Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ৩.১৬.২ আলাদিনের চেরাগ (পার্ট ২)

    সাতশো চল্লিশতম রজনীতে আবার সে গল্প শুরু করে :

    ছোটোবেলা থেকে সে যাদুবিদ্যা ও জ্যোতিষ শাস্ত্র শিক্ষালাভ করে অনেক অলৌকিক কায়দা কৌশল আয়ত্ত করতে পেরেছিলো। গণনায় সে জানতে পেরেছিলো এই পাহাড়ের নিচে এক আশ্চর্য যাদু চিরাগ আছে। সেই চিরাগ হস্তগত করতে পারলে, দুনিয়ার তাবৎ ধন-সম্পদের সে মালিক হতে পারবে।

    গণনায় জানতে পাওয়ার পরই সে মরোক্কো ছেড়ে সুদূর এই চীন দেশে পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁচেছিলো। এবং গণনায় এও পরিষ্কার জানতে পেরেছিলো, মুসতাফার পুত্র আলাদিনের নামেই সে চিরাগ বরাদ্দ করে রেখেছেন আল্লাহ। কিন্তু খোদার এই লিখন সে ভণ্ডুল করে আলাদিনকে দিয়েই চিরাগবাতি নিজের কজায় আনতে চেয়েছিলো। কাজটা নির্বিঘ্নে সমাধাও হয়ে এসেছিলো। আলাদিন চিরাগটা এনেছিলো। কিন্তু ওর নিজেরই ভয় হলো, ওপরে উঠে যদি সে চিরাগটা না দেয়। যদি বলে, আমি কষ্ট করে এনেছি, তোমাকে দেব কেন? তাই তো সে ওকে দু’টো থাপ্পড় মেরে কেড়ে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আলাদিন যে নিচে গড়িয়ে পড়ে যাবে তা ভাবতে পারেনি। গুহার নিচে নামার তার এক্তিয়ার নাই। আল্লাহর নির্দেশে এটা তার কাছে নিষিদ্ধ এলাকা। তাই সে তাকে চিরকালের মতো সমাধিস্থ করে রেখে দিলো। এখন সেই গুহার মধ্যে অনাহারে শুকিয়ে শুকিয়ে মরুক।

    মূর ঠিক করলো সে আর এদেশে থাকবে না, তার স্বদেশ অফ্রিকাতেই সে ফিরে চললো।

    এখানকার মতো যাদুকর মূরের কথা মুলতুবী রাখছি। যথাসময়ে আবার আমরা তার কথায় ফিরে আসবো।

    আলাদিন গুহার নিচে বসে যখন ভাবছিলো চাচা ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তার রাগ কিছুটা প্রশমিত হলে সে উপরে উঠে যাবে, সেই সময় বুঝতে পারলো গুহাটা দুলছে। ভয়ে সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করলো। কিন্তু গুহার মুখে পাথরের চাইখানা চাপা দেখে হতাশায় ভেঙ্গে পড়লো। প্রাণপণ শক্তিতে নড়াবার চেষ্টা করলো, কিন্তু একতিলও নড়াতে পারলো না। চিৎকার করে সে ডাকতে থাকলো, চাচা, আমাকে উপরে উঠতে দিন। এই নিন আপনার চিরাগবাতি।

    কিন্তু কে শুনবে তার আর্ত-আহ্বান? মূর তখন সেখান থেকে বহু দূরে চলে গেছে। আলাদিন বুঝতে পেরেছিলো, লোকটা আসলে তার চাচা নয়। হতে পারে না। কারণ কোনও চাচা তার ভাইপোকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি গালাজ করে না। নিশ্চয়ই সে কোন শয়তান যাদুকর। তাকে দিয়ে কার্য সিদ্ধি করে নিতে চেয়েছিলো।

    এখন সে কী করবে? কী করে এই পাতালপুরীর কয়েদখানা থেকে উদ্ধার পাবে, কিছুই ভাবতে পারে না। বাগানের দিকে যেতে চায় কিন্তু সে দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ধাক্কা-ধাকি করেও খুলতে পারলো না। তাই নিরুপায় হয়ে আবার ফিরে এসে গুহার সিঁড়ির মুখে বসে বসে কাঁদতে লাগলো।

    মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, এই গুহার মধ্যেই সে তিলে তিলে শুকিয়ে মরবে। আর সে তার মার কাছে ফিরে যেতে পারবে না। ফিরে যেতে পারবে না তার আত্মীয় বন্ধুদের মাঝে। একবিন্দু জল একটুকরো রুটির অভাবে তাকে—প্রাণ দিতে হবে। অথচ তার ধারে কাছে কত সোনা। এখানে তার কানা কড়িও দাম নাই।

    আসন্ন মৃত্যুর ভয়াল ছায়া তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মরতে তাকে হবে।-ইয়া আল্লাহ এ কী করলে তুমি? কী এমন পাপ করেছিলাম, যার সাজা এইভাবে আমাকে পেতে হবে?

    আলাদিন পাথরের দেওয়ালে মাথা কুটতে থাকে। কিন্তু আল্লাহ বড় অকরুণ। তার এতো কাকুতি-মিনতি তিনি কর্ণপাত করলেন না।

    তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।নিশ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে। আলাদিন হাতের তালু দিয়ে বুক গলা ঘষে কষ্টাটা কিছু লাঘব করতে চায়। হঠাৎ তার হাতের আংটির সঙ্গে বুকে ঘষা লাগতেই এক কাণ্ড ঘটে গেলো।

    বিশাল আকারের এক আবলুস কালো আফ্রিদি দৈত্য এসে দাঁড়ালো আলাদিনের সামনে।

    —আমি স্থল জল এবং অন্তরীক্ষের অধিপতি, আমার অসাধ্য কিছুই নাই। কিন্তু আমি ঐ আংটির দাস। এখন আংটিটা আপনার হাতে—তাই। আমি আপনার আজ্ঞাবহ। বলুন মালিক, কী চান আপনি?

    অন্য সময় হলে দৈত্যের এই বিকটাকৃতি দেখে আলাদিন মুছা যেত, কিন্তু এখন সে মৃত্যুভয়ে ভীত নয়। সে ধরেই নিয়েছে, আজ হোক, কাল হোক তাকে মরতেই হবে। সুতরাং আফ্রিদিকে দেখে সে ভাববে কেন?

    —এই মুহূর্তে আমি এই গুহার নির্বাসন থেকে মুক্ত হয়ে মাটির উপরে যেতে চাই।

    আফ্রিদি বললো, এখুনি আপনার হুকুম তামিল করছি, মালিক।

    মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো, আলাদিন দেখলো, দৈত্যটার মাথার ওপর থেকে পাথর সরে গেলো। এবং তৎক্ষণাৎ আলাদিনকে তুলে নিয়ে সে উপরে চলে এলো।ঠিক যেখানে মুর যাদুকর কাঠের ধূনী জ্বালিয়েছিলো সেখানে বসিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো সে।

    আলাদিনের সে কী আনন্দ! প্রাণভরে সে নিশ্বাস টানলো। ওপরে তাকিয়ে দেখলো, লক্ষ-কোটি তারকা-খচিত সুন্দর নীল আকাশ। মৃদুমন্দ সমীরণ বইছিলো। আলাদিন বাঁচার আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো।

    পাহাড় থেকে বাড়ির পথ অনেকটা। কিন্তু তখন সে খিদে-তৃষ্ণা ভুলে ছুটে চললো বাড়ির দিকে। যখন বাড়ির দোরগড়ায় পৌঁছলে, তখন রাত অনেক। মা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছেলের আগমন প্রতীক্ষা করছিলো। আলাদিনকে ঐভাবে ফিরতে দেখে আকুল হয়ে ছুটে গিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলো সে।

    -এতো রাত হলো কেন রে? আমি ভয়ে মরি, তোর কী মায়ের কথা একটুও মনে ছিলো না বাবা!

    আলাদিনের তখন কথা বলার অবস্থা নাই, শুধু বলতে পারলো, মা, পানি–

    তাড়াতাড়ি এক বদনা জল এনে ছেলের মুখে ধরে মা। আলাদিন ঢক ঢক করে প্রায় পুরো বদনাটাই নিঃশেষ করে দেয়। তারপর নেতিয়ে শুয়ে পড়ে দরজার পাশেই।

    মা গায়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে। সেই মুহূর্তে ছেলেকে আর জিজ্ঞাসাবাদ করে না।

    বেশ কিছুক্ষণ পরে আলাদিন চোখ খোলে, মা, বড্ড খিদে পেয়েছে, খেতে দাও।

    ঘরে যা ছিলো এনে দেয় সে। আলাদিন আর ধৈর্য রাখতে পারে না। গোগ্রাসে খেতে থাকে। মা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে, সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি, বাবা?

    আলাদিন কোন রকমে মুখের খাবার গিলে নিয়ে বলে, সেই সকালে দু-একটা ফল খেয়েছিলাম। তারপর আর জোটেনি কিছু।

    মা বললো, বুঝেছি, খুব খিদে পেয়েছে। তা অত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? ধীরে-সুস্থে খা।

    অমনভাবে খেলে, গলায় আটকে মরবি যে?

    আলাদিন বলে, তুমি কিছু ভেবো না মা। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। আগে পেট ভরে খেতে দাও।

    -কেন, তোর চাচা খেতে দেয়নি কিছু?

    –চাচা? কে চাচা? লোকটা একটা ধাপ্পাবাজ শয়তান যাদুকর। ও জাতে মূর, কোন কালেও আমার চাচা না।

    মা আঁৎকে ওঠে, ওমা বলিস কী? তবে যে সে বলেছিলো তোর বাবার মায়ের পেটের ভাই। তিরিশ বছর আগে দেশ থেকে বিবাগী হয়ে গিয়েছিলো?

    —সব ধাপ্পা মা, সব ধাপ্পা। আমাকে দিয়ে কাজ হাসিল করার জন্যে সে ঐরকম বাহানা করে আমাদের ঘরে ঢুকেছিলো।

    মা অবাক হয়ে বলে, কাজ হাসিল করার জন্য? তা তোকে দিয়ে তার কোন উপকার হবে? কী এমন কাজ করে দিতে পারিস তুই।

    আলাদিন তখন সব কথা মাকে খুলে বলে। কীভাবে সে তাকে পাহাড়ের উপত্যকায় নিয়ে গিয়েছিলো, কীভাবে মন্ত্রবলে সে পাহাড় বিদীর্ণ করে ফেলেছিলো এবং কেমন করে আলাদিন তার কথামতো সেই চিরাগবাতিটা আনতে পেরেছিলো—সব কাহিনী সবিস্তারে সে মাকে খুলে বললো।

    মা তো শুনে থ। এমন সব ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা যে হতে পারে বিশ্বাসই হতে চায় না তার। বলে, সামান্য একটা চিরাগবাতির জন্য তোকে ঐ পাতালপুরীতে নামিয়ে দিয়েছিলো লোকটা? কই, কোথায় সে চিরাগবাতি?

    আলাদিন এবার বুকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে-ঢুকিয়ে ঐসব হীরে চুনি পান্না মুক্তোর ফলগুলো এক এক করে বের করতে থাকে।

    মা অবাক হয়ে বলে এগুলো কী? এতো দেখছি সব খেলনার জিনিস! তোর চিরাগ কই?

    আলাদিন বলে, সবুর কর সব বের করি, তারপর ওটাও বের করবো। একেবারে পেটের নিচে পড়ে আছে।

    একটা ছোট্ট তামার চিরাগবাতি। মা দেখে বলে ওমা, এর জন্য এতো কাণ্ড। দাম তো এক আধলাই হবে!

    আলাদিন ঘাড় নেড়ে বলে, আমারও তো তাই ধারণা মা। কিন্তু বুঝলাম না, লোকটা এই তুচ্ছ একটা জিনিসের জন্য কেন আমাকে ঐ গুহার মধ্যে পাঠিয়েছিলো? আর কেনই বা সে আমাকে ঐভাবে পাথর চাপা দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলো, তাই বুঝতে পারছি না আমি। অথচ দেখ, আমার জন্য আমাদের সংসারের জন্য কত পয়সাই না সে খরচাপাতি করলো? জানি না এই তামার চিরাগটা দিয়ে তার কী উপকার হতো?

    মা বলে, ওসব যাদুকররা ঐরকম হয়। শুনেছি, অল্প বয়সী ছেলেদের ওপর ওদের খুব নজর। তুকতাক করার জন্যে নাকি উঠতি বয়সের ছোকরার দরকার হয়। যাক বাবা, জান নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে পেরেছিস, সেই তোর চৌদ্দপুরুষের ভাগ্যি। নে, এখন ঘুমিয়ে পড়।

    পরদিন সকালে আলাদিন বললো, মা খেতে দাও।

    মা-এর মুখ কালো হয়ে গেলো। ঘরে যা ছিলো কাল রাতেই তো সব শেষ হয়ে গেছে!বললো বাবা আর তো কিছু নাই। দাঁড়া দেখি মহাজনের কাছ থেকে কিছু ধার-কর্জ পাই কিনা। পেলে কিছু কিনে নিয়ে আসবো।

    আলাদিন বললো, মা ঐ চিরাগটা বেচলে একটা আধলা দিরহামও তো মিলতে পারে। ওটা সঙ্গে নিয়ে যাও না, ধার যদি না পাও,তবে খালি হাতে ফিরতে হবে না। বিক্রি করে যা-পাও তাই দিয়ে যাহোক কিছু একটা আনতে পারবে।

    মা-বলে, ভালো কথা বলেছিস বাপ। ওটা সঙ্গেই নিয়ে যাই। অমন চিরাগ ঘরে রেখে কী ফয়দা হবে। তার চেয়ে বেচে দিলে আধ দিরহাম তত মিলতে পারে! কই দে দেখি চিরাগটা!

    আলাদিন ঘর থেকে চিরাগবাতিটা এনে দেয় মা-এর হাতে। বলে, এক কাজ কর মা, খানিকটা ছাই দিয়ে মেজে ঘষে সাফ করে নাও। তামার জিনিস মাজলে একটু চক চক করবে। খদ্দেরের নজরে ধরলে হয়তো পুরো একটা দিরহামই পেয়ে যেতে পারো।

    মা বলে, তা মন্দ বলিসনি আলা।

    রসুইখানায় গিয়ে আলাদিনের মা উনুনের ছাই নিয়ে চিরাগটা মাজতে বসে যায়। একটা ঘষা দিতেই বিরাট এক আফ্রিদি দৈত্য এসে হাজির হয় সামনে। আলাদিনের মা তো সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে বিকট এক চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেয়?

    আলাদিন ছুটে এসে রান্নাঘরের মাঝখানে দণ্ডায়মান আফ্রিদিকে দেখে আঁৎকে ওঠে, কিন্তু মূছা যায় না। কাল রাতে পাহাড়ের গুহায় সে এই রকমই আর একটা আরও কুৎসিত আফ্রিদির মুখোমুখি হয়েছিলো। তাই ভয় অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে।

    আলাদিনের আর বুঝতে কষ্ট হলো না, ঐ চিরাগের অলৌকিক ক্ষমতায় এই আফ্রিদির আবির্ভাব ঘটেছে। তাড়াতাড়ি সে চিরাগবাতিটা হাতে তুলে ও নিয়ে আফ্রিদিকে প্রশ্ন করে, তুমি কে?

    আফ্রিদি বিশাল বুকটা সামনের দিকে নুইয়ে অভিবাদনের ভঙ্গী। করে বলে, আমি জল স্থল অন্তরীক্ষের অধীশ্বর। কিন্তু আমার ঈশ্বর ঐ ৩ চিরাগবাতি। সে এখন আপনার হাতের মুঠোয়। সুতরাং আমি ®িচ্ছ আপনার দাসানুদাস, আজ্ঞা করুন প্রভু, কী করতে হবে?

    আলাদিন বললো, কিছু খাবার-দাবার নিয়ে এসো।

    পলকে অদৃশ্য হয়ে গেলো দৈত্যটা। কিন্তু তা পলকের জন্যই। আবার তাকে দেখা গেলো এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে তার বিরাট একখানা রূপোর বারকোস। তার ওপর বারখানা সোনার থালায় সাজানো নানারকম সুগন্ধী সব খানাপিনা। বারকোসখানা মেঝেয় নামিয়ে দিয়ে সে আবার অদৃশ্য হয়ে গেলো।

    মা তখনও মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলো। আলাদিন চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিতে চোখ। মেলে তাকালো সে। তখনও তার ভয়,,, দৈত্যটা বুঝি ধারে-কাছেই রয়ে এ গেছে। এদিক ওদিক ভালো করে সে দেখতে লাগলো।

    আলাদিন হাসতে হাসতে বলে, নাও ওঠ। তুমি ভয় করছো, দৈত্যটা তোমার গলা টিপে ধরবে? না না, ওসব কিছু সে করবে না। ওঠ, এখন সে চলে গেছে।

    মা উঠে বসে। ঘরের মেঝেয় বিরাট একটা রূপোর বারকোসে সাজানো নানারকম খানাপিনা দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, এ সব কী? কে আনলো আলাদিন?

    -আবার কে? ঐ আফ্রিদি দৈত্য, যাকে দেখে তুমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। সে দেখ কত সুন্দর সুন্দর খাবার-দাবার নিয়ে এসেছে আমাদের জন্য? নাও, এসো খেতে বসি। বেশ গরম আছে, দেখছো না কেমন ধোঁয়া ছাড়ছে।

    মা-এ পো-এ খুব রসিয়ে রসিয়ে খায়। কতকাল এসব খানাপিনা চোখে দেখিনি তারা। অন্যের বাড়ি শাদী নিকায় নিমন্ত্রণ হলে তবে এরকম দু-একটা পদ হয়তো বরাতে জোটে। না হলে গাঁটের কড়ি খরচ করে কেউ এমন বাহারী খাবার বানায় না।

    মা বলে, এতো খাবার তো তিন বেলা খেয়েও শেষ করতে পারবো না আমরা। আর এমন দামী খানাপিনা ফেলে দিতেও মায়া লাগে। তার চেয়ে আর্ধেকটা কালকের জন্যে তুলে রেখে দিই, কী বলিস?

    আলাদিন বলে, তাই দাও। আচ্ছা মা, এই থালাগুলো দেখছো, কেমন সোনার মতো চক চক করছে।

    মা বললো, পিতলের বাসন যত্ন করে ঘষা মাজা করে রাখলে সোনার মতই মনে হয়, বাবা।

    সেই কালিয়া, কোর্মা কাবাব, বিরিয়ানী, তন্দুরী প্রভৃতি উপাদেয় খাবারগুলো ওরা দুদিন ধরে ভুরিভোজ করে খেলো। তৃতীয় দিন সকালে আবার যে কে সেই অবস্থা। ঘুরে ফুটো পয়সা নাই। আলাদিন বলে, আবার আফ্রিদিকে ডাকি মা? আবার সে খাবার-দাবার দিয়ে যাবে।

    মা শিউরে ওঠে, না না, বাবা, ও সবের দরকার নাই। ওই সব জীন দৈত্য আমি সহ্য করতে পারবো না। আমাদের পয়গম্বর মহম্মদ (আল্লাহ তাকে অমর করুন) এসব একদম পছন্দ করতেন না। আফ্রিদি দৈত্য বা অলৌকিক যাদু ভেল্কী থেকে তিনি শত হাত দূরে থাকতে বলেছেন। কারণ ওগুলো শয়তানের আধার। তুই বরং এই সব রেখে অন্য কোনও ধান্দা দেখ বাবা, কিছু রোজগারপাতি করার চেষ্টা কর।

    একখানা থালা কামিজের তলায় পেটে গুজে আলাদিন বাজারে চলে আসে। ওপাশে একটা বিধর্মী ইহুদীর দোকান। লোকটার তেজারতি কারবার। ওর দোকানেই ঢুকে পড়ে সে। লোকটাকে দেখতে ঠিক রক্তচোষা কাকনাসের মতো। একেবারে হাড্ডিসার চেহারা। চোখ দুটো কোটরে-বসা শকুনের মতো লোলুপ।

    –আইয়ে আইয়ে বইঠিয়ে, জনাব। বলুন, কী উপকারে লাগতে পারি আপনার?

    আলাদিন সঙ্কুচিতভাবে থালাটা বের করে ইহুদীর হাতে দেয়। ইহুদীটা থালাটার দিকে দৃষ্টিপাত করেই আলাদিনের আপাদ মস্তক নিরীক্ষণ করতে থাকে। চোরাই মাল কিনা বুঝতে পারে না। কষ্টিপাথর থালায় ঘষে সোনার মান যাচাই করে বলে, কত হলে দেবে?

    আলাদিন কী বলবে, কী দাম হতে পারে, ও বুঝবে কী করে? বলে, আপনিই তো ভালো বুঝবেন, দরাদরির কি আছে। যা উচিত দাম হয়, দিন।

    অনেক ইতঃস্তত করার পর ইহুদীটা একটা সোনার দিনার তুলে দেয় আলাদিনের হাতে। আসলে থালাটার দাম কম করে হলেও দুশো দিনার হবে। কিন্তু লোকটা বুঝতে পেরেছে, ছেলেটা এর আসল কিমৎ জানে না।

    পুরো একটা দিনার হাতে পেয়ে আলাদিনের চোখ চকচক করে ওঠে। দিনারটাকে মুঠি করে চেপে ধরে ইহুদীটাকে আদাব জানিয়ে সে রাস্তায় নেমে হন হন করে হেঁটে বাজারের অন্য প্রান্তে চলে যায়। ইহুদী স্যাকরাটা চুক চুক করে পস্তাতে পস্তাতে কপাল চাপড়ায়।

    -ইস, আধ দিনার দিলেই চলতো, কেন একটা গোটা দিনার দিতে গেলাম—

    দিনারটা ভাঙ্গিয়ে আলাদিন কিছু খানাপিনা কিনে বাড়ি ফিরে এসে মাকে বলে, জান মা বাজারের ঐ ইহুদীটা কত ভালো, থালাখানা নিয়ে সে পুরো একটা দিনারই দিয়ে দিলো! এই নাও বাকী টাকা।

    মা হেসে বললো, তুমি কচি ছেলে। দেখতেও তো শাহজাদার মতো—তাই বুড়ো তোকে ভালোবেসে বেশি পয়সা দিয়েছে।

    দিনারটা ফুরিয়ে গেলে কয়েকদিন পরে আর একখানা থালা পেটে গুঁজে গায়ে চাদর জড়িয়ে আলাদিন আবার সেই ইহুদীর দোকানে আসে। ইহুদী জুল জুল চোখে আলাদিনের চাদর ঢাকা পেটের দিকে তাকায়, আজ কী আছে, জনাব?

    আলাদিন থালাখানা বের করে দেয়। বুড়োটা আবার একটা দিনার বের করে দেয়। ভাবে, গত দিনই চালে ভুল হয়ে গেছে, আজ আর একই মালের জন্য কম দেওয়া যাবে না।

    এইভাবে কয়েকদিন বাদে বাদে এক একখানা করে থালা এক এক দিনারের বিনিময়ে ইহুদীটার দোকানে বেচে দেয় আলাদিন। সেই পয়সায় চলে যায় বেশ কিছুদিন।

    কিন্তু বেশ কিছুদিন একদা শেষ হয়ে আসে। গৃহে আহার্যের অভাব দেখা যায়। মা-এর মুখ শুকিয়ে যায়। আলাদিন বলে, ঐ চাদীর বারকোসটাও বেচে দিয়ে আসি মা। কী হবে ও জিনিস ঘরে রেখে? পেটে খিদে রেখে ঘরে সোনা রূপা জমা করে রেখে কী ফয়দা?

    মা, বলে জিনিসটা বড় বাহারী। তা ভেদ করে আর কী হবে, যা নিয়ে যা। দেখ, কী পাওয়া যায়।

    ইহুদী পুরো দু’টো সোনার মোহর দিলো আলাদিনকে। বললো, আমার কাছে এলে ন্যায্য দাম পাবেন, জনাব। অন্য দোকানে যাচাই করার আগে আমার কাছে একবার আসবেন, মোসেস-আরন-এর নামে কসম খেয়ে বলছি ঠকবেন না।

    আলাদিন বলে, সেইজন্যেই তো সোজা আপনার কাছেই আসি। আচ্ছা, আজ চলি।

    শেষ সম্বল দুটি মোহরও কয়েকদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়। আলাদিন মাকে বলে, মা তোমার ভয় ডর একটু কমাও তো, না খেয়ে তো মরা যাবে না, আমি আবার ঐ আফ্রিদিকে ডাকছি একবার। না হলে চলবে কী করে?

    মা বললো, ঠিক আছে, আমি একটু পাশের বাড়িতে বেড়িয়ে আসি। তুমি যা ভালো বুঝিস, কর।

    মা চলে গেলে আলাদিন চিরাগবাতিটা বের করে একটা ঘষা দিতেই আবার সেই আফ্রিদিটা এসে সালাম ঠুকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

    —আমি জল স্থল অন্তরীক্ষের অধীশ্বর। কিন্তু আমার ঈশ্বর ঐ চিরাগ। সে এখন আপনার কজায়। সুতরাং আমি আপনার দাসানুদাস, আজ্ঞা করুন প্রভু।

    আলাদিন বলে, আরও কিছু খানাপিনা নিয়ে এসো।

    পলকের মধ্যে আবার সে ঠিক আগের মতো একখানা চাদীর বারকোস এনে নামায়। তার উপরে বারখানা সোনার থালায় সুগন্ধী সব মন-মাতানো খাবার দাবার।

    দুদিন ধরে খুব চব্য চোষ্য করে খেলো ওরা। তার পরদিন আলাদিন আবার একখানা থালা জামার তলায় পেটে গুঁজে বাজারের পথে বেরিয়ে পড়ে।

    ইহুদীটার দোকানে যাবার পথে এক মুসলমান বৃদ্ধের স্যাকরার দোকান পড়ে। এই সদাশয় বৃদ্ধ কিছুকাল ধরেই লক্ষ্য করছিলো, কয়েকদিন পর পর ছেলেটা কামিজের তলায় কি যেন একটা নিয়ে ইহুদীর দোকানে ঢোকে। ইহুদীটা যে মস্ত ফাঁকিবাজ-লোক ঠকাতে ওস্তাদ সে কথা সবাই জানে। বৃদ্ধ ভাবে, অবোধ সরল ছেলেটাকে না জানি শয়তানটা কী ভাবে ঠকাচ্ছে। দোকানের সামনে আসতে বৃদ্ধ আলাদিনকে ডাকে, শোনো বাবা, শোনো।

    আলাদিন দ্বিধাভরে দোকানে উঠে আসে। বৃদ্ধ বলে, প্রায়ই দেখি, তুমি ঐ বিধর্মী ইহুদীটার দোকানে যাও। লোকটা ভালো না, কী ব্যাপার, কেন যাও সেখানে?

    আলাদিন বলে, সংসারের অবস্থা আগে ভালো ছিলো আমাদের। এখন অভাব অনটনে পড়েছি। তাই কিছু থালাবাটি বিক্রি করে খেতে হচ্ছে।

    বৃদ্ধ বলে, কই দেখি, কী এনেছে আজ?

    আলাদিন থালাখানা বের করে বৃদ্ধের হাতে দেয়। এক নজরেই বৃদ্ধ বুঝতে পারে একেবারে নিখাদ খাঁটি সোনার তৈরি। জিজ্ঞেস করে এরকম কতগুলো আছে তোমাদের ঘরে।

    -বারখানা। আরও বারখানা ছিলো, ঐ ইহুদীকে বেচে দিয়েছি। কী দাম দেবেন এটার। বৃদ্ধ বলে, তুমি যেই হও, আমি কোনও ঠকাবার ব্যবসা করি না, বাবা। দাঁড়াও ওজন করে দেখি, যা ন্যায্য দাম হয় তাই পাবে।

    নিক্তিতে ওজন করে হিসেব কষে সে দাম বলে, দুশো দিনার পেতে পার।

    আলাদিন আকাশ থেকে পড়ে। দুশো দি-না-র?

    -হ্যাঁ দুশো দিনার। অন্য পাঁচটা দোকানে যাচাই করে দেখতে পার। যদি কেউ বেশি দিতে চায় তবু তাকে দিও না। আমার কাছে এসো, আমিও দেব তোমাকে সেই দাম।

    আলাদিন বলে, অন্য দোকানে যাওয়ার কোনও দরকার নাই আমার। এখন বুঝতে পারছি, ইহুদীটা আমাকে কি ঠকান ঠকিয়েছে।

    —কত করে দিয়েছিলো এই এক একটা থালার জন্য?

    –মাত্র এক দিনার।

    বৃদ্ধ চমকে ওঠে, এক দিনার? বলো কী? এ যে গলাকাটা ব্যাপার। লোকটাকে ফাঁসী দেওয়া দরকার। কিন্তু কী করবে বলো, সাক্ষী প্রমাণ তো কিছু নাই, তা না হলে ওকে জেলে ভরে দেওয়া যেত।

    আলাদিন বলে, যাক, যা-গেছে তা-যাক। ও নিয়ে আর ঝুট ঝামেলা বাড়াতে চাই না। এখন থেকে আপনার কাছে ছাড়া আর কোথাও যাবো না।

    এর পর থেকে সেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানের দোকানে সব থালাগুলো বেচে দিয়ে অনেক টাকা ঘরে তোলে আলাদিন। বহুল পরে নিজেদের দৈন্যদশা কাটিয়ে বেশ পয়সাকড়ির মালিক হয়ে ওঠে।

    বৃদ্ধ দোকানীর সঙ্গে ইতিমধ্যেই আলাদিনের বেশ ভাব জমে ওঠে। কথায় কথায় বৃদ্ধ বলে, এছাড়া আর কিছু নাই তোমাদের বাড়িতে?

    আলাদিন বলে দামী জিনিস বলতে আর বিশেষ কিছু নাই। তবে কতগুলো শৌখিন ঘর সাজানো জিনিস কিছু আছে। তবে সেগুলো সবই কঁচের, পাথরের। আপনার দোকানে তার কিই বা কদর হবে।

    বৃদ্ধ বলে, ঠিক আছে, কাল একটা নিয়ে এসো তো, দেখবো, কেমন শখের জিনিস?

    পরদিন সে একটা আনার নিয়ে বৃদ্ধের দোকানে আসে। বৃদ্ধ সমঝদার জহুরী। হাতে ধরেই বুঝতে পারে, এ বস্তু সাত বাদশাহর ধন-মালিক। বলে, বাবা, একটা কথা বলবো?

    —এ-রকম ঘর সাজানো কঁচ-পাথর বগুলো আছে তোমার বাড়িতে? আলাদিন বলে, ঠিক গুনিনি, তা কমসে কম শ’খানেক হবে। বৃদ্ধের চোখ ছানাবড়ার মতো গোল গোল হয়ে ওঠে, এক-শো? আলাদিন বলে, ঐ রকমই হবে? কিন্তু কেন?

    বৃদ্ধ বললো, শোনো বাবা, আমি অধর্ম করিনি জীবনে, আজও করবো না। তাই বলছি, এ জিনিস তুমি আর কাউকে দেখাবে না বা বলবে না তোমার কাছে আছে এ সব?

    আলাদিন বুঝতে পারে না। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়, কেন?

    বৃদ্ধ বলে, আমার এই দোকানে খুব কম করে হলেও কয়েক লক্ষ দিনারের সম্পত্তি আছে। আমার বাড়ি ঘর জমি জমা এবং অন্য বিষয় আসয় বেচলেও দশ বিশ লাখ হয়তা পাওয়া যাবে। কিন্তু সব দিয়েও তোমার এই একটা কাচের ফলের দাম মেটানো যাবে না, বাবা। এবং সে চেষ্টাও আমি করবো না। শুধু আমি কেন এই শহরের সব সওদাগরের তামাম সম্পত্তি ধনদৌলত একত্র করলেও এর একটার দাম হবে না। তাই বা বলি কেন, আমাদের যে সুলতান, তার যে এই বিশাল সলনিয়ত—এই রকম সাত সাতটা সলতানিয়তের যা মূল্য, তোমার এই আনারটার মূল্য তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সুতরাং এমন অমূল্য রত্ন যখন যে-কোনও কারণেই হোক, তোমার নসীবে জুটেছে এগুলো হাতছাড়া করো না। যত্ন করে বাক্সে তুলে রেখে দিও।

    আলাদিন বৃদ্ধের কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই অনুধাবন করতে পারলো না। যাই হোক, বুঝলো জিনিসগুলো শখের হলেও বাজারে হামেশা মেলে না। কোনও শৌখিন মানুষের দেখা পেলে হয়তো মোটামুটি ভালো দামে বিকতেও পারে। তবে এটা সার বুঝতে পেরেছে, এই সদাশয় বৃদ্ধ এ বস্তুর বেসাতি করে না। যাই হোক সৎ পরমর্শই দিয়েছে। হাটে বাজারে অন্য কোনও দোকানে নিয়ে গেলে ওকে ঠকিয়ে নামমাত্র মূল্য ধরিয়ে সবগুলো হাতি নিয়ে নেবে।

    বাড়িতে ফিরে এসে আলাদিন কঁচ-পাথরের ফলগুলো একটা প্যাটরায় পুরে খাটের তলায় ফেলে রাখে।

    এর পর আর ও-নিয়ে মাথা ঘামায় না আলাদিন। খায়-দায় ঘুরে বেড়ায়। বৃদ্ধের দোকানে বসে গল্প স্বল্প করে।

    এইভাবে দিন কাটছিলো। একদিন বৃদ্ধের দোকানে বসে খোস-গল্পে মশগুল ছিলো আলাদিন, এমন সময় সুলতানের পেয়াদা বরকন্দাজরা ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে ফরমাস জারি করতে করতে রাস্তা সাফ করে করে এগোচ্ছিল।

    –শোনও শহরবাসীরা, সুলতানের কন্যা শাহজাদী বদর অল বুদুর আজ হামামে গোসল করতে যাবেন। সেইজন্যে সুলতানের হুকুম, যে যেখানে আছ, দোকান-পাট বন্ধ করে এ রাস্তা থেকে সরে পড়ো, না হলে গর্দান যাবে।

    হুঁড়মুড় করে ঝপ ঝপ করে দোকানের ঝপ বন্ধ হয়ে গেলো নিমেষে। বৃদ্ধ আলাদিনকে বললো, পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। এখনই শাহজাদী পথে বেরুবেন। তার সামনে পিছনে কয়েক শো নিগ্রো খোলা তলোয়ার বাগিয়ে ধরে হাঁটবে। যদি কাউকে পথের এধারে ওধারে দেখে তারা, তবে আর রক্ষে নাই। একেবারে কচু-কাটা করে ফেলবে। তাই আর এক পলক দেরি করো না, বাবা! কি জানি কিছুই বলা যায় না, কার নসীবে কী লেখা আছে।

    দোকান থেকে বেরিয়ে আলাদিন বাড়ি ফিরে যায় না। শুনেছিলো, সুলতান কন্যা বদুর অল বুদুর নাকি বেহেস্তের ডানাকাটা পরী। সুলতাদের হারেমে ঢুকে তাকে তো দেখার দুঃসাহস হবে কারো, তবে আজ যখন হাতের কাছে সুযোগ একটা মিলেই গেছে, এ সুযোগ হেলায় হারাবে

    আলাদিন। না হয় নিগ্রো খোজাদের হাতে তার মাথাটা উড়ে যাবে। তা যাক, বুদুর সুন্দরীকে সে দেখবেই।

    ছুটে চলে যায় ঐ খানদানী হামামে। দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকে ঘাপটি মেরে।

    একটু পরে সদলবলে শাহজাদীর ডুলি এসে দাঁড়ায় হামামের সামনে। সশস্ত্র নিগ্রোর খোজারা দুই ধারে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়! ডুলি থেকে নামে শাহজাদী। হামামের ভিতরে ঢুকে সে বোরখার নাকাব খুলে ফেলে।

    আলাদিনের বুকের মধ্যে ধক করে জ্বলে ওঠে এক ঝলক আগুন। একি দেখছে সে। এতদিন ধরে এই  না-দেখা সুন্দরীর অনেক সুন্দর মুখচ্ছবি সে মনের মুকুরে এঁকেছিলো, কিন্তু আজ বাস্তবে যা প্রত্যক্ষ। করলো, তার তুলনা কোথায়! মানুষের কল্পনা এখানে পৌঁছতে পারে না। শাহজাদী হামামের ভিতরে ঢুকে যায়। সকলের অলক্ষে টুক করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে আলাদিন। তারপর সোজা চলে আসে বাড়িতে।

    আলাদিনের সমস্ত হৃদয়ে তুফান ওঠে। কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় সে কাতরাতে কাতরাতে বিছানায় ঢলে পড়ে।

    ছেলের অস্ফুট গোঙানি শুনে মা ছুটে আসে ঘরে। আলাদিন তখন বিছানায় এপাশ থেকে ওপা গড়াগড়ি খাচ্ছিল। মা ভাবে, ছেলের বুঝি বিমার হয়েছে। গায়ে হাত রেখে বলে, কী হয়েছে বাবা, এমন করছিস কেন? কোথাও চোটফোট লেগেছে?

    আলাদিন খাটের বাজুর সঙ্গে কপাল ঠুকতে ঠুকতে বলে, না না ওসব কিছু হয়নি।

    -তবে? তবে এমন ছটফট করছিস কেন?

    —সে তুমি বুঝবে না মা, এখন এখান থেকে যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

    মা আর কথা বাড়ায় না। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাত্রে এসে জিজ্ঞেস করে, ওঠ বাবা খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়। দেখবি কাল সকালে সব দর্দ সেরে গেছে।

    আলাদিন বলে, তুমি খেয়ে নাও, আমি খাবো না।

    —সে কি! তুই না খেলে আমি খাব কি করে, বাবা?

    -বাঃ, আমার তবিয়ত ভালো না থাকলেও আমাকে খেতে হবে। তুমি যাও আমার মাথা ধরেছে, আমি খাব না।

    মা বলে মাথা ধরার ভালো গোলি আছে আমার কাছে। এক গেলাস পানির সঙ্গে খেয়ে নে, এখুনি ছেড়ে যাবে।

    আলাদিন এবার ঝাকিয়ে ওঠে, ওসব দাওয়াই ফাওয়াই-এ আমার কিছু হবে না, মা। তুমি আর কথা বাড়িও না। এখন যাও। আমাকে একা থাকতে দাও।

    মা চলে যায়। আলাদিন সারারাত ধরে বিছানায় পড়ে ছটফট করে। একি অসহ্য যন্ত্রণা, কেন এমন হলো তার? বুদুর এর রূপে কী যাদু ছিলো, যা তার সকল প্রাণ-মন মথিত করে ফেললো?

    পরদিনও আলাদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। মা অনেক সাধাসাধি করে কিন্তু কিছুই ফল হয় না। আলাদিনের বুকের জ্বালা কিছুতেই প্রশমিত হয় না।

    মা ভাবে, ছেলের কঠিন কোনও অসুখ করেছে। বলে, শহরে শুনেছি এক নামজাদা হাকিম এসেছে। আমি ভাবছি, তাকে ডেকে এনে দেখাবো তোকে। তা সে যে টাকাই লাগুক।

    আলাদিন চিৎকার করে ওঠে, না। ওসব করো না, মা। তাতে কোনও লাভ হবে না। আমার কোনও অসুখ বিসুখ করেনি।

    –তবে তুই আহার নিদ্রা ত্যাগ করেছিস কেন, বল বাবা? তোর কী হয়েছে?

    আলাদিন তখন মাকে সব কথা বলে। বুদুরের রূপে সে দিশাহরা উভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। অন্য কোনও হাকিম কবিরাজের ওষুধে কিছু উপকার হবে না। বুদুর তার বুকের সবটুকু অধিকার করে বসে আছে। সেখানে অন্য কোনও মেয়ের কোনও জায়গা হবে না কোনওদিন।

    মা কপাল চাপড়াতে থাকে, একি সব্বনেশে কথা বলছিস বাবা। এ যে অসম্ভব ব্যাপার। সুলতান বাদশাহ বলে কথা—তাদের দিকে নজর দিলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চলে!

    একথা যদি ঘুনাক্ষরেও সুলতানের কানে যায়, একেবারে মায়ে-বেটার দুজনেরই গর্দান যাবে। ওসব আকাশকুসুম চিন্তাভাবনা তুইমন থেকে ঝেড়ে ফেলো বাবা। আমরা সাধারণ মানুষ, সাধারণ ভাবেই বেঁচে-বর্তে থাকতে চাই। চাদে হাত বাড়িয়ে কোনও লাভ আছে?

    আলাদিন মা-এর এইউপদেশ কর্ণপাত করে না। বলে, তুমি যতই আমাকে বোঝাতে চাও মা, মন আমার বুঝবে না। হয় বুদুরকে পাবো, নয় জান খতম করে দেব, এই আমার পণ।

    মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, কিন্তু কী করে এই অসম্ভব সম্ভব হতে পারবে, একবার ভেবে দেখ, বাবা। শুনেছি, শাহজাদী বুদুরের রূপের কথায় সারা দুনিয়ার শাহজাদারা লক্ষ-কোটি টাকার সাম্রাজ্য বিলিয়ে দিতে চায় তার পায়ে। আর আমরা এক সামান্য দরিদ্র মানুষ—কী করে তাদের চালের সঙ্গে টেক্কা দিতে সাহস করবো?

    আলাদিন বলে, টেক্কা আমাকে দিতেই হবে মা। সারা দুনিয়ার শাহজাদাদের ঘরে যা নাই আমাদের ঘরে সেই বস্তু আছে। পয়সা দিয়ে তার দাম হয় না। তবে এও জানি সুলতান বা তার কন্যার হাতে সে জিনিস পড়লে তার কদর হবে।

    মা, অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কী সে জিনিস?

    আলাদিন বলে, ঐ যে কাচের ফলগুলো দেখেছিলে—পাহাড়ের গুহা থেকে এনেছিলাম, ওগুলো আমি বাজারের ঐ বৃদ্ধ জহুরীকে একবার দেখিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, সুলতান বাদশাহ ছাড়া এ বস্তুর কদর কেউ বুঝবে না—এর ন্যায্য দামও কেউ দিতে পারবে না। ঐকাচের ফলগুলো তুমি নিয়ে সুলতানের দরবারে যাও মা। তাকে উপহার দিয়ে এসে গে।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো সাতচল্লিশতম রজনী :

    আবার গল্প শুরু হয় :

    মা বলে, কই কোথায় রেখেছিস, বাবা?

    আলাদিন বলে, রসুইখানায় একটা ঝোলায় করে টাঙানো আছে।

    মা তাড়াতাড়ি ছুটে যায় রান্নাঘরে। ঝোলাটা নিয়ে আসে।

    আলাদিন বলে, একখানা চিনেমাটির পিরিচ নিয়ে এসো বড় দেখে।

    সেই হীরে জহরতের ফলগুলো পিরিচে সাজিয়ে দেয় আলাদিন। বলে, গায়ে একখানা শাল জড়িয়ে তার নিচে এই পিরিচখানা ঢেকে নিয়ে যাও। সুলতানকে এগুলো ভেট দিয়ে আমার মনের বাসনা জানাবে তাকে। দেখবে, তিনি খুশি মনে রাজি হয়ে যাবেন।

    মা বলে, আমার কিন্তু কেমন ভয় ভয় করছে, বাবা। সুলতান বাদশাহ বলে কথা, তাদের দরবারে তো কখনও যাইনি। সাহস করে পিরবো তো যেতে?

    আলাদিন বলে, সাহস তোমাকে করতেই হবে, মা। তা না হলে আমি প্রাণে বাঁচবো না। একদিকে তোমার ছেলের জীবন, অন্যদিকে তোমার লজ্জা ভয় সঙ্কোচ—আমাকে যদি বাঁচাতে চাও মা, সাহস করে তোমাকে দাঁড়াতেই হবে সুলতানের সামনে।

    মা বলে, অমন অলুক্ষণে কথা মুখে আনিসনে বাবা। এ দুনিয়ায় তোর চাইতে বড় আমার কাছে কিছু নাই। তোর জন্যে আমি ফাঁসীতেও ঝুলতে রাজি আছি।

    আলাদিন বলে না, তোমাকে ফাঁসীতে ঝোলাবে কেন? তোমার প্রস্তাবে তিনি রাজি না হলে ফিরিয়ে দিতে পারেন, সাজা দেবেন কেন?

    —কী জানি বাবা, সুলতান বাদশাহর খেয়াল, হুকুম জারি করে দিলেই হলো। তা হোক, তোর জন্যে আমি জান কবুলও করতে পারি। ও জন্যে আমি ভয় করবো না, যাবো তার কাছে, বলবো আমার প্রস্তাব। নিতে হয় নেবেন, না হয় নেবেন না। আমাকে যদি সাজা দেন তার জন্যে আমি চিন্তা করি না, কিন্তু প্রস্তাব শুনে সুলতান যদি ক্ষেপে তোকে কোনও সাজা দেয়- সে আমি সইবো কী করে, বাবা?

    আলাদিন বলে, তা হোক, বুদুরকে না পেলে এ-জীবন আমি এমনিতেও রাখবো না, না হয় সুলতানের রোষেই মরবো। যাই হোক, তুমি যাও, মা। আমায় বিশ্বাস কর এই ভেট তার সামনে ধরলে তিনি তোমার ওপর প্রসন্নই হবেন।

    মা গায়ে শাল জড়িয়ে তার তলায় ফলের পিরিচখানা ঢেকে নিয়ে দরবারে এসে এক কোণে দাঁড়ালো। তখন সুলতান মসনদে বসে হুকুমতের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সারা দরবার-কক্ষ উজির আমির এবং বিচার প্রার্থীদের ভিড়ে পরিপূর্ণ। উজির এক এক করে নাম ডাকতে থাকে। সুলতান তাদের আর্জি শোনেন। তারপর ফরমাস দিতে থাকেন। এইভাবে ধীরে ধীরে দরবারটার ভীড় হাল্কা হতে থাকে। এক সময় সুলতান তার কাজ-কাম সমাধা করে মসনদ ছেড়ে নেমে প্রাসাদের অভ্যন্তরে চলে যায়। আলাদিনের মা কিন্তু সাহস করে সামনে এগিয়ে যেতে পারে ন। বলতে পারে না। বলতে পারে না তার আগমনের উদ্দেশ্যে। দরবার যখন একেবারে ফাঁকা হয়ে যায় তখন সে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসে বাড়িতে।

    আলাদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো। মাকে ফিরতে দেখে বড় আশা নিয়ে সে ছুটে আসে।কিন্তু মা ছেলেকে কোনও সুখবর দিতে পারে না।বলে, সবই আমার দোষ বাবা, পারলাম

    —কিছুতেই পারলাম না বলতে। কে যেন আমার গলাটা চেপে ধরলো। বিশ্বাস কর বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সুলতানের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস হলো না।

    আলাদিন হতাশায় ভেঙ্গে পড়লো। ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে মা বলে, তুই ঘাবড়াসনে বাবা। আজ পারিনি, কিন্তু দেখে নিস, কাল ঠিক পারবো। কাল আমি সুলতানের সামনে গিয়ে দাঁড়াবোই।

    পরদিন যথাসময়ে আবার সেই ফলের পিরিচ শালের তলায় ঢেকে আবার দরবারে হাজির হয়। কিন্তু সেদিনও সেই একই অবস্থা—অনেক চেষ্টা করেও জড়তা কাটাতে পারে না আলাদিনের মা। একে-একে দরবারের সব কাজ সমাধা করে সুলতান প্রাসাদে ফিরে চলে যান। আলাদিনের মা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েই থাকে।

    সে দিনও বাড়ি ফিরে সে আলাদিনকে কোনও আশার বাণী শোনাতে পারে না। তবে ভরসা দেয়, হাল সে কিছুতেই ছাড়বে না। আবার যাবে আগামী কাল।

    পরের দিনও এক দশা। বোবার মতো দরবারের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে ব্যর্থ মনে ফিরে আসে।

    এইভাবে অনেক দিন কাটার পর একদিন সুলতান উজিরকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ঐ যে ওপাশে একটা মেয়েকে দেখো, আমি লক্ষ্য করছি, প্রতিদিন সে দরবারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঐ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমার মনে হয় সে কিছু বলতে চায়।

    উজির বললো, কিন্তু জাঁহাপনা কত সাধারণ মানুষ আপনার দরবারে আসে—তাদের নিজের নিজের আর্জি পেশ করে।ওর যদি বলারই কিছু থাকবে, ঐ ভাবে বোবার মত দাঁড়িয়ে থাকবে কেন। নিয়ম মতো দরখাস্ত পেশ করতে পারে। সময় মতো তার শুনানিও উঠতে পারে।

    সুলতান বলে, তোমার কথা আমি বুঝলাম সবই। কিন্তু সব মানুষই তো সমান বিচক্ষণ নয়। হয়তো কোন কারণে সে সামনে এসে দাঁড়াতে সাহস করছে না। যাই হোক ওকে আমার কাছে আসতে বলো, আমি ওকে জিজ্ঞেস করবো।

    তৎক্ষণাৎ উজিরের ইশারায় পেয়াদা এসে আলাদিনের মাকে বললো, আপনি মসনদের সামনে হাজির হোন, সুলতান আপনাকে জেরা করবেন।

    আলাদিনের মা-এর বুকে কাঁপুনি ধরে! কোনও রকমে টলতে টলতে সে সুলতানের সামনে এসে কুর্ণিশ করে দাঁড়ায়।

    সুলতান প্রশ্ন করেন, কে তুমি?

    —আমি জাঁহাপনার একান্ত অনুগত এক দাসী, ধর্মাবতার আমার স্বামী এই শহরের এক সামান্য দর্জি ছিলো। অনেক দিন তার এন্তেকাল হয়েছে। এখন আমার একমাত্র সন্তান আলাদিন—তাকে নিয়ে কোনও রকমে দিন গুজরান করছি।

    সুলতান বলেন, বেশ কিন্তু এখানে এই দরবারে তোমার কী আর্জি। আমি লক্ষ্য করছি, রোজই তুমি আস। ঐ এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। কী ব্যাপার, তোমার যদি কোনও কিছু না বলারই আছে, তা বলো না কেন?

    আলাদিনের মা বলে, ভয়ে জাঁহাপনা।

    —ভয়ে? কিসের ভয়ে? আমার সলতানিয়তের কোনও প্রজা আমার সামনে ভয়-সঙ্কোচ করে কোনও কথা গোপন করবে না এই-ই আমি চাই। তোমার কোনও ভয় নাই, নির্ভয়ে বলল, আমি তোমার অর্জি শুনতে চাই। কী তোমার অভাব, অথবা অভিযোগের নালিশ? কেউ তোমার কোন অনিষ্ট করেছে বা কারো কাছে প্রতারিত হয়েছ?

    -না জাঁহাপনা, কোন অভাবের আর্জি পেশ করতে আমি আসিনি। আর তাছাড়া মহামান্য শাহেন শাহর সুশাসনে আমি বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছি। আমার প্রতিবেশিরা প্রত্যেকেই সহৃদয়, মহানুভব, কোনও নালিশ অভিযোগ আমার নাই।

    সুলতান অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, তবে? তবে কেন নিত্য এই দরবারে এসে দাঁড়িয়ে থাকো।

    আলাদিনের মা বলে, আমার নিবেদনটা একটু অন্য রকম। এবং তা দরবারের এই সব লোকজনের মধ্যে বলাও সঙ্গত মনে করি না। ধর্মাবতার যদি একান্তে আমার কথা বলার অনুমতি দেন তবে খুব ভালো হয়।

    সুলতান কিছুই বুঝতে পারেন না। উজিরের দিকে তাকালেন তিনি। উজির বললো, আজকের দরবারে কাজ সবই শেষ হয়ে গেছে জাঁহাপনা, আপনি যদি অনুমতি করেন। আমরা দরবার ত্যাগ করে চলে যাই।

    সুলতান বললেন, ঠিক আছে সবাইকে যেতে বলে। কিন্তু তুমি যেও না।

    উজিরের ইশারায় দরবার-কক্ষ নিমেষে ফাঁকা হয়ে গেলো। তখন সুলতান বললেন, এবার তোমার কী বলার আছে, বলো?

    আলাদিনের মা একটু সামনে এগিয়ে আসে। কিন্তু মুখে কোনও কথা বলতে পারে না। কে যেন তার গলাটা চেপে ধরে থাকে। বুকের স্পন্দন আরও দ্রুততর হয়ে ওঠে।

    উজির বলে, কই, তোমার কী বলার আছে বল জাঁহাপনার সামনে!

    সুলতানও বলেন, নির্ভয়ে বলো। তোমার কথা নিভৃতে শুনবো বলে আমি দরবারের সকলকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। বলল।

    আলাদিনের মা তবু কথাটা যেন বলতে পারে না। সুলতান এবার একটু রাগত স্বরেই বলে, এভাবে সময় নষ্ট করো না, যা বলার আছে চটপট বলে ফেলল।

    এবার আলাদিনের মা মরিয়া হয়ে বলে, মহামান্য ধর্মাবতার আমার গুস্তাফী মাফ করবেন। আমি সামান্য এক দর্জির বিধবা পত্নী। আমার একমাত্র ছেলে আলাদিন। দেখতে শুনতে চমৎকার। কিন্তু পয়সা না থাকলে এ-দুনিয়ায় রূপের কী দাম? কোনরকমে দু-বেলা দুমুঠো অন্ন সংস্থান হয়তো হয়, কিন্তু তার বেশি নয়।

    সুলতান অধৈর্য হয়ে ওঠেন, আহা, সে তো বুঝলাম, এখন আসল কথাটা কী ঝটপট বলে ফেলো তো, বাপু। আমার আর নষ্ট করার মতো সময় নাই।

    আলাদিনের মা বলে, কিন্তু জাঁহাপনা, সে কথা শুনে আপনি কুপিত হবেন না। আপনি দীন-দুনিয়ার মালিক, আপনার অসীম ক্ষমতা, আপনি ক্রুদ্ধ হলে

    —আহা, অত ভনিতা করছো কেন, যা বলার সোজাসুজিই বলো না—আমি তো বলেছি, আমার দরবারে যার যা অভিরুচি আর্জি জানাতে পারে। তার জন্য আমি রুষ্ট বা ক্ষুব্ধ হই না।

    আলাদিনের মা বলে, জাঁহাপনা, আমার নির্বোধ পুত্র আলাদিন আপনার দাসানুদাস নফর, সে একদিন শাহজাদী বদর অল বুদুরকে স্বচক্ষে দেখেছে।

    উজির প্রশ্ন করলো, কী উপায়ে?

    —শাহজাদী কিছুদিন আগে গোসল কেলীর জন্য হামামে গিয়েছিলেন। সেই সময় জাঁহাপনার কড়া পাহারা সত্ত্বেও আলাদিন হামামে ঢুকে পড়তে পেরেছিলো।

    সুলতান এবং উজির দুজনেই বিস্মিত হয়ে বললেন, আশ্চর্য!

    আলাদিনের মা বলতে থাকে, ঐ হামামে পরমাসুন্দরী শাহজাদীর রূপের ছটা দেখে বাছা আমার মজে যায়। সেই থেকে সে প্রেমানলে দগ্ধ হচ্ছে। আহার নিদ্রা ত্যাগ করেছে। তার এক কথা শাহজদী বুদুরকে না পেলে জীবন রাখবে না। আমি তাকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছি, জাঁহাপনা, বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে নাই, কিন্তু ছেলের আমার ধনুর্ভাঙ্গা পণ, হয় সে বুদুরকে শাদী করবে নয় সে জান দেবে। এখন আপনিই বিচার করুন, ধর্মাবতার। এ-কথা শোনার পর কোন্ পাষাণী মা চুপ করে ঘরে থাকতে পারে? আলাদিন আমার একমাত্র সন্তান, ঈদের চাঁদ। তাকে যদি হারাই—এ বিশ্ব-সংসারে আমার আর কী থাকবে? তাই একেবারে অসম্ভব জেনেও এই অবাস্তব প্রস্তাব নিয়ে আপনার দরবারে আমি নিত্য আসি। এবং শত চেষ্টা করেও যখন আপনার সামনে তা পেশ করতে পারি না তখন বুকের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে ব্যর্থ হয়ে আবার ঘরে ফিরে যাই। লোকে শুনলে, আমাকে ও আমার ছেলে আলাদিন দু’জনকেই বদ্ধ পাগল বলবে জানি। তবু, সব জেনে-শুনেও, কেন আপনার কাছে এই প্রস্তাব আজ রাখছি তা তো সন্তানের পিতা হয়ে আপনি নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারছেন, জাঁহাপনা!

    সুলতান গম্ভীর ভাবে বললেন, অবশ্যই পারছি। তুমি ছেলের মা। আমি মেয়ের বাবা। সন্তানের প্রতি মাতাপিতার যে অপত্য স্নেহ মায়া মমতা মহব্বত, তার তুলনা 2 কোথায়? না, আমি তোমাকে উন্মাদ বলবো না। পুত্রের মুখে হাসি? ফোটাবার জন্য, তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য, তুমি অসাধ্য সাধন করতে পার, আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু একটা কথা ভেবে। দেখো তোমার আমার মধ্যে কোনও সমতা নাই। সুতরাং এ প্রস্তাব তো আমি গ্রহণ করতে পারি না। আমার কন্যা শাহজাদী—আজন্ম ঐশ্বর্য-বিলাসের মধ্যে লালিতা। তোমার পুত্র সাধারণ এক গরীব দর্জির সন্তান। এই বিরাট ফারাক পূরণ করার তো? কোনও পথ নাই। আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে আমরা মানুষকে মানুষের ধন-দৌলতের মাপ কাঠিতে বিচার করি। অন্য যা কোনও গুণাবলী কোনও কাজে আসে না। এক্ষেত্রে আমার কন্যা বুদুরের পাণি গ্রহণ করতে গেলে তার যোগ্য ইনাম চাই। এবং আমি বুঝতে পারছি, সে দৌলত তোমাদের নাই। সুতরাং তোমার ছেলের মন থেকে এ দুরাশা মুছে ফেলার পরামর্শ দাও গে।

    আলাদিনের মা-এর চোখ জলে ভরে আসে। শালের তলা থেকে চিনা মাটির থালাখানা বের করে সুলতানের সামনে রাখে সে।

    -আমার পুত্র আলাদিন, শাহেন শাহকে তার নজরানা পাঠিয়েছে, জাঁহাপনা।

    মণি-মাণিক্যের দ্যুতিতে সমগ্র দরবার-কক্ষ ঝলমল করে ওঠে। সুলতান দু’হাতে মুখ ঢেকে মসনদের পিছনে হেলে পড়েন।

    —এ কী! এসব কি? উজির থালা থেকে একটা ফল হাতে তুলে নেয়। দেখতে দেখতে ওর চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে ওঠে, অপূর্ব।

    সুলতানের হাতে তুলে দেয় সে ফলটা, দেখুন, জাঁহাপনা, আপনি তো জগৎ-বিখ্যাত জহুরী, একমাত্র আপনিই এর আসল কদর বুঝবেন। ও, আমি ভাবতে পারছিনা; এ ধন কোথায় পেলো সে।

    সুলতান পরীক্ষা করে বললেন, সারা দুনিয়ার কোনও নবাব বাদশাহদের কারো ঘরে এ বস্তু নাই। এই সামান্য দর্জির বিবি এসব পেলো কোথায়? এর একটার উচিত দাম আমার ধনাগারে নাই। এতোগুলো তুমি কোথায় পেলে, দর্জির বিবি?

    আমার ছেলে আলাদিন একবার পরদেশে বাণিজ্য করতে গিয়েছিলো। সেখান থেকে সে নিয়ে এসেছে। সুলতান মহানুভব, আপনি যদি আমার ছেলের এই সামান্য ভেট গ্রহণ করেন সে ধন্য হবে, জাঁহাপনা।

    সুলতান উজিরের দিকে তাকালেন, তা হলে উজির, এর পর তো আর এই বিধবাকে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব না। বুদুরকে পাওয়ার যোগ্যতার মূল্য তো সে সংগ্রহ করে এনেছে। এখন না বলা যাবে কী করে?

    উজির বলে, কিন্তু জাঁহাপনা আপনার সঙ্গে অনেক আগেই আমার কথা হয়ে আছে, আপনি বলেছিলেন, বিশেষ যোগ্যতর পাত্র না পাওয়া গেলে শাহজাদী বুদুরকে আপনি আমার পুত্রের সঙ্গেই শাদী দেবেন।

    সুলতান বলেন, সে কথা আমি বিস্মৃত হইনি, উজির। এখনও বলছি, আমার যোগ্য ইনাম তুমি সংগ্রহ কর, তোমার ছেলের সঙ্গেই বুদুরের শাদী দেব। এর জন্য আমি তোমাকে তিন মাস সময় দিলাম। এই তিন মাসের মধ্যে তোমাকে এর চেয়ে আরও মূল্যবান দান-সামগ্রী সংগ্রহ করতে হবে।

    উজির বললো, তাই হবে জাঁহাপনা। যেভাবেই পারি, আমি এর চেয়ে আরও অমূল্য রত্নমাণিক্য আপনাকে এনে দেব।

    সুলতান এবার আলাদিনের মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফিরে যাও, দর্জি-ঘরণী। তোমার পুত্র আলাদিনের সঙ্গেই বুদুরের শাদী হবে, এ একরকম নিশ্চিত রইলো। শুধু আমার সত্য রক্ষার জন্য উজিরকে আমি তিন মাসের সময় দিলাম। আমি জানি, আমার উজির কেন, দুনিয়ার কোনও সম্রাট বাদশাহর পক্ষেও—এই মণি-মাণিক্যের অধিক কোনও বস্তু সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। ধরে নিতে পার, সে তোমারই পুত্রবধূ হবে, শুধু তিনটি মাস সময় আমি উজিরকে দিলাম। এই তিন মাস পরে আর কোনও-বাধা থাকবে না। বুদুরকে আমি তোমার ছেলের হাতেই তুলে দেব।

    আলাদিনের মা-সুলতানকে কুর্ণিশ জানিয়ে ঘরে ফিরে এলো। আলাদিন অধীর হয়ে পায়চারী করছিলো। অন্যদিন মা তাড়াতাড়ি ফিরে আসে দরবার থেকে। কিন্তু আজ তার অনেক বেশি দেরি হচ্ছে। তবে কি, কোনও অঘটন ঘটলো?

    -বেটা আলাদিন, মা আনন্দে ছুটে এসে আলাদিনকে জড়িয়ে ধরে, আজ আমার এতো চেষ্টার সুফল পেয়েছি।

    আলাদিন বুঝতে পারে খবর, শুভ সন্দহ নাই। বলে, কী মা? কী হয়েছে, বলো।

    আলাদিনের মা বলে, তোর ঐ কাচের খেলনাগুলো দিতেই সুলতান গলে গেলেন। বললেন, শাহজাদী বুদুরকে তোর সঙ্গেই শাদী দেবেন তিনি। কিন্তু তিন মাস বাদে এই শাদী হবে। এখনই হ’তো, কিন্তু ঐ মুখপোড়া উজিরটা বাগড়া দিলো।

    -বাগড়া দিলো কেন?

    –তার নিজের বাঁদরমুখো বামন হাঁদা একটি ছেলে আছে। শাহজাদী বুদুরের সঙ্গে শাদী দেবার জন্য সে সুলতানের কাছে বায়না ধরেছে। সুলতান ওকে তিন মাস সময় দিলেন, বললেন, এর মধ্যে আমাদের চেয়ে আরও দামী দেন-মোহর দিতে হবে, তা না হলে এ শাদী তোর সঙ্গেই দিয়ে দেবেন তিনি। কিন্তু এখন আমার ভয় লাগছে, বাবা, ঐ বাঁদরমুখো উজিরটা যদি আরও বেশি ধনদৌলত জোগাড় করে?

    আলাদিন হাসে, তুমি একটা আস্ত পাগল, না। যে-বস্তু সুলতানের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে, তামাম দুনিয়া কুঁড়লেও তার নখের যুগ্যি একটা জিনিস জোগাড় করতে পারবে না।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.