Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সহস্র এক আরব্য রজনী

    ক্ষিতিশ সরকার এক পাতা গল্প3728 Mins Read0

    ৪.০২ গোলাপ-সুন্দরী ফারিজাদের কাহিনী

    সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখন পারস্যের সুলতান খসরু শাহ।

    অবশ্য আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন, জাঁহাপনা শাহেনশাহ খসরু শাহ কেমন দোর্দণ্ড প্রতাপ বাদশাহ ছিলেন। একদিকে যেমন কুসুমাদপি কোমল ছিলো তার হৃদয়, অন্যদিকে বজ্রের চেয়েও কঠিন এবং দীপ্যমান ছিলেন তিনি। লোকে বলে, তার ইঙ্গিতে বাঘে ছাগলে একঘাটে পানি খেত।

    সে যাই হোক, তার জীবনের বহু বিখ্যাত-কাহিনী আজ লোকের মুখে মুখে ফেরে, আজ আমি তাঁরই সময়ের একটি সত্য ঘটনা আপনাকে বলছি।

    সুলতান প্রায় প্রতিরাতেই বিদেশী বণিকের ছদ্মবেশে শহর পরিক্রমায় বেরুতেন। উদ্দেশ্য—তার প্রজারা কে কেমন ভাবে দিন গুজরান করছে, প্রত্যক্ষ করা।

    এক রাতে তিনি তার উজিরকে সঙ্গে নিয়ে শহরের প্রান্তে অতি দিন দরিদ্র এক পল্লীতে প্রবেশ করলেন। সেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দারাই অভাবের তাড়নায় জর্জরিত।

    একটা গলির মুখে পুরানো বস্তিবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই গুটিকয়েক মেয়ের বাক্যালাপ শুনে থমকে দাঁড়ালেন সুলতান। দরমার বেড়ার ফুটো দিয়ে দেখলেন ঘরের মধ্যে তিনটি মেয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গী করে আড্ডা জমিয়েছে। মনে হয় ওরা তিন বোন। বড় দুটির শাদীর বয়স পার হয়ে গেছে। ছোটোটি অপেক্ষাকৃত কচি এবং সুন্দরী। বেশ বোঝা যায় দারিদ্র্যের চাপেই ওদের বাবা-মা মেয়েদের শাদী দিতে পারেনি।

    বড় জন বলছিলো, আমি যদি কখনও শাদী করি তবে কাকে করবো জানিস?

    অন্য দু’জন কৌতূহলী হয়ে তাকায়। বড়টি বলে, সুলতানের যে হালুইকর আছে—তাকে আমি শাদী করবো। ওঃ, কী মজা হবে, যত খুশি মিঠাই মণ্ডা আর বাদশাহী হালওয়া খাবো রোজ। জানিস ভাই, শাহী হাওয়া খেতে আমার ভারি ভালো লাগে। তা হালুইকরকে শাদী করলে তো আর হালওয়ার কোনও অভাব থাকবে না। যত প্রাণ চায় খাবো। কিন্তু তোদের জন্য মন কেমন করবে। আমি খাবো আর ভাববো, আহা তোরা একটু খেতে পেলি না। আমি কিন্তু আমার স্বামীকে বলবো তোদের জন্য একটু পাঠাতে। কিন্তু সে কি রাজি হবে? যাক, সে পরে দেখা যাবে।

    মেজটি বলে, না ভাই আমার ওসব মিঠাই-মণ্ডার লোভ নাই। আমি যদি শাদী করি তো করবো সুলতানের খাস বাবুর্চিকে। সে কতরকম কোর্মা কোপ্তা কালিয়া পোলাও বানায় বোজ। উ, ভাবতেই জিভে পানি এসে যাচ্ছে। কী মজাসে খাবো রোজ। মাংস খেতে আমার কী যে ভালো লাগে দিদি। তোরা ভাবিস নে, আমার স্বামীকে বলে তোদের জন্যেও মাঝে মাঝে পাঠিয়ে দেব একটু আধটু।

    বড় দুজনের কথা শেষ হলো। কিন্তু ছোট তখনও নীরব। বড় বোন ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করে, কি রে ছোট, তুমি যে বড় চুপটি করে আছিস্? তোর কী ইচ্ছে-টিচ্ছে বলে কিছু নাই? বল না, ভাই, শুনি।

    ছোট তবু কথা বলে না। ও এখনও বড়দিদির মতো প্রগলভ হয়ে উঠতে পারেনি। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে। মেজ বলে, ঘাবড়াস নে বোন, আমাদের শাদী হয়ে গেলে তোরও একটা হিল্লে হয়ে যাবে। খুব সুন্দর দেখে একটা পাত্র দেখে শাদী দিয়ে দেব তোর। প্রাসাদেরই কোনও আমলা-টামলা কাউকে দেখে গছিয়ে দেব তোকে। তাহলে তিন বোন। কাছাকাছি থাকতে পারবো, কী বলিস?

    ছোট যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চায়। এমনিতেই সে বেশ সুন্দরী, তার ওপর লজ্জারক্ত মুখখানা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। এবার সে মৃদু অথচ বেশ প্রত্যয় নিয়ে মধুর কণ্ঠে বলে, শোনও দিদি, আমার ইচ্ছা শাদী যদি করতেই হয় তবে কোনও আমলা অমাত্য নয়, খোদ মালিককেই করবো।

    দুই বোন ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে, মানে?

    -মানে—আমি স্বয়ং সুলতানকেই স্বামী হিসেবে পেতে চাই। বড় দু’বোন হো হো করে হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে, ওরে বাব্বা, দেখি অল্পে মন ওঠেনা।

    ঘোট বলে, সত্যিই দিদি অল্পে আমার মন ভরবে না। আমি বাদশাহর বেগম হবো, আমার ছেলেমেয়েরা চাদের মতো সুন্দর হবে। আমার মেয়ের রূপ দেখে দেশ-বিদেশের সুলতান বাদশাহরা পাগল হয়ে ছুটে আসবে। আমার আদরের দুলালীর কান্নায় পান্না ঝরবে, হাসলে মুক্তো পড়বে।

    সুলতান খসরু শাহ এবং তার উজির দাঁড়িয়ে সব শুনলেন। তার পর অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে সরে পড়লেন যাতে ওরা কেউ টের না পায়।

    পরদিন সকালে সুলতান উজিরকে বললেন, ঐ মেয়ে তিনটিকে দরবারে হাজির কর।

    কোরবানীর খাসির মতো এসে দাঁড়ালো তিন বোন। ভয়ে ওরা কাপছিলো। না জানি কোন অপরাধে সুলতান তাদের তলব করেছেন। হয়তো ফাঁসীর দড়িতেই লটকে দেবেন তিনি। নানারকম অজ্ঞাত আশঙ্কায় ভীত-চকিত হয়ে দরবারের এক পাশে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা।

    সুলতান খসরু তখতে বসে গম্ভীর গলায় বড় জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কী, তোমার কী মনের বাসনা? কী হলে তুমি সুখী হবে?

    মেয়েটি ভেবে পায় না, এ কথার কী জবাব সে দেবে। ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। সুলতান বলে, কী বলতে পারলে না তো? তাহলে আমিই বলি তোমার মনের কথা। তুমি আমার হালুইকরকে শাদী করতে পেলে জীবনে খুব সুখে থাকবে, তাই না?

    মেয়েটি অবাক হয়, সুলতান সর্বজ্ঞ, না হলে তার মনের কথা তিনি জানলেন কী করে! মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, ঘাড় নেড়ে সে জানায়-হ্যাঁ।

    এবার সুলতান মেজকে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমার কী বাসনা? আমার খাস বাবুর্চিকে শাদী করবে? খুব ভালো-মন্দ খানা-পিনা খেতে পাবে রোজ না? বেশ তাই হবে। তোমাদের দুজনের ইচ্ছেমতো হালুইকর আর বাবুর্চির সঙ্গেই তোমাদের দুজনের শাদী দিয়ে দেব।

    এরপর সুলতান মসনদ থেকে নেমে এসে অধোবদনা ছোটকে হাতে ধরে নিজের পাশে বসালো।

    —এখন থেকে তোমার আসন আমার এই পাশে। তুমি আমার খাস বেগম হবে আজ। কেমন, রাজি তো?

    সেইদিনই যথানিয়মে কাজী এবং সাক্ষীদের ডেকে তিন বোনের শাদীর পর্ব সমাধা হয়ে যায়।

    ছোটর সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিতা বড় দুই বোন আঙ্গুল কামড়াতে থাকে। ইস, কী ভুলই না ওরা করেছে। কেন মরতে হালুইকর আর বাবুর্চির সঙ্গে শাদী করার ইচ্ছা মনে এসেছিলো। ছোটটা কী ভাগ্যবতী, যেই মুখ দিয়ে বের করলো, সুলতানকে শাদী করবে, অমনি তার কপালে স্বয়ং সুলতান খসরুই জুটে গেলো। হায় হয়, এ কী নিজের সর্বনাশ নিজেই করলো ওরা।

    যত দিন যায় ততইঈর্ষার আগুন বুকে ধক ধক করে জ্বলতে থাকে দুই বোনের।কিন্তু মুখে মধু ঢেলে কথাবার্তা বলে ছোট বোনের সঙ্গে। ছোট বোন বড়দের মনের এই কুটিলতা বুঝতে পারে না।

    ন’মাস পরে ছোট বোন একটা চাঁদের মতো ফুটফুটে পুত্র-সন্তানের জন্ম দিলো। স্বভাবতই বড় দুই বোন ছোট বোনের পরিচর্যা করতে এগিয়ে এসেছেন। সন্তান প্রসবের পর প্রসূতি যখন অচৈতন্য সেই ফাঁকে তার পুত্র-সন্তানটিকে ওরা সরিয়ে ফেলে তার জায়গায় একটা কুকুরের মরা বাচ্চা এনে রেখে দিলো।

    জ্ঞান ফিরে ছোট তার দুর্ভাগ্য দেখে ভেঙ্গে পড়লো। সুলতান ক্ষোভে দুঃখে দরজা বন্ধ করলেন।

    বড় দুই বোন একটা বাক্সের ডালায় বসিয়ে সদ্যজাত পুত্রটিকে খালের জলে ভাসিয়ে দিলো। বাক্সটা ভাসতে ভাসতে গিয়ে ভিড়ল সুলতানের বাগানের পাশে।

    এক সদাশয় বৃদ্ধ মালী ঐ বাগানের পরিচর্যা করে। হঠাৎ তার নজরে পড়লো একটি সদ্যজাত শিশু ভেসে এসে ভিড়েছে বাগিচার ধারে। ছেলেটিকে বুকে তুলে সে বাসায় যায়। মালী-বিবি চিরকালের বন্ধ্যা। শাদীর পর কতকাল কেটে গেছে, অনেক দোয়া মানত করেও একটি সন্তান পেটে ধরতে পারেনি সে। শিশুটিকে পেয়ে সে যেন হাতে চাঁদ পেলো। ভাবলো আল্লাহর করুণাতেই সে পুত্রবতী হতে পারলো।

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো পঁচাত্তরতম রজনী :

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    পর বৎসর সুলতানের বেগম আর এক পুত্রের জন্ম দিলো। এ সন্তানটি আগের পুত্রের চেয়েও সুন্দর। কিন্তু বড় বোনদের চক্রান্তে সেবার সে পুত্র প্রসবের গৌরব থেকে বঞ্চিত হলো। ওর দিদিরা কায়দা করে ছেলেটিকে সরিয়ে ফেলে তার জায়গায় একটা বেড়ালের মরা বাচ্চাকে রেখে দিলো।

    প্রসূতির প্রাণ হাহাকার করে ওঠে। সুলতান ক্ষোভে দুঃখে ঘৃণায় মুহ্যমান হয়ে পড়েন।

    সেবারও বড় দুই বোন সদ্যজাতকে একটি বাক্সের ডালায় বসিয়ে খালের জলে ভাসিয়ে দেয়। এবং একই ভাবে ভাসতে ভাসতে গিয়ে বাগানের ধারে ভেড়ে, বৃদ্ধ মালী দেখতে পেয়ে বুকে তুলে ঘরে নিয়ে যায়। বড় ভাই-এর পাশে পাশে ছোট ভাইও মালী এবং মালী বৌ-এর অশেষ আদর-যত্নে মানুষ হতে থাকে।

    এর পরের বছর সুলতান-বেগম তৃতীয় সন্তান প্রসব করে। এবারেরটি কন্যা। কী তার রূপ, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। যেন বেহেস্তের ডানাকাটা পরী! দুই বোনের চক্রান্তে সে সন্তানও কোলে পায় না মা। এবার ওরা মেয়েটিকে সরিয়ে নিয়ে একটা মরা ইদুর বাচ্চাকে রেখে দেয় সেখানে।

    এ আঘাত সুলতান আর সহ্য করতে পারে না। পর পর তিনবার এ ধরনের অশুভ ঘটনার মূল কারণ হিসাবে বেগমকে দায়ী করেন তিনি। তার ধারণা হয় বেগম নিশ্চয়ই শাপগ্রস্ত কোনও শয়তানী। প্রাণদণ্ডের আদেশ হলো তার।

    বেগম সুলতানের কাছে মিনতি করে প্রাণ ভিক্ষা করলো। হাজার হলেও হারেমের বেগম, সুলতান বিচলিত হলেন তার প্রার্থনায়। যাই হোক, প্রাণে সংহার না করে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন তিনি।

    একই ভাবে কন্যাটিকেও খালের জলে ভাসিয়ে দিলো দুই বোন। এবং সৌভাগ্যক্রমে সেই বৃদ্ধ মালীর নজরে পড়ায় তাকেও সে ঘরে নিয়ে গিয়ে পরম আদরে লালন পালন করতে লাগলো।

    দুই বোন গোপন এই সব কাজ করতে পেরে পরম আত্মপ্রসাদ লাভ করলো।

    সময় বয়ে চলে। ছোট বোনের তিন সন্তান মালীর ঘরে বড় হতে থাকে। ওদের নাম রাখা হয় ফরিদ ফারুজ এবং ফরিজাদ। ফরিজাদ দেখতে পরীর মতো সুন্দরী। তার চুলের বর্ণ সোনালী। কান্নায় তার পান্না ঝরে, আর হাসলে পরে মুক্তো পড়ে মুখ দিয়ে। যে দেখে সেই বলে এমন সুন্দর মেয়ে মানুষের ঘরে জন্মায় না।

    বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন ভাইবোন লেখাপড়ায় চৌকস হয়ে ওঠে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তারা যাবতীয় পাঠ্যক্রম সমাপ্ত করে ফেলে। শুধু লেখা পড়া নয়, আচারে ব্যবহারেও তাদের তুলনা রইলো না।

    এইভাবে ওরা যখন বেশ বড় সড় হয়ে উঠলো, মালী -বৌ একদিন দেহ রাখলো। বিবির শোকে মালী কাতর হয়ে পড়লো। সুলতান দেখলেন, বৃদ্ধ মালী বয়সের ভারে এবং শোকে তাপে অথর্ব হয়ে পড়েছে। তিনি তাকে অবসর নিতে বললেন। মালীর নামে তিনি জায়গীর লিখে দিলেন। বললেন, সারা জীবন তো আমার সেবা করেছ, এবার আর তোমাকে খেটে খেতে হবে না। আমি তোমার ভরণ-পোষণের জন্য পাকাপাকি ব্যবস্থা করে দিলাম।

    এর কিছুকাল পরে মালীও দেহ রক্ষা করলো।

    তিন ভাইবোন বেশ লায়েক হয়ে উঠেছে। সুলতানের মৌরসীপাট্টার আয় থেকে তাদের বেশ ভালোভাবেই দিন কাটতে থাকে।

    দুই ভাই প্রায়ই শিকার সন্ধানে বাইরে যায়। বোনটি ঘরে থাকে। ওদের বাড়ির লাগোয়া একটি সুন্দর বাগান। একদিন ফরিজাদ একা একা বাগানের মধ্যে বিচরণ করে বেড়াচ্ছিল, এমন সময় তার দাসী এসে খবর দিলো বাগানের ফটকে এক বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়েছেন। ফরিজাত এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধাকে সাদরে অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে এসে একটি গাছের তলায় বসালো। কেন জানি না, বৃদ্ধাকে দেখামাত্র ফরিজাদের মনে হলো মহিলাটি বড় সুন্দর পবিত্র। একটা থালায় করে কিছু ফল কেটে এনে তার সামনে রেখে বললো, মেহেরবানী করে একটু কিছু খান।

    বৃদ্ধা ফরিজাদের ব্যবহারে বড়ই মুগ্ধ হয়ে বললো, মা তোমাকে দেখে বড় আনন্দ হলো।

    ফরিজাদ জিজ্ঞেস করে, আপনি কে মা? কেনই বা এমনভাবে পথে বেরিয়েছেন।

    বৃদ্ধা বললে,, আমি আল্লাহর এক নগণ্য সেবিকা। সারা জীবন ধরে তাঁরই নাম গান করে আমার দিন কাটছে। পথে পথে ঘুরে বেড়াই। যে আদর করে ডাকে তারই কাছে যাই। আজ তুমি ভালোবেসে ডাকলে তাই এলাম। আবার কোথায় চলে যাবো জানি না। তোমার এই বাগানটা দেখে বড় ভালো লাগলো। কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না মা। বাগানে সবই আছে কিন্তু তিনটি জিনিসের অভাব দেখছি।

    ফরিজাদ জিজ্ঞেস করে, কী সে তিনটি বস্তু, মা?

    বৃদ্ধা বললো, বলছি মা, বলছি।

    এরপর সে অনেকক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে বসে রইলো। তারপর বললো, ‘তোমার বাগানে অনেক সুন্দর সুন্দর পাখী আছে। কিন্তু ওরা এক সঙ্গে সুমধুর তানে গান করে না। আর এই যে সব তরুবর এদের শাখা মলয় বাতাসে আন্দোলিত হলে এক সঙ্গীতের মূৰ্ছন ভেসে আসতে পারে, কিন্তু আসছে না। তৃতীয়ত ঐ যে ঝর্ণা বয়ে চলেছে ওখানে ঐ ঝর্নাও তো গান গেয়ে উঠতে  পারে। কিন্তু তোমার ঝর্না গেয়ে ওঠে না কেন? শোনো মা, এই তিনটি জিনিস যদি তোমার বাগিচায় থাকতো তা হলে একেবারে বেহেস্ত হয়ে উঠতো জায়গাটা।

    ফরিজাদ বলে, আপনি ঠিকই বলেছেন, মা। কিন্তু এমন অপার্থিব বস্তু আমি কোথায় পাবো? আপনি কী তার সন্ধান জানাতে পারেন, কোথায় কোন দেশে গেলে এসব পাওয়া যেতে পারে?

    বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বলে, তোমাকে আমি নিশানা বলে দিচ্ছি, যদি সেখানে কাউকে পাঠাতে পারো সে দেখে আসতে পারবে সেই নন্দন কানন। এখান থেকে বিশ দিনের পথ। সোজা চলে যেতে হবে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে। সেখানে প্রথম যে মানুষটির সঙ্গে দেখা হবে, তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এখানে এমন কোন উপবন আছে যেখানে পাখিরা কথা বলে, গান গায়। তরুশাখা মধুর সুরের মূছানা তোলে এবং ঝর্ণা কলতান করে? সেই মুসাফীর পরদেশী পথ বাতলে দেবে। সেই মতো গেলে পৌঁছে যাবে সেই সুন্দর উপবনে। আচ্ছা মা, তোমার আদর যত্ন এবং সুন্দর ব্যবহারে আমি বিশেষ প্রীত ও মুগ্ধ হয়েছি। এবার আমি চলি। খোদা হাফেজ।

    বৃদ্ধা আশীর্বাদ করতে করতে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

    ফরিজাদ এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বৃদ্ধার কথা শুনছিলো। সে চলে যেতে তার সম্যক চৈতন্য ফিরে এলো। মনে মনে আফশোশ করতে লাগলো, বৃদ্ধার কাছে আরও ভালো করে পথের নিশানাটা জেনে নিলে ভালো হতো। কিন্তু তখন আর তার কোনও উপায় রইলো না। দৃষ্টিপথের আড়ালে চলে গেছে সে। ব্যথ্যায় বুকটা টন টন করে ওঠে ফরিজাদের। দু’চোখ জলে ভরে ওঠে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

    শিকার শেষে দুই ভাই ফিরে দেখে বোন ফরিজাদ সেখানে নাই। বেশ অবাক হয় ওরা। এ সময় তো সে ঘরেই থাকে। বাইরে বাগানে আসে। ছোট ভাই ফারুজ বলে ঐ দেখ বড় ভাই গাছের তলায় কত পান্না। তাহলে তো বোন খুব কান্নাকাটি করেছে।

    দুভাই চিন্তিত হয়ে বাগানের এদিক ওদিক অনুসন্ধান করতে করতে এক জায়গায় এসে দেখে ফরিজাদ অঝোর নয়নে কাঁদছে। দুই ভাই আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে কী এমন ব্যাপার ঘটেছে যার জন্যে তাদের আদরের বোনের চোখে জল।

    ফরিজাদ করুণভাবে হাসে। বলে কেন কাদছি জানতে চাইছ দাদা? সে আমি বলতে পারবো না।

    -কেন? কী এমন কথা যে বলতে পারবে না, বোন? কেউ তোমার মনে আঘাত করে গেছে?

    ফরিজাদ বলে, না না, সে সব কিছু নয়।

    -তবে?তবে কেন তোমার চোখে পানি বোন? বলল, আমাদের কাছে কোনও কথা গোপন করোনা বোন। তোমার মুখে হাসি না দেখলে আমরা স্থির থাকতে পারি না।

    ফরিজাদ বলে, এই বাগানটা আমার একদম পছন্দ নয়, দাদা। এখানকার পাখিরা কথা বলতে পারে না, গান গাইতে পারে না। গাছগুলো সব বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে, আর ঝর্না সেই বা এমন নীরব কেন?

    ফরিজাদ কী বলতে চায় কিছুই অনুধাবন করতে পারে না ভাইরা। তখন সে সেই বৃদ্ধার আগমন এবং তার কথোপকথন বৃত্তান্ত সব দাদাদের খুলে বললো।

    বোনের কথা শুনে ভাইরা বেশ অবাক হয়। বড় ভাই আশ্বাস দিয়ে বলে, তুমি কিচ্ছু ভেব, না বোন, আমি তোমার মনের বাসনা পূর্ণ করবো। তোমার জন্য দুর্লঙ্ঘ্য কাফ পর্বত-শিখরেও আমরা উঠে যেতে পারি। এ তো সামান্য বিশদিনের পথ। আমি অনায়াসেই এনে দিতে পারবো তোমাকে এসব। আমাকে শুধুপথের নিশানাটা ভালো করে বলে দাও।

    ফরিজাদ বললো, আমি যেটুকু শুনেছিলাম বললাম, দাদা। এর বেশি কিছু আর জানি না। কিন্তু এ নিয়ে তোমরা এতো চিন্তা করছো কেন? ঐ অজানা দেশে যাওয়ার কোন দরকার নাই।

    বড় ভাই ফরিদ বলে, ও নিয়ে তুমি কোনও দুর্ভাবনা করো না বোন। আমার চমৎকার এক ঘোড়া আছে। সে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে ভারত সীমান্তে। আমার কোনও কষ্ট হবে না। আমি একাই যাবো, ফারুজকে সঙ্গে নেব না। সে তোমার কাছে থাকবে।

    ফরিজাদ দাদাকে নিরস্ত করার অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু ফরিদ বলে সে যাবেই। এবং এ যাত্রায় আর কারো সঙ্গে যাবার প্রয়োজন হবে না। বোনকে অভয় দিয়ে বলে, আমার জন্যে একটুও ভাবিস না বহিন, আমার কোনও বিপদ হবে না! এই নে এই ছুরিখানা রাখ। যদি কখনও দেখিস এর ফলায় মরচে ধরছে, বুঝবি, আমার কোনও বিপদ ঘটেছে বা কোনও দুর্ঘটনায় পড়েছি আমি। কিন্তু যদি দেখিস ছুরির গায়ে লাল লাল রক্তের মতো দাগ লেগেছে-বুঝবি আমার ইন্তেকাল হয়ে গেছে। এবং সে রকম কোনও চিহ্ন দেখতে পেলে, তোদের দুজনকেই বলে যাচ্ছি, আল্লাহর কাছে আমার নামে মোনাজাত করিস!

    ফরিদ ছুরিখানা বোনের হাতে তুলে দিলো।

    একটানা কুড়ি দিন ঘোড়া ছুটিয়ে চলার পর ভারত সীমান্তের পর্বতমালার পাদদেশে এক শস্য-শ্যামল প্রান্তরে এসে পৌঁছল ফরিদ।

    কিছুদূর এগোতে এক বটবৃক্ষের নিচে এক বৃদ্ধ সাধুকে দেখে সে এগিয়ে এলো। ঘোড়া থেকে নেমে ফরিদ সাধুকে প্রণতি জানিয়ে বললো, আমি দূর দেশ থেকে আসছি, বাবা। সাহেব।

    সাধু হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গী করে কী যেন বলে, সে বুঝতে পারে না। আবার বলে, সন্ত বাবা, আমি অনেক দূর দেশ পারস্য। মুলুক থেকে আসছি। শুনেছি এখানে এমন উপবন আছে। যেখানে পাখিরা কথা বলে গান গায়, গাছপালা এবং নদী। ঝর্নাও নাকি সঙ্গীত-মুখর হয়ে থাকে সর্বদা, আপনি কী? বলতে পারেন, কোন পথে গেলে সেই শ্রুতিসুখকর নয়নাভিরাম জগতে আমি পৌঁছতে পারবো?

    সাধু মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ, সে বলতে পারে। কিন্তু মুখে কোনও কথা উচ্চারণ করলো না।

    ফরিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি মুখ ফুটে কথা বলছেন না কেন, ফকির সাহেব? আপনি যদি বলতে না পারেন, শুধু শুধু এখানে আমাকে দেরি করিয়ে দেবেন না। আমাকে যেভাবেই হোক সেই অপরূপ অলৌকিক উপবনে পৌঁছতেই হবে।

    এবার ফকির বেশ পরিষ্কার বোধগম্য ভাষায় বললো, অধৈর্য হয়ো না বেটা, আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি। এতক্ষণ বলতে দ্বিধা করছিলাম, কারণ তোমার মতো এমন সুন্দর একটি নওজোয়ান ছেলের সেই বিপদ-সঙ্কুল দুর্লঙ্ঘ্য গিরি-শিখরে ওঠা কি সঙ্গত হবে! বড় দুর্গম ভয়ঙ্কর সে পথ।

    ফরিদ বলে, তা হোক, যেতে আমাকে হবেই। আপনি আমাকে নিশানা বলে দিন। আল্লাহ আমার দেহে যথেষ্ট শক্তি এবং মনে অপরিমিত সাহস দিয়েছেন। আমি কিছুতেই ভয় করি না।

    কিন্তু বেটা, অদৃশ্য দানবের সঙ্গে যুঝবে কী করে? তুমি তো তাকে চোখে দেখতে পাবে।। আর সেই সব ভূতপ্রেতদের সংখ্যা হাজার হাজার।

    —তা হোক, আপনি আমাকে পথ বলে দিন, আমি যাব। কোনও বাধাই আমার কাছে বাধা নয়। কোনও বিপদই আমি গ্রাহ্য করি না।

    সাধু বললো, বেশ আমার বারণ যখন শুনবে না, তখন যাও। পথ আমি বাৎলে দিচ্ছি।

    এই বলে সে তার কাঁধের ঝুলি থেকে একটা লালরঙের মসৃণ ও গোলাকৃতি কঠিন বস্তু বের করে সজোরে নিক্ষেপ করলো! গোলাকার ডেলাটা অনেকটা দূরে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে বাঁই বাঁই করে ছুটতে ছুটতে এক জায়গায় গিয়ে আটকে গেলো! সাধু আঙ্গুল দিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে বললো, ঐ—ঐ জায়গাটায় চলে যাও। ওখান থেকে সোজা উঠে যাবে পাহাড়ের চূড়ায়।

    এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো সাতাত্তরতম রজনী।

    আবার সে বলতে শুরু করে :

    খুব সাবধান, সাধু বলতে থাকে, পাহাড়টা একেবারে খাড়াই। তবে দু’পাশে ধরার মতো পাথরের চাঁই আছে অনেক। ওগুলো ধরে ধরে খুব সন্তর্পণে ওপরে উঠতে হবে। মাঝে মাঝেই নানারকম বিকট আওয়াজ শুনতে পাবে। ভেবোনা, সেগুলো হাওয়ার দাপটের শব্দ, সবই ঐসব অদৃশ্য ভূতপ্রেতের ভয় দেখানো আওয়াজ। ওসবে যদি ভয় পাও, তবে ওঠার পথেই তোমাকে খতম করে দেবে ওরা। তুমি ওদের হুমকীতে ভয় পেও না একটুও। কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপনা করে খুব সাবধানে ওপরে উঠতে থাকবে। এইভাবে সব বাধাবিপত্তি এবং ভয়-ভীতি কাটিয়ে যদি ওপরে উঠতে পারো, দেখবে পাহাড়ের চূড়ায় একটা বিরাট খোলা জায়গায় অনেক সুন্দর সুন্দর পাখি। ওরা একে অন্যের সঙ্গে দিব্যি কথা বলছে, গান গাইছে। তুমি অনায়াসে ঐ পাখিদের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। ওরা তোমার কথার উত্তর দেবে। তুমি ওদের জিজ্ঞেস করবে, সেই গাছপালা ঝর্নাধারা কোথায়—যারা গানের মূৰ্ছনা তুলতে পারে? তখন পাখিরা তোমাকে নিশানা বলে দেবে। তারপর খোদা তোমার সঙ্গে আছেন।

    যথা-নির্দেশিত স্থান থেকে পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠার কালে প্রথম দিকে তেমন কোনও অসুবিধা মনে হলো নাফরিদের। কোনও ভয়ঙ্কর কিছুও শ্রুতিগোচর হলো না। শুধু মাঝে মাঝে মনুষ্যাকৃতির বড় বড় কালো পাথরের চাই পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে ঝুলছিল। সেই পাথরগুলো ধরে ধরে সে উপরে উঠে যেতে লাগলো। ফরিঙ্ক বুঝতে পারলো, তার পূর্বসূরীরা অনেকে এই পথ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে শয়তানের ভীতিতে ভয় পেয়ে পাথর হয়ে জমে গেছে।

    আরও খানিকটা উঠতে এক বিকটু কান-ফাটা গগনবিদারী শব্দ ভেসে এলো। ফরিদ বিচলিত হলো না একটুও। ফরিদ কেশ বুঝতে পারলো, এ আর্তনাদ কোনও মানুষের হতে পারে না। সব শয়তানের কারসাজী। তা হোক, ভয় সে পাবে না কিছুতেই। হঠাৎ কে যেন প্রশ্ন করলো, কী চাও তুমি? কেন উপরে ওঠার দুঃসাহস করছে। এখনও বলছি ভালোয় ভালোয় নেমে যাও। নইলে আর সকলের যা দশা হয়েছে দেখতে পাচ্ছো—তোমারও তাই হবে।

    এমন কর্কশ কণ্ঠ কী করে মানুষের হতে পারে! আর মানুষ হলে কী সে তাকে দেখতে পাবে? ফরিদ অবিচল নির্বিকার। শয়তানের শাসানি সে শুনেও শুনলো না। যেমন উপরে উঠছিলো তেমনি উঠতে থাকলো।

    আবার কানে এলো, লোকটাকে টুটি টিপে মেরে ফেলল, ওকে রুখে দাও, মেরে ফেলো, রুখে দাও, মেরে

    অগণিত হাজার হাজার কণ্ঠের আক্রোশ ভেঙ্গে পড়তে লাগলো চারদিক থেকে। আবার কেউ কেউ হুঙ্কার ছাড়তে লাগলো, লোকটাকে ছুঁড়ে টেনে দাও নিচে। ছাতু হয়ে যাক।

    কিন্তু আবার যেন কে অপেক্ষাকৃত নরম গলায় বললো, আহা মেরো না, মেরো না, ছুঁড়ে দিও, দেখছো না কেমন সুন্দর দেখতে–

    কে যেন বললো, তুমি খুবসুরত, এসো এসো, আমাদের সঙ্গে এসো। মনে হলো খিল খিল করে হেসে উঠলো কারা। কিন্তু ফরিদ কিছুই গ্রাহ্যে আনলো না! সোজা ওপরে উঠতে লাগলো। মনে তার অদম্য সাহস। কোনও দিকে সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে চাইলো না, কে বা কারা তার আশে পাশে বা পিছনে ঘিরে ধরছে কিনা।

    যতই সে উপরে যেতে থাকলো দানবের চিৎকার কোলাহল শাসানী হুঙ্কার ক্রমশই বাড়তে লাগলো। ফরিদ বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলো, ভূত-প্রেতের আগুনের হল্কার মতো প্রশ্বাস তার গায়ে লাগছে। কখনও বা চেঁচামেচি চিৎকার ক্ষীয়মান হয়ে মিলিয়ে যায়। মনে হয় ওরা ওকে ছেড়ে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে। আবার কখনও বা মনে হয় ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রাক্ষসগুলো! চিৎকার গর্জনে কানের পর্দা ফেটে যায় আর কি?

    বৃদ্ধ ফকির বলে দিয়েছিলো চারপাশে বা পিছনে যাই ঘটুক, তুমি কখনও ঘাড় ফিরিয়ে দেখার চেষ্টা করবে না। এতক্ষণ সে সাধুর কথা স্মরণ রেখে কোনও কিছুতেই বিভ্রান্ত না হওয়ার সংকল্প নিয়ে শান্ত সবল পদক্ষেপে উপরে উঠে আসছিলো। কিন্তু ঠিক তার পিছনে কে যেন কার মাথায় গদাম। করে একখানা লাঠি বসিয়ে দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক। আর্তচিৎকার দিয়ে সে হাজার হাজার হাত নিচে পড়ে গেলো। এরপর আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না ফরিদ। ঘাড় ফিরিয়ে এসে দেখতে চাইলো ঘটনাটা কী। এবং সেই তার প্রথম পদস্খলন। সঙ্কল্পচ্যুতি। এবং সেই তার চরম বিপর্যয়।

    সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো অদৃশ্য শয়তানরা। অর্থাৎ অবশেষে তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে বাছাধন! তৎক্ষণাৎ ফরিদের দেহখানা একখণ্ড কালো পাথরে রূপান্তরিত হয়ে পাহাড়ের গায়ে লটকেরইলো। সেই সঙ্গে পাহাড়ের পাদদেশে ফরিদের পেয়ারের তাজি ঘোড়াটাও নিশ্চল পাথরের চাঁই হয়ে গেলো। এবং ঐ গোলাকৃতি লাল শক্ত বস্তুটি গড়গড় করে গড়াতে গড়াতে ফিরে চলে গেলো সেই বৃদ্ধ ফকিরের সামনে।

    শাহজাদী ফরিজাদ প্রতিদিন দাদার দেওয়া ছুরিখানা পরীক্ষা করে দেখে। সে দিনে সকালে উঠে ছুরির গায়ে রক্তের ছিটে দেখে তার বুক কেঁপে উঠলো। তা হলে তাদের বুকের কলিজা চোখের মণি বড় ভাই আর ইহজগতে বেঁচে নাই! আর সে ভাবতে পারে না। অস্ফুট একে আর্তনাদ করে ঢলে পড়লো।

    ফারুজ ছুটে এসে দেখে একপাশে বোন ফরিজা অন্যপাশে ছুরিখানা লুটিয়ে পড়ে আছে। বোনের মূৰ্ছিত দেহখানা তুলে ধরে চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে প্রকৃতিস্থ করার প্রয়াস করতে থাকে ফারুজ। একটু পরে জ্ঞান ফিরে এলো। মেজ ভাইকে সামনে দেখে কান্নায় সে ভেঙ্গে পড়লো, বড় ভাই আর বেঁচে নাই, দাদা। হায় হায়, কেন আমি তাকে যেতে দিলাম। আমার শখের বায়না মেটাতে গিয়ে দাদা আমার প্রাণ খোয়ালো। ও ফরিদ ভাই, কোথায় গেলে তুমি। এ আমি কী করলাম। কেন তাকে যেতে দিলাম, দাদা?

    ফরিজাদ নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে, কপাল বুক চাপড়ায়। নিজেকেই নিজে গালি-গালাজ করে, ওরে মুখপুড়ি, শয়তানী, তুই তো অমন সুন্দর ভাইটাকে হত্যা করলি? এ পাপের শাস্তি তোর কী হবে?

    বোনকে নানাভাবে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে ফারুজ। সে-ও দাদার শোকে মুহ্যমান। কিন্তু এ অবস্থায় আদরের দুলালী বোনকে সামলাতে না পারলে সে হয়তো আত্মঘাতী হতে পারে। এই আশঙ্কায় ফারুজ বোনকে আঁকড়ে ধরে সোহাগ আদর দিয়ে ভ্রাতৃশোক ভোলাবার প্রয়াস করে।

    —অমন করে কান্নাকাটি করে কী হবে, বহিন, নসীবে যার যা লেখা আছে তা তো কেউ খণ্ডাতে পারে না। তা না হলে, বলো, কোথায় পারস্য আর কোথায় ভারত, সহস্র যোজন পথ। সেই পথ পাড়ি দিয়ে সে মোউৎকে বরণ করতে যাবে কেন? একবার শান্ত হয়ে ভেবে দেখ, নিয়তির এই-ই নির্দেশ ছিলো। তা না হলে এমনটা হতে পারত না। যাই হোক, আমি তো আর এখানে চুপচাপ বসে থাকতে পারি না, বহিন! আর কালবিলম্ব না করে এখুনি আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। দেখতে হবে দাদার কী হয়েছে। তুমি কিছু ভেবো না, আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো তোমার কাছে।

    ফরিজাদ আর্তনাদ করে ওঠে, না না, সর্বনেশে দেশে তোমার গিয়ে কাজ নাই। একবার এক ভাইকে হারিয়েছি, আর আমি আর এক ভাইকে ঐ বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারবো না।

    ফারুজ হেসে ফরিজাদ-এর মাথায় হাত বুলায়।পাগলী, আমার কোনও বিপদ আপদ হবে না, দেখে নিস। আমি যাচ্ছি, তুই বহিন, একটু সাবধানে থাকিস।

    এই বলে ফারুজ বোনের হাতে একটা মুক্তোর মালা তুলে দিয়ে বলে, এই মুক্তোগুলোয় যদি কালো চিহ্ন দেখতে পাস তবে বুঝবি, দাদার যা দশা হয়েছে আমারও তাই ঘটেছে। তবে আমার বিশ্বাস, তেমন কিছু হবে না।

    বিশ দিন একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে চলার পর ফারুজও এসে পৌঁছয় সেই বৃদ্ধ ফকিরের সামনে। ফকির তাকে অনেক চেষ্টা করে ঐ পাহাড়ে ওঠা থেকে বিরত হওয়ার জন্য। কিন্তু ফারুজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সে যাবেই। তাই অবশেষে সে ঝুলি থেকে সেই গোলাকৃতি মসৃণ বস্তুটি বের করে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, ঐ ওখান থেকে পাহাড় চূড়ায় উঠে যাও। কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ করবে না, পিছন ফিরে তাকাবে না কখনও। তা সে যাই ঘটুক।

    ফারুজ বৃদ্ধের উপদেশ শিরোধার্য করে নির্ভয় চিত্তে পাহাড়-শীর্ষে আরোহণ করার জন্য উপরে উঠতে থাকে। দানব শয়তানের হুঙ্কার, চিৎকার তর্জন গর্জন উপেক্ষা করে সে প্রায় শীর্ষদেশে পৌঁছে গেছে, এমন সময় সে শুনতে পেলো দাদা ফরিদের কণ্ঠস্বর, ভাইজান আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছিস? আমি যে পাহাড়-গহ্বরে আটকে পড়ে আছি ভাই, একবার আমাকে একটু ধর।

    ফারুজের সব কেমন গোলমাল হয়ে গেলো। সে বুঝতেই পারলো না, এও সেই সব শয়তানদের এক অভিনব ছল। দাদাকে উদ্ধার করার জন্য পিছন ফিরে তাকাতেই পলকে সে কঠিন কালো প্রস্তরখণ্ডে পরিবর্তিত হয়ে ঝুলতে থাকলো।

    ফরিজাদ রোজ সকালে উঠে মুক্তোর মালাটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে। সে দিন সকালে মালাটা হাতে নিয়েই সে ডুকরে কেঁদে উঠলো।—হায় হায় একি হলো, এ কি করলাম আমি? দু-দুটি ভাইকে মেরে ফেললাম?

    মুক্তোর মালাটা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। ফরিজাদ বুক চাপড়াতে চাপড়াতে হা-হুতাশ করতে থাকে। তারই দোষে তারা প্রাণ হারালো। সে এমনই সর্বনাশী, এমনই পাপীয়সী?

    ফরিজাদ মন স্থির করে, সেও যাবে ভাইদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। তাতে যদি মোউৎ আসে তা আসুক। ক্ষতি কী? কী হবে এই শোকাহত বিষাদাচ্ছন্ন জীবনে বেঁচে থেকে। তার চেয়ে মৃত্যু

    যদি তাকে কোলে টেনে নেয়, সেই হবে তার পরম শান্তি।

    পুরুষের ছদ্মবেশে সেজে তাগড়াই একটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে ফরিজাদ। বিশ দিনের দিন সে-ও এসে পৌঁছয় সেই বৃদ্ধ ফকিরের আস্তানায়। ফরিজাদ সন্তকে সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করে, ফকির সাহেব, এদিকে দু’জন খুবসুরত নওজোয়ান ছেলেকে দেখেছেন এর আগে? তারা এসেছিলো সেই উপবনের সন্ধানে—যেখানে বনের পাখি কথা বলে, গান গায়, তরুশাখা এবং ঝর্ণাধারা সঙ্গীতে মুখর হয়ে থাকে, দেখেছেন কী তাদের?

    বৃদ্ধ বললো, তুমিই তো সেই সুন্দরী ফরিজাদ? হ্যাঁ, আমি ওদের দুজনকেই দেখেছি। ওরা আমার কাছে সেই আশ্চর্য উপবনের নিশানা জানতে চেয়েছিলো। আমি ওদের বারণ করেছিলাম, কিন্তু আমার কথা ওরা শোনেনি। তাই পথের নিশানা আমি বাতলে দিয়েছিলাম। তারপর, এর আগে আরও অনেকের ভাগ্যে যা ঘটেছিলো, তাদের ভাগ্যেও তাই ঘটেছে। আমি জানতাম, আমার উপদেশ ঠিক ঠিক জেনে শেষ পর্যন্ত কেউ চলতে পারবে না। তাই সকলকেই আমি বারণ করেছিলাম। কিন্তু সকলেরই এক গোঁ। তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, যা হবার তাই হয়েছে।

    ফরিজাদ ভাবে, এই বৃদ্ধ ফকির তার নাম কী করে জানলো? তবে কী সে অন্তর্যামী ত্রিকালজ্ঞ পয়গম্বর?

    ফকির বললো, আমি জানি তুমিও সেই আশ্চর্য উপবনে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারছো। সেখানে পাখিরা কথা বলে, বৃক্ষ-তরুলতা এবং ঝর্না নদী গান গায়—সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার লোভ কী সামলানো যায়? তবু বলবো, আমার যদি কথা শোনো, ঐ দুর্গম গিরিশৃঙ্গে ওঠার পরিকল্পনা তুমি ত্যাগ কর ফরিজাদ? একাগ্র চিত্তে আমার উপদেশ মনে রেখে নিতে না পারলে তুমিও তোমার দাদাদের মতোই কালো পাথরের একখণ্ড চাই-এ পরিণত হবে।

    ফরিজাদ বলে, না বাবা সাহেব, আশ্চর্য উপবনের যাদু দেখার কোনও বাসনা আমার নাই। কিন্তু আমার দুই দাদা যেখান থেকে ফিরে আসেনি সেখানে আমাকে যেতেই হবে। আমি স্বচক্ষে দেখতে চাই তাদের কী হয়েছে? আপনি আমাকে মেহেরবানী করে পথটা একবার বলে দিন, বাবা?

    ফকির বললো, ঠিক আছে শাহজাদী ফরিজাদ নিজের চোখেই যখন দেখতে চাও তোমার দাদাদের হাল, যাও, পথ আমিও পথ বাতলে দিচ্ছি।

    এই বলে ঝুলি থেকে সেই লাল গোলাকৃতি বস্তুটি দূরে নিক্ষেপ করে দিলো বৃদ্ধ! বললো, ঐ দেখ, ওটা গড়াতে গড়াতে গিয়ে পাহাড়ের তলায় একটা জায়গায় থেমে গেলো। তুমি চলে যাও সেখানে। ওখান থেকে পাহাড়ে ওঠার একটা দুর্গম পথ পাবে। ঐ পথ বেয়ে খাড়াই উঠে যেতে হবে সোজা ওপরে। আশে পাশে আঁকড়ে ধরার মতো কতকগুলো কালো পাথরের ঝুলন্ত চাই দেখতে পাবে। আসলে ওগুলো কিন্তু পাথর নয়। তোমার পূর্বসূরীরা শিখরে ওঠার আশা নিয়ে উঠতে গিয়ে ভয়ে আতঙ্কে পাথর হয়ে জমে গেছে। যাই হোক, ওগুলো ধরে ধরে তোমাকে এগোতে হবে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখ মা, ঐ পাহাড়ের চারপাশে ঘিরে রয়েছে হাজার হাজার ভূত-প্রেত ডাকিনী-যোগিনী। ওরা তোমাকে ভয় দেখাবে। নানারকম হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ডাকে তোমার কানে তালা ধরিয়ে দেবে। ভয়ে তোমার বুক কেঁপে উঠবে। কিন্তু সাবধান, কিছুতেই ভীত হয়ো না। সামনে ছাড়া অন্য কোনও দিকে দৃকপাত করার চেষ্টা করো না। তাহলে তোমারও দশা তোমার ভাইদের মতোই হয়ে যাবে।

    বৃদ্ধ তার ঝুলি থেকে খানিকটা তুলো বের করে ফরিজার হাতে দিয়ে বললো, ভালো করে দু কানে গুঁজে নাও। তাহলে ঐ সব বিকট আওয়াজ তোমাকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।

    ফরিজাদ তুলোটুকু হাত পেতে নিয়ে দু কানে গুঁজে ফরিদকে সালাম জানিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেলো।

    তুলো গুঁজা থাকার দরুন ভূত-প্রেতদের নানারকম বিকট আওয়াজ তার কর্ণকুহরে তেমন একটা পৌঁছতে পারলো না। তাই অনেক কষ্টে এক সময় সে পাহাড়-শিখরে উঠে আসতেও পারলো।

    যে দিকে সে তাকায়, বড় সুন্দর নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করে। একটু এগোতেই চোখে পড়ে একটা বিশাল পাখির খাঁচা, তার মধ্যে হাজার হাজার নানা বর্ণের সুন্দর সুন্দর সব পাখি কল কল করে কথা বলছে পরস্পর। কাছে যেতেই একটা বুলবুল এগিয়ে এসে ফরিজাদকে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার, এখানে এলে কী করে?

    ফরিজাদ বললো সব। বুলবুল শুনে বলে, খুব ভালো করেছ, ঠিক আছে, এখানে যখন এসে পড়েছ তখন ঘুরে ঘুরে সব দেখবে তো?

    ফরিজাদ বলে, শুনেছি এখানে গাছেরা গান গায়?

    বুলবুল বলে, ওমা, গাইবেনা কেন? তোমাদের দেশে বুঝি গায় না?চলো তোমাকে ঐ বনের কাছে নিয়ে যাই, ওখানে দেখবে কি সুন্দর সব গাছপালা। আর সোনালী জলের কি চমৎকার ঝর্ণা। সবাই গান গাইছে।

    বুলবুল ফরিদজাদকে সঙ্গে করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখায়।ফরিজাদ বলে, খুবই ভালো ভাই, কিন্তু মনে আমার সুখ নাই। এতে আনন্দের মুলুকে এসেও খুশিতে নাচতে পারছি না।

    বুলবুল অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, কেন ভাই?

    ফরিজাদ বলে, আমার দুই দাদা এই উপবনে আসতে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে কালো পাথর হয়ে আটকে আছে।

    বুলবুল বলে, ও এই কথা। ও জন্যে আবার দুঃখ করছ কেন? এই ঝর্নার জল খানিকটা নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের মাথা থেকে ছিটিয়ে দাও ওদের গায়ে। দেখবে এখুনি ওরা রক্তমাংসের মানুষ হয়ে আবার কথা ক’য়ে উঠবে।

    বুলবুলের কথামতো ঝর্নার জল নিয়ে গিয়ে পাহড়ের গা বেয়ে নিচে ঢেলে দিলো ফরিজাদ। আর কী আশ্চর্য, ফরিদ এবং ফারুজ দু’জনেরই তরতর করে উপরে উঠে এলো তখুনি। শুধু ওর দুই দাদাই নয় এতকাল ধরে যে সব দুঃসাহসী নওজোয়ান এই পর্বতারোহণ করতে এসে শয়তানের পাল্লায় পড়ে কৃষ্ণপাথরে রূপান্তরিত হয়েছিলো তারা সকলেই সজীব হয়ে উঠলো।

    এরপর ওরা তিন ভাইবোন বুলবুলকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড় থেকে সমতলে নেমে এসে ওদের প্রস্তরীভূত ঘোড়াগুলোকে জীবন্ত করে তুললো।

    ফরিজাদ বললো, চলো দাদা, আগে ঐ সন্তের কাছে গিয়ে তাকে সালাম জানাই। কারণ তার দয়াতেই আজ তোমাদের ফিরে পেলাম আমি।

    কিন্তু অবাক কাণ্ড, সেই গাছতলায় এসে দেখা গেলো, বৃদ্ধ ফকির আর সেখানে নাই। আস্তানা গুটিয়ে কোথায় সে চলে গেছে। ফরিজাদ বুলবুলকে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার বুলবুল, ফকির সাহেব কোথায় চলে গেলেন?

    বুলবুল ঈষৎ রাগতভাবেই বলে, এ তোমার অযথা কৌতূহল শাহজাদী। তোমাকে তিনি কী শিক্ষা দিয়ে গেছেন, মনে নাই? অহেতুক অন্যের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে নাই। তোমার চারপাশে হাজারো রকম ঘটনা ঘটতেই পারে। সব ব্যাপারে তুমি কেন নাক গলাবে। তোমার নিজের কাজ তুমি ভালো করে সমাধা করবে, এই তার নির্দেশ। সেই কারণেই তিনি তোমার দু কানে তুলো খুঁজতে উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, বুঝতে পারনি? ফরিজাদ লজ্জিত বোধ করে। হ্যাঁ, তাই তো, তার নিজের যাতে কোনও প্রয়োজন নাই সে ব্যাপারে অযথা আগ্রহ প্রকাশ করা উচিত হয়নি। বৃদ্ধ ফকির হয়তো তাদের পথ চেয়েই সেখানে অপেক্ষা করছিলো। তার কর্তব্য কর্ম শেষ হয়ে যাওয়াতে সে প্রস্থান করেছে। সুতরাং ও নিয়ে সে কেন চিন্তা করছে?

    রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

     

    সাতশো ঊনআশিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

    এরপর বুলবুলকে সঙ্গে নিয়ে তিন ভাইবোন নিজের দেশ পারস্যে ফিরে আসে।

    আবার দুই ভাই শিকারে যায়। ফরিজাদ বুলবুলকে নিয়ে ঘরে থাকে। এখন সে তার দিবারাত্রির সঙ্গী। দু’জনে কত কথা বলে, গান গায়।

    একদিন শিকার শেষে ঘরে ফিরে আসছিলো ফরিদ আর ফারুজ। পথের মধ্যে দেখা হয়ে গেলো সুলতান খসরুর সঙ্গে। পুত্রদ্বয়ের আলোক-সামান্য রূপে আকৃষ্ট হয়ে সুলতান থমকে দাঁড়ালেন। এমন চাদের মতো সুন্দর ছেলে দুটি কার?

    ফরিদ আর ফারুজ কাছে এসে ঘোড়া থেকে নেমে আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানায়।

    সুলতান সস্নেহে জিজ্ঞেস করেন, কে তোমরা, বাবা?

    —আমরা জাঁহাপনার বান্দা মৃত মালীপুত্র।

    —ও, তোমরাই সেই দুই ছেলে? শুনেছিলাম, তোমাদের এক ভগ্নি আছে?

    —হ্যাঁ জাঁহাপনা, সে আমাদের ছোট। ঘরেই আছে সে।

    সুলতান বলে, তোমাদের দেখে বড় আনন্দ হলো, বাবা। চলো তোমাদের ঘরে যাওয়া যাক। বোনটিকেও দেখে আসি।

    ফরিদ বলে, এ তো আমাদের পরম সৌভাগ্যের কথা।

    ফারুজকে সে ফিস ফিস করে বলে, তুই ঘোড়া ছুটিয়ে বাড়ি চলে যা। ফরিজাদকে খবর দে, সুলতান আসছেন। তাঁর আদর আপ্যায়নের যেন ব্যবস্থা করে সে।

    ফারুজ এসে বোনকে বললো, জানিস বোন, পথে সুলতানের সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, তোমাদের বাড়িতে বেড়াতে যাবো, ফরিজাদের সঙ্গে আলাপ করবো। ওরা এখুনি এসে পড়বেন। তুই একটু খানাপিনার ব্যবস্থা কর।

    ফারুজ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ফরিজাদ সমস্যায় পড়লো, সুলতান বাদশাহ বলে কথা। তাকে আদর অভ্যর্থনা করার কতটুকুই বা সাধ্য আছে তাদের?

    বুলবুল বলে, এ নিয়ে ভাবছো কেন? তোমাদের সুলতান শশা খেতে খুব ভালোবাসে। এক কাজ কর একখানা মুক্তো দিয়ে শশার বিরিয়ানী বানিয়ে রাখ। সুলতান খুব তৃপ্তি করে খাবেন।

    পাখিটার আজগুবি কথা শুনে ফরিজাদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। বলে, এ তুমি কী বলছো? মুক্তোর বিরিয়ানী? মুক্তো কী আবার খাওয়া যায় নাকি? বলো, চালের বিরিয়ানী?

    বুলবুল বলে, না না, চালের নয়, মুক্তো দিয়েই শশার বিরিয়ানী বানাও। সুলতান খুব তৃপ্তি করে খাবেন। আর অন্য কিছু খানা-পিনাও দরকার হবে না।

    ফরিজাদ যদিও ব্যাপারটা বুঝতে পারলো না তবু তার প্রিয় সঙ্গী বুলবুলের পরামর্শ অগ্রাহ্য করলো না। কারণ সে জানতো, বুলবুল যা বলে তা ভেবে-চিন্তেই বলে। কখনও সে ফালতু কথা বলবে না।

    সুলতান খসরু বাড়িতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে পাখিটা সোচ্চার হয়ে ওঠে, এই যে সুলতান খসরু, আসুন আসুন—আসতে আজ্ঞা হোক। আমরা আপনার আগমনেরই প্রতীক্ষায় বসে আছি এত কাল।

    ফরিজাদ এই প্রথম বোরখায় সর্বাঙ্গ ঢেকে সুলতানের সামনে এসে যথাবিহিত কুর্নিশ করে দাঁড়ালো।

    সুলতান বলেন, বাঃ, চমৎকার! তোমরা আমার বহুকালের অনুরক্ত ভৃত্য মালীর সন্তান। আমার বড় আদরের! আজ তোমাদের বাবা বেঁচে থাকলে আরও অনন্দের হতো। যাই হোক, বাবা-মা তো আর চিরকাল কারও বেঁচে থাকে না। আল্লাহ তাকে কোলে নিয়েছেন, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। সব পিতা বেঁচে থাকে তার সন্তানের মধ্যে।

    খাবারের টেবিলে কাপড় বিছানো হলো। ফরিজাদ শসা দিয়ে বানানো একটিমাত্র মুক্তোর বিরিয়ানীর থালা এনে রাখলো সেখানে। তারপর সুলতানের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি আমাদের গরীবখানায় এসেছেন। বিশেষ কিছুই ব্যবস্থা করতে পারিনি। এই সামন্য একটু বিরিয়ানী বানিয়েছি। যদি মেহেরবানী করে আহার করেন।

    ভারী মিষ্টি কণ্ঠস্বর ফরিজাদ-এর। এবং আরও মিষ্টি করে বলতে জানে সে। সুলতান খসরু মুগ্ধ হয়ে যান। বলেন, বাঃ, মাইজী নিজে হাতে বানিয়েছে, খাবো না? পেট ভরে পরিতৃপ্তি করে খাবো। তাছাড়া দেখছি আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার শসা দিয়ে বানিয়েছ? ওঃ, জিভে আমার জল এসে যাচ্ছে এখুনি।

    সুলতান হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে এসে বসে। শশা ভাজার টুকরোগুলোর দিকে লোলুপ চোখে তাকায়। কিন্তু একি! এ তো চালের বিরিয়ানী নয়। এক থালা মুক্তো—তার সঙ্গে শশা ভাজা? খসরু ভাবে, এ নিশ্চয়ই নতুন ধরনের এক খানা। নিশ্চয়ই শশা ভাজার সঙ্গে খেতে চালের বিরিয়ানীর চেয়েও সুস্বাদু লাগবে।

    এই যখন ভাবছে সুলতান, সেই সময় বুলবুল পাখিটা বেশ জোরে জোরে বলে ওঠে, অমন করে ভাবছেন কী সুলতান খসরু। নিন খান। কী, একথালা মুক্তো দেখে ঘাবড়ে গেলেন?

    ভাবছেন এ আবার কেমনতর খানা? তাহলে অনেক বছর পিছনে চলে যান একবার। মনে আছে সুলতান খসরু, কোন এক সন্ধ্যায় আপনি বণিকের ছদ্মবেশে শহর পরিক্রমা করতে করতে এক দরিদ্র পল্লীতে প্রবেশ করেছিলেন? মনে পড়ে সে দিনের কথা? ভালো করে ইয়াদ করে দেখুন তো, একটি বস্তিবাড়ির দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সে-বাড়ির তিনটি অবিবাহিত কন্যার নানারকম জল্পনা-কল্পনার কথাবার্তা আড়ি পেতে শুনেছিলেন কিনা। মনে পড়ে—ঐ তিন কন্যার সর্বকনিষ্ঠা বলেছিলো,শাদী যদি করতেই হয়, খোদ সুলতানকেই করবো?মনে পড়ে? ভাবুন, ভেবে দেখুন, আরও সে বলেছিলো কিনা–আমাদের মিলনে যে সন্তানের জন্ম হবে তারা হবে চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর। আরও সে বলেছিলো একটি মেয়ে হবে। তার মাথার চুল হবে সোনার মতো সোনালী। কান্নাতে তার পান্না ঝরবে, আর হাসলে পড়বে রাশি রাশি মুক্তো। এ সেই কন্যার মুখ-নিঃসৃত মুক্তো।

    সুলতান খসরুর কপালে বিন্দু বিন্দু স্বেদ জমে উঠছে ততক্ষণে। হা হা, সব তার মনে পড়ছে!

    বুলবুল ফরিজাদকে উদ্দেশ্য করে বললো, ফরিজাদ, বোরখা খুলে পিতার সামনে দাঁড়াও। তোমার পিতা তোমাকে দেখুন। তোমার মাথার সোনালী চুল দেখলে তার সব সংশয় ঘুচে যাবে।

    ফরিজাদ বোরখা খুলে ফেলে সুলতানকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠে, বাবা, তুমি আমাদের বাবা! বলো, বাবা, বুলবুল যা বলছে তা ঠিক?

    বুলবুল এবার চটে ওঠে, বুলবুল কখনও মিথ্যে বলে না ফরিজাদ। তোমার পিতাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, সেই রাতের পর পরদিন তোমার মা আর দুই মাসীকে তিনি দরবারে ডেকে এনেছিলেন কিনা। এবং সেইদিনই তিন বোনের ইচ্ছামত পাত্রের সঙ্গে তাদের শাদী হয়ে গিয়েছিলো কিনা?

    সুলতান মাথা নাড়েন, হা হা, সব ঠিক। কিন্তু আমার বেগম তো তিনবারে তিনটি জন্তু-জানায়োরের বাচ্চা পয়দা করেছিলো।

    ঝুট! সব মিথ্যে কথা। বড় দুই বোন, ছোট বোনের সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে এই চক্রান্ত করেছিলো। সুলতান তাদের শয়তানীর কথায় বিশ্বাস করে নিরপরাধ বেগম সাহেবাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন—

    সুলতান খসরু আর্তনাদ করে ওঠেন, আমি সব—সব বুঝতে পারছি এখন। সব পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু কিন্তু বেটা, ও পাপ আমি রাখবো কোথায়? তোমাদের জননী নিস্পাপ ফুলের মতো পবিত্র এক মেয়ে। তাকে আমি কারাগারে দোজক যন্ত্রণা দিয়েছি এতকাল।

    এই গুনাহ কী খোদাতালা ক্ষমা করবেন?

    ফরিজাদ বলে, কিন্তু বাবা, এতে তো আপনার দোষ সামান্যই। সাজা যদি পেতে হয় আমাদের মাসীদেরই পাওয়া উচিত। কারণ তারাই আপনাকে ধোঁকা দিয়েছিলো।

    এর পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত।

    সুলতান বেগমকে কারাগার থেকে মুক্ত করে হারেমে নিয়ে এলেন। সে ছেলেমেয়েদের ফিরে পেয়ে সুখের সাগরে ভাসতে থাকলো। আর সেসই বড় দুই বোন? তাদের যে-সাজা যোগ্য ছিলো, তাই মাথা পেতে নিতে হলো তাদের।

    গল্প শেষ করে শাহরাজাদ থামে। দুনিয়াজাদ এতক্ষণ তন্ময় হয়ে শুনছিলো, এবার সে দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলে, যেমন সুন্দর তোমার কিসসা তেমনি মিষ্টি তোমার বলার ঢং, দিদি।

    —ঠিক। বিলকুল ঠিক বলেছে দুনিয়াজাদ। বহুৎ মিঠা তোমার বলার কায়দা, শাহরাজাদ। আহার নিদ্রা ভুলে রুদ্ধশ্বাসে শুনতে হয়!

    শাহরাজাদ বলে, এবার জাঁহাপনা, আপনাকে সেই কামর আর হালিমাহর কিসসা শোনাবো। তবে আজ তো রাত খতম হয়ে এলো। আজ আর নয়, আসুন আমরা শুয়ে পড়ি। কাল থেকে শুরু করা যাবে, কেমন?

    সুলতান শাহরিয়ার শাহরাজাদকে বুকের মধ্যে টেনে নিতে নিতে বলে, সেই ভালো, শাহরাজাদ আজ এখানেই গল্পের ইতি হোক। এসো ঘুমের আগে আমরা একটু ভালোবাসা করি, কী বলো?

    শাহরাজাদ সুলতানের বুকের তলায় হারিয়ে যেতে যেতে বলে, এই দুনিয়া ওদিকে ফিরে শো-মুখপুড়ি!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142 143 144 145 146 147 148 149 150 151 152 153 154 155 156 157 158 159 160
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকবীর – ১ – ক্ষিতিমোহন সেন
    Next Article প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা – ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.