Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সর্ববিদ্যাবিশারদের বউ

    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প17 Mins Read0

    সর্ববিদ্যাবিশারদের বউ

    বিবাহের রাত্রেই নিবারণ ডান দিকের স্ত্রীকে বাঁ দিকে চালান করিয়া দিয়াছিল।

    তুমি এ পাশে এসে শোও, কেমন?

    এই তার প্রথম প্রেমালাপ। সুকুমারী একটু ভীরু আর ভাবপ্রবণ মেয়ে, তার আশঙ্কা আর আশা দুইই ছিল অন্যরকমের। ব্যাপারটা সে বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই, কিন্তু কারণ জানিবার চেষ্টাও করে নাই। কে জানে, ডান দিকের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হয়তো ব্যথাট্যাথা হইয়াছে মানুষটার, ডান দিকে পাশ ফিরিয়া শুইয়া বউয়ের সঙ্গে আলাপ করিতে কষ্ট হইবে। এই রকম একটা অনুমান করিয়া সে নীরবে স্বামীর সঙ্গে শয্যায় স্থান পরিবর্তন করিয়াছিল।

    সুকুমারী কোনো প্রশ্ন করিল না দেখিয়া নিবারণ নিজেই কারণটা ব্যাখ্যা করিয়া তাকে বুঝাইয়া দিয়াছিল : স্ত্রীকে বাঁ দিকে শুতে হয়—তাই নিয়ম। পরে এ নিয়ম মেনে চল বা না চল তাতে অবশ্য কিছু এসে যায় না, কিন্তু বিয়ের রাতে—

    রাত্রি তখন প্রায় তিনটা বাজে। এত রাত্রে এরকম একটা তামাশার মধ্যে কি কেউ বউয়ের সঙ্গে প্রথম আলাপ আরম্ভ করে? যারা আড়ি পাতিয়াছে তারা শুনিলে কী ভাবিবে! সুকুমারী ভীরু বটে, কিন্তু ভাবপ্রবণতার জোরে ভীরুতাকে জয় করিয়া একটু রাগিয়াই গিয়াছিল। আর কিছু মাথায় না আসুক, সোজাসুজি নাম জিজ্ঞাসা করিয়া কথা আরম্ভ করিলেই হইত।

    নিবারণের বোধ হয় ধারণা হইয়াছিল, কথা আরম্ভ করা মাত্র বউয়ের সঙ্গে ভাব জমিয়া গিয়াছে। প্রকাণ্ড একটা হাই তুলিয়া অন্তরঙ্গ স্বামীর মতো সে বলিয়াছিল, কত যে ভুল হয়েছে বিয়েতে বলবার নয়। মন্ত্রতন্ত্র থেকে আরম্ভ করে স্ত্রী-আচার পর্যন্ত। নতুন জামাই বলে চুপ করে ছিলাম, কিন্তু এমন অস্বস্তি লাগছিল মাঝে মাঝে–

    শুনিতে শুনিতে সুকুমারীর সর্বাঙ্গ অবশ হইয়া আসিয়াছিল। কী সর্বনাশ, শেষ পর্যন্ত তবে কি একটা পাগলের সঙ্গে তার বিবাহ হইয়াছে? একটু পরেই অবশ্য জানা গিয়াছিল ঠিক পাগল নিবারণ নয়, সম্ভবত তামাশাই করিতেছিল।

    তুমি যে কথা বলছ না? ও, সাধাসাধি করি নি বলে? বলিয়া এতক্ষণ পরে নিবারণ আবার গোড়া হইতে বউয়ের সঙ্গে ভাব করিবার চেষ্টা আরম্ভ করিয়াছিল, সুকুমারীর বন্ধুদের কাছে শোনা বিবরণের সঙ্গে যার অনেক মিল। বেশ মিষ্টি লাগিয়াছিল নিবারণকে সুকুমারীর তখন, ভোর পর্যন্ত সামান্য সময়টুকুর মধ্যেই অনেকবার রোমাঞ্চ হইয়া সর্বাঙ্গ তার অবশ হইয়া আসিয়াছিল প্রথমবারের চেয়ে ভিন্ন কারণে।

    কয়েকটা দিন কাটিতে না কাটিতে সুকুমারী বুঝিতে পারিল, বিবাহের রাত্রে বাঁ দিকে তাকে শোয়াইয়া আর মন্ত্রতন্ত্র এবং স্ত্রী-আচারের ভুল দেখাইয়া দিয়া নিবারণ তার সঙ্গে তামাশা করে নাই। তামাশা যে নিবারণ করে না তা নয়, রসকষ মানুষটার মধ্যে যথেষ্টই আছে, কিন্তু নিয়ম পালনের সময় আর ভুলত্রুটি দেখাইয়া দেওয়ার সময় তামাশা করার পাত্র সে নয়।

    বিবাহ হইয়াছে শীতকালে, মুখে তাই সুকুমারী একটু ক্রিম মাখে। নয় তো এমন টুকটুকে রঙ তার, স্নো ক্রিম পাউডার মাখিবার তার দরকার? ক্রিমের কৌটাটা দেখিয়া নিবারণ একদিন বলে কী, এই ক্রিম মাখো তুমি? ছি! আর মেখো না।

    সুকুমারী অবাক। –কেন?

    এই ক্রিমটা ভালো নয়, চামড়া উঠে যায়। তোমায় অন্য ক্রিম এনে দেব।

    সুকুমারীর দুই বউদিদি এই ক্রিম মাখিয়া মাখিয়া চামড়া ফাটা ঠেকাইয়া রাখে—দুজনের চামড়াই বড় ফাটল-প্রবণ। সুকুমারী নিজেও আজ কত বছর এই ক্রিম মাখিতেছে ঠিক নাই। সে একটু হাসিয়া বলে, তুমি কী করে জানলে চামড়া ফাটে?

    নিবারণ রীতিমতো বিরক্ত হইয়াছে বুঝিতে পারিয়া সুকুমারীর হাসি পরক্ষণেই মিলিইয়া যায়। নিবারণ গম্ভীর মুখে বলে, আমি জানি। আর মেখো না।

    এরকম হুকুম কোনো নতুন বউ মানিতে পারে? অন্য একটা ক্ৰিম আনিয়া দিলেও বরং কথা ছিল। বিকালবেলা সুকুমারী মুখে একটু ক্রিম মাখিয়াছে, তারপর কতবার যে আঁচল দিয়া মুখ মুছিয়াছে হিসাব হয় না, রাত্রি আটটার সময় বাড়ি ফিরিয়া নিবারণ যে কী করিয়া টের পাইয়া গেল!

    ক্রিম মেখেছ যে?

    নিবারণের মুখ দেখিয়া সুকুমারীর মুখ শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গিয়াছে। ঢোক গিলিয়া সে বলে, এমন চড়চড় করছিল—

    চড়চড় করবে বলেই তো মাখতে বারণ করেছি। এবার থেকে এই ক্রিম মেখো।

    পকেট হইতে নিবারণ নতুন ক্রিমটি বাহির করে দেয়। হাতে নিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিয়া সুকুমারী হাসিবে না কাঁদিবে ভাবিয়া পায় না। এই ক্রিম মাখব? এ কি মেয়েরা মাখে? এ তো ব্যাটাছেলের দাড়ি কামিয়ে মাখবার ক্রিম।

    নিবারণ জাঁকিয়া বসিয়া বলে, তাই তো এটা আনলাম। দাড়ি কামিয়ে লোকে ক্রিম মাখে কেন, চামড়া চড়চড় করবে না বলে তো? কামানোর পর যে ক্রিমে চড়চড় করে না, এমনি লাগালে তো তোমার আরো বেশি কম চড়চড় করবে।

    সেদিন হইতে সুকুমারীর ক্রিম মাখা বন্ধ হইয়াছে।

    কেবল মেয়েদের প্রসাধনের একটি বিষয় নয়, নিবারণ জানে না এমন বিষয় নাই। বিবাহের রাত্রে চারদিকে সমস্ত ব্যাপারে ভুলত্রুটি আবিষ্কার করিয়া নিবারণের অস্বস্তি বোধ করিবার অর্থটা ধীরে ধীরে সুকুমারী বুঝিতে পারে। চোখের সামনে মানুষকে ভুল করিতে দেখিয়াও চুপ করিয়া থাকিতে যাওয়াটা নিবারণের পক্ষে অস্বস্তির ব্যাপারই বটে। এখনো মাঝে মাঝে ওরকম অস্বস্তি তাকে বোধ করিতে হয়। সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যের কথা, নিজের বাড়িতে চুপ করিয়া থাকিবার প্রয়োজন বেশি হয় না বলিয়া অস্বস্তিটাও তাকে বেশি ভোগ করিতে হয় না। বাড়ির বাহিরে পথেঘাটে, আত্মীয়বন্ধুর বাড়িতে আর আপিসে সে কী করে সুকুমারী জানে না।

    সমস্ত বিষয়েই নিবারণ ব্যবস্থা দেয়, সমস্ত ব্যবস্থার সমালোচনা করে। ব্যাখ্যা তার মুখে লাগিয়াই আছে, পিঁপড়ার লাইন বাঁধিয়া চলার কারণ হইতে সেজো পিসির ছেলেটা অপদার্থ কেন পর্যন্ত। তার অনেকগুলো নিয়ম এখন এ বাড়িতে চালু হইয়াছে, তার প্রায় সবগুলো নিষেধই বাড়ির মানুষেরা তার সামনে মানিয়া চলে। আগে যে তার মতামতের একটা মর্যাদা ছিল না, বাড়ির কর্তা হওয়ার পর হইয়াছে, এটুকু সুকুমারী সহজেই অনুমান করিতে পারে। তবে কর্তা হইয়া নিবারণ যে নিয়ম কানুনের বহর আর অবিচার অনাচারে বাড়িটাকে গারদখানা বানাইয়া তুলিয়াছে তা নয়। মত মানানোর জন্য তার কোনোরকম জোর জবরদস্তি নাই, তার মতের বিরুদ্ধে গেলেও সে রাগ করে না বা তার মটা মানিয়া চলিলেও খুশিও হয় না। মত প্রকাশ করিতে পাইলেই তার হইল। কঠোর সে শুধু তার অমতের বেলা। তার নিষেধ কেউ না মানিলে সে রাগিয়া আগুন হইয়া ওঠে—তা সে যত তুচ্ছ বিষয়েই নিষেধ হোক। কাঁচা টমেটো খাওয়া যে কত উপকারী আর কেন উপকারী সে কথা সে প্রায়ই বলে, কিন্তু সে ছাড়া বাড়ির কেউ কাঁচা টমেটো খায় না। খায় কি না খায় এটা সে খেয়াল করিয়াও দ্যাখে না। কিন্তু একবার যদি তার নজরে পড়ে যে কেউ একতলায় খালি পায়ে হাঁটিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে একেবারে কুরুক্ষেত্র বাধিয়া যায়। চটি বা স্যান্ডেল পায়ে সকলের হাঁটার ব্যবস্থা সে দেয় নাই, দিলে হয়তো সকলে মিলিয়া একসঙ্গে স্যাঁতসেঁতে উঠানে খালি পায়ে সারা দিন হাঁটিলেও সে চাহিয়া দেখিত না! কিন্তু খালি পায়ে একতলায় হাঁটা সে নিষেধ করিয়া দিয়াছে কিনা, তাই বিধবা পিসিকে পর্যন্ত খালি পায়ে হাঁটিতে দেখিলে সে গজগজ করে আর কাঠের সোল দেওয়া নানা প্যাটার্নের কাপড়ের জুতা কিনিয়া আনিয়া জুতা পরানোর জন্য দু বেলা পিসির সঙ্গে ঝগড়া করে।

    পিসি বলে, নে থাম। জুতো পরিয়ে আমায় চিতায় তুলিস।

    নিবারণ বলে, ছেলে কী তোমার সাধে বিগড়েছে পিসিমা? তোমার স্বভাবের জন্য।

    পিসি তখন কাঁদিতে আরম্ভ করে। দুটি অন্ন দেয় বলিয়া এমনভাবে লাঞ্ছনা গঞ্জনা অপমান করা নিবারণের উচিত, যতই হোক সে তো তার বাপের বোন? বলিতে বলিতে ভাইয়ের জন্য পিসির শোক উথলাইয়া ওঠে, নিবারণ কিছু বলিলেই পিসির এরকম হয়। বাড়িতে একমাত্র পিসির সঙ্গেই নিবারণ আঁটিয়া উঠিতে পারে না।

    পিসির ছেলের নাম নিখিল। যেমন রোগা তেমনই লম্বা চেহারা। ছেলেটা সত্যই এক নম্বরের শয়তান। এদিকে মা হয়তো তার ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতেছে আর যুদ্ধে হার মানিয়া নিবারণ গজর গজর করিতেছে, ভালোমানুষের মতো মুখ করিয়া চোখ মিটমিট করিতে করিতে নিখিল প্রশ্ন করে, কাঁদলে মানুষের চোখ দিয়ে জল পড়ে কেন দাদা?

    সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিবার উপক্রম করিতে করিতে সুকুমারী মুখ লাল করিয়া থমকিয়া দাঁড়ায়। ভাবে, উদ্ধত গোঁয়ার ছেলেটার এমন একটা খোঁচা দেওয়া ফাজলামিতে কী রাগটাই না জানি নিবারণ করিবে। হয়তো দূর করিয়া তাড়াইয়া দিবে বাড়ি হইতে। কিন্তু পরক্ষণে নিবারণের ব্যাখ্যা তার কানে আসে—বাপের বাড়ির জন্য মন কেমন করিয়া কাঁদায় একদিন তাকে যে ব্যাখ্যা শুনিতে হইয়াছিল। চাহিয়া দেখিতে পায়, দু হাত পিছনে দিয়া একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়া নিবারণ পায়চারি আরম্ভ করিয়াছে।

    কিছুক্ষণ পরে উপরে গিয়া নিবারণ নিজেই বলে, বড় বজ্জাত হয়েছে নিখিলটা। কী রকম অপমান করল আমায় দেখলে?

    অপমানজ্ঞান আছে তোমার? – সুকুমারীর বড় রাগ হইয়াছিল।

    কী বললে? বলিয়া রাগ করিয়া কাছে আসিয়া নিবারণ অন্যমনা হইয়া যায়। এতক্ষণ সুকুমারী মাথা নিচু করিয়া ছিল, মুখ তুলিয়া চাহিবামাত্র নিবারণ ব্যস্ত হইয়া বলে, তোমার জ্বর হয়েছে।

    না, জ্বর হতে যাবে কেন?

    উঁহু, তোমার নিশ্চয়ই জ্বর হয়েছে। এ বেলা ভাত খেয়ো না।

    স্নেহ করিয়াই নিবারণ তাকে ভাত খাইতে বারণ করে, চিন্তিত মুখে সহানুভূতিভরা কোমল গলায়। অন্য সময় হয়তো সুকুমারী গলিয়া যাইত, এখন ব্যঙ্গ করিয়া জিজ্ঞাসা করে, কী করে জানলে আমার জ্বর হয়েছে? মুখ দেখে?

    নিবারণ গম্ভীর হইয়া যায়।—আমি জানি।

    ছাই জান তুমি। রাগটাগ হলে আমার মুখ এরকম লাল দেখায়—সবারই দেখায়। থার্মোমিটার দিয়া দ্যাখো, এক ফোঁটা জ্বর যদি ওঠে—

    সব জ্বর থার্মোমিটারে ওঠে না। যাই হোক, এ বেলা ভাত খেয়ো না।

    .

    ছুটির দিন সকালবেলার ঘটনা, সবে চা-টা খাওয়া হইয়াছে, ভাত খাইতে তখনো অনেক দেরি। তবু সুকুমারীর মনে হয়, সে কতকাল খায় নাই, তখন তখন খুব ঝাল কোনো একটা তরকারি দিয়া দুটি ভাত খাইতে পাইলে বড় ভালো হইত। এখনো দেহেমনে স্বামীর গতরাত্রের আদরের স্বাদ লাগিয়া আছে, এর মধ্যে স্বামীর নিষেধ ভাঙার স্বাদ পাওয়ার জন্য এরকম ছটফটানি জাগার মতো রাগ হওয়া কি তার উচিত? ঠিক রাগ কি না সুকুমারী বুঝিয়া উঠিতে পারে না। কেমন একটা ঝাঁজালো বিষাদ! দিন আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে অন্য দিনও তো এটা সে অনুভব করিয়াছে, আজ তো নয় কেবল?

    এ বেলা তাকে ভাত খাইতে বারণ করিয়া নিবারণ বাজারে গিয়াছে, সমস্ত বাজারটাই কিনিয়া আনিবে। কিন্তু একটি বেহিসাবি জিনিস কি থাকিবে তাতে? যা খাইলে মানুষের ভিটামিন বাড়ে না, রক্তমাংস হাড়ের পুষ্টি হয় না, তাপের উৎপাদন হয় না? খাওয়ার কথা ভাবিলে নিছক জিভে জল আসে মাত্র এমন কোনো বাজে জিনিস?

    সকালবেলা এখন সংসারের কত কাজ, ঘরে বসিয়া থাকা তার উচিত নয় জানে, তবু ভাত খাইতে বারণ করার রাগে ঘরেই সুকুমারী বসিয়া থাকে। বাজার আসার পাঁচ মিনিট পরে আসে ছোট ননদ পলটু। বিবাহের এক বছরের মধ্যে পলটুর সন্তান সম্ভাবনা ঘটিয়াছে। পলটুর ধারণা, এ জগতে এমন কেলেঙ্কারি আর কোনো মেয়ের অদৃষ্টে জোটে নাই।

    দাদা যেন কী, ছি! বলিয়া লজ্জায় প্রায় মূর্ছা গিয়া সে বউদিদির গায়ের উপর ঢলিয়া পড়ার উপক্রম করে, একগাদা কত কী সব কিনে এনে বলছে আমার জন্য এনেছে, আমার খেতে ভালো লাগবে। এ অবস্থায় আমাদের নাকি অরুচি হয়!

    চোখ বুজিয়া থাকিয়াই পলটু একবার শিহরিয়া ওঠে!

    সুকুমারী ভাবে, তবু তো আনিয়াছে? তাই বা কম কী! কাজের ছলে বাজার দেখিতে নিচে গিয়া বাহিরের ঘর হইতে নিবারণের গলা তার কানে ভাসিয়া আসে। খবরের কাগজকে কেন্দ্র করিয়া পাড়ার কয়েকজন ভদ্রলোকের কাছে রাজনীতির বক্তৃতা হইতেছে। কথা শুনিলে মনে হয়, সব যেন তার কাছে অপোগণ্ড শিশু। ভিতরের দিকের জানলার পরদা একটু ফাঁক করিয়া সুকুমারী একবার উঁকি মারে, মুচকি হাসি খুঁজিয়া বাহির করিবার জন্য সকলের মুখের দিকে তাকায়। সকলেই চা পানে ব্যস্ত। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাও তাদের নির্বিবাদে চলিতেছে। এক বছরের মধ্যে ইউরোপের অবস্থা কী দাঁড়াইবে ব্যাখ্যা করিতে করিতে নিবারণ যেন কেমন করিয়া ভারতের প্রাচীন ইতিহাসে চলিয়া গিয়াছিল, কার একটা কথা কানে যাওয়ায় মুখের কথাটা শেষ না করিয়াই বলে, আপনি ভুল করেছেন সতীশবাবু, ও শেয়ার কি কিনতে আছে! এক মাসের মধ্যে অর্ধেক নেমে যাবে। তার চেয়ে যদি—

    এখন নয়, এসব বিষয়ে নিবারণের সঙ্গে কেউ বিশেষ তর্ক করে না, ঝগড়া বাধিবে খেলার সময়। আজ ছুটির দিন, তাস আর দাবার আড্ডা বসিবেই, নিবারণ হয়তো তাস হাতে করিয়া দাবার চাল বলিয়া দিতে থাকিবে। ঝগড়া শুনিয়া মাঝে মাঝে ভয় হইবে এই বুঝি মারামারি বাধিয়া গেল। কেন যে ওরা এখানে খেলিতে আসে!

    কী ঠাকুর?

    এবার মাংস চড়াব।

    বাহিরের ঘরের ভেজানো দরজার কাছে ঠাকুর ইতস্ত করে।

    নাই বা ডাকলে? নিজেই চড়িয়ে দাও আজকে চল আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

    সে সাহস ঠাকুরের নাই, মাংস চড়ানোর সময় নিবারণ তাকে ডাকিবার হুকুম দিয়া রাখিয়াছে, না ডাকিলে কী রক্ষা রাখিবে!

    শুনিয়া সুকুমারীর মনে হয়, তবে তো বারণ না মানিয়া এ বেলা মাংস দিয়া সে দুটি ভাত খাইলেও নিবারণ রক্ষা রাখিবে না! এতক্ষণ পরে গভীর অভিমানে সুকুমারীর চোখে হঠাৎ জল আসিয়া পড়ে।

    নতুন কিছুই আজ বাড়িতে ঘটে নাই, তবু যেন সব সুকুমারীর কেমন খাপছাড়া অর্থহীন মনে হয়, বাড়ির সকলের কাজকর্ম চলাফেরা গল্পগুজব। নিবারণের ভাগনি অর্গান বাজাইয়া গান ধরিয়াছে, নিবারণ নিজেই তাকে গান শেখায়। সুকুমারী নিজেও ভালো গান জানে, ভাগনির ভুল সুর শুনিতে শুনিতে তার হতাশা মেশানো এমন একটা উৎকট কষ্ট হয়! রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া নিবারণের মা একটি নাতিকে দুধ খাওয়াইতেছিল, ভাঁড়ার ঘরের পাশের ছোট ঘরটিতে বাড়ির অন্য মেয়েরা চানাচুর খাইতে খাইতে গল্প করিতেছে, ছেলেমেয়েরা হইচই করিয়া খেলা করিতেছে সারা বাড়িতে। এর মধ্যে কী খাপছাড়া, কী অর্থহীন? এতবড় একটা সংসারের দায়িত্ব যার ঘাড়ে সেই লোকটা একটু খাপছাড়া বলিয়া কি তার এরকম মনে হয়? সঙ্গ ভালো না লাগায়, করার মতো একটা বাজে কাজও হাতের কাছে না থাকায় সুকুমারী ঘরে গিয়া ব্লাউজ সেলাই করিতে বসে। ব্লাউজ দুটি নিবারণ ছাঁটিয়া দিয়াছে। গলার ছাঁট দেখিতে দেখিতে সুকুমারী ভাবে, এ ব্লাউজ পরিলে লোকে হাসিবে না তো?

    .

    বেলা প্রায় তিনটার সময় সুকুমারীর দাদা পরমেশ আসিল। এই দাদাটির জন্য সুকুমারীর মনে কত যে গর্ব আছে বলিবার নয়। পরমেশ খ্যাতনামা অধ্যাপক, এই বয়সেই কলেজের ছেলেদের জন্য দু খানা বই পর্যন্ত লিখিয়া ফেলিয়াছে। তার ডিগ্রিগুলো উচ্চারণ করিবার সময় আহ্লাদে সুকুমারীর জিভ জড়াইয়া আসে।

    খানিকটা দুধবার্লি গিলিয়া সুকুমারী বিছানায় পড়িয়াছিল। ততক্ষণে তার নিজের মনেই সন্দেহ জন্মিয়া গিয়াছে, থার্মোমিটারে ধরা পড়ে না এমন জ্বর হয়তো সত্যসত্যই তার হইয়াছে। ঘরের পাশে একতলার মস্ত খোলা ছাদ, তারই এক প্রান্তে এদিকের ঘরগুলোর সঙ্গে কোনাকুনিভাবে আরেকটি ঘর তোলা হইতেছে। নিবারণ গিয়া মিস্ত্রিদের কাজ দেখাইয়া দিতেছিল আর শুইয়া শুইয়া জানালা দিয়া সুকুমারী তাই দেখিতেছিল। পরমেশ সাড়া দিয়া ঘরে ঢুকিতে সে খুশি হইয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, এস দাদা।

    তোর নাকি জ্বর হয়েছে!

    হুঁ।

    পরমেশ বসিয়া বলিল, নিবারণ কই?

    সুকুমারী আঙুল বাড়াইয়া দেখাইয়া দিল। একজন মিস্ত্রি তখন কাজ বন্ধ করিয়া নিবারণের সামনে মুখোমুখি দাঁড়াইয়াছে, বোধ হয় সর্দার মিস্ত্রি। ঘরের মধ্যে ভাইবোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, আর ওদিকে সর্দার মিস্ত্রি বলে, আপনি যদি সব জানেন বাবু তবে আর আমাদের কাজ করতে ডেকেছেন কেন?

    সুকুমারী চাপা গলায় বলে, শিগগির ডাক দাদা—এখুনি হয়তো মেরে বসবে।

    নিবারণ কী করিত বলা যায় না, পরমেশের ডাক শুনিয়া মুখ ফিরাইয়া চাহিল। তারপর মিস্ত্রিকে বলিল, তোমাদের আর কাজ করতে হবে না। নিচে যাও, তোমাদের পাওনা দিয়ে দিচ্ছি। বলিয়া গটগট করিয়া ঘরে চলিয়া আসিল।

    তারপর সাধারণ কুশল প্রশ্নের অবসরও তাদের হয় না, শালা-ভগ্নিপতিতে তর্ক শুরু হইয়া যায়। পরমেশ বলে, ওরা সব ছোটলোক, ওদের সঙ্গে কি ঝগড়া মারামারি করতে আছে হে!

    নিবারণ আশ্চর্য হইয়া বলে, ছোটলোক? ছোটলোক হবে কেন ওরা? ওই তো দোষ আপনাদের, যারা খেটে খায় তাদেরই ছোটলোক ধরে নেন।

    অকারণে খোঁচা খাইয়া পরমেশ একটু চটিয়া বলে, ও, তোমার বুঝি ওসব মতবাদ আছে? কিন্তু তুমিও তো বাবু সামান্য একটা কথা সইতে না পেরে বেচারাদের তাড়িয়ে দিলে?

    নিবারণ একটু অবহেলার হাসি হাসিয়া বলে, তাড়িয়ে দিলাম কি ওরা ছোটলোক বলে? ওইখানে তো মুশকিল আপনাদের নিয়ে, বই পড়ে পড়ে সহজ বিচারবুদ্ধিও আপনাদের লোপ পেয়ে গেছে। ঘর তুলব আমি, আমি যেরকম বলব সেরকমভাবে ওরা যদি কাজ না করে তা হলে চলবে কেন? তাই ওদের বিদেয় করে দিলাম—ওরা ছোটলোক বলে নয়।

    আজ প্রথম নয়, আগেও কয়েকবার দুজনে তুমুল তর্ক হইয়া গিয়াছে, শেষ পর্যন্ত যা গড়াইয়াছে প্রায় রাগরাগিতে। তর্কটা অবশ্য আরম্ভ করে নিবারণ, বিজ্ঞানের কোনো একটা বিষয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা অভিমত প্রশ্ন বা সন্দেহের মধ্যে ব্যক্ত করিয়া পরমেশের মুখ খুলিয়া দেয়। প্রথমে পরমেশ পরম ধৈর্যের সঙ্গে তাকে বুঝাইবার চেষ্টা করে, তারপর ধৈর্যহারা হইয়া চেষ্টা করে আত্মপক্ষ সমর্থনের, তারও পরে চটিয়া গিয়া আরম্ভ করে আক্রমণ। আজ নিবারণের খোঁচায় প্রথমেই তাকে চটিয়া উঠিতে দেখিয়া সুকুমারী চট করিয়া ঘরের বাহিরে গিয়া ডাকে, দাদা, একবার শোন। শিগগির শুনে যাও আগে।

    পরমেশ কাছে গেলে ফিসফিস করিয়া বলে, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, ওর সঙ্গে তর্ক কর কেন? যাই বলুক হেসে উড়িয়ে দিতে পার না?

    শুনিয়া আজ পরমেশের হঠাৎ প্রথম খেয়াল হয় যে, তাই তো বটে, নিবারণের সঙ্গে সে তর্ক করে কেন? নিবারণ ছেলেমানুষি করে বলিয়া সেও ছেলেমানুষ হইতে যায় কেন? তারপর দুজনে ঘরে ফিরিয়া যায়, এ কথায় সে কথায় কিছুক্ষণ কাটিয়া যায়, কোথা হইতে এক টুকরো মেঘ আসিয়া বাহিরের রোদটুকু মুছিয়া নিয়া যায়। ভাসা আলগা মেঘ, একটু পরেই সরিয়া যাইবে।

    তখন নিবারণ বলে, আচ্ছা আপনারা যে বলেন লাইটের চেয়ে বেশি স্পিড আর কোনো কিছুর হতে পারে না, তার কী প্রমাণ আছে?

    পরমেশ তাকায় সুকুমারীর মুখের দিকে, ঠোটের কোণে মৃদু একটা হাসি দেখা দেয়। উদাসভাবে বলে, কে জানে।

    জবাব শুনিয়া একটু থতমত খাইয়া নিবারণ খানিক্ষণ চুপ করিয়া থাকে। তারপর বলে, আমি বলছিলাম, মানুষের স্পিড তো আরো বেশি হতে পারে। যাকগে ও কথা। আচ্ছা, গ্রহণের সময় দেখা গেছে তারার আলো সূর্যের পাশ দিয়ে আসবার সময় সূর্যের আকর্ষণে বেঁকে যায়

    তাও আমি জানি না।

    ও! বলিয়া নিবারণ এবার গম্ভীর হইয়া যায়। গাম্ভীর্য তার বজায় থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণে সুকুমারীর মুখ শুকাইয়া গিয়াছে এবং পরমেশ দারুণ অস্বস্তি বোধ করিতে আরম্ভ করিয়া ভাবিতেছে, তার রাগটা কমানোর জন্য কী বলা যায়। কিন্তু গাম্ভীর্য নিবারণের আপনা হইতেই উবিয়া যায়। সহজভাবেই আবার সে কথাবার্তা আরম্ভ করে। আলগা মেঘটা উড়িয়া গিয়া আবার চারদিক রোদে ভরিয়া যায়, সুকুমারীর মুখের বিষাদের ছায়াটা কিন্তু সরিয়া যায় না। গম্ভীর হইয়া থাকাটা বেশি অপমানকর জানিয়াই কি নিবারণ গাম্ভীর্য ত্যাগ করিল? আর সমস্ত বিষয়ে যেমন, রাগ-দুঃখে মান-অভিমানের বেলাতেও কি তেমনই জানাটা নিবারণের কাছে বড়? এত যে ভালবাসে তাকে নিবারণ, তার মধ্যেও জানাজানির প্রাধান্য কতখানি কে জানে?

    .

    সন্ধ্যার সময় পরমেশের সঙ্গে নিবারণও বাহির হইয়া যায়। পরমেশ যায় বাড়ি ফিরিয়া, নিবারণ যায় বেড়াইতে। বেড়াইতে গেলে নিবারণ ফিরিয়া আসে এক ঘণ্টার মধ্যে, আজ নটার সময়ও তাকে ফিরিতে না দেখিয়া মনের ক্ষোভে সুকুমারীর মুখে জ্বালাভরা হাসি দেখা দেয়। ক্ষুধায় পেটটা বড় বেশি জ্বলিতেছিল বলিয়াই বোধ হয় ক্ষোভটাও তার বেশি হয়। বাড়ির সকলে অনেকবার খবর নিয়া গিয়াছে, দুধ আনিয়া খাইতে সাধিয়াছে, সুকুমারী খায় নাই। পলটু বসিয়া বসিয়া গল্প করিয়া গিয়াছে নটা পর্যন্ত। একা হওয়ামাত্র ক্ষোভটা যেন একলাফে মাথায় চড়িয়া গিয়াছে।

    আর কী সুকুমারীর জানিতে বাকি আছে, এতকাল তাকে ভালবাসার মধ্যে এত বৈচিত্র্য নিবারণ কী করিয়া আনিয়াছে? আর সব সে যেমন জানে বলিয়া করে, ভালবাসিবার নিয়ম-কানুনও জানে বলিয়া মানিয়া চলে! পলটুর মতো অবস্থায় মেয়েদের অরুচি হয় জানে বলিয়া সে যেমন বিশেষ বিশেষ খাবার জিনিস আনিয়া দিয়াছে, ওর মধ্যে দয়া-মায়া স্নেহ-মমতার প্রশ্ন কিছু নাই, স্ত্রীর সঙ্গে কী করিয়া ভাব করিতে, স্ত্রীকে কী করিয়া আদরযত্ন করিতে হয় তাও তেমনই জানে বলিয়াই তার সঙ্গে এমনভাবে ভাব করিয়াছে, তাকে এত আদরযত্ন করিয়াছে নয়তো নিবারণের মতো মানুষের কাছে ওরকম রোমাঞ্চকর মধুর কথা ও ব্যবহার কে কল্পনা করিতে পারে, প্রতিদিন রাত্রে ঘরে আসিবার পর এতকাল তার যা জুটিয়াছে?

    নিজের মনের জানাজানি প্রক্রিয়াকে সেও যে নিবারণের চেয়ে অনেক বেশি খাপছাড়াভাবে উদ্‌ভ্রান্ত করিয়া দিতেছে এটা অবশ্য তার খেলায় হয় না, বেশ জোরের সঙ্গেই অনেক কিছু জানিয়া চলিতে থাকে। একবারে নিঃসন্দেহে হইয়া মানে, রাত্রে নিবারণকে একেবারে নতুন মানুষ মনে হইত কেন, তার কারণটা। বাপের বাড়িতে যে রাত্রিগুলো নিঃসঙ্গ কাটিয়াছে সেগুলো ছাড়া প্রত্যেকটি রাত্রি আজ দুপুরেও তার কাছে রোমাঞ্চ ও শিহরনে ভরা ছিল, এখন সব ভোঁতা হইয়া গিয়াছে। সব ফাঁকি নিবারণের, শুধু নিয়ম পালন।

    আজ একটু রাগ হইয়াছে তাই নিয়মমাফিক স্ত্রীকে স্নেহ করিবার ইচ্ছাটাও উবিয়া গিয়াছে। পরমেশের উপর রাগটা চলিয়া গেল দু-চার মিনিটের মধ্যেই, কিন্তু অসুস্থা উপবাসী বউকে আর ক্ষমা করিতে পারিল না। কী করিয়া করিবে? যেখানে দরদ আন্তরিক নয়, সেখানে সুবিচারের প্রেরণা আসিবে কোথা হইতে?

    বিবাহের আগে এরকম বিশ্লেষণের ক্ষমতা সুকুমারীর ছিল না, কোনো মানুষের মাথার মধ্যে যে নিজের পছন্দমতো সিদ্ধান্ত দাঁড় করানোর জন্য দৈনন্দিন জীবনের রাশি রাশি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আবর্জনা হইতে যুক্তিরূপী প্রয়োজনীয় টুকরাগুলোকে শুধু বাছিয়া নেওয়ার এমন একটা প্রক্রিয়া চলিতে পারে এ কথা কল্পনা করার ক্ষমতাও ছিল না। এখন সে যেন খানিক খানিক বুঝিতে পারে, এ ধরনের চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া তার পক্ষে ঠিক উচিত হইতেছে না, এসব ছেলেমানুষি কল্পনামাত্র, এরকম জ্বালাভরা দুঃখ ভোগ করার কোনো কারণ ঘটে নাই। তবু অন্ধকার ঘটে ছটফট করিতে করিতে না ভাবিয়া সে পারে না যে, হায়, যে স্বামী উঠিতে বসিতে চলিতে-ফিরিতে বলে এই করা উচিত আর ওই করা উচিত নয়, যে ক্রিম মাখিতে দেয় না, অকারণে উপোস করাইয়া রাখে আর একরকম বিনা দোষে রাগ করিয়া বাড়ি ফিরিতে দেরি করে, তার সঙ্গে জীবন কাটাইবে কী করিয়া?

    দশটার পরে অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়া নিবারণ আলো জ্বালে। সুকুমারী চোখ বুজিয়া ঘুমের ভান করিয়া পড়িয়া থাকে আর চোখের পাতা একটু ফাঁক করিয়া চুপিচুপি নিবারণ কী করে দেখিবার চেষ্টা করিয়া রামধনুর রঙ দেখিয়া বসে। চোখে একটু জল জমিয়াছে। চোখ মেলিয়া হয়তো সব স্পষ্ট দেখা যাইবে, চোখের পাতা একটুখানি ফাঁক করিয়া কিছু দেখা সম্ভব নয়,— অন্তত চোখ না মুছিয়া।

    জামাকাপড় ছাড়িয়া নিবারণ মুখহাত ধুইতে বাহির হইয়া যায়। সুকুমারী তাড়াতাড়ি চোখ দুটি মুছিয়া ফেলে বটে, কিন্তু এবার আরো বেশি জল আসিয়া পড়ে। জানে জানে, নিবারণের মতো সব না জানুক, এটুকু সে জানে যে নিবারণ আর কোনো দিন তার সঙ্গে ভালো করিয়া কথা বলিবে না।

    নিবারণ ঘরে ফিরিয়া আসে। খানিকক্ষণ তার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। তারপর প্রায় কানের কাছে অতি মৃদুস্বরে তার প্রশ্ন শুনিতে পায়, কাঁদছ কেন?

    সুকুমারীর সর্বাঙ্গ শিহরিয়া ওঠে, এক মুহূর্তে তার এতক্ষণের সমস্ত জানা যেন বাতিল হইয়া যায়। চোখে একটু জল দেখিবামাত্র রাগ কমিয়া গিয়াছে! দাদাকে পরামর্শ দিয়া অপমান করানোর মতো অমার্জনীয় অপরাধের জন্য যে রাগ হইয়াছিল। এমন গভীর মায়া তার জন্য তার স্বামীর, আর সে এতক্ষণ সন্দেহ করিয়া মরিতেছিল কিছুই তার আন্তরিক নয়!

    চোখের পলকে উঠিয়া সুকুমারী নিবারণের পা চাপিয়া ধরে।—আমায় মাপ কর আমি বড্ড অন্যায় করেছি।

    নিবারণ অবশ্য তখন তাকে বুকে তুলিয়া নেয়।—তোমার জ্বর তো বেড়েছে দেখছি।

    জ্বর বেড়েছে? গা গরম হয়েছে আমার?

    বেশ গরম হয়েছে। দাঁড়াও, একবার থার্মোমিটার দিয়ে দেখি।

    থার্মোমিটারে দেখা যায়, সত্যই সুকুমারীর জ্বর হইয়াছে, প্রায় একশর কাছাকাছি। থার্মোমিটারটি রাখিয়া আসিয়া নিবারণ সুকুমারীর গায়ে আদর করিয়া হাত বুলাইয়া দেয়। সুকুমারী আরামে চোখ বোজে।

    নিবারণ বলে, আমার সত্যি রাগ হয়েছিল। রাগ করে থাকতে পারলাম না কেন জান?

    সুকুমারী নীরবে মাথাটা একটু কাত করে। মনে মনে বলে, জানি, আমায় ভালবাস বলে।

    আবার প্রায় কানের সঙ্গে মুখ লাগাইয়া অতি মৃদুস্বরে নিবারণ বলে, আজ জানতে পারলাম কিনা তোমার খোকা হবে, জানা মাত্র সব রাগ কেমন জল হয়ে গেল।

    ধীরে ধীরে চোখ মেলিয়া সুকুমারী বিস্ফারিত চোখে স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকে, জানা মাত্র সব রাগ জল হয়ে গেল! এই তবে নিবারণের ক্ষমা করিবার কারণ। যে খোকার মা হইবে তার গুরুতর অপরাধও ক্ষমা করিতে হয়! গায়ের চামড়া বড় চড়চড় করিতে থাকে সুকুমারীর, যেখানে যেখানে নিবারণের হাত বুলানোয় এতক্ষণ আরামের সীমা ছিল না। পেটটা জ্বালা করিতে থাকে। মুখটা তিতো লাগে। মাথাটা ঘুরিতে থাকে।

    হঠাৎ সে করে কী, নিবারণকে দু হাতে ঠেলিয়া দিয়া ছুটিয়া খোলা ছাদে চলিয়া যায়। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় মিস্ত্রিরা ঘরের যে গাঁথনি আরম্ভ করিয়াছিল অস্পষ্ট হইলেও দেখা যাইতেছিল। তবু সেই হাতখানেক উঁচু গাঁথনিতে হোঁচট খাইয়া সুকুমারী দড়াম করিয়া পড়িয়া যায়।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্রৌঢ়ের বউ
    Next Article অন্ধের বউ

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী ছোটগল্প

    আসল বেনারসী ল্যাংড়া

    April 5, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    জুয়াড়ির বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    অন্ধের বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    প্রৌঢ়ের বউ

    March 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.