Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ৩.১৬.৪ আলাদিনের দৈত্য (পার্ট ৪)

    সাতশো ছাপ্পান্নতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    আলাদিনের মা দ্বিধা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আলাদিন এতো জোর দিয়ে ও সব কথা কী করে বলতে পারে বুঝতে পারলো না সে। খানা পাকাবার জন্য বাজারে সওদা করতে চলে যায় সে।

    আলাদিন দরজা বন্ধ করে চিরাগটা বের করে মৃদু ঘষা দিতেই সেই আফ্রিদিটা আবার এসে হাজির হয়ে কুর্নিশ জানিয়ে বলে আমি ত্রিভুবনের মালিক, আমার ওপরে আর কেউ নাই। কিন্তু আমার মালিক ঐ চিরাগ। এখন তা আপনার হাতে, সুতরাং আপনিই আমার একমাত্র মালিক। আজ্ঞা করুন, হুজুর, কী করতে হবে আমাকে?

    আলাদিন বলে, শোনও আফ্রিদি, সুলতান তার কন্যা বুদুরকে আমার সঙ্গে শাদী দিতে রাজি হয়েছে। আর তার বদলে আমাকে চল্লিশটা সোনার থালায় ভর্তি করে মণি-মাণিক্য পাঠাতে হবে। আর সেই থালাগুলো প্রাসাদে বয়ে নিয়ে যাবে চল্লিশজন সুবেশা সুন্দরী বাঁদী। তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবে চল্লিশটি সুদর্শন সুঠামদেহী নওজোয়ান নিগ্রো নফর। এ সবই তোমাকে ব্যবস্থা করতে হবে, পারবে তো?

    আফ্রিদি বিকট মুখব্যাদন করে হাসলো, কী যে বলেন মালিক; এ আবার একটা কাজ নাকি! আমি এক পলকেই আপনার কাছে সব হাজির করে দিচ্ছি।

    আফ্রিদি অদৃশ্য হয়ে গেলো। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চল্লিশজন সুন্দরী বাদী আর চল্লিশজন নওজোয়ান নিগ্রো নফরকে এনে হাজির করলো আলাদিনের বাড়ির সামনে। বাদীগুলোর প্রত্যেকের মাথায় একখানা করে বিরাট বড় সোনার থালা। আর সেই সব থালায় থরে থরে সাজানো মণি-মাণিক্যের নানা রকম ফল। আলাদিন এর আগে সুলতানকে ভেট পাঠিয়েছিলো তার চাইতেও আকারে এগুলো অনেক বড়।

    আলাদিন ইশারা করতে আফ্রিদি অদৃশ্য হয়ে গেলো। আলাদিনের মা বাজার থেকে ফিরে এসে ছেলের শান্তভাব দেখে তাজ্জব বনে যায়। এই এক দণ্ডের মধ্যে আলাদিন এভোগুলো নফর বাঁদীই বা জোগাড় করলো কী করে? আর ঐ সব হীরে চুনি পান্না মণি-মাণিক্য ভর্তি সোনার থালাগুলোই বা কোথায় পেলো সে!

    আলাদিন হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

    -কী মা, কী দেখছো? খুব অবাক হচ্ছে, ছেলের কাণ্ড দেখে, তাই না? এ আমার এমন কী, তোমার ছেলে আরও অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে মা।

    আলাদিন মায়ের হাত থেকে বাজারের থলেটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, মা তুমি আর দেরি করো না। এদের নিয়ে এখুনি প্রাসাদে রওনা হয়ে যাও। সুলতানের পায়ের সামনে থালাগুলো নিবেদন করে বলল, জাঁহাপনার সব ফরমাশ এনে হাজির করেছি, এবার শাদীর আজ্ঞা করুন।

    আলাদিনের মা চল্লিশজন বাঁদী আর চল্লিশজন নিগ্রো নফরকে সঙ্গে নিয়ে সুলতানের প্রাসাদাভিমুখে রওনা হলো।

    এক একজন সুবৰ্ণ-থালা-বাহক বাঁদী তার সামনে দশ হাত এবং পিছনে দশ হাত দূরে দূরে এক একজন নিগ্রো নফর। সকলেই জমকালো সাজে সজ্জিত। সেই আশিজনের বিশাল বাহিনী নিয়ে আলাদিনের মা প্রাসাদ-ফটকে এসে হাজির হলো এক সময়।

    সান্ত্রীরা ছুটে গিয়ে সুলতানকে খবর দিলো, আলাদিনের মা শাদীর দেনমোহর নিয়ে এসেছে, জাঁহাপনার সঙ্গে মোলাকাত করতে। সুলতানের নির্দেশে তাকে বর করে দরবারে নিয়ে আসতে গেলো উজির।

    সুলতান সেদিনের মতো দরবারের কাজ মুলতুবী করে সভা ভঙ্গ করে সকলকে বিদায় দিয়ে নতুন অভ্যাগতদের জন্য দরবারকক্ষ মুক্ত করে রাখলেন।

    এক এক করে চল্লিশজন সুসজ্জিত নিগ্রো নফর এবং চল্লিশজন সুবেশা সুন্দরী বাঁদী দরবারে প্রবেশ করলো। মেয়েরা সুলতানের মসনদের সামনে সোনার থালাগুলো এক এক করে নামিয়ে রেখে এক পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সকলে। আর এক পাশে দাঁড়ালো নিগ্রো-নফরগুলো। মা এসে দাঁড়ালো ঠিক মাঝখানে। যথাবিহিত কুর্নিশ জানিয়ে বললল, আপনার ওয়াদা মতো সবকিছু এনে হাজির করেছি, জাঁহাপনা। এবার আপনি সন্তুষ্ট মনে। শাদীর সম্মতি দিলে বাঁদী কৃতার্থ হবে।

    সুলতান অভাবনীয় দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি একবার সুবর্ণ থালায় সজ্জিত মণি-মাণিক্যের রত্নফলগুলোর দিকে আর একবার সুন্দরী বাদীদের দিকে এবং সুঠামদেহী নিগ্রো নফরদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নয়ন ভরে দেখতে থাকলেন। এই সময়ে আলাদিনের মা যে তাকে কুর্নিশাদি জানিয়ে তার আর্জি পেশ করেছে সে দিকে আর একদম খেয়াল নাই। সুলতানকে নীরব থাকতে দেখে আলাদিনের মা প্রমাদ গুণলেন, হায় আল্লাহ, জাঁহাপনার বুঝি পছন্দ হয়নি এ সব।

    -আমার গোস্তাকি মাফ করবেন জাঁহাপনা, কোথায় আমার ত্রুটি হয়েছে জানলে তার বিহিত করতে পারি। মনে হচ্ছে, শাহেনশাহ খুশি হতে পারেননি।

    আলাদিনের মা-এর এই কথায় সুলতান সম্বিত ফিরে পান। উজিরের এ দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, তাজ্জব ব্যাপার। এই সব দৌলতের কাছে আমার কোষাগারের ধনরত্ন তো তুচ্ছ উজির!

    উজির মাথা নাড়লেন, জাঁহাপনা যথার্থই বলেছেন।

    সুলতান বললেন, এমন অতুল ঐশ্বর্যের যে মালিক সে হবে আমার জামাতা—এ কি আমার কম সৌভাগ্যের কথা উজির?

    —হুজুর যথার্থই বলেছেন।

    সুলতান বললেন, আমার কন্যা শাহজাদী বুদুরের রূপের খ্যাতি জগৎজোড়া সন্দেহ নাই, কিন্তু তাই বলে এত বিপুল ধনরত্নের মালিক যে তার স্বামী হবে তাও তো আমি কল্পনা করতে পারিনি, উজির? -মহানুভবশাহেনশাহ যথার্থই বলেছেন। তবে যদি অভয় দেন একটা কথা বলি, আমাদের শাহজাদী বুদুরের রূপের মূল্য এ-সব ধন-দৌলত দিয়ে মাপা যাবে না, জাঁহাপনা।

    সুলতান বুঝলেন, উজির তাকে তোষামদ করতে চাইছে। হেসে বললেন তিনি, না না, উজির ওসব কথা বলে তুমি আমাকে খুশি করতে পারবে না। যে সম্পদ আজ আলাদিন পাঠিয়েছে এখানে তামাম দুনিয়ার সব কিছুর বদলেও তার দাম শোধ হয় না। বুদুর আমার চোখের মণি, আদরের ধন, জগতের সেরা সুন্দরী, কিন্তু, বাবা হয়েও বলছি, এতো দাম তার হতে পারেনা। যাই হোক, এরপরে তুমি আর বলতে পার না, উজির, আমি আমার কন্যাকে হাত পা বেঁধে দরিয়ায় ফেলে দিতে যাচ্ছি।

    উজির মুখ কাচুমাচু করে বলে, না, তা অবশ্য নয়

    সুলতান এবার দরবারের অন্যান্য আমির অমাত্যদের দিকে তাকালেন। তারা সবাই সমস্বরে প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলো।

    —এমন সুপাত্র আর দুটি পাওয়া যাবে না, জাঁহাপনা। আমাদের মনে হয়, মহামান্য আলাদিনই শাহজাদী বুদুরের একমাত্র যোগ্য পাত্র।

    সকলে উঠে দাঁড়িয়ে আভূমি আনত হয়ে তিনবার কুর্নিশ জানালো সুলতানকে। অর্থাৎ তারা সকলে সর্বান্তঃকরণে সম্মতি দিলো।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    সাতশো আটান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    সুলতান এবার আলাদিনের মা-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার পুত্র আলাদিনের অতুল সম্পদ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু বুদুরকে জীবনসঙ্গিনী রূপে পেতে গেলে টাকাটাই তো একমাত্র ব্যাপার নয়, এখন বল তোমার পুত্র আর কী কী গুণের অধিকারী?

    আলাদিনের মা বললো, ছেলে আমার রূপবান, অবশ্য লোকে বলে। আমি মা, মা-এর চোখে সব সন্তানই অপরূপ, সুতরাং আমার মতামত আপনাকে শোনাবো না, জাঁহাপনা। আমার চোখে ছেলে বড় দুবলা; কিন্তু অপরে বলে আলাদিনের মত সুন্দর স্বাস্থ্যবান নওজোয়ান নাকি এ শহরে খুব বেশি নাই।

    -ব্যস ব্যস, সুলতান উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, আর বলতে হবে না। রূপ আছে, যৌবন আছে, দৌলত আছে এর চেয়ে বেশি তো আর কী চাই? এ-ই বুদুরের একমাত্র যোগ্য বর। আমি আর একদিনও দেরি করতে চাই না পাত্রের মা। আজ থেকেই তাকে আমি আমার বাদশাহী খানদানীর এক শরিক করে নিতে চাই। এই মুহূর্ত থেকে আমি আমার পুত্রাধিক স্নেহে বুকে টেনে নিতে চাই। পবিত্র গ্রন্থ সাক্ষী রেখে তার সঙ্গে আমার কন্যার শাদী দেব আজ সন্ধ্যায়। এই আমার পাকা কথা।

    আলাদিনের মা দরবার থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরে আসে। আলাদিন অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসেছিলো। না জানি আবার কোন বাগড়া আসে। মাকে ছুটে আসতে দেখে আলাদিন বুঝতে পারে, সংবাদ শুভ।

    আলাদিন বলে, কী সংবাদ এনেছ, মা?

    মা বলে, সুলতান পাকা কথা দিয়েছেন। আজই শাদী হবে।

    আলাদিনের আনন্দ আর ধরে না। এতদিনে তার মনস্কামনা পূর্ণ হতে চলেছে। মা বলে, সবই আল্লাহর অসীম কৃপাতে সম্ভব হতে চলেছে, বাবা। তার করুণা ছাড়া এ-অসম্ভব কী করে সম্ভব হতে পারে? নে আর দেরি করিস নে, তৈরি হয়ে নে। সন্ধ্যের আগেই রওনা হতে হবে।

    আলাদিন নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে প্রদীপটা বের করে আলতোভাবে ঘষে। এবং তৎক্ষণাৎ এসে হাজির হয় সেই আফ্রিদি। আলাদিন বলে, শোনো চিরাগের বান্দা, আমি আগে গোসল করবো, তারপর জমকালো শাহজাদার সাজপোশাকে সাজবো। এমন বাহারী মূল্যবান। পোশাক আমার জন্যে আনবে যা দুনিয়ার আর কেউ যেন যোগাড় করতে না পারে। লোকে দেখে যাতে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে আমার দিকে। খুব কম করে হলে লক্ষ কোটি দিনার তার দাম হওয়া চাই।

    আফ্রিদি কুর্ণিশ জানিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বসে বললো, আপনি আমার পিঠে চেপে বসুন, মালিক। আমি আপনাকে হামামে নিয়ে যাব।

    আলাদিন চেপে বসলে আফ্রিদি তাকে নিয়ে আকাশ পথে উড়তে উড়তে এক সুরম্য হামামে নিয়ে এসে হাজির হলো। এমন চোখ ঝলসানো হামাম কোনও সুলতান বাদশাহও চোখে দেখেনি কখনও। আগাগোড়া ইমারতটা স্ফটিকে নির্মিত। প্রবাল, পোখরাজ, পান্না, মতি দিয়ে নানারকম কারুকার্য করা। একটা বিশাল ফুলবাগিচার মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের নিচে এই হামাম। বাগিচার মাঝখানে একটি বিরাট জলের ফোয়ারা-অবিরত ধারা বহন করে চলেছে। তাকে ঘিরে প্রশস্ত এক জলধারা—প্রায় পুকুরের মতো। স্বচ্ছ নির্মল নীল জল-নিথর। মনে হয় এখানে কেউ কখনও অবস্থান করেনি এর আগে। আলাদিন এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারলো, ধারে কাছে কোনও লোকালয় নাই। শুধু পাখির কূজন ছাড়া জন-মানবের কোনও সাড়া নাই।

    অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কেটে স্নান করলো আলাদিন। আফ্রিদি সাজ-পোশাক নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো পুকুরের পাড়ে। আলাদিন জল থেকে উঠে এসে ঐ সাজ-পোশাকে শাহজাদার মতো করে সাজলো।

    এরপর আফ্রিদি আবার তাকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে নামায়। আলাদিন বলে, এর পর। তোমাকে কী করতে হবে জান, বান্দা?

    আফ্রিদি বলে, হুকুম করুন, মালিক।

    আলাদিন বলে, আমার জন্যে একটা চমৎকার তাজি ঘোড়া নিয়ে এসো। সব চেয়ে সেরা হওয়া চাই। সেই সঙ্গে আটচল্লিশটা সুঠাম সুন্দর নওজোয়ান বান্দা নিয়ে আসবে। ওরা আমার ঘোড়ার দুই পাশে এবং সামনে পিছনে বারজন করে সারিবদ্ধভাবে প্রহরী হয়ে চলবে। এছাড়া আরও বারটি সুবেশা সুন্দরী বাদী চাই আমার মা-এর জন্য। মাকে বৃত্তাকারে ঘিরে সুলতানের প্রাসাদে নিয়ে যাবে তারা। আরও একটা কথা, আমার আটচল্লিশজন দেহরক্ষী প্রত্যেকের গলায় একটা করে পাঁচ হাজার দিনার ভর্তি বটুয়া ঝোলানো থাকবে। প্রয়োজন হলে যাতে আমি সেই অর্থ দু’হাতে খরচ করতে পারি। বৎস, এখন এই পর্যন্ত। তুমি এসো।

    রাত্রির অন্ধকার সরে যেতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    সাতশো ঊনষাটতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    আলাদিনের কথা শেষ হতে না হতেই আফ্রিদি অদৃশ্য হয়ে গেলো। কিন্তু সে ক্ষণকালের জন্য। পর মুহূর্তেই সে একটা আরবী তাজি ঘোড়া, আটচল্লিশটা বান্দা, বারটি সুন্দরী বাঁদী এবং অন্যান্য যে-সব জিনিসপত্র আলাদিন ফরমাস করেছিলো-সব যথাযথ এনে হাজির করলো। এবং সব কিছুই বড় চমৎকার। আলাদিন যেমন যেমন চেয়েছিলো তার চেয়েও সুন্দর।

    আলাদিন বললো, ঠিক আছে, এখন তুমি যাও। আবার যখন দরকার হবে ডাকবো।

    আফ্রিদি অভিবাদন জানিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

    আলাদিন ঘোড়ায় চেপে বসলো। বান্দারা সারিবদ্ধভাবে তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়ালো। মা সেজেগুজে বাইরে আসতে বাঁদীরা তাকে বৃত্তাকারে ঘিরে নিলো।

    এইবার আলাদিন শহর পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়লো। রাস্তার দু’ধারে কাতারে কাতারে শত সহস্র মানুষ জমায়েৎ হতে লাগলো। সুলতানের হবু জামাতা আলাদিনকে দেখার কৌতূহলে পদানসীন মেয়েরাও জানালার পর্দা সরিয়ে তাকিয়ে রইলো পথের দিকে।

    মহা সমারোহে পথ পরিক্রমা শেষ করে এক সময় মিছিল প্রাসাদ ফটকে এসে হাজির হলো।

    সুলতান আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিলেন আলাদিন সদলে প্রাসাদ অভিমুখে আসছে। যথাযোগ্য সমাদরে হবু জামাতাকে বরণ করার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সুলতান স্বয়ং প্রাসাদ প্রাঙ্গণের ওপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আলাদিনকে অভ্যর্থনা করার তদারক করছিলেন।

    উজির হাতে ধরে আলাদিনকে ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য করলো। আলাদিন এগিয়ে গিয়ে সুলতানের সামনে দাঁড়িয়ে যথাবিহিত কুর্নিশ জানালো। আলাদিনের সুন্দর চেহারা এবং তার

    মূল্যবান সাজ-পোশাক দেখে মুগ্ধ হয়ে এগিয়ে এসে তাকে আলিঙ্গন করলেন। এর সঙ্গে সঙ্গে আমির অমাত্য সেনাপতিদের হর্ষধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে নানারকম বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠলো এক অপূর্ব ছন্দলহরী তুলে!

    সুলতান আলাদিনকে এক হাতে বেষ্টন করে ধীর পদক্ষেপে নদরবার কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, খোদা হাফেজ, বাবা, আল্লাহর অভিপ্রায় কেউ এড়াতে পারে না। শাহজাদী বুদুরের সঙ্গে তোমার মিলন বিধাতার লিখন, তাই শেষ পর্যন্ত তা ঘটতে চলেছে। অনেক আগেই এশাদী হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক যা হয়ে গেছে ও নিয়ে এখন সে জন্য আমি দুঃখিত বাবা। যাক, যা হবার তা হয়ে গেছে, ও নিয়ে এখন আমার খেদ নাই। সব ভালো যার শেষ ভালো।

    আলাদিন বললো, ফল পাকবার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। সময় না হলে তা ভোগের যোগ্য হয় না, জাঁহাপনা।

    আলাদিনের এই চমৎকার সারবান কথায় মুগ্ধ হন সুলতান।

    —আজ আমি ধন্য আলাদিন, তোমার মত যোগ্য পাত্র কার না কাম্য। দুনিয়ার যে-কোনও সুলতান বাদশাহ তোমাকে জামাতা করতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতো।

    দরবারে নিজের তখতের একপাশে বসিয়ে আলাদিনের সঙ্গে নানারকম সৌহার্দ্যপূর্ণ আলাপ আলোচনায় মেতে উঠলেন সুলতান।

    এর পর খানা-পিনার আয়োজন করা হয়। দরবারের আমির অমাত্যদের সঙ্গে নিয়ে সুলতান এবং আলাদিন আহারাদি সমাধা করেন। এই ভোজসভার প্রধান পরিবেশক ছিলো সেই বাঁদরমুখো বুড়ো প্রধান উজির। সে নিজে হাতে সুলতান এবং আলাদিনের খানাপিনা পরিবেশন করলো।

    আহার উৎসব শেষ হলে সুলতান কাজী এবং সাক্ষীদের ডেকে পাঠালেন। তার এসে শাদী-নামা বানিয়ে সইসাবুদ করে দিয়ে বিদায় নিলো।

    সুলতান আলাদিনকে বললো, বাবা, আজ রাতে তুমি কি বাসরঘরে বুদুরকে নিয়ে সহবাস করবে?

    আলাদিন বলে, জাঁহাপনা, যে শুভ মুহূর্তটির জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি এতো কাল, সেই সৌভাগ্য আমি হাতের মুঠোয় পেয়ে আর ক্ষণকাল বিলম্ব করতে চাই না। শাহজাদী বুদুরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমার হৃদয়মন আকুল হয়ে উঠেছে। আমি তাকে একান্ত করে পেতে চাই জাঁহাপনা। প্রাসাদের ওই কল-কোলাহল আমাদের ভালোবাসার অন্তরায় হয়ে উঠবে। তাই আমি আপনার এই প্রাসাদকক্ষে আমার বিবিকে নিয়ে সহবাস করতে ইচ্ছা করি না।

    সুলতান বললেন, বেশ তো তুমি যদি জনসমারোহ পছন্দ না করে তবে তোমার জন্য আমি আমার প্রমোদ বিরাহের নিরালা নির্জন প্রাসাদকক্ষই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সেখানে প্রকৃতির অপরূপ শোভা তোমাদের মুগ্ধ করবে। বাইরের কোনও অবাঞ্ছিত মানুষ বিরক্ত করতে যাবে না।

    -না, জাঁহাপনা। শাহজাদী বুদুর আমার প্রাণের স্পর্শমণি। তাকে আপনার জলসাঘরে নিয়ে তুলতে চাই না। সে ফুলের মতো পবিত্র নির্মল। বহু বাঁদীর নূপুর নিক্কণে যে প্রাসাদের পাথরের মেঝে কলঙ্কিত হয়ে আছে শাহজাদী বুদুর সে ঘরে পা রাখবে না।

    সুলতান আহত হলেন, ঈষৎ; কিন্তু আনন্দিত হলেন ততোধিক। কী অপরূপ মান ইজ্জৎ বোধ! বুদুর তার প্রাণাধিক কন্যা। প্রমোদ-বিহারের রঙমহলে তাকে নিয়ে যাওয়া যে অসঙ্গত এ চৈতন্য তিনি আলাদিনের কাছ থেকেই পেলেন। জামাতার বুদ্ধিমত্তা বিচক্ষণতা ও আত্মসম্মানবোধে সুলতান বিমোহিত হয়ে গেলেন।

    —তা হলে তুমিই অভিপ্রায় ব্যক্ত কর বেটা, তোমাদের মধুযামিনী কোথায় হতে পারে। যেখানে বলবে সেখানেই আমি ব্যবস্থা করে দেব।

    আলাদিন বললো, এই প্রাসাদের এ পাশে যে বিশাল ফাকা মাঠটা পড়ে আছে ঐ মাঠে আমি একখানা নতুন প্রাসাদ বানাতে চাই, জাঁহাপনা। সেই নতুন প্রাসাদে আমি আমর বিবিকে নিয়ে বসবাস করতে চাই। এখন আপনার অনুমতি পেলেই আমি কাজে হাত দিতে পারি।

    —এ অতি উত্তম কথা। তুমি আমার শুধু জামাতা নয়। পুত্রসম প্রাণাধিক প্রিয়। তোমার যেখানে খুশি যেমন খুশি, প্রাসাদ ইমারত বানাও, এর জন্য আমার কোনও অনুমতির প্রয়োজন নাই, বাবা। তোমরা দুজনে বেহেস্তের সুখে সম্পদে দিন কাটাবে—এই তো আমি আশা করবো। তার জন্য যা যা দরকার আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। তাহলে আর দেরি করো না বাবা, চটপট প্রাসাদ নির্মাণের কাজ শুরু করে দাও। বলা তো যায় না, বুড়ো হয়েছি, কবে আছি কবে নাই, যাবার আগে তোমরা ঐ প্রাসাদে বসবাস করছো-পুত্র পরিবার নিয়ে ধন সম্পদ সুখ বিলাসের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়েছ—দেখে মরতে চাই।

    আলাদিন বললো, এবার আমাকে অনুমতি করুন, আঁহাপনা, আমি আমার বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি।

    আলাদিন নিজের বাড়িতে ফিরে এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চিরাগটা বের করে আলতোভাবে ঘষতেই আফ্রিদি দৈত্য এসে হাজির হলো।

    আলাদিন বললো, তোমার এতাবৎ সব কাজে আমি খুব খুশি হয়েছি, বান্দা। কিন্তু এবারে তোমাকে আরও অনেক কঠিন কাজের ভার দেব।

    আফ্রিদি অভিবাদন জানিয়ে ঘোৎ ঘোৎকরে নাক দিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ তুলে বললো, হুকুম করুন, মালিক, কঠিন বলে কোনও কাজ আমার কাছে নাই।

    আলাদিন বললো, জানি। সেইজন্যেই ভরসা করে তোমাকে ডেকেছি। শোনো, সুলতানের প্রাসাদের পাশে যে ফাঁকা মাঠটা আছে সেখানে আমি এক অনিন্দ্যসুন্দর হৰ্য্যপ্রাসাদ বানাতে চাই। সারা দুনিয়ায় তার তুল্য ইমারত কোথাও কেউ কখনও দেখেনি এবং ভবিষ্যতেও দেখবে না—এমনি হওয়া চাই, পারবে তো?

    আফ্রিদি আকর্ণ বিস্তৃত দাঁত বের করে হাসলো, কী যে বলেন, কত্তা, এ আবার একটা কঠিন কাম নাকি। আগাগোড়া প্রাসাদটা আমি পান্নার পাথর দিয়ে বানিয়ে দেব। তার ভিতরে বাইরে হীরে, চুনী, মুক্তো, নীলা, চন্দ্রকান্তমণি, পলা, পোখরাজ—নানারকম মণি-মাণিক্য দিয়ে কারুকাজ করা হবে। এখন বলুন, এ জিনিস আপনি পছন্দ করেন কিনা?

    আলাদিন অবাক হয়ে বলে, আগাগোড়া প্রাসাদটা পান্নার পাথর দিয়ে গড়া হবে? কিন্তু সে

    তো পাহাড়প্রমাণ পান্না লাগবে, বান্দা!

    —তা লাগুক। সে আমি ব্যবস্থা করবো। আপনি ওসব নিয়ে আদৌ চিন্তা-ভাবনা করবেন না মালিক। শুধু হুকুম করুন, আপনার কী পছন্দ।

    আলাদিন বলে, ঠিক আছে, আমি আর ভাবতে পারছি না, তুমি যা ভালো বোঝ, তাই কর। শুধু খেয়াল রাখবে, দেখা মাত্র লোকে যেন বাহবা দিয়ে বলে, এমনটি আর হয় না। আর একটা কথা, প্রাসাদের মাথার উপরে ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল গম্বুজ বসানো থাকবে। এই গম্বুজটাকে কয়েকটা সোনা আর চাদীর থাম মাথায় করে ধরে রাখবে। আর গম্বুজটা হবে স্বচ্ছ স্ফটিকের। সূর্যের কিরণ পড়লে গগণমণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। এছাড়া সারা প্রাসাদের চারপাশে যেন নিরানব্বইটা জানলা থাকে। এই সব জানলাগুলোর কার্নিশ প্রবাল পাথরের তৈরি হবে। এবং হীরে মতি ও মূল্যবান মণি-মাণিক্যে খচিত থাকবে এর পাল্লা আর চৌকাঠগুলো। আর হ্যাঁ, ভুলে যেও না, প্রাসাদের সামনে এক অনুপম বাগিচা থাকবে। তার মাঝখানটা ঝর্ণা, ফোয়ারা, পানির চৌবাচ্চা এবং বিলাসের নানা উপকরণে সুসজ্জিত হবে।

    আফ্রিদি মাথা নুইয়ে বলে, যথা আজ্ঞা মালিক। আর কিছু অভিপ্রায় আছে?

    -ওঃ, হা, শোনো, প্রাসাদের তলায় মাটির নিচে একটা গুপ্তঘর থাকবে। এটি হবে আমার কোষাগার। এই ঘরে মূল্যবান মণি-মাণিক্য, ধনরত্ন এবং সোনা-দানায় ঠাসা থাকবে। এছাড়া রসুইখানা, আস্তাবল এবং দাসদাসী নফর চাকরদের থাকার জন্য আস্তানা। সেগুলো সম্বন্ধে তোমাকে আর পরামর্শ দেবার কিছু নাই। যেমন ভালো বুঝবে তেমনি করে বসাবে। ব্যস এখন এই পর্যন্ত। এবার যাও; সব ঠিকঠাক বানিয়ে তবে আমার কাছে ফিরে আসবে।

    আফ্রিদি অদৃশ্য হয়ে গেলো।

    পরদিন ভোর হতে না হতেই আবার সে আলাদিনের কামরার শয্যাপাশে এসে দাঁড়ালো। আলাদিন তখনও নিদ্রামগ্ন। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে নাক দিয়ে অদ্ভুত ধরনের সেই আওয়াজ বের করতেই আলাদিনের ঘুম ছুটে যায়। আফ্রিদি কুর্নিশ জানিয়ে বললে, মালিক আপনার আজ্ঞামত সব তৈরি। মেহেরবানী করে আপনি গিয়ে একবার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করুন।

    আলাদিন বললো, বেশ, চলো যাই দেখে আসি।

    আফ্রিদির পিঠে উঠে বসতে সে তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো সুলতানের প্রাসাদের পাশের খালি ময়দানে নব নির্মিত ইমারতের সামনে। প্রথম দর্শনেই আলাদিন খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো, বাঃ চমৎকার। এতে আমি যা কল্পনা করেছিলাম তার চেয়ে অনেক সুন্দর বান্দা।

    —মেহেরবানী করে ভিতরে চলুন মালিক। ভিতরে প্রবেশ করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় আলাদিন। একি ব্যাপার! মর্তলোকে না বেহেস্তে এসে দাঁড়িয়েছে সে? আলাদিন বলে, আমি কিন্তু এতোটা ভাবিনি। তুমি যা বানিয়েছে, সত্যিই তার তুলনা নাই।

    খুটিয়ে খুটিয়ে সব ঘুরে দেখতে থাকে আলাদিন। যেখানে যে বস্তুটি থাকলে দেখতে বাহারী হয় তাই বসানো হয়েছে। মাটির নিচের ঘরটা দেখে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। অমন হীরা মণি-মাণিক্যের দ্যুতি কী কেউ খোলা চোখে সহ্য করতে পারে?

    আলাদিন বললো, তোমাকে বহুত বাহবা দিচ্ছি নফর। কিন্তু একটা জিনিস করতে বাকী রয়ে গেছে। অবশ্য তোমার কোনও দোষ নাই। আমিই বলতে ভুলে গেছি।

    আফ্রিদি সাগ্রহে জানতে চায়! কী করতে হবে, মালিক?

    —সুলতানের প্রাসাদ আর আমার প্রাসাদের মাথার ওপর দিয়ে একখানা গালিচা পাতা থাকবে, শাহজাদী বুদুর তার ইচ্ছামত এ প্রাসাদ থেকে ও প্রাসাদে যাতে খালি পায়ে যাতায়াত করতে পারেন তার জন্য এটা দরকার।

    আফ্রিদি বলে, এতো আলবৎ দরকার, মালিক। তিনি তো আর মাটিতে পা রেখে এ প্রসাদ-ওপ্ৰসাদ করতে পারেন না। সেইজন্যে আপনি না বললেও আমি নিজে থেকেই দুই প্রাসাদের মাথার ওপর দিয়ে একখানা গালিচা বীথি তৈরি করে দিয়েছি।

    আলাদিন খুব খুসি হলো আফ্রিদির কথা শুনে। কিন্তু অবাক হলো তখুনি!

    -কই, কোথায় তোমার গালিচা বীথি, বান্দা? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। আফ্রিদি হাসে, আছে, আপনি প্রাসাদের ওপরে চলুন দেখতে পাবেন।

    উপরে উঠে আসতে আলাদিনের ভ্রম ঘুচলো৷ একখান হাল্কা মেঘরঙের মখমলের গালিচা ও প্রাসাদ থেকে ও প্রাসাদের ছাদ পর্যন্ত বিছান আছে। বলে না দিলে মনে হতে পারে একখণ্ড মেঘ ভেসে রয়েছে মাত্র।

    —নিখুঁত সুন্দর, আলাদিন আনন্দে নেচে ওঠে, এমন অপূর্ব সুন্দর কখনও দেখিনি কেউ। সত্যিই তোমার কাজ তারিফ করার মতো বান্দা! আমি খুব খুশি হয়েছি! চলল, দেখাআমার শেষ হয়েছে, এবার আমাকে আবার ঘরে পৌঁছে দাও।

    আফ্রিদি আলাদিনকে নিয়ে উড়ে চলে গেলো তার ঘরে।

    এদিকে সুলতান-প্রাসাদে তখন বিস্ময়ের বান ডেকেছে। প্রাসাদের প্রহরী কর্মচারী নফর চাকররা সকালবেলায় ঘুম থেকে চোখ খুলেই দেখে পাশের খোলা ময়দানে এক সুরম্য প্রাসাদ, তার বর্ণাঢ্যে চোখ ঝলসে যায়। মাথার ওপরের স্ফটিকের গম্বুজটায় তখন সূর্যকিরণ পড়ে জ্বলন্ত এক সূর্যগোলকে পরিণত হয়েছে। সবাই মিলে ছুটে গেলো উজিরের কাছে। উজির অবিশ্বাস নিয়ে বাইরে এসে তাজ্জব বনে যায়। দ্রুত পায়ে সে ছুটে যায় সুলতান-সকাশে।

    —জাঁহাপনা আপনার জামাতা আলাদিনএক কুশলী যাদুকর ছাড়া আর কিছুই নয়।

    সুলতান উজিরের একম্বিধ উক্তিতে অসম্মানিত বোধ করেন।

    -কেন? কী দেখলে তার?

    —আপনি বাইরে বেরিয়ে দেখুন জাঁহাপনা, এক রাতের মধ্যে প্রাসাদের প্রান্তে সে এক বিশাল ইমারত বানিয়ে ফেলেছে। এতে কোনও মানুষের সাধ্যে সম্ভব হতে পারে না, হুজুর।

    –কেন হতে পারে না, উজির! ওসবই তোমাদের ঈর্ষার কথা। যে মানুষ পৃথিবীর দুষ্প্রাপ্য মণি-মাণিক্যের মালিক, যার ধন-দৌলতের কোন সীমা পরিসীমা নাই, সে শুধু বিত্তবানই নয়, অসীম ক্ষমতাবানও বটে। তার ধনবল যেমন অপার জনবলও তেমনি অপর্যাপ্ত থাকতে পারে। সুতরাং তার মতো মানুষের পক্ষে রাতারাতি একখানা ইমারত বানানো কী অসম্ভব ব্যাপার হতে পারে?

    উজির বুঝলল, সুলতান স্নেহবন্ধ হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় তাকে অন্যরূপে বোঝাতে গেলে বিপত্তি ঘটতে পারে। তাই সে আর দ্বিরুক্তি না করে চুপ করে গেলো।

    এ প্রসঙ্গ এই পর্যন্তই থাক এখানে। এখন আমরা আবার আলাদিনের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    সাতশো একষট্টিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    ঘরে ফিরে এসে আলাদিন মা-এর কাছে গিয়ে বললো, মা তৈরি হয়ে নাও। একটু পরেই আমরা প্রাসাদে যাবো। তোমার বাঁদীদেরও তৈরি হয়ে নিতে বলল।

    কিছুক্ষণের মধ্যে আলাদিন নিজেও সেজেগুজে ঘোড়ায় চেপে বসলো। বেরিয়ে এলো বারজনে সারিবৃত হয়ে। আলাদিন মাকে উদ্দেশ্য করে বললো, মা আমি আমার মত নফরদের সঙ্গে নিয়ে চললাম। তুমি তোমার মতো বাঁদীদের নিয়ে প্রাসাদে চলে এসো।

    আলাদিন শহর পরিক্রমা করতে করতে এগোতে থাকে। কিন্তু আলাদিনের মা সোজা পথে অনেক আগেই প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে এসে হাজি হলো।

    সুলতান নিজে এসে সাদর অভ্যর্থনা করলো জামাইএর মাকে। খোজাদের হুকুম করলো, যা এঁকে শাহজাদীর কাছে নিয়ে যা।

    -যান, ওদের সঙ্গে যান, ছেলের বৌকে একবার দেখুন।

    শাহজাদী বুদুর শাশুড়ীকে শ্রদ্ধাবনত হয়ে সালাম জানিয়ে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ফরাসে বসালো। দাসী বাঁদীরা নানারকম সরবৎ গোলাপজল মিঠাই মণ্ডা ইত্যাদি নিয়ে এসে সামনে সাজিয়ে দিলো।শাহজাদী অনুরোধ জানায়, একটু কিছু খান, মা।

    মা-এর মন ভরে যায়। আহা, কী মিষ্টি মধুর কণ্ঠস্বর। অপলক চোখে সে তাকিয়ে তাকিয়ে বুদুরকে দেখতে থাকে। বিধাতা পুরুষ এমন নিখুঁত করে গড়েছেন কী করে তাকে—সেই কথা সে ভেবে পায় না।

    বুদুরের রূপে মোহিত হয়ে গিয়েছিলো আলাদিনের মা। এমন সময় তার কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় বলে, হ্যাঁ, খাবো মা। তুমিও খাবে তো?

    বুদুর বলে, বেশ, খাবো। আপনি খান, আমিও নিচ্ছি।

    একটু পরে সখিরা বুদুরকে সাজাতে বসে। তার চুল বেঁধে দিলো এক অপূর্ব ছাঁদে। মুখে মাখিয়ে দিলো মসৃণ প্রসাধন। দেহে পরালো নানারকম মূল্যবান আভরণ অলঙ্কার! জমকালো সাজ-পোশাক পরে যখন সে উঠে দাঁড়ালো, আলাদিনের মা ভাবতে থাকলো, মাটির দেশে এ মেয়ের জন্ম হলো কী করে?

    সন্ধ্যা সমাগত। এবার পাত্রী তার জন্য নির্মিত নতুন প্রাসাদে যাবে। সেখানেই যাপন করবে তারা মধুযামিনী। আলাদিন তার নিজের প্রাসাদের ছাদে গালিচা-বীথির পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো তার প্রাণাধিকা বুদুরের জন্য।

    শাহজাদী এক এক করে মা বাবার কাছে বিদায় নিলো। তার সঙ্গে চলেছে শতাধিক দাসী বাদী খোজা নফর। বাজিয়েরা অপূর্ব তালে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করলো। সুরের মুর্ঘনায় প্রাসাদ-পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠলো। শাহজাদী ধীর পায়ে গালিচা-বীথি অতিক্রম করে নতুন প্রাসাদে চলে এলো। আলাদিন স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়েছিলো, এগিয়ে এসে সেবুদুরের হাত ধরে প্রাসাদের বড় ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো। সে ঘরে অন্য কোনও লোকের ভিড় নাই। শুধু আলাদিন তার মা আর বুদুর।

    নানা উপাচারে খানাপিনা সাজানো হয়েছিলো। বিশাল টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো সোনার থালায় নানা দেশের নানারকম মুখরোচক আহার্য।

    আলাদিনের মা বুদুরকে বলে, এসো মা, আমরা খানাপিনা শেষ করে নিই।

    খেতে বসে বুদুর মুখে গ্রাস তুলতে ভুলে যায়। হাঁ করে সে দেখতে থাকে প্রাসাদের অপরূপ সূক্ষ্ম কারুকার্য। সে প্রাসাদ পরিবেশে মানুষ। দুনিয়ার সেরা সেরা শিল্পকর্ম সে দেখেছে, কিন্তু এমন অসাধারণ বস্তু কখনও প্রত্যক্ষ করেনি জীবনে।

    —এসব কী করে, কারা বানিয়েছে, মা? মা এ কথার কী জবাব দেবে। আলাদিন বলে, কেন ভালো হয়নি?

    -ভালো? একে যদি সামান্য ভালো বলল, তা হলে এতকাল আমরা যা দেখেছি জেনেছি সে সবকে তো কুৎসিত বলতে হয়। আমি বলছি, এই যে শিল্পকর্ম ছড়িয়ে আছে সারা প্রাসাদের প্রতিটি দেওয়ালে চাতালে, আবসাবপত্রে, এমন শিল্পীরা কী দুনিয়ায় আছে?

    আলাদিন হাসে, কেন থাকবে না। না থাকলে এসব হলোই বা কী করে?

    বুদুর তন্ময় হয়ে ঘাড় নাড়ে, তবু সে খাবারের থালায় চোখ নামাতে পারে না। অপলকভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখতে থাকে।

    আলাদিনের মা মোটা বুদ্ধির মানুষ, প্রাসাদটা দেখতে বড় বাহারী হয়েছে, এ কথা সেও তারিফ করেছে। কিন্তু শিল্পীর সূক্ষ্ম কাজ বোঝার মতো অমন সংবেদশীল মন তার নয়—সে ওসব বুঝবে কী করে? কিন্তু বুদুরের যে শিক্ষা-দীক্ষা আছে। সে বুঝতে পারে, সুচারু শিল্পকর্ম দেখে সে রসাপ্লুত হতে পারে।

    বুদুর দেখে খুশি হতে পেরেছে জেনে আলাদিনের মনে আনন্দ আর ধরে না। খেতে খেতে বুদুর তারিফ করে, আজ এমন এক পরিবেশের মধ্যে আমি এসে পড়লাম, এমনটা শুনেছি ইস্কান্দার বা সুলেমানের সময়েই নাকি সম্ভব হতো।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো বাষট্টিতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    খানাপিনা শেষ হলো। সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। রাত্রির মাদকতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বড় ঘরে এক দল সুবেশ সুন্দরী বাঁদী এসে দাঁড়ালো। সকলের হাতে বাদ্যযন্ত্র।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই নাচ গানের আসর জমে ওঠে। আলাদিন বুদুরকে হাতে ধরে বাসরকক্ষে নিয়ে আসে। এক এক করে ওর দেহের সকল বেশবাস সে খুলে এক পাশে রেখে দেয়। শাদীর

    প্রথম রাতে এই রীতিই প্রচলিত।

    এর পর যা ঘটতে পারে তাই ঘটেছিলো। সে সব খুঁটিনাটি বিবরণের কোন প্রয়োজন নাই।

    রাত্রি শেষ হলো, সকালে শাহজাদী বুদুরের বাহুপাশ থেকে মুক্ত হয়। আলাদিন সেজেগুজে আস্তাবলে গিয়ে একটি তাজি ঘোড়া বেছে নিয়ে চেপে সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলো। আলাদিনকে পেয়ে সুলতান খুশিতে উপচে পড়লেন।

    আশা করি তোমাদের প্রথম মিলন রাত্রি সুখের হয়েছে বেটা? বুদুর কেমন আছে?

    আলাদিন বলে, ভালো, খুবই ভালো কেটেছে, জাহাপনা। বুদুর এখন সুখ-নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আমি আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি। আজ আপনি আপনার উজির আমির অমাত্যদের নিয়ে আমার প্রাসাদে পায়ের ধূলো দিলে আমি ধন্য হবো।

    সুলতান বললেন, এ তো বড় আনন্দের কথা, বাবা। চলো, আমি এখুনি যাবো তোমার প্রাসাদে।

    সুলতান আলাদিনকে সঙ্গে করে উজির আমির অমাত্য সমভিব্যাহারে তখনি জামাই-এর প্রাসাদ পরিদর্শন করতে বেরুলেন।

    দূর থেকে দেখে প্রাসাদের ভিতরের অসাধারণ কারুকর্ম আন্দাজ করতে পারেননি সুলতান। যতই দেখতে থাকেন ততই মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন। এমন জাঁকজমক বিলাসবহুল প্রাসাদ তিনি কল্পনাতেও ভাবতে পারেননি কখনও। কোন্ দক্ষ কারিগর বানিয়েছে এসব, সেই কথা ভেবেই তিনি অবাক হন। জানালাগুলো এক এক করে গুণে দেখলো, মোট নিরানব্বইটি, প্রতিটি জানালা সুন্দর করে সাজানো—তাদের চারপাশ ঘিরে সে কি অপরূপ চারুকলার নিদর্শন! শুধুমাত্র একটি জানালার কাজ অসম্পূর্ণ।

    আলাদিন সুলতানকে সঙ্গে করে বুদুরের বাসরকক্ষে নিয়ে গেলো। মেয়ের মাথায় হাত রেখে সুলতান আদর করে বললেন, ভালো আছিস, মা? দুঃস্বপ্ন কিছু দেখিসনি তো?

    বুদুর সলজ্জ হাসি হেসে অস্ফুট স্বরে বলে, না বাবা। ভালোই ঘুমিয়েছি।

    সুলতান বুঝলেন, কন্যা সুখ-সম্ভোগে মধুযামিনী যাপন করেছে। আলাদিনকে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি আমাকে নিশ্চিন্ত করেছ, বাবা। আশীর্বাদ করি, চিরজীবন সুখে থাক।

    এরপর কন্যা জামাতাকে সঙ্গে নিয়ে আহার করলেন সুলতান। আফ্রিদির দৌলতে নানাবিধ মুখরোচক খানা-পিনায় আপ্যায়ন করলো আলাদিন। সুলতান সে-সব অসাধারণ খাবার-দাবার জীবনে কখনও চোখে দেখেননি। কী তার সুবাস, কী তার জিভে জল আসা আস্বাদ!

    রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

     

    সাতশো তেষট্টিতম রজনী?

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    খানা-পিনা শেষ হলে আলাদিন বললো, আমার প্রাসাদ দেখে আপনার কেমন লাগলো, জাঁহাপনা।

    সুলতান বলল, এক কথায় অপূর্ব—অসাধারণ। তামাম দুনিয়ায় এর কোনও জুড়ি নাই। শুধু একটি জানালার কারুকাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে দেখছি। যাই হোক, আমি আমার জহুরীদের ডেকে কাজটুকু সমাধা করে দিচ্ছি।

    এই বলে তিনি উজিরকে বললেন কারিগর আর জহুরীদের শমন পাঠাও। এখুনি-এখানে আসতে বলো।

    সুলতানের হুকুমে তৎক্ষণাৎ শহরের সেরা জহুরী এবং কারিগররা এসে হাজির হলো সেখানে। সুলতান বললেন, ঐ দেখছো একটি জানালা—এটার কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।

    জহুরীরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। অন্য সব জানালায় যে ধরনের হীরে জহরত বসানো আছে তার সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করতে হবে। অনেকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে তারা অবনত মস্তকে এসে দাঁড়ালো সুলতানের সামনে।

    -গোস্তাকি মাফ করবেন, জাঁহাপনা, পাশের সব জানালায় যে ধরনের কাজ রয়েছে, তা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সারা দেশ খুঁজেও ঐ একটা জানালার একশো ভাগের এক ভাগ পরিমাণ হীরে জহরত সংগ্রহ করা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। কোনও অর্থের বিনিময়েই ঐ সব একটা মণিরত্ন সংগ্রহ করা যাবে না।

    সুলতান উজিরকে বললেন, তুমি আমার কোষাগারে যাও। সেখানে যা কিছু মূল্যবান ধনরত্ন আছে নিয়ে এসো এখানে! জহুরীদের দেখাও সে-সব দিয়ে তারা জানালাটার কাজ সমাধা করে দিতে পারে কিনা।

    —জো হুকুম, জাঁহাপনা!

    উজির সুলতানের ধনাগারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। সুলতান কিছুটা আহত কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তার এই সলনিয়তের জহুরীদের কাছে এতোটা ধনরত্ন পাওয়া গেলো না—এই সব ধনরত্নের সমান।

    আলাদিন সুলতানের অবস্থা বুঝতে পেরে ব্যাপারটাকে সহজ করে তোলার জন্য গান-বাজনার আয়োজন করে। মনে আশা, সঙ্গীতের মূৰ্ছনায় হয়তো বা তিনি একটু সহজ হতে পারেন।

    ফল যে হলো না-তা নয়। সুলতান কিছুক্ষণের জন্য গানের জগতে তন্ময় হয়ে পড়লেন। কিন্তু সে ক্ষণকাল মাত্র। উজির ফিরে আসতেই তিনি আবার সেইদিকে মনোেযোগ দিলেন, কই দেখি কী সব এনেছ?

    জহুরী সামনেই দাঁড়িয়েছিলো। সুলতান বললেন, দেখ তো এসব দিয়ে কাজটা নিখুঁতভাবে অন্য জানালার কাজের সঙ্গে মিলিয়ে, করা যাবে কিনা!

    জহুরীরা পরীক্ষা করে দেখে বললো, এখানে যা আছে তার আটগুণ জহরত লাগবে, জাহাপনা। এবং আপনি যদি পুরো জহরত সংগ্রহ করে দিতে পারেন তা হলে আমার কারিগররা—তিন মাসের মধ্যে সেগুলি বসিয়ে অন্য জানালার প্রায় অনুরূপ কাজ—কিছুই বলা যায় না, তুলে দিতে পারবে আশা করি। অবশ্য হাতের কাজ কিছুই বলা যায় না, দু-চারদিন বেশিও লাগতে পারে।

    লজ্জায় সুলতানের মুখমণ্ডল বেগুনী বর্ণ হয়ে গেলো। সারা প্রাসাদটা এক রাতের মধ্যে বানিয়েছে আলাদিন। এই একটি মাত্র জানালার কারুকাজ সমাধা করতে শহরের সেরা কারিগররা বলছে তিন মাস সময় লাগবে? অপারগতার দুঃসহ জ্বালায় জ্বলতে থাকেন তিনি। ছিঃ ছিঃ, এ লজ্জা তিনি রাখবেন কোথায়?

    আলাদিন মজা দেখছিলো। এবার অবশ্যই তার অসামান্য ক্ষমতার পরিচয় সুলতান পেয়েছেন, বুঝতে পারলো সে। আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠলো মন বললো, যাক ওসব হীরে জহরতের দরকার হবে না। ওগুলো যেখানে ছিলো সেখানেই রেখে আসুন উজির সাহেব, জানালার বাকী কাজটুকু আমি এখুনি সমাধা করে নিচ্ছি।

    সুলতানের দিকে তাকিয়ে আলাদিন বিনম্র বিগলিত হয়ে বলে, মহামান্য শাহেনশাহ আমার অপরাধ নেবেন না, যে মণিমাণিক্য আপনাকে আমি ভেট দিয়েছি সেগুলো দিয়ে আমার প্রাসাদের জানালার কারুকাজ করা আপনার পক্ষে শোভন সঙ্গত হবে না, জাঁহাপনা। এভাবে আমার দেওয়া জিনিস আমাকে ওআপস করে দিলে আমি আহত হবো। ওগুলো যেমন আপনার প্রাসাদে ছিলো তেমনিই সেখানে থাক। আমি নিজেই এ জানালার কাজ সম্পূর্ণ করে নিচ্ছি। আপনি, মেহেরবানী করে, একটুক্ষণ আপনার কন্যার কক্ষে বিশ্রাম করুন। আমি এখুনি কাজটুকু শেষ করে আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।

    সুলতানকে সঙ্গে করে বুদুরের কামরায় নিয়ে যায় আলাদিন।

    —আপনি এখানে বসে কন্যার সঙ্গে কথা বলুন, আমি এখুনি আসছি।

    আলাদিন ফিরে এসে চিরাগটা নিয়ে ঘষতেই আফ্রিদি এসে হাজির হলো। আলাদিন বললো, বান্দা, ঐ জানালাটার কারুকাজ বাকী রয়ে গেছে। ওটা অন্য জানালার মতো করে দাও এখুনি!

    আলাদিনের মুখের কথা শেষ হতে না হতে আফ্রিদি এক অত্যাশ্চর্য দক্ষতায় পলকের মধ্যে জানালাটকে অন্য জানালার মতো নিখুঁত সুন্দর করে হীরে জহরত বসিয়ে সাজিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

    আলাদিন সুলতানকে বুদুরের ঘর থেকে ডেকে নিয়ে এসে বললো, দেখুন, দেখুন তো জাঁহাপনা, কাজটা অন্য জানালাগুলোর মতো নিখুঁত হয়েছে কিনা।

    সুলতান ধাঁধায় পড়লেন। তিনি অনেক চেষ্টা করেও ওই নিরানব্বইটি এ জানালার মধ্য থেকে সেই জানালাটিকে আর খুঁজে বের করতে পারলেন না।

    আগের এবং সদ্য তৈরি জিনিস চোখে দেখলেই ধরা যায়। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সুলতান সদ্য নির্মিত জানালাটাকে চিহ্নিত করতে পারলেন না।

    আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না, আলাদিন, কোন্টার কাজ তুমি সমাধা করলে?

    আলাদিন হাসতে থাকে। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, এইটে।

    সুলতান লজ্জিত হলেন। বললেন, তোমাকে যতই আমি দেখছি, ততই বেশি অবাক হচ্ছি বাবা। এতো গুণের অধিকারী কী করে হলে তুমি?

    রাত্রি অবসান হয়। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো!

     

    সাতশো চৌষট্টিতম রজনীতে আবার গল্প শুরু হয় :

    সুলতান উজিরকে ডেকে পাঠালেন। একটু পরে সে কুর্নিশ জানাতে তাকে বললেন তিনি, তাকিয়ে দেখ উজির-জানালাটার দিকে তাকিয়ে দেখ। •

    উজির এদিকে ওদিক সবগুলো জানালার ওপর চোখ বুলাতে থাকে কিন্তু সেই অসমাপ্ত জানালাটিকে আর দেখতে না পেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, সে জানালাটা কোথায় গেলো, ধর্মাবতার?

    সুলতান হেসে বলেন, ঐ তো, দেখতে পাচ্ছো না? আলাদিন এক লহমায় কেমন সুন্দর করে কারুকাজ করে ফেলেছে।

    উজির আগেই বুঝেছিলো আলাদিন এক কুশলী যাদুকর ছাড়া কিছু নয়। এবার তার ধারণা আরও বদ্ধমূল হলো। বুঝতে বাকী রইলো না ছেলেটি শুধু যাদুকরই নয়, জাল ধনরত্ন বানাতেও, ওস্তাদ। কিন্তু এসব কথা সুলতানকে শোনালে হিতে বিপরীত হবে। সুতরাং সে মনেব কথা মনেই চেপে শুধু বলতে পারলো, খোদা হাফেজ, তার অপার লীলা বোঝা বড় ভার।

    সেদিন থেকে প্রতি সন্ধ্যায় সুলতান আলাদিনের প্রাসাদে এসে কন্যা জামাতার সঙ্গে অবসর বিনোদন করতে থাকেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন বাহারী জিনিসের আমদানী দেখে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি।

    অপরিমিত সুখ বিলাসের মধ্যে কাল কাটাতে থাকলেও আলাদিন কিন্তু তার শৈশবের দারিদ্র্য দুর্দশার বীভৎস চিত্র কিছুতেই ভুলতে পারে না। সে বুঝতে পারে, এই শহরেরই সর্বত্র কত নিরন্ন অসহায় পরিবার এক টুকরো রুটির জন্যে অসহ্য ক্ষুধা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। ভাবতে ভাবতে এক-এক সময় সে অন্য জগতে হারিয়ে যায়। সেই সুরম্য অট্টালিকার বিলাসমহলে তার দেহটা পড়ে থাকলেও মন কিন্তু উধাও হয়ে যায় সর্বহারাদের পাশে। এবং শুধু এই কারণে প্রায় রোজই সে তার নফরদের হাতে দিনারের তোড়া দিয়ে বলে, যা পথে-ঘাটে যাদের দেখবি দারুণ দুর্দশা—তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে আসবি এগুলো।

    এইভাবে দরিদ্রদের মধ্যে দু’হাতে অর্থ বিলিয়ে খানিকটা তৃপ্তি বোধ করে সে। অভাব অনটনের দুঃখ অনেক। কিন্তু প্রাচুর্যের যন্ত্রণাও বড় কম নয়। আলাদিন অহরহ দগ্ধ হতে থাকে। দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষের সঙ্গে তার এত বৈভব-বৈষম্য সে বুঝি আর সহ্য করতে পারে না।

    আলাদিনের নির্দেশে তার প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে প্রতিদিন হাজার হাজার দীন ভিখারীকে পাত পেড়ে খাওয়াবার ব্যবস্থা করা হলো। আলাদিনের এই সহৃদয় বদান্যতা সারা শহরের আপামর মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগলো না। চারদিকে ধন্য ধন্য রব উঠতে থাকলো। এমন দয়ালু দাতা জামাই পেয়েছেন সুলতান। সবাই দুহাত তুলে আলাদিন বুদুরের নামে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করে। ওরা যেন শতায়ু-সুখী হয়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.