Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ৩.১৬.৩ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ (পার্ট ৩)

    সাতশো ঊনপঞ্চাশতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    আলাদিন আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরে, মা, মাগো, এতদিনে তুমি আমার স্বপ্ন সফল করতে পেরেছে। শাহজাদী বুদুর এখন আমার। তাকে আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। যে রত্ন আমি ভেট দিয়েছি, সুলতানকে তার সমান দূরে থাক, হাজার ভাগের এক ভাগও দেওয়ার সাধ্য নাই কারো। সুতরাং বুদুর আমার।

    আলাদিনের মা-ছেলেকে আদর করে বলে, এখন ভালোয় ভালোয় শুভ কাজটা মিটে গেলে হয়। ঐ কু-নজরে উজিরটাকে দেখে আমার ভালো ঠেকল না বাবা। না জানি ছুঁচোটা কি শয়তানী করে বাগড়া দেয়?

    আলাদিন বলে, তুমি রাখতো মা, উজিরের কী ক্ষমতা, সে আমার একগাছি চুলও ছিড়তে পারবে না। তুমি দেখে নিও, ও ব্যাটার নাকের ডগা দিয়ে শাহজাদীকে আমি শাদী করে ঘরে নিয়ে আসবো।

    পুরো তিনটি মাস অপেক্ষা করতে হবে আলাদিনকে। মা-এ পো-এ দুজনে মিলে পল পল করে সময় গুণতে থাকে। এইভাবে এক এক করে দুটি মাস কেটে যায়। আলাদিন আশায় আনন্দে নেচে ওঠে। আর মাত্র একটা মাস। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। মাকে ডেকে আলাদিন বলে, মা শাদীর তো আর মাত্র একটা মাস বাকী। তুমি এবার ধীরে ধীরে কেনাকাটা শুরু কর। সওদাপত্র তো কম লাগবে না, শাহজাদীর সঙ্গে শাদী, জাঁকজমকের ঘাটতি হলে তো চলবে না, মা।

    মা বলে, আমি সেই কথাই ভাবছিলাম, বাবা। আজই বাজারে যাচ্ছি।

    আলাদিনের মা বাজারে ঢুকেই তাজ্জব বনে যায়। সারা বাজারের প্রতিটি দোকান ঝলমল করছে। নানারকম বাহারী সাজপোশাক এবং শৌখিন জিনিসের চমকে চোখ ঝলসে যায় আর কি!

    একটা বড় দোকানে ঢুকে পড়ে আলাদিনের মা! সোনার জরির কাজ করা কয়েকটি মূল্যবান সাজ-পোশাক ঝোলানো ছিলো দোকানের সামনে। তার একটার দাম জিজ্ঞেস করে সে।

    —কত দাম এটার?

    দোকানী অবাক হয়ে আলাদিনের মা-এর দিকে তাকায়। বলে, তোমার কী দেমাক খারাপ হয়েছে নাকি গো, জান না আজ বাজারের যত দোকানে যত বাহারী সাজ-পোশাক বা শখের সামান যা ঝোলানো হয়েছে সব বিক্রি হয়ে গেছে।

    বিক্রি হয়ে গেছে? বিক্রি হয়ে গেছে তো দোকানে রাখছো কেন? সে তো ঘরে নিয়ে গেলেই পারে।

    দোকানী বলে, তোমার সাহস তো বড় কম নয় মেয়ে, কার সম্বন্ধে কী কথা বলছে, তা জান? স্বয়ং শাহজাদী বুদুরের শাদীর সাজ-পোশাক এসব—যা দেখছো, সব। জান না, আজ রাতে উজিরের ছেলের সঙ্গে শাহজাদী বুদুরের শাদী হবে? উজির নিতে এসে এইসব সাজ-পোশাক পছন্দ করে গেছে। এখুনি তার লোক-লস্কর আসবে। উটের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে চলে যাবে।

    আলাদিনের মা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। তাড়াতাড়ি ছুটে যায় আর একটা দোকানে। সে দোকানদারও একই কথা বলে। এর পর সে প্রায় উন্মাদিনীর মতো ছুটতে ছুটতে ঘরে ফিরে আসে। মাকে শূন্য হাতে ফিরে আসতে দেখে, আলাদিন অবাক হয়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কী হলো মা, কী হয়েছে, শুধু হাতে ফিরে এলে যে? সওদা করলে না কিছু?

    মা বলে, আমার মাথা ঘুরছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে, আগে একটু পানি দে, সহ বলছি।

    আলাদিন ছুটে গিয়ে এক গেলাস জল এনে মা-এর মুখে ধরে। ঢক ঢক করে জলটুকু এক নিঃশ্বাসে পান করে মা বলে, বাবা, আমাদের কপাল ভেঙ্গেছে।

    -মানে, আলাদিন কিছুই আঁচ করতে পারে না, কী বলছো মা, কপাল ভেঙ্গেছে কেন? মা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, আমি বাজারে গিয়ে শুনে এলাম ঐ বাঁদরমুখো মুখপোড়া উজিরটার ছেলের সঙ্গে শাহজাদী বুদুরের শাদী হচ্ছে আজ রাতে।

    আলাদিন বলে, না মা সে কী করে হয়, কেউ তোমার সঙ্গে মস্করা করেছে।

    -না বাবা, না; আমি জনে জনে জিজ্ঞেস করেছি। সবারই মুখে এক কথা। পথে ঘাটের মানুষ এই শাদীর কথায় মেতে উঠেছে, আমি নিজে কানে শুনে এসেছি। তাছাড়া সারা বাজারের সব সেরা সাজ-পোশাক আর শখের বাহারী জিনিস তামাম কিনে নিয়েছে ঐ উজিরটা।

    আলাদিনের চোখ জ্বলে ওঠে, বেইমান—

    আলাদিনের মা বলে, বেইমান বলে বেইমান, সুলতান নিজ মুখে আমাকে কথা দিলো, শাহজাদী বুদুরের সঙ্গে তোমার ছেলের শাদী হবে। তা এই কী ইমানদারের বাক্যি? সর্বনাশ হবে ছারখার হয়ে যাবে সব।

    আলাদিন মাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, মা, তুমি মেজাজ খারাপ করো না। কী করে এই মিথ্যের মোকাবিলা করতে হয় তা আমার জানা আছে। তবে এও তোমাকে বলে রাখলাম মা, ঐ শয়তান উজির যদি স্বপ্ন দেখে থাকে তার গুণধর পুত্রের অঙ্কশায়িনী করাবে শাহজাদী বুদুরকে, সে গুড়ে বালি। আমার হাতে এমন অস্ত্র আছে যাতে বাছাধনের সব সাধ ধুলোয় লুটিয়ে যাবে। যাও মা তুমি আর মন খারাপ করো না। ভালো করে খানা পাকাও। আমার বড় খিদে পেয়েছে।

    মা সুলতান আর উজিরের মুণ্ডুপাত করতে করতে রসুইখানার দিকে চলে যায়। আলাদিন ঘরের দরজা বন্দ করে ঝোলা থেকে চিরগটা বের করে। আলতো করে একটু ঘষা দিতেই সেই আফ্রিদি দৈত্য এসে হাজি হয়। আভূমি আনত হয়ে আলাদিনকে সে কুর্নিশ করে। বলে, আমি ত্রিভুবনের মালিক। আমার অসীম ক্ষমতার কাছে সবই পদানত। শুধুমাত্র এই যাদু চিরাগই আমার একমাত্র ঈশ্বর। এঁর নির্দেশ আমার শিরোধার্য, এখন আপনি যখন এই চিরাগেরমালিক, সেই কারণে আমি আপনার দাসানুদাস। গোলামকেহুকুম করুন মালিক। আপনার আজ্ঞা পালন করতে আমি প্রস্তুত।

    আলাদিন বললো, শোনো, চিরাগ-দাস তোমাকে একটা কথা বলি। এবারে কিন্তু আমার খানাপিনার জন্য তোমাকে ডেকে পাঠাইনি। ব্যাপারটা বেশ জটিল এবং তোমাকেই তার সুরাহা করতে হবে। সুলতান আমার কাছে মণিরত্নের উপঢৌকন গ্রহণ করেছে। এবং কথা দিয়েছিলো, তার কন্যা শাহজাদী বুদুরকে আমার সঙ্গে শাদী দেবে। কথা ছিলো তিন মাস পরে আমাদের শাদী হবে। কিন্তু দু মাস পার হতে না হতেই সুলতান তার বাগদানের সব কথা ভুলে গেছে, অথবা মনে রেখেও আমার সঙ্গে বেইমানী করতে চলেছে। খবর পেলাম সে তার মেয়েকে উজিরের ছেলের সঙ্গে শাদী দিচ্ছে আজ রাতে। কিন্তু এ শাদী আইন-সিদ্ধ নয়। যেন তেন প্রকারে উজিরের ছেলের হাত থেকে শাহজাদীর সতীত্ব রক্ষা করতে হবে। আমার একান্তভাবে অধিকার আছে শাহজাদী বুদুরকে ভোগ করার। সুতরাং অন্য কারো থাবা আমি বরদাস্ত করবো না। এবং এই কারণেই আমাকে সাহায্য করার জন্য আজ তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি।

    আফ্রিদি বললো, আমাকে এতো সব কৈফিয়ৎ দিচ্ছেন কেন মালিক। আমি আপনার আজ্ঞাবহ দাসমাত্র। আপনি হুকুম করুন, বান্দা তামিল করতে প্রস্তুত।

    আলাদিন বলে, ঠিক আছে, তবে শোনো, আজ সন্ধ্যায় যখন শাহজাদী বুদুরকে উজিরের ছেলের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সবাই চলে যাবে সেই সময় তুমি তাকে-তাকেই আশে পাশে থাকবে, সাবধান উজিরের ছেলেটা যেন ওর গায়ে হাত ঠেকাতে না পারে। তুমি তাদের চোখে ঘুম ঢেলে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে তখুনি। তারপর দু’জনকেই নিয়ে চলে আসবে এখানে আমার এই ঘরে। আর তারপরের ব্যাপার আমি বুঝবো। হ্যাঁ, আনার সময় পালঙ্কশয্যা সমেত নিয়ে আসবে ওদের, বুঝলে?

    আফ্রিদি মাথা নুইয়ে বলে, জো-হুকুম, মালিক।

    এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    সাতশো একান্নতম রজনীতে আবার কাহিনী বলতে শুরু করে সে।

    সুলতান শাহজাদী বুদুরকে উজির-পুত্রের সঙ্গে কেন শাদী দিতে সম্মত হলেন সে সম্বন্ধে একটু আলোকপাত করা দরকার।

    সেদিন আলাদিনের মা দরবার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সুলতান উজিরকে বললেন, শাদীর যৌতুক হিসেবে আলাদিন যে মণিরত্ন পাঠিয়েছে তার মূল্য অর্থ দিয়ে যাচাই করা সম্ভব নয়। সুতরাং এক্ষেত্রে শাহজাদীকে আলাদিনের হাতে তুলে না দিয়ে উপায় নাই উজির। আমি তিন মাস সময় অবশ্য রেখেছি কিন্তু আমার মনে হয় সারা আরব দুনিয়ার কোনও সুলতান শাহজাদাই আলাদিনের উপটৌকনকে টেক্কা দিতে পারবে না। সুতরাং একরকম ধরেই রাখ, শাহজাদী বুদুর আলাদিনের বেগম হবে।

    উজির বলে, কিন্তু জাঁহাপনা, শাহজাদীকে শাদী করার পক্ষে একমাত্র যৌতুক উপঢৌকনই কী সব? ঘর বর কিছুই দেখার প্রয়োজন নাই? ছেলে দেখতে কেমন-কালো বোবা হাঁদা কিংবা অন্ধ-খঞ্জ কিনা তাও তো একবার স্বচক্ষে দেখা দরকার।

    সুলতান বললেন, একশোবার। তিন মাস সময় কি আমি শুধু শুধু পিছিয়ে দিলাম নাকি? সবই তো খোঁজ খবর নিতে হবে? এবং তা তোমাকেই নিতে হবে। আজ থেকেই আলাদিনের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা কর উজির। কী করে সে, কোথায় থাকে, কী তার খানদানী সব আমার জানা দরকার।

    উজির বলে, ওসব নিয়ে আপনি একটুও চিন্তা করবেন না হুজুর। কাক পক্ষীও টের পাবে না। আমি আজই চর নিযুক্ত করছি। তারা আমাকে আলাদিনের সব গোপন সংবাদ এনে দেবে নিত্য।

    উজির কয়েকদিন পরে সুলতানকে বললো, জাঁহাপনা, আলাদিন বাণিজ্য করতে বিদেশ গেছে। মাসখানেক বাদে ফিরবে কথা আছে।

    মাসখানেক পরে উজির আবার সুলতানকে বললো, জাঁহাপনা, খবর এসেছে ভারত সাগরের কূলে আলাদিনদের জাহাজ ডুবে গেছে। জাহাজের মাত্র একজন যাত্রী রক্ষা পেয়ে দেশে ফিরে এসেছে। তার বিবরণে জানতে পারলাম, জাহাজের আর কেউই প্রাণে রক্ষা পায়নি।

    সুলতান বললেন, আহা হা, বেচারী! ভাগ্যে বুদুরের শাদীটা দিয়ে দিই নি তখন। তাহলে মেয়েটা আমার পাথারে পড়তো। তা এক কাজ করো উজির। তুমি বরং আর একটু ভালো করে খোঁজ খবর করো। হয়তো আল্লাহর কৃপায় সে বাঁচলেও বাঁচতে পারে।

    উজির বলে, যে তোক ফিরে এসে খবর দিয়েছে, তার কথা অবিশ্বাস করার মতো কোনও কারণ নাই। তা সত্ত্বেও আপনি যখন বলছেন, আমি খোঁজখবর নিতে লোক পাঠাচ্ছি। তবে মৃত্যু সংবাদ সচরাচর মিথ্যে হয় না, জাঁহাপনা।

    এর কিছুদিন পরে উজির সুলতানকে জানালো, জাঁহাপনা আমার দূতরা ফিরে এসেছে। তারা খবর নিয়ে জেনেছে, সত্যিই সে-জাহাজের একটিমাত্র মানুষ ছাড়া দ্বিতীয় কেউ প্রাণে রক্ষা পায়নি।

    সুলতান অনেক আফশোশ করলেন। তারপর বললেন, সবই নিয়তির লেখা। কেউই তার বাইরে যেতে পারে না উজির। যাই হোক, আর তো অপেক্ষা করা যায় না, এবার শাহজাদীর শাদীর ব্যবস্থা করতে হয়।

    উজির করজোড়ে আর্জি পেশ করে, সুলতান মহানুভব, আপনি এক সময় আমার পুত্রকে জামাতা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। যদি অধমের আর্জি মঞ্জুর করেন তবে আমার ছেলেটার একটা গতি হয়।

    সুলতান বললেন, উত্তম, তাই হবে। আমি আর দেরি করতে চাই না। দু একদিনেই শাদীর সব ব্যবস্থা করে ফেলল।

    উজিরের চালে বিভ্রান্ত হয়ে বুদুরের শাদীতে সায় দিলেন তিনি। পরদিন থেকেই শাদীর সাজ সাজ রব পড়ে গেলো। সারা শহরে রটে গেলো সেই বার্তা। দোকান পাট-এ নানারকম বাহারী রংদার সাজ-পোশাক এবং উপহার উপঢৌকনের সামান ঝলমল করে উঠলো। উজিরের ঢালাও হুকুম, বাজারের সেরা সেরা সব জিনিস তার ছেলের শাদীর জন্যে চাই। অন্য কাউকে তা বিক্রি করা চলবে না। দোকানীরাও মওকা বুঝে দামী দামী সাজ-পোশাক আর সামানপত্র আমদানী করে দোকান ভরে ফেললো। এবং তিন-চারগুণ দামে তা উজিরের কাছে বিক্রি করে মোটা মুনাফা ঘরে তুলতে লাগলো।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো বাহান্নতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    আলাদিন মাকে তার ফন্দী ফিকিরের কোনও আভাষ দিলো না। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। খানাপিনা শেষ করে মা ঘরে শুতে চলে গেলো। আর আলাদিন নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে আফ্রিদির আগমন প্রতীক্ষায় মুহূর্ত গুণতে থাকলো।

    এদিকে সুলতানের প্রাসাদে শাদীর উৎসব সমারোহ চলছে তখন। একে একে অভ্যাগত আমন্ত্রিতরা বিদায় নিচ্ছে। শাহজাদী বুদুরকে যথারীতি উজির-পুত্রের সঙ্গে এক ঘরে শোয়ানোর ব্যবস্থা করা হলো। প্রথা অনুযায়ী পাত্র পাত্রী উভয়ে নগ্ন হয়ে ফুলশয্যায় রাত্রি যাপন করবে। সেইভাবে শাহজাদী বুদুরকে বিবস্ত্র করে উজির-পুত্রের ঘরে পালঙ্কে বসিয়ে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেছে হারামের মেয়েরা।

    উজির-নন্দন উলঙ্গ হয়ে পালঙ্কে শুয়ে এতক্ষণ শাহজাদীর প্রতীক্ষায় অধীর হয়েছিলো, এবার তাকে কাছে পেয়েই জড়িয়ে জাপটে ধরতে এগিয়ে যায়। কিন্তু পলকে তাজ্জব কাণ্ড ঘরে গেলো। পালঙ্কটা মেঝে ছেড়ে শূন্যে উড়ে যেতে লাগলো। আতঙ্কে দুজনেরই অবস্থা কাহিল। প্রায় হত-চৈতন্য বলা যায়। প্রাণপণে বিছানায় মুখ ঢেকে পড়ে রইলো ওরা। পালঙ্কটা নিমেষে খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়ে আকাশপথে উড়ে চললো। এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আলাদিনের ঘরের মেঝেয় এসে নেমে পড়লো।

    এ সবই আফ্রিদির ঐন্দ্রজালিক কারসাজি। অদৃশ্য দৈত্য এবার স্বরূপ ধারণ করে আলাদিনকে আভূমি আনত হয়ে কুর্ণিশ জানিয়ে বললো, হুকুম তামিল করেছি হুজুর। এবার আর কী করতে হবে আজ্ঞা করুন, বান্দা প্রস্তুত।

    আলাদিন বললো, এই মেয়েছেলের দালালটাকে পায়খানার হাঁড়ির মধ্যে বন্ধ করে রেখে দিয়ে আজকের মতো তুমি বিদায় নাও। কাল খুব ভোরে—রাতের আঁধার না কাটতেই আবার

    এসে হাজির হবে আমার সামনে। তখন যা বলার বলবো।

    —জো হুকুম জাঁহাপনা।

    এই বলে সে উজিরের ছেলেকে এক হাতে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে পায়খানা ঘরে চলে গেলো।

    আলাদিন দেখলো মখমলের শয্যায় শাহজাদী বুদুরের নগ্ন দেহখানা এলিয়ে পড়ে আছে। সারা চোখে মুখে তার আতঙ্ক। আলাদিন বললো, শাহজাদী শঙ্কা করার কোনও কারণ নাই। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করবো না। আমাকে বিশ্বাস কর, যদিও তুমি আর আমি এই ঘরে একা, তবু কথা দিচ্ছি তোমার অঙ্গ স্পর্শ করবো না আমি।

    আলাদিনের এই কথায় শাহজাদী বুদুর তেমন কোনও ভরসা পায় না। সন্দেহাকুল চোখে সে আলাদিনের দিকে তাকায়।

    আলাদিন বলে, আমাকে নির্ভর করতে পারো শাহজাদী, তোমার কোনও অসম্মান আমি করবো না। তোমার বাবার প্রাসাদে যেমন নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলে, এখানেও ঠিক তেমনি নির্ভয় নিরাপদ তুমি। আমি শুধু ঐ জন্তুটার থাবা থেকে তোমাকে রক্ষা করার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছি। অন্য কোনও উদ্দেশ্য নাই। উজিরের ঐ ছেলেটা একটা গবেট হাঁদা। শুধু সে নারী-মাংস খুবলে খেতে জানে, আর কোনও যোগ্যতাই তার নাই। আমি জানি না, তোমার বাবা আমার সঙ্গে শাদী দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েও কেন ঐ বেল্লিকটার হাতে তোমাকে সঁপে দিয়েছেন। কিন্তু শুনে রাখ শাহজাদী আমার জান থাকতে তা হতে দেব না। তুমি আমার বাগদত্তা। আইনতঃ তোমাকে শাদী করার একমাত্র অধিকার আমারই আছে। এবং সে শাদী হবেও। তাই আমি চাই

    —আমার ভাবী বিবির দেহ কেউ স্পর্শ করুক। এমন কি আমিও বিধি সম্মত শাদী করার আগে তোমার দেহ গ্রহণ করবো না।

    শাহজাদী বুদুর তার বাবার বাগদানের কোনও কথাই জানত না। তাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে শুধু কাঁদতে থাকলো, আলাদিনের কোন কথার জবাব দিলো না।

    আলাদিন ওকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করলো: একখানা শাল ছুঁড়ে দিয়ে বললো, আমি থাকবো এ পাশে। নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়, তোমার কোনও অনিষ্ট করবে না কেউ।

    আলাদিন এক মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়ে নাক ডাকাতে লাগলো, কিন্তু শাহজাদীর চোখে আর ঘুম এলো না। সারারাত সে অজানা আতঙ্কে শিহরিত হতে থাকলো। অবশ্য তার সদ্য বিবাহিত স্বামী উজির পুত্রের জন্য তার বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিলো না। শাদীর সময় থেকে ওকে দেখা ইস্তক বুদুরের সমস্ত সত্তা বিদ্রোহ করে উঠতে চাইছিলো। এমন কদাকার কুৎসিত, বেঁটে হাঁদা বাঁদরমুখো একটা লোক তার স্বামী হবে, ভাবতে পারেনি সে।

    পরদিন প্রত্যুষে চিরাগের আফ্রিদি আবার এসে হাজির হলো। আলাদিন তখনও নিদ্রামগ্ন। আফ্রিদি একটা অদ্ভুত আওয়াজ করতে আলাদিনের ঘুম ছুটে যায়। শাহজাদী জেগেই ছিলো, কিন্তু হঠাৎ সেই শব্দে আতঙ্কিত হয়ে সে ধড়মড় করে শয্যার উপর উঠে বসেকাপতে লাগলো। ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি চোখ বুলিয়ে কাউকেই দেখতে পেলো না। অথচ সে নির্ঘাত জানে, এই ঘরের মধ্যেই কেউ সেই বিকট বিদঘুটে আওয়াজটা তুলেছে।

    আলাদিন কিন্তু পরিস্কার আফ্রিদিকে দেখতে পাচ্ছিল। বিছানা ছেড়ে সে আফ্রিদিকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের অন্য প্রান্তে চলে গেলো। সেখানে ফিস ফিস করে সে আফ্রিদিকে কী সব বললো, বুদুর শুনতে পেলো না।

    একটু পরে আফ্রিদি পায়খানা থেকে উজির-পুত্রকে শূন্যে ঝুলিয়ে এনে নামালো বুদুরের পাশে-পালঙ্ক-শয্যায়। পায়খানার নোংরা জলে তার সর্বাঙ্গ কর্দমাক্ত—ভেজা। ভয়ে অথবা হিমে বোঝ গেলো না, সর্বাঙ্গ ওর ঠক ঠক করে কাপছিলো।

    এরপর পালঙ্কটা আবার শূন্যে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে। বেরিয়ে আকাশ-পথে বায়ুবেগে সুলতানের প্রাসাদের দিকে ধাবমান হলো।

    পলকের মধ্যেই আবার সুলতান- প্রাসাদের যথা-নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে ১ এনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো আফ্রিদি। বুদুর এবং উজির পুত্র বোবা? বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলো পালঙ্গটা আবার তাদের নিজেদের কামরাতেই – ফিরে এসেছে।

    কিছুক্ষণ পরে বুদুরের বাবা মা মেয়েকে দেখতে এলেন। বুদুর আকুল হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে যুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। মা মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে সোহাগ করে বলে, কী বাছা, কী হয়েছে। শাদীর প্রথম রাতে ভয় পেয়েছিস? তা ভয় পাবার কী আছে বাছা? ওরকম প্রথম। প্রথম দু-একটা রাত কেমন কেমন মনে হবে। তারপর দেখবি, আপসে আপ সব সহজ হয়ে গেছে। মা মেয়ের কানে কানে ফিস ফিস করে বলে, খুব কী ব্যথা পেয়েছিস মা? রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে গেছে?

    বুদুর মাকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে, না মা ওসব কিছু না।

    —তবে? তবে কী হয়েছে,মা? তোর স্বামী কী তোর সঙ্গে কাজ কাম ঠিক ঠিক করেনি? একথার কোন জবাব দেয় না বুদুর। সুলতান জামাতার দিকে দৃষ্টিপাত করেন। কিন্তু উজির-পুত্র মাথা নিচু করে বসে থাকে। কোনও কথা বলতে পারে না। সুলতান এবং বেগম দুজনেই আবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকেন। উজির-পুত্র শয্যা ছেড়ে নেমে সুড় সুড় করে হামামে গিয়ে ঢোকে। গত রাতের পায়খানার নর্দমার নোংরা জলে তার সর্বাঙ্গ ক্লেদাক্ত হয়েছিলো। হামামে ঢুকেই সে গামলা-গামলা জল ঢেলে ময়লা কাদা ধুয়ে সাফ করার কসরৎ করতে থাকে। মনে মনে ভাবে গত রাতের ঐ লজ্জার কাহিনী সে বলবে কী করে লোককে।

    বুদুরও নীরবে চোখের জলে গাল ভাসিয়ে দিতে থাকে। মা-বাবার হাজার প্রশ্নের একটাও সে জবাব দেয় না—দিতে পারে না। গত রাতের ঐ অবিশ্বাস্য অলৌকিক লজ্জাকর কাহিনী কী করে শোনাবে সে তাদের। আর শুনলেই কী তারা সে কথা বিশ্বাস করবেন?

    মেয়ের অঝোর নয়নে কান্নায় মা কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েই প্রশ্ন করেন, সব মেয়েরই শাদীর প্রথম রাত অদ্ভুত লাগে। কারো সুখের মনে হয় আবার কেউ আতঙ্কে শিউরে ওঠে। কিন্তু এ সবই তো সাময়িক মা। দু’টো রাত কাটাতে পারলেই সব গা সওয়া হয়ে যাবে। তখন আজ যার কথা ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছিস দেখবি তখন তার জন্যেই প্রাণে আকুলি বিকুলি করবে। এখন কান্না থামা, বেটা। লজ্জা করিস নে, সত্যি করে বলতো, জামাই তোর সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করেছে?

    তবু বুদুর চুপ করে থাকে। মা অধৈর্য হয়ে বলেন, কী, কথার জবাব দিবি না? যা বাবা, এতো ঢং করছিস কেন? আমিও তো এক সময় শাদীর কনে হয়েছিলাম না, হইনি? কিন্তু তোর মতো এতো সৃষ্টি ছাড়া কাণ্ড করিনি বাছা! তোর বাবা আর আমি এই সাত সকালে ছুটে এসেছি তোর খবর নিতে। তাঁরও তো মান-সম্ভ্রম রক্ষা করা তোর উচিত!

    বুদুর দেখলো মা বাবা উভয়েই বিশেষ চিন্তিত এবং আহত, অপমানিত হয়েছেন। সুতরাং আর চুপ করে থাকা সঙ্গত হবে না।

    -মা, তোমার কী করে ভাবলে তোমাদের উপর আমার শ্রদ্ধাভক্তি এতোটুকু কম আছে? আমি এতোক্ষণ চুপ করে আছি, শুধু লজ্জায়। কী করে তোমাদের বলবো সে-সব কথা, তাই ভেবে পাচ্ছি না, মা। কী যে ঘটে গেছে গত রাতে, আমি নিজেই তা এখনও বুঝতে পারছি না। একেবারে আজগুবি অবিশ্বাস্য ভূতুড়ে কাণ্ড!

    এরপর অনেকসময় ধরে নানাভাবে বর্ণনা করে মা বাবাকে গত রাত্রের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শোনালো সে। তার স্বামী পাশে শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালঙ্কটা কী ভাবে ওপরে ওঠে জানালা দিয়ে বেরিয়ে আকাশপথে উড়তে উড়তে এক অজানা বাড়ির একটা ঘরে গিয়ে নেমেছিলো এবং সে ঘরের এক সুন্দর যুবক তার পাশে সারারাত শুয়ে ঘুমিয়েছিলো, অথচ তাকে

    স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। সেই সব ঘটনা সে মা-বাবার সামনে বিবৃত করলো।

    তখনও বুদুরের আতঙ্ক কাটেনি। সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, মা, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, কী ভাকে কোন্ অদৃশ্য শক্তি আমাদের উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো সেখানে। আবার সকাল হওয়ার আগেই আমাদের পালঙ্কটা আবার উড়তে উড়তে ফিরে এলো এই বাসর-কক্ষে। আমি এখনও ভাবতে পারছি না মা, শাদীর প্রথম রাতে এমন একটা অলক্ষুণে কাণ্ড কেন ঘটলো।

    সুলতান এবং বেগম পরস্পরে দৃষ্টি বিনিময় করেন। ওদের আর বুঝতে বাকী থাকে না, অনভ্যস্ত সহবাসের আতঙ্কে মেয়ে সারারাত ধরে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। মা বললেন, বেটা, ওসব মন থেকে মুছে ফেলো। শাদীর প্রথম রাতে অনেক মেয়েরই ওরকম হয়ে থাকে। যাই হোক আমাদের কাছে যা বললে তা আর অন্য কাউকে বলো না। এসব কথা শুনলে লোকে তোমাকে পাগল ঠাওরাবে। যাক ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামিও না। মন থেকে ওসব বাজে দুঃস্বপ্নের কথা মুছে ফেললো। হাসি গানে মেতে থাকো। তুমি আমাদের একমাত্র কন্যা। তোমার শাদীর জন্য দেশ-বিদেশ থেকে কত গণ্যমান্য মেহেমানরা এসেছে। সারাদেশের মানুষ কত আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে। চল্লিশ দিন ধরে চলবে এই উৎসব। এখন এই সব অলক্ষুণে দুঃস্বপ্নের কথা কারো কানে গেলে সব আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। তাই বলছি মা, কেউ যেন না জানতে পারে এসব কথা।

    সুলতান এবং বেগম মেয়েকে নানারকম উপদেশ বাক্য শুনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

    হামাম থেকে গোসল করে উজির-পুত্র আবার ঘরে ফিরে আসছিলো, সুলতান তাকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বেটা, কাল রাতটা তোমাদের কেমন কাটলো?

    উজির-পুত্র বোকার মত ফি ফিক করে হেসে বললো, কেন বলুন তো, আপনার মেয়ে আমার নামে কিছু খারাপ বলেছে নাকি?

    সুলতান বলে, না, খারাপ বলবে কেন? কিন্তু মনে হলো সাধারণ ভাবে যেমনটা কাটা উচিত তা কাটেনি। কী ব্যাপার বলতো? শাহজাদী কী তোমার এই কুরূপ দেখে মুখ ফিরিয়েছিলো?

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো তিপ্পান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    উজির-পুত্র সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলে, না না, ওসব তো কিছুই হয়নি। সাধারণভাবে যা ঘটা সম্ভব সবই আমাদের ঘটেছে।

    জামাই-এর কথা শুনে সুলতান এবং বেগমের ধারণা বদ্ধমূল হলো, মেয়ে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সুলতান বললো, মনে হচ্ছে, শাহজাদীশরীরে অস্বাভাবিক ব্যথা পেয়েছে। বাবা, একটা কথা মনে রেখ, তোমার বিবির শরীর বড় পলকা ফুলের মতো নরম। ওকে একটু সাবধানে ব্যবহার করো।

    জামাইকে উপদেশবাণী দিয়ে সুলতান বেগমকে নিয়ে প্রস্থান করলেন।

    আলাদিন সারাদিন ধরে মনে কল্পনা করতে লাগলো, শাহজাদী বুদুর আর তার সদ্য শাদী করা স্বামীটিকে নিয়ে সুলতান-প্রাসাদে কী সব কাণ্ডকারখানা ঘটতে পারে!

    সন্ধ্যার পরে খানা-পিনা শেষ করে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করলো আলাদিন। চিরাগটা বের করে আলতোভাবে একবার ঘষতেই আবার এসে হাজির হলো সেই আফ্রিদি। আলাদিন বললে, সুলতানের প্রাসাদে যাও অপেক্ষা কর, যখন শাহজাদী এসে আবার পালঙ্ক-শয্যায় শোবে আবার ওদের নিয়ে এসো এখানে।

    আফ্রিদি অদৃশ্য হয়ে গেলো। এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই পালঙ্ক-শয্যা সমেত শাহজাদী আর স্বামীটাকে নিয়ে এসে হাজির করলো আলাদিনের সামনে। তারপর উজির-পুত্রকে তুলে নিয়ে চলে গেলো পায়খানার ঘরে।

    সে রাতেও আলাদিন রোরুদ্যমানা শাহজাদীকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, তোমার কোনও ভয় নাই। এখানে তোমার মান ইজ্জত সব নিরাপদ। তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও, কেউ তোমাকে স্পর্শ করবে না।

    শয্যার মাঝখানে আবার রাখা হলো একখানা মারাত্মক ধারালো অস্ত্র। তার এক পাশে শাহজাদী অন্য পাশে আলাদিন শুয়ে রাত্রি অতিবাহিত করলো। পরদিন সকাল হওয়ার আগেই আবার সেই আফ্রিদি এসে পালঙ্কসমেত ওদের দুজনকে রেখে এলো প্রাসাদের বাসর-কক্ষে।

    সুলতান সারারাত কন্যর চিন্তায় দু-চোখের পাতা এক করতে পারেননি। সকাল হতে না হতে তিনি একাই চলে এলেন শাহজাদীর বাসরঘরে। বেগমকে সঙ্গে আনলেন না,কারণ বেগম অল্পতেই অধৈর্য হয়ে ওঠেন। মেয়েকে কটু কথা বলতে দ্বিধা করেন না।

    সুলতানের আগমন সংবাদ পাওয়ামাত্র উজির-পুত্র শয্যাত্যাগ করে খিড়কীর দরজা দিয়ে হামামে পালিয়ে যায়।

    সুলতান ঘরে প্রবেশ করলেন। মেয়ের কাছে এসে কপালে চুমু দিয়ে বললেন, আজকের রাতটা নিশ্চয়ই তোমার ঐরকম বাজে দুঃস্বপ্নে কাটেনি মা! মনে কোনও দ্বিধা সংকোচ করো না। কেমন কেটেছে তোমাদের বাসর রাত বলতো, মা?

    শাহজাদী বুদুর বাবার প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না। তার হাতের মধ্যে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে যুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো।

    সুলতান ক্রোধে আরক্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু শাহজাদী তার হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদছিলো বলে সুলতানের সেই রোষ কষায়িত মূর্তি প্রত্যক্ষ করতে পারলো না। সুলতানের গলার স্বরে সে চমকে উঠলো।

    সাফ সাফ জলদি জবাব দাও। আসল কথা কী? না হলে আমি তোমার গর্দান নেব, বেয়াদপ লেড়কী কোথাকার!

    বুদুর বাবার এই হুঙ্কারে কান্না-বিজড়িত ভাঙ্গা-ভাঙ্গা কন্ঠে বলতে পারলো আব্বাজান, রাগ করো না, আমাকে দয়া কর। কেন জানি না, আজ রাতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। একথা শুনলে আম্মা আমাকে আস্ত রাখবে না জানি, কিন্তু আব্বাজান, তুমি আমার অসহায় অবস্থা নিশ্চয়ই বুঝতে চেষ্টা করবে। এ কী দুর্বিপাকে পড়লাম আমি, কী অপরাধ করেছি, কেন এভাবে আল্লাহ আমাকে সাজা দিচ্ছেন। এর চেয়ে যে মরাও অনেক ভালো। আব্বাজান আমি তোমাকে বলছি আজ রাতেও যদি ফের একই ঘটনা ঘটে, তবে আর এ জীবন আমি রাখবো না। কাল সকালে আমাকে তোমরা আর জ্যান্ত দেখতে পাবে না।

    এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    সাতশো চুয়ান্নতম রজনীতে আবার কাহিনী শুরু করে সে।

    কন্যার কথায় সুলতানের হৃদয় বিগলিত হয়। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন তিনি।

    -সত্যি করে বলতো মা, কী কী ঘটনা তুমি প্রত্যক্ষ করেছ বলো, তোমার কোনও ভয় নাই। এখানে তোমার মা আসেননি। ভয়ের কোনও কারণ নাই, আমাকে সব খুলে বলো দেখি।

    বুদুর বাবার বুকে মুখ গুঁজে কাদতে কাঁদতে সব সবিস্তারে খুলে বললো তাকে।

    —তোমার যদি বিশ্বাস নাহয় আব্বাজান, উজির-পুত্রকে তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ। তাহলেই বুঝতে পারবে, আমি কতটা কি সত্যি বললাম।

    সুলতানের চোখ জলে ভরে ওঠে। প্রায় চিৎকার করে বলতে থাকেন, এ সবই আমার গলতি মা, আমিই তোমাকে হাত পা বেঁধে দরিয়ায় ফেলে দিয়েছি। এমন একটা অকাল-কুম্মার হাতে তোমাকে সঁপে দিলাম—তোমাকে রক্ষা করার কোনও ক্ষমতাই সে বুড়বাকটার নাই, বেশ না বুঝতে পারছি। আমার কত আশা কত স্বপ্ন ছিলো। তুমি আমার আদরের দুলালী—সুখে থাকবে, তোমার মুখে হাসি দেখবো, এই ছিলো আমার একমাত্র বাসনা। কিন্তু বিধি বাম হলেন, আমি দেখছি তোমার কাছে এ জীবন বিষবৎ মনে হচ্ছে, মৃত্যুর আতঙ্ক তোমাকে ঘিরে ধরেছে—এর চেয়ে দুঃখের বেদনার আর কী হতে পারে, মা? আমি ঐ অপদার্থ আহম্মকটার বাবাকে ডেকে পাঠাচ্ছি। তার কাছে আমি কৈফিয়ৎ তলব করবো, কেন তার ছেলে আমার মেয়ের জীবনটাকে এমনি ভাবে তছনছ করে দিচ্ছে। তুমি নিশ্চিন্ত থাক মা, সহজে আমি ওদের বাপ বেটাকে রেহাই দেব না। এর পরে আর একটা দিনও যাতে এসব ঘটনা না ঘটে তার ব্যবস্থা আমাকে করতেই হবে।

    সুলতান বুদুরদের বাসরকক্ষ ছেড়ে নিজের দরবারে ফিরে গেলেন। ক্রোধে তার সর্বাঙ্গ কাপছিলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন,—এই বিশ্রী ব্যাপারের ইতি তিনি ঘটাবেনই।

    প্রধান উজিরকে ডেকে পাঠালেন সুলতান। উজির হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। সুলতান ক্রোধে ফেটে পড়লেন, তোমার ঐ গুণধর পুত্রটি কোথায়? হাজির কর তাকে। গত দুই রাতে কী সব ঘটনা ঘটছে, সে তোমাকে বলেছে কিছু?

    উজির করজোড়ে বললো, আপনার এই ক্রোধের টান আমি অনুধাবন করতে পারছি না জাঁহাপনা। না, ছেলে আমাকে কিছুই বলেনি। যদি অনুমতি করেন, আমি এখনি গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি।

    সুলতান বললেন, হ্যাঁ,তাই যাও, গিয়ে জিজ্ঞেস করে উল্লুটাকে।

    উজির দরবার থেকে বেরিয়ে ছুটে যায় ছেলের সন্ধানে। উজির-পুত্র তখন গোসলাদি শেষ করে সবে হামাম থেকে বেরিয়েছে, উজির তাকে দেখতে পেয়েই রাগে ফেটে পড়ে, এই কুত্তার বাচ্চা, কুত্তা, বল কী হয়েছে গত দুই রাতে। কৈফিয়ৎ দে, কেন আমাকে সত্যি কথা সঙ্গে সঙ্গে

    জানাসনি, পিঠের চামড়া আজ আমি খুলে নেব, বদমাইশ।

    উজির-দুলাল মাথা হেঁট করে বলে, আমি বলবো বলবো ভেবেছিলাম, আব্বাজান। কিন্তু লজ্জায় সে-কথা বলতে পারিনি আপনার কাছে।

    -লজ্জা? কীসের লজ্জা? কী কী ব্যাপারটা ঘটেছে শুনি?

    উজির-তনয় গত দুই রাতের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলো তার কাছে। সব শুনে উজিরের মুখ কালো হয়ে যায়।

    ছিঃ ছিঃ, এসব শোনার আগে তোমার মরা মুখ কেন আমি দেখলাম না? কেন, একগাছি দড়িও কী তোমার জোটেনি? কড়িকাঠে ঝুলে পড়ে জান খতম করে দিতে পারনি, বে-শরম?

    উজির-পুত্র অধোবদন হয়েই বলে, সত্যিই আব্বাজান, এর চেয়ে মৃত্যুই আমার কাছে অনেক ভালো। এমন শাদীতে আমার দরকার নাই। অমন পরমাসুন্দরী শাহজাদী আমার চাই না আব্বাজান। আমি ঠিক করেছি, ওকে আমি তিনতালাক বয়ান তালাক দেব—আজই। আপনি সুলতানকে বলে দিন, আজ থেকে শাদী-নামা নাকচ হয়ে গেলো। আমি বাদশাহ বনতে চাই না, আব্বাজান। ধনদৌলত, সলতানিয়ত কুমত আর শাহজাদীতে আমার লোভ নাই। সব শখ আমার মিটে গেছে। আমি আপনার সাধারণ উজির সন্তান হয়েই একটু শান্তিতে বাস করতে চাই। সারা জীবন আমি অকৃতদার হয়ে একা একা নিজের ঘরে কাটাবো, তবু ঐ সব প্রাণান্তকর ঝামেলার মধ্যে আমি আর মাথা গলাবো না, আব্বাজান। পায়খানার নর্দমার মধ্যে রাত্রিবাস—উফ, সে কী দুঃসহ যন্ত্রণা। ওসব আমি আর ভাবতে পারছি না, এর এখনই একটা বিহিত করুন আপনি।

    ছেলের কথায় উজির মুষড়ে পড়ে। তার কত উচ্চাশা ছিলো—সে একদিন এই বিশাল সলনিয়তের একচ্ছত্র অধিপতি হবে। তার হুকুমেই চলবে সব। কিন্তু মুখপোড়া বাঁদর। ছেলেটা এসব কী বলছে? সব সাধ যে তার ভেস্তে গেলো।

    —আমি বুঝতে পারছি, অশেষ ক্লেশ তোমাকে সহ্য করতে হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা কী ভেবে দেখেছ, এর ফলে কতটা তুমি হারাবে? তার চেয়ে আমি বলি কি, ধৈর্য ধরে আর একটা রাত দেখো। কথা দিচ্ছি, আমি তোমার জন্যে সশস্ত্র প্রহরার ব্যবস্থা করবো, তোমার কোনও ভয় নাই, কেউ স্পর্শ করতে পারবে না তোমাকে।

    —আপনি যত খুশি পাহারার ব্যবস্থা করতে পারেন, কিন্তু আমি আর ঐ অপয়া বাসরঘরে ঢুকবো না, আব্বাজান।

    উজির বিষণ্ণ মনে ফিরে আসে দরবারে। সুলতান জিজ্ঞেস করে, এবার তোমার কী বলার আছে বলে উজির?

    উজির মাথা হেঁট করে বলে, শাহজাদী যা বলেছেন, তা সবই সত্য, জাঁহাপনা। কিন্তু সে-জন্য আমার ছেলের কোনও দোষ নাই। যাই হোক, শাহজাদী বুদুরকে এই ভীতি থেকে অব্যহতি দেবার জন্যেই আমার পুত্র তাকে তালাক দিতে চায়।

    —চমৎকার। আমিও সেই কথাই ভাবছিলাম। এ শাদী সুখের হতে পারবে না। সুতরাং তালাকই শ্রেয়। পাত্র যদি তোমার পুত্র না হতো উজির, তবে আমি তাকে তলোয়ারের এক কোপেই খতম করে দিতাম। যাক, আপদ চুকে গেলো, তুমি আজই আবার সারা দেশে ঘোষণা করে দাও, শাহজাদীর শাদী নাকচ হয়ে গেছে। আর এও জানিয়ে দাও সবাইকে, যদিও উজির-পুত্রের সঙ্গে তার শাদী হয়েছিলো তবু এখনও সে অপাপবিদ্ধ কুমারী। তার সতীত্ব অটুট আছে।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ বলা থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো পঞ্চান্নতম রজনীঃ

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    আলাদিন ঘরে বসেই জানতে পারলো, শাহজাদীর শাদী নাকচ হয়ে গেছে। আনন্দে সে নেচে উঠলো। আশ্চর্য যাদু চিরাগের দৈত্যের উদ্দেশ্যে সে দু হাত তুলে আশীর্বাদ জানাতে থাকলো। এতো সহজে এমন চমৎকার ভাবে কাজ সমাধা হয়ে গেলো-আফ্রিদি ছাড়া কী সম্ভব হতে পারতো!

    সুলতানের কথামতো তিন মাসের শেষ দিন পর্যন্ত সে চুপচাপ অপেক্ষা করলো। তারপর আলাদিন মাকে বললো, মা এবার তুমি সুলতানের কাছে যাও। গিয়ে বলল, আপনার কথামতো আমি তিন মাস অপেক্ষা করেছি। এখন আপনি আপনার সত্য রক্ষা করুন।

    আলাদিনের মা দরবারে আসতেই সুলতান তাকে চিনতে পারেন। উজিরের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। উজির তখন কম্পমান। সুলতানকে বললো, জাঁহাপনা, আমাদের পরম সৌভাগ্য যে সেই জাহাজ ডুবিতে আল্লাহর অশেষ কৃপায় আলাদিন প্রাণে রক্ষা পেয়ে দেশে ফিরে এসেছে সম্প্রতি। কথাটা আমি আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, জাহাপনা। আমার গোস্তাকি মাফ করুন।

    সুলতান বললেন, আল্লাহই আমাকে সত্যভ্রষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন, উজির। আজ যদি তোমার ছেলে শাহজাদীকে তালাক দিয়ে মুক্ত না করতো তবে আমি তো মহাপাতক হতাম। আজ তো সে শাহজাদীকে দাবী করতেই এসেছে আমার কাছে। আমি ভাবতে পারছিনা, বয়ান তালাক হয়ে গেলে কী কেলেঙ্কারী কাণ্ডটাই না হতো আজ। খোদা মেহেরবান। তিনি আমার সত্য রক্ষা করেছেন। আমি যে বাগদান করেছিলাম উজির! উফ, ভাবতে পারছি না—কী সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটতে পারতো। যাই হোক, এখন আল্লাহর দোয়ায় আমার সত্য রক্ষা হবে!

    উজির তখন ঈর্ষায় জ্বলছিলো! শাহজাদীর শাদী বাগড়া দিয়ে ভণ্ডুল করার শেষ চেষ্টা করলো সে, জাঁহাপনা, আপনি আমাকে হুকুম করেছিলেন পাত্রের সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিতে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার সব তথ্য সংগ্রহ করেছি। আলাদিনের বাবা এই শহরের একপ্রান্তে একটি ছোট্ট দর্জির দোকানে কাজ করে প্রায় অর্ধাহারে দিন কাটাতো। মরার সময় সে একটা কানাকড়িও রেখে যেতে পারেনি বিবি-বাচ্চার জন্য। এখন জাঁহাপনা নিজেই বিবেচনা করে দেখুন, এই দীন-দরিদ্র দর্জির সন্তানের সঙ্গে শাহজাদীর শাদী দেওয়া সঙ্গত হবে কিনা! আমার তো একদম বিশ্বাস হয় না, সে সভাবে জীবন-যাপন করে।

    সুলতান বলেন, কিন্তু এখন সে তো আর গরীব নাই উজির। যে-সব রত্নমাণিক সে যৌতুক পাঠিয়েছিলো, তা দেখার পর নিশ্চয়ই তোমার মনে কোনও সংশয় নাই।

    —আমিও সেই কথাই বলছি, জাঁহাপনা। এই সামান্য কিছুকাল আগেও যার ঘরে দু’বেলা উনুন জ্বলতো না, সে সভাবে এই সম্পদ রোজগার করলে কী করে?

    সুলতান হাসেন, তুমি একটা আস্ত আহাম্মক। যে সব রত্নমণি-মাণিক্য সে আমাকে ভেট পাঠিয়েছে তা কেউ রোজগার করে কখনই সঞ্চয় করতে পারে না, উজির। একটা জীবনে দূরে থাক, সাতপুরুষ ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে ফুলে ফেঁপে উঠলেও এ ধন-সম্পদ সংগ্রহ করা সম্ভব না। একমাত্র খোদাতালার অসীম কৃপা ছাড়া এসব বস্তু কারও করায়ত্ত হতে পারে না। তার নিজের নসীবেই হোক বা তার পূর্ব-পুরুষদের সুকৃতির ফলেই হোক, একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহেই সে এই দুর্লভ সম্পদের মালিক হতে পেরেছে। কিভাবে কেমন করে সে হতে পেরেছে সে সব তথ্য আমার জানবার প্রয়োজন নাই। এটুকু বুঝতে পেরেছি, সে পরম ভাগ্যবান পুরুষ হয়ে ধরায় জন্মেছে। সুতরাং শাহজাদী বুদুর তারই ভোগের পাত্রী হওয়া উচিত বলে মনে করি আমি।

    উজির দেখলো আর কোনও মতেই সুলতানকে নিরস্ত করা যাবে না। তবু শেষবারের মতো আর একটা বাণ ছুঁড়লো সে।

    মহামান্য সুলতানকে এই অধমের নিবেদন, সবই ঠিক আছে, তা আলাদিনের ঐশ্বর্য ভাণ্ডার পরীক্ষা করার জন্য আর একদফা যৌতুক চেয়ে পাঠানো দরকার মনে করি আমি। অবশ্য জাঁহাপনা যদি আমার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন আমার কিছু বলার নাই।

    সুলতান স্মিত হাসলেন, উত্তম। তাহলে পাত্রের মাকে সেই বায়নাই শুনিয়ে দাও উজির। ঠিক আছে ওর মাকে আমার সামনে এসে দাঁড়াতে বলল আমিই বলছি তাকে।

    সুলতানের হুকুম মতো আলাদিনের মা তার সামনে এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ালো। সুলতান বললেন, আমি তোমাকে দেখেই চিনতে পেরেছি মেয়ে। আমি আমার হলফ-এর কথা ভুলিনি, মনে আছে। তোমার পুত্রের সঙ্গেই শাহজাদীর শাদী হবে সন্দেহ নাই। এবার তাহলে দেনমোহরের কথায় আসা যাক, কী বলো? একথা তো সারা দুনিয়ার মানুষ জানে, শাহজাদী বুদুরের রূপের জোড়া নাই কোথাও। সুতরাং যোগ্য পাত্রীর যোগ্য দেনমোহর তত দিতে হবে।

    —জাঁহাপনা যথার্থ বলেছেন। উপযুক্ত দেনমোহর ছাড়া তো শাদী সুসম্পন্ন হতে পারে না। আপনি আজ্ঞা করুন, হুজুর। আপনার অভিলাষ পূরণ করবো।

    সুলতান বললো, সাবাস! তবে শোনও আমার কন্যা যা চায় তার ফিরিস্তি শোনাচ্ছি, তিন মাস আগে যে রত্নমণিগুলো আমাকে উপঢৌকন পাঠিয়েছিলো তোমার পুত্র, সেই রকম চল্লিশখানা সোনার থালায় ভর্তি ঐ ধরনের। মণিমাণিক্যের ফল সাজিয়ে নিয়ে আসবে চল্লিশজন সুবেশা সুন্দরী বাঁদী। আর এই বাঁদীদের পাহারা দিয়ে নিয়ে আসবে চল্লিশজন নিগ্রো নফর। তারা কালো হলেও দেখতে সকলেই সুন্দর এবং তাগড়াই জোয়ান যুবক হওয়া চাই। তারা সবাই বাদশাহী কেতা অনুসারে যথাযোগ্য সুন্দর সুন্দর সাজে সুসজ্জিত হয়ে আসবে আমার প্রাসাদে। ব্যস, এর বেশি আর আমার কিছু চাইবার নাই, পাত্রের মা। অবশ্য তোমার ছেলে এর আগে আমাকে যা পাঠিয়েছে তার একটা মণি-মাণিক্যের মূল্য অনেক। কোনও সুলতান বাদশাহঐ সব রত্ন-মাণিক্যের একটাও সংগ্রহকরে আনতে পারবেনা আমি জানি। তাই এ আমার দাবিনয়, অভিলাষ।যদি তোমার পুত্র পূরণ করতে পারে, আমি খুব খুশি হবো।

    আলাদিনের মা সুলতানের বায়না শুনে শিউরে উঠলো। সর্বনাশ, এই রকম অসম্ভব দাবি কেউ পূরণ করতে পারে নাকি! এতো শাহজাদীকে না দেবার ছল।মুখে হা না কোন শব্দ উচ্চারণ না করে সে নীরবে দরবার ছেড়ে ঘরে ফিরে যায়। কাঁদতে কাঁদতে সে ছেলেকে বলে, আমি আগেই বলেছিলাম। বাবা, ওসব সুলতান বাদশাহদের সংস্রবে যেতে নাই। তুই শাহজাদী বুদুরের আশা ছাড়। কিন্তু আমার কথা শুনলি না তখন, এখন ঠেলা বোঝ।

    আলাদিন উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন মা, আবার কী বাগড়া হলো?

    আলাদিনের মা তখন ইনিয়ে বিনিয়ে লোভী শকুনি সুলতানের লালসার কাহিনী শোনালো ছেলেকে।

    -বাবা তখন যদি ঐ সোনার থালাগুলো না বেচে লুকিয়ে রাখতিস তবে আবার না হয় সেই পাহাড় গুহায় ঢুকে ঐরকম কিছু কাচের ফল সংগ্রহ করে আনতিস। কিন্তু সে-সব কঁচ পাথরের ফল জোগাড় হলেও চল্লিশখানা সোনার থালা কোথায় পাবি, বাবা। আর সোনার থালাও যদি যোগাড় হয়, ঐ চল্লিশটা সুন্দরী বাঁদী আর চল্লিশটা নিগ্রো নফর তুই কোথায় পাবি? জানিস বেটা সুলতানটা হয়তো অত খারাপ নয়, কিন্তু বাঁদরমুখো ঐ পাজি উজিরটাই যত নষ্টের গোড়া। যত সব কুবুদ্ধি, ঐ লোকটাই জোগাচ্ছে তাকে। সে চায় না এ শাদী হোক। কারণটা অতি সোজা—এতো বড় হুকুমত আর অমন সুন্দরী শাহজাদী তার হাতছাড়া হয়ে গেছে—এ শোক কী সে ভুলতে পারে? আমি স্বচক্ষে দেখলাম, ঐ শয়তান উজিরটা সুলতানের কানে কানে ফুসমন্তর দিচ্ছিল।

    আলাদিন হাসে। তোমাকে কালো মুখ করে ঢুকতে দেখে আমার তো আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে গিয়েছিলো মা। ভাবলাম আবার বুঝি সব কেঁচে গেছে। কিন্তু এখন ধড়ে প্রাণ এলো, যাক বাঁচালে

    তুমি।

    —ধরে প্রাণ এলো?বলিস কী বাবা?সুলতানের যা বায়নাক্কা তাতে কী তুই শাহজাদীকে ঘরে আনতে পারবি কখনও?

    –আলবাৎ পিরবো মা। তুমি কিছু ভেবো না। তুমি জান না, আমার হাতে কী মোক্ষম অস্ত্র আছে। পয়সা-কড়ির সমস্যা আমার কাছে কোনও সমস্যাই নয়। এক লহমায় আমি সুলতানের সব চাহিদা পূরণ করে দেব! তুমি নিশ্চিত হয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাও গে, মা।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.