Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহযাত্রী

    উপন্যাস সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প11 Mins Read0

    সহযাত্রী

    বাথরুম থেকে ফিরে এসে কমলিকা চোখ বড়-বড় করে বলল, জানো, একটা লোক বসে আছে, হাতে হ্যান্ডকাফ…পাশেদুজন পুলিশ…লোকটার চোখ দুটো দেখলেই ভয় করে…

    ট্রেনটা ব্রিজের ওপর দিয়ে যাচ্ছে বলে ঝমঝম শব্দ হচ্ছে, সুমিত্রা ভালো করে শুনতে পেল না মেয়ের কথা। জানলা থেকে মাথাটা সরিয়ে এনে জিগ্যেস করল, কী বললি?

    কমলিকার মুখখানা এমনিতেই দেখলে মনে হয় বিস্ময় মাখানো। এখন ভুরু দুটো কপালের ওপর অনেকখানি তোলা। সে বলল, একটা ডাকাত!

    ওপরের বাঙ্কে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে মনোজিৎ, বুকের ওপর একটা মোটা গোয়েন্দা বই, সারাদিনে সে প্রায় অর্ধেকটা পড়ে ফেলেছে, বই থেকে চোখ সরিয়ে সে একবার মেয়ের দিকে তাকাল। কমলিকা বানিয়ে-বানিয়ে কথা বলতে ওস্তাদ। এই গল্পটি নিশ্চয়ই তার ছোটভাইয়ের জন্য।

    বাবুনও একটা কমিকস পড়ছিল। সে সঙ্গে-সঙ্গে বলল, ডাকাত? কোথায়? কোথায়?

    বাবুন নেমে পড়েছে। মনোজিৎ সুমিত্রার চোখে চোখ ফেলে বলল, উঁহু, ওকে যেতে দিও না।

    বাবুন অতি দুরন্ত। সে যাওয়ার পথে চলন্ত ট্রেনের দরজা খুলে ফেলেছিল। তাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতে হয়।

    তাদের পাশে বসাদু-তিনজন লোক ঝিমোচ্ছে। কয়েকজন এমনিই চোখ চেয়ে বসে আছে, বইও পড়ছে না, কিছু না। তারা কেউ কমলিকার কথা শুনে কোনওরকম চাঞ্চল্য দেখাল না।

    বাবুন যাবেই, সুমিত্রা তার হাত চেপে ধরেছে।

    কমলিকা বলল, মা, আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আয় বাবুন!

    একটু বাদেই বাবুন ফিরে এসে বলল, মা দেখবে এসো, দেখবে এসো! একটা সত্যি-সত্যি ডাকাত, লাল-লাল চোখ, অ্যাত্ত বড়-বড় চুল!

    ছেলেমেয়েরা সুমিত্রাকে প্রায়ই ঠকায়। এখন বোধ হয় ভাই-বোন যেন একসঙ্গে যুক্তি করেছে। সে বলল, যাঃ!

    বাবুন মায়ের হাত ধরে টানাটানি করল, তবু সুমিত্রা গেল না। বাবুন ফিরে গেল আবার।

    পরের স্টেশন এসে পড়তেই ওপর থেকে মনোজিৎ বলল, ওরা গেল কোথায়, ওদের ডাকো?

    মনোজিৎ কর্মব্যস্ত লোক, সারাবছর তাকে অফিসের কাজে প্রচণ্ড খাটতে হয়। কিন্তু যখন সে সপরিবারে বেড়াতে বেরোয়, তখন সে একেবারে আলস্যের চূড়ান্ত করে নেয়। সারাদিন শুয়ে শুয়ে গল্পের বই নিয়ে কাটায়। এমনকি ট্রেন জার্নির সময় কোনও স্টেশন থেকে ওয়াটার বটলে জল ভরতে হলেও সে স্ত্রীকে বলে, যাও না, নিয়ে এসো। আজকাল মেয়েরা তো সবকিছুই পারে!

    সুমিত্রাকে যেতে হল না। বাবুন আর কমলিকা তক্ষুনি ফিরে এল। দুজনেই খুব উত্তেজিত। ওদের কথা শুনে এখন বোঝা যাচ্ছে, ব্যাপারটা বানানো নয়। মাঝখানের কোন স্টেশন থেকে পুলিস একজন কয়েদিকে নিয়ে ট্রেনে উঠেছে। লোকটি নিশ্চয়ই কোন বিপজ্জনক আসামি, কেন না। পুলিশরা মাঝে-মাঝে চড় মারছে তাকে। লোকটা দাঁত কিড়মিড় করছে রাগে। তাগড়া চেহারা।

    ওরা কখনও জ্যান্ত ডাকাত দেখেনি, তাই দারুণ রোমাঞ্চিত। বাবুন বেশ জোরে-জোরে সব কথা বলতে শুরু করায় তার বাপ ওখান থেকে একবার বলল, আস্তে, বাবুন, আস্তে!

    একটু বাদে সুমিত্রা কমলিকাকে বলল, এই, দেখিস যেন বাবুন কোথাও যায় না। আমি আসছি বাথরুম থেকে। …বাথরুম যাওয়াটা একটা অছিলা। সুমিত্রাও আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছে না।

    দরজার কাছেই, দুটো বাথরুমের মাঝখানের জায়গাটায় বসে আছে ওরা। দুজন পুলিশের মাঝখানে একজন লোক। হাতে তো হ্যাণ্ডকাফ আছে বটেই, পায়েও দড়ি বাঁধা। মুখটা নীচু করে

    আছে, তাই সুমিত্রা মুখ দেখতে পেল না ভালো করে। গায়ের জামাটা ছেড়া, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, কপালের একপাশে খুব সম্ভবত রক্তের দাগ।

    কন্ডাক্টর গার্ডের চেয়ারটিতে বসে আছে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। শুধু কনস্টেবল নয়, সঙ্গে অফিসারও আছে। তার মানে বেশ বড় ধরনের আসামি।

    সুমিত্রার খুব ইচ্ছে করল, ইন্সেপেক্টরটিকে জিগ্যেস করে। পুলিশ আর আসামি দেখলেই ঘটনাটা জানতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় সুমিত্রা আর কিছু বলতে পারল না।

    নিজেদের কিউবিকলে ফিরে এসে সুমিত্রা তার স্বামীর উদ্দেশ্যে বলল, জানো, সত্যি পুলিশরা হাত-পা বেঁধে একটা লোককে নিয়ে যাচ্ছে। এরকম প্রকাশ্যে প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্টে নিয়ে যায়?

    বই থেকে চোখ না সরিয়ে মনোজিৎ বলল, হু!

    কার্লোস নামে এক আন্তর্জাতিক ভয়াবহ দস্যুর কীর্তি-কাহিনি পড়ায় এমনই নিমগ্ন সে যে বাস্তব ডাকাত সম্পর্কে তার কোনও আগ্রহই নেই।

    সুমিত্রার পাশে বসা দুজন লোক এবার উঠে গেল।

    কমলিকা আর বাবুনও ছুটে গেল আবার।

    প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে কমলিকা ফিরে এসে বলল, মা, জানো, লোকটা বাঙালি! পানি না বলে জল চাইল!

    সুমিত্রা ব্যস্ত হয়ে বলল, তুই বাবুনকে একলা রেখে এলি!

    সুমিত্রার ঠিক পাশেই যে লম্বা, রোগামতন লোকটি বসেছিল এতক্ষণ, সে-ও বাঙালি। তাকে পছন্দ হয়নি সুমিত্রার। সে কমলিকার দিকে বারবার বিশ্রীভাবে তাকাচ্ছিল। পনেরোয় পা দিয়েছে কমলিকা, এই বয়েসের মেয়েদের নিয়ে সবসময় সাবধানে থাকতে হয়। বয়েসের তুলনায় কমলিকা এখনও বেশ ছেলেমানুষ রয়ে গেছে।

    লম্বা লোকটা দু-একবার ভাব জমাবার চেষ্টা করেছিল, সুমিত্রা পাত্তা দেয়নি। লোকটিকে দেখলে কোনও কোম্পানির সেলসম্যান বলে মনে হয়।

    সেই লম্বা লোকটাই আগে ফিরে এল। সোজা সুমিত্রার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব পরিচিতের মতন ভঙ্গিতে বলল, ও লোকটা তো অর্ধেন্দু দাশগুপ্ত। সেই বঙ্কা! ব্যাটা ধরা পড়েছে এতদিনে!

    সুমিত্রার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। নামটা খুব চেনা লাগছে। কে অর্ধেন্দুদাশগুপ্ত? কী করেছিল সে? নামটা কার মুখে শুনেছে?

    সুমিত্রা আবার চোখ তুলতেই দেখল লম্বা লোকটি সোজা তার দিকে চেয়ে আছে। কোনও দ্বিধা নেই। সে যেন ধরেই নিয়েছে যে সুমিত্রা এখন আর তার সঙ্গে কথা বলতে আপত্তি করবে না!

    আমি দেখেই চিনেছি, কাগজে দু-তিনবার ছবি বেরিয়েছিল। ইন্সপেক্টরটা ওখানে বসে আছে, সে তো লালবাজার থেকে এসেছে, তাকে জিগ্যেস করলুম—

    সুমিত্রা জিগ্যেস না করে পারল না, কে অর্ধেন্দু দাশগুপ্ত?

    কাগজে পড়েননি, গত মাসে, না-না, তার আগের মাসে প্রত্যেক দিনই তো বেরুত…শর্মিলা মার্ডার কেস!

    সঙ্গে-সঙ্গে সব মনে পড়ে গেল। ফুলের মতন সুন্দর মেয়ে শর্মিলা, লেখা-পড়াতেও খুব ভালো। ছিল, মাধ্যমিক-এর রেজাল্ট আনতে গিয়েছিল স্কুলে, তারপর আর ফেরেনি। তার এক সহপাঠিনী জানিয়েছিল যে শর্মিলার দাদার বন্ধুর পরিচয় দিয়ে একজন যুবকশর্মিলাকে একটুখানি দূরে। ডেকে নিয়ে যায়। তারপর একটা ট্যাক্সি হঠাৎ ওদের কাছে এসে থামে। কেউ কিছু বুঝবার আগেই কয়েকজন ট্যাক্সি থেকে নেমে শর্মিলাকে আর তার সেই দাদার বন্ধুকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে যায়। এরপর চার-পাঁচদিন পুলিশ সারাদেশ তোলপাড় করে ফেলে শর্মিলাকে খুঁজে বার। করবার জন্য। শর্মিলার বাবা একজন নামকরা ডাক্তার, মা সমাজসেবিকা। প্রত্যেকদিন খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় শর্মিলার ছবি, তার মা-বাবার ছবি, পাড়া-প্রতিবেশীর জবানবন্দি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত শর্মিলাকে উদ্ধার করতে দেরি হওয়ার জন্য পুলিশকে ভৎসনা দিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন। দশদিন বাদে শর্মিলার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল আসানসোলে এক পরিত্যক্ত কয়লাখনির কাছে।

    জীবিত শর্মিলাকে খুঁজে বার করতে ব্যর্থ হলেও পুলিশ এরপর কয়েকদিনের মধ্যেই চটপট গ্রেফতার করল তিনজনকে। তাদের মধ্যে একজন স্বীকার করে ফেলল সব অপরাধ। চার বন্ধু মিলে অসৎ উদ্দেশ্যে অপহরণ করেছিল শর্মিলাকে। পুরুলিয়ার এক বাগানবাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিল কয়েকদিন। প্রায় সবসময় মুখ বেঁধে রাখত শর্মিলার। ওরা সবাই মিলে যতরকমভাবে অত্যাচার করেছিল শর্মিলার ওপরে তার গরগরে বিবরণ বেরিয়েছিল সব সংবাদপত্রে। আসামি তিনজনের নাম পন্টু, পরেশ আর গজা। তারা তিনজনেই বলেছিল যে তাদের সর্দারের নাম। অর্ধেন্দু। ওদের কারুরই ইচ্ছে ছিল না শর্মিলাকে খুন করার, সে কাজটা অর্ধেন্দু ওরফে বঙ্কা একাই করেছে।

    অর্ধেন্দুকে ধরতে পারেনি পুলিস, কিন্তু তার একটা ছবি জোগাড় করে ছাপিয়ে দিয়েছিল কাগজে। সেই সময় অর্ধেন্দুর নাম ঘুরত সবার মুখে-মুখে। সুমিত্রা নিজেই তো কতবার বলেছে, ওই অর্ধেন্দুটাকে ধরতে পারলে ময়দানে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে প্রকাশ্যে ওর গা চিরে-চিরে নুন ছিটিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত!

    মাত্র দু-মাস আগের ঘটনা, অথচ সেই নামটা শুনে প্রথমে চিনতেই পারেনি সুমিত্রা।

    শর্মিলা মেয়েটা তো ছিল প্রায় কমলিকারই বয়েসি। কোনও দোষ করেনি মেয়েটি, তবু বীভৎস ভাবে তার জীবনটা শেষ হয়ে গেল কয়েকটা নরপশুর জন্য। শর্মিলা নয়, কমলিকার জন্যই বেশি চিন্তা হচ্ছিল সুমিত্রার। মেয়ে বড় হচ্ছে। দু-দিন বাদে সে স্কুল ছেড়ে কলেজে যাবে, একা-একাই চলাফেরা করতে হবে তাকে, যদি হঠাৎ এরকম কিছু হয়ে যায়?

    সেই সময় মনোজিৎকে এই আশঙ্কাটা প্রকাশ করায় মনোজিৎ হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। ওরকম একটা-আধটা ঘটনা নিয়ে কাগজগুলো ঢাক পেটায় তাই সুমিত্রার মতন মায়েরা ভয়ে কাঁপে। ইওরোপ-আমেরিকাতে কত বেশি ভায়োলেন্স হয়। ওসব ভাবতে গেলে বাঁচাই যাবে না!

    লম্বা লোকটা বলল, হাওড়া স্টেশনে নামবার পর, লোকে যদি বঙ্কাকে চিনতে পারে, বুঝলেন, ওকে একেবারে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলবে! পুলিশ কিছুতেই আটকাতে পারবে না!

    সুমিত্রা ব্যাকুলভাবে বলল, প্লিজ…বাচ্চাদের সামনে…আমার ছেলেমেয়েদের সামনে এসব কিছু বলবেন না। ওরা জানে না…জানবার দরকারও নেই।

    বাবুনের বয়েস এগারো, এখন সে শুধু খবরের কাগজে খেলার খবরটা উলটে দেখে নেয়। কমলিকাও এখনও পর্যন্ত খবরের কাগজ পড়ার অভ্যেস করেনি। মাঝে-মাঝে সিনেমার পাতাটা দেখে। সুমিত্রাই মাঝে-মাঝে বলেছে, এত বড় হলি, এখনও খবরের কাগজ পড়তে শিখলি না?

    মনোজিৎ তা শুনে বলেছে, না শিখলেই বা ক্ষতি কী? খবরের কাগজ পড়া একটা বাজে নেশা। ছাড়া তো আর কিছু না!

    শর্মিলা হত্যা-কাহিনি অবশ্য কমলিকা জানে। সব বাড়িতে তখন ওই নিয়ে আলোচনা হত। কিন্তু অর্ধেন্দু দাশগুপ্তর নাম কি আর মনে আছে?

    লম্বা লোকটা এবার আপন মনেই বলল, পুলিশকে কেউ বিশ্বাস করে না! ওরাই বা কী করবে? কোনও পার্টির দাদা ফোন করে বলবে, ও আমার লোক, ওকে ছেড়ে দাও, ব্যস! অমনি ছাড়া পেয়ে যাবে। এই জন্যই তো পাবলিক আজকাল চোর-ডাকাত ধরতে পারলেই পেঁদিয়ে শেষ করে দেয়!

    ধপাস করে একটা বই পড়ল ওপর থেকে।

    মনোজিৎ মাঝে-মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে, হাত থেকে বই খসে যায়। সুমিত্রা বইটা তুলে দিতে যেতেই মনোজিৎ বলল, দাঁড়াও, আমি নামছি।

    সুমিত্রা খুব আলাপি নয়। অথচ সে একজন সহযাত্রীর সঙ্গে গল্প চালিয়ে যাচ্ছে দেখে মনোজিৎ একটু কৌতূহলী হয়েছে। সে এসে সুমিত্রার পাশে বসে লম্বা লোকটির চোখে চোখ ফেলে জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার?

    লম্বা লোকটি বলল, ওই বঙ্কার কথা বলছিলাম। ব্যাটা আমাদের সঙ্গে একই কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছে।

    মনোজিৎ ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, বঙ্কা কে? সুমিত্রা বলল, তোমার মনে আছে? শর্মিলা নামে একটা মেয়েকে…মাস দু-এক আগে…

    মনোজিৎ চট করে ধরে ফেলল ব্যাপারটা। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। ওই বিষয়ে কোনওরকম আলোচনায় না গিয়ে সে বলল, বাবুন আর মামুন কোথায়?

    সুমিত্রা বলল, আমি ডেকে আনছি।

    মনোজিৎ লম্বা লোকটির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, আপনি কলকাতায় থাকেন? কোন লাইনে আছেন, বিজনেস না চাকরি?

    সুমিত্রার অনুমানই ঠিক। লোকটি একটি বেবি ফুড কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ। নাম সৌরীন সরকার।

    দু-চারটি কথা বলেই মনোজিৎ বুঝে নিল লোকটির চাকরির ওজন কতখানি। মনোজিতের তুলনায় বেশ কম। কোম্পানিটাও সুবিধের নয়। সুতরাং মনোজিৎ খানিকটা ভারিক্কি চালে বলল, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বেবি ফুড ব্যানড হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। আমাদের দেশেও বেবি-ফুডের বিশেষ ভবিষ্যৎ নেই। অবশ্য আপনার সেলস-এর অভিজ্ঞতা অন্য যে-কোনও কোম্পানিতেই কাজে লেগে যাবে।

    দাদা, আপনি কোথায় আছেন?

    মনোজিৎ সে-কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট করছি। আমার ছেলেমেয়ের সামনে ওইসব খুন-জখমের কথা একদম ভুলবেন না। বেঁচে থাকলে ওদের অনেক কিছুই দেখতে হবে ঠিকই, কিন্তু ছেলেবেলাটা যতদূর সম্ভব নিষ্পাপ রাখা যায়—

    পকেট থেকে পার্সবার করে, তার থেকে আবার একটা কার্ড বার করল মনোজিৎ। সেটা তুলে দিল লোকটির হাতে। অর্থাৎ নিজের পরিচয় সে মুখে জানাতে চায় না।

    সৌরীন সরকার বেশ ভক্তিভরে কার্ডখানা দেখছে, মনোজিৎ খানিকটা কৈফিয়তের সুরে বলল, আমি ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া পাই, কিন্তু ফ্যামিলি নিয়ে ট্রাভল করার সময় আমি সেকেন্ড ক্লাস স্লিপারই পছন্দ করি। অনেক খোলামেলা থাকা যায়।

    সুমিত্রা ছেলেমেয়েকে নিয়ে ফিরে এল। কমলিকা মায়ের কাছে ধমক খেয়ে চুপ করে গেছে, কিন্তু বাবুন এখনও ছটফট করছে, সে এখানে আসতে চায় না। বাথরুমের পাশে অনেক কিছু ঘটছে।

    মনোজিৎ একটু কড়া গলায় বলল, বাবুন, চুপ করে বসো!

    বাবুন বলল, মামুন, জানো, ডাকাতটা কাঁদছিল!

    বাবুনের গলার আওয়াজে এমন এক বিস্ময় ফুটে উঠল, যেরকম বিস্ময়বোধ শুধু শিশুদেরই সম্ভব। যত কমিক্স আর গল্পের বই সে পড়েছে, তাতে ডাকাতদের একটা ছবি তার মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গেছে, সেই ডাকাতদের চোখে জল থাকবার কথা নয়।

    মনোজিৎ জিগ্যেস করল, বাবুন, খিদে পায়নি? সামনের জংশনেই আমাদের খাবার দেবে।

    বাবুন তবু জিগ্যেস করল, ডাকাতটা কাঁদছে কেন, বাবা?

    মনোজিৎ আর এড়িয়ে যেতে পারল না, বাবুনের মাথায় হাত দিয়ে বলল, অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হয়। ডাকাতরা তো খুব খারাপ কাজ করে, তাই পুলিশ ওদের মারে!

    বাবুন বলল, না, পুলিস এখন মারছেনা! লোকটা এমনি কাঁদছে! এইরকম, দ্যাখো, ঠিক এইরকম, হাঁটুতে মুখটা গুঁজে, ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে!

    সুমিত্রা মুখখানা কঠোর করে আছে। ছেলে-মেয়েদের আনতে গিয়ে সে-ও দেখেছে বঙ্কার কান্না। তার একটুও মায়া-দয়া হয়নি। ওটা কি একটা মানুষ না নরপিশাচ! ওর মতন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাই অন্যায়। শর্মিলার মতন একটি মেয়েকে…শর্মিলার মুখটা যতই ভাবতে যাচ্ছে, সেটা। কমলিকার মুখ হয়ে যাচ্ছে! তাতেই আরও শিউরে উঠছে সুমিত্রা। এই পৃথিবীর হিংস্রতা সম্পর্কে কোনও জ্ঞানই হয়নি কমলিকার, সে যে একটা মেয়ে এই বোধটাই তার সবসময় থাকে না, সেই কমলিকাকে যদি কোনওদিন ওইরকম কয়েকটা ছেলে…।

    মনোজিৎ বাবুনকে অন্য গল্পে ফেরাবার চেষ্টা করে যেতে লাগল প্রাণপণে। কমলিকা গুম হয়ে বসে আছে। অন্য সময় ওরা জানলা দিয়ে বাইরের কত দৃশ্য দেখে, সেদিকে ওদের এখন মনই নেই।

    পরের স্টেশনে থামতেই খাবার দিয়ে গেল। কোলের ওপর প্লেট রেখে খেতে গেলে বাবুন মাটিতে ভাত ছড়াবেই। তাকে অনবরত সামলাতে লাগল সুমিত্রা। কমলিকা আর-এক কাণ্ড করে বসল, শেষদিকে তার প্লেটটাই উলটে গেল, ঝোল লেগে গেল ফ্রকে। এক্ষুনি ধুয়ে ফেলা দরকার।

    কমলিকা উঠে দাঁড়াতেই সুমিত্রা বলল, ডানদিকের বাথরুমে যাবি। ওদিকটা ফাঁকা আছে।

    বাবুনকে উঠতেই দেওয়া হল না। কেটারাররা বোতলে যে জল দিয়ে গেছে তা দিয়ে ধুইয়ে দেওয়া হল ওর হাত মুখ।

    মনোজিৎ বলল, এবার বাবুনের বিছানা করে দাও, ও শুয়ে পড়বে!

    কমলিকা ফিরে এল একটু পরে। তার মুখখানা অসম্ভব বিবর্ণ।

    কী হয়েছে, মামুন?

    মা, লোকটা জল খেতে চেয়েছিল।

    তুই এদিকের বাথরুমে গিয়েছিলি? তোকে বললুম যে…

    ডানদিকের দুটো বাথরুমই বন্ধ ছিল যে!

    ওদিকে খবর্দার আর যাবি না।

    মা, লোকটা জল খেতে চাইছিল।

    সে পুলিশের লোক বুঝবে। তার মাথা ঘামাবার দরকার নেই।

    পুলিশরা ওকে বাথরুম থেকে জল এনে দিল। ও সেই জল খাবে না!

    কমলিকা কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, মা, আমাদের ফ্লাস্কে জল আছে, একটু দিয়ে আসব?

    সুমিত্রা মেয়ের দিকে তাকাল। কয়েক পলক, তবু তার মধ্যে যেন কেটে গেল অনন্ত সময়। কমলিকা কি জানে ওই লোকটা সত্যিকারের কে? শর্মিলার ঘটনা ওর মনে আছে? কমলিকা কী ভাবছে? একজন মানুষ জল খেতে চেয়েছে, তাকে ও জল দিতে চায়…কমলিকা এখনও এই

    পৃথিবীর মানুষদের চেনে না…

    সুমিত্রা স্বামীর দিকে তাকাল। নিঃশব্দে একটু ঘাড় নাড়ল মনোজিৎ।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমিত্রা বলল, যা দিয়ে আয়!

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসমান্তরাল
    Next Article সাঁকো

    Related Articles

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }