো। চেঞ্জটা কতখানি হয়েছে তার একটা কম্পারেটিভ স্টাডি করা যেত।

    মুখ লাল হয়ে উঠেছিল অবনীনাথের। কিছু একটা উত্তর দিতে চেষ্টা করেছিলেন অবনীনাথ, গলার স্বর ফোটেনি। এই সময় বাস এসে গিয়েছিল। ওপরে উঠেই অনীতার খেয়াল হয়েছিল, অবনীনাথ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। বলেছিল, কী হল, উঠে পড়ুন, এক্ষুনি বাস ছেড়ে দেবে।

    অনীতার সঙ্গে যাবার ইচ্ছা ছিল না অবনীনাথের। তিনি ওঠেননি। অনীতার কথার উত্তর না দিয়ে তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এদিকে ঘন্টি দিয়ে বাস ছেড়ে দিয়েছিল। ফুটবোর্ড থেকে অনীতা চেঁচিয়ে উঠেছিল, উঠুন, তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। চলন্ত বাস থেকে কোনো মেয়ের লাফ দিয়ে নামা অসম্ভব। পারলে হয়তো সে নেমেই পড়ত।

    মিনিট দশেক বাদে আবার একটা দোতলা বাস এসে গিয়েছিল। অবনীনাথ সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে উঠে সামনের দিকের সিটে বসে পড়েছিলেন।

    দুপুরবেলায় আপ এবং ডাউন দুদিকের কোনো বাসেই ভিড়-টিড থাকত না তখন। ওপরটা বেশ ফাঁকাই, দু-চারটে লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিল।

    কয়েকটা স্টপেজ পার হয়ে বাসটা ময়দানের কাছে আসতেই আচমকা ঠিক পিছন থেকে মেয়েলি গলা ভেসে এসেছিল, একটু শুনুন–

    চমকে ঘাড় ফেরাতেই অবনীনাথ দেখতে পেয়েছিলেন, অনীতা ঠিক তাঁর পিছনের সিটটায় বসে আছে। চোখাচোখি হতেই অবাক অবনীনাথ বলেছিলেন, আপনি এ বাসে এলেন কী করে?

    অনীতার চোখে-মুখে ঠাট্টা বা রগডের লেশমাত্র ছিল না। আস্তে আস্তে সে বলেছিল, আগের বাসটায় দুটো স্টপেজ গিয়েই নেমে পড়েছিলাম। জানতাম আপনি নেক্সট বাসটায় আসবেন। এ বাসটা আসতেই উঠে পড়লাম।

    অবনীনাথ বুঝতে পারছিলেন না, তাঁর পিছনে ভালো করে লাগবার জন্যই অনীতা আগের বাসটা থেকে নেমে পড়েছে কিনা। তিনি আর কিছু বলতে পারেননি।

    অনীতা এবার বলেছিল, আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।

    অবনীনাথ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, ক্ষমা ক্ষমা কীসের?

    সেদিন ইউনিভার্সিটিতে আলাপ হবার পর যে কবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে খারাপ ব্যবহার করেছি। এটা করা আমার উচিত হয়নি।

    ঠিক আছে, ঠিক আছে–

    অনীতা বলে গিয়েছিল, তবে একটা কথা বলতে পারি, আমার মধ্যে কোনো ম্যালিস ছিল না বা এখনও নেই। যা করেছি শুধু মজা করবার জন্যেই। আপনাকেই সত্যি হার্ট করতে চাইনি। কিন্তু বুঝতে পারছি ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। প্লিজ, মনে কিছু করবেন না।

    অনীতার কথাগুলো খুবই আন্তরিক মনে হয়েছিল অবনীনাথের। আস্তে করে বলেছিলেন, ঠিক আছে, মনে কিছু করব না।

    অনীতা তক্ষুণি আর কিছু বলেনি। জানলার বাইরে চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তারপর আবছা গলায় বলেছিল, এমনিতে ভালো লাগে না, লোকের সঙ্গে মজা-টজা করে যতক্ষণ অন্যমনস্ক থাকা যায় আর কী।

    আর আচমকা তখনই মামা বা মামির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল অবনীনাথের। অনীতাটা বড় দুঃখী।

    যাই হোক, সেদিনের পর অনীতা তাকে নিয়ে আর মজা-টজা করেনি।

    এদিকে ক্লাস পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনীতা এবং অবনীনাথের সাবজেক্ট এক না। দুজনের ক্লাসও সব দিন এক সময় শুরু হত না। যেদিন হত সেদিন বাস রাস্তায় অনীতার সঙ্গে দেখা হত। দোতলা বাসে পাশাপাশি বসে দুজনে ইউনিভার্সিটিতে চলে যেতেন।

    মাঝে মধ্যে বাস স্টপেজেই শুধু দেখা হত না। দু-একদিন পর পর হঠাৎ হঠাৎ মামাদের বাড়িতে চলে আসত অনীতা। তা ছাড়া ইউনিভার্সিটিতে তো প্রায় রোজই দেখা হত।

    পোশাকে এবং চেহারাতেই শুধু না, চালচলন কথাবার্তা–সব কিছুর ওপরেই দ্রুত শহুরে পালিশ পড়তে শুরু করেছিল অবনীনাথের প্রথম দিকের সেই আড়ষ্টতা আর ছিল না।

    অনীতার সঙ্গে দেখা হলে আগে গুটিয়ে যেতেন অবনীনাথ। কিন্তু মাসখানেকের ভেতর ব্যাপারটা বদলে গেল। অনীতাকে দেখলে হাসতেন, কখনও নিজের থেকে এগিয়ে গিয়ে কথাটথা বলতেন। আস্তে আস্তে এমন হল, একই সময়ে ক্লাস শুরু না হলেও ওঁরা একসঙ্গেই ইউনিভার্সিটিতে যেতেন। যার আগে ক্লাস থাকত, তিনি অন্যকে সময়টা বলে দিতেন। সেই অনুযায়ী আরেকজন বাস স্টপেজে গিয়ে দাঁড়াত। ক্লাস ছুটির পর আগে যে যার মতো বাড়ি ফিরতেন। পরে যাঁর আগে ছুটি হত তিনি অন্যের জন্য অপেক্ষা করতেন। এর মধ্যে পরস্পরকে কবে যে ওরা তুমি-টুমি করে বলতে শুরু করেছিলেন, কে জানে! এত সব কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, এত কাল বাদে আর মনেও পড়ে না।

    সেক্সান আরম্ভের মাসখানেক কি মাস দুয়েক বাদে হঠাৎ একটা ব্যাপার ঘটল। পর পর তিনটে ক্লাসের পর সেদিন দুটো পিরিয়ড অফ ছিল অবনীনাথের। তারপর আবার একটা ক্লাস হয়ে ছুটি। অবনীনাথ জানতেন, অনীতার প্রথম দিকে দুটো পিরিয়ডের পর তিন পিরিয়ড অফ; তারপর দুটো ক্লাস আছে। আগে থেকে ঠিক করা ছিল, অনীতার ছুটি হলেই একসঙ্গে দুজনে বাড়ি ফিরবেন।

    যাই হোক, পর পর তিনটে পিরিয়ড করে ক্লাস থেকে বেরুতেই অবনীনাথের চোখে পড়েছিল দরজার সামনের করিডরে দাঁড়িয়ে আছে অনীতা।

    দুজনেরই অফ পিরিয়ড থাকলে কেউ কারো ক্লাসের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন না। নীচে দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ের সামনে কম্পাউন্ডে বা সেনেট হলে লম্বা লম্বা সিঁড়িতে গিয়ে বসতেন। বা হেঁটে হেঁটে গল্প করতেন। কাজেই অনীতাকে ওখানে দেখে অবনীনাথ বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিলেন। কেমন যেন অস্থির আর অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল তাকে। অবনীনাথ কিছু বলার আগেই অনীতা কাছে এগিয়ে এসেছিল, তোমার সঙ্গে আজ ফিরতে পারব না। আমি এখন যাচ্ছি।

    অনীতা এমনিতেই ক্লাস ফাঁকি দিত না। অবনীনাথ উদ্বেগের গলায় জিগ্যেস করেছিলেন, কী ব্যাপার, শরীর-টরীর খারাপ লাগছে?

    না।

    তোমার তো শেষের দিকে আরও দুটো ক্লাস আছে।

    করব না। আচ্ছা চলি। অবনীনাথকে কিছু বলার সময় না দিয়ে চলে গিয়েছিল অনীতা।

    পরের দিনও একই ঘটনা। সেকেন্ড পিরিয়ডের পর ক্লাস থেকে বেরিয়ে করিডরে সেদিনও অনীতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন অবনীনাথ। সেদিন অনীতার শেষ দিকে অনেকগুলো ক্লাস ছিল কিন্তু একটাও না-করে অবনীনাথকে তার জন্য অপেক্ষা করতে না-বলে চলে গিয়েছিল। আগের দিনের মতোই তার মধ্যে ছিল অস্থিরতা এবং উদ্বেগ।

    পর পর দুদিন এভাবে অনীতার চলে যাবার কারণটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। সেদিনে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে সন্ধেবেলা অনীতাদের বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নেবেন কিনা ভাবতে ভাবতে দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে নীচের কম্পাউন্ডে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। সেই নেমন্তন্নর দিন রাত্তিরে লুব্ধ বেড়ালের মতো চকচকে চোখে যে যুবকটি অনীতার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে বসে ছিল সে চনমন করে কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কী যেন নাম তার? অবনীনাথের তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গিয়েছিলনবকুমার। সে কি কোনো দরকারে এখানে এসেছে, না কারো খোঁজে?

    এগিয়ে গিয়ে কথা বলবেন কিনা অবনীনাথ যখন ভাবছিলেন সেই সময় নবকুমার তাকে দেখতে পেয়েছিল। কয়েক সেকেন্ড স্থির চোখে তাকিয়ে তেকে লম্বা লম্বা পা ফেলে কাছে চলে এসেছিল সে। বলেছিল, চিনতে পারছেন?

    অবনীনাথ মাথা নেড়েছিলেন। অর্থাৎ পেরেছেন।

    ভালো আছেন?

    হ্যাঁ। আপনি?

    ফাইন।

    এখন কি আপনার অফ পিরিয়ড চলছে?

    হ্যাঁ–

    নবকুমার কথা বলছিল ঠিকই, তবে তার চোখ দুটো চরকির মতো অনবরত চারদিকে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল। দুম করে নিজের অজান্তেই হঠাৎ অবনীনাথ বলে ফেলেছিলেন, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?

    কোনোরকম ভণিতা না করে সোজাসুজি পরিষ্কার গলায় নবকুমার বলেছিল, হ্যাঁ। অনীতাকে।

    অবনীনাথ এইরকমই ভেবেছিলেন। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, তার আগেই কবজি উলটে ঘড়িটা দেখে নবকুমার আবার বলে উঠেছিল, দুটো পাঁচ। ওকে বলেছিলাম ঠিক দুটোয় এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। স্ট্রেঞ্জ! কালও ছিল না, আজও নেই! বলতে বলতে বিরক্তি এবং রাগে তার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছিল।

    অবনীনাথ এবার বুঝতে পেরেছিলেন, কেন দুদিন ধরে সবে ক্লাস না-করেই অনীতা চলে যাচ্ছে। এই লোকটাকে স্পষ্টতই সে এড়াতে চাইছিল।

    নবকুমার এবার জিগ্যেস করেছিল, অনীতার আর আপনার কি সেম সাবজেক্ট?

    অবনীনাথ বলেছিলেন, না। অনীতার হিস্ট্রি, আমার ইংলিশ।

    নবকুমার জিগ্যেস করেছিল, অনীতাকে কি আজ ইউনিভার্সিটিতে দেখেছেন?

    এক মুহূর্ত না-ভেবে অবনীনাথ বলেছিলেন, দেখেছি। পাঁচ মিনিট আগেই আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

    নবকুমার এবার কিছুটা অস্থির হয়ে উঠেছিল, কোথায় দেখলেন?

    আমার ক্লাসরুমের সামনের করিডরে। দেখা হতেই বলল, চলে যাচ্ছে। আজ আর ক্লাস করবে না।

    কোথায় গেল বলতে পারেন?

    না।

    চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল নবকুমারের। দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, যেখানেই যাও আমার হাতের বাইরে যেতে পারবে না। আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায়নি নবকুমার। এক মোচড়ে শরীরটাকে দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে কলেজ স্ট্রিটের দিকে একরকম দৌড়োতেই শুরু করেছিল।

    নবকুমার ইচ্ছা করলে অনীতাদের বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে পারত। তবু কেন যে ইউনিভার্সিটিতে এসেছিল মোটেই বোঝা যাচ্ছিল না। নবকুমারের পিছু পিছু কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। ততক্ষণে সে গেট পার হয়ে টাম-রাস্তায় চলে গেছে। ওখানে একটা টু-সিটার পার্ক করা ছিল। সেটায় উঠে ঝড়ের বেগে চালিয়ে দিয়েছিল সে।

    ছুটির পর বাড়ি ফিরে একবার অবনীনাথ ভেবেছিলেন, অনীতাদের বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসবেন। বার দু-তিনেক রাস্তায় নেমেও ফিরে এসেছেন। আগে কখনও একা একা অনীতাদের বাড়ি যাননি, ভীষণ সংকোচ হচ্ছিল তাঁর। হঠাৎ আসার কারণটা সম্বন্ধে কেউ যদি জিগ্যেস করে, তখন কী উত্তর দেবেন তিনি? মনে মনে অবনীনাথ ঠিক করে ফেলেছিলেন পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে যাবার সময় এ নিয়ে অনীতার সঙ্গে কথা বলবেন।

    বলেছিলেনও। শুনে অনীতা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকেছে। তারপর মলিন একটু হেসে বলেছে, ও কিছু না।

    অবনীনাথ বলেছিলেন, কিছু না হলে ক্লাস না করে দুদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?

    অনীতা চমকে উঠেছিল, কে বললে পালিয়ে বেড়াচ্ছি?

    কারো বলার দরকার নেই। এটুকু বুঝবার মতো আমি সাফিসিয়েন্টলি গ্রোন আপ।

    দোতলা বাসের ফ্রন্ট সিটে পাশাপাশি বসে যাচ্ছিল ওরা। এবার আর উত্তর দেয়নি অনীতা, বিষণ্ণ চোখে সামনের জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিল।

    অবনীনাথ বলেছিলেন, কী হল, চুপ করে রইলে যে?

    অনীতা মুখ ফেরায়নি। অন্যমনস্কর মতো চৌরঙ্গীর ঝকঝকে রাস্তা দেখতে দেখতে বলেছিল, কী বলব?

    তুমি নবকুমারকে ভয় পাচ্ছ কেন?

    শুধু শুধু ভয় পাব কেন? অনীতা হাসতে চেষ্টা করেছিল।

    অবনীনাথ বলেছিলেন, পাচ্ছ, আর বলছ পাব কেন?

    খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে অনীতা বলেছিল, ভয় কিনা ঠিক বলতে পারব না। তবে ওকে দেখলে ভীষণ অস্বস্তি হয়। একটু থেমে আবার বলেছিল, কী জানি, হয়তো ভয়ই পাই ওকে।

    অবনীনাথ বলেছিলেন, কারণটা কী?

    আজ আর কিছু জিগ্যেস কোরো না। পরে একদিন তোমাকে সব বলব।

    অবনীনাথ তবু বলেছিলেন, সেদিন তোমার বাবা বলছিলেন, নবকুমার তোমাদের কী রকম যেন আত্মীয় হয়–

    হ্যাঁ। আমার মায়ের অনেক দূর সম্পর্কে জেঠতুতো ভাই।

    ভদ্রলোকের কাছে তোমার কি কোনো অবলিগেশন আছে?

    আজ আর কিছু জানতে চেও না। প্লিজ

    অগত্যা আর কিছু জিগ্যেস করেননি অবনীনাথ। তবে নবকুমার সম্পর্কে অদম্য এক কৌতূহল তাঁকে যেন পেয়ে বসেছিল।

    মনে আছে সেদিনও নবকুমার ইউনিভার্সিটিতে এসেছিল। অনীতা কিন্তু আগের দুদিনের মতো ক্লাস ফেলে চলে যায়নি।

    অবনীনাথ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন, অনীতার ওপর লক্ষ রাখবেন। যদি নবকুমার এসে পড়ে অনীতা কী করে, সেটা দেখাই তার উদ্দেশ্য। তিনি জানতেন কখন অনীতার অফ পিরিয়ড রয়েছে। সেদিন অনীতার ওপর চোখ রাখার জন্য কখনও যা করেন না তা-ই করেছিলেন। প্রথম দিকের পর পর দু-দুটো ক্লাসে তিনি যাননি।

    মনে আছে সেদিন আড়াইটেয় নবকুমার ইউনিভার্সিটিতে এসেছিল। তারপর খোঁজাখুঁজি করে আশুতোষ বিল্ডিংয়ে অনীতাকে ধরেছিল। অবনীনাথ অনীতার কাছ থেকে খানিকটা দূরে একটা মোটা পিলারের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি জানতেন, অনীতার কাছাকাছি থাকলেই নবকুমারকে পাওয়া যাবে।

    আশুতোষ বিল্ডিংয়ের চওড়া করিডরে তখন বেশি ভিড়। ছেলেমেয়েরা আর প্রফেসররা অনবরত এধার থেকে ওধারে যাওয়া-আসা করছিল। নবকুমার একধারে অনীতাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, কাল রাত্তিরে তোমাদের বাড়িতে কী বলেছিলাম?

    অনীতা বলেছিল, দ্বারাভাঙা বিল্ডিংয়ের সামনের কম্পাউন্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে।

    দাঁড়াওনি কেন? কৈফিয়ত চাইবার মতো করে জিগ্যেস করেছিল নবকুমার।

    বেপরোয়া ভঙ্গিতে অনীতা বলেছিল, প্রয়োজন মনে করিনি।

    খানিকক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে, তারপর বলেছিল, ও, তাই নাকি!

    অনীতা উত্তর দেয়নি। নবকুমার আবার বলেছিল, চলো এখন

    আমার ক্লাস আছে।

    ক্লাস একদিন না করলেও চলবে।

    খুব ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস। এটা মিস করলে পরে অসুবিধা হবে।

    এম.এ ডিগ্রির কী এমন দরকার? এক্সটা কিছু হাত-পা গজাবে?

    সেটা আমার পার্সোনাল ব্যাপার। আমি বুঝব।

    তীব্র চাপা গলায় নবকুমার এবার বলেছিল, তোমার ব্যাপারটা চিরকাল তোমার পার্সোনাল থাকবে না। এর মধ্যেও আমারও কিছু মতামত থাকবে। আমার ইচ্ছা নয়, তুমি আর পড়াশোনা কন্টিনিউ করো।

    মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠেছিল অনীতার। সে বলেছিল, আপনার ইচ্ছায় পৃথিবীতে সব কিছু হবে বলে আপনার ধারণা নাকি?

    পৃথিবীর সবার বেলায় না হলেও তোমার বেলায় হবে। বলে একটু থেমে নবকুমার আবার শুরু করেছিল, তর্ক করে সময় ওয়েস্ট করার মনে হয় না। মুডটাই শুধু শুধু নষ্ট করে দিলে। এখন চলো

    বললাম তো, ক্লাস আছে।

    তুমি তাহলে যাবে না?

    না। আরেকটা কথা কী?

    আপনি আর কখনও ইউনিভার্সিটিতে আসবেন না।

    চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল নবকুমারের। চোখ কুঁচকে যাচ্ছিল। সে বলেছিল, ঠিক আছে, তোমার কথাটা আমার মনে থাকবে। চলি-সে চলে গিয়েছিল।

    নবকুমার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাবার পর অনীতা করিডর ধরে সোজা ডান দিকে চলে গিয়েছিল। তখন আর তার সঙ্গে দেখা করেননি অবনীনাথ।

    তবে বাড়ি ফেরার পথে সেদিন অনীতাকে ভয়ানক বিষণ্ণ আর উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছিল। এবং অত্যন্ত অন্যমনস্কও।

    অবনীনাথ জিগ্যেস করেছিলেন, কী হয়েছে তোমার?

    অনীতা চমকে উঠেছিল।কই, কিছু হয়নি তো।

    তাহলে এরকম দেখাচ্ছে কেন?

    চোখে-মুখে হাসি ফোটাতে চেষ্টা করেছিল অনীতা, কী রকম আবার দেখবে! যেমন ছিলাম তেমনই তো আছি। অ্যাজ ফ্রেশ অ্যাজ এভার।

    ডোন্ট বি ওভার স্মার্ট। আমাকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না।

    কী আশ্চর্য! আমি–

    অনীতার কথা শেষ হবার আগেই অবনীনাথ বলে উঠেছিলেন, এক্সকিউজ মি, তোমার ওপর আজ প্রথম থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে লক্ষ রেখেছিলাম। মনে হয়েছিল নবকুমার আজও আসবে। অ্যান্ড হি কেম। দূর থেকে আমি তোমাদের কিছু কিছু কথা শুনেছি।

    অনীতা হকচকিয়ে গিয়েছিল। অবনীনাথ আবার বলেছিলেন, লোকটার এতটা সাহস কী করে হয় বুঝতে পারছি না।

    অনীতা উত্তর দেয়নি। অবনীনাথ থামেননি, নবকুমার তোমার কাছে কী চায়? সব-সময় তোমার পিছনে ও লেগে আছে কেন?

    অনীতা এবারও চুপ করে ছিল।

    অবনীনাথ আবার জিগ্যেস করেছিলেন, লোকটা কী টাইপের?

    এতক্ষণে বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়েছিল অনীতা, এক নম্বর শয়তান! আমার লাইফ নষ্ট করে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কী করে যে ওর হাত থেকে মুক্তি পাব, বুঝতে পারছি না।

    অনীতা সেদিন বলেছিল পরে আরেকদিন নবকুমারের কথা বলবে। পরে কোনো সময়ের জন্য আর অপেক্ষা করেনি সে, সেদিন বিকেলেই বলে ফেলেছিল। শুধু নবকুমারের কথাই না; তার জীবনের কিছু কিছু কথাও। যা বলেছিল, মোটামুটি এই রকম–

    বাবা, মা এবং অনীতাকে নিয়ে ছিল তাদের চোট ফ্যামিলি। অনীতার বয়স যখন বছর তেরো সেই সময় ওর মা মারা যান। তার কিছুদিন বাদে বাবা তাঁর চাইতে তেইশ-চব্বিশ বছরের ছোট এক মহিলাকে বিয়ে করে আনেন। আর বাবার এই দ্বিতীয় বিয়ের ব্যবস্থাটা যে করেছিল সে নবকুমার।

    নবকুমার অনীতার বাবা অনিমেষ মুখার্জির অফিসেই কাজ করত; তাঁর জুনিয়র কলিগ। অনীতার সৎমা সুরমার মা-বাবা ছিল না। দুর সম্পর্কের লতার পাতায় আত্মীয় নবকুমারদের বাড়িতে সে ছিল আশ্রিতা। ঘাড় থেকে ওরা তাকে নামাতে চাইছিল। এদিকে তেরো-চোদ্দো বছরের বড় মেয়েসুদ্ধ অনিমেষের পক্ষে স্বাভাবিক একটা বিয়ে হওয়া সম্ভব ছিল না। একজন ঝেড়ে ফেলতে চায়, আরেকজন মাথায় করে ঘরে এনে বসাতে চায়-কাজেই বিয়েটা হয়ে যেতে আদৌ কোনো বেগ পেতে হয়নি নবকুমারদের।

    সুরমা এবং অনিমেষ দুজনেই এই বিয়ের জন্য নবকুমারের কাছে কৃতজ্ঞ। সুরমার কৃতজ্ঞতার কারণটা এইরকম। অনিমেষ তার চাইতে তেইশ-চব্বিশ বছরের বড় হলেও আর ঘরে সতীনের একটি ধেড়ে মেয়ে থাকলেও স্বামী মানুষটি তাঁর চমৎকার। আত্মীয় বাড়িতে পরগাছার মতো বেঁচে থাকার চাইতে নিজের সংসারে মর্যাদা নিয়ে থাকা যে-কোনো মেয়েরই কাম্য। তা ছাড়া অনিমেষের মধ্যে মমত্ববোধ আছে, সহৃদয়তা আছে। তাঁর কাছে এসে জীবনে প্রথম নিরাপত্তা এবং সম্মানের আস্বাদ পেয়েছে সুরমা। যে নবকুমার তাকে এমন একটা সংসারে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে সারা জীবন তার কাছে কেনা হয়ে থাকারই তো কথা।

    অনিমেষের কৃতজ্ঞতার কারণ, এই বয়সে কে আর তাঁকে বিয়ে করত! অথচ ঘরে স্ত্রী না থাকলে কে অনীতাকে দেখে। শুধু স্ত্রী না, একটি সুন্দরী তরুণী স্ত্রী-ই জোগাড় করে দিয়েছে নবকুমার। তার কাছে কৃতজ্ঞ না-থেকে পারা যায়।

    অনিমেষ মানুষ হিসেবে তুলনাহীন। তবে স্বভাবটা খুবই দুর্বল। মা-মরা-মেয়ের জন্য তাঁর যথেষ্টই মমতা আর সহানুভূতি। কিন্তু যুবতী স্ত্রীকে বেশ ভয়ও করেন। সুরমার সামনে অনীতাকে বেশি স্নেহ বা আদর দেখাতে তিনি সাহস করেন না; পাছে স্ত্রী অসস্তুষ্ট হয়।

    সুরমা মানুষ্টা বেশ জটিল ধরনের। লাইফের গোড়ার দিকে যারা খুব দুঃখ পায় বা মা-বাপ হারিয়ে অন্যের আশ্রয়ে থাকে তারা পরে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং মর্যাদা পেলে হয় দারুণ উদার হয়ে যায় নইলে অত্যন্ত স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। কিন্তু সুরমার বেলা এ নিয়ম খাটেনি। সে না-হতে পেরেছে পুরোপুরি উদার, না সম্পূর্ণ নিষ্ঠুর। উদারতা এবং নিমর্মতা তার চরিত্রে একসঙ্গে মেশানো নেই; বিভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদাভাবে এই দুটো ব্যাপার ফুটে উঠেছে।

    বিয়ের পর অনিমেষের কাছে এসে স্বামীর আগের পক্ষের মেয়েকে দুহাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিয়েছিল সুরমা। আট-দশ বছরের ছোট অনীতার সঙ্গে তার সম্পর্ক তখন সমবয়সি বন্ধুর মতো। তাকে ছাড়া সেসময়ে কিছুই ভাবতে পারত না সুরমা। বেড়াতে যাবে; অনীতা সঙ্গে থাকা চাই। সিনেমা দেখবে, অনীতা না গেলে চলবে না। তখন স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ত অনীতা। স্কুলে যাবার আগে নিজের হাতে তার চুলে বিনুনি করে রিবন বেঁধে দিত সুরমা। স্কুল থেকে ফিরলে তাকে খেতে দিয়ে গল্প করত কিংবা সামানের পার্কে তাকে নিয়ে খানিকক্ষণ বেরিয়ে আসত।

    সুরমার সহৃদয় ব্যবহার মায়ের মৃত্যুজনিত কষ্ট অনেকখানি জুড়িয়ে দিতে পেরেছিল। কিন্তু নিজের ছেলেপুলে হবার পর সুরমা বদলে যেতে শুরু করেছিল। সৎ ভাইবোনদের নিয়েই তখন সময় কেটে যেত তার; অনীতার দিকে তাকাবার ফুরসত তখন কোথায় সুরমার? আগের মতো আর গল্প করত না সুরমা, সঙ্গে করে বেড়াতে বা সিনেমা দেখতে নিয়ে যেত না। সে কী খাচ্ছে, কখন স্কুলে যাচ্ছে, কখন ফিরছে, সেসব দিকে সুরমার নজর ছিল না। প্রথম প্রথম কষ্ট হত অনীতার, অভিমান হত। পরে ভাবত নতুন ভাই-বোনেরা ছোট ছোট, তাই সুরমা ওদের নিয়েই থাকে। পরে বুঝতে পারছিল এটা ইচ্ছাকৃত। বাপ কিংবা মা-মরা ছেলেমেয়েদের অনুভূতিগুলো সাঙ্ঘাতিক ধারালো। সামান্য অবহেলা বা অনাদর তারা একটুতেই ধরে ফেলতে পারে।

    যতদিন পর্যন্ত নিজের ছেলেপুলে হয়নি ততদিন অনীতা সম্পর্কে সুরমা ছিল উদার এবং স্নেহময়ী। কিন্তু সব মানুষেরই স্নেহ এবং উদারতা সম্ভবত একটা বিশেষ বাউন্ডারি পর্যন্ত। মানুষ তার লিমিটেশন পার হতে পারে না। সুরমাও পরেনি। স্বামীর প্রথম পক্ষের মেয়ের চাইতে নিজের ছেলেমেয়েদের সে যে অনেক বেশি ভালোবাসবে, সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু সুরমা অন্যভাবে হিসেব কষেছিল হয়তো। স্বামীর যা কিছু আছে, টাকা-পয়সা, বাড়ি-ঘর, সব নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমান ভাগে ভাগ করে দিতে হবে অনীতাকে। তা ছাড়া তার বিয়ের প্রশ্ন আছে। তখনও প্রচুর খরচ। এটা তার পক্ষে অসহ্য। স্নেহ তার মধ্যে এত অপর্যাপ্ত ছিল না যা নিজের সন্তানদের দেবার পরও সতীনের মেয়েকে দেওয়া যায়। ক্রমশ নিজেকে এবং নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য সে প্রচণ্ড স্বার্থপর হয়ে উঠেছিল।

    এদিকে আরও একটা ব্যাপার ঘটেছিল। সুরমার বিয়ের পর থেকেই নবকুমার অনীতাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছিল। প্রথমত সে অনিমেষের কলিগ, তার ওপর নতুন আত্মীয়। যার জন্য অনিমেষের দ্বিতীয় বিয়ে এবং যার কাছে সুরমা আর অনিমেষ দুজনেই কৃতজ্ঞ, এ বাড়িতে দস্তুরমতো সে একজন ভিআইপি।

    প্রথম প্রথম সপ্তাহে এক-আধদিন আসত। বাবা এবং সম্মায়ের কথাবার্তা থেকে নবকুমার সম্পর্কে অস্পষ্ট একটা ধারণা অনীতার তৈরি হয়েছিল। মোটামুটি দু-তিনটে খবর সে পেয়েছিল–এক, অফিসের যে ডিপার্টমেন্টে নবকুমার কাজ করে সেখানে ঘুষের স্কোপ আছে। সুযোগ পেলেই সে ঘুষ খায়। দুই, মেয়েদের সম্পর্কে তার ছোঁকছোঁকানি দোষ আছে। তিন, রীতিমতো মদ্যপানও করে থাকে সে। এসব কথা বেশ গর্বের সঙ্গেই বলতে নবকুমার।

    তার নাকি অনেক মেয়ে বন্ধু। এদের নিয়ে গল্প করবার সময় তার চোখ চকচকিয়ে উঠত। কোন মেয়ের সঙ্গে কীভাবে কতরকম কৌশলে সে ভাব জমিয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট দিতে দিতে যেন লালা ঝরতে থাকত। এসব গল্প সে করত সুরমার সঙ্গেই বেশি। মাঝে মাঝে অনিমেষও থাকতেন। অনিমেষ দূর সম্পর্কের শ্যালকের চারিত্রিক এই ব্যাপারগুলো হালকাভাবেই নিতেন। মনে করতেন নবকুমার মজা করছে–এ সব ভান। সুরমা হেসে হেসে বলত, তোমাকে নিয়ে পারা যায় না দাদা।

    নবকুমারকে নিয়ে প্রথম দিকে আদৌ কোনোরকম দুর্ভাবনা ছিল না অনীতার। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর লতায় পাতায় সম্পর্কের ভাই মদ খাক, ঘুষ খাক বা মেয়েদের পিছনে দৌড়ে জীবন ক্ষয় করে ফেলুক তাতে তার কী? তবে এটা ঠিক, লোকটাকে তার ভালো লাগত না। মদ ঘুষ মেয়ে ইত্যাদি মিশিয়ে তার সম্পর্কে মনটা বিরূপ হয়েই থাকত। তবে মুখে কখনো কিছু বলেনি।

    নবকুমারও অনীতার ব্যাপারে প্রথম প্রথম খুব একটা সচেতন ছিল না। বহু দূর সম্পর্কের বোনের সৎমেয়ের সঙ্গে দেখা হলে একটু হাসত, দু-একটা কথা বলত। ব্যস, এই পর্যন্ত।

    কিন্তু নবকুমারের ব্যাপারে খুব বেশি দিন নিশ্চিন্ত বা উদাসীন থাকা গেল না।

    অনীতা যখন বি.এ পড়ছে সেই সময় নবকুমারের নজর এসে পড়ল তার ওপর। অনীতা তখন ফুল-গ্রোন ইয়াং লেডি। নবকুমার আগে আগে সপ্তাহে এক-আধ দিন আসত, তখন থেকে রোজ আসতে শুরু করল। আগে বোন-ভগ্নিপতির সঙ্গে গল্প করত, অনীতা নামে একটা মেয়ে যে এ বাড়িতে আছে সে সম্বন্ধে তার বিশেষ খেয়াল থাকত না। কিন্তু সব ব্যাপারটা একেবারে বদলে গেল।

    এখন থেকে এ বাড়িতে ঢুকেই নবকুমার খানিকক্ষণ অন্যমনস্কর মতো সুরমার সঙ্গে গল্প করত কিন্তু তার চোখ দুটো থাকত অনীতার ঘরের দিকে। উসখুস করতে থাকত সে; তারপর একসময় বলেই ফেলত, অনুকে দেখছি না তো

    সুরমা বলত, পড়ছে।

    যখনই আসি তখনই দেখি পড়ে, ওকে আসতে বলো তো

    নবকুমার এলেই যে ডাক পড়বে সেটা কিছুদিনের মধ্যেই জেনে গিয়েছিল অনীতা। সুরমা একবার ডাকলে সে যেত না; চুপচাপ অসীম বিরক্তি নিয়ে বসে থাকত। দু-তিনবার ডাকাডাকির পর দারুণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হত। তাকে দেখা মাত্র চোখ দুটো অস্বভাবিক চকচক করতে থাকত। পুরুষের চোখ কখন এভাবে চকচকায়, সেটা বুঝবার মতো বয়স তখন হয়েছে অনীতার। ভেতরে ভেতরে সে কুঁচকে যেত।

    নবকুমার হেসে বলত, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো

    অনীতা বলত, কী বলবেন বলুন না। আমি পড়া ফেলে এসেছি।

    সবসময় এত কী পড়ো? ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলার হবে নাকি?

    না, মানে অনার্সের একটা পেপার–

    অনীতাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে নবকুমার বলে উঠত, এক ঘণ্টা না পড়লেও তুমি অনার্স পেয়ে যাবে। এসো তো ভেতরে

    অনীতা হয়তো আপত্তি করত কিন্তু তার আগেই সুরমা ঝাঁকিয়ে উঠত, এত করে একটা লোক ভেতরে আসতে বলছে তবু তোমার গ্রাহ্য হচ্ছে না। তোমাকে কি পায়ে ধরে সাধতে হবে?

    অগত্যা ভেতরে যেতেই হত। এক ঘণ্টা না, রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত অর্থাৎ যতক্ষণ নবকুমার থাকত ততক্ষণ একটানা কত কথা যে বলে যেত।

    প্রথম দিকে সুরমার ঘরে ডাকিয়ে নিয়ে যেত নবকুমার। পরে সাহস বেড়ে গিয়েছিল তার; সোজাসুজি অনীতার ঘরে চলে আসত। পড়াশোনার নাম করে তাকে এড়াতে চাইত অনীতা। কোনও দিন পারত, কোনও দিন পারত না। প্রায়ই ভাবত, বাবাকে নবকুমারের কথা বলবে কিন্তু তার আচরণের মধ্যে তখন পর্যন্ত এমন কিছু অশোভনতা ছিল না যা নিয়ে অভিযোগ তোলা যায়। অথচ লোকটাকে সহ্যও করা যাচ্ছিল না। তা ছাড়া আরও ব্যাপার ছিল। লতায় পাতায় হলেও সত্মায়ের ভাই তো; সম্পর্ক ধরলে মামাই দাঁড়ায়। মামা যদি ভাগ্নির ঘরে গল্প করতে ঢোকে, সেটা এমন কোনো দোষবহ ঘটনা নয়। এ নিয়ে বলার বিপদও আছে, নবকুমার সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত দিলে সুরমা নিশ্চয়ই চুপ করে থাকবে না। হইচই আর অশান্তি খুবই অপছন্দ অনীতার। কাজেই সে মুখ বুজে ছিল।

    মোটামুটি এভাবেই চলছিল। অনীতা যখন ফোর্থ ইয়ারে উঠল তখন থেকে সাহসটা আরেকটু বাড়ল নবকুমারের। আগে তবু অফিস ছুটির পর সন্ধের দিকে আসত সে; এবার থেকে যখন-তখন উদয় হতে লাগল।

    একদিন তার কলেজ কী কারণে যেন বন্ধ ছিল। দুপুরবেলা একটু দেরি করেই স্নান করতে গিয়েছিল অনীতা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সুরমাদের ঘরের পাশে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়েছিল অনীতা। ষড়যন্ত্রকারীদের মতো চাপা গলায় নবকুমার আর সুরমা কী যেন বলাবলি করছে। নবকুমার কখন এসেছে, অনীতা টের পাইনি, খুব সম্ভব সে তখন বাথরুমে ছিল।

    এমনিতে গোপনে আড়ি পেতে কারো কথা শোনার মতো অশোভনতা বা কুরুচি অনীতার মধ্যে নেই। কিন্তু নবকুমার আর সুরমার কথার মধ্যে দু-তিনবার নিজের নাম শুনতে পাওয়ায় অনীতার দারুণ কৌতূহল হয়েছিল; কৌতূহলের সঙ্গে এক ধরনের উদ্বেগও। নবকুমার বলছিল, কথাটা অনিমেষবাবুকে বলেছিস?

    সুরমা বলেছিল না, এখনও বলিনি। বলার জন্যে সুযোগ খুঁজছি।

    সুযোগ খোঁজাখুঁজির কী আছে, স্ট্রেট বলবি। আমিই বলতাম। নেহাত খারাপ দেখায় তাই তোকে রিকোয়েস্ট করছি।

    দেখি

    একমাস ধরে তো দেখেই আসছিস। তুই যখন পারছিসই না, আমাকেই বলতে হবে দেখছি

    আরেকটু অপেক্ষা করো।

    ঠিক আছে। কিন্তু এক উইকের বেশি এক সেকেন্ড ওয়েট করব না। অনিমেষবাবুকে বলবি, এ বিয়েতে তার একটা পয়সাও খরচ হবে না। সব এক্সপেন্ডিচার আমার।

    এই খরচ না-হওয়ার ব্যাপারটা সুরমাকে খুবই উৎসাহিত করে তুলেছিল। সে বলেছিল, তুমি ভেবো না; আজকালের মধ্যেই আমি বলে ফেলব। কিন্তু বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়েছিল সে।

    সুরকুমার দ্বিধান্বিত ভাবটা লক্ষ করে নবকুমার জিগ্যেস করেছিল, কী হল আবার?

    অনীতার সঙ্গে বিয়ে হলে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী দাঁড়াবে, ভেবেছ?

    কী আবার, তুই আমার শাশুড়ি হবি।

    কিন্তু তুই আমার দাদা না?

    দাদা না হাতি! তোর বাবার অনেক দূর সম্পর্কের পিসতুতো দাদার শালার আমি যেন কী হই? ওরে বাপ রে, রিলেশানের লাইন খুঁজতে চৌদ্দো পুরুষের মুণ্ডু ঘুরে যাবে। ওই সম্পর্ক কেউ ধরে!

    মজা করে সুরমা বলেছিল, বিয়ের পর আমাকে মা বলবে তো? প্রণাম করবে?

    মা কেন জ্যাঠাইমা কাকিমা পিসিমা ঠাকুমা–যা ডাকতে বলবি তাই ডাকব। আর প্রণাম? বলিস তো এখনই বাইশটা প্রণাম অ্যাডভান্স করে দিচ্ছি।

    থাক, অ্যাডভান্সের দরকার নেই। ওগুলো পাওনা রইল।

    অল রাইট। কিন্তু আসল কাজটা ভুলিস না। আমি তোর বিয়ে দিয়েছি, তুই আমার বিয়েটা দিয়ে দে। কিছু করলে তার রিটার্ন দিতে হয়।

    তোমার কথা আমার মনে থাকবে।

    শুনতে শুনতে অনীতার মনে হচ্ছিল, পায়ের তলায় সিমেন্টের পাকা ফ্লোর ঢেউয়ের মতো দুলে যাচ্ছে। নাক মুখ ঝাঁ ঝাঁ করে যাচ্ছিল।

    যাই হোক, সুরমার অ্যাকটিভিটি এর পর কীরকম হয় সেদিকে লক্ষ রেখে গিয়েছিল অনীতা। দুদিন পরে সত্যি সত্যিই অনিমেষকে বিয়ের কথাটা বলেছিল সে। প্রথমটা রাজি হননি অনিমেষ। সেই কদিন প্রচণ্ড অশান্তি গেছে বাড়িতে। প্রথম স্ত্রী মারা গেলেও তাঁরই সন্তান তো অনীতা। কোন বাপ আর জেনেশুনে নিজের মেয়েকে একজন ঘুষখোর মদ্যপ আর নারী-ঘটিত ব্যাপারে গোলমেলে লোকের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু যুবতী দ্বিতীয় স্ত্রীর চাপে এবং জেদে দুর্বল টাইপের অনিমেষকে রাজি হতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। অন্তত সুরমার মতো স্ত্রীর সঙ্গে এক বাড়িতে থেকে দীর্ঘকাল নিজের আপত্তি টিকিয়ে রাখার মতো সাহস, শক্তি বা অধ্যবসায় তাঁর ছিল না। মনে তাঁর যা-ই থাক, মুখে কিন্তু এ বিয়ের পক্ষে মত দিতে হয়েছিল।

    স্ত্রীর কাছে রাজি হবার পরের দিনই অফিস থেকে ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি নিয়ে অনীতার কলেজে গিয়েছিলেন অনিমেষ। সুরমা বাড়িতে আছে বলে বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি অনীতা। সে ঠিক করে ফেলেছিল, কলেজ থেকে অনিমেষের অফিসে ফোন করে কোনো একটা জায়গায় তাঁকে আসতে বলবে। ভালোই হয়েছিল, ফোনটা আর করতে হয়নি।

    বাবাকে নিয়ে কলেজের খেলার মাঠের একধারে গিয়ে বসেছিল অনীতা। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল, এ তুমি কী করলে বাবা, ওই বাজে লোকটার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলে!

    অনিমেষ তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে করুণ মুখে বলেছিল, কাঁদিস না মা, কাঁদিস না। কী করব বল, সুরোটা এত প্রেসার দিচ্ছে।

    তুমি তো জানো ওই লোকটা কীরকম?

    জানি না আবার, এক নম্বর ডিবচ, ঘুষখোর, পাজি। আমার বাড়িতে এই মতলব নিয়ে যে ঢুকবে, কী করে বুঝব!

    কিন্তু আমি তো তোমার মেয়ে। আমার জীবনটা তুমি নষ্ট করে দেবে? ওর সঙ্গে বিয়ে হলে আমি মরে যাব বাবা।

    এই বিয়ে কিছুতেই হওয়া উচিত না। তোর লাইফ আমি কোনোভাবেই নষ্ট হতে দিতে পারি না। কিন্তু কী করি বল তো?

    দুর্বল অসহায় বাবার দিকে তাকিয়ে করুণাই হয়েছে অনীতার। সে বলেছে, আমি একটা বাঁচার রাস্তা ভেবে বার করেছি।

    অনিমেষ খুবই উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন, কী রে?

    তুমি ওদের সামনে না বোলো না। শুধু জোর দিয়ে জানিয়ে দিও আমার এম.এ-টা কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে হবে না। এম. এটা হয়ে গেলে স্কুল-কলেজে একটা চাকরি-টাকরি পেয়ে যাবই, তখন আমি হোস্টেলে গিয়ে থাকব। বাড়িতে থেকে ওই লোকটার সঙ্গে আমরা পারব না। কিন্তু হোস্টেলে গেলে ও যদি আমার পিছু নেয় কী করে ঢিট করতে হয় আমি জানি।

    সমস্যাটার এত সহজে সমাধান হয়ে যাবে ভাবতে পারেননি অনিমেষ। তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছেন, দ্যটস ফাইন, দ্যাটস ফাইন। ওদের আশা দিয়ে দিয়ে রেখে আমাদের কাজ গুছিয়ে নেব। তারপর একটা সত্যিকারের ভালো ছেলে দেখে তোর বিয়ে দেব। বলতে বলতে কী ভেবে তাঁর মুখ হঠাৎ বিষাদে ছেয়ে যেতে শুরু করেছিল। একটু চুপ করে থেকে আবছা গলায় তিনি আবার বলেছিলেন, কিন্তু

    কী বাবা?

    তুই আমাকে ছেড়ে হোস্টেলে চলে যাবি?

    সরল ভালো মানুষ দুর্বল বাবার জন্য খুব কষ্ট হয়েছিল অনীতার। সে বলেছিল, বাড়ির ব্যাপারটা তো তুমি বোঝোই। ওখানে থাকব আর এই বিয়ে হবে না, তাতে অশান্তি শুধু বাড়বেই।

    অনীতা কার সম্বন্ধে ইঙ্গিত করেছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি অনিমেষের। বিভিন্ন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে তিনি বলেছিলেন, ঠিকই বলেছিস মা।

    তুমি এখন থেকে আবার মন খারাপ করে থেকো না বাবা। এম.এ-টা পর্যন্ত আমি তো বাড়িতেই থাকছি। হোস্টেলে যাবার পর রোজ তোমার সঙ্গে দেখা করব।

    বাবা আর মেয়ে ভবিষ্যতের একটা পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছিল। বিয়ের ব্যাপারে তারা আপত্তি তো করবেই না, বরং ওপরে ওপরে এমন একটা ভাব দেখাবে যেন বিয়েটা নিতান্তই অবধারিত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিজেদের কাজ করে যাবে।

    অনীতারা একভাবে ভবিষ্যতের প্ল্যান করেছিল। কিন্তু উলটোদিকের ব্যাপারটা সেই মুহূর্তে ভেবে দ্যাখেনি।

    অনিমেষ বিয়েতে রাজি হওয়ায় নবকুমারের সাহস দশগুণ বেড়ে গিয়েছিল। অনীতাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভাবতে শুরু করেছিল সে। একবার এলে খুব সহজে নড়তে চাইত না।

    এইভাবে বি. এ ফোর্থ ইয়ার পর্যন্ত চলেছিল। তারপর টেস্টের কয়েক দিন বাদে হঠাৎ নবকুমার জেদ ধরল আত্মীয়স্বজনদের ডেকে বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করে ফেলতে হবে। বাবা আপত্তি করেছিলেন কিন্তু নবকুমার একেবারে নাছোড়। সে বলেছিল, বিয়েটা নাহয় এম. এর পরেই হবে। ব্যবস্থাটা ফাইনাল করে রাখতে অসুবিধাটা কোথায়? সে তো আর বিয়ের জন্য এই মুহূর্তে চাপ দিচ্ছে না। মোট কথা চারদিক থেকে অক্টোপাসের মতো অনীতাকে বেঁধে ফেলতে চাইছিল নবকুমার। দুর্বল ভালোমানুষ বাবা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। আড়ালে অনীতাকে বলেছেন বিয়েটা যখন হবেই না তখন কথা পাকা হতে অসুবিধা কোথায়? লোক দেখানো একটা অনুষ্ঠান ছাড়া এটা কিছুই না। এতে নবকুমাররা খুশি থাকবে। দুটো-আড়াইটা বছর কোনও রকমে কাটিয়ে দিতে পারলে অনীতা যখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে তখন বিয়েটা ভেঙে দিতে আর কতক্ষণ।

    কিন্ত অনীতা বাবার ওপর বিশেষ ভরসা রাখতে পারছিল না। তাঁর মনের জোর এত কম, চরিত্রের ভিত এত নড়বড়ে যে খুব চাপ দিলে হয়তো নবকুমারের সঙ্গে সত্যিকারের বিয়েতেই রাজি হয়ে যাবেন। মনে মনে এর জন্য খুবই কষ্ট পাবেন তিনি কিন্তু মেরুদণ্ড টান টান করে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো শক্তি বা সাহস জুটিয়ে উঠতে পারবেন না। কাজেই অনীতা ঠিক করে ফেলেছিল বাবাকে সামনে দাঁড় করিয়ে যেটুকু যুদ্ধ করার সেটা তাকে নিজেকেই করতে হবে।

    যাই হোক, অনিমেষ যখন কথা দিয়েছেন তখন বিয়ের ব্যাপারটা ফাইনাল করতেই হয়েছিল। কারণ এই কথার সঙ্গে বাবার সম্মান জড়ানো ছিল। তবে খুব সহজে এটা ঘটতে দেয়নি অনীতা, পড়াশোনা, শরীর খারাপ ইত্যাদি একেকটা বাধা সামনে দাঁড় করিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত আটকে রেখেছিল।

    বিয়ের কথা ফাইনাল হবার দিন কয়েক পর অনীতা ডাকে একটি মহিলার চিঠি পায়। তাতে লেখা ছিল, নবকুমার তার সঙ্গে কিছুকাল স্বামী-স্ত্রীর মতো থেকেছে। তারপর তাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুধু তার-ই না, আরো বহু মেয়ের ক্ষতি করেছে নবকুমার। মহিলাটি কীভাবে যেন অনীতার সঙ্গে নবকুমারের বিয়ের খবর পেয়েছিল, অনেক কষ্টে তাদের ঠিকানা জোগাড় করে এই চিঠি পাঠিয়েছে। উদ্দেশ্য নবকুমারের হাত থেকে একটি মেয়েকে বাঁচানো।

    চিঠির কথা কাউকে জানায়নি অনীতা। তবে নবকুমার সম্পর্কে আরও সতর্ক হয়ে উঠেছে। এম. এটা পাশ না-করা পর্যন্ত তার অধৈর্য বা উত্তেজিত হওয়া চলবে না। ইচ্ছা করলে পায়ের থেকে জুতো খুলে নবকুমারের মুখে বসিয়ে দিতে পারত অনীতা কিন্ত তৎক্ষণাৎ তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হত। বাড়ি ছাড়ার জন্য সে পা বাড়িয়েই ছিল। কিন্তু বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় তো তার মতো একটি তরুণীর পক্ষে থাকা সম্ভব না। কোথাও গিয়ে তাকে উঠতে হয়। তা নাহয় উঠল, কিন্তু খরচ চলবে কী করে? বাবার যা রোজগার তাতে একসঙ্গে থাকলে ভালোভাবেই চলে যায় কিন্তু আলাদা করে তাকে টাকা দেওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া তাকে ওভাবে টাকা দিলে সুরমা আর বাবার মধ্যে অশান্তি অনিবার্য।

    এ তো গেল একটা দিক; বিয়ের কথা ফাইনাল হবার পর নবকুমার চাইত, অনীতাকে নিয়ে বেড়াতে বেরোয়। একটা টু-সিটার আছে তার; সেটা নিয়ে রোজ এসে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। প্রথম দিকে বাড়িতে এসে যাবার জন্য জেদ ধরত। পরে কদিন ধরে ইউনিভার্সিটিতে হানা দিতে শুরু করেছে।

    অনীতার ধারণা নবকুমারের সঙ্গে একা একা বাইরে বেরুনো খুবই বিপজ্জনক। তাই সে তাকে প্রাণপণে এড়িয়ে যাচ্ছে।

    বাড়িটা ভীষণ অহস্য লাগে অনীতার, সবসময় মনে হয় একটা বিস্ফোরকে ঠাসা ঘরের ভেতর তাকে আটকে রাখা হয়েছে। নিজে দুঃখ কষ্ট আর দুশ্চিন্তা ভুলবার জন্য তাই সে বাইরে হাসি-খুশি থাকতে চেষ্টা করে; বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মজা-টজা করে।

    এই হচ্ছে অনীতার তেইশ বছরের জীবনের ব্যাকগ্রাউন্ড। ডাবল ডেকারের ফ্রন্ট সিটে পাশাপাশি বসে তার কথা শুনতে শুনতে গভীর সহনুভূতিতে মন ভরে গিয়েছিল অবনীনাথের।

    বিষণ্ণ একটু হেসে অনীতা বলেছিল, ঝোঁকের মাথায় সব বলে গেলাম। নিশ্চয়ই তোমার খুব খারাপ লাগল।

    অবনীনাথ উত্তর দেননি।

    সেদিন ইউনিভার্সিটি থেকে নবকুমারকে ফিরিয়ে দিয়ে বাড়ি যাবার পর কী ঘটেছিল, নিজে অনীতা বলেনি। তবে জানার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন অবনীনাথ। পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে যাবার সময় কথাটা তিনি জিগ্যেস করেছিলেন। অনীতা মলিন হেসে বলেছিল, আন্দাজ করে নাও। ডিটেলসে বলে আর কী হবে?

    অবনীনাথ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, জানোয়ারটার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে যাও

    তাই তো করছি।

    এ ব্যাপারে আমাকে যদি কোনওভাবে দরকার হয় বলো। কথাগুলো বলেই চমকে উঠেছিলেন অবনীনাথ। নিজের অজান্তে এ তিনি কী বলে ফেললেন।

    অনীতা বলেছিল, তুমি যা বললে, এমন করে আগে আর কেউ বলেনি। তোমার কাছে সারাজীবন আমি কৃতজ্ঞ থাকব। তবে–তুমি বড় ভালো ছেলে। এই নোংরা ব্যাপারে তোমাকে জড়াতে চাই না। প্লিজ, আমাকে ভুল বুঝো না।

    একটু চুপচাপ। তারপর অবনীনাথ বলেছিলেন, ঠিক আছে, জড়িও না। তবে একটা অনুরোধ করব

    কী?

    তুমি নিশ্চয়ই আমাকে তোমার শুভাকক্ষী ভাবো?

    নিশ্চয়ই।

    তাহলে তোমার সঙ্গে ওরা কীরকম ব্যবহার করছে রোজ আমাকে জানিও।

    কিছুক্ষণ ভেবে অনীতা বলেছিল, ঠিক আছে, জানাব।

    এরপর থেকে নবকুমার আর সুরমা কীভাবে তাকে কষ্ট দিচ্ছে আর এ-ব্যাপারটা কিছুটা জেনে এবং বা কিছুটা আন্দাজ করে কীভাবে অনিমেষ অসহায়ের মতো দেখে যাচ্ছেন, সব বলে যেতে অনীতা। তবে নবকুমার কোনো দিনই তাকে একা একা বেড়াতে নিয়ে যেতে পারেনি। ওই জায়গাটায় অনমনীয় ছিল অনীতা।

    এইভাবেই প্রায় দুটো বছর কেটে গিয়েছিল। আর এই দুবছরের মধ্যে সেকেন্ড গ্রেট ওয়ার শুরু হয়ে গেছে।

    কলকাতার পার্কে পার্কে তখন ট্রেঞ্চ, বড় বড় বাড়ির সামনে বাফেলো ওয়াল, রাস্তায় রাস্তায় এ-আর-পি। রাত্তিরে ব্ল্যাক আউট। চারদিকে মিলিটারিদের ছাউনি পড়েছে। যুদ্ধের কল্যাণে তখন গন্ডা গন্ডা নতুন নতুন অফিস খোলা হচ্ছে। চাকরি তখন অঢেল।

    ঘুষ, ব্ল্যাক মার্কেটিং আর মদ মেয়েমানুষ–সব মিলিয়ে কলকাতায় তখন নরক গুলজার। হাওয়ায় হাওয়ায় ইনফ্লেসনের কোটি টাকা উড়ছে।

    এই সময় অনিমেষ গভর্নমেন্টের পে অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে মিলিটারির একটা ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন। ওয়ার সারভিস একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। প্রায় দিন-রাতই তখন অনিমেষের ডিউটি। মাসের ভেতর দশ-পনেরো দিন তাকে বাইরে থাকতে হত–কখনও শিলং, কখনও ডিব্ৰুগড়, কখনও সদিয়া বা তিনশুকিয়া। বাড়িতে থাকত অনীতা, সুরমা আর তার দুটো ছেলেমেয়ে।

    এদিকে নবকুমার গভর্নমেন্ট সারভিস ছেড়ে দিয়ে কনস্ট্রাক্টরি বিজনেসে নেমে গিয়েছিল। যুদ্ধের দৌলতে তখন চারদিকে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, এয়ারোড্রোম, মিলিটারি ব্যারাক তৈরি হচ্ছে। চারদিকে টাকা, টাকা আর টাকা। হাত বাড়িয়ে শুধু ধরতে পারলেই হয়।

    নবকুমারের বিজনেস ব্রেন দারুণ পরিষ্কার। দুদিনেই এ-লাইনের সব ঘোঁত-ঘাঁত জেনে নিয়েছিল। টপ র‍্যাঙ্কের ব্রিটিশ আর আমেরিকান মিলিটারি অফিসারদের হুইস্কির পেটি আর মেয়েমানুষ সাপ্লাই দিয়ে বিরাট সব কনটাক্ট বাগিয়ে ফেলতে লাগল সে। টাকা আসতে লাগল হুড়হুড় করে প্রায় ঢলের মতো। কয়েক মাসের ভেতর দুটো নতুন মডেলের ঝকঝকে ফরেন গাড়ি আর গোটাতিনেক বাড়ি কিনে ফেলেছিল সে। আগে কম করে একটু আধটু-ড্রিংক করত, পরে সেটার মাত্র, দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।

    লাখ লাখ টাকা কামাক, গাড়ি-বাড়ি করুক, হুইস্কির সমুদ্রে ভেসে যাক–যা ইচ্ছা নবকুমার করে যাক, অনীতার মাথাব্যথা নেই, কিন্তু যুদ্ধের বাজারের অঢেল টাকা একেবারেই বেপরোয়া করে তুলেছিল নবকুমারকে। অনিমেষ যখন অফিসের কাজে বাইরে বেরিয়ে টুরে ঘুরে বেড়াতেন তখন একেকদিন রাত্তিরবেলা মদে চুর হয়ে নতুন গাড়ি ড্রাইভ করে চলে আসত সে। জড়ানো গলায় চিৎকার করে বলত, বিয়ে যখন ফাইনাল হয়ে গেছে তখন অনীতা তার বউ-ই। এম. এ পড়ার আর দরকার নেই। সব শালা কনট্রাক্টরের বউ আছে, বউদের নিয়ে তারা মেজর, লেফটেন্যান্ট কর্নেলদের সঙ্গে খানাপিনা করে, পার্টিতে যায়। এতে বিজনেসের কত সুবিধে। পড়াশোনা করে কদ্দর আর অনীতা তাকে এগিয়ে দেবে। তার চাইতে চটপট বিয়েটা করে নবকুমারের সঙ্গে পার্টিটাতে গেলে তার যথেষ্ট উপকার হবে। যুদ্ধের সময়টা হল টাকা কামাবার সিজন। স্ত্রী না থাকলে ফিউচারে আর ভালো কনটাক্ট-টনটাক্ট পাওয়া সম্ভব হবে না। অতএব সে যা বলে অনীতাকে তাই করতে হবে…ইত্যাদি ইত্যাদি। কী করে যে জন্তুর মতো বেপরোয়া, পয়সার জোরে প্রবল শক্তিমান এই লোকটাকে ঠেকিয়ে গেছে, অনীতাই শুধু জানে।

    এদিকে দুবছরে অনীতার অনেক কাছাকাছি এসে পড়েছিলেন অবনীনাথ। ইউনিভার্সিটিতে যাবার বা ফেররে সময় অনীতার সঙ্গে তাঁর দেখা হত। তবে ওদের বাড়ি চিৎ কখনো যেতেন অবনীনাথ।

    যাই হোক, ফিফথ আর সিকথ ইয়ার–এই দুটো বছর একটানা কলকাতায় থাকা হয়নি অবনীনাথের। ছুটিছাটা হলেই দেশে চলে যেতেন তিনি।

    এই দুবছরে তাঁদের পারিবারিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ভাই-বোনগুলোর ঠিকমতো খাওয়া জুটত না। অবনীনাথ বুঝতে পারছিলেন গোটা সংসার তার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

    বাড়ি গেলে অনীতার মুখ সারাক্ষণ অবনীনাথের চোখের সামনে ভাসত, তার জন্য উল্কণ্ঠা এবং দুর্ভাবনায় মনটা ভরে থাকত। সবসময় ভাবতেন ছুটিতে বাড়ি এসে ভালো করেননি। হয়তো কলকাতায় ফিরে গিয়ে দেখবেন, অনীতার কোনো ক্ষতি হয়ে গেছে। হাজার হলেও মেয়ে তো। কতদিন আর এক হাতে তার পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? কিন্তু বাড়ি না-এলেও নয়। বাবা-মা ভাই-বোনেরা কবে অবনীনাথের ছুটি পড়বে সেজন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। আর বাড়ি এসে কলকাতায় এক দুঃখী অসহায় মেয়ের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে থাকতেন অবনীনাথ। খেতে ইচ্ছা করত না, রাতগুলো জেগে কেটে যেত।

    সে আমলে অনাত্মীয় কোনো মেয়েকে চিঠি লেখার চল ছিল না। ইচ্ছা যে হত না তা নয়। কিন্তু পরক্ষণেই ভয় হত, কার হাতে পড়বে, কে এর কী মানে করে বসবে। তাই নিয়ে পরে একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারি ঘটে যেতে পারে।

    ছুটির পর কলকাতায় ফিরে এলে অনীতা জিগ্যেস করত, কেমন কাটল ছুটিটা? খুব মায়ের আটর-টাদর খেয়ে এলে

    তা তো খেলাম। তবে

    তবে কী? গম্ভীর গলায় বলত অনীতা।

    দ্বিধান্বিতের মতো খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবনীনাথ বলতেন, না কিছু না

    একেবারেই কিছু না?

    হয়তো কিছু, কিন্তু বলতে ভরসা পাই না।

    অনীতা সামান্য হাসত, এতই বিপজ্জনক ব্যাপার নাকি?

    অবনীনাথ উত্তর দিতেন না। তাঁর বলতে ইচ্ছা করত ছুটির সময় কলকাতা থেকে একশো মাইল দূরে বসে একটি দুঃখী মেয়ের মুখ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি। তাঁর স্মৃতি এবং অস্তিত্বের ওপর মেয়েটি যেন ব্যাপ্ত হয়ে থেকেছে। কিন্তু এ কথা কী করে তাকে বলা যায়?

    অবনীনাথ জিগ্যেস করতেন, তোমার ছুটি কীভাবে কাটল?

    অনীতা পরিপূর্ণ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলত, সত্যি কথাই বলব তো?

    নিশ্চয়ই।

    তোমার কথা ভেবে।

    গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত অবনীনাথের। দুর্বল জড়ানো গলায় কী বলতেন, ঠিক বোঝা যেত না।

    দুঃখের কথা বলার মতো মানুষের তো কাউকে চাই। তুমি ছাড়া আমার তেমন কেউ নেই। ছুটিতে তুমি চলে গেলে বড় কষ্ট হয়। মনে হয় আর পারব না, ওরা আমাকে ভেঙে গুঁড়ো করে দেবে। তাই ছুটি যেদিন থেকে পড়ে সেদিন থেকেই ভাবতে বসি কবে ছুটি শেষ হবে। কবে তুমি দেশ থেকে ফিরবে।

    কিন্তু আমি তো তোমাকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারি না।

    তুমি থাকলেই আমি অনেকখানি সাহস পাই।

    1 2
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleক্রান্তিকাল – প্রফুল্ল রায়
    Next Article ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.