Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    October 27, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩.১৫ সপ্তম হীরক কন্যার কাহিনী

    সপ্তম হীরক কন্যার কাহিনী

    শাহরাজাদ বলে, খুব বড় গল্প আরম্ভ করার আগে একটা ছোট কাহিনী শুনুন জাঁহাপনা।

    সে বলতে শুরু করে :

    কোন এক সময়ে বসরাহর এক দরাজ-দিলো উদার স্বভাবের এক সুলতান বাস করতেন। তার নাম সুলতান জাইন। বয়সে সে নবীন নওজোয়ান। স্বভাবতই সমবয়সী ইয়ার বন্ধু এবং স্তাবকের অভাব ছিলো না।

    অন্যের দুঃখ কষ্ট দেখলে তিনি সইতে পারতেন না। কারণে অকারণে অকাতরে মুক্তহস্তে দানধ্যান করতেন। তার মত সদাশয় বন্ধুবৎসল মহৎ উদার সুলতান খুব কমই দেখা যেত।

    এত সব সদগুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি বড্ড বেপরোয়া এবং কিছু খামখেয়ালীও ছিলেন। তার বন্ধুবান্ধব এবং আপনজনেরা এর সুযোগ নিতে কসুর করতো না। নানা ছল ছুতোয় তারা এসে হাত পাততে। এবং সুলতানের সামনে কেউ হাত পেতে ব্যর্থ-মনোরথে হয়ে ফিরে যায় না, সে কথাও তারা খুব ভালো করেই জানতো।

    এইভাবে তারা একদিন সুলতানের সঞ্চিত ধনভাণ্ডার শূন্য করে ফেললো। ইয়ার বন্ধুরা নিত্য নতুন বাঁদী মেয়েমানুষের সন্ধান আনতে লাগলো, আর সুলতান তাদের পিছনে লক্ষ লক্ষ দিনার ওড়াতে থাকলো। এভাবে চলতে থাকলে কুবেরের ভাড়ারও একদিন নিঃশেষ হতে পারে, জাইন তো কোন ছার। বসরাহর একটা ছোট অঞ্চলের সুবাদার মাত্র। বাৎসরিক আয়ের একটা মোটা অঙ্ক ফি বছর বাগদাদে খলিফার কাছে নজরানা পাঠাতে হয় তাকে।

    একদিন উজির এসে কুর্নিশ করে বললো, জাঁহাপনা, বড়ই দুঃসংবাদ, কোষাগারে কোনও অর্থ নাই। এমন সঙ্কট অবস্থা কখনও ঘটেনি। কাল কী হবে, তার কোনও সংস্থান নাই। এখন কী উপায় হবে জাঁহাপনা?

    সুলতান জাইন ভাবিত হলেন। তাই তো, তারই খামখেয়ালীর জন্য সব ধন নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন প্রাসাদ দরবারের কর্মচারীদের বেতন এবং আহারাদির সংস্থান হবে কী করে?

    ভেবে কোন কূলকিনারা পান না তিনি। এখন মৃত্যু ছাড়া আর সম্মানজনক কোনও পথই খোলা নাই। তার হারেমের সব প্রিয় বাঁদীদেরই বিদায় করে দিতে হবে। বিদায় দিতে হবে খোজা নফর চাকর সবাইকে। শূন্য প্রাসাদে একা একা বসে কী সে হাহাকার করে মরবে? না ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে পথে নামবে?

    প্রবাদ আছে–দারিদ্র্যের চেয়ে কবর অনেক শ্রেয়।

    এই কথা স্মরণ করে সন্ধ্যার অন্ধকারে ছদ্মবেশ ধারণ করে পথে বেরিয়ে পড়েন। হঠাৎ খেয়াল হয়, বাবা মৃত্যুর পূর্বে কিছু উপদেশবাণী রেখে ছিলেন তার জন্য। কিন্তু কী সেই উপদেশ? কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর মনে করতে পারেন তিনি।

    বৃদ্ধ পিতা সন্তানের প্রতি উপদেশ রেখে গিয়েছিলেন : যত সুখ-সম্ভোগ আর বিলাস-ব্যসনেই দিন কাটাতে থাক না কেন বাবা, সবার ওপর একটা কথা অন্তরে গেঁথে রাখবে। তাহলো সুদিন কারো চিরকাল থাকে না। সৌভাগ্যের একটা বিবর্তন ঘটতে পারে। এই কারণে আমি আমার মহাফেজখানায় এমন এক সম্পদ লুকিয়ে রেখে গেলাম, যা তোমার দুঃসময়ে সকল দুর্ভাগ্য ও দুঃখ কষ্টের লাঘব করতে পারবে।

    সুলতান জাইন বাবার এই উপদেশ বাণী এতদিন বিস্মৃত হয়েছিলেন। আজ এই মুহূর্তে সে-কথা মনে পড়ায় তিনি দ্রুত পায়ে প্রাসাদে ফিরে এসে মহাফেজখানায় প্রবেশ করলেন।

    চারপাশে থরে থরে সাজানো কত কলা-কথার পাণ্ডুলিপি, কত মূল্যবান উপদেশাবলীর মহামূল্য গ্রন্থরাজি। সব তন্নতন্ন করে খুঁজে পেতে দেখলেন তিনি। কিন্তু না, কোথাও একটুকরো সোনা রূপাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। শুধু কাগজের ওপরে কালির আঁচড়ে লেখা হাজার হাজার কাব্য, গাঁথা কিসসা কাহিনী; সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান কোরান প্রভৃতি। •

    এছাড়া আরও আছে কত মূল্যবান দলিল পাট্টা, কবুলিয়ৎ নানা খতিয়ান পর্চা রসিদ ইত্যাদি।

    সবই তিনি আঁতিপাঁতি করে খুঁজলেন। কিন্তু নাঃ, কোথাও কিছু হদিশ করতে পারলেন তবু কিন্তু হাল ছেড়ে দিলেন না সুলতান জাইন। তার বদ্ধমূল ধারণা, বাবা ভাবাবেগের মানুষ ছিলেন না। হঠাৎ খেয়ালের বশে কোনও বাজে কথা বলে যাননি। নিশ্চয়ই কোথাও কিছু রেখে গেছেন।

    প্রায় উন্মাদের মতো হাতড়াতে থাকেন। কিন্তু কোথাও কিছু দেখে উৎসাহিত হতে পারেন। হতাশায় খাঁ-খাঁ করে ওঠে মন।

    হঠাৎ তার চোখ পড়ে, একটা ছোট্ট বাক্স। তালাবন্ধ। এর মধ্যে আর তেমন কী ঐশ্বর্য আঁটতে পারে? তবু সে নেহাতই কৌতূহলের বশে কুলুপটা ভেঙ্গে ফেলে। বাক্সটার মধ্যে কোনও রত্নমণি কিছুই নাই। ছিলো একখণ্ড কাগজ মাত্র। সুলতান জাইন চিরকুটটা মেলে ধরেন। একখানা শাবল নিয়ে প্রাসাদের পশ্চিম প্রান্তে চলে যাও। সেখানে একখানা ছোট্ট নহবতখানা আছে। সেই নহবতখানার মেঝের ঠিক মাঝখানে একখানা বৃত্তাকার শ্বেত পাথর আছে। ঐ পাথরখানা তুলে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকবে। তারপর আল্লাহ ভরসা।

    জাইন কাগজখানা হাতে নিয়ে ভাবেন, এদ্বারা বাবা তাকে কী বোঝাতে চেয়েছেন? মনে হয়, তিনি প্রকারান্তরে উপদেশ দিয়েছেন, কঠোর পরিশ্রম কর। কোনও অভাব হবে না। ভিক্ষার চেয়ে মোট বওয়াও অনেক ভালো।

    যাই হোক, পিতৃ আদেশ শিরোধার্য। জাইন ভাবলেন, তিনি জায়গা মত শাবল চালিয়ে দেখবেন, কী হয়।

    ফুলবাগিচা থেকে একখানা সাবল নিয়ে নহবতখানায় প্রবেশ করেন সুলতান। ঘরের ঠিক মাঝখানে একখানা বৃত্তাকার শ্বেত পাথরও দেখতে পান তিনি।

    রাত্রি অবসান হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

    ছোট দুনিয়াজাদ গালিচা থেকে উঠে এসে বলে, তোমার গল্প বলার কী মিষ্টি কায়দা দিদি। শাহরাজাদ বলে, আগে যে সব কাহিনী শুনেছো এটা তার থেকে কিছু আলাদা, বোন। একটু ধৈর্য ধরে শোনো, তবেই বুঝতে পারবে।

     

    সাতশো একুশতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    নহবতখানা ছোট্ট ঘর। সব দরজা জানালা বহুকাল ধরে বন্ধ প্রায়ান্ধকার বলা যায়। একটা চিরাগবাতি নিয়ে আসেন জাইন।

    সাবলখানা দিয়ে চাড় দিতেই পাথরখানা উঠে আসে। তারপর মাটি। খানিকটা গর্ত খুঁড়তেই খং খং করে ফাপা আওয়াজ ওঠে।

    মাটি সরাতেই চোখে পড়ে, একখানা পাথরের চাই। অনেক কষ্ট করে পাথরখানা টেনে তুলতে চোখে পড়ে, একখানা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। আলো আর সাবলখানা হাতে নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকেন।

    নিচে নেমে যেতে চোখে পড়ে, একখানা সুন্দর প্রশস্ত কক্ষ। চারদিকের দেওয়াল চীনা স্ফটিক পাথরে নির্মিত। মাথার ওপরের ছাতটা নীল রঙের। নানা কারুকার্য করা। ঘরের একপাশে পর পর চারখানা লম্বা লম্বা টেবিল। সেই টেবিলে সাজানো দশটি সোনার জালা। তার গায়ে কী সব বিচিত্র কারুকার্য। চোখ জুড়িয়ে যায়।

    জাইন ভেবে পান না, জালাগুলোয় কী আছে। জালার আকৃতি না হলেও প্রকৃতি দেখে মনে হয়, ওগুলো দামী মদের পাত্র সব। তাই যদি হয় ক্ষতি কী? প্রাণ ভরে পান করা যাবে তো। এই, ভেবে তিনি কাছে এগিয়ে আসেন। একখানা টেবিলের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে একটা জালার ঢাকনা খুলে ফেলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, জালাটা সোনার গুঁড়োতে কানায় কানায় ভরা! জাইন হাত ঢুকিয়ে দেন জালার ভিতরে। সারা হাতটায় সোনার গুড়োয় মাখামাখি হয়ে যায়। এরপর আর একটা জালার ঢাকনা খুলে ফেলেন। সেটায় মোহর ভরা। এইভাবে তিনি প্রতিটি জালার মুখ খুলে ধরেন। প্রতিটিই হয় সোনার গুঁড়ো, নয় সোনার মোহরে পরিপূর্ণ।

    জাইন শিহরিত হয়ে ওঠেন। আনন্দে নেচে ওঠে তার সর্বাঙ্গ। মনের আনন্দে গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওঠেন। একটা জালা টেনে মাথায় তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু সোনার গুডোর খানিকটা তাঁর মাথায় ঘাড়ে পিঠে মুখে বুকে ছড়িয়ে পড়ে যায়। মুহূর্তে জাইনের সর্বাঙ্গ সোনার বর্ণ ধারণ করে।

    ঘরের পাশে এক মনোরম হামাম। সেই হামামের ফোয়ারায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি গোসল করে গায়ের স্বর্ণরেণু ধুয়ে ফেলেন। গোসল করতে করতে নিজের খেয়ালেই তিনি বলতে থাকেন, জাইন, তুমি তো ভিক্ষার পাত্র হাতে ধরতে গিয়েছিলে? এত ঐশ্বর্য নিয়ে এখন কী করবে?

    জাইন ভাবেন, প্রাণ খুলে মানুষকে দান করার বুঝি এই পুরষ্কার। একদিন যখন ছিলো, যে যা চেয়েছে, উজাড় করে দিয়েছেন, এ তারই সুফল। একটা কথা আল্লাহ তাকে বুঝিয়ে দিলেন, যে প্রাণ খুলে দান করতে চায়, তার সামগ্রীর কোনও অভাব হয় না।

    জাইন সব হাঁড়িগুলো মেঝের ওপর উপুড় করে ঢালতে থাকে। আর দেখে অবাক হতে থাকেন, কত সোনা এবং সোনার মোহর। সারা মেঝেটায় সোনার পাহাড় জমে ওঠে।

    জাইন নাবালক শিশুর মতো স্বর্ণস্তুপের সামনে বসে পড়ে দুহাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে খেলা করতে থাকেন। কখনও বা মোহরগুলো আর সোনার গুঁড়োগুলো আঁজলা ভরে তুলে মাথার ওপর দিয়ে সারা অঙ্গে গড়িয়ে দেন। ভারি মজা লাগে। এত অর্থ নিয়ে তিনি কী করবেন, কীই বা এর মূল্য।

    জাইন কী করবেন ঠিক বুঝতে পারেন না। সেই নির্জন কক্ষে কুবেরের ধন সামনে নিয়ে বিহুল হয়ে পড়েন। সোনার গুঁড়োর মধ্যে গড়াগড়ি খান। মোহরের বিছানা করে শুয়ে পড়েন। নাঃ, এ শয্যা তো তেমন সুখাবহ কোমল কুসুমাস্তীর্ণ নয়? এমন স্বর্ণশয্যায় শুয়ে পিঠে তার ব্যথা লাগে কেন?

    আবার তার সর্বাঙ্গ সোনায় সোনায় সোনালী বর্ণ হয়ে ওঠে। দেওয়ালের আয়নায় নিজের চেহারার প্রতিবিম্ব দেখে তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। একটা সোনার তৈরি পুতুল হয়ে গেছেন তিনি।

    জাইন নিজের মনেই ভাবেন আর হো হো করে হাসেন। এই সন্ধ্যাবেলাতেই তিনি দৈন্যের লজ্জা ঢাকবার জন্য সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে জীবন শেষ করে দেবেন বলে পথে বেরিয়েছিলেন, আর এখন কতই বা রাত্রি হবে—তার মধ্যে তিনি বোধ হয় তামাম দুনিয়ার সেরা ধনবানদের একজন হয়ে উঠেছেন। আল্লাহর কী মহিমা।

    জাইন ভেবে পান না, তার বাবা জনাকীর্ণ প্রাসাদের এই কক্ষতলে কী করে এমন সুন্দর একখানি হৰ্মকক্ষ বানাতে পেরেছিলেন? নিশ্চয়ই তিনি সকলের অলক্ষ্যেই করেছিলেন এ কাজ। এই যে জালা জালা মোহর আর সোনার গুঁড়ো এ সবই বা তিনি লোকচক্ষুর অগোচর করে এখানে এসে জমা করতে পেরেছিলেন কী করে?

    ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে। এত ঐশ্বর্যই বা তিনি সংগ্রহ করলেন কী করে। তার সলতানিয়তের যা আয় তা থেকে তো এ সম্পদ সঞ্চয় করে রাখা সম্ভব নয়।

    এইসব নানারকম ভাবছিলেন এবং মোহর আর সোনার গুড়োগুলো নিয়ে আপন মনে খেলা করে চলেছিলেন জাইন। হঠাৎ তার নজরে পড়লো ছোট্ট একটি কৌটো। সোনার তৈরি; খুব কারুকার্য করা।

    এই রকম একটা ক্ষুদ্র কৌটো এখানে কেন? কী এমন ধন-রত্নই বা থাকতে পারে এর ভিতরে। একটু এদিক ওদিক চাপ দিতে দিতে কৌটোটা খুলে ফেললেন জাইন। না, কোনও মণি-রত্ন কিছু নয়, একটুকরো কাগজ এবং একটা চাবি মাত্র।

    কাগজখানায় ঘরের নক্সা আঁকা ছিলো। জাইন একটু মিলিয়ে দেখে বুঝতে পারেন, এই মহলেরই পুরো নক্সা করা আছে ঐ কাগজে।

    জাইন ভাবে, চাবিটা যখন এত সযত্নে রাখা আছে, মনে হয় এই ঘরের আশেপাশে আরও কোনও ঘর আছে।

    নক্সাটা মিলিয়ে মিলিয়ে তিনি দেওয়ালের এক ধারে কী যেন সন্ধান করতে থাকেন। এবং পেয়েও যান একটা চিহ্ন। হাত দিয়ে একটু নাড়া চাড়া করতেই দেওয়ালের ঐ জায়গা থেকে খুলে আসে ছোট্ট একখানা স্ফটিক পাথর। জাইন দেখতে পান চাবি লাগানোর মতো একটা ছোট্ট ফুটো। চাবিটা ঢুকিয়ে এদিক ওদিক দু একবার ঘোরাতেই হঠাৎ দেওয়ালটা একদিকে সরে ফাঁক হয়ে যায়।

    ওপাশে আর একখানা ঘর। এবং আরও আরও সুন্দর দেখতে। এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো বাইশতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    সারা ঘরঘানা পান্না রঙে রঙ করা, এবং সোনার জলে নানারকম নক্সার কাজ করা ছিলো। মাথার ওপরের বৃত্তাকার গোলকে ছয়টি পরমাসুন্দরী মেয়ে। প্রত্যেকে পৃথক পৃথক সোনার সিংহাসনে সমাসীন। কিন্তু তারা কেউ জীয়ন্ত নয়—এক এক খণ্ড হীরে কেটে এক একটি গড়া।

    জাইন হতবাক হয়ে ভাবেন, ইয়া আল্লাহ তার বাবা এত সম্পদের মালিক হয়েছিলেন কী করে? এ দৌলত তো উপার্জন করা সম্ভব নয় কোনও মানুষের পক্ষে।

    জাইন ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝতে পারেন, আরও একটা সিংহাসন সেখানে রয়েছে। কিন্তু সেটায় কোনও পুতুল নাই। খালিই পড়ে আছে মনে হলো তার। কিন্তু একটু ওপরে উঠে দেখতে পেলেন, না, একেবারে শূন্য সিংহাসন নয়। একখণ্ড রেশমীর কাপড় রাখা আছে তার ওপর।

    জাইন কাপড়খানা নামিয়ে নিয়ে আসেন। কাপড়টায় সোনার অক্ষরে লেখা–

    বাবা, এই হীরক-কন্যাদের সংগ্রহ করতে আমাকে বহু দুঃখ কষ্ট অতিক্রম করতে  হয়েছে। এই পুতুলগুলো প্রত্যেকটিই এক একটা হীরে কেটে বসানো। তুমি ভালো করে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবে কী নিপুণ শিল্পীর হাতে এগুলো গড়া। প্রতিটি মেয়ে যেন প্রাণবন্ত বেহেস্তের হুরীর মতো পরমাসুন্দরী। কিন্তু তাই বলে ভেব না এদের চেয়ে আরও বেশি সুন্দরী কোনও নারী হতে পারে না। পারে। এখানে ছ জনকে দেখছে, কিন্তু সপ্তম কন্যার সিংহাসন শূন্যই পড়ে আছে, সে নাই। সে এখানে নাই, কিন্তু আছে। আছে সে মিশরে-কাইরোয়। সেখানে যদি যাও, আমার এক অতি বৃদ্ধ নফর মুবারকের খোঁজ করো তুমি। সেখানকার প্রায় প্রতিটি মানুষই তাকে চেনে। সেই তোমাকে বলে দিতে পারবে-এই সপ্তম কন্যার সন্ধান। নিজের চোখে যদি কখনও সে কন্যার অলোকসামান্য রূপ প্রত্যক্ষ করতে পার, তবে বুঝবে সে এই ছয় কন্যার চেয়েও কত বেশি সুন্দরী রমণী। যদি পার তাকে সংগ্রহ করে এনে এই শূন্য সিংহাসনে বসিয়ে দিও, জাইন। এই আমার শেষ বাসনা। আল্লাহ তোমায় রক্ষা করুন।

    জাইন ঠিক করেন, তিনি কাইরোয় যাবেন। এবং কালই। সপ্তম কন্যাকে দেখতেই হবে।

    জাইন আর অপেক্ষা করেন না সেখানে। একটা বাক্সে করে কিছু মোহর ভরে নিয়ে যথানিয়মে তালা চাবি বন্ধ করে ওপরে উঠে এসে আবার ঘরের মেঝেয় পাথরখানা বসিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে আসেন।

    পরদিন সকালে তিনি উজির আমির এবং সভাসদদের ডেকে বললেন, আমি অত্যধিক মানসিক যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছি। কিছুদিন একটু বাইরে বেড়িয়ে আসবো ভেবেছি। আমার প্রধান উজিরকে হুকুমতের পুরো দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। আপনারা তার আনুগত্য নিয়ে আপন আপন কর্তব্য করবেন, আশা করি।

    প্রধান উজির বুঝতে পারলো, সুলতানের মনোকষ্টের কারণ কী?

    —জাঁহাপনা কোথায় যাবেন মনস্থ করেছেন? বৃদ্ধ উজির কুণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞেস করে। জাইন বলেন, কায়রো। কাইরোর মনোহর প্রাকৃতিক শোভা মনের সব দুঃখ যন্ত্রণা লাঘব করে দিতে পারে। আপনি আমার যাবার ব্যবস্থা করুন উজির সাহেব। বিশেষ কোনও আড়ম্বরের প্রয়োজন নাই, বাছাই করা দু’চার জন নফর চাকর সঙ্গে দিলেই চলবে।

    উজির জো হুকুম-বলে কুর্ণিশ করে সুলতানের কাইরো সফরের উদ্যোগ আয়োজন করতে প্রাসাদের ভিতরে চলে যায়।

    যথাসময়ে কাইরোয় পৌঁছে জাইন এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা শেখ সাহেব, মুবারক নামে এক বৃদ্ধ, শুনেছি এখানকার প্রায় সব মানুষই তাকে এক ডাকে চেনে, কোথায় থাকে বলতে পারেন।

    লোকটি জাইনের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলে, তুমি বুঝি মুসাফির?

    —জী হা।

    —শাহ বাদশার মুবারক সাহেবের প্রাসাদ কে না চেনে? তিনি এখন বলতে গেলে কাইরোর মালিক। তার মতো বিত্তবান এ শহরে আর কেউই নাই। এমন কি এখানকার সুলতানও ধন-দৌলতে তার সমকক্ষ নন। তুমি এক কাজ কর, বাবা, এই পথ দিয়ে সোজা চলে যাও। যেতে যেতে দেখবে পথটা ডাইনে বেঁকে গেছে। সেইখানে দাঁড়ালেই দেখতে পাবে তার বিশাল প্রাসাদ।

    জাইন বিনীত হয়ে বলে, বহুত সুক্রিয়া।

    যথা-নির্দেশিত স্থানে এসে প্রাসাদখানার আকার এবং কারুকার্য দেখে অবাক হয়ে যান। বাবার কথাগুলো মনে পড়ে, মুবারক তার একজন সামান্য নফর ছিলো। আজ সে এই বিশাল প্রাসাদের মালিক! ভাবতে অবাক লাগে।

    বিরাট একখানা বসার ঘর। দেওয়ালে দেওয়ালে নানা প্রাচীন কারু-শিল্পের নিদর্শন। মেঝেয় দামি গালিচা পাতা। ঘরের আসবাবপত্রও অনেক খানদানী আভিজাত্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে, এক নজরেই বোঝা যায়।

    ঘরের ভিতরে একটা মখমলের আসন পাতা উঁচু বেদীতে বসে আছেন শুভ্র শ্মশ্রু পলিতকেশ এক সদাশয় বৃদ্ধ। সারা মুখে চোখে তার নির্লিপ্ত প্রশান্তি।

    জাইনকে দরজায় দেখে স্বাগত জানান তিনি।

    —আসুন ভিতরে আসুন, মনে হচ্ছে আপনি পরদেশী মুসাফির, মেহেরবান করে আসন গ্রহণ করুন।

    অতি অমায়িক ব্যবহার। জাইন কোনও কথা বলতে পারেন না। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে একটা জায়গায় বসে পড়েন।

    বৃদ্ধ এবার সবিনয়ে জানতে চান, সাহেবের আগমনের উদ্দেশ্য? জাইন বলেন, আমি মুবারকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

    একটি অল্পবয়সী নওজোয়ানের মুখে তার অলঙ্কার-বর্জিত শুধু নামটা শুনে একটু বা আহত হয় সে। কিন্তু মুখের ভাবে তা প্রকাশ পায় না। কায়রোর প্রতিটি মানুষ তাকে দারুণ শ্রদ্ধা সম্মান করে। শুধু মুবারক বলে, ডাকার মতো লোক এখন আর কাইরোয় কেউ বেঁচে নাই। বৃদ্ধ ঈষৎ হেসে বলে, আমিই মুবারক। বলুন কী চাই আপনার?

    জাইন বলে, আমার নাম জাইন, বসরাহ থেকে আসছি। আমি সেখানকার বর্তমান সুলতান। আমার বাবা গত হয়েছেন—

    আরও কী সব বলতে যাচ্ছিলেন জাইনের কিন্তু বলা হলো না। বৃদ্ধ মুবারক তৎক্ষণাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে সসম্রমে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন নিজের আসন ছেড়ে। এক মুহূর্ত। জাইনের সামনে ছুটে এসে

    জাইনের পায়ের পরে লুটিয়ে পড়ে আর্তনাদ করে ওঠে মালিক

    ঘরে বসেছিলো শহরের সম্রান্ত সব সওদাগররা। তারা তো বিস্ময়ে বিমূঢ়! জাইনও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দু’হাতে মুবারককে টেনে তোলে, আহা এ কি করছেন আপনি?

    মুবারকের চোখে জল।

    —আপনার বাবা গত হয়েছেন। কিন্তু পুণ্যবান মানুষের কখনও মৃত্যু হয় না। আপনি আমার মালিক। আপনার বাবা আমার মালিকের মালিক। আজ এতকাল পরে এই শেষ বয়সে মালিকে-নফরে আবার মিলন হলো। আজ আমার এ গরীবখানা পবিত্র পূর্ণতীর্থ হয়ে গেলো, জাঁহাপনা!

    মুবারকের এই কথায় ঘরের উপস্থিত সকলেই সসম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে কুর্ণিশ জানালো জাইনকে। তারপর নিঃশব্দে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলো সকলে।

    মুবারক বলে, এখন হুকুম করুন, জাঁহাপনা।

    হুকুম নয়, জাঁহাপনাও আর নয়-বন্ধু বলে কাছে টেনে নিন। আমি আপনার কাছে এসেছি সপ্তম হীরক-কন্যাকে দেখবো বলে। বাবার লেখা থেকে জানতে পারলাম, আপনিই তার হদিশ

    জানাতে পারবেন!

    -ঠিকই জেনেছেন, মালিক। আমি একদিন আপনাদের যে নফর ছিলাম আজও ঠিক সেই নফর মুবারকই আছি। এই যা ধন-দৌলত প্রাসাদ ইমারত দেখছেন, এ সবই আপনার, মালিক।

    একটু থেমে আবার সে বলতে থাকে। হীরক-কন্যার সন্ধানে আপনাকে আমি নিয়ে যাবো অবশ্যই। তার আগে এখানে দু’একদিন জিরিয়ে নিন। শরীর মন দুই-ই চাঙ্গা হয়ে যাবে।

    ইতিমধ্যে আপনার সম্মানে আমি এক ভোজসভার আয়োজন করবো ঠিক করেছি। আমার আমন্ত্রণে শহরের তাবড় তাবড় সম্রান্ত ব্যক্তিরা সবাই আসবেন আপনাকে সম্বর্ধনা জানাতে। তাদের সকলের সঙ্গে আপনার আলাপ পরিচয় করাবো, এই আমার ইচ্ছা। আপনি মালিক, বান্দার এই অভিলাষ পূর্ণ করুন জাঁহাপনা।

    রজনী শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো তেইশতম রজনী :

    আবার সে গল্প শুরু করে :

    জাইন বলে, একথা সত্য, আপনি আমার বাবার কেনা গোলাম ছিলেন। জানি না আপনি যখন বসরাহ ছেড়ে চলে আসেন তখন তিনি আপনাকে মুক্তিনামা দিয়েছিলেন কিনা। তবে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি এখনও আমার বান্দা হয়েই আটক আছেন। মুক্ত হননি। যাই হোক, আজ আমি আপনাকে আমাদের সব গোলামী থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিনাশর্তে মুক্ত করে দিলাম।

    একটু থেমে জাইন বলেন, আমি বসরাহ থেকে এতটা পথ এসেছি, পথশ্রমে ক্লান্ত-অবশ্যই। কিন্তু সপ্তম হীরক-কন্যাকে দেখার জন্য মন আমার ছটফট করছে। তাই আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণের আড়ম্বর এখন থাক। আপনি আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।

    মুবারক বুঝলো, মালিক বিশেষ উন্মুখ হয়ে উঠেছেন। সুতরাং আর কাল-বিলম্ব না করাই সঙ্গত। বললো, ঠিক আছে, মালিক কালই রওনা হবো আমরা। কিন্তু একটা কথা কী ভেবেছেন মালিক, পথে যে সব বাধা-বিপত্তি আসবে তা কাটাতে হবে। সপ্তম হীরক-কন্যা এখন ত্রিভুজ দ্বীপের এক বৃদ্ধের হেপাজতে আছে। বড় দুর্ভেদ্য দুর্গম পথ; দুস্তর বাধা অতিক্রম করতে হবে। যারা ঘাঁৎ ঘোঁৎ জানে না, তারা কিছুতেই এই ত্রিভুজ দ্বীপের ত্রিসীমানায় ঢুকতে পারে না। যে দু একজন এই বিপদ বাধা কাটিয়ে সেখানে পৌঁছোতে পেরেছিলো আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন। সেইজন্যই জানি, কত মারাত্মক কত বিপদসঙ্কুল এর যাত্রাপথ।

    জাইন বলে, সে যাই হোক, আমি সবকিছুর জন্য তৈরি। আপনি আর ভয় দেখাবেন না, চলুন বেরিয়ে পড়ি। আমার বুকে দুর্জয় সাহস আছে, মৃত্যুকে আমি ডরাই না।

    মুবারক তার নফরদের বললো, সব বাঁধা-ছাঁদা করে ফেলো, কালই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।

    পরদিন খুব ভোরে মুখে হাত ধুয়ে রুজু নামাজ সেরে ওরা পথে বেরিয়ে পড়লো।

    দিনের পর দিন তারা কত নদী মরুপ্রান্তর পার হয়ে চলে। পার হয় কত সবুজ শস্য ক্ষেত, গিরি পর্বতমালা, কী করে তার পরিমাপ করা যাবে। চলতে চলতে রাত্রি নেমে আসে। রাত্রি শেষ হলে আবার ওঠে দিনের সূর্য। আবার সূর্যও এক সময় ঢলে পড়ে। কিন্তু জাইন আর মুবারক ক্লান্তিবিহীন চলতেই থাকে। যখন একেবারেই আর শরীর সইতে পারে না তখন খানিকটা জিরিয়ে নেয়। খানাপিনা সারে। তারপর আবার শুরু হয় পথ চলা।

    এইভাবে ওরা একদিন সমুদ্র উপকূলে এসে একখানা নৌকায় চেপে আবার চলতে থাকে। চারদিকে জল, শুধু জল। জাইন কিছুই নিশানা বুঝতে পারে না।

    এক সময় মুবারক বলে, এই সামনেই ত্রিভুজ দ্বীপ দেখতে পাবেন এবার।

    সত্যিই একটু পরে দেখা গেলো একটা দ্বীপ। গাছপালা, তরুলতা গুল্মে ভরা সুন্দর সবুজের হাট।

    নৌকাখানা কুলে ভিড়িয়ে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধলো মুবারক। তারপর জাইনকে বললো, আপনি এখানে নৌকাতেই থাকুন, আমি আসছি।

    জাইন বললেন, না, আমিও আপনার সঙ্গে যাবো।

    মুবারক হাসে, আমি আগে পথঘাট দেখে আসতে চেয়েছিলাম। পরে তো আপনাকে নিয়ে যাবোই। না হলে, সেই হীরক-কন্যাকে দেখবেন কী করে আপনি। তা এখন যদি যেতে চান চলুন, তবে বড়ই বিপদসঙ্কুল পথ—তাই বলছিলাম আগে আমি দেখে আসি।

    জাইন বলেন, তা হোক। বিপদে আমি ভয় করি না। চলতে চলতে বৃদ্ধ বলে, সে তো একশোবার মালিক। আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন কেউ তাকে মারতে পারে না। আবার কথা আছে খোদার মার, দুনিয়ার বার। তিনি যদি মারেন, কেউ বাঁচাতেও পারবে না। সুতরাং ভয় আতঙ্ক সব মিছে। যা ঘটবার তা ঘটবেই। আমরা নিমিত্ত মাত্র।

    চলতে চলতে একসময় বৃদ্ধ আবার বলে, আমরা কিন্তু এবার হীরক-কন্যার সেই নিষিদ্ধ এলাকার দোরগড়ায় এসে পড়েছি প্রায়। বুকে সাহস সঞ্চয় করুন মালিক, এবার আমাদের ভেতরে ঢুকতে হবে। মনে রাখবেন, আমরা রিক্তহস্ত। আমাদের কাছে আত্মরক্ষারও কোন অস্ত্র নাই কিছু।

    আরও কিছুক্ষণ চলার পর ওরা একটা পাহাড় দেখতে পায়। উচ্চতায় পাহাড়টা নেহাত খাটো নয়। মুবারক বলে, ঐ চূড়ায় উঠতে হবে আমাদের।

    জাইন বলে, কিন্তু আমাদের তো ডানা নাই, মুবারক।ওপরে যাবো কী করে। হাঁটা পথ বলতে তো কিছু দেখছি না!

    মুবারক বলে, আমাদের ওড়ারও দরকার নাই, ওঠারও দরকার নাই।

    এই বলে সে কুর্তার জেব থেকে একখানা ছোট্ট পুরোনো কিতাব বের করে। একেবারে জরাজীর্ণ। পাতাগুলো ঝুরঝুর হয়ে গেছে। মৃদুমন্দ হাওয়াতেই খসে যেতে পারে। কোথাও কোথাও উই-এ কেটেছে।

    বৃদ্ধ ওই বইখানার পাতা খুলে একটা জায়গা পড়তে থাকলো। জাইন বুঝতে পারলেন, কয়েকটি ছত্রের একটি কবিতা সে পাঠ করে চলেছে। কিন্তু তার ভাষা বা উচ্চারণ কিছুই বোধগম্য হবে না তার।

    মুবারক নিবিষ্ট মনে কবিতা অথবা মন্ত্রের ছত্রগুলো বিড় বিড় করে আওড়াতে আওড়াতে পাহাড়ের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, আকাশ থেকে সমতল পর্যন্ত সব দিক নিরীক্ষণ করতে থাকলো।

    হঠাৎ দেখা গেলো পাহাড়টা সমান দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। প্রথমে ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা ফাটল দেখা দিলো। তারপর সেই ফাটল ক্রমশঃ একটি সরু পথের সৃষ্টি করলো, অংশ দুটির মধ্যে।

    কোন রকমে একটি মাত্র মানুষ প্রবেশ করতে পারে সে পথ দিয়ে।

    মুবারক আগে এবং তার পরে পিছনে পিছনে প্রবেশ করলেন জাইন। একটানা এক ঘণ্টা ধরে ওরা হেঁটে চললো সেই দুর্গম পথ বেয়ে। অবশেষে এক সময় পাহাড় পথ অতিক্রম করে ওপারে বের হতে পারলো। কি আশ্চর্য, বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের ফাটলটা আবার জোড়া লেগে গেলো। একটা সরু চুলের মতো দাগও আর চোখে পড়লো না।

    সামনেই এক বিশাল হ্রদ। হ্রদ না বলে সমুদ্র বলাই সঙ্গত। তার ওপারে বহুদূরে এক সবুজ গাছপালার বন-জঙ্গল চোখে পড়ে। হ্রদের প্রাকৃতিক শোভা বড় সুন্দর। নীচে নীল নিথর স্বচ্ছ জলরাশি। মাথার ওপরেও নীল আকাশ-নির্মেঘ। ঝাঁকে ঝুঁকে পাখীরা মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে।

    জাইনকে পাশে নিয়ে মুবারক জলের ধারে পা ছড়িয়ে বসলো। ওপারে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, ঐ যে দেখছেন, ওপারের যে গাছগুলো শস্যশ্যামল প্রান্ত, ঐখানে আমাদের যেতে হবে মালিক।

    জাইন-এর চোখে জিজ্ঞাসা, কিন্তু ওপারে আমরা যাবো কী করে?

    মুবারক বলে, ও-নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, জনাব।এখুনি একখানা ছোট নৌকো এসে আমাদের নিয়ে যাবে। ঐ সুন্দর স্বপ্নের দেশে কোনও কিছুরই অভাব নাই। শুধু আপনার কাছে একটা আর্জি জাঁহাপনা, যা কিছু দেখবেন, সহজভাবে দেখবেন। কোনও কিছু দেখে বিচলিত বা অবাক হবেন না যেন। আর একটা কথা, ভয় পেয়ে ভুলেও কখনও ফিরে যাওয়ার নামটি মুখে আনবেন না। তা সে যদি ঐ নৌকোর মাঝি আমাদের কোনও বিপদের মধ্যে নিয়ে যায় তবুও না। ধৈর্য ধরে মুখ বুজে সব সয়ে যাবেন। আপনি ভয় পেয়েছেনএটা বুঝতে পারলে খুব খারাপ হবে। যতই বেকায়দায় সে ফেলুক, কোনও কথা বলবেন না। যদি বলেন, সঙ্গে সঙ্গে একেবারে পানির নিচে ডুবিয়ে দেবে সে।

    জাইন বলে, এই আমি মুখে কুলুপ এঁটে দিলাম। আর একটি কথাও বেরুবে না। আপনার কথাবার্তা শুনে বেশ রোমাঞ্চ লাগছে।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো চব্বিশতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    ওরা যখন এই সব আলোচনায় রত সেই সময় একখানা ডিঙি নৌকো এসে ভিড়লো ওদের সামনে। জাইন অবাক হয়ে ভাবেন কি আশ্চর্য, সে তো এতক্ষণ সামনে তাকিয়েছিলো! যতদূর দৃষ্টি যায়, কই, কোথাও তো কোনও নৌকো-টৌকার আভাষ সে বুঝতে পারেনি এতক্ষণ। তবে হঠাৎ এই ডিঙিখানার আবির্ভাব ঘটলো কী করে? আকাশ থেকে নেমে আসলো, না জলের তলা থেকে উঠে আসলো, কিছুই বুঝতে পারেন না জাইন।

    ডিঙিখানা আগা গোড়া রক্তচন্দন-কাঠে তৈরি। দড়ি কাছিগুলো রেশমের। সুন্দর সুগন্ধে আকাশ বাতাস আমোদিত হয়ে উঠলো।

    ডিঙির মাঝিটার নিম্নাঙ্গ দেখতে মানুষের মতো। কিন্তু তার মাথাটা হাতীর। কান দুখানা বিরাট বিরাট কুলোর মতো লটরপটর করছিলো।

    ডিঙিখানা একেবারে কূলে এসে ভিড়লো না। তার থেকে কয়েক হাত দূরে রেখে এক লাফ দিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ালো। তারপর দুজনকে দু’হাতে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে আবার এক লাফে ডিঙিতে গিয়ে উঠলো।

    জাইন আর মুবারককে ডিঙির খোলের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে সে গলুই-এর ওপর সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বিরাট বিরাট কান দুখানা টানটান করে মেলে ধরে। একেবারে পালের মতো করে।

    শোঁ শোঁ করে হাওয়া বইছিলো। মঝিটার কানের পালে হাওয়া লাগতে নৌকোখানা তর তর করে চলতে থাকলো।

    অল্পক্ষণের মধ্যে সেই দ্বীপ নিকটবর্তী হয়ে এলো। তখন মঝিটা আবার ওদের দুজনকে দু হাতে তুলে এক লাফ দিয়ে দ্বীপের কূলে নামিয়ে দিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে গেলো।

    জাইনকে হাতে ধরে মুবারক দ্বীপের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। সুন্দর একটি সান-বাঁধানো পথ দিয়ে ওরা হেঁটে চলে। পথের দুপাশে আমরা যেমন পাথরের খোয়া দিয়ে আল করে দিই, সেই রকমই আল করা ছিলো পাথরের নুড়ি দিয়ে। কিন্তু সে নুড়িগুলো কোনও সাধারণ পাথর নয়। বহু বর্ণের চূণী পান্না পলা মুক্তো সব। জাইন ভাবতে পারেন না, কত লক্ষ কোটি দিনার তার মূল্য হতে পারে। আশ্চর্য, এতটা পথ তাঁরা হাঁটলেন, অথচ কোথাও একটি জন-প্রাণীর সাড়া পেলেন না।

    হাঁটতে হাঁটতে এক সময়ে এক বিশাল প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন ওঁরা। মুবারক বললো, এই সেই প্রাসাদ। এর মধ্যেই থাকে ঐ বৃদ্ধ।

    জাইন বলে, কিন্তু এর তো দরজা কপাট সব ভিতর থেকে বন্ধ। কোনও পাহারা পেয়াদাও দেখছি না?

    মুবারক বলে, তার কোনও দরকারও নাই।

    -তবে ভিতরে ঢুকবেন কী করে, খবরই বা দেবেন কী করে? মুবারক বলে, খবর-টবর কিছু দিতে হবে না, যা করতে হবে আমি করছি।

    জাইন দেখলেন, আগাগোড়া প্রাসাদটা একখানা মাত্র পান্নার পাথর কেটে J তৈরি করা হয়েছে। কোথাও জোড়া-টোড়া কিছু নাই। এত বড় পান্না পাথর কোথা থেকেই বা জোগাড় করেছে, আর কী করেই বা এখানেই এনে বসিয়েছে, কিছু বোধমগম্য হয় না তার। প্রাসাদের চারপাশ ঘিরে দুর্গ পরিখা। বাইরের কোনও অবাঞ্ছিত কেউ যাতে প্রাসাদ-সান্নিধ্যে যেতে না পারে তার জন্যই এই কড়া ব্যবস্থা। পরিখার এপাশের পাড়ে সারবন্দী করে কঁকড়া ঝাঁকড়া গাছ বসানো। যার ফলে বাইরে থেকে ঠিকমত নজর না করতে পারলে বোঝারই উপায় নাই, ভিতরে অত বিরাট একখানা প্রাসাদ সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

    প্রাসাদের সব দরজাই রুদ্ধ। তার মধ্যে সবচেয়ে যে দরজাটা বড়, তার চৌকাঠ থেকে শুরু করে পাল্লা সব আগাগোড়া সোনার তৈরি। দূর থেকে দেখে মনে হয়, পাল্লা দুখানা কুমীরের চামড়ায় গড়া।

    মুবারক তার কামিজের তলা থেকে চারখানা রেশমী ফিতে বের করে দু’খানা জাইনের হাতে দেয়, আর দু’খানা নিজে রাখে। তারপর একখানা ফিতে সে নিজের কোমরে এবং একখানা পিছনে বাঁধে। জাইনকে বলে, ঠিক আমি যেমনটি করে বাঁধলাম, আপনিও দেখে এই রকম করে বাঁধুন, মালিক।

    মুবারকের অনুকরণ করে জাইনও তার নিজের কোমরে বাঁধে একখানা, অন্য খানা ঝুলিয়ে দেয় পিছনে।

    এরপর মুবারক তার কামিজের তলা থেকে নমাজে বসার উপযোগী দু’খানা বড় আকারের রেশমী কাপড় বের করে মাটিতে পাশাপাশি পাতে। একটার ওপরে সে নিজে বসে। জাইনকে বলে, আপনিও বসুন আমার মতো করে।

    মুবারক আতরের শিশি বের করে জাইন এবং নিজের গায়ে ছড়িয়ে দেয়। ভুর ভুর করে সুবাস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আর একটা শিশি থেকে গোলাপ জল বের করে বিড় বিড় করে মন্ত্র পাঠ করতে করতে চারপাশে ছড়াতে থাকে।

    মুবারক বলে, ব্যস। এবার আমি বৃদ্ধকে আহ্বান করব! জানি না সে কী মূর্তি ধরে দেখা দেবে। যে ভাবেই আসুক, যে মূর্তিতেই দেখা দিক, আগেই বলেছি, বিন্দুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ করবেন না বা আঁৎকে উঠবেন না। তা হলে কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।

    জাইন বলে আমার মনে আছে।

    মুবারক বলে, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, সে যেন কূপিত না হয়ে আসে। আমাদের আগমন যদি অবাঞ্ছিত মনে করে, তবে বিকট বীভৎস এক দৈত্য দানবের রূপ ধরে দেখা দেবে। এবং তার সেই ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই আরও একবার সাবধান করে দিচ্ছিমালিক, কিছুতেই ভয় পাবেন না। আর যদি খুশ-মেজাজে থাকে সে, তবে আর কথা নাই, এক সদাশয় মিষ্টভাষী বৃদ্ধের মূর্তিতে আবির্ভূত হবে। কিন্তু একটা কথা, যে রূপ ধরেই সে আসুক, আপনি তাকে শ্রদ্ধা সম্মান জানাবেন বেশ ভালো করে। মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে বলবেন, আপনি মহা শক্তিধর—সম্রাটের সম্রাট। আমরা আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করতে আপনার সাম্রাজ্যে হাজির হয়েছি। আপনি আমাদের রক্ষা করুন, এই প্রার্থনা জানাই, আমি আপনার একান্ত অনুগত এক ভৃত্য। অধমের নাম জাইন—বসরাহর বর্তমান সুলতান। আমার বাবা মহামান্য সম্রাটের অনুগ্রহেছয় ছয় বার এখানে এসেছয়টি হীরকের পুতুল পেয়েছিলেন। আমি এসেছি আমার বাবারই নির্দেশে। তিনি আজ ইহলোকে নাই। কিন্তু আমাকে আদেশ করে গেছেন, এখানে এসে আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করতে। তাঁর জীবদ্দশাতে সপ্তম হীরক-কন্যাটি তিনি আর আপনার কাছ থেকে সংগ্রহ করে যেতে পারেননি। তাই আমার ওপরে দায়িত্ব আরোপ করে গেছেন, আমি যেন আপনার কাছে এসে সেই সপ্তম হীরক-কন্যাটি প্রার্থনা করি। আমি আমার প্রস্তাব রাখলাম। এখন আপনি যদি প্রসন্ন হয়ে প্রদান করেন, তবে আমার মনস্কামনা পূর্ণ হয়। তবে একথাও ঠিক, আপনি যদি আমাকে নাও দেন, ঐ সপ্তম কন্যা, তবু আমার পিতৃদেবের মতো শ্রদ্ধা-ভক্তি অম্লান এবং অবিচল থাকবে আপনার প্রতি। কোনও দিন তা বিন্দুমাত্র নষ্ট হবে না। এর পর বৃদ্ধ যদি জিজ্ঞেস করে, ঐ সপ্তম হীরক-কন্যা নিয়ে তুমি কী করবে, তখন আপনি বললেন, আপনার অনুগ্রহে দৌলতের কোনও অভাব নাই আমার। এ শুধু পিতৃ আজ্ঞা পালন। তিনি বলে গেছেন, তাঁর গুপ্তধনাগারে সাতটি কন্যার জন্য সাতটি সোনার সিংহাসন আছে। তার মধ্যে ছয়টিতে ছয় কন্যা অধিষ্ঠিত, কিন্তু সপ্তম আসনটি শূন্য পড়ে আছে। ওটি নিয়ে গিয়ে ওখানে বসাতে পারলে যোলকলা পূর্ণ হয়।

    এর পর মুবারক জপ তপ, মন্ত্রপাঠ এবং অনেক রকম তুকতাক এবং নানা রকম অঙ্গভঙ্গী করে ডাকাডাকি করতে থাকে। এমন সময় চারদিক আঁধার হয়ে আসে। সূর্য ঢাকা পড়ে যায়। ক্রমশঃ অন্ধকার ঘনীভূত হতে হতে এমন অবস্থা হয়, জাইন আর মুবারক কেউ কাউকে দেখতে পায় না। হঠাৎ সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার চিরে এক ঝলক বিদ্যুৎ চমকায়। এবং তখনি গগন-মণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

    জাইন দেখলেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক পলিত-কেশ বৃদ্ধ। মুখে তার মধুর হাসি। প্রশ্ন করলেন, কে তুমি বাবা?

    —মহামান্য ত্রিলোকেশ্বর, আমি আপনার বান্দা জাইন, বর্তমানে বসরাহর সুলতান। তখন মুবারক যা যা শিখিয়েছিলো, হুবহু সেইসব কথাগুলো বলে গেলেন জাইন। রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    সাতশো পঁচিশতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    সব শুনে বৃদ্ধ প্রীত হয়ে বললো, তোমরা এই দুর্গম দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছ, সেজন্য খুব খুশি হয়েছি বাবা। কিন্তু সপ্তম হীরক কন্যাটি পাওয়ার পথে একটি কঠিন অন্তরায় আছে। তোমার বাবাকে আমি পর পর ছয়টি শর্ত পালনের জন্য ছয়টি হীরক কন্যা দান করেছিলাম। সপ্তমটিও তাকেই দেবার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু আমার শেষের শর্তটি সে পূরণ করতে পারেনি। অবশ্য চেষ্টার কোনও ত্রুটি সে করেনি। তার মৃত্যুর পর তার যোগ্য সন্তান তুমি এসেছো, ঐ সপ্তমটিকে নিতে। অবশ্যই আমি দেব—দিতেও চাই। তার কারণ, ওরা একসঙ্গে সাতজন ছিলো, তার মধ্যে ছ’টি এখন তোমার ধনাগারে, আর এই সপ্তম বেচারী একা একা পড়ে হাহাকার করছে। তাই ঠিক করেছি, দিতে হলে তোমার কাছেই দেব। কিন্তু সেই শর্তটি তোমাকে পূরণ করতে হবে যে, বেটা!

    জাইন এক পলকও চিন্তা না করে বলে, আপনার যে-কোনও শর্তে আমি রাজি আছি, ত্রিভুবন অধিপতি। আদেশ করুন।

    বৃদ্ধ হাসে, কিন্তু বাবা, তুমি কী পারবে তা পূরণ করতে?

    —অবশ্যই পারবো। আপনি হুকুম করুন। ওই সপ্তম কন্যার বিনিময়ে আপনি যদি আমার গোটা সলনিয়তটাও চান, আমার কোনও দুঃখ থাকবে না—দিয়ে দেব আপনাকে। আপনার গুপ্ত ধনাগারে অগাধ ঐশ্বর্য আছে, যদি চান, তাও সব দিতে পারি। বলুন, কী চান?

    বৃদ্ধ হো হো করে হাসে, না, না, ওসবে আমার কোনও প্রয়োজন নাই।

    —না, না, সে তুমি পারবে না। তোমার পিতা বহু বৎসর চেষ্টা করেছিলো। সে-ও পারেনি।

    —বাবা পারেননি বলে ছেলে পারবে না, তা তো হয় না। আপনি বলুন, দেখি, পারি কিনা। একি কোনও অপার্থিব বস্তু, সম্রাট?

    বৃদ্ধ মৃদু হেসে বলে, না। তুমি সাধারণ এক মনুষ্য সন্তান। তোমার কাছে অলৌকিক বা অপার্থিব বস্তু চাইবো কেন? এ বস্তু অত্যন্ত পার্থিব। কিন্তু মেলানো ভার।

    জাইন বলে, পৃথিবীর যে-প্রান্তেই পাওয়া যাক, আর যত দুর্গমই হোক সে পথ, আমি এনে দেব আপনাকে, আপনি মেহেরবানী করে আজ্ঞা করুন।

    বৃদ্ধ বলে, আমি একটি পরমাসুন্দরী পঞ্চদশী প্রকৃত কুমারী কন্যা চাই।

    জাইন ভাবতে পারেনি, এত সাধারণ বস্তু তার কাম্য। বলেন, এ আপনি কী বললেন, সম্রাট। আমার হারেমেই অন্ততঃ বিশটা পঞ্চদশী পরমাসুন্দরী কুমারী পালিত হচ্ছে। এখনও ওরা আমার ভোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। আপনি আদেশ করুন, তাদের সবাইকে আপনার সামনে হাজির করছি। তাদের মধ্যে এমন অলোক-সামান্য সুন্দরীও আছে, তামাম দুনিয়ায় যার জুড়ি মেলা ভার।

    এবার বৃদ্ধ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তুমি অবোধ শিশু। কুমারীত্ব কাকে বলে তাই জানো না। আমি শুধু রূপবতী নারী চাই না। আমার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হচ্ছে, সে হবে অপাপবিদ্ধ কুমারী।

    জাইন বলে, তাই দেব আপনাকে। আমি জানি আমার হারেমের যা সুরক্ষা, তাতে কোন বাঁদী বেগম ব্যভিচার করার কোনও সুযোগ পেতে পারে না।

    —তা সত্ত্বেও আমি বলছি, তারা কেউই প্রকৃত কুমারী নয়। তা হলে তোমাকে খুলেই বলি, প্রকৃত কুমারী কন্যার সতীচ্ছদ অটুট থাকবে। কিন্তু আমি বাজি রেখে বলতে পারি, যাদের তুমি অসূর্যস্পশ্যা করে অন্দরে পুরে রেখেছ, তারাও কেউ পূত-পবিত্র নাই।

    জাইন বলে, ঠিক আছে, আমি তাদের এনে হাজির করছি। আপনি নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন, তারা কুমারী কিনা।

    -এখানে এনে পরীক্ষা করার কোনও প্রয়োজন নাই। তুমি নিজেও পরীক্ষা করে দেখতে, পার। তাতেই হবে।

    জাইন বলে, কিন্তু পিতা,সহবাস ছাড়া পরীক্ষার তত দ্বিতীয় কোনও উপায় নাই। এবং সহবাস করে পরীক্ষা সমাধা করতে গেলে তারপর তো সে আর কুমারী থাকবে না!

    —তুমি যথার্থই বলেছ। সহবাসের পর প্রকৃত কুমারীরও আর কুমারীত্ব বজায় থাকে না।

    জাইন বলে, তা হলে? আপনার সন্দেহ মোচন হবে কী করে? আপনি যদি আজ্ঞা করেন, আপনাকে আমি শতাধিক কুমারী কন্যা এনে দিতে পারি! এখানে আপনি নিজে তাদের সঙ্গে সহবাস করতে করতে জানতে পারবেন, কোটি প্রকৃত কুমারী। তাকেই আপনি গ্রহণ করে বাকীগুলোকে ফেরত দিয়ে দেবেন?

    -কিন্তু বৎস, তোমার এ প্রস্তাব একেবারেই অবাস্তব।

    -কেন?

    -কারণ, একশো কেন, একশো হাজার পঞ্চদশীর মধ্যেও একটি প্রকৃত কুমারী পাওয়া সম্ভব নয়। তুমি কত মেয়ে জোগাড় করতে পার? যদি পারও তাদের প্রত্যেককে ঐ পদ্ধতিতে পরীক্ষা তো একেবারেই অসম্ভব।

    জাইন নিরুৎসাহ হয়ে ভেঙ্গে পড়ে, আপনি বলছেন,একশো হাজারেও একটি প্রকৃত কুমারী মেয়ে পাওয়া শক্ত?

    বৃদ্ধ বলে, বুঝেছি, তোমার মনে সন্দেহ জমছে। ঠিক আছে, তোমাকে পরীক্ষার এক নতুন উপায় বাৎলে দিচ্ছি। তুমি একটু দাঁড়াও, আমি এখুনি আসছি।

    বৃদ্ধ প্রাসাদের ভিতরে চলে গেলো।

    একটু পরে সে ফিরে এলো একখানা আয়না হাতে করে।

    —এই যে দেখছো, আর্শিখানা—এই আর্শির সামনে কোনও কুমারী মেয়েকে দাঁড় করালে তার নিরাবরণ দেহখানা দেখতে পাবে। শুধু তাই নয়, সে মেয়ে যদি পাপবিদ্ধ হয়ে কুমারীত্ব খুইয়ে থাকে, তবে সঙ্গে সঙ্গে তাও ধরা পড়বে এই আয়নায়।

    জাইন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কীভাবে?

    -আয়নার কাঁচখানা আস্তে আস্তে ঘোলাটে হয়ে যাবে। তখন আর কিছুই দেখা যাবে না।

    —আশ্চর্য তো!

    —হ্যাঁ, আশ্চর্যই বটে। এ কষ্টিপাথর আর দুটি কোথাও খুঁজে পাবে না। এটা তোমাকে দিলাম। সযত্নে রক্ষা করবে। সাবধান, যদি ভেঙ্গে বা হারিয়ে যায়, তোমার দারুণ দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসবে।

    জাইন হাত পেতে নিলো আয়নাখানা। বৃদ্ধ আবার বলে, তোমার যাকে যাকে মনে হবে পঞ্চদশী পরমাসুন্দরী এবং প্রকৃতকুমারী, কেবল তাদেরই পরীক্ষা করে দেখবে। অহেতুক ব্যবহার বিধেয় নয়। তারপর যদি কখনও সন্ধান পাও তেমন মেয়ের এবং তাকে যদি সংগ্রহ করে আনতে পার এখানে, তবেই আমি তোমাকে দেব ঐ সপ্তম হীরককন্যা। এবং আমি স্বয়ং তোমার প্রাসাদের গুপ্ত ধনাগারে পৌঁছে দিয়ে আসবো। তার কারণ, এই সব মহামূল্যবান সামগ্রী উটের পিঠে নিয়ে এত বিপদ-সঙ্কুল দূরদেশ পাড়ি দিয়ে নিরাপদে ঘরেতুলতে পারবেনা। পথের মধ্যে অনেক চোর ডাকাত দুবৃত্ত ওৎ পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই তারা ডাকাতি ছিনতাই করে কেড়ে নিতে পারে, এই আশঙ্কায় ঐ ছ’টি হীরক পুতুল আমি তোমার বাবার হাতেও দিইনি। আমি নিজে তোমাদের প্রাসাদে গিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। আর এই সপ্তম পুতুলটি পৃথিবীর পরমাশ্চর্য বস্তু। ঐ রকম হাজারটি পুতুলের চেয়েও এর দাম অনেক বেশি। সুতরাং এ বস্তুর কেউ সন্ধান পেলে আর রক্ষা থাকবে না। তাই আমি নিজেই তোমার প্রাসাদে দিয়ে আসবো। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। তার আগে আমার ওয়াদা পূরণ কর, তবে তো সে প্রশ্ন উঠবে।

    জাইন আভূমি আনত হয়ে কুর্ণিশ করে বলে, আপনি আশীর্বাদ করুন সম্রাট, আমি যেন কৃতকার্য হই। ইরান, ইরাক, পারস্য—তামাম আরবের, দরকার হলে প্রতিটি সুন্দরী পঞ্চদশীকে আমরা পরীক্ষা করে দেখবো। এবং যদি ইপ্সিত বস্তুর সন্ধান করতে পারি, তারপর যে মূল্যেই পারি, কিনে এনে আপনার চরণে নিবেদন করবো।

    বৃদ্ধ ডানহাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গী করে বলে, তোমাদের জয় হোক।

    আবার চারদিক ঘন ঘোর অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হয়ে গেলো। আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। জাইন দেখলেন, গগনমণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এবং কী আশ্চর্য, বৃদ্ধ অদৃশ্য হয়ে গেছে কখন।

    মুবারক বললো, আপাততঃ পর্ব শেষ। চলুন মালিক, এবার দেশে ফিরে যেতে হবে। তারপর শুরু হবে আমাদের দ্বিতীয় পর্বের কাজ।

    আবার ওরা হাঁটতে হাঁটতে সেই হ্রদের তীরে আসে। একটু পরে নৌকাখানা এসে ওপারে পার করে দেয়। সেই পাহাড়। মন্ত্রবলে পাহাড়ও দ্বিখণ্ডিত হয়ে পথ করে দেয়! তারপর সমুদ্রের কূলে অপেক্ষমান সেই নৌকায় চড়ে এপারে এসে আবার দীর্ঘ যাত্রা শেষে একদিন কাইরোয় এসে পৌঁছোয়।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো ছাব্বিশতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু হয়?

    মুবারকের একান্ত অনুরোধে জাইন কয়েকটা দিন তার প্রাসাদে বিলাস বিশ্রামের মধ্যে কাটাতে রাজি হলেন।

    জাইন ভাবে, না। যতটা ভয় পেয়েছিলাম ততটা কিছু ঘটেনি। ত্রিভূজ দ্বীপের বৃদ্ধটি তোক খুব ভালো। ঐ রকম একটা অমূল্য সম্পদ-সপ্তম হীরক-কন্যা সে সামান্য এক মর্তের কুমারী-কন্যার বদলে দিতে রাজী হয়ে গেলো। এ তো হাত বাড়িয়ে চাঁদ ধরা। তার কী ধারণা সারা দুনিয়ায় একটিও কুমারী কন্যা নাই?

    অবসর বিনোদনের মধ্যে এক সময় জাইন মুবারককে বলেন, এবার তাহলে আমরা বাগদাদেই যাত্রা করি? সেখানে আখচার পরমাসুন্দরী কন্যা পাওয়া যায়। এবং খুঁজে-পেতে দেখলে, তার মধ্যে কী একটা কুমারী কন্যা মিলবে না? বাগদাদে গেলে, অনেক সুন্দরী মেয়ের মধ্যে পছন্দসই কুমারীদের বেছে বেছে পরীক্ষা করে দেখতে পারবো।

    মুবারক বাধা দিয়ে বলে, কেন আপনি অত ভাবনা করছেন, মালিক? কাইরোই বা কী কম যায়! মিশরের মেয়েরা জগৎ-বিখ্যাত। তা ছাড়া এখানে দুনিয়ার সব দেশ থেকেই সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে আসা হয়। আমার বিশ্বাস অন্য কোথাও যাওয়ার দরকারই হবে না। এখানেই পেয়ে যাবেন।

    জাইন বলে, বেশ, পেলে তো ভালোই হয়। নানাদেশের ঘোরাঘুরির হয়রানি থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

    মুবারক বলে, আসল মেয়ে আমি খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিচ্ছি মালিক।

    —কী ভাবে খুঁজবেন?

    —আমি একটি বুড়িকে জানি, তার কাজই এই। ভালো ভালো মেয়েদের ভালো ভালো পাত্র জুটিয়ে দেওয়া।

    জাইন জিজ্ঞেস করে, কী ভাবে সে এত সব মেয়েদের সন্ধান রাখে?

    -সন্ধান কি সে বাড়ি বাড়ি খোঁজ করে রাখতে যায়? সন্ধান তার কাছে আসে আসে। দু তরফ থেকেই—ছেলে এবং মেয়ে।

    —অর্থাৎ।

    ধরুন আপনার যেমন একটি পঞ্চদশী পরমাসুন্দরী কন্যা দরকার—আপনি তাকে আপনার নাম ঠিকানা জানিয়ে বলে এলেন, তেমনি কোনও পরমাসুন্দরী পঞ্চদশীর বাবা-মাও তো উপযুক্ত পাত্র খুঁজছে। তারাও তার কাছে নাম ঠিকানা জানিয়ে তার চাহিদা জানিয়ে আসছে। বুড়ি শুধু ঘটকের কাজ করছে। মেয়ের চেহারা চরিত্র বয়স আপনাকে জানিয়ে আপনার চেহারা চরিত্র বয়স এবং ধনদৌলত এর খবর নিয়ে তাদের জানিয়ে আসছে। তারপর আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে শাদী-নিকা হতে আর কতক্ষণ।

    জাইন বলে, বাঃ, চমৎকার ব্যবস্থা তো। এতে তো বুড়ির দু তরফা লাভ, তাই না?

    মুবারক বলে, আলবত। এই ভাবে অনেক অনাথ মেয়েছেলে রোজগার করে সংসার চালাচ্ছে।

    জাইন বলে, ঠিক আছে, আপনি তাহলে, সেইরকম কাউকেই ডাকুন।

    মুবারক বলে, ঠিক আছে আজই তাকে ডেকে পাঠাচ্ছি। আপনার সামনেই তাকে বলবো, সারা মিশরের সেরা সুন্দরী চাই, আমাদের এই বসরাহর সুলতান জাইন শাদী করবেন। তোমার যা দালালী তার চাইতে কিছু বেশিই পাবে। অবশ্য যদি পছন্দ হয়। বাঁদী-বাজারেরমেয়ে হলেও আপত্তি নাই, তবে হ্যাঁ,বড়িয়া খুবসুরত হওয়া চাই। বয়স পনের হতে হবে। অবশ্যই অন্যের হাত ফেরা মেয়ে চলবে না। একেবারে গোলাপকুঁড়ি হওয়া চাই।

    আমার মনে হয়, বুড়ি প্রাণ দিয়ে খাটবে। সুলতান বাদশাহ বলে কথা! সে তো বুঝতে পারবে, সুলতানের মনে ধরলে তার সারা-জীবনের মতো একটা হিল্লে হয়ে যাবে।

    জাইন বলে, আপনার ফিকির খুবই ভালো মনে হয়, ভালো কাজ হবে। কিন্তু একটি কথা-বাঁদী-বাজারে মেয়ে পছন্দ হলে, না হয়, দাম দিয়ে কিনে নিলেন কিন্তু পছন্দ যদি কোনও খানদানী ঘরের মেয়েকে করি, সেক্ষেত্রে কী উপায় হবে। সেখানে তো শুধু পাত্রপক্ষই সব নয়। মেয়ের মতামতই সব আগে দরকার! তারপরে তার মা বাবা আছে। তাদের যদি একজন রাজি না হয়, তবে তো সব ভেস্তে যাবে।

    মুবারক বলে, সে ব্যাপার, আমি থাকতে, সারা মিশরে কোথায়ও ঘটবে না। প্রথমে আপনাকে দেখবে—যে সে পরিচয় তো নয়। একেবারে সুলতান! দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তারপর আমার প্রতাপ প্রতিপত্তি আছে। সারা মিশরে এমন কোনও সম্ভ্রান্ত আমির বাদশা-সওদাগর বা অন্য কোনও খানদানী পরিবার নাই, যারা আমাকে খাতির সম্মান করে না। ওসব আপনি আদৌ চিন্তা করবেন না, মালিক। মেয়ে যদি পছন্দ হয়, হাতে আমাদের আসবেই।

    মুবারক আরও বলে, আর একটা কথা, হুজুর, যদি দেখেন একেবারে ডানা কাটা পরী মিলছে না, যা পাওয়া যাচ্ছে—মোটামুটি সেরা, সে মেয়েকেও হাত ছাড়া করবেন না।শাদী করে নেবেন। সারা মিশরে বাছাই করে, ধরুন, পাঁচটা সুন্দরী মেয়ে মনে ধরলো। কাউকেই হাত ছাড়া করবেন না, মালিক। সবগুলোকেই শাদী করে রেখে দেবেন।

    এরপর আমরা দামাসকাসে যাবো। সেখানকার সেরা মেয়েগুলোকে শাদী করে নেবেন। ঠিক একভাবে বাছাই করে। তারপর যাবো আমরা বসরাহ এবং বাগদাদে। একই কায়দায় ছাকনী করে সেরা মেয়েদের বাছাই করে তারপর সবগুলো এক জায়গায় এনে তাদের মধ্যে থেকে সবার। সেরা সুন্দরী ঠিক করা যাবে। আমার মনে হয়, এইভাবে যদি আমরা এগোই, কাজটা, অনেক সহজ হতে পারবে। আমার তো মনে হয়, অল্প সময়ের মধ্যে এখানেই আমরা ডানাকাটা পরী পেয়ে যাবো।

    জাইন বলে, শুধু ডানাকাটা পরী পেলে তো হবে না, মুবারক ভাই। সব আগে তাকে প্রকৃত কুমারী হতে হবে।

    মুবারক বলে, সে তো একশোবার। প্রথম বাছাই-এর সময় সব আগে তো আমরা আয়না দিয়ে তার কুমারীত্বই পরীক্ষা করবো। সে পরীক্ষা পাশ করলে তবে তো রূপ-যৌবনের কথা উঠবে।

    জাইন বললে, আপনার পরিকল্পনা অভিনব। এখন দেখা যাক, কতদূর কী হয়। আপনি আগে সেই বৃদ্ধাকে ডেকে পাঠাবেন। সে কী রকম মেয়ের সন্ধান দিতে পারে দেখা যাক।

    কিছুক্ষণ পরেই এক বৃদ্ধা এলো।দূতয়ালী করাই তার একমাত্র কাজ। মুবারক বললো, কি গো বুড়ি মা, তেমন কোন বেহেস্তের ডানাকাটা পরী-টরির কোনও সন্ধান আছে?

    বুড়ি ফোকলা মুখে এক গাল হেসে বলে, তা আর নাই? খুব আছে। কত চাই?

    দু চারটে দেখাও দেখি। তবে হ্যাঁ, বয়স পনেরোর বেশি হলে চলবে না এবং হাতফেরা মেয়ে চলবে না। তোমার দালালী এবং বখশিশের কথা চিন্তা করো না। পছন্দ হলে অনেক পাবে। যা আশা করতে পার না, তাও পাবে।

    বুড়ি বললো, আজই দেখাবো গোটা-পাঁচেক। মুবারক বলে, বেশ, দেখাও।

    বুড়িটা বলে, আমি কোনও হেঁজি-পেঁজি মেয়ে নিয়ে কারবার করি না, মালিক। সবই খানদানী ঘরের খুবসুরত কন্যা। মহামান্য সুলতানের পছন্দ না হয়েই পারবে না। একেবারে আসমান থেকে ধরায় নেমে এসেছে—ফুটফুটে চাঁদ। ওদের যখন নিয়ে আসবো, আপনারা দেখে তাজ্জব বনে যাবেন। ভাববেন, কোনটাকে ছেড়ে কোনটাকে নিই। আচ্ছা, এখন আমি চলি, সন্ধ্যের আগেই সবাইকে নিয়ে হাজির হবো।

    সন্ধ্যে হতে না হতেই সে গুটি-পাঁচ মেয়েকে নিয়ে এলো।

    —এই নিন, এনে দিলাম। উল্টেপাল্টে দেখে নিন। হলফ করে বলতে পারি, এ মেয়েদের কেউই এর আগে কোনও পুরুষের ছায়া মাড়ায়নি। একেবারে আনকোরা—পবিত্র কুমারী। আর নষ্ট হবেই বা কী করে বলুন? বড় বড় আমিরের হারেমের মেয়ে এরা। সেখানে তো খাজা নফরের চোখে ফাঁকি দিয়ে কোনও আস্ত পুরুষ দূরে থাক, দুধের বালকও ঢুকতে পায় না।

    মুবারক বুড়ির এবং মেয়েদের অলক্ষ্যে আয়নাখানা এমনভাবে কায়দা করে ঘরের এক পাশে স্থাপন করে—যেখান থেকে মুবারক এবং জাইন ছাড়া অন্য কারুই চোখে পড়া সম্ভব নয়।

    এক এক করে এক একটি মেয়েকে এনে দাঁড় করানো হয় ওদের সামনে। মেয়েগুলোর সকলেই সত্যিই পরমাসুন্দরী কিন্তু আয়নার পরীক্ষায় কেউই পাশ করতে পারলো না। প্রত্যেকটি মেয়ের ছায়া পড়তেই দেখা যেতে লাগলো তাদের নগ্ন দেহবল্লরী। এবং সঙ্গে সঙ্গেই কাচখানা ঝাপসা হয়ে গেলো।

    মুবারক আফশোশ করে ওঠে, শোভন আল্লাহ, একি কাণ্ড! এই-ই কী আমির। বাদশাহর হারেম?

    মুবারক আর আসল কথা ফাঁস করলো না। শুধু বললো, বুড়ি মা, তোমার মেয়েরা সবাই ভালো, কিন্তু আমাদের সুলতান একটু অন্য ধাঁচের মেয়ে চাইছেন। সুতরাং তোমার মেয়েদের তুমি ফেরত নিয়ে যাও।

    বুড়ি কিন্তু নাছোড়বান্দা। বললো, ঠিক আছে, বুঝতে পারছি মহামান্য সুলতান অনেক উঁচুদরের সমঝদার। আমি এর পর কাল নিয়ে আসবো আরও সুন্দরী কন্যা–বিদেশী কন্যা।

    মুবারক অবাক হয়, বিদেশী কন্যা!

    বুড়ি বলে, হ্যাঁ, আমার খোঁজে সুদানী, বাদাবী, আরবী, মরোক্কো আর আবসিনিয়া প্রভৃতি অনেক জাতের, অনেক দেশের মেয়ে—পরমাসুন্দরী মেয়ে আছে।

    মুবারক বলে, ঠিক আছে, নিয়ে এসে দেখবো?

    বুড়ি বিদায় নিতে, জাইন বলে, এই যদি নমুনা হয়, তবে কোথায় পাওয়া যাবে সেই মেয়ে? আমি তো ভীষণ চিন্তায় পড়লাম।

    মুবারক বলে, আজ পাওয়া গেলো না বলে কাল পাওয়া যাবে না, তেমন নাও হতে পারে জাঁহাপনা।

    জাইন, প্রায় হতাশ হয়ে বলে, দেখুন।

    পরদিনও একই ফল দেখা গেলো। বুড়ি যাদের নিয়ে এলো, খেতে তাদের প্রায় সকলেই পরমাসুন্দরী, কিন্তু আয়নার পরীক্ষায় দেখা গেলো,কাচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অতএব বাতিল।

    বুড়ি হতাশ হয়। বসরাহর সুলতান মস্ত বড় মক্কেল, আশা করেছিলো, ভালো দাও মারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবই ফক্কা হয়ে গেলো।

    এর পর নিরাশ হয়ে জাইন আর মুবারক সিরিয়ার পথে যাত্রা করেন। মুবারক শুনেছিলো, সেখানে কিছু অসাধারণ রূপবতী কন্যা আছে এক সওদাগরের হেপাজতে। মেয়ে কেনা-বেচাই তার ব্যবসা। কিন্তু সাধারণ বাঁদী নিয়ে সে কারবার করে না।নবাব বাদশাহর রক্ষিতাদের পরিত্যক্ত কন্যা আতুড় থেকেই কিনে নিয়ে এসে লালন পালন করে। তারপর যখন ডাগর ডাসা হয়ে ওঠে, মোটা দরে বেচে দেয়।

    দামাসকাসে এসে একখানা সুন্দর চকমিলান বাড়ি ভাড়া করে মুবারক, সারা শহরে রটিয়ে দিলো, বসরাহর মহামান্য সুলতান অবসর বিনোদনের জন্য এখানে এসেছেন। তবে মনের মতো সুন্দরী মেয়ে পেলে তিনি হারেমের বাঁদী বেগম করেও নিয়ে যেতে পারেন।

    এই খবর রটে যাওয়া মাত্র নানা দিক থেকে নানা মেয়ের সন্ধান আসতে লাগলো। দামাসকাস পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর, (এই তথ্য ভুল। যতদূর মনেহয়, ভারতের কাশীই সবচেয়ে প্রাচীন) নানা দেশের নানা জাতের বাহারী সামগ্রী এখানে পাওয়া যায়। তার মধ্যে সুন্দরী নারীই প্রধান। বহু দূর থেকে সুলতান বাদশাহর দালালরা এখানকার বাঁদী-বাজারে আসে মেয়ে সংগ্রহ করতে। দুর্ধর্ষ বাদাবী দস্যুরা ডাকাতি রাহাজানী করে যে সব সুন্দরী মেয়ে নিয়ে আসে, তারও ভীষণ চাহিদা।

    মুবারক সব রকমই দেখতে লাগলো। কিন্তু না, কোনও মেয়েই ধোপে টেকে না। দেখতে অনেক পরীর মতো মেয়ে তারা পায়, কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড় করানো মাত্র সব বাতিল হয়ে যায়।

    জাইন হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে, ইয়া আল্লাহ, শেষ পর্যন্ত কী সেই ত্রিভুজ দ্বীপের বৃদ্ধের কথাই ঠিক হবে? সারা দেশে কী একটাও সতী নারী নাই? এমন ব্যভিচার ঢুকে গেছে আমাদের শোবার ঘরে?

    মুবারক বললো, তা হলে এবার চলুন বসরাহতেই যাই। অন্য কোথাও না থাক, আপনার নিজের হারেমের মেয়েরা তো অসতী হতে পারবে না! আমি তো জানি, আপনার বাবা—আমার মালিক, কড়া মানুষ ছিলেন। এমনভাবে হারেমগুলো তৈরি যে, বাইরের মাছি পর্যন্ত ঢুকতে পারে না সেখানে।

    —কিন্তু মুবারক ভাই, জাইন বলে, যতই দেখছি আমার চোখের পর্দা সরে যাচ্ছে। আমরা তো অনেক আমির বাদশাহর মেয়েও দেখলাম, আপনার কী ধারণা, তাদের হারেমগুলো সবই অরক্ষিত? আসল কথা, খারাপ হতে চাইলে, তাকে সিন্দুকে ভরে রাখলেও খারাপ সে হবেই। আপনি বলছেন বসরাহয় যেতে। আপনার ধারণা আমার হারেমের মেয়েরা একদম সাচ্চা আছে। আপনার কথা মানাই উচিত। কারণ আমার বাবা এবং আমি যে ভাবে হারেমগুলো বানিয়েছি, তাতে একটা সূচও গলে ভিতরে যেতে পারে না আমি জানি। কিন্তু আমার মনে দারুণ ভয় ঢুকেছে, মুবারক ভাই। সেই কারণেই আমি বসরাহ যেতে চাইছি না।

    মুবারক অবাক হয়, ভয়? ভয় কেন, জাঁহাপনা? ভয় কাকে?

    জাইন বলে, আরে না না সে সব ভয় নয়। ভয় আমার নিজেকে। আপনি তো জানেন, মুবারক ভাই, আমার বাবা ভীষণ গোঁড়া মানুষ ছিলেন। সেই কারণে তিনি বাছাই করে কোলের বাচ্চাকে কিনে নিয়ে আসতেন। এবং হারেমে লালন পালন করতেন ধাই পরিচারিকা দিয়ে। তারপর সে যখন ডাগর হয়ে উঠতো তখন তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতেন। প্রতি বছরই তিনি নতুন নতুন শিশুকন্যাদের কিনে আনতেন এবং প্রতি বছরই নতুন নতুন আনকোরা মেয়ের সঙ্গে সহবাস করতেন। বাবার মৃত্যুর পরও আমার হারেমের এই সুন্দর ব্যবস্থাটি চালু আছে। এখনও নিয়ম করে শিশুকন্যা কিনে আনা হয়। এবং নিয়ম করে কিশোরী কন্যার নথ খোলা হয়।

    কিন্তু সব দেখে শুনে আমার আর কোনও ভরসা হচ্ছে না। ধরুন যদি বসরাহয় যাই, এবং হারেমের একেবারে আনকোরা কুঁড়ি যাদের নথ এখনও আমি খুলিনি, তাদের পরীক্ষা করে যদি দেখি আয়না ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে-তাহলে? তাহলে তো আমার মাথায় খুন চেপে যাবে। জানি না, রাগের মাথায় হয়তো তামাম হারেমের দরজা পাট বন্ধ করে বাইরে থেকে আগুন লাগিয়ে দেব। না না-মুবারক ভাই, ঐ ভয়ঙ্কর সত্যকে আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে চাই না। তার চেয়ে ওরা যেমনভাবে দিন কাটাচ্ছে কাটাক। আমি অন্ততঃ এই সান্ত্বনা নিয়ে কাটাতে পারবো যে, আমার মেয়েরা সতীই আছে। ঐ নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি আমি দাঁড়াতে পারব না। তার চেয়ে চলুন, আমরা সোজা বাগদাদেই চলে যাই। শহরও বড়, খানাদানী লোকের বাসও বেশী। সুতরাং খুব-সুরত মেয়েও অনেক মিলবে। তারপর বরাতে যদি থাকে, আসলি চীজ হয়তো পেলেও পেয়ে যেতে পারি।

    জাইন-এর কথাবার্তায় আর তেমন কোনও উৎসাহ উদ্দীপনার আমেজ নাই। তার সারা জীবনের বিশ্বাস ধুলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, সাচ্চা মুসলমান মেয়েরা কখনও অসতী হয় না। আর তাদের এই যে পর্দা বোরখা এবং হারেমের কঠিন কড়া প্রহরার ব্যবস্থা—তামাম দুনিয়ার মধ্যে সেরা। এখানকার মেয়েরা খ্রীষ্টানদের মতো বেহায়া অসতী হতেই পারে না। কিন্তু এই আয়নাটা হাতে আসার পর থেকে তার সে-সব বিশ্বাস একেবারে মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। কত শত মেয়েকে তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন, কিন্তু হায়, একটি মেয়েও অক্ষত পাওয়া গেলো না!

    বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। জাইন বললে, মুবারক ভাই, আর কাল-বিলম্ব না করে চলুন, আমরা আজই বাগদাদে রওনা হয়ে যাই।

    মুবারক সেইদিনই বাগদাদে যাবার জন্য প্রস্তু হতে লাগলো।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো আটাশতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

    আল্লাহর কৃপায় কয়েকদিনের মধ্যে ওঁরা বাগদাদে এসে উপস্থিত হলেন। দামাস্কাসের মতো বাগদাদেও একখানা সুন্দর সাজানো গোছানো ইমারত ভাড়া করা হলো।

    টাইগ্রিসের উপকূলে একখানা বাগান বাড়ি। একদিকে স্রোতস্বিনী নদী প্রবাহিতা এবং অপর দিকে প্রকৃতির অপূর্ব শ্যামল শোভা। বড় মনোরম পরিবেশ।

    মুবারক প্রচার করে দিলো, বসরাহর পরম দয়ালু সুলতান এসেছেন দীন-দুঃখীদের দান ধ্যান করতে।

    প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি অগণিত দীন ভিখারী এসে সুলতানের খয়রাতি নিতে হাজির হয়।

    ওদের বাসার কাছেই এক গরীব ইমামের বাসা। লোকটা নিজে দরিদ্র। বোধ হয় সে কারণেই, ধনীর ঐশ্বর্যে খুব ঈর্ষাকাতর ছিলো। বড় লোকেদের এই সব দান খয়রাতি দু চোখে দেখতে পারতো না সে। মনে প্রাণে সে সবদিক থেকে দীন এবং ভীষণ কৃপণ। জাইনের এই ঢালাও দানসত্রের ব্যাপারটা সে আদৌ সহ্য করতে পারে না।

    মসজিদে নামাজ শেষে উপস্থিত ধর্মানুরাগীদের সে অনেক ভালো ভালো উপদেশের বাণী ছাড়ে নিয়ত। একদিন ইমাম সাহেব বললো, দেখ ভাইসাহেবরা, আমার বাড়ির পাশে জানি না কোন এক পরদেশী আমির এসে উঠেছে, সারাদিন ধরে শুধু লোকজনদের টাকা পয়সাই বিলিয়ে যাচ্ছে-দেদার। আচ্ছা বলতে পার, এই পয়সা সে পাচ্ছে কোথায়? আমার তো মনে হয়, কোনও ডাকাতের সর্দার পালিয়ে এসে পীর সেজে দান খয়রাতি করছে। ব্যাপারটা পরখ করে দেখা দরকার। তোমরা সকলে একটু সজাগ থাকবে। কদাচ তার ঐ খয়রাতির অর্থ গ্রহণ করবে না। শুধু তাই নয়, ধর্মের পীঠস্থান এই বাগদাদ শহরের বুকে বসে অসাধু চোর ডাকাত বদমাইশ যা খুশি তাই অনাচার চালিয়ে যাবে, তা তো হতে পারে না। পূর্বাহ্নেই ব্যাপারটা ধর্মাবতারের কর্ণগোচর করা সমীচীন মনে করি। তা না হলে পরে, কোনও গণ্ডগোল হলে আমাদের আর জবাবদিহি করার মুখ থাকবে না। খলিফা আমার ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে বলবেন, তোমার বাড়ির সামনে, তোমার নাকের ডগা দিয়ে এই ঘটনা ঘটে গেলো—নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল নাকি?

    তখন আমি কী বলবো? সুতরাং আর দেরি না করে সমস্ত ব্যাপারটা খলিফার গোচরে আনা দরকার। তারপর তিনি যা ভালো বোঝেন, করবেন, আমাদের আর কোন ঝুঁকি থাকবে না।

    ইমাম আবু বকর-এর কথা শুনে উপস্থিত সকলে সমস্বরে জানালো, ইমাম সাহেব যথার্থ উপদেশই দিয়েছেন। এই রকম একটা গুরুতর ব্যাপার অবশ্যই খলিফাঁকে জানানো দরকার।

    সেই সভাতেই সাব্যস্ত হলো, তারা সকলে মিলে খলিফার দরবারে গিয়ে ঐ পরদেশীদের সন্দেহজনক কার্যবিধি সম্পকে নালিশ জানাবে।

    এ-সব কথা মুবারকের কানে পৌঁছতে বেশি দেরি হলো না। জাইনকে সে বললো, মালিক, এই ইমাম আবু বকর লোকটা ভীষণ ঈর্ষাকাতর। সে তার দলবল নিয়ে ঘোঁট পাকাচ্ছে। খলিফা হারুন অল রসিদের কাছে আমাদের নামে নাকি মিথ্যে লাগানি ভাঙ্গানি করতে যাবে।

    জাইন বললে, এসব লোকের মুখ বন্ধ করার একটা সহজ উপায় আছে। আপনি শ’পাঁচেক দিনারের তোড়া নিয়ে ওর বাড়িতে যান। তাহলেই সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

    সেইদিনই সন্ধ্যেবেলায় মুবারক পাঁচশো দিনারের একটা তোড়া হাতে করে ইমাম আবু বকর-এর বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়লো।

    ইমাম দরজা খুলে মুবারককে দেখে না চেনার ভান করে বলে, কী চাই? কোত্থেকে আসছেন?

    মুবারক যথাবিহিত সালাম শুভেচ্ছা জানিয়ে বললো, আমার নাম মুবারক, আমার মালিক বসরাহর আমির জাইন এখন আপনার বাড়ির পাশে ঐ প্রাসাদে অবস্থান করছেন। খুব ধার্মিক মানুষ। সব সময় ধর্ম-কর্ম নিয়েই দিন কাটান। তিনি জেনেছেন, আপনি এখানকার মসজিদের ইমাম সাহেব। তাই কুণ্ঠিত চিত্তে এই পাঁচশো দিনারের একটা তোড়া আপনার চরণে নিবেদন করার জন্য আমার হাত দিয়ে পাঠিয়েছেন। আপনি যদি মেহেরবানী করে গ্রহণ করেন, তিনি কৃতার্থ হবেন। আপনার মতো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি সহবত করতে সদাই ব্যাকুল।

    আবু বকর দিনারের থলেটা হাতে নিয়ে ওজনটা অনুভব করে বোঝার চেষ্টা করে। তা শ’পাঁচেক হতে পারে।

    এতক্ষণে ইমাম সাহেবের খেয়াল হয়, দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে মুবারককে।

    —আরে কী কাণ্ড, এই রকম বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলবেন নাকি! আসুন, ভেতরে এসে বসুন, মেহেরবানী করে।

    হঠাৎ আতিথেয়তার ধূম পড়ে যায়। মুবারক ভিতরে গিয়ে বসে। চাকর এসে সরবতের গেলাস রেখে যায়। ইমাম বলে, নিন, একটু খেয়ে নিন।

    সরবতের গেলাসটা হাতে তুলে নিয়ে মুবারক বলে, আমার মালিকের সঙ্গে মোলাকাত হলে আপনি বুঝবেন, তিনি কত ধর্মপ্রাণ উদার মহৎ মানুষ, গরীবের দুঃখে সদা তার প্রাণ কাঁদে। আর ধার্মিক মানুষের সন্ধান পেলে তো আর কথাই নাই। নাওয়া খাওয়া ভুলে তার কাছে ছুটে যান উপদেশ বাণী শুনতে। আজকেও তিনি নিজেই আসতে চাইছিলেন, আমিই বললাম, আমি আগে তার কাছে যাই। অনেক কাজের মানুষ। তার সময় সুযোগ বুঝে আপনাকে নিয়ে যাবো।

    ইমাম বলে, তাতে কী? নিয়ে এলেই পারতেন? এর পরে যখন খুশি নিয়ে আসবেন তাকে। মহামান্য আমিরের জন্য আমার গরীবখানা সব সময়ই খোলা আছে।

    মুবারক বলে, ইমাম সাহেব কী আমাদের সুলতানের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন? ইমাম বলে, কেন, একথা বলছেন কেন?

    —না, মানে এই পাড়াপড়শীরা বলাবলি করছিলো আর কি?

    ও হো হো, বুঝেছি—বুঝেছি, দুষ্টলোকে লাগিয়েছে। বলেছে বুঝি যে, খলিফার কাছে আমরা খবর দেব? মানে-সে-সব কিছু না। আসল কথা কি জানেন, বাগদাদে এসেছেন, আপনারা মহামান্য ব্যক্তি, আপনাদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেটাও খলিফার দেখা ক্য। তাই ভেবেছিলাম, তাকে একবার জানাবো। কিন্তু এখন তো আর তার দরকার নাই। আপনার মুখ থেকেই তো সব শুনলাম। ওসব নিয়ে আপনারা কোনও ভাবনা করবেন না।

    মুবারক বললো, তাহলে কালই আমরা আবার ইমাম সাহেবের কাছে আসছি?

    —নিশ্চয়ই। যখন খুশি আসবেন। মহামান্য আমির যদি মেহেরবানী করে আমার দরজায় পায়ের ধূলো দেয় কৃতার্থ হবো।

    মুবারক চলে গেলো! পরদিন আবু বকর মসজিদে অন্য বক্তৃতা দিলো।

    —ভাই সাহেবরা, গতকাল আমি তোমাদের বলেছিলাম, ঐ পরদেশীরা হয়তো কোনও ডাকাতের দলের সর্দার হতে পারে। কিন্তু কালই আমি ভালো করে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওরা খুব শেরীফ মানুষ। বসরাহর সুলতান। অনেক ধন-দৌলত সঙ্গে এনেছেন। দু’হাতে বিলিয়ে দান-ধ্যান করে পুণ্য অর্জন করাই একমাত্র উদ্দেশ্য। ছিঃ ছিঃ, না জেনেশুনে এই রকম ধর্মপ্রাণ মানুষের সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে আমি খুব অন্যায় করেছি। যাক, কাল যা বলেছিলাম, আপনারা ভুলে যান।

    মসজিদের সামনেই দাঁড়িয়েছিলো মুবারক। ইমাম আবু বকর বেরিয়ে আসতেই সে সালাম জানিয়ে বললো, আমার মালিক আপনার দর্শনপ্রার্থী। মেহেরবানী করে বাড়ি ফেরার পথে একবার যদি আমাদের প্রাসাদে পায়ের ধুলো দেন—খুব আনন্দিত হবেন তিনি। আপনার দক্ষিণা বাবদ আর একটা তোড়া তিনি আলাদা করে রেখেছেন।

    তোড়ার কথা শুনে ইমামের চোখ চক্করে ওঠে। তা বেশ তো, চলুন না। দেখাটা করেই যাই।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো ঊনত্রিশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    ইমাম প্রাসাদে প্রবেশ করে জাইনকে কুর্নিশ করে। জাইনও যথারীতি প্রত্যভিবাদন জানিয়ে আসন গ্রহণ করতে বলেন।

    খানাপিনা সাজানো হয়। জাইন বলেন, মেহেরবানী করে কিছু গ্রহণ করুন।

    তিনজনেই খেতে বসে। ধীরে ধীরে আলাপ-সালাপ জমে ওঠে।

    ইমাম জিজ্ঞেস করে, মহামান্য আমির কী আমাদের শহরে কিছুকাল অবস্থান করবেন?

    জাইন বলে, হ্যাঁ মানে আমি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি এখানে। যতদিন না কাজ সমাধা করতে পারছি ততদিন তো থাকতেই হবে।

    ইমাম বলে, আপনার উদ্দেশ্যটা কী জানতে পারি? যদি আমাকে দিয়ে কোনও কাজ হয় আপনার, সানন্দে আমি করে দিতে পারি।

    জাইন বলে, আমার উদ্দেশ্য একটাই-শাদী করা। আপনি হয়তো বলবেন, আমি সুলতান, এ আর এমন কঠিন কী কাজ! হাত বাড়ালেই হাজারো মেয়ে পেতে পারি! তা পারি। এবং পরমাসুন্দরী মেয়েও পেতে পারি অনেক। কিন্তু আমার ইচ্ছা একটু অন্যরূপ।

    ইমাম ঠিক বুঝতে পারে না, কী রকম?

    জাইন জানান, আমি যাকে শাদী করবো নিশ্চয়ই সে পরমাসুন্দরী হবে। তার বয়স হবে পনের। এবং সব থেকে প্রথম কথা—প্রকৃত কুমারী হতে হবে তাকে। আচ্ছা এমন কোনও মেয়ের সন্ধান দিতে পারেন? আমি সারা মিশর-সিরিয়ার প্রতিটি শহর ঘুরে এসেছি। কিন্তু এই তিনটি গুণের সমন্বয় কোন কন্যার ভেতরে পাইনি। তাই বড় আশা নিয়ে এই বাগদাদে এসেছি। জানি না, আমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে কিনা।

    ইমাম বলে, হ্যাঁ। এ রকম মেয়ে পাওয়া খুবই শক্ত। হয়তো আপনি বুড়িগুলোকে ঘটকালীর জন্য বাড়িতে বাড়িতে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু আমার ধারণা তাতে কোনও সুবিধে হবে না। ঐ মেয়েছেলেগুলো যে-সব পাত্রীর সন্ধান দেবে তারা কেউই আনকোরা হবে না। তবে আমি আপনাকে একটি মেয়ের হদিশ দিতে পারি। যদি আপনি অনুমতি করেন, তাকে দেখাবার ব্যবস্থাও করতে পারি।

    মুবারক বলে, ইমাম সাহেব, আপনি কী সে মেয়ের সতীত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ? কিন্তু কী করেই-বা নিঃসন্দেহ আপনি হতে পারবেন? আপনি কী করে বুঝবেন, সে মেয়ের সতীচ্ছদ এখনও অটুট অক্ষত আছে? তা যদি না থাকে, অসূর্যম্পশ্যা হয়ে আজন্ম হারেমে বন্দী থাকলেও, প্রকৃত কুমারী থাকতে পারে না সে।

    ইমাম বলে, না আমি তাকে চোখে দেখিনি কখনও। আমি কেন, সারা বাগদাদের কোনও মানুষই তাকে দেখেনি। জন্মের পর থেকে সে হারেমের বাইরে আসেনি কখনও।এবং যে-ঘরের মেয়ে সে, আমি বাজি রেখে বলতে পারি, কোনও রকম অসৎ প্রবৃত্তি তার মনে জাগতে পারে না। আমার এই কথা যদি মিথ্যা প্রমাণিত হয়, আমি হলফ করছি, আমার এই ডান হাতখানা আমি কেটে ফেলবো। এখন আপনারা যদি গা-জোয়ারী করে বলেন, না সে কুমারী নয়—সে, এঁড়ে তর্কের মধ্যে আমি যাবো না। একথা তো ঠিক, শাদীর প্রথম রাত ছাড়া কুমারীত্বের পরীক্ষা করা সম্ভব না। আমার কথায় ভরসা করে আপনাকে শাদী করতে হবে। তারপর শাদীর পরদিন সকালে আমাকে বলবেন, তখন যদি বলেন, মেয়ে কুমারী ছিলো না। আমি আমার এই হাত তখুনি কেটে ফেলবো।

    আশ্চর্য আয়নার কথা তো কাউকে বলা যাবে না, জাইন মনে মনে ভাবেন, খুব সহজ ভাবেই তো পরীক্ষা করে নিতে পারবো। ঠিক আছে আগে সে দেখাকনা। ইমামকে বলেন, আপনার কথা একশোবার খাঁটি। শাদীর প্রথম রাত ছাড়া সত্যিই তাকে কী করে পরীক্ষা করা যাবে? যাই হোক, আপনি একবার দেখাবার ব্যবস্থা করুন পাত্রীকে। যদি তার রূপ দেখে পছন্দ হয়ে যায় তখন আপনার সঙ্গে বাজি লড়া যাবে। আমিও বাজি ধরছি, যদি সে মেয়ে সত্যিই প্রকৃত কুমারী হয়, দশ হাজার দিনারের একটি তোড়া আপনাকে ইনাম দেব। অবশ্য ইমাম সাহেব, আমি বাজিতে হারতেই চাই। কারণ বাজি জেতার চেয়ে একটি কুমারী-কন্যা পাওয়ার দিকেই আমার নজর বেশি।

    ইমাম বললো, ঠিক আছে আজই সন্ধ্যায় পাত্রীকে দেখাচ্ছি। তা হলে এখন আমি উঠি?

    বাগদাদের প্রধান ইমামের একটি পরমাসুন্দরী পঞ্চদশী কন্যা আছে। মেয়েটি রূপে-গুণে অতুলনীয়া। স্বভাবতই ইমাম-বাড়ির খানদান বহুজনবিদিত। সেবংশের ছেলেমেয়ে জন্মাবধি নম্র বিনয়ী এবং মিষ্টভাষী হয়। তাদের আদব-কায়দা আচার ব্যবহার আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। প্রধান ইমাম সাহেব নিষ্ঠাবান আল্লাহর উপাসক। তার মতো সত্যভাষী ধর্মাত্মা বাগদাদে আর দুটি নাই। এই সব সগুণের অধিকারী তার সন্তানরাও।

    ইমাম আবু বকর-এর সঙ্গে প্রধান ইমামের খুব ভাব ছিলো। প্রায়ই সে বলতো, আবু মেয়েটা লায়েক হয়ে উঠলো, এবার তো একটা পাত্র-টাত্র দেখতে হবে। কিন্তু কে আমার মেয়েকে শাদী করবে? আমরা তো পয়সাওলা মানুষ নই।

    আবু বকর বলেছিলো, আমি কোশিস্ করবো, মালিক। তবে মা জননীকে যে সে ফালতু লোকের হাতে দিলে হবে না। ও যে শাহজাদার বেগম হওয়ার যোগ্য হয়ে উঠেছে।

    প্রধান ইমাম বলে যোগ্যতা থাকলেই তো হবে না আবু, ভাগ্য থাকা দরকার। নসীবে যা লেখা আছে, তার বাইরে তো কিছু হবে না।

    আবু বকর সোজা প্রধান সাহেবের বাড়িতে চলে আসে। এই অসময়ে আবু বকরকে তার বাড়িতে আসতে দেখে ইমাম সাহেব একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী খবর আবু, কোনও দুঃসংবাদ আছে নাকি?

    -জী না, মালিক। আজ শুভ সংবাদ এনেছি। মা জননীর জন্য একটি বহুত খানদানি আমির পাত্র দেখে এসেছি। আপনার মেয়ের রূপ-গুণের কথা শুনে তিনি পাত্রী দেখতে চেয়েছেন। আমার তো মনে হয়, মাকে দেখে সুলতানের অপছন্দ হবে না।

    -তা কোথাকার সুলতান?

    –বসরাহর। নাম জাইন। খুব সুন্দর নওজোয়ান যুবক। শুধু ধনদৌলত আছে, তা নয়, সৎ, আদর্শ চরিত্রের মানুষ তিনি। ধর্মে মতি আছে খুব। মানাবে ভালো। আপনি যা দেন-মোহর চাইবেন দিতে তার কোনও অসুবিধে হবে না। সুলতান জানিয়েছেন, মেয়েকে তিনি একটিবার স্বচক্ষে দেখবেন। তা তাকে অসভ্য সাজ-পোশাক পরে দাঁড়াতে হবে না, খুব মার্জিত রুচির ইজার বোরখা পরে সে দাঁড়াবে। আপনি যদি মত করেন আজই দেখাতে পারি তাকে।

    প্রধান ইমাম সাহেব ভাবতে থাকেন, তার খানদানের মেয়ে কখনও পর পুরুষের সামনে দাঁড়ায়নি। শাদীর আগে কেউ দেখতেও চায়নি। কিন্তু আজ অন্য প্রশ্ন। এ পাত্র সাধারণ মানুষ নন—স্বয়ং সুলতান। সুতরাং তার ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রশ্নই বড় কথা। যাই হোক, অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে ইমাম সাহেব মত দিলেন, ঠিক আছে, আমার আপত্তি নাই। দেখাও তাকে।

    বিবিকে ডেকে তিনি বললেন, আবু বকর একটি সুপাত্রের সন্ধান এনেছে, স্বয়ং সুলতান। এমন পাত্র হাতছাড়া করা যায় না। তুমি লতিফাঁকে নিয়ে আবু বকর-এর সঙ্গে চলে যাও, পাত্রর প্রাসাদে দেখিয়ে এসো তাকে। পছন্দ হলে মেয়েটা বেগম হয়ে সুখে কাটাবে।জানি না ওর নসীবে কী লিখেছেন তিনি।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো ত্রিশতম রজনী?

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    প্রথম দর্শনেই অভিভূত হয়ে পড়ে জাইন। রূপে সে হুরী, সেকথা খুব বড় নয়। চেষ্টা চরিত্র করলে অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে কিছু পাওয়া যায়। ইদানীং দেখলেনও অনেক, কিন্তু সারা মুখে চোখে এমন নিস্পাপ নির্মল অভিব্যক্তি অন্য কোনও মেয়ের মধ্যে এ যাবৎ তিনি কখনও প্রত্যক্ষ করেননি।

    যাই হোক, মুবারক আগে থেকেই আয়নাটা যথাস্থানে আড়াল করে বসিয়ে রেখেছিলো এক জায়গায়। মেয়েটিকে যেখানে দাঁড় করানো হবে সেখান থেকে আয়নায় তার পুরো দেহের ছবি প্রতিবিম্বিত হতে পারবে—অথচ তারা দুজনে ছাড়া ঘরে অন্য কেউ দেখতে পাবে না।

    লতিফা ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। জাইন দেখেন, মেয়েটির বোরখাইজার সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠলো। অপূর্ব নিখুঁত দেহবল্লরী। নিখাদ নিভাজ। এমন সুচারু দেহ সৌন্দর্য জাইন কখনও কোনও বাঁদী বেগমের দেহে দেখেনি।

    বেশ অনেকক্ষণ আড়চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে জাইন। কিন্তু আয়না তো ঝাপসা হয়ে ওঠে না। একি অবিশ্বাস্য কাণ্ড! স্থানকাল পাত্র ভুলে গিয়ে আনন্দের আতিশয্যে লাফিয়ে ওঠে জাইন, মুবারক ভাই। বাজীমাৎ

    অর্থাৎ আসল মেয়ে পাওয়া গেছে। একেবারে নিখাদ প্রকৃত সুন্দরী। সুতরাং সেই রাতেই যথারীতি শাদী করলেন জাইন। লতিফা জাইন-এর বেগম হয়ে গেলো।

    পরদিন সকালে মুবারক প্রধান ইমামকে বললেন, মহামান্য সুলতান স্বদেশে ফেরার জন্য আকুল হয়ে উঠেছেন। আজই আমরা রওনা হতে চাই।

    -শাদীর পর মেয়ে শ্বশুরের ঘরেই যাবে। ইমাম সাহেব ম্লান হাসলেন।

    এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। সেইদিনই মুবারক ও জাইন লতিফাঁকে সঙ্গে নিয়ে আবার ত্রিভুজ দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো। এবং অনেক দিনের দুর্গম যাত্রাপথ অতিক্রম করে অবশেষে এসে পৌঁছলো সেই বৃদ্ধের প্রাসাদ সম্মুখে।

    বৃদ্ধ পরীক্ষা করে দেখে বললেন, ঠিক আছে তোমার ওয়াদা পূরণ করেছ। আমার ওয়াদাও পূরণ অবশ্যই করবো। যাও, নিজের দেশে প্রাসাদে ফিরে যাও। আমিশূন্যপথে তোমাদের অনেক আগেই পৌঁছে দেব সপ্তম হীরক কন্যাকে।

    মুবারক ও জাইন বিদায় নিয়ে চলে যায়। লতিফা কাঁদতে থাকে। এইভাবে তাকে নির্বাসন দেবার জন্যই কী সুলতান তাকে শাদী করেছিলো সেদিন।

    বসরাহর প্রাসাদ।

    অনেকদিন একটানা পথ চলার পর একদিন জাইন পৌঁছে গেলেন নিজের প্রাসাদে। পৌঁছে দ্রুত পায়ে তিনি গুপ্ত ধনাগারে নেমে যান। বৃদ্ধ বলেছিলো, সপ্তম হীরক-কন্যাকে ছয় পুতুলের পাশে রেখে যাবে।

    কিন্তু এ কী! দরজা খুলতেই দেখলেন জাইন, বৃদ্ধের পাশে লতিফা। হাসতে হাসতে বৃদ্ধ বললল, এই সেই সপ্তম হীরক-কন্যা, জাইন। হাজার হীরক কন্যার চেয়েও পরম মূল্যবান রত্ন। একে জীবনসঙ্গিনী করে তুমি সুখী হও এই আশীর্বাদ করে আমি বিদায় নিচ্ছি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : জয়ন্ত সিং)

    October 27, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    October 27, 2025

    নৌকাডুবি

    October 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }